Sunday, June 4, 2017

গীতা ও বাইবেল (Gita & Bible)

গীতা ও বাইবেল


সূচি


1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য – পাদ্রিদের ভ্রান্ত প্রচার
2) যুক্তির দ্বারা গ্রন্থদ্বয়ের সাম্য বিচার
3) ইহুদী বাইবেল ও খৃষ্টধর্মের নব-বিধান
4) এসী/এসীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়
5) ইহুদীদের মধ্যে সন্ন্যাসপর ধর্মের উৎপত্তি
6) বৌদ্ধধর্মের সহিত এসী/খৃষ্টধর্মের সাম্য
7) বৌদ্ধধর্মের সহিত এই সাম্যের কারণ
8) সার কথা : বৈদিক ধর্ম ⇒ বৌদ্ধ ধর্ম ⇒ খৃষ্টধর্ম
9) উপসংহার


1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য – পাদ্রিদের ভ্রান্ত প্রচার


উপর্য্যুক্ত আলোচনা হইতে স্থির হইল যে, ভারতবর্ষে ভক্তিপ্রধান ভাগবতধর্মের আবির্ভাব খৃষ্টপূর্ব প্রায় ১৪ শতাব্দীতে হইয়াছিল, এবং খৃষ্টের পূর্বে প্ৰাদুর্ভূত সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্মে প্ৰবৃত্তিপ্রধান ভক্তিতত্ত্বের প্রবেশ, বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারদিগেরই মতে, শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰণীত গীতারই কারণে হইয়াছে । গীতার অনেক সিদ্ধান্ত খৃষ্টানদিগের নূতন বাইবেলেও পাওয়া যায়; বস্‌, এই ভিত্তির উপরেই খৃষ্টধর্ম হইতে এই সকল তত্ত্ব গীতায় গৃহীত হইয়া থাকিবে, এইরূপ কতকগুলি পাদ্রি স্বকীয় গ্রন্থে প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন, এবং বিশেষতঃ ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে; ডাঃ লরিনসর গীতার জর্মন অনুবাদগ্রন্থে যাহা কিছু প্ৰতিপাদন করিয়াছেন তাহার নির্মূলত্ব এক্ষণে স্বতই সিদ্ধ হয় । লরিনসর স্বকীয় পুস্তকের (গীতার জর্মন ভাষান্তরের) শেষে ভগবদ্গীতা ও বাইবেলের-বিশেষত নূতন বাইবেলের প্ৰায় শতাধিক স্থলে শব্দসাদৃশ্য দেখাইয়াছেন এবং তন্মধ্যে কতকগুলি অসাধারণ ও ভাবিয়া দেখিবার যোগ্যও আছে । উদাহরণ যথা - “সেইদিন তোমরা জানিতে পরিবে যে, আমি আমার পিতার মধ্যে, তোমরা আমার মধ্যে এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি[জন|১৪|২০], এই বাক্য গীতার “যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি” [গী|৪|৩৫] এবং “যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি” [গী|৬|৩০] এই বাক্যগুলির সহিত কেবল সমানার্থকই নহে, প্ৰত্যুত শব্দশও একই । সেইরূপ জনের পরবর্তী “যে আমাকে প্ৰীতি করে আমিও তাহাকে প্ৰীতি করি ।” এই বাক্য [১৪|২১], গীতার “প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যৰ্থং অহং স চ মম প্ৰিয়ঃ” [গী|৭|১৭] এই বাক্যের সহিত সর্বাংশেই সদৃশ । এই বাক্য এবং এই প্রকার অন্য সদৃশ বাক্য হইতে ডাক্তার লরিনসর এইরূপ অনুমান করেন যে, বাইবেল গীতাকারের বিদিত ছিল, এবং গীতা খৃষ্টের প্রায় পাঁচ শত বৎসর পরে রচিত হইয়া থাকিবে । ডাঃ লরিনসরের পুস্তকের এই অংশের ইংরাজী অনুবাদ ‘ইণ্ডিয়ান আন্টিকোয়ারি’র দ্বিতীয় খণ্ডে সেই সময়ে প্ৰকাশিত হইয়াছিল । এবং ৺ তৈলং ভগবদ্গীতার যে পদ্যাত্মক ইংরাজী অনুবাদ করিয়াছেন তাহার প্রস্তাবনায় তিনি লরিনসরের মতের সম্পূর্ণ খণ্ডন করিয়াছেন । (See Bhagavadgita translated into English Blank Verse with Notes &c. by K. T. Telang, 1875 (Bombay). This book is different from the translation in the S.B.E. Series.)

ডাঃ লরিনসর পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়া পরিগণিত ছিলেন না, এবং সংস্কৃত অপেক্ষা খুষ্টধর্মের জ্ঞান ও অভিমান তাহার অধিক ছিল । তাই, তাঁহার মত, শুধু ৺ তৈলঙ্গের নহে, কিন্তু মোক্ষমূলার প্রভৃতি প্ৰধান প্ৰধান পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগেরও অগ্রাহ্য হইয়াছিল । বেচারা লরিনসরের এ কল্পনাও হয় তো আসে নাই যে, একবার যখন গীতার কাল নিঃসংশয়রূপে খৃষ্টপূর্ব বলিয়া স্থির হইল, তখনই গীতা ও বাইবেলের মধ্যে যে শত শত অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য দেখাইয়াছি তাহা ভূতের মতো উল্টা আমারই ঘাড়ে চাপিবে । কিন্তু ইহাতে সন্দেহ নাই যে, যাহা কখনও স্বপ্নেরও গোচর হয় না, তাহাই কখন কখন চক্ষের সম্মুখে আসিয়া খাড়া হয় ও সত্য সত্য প্রত্যক্ষ হয়, তবে এখন ডাঃ লরিনসরের কথার উত্তর দিবার কোনই আবশ্যকতা নাই । তথাপি কোন কোন বড় ইংরাজী গ্রন্থে এখনও এই মিথ্যা মতেরই উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাই এখানে এই সম্বন্ধে আধুনিক গবেষণার পর যাহা নিষ্পন্ন হইয়াছে, তাহাই সংক্ষেপে বলা অবশ্যক মনে হয় । 


2) যুক্তির দ্বারা গ্রন্থদ্বয়ের সাম্য বিচার


প্ৰথমে ইহা মনে রাখা উচিত যে, যখন কোন দুই গ্রন্থের সিদ্ধান্ত একরকম হয়, তখন কেবল এই সিদ্ধান্তের সাম্য হইতেই কোন গ্ৰন্থটি প্রথম এবং কোনটি পরবর্তী, তাহা নির্ণয় করা যাইতে পারে না । কারণ এস্থলে এই দুই-ই সম্ভব যে, (১) এই দুয়ের মধ্যে প্রথম গ্রন্থের বিচার দ্বিতীয় গ্রন্থ হইতে, কিম্বা (২) দ্বিতীয় গ্রন্থের বিচার প্রথম গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়া থাকিবে । তাই প্ৰথমে যখন দুই গ্রন্থের কাল স্বতন্ত্রভাবে করিয়া লওয়া হয়, তখন আবার বিচারসাদৃশ্য হইতে স্থির করিতে হয় যে, অমুক গ্ৰন্থকার অমুক গ্ৰন্থ হইতে অমুক বিচার গ্রহণ করিয়াছেন । তাছাড়া, একই রকম বিচার দুই বিভিন্ন দেশের দুই গ্ৰন্থকারের মনে স্বতন্ত্রভাবে একই কালে কিংবা অগ্রপশ্চাতে উদয় হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে; এই জন্য, ঐ দুই গ্রন্থের সাম্য দেখিবার সময় ইহাও বিচার করিতে হয়যে, উহার উদ্ভব স্বতন্ত্রভাবে হওয়া সম্ভব কি না; এবং যে দুই দেশে এই গ্ৰন্থ রচিত হইল, তাহাদের মধ্যে তৎকালে যাতায়াত বা কারবার থাকায় এক দেশ হইতে এই বিচার অপর দেশে যাওয়া সম্ভব ছিল কি না । এই প্রকার সকল দিক হইতে দেখিলে দেখা যায় যে, খৃষ্টধর্ম হইতে কোন বিষয়ই গীতায় গৃহীত হওয়া সম্ভব ছিল না; বরঞ্চ গীতার তত্ত্বসমূহের ন্যায় যে কিছু তত্ত্ব খৃষ্টীয় বাইবেলে পাওয়া যায়, সেগুলি বাইবেলেই, অন্তত বৌদ্ধ ধর্ম হইতে - অৰ্থাৎ পর্যায়ক্ৰমে গীতা বা বৈদিক ধর্ম হইতেই - খৃষ্ট কিংবা তাঁহার শিষ্যদের কর্তৃক গৃহীত হওয়াই খুব সম্ভব; এবং কোন কোন পাশ্চাত্য পণ্ডিত এক্ষণে ইহা স্পষ্টরূপে বলিতেও আরম্ভ করিয়াছেন । এই প্রকারে দাঁড়িপাল্লা অন্যদিকে ঝুঁকিয়াছে দেখিয়া গোঁড়া খৃষ্টভক্তেরা আশ্চৰ্য হইবেন এবং এই কথা অস্বীকারের দিকেই যদি তাহাদের মনের প্রবণতা হয়, তাহাতে আশ্চৰ্য হইবার কিছুই নাই । কিন্তু ইহাঁদিগকে আমি এইটুকু বলিতে চাহি যে, এই প্রশ্ন ধর্মঘটিত নহে, ইহা ঐতিহাসিক; অতএব ইতিহাসের চিরন্তন পদ্ধতি অনুসারে অধুনা উপলব্ধ বিষয়সমূহের শান্তভাবে বিচার করা আবশ্যক । তার পর ইহা হইতে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় সেই সিদ্ধান্তই সকলের পক্ষে, বিশেষত বিচারসাদৃশ্যের প্রশ্ন যাঁহারা প্রথমে উপস্থিত করিয়াছেন তাঁহাদের পক্ষে আনন্দের সহিত ও পক্ষপাতরহিত বুদ্ধিতে গ্রহণ করাই ন্যায্য ও যুক্তিসিদ্ধ ।


3) ইহুদী বাইবেল ও খৃষ্টধর্মের নব-বিধান


ইহুদী বাইবেলে অর্থাৎ বাইবেলের পুরাতন বিধানে প্ৰতিপাদিত প্ৰাচীন ইহুদী ধর্মের সংস্করণ হিসাবে খৃষ্টধর্মের নব-বিধান বাহির হইয়াছে । ইহুদী ভাষায় ঈশ্বরকে ‘ইলোহা’ (আরবী ‘ইলাহ’) বলে । কিন্তু মোজেসের (Moses) স্থাপিত নিয়মানুসারে ইহুদীধর্মের মুখ্য উপাস্য দেবতার বিশেষ সংজ্ঞা হইল ‘জিহোভা’ । পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাই এক্ষণে স্থির করিয়াছেন যে, এই ‘জিহোভা’ শব্দ মূলে ইহুদী শব্দ নহে; খাল্‌দীয় ভাষার ‘যবে’ (সংস্কৃত যহ্ব) শব্দ হইতে আসিয়াছে । ইহুদীরা মূর্তিপূজক নহে । অগ্নিতে পশু বা অন্য বস্তুর হোম করা; ঈশ্বরের ব্যাখ্যাত নিয়ম-সকল পালন করা এবং তাঁহার দ্বারা ইহলোকে নিজের ও নিজের জাতির কল্যাণ সাধন করা - ইহাই উহাদের ধর্মের মুখ্য আচার । সংক্ষেপে বলিতে হইলে, বৈদিক ধর্মের কর্মকাণ্ড অনুসারে, ইহুদী ধর্মকেও যজ্ঞময় ও প্ৰবৃত্তিপর বলা যায় । ইহার বিরুদ্ধে অনেক স্থানে খৃষ্টের উপদেশ আছে যে, ‘আমি (হিংসাকারক) যজ্ঞ চাহি না, আমি (ঈশ্বরের) কৃপা চাই’ [মাথ্যু|৯|১৩], ঈশ্বর ও দ্রব্য উভয়ের সাধন এক-সঙ্গে হইতে পারে না” [মাথ্যু|৬|২৪], ‘যে অমৃতত্ব লাভ করিতে চাহে, তাহাকে স্ত্রীপুত্ৰ ত্যাগ করিয়া আমার ভক্ত হইতে হইবে’ [মাথ্যু|১৯|২১]; এবং তাঁহার শিষ্যদিগকে ধর্মপ্রচারার্থ যখন দেশবিদেশে প্রেরণ করেন, তখন সন্ন্যাসধর্মের এই নিয়ম সকল পালন করিবার জন্য খৃষ্ট তাহাদিগকে উপদেশ করিলেন যে, “তোমরা তোমাদের কাছে সোনা, রূপা কিংবা অনাবশ্যক বস্ত্ৰাচ্ছাদনও রাখিবে না” [মাথ্যু|১০|৯-১৩] । ইহা সত্য যে, আধুনিক খৃষ্টীয় রাষ্ট্রসকল খৃষ্টর এই সমস্ত উপদেশ গুটাইয়া তাকে উঠাইয়া রাখিয়াছেন; কিন্তু আধুনিক শঙ্করাচার্য হাতী ঘোড়া ব্যবহার করিলে শাঙ্কর সম্প্রদায়কে যেরূপ দরবারী বলা যায় না, সেইরূপ আধুনিক খৃষ্টীয় রাষ্ট্রসমূহের এই আচরণের জন্য মূল খৃষ্টধর্মও প্ৰবৃত্তিপর ছিল, একথা বলা যায় না । মূল বৈদিক ধর্ম কর্মকাণ্ডাত্মক হইলে পরও, যে প্রকার তাহার মধ্যে পরে জ্ঞানকাণ্ডের আবিভাব হইয়াছিল, সেইপ্রকারই ইহুদী ও খৃষ্টধর্মেরও সম্বন্ধ । কিন্তু বৈদিক কর্মকাণ্ডে ক্রমশ জ্ঞানকাণ্ডের ও তাহার পর ভক্তিপ্রধান ভাগবতধর্মের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি শত শত বৎসর পৰ্যন্ত হইতে চলিয়াছে; কিন্তু একথা খৃষ্টধর্মে খাটে না


4) এসী/এসীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়


ইতিহাস হইতে জানা যায় যে, খৃষ্টের অনধিক প্রায় ২০০ বৎসর পূর্বে এসী বা এসীন (Essenes) নামক সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইহুদিদিগের দেশে সহসা আবির্ভূত হইয়াছিল । এই এসী লোকেরা ইহুদীধর্মাবলম্বী হইলেও হিংসাত্মক যাগযজ্ঞ ত্যাগ করিয়া উহারা কোন নির্জনস্থানে বসিয়া ঈশ্বরচিন্তায় কালাতিপাত করিত, এবং জীবিকার জন্য বড় জোর কৃষিকার্যের মত কোন নিরুপদ্রব ব্যবসায় করিত । অবিবাহিত থাকা, মদ্যমাংস বর্জন করা, শপথ গ্ৰহণ না করা, সংঘের সহিত মঠে থাকা, এবং কেহ কোন দ্রব্য পাইলে তাহা সমস্ত সংঘের সামাজিক লাভ মনে করা প্ৰভৃতি এই সম্প্রদায়ের মুখ্য তত্ত্ব ছিল । এই মণ্ডলীর মধ্যে কেহ প্ৰবেশ করিতে চাহিলে, তাহাকে তিন বৎসর উমেদারী করিয়া তাহার পর কতকগুলি নিয়ম পালন করিব বলিয়া স্বীকার করিতে হইত । উহাদের মুখ্য মঠ মৃতসমুদ্রের (Dead Sea) পশ্চিমাধারে এঙ্গদীতে (Ein Gedi) ছিল; সেখানেই উহারা সন্ন্যাস অবলম্বন করিয়া শান্তিতে অবস্থিতি করিত । স্বয়ং খৃষ্ট এবং তাঁহার শিষ্যেরা নববিধান বাইবেলে এসী সম্প্রদায়ের মতের যেরূপ সম্মান পূর্বক নির্দেশ করিয়াছেন [মাথ্যু|৫|৩৪; ১৯|১২; জেম্‌স্‌|৫|১২; কৃত্য|৪|৩২-৩৫], তাহা হইতে দেখা যায় যে, যিশু খৃষ্ট এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন; এবং এই পন্থার সন্ন্যাসধর্ম তিনি অধিক প্রচার করিয়াছেন ।


5) ইহুদীদের মধ্যে সন্ন্যাসপর ধর্মের উৎপত্তি


খৃষ্টের সন্ন্যাসপর ভক্তিমার্গের পরম্পরা এই প্রকারে এসী-সম্প্রদায়ের পরম্পরার সহিত মিলাইয়া দিলেও মূল কর্মময় ইহুদী ধর্মের মধ্যে সন্ন্যাসপর এসী সম্প্রদায়ই বা কিরূপে প্রাদুর্ভূত হইল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাহার কোন-না কোন সযুক্তিক উপপত্তি বলা আবশ্যক । খৃষ্ট এসীন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না, এইরূপ কেহ কেহ বলিয়া থাকেন । এখন ইহা সত্য বলিয়া মনে করিলেও বাইবেলের নববিধানে যে সন্ন্যাসপর ধর্ম বৰ্ণিত হইয়াছে তাহার মূল কি, কিংবা কর্ম প্ৰধান ইহুদীধর্মে তাহার আবির্ভাব সহসা কিরূপে হইল এই প্রশ্নটিকে এড়াইতে পারা যায় না । ইহাতে কেবল এইটুকু ভেদ হয় যে, এসীন সম্প্রদায়ের উৎপত্তিসম্বন্ধীয় প্রশ্নের বদলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আবশ্যক হয় । কারণ, এক্ষণে সমাজশাস্ত্রের এই মামুলী সিদ্ধান্ত স্থির হইয়া গিয়াছে যে, কোনও বিষয় কোথাও হঠাৎ উৎপন্ন হয় না, উহা আস্তে আস্তে অনেক দিন পুর্ব হইতে বৃদ্ধি পাইতে থাকে; এবং যেস্থলে এই প্ৰকার বৃদ্ধি নজরে না আসে, সেস্থলে প্রায়ই উহা পরকীয় দেশ হইতে কিংবা পরকীয় লোক হইতে গৃহীত হইয়া থাকে” । এই কঠিন সমস্যা প্ৰাচীন খৃষ্টীয় গ্ৰন্থকারদিগের নজরে যে আসে নাই এরূপ নহে । কিন্তু বৌদ্ধধর্ম যুরোপীয়দিগের জ্ঞানগোচরে আসিবার পূর্বে অর্থাৎ খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী পৰ্যন্ত তত্ত্বানুসন্ধায়ী খৃষ্টীয় বিদ্বানদিগের এই মত ছিল যে, গ্ৰীক ও ইহুদি লোকদিগের পরস্পর নিকট-সম্বন্ধ ঘটিলে পর গ্রীকলোকদিগের - বিশেষতঃ পাইথাগোরসের-তত্ত্বজ্ঞানের কল্যাণে কর্মময় ইহুদীধর্মে এসী-সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসমার্গের আবির্ভাব হইয়া থাকিবে । কিন্তু আধুনিক গবেষণা হইতে এই সিদ্ধান্ত সত্য বলিয়া মানা যায় না । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, যজ্ঞময় ইহুদী ধর্মেই একা এক সন্ন্যাসপর এসী-ধর্মের বা খৃষ্টধর্মের আবির্ভাব হওয়া স্বভাবত সম্ভব ছিল না, এবং তাহার জন্য ইহুদীধর্মের বাহিরে উহার অন্য কোন-না-কোন কারণ হইয়াছিল - এই কল্পনাটি নূতন নহে, কিন্তু খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে খৃষ্টান পণ্ডিতদিগেরও এই মত গ্ৰাহ্য হইয়াছিল ।


