Monday, May 22, 2017

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী (Biography - Jyotirindranath Thakur)

মনীষী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী(wiki, উইকি)

(৪ঠা মে, ১৯৪৯ - ৪ঠা মাৰ্চ, ১৯২৫)

বঙ্গ ভারতের নবজাগরণে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ীর অপরিমেয় অবদান ঐতিহাসিক সত্য । প্রিন্স দ্বারকানাথ হ'তে আরম্ভ করে সদ্যঃস্বর্গত সৌম্যেন্দ্রনাথ পর্যন্ত এই পরিবারে মনীষার ধারা ছিল অব্যাহত । এতগুলি প্রতিভাধরের একই পরিবারে জন্মগ্রহণের দ্বিতীয় কোন নিদর্শন বিশ্বের ইতিহাসে কোন দেশে দেখা যায়নি । কবিসার্বভৌম রবীন্দ্রনাথের সর্বাতিশায়ী প্রভাবে ঐ পরিবারস্থ অন্য মনস্বীদের যথার্থ মূল্যায়নে অনেকেই কুণ্ঠিত এবং বিস্মৃত । তাঁরা যদি পৃথগ্‌ভাবে ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে আবির্ভূত হতেন তাহলে তাঁদের মনীষার দীপ্তিচ্ছটা সকলকে সফলভাবে আকর্ষণ করতো । এমনই এক স্বল্প-আলোচিত অথচ অসাধারণ মনীষী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর । বহুমুখী প্রতিভার অনন্যসাধারণ অধিকারী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কনিষ্ঠভ্রাতা রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাবিকাশে ছিলেন সদা জাগ্রত সহায়ক । স্ত্রী-স্বাধীনতার প্রবক্তা, অশ্বারোহী, বহুভাষাবিদ্‌, সার্থক নাট্যকার, সফল অনুবাদক, আদর্শ জমিদার, নিপুণ চিত্রশিল্পী, শিরোমিতিবিদ্যায় নিষ্ণাত, অভিনেতা, গীতিকার, সুরশিল্পী, দেশপ্রেমিক, ধর্মনেতা, দার্শনিক, স্বদেশী শিল্প ও দেশীয় বাণিজ্যের পথিকৃৎ, নিষ্কাম কর্মযোগী, কল্পনা ও উদ্ভাবনাশক্তির অনন্য সাধারণ অধিকারী এমন বিস্ময়কর চরিত্রের বিস্মৃতি আমাদের জাতীয় অপরাধ ।