6) বৌদ্ধধর্মের সহিত এসী/খৃষ্টধর্মের সাম্য


কোলব্রুক বলিয়াছেন যে, পাইথাগোরসের তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বজ্ঞানের কোথাও অধিক সাম্য আছে; তাই উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত ঠিক মনে করিলেও বলা যাইতে পারে যে, এসী-সম্প্রদায়ের জনকত্ব পরম্পরাক্রমে ভারতবর্ষেই আসে (See Colebrooke's Miscellaneous Essays, Vol.1, pp. 399-400.) কিন্তু এতটা ঘোর-ফের করিবারও কোন আবশ্যকতা নাই । বৌদ্ধগ্ৰন্থ ও বাইবেলের নববিধান তুলনা করিলে স্পষ্ট দেখা যায় যে, পাইথাগোরীয় মণ্ডলীর সহিত এসী বা খৃষ্টধর্মের যত সাম্য আছে, তদপেক্ষা অধিক ও বিশেষ সাম্য বৌদ্ধধর্মের সহিত শুধু এসীধর্মেরই নহে, কিন্তু খৃষ্টচরিত্র ও খৃষ্ট-উপদেশেরও আছে । খৃষ্টকে ভুলাইবার জন্য যেরূপ শয়তান চেষ্টা করিয়াছিল এবং যে প্রকার সিদ্ধাবস্থা প্ৰাপ্ত হইবার সময় খৃষ্ট যেরূপ ৪০ দিন উপবাস করিয়াছিলেন, সেইরূপই বুদ্ধকেও মারের ভয় দেখাইয়া মোহমুগ্ধ করিবার জন্য চেষ্টা করা হইয়াছিল এবং সেই সময় বুদ্ধ ৪৯ দিন (সাত সপ্তাহ) উপবাসী ছিলেন, ইহা বুদ্ধচরিত্রে বর্ণিত হইয়াছে । এই প্রকারেই পূৰ্ণশ্ৰদ্ধার প্রভাবে জলের উপর দিয়া চলা, মুখের দেহের কান্তি সম্পূর্ণ সুৰ্যের সদৃশ করা, অথবা শরণাগত চোর ও বেশ্যাদিগকেও সদ্‌গতি দেওয়া, ইত্যাদি কথা বুদ্ধ ও খৃষ্ট উভয়ের চরিত্রে একই সমান পাওয়া যায়; এবং “তুমি আপন প্রতিবেশীকে এবং বৈরীকেও প্রীতি করিবে” প্ৰভৃতি খৃষ্টের যে মুখ্য মুখ্য নৈতিক উপদেশ আছে, তাহাও কখন কখন একেবারে অক্ষরশঃ মূল বৌদ্ধধর্মের মধ্যে খৃষ্টের পূর্বেই আসিয়াছে । উপরে বলিয়া আসিয়াছি যে, ভক্তির তত্ত্ব মূল বৌদ্ধধর্মে ছিল না; কিন্তু তাহাও পরে, অর্থাৎ খৃষ্টের ন্যূন দুই তিন শতাব্দী পূর্বেই, মহাযান বৌদ্ধপন্থায় ভগবদ্গীতা হইতে গৃহীত হইয়াছিল

মিঃ আৰ্থর লিলী স্বকীয় পুস্তকে প্রমাণের সহিত স্পষ্ট দেখাইয়াছেন যে, এই সাম্য শুধু এইটুকু বিষয়েই পর্যাপ্ত নহে, ইহা ব্যতীত খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে আরও শত শত ছোটখাটো বিষয়ে এইরূপই সাম্য আছে । অধিক কি, খৃষ্টকে ক্রুশে চড়াইয়া বধ করিবার দরুণ খৃষ্টানদিগের নিকট ক্রুশের চিহ্ন পবিত্র ও পূজ্য সেই ক্রুশের চিহ্নকে ‘স্বস্তিক আকারে বৈদিক ও বৌদ্ধধর্মের লোকেরা খৃষ্টের শত শত বৎসর পুর্বাবধিই শুভদায়ক বলিয়া মনে করিত; এবং ইজিপ্ট প্রভৃতি পৃথিবীর পুরাতন খণ্ডের দেশেই শুধু নহে, কিন্তু কলম্বসের কয়েক শতাব্দী পূর্বে আমেরিকার পেরুমেক্‌সিকো দেশেও স্বস্তিক-চিহ্ন শুভাবহ বলিয়া বিবেচিত হইত, ইহা প্রত্নতত্ত্ববেত্তারা স্থির করিয়াছেন । (See “The Secret of the Pacific” by C. Reginald Enock, 1912, pp, 248-252.) ইহা হইতে অনুমান করিতে হয় যে, খৃষ্টের পূর্বেই স্বস্তিক চিহ্ন সমস্ত লোকের পূজ্য ছিল, পরে খৃষ্টভক্তেরা কোন-এক বিশেষ ধরণে উহারই উপযোগ করিয়া লয় । বৌদ্ধ ভিক্ষু ও প্রাচীন খৃষ্টধর্মোপদেশকদিগের, বিশেষত প্ৰাচীন পাদ্রীদিগের, পরিচ্ছদ ও ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যেও অনেক সাম্য আছে । উদাহরণ যথা, ‘ব্যাপ্‌টিজ্‌ম্‌-এর অনুষ্ঠান অর্থাৎ স্নানোত্তর দীক্ষা দিবার অনুষ্ঠানও খৃষ্টের পূর্বেই প্রচলিত ছিল । এক্ষণে ইহা সপ্রমাণ হইয়াছে যে, দূর-দূর দেশে ধর্মোপদেশক পাঠাইয়া ধর্ম প্রচার করিবার পদ্ধতি খৃষ্টীয় ধর্মোপদেশকদিগের পূর্বেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদিগের সম্পূর্ণ স্বীকৃত হইয়াছিল ।

এই প্রশ্ন যে-কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির মনে উদয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, বুদ্ধ ও খৃষ্টের চরিত্র ও নৈতিক উপদেশে এবং এই দুই ধর্মের অনুষ্ঠানবিধির মধ্যে এই যে অসাধারণ ও ব্যাপক সাম্য দেখিতে পাওয়া যায়, ইহার কারণ কি ? 
(এই সম্বন্ধে মিঃ আর্থর লিলী Buddhism in Christendom এই নামে এক স্বতন্ত্র গ্রন্থ লিখিয়াছেন; তাছাড়া স্বকীয় মত সংক্ষেপে Buddha and Buddhism নামক গ্রন্থের শেষ চার ভাগে স্পষ্টরূপে নিরূপণ করিয়াছেন । আমি পরিশিষ্টের এই ভাগে যে বিচার আলোচনা করিয়াছি তাহা মুখ্যরূপে এই দ্বিতীয় গ্রন্থের আধারেই করিয়াছি । Buddha and Buddhism গ্রন্থ The World’s Epoch-makers Series-এ ১৯০০ খৃষ্টাব্দে প্ৰকাশিত হয় এবং তাহার দশম ভাগে, বৌদ্ধ ও খৃষ্টধর্মের মধ্যে প্রায় ৫০টা সাদৃশ্য দেখাইয়াছেন ।)


7) বৌদ্ধধর্মের সহিত এই সাম্যের কারণ


বৌদ্ধ ধর্ম-গ্রন্থের অনুশীলনের ফলে এই সাম্য যখন প্রথম-প্ৰথম পাশ্চাত্যদিগের নজরে পড়িল, তখন কোন কোন খৃষ্টীয় পণ্ডিত বলিতে লাগিলেন যে, বৌদ্ধের এই তত্ত্ব ‘নেষ্টোরিয়ান’ (Nestorianism) নামক আসিয়াখণ্ডে (Sasanian Empire) প্রচলিত খৃষ্টীয় পন্থা হইতে গ্ৰহণ করিয়া থাকিবে । কিন্তু এই কথাই সম্ভবপর নহে; কারণ, নেষ্টার সম্প্রদায়ের প্রবর্তকই খৃষ্টের প্রায় সওয়া চারি শত বৎসর পরে আবির্ভূত হইয়াছিলেন; এবং এখন অশোকের শিলালিপি হইতে নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হইয়াছে যে, খৃষ্টের প্রায় পাঁচ শত বৎসর পূর্বে এবং নেষ্টারের প্রায় নয় শত বৎসর পূর্বে - বুদ্ধের জন্ম হইয়া গিয়াছিল । অশোকের সময়ে, অর্থাৎ খৃষ্টের অন্তত আড়াই শত বৎসর পূর্বে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে ও আশপাশের দেশে খুব প্রচলিত হইয়াছিল; এবং বুদ্ধ-চরিত্ৰাদি গ্ৰন্থও তখন রচিত হইয়াছিল । এই প্রকারে বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনত্ব যখন নির্বিবাদ, তখন খৃষ্টীয় ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে সাম্য দেখা যায় তৎসম্বন্ধে দুই পক্ষমাত্র অবশিষ্ট থাকিয়া যায়; (১) ঐ সাম্য স্বতন্ত্র ভাবে দুইদিকে উৎপন্ন হইয়া থাকিবে, কিংবা (২) বৌদ্ধ ধর্ম হইতে এই সকল তত্ত্ব খৃষ্ট বা খৃষ্টের শিষ্যেরা গ্ৰহণ করিয়া থাকিবেন । প্রোঃ রিস-ডেভিড্‌স্‌ বলেন যে, এই বিষয়ে বুদ্ধ ও খৃষ্টের পরিস্থিতির ঐক্য নিবন্ধন, উভয়ের মধ্যেই এই সাম্য, স্বভাবতই স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হইয়াছে । (See Buddhist Suttas, S.B.E. Series Vol XI, p.163.) কিন্তু একটু বিচার করিয়া দেখিলেই সহজে উপলব্ধি হইবে যে, এই কল্পনা সন্তোষজনক নহে । কারণ, কোন নূতন বিষয় কোথাও যখন স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হয়, তখন উহা ক্ৰমে ক্ৰমেই হইয়া থাকে এবং সেইজন্য উহার উন্নতির ক্রমও আমরা বলিতে পারি । উদাহরণ যথা - বৈদিক কর্মকাণ্ড হইতে জ্ঞানকাণ্ড, এবং জ্ঞানকাণ্ড অর্থাৎ উপনিষৎ হইতেই পরে ভক্তি, পাতঞ্জল যোগ কিংবা শেষে বৌদ্ধধর্ম কেমন করিয়া নিঃসৃত হইল, যুক্তিসহকারে তাহার ক্রমপরম্পরা ঠিক দেখান যাইতে পারে । কিন্তু যজ্ঞময় ইহুদীধর্মে সন্ন্যাসপার এসী বা খৃষ্টধর্মের উদ্ভব এই প্রকারে হয় নাই । উহা একেবারেই উৎপন্ন হইয়াছে; এবং উপরে বলিয়া আসিয়াছি যে, প্রাচীন খৃষ্টান পণ্ডিতও ইহা মানিতেন যে, এইভাবে উহার একেবারে উৎপন্ন হইবার কোন কিছু কারণ ইহুদীধর্মের বাহিরে ঘটিয়া থাকিবে । তাছাড়া, খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে সাম্য দেখা যায় তাহা এত অসাধারণ ও সম্পূর্ণ যে, সেরূপ সাম্য স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হইতেই পারে না । ইহা যদি সপ্ৰমাণ হইয়া গিয়া থাকিত যে, সে সময় বৌদ্ধধর্মের কথা ইহুদীদিগের জানাই সর্বথা অসম্ভব ছিল, তবে সে কথা স্বতন্ত্র ছিল । কিন্তু ইতিহাস হইতে সপ্ৰমাণ হয় যে, আলেক্‌জাণ্ডারের পরবর্তী সময়ে - এবং বিশেষতঃ অশোকের সময়েই (অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০ বৎসরে) - বৌদ্ধ যতির পূর্বদিকে ইজিপ্টের অন্তর্গত আলেকজান্দ্ৰিয়া এবং গ্রীস পৰ্যন্ত প্ৰবেশ করিয়াছিল । অশোকের এক শিলালিপিতে এইরূপ লিখিত আছে যে, তিনি ইহুদীলোকদিগের এবং আশপাশের দেশসমূহের গ্ৰীক রাজা আন্টিওকসের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন । সেইরূপ বাইবেলে ইহা বর্ণিত হইয়াছে [মাথ্যু|২|১] যে, খৃষ্ট যখন জন্মিয়াছিলেন তখন পুর্বাঞ্চলের কোন, জ্ঞানী ব্যক্তি জেরুজালেমে গিয়াছিলেন, খৃষ্টানেরা বলেন যে, এই জ্ঞানী পুরুষেরা ‘মগী’ অর্থাৎ সম্ভবত ইরাণীধর্মের লোক হইবেন, - ভারতবর্ষের নহে । কিন্তু যাহাই বল না কেন, উভয়ের অর্থ তো একই । কারণ, এই কালের পুর্বেই বৌদ্ধধর্মের প্রসার কাশ্মীর ও কাবুলে হইয়া গিয়াছিল; এবং উহা পূর্বদিকে ইরান ও তুর্কিস্থান পৰ্যন্তও পৌঁছিয়াছিল, ইহা ইতিহাস হইতে স্পষ্ট জানা যায় । তাছাড়া, খৃষ্টের সময়ে ভারতবর্ষের এক যতি লোহিতসমুদ্রের উপকূলে এবং আলেকজান্দ্ৰিয়ার আশপাশের প্রদেশে প্রতিবৎসর আসিতেন, এইরূপ প্লুটার্ক স্পষ্ট লিখিয়াছেন ।
(“See Plutarch's Morals - Theosophical Essays”, translated by C. N. King (George Bell & Sons) pp. 96, 97. পালীভাষার মহাবংশে [২৯|৩৯] যবনদিগের অর্থাৎ গ্ৰীকদিগের অলসন্দা (যোননগরী হলসন্দা) নামক নগরের উল্লেখ আছে । উহাতে কথিত হইয়াছে যে, খৃষ্টীয় শতাব্দীর কয়েক বৎসর পূর্বে সিংহলে এক দেবালয়ের নির্মাণকালে অনেক বৌদ্ধ যতি উৎসব উপলক্ষে গিয়াছিল । মহাবংশের ইংরাজী অনুবাদক অলসন্দা শব্দে ইজিপ্টদেশের আলেকজান্দ্ৰিয়া নগর গ্রহণ না করিয়া, কাবুলের মধ্যে এই নামে আলেক্‌জাণ্ডার এক যে গ্রাম স্থাপন করেন, অলসন্দা শব্দে এই স্থানই বিবক্ষিত এইরূপ বলেন । কিন্তু ইহা ঠিক নহে । কারণ, এই ক্ষুদ্র গ্রামকে কেহই যবনদিগের নগর বলিত না । তাছাড়া উপরি-উক্ত অশোকের শিলালিপিতেই যবনদিগের রাজ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষু পাঠাইবার স্পষ্ট উল্লেখ আছে ।)

তাৎপৰ্য, খৃষ্টের দুই তিন শত বৎসর পূর্বেই, ইহুদীদের দেশে বৌদ্ধ যতিগণ যে প্ৰবেশ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে এখন আর কোন সংশয় নাই; এবং এই গতিবিধি যখন সপ্ৰমাণ হইল, তখন ইহুদীলোকের মধ্যে সন্ন্যাসপর এসী ধর্মের এবং পরে সন্ন্যাসযুক্ত ভক্তি প্রধান খৃষ্টধর্মের আবির্ভাব হইবার পক্ষে বৌদ্ধধর্মই যে বিশেষ কারণ হইয়া থাকিবে তাহা সহজেই নিষ্পন্ন হয় । ইংরাজ গ্রন্থকার লিলীও ইহাই অনুমান করিয়াছেন (See Lillie's Buddha and Buddhism pp, 158 ff.); এবং ইহার সমর্থনে ফরাসী পণ্ডিত এমিল্‌ বুর্ণুফ্‌ এবং রোস্নীর এই প্রকার মত আপন গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন; এবং জর্মনদেশে লিপজিকের তত্ত্বজ্ঞানশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রোঃ সেডন এই বিষয়সংক্রান্ত স্বকীয় গ্রন্থে এই মতই প্ৰতিপাদনা করিয়াছেন । জর্মন প্রোফেসর শ্ৰডর তাঁহার এক নিবন্ধে বলেন যে, খৃষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ণরূপে সমান নহে; দুয়ের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে সাম্য থাকিলেও অন্য বিষয়ে বৈষম্যও অনেক আছে এবং সেইজন্য খৃষ্টধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম হইতে নিঃসৃত এই মত গ্ৰাহ্য হইতে পারে না । কিন্তু এই কথা আসল বিষয়ের বহির্ভূত হওয়ায় এই কথার কোন মূল্য নাই । খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্ম সর্বাংশে একই, এ কথা কেহই বলে না; কারণ তাহা যদি হইত, তবে এই দুই ধর্ম ভিন্ন বলিয়া ধরা হইত না । মুখ্য প্রশ্ন তো এই যে, যখন মূলে ইহুদি ধর্ম নিছক কর্মময়, তখন উহাতে সংস্কারের আকারে সন্ন্যাসযুক্ত ভক্তিমাৰ্গপ্রতিপাদক খৃষ্টধর্মের আবির্ভাবের সম্ভবতঃ কি কারণ হইয়াছিল । এবং খৃষ্টধর্মাপেক্ষা বৌদ্ধধর্ম নিঃসংশয় প্রাচীন; উহার ইতিহাসের প্ৰতি লক্ষ্য করিলে, সন্ন্যাসপর ভক্তি ও নীতির তত্ত্ব খৃষ্ট স্বতন্ত্ররূপে আবিষ্কার করিষাছিলেন এই কথা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না । খৃষ্ট দ্বাদশ বৎসর বয়স হইতে ত্ৰিশ বৎসর বয়স পৰ্যন্ত কি করিতেন, অথবা কোথায় ছিলেন এই সম্বন্ধে বাইবেলে কোন সংবাদই পাওয়া যায় না । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, এই কাল তিনি সম্ভবত জ্ঞানার্জনে, ধর্মচিন্তনে, ও প্ৰবাসে অতিবাহিত করিয়াছিলেন । অতএব, জীবনের এই সময়ে তাঁহার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সহিত প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সম্বন্ধ ঘটিয়াছিল কি না তাহা দৃঢ় বিশ্বাসের সহিত কে বলিতে পারে ? কারণ, বৌদ্ধ যতিদিগের গতিবিধি সেই সময়ে গ্রীস দেশ পৰ্যন্ত ছিল । নেপালের এক বৌদ্ধ মঠের গ্রন্থে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, যিশু সেই সময়ে ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন এবং সেখানে তিনি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন । নিকোলস নোটোভিশ নামক এক রুসিয়ান ভদ্রলোক এই গ্ৰন্থ প্রাপ্ত হইয়া ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে ফরাসী ভাষায় তাহার ভাষান্তর প্রকাশ করিয়াছিলেন । নোটোভিশের ভাষান্তর ভাল হইলেও মূল গ্ৰন্থ পরে কোন মিথ্যুক মিথ্যা করিয়া রচনা করিয়াছে, এইরূপ অনেক খৃষ্ঠান পণ্ডিত বলেন । উক্ত গ্ৰন্থ এই পণ্ডিতেরা সত্য মনে করুন বলিয়া আমারও বিশেষ কোন আগ্রহ নাই । নোটোভিশ যে গ্রন্থ পাইয়াছেন তাহা সত্যই হউক বা প্রক্ষিপ্তই হউক, কেবল ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আমি যে বিচার-আলোচনা উপরে করিয়াছি তাহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে যে, খৃষ্টের না হউক, নিদান পক্ষে বাইবেলের নববিধানে তাঁহার চরিত্ৰলেখক ভক্তদিগের বৌদ্ধধর্মের কথা জানা অসম্ভব ছিল না; এবং ইহা যদি অসম্ভব না হয় তবে খৃষ্ট এবং বুদ্ধের চরিত্র ও উপদেশে যে অসাধারণ সাম্য পাওয়া যায়, উহার স্বতন্ত্র ভাবে উৎপত্তি স্বীকার করাও যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না ।
(রমেশচন্দ্র দত্তেরও এইরূপ মত; তিনি তাঁহার গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন । Romesh Chandra Dutt's History of Civilization in Ancient India, Vol II, Chap. xx. P.328-340.) 


8) সার কথা : বৈদিক ধর্ম ⇒ বৌদ্ধ ধর্ম ⇒ খৃষ্টধর্ম


সার কথা, মীমাংসকদিগের নিছক্‌ কর্মমাৰ্গ, জনকাদির জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগ (নৈষ্কর্ম্য), উপনিষৎকারদিগের ও সাংখ্যাদিগের জ্ঞাননিষ্ঠা ও সন্ন্যাস, চিত্তনিরোধরূপ পাতঞ্জল যোগ, এবং পাঞ্চরাত্র বা ভাগবত ধর্ম অর্থাৎ ভক্তি - এই সমস্ত ধর্মাঙ্গ ও তত্ত্বই মূলে প্ৰাচীন বৈদিক ধর্মেরই অন্তর্ভূত । তন্মধ্যে ব্ৰহ্মজ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিকে ছাড়িয়া, চিত্তনিরোধ রূপ যোগ ও কর্মসন্ন্যাস এই দুই তত্ত্বেরই ভিত্তিতে বুদ্ধ সর্বপ্রথম আপন সন্ন্যাসপর ধর্ম চারি বর্ণকে উপদেশ করেন; কিন্তু পরে উহাতেই ভক্তি ও নিষ্কাম কর্ম মিলাইয়া দিয়া বুদ্ধের অনুগামীরা তাঁহার ধর্ম চারিদিকে প্রচার করেন । অশোকের সময়ে বৌদ্ধধর্মের এই প্ৰকার প্রচার হইলে পর, নিছক কর্মপর ইহুদীধর্মে সন্ন্যাসমার্গের তত্ত্ব প্ৰবেশ করিতে আরম্ভ হয়; এবং শেষে উহাতেই ভক্তি মিলাইয়া দিয়া খৃষ্ট স্বকীয় ধর্ম প্ৰবর্তিত করেন । ইতিহাস হইতে নিষ্পন্ন এই পরম্পরা দেখিলে, ডাঃ লরিনসরের এই উক্তি তো অসত্য সিদ্ধ হয় যে, গীতাতে খৃষ্টধর্ম হইতে কোন কিছু গৃহীত হইয়াছে, বরং বিপরীতে, আত্মৌপম্যদৃষ্টি, সন্ন্যাস, নির্বৈরত্ব ও ভক্তির যে সকল তত্ত্ব বাইবেলের নববিধান-ভাগে পাওয়া যায় তাহা বৌদ্ধ ধর্ম হইতে অর্থাৎ পরম্পরাক্রমে বৈদিক ধর্ম হইতে খৃষ্টধর্মে গৃহীত হওয়া খুব সম্ভবমাত্র নহে, বরঞ্চ গৃহীত হওয়াই বিশ্বাসযোগ্য । এবং ইহার জন্য হিন্দুদিগকে অপরের মুখের দিকে তাকাইবার কোনও আবশ্যকতা ছিলই না, ইহা সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় ।


9) উপসংহার


এই প্রকারে, এই প্ৰকরণের আরম্ভে প্ৰদত্ত সাত প্রশ্নের বিচার শেষ হইল । এক্ষণে ইহারই সঙ্গে কতকগুলি এইরূপ গুরুতর প্রশ্ন উদিত হয় যে, ভারতবর্ষে যে ভক্তিপন্থা আজকাল প্ৰচলিত আছে, উহার উপর ভগবদ্গীতার কি পরিণাম ঘটয়াছে ? কিন্তু এই সকল প্ৰশ্নকে গীতাগ্রন্থসম্বন্ধীয় বলা অপেক্ষা হিন্দুধর্মের আধুনিক ইতিহাসের অন্তর্গত এইরূপ বলাই সঙ্গত, সেইজন্য, এবং বিশেষতঃ এই পরিশিষ্ট প্রকরণ অল্প অল্প করিলেও আমার নির্দিষ্ট সীমা অনেক অতিক্রম করিয়াছে; অতএব গীতার বহিরঙ্গের বিচার-আলোচনা এইখানেই শেষ করা গেল ।


ইতি পরিশিষ্ট প্রকরণ সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ (Gita & Buddhist Literature)

গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ


সূচি


1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য
2) বুদ্ধের নির্বাণকাল
3) বুদ্ধের পূর্বেই বৈদিকধর্মের পুর্ণাবস্থা-প্রাপ্তি
4) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - সন্ন্যাসমার্গের বিচার
4.1) প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি ? চারি আৰ্যসত্য :
4.2) সার কথা
5) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - গাৰ্হস্থ্যমার্গের বিচার
6) গীতার প্রাচীনত্ব প্রমাণে শ্লোকসাদৃশ্যই যথেষ্ট নয়
7) বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপের পরিবর্তন
7.1) ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা
8) বৌদ্ধধর্মে ভক্তিমার্গের উন্মেষে ভগবদ্গীতার প্রভাব ?
9) সার কথা


1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য


বর্তমান গীতার কালনির্ণয়ের জন্য উপরে যে বৌদ্ধগ্রন্থের প্রমাণ দেওয়া গিয়াছে, তাহার পূর্ণ গুরুত্ব উপলব্ধি করিবার জন্য গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ বা বৌদ্ধধর্মের সাধারণ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সম্বন্ধেও এখানে একটু বিচার করা আবশ্যক । গীতার স্থিতপ্ৰজ্ঞ প্ৰবৃত্তিমার্গেরই অনুসরণ করেন - ইহাই গীতাধর্মের বিশেষত্ব, ইহা পূর্বে অনেকবার বলিয়াছি । কিন্তু এই বিশেষ গুণটিকে ক্ষণকাল একপাশে রাখিয়া, এইরূপ পুরুষের কেবল মানসিক ও নৈতিক গুণসমূহেরই বিচার করিলে, গীতার স্থিতপ্ৰজ্ঞ [গী|২|৫৫, ৭২], ব্ৰহ্মনিষ্ঠ পুরুষ [৪|১৯-২৩; ৫|১৮-২৮] এবং ভক্তিযোগী পুরুষের [১২|১৩-১৯] যে লক্ষণ বলা হইয়াছে, সেই সব লক্ষণ এবং নির্বাণ-পদের অধিকারী অৰ্হৎদিগের অর্থাৎ পূর্ণ অবস্থায় উপনীত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভিন্ন ভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থে যে সকল লক্ষণ প্রদত্ত হইয়াছে সেই সব লক্ষণ - এই উভয়ের মধ্যে বিলক্ষণ সাম্য আছে দেখিতে পাওয়া যায় [ধম্মপদ শ্লো|৩৬০-৪২৩ ও সুত্তনিপাতের মধ্যে মুনিসুত্ত ও ধম্মিকসুত্ত দেখ] । অধিক কি, এই বর্ণনাসমূহের শব্দসাম্য হইতে দেখা যায় যে, স্থিতপ্রজ্ঞ এবং ভক্তিমান ব্যক্তির সমানই প্রকৃত ভিক্ষুও ‘শান্ত’, ‘নিষ্কাম’, ‘নির্মম’, ‘নিরাশী’ (নিরিস্‌সিত), ‘সমদূঃখসুখ’, ‘নিরারম্ভ’, ‘অনিকেতন’, বা ‘অনিবেশন’ অথবা ‘সমনিন্দাস্তুতি’, এবং ‘মানাপমান ও লাভালাভে সমদর্শী’ থাকে [ধম্মপদ|৪০, ৪১ ও ৯১; সুত্তনি|মুনিসুত্ত|১|৭ ও ১৪; দ্বয়তানুপস্‌সনসুত্ত ২১-২৩; ও বিনয়পিটক চুল্লবগ্‌গ|৭|৪|৭ দেখ] । জ্ঞানী পুরুষের নিকট যাহা আলোক অজ্ঞানের নিকট তাহাই অন্ধকার, দ্বয়তানুপস্‌সনসুত্তের ৪০ শ্লোকের এই বিচার “যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী” [গী|২|৩৯] গীতার এই বিচারের অনুরূপ; এবং “অরোসনেয্যো ন রোসেতি” - অৰ্থাৎ, নিজেও কষ্ট পায় না, অন্যকেও কষ্ট দেয় না, মুনিসুত্তের ১০ শ্লোকের এই বর্ণনা গীতার “যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ” [গী|১২|১৫] এই বর্ণনার সদৃশ । সেইরূপ সল্লসুত্তের “যাহার জন্ম তাহারই মৃত্যু” এবং “ভূতদিগের আদি ও অন্ত অব্যক্ত হওয়ায় তাহার জন্য শোক করা বৃথা” [সল্লমুত্ত|১ ও ৯ এবং গী|২|২৭ ও ২৮] ইত্যাদি বিচার অল্প শব্দভেদে গীতারই বিচার । গীতার দশম অধ্যায়ে কিংবা অনুগীতার [মভা|অশ্ব|৪৩|৪৪] “জ্যোতিষ্মানদিগের মধ্যে সূৰ্য, নক্ষত্রদিগের মধ্যে চন্দ্র, এবং বেদমন্ত্রের মধ্যে গায়ত্ৰী” ইত্যাদি যে বৰ্ণনা আছে তাহাই অবিকল সেলসুত্তের ২৭ ও ২২ শ্লোকে এবং মহাবগ্‌গে [৬|৩৫|৮] পাওয়া যায় । ইহা ব্যতীত ছোট-খাটো শব্দ সাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য, ৺তৈলং স্বকীয় গীতার ইংরাজী ভাষান্তরের টিপ্পনীতে দেখাইয়াছেন । তথাপি প্রশ্ন উঠে যে, এই সাদৃশ্য কিরূপে উৎপন্ন হইল ? এই বিচার মূলে বৌদ্ধদিগের, বা বৈদিক ধর্মের ? এবং ইহা হইতে কি অনুমান হয় ? কিন্তু এই প্ৰশ্নসমূহের নির্ণয় করিবার জন্য সে সময়ে যে সাধন পাওয়া গিয়াছিল, তাহা অপূর্ণ থাকায় উপরিউক্ত আশ্চৰ্য শব্দসাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য প্রদর্শন অপেক্ষা আর বেশী কিছু এই বিষয়ে ৺ তৈলং লিখিতে পারেন নাই । কিন্তু এক্ষণে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে যে সকল নানা বিবরণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে এই সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা হইতে পারে বলিয়া এখানে বৌদ্ধধর্মের সেই সকল বিষয় সংক্ষেপে বলিতেছি । ৺তৈলং-কৃত গীতার ইংরাজী ভাষান্তর যাহা ‘প্ৰাচ্যধর্মগ্রন্থমালায়’ প্ৰকাশিত হইয়াছে, উহাতে পরে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বৌদ্ধধর্মগ্রন্থসমূহের ইংরাজী অনুবাদ প্ৰকাশ করিয়াছেন । এই সকল বিষয় প্রায় সেই সকল গ্ৰন্থ হইতে সংগ্ৰহ করা হইয়াছে এবং প্রমাণার্থ উপস্থাপিত বৌদ্ধগ্রন্থের স্থলনির্দেশও এই সকল ভাষান্তরেরই অনুযায়ী করা হইয়াছে । কোন কোন স্থলে পালী শব্দ ও বাক্য মূল পালী গ্ৰন্থ হইতেই গৃহীত হইয়াছে ।


2) বুদ্ধের নির্বাণকাল


এই কথা এখন নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হইয়াছে যে, জৈনধর্মের ন্যায় বৌদ্ধধর্মও আপন বৈদিক ধর্মরূপ পিতারই পুত্র, যে নিজের সম্পত্তির অংশ লইয়া কোন কারণে পৃথক হইয়া গিয়াছে; অর্থাৎ উহা পরকীয় নহে, কিন্তু তৎপূর্বে এখানে যে ব্ৰাহ্মণধর্ম ছিল, উহারই এখানেই উৎপন্ন এক শাখা । সিংহল দ্বীপের মহাবংস কিংবা দীপবংসাদি পুরাতন পালীগ্রন্থে, বুদ্ধের পরবর্তী রাজাদিগের ও বৌদ্ধ আচাৰ্য-পরম্পরার যে বৰ্ণনা আছে, তাহা হইতে হিসাব করিয়া দেখিলে নিষ্পন্ন হয় যে, ৮০ বৎসর বয়সে খৃষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু হয় । কিন্তু ইহাতে কতকগুলি কথা অসম্বদ্ধ আছে; এইজন্য প্ৰোঃ মোক্ষমুলার এই গণনাসম্বন্ধে সূক্ষ্ম বিচার করিয়া বুদ্ধের প্রকৃত নিৰ্বাণকাল খৃষ্টপূর্ব ৪৭৩ অব্দে হইয়াছিল বলিয়াছেন; এবং ঐ কালই অশোকের শিলালিপি হইতে সিদ্ধ হয় ইহা বুহ্লরও দেখাইয়াছেন । তথাপি প্রোঃ রিজ-ডেভিড্‌স্‌ এবং ডাঃ কের্ণ-এর ন্যায় কোন কোন তত্ত্বানুসন্ধায়ী, ইহা অপেক্ষা ৬৫ ও ১০০ বৎসর আরও পরের দিকে হটাইতে চাহেন । প্ৰোঃ গায়গর সম্প্রতিই এই সমস্ত মতের বিচার করিয়া খৃঃ পুঃ ৪৮৩ অব্দকে বুদ্ধের নির্বাণকাল স্থির করিয়াছেন । (প্রোঃ মোক্ষমূলর স্বকীয় ধর্মপদের ইংরাজী ভাষান্তরের প্রস্তাবনায় বুদ্ধের নির্বাণকাল-সম্বন্ধীয় বিবরণ দিয়াছেন S. B. E. Vọl. X. Intro. pp. xxxv-xiv এবং ডাঃ গায়গর ১৯১২ অব্দে প্রকাশিত স্বীয় মহাবংসের ভাষান্তরের প্রস্তাবনায় উহার সমালোচনা করিয়াছেন – তাহা দেখ - The Mahavamsa by Dr. Geiger Pali Text Society Intro p. xxiif.)