১৮৪৯-এর ৪ঠা মে, ১২৫৬ বঙ্গাব্দের ২২শে বৈশাখ, মধ্য রাত্রের তিমিররাশি বিদারণ করে এই জ্যোতির আবির্ভাব । ব্রহ্মনিষ্ঠ মনীষী মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রত্নগর্ভা সারদাদেবীর তিনি পঞ্চমপুত্র, সপ্তম সন্তান । রবীন্দ্রনাথ বারো বৎসরের বড়ো এই অগ্রজকে নতুন দাদা বলে ডাকতেন । প্রথমে বাড়ীর ঠাকুরদালানে গুরু মহাশয়ের কাছে, পরে সেজদা সংস্কৃতজ্ঞ ও বিজ্ঞানী হেমেন্দ্রনাথের কঠোর তত্ত্বাবধানে গৃহ শিক্ষকের কাছে, ক্রমে সেন্টপল্‌স্‌ স্কুল, মন্টেগু একাডেমী, হিন্দু স্কুল, কলকাতা কলেজে একের পর এক ঘুরে এণ্ট্রান্স্‌ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রেসিডেন্সী কলেজে এফ্‌-এ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন । সেখানে নবীনচন্দ্র সেন, বিহারীলাল গুপ্তরমেশচন্দ্র দত্ত ছিলেন তাঁর সহাধ্যায়ী । ১৮৬৭-তে আসন্ন পরীক্ষা উপেক্ষা করে তিনি মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে বোম্বাই চলে গেলেন । সেখানে তিনি বিবিধ ভাষা, শিল্প, চিত্রাঙ্কন ও সেতারবাজানো শিক্ষায় নিরত হলেন । কিছুদিন পরে কলকাতায় যখন অসুস্থ দাদার সঙ্গে ফিরে এলেন, তখন হিন্দুমেলার দ্বিতীয় অধিবেশনের আয়োজন চলেছে । ন্যাশনাল পত্রিকা সম্পাদক নবগোপাল মিত্র ছিলেন তাঁর প্রাণপুরুষ, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদক, পৃষ্ঠপোষক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ । নবগোপাল মিত্রের উৎসাহে আঠারো বৎসর বয়সে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এ মেলাই উপলক্ষ্যে রচনা করলেন জীবনের প্রথম কবিতা - “উদ্বোধন” । তার কিছুদিন পরেই ৫ই জুলাই ১৮৬৮-তে কাদম্বরীদেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয় । এর পর থেকে কর্মে ও কল্পনায় তাঁর জীবনে এলো গভীরতা । বাবা ও দাদাদের উৎসাহে আরম্ভ করলেন ব্রহ্মসঙ্গীত রচনা । ১৮৬৯ হ’তে ১৮৮৪-তে স্ত্রী বিয়োগের কিছুদিন পর পর্যন্ত আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদক পদে অবিচ্ছিন্নভাবে পঞ্চদশ বর্ষ কাজ করে গেলেন । ১৮৭২-এ ব্রাহ্মধর্মবোধিনী সভা স্থাপিত হলে তার এবং ১৮৭৫-এ আদি ব্রাহ্মসমাজ সঙ্গীত বিদ্যালয় স্থাপিত হলে তারও সম্পাদক পদ তিনি অলঙ্কৃত করেন । ১৮৭৪-৭৫-এ হিন্দু মেলার সংশ্লিষ্ট সম্পাদকরূপেও তাঁকে দেখা যায় । ইতোমধ্যে স্ত্রীস্বাধীনতা নিয়ে নব্যপন্থীদের কটাক্ষ করে তিনি রচনা করলেন “কিঞ্চিৎ জলযোগ” । তারপর কটকে গেলেন জমিদারী পরিচালনায় । সেখানে রচনা করলেন “পুরু-বিক্রম” নাটক । ফিরেই কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন “বিদ্বজ্জনসমাগম”, “সঞ্জীবনী সভা”, “সারস্বত সমাজ” প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও “ভারতী” পত্রিকা । সাহিত্য, সঙ্গীত ও ধর্ম সাধনার সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যেও দেশকে সমুন্নত করার স্বপ্ন তাঁর । আরম্ভ করলেন পাট ও নীলের চাষ ও ব্যবসা । স্বদেশীয়দের বাণিজ্যে প্রবৃত্ত করাবার জন্য “সরোজিনী” নামে একটি স্টীমার কিনে বরিশালে চালাতে লাগলেন । বিলাতী কোম্পানীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য শেষ পর্যন্ত বিনা ভাড়ায় এবং যাত্রীদের রসগোল্লা খাইয়ে জাহাজ চালিয়ে সর্বস্বান্ত হলেন । সর্বজনীন জাতীয় পোষাক প্রবর্তন ও একমাত্র নিজেই তার ব্যবহার করে জনসাধারণের পরিহাসকে উপেক্ষা করলেন । সঙ্গে সঙ্গে তখনি করছেন বাংলা গানে নূতন নূতন সুর-যোজনা এবং স্বরলিপির আকার-মাত্রিক রূপায়ণ । ১৮৯৯-তে “বীণাবাদিনী” এবং ১৯০১-এ “সঙ্গীত প্রকশিকা” নামে সঙ্গীত পত্রিকা প্রকাশ করলেন । “বীণাবাদিনী” পত্রিকায় প্রথম সংখ্যায় শীর্ষে মুদ্রিত হয় – “সাহিত্যসঙ্গীতকলাবিহীনঃ সাক্ষাৎ পশুঃ পুচ্ছবিষাণহীনঃ” । দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে শোভা পেতো -
“বীণাবাদনতত্তবিজ্ঞঃ রাগবিদ্যাবশারদঃ ৷
মূর্চ্ছনাশ্রুতিসম্পন্নঃ মোক্ষমার্গং চ গচ্ছতি ৷৷”
আর, “সঙ্গীত প্রকাশিকার” শিরোদেশে শোভা পেতো -
নাহং বসামি বৈকুণ্ঠে যোগিনাং হৃদয়ে ন চ ৷
মদ্‌ভক্তা যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ ৷৷
১৮৯৪-৯৭ পুণাতে মেজদাদার কাছে থেকে মারাঠী ভাষা উত্তম করে শিখে এলেন । ১৮৯৯-১৯০৪-এর মধ্যে সতেরোটি সংস্কৃত নাটক অনবদ্য বাংলায় তিনি অনুবাদ করলেন । ইংরেজী এবং ফরাসী শ্রেষ্ঠ নাটকাবলীও আকর্ষণীয় বাংলায় তিনি অনুবাদ করলেন । পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সে অদম্য উৎসাহ নিয়ে এই সব দুরুহ অনুবাদ তিনি করে চলেছেন । জীবনের ষাটটি বৎসর এইভাবে কাটিয়ে পরে লোকলোচনের অন্তরালে রাঁচীতে মোরাবাদী পাহাড়ে “শান্তিধামে” তিনি অবশিষ্ট জীবন যাপন করেন । ১৯২৫-এর ৪ঠা মার্চ শান্তচিত্তে জীবনের পরম পরিণামকে বরণ করে নিলেন ।