3) বুদ্ধের পূর্বেই বৈদিকধর্মের পুর্ণাবস্থা-প্রাপ্তি


তন্মধ্যে যে কালই স্বীকার কর না কেন, বুদ্ধের জন্ম হইবার পূর্বেই বৈদিকধর্ম পুর্ণাবস্থায় উপনীত হইয়াছিল, এবং শুধু উপনিষদ নহে, কিন্তু ধর্মসূত্রের ন্যায় গ্ৰন্থও তাহার পূর্বেই রচিত হইয়াছিল, ইহা নির্বিবাদ । কারণ, পালী ভাষার প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহেই লিখিত আছে যে, “চারি বেদ, বেদাঙ্গ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ইতিহাস ও নিঘণ্টু” প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী সাত্ত্বিক গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণদিগকে এবং জটাধারী তপস্বীদিগকে গৌতম বুদ্ধ তর্ক করিয়া আপন ধর্মে দীক্ষিত করেন (সুত্ত্বনিপাতের মধ্যে সেলসুত্তের সেলের বর্ণনা ও বথ্‌থু গাথা ৩০-৪৫) । কঠাদি উপনিষদে [কঠ|১|১৮; মুণ্ড|১|২|১০]; এবং উহাদিগকেই লক্ষ্য করিয়া গীতায় [২|৪০-৪৫; ৯|২০, ২১] যাগযজ্ঞাদি শ্রৌতকর্মের যেরূপ লঘুতা বর্ণিত হইয়াছে, সেইরূপ এবং কোন কোন অংশে সেই সকল শব্দেরই দ্বারা তেবিজ্জসুত্তে (ত্রৈবিদ্য সূত্রে) বুদ্ধও স্বমতানুসারে ‘যাগযজ্ঞাদিকে’ অনুপযোগী ও ত্যাজ্য স্থির করিয়াছেন এবং ব্ৰাহ্মণ যাহাকে ‘ব্ৰহ্মসহব্যতায়’ (ব্ৰহ্মসহব্যতায় = ব্ৰহ্মসাযুজ্যতা) বলেন সেই অবস্থা কিরূপে প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, তাহার নিরূপণ করিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড - কিংবা গাৰ্হস্থ্যধর্ম ও সন্ন্যাসধর্ম, অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি - এই দুই শাখা সম্পূর্ণরূপে প্ৰচলিত হইবার পর, তাহার সংস্কার-সাধনের জন্য বৌদ্ধধর্ম উৎপন্ন হয় । সংস্কার-সাধনের সাধারণ নিয়ম এই যে, উহাতে পূর্বের কোন কোন বিষয় বজায় থাকে এবং কোন কোন বিষয় পরিবর্তিত হয় । তাই এই নিয়মানুসারে, বৌদ্ধধর্মে বৈদিক ধর্মের কোন কোন কথা বজায় রাখা হইয়াছে এবং কোন কোন বিষয় পরিত্যক্ত হইয়াছে, এক্ষণে তাহার বিচার করিব । এই বিচার গাৰ্হস্থ্যধর্ম ও সন্ন্যাস এই দুইয়ের পৃথক পৃথক দৃষ্টিতে করিতে হইবে । কিন্তু বৌদ্ধধর্ম মূলে সন্ন্যাসমাৰ্গীয় কিংবা নিবৃত্তিপ্রধানই হওয়ায় প্ৰথমে দুইয়ের সন্ন্যাসমার্গের বিচার করিয়া তাহার পর উভয়ের গাৰ্হস্থ্যধর্মের তারতম্য সম্বন্ধে বিচার করিব ।


4) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - সন্ন্যাসমার্গের বিচার


বৈদিক সন্ন্যাসধর্মের প্রতি লক্ষ্য করিলে উপলব্ধি হইবে যে, কর্মময় জগতের সমস্ত ব্যবহার তৃষ্ণামূলক সুতরাং দুঃখময়; উহা হইতে অর্থাৎ জন্মমরণের ভবচক্র হইতে আত্মার চিরমুক্তি সাধনের জন্য মনকে নিষ্কাম ও বিরক্ত করিয়া উহাকে দৃশ্য জগতের মূলে অবস্থিত আত্মস্বরূপ নিত্য পরব্রহ্মে সমাধান পূর্বক সাংসারিক কর্মসকল সর্বথা ত্যাগ করা উচিত; এই আত্মনিষ্ঠ অবস্থাতেই সর্বদা নিমগ্ন থাকা সন্ন্যাসধর্মের মুখ্য তত্ত্ব । দৃশ্যজগৎ নামরূপাত্মক ও নশ্বর; এবং তাহার অখণ্ডিত ব্যাপার কর্মবিপাক প্ৰযুক্তই বরাবর বজায় আছে ।
কম্মনা বত্ততী লোকো কম্মনা বত্ততী পজা (প্ৰজা) ৷
কম্মনিবন্ধনা সত্তা (সত্ত্বখানি) রথস্‌সাহণীব যায়তো ॥
অর্থাৎ “কর্মের দ্বারাই লোক ও প্ৰজা বজায় আছে; চল্‌তি গাড়ী যেরূপ রথের কীলকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেইপ্ৰকার প্রাণীমাত্র কর্মের দ্বারা বদ্ধ হইয়া আছে” [সুত্তনি|বাসেঠসুত্ত|৬১] । বৈদিক ধর্মের জ্ঞানকাণ্ডের উক্ত তত্ত্ব, অথবা জন্ম-মরণের চক্র বা ব্রহ্মা, ইন্দ্র, মহেশ্বর, ঈশ্বর, যম, প্রভৃতি অনেক দেবতা এবং উঁহাদের বিভিন্ন স্বর্গপাতালাদি লোকসমূহের ব্রাহ্মণধর্মে বর্ণিত অস্তিত্ব বুদ্ধের মান্য ছিল; এবং সেইজন্যই নামরূপ, কর্মবিপাক, অবিদ্যা, উপাদান ও প্ৰকৃতি প্ৰভৃতি বেদান্ত বা সাংখ্যশাস্ত্রের শব্দ ও ব্ৰহ্মাদি বৈদিক দেবতাদিগের কথাও (বুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিয়া) ন্যূনাধিক ভেদে বৌদ্ধগ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় । দৃশ্য জগৎ নশ্বর ও অনিত্য এবং উহার ব্যবহার কর্ম-বিপাকনিবন্ধন চলিতেছে, ইত্যাদি কর্মজগৎসংক্রান্ত বৈদিক ধর্মের সিদ্ধান্ত বুদ্ধের মান্য হইলেও নামরূপাত্মক নশ্বর জগতের মূলে নামরূপের অতিরিক্ত আত্মস্বরূপ পরব্রহ্মের সমান এক নিত্য ও সর্বব্যাপী বস্তু আছে, বৈদিক ধর্মের অর্থাৎ উপনিষদের এই সিদ্ধান্ত বুদ্ধ স্বীকার করিতেন না । এই দুই ধর্মের মধ্যে ইহাই শুরুতর প্রভেদ । গৌতম বুদ্ধ স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, আত্মা বা ব্ৰহ্ম বস্তুত কিছু নাই - কেবল ভ্রম; তাই আত্মানাত্মবিচারে বা ব্ৰহ্মচিন্তনের গোলযোগে পড়িয়া বৃথা সময় নষ্ট করা কাহারও উচিত নহে [সব্বাসবসুত্ত|৯-১৩ দেখ] । আত্মার সম্বন্ধে কোন প্রকার কল্পনাই বুদ্ধের মান্য ছিল না,ইহা দীঘ্‌ঘনিকায়ের অন্তর্গত ব্ৰহ্মজালসুত্ত হইতেও স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । (ব্ৰহ্মজালসুত্তের ভাষান্তর ইংরাজীতে হয় নাই, কিন্তু তাহার সংক্ষিপ্ত সার রিজ্‌-ডেভিড্‌স্‌ S. B. E. Vol XXVI Intro, pp, xxiii-xxv-এ দিয়াছেন – তাহা দেখ ।)

এই সকল সুত্তে প্ৰথমে বলা হইয়াছে যে, আত্মা ও ব্ৰহ্ম এক কি দুই; আবার এই প্ৰকার ভেদই বলিবার সময় আত্মার ৬২ প্রকার বিভিন্ন কল্পনার কথা বলিয়া বলা হইয়াছে যে, এই সমস্তই মিথ্যা ‘দৃষ্টি’; এবং মিলিন্দ-প্রশ্নেও বৌদ্ধধর্মানুসারে “আত্মা বলিয়া কোন যথার্থ বস্তু নাই” এইরূপ নাগসেন গ্ৰীক মিলিন্দকে (Minander) স্পষ্ট বলিয়াছেন [মি|প্র|২|৩|৬ ও ২|৭|১৫] । আত্মা ও তদ্বৎ ব্ৰহ্ম দুইই ভ্ৰম, সত্য নহে, এইরূপ স্বীকার করিলে তো ধর্মের ভিত্তিই ধসিয়া যায় । কারণ, তাহলে তো সমস্ত অনিত্য বস্তুই অবশিষ্ট থাকে, এবং নিত্য সুখ বা সেই সুখের ভোক্তাও কেহ থাকে না; এবং এই কারণেই তৰ্কদৃষ্টিতে এই মত শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য অগ্ৰাহ্য করিয়াছেন ।


4.1) প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি ? চারি আৰ্যসত্য :


কিন্তু এখন আমাকে কেবল ইহাই দেখিতে হইবে যে, প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি, এইজন্য এই তর্ক এখানেই ছাড়িয়া দেখিব যে, বুদ্ধ স্বকীয় ধর্মের কি উপপত্তি বলিয়াছেন । আত্মার অস্তিত্ব বুদ্ধের মান্য না হইলেও, 
(১) কর্ম-বিপাক নিবন্ধন নামরূপাত্মক দেহকে (আত্মাকে নহে) নশ্বর জগতের প্রপঞ্চে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করিতে হয়, এবং 
(২) পুনর্জন্মের এই চক্র বা সমস্ত সংসারই দুঃখময়, এই দুই বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ একমত ছিলেন; ইহা হইতে মুক্তি লাভ করিয়া চিরন্তন শান্তি বা সুখ অর্জন করা অত্যাবশ্যক । এই প্ৰকার সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব এবং তন্নিবারণের আবশ্যকতা, এই দুই বিষয় স্বীকার করিলে বৈদিক ধর্মের এই প্রশ্নটি সমান থাকিয়া যায় যে, দুঃখ নিবারণ করিয়া অত্যন্ত সুখলাভের পন্থাটি কি; এবং উহার কোন-না-কোন সন্তোষজনক ঠিক্‌ ঠিক্‌ উত্তর দেওয়া আবশ্যক হয় । উপনিষৎকারেরা বলিয়াছেন যে, যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা ভবচক্র হইতে মুক্তি লাভ করা যায় না এবং বুদ্ধ আরও একটু বেশী অগ্রসর হইয়া এই সমস্ত কর্মকে হিংসাত্মক সুতরাং সর্বথা ত্যাজ্য ও নিষিদ্ধ বলিয়াছেন । সেইরূপ স্বয়ং ‘ব্ৰহ্মকেই’ এক মহা ভ্ৰম বলিয়া মনে করিলে, দুঃখনিবারণার্থ ব্ৰহ্মজ্ঞানের মাৰ্গকেও ভ্ৰান্তিমূলক ও অসম্ভব বলিয়া স্থির করিতে হয় । তাহা হইলে দুঃখময় ভবচক্র হইতে মুক্তিলাভের মার্গটি কি ? বুদ্ধ ইহার উত্তর দিয়াছেন যে, কোন রোগ দূর করিতে হইলে সেই রোগের মূল কি তাহা স্থির করিয়া সেই মূল কারণকেই উন্মূলিত করিবার জন্য সৎবৈদ্য যেরূপ চেষ্টা করিয়া থাকেন, সেইরূপ সাংসারিক দুঃখের রোগ দূর করিবার জন্য 
(৩) উহার কারণ অবগত হইয়া 
(৪) সেই কারণকেই দূর করিবার মার্গ বুদ্ধিমান ব্যক্তির অবলম্বন করা উচিত ।

এই কারণ-সমূহের বিচার করিলে দেখা যায় যে, তৃষ্ণা বা বাসনাই এই জগতের সমস্ত দুঃখের মূল; এবং এক, নাম-রূপাত্মক দেহের নাশ হইলে, অবশিষ্ট এই বাসনাত্মক বীজ হইতেই অন্যান্য নাম রূপাত্মক দেহ পুনঃপুনঃ উৎপন্ন হইয়া থাকে । এবং তাহার পর বুদ্ধ স্থির করিয়াছেন যে, পুনর্জন্মের দুঃখময় সংসার হইতে মুক্তি লাভ করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ, ধ্যান ও বৈরাগ্যের দ্বারা তৃষ্ণার সম্পূর্ণ ক্ষয় করিয়া সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু হওয়াই এক প্ৰকৃত মাৰ্গ, এবং এই বৈরাগ্যযুক্ত সন্ন্যাস হইতেই চিরন্তন শান্তি ও নিত্য সুখ লাভ করা যায় । তাৎপৰ্য এই যে, যাগযজ্ঞাদির এবং আত্মানাত্মবিচারের গোলযোগে না পড়িয়া, নিম্নোক্ত চারি প্রত্যক্ষ বিষয়ের উপরেই বৌদ্ধধর্ম খাড়া করা হইয়াছে - সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব, তাহার কারণ, তাহার নিরোধ বা নিবারণ করিবার আবশ্যকতা, এবং উহা সমূলে বিনষ্ট করিবার জন্য বৈরাগ্যরূপ সাধন; কিংবা বৌদ্ধ পরিভাষা অনুসারে অনুক্ৰমে দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ ও মার্গ । নিজ ধর্মের এই চারি মূলতত্ত্বকেই বুদ্ধ ‘আৰ্যসত্য’ নাম দিয়াছেন । উপনিষদের আত্মজ্ঞানের বদলে চারি আৰ্যসত্যের প্রত্যক্ষ ভিত্তির উপর এই প্রকারে বৌদ্ধধর্মকে দাঁড় করাইলেও নিত্য শান্তি বা সুখ লাভ করিবার জন্য তৃষ্ণা কিংবা বাসনার ক্ষয় করিয়া মনকে নিষ্কাম করিবার যে মাৰ্গ বুদ্ধের উপদিষ্ট সেই মার্গ (চতুর্থ সত্য), এবং মোক্ষলাভের জন্য উপনিষদের বর্ণিত মার্গ - এই দুই মাৰ্গ বস্তুত একই হওয়ায়, দুই ধর্মের চরম দৃশ্যসাধ্য মনের নির্বিষয় অবস্থাই, ইহা স্পষ্ট দেখা যায় । কিন্তু এই দুই ধর্মের মধ্যে প্ৰভেদ এই যে, ব্ৰহ্ম ও আত্মাকে যাঁহারা এক বলিয়া মানেন সেই উপনিষৎকারেরা মনের এই নিষ্কাম অবস্থাকে ‘আত্মনিষ্টা’, ‘ব্রহ্মসংস্থা’, ‘ব্ৰহ্মভূততা’, ‘ব্রহ্মনিৰ্বাণ’ [গী|৫|১৭-২৫; ছাং|২|২৩|১], অর্থাৎ ব্রহ্মেতে আত্মার লয় হওয়া, ইত্যাদি চরম আধারসূচক নাম দিয়াছেন, এবং বুদ্ধ উহাকে কেবল ‘নির্বাণ’ অর্থাৎ “বিরাম পাওয়া বা প্রদীপ নিভিবার ন্যায় বাসনার নাশ হওয়া” এই ক্রিয়াপ্রদর্শক নাম দিয়াছেন । কারণ, ব্ৰহ্ম বা আত্মা ভ্ৰম, ইহা বলিবার পর এই প্ৰশ্নই আর থাকে না যে, “বিরাম কে পায়, ও কেমন করিয়া পায়” [সুত্তনিপাতে রতনসুত্ত|১৪ ও বঙ্গীসসুত্ত|১২ ও ১৩ দেখ]; এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তির এই গুঢ় প্রশ্নের বিচারও করা উচিত নহে, ইহা বুদ্ধ স্পষ্ট বলিয়াছেন [সব্বাসবসুক্ত|৯-১৩ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৪|২|৪ ও ৫ দেখ] । এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে আর পুনর্জন্ম হয় না, এই জন্য এক দেহের নাশ হইয়া অন্য দেহ প্ৰাপ্ত হইবার সাধারণ ক্রিয়া সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত ‘মরণ’ শব্দের উপযোগ বৌদ্ধধর্মের অনুসারে ‘নির্বাণ’ সম্বন্ধে করিতেও পারা যায় না । নির্বাণ তো ‘মরণের মরণ’ কিংবা উপনিষদের বর্ণনা অনুসারে “মৃত্যু পার হইবার পথ” - শুধু মরণ নহে । সাপ যেরূপ আপন নির্মোক পরিত্যাগ করিতে ভয় পায় না, সেইরূপ এই অবস্থায় উপনীত মনুষ্য নিজের শরীরের জন্য ভাবে না, বৃহদারণ্যক-উপনিষদে [৪|৪|৭] এই যে দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে, তাহাই প্রকৃত বৌদ্ধভিক্ষুর বর্ণনা করিবার সময় সুত্তনিপাতের অন্তৰ্গত উরগসুত্তের প্রত্যেক শ্লোকে গৃহীত হইয়াছে । “আত্মনিষ্ঠ ব্যক্তি পাপপুণ্যে সর্বদাই অলিপ্ত থাকায় [বৃ|৪|৪|২৩] মাতৃবধ কিংবা পিতৃবধের সদৃশ পাতকেরও দোষ তাহাকে স্পর্শ করে না”, বৈদিক ধর্মের এই তত্ত্ব [কৌষী|ব্রা|৩|১] ধম্মপদে শব্দশঃ যেমনটি-তেমনি বলা হইরাছে [ধম্ম|২৯৪ ও ২৯৫ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৪|৫|৭ দেখ]


4.2) সার কথা


ব্ৰহ্ম ও আত্মার অস্তিত্ব বুদ্ধ স্বীকার না করিলেও মনকে শান্ত, বিরক্ত ও নিষ্কাম করা প্রভৃতি মোক্ষলাভের যে সকল সাধন উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে, সেই সকল সাধনই বুদ্ধের মতে নির্বাণলাভের পক্ষেও আবশ্যক, এই জন্য বৌদ্ধ যতি ও বৈদিক সন্ন্যাসীর বৰ্ণনা মানসিক অবস্থার দৃষ্টিতে একই রকমের; এবং সেই কারণেই পাপপুণ্যের দায়িত্ব সম্বন্ধে, এবং জন্ম-মরণের চক্ৰ হইতে মুক্তিলাভ বিষয়ে বৈদিক সন্ন্যাসধর্মের সিদ্ধান্তই বৌদ্ধধর্মেও বজায় রাখা হইয়াছে । কিন্তু বৈদিক ধর্ম গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী হওয়ায়, এই বিচার আসলে যে বৈদিক ধর্মেরই সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই ।


5) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - গাৰ্হস্থ্যমার্গের বিচার



বৈদিক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসধর্মের ভেদাভেদ কি, তাহা বলিয়াছি । এক্ষণে গাৰ্হস্থ্যধর্ম সম্বন্ধে বুদ্ধ কি বলিয়াছেন তাহা দেখা যাক । আত্মানাত্মবিচারের তত্ত্ব জ্ঞানকে প্রাধান্য না দিয়া সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব প্রভৃতি দৃশ্য ভিত্তির উপরেই বৌদ্ধধর্মকে খাড়া করা হইলেও, মনে থাকে যেন, কোঁতের ন্যায় আধুনিক পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের নিছক আধিভৌতিক ধর্মের সদৃশ - কিংবা গীতাধর্মেরও মত - বৌদ্ধধর্ম মূলে প্ৰবৃত্তিমূলক নহে । ইহা সত্য যে, উপনিষদের আত্মজ্ঞানের তাত্ত্বিক ‘দৃষ্টি’ বুদ্ধের মান্য নহে, কিন্তু “সংসার সম্পূর্ণ ত্যাগ করিয়া মনকে নির্বিষয় ও নিষ্কাম করাই এই জগতে মনুষ্যের একমাত্র পরম কর্তব্য”, বৃহদারণ্যক উপনিষদে বর্ণিত যাজ্ঞবল্ক্যের এই সিদ্ধান্ত [বৃ|৪|৪|৬] বৌদ্ধধর্মে সম্পূর্ণরূপে বজায় রাখা হইয়াছে । এই জন্য বৌদ্ধধর্ম মূলে কেবল সন্ন্যাসপ্ৰধান হইয়াছে । সংসারকে ত্যাগ না করিয়া, কেবল গৃহস্থাশ্রমেই থাকিলে, পরম সুখ ও অৰ্হতাবস্থা লাভ করা কখনই সম্ভব নহে, ইহাই বুদ্ধের সমস্ত উপদেশের তাৎপৰ্য হইলেও ইহা বুঝিতে হইবে না যে, উহাতে গাৰ্হস্থ্যবৃত্তির কিছুমাত্র বিচারই নাই । ভিক্ষু না হইয়া, বুদ্ধ, বুদ্ধের ধর্ম ও বৌদ্ধভিক্ষুদিগের সংঘ বা মণ্ডলী - এই তিনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধৰ্ম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি”, এই সংকল্প উচ্চারণের দ্বারা যাহারা ঐ তিনের শরণাপন্ন হয়, বৌদ্ধগ্রন্থে তাহাদিগকে ‘উপাসক’ বলা হয় । ইহারাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী গৃহস্থ ।” এই উপাসকেরা স্বকীয় গাৰ্হস্থ্যবৃত্তি কিরূপে নিৰ্বাহ করিবে তৎসম্বন্ধে বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্বয়ং বুদ্ধ কোন কোন স্থানে উপদেশ করিয়াছেন [মহাপরিনিব্বাণসুত্ত|১|২৪] । বৈদিক গাৰ্হস্থ্যধর্মের মধ্যে হিংসাত্মক শ্রৌত যাগযজ্ঞ ও চাতুর্বর্ণ্যভেদ বুদ্ধ স্বীকার করিতেন না । এই বিষয়গুলি ছাড়িয়া দিলে, স্মার্ত্ত পঞ্চ মহাযজ্ঞ, দানাদি পরোপকারধর্ম ও নৈতিক আচরণ করাই গৃহস্থের কর্তব্য থাকিয়া যায়; এবং গৃহস্থ ধর্ম বর্ণনা করিবার সময় বৌদ্ধধর্মগ্রন্থে কেবল এই সকল বিষয়েরই উল্লেখ করা হয় । পঞ্চমহাযজ্ঞ প্রত্যেক গৃহস্থ অর্থাৎ উপাসকের অনুষ্ঠান করিতেই হইবে, ইহা বুদ্ধের মত । তিনি স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, সর্বভুতে দয়া ও (আত্মা স্বীকৃত না হইলেও) আত্মৌপম্যদৃষ্টি, শৌচ বা মনের পবিত্রতা, এবং বিশেষ করিয়া সৎপাত্রে অর্থাৎ বৌদ্ধ-ভিক্ষুকে এবং বৌদ্ধ-ভিক্ষু-সংঘকে অন্নবস্ত্ৰাদি দান করা প্ৰভৃতি নীতিধর্মের পালন বৌদ্ধ উপাসককে করিতে হইবে । বৌদ্ধধর্মে ইহাকেই ‘শীল’ বলে; এবং উভয়ের তুলনা করিলে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, পঞ্চমহাযজ্ঞের ন্যায় এই নীতিধর্মও ব্রাহ্মণধর্মের ধর্মসূত্র এবং প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থ [মনু|৬৯২ ও ১০, ৬৩ দেখ] হইতে বুদ্ধ গ্ৰহণ করিয়াছেন (See Dr. Kern's “Manual of Buddhism”, Grundriss III, 8; p.68.) । অধিক কি, স্বয়ং বুদ্ধ এই আচরণ বিষয়ে প্ৰাচীন ব্ৰাহ্মণ-ধম্মিকসুত্তে প্ৰাচীন ব্ৰাহ্মণদিগের স্তুতি করিয়াছেন; এবং মনুস্মৃতির কতক শ্লোক তো ধম্মপদে অক্ষরশ পাওয়া যায় [মনু|২|১২১ ও ৫|৪৫ এবং ধম্মপদ|১০৯ ও ১৩১ দেখ] । বৈদিকগ্ৰন্থ হইতে বৌদ্ধধর্মে কেবল পঞ্চমহাযজ্ঞ ও নীতিধর্মই লওয়া হইয়াছে তাহা নহে, কিন্তু গৃহস্থাশ্রমে সম্পূৰ্ণ মোক্ষলাভ কখনও হয় না, বৈদিকধর্মে পূর্বে কোন কোন উপনিষৎকার কর্তৃক প্রতিপাদিত এই মতও বুদ্ধ স্বীকার করিয়াছেন । উদাহরণ যথা – সুত্তনিপাতের ধম্মিকসুত্তে ভিক্ষুর সঙ্গে উপাসকের তুলনা করিয়া বুদ্ধ স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, উত্তম শীলের দ্বারা গৃহস্থ বড় জোর ‘স্বয়ংপ্রকাশ’ দেবলোক প্ৰাপ্ত হইবে, কিন্তু জন্মমরণের চক্ৰ হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভের জন্য সংসার ও পুত্ৰকলত্ৰাদি ত্যাগ করিয়া শেষে উহাকে ভিক্ষু-ধর্মই স্বীকার করিতে হইবে [ধম্মিক সুত্ত|১৭|২৯; ও বৃ|৪|৪|৬ ও মভা|বন|২|৬৩ দেখ] । তেবিজ্জসুত্তে বৰ্ণিত হইয়াছে [তে|সু|১|৩৫; ৩|৫] যে, কর্মমাৰ্গীয় বৈদিক ব্ৰাহ্মণদিগের সহিত তর্ক করিবার সময় নিজের উক্ত সন্ন্যাসপ্রধান মত সিদ্ধ করিবার জন্য বুদ্ধ “তোমার ব্ৰহ্মের যদি স্ত্রীপুত্র ও ক্ৰোধ-লোভ নাই, তবে স্ত্রী-পুত্রের মধ্যে থাকিয়া ও যাগযজ্ঞাদি কাম্য কর্ম করিয়া তোমাদের ব্ৰহ্মপ্ৰাপ্তি কিরূপে হইবে” এই প্ৰকার যুক্তিবাদ করিতেন । এবং এই কথাও প্ৰসিদ্ধ আছে যে, স্বয়ং বুদ্ধ যৌবনকালেই নিজের স্ত্ৰীপুত্র ও রাজ্য ত্যাগ করিয়া ভিক্ষুধর্ম অঙ্গীকার করিবার ছয় বৎসর পরে তিনি বুদ্ধাবস্থা প্ৰাপ্ত হন । বুদ্ধের সমকালীন, কিন্তু তাঁহার পূর্বেই সমাধিপ্রাপ্ত, মহাবীর নামক শেষ জৈন তীর্থঙ্করেরও উপদেশ এইরূপই । কিন্তু তিনি বুদ্ধের ন্যায় অনাত্মবাদী ছিলেন না; এবং এই দুই ধর্মের মধ্যে গুরুতর, প্ৰভেদ এই যে, বস্ত্ৰপ্ৰাবরণাদি ঐহিক সুখত্যাগ এবং অহিংসা ব্ৰত প্ৰভৃতি ধর্মপালন জৈন যতি বৌদ্ধভিক্ষু অপেক্ষা অধিক কড়াকড়িভাবে পালন করিতেন; এবং অদ্যাপি পালন করিয়া থাকেন । আহারেরই জন্য ইচ্ছাপূর্বক মারা হয় নাই এইরূপ প্ৰাণীদিগের ‘পবত্ত’ (সং, প্ৰবৃত্ত) অর্থাৎ ‘তৈয়ারী মাংস’ (হাতী, সিংহ প্ৰভৃতি কোন কোন প্ৰাণীকে বর্জন করিয়া) বুদ্ধ স্বয়ং খাইতেন এবং ‘পবত্ত’ মাংস ও মৎস্য বৌদ্ধভিক্ষুদিগকেও তিনি খাইতে অনুমতি দিয়াছেন; এবং বস্ত্ৰ ব্যতীত নগ্ন হইয়া ভ্ৰমণ করা বৌদ্ধভিক্ষুধর্মের নিয়মানুসারে দোষ [মহাবগ্‌গ|৬|৩১|১৪ ও ৮|২৮|১] । সারকথা, অনাত্মবাদী ভিক্ষু হও, ইহা বুদ্ধের নিশ্চিত উপদেশ হইলেও, কায়ক্লেশময় উগ্র তপ সম্বন্ধে বুদ্ধের অভিমত ছিল না [মহাবগ্‌গ|৫|১|১৬ ও গী|৬|১৬]; বৌদ্ধভিক্ষুদিগের বিহারের অর্থাৎ তাহাদের থাকিবার মঠের সমস্ত ব্যবস্থাও এরূপ রাখা হইত যাহাতে শরীরের বেশী কষ্ট না হয় এবং প্ৰাণায়ামাদি যোগাভ্যাস সহজে হইতে পারে । তথাপি অৰ্হতাবস্থা বা নিৰ্বাণসুখ প্ৰাপ্তির জন্য গৃহস্থাশ্রম ছাড়িতেই হইবে, এই তত্ত্ব বৌদ্ধধর্মে পুরাপুরি বজায় থাকায় বৌদ্ধধর্ম যে সন্ন্যাসপ্রধান, ইহা বলিতে কোন প্ৰত্যবায় নাই ।


6) গীতার প্রাচীনত্ব প্রমাণে শ্লোকসাদৃশ্যই যথেষ্ট নয়


ব্ৰহ্মজ্ঞান ও আত্মানাত্ম-বিচার ভ্ৰমের একটা বড় জালমাত্ৰ, ইহাই যদিও বুদ্ধের স্থির মত ছিল, তথাপি এই প্ৰত্যক্ষ কারণের জন্য অর্থাৎ দুঃখময় সংসারচক্র হইতে মুক্ত হইয়া নিরন্তর শান্তি ও সুখ লাভ করিবার জন্য উপনিষদে বর্ণিত সন্ন্যাসমার্গীদিগের সাধন - বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে নিৰ্বিষয় করা - তাঁহার স্বীকৃত হইয়াছিল । এবং চাতুর্বর্ণ্যভেদ ও হিংসাত্মক যাগযজ্ঞ ত্যাগ করিয়া বৌদ্ধধর্মে বৈদিক গাৰ্হস্থ্যধর্মের নীতিনিয়মই অল্প হেরফেরে গৃহীত হইয়াছে, ইহা যখন সিদ্ধ হইল, তখন যদি উপনিষদ ও মনুস্মৃতি ইত্যাদি গ্রন্থে বৈদিক সন্ন্যাসীদিগের যে বৰ্ণনা আছে তাহা, এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বা অৰ্হৎদিগের বর্ণনা অথবা অহিংসাদি নীতিধর্ম, দুই ধর্মে একই সমান - কখন কখন শব্দশও একই - দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কিছু আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, এই সমস্ত কথা মূল বৈদিক ধর্মেরই । কিন্তু কেবল এই বিষয়গুলিই বৌদ্ধেরা বৈদিকধর্ম হইতে গ্ৰহণ করে নাই, প্ৰত্যুত দশরথজাতকের মত বৌদ্ধধর্মের জাতকগ্ৰন্থও প্রাচীন বৈদিক পুরাণ-ইতিহাসকথার বৌদ্ধধর্মানুকুল করিয়া রচিত রূপান্তরমাত্র । শুধু বৌদ্ধেরা কেন, জৈনেরাও স্বকীয় অভিনব পুরাণসমূহে বৈদিক কথা-সকলের এইরূপ রূপান্তর করিয়াছে । খৃষ্টের পর আবির্ভূত মহম্মদীয় ধর্মে খৃষ্টচরিত্রের এইরূপ এক বিপৰ্যয় করা হইয়াছে, ইহা সেল সাহেব লিখিয়াছেন (See Sale's Koran “To the Reader” (Preface) p. x and the Preliminary Discourse, Sec, IV, p.58; Chandos Classics Ed.). আধুনিক গবেষণা হইতে সিদ্ধ হইয়াছে যে, বাইবেলের পুরাতন অঙ্গীকারের অন্তৰ্গত সৃষ্টির উৎপত্তি, প্ৰলয় ও নোয়া প্রভৃতির কথা, প্রাচীন খাল্‌দীয় জাতির ধর্মকথার এইরূপ রূপান্তর করিয়া ইহুদীরা বর্ণনা করিয়াছে । উপনিষৎ, প্ৰাচীন ধর্মসূত্র ও মনুস্মৃতিতে বর্ণিত কথা কিংবা বিচার যখন বৌদ্ধগ্রন্থে এইরূপ – অনেক সময় একেবারে শব্দশ – গৃহীত হইয়াছে, তখন সহজেই এই অনুমান হয় যে, ইহা আসলে মহাভারতেরই । বৌদ্ধগ্রন্থকারেরা এই সকল উহা হইতেই উদ্ধৃত করিয়া থাকিবেন । বৈদিক ধর্মগ্রন্থের যে ভাব ও শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহার কয়েকটি উদাহরণ প্রদত্ত হইল — “জয়ের দ্বারা বৈরতা বৃদ্ধি হয়; এবং বৈরতা দ্বারা বৈরতার উপশম হয় না” [মভা|উদ্যো|৭১|৫৯ ও ৬৩] “অন্যের ক্রোধকে শান্তির দ্বারা জয় করিবে” ইত্যাদি বিদুরনীতির উপদেশ [মভা|উদ্যো|৩৮|৭৯], এবং জনকের এই উক্তি - “আমার এক বাহু চন্দনে চর্চিত করা ও অন্য বাহু কাটিয়া ফেলা আমার নিকট উভয়ই সমান” [মভা|শাং|৩২০|৩৬]; ইহার অতিরিক্ত মহাভারতের আরও অনেক শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে শব্দশ পাওয়া যায় [ধম্মপদ|৫ ও ২২৩ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৭|৩|৫] । ইহা নিঃসন্দেহ যে, উপনিষৎ, ব্রহ্মসূত্র ও মনুস্মৃতি প্রভৃতি বৈদিক গ্রন্থ বুদ্ধাপেক্ষা প্রাচীন, তাই উহাদের যে সকল শ্লোক বা বিচার বৌদ্ধগ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহাদের বিষয়ে নিঃসংশয়ে বলিতে পারা যায় যে, বৌদ্ধগ্রন্থকারেরা সেগুলি উক্ত বৈদিক গ্ৰন্থ হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন । কিন্তু এই কথা মহাভারতের বিষয়ে বলিতে পারা যায় না । মহাভারতেই বৌদ্ধ ‘ডাগোবাদিগের’ যে উল্লেখ আছে, তাহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মহাভারতের শেষ সংস্করণ বুদ্ধের পরে হইয়াছে । অতএব কেবল শ্লোকসাদৃশ্য হইতে স্থির সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে না যে, বর্তমান মহাভারত বৌদ্ধগ্রন্থের পূর্ববর্তীই, এবং গীতা মহাভারতেরই এক অংশ হওয়ায় ঐ ন্যায়ই গীতাসম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হইতে পারে । তাছাড়া, গীতাতেই ব্ৰহ্মসূত্রের উল্লেখ আছে এবং ব্ৰহ্মসূত্রে বৌদ্ধমতের খণ্ডন আছে, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । অতএব স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা প্ৰভৃতি সম্বন্ধে (বৈদিক ও বৌদ্ধ) উভয়ের সাদৃশ্য ছাড়িয়া দিয়া এখানে বিচার করিব যে, উক্ত সংশয় দূর করিবার এবং গীতাকে নির্বিবাদরূপে বৌদ্ধগ্রন্থ হইতে প্রাচীন প্রমাণিত করিবার জন্য বৌদ্ধগ্রন্থে অন্য কোন উপকরণ পাওয়া যায় কি না ।


7) বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপের পরিবর্তন


বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপ নিছক নিরাত্মবাদী ও নিবৃত্তিমূলক, ইহা উপরে বলা হইয়াছে । কিন্তু উহার এই স্বরূপ বেশী দিন টিকে নাই । ভিক্ষুদিগের আচার সম্বন্ধে মতভেদ ঘটিল এবং বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাহার মধ্যে কেবল অনেক উপপন্থাই গঠিত হইতে আরম্ভ হয় নাই, কিন্তু ধর্মতত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধেও এইরূপ মতভেদ উৎপন্ন হইল । আজকাল কেহ কেহ এই তর্কও করিতে আরম্ভ করিয়াছেন যে, ‘আত্মা নাই’ এই উক্তি দ্বারা এই কথা বলাই বুদ্ধের মনোগত অভিপ্ৰায় যে, “অচিন্ত্য আত্মজ্ঞানের শুষ্ক তর্কের মধ্যে না গিয়া বৈরাগ্য ও অভ্যাসের দ্বারা মনকে নিষ্কাম করিতে প্ৰথমে চেষ্টা কর, আত্মা থাক্‌ বা নাই থাক্‌; মনোনিগ্রহের কাজই মুখ্য এবং তাহা সিদ্ধ করিবার চেষ্টা প্ৰথমে করা আবশ্যক”; ব্ৰহ্ম বা আত্মার আদৌ অস্তিত্ব নাই এরূপ বলা তাহার অভিপ্ৰায় নহে । কারণ, তেবিজ্জসুত্তে স্বয়ং বুদ্ধ ‘ব্রহ্মসব্যতায়’ অবস্থার উল্লেখ করিয়াছেন এবং সেলসুত্তে ও থের-গাথাতে “আমি ব্ৰহ্মভুত” এইরূপ তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন [সেলসু|১৪; থেরগা|৮৩১ দেখ]  । কিন্তু মূল কারণ যাহাই হৌক, ইহা নির্বিবাদ যে, এই প্রকার নানাবিধ মত, তর্ক ও উৎসাহী পন্থা তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে রচিত হইয়া প্রচার করিতেছিল যে, “আত্মা বা ব্ৰহ্মের মধ্যে কোন নিত্য বস্তুই জগতের মূলে নাই, যাহা কিছু দেখা যায় তাহা ক্ষণিক বা শূন্য” অথবা “যাহা কিছু দেখা যায় তাহা জ্ঞান, জ্ঞান-ছাড়া জগতে কিছুই নাই” ইত্যাদি [বেসূ|শাং ভা|২|২|১৮-২৬ দেখ] । এই নিরীশ্বর ও অনাত্মবাদী বৌদ্ধ মতকেই ক্ষণিকবাদ, শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ বলা হয় । এই সমস্ত পন্থার এখানে বিচার করিবার কোন প্ৰয়োজন নাই । আমাদের প্রশ্ন ঐতিহাসিক । তাই, উহার মীমাংসা পক্ষে ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা যতটুকু আবশ্যক তাহাই এখানে করা হইতেছে । 