স্বদেশের মুক্তি সাধনে ছিল তাঁর তীব্র আগ্রহ । মন্ত্রগুপ্তির মাধ্যমে অধ্যাত্ম রহস্যে বেদ স্বাক্ষী করে স্বদেশ-চিন্তায় একদল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ১৮৭৭-এ তাঁর "সঞ্জীবনী” সভা স্থাপন । এর মধ্যে রয়েছে পরবর্তীকালের বিপ্লবী সমিতিসমূহের পূর্ব ছায়া । এই সভার নিয়ম ছিল যে এই সভার সদস্য ব্যতীত আর কারো কাছে সভায় আলোচিত বিষয় বলা যাবে না । সভার অধিবেশনের সময় টেবিলের দুই পাশে দুইটি কঙ্কালের মস্তক রক্ষিত হত । তাদের নেত্রকোটরে বসান হত দুটি মোমবাতি । ব্যঞ্জনা হল – কঙ্কালের মস্তক হৃতসর্বস্ব ভারত । বাতি দুটির দ্বারা সূচিত হচ্ছে মৃত ভারতের প্রাণ সঞ্চার এবং জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন । “সংগচ্ছদ্বং সংবদধ্বং” বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে সভার কাজ শুরু হত । রক্তবর্ণ রেশমী বস্ত্রে আবৃত করে বেদগ্রন্থ সভাস্থলে রক্ষিত হত । নূতন সদস্যের দীক্ষাকালে সভার অধ্যক্ষ রক্তবর্ণ পট্টবস্ত্র পরিধান করে আসতেন । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছেন – “এই দীক্ষা অনুষ্ঠানে একটা ভীষণ গাম্ভীর্য ছিল । দীক্ষাকালে নব দীক্ষার্থীর সর্বাঙ্গ একটা অজ্ঞাত ভাবাবেশে শিহরিয়া উঠিত ।” শ্রীঅরবিন্দের মাতামহ ঋষি রাজনারায়ণ বসুকে করা হয় সভাপতি । কিশোর বালক রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন দশ । তাঁরই স্মরণে পরে তিনি বলছেন – “সেখানে আমরা ভারত উদ্ধারের দীক্ষা পেলাম” । পরিণত বয়সে তিনি বলছেন যে তাঁর মহর্ষি পিতার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন সময় নিষ্ঠা, সাহিত্য ও সঙ্গীতে অনুরাগ, অতিথিপরায়ণতা, দানশীলতা, অর্থের প্রতি অনাসক্তি, গীতা এবং উপনিষদের শ্লোকাভ্যাস । গীতা এবং উপনিষদ্‌ ঠাকুর বাড়ীর সকলেরই জীবন গঠনের ভিত্তি । জ্যেষ্ঠাগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ গীতাপাঠ” নামক অনবদ্যগ্রন্থে গীতার তত্ত্বালোচনা করেন প্রাণস্পর্শী করে । মধ্যমাগ্রজ, প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ করেন গীতার পদ্যানুবাদ । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ করলেন তিলকের নবীন গীতা ভাষ্যের অনুবাদ । শেষ জীবনে তিনি গীতার চর্চাতেই নিমগ্ন থাকতেন । ১৯০৩-এ ঝান্সীর রাণী লক্ষ্মীবাঈর জীবনী মারাঠী হতে বাংলায় তিনি অনুবাদ করেন । পরিণত জীবনে পরিশীলিত প্রজ্ঞা নিয়ে অনুবাদ করলেন তিনি “গীতারহস্য” ।


___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning, then by running Google OCR and lastly by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Contents>

No comments:

Post a Comment