7.1) ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা


বুদ্ধের মূল উপদেশে আত্মা বা ব্ৰহ্মের (অর্থাৎ পরমাত্মা বা পরমেশ্বরের) অস্তিত্বই অস্বীকৃত কিংবা গৌণ বলিয়া স্বীকৃত হওয়ায় স্বয়ং বুদ্ধের জীবদ্দশায় ভক্তি দ্বারা পরমেশ্বরকে লাভ করিবার মার্গের উপদেশ করা সম্ভব ছিল না; এবং তাঁহার ভব্য মূর্তি ও চরিত্র লোকদিগের চক্ষের সম্মুখে যে পৰ্যন্ত প্ৰত্যক্ষ ছিল সে পৰ্যন্ত এই মার্গের কোন আবশ্যকতাই ছিল না । কিন্তু পরে ইহা আবশ্যক হইল যে, এই ধর্ম সাধারণ লোকের প্রিয় হউক এবং ইহার আরও বেশী প্রচারও হউক । অতএব সংসার ত্যাগ করিয়া ও ভিক্ষু হইয়া মনোনিগ্রহের দ্বারা স্বস্থানে থাকিয়াই নিৰ্বাণ লাভ করিবার - কিসে তাহা না বুঝিয়া - এই নিরীশ্বর নিবৃত্তিমাৰ্গ অপেক্ষা কোন সহজ ও প্ৰত্যক্ষ-মার্গের প্রয়োজন হইল । খুব সম্ভব যে, সাধারণ বুদ্ধভক্তেরা তৎকালে প্ৰচলিত বৈদিক ভক্তিমার্গের অনুকরণ করিয়া, আপনারাই বুদ্ধের উপাসনা প্ৰথম প্ৰথম আরম্ভ করিয়া থাকিবে । অতএব বুদ্ধের নির্বাণের পর শীঘ্রই বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা বুদ্ধকেই “স্বয়ম্ভূ ও অনাদ্যনন্ত পুরুষোত্তমের” রূপ প্ৰদান করেন; এবং তাঁহারা বলিতে লাগিলেন যে, বুদ্ধের নির্বাণ পাওয়াও বুদ্ধেরই লীলা; “প্রকৃত বুদ্ধের কখনও বিনাশ হয় না - তাঁহার অস্তিত্ব চিরস্থায়ী” । সেইরূপ আবার, বৌদ্ধগ্রন্থে প্ৰতিপাদিত হইতে লাগিল যে, প্রকৃত বুদ্ধ “সর্বজগতের পিতা এবং লোকেরা তাঁহারই সন্তান” অতএব তিনি সকলের প্রতিই “সমদৃষ্টি, কাহাকেও তিনি প্রীতি করেন না, কাহাকেও তিনি দ্বেষও করেন না”, “ধর্মের ব্যবস্থা বিগ্‌ড়াইয়া গেলে তিনি ‘ধর্ম কার্যের’ জন্যই সময়ে সময়ে বুদ্ধের রূপে প্ৰকট হইয়া থাকেন”, এবং এই দেবাদিদেব বুদ্ধের প্রতি “ভক্তি করিলে, তাঁহার গ্রন্থের পুজা করিলে এবং তাঁহার ডাগোবার সম্মুখে কীর্তন করিলে” অথবা “তাঁকে ভক্তি-পূর্বক দুই-চারি কমল বা একটী ফুল দিলেই” মনুষ্য সদ্‌গতিলাভ করে [সদ্ধর্মপুণ্ডরীক|২|৭৭-৯৮; ৫|২২; ১৫|৫-২২ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৩|৭|৭ দেখ](সদ্ধর্মপুণ্ডরীক গ্রন্থের প্রাচ্যধর্মপুস্তকমালার ২১ খণ্ডে ভাষান্তর হইয়াছে । এই গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত । এক্ষণে মূল সংস্কৃত ভাষার গ্ৰন্থও ছাপা হইয়াছে ।) মিলিন্দপ্রশ্নে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, “মনুষ্যের সমস্ত জীবিতকাল দুরাচরণে অতিবাহিত হইলেও মৃত্যুসময়ে যদি সে বুদ্ধের শরণ লয়, তাহা হইলে তাহার স্বৰ্গলাভ না হইয়া যায় না” [মি|প্র|৩|৭|২]; এবং  সদ্ধর্মপুণ্ডরীকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে সবিস্তার বর্ণিত হইয়াছে যে, সমস্ত লোকের “অধিকার, স্বভাব ও জ্ঞান একই প্ৰকার না হওয়ায়, অনাত্মপর নিবৃত্তিপ্রধান মাৰ্গ ব্যতীত ভক্তির এই মাৰ্গ (যান) বুদ্ধই কৃপা করিয়া স্বকীয় ‘উপায়কুশলতা দ্বারা’ নির্মাণ করিয়াছেন” । নিৰ্বাণাবস্থা প্ৰাপ্তির জন্য ভিক্ষুধর্মকেই স্বীকার করিতে হইবে, বুদ্ধ স্বয়ং এই যে ধর্মতত্ত্ব উপদেশ করিয়াছেন, ইহা একেবারে ছাড়িয়া দেওয়া সম্ভব ছিল না; কারণ, তাহা করিলে বুদ্ধের মূল উপদেশেই হরতাল লাগানো হইত । কিন্তু ইহা বলা কিছু অনুচিত ছিল না যে, ভিক্ষু হইল তো কি হইল, অরণ্যে ‘গণ্ডারের’ মত একাকী ও উদাসীনভাবে না থাকিয়া ধর্মপ্রচারাদি লোকহিতকর ও পরোপকার-কার্য ‘নিরিস্‌সিত’ বুদ্ধিতে করাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কর্তব্য; এই মতই মহাযান পন্থার সদ্ধর্মপুণ্ডরীকাদি গ্রন্থে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে (সুত্ত-নিপাতে খগ্‌গ-বিসাণসুত্তের ৪১ শ্লোকের ধ্রুবপদ “একো চরে খগ্‌গবিসাণ কপ্পো” এইরূপ আছে । খগ্‌গবিসাণ অর্থাৎ গণ্ডার, এবং উহারই ন্যায় বৌদ্ধ ভিক্ষুর বনে একাকী বাস করিতে হয়, উহার এই অর্থ ।) । এবং নাগসেন মিলিন্দিকে বলিয়াছেন যে, “গৃহস্থাশ্ৰম নিৰ্বাহ করিয়া নিৰ্বাণপদ লাভ করা একেবারেই অসম্ভব নহে, - এবং ইহার অনেক উদাহরণও আছে ।” [মি|প্ৰ|৬|২|৪] । ইহা যে-কোন-লোকের সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, এই বিচার অনাত্মবাদী ও নিছক্‌ সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্মের নহে, অথবা শূন্যবাদ বা বিজ্ঞানবাদ স্বীকার করিয়াও ইহার উপপত্তি জানা যায় না; এবং প্রথম প্রথম অধিকাংশ বৌদ্ধধর্মীর নিজেদেরই মনে হইত যে এই বিচার বুদ্ধের মূল উপদেশের বিরুদ্ধ । কিন্তু আবার এই নূতন মতটিই স্বভাবত অধিকাধিক লোকপ্রিয় হইতে লাগিল; এবং বুদ্ধের মূল উপদেশ অনুসারে যাহারা চলিত তাহাদেব নাম হইল “হীনযান” (হাল্কা মাৰ্গ) এবং এই নূতন পন্থার নাম হইল ‘মহাযান’ (বড় মার্গ) । 
(হীনযান ও মহাযান এই দুই পন্থায় ভেদ-বৰ্ণনা-কালে ডাঃ কেৰ্ণ বলেন - Not the Arhat who has shaken off all human feeling, but the generous, self-sacrificing, active Bodhisattva is the ideal of the Mahayanists, and this attractive side of the creed has, more perhaps than anything else, contributed to their wide conquests, whereas S. Buddhism has not been able to make converts except where the soil had been prepared by Hinduism and Mahayanism,” - Manual of Indian Buddhism. 69. Southern Buddhism অর্থাৎ হীনযান । মহাযানপন্থায় ভক্তিরও সমাবেশ হইয়াছিল Mahayanism lays a great stress on devotion, in this respect as in many others harmonising with the current of feeling in India which led to the growing importance of Bhakti.” Ibid p.124.)

চীন, তিব্বৎ জাপান প্রভৃতি দেশে আজকাল যে বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত আছে তাহা মহাযান পন্থার; এবং বুদ্ধের নির্বাণের পরে মহাযানপন্থী ভিক্ষু-সংঘের দীর্ঘ উদ্যোগেই বৌদ্ধধর্মের এত শীঘ্ৰ বিস্তার হয় । বৌদ্ধধর্মে এই যে সংস্কার সাধিত হইয়াছিল, তাহা শালিবাহন শকের প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্বে হইয়া থাকিবে এইরূপ ডাঃ কেৰ্ণ স্থির করিয়াছেন । (See Dr. Kern's “Manual of Indian Buddhism”, pp.6, 69 and 119, মিলিন্দ, মিনণ্ডর নামক গ্রীক রাজা, প্রায় খৃঃ পূঃ ১৪০ কিংবা ১৫০ অব্দে ভারতবর্ষের বায়ুকোণে ব্যাক্‌ট্ৰীয়া দেশে রাজত্ব করিতেন । তাঁহাকে নাগসেন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন ইহা মিলিন্দপ্রশ্নে উক্ত হইয়াছে । মহাযানপন্থার লোকেরাই বৌদ্ধধর্মের এই প্ৰচার কাৰ্য করিত, তাই ইহা সুস্পষ্ট যে, মহাযানপন্থা তখন আবির্ভূত হইয়াছিল ।) কারণ, শক রাজা কনিষ্কের শাসনকালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যে এক মহাপরিষৎ বসিয়াছিল উহাতে মহাযানপন্থার ভিক্ষুরা উপস্থিত ছিল, এইরূপ বৌদ্ধগ্রন্থে উল্লেখ আছে । এই মহাযানপন্থার ‘অমিতায়ুসুত্ত’ নামক প্রধান সুত্ৰগ্রন্থের চিনীয় ভাষায় ভাষান্তর প্রায় ১৪৮ খৃষ্টাব্দে করা হয়; তাহা এখন পাওয়া গিয়াছে । কিন্তু আমার মতে, এই কাল ইহা হইতেও প্ৰাচীন হইবে । কারণ, খৃষ্টের প্রায় ২৩০ বৎসর পূর্বে প্ৰকাশিত অশোকের শিলালিপিতে সন্ন্যাসমূলক নিরীশ্বর বৌদ্ধধর্মের বিশেষ ভাবে কোনই উল্লেখ নাই; উহাতে সর্বত্র প্রাণীমাত্রের প্রতি দয়াপর প্রবৃত্তিমূলক বৌদ্ধধর্মই উপদিষ্ট হইয়াছে । তখন ইহা সুস্পষ্ট যে, তৎপূর্বেই বৌদ্ধধর্মের মহাযান পন্থায় প্রবৃত্তিপ্রধান স্বরূপ আসিতে আরম্ভ হইয়াছিল । বৌদ্ধ যতি নাগার্জুন এই পথের মুখ্য প্ৰবর্তক ছিলেন, মূল সংস্থাপক নহে ।


8) বৌদ্ধধর্মে ভক্তিমার্গের উন্মেষে ভগবদ্গীতার প্রভাব ?


ব্ৰহ্ম বা পরমাত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া, উপনিষদের মতানুসারে কেবল নিবৃত্তিমার্গের মনকে নিৰ্বিষয় করিবার উপদেশ যে মূল নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধধর্ম গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহা হইতেই পরে ক্রমশ স্বাভাবিকভাবে ভক্তিপর প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ বাহির হওয়া কখনও কি সম্ভব ছিল; এই জন্য বুদ্ধের নির্বাণের পর, শীঘ্রই বৌদ্ধধর্ম যে এই কর্মপ্রধান ভক্তির স্বরূপ প্রাপ্ত হইল, ইহা হইতে প্ৰকাশ পাইতেছে যে, ইহার জন্য বৌদ্ধধর্মের বাহিরের তৎকালীন কোন-না-কোন অন্য কারণ থাকিবে; এবং এই কারণের বিচারে প্রবৃত্ত হইলে, ভগবদ্গীতার উপর দৃষ্টি না পড়িয়া থাকিতে পারে না । কারণ, ভারতবর্ষে তৎকালে প্ৰচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে জৈন ও উপনিষদ্‌ধর্ম সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্তিপরই ছিল, ইহা আমি গীতারহস্যের একাদশ প্ৰকরণে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছি; এবং বৈদিক ধর্মান্তৰ্গত পাশুপত কিংবা শৈব ও প্রভৃতি পন্থা ভক্তিপর হইলেও প্রবৃত্তিমাৰ্গ ও ভক্তির মিলন ভগবদ্গীতা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাইতেছিল না । গীতায় ভগবান আপনাকে পুরুষোত্তম নামে অভিহিত করিয়াছেন এবং এই বিচার ভগবদ্গীতাতেই আসিয়াছে যে, “আমি পুরুষোত্তমই সমস্ত লোকের ‘পিতা’ ও ‘পিতামহ’ [৯|১৭]; আমার নিকট সকলেই সমান (‘সম’), আমার কেহ দ্বেষ্যও নাই, কেহ প্রিয়ও নাই [৯|২৯]; আমি অজ ও অব্যয় হইয়াও ধর্মসংরক্ষণার্থ সময়ে সময়ে অবতার ধারণ করি [৪|৬-৮]; মনুষ্য যতই দুরাচারী হোক না, আমাকে ভজনা করিলে সে সাধু হইয়া যায় [৯|৩০], কিংবা আমাকে ভক্তিপূর্বক ফুল, পত্র কিংবা একটু জলও দিলে আমি তাহা সন্তোষের সহিত গ্ৰহণ করি [৯|২৬]; এবং অজ্ঞলোকের জন্য ভক্তি এক সুলভ মাৰ্গ” [১২|৫]; ইত্যাদি । এই প্ৰকারই ব্ৰহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তির লোকসংগ্ৰহাৰ্থ প্ৰবৃত্তিধর্মকেই স্বীকার করা কর্তব্য, এই তত্ত্ব গীতা ছাড়া অন্য কোথাও সবিস্তার প্রতিপাদিত হয় নাই । তাই, এইরূপ অনুমান অগত্যা করিতে হয় যে, মূল বৌদ্ধধর্মে যেরূপ বাসনাক্ষয়ের নিছক নিবৃত্তিপর মাৰ্গ উপনিষৎ হইতে গৃহীত হইয়াছে, সেইরূপই পরে মহাযানপন্থা বাহির হইলে পর উহাতে প্ৰবৃত্তি প্ৰধান ভক্তিতত্ত্বও ভগবদ্গীতা হইতেই গৃহীত হইয়া থাকিবে । কিন্তু এই কথাটা কিছু অনুমানের উপরেই অবলম্বিত নহে । তিববতীয় ভাষায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সম্বন্ধে বৌদ্ধধর্মী তারানাথের যে এক গ্ৰন্থ আছে তাহাতে স্পষ্ট লিখিত হইয়াছে যে, মহাযানপন্থার মুখ্য প্ৰবর্তকের অর্থাৎ “নাগার্জুনের গুরু রাহুলভদ্র নামক বৌদ্ধ প্ৰথমে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন, এবং জ্ঞানী শ্ৰীকৃষ্ণগণেশ এই ব্ৰাহ্মণের (মহাযানপন্থার) কল্পনা উদ্রেক করিবার কারণ হইয়াছিলেন” । ইহা ব্যতীত অন্য এক তিব্বতীয় গ্রন্থেও এইরূপ উল্লেখই পাওয়া যায় ।
(See Dr. Kern's “Manual of Indian Buddhism” p. 122. “He (Nagarjuna) was a pupil of the Brahmana Rahulabhadra, who himself was a Mahayanist. This Brahmana was much indebted to sage Krishna and still more to Ganesha. This quasi-historical notice, reduced to its less allegorical expression, means that Mahayanisim is much indebted to the Bhagabadgita and more even to Shivaism.” ‘গণেশ’ শব্দে ডাঃ কের্ণ শৈবপন্থা বুঝিয়াছেন মনে হয় । ডাঃ কের্ণ, প্রাচ্যধর্মপুস্তক-মালায় সদ্ধর্মপুণ্ডরীকগ্রন্থের ভাষান্তর করিয়াছেন এবং তাঁহার প্রস্তাবনায় এই মতই তিনি প্রতিপাদন করিয়াছেন (S.B.E. Vol. XXI, Intro. pp. xxv-xxviii.)

তারানাথের গ্ৰন্থ প্রাচীন নহে, একথা সত্য; কিন্তু উহার বর্ণনা প্রাচীন গ্রন্থের ভিত্তি ছাড়িয়া হয় নাই ইহা বলা বাহুল্য । কারণ, কোনও বৌদ্ধ গ্ৰন্থকার স্বকীয় ধর্মপন্থার তত্ত্ব বলিবার সময় বিনা, কোন কারণে পরধর্মীর এই প্রকার উল্লেখ করিবে ইহা সম্ভবপর নহে । এইজন্য স্বয়ং বৌদ্ধগ্রন্থকারগণ কর্তৃক এই বিষয়ে শ্ৰীকৃষ্ণের নামোল্লেখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য । কারণ ভগবদ্গীতা ব্যতীক্ত শ্ৰীকৃষ্ণোক্ত অন্য প্ৰবৃত্তিপর ভক্তিগ্ৰন্থ বৈদিক ধর্মেই নাই; অতএব ইহা হইতে সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয় যে, মহাযানপন্থার আবির্ভাবের পূর্বেই শুধু ভাগবতধর্ম নহে, ভাগবতধর্মসম্বন্ধীয় শ্ৰীকৃষ্ণোক্ত গ্ৰন্থ অর্থাৎ ভগবদ্গীতাও সে সময়ে প্রচলিত ছিল; এবং ডাঃ কেৰ্ণও এই মত সমর্থন করেন । গীতার অস্তিত্ব যখন বৌদ্ধধর্মীয় মহাযানপন্থার পূর্ববর্তী স্থির হইল, তখন মহাভারতও উহার সঙ্গে ছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে । বুদ্ধের মৃত্যুর পর সত্বরই তাঁহার মত সকল একত্ৰ সংগ্ৰহ করা হইয়াছিল, ইহা বৌদ্ধগ্রন্থে উক্ত হইয়াছে; কিন্তু ইহা হইতে সিদ্ধ হয় না যে, বর্তমান কালে প্ৰাপ্ত অতি প্ৰাচীন বৌদ্ধগ্ৰন্থও সেই সময়েই রচিত হইয়াছিল । মহাপরিনিব্বাণসুত্ত বর্তমান বৌদ্ধ গ্ৰন্থসমূহের মধ্যে প্ৰাচীন গ্ৰন্থ বলিয়া স্বীকৃত হয় । কিন্তু উহাতে পাটলিপুত্র নগর সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে, তাহা হইবে প্রোফেসর রিস্‌-ডেভিড্‌স্‌ দেখাইয়াছেন যে, এই গ্ৰন্থ বুদ্ধের নির্বাণের অন্যূন শত বৎসর পূর্বেও বোধ হয় রচিত হয় নাই । এবং বুদ্ধের শত বৎসর পরে, বৌদ্ধধর্মীয় ভিক্ষুদের যে দ্বিতীয় পরিষদের অধিবেশন হইয়াছিল, তাহার বর্ণনা বিনয়পিটকের অন্তর্গত চুল্লবগ্‌গ গ্রন্থের শেষে দেওয়া হইয়াছে । ইহা হইতে জানা যায় যে, সিংহলদ্বীপের পালিভাষায় লিখিত বিনয়পিটকাদি প্ৰাচীন বৌদ্ধ গ্ৰন্থ, এই পরিষদের পরে রচিত (See S.B.E. Vol. XI. Intro. pp, xv xx and p.58.) । এই বিষয়ে বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারেরাই বলিয়াছেন যে, অশোকের পুত্ৰ মহেন্দ্ৰ খৃঃ পূঃ প্ৰায় ২৪১ অব্দে সিংহল দ্বীপে যখন বৌদ্ধধর্ম প্রচার করিতে আরম্ভ করেন, সেই সময় এই গ্ৰন্থও সেখানে গিয়াছে, এবং তাহার প্রায় ১৫০ বৎসর পরে ইহা সেখানে সর্বপ্রথম পুস্তকাকারে লিখিত হয় । এই গ্ৰন্থ কণ্ঠস্থ করিবার রীতি ছিল, তৎপ্রযুক্ত মহেন্দ্রের কাল হইতে উহাতে কোনও পরিবর্তন হয় নাই, ইহা মনে করিলেও, কি প্রকারে বলা যাইতে পারে যে, বুদ্ধের নির্বাণের পরে এই গ্ৰন্থ যখন সর্বপ্রথম রচিত হয় তখন, অথবা পরে মহেন্দ্ৰ বা অশোকের কাল পৰ্যন্ত, তৎকালে প্ৰচলিত বৈদিক গ্ৰন্থ হইতে ইহাতে কোন কিছুই গৃহীত হয় নাই ? অতএব মহাভারত বুদ্ধের পরে হইলেও অন্য প্ৰমাণ হইতে উহার, আলেক্‌জণ্ডর বাদ্‌শার পূৰ্ববর্তী, অর্থাৎ খৃঃ পূঃ ৩২৫ অব্দের পূর্ববর্তী হওয়া সিদ্ধ হয়; এইজন্য মনুস্মৃতির শ্লোকের ন্যায় মহাভারতের শ্লোকও মহেন্দ্রের সিংহলে নীত পুস্তকসমূহের মধ্যে পাওয়া সম্ভব ।


9) সার কথা


বুদ্ধের মৃত্যুর পরে তাঁহার ধর্মের প্রসার হইতেছে দেখিয়া শীঘ্রই প্ৰাচীন বৈদিক গাথা ও কথাসমূহ মহাভারতে একত্র সংগ্ৰহ করা হয়; উহার যে শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে শব্দশঃ পাওয়া যায় তাহা বৌদ্ধ গ্রন্থকারেরা মহাভারত হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন, মহাভারতকার বৌদ্ধ গ্ৰন্থ হইতে গ্ৰহণ করেন নাই । কিন্তু যদি স্বীকার করা যায় যে, বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারেরা এই সকল শ্লোক মহাভারত হইতে না লইয়া মহাভারতেরও আধারভূত কিন্তু এক্ষণে বিলুপ্ত তৎপূর্ববর্তী প্রাচীন বৈদিক গ্ৰন্থাদি হইতে লইয়া থাকিবেন; এবং সেইজন্য মহাভারতের কালনির্ণয় উপযুক্ত শ্লোকসাদৃশ্য হইতে সম্পূর্ণরূপে হয় না, তথাপি নিম্নোক্ত চারি বিষয় হইতে ইহা তো নিঃসন্দেহ সিদ্ধ হয় যে, বৌদ্ধধর্মে মহাযানপন্থার প্রাদুর্ভাব হইবার পূর্বে কেবল ভাগবতধর্মই প্ৰচলিত ছিল না, বরং সে সময় ভগবদ্গীতাও সর্বমান্য হইয়াছিল, এবং এই গীতারই আধারে মহাযানপন্থা বাহির হইয়াছে, এবং শ্ৰীকৃষ্ণপ্রণীত গীতার তত্ত্ব বৌদ্ধধর্ম হইতে গৃহীত হয় নাই । এই চারিটি বিষয় হইতেছে –
(১) নিছক্‌ অনাত্মবাদী ও সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্ম হইতেই পরে ক্রমশঃ স্বাভাবিকভাবে ভক্তিপ্রধান ও প্ৰবৃত্তিপ্ৰধান তত্ত্ব বাহির হওয়া অসম্ভব,
(২) মহাযানপন্থার উৎপত্তি সম্বন্ধে স্বয়ং বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারগণ শ্ৰীকৃষ্ণের নাম স্পষ্ট নির্দেশ করিয়াছেন,
(৩) মহাযানপন্থার মতের সহিত গীতার ভক্তিপর ও প্ৰবৃত্তিপর তত্ত্বের অৰ্থতঃ ও শব্দশঃ সাদৃশ্যআছে, এবং
(৪) বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গেই তৎকালে প্ৰচলিত অন্যান্য জৈন ও বৈদিক পন্থায় প্রবৃত্তিপর ভক্তিমার্গের প্রচার ছিল না ।
উপযুক্ত প্ৰমাণসমূহ হইতে বর্তমান গীতার যে কাল নির্ণীত হইয়াছে তাহার সহিত ইহার সম্পূর্ণ ঐক্য আছে ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

বর্তমান গীতার কাল (Current age of Gita)

বর্তমান গীতার কাল


সূচি


1) ভূমিকা
2) মহাভারত-কাল নিৰ্ণয়
3) গীতার কাল নিৰ্ণয়
4) সিদ্ধান্ত


1) ভূমিকা


ইহা আলোচিত হইয়াছে যে, ভগবদ্গীতা ভাগবতধর্মের প্রধান গ্ৰন্থ, এবং এই ভাগবতধর্ম খৃষ্টের প্রায় ১৪০০ বৎসর পূর্বে প্ৰাদুর্ভূত হয়; এবং ইহাও মোটামুটিভাবে নির্ধারিত হইয়াছে যে, কয়েক শতাব্দী পরে মূল গীতা বাহির হইয়া থাকিবে । উহার এবং ইহাও বলিয়াছি যে, মূল ভাগবতধর্ম নিষ্কামপ্ৰধান হইলেও পরে ভক্তি প্ৰধান-স্বরূপ হইয়া শেষে উহাতে বিশিষ্টাদ্বৈতেরও সমাবেশ হইয়াছে । মূল গীতা এবং মূল ভাগবতধর্ম সম্বন্ধে ইহা অপেক্ষা বেশী জ্ঞাতব্য বিবরণ অন্ততঃ বর্তমান কালে তো পাওয়া যায় না; এবং এই দশাই পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বর্তমান মহাভারত ও বর্তমান গীতারও ছিল । কিন্তু ডাঃ ভাণ্ডারকর, ৺কাশীনাথপন্ত তৈলং, ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত এবং রাওবাহাদুর চিন্তামণি রাও বৈদ্য প্রভৃতি বিদ্বান ব্যক্তিগণের উদ্যোগে বর্তমান মহাভারতের এবং বর্তমান গীতার কালনিৰ্ণয় সম্বন্ধে অনেক উপকরণ পাওয়া গিয়াছে; এবং সম্প্রতি, ‘আরও দুই একটা প্রমাণ ৺ত্র্যম্বক গুরুনাথ কালে প্ৰদৰ্শন করিয়াছেন । এই সমস্ত একত্র করিয়া, এবং আমার ধারণা অনুসারে তাহার মধ্যে আরও যাহা কিছু দিবার আছে তাহাও সন্নিবিষ্ট করিয়া পরিশিষ্টের এই ভাগ সংক্ষেপে লিখিয়াছি । এই পরিশিষ্ট প্রকরণের আরম্ভেই ইহা আমি প্রমাণসহ দেখাইয়াছি যে, বর্তমান মহাভারত ও বর্তমান গীতা, এই দুই গ্ৰন্থ এক হাতেরই রচনা । এই দুই গ্ৰন্থ একই হাতের সুতরাং একই কালের বলিয়া স্বীকার করিলে, মহাভারতের কাল হইতে গীতার কালও সহজেই নির্ণয় হয় । তাই, এই ভাগে প্রথমে বর্তমান, মহাভারতের কাল স্থির করিবার জন্য যে প্রমাণ অত্যন্ত প্ৰধান বলিয়া স্বীকৃত হয়, তাহাই দেওয়া হইয়াছে, এবং তাহার পর স্বতন্ত্ররূপে বর্তমান গীতার কাল স্থির করিবার উপযোগী প্ৰমাণ দেওয়া হইয়াছে । উদ্দেশ্য এই যে, মহাভারতের কালনির্ণয় করিবার প্রমাণগুলি কেহ সন্দেহমূলক মনে করিলেও তজ্জন্য গীতার কালনির্ণয়ে বাধা কোন হইবে না ।


2) মহাভারত-কাল নিৰ্ণয়


মহাভারত-গ্ৰন্থ অতি বিস্তীর্ণ এবং মহাভারতেই লিখিত হইয়াছে যে, উহা লক্ষ শ্লোকাত্মক । কিন্তু রাওবাহাদুর বৈদ্য মহাভারতের স্বকীয় টীকাত্মক ইংরাজী গ্রন্থের প্রথম পরিশিষ্টে দেখাইয়াছেন যে, এক্ষণে মহাভারতের যে গ্ৰন্থ পাওয়া যায় তাহাতে এই লক্ষ শ্লোক অপেক্ষা কিছু কমিবেশী হইয়া পড়িয়ছে, এবং উহার মধ্যে হরিবংশের শ্লোক সমাবেশ করিলেও লক্ষ অঙ্ক সম্পূর্ণ হয় না । (The Mahabharat : a criticism p. 185. রাওবাহাদুর বৈদ্যের মহাভারতসম্বন্ধীয় যে টীকাত্মক পুস্তকের আমি কোন কোন স্থলে উল্লেখ করিয়াছি, তাহা এই পুস্তক ।) তথাপি ভারত মহাভারতে পরিণত হইবার পর যে বৃহৎ গ্রন্থ রচিত হয়, তাহা অনেকটা বর্তমান মহাভারতেরই সদৃশ হইবে এরূপ মনে করিতে কোন বাধা নাই । এই মহাভারতে যাস্কের নিরুক্ত ও মনুসংহিতার উল্লেখ এবং ভগবদ্গীতাতে আবার ব্রহ্মসূত্রেরও উল্লেখ আছে, ইহা উপরে বলিয়াছি । এক্ষণে ইহা ব্যতীত মহাভারতের কালনিৰ্ণয়াৰ্থ যে প্রমাণ পাওয়া যায় তাহা এইরূপ -

(১) আঠারো পর্বের এই গ্রন্থ এবং হরিবংশ, এই দুই সম্বৎ ৫৩৫ ও ৬৩৫ অব্দের ভিতর জাবা ও বালীদ্বীপে ছিল, এবং তত্ৰত্য প্ৰাচীন ‘কবি’ নামক ভাষায় তাহার ভাষান্তর হইয়াছিল; এই ভাষান্তরের আদি, বিরাট, উদ্যোগ, ভীষ্ম, আশ্রমবাসী, মুষল, প্ৰস্থানিক ও স্বৰ্গারোহণ এই আট পর্ব বালীদ্বীপে এক্ষণে পাওয়া গিয়াছে এবং তন্মধ্যে কোন কোনটা ছাপাও হইয়াছে । কিন্তু ভাষান্তর ‘কবি’-ভাষাতে হইলেও উহাতে স্থানে স্থানে মহাভারতের মূল সংস্কৃত শ্লোকই রক্ষিত হইয়াছে । তন্মধ্যে উদ্যোগপর্বের শ্লোক আমি মিলাইয়া দেখিয়াছি । ওই সমস্ত শ্লোক বর্তমান মহাভারতের কলিকাতা-সংস্করণের উদ্যোগ পর্বের অধ্যায়ে - মধ্যে মধ্যে ক্রমশঃ - পাওয়া যায় । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, লক্ষ শ্লোকাত্মক মহাভারত ৪৩৫ সম্বতের পূর্বে প্ৰায় দুই শত বৎসর পৰ্যন্ত ভারতবর্ষে প্রমাণভূত মানা যাইত । কারণ তাহা না হইলে উহা জাবা ও বালীদ্বীপে লইয়া যাইবার কোন কারণ ছিল না । তিব্বতীয় ভাষাতেও মহাভারতের এক ভাষান্তর হইয়াছে, কিন্তু ইহা উহার পরবর্তী । (জাবাদ্বীপের মহাভারতসম্বন্ধীয় বৃত্তান্ত “The Modern Review”, July 1914 pp. 32-38-র মধ্যে প্রদত্ত হইয়াছে তাহা দেখ; এবং তিব্বতী ভাষায় মহাভারত সম্বন্ধীয় উল্লেখ Rockhill’s “Life of the Budha”, p. 228 note-এ আছে ।)

(২) চেদি-সম্বৎ ১৯৭ অর্থাৎ বিক্ৰমী ৫০২ সম্বতে লিখিত গুপ্ত-রাজাদিগের সময়ের এক শিলালিপি সম্প্রতি পাওয়া গিয়াছে । তাহাতে স্পষ্ট নির্দেশ আছে যে, মহাভারত গ্রন্থে তৎকালে এক লক্ষ শ্লোক ছিল; এবং ইহা হইতে দেখা যায় যে, বিক্রমী ৫০২ সম্বতের প্রায় দুই শত বৎসর পূর্বে উহার অস্তিত্ব নিশ্চয়ই ছিল । (এই শিলালিপি Inscriptionum Indicarum নামক পুস্তকের তৃতীয় খণ্ডে পৃ. ১০৪-তে সমগ্র প্রদত্ত হইয়াছে এবং ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বকীয় ভারতীয় জ্যোতিঃষশাস্ত্রে (পৃ.১০৮) তাহার উল্লেখ করিয়াছেন ।)

(৩) বৰ্তমানে ভাস কবির যে নাটক প্ৰকাশিত হইয়াছে তন্মধ্যে অধিকাংশ মহাভারতের আখ্যান অবলম্বনে রচিত । সুতরাং সেই সময়ে মহাভারত পাওয়া যাইত এবং লোকেরাও উহাকে প্ৰমাণ বলিয়া মনে করিত, ইহা সুস্পষ্ট । ভাস কবির বালচরিত নাটকে শ্ৰীকৃষ্ণের বাল্যকথা ও গোপীদিগের উল্লেখ আছে । তাই, বলিতে হয় যে, হরিবংশও তখন পাওয়া যাইত । ভাস কবি যে কালিদাসের পূর্ববর্তী তাহা নির্বিবাদ । ভাস কবির নাটকসমূহের সম্পাদক পণ্ডিত গণপতিশাস্ত্রী স্বপ্নবাসবদত্তা নামক নাটকের প্রস্তাবনায় লিখিয়াছেন যে, ভাস চাণক্যেরও পূর্বে আবিভূর্ত হইয়াছিলেন; কারণ, ভাস কবির নাটকের এক শ্লোক চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায়, এবং উহাতে বলা হইয়াছে যে, তাহা অন্য কাহারও । কিন্তু এই কাল সন্দিগ্ধ মনে করিলেও ভাস কবিকে যে খৃষ্টাব্দের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শতাব্দীর অধিক আধুনিক বলিয়া মানা যাইতে পারে না, তাহা আমার মতে নির্বিবাদ ।

(৪) অশ্বঘোষ নামে এক বৌদ্ধ কবি শালিবাহন শকের আরম্ভে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, ইহা বৌদ্ধ গ্রন্থের সাহায্যে স্থির হইয়াছে । এই অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত ও সৌন্দরানন্দ নামক দুই বৌদ্ধধর্মীয় সংস্কৃত মহাকাব্য ছিল । এই গ্ৰন্থ এক্ষণে মুদ্রিত হইয়া প্ৰকাশিত হইয়াছে । এই দুয়েতেও ভারতীয় কথার উল্লেখ আছে । তাছাড়া বজ্ৰসূচিকোপনিষদের উপর ব্যাখ্যানরূপ অশ্বঘোষের আর এক গ্ৰন্থ আছে; কিংবা বলিতে হয় যে, এই বজ্ৰসূচি উপনিষৎ তাঁহারই রচিত । প্রোঃ বেবর এই গ্ৰন্থ ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে জর্মণীতে প্ৰকাশিত করিয়াছিলেন । তাহাতে হরিবংশের অন্তর্গত শ্ৰাদ্ধামাহাত্ম্যের মধ্যে “সপ্তব্যাধা দশার্ণেষু” [হরি|২৪|২০ ও ২১] ইত্যাদি শ্লোক এবং স্বয়ং  মহাভারতেরও অন্য কতকগুলি শ্লোক [যথা - মভা|শা|২৬১|১৭] সন্নিবিষ্ট হইয়াছে । ইহা হইতে দেখা যায় যে, শকারম্ভের পূর্বে হরিবংশসমেত বর্তমান লক্ষশ্লোকাত্মক মহাভারত প্ৰচলিত ছিল ।

(৫) আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে [৩|৪|৪] ভারত এবং মহাভারতের পৃথক পৃথক উল্লেখ আছে; এবং বৌধায়ন ধর্মসূত্রের এক স্থানে [২|২|২৬] মহাভারতের অন্তর্গত যযাতি উপাখ্যানের এক শ্লোক পাওয়া যায় [মভা|আ|৭৮|১০] । কিন্তু কেবল এই একটী শ্লোকের ভিত্তিতে বৌধায়নের পূর্বে মহাভারত ছিল এই অনুমান দৃঢ় হয় না, এই কথা বুহ্লর সাহেব বলেন (See Sacred Books of the East Series, Vol. XIV. Intro. P. Xli.) । কিন্তু এই সন্দেহ ঠিক নহে; কারণ, বৌধায়নের গৃহ্যসূত্রে বিষ্ণুসহস্ৰনামের স্পষ্ট উল্লেখ আছে [বৌ|গৃ|শে|১|২২|৮], এবং পরে এই সূত্ৰেই [২|২২|৯] গীতার “পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং” শ্লোকও [গী|৯|২৬] পাওয়া যায় । বৌধায়নসূত্রের এই উল্লেখ সর্বপ্রথম ৺ত্র্যম্বক গুরুনাথ কালে প্ৰকাশ করেন । এই সকল উল্লেখ হইতে বলিতে হয় যে, বুহ্লের সাহেবের সন্দেহটা নির্মূল, এবং আশ্বলায়ন ও বৌধায়ন উভয়েই মহাভারতের সহিত পরিচিত ছিলেন । বৌধায়ন খৃষ্টের প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্বে আবির্ভূত হইয়া থাকিবেন, বুহ্লরই তাহা অন্য প্রমাণাদি হইতে নির্ধারিত করিয়াছেন ।
(৺ত্র্যম্বক গুরুনাথকালের সম্পূর্ণ প্রবন্ধ “The Vedic Magazine and Gurukula Samnachar”, Vol. VII Nos 6, 7. pp. 528-532’তে প্রকাশিত হইয়াছে । লেখকের নাম দেওয়া হইয়াছে প্রোঃ কালে; উহা ভুল ।)

(৬) স্বয়ং মহাভারতে যেখানে বিষ্ণু-অবতারের বর্ণনা আছে, সেখানে বুদ্ধের নাম পৰ্যন্ত নাই; এবং নারায়ণীয় উপাখ্যানে [মভা|শাং|৩৯|১০০] যেখানে দেশ অবতারের নাম আছে সেখানে হংসকে প্ৰথম অবতার ধরিয়া এবং কৃষ্ণের পরই একেবারে কল্কির উল্লেখ করিয়া দশসংখ্যা পুরণ করা  হইয়াছে । কিন্তু বনপর্বে কলিযুগের ভবিষ্যৎ অবস্থার বর্ণনা করিবার সময় বলা হইয়াছে যে, “এডুকচিহ্না পৃথিবী ন দেবগৃহভূষিতা” অর্থাৎ পৃথিবীতে দেবালয়ের বদলে এডুক হইবে [মহা|বন|১৬০|৩৮]এডুক অর্থে বুদ্ধের কেশ দাঁত প্ৰভৃতি কোন স্মারক বস্তুকে জমীর ভিতরে পুঁতিয়া তাহার উপর যে স্তম্ভ, মিনার বা ইমারৎ নির্মিত হয়, তাহাই; এখন ইহাকে “ডাগোবা” বলা হয় । ডাগোবা শব্দ সংস্কৃত ‘ধাতুগর্ত’ (= পালী ডাগিব) শব্দের অপভ্রংশ, এবং ‘ধাতু’ অর্থে ‘ভিতরে রাখা স্মারক বস্তু’ । সিংহল ও ব্ৰহ্মদেশের স্থানে স্থানে এই ডাগোবা পাওয়া যায় । ইহা হইতে মনে হয় যে, বুদ্ধ আবির্ভূত হইবার পরে – কিন্তু তাঁহার অবতার মধ্যে পরিগণিত হইবার পূর্বেই – মহাভারত রচিত হইয়া থাকিবে । মহাভারতে, ‘বুদ্ধ’ ও ‘প্রতিবুদ্ধ’ শব্দ অনেক স্থানে পাওয়া যায় [শাং|১৯৪|৫৮; ৩০৭|৪৭; ৩৪৩|৫২] । কিন্তু এখানে জ্ঞানী, জ্ঞানবান অথবা স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি – এই অর্থই ঐ সকল শব্দের অভিপ্রেত । বৌদ্ধধর্ম হইতে ঐ শব্দ গৃহীত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না; কিন্তু এরূপ মনে করিবার বলবৎ কারণও আছে যে, বৌদ্ধেরাই এই শব্দ বৈদিক ধর্ম হইতে গ্ৰহণ করিয়া থাকিবে ।

(৭) মহাভারতে নক্ষত্রগণনা অশ্বিনী প্রভৃতি হইতে নহে, কিন্তু কৃত্তিকা আদি হইতে হইয়াছে [মভা|অনু|৬৪ ও ৮৯], এবং মেষ-বৃষভাদি রাশির কোথাও কোথাও উল্লেখ নাই — এই কথাটি কালনির্ণয়ের দৃষ্টিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । কারণ, ইহা হইতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, গ্ৰীক লোকদিগের সহবাসে, মেষ-বৃষভাদি রাশি ভারতবর্ষে আসিবার পূর্বে অর্থাৎ আলেকজাণ্ডরের পূৰ্বেই মহাভারত গ্ৰন্থ রচিত হইয়া থাকিবে । কিন্তু ইহা অপেক্ষাও প্রয়োজনীয় কথা হইতেছে - শ্রবণাদি নক্ষত্রগণনার কথা । অনুগীতায় [মভা|অশ্ব|৪৪|২ ও আদি|৭১|৩৪] উক্ত হইয়াছে যে, বিশ্বামিত্ৰ শ্ৰবণাদি নক্ষত্ৰগণনা শুরু করেন; এবং টীকাকার উহার এই অর্থ করিয়াছেন যে, তখন শ্রবণা নক্ষত্র হইতে উত্তরায়ণের শুরু হইত – ইহা ব্যতীত অন্য অর্থও ঠিক্‌ হয় না । বেদাঙ্গজ্যোতিষের কালে উত্তরায়ণের আরম্ভ ধনিষ্ঠা নক্ষত্ৰ হইতে হইত । ধনিষ্ঠায় উত্তরায়ণ হইবার কাল জ্যোতিৰ্গণিত-পদ্ধতি অনুসারে শকের পূর্বে প্ৰায় ১৫০০ বৎসর আসে; এবং জ্যোতিৰ্গণিত-পদ্ধতি অনুসারে উত্তরায়ণের এক নক্ষত্র পশ্চাতে হটিতে প্ৰায় হাজার বৎসর লাগে । এই হিসাবে, শ্রবণারম্ভে উত্তরায়ণ হইবার কাল শকের পূর্বে প্ৰায় ৫০০ বৎসর হয় । সার কথা, গণিতের দ্বারা দেখাইতে পারা যায় যে, শকের প্রায় ৫০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান মহাভারত রচিত হইয়া থাকিবে । ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বকীয় ভারতীয় জ্যোতিঃশাস্ত্রে এই অনুমানই করিয়াছেন [ভা|জ্যো|পৃঃ ৮৭-৯০, ১১১ ও ১৪৭ দেখ] । এই প্রমাণের বিশেষত্ব এই যে, এই কারণে বর্তমান মহাভারতের কাল শকপূর্ব ৫০০ বৎসরের অধিক পিছাইয়া লইতেই পারা যায় না ।

(৮) রাও বাহাদুর বৈদ্য, স্বকীয় মহাভারতের টীকাত্মক ইংরাজী পুস্তকে দেখাইয়াছেন যে, চন্দ্রগুপ্তের দরবারে (খৃঃ পূঃ প্ৰায় ৩২০ বৎসর) অবস্থিত মেগস্থনীস নামক গ্রীক দূতের নিকট মহাভারতের কথা বিদিত ছিল । মেগস্থনীসের সম্পূর্ণ গ্ৰন্থ এক্ষণে পাওয়া যায় না, কিন্তু তাহা হইতে অন্য ব্যক্তি কর্তৃক উদ্ধৃত অংশ একত্র করিয়া প্ৰথমে জর্মণ ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং ম্যাকরিণ্ডল তাহারই ইংরাজী ভাষান্তর করিয়াছেন । এই পুস্তকে [পৃঃ ২০০-২০৫] উক্ত হইয়াছে যে, উহাতে বৰ্ণিত হেরক্লীজই শ্ৰীকৃষ্ণ এবং মেগস্থনীসের সময় মথুরানিবাসী শৌরসেনী লোকেরা তাঁহার পুজা করিত । হেরক্লীজ নিজের আদিপুরুষ ডায়োনিসস্‌ হইতে পঞ্চদশ পুরুষ ছিলেন, ইহাও তাহাতে লিখিত আছে । মহাভারতেও [মভা|অনু|১৪৭|২৫-৩৩] এইরূপ বর্ণনা আছে যে, শ্রীকৃষ্ণ দক্ষপ্রজাপতি হইতে পঞ্চদশ পুরুষ । এবং মেগস্থনীস কর্ণপ্রাবরণ, একপাদ, ললাটাক্ষ প্রভৃতি অদ্ভুত লোকদিগের কথা [পৃঃ ৭৪], এবং ভূগর্ভ হইতে সোনা বাহির করিবার পিপীলিকার কথা যাহা বৰ্ণনা করিয়াছেন তাহাও মহাভারতেই পাওয়া যায় [সভা|৫১ ও ৫২] । এই কথা এবং অন্য কথা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, শুধু মহাভারত গ্ৰন্থ নহে, শ্ৰীকৃষ্ণচরিত্র ও শ্ৰীকৃষ্ণের পূজাও মেগস্থনীসের সময়ে প্রচলিত ছিল ।
(See M’crindle's “Ancient India - Megasthenes and Arrian” pp. 200-205. মোগস্থনীসের এই কথা আজকাল এক গবেষণার দ্বারা আশ্চর্যরূপে দৃঢ় হইয়াছে । বোম্বাই সরকারের Archaeological Department’এর ১৯১৪ খৃষ্টাব্দের Progress Report সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে । তাহাতে এক শিলালিপি আছে, উহা গোয়ালিয়র-রাজ্যের ভিল্‌সা শহরের নিকট বেসনগর গ্রামে খাম্ববাবা বলিয়া এক গরুড়ধ্বজ স্তম্ভের উপর পাওয়া গিয়াছে । ইহাতে উক্ত হইয়াছে যে, উক্ত স্তম্ভের সম্মুখে বাসুদেবের দেবালয়, হেলিয়োডোরস্‌ নামক হিন্দু-ভূত এক যবন অর্থাৎ গ্ৰীক গড়িয়াছিল এবং সেই যবন তত্রস্থ ভগভদ্র নামক রাজার দরবারে তক্ষশিলার অন্টিয়াল্‌কিডস্‌ নামক গ্রীক রাজার দূত ছিল । খৃষ্টপূর্ব ১৪০ বৎসরে অন্টিয়াল্‌কিডস্‌ রাজত্ব করিতেন ইহা তাঁহার মুদ্রা হইতে এক্ষণে সিদ্ধ হইয়াছে । তখন, এই সময়ে বাসুদেবভক্তি প্রচলিত ছিল শুধু নহে, কিন্তু যবনও বাসুদেবের মন্দিরনির্মাণে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিল ইহা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয় । মেগেস্থেনিসের শুধু নহে, বাসুদেবভক্তি পাণিনিরও বিদিত ছিল ইহা পূর্বেই বলিয়ছি ।) 

উপরি প্রদত্ত প্ৰমাণগুলি পরস্পরসাপেক্ষ নহে, স্বতন্ত্র - এই কথা মনে রাখিলে শকপূর্ব প্ৰায় ৫০০ অব্দে মহাভারতের অস্তিত্ব ছিল, ইহা নিঃসংশয়রূপে উপলব্ধি হয় । ইহার পর কখনও কেহ কোন নূতন শ্লোক উহাতে ঢুকাইয়া দিয়া থাকিবে কিংবা উহা হইতে কিছু বাহির করিয়া দিয়াও থাকিবে । কিন্তু উপস্থিত সময়ে কোন বিশিষ্ট শ্লোকের সম্বন্ধে কোনই প্রশ্ন নাই, - প্রশ্ন তো সমগ্র গ্রন্থেয়ই সম্বন্ধে; এবং এই সমগ্ৰ গ্ৰন্থ শকাব্দের অন্যূন পাঁচ শতাব্দী পূর্বেই রচিত হইয়াছে ইহা প্ৰমাণিত । এই প্রকরণের আরম্ভেই আমি সিদ্ধ করিয়াছি যে, গীতা সমগ্ৰ মহাভারত গ্রন্থেরই এক অংশ এবং উহা মহাভারতে পরে ঢুকাইয়া দেওয়া হয় নাই । অতএব মহাভারতের কাল গীতারও কাল ধরিতে হয় । সম্ভবত মূল গীতা ইহার পূর্ববর্তী, কারণ, এই প্রকরণেরই চতুর্থ ভাগে যেমন দেখাইয়াছি, উহার পরম্পরা অনেক প্রাচীনকাল পৰ্যন্ত পিছাইয়া লইয়া যাইতে হয় । কিন্তু যাহাই বল না কেন, ইহা নির্বিবাদ যে, গীতার কালকে মহাভারতের পরে লইয়া যাওয়া যায় না । কেবল উপরি-উক্ত প্ৰমাণ অনুসারেই এই কথা সিদ্ধ হয় এরূপ নহে; ঐ সম্বন্ধে স্বতন্ত্র প্রমাণও পাওয়া যায় । সে প্রমাণগুলি কি, এক্ষণে তাহা বলিতেছি ।


3) গীতার কাল নিৰ্ণয়


উপরে যে সকল প্ৰমাণ বলা হইয়াছে, তাহার মধ্যে গীতার নামতঃ স্পষ্ট নির্দেশ করা হয় নাই । উহাতে গীতার কালনির্ণয় মহাভারতের কাল ধরিয়াই করা হইয়াছে । এক্ষণে যে সকল প্রমাণে গীতার স্পষ্ট উল্লেখ আছে, সেইগুলি ক্ৰমান্বয়ে এখানে দিতেছি । কিন্তু তৎপূর্বে ইহা বলা আবশ্যক যে, ৺তৈলং গীতাকে আপস্তম্বের পূর্বের অর্থাৎ খৃষ্ট অপেক্ষা অন্যূন তিন শত বৎসরের অধিক প্রাচীন স্থির করিয়াছেন; এবং ডাঃ ভাণ্ডারকর স্বকীয় “বৈষ্ণব, শৈব প্ৰভৃতি পন্থা” এই ইংরেজী গ্রন্থে প্ৰায় এই কালই স্বীকার করিয়াছেন । প্রোঃ গার্বের মতে ৺তৈলঙ্গের নির্ধারিত কাল ঠিক নহে । তাহার মতে মূল গীতা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত এবং খৃষ্টের পর দ্বিতীয় শতাব্দীতে ঐ গীতার কিছু সংশোধন করা হইবে । কিন্তু গার্বের এই কথা ঠিক নহে তাহা নিম্নলিখিত প্ৰমাণগুলি হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে :-
(See Telang's “Bhagabad Gita” S. B. E. Vol. VIII. Intro, pp. 21 and 34; Dr. Bhandarkar's Vaishnavism, Shaivism and other Sects, P. 13 ; Dr. Garbe's Die Bhagavadgita, P.64.)

(১) গীতার উপর যে টীকা ও ভাষ্য পাওয়া যায় তন্মধ্যে শাঙ্কর ভাষ্যই অত্যন্ত প্ৰাচীন । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য মহাভারতের অন্তৰ্গত সনৎসুজাতীয় প্রকরণেরও ভাষ্য লিখিয়াছেন এবং তাঁহার সেই গ্রন্থে মহাভারতের অনুগীতা, মনু-বৃহস্পতিসংবাদ এবং শুকানুপ্রশ্ন হইতে অনেক বচন অনেক স্থানে প্ৰমাণার্থ গৃহীত হইয়াছে । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, মহাভারত ও গীতা এই দুই গ্ৰন্থ তাঁহার কালে প্ৰমাণ বলিয়া মানা হইত । এক সাম্প্রদায়িক শ্লোকের প্রমাণে প্রোঃ কাশীনাথ বাপু পাঠক শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্যের জন্মকাল ৮৪৫ বিক্রমী সম্বৎ (৭১০ শকাব্দ) স্থির করিয়াছেন । কিন্তু আমার মতে, এই কাল আরও একশত বৎসর পিছাইয়া দেওয়া আবশ্যক । কারণ মহানুভব পন্থার ‘দর্শনপ্রকাশ’ নামক গ্রন্থে উক্ত হইয়াছে যে, “যুগ্মপয়োধিয়সান্বিতশাকে” অর্থাৎ ৬৪২ শকে (বিক্ৰমী সম্বৎ ৭৭৭), শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য গুহাপ্ৰবেশ করিয়াছিলেন, এবং সেই সময়ে তাঁহার বয়স ৩২ বৎসর ছিল; অতএব তাঁহার জন্মকাল ৬১০ শকাব্দ (সম্বৎ ৭৪৫) এইরূপ সিদ্ধ হয় । আমার মতে এই কালই প্রোফেসর পাঠক-নির্ধারিত কাল অপেক্ষা অধিক সযুক্তিক । কিন্তু এই সম্বন্ধে সবিস্তার বিচার এখানে করিতে পারা যায় না । গীতার শাঙ্করভাষ্যে পূর্ববর্তী অধিকাংশ টীকাকারদিগের উল্লেখ আছে, এবং উক্ত ভাষ্যের আরম্ভেই শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য বলিয়াছেন যে, এই সকল টীকাকারদিগের মত খণ্ডন করিয়া আমি নুতন ভাষ্য লিখিয়াছি । অতএব আচার্যের জন্মকাল শকাব্দ ৬১০’ই ধর, কিংবা ৭১০’ই ধর, ইহা নির্বিবাদ যে, ঐ সময়ে অন্ততঃ দুই-তিনশত বৎসর পূর্বে অর্থাৎ ৪০০ শকের কাছাকাছি গীতা প্রচলিত ছিল । এক্ষণে দেখা যাক্‌, ইহারও পূর্বে কিরূপে এবং কতটা যাওয়া যাইতে পারে ।

(২) গীতা কালিদাসবাণভট্টের যে বিদিত ছিল, তাহা ৺তৈলঙ্গ দেখাইয়াছেন । কালিদাসের রঘুবংশে [১০|৩১] বিষ্ণুস্তুতিতে “অনবাপ্ত মবাপ্তব্যং ন তে কিঞ্চন বিদ্যতে” এই শ্লোক আছে, তাহা গীতার “অনবাপ্ত মবাপ্তব্যং” [৩|২২] এই শ্লোকে পাওয়া যায়; এবং বাণভট্টের কাদম্বরীর “মহাভারতমিবানন্তগীতাকর্ণনানন্দিততরং” এই এক শ্লেষপ্রধান বাক্যে গীতার স্পষ্ট উল্লেখ আসিয়াছে । কালিদাস এবং ভারবির স্পষ্টত উল্লেখ ৬৯১ সম্বতের (শকাব্দ ৫৫৬) এক শিলালিপিতে পাওয়া যায়; এবং এক্ষণে ইহাও নির্ধারিত হইয়াছে যে, বাণভট্ট ৬৬৩ সম্বতের (৫২৮ শকাব্দের) কাছাকাছি হর্ষরাজার নিকটে ছিলেন । ৺পাণ্ডুরং গোবিন্দ শাস্ত্রী পারখী স্বকীয় বাণভট্টসম্বন্ধীয় এক মারাঠী প্রবন্ধে ইহার বিচার করিয়াছেন ।

(৩) জাবা দ্বীপে যে মহাভারত এখান হইতে যায় তদন্তৰ্গত ভীষ্মপর্বে এক গীতা প্ৰকরণ আছে এবং তাহাতে গীতার বিভিন্ন অধ্যায়ের প্রায় একশো সওয়া-শো শ্লোক অক্ষরশঃ পাওয়া যায় । কেবল ১২, ১৫, ১৬ ও ১৭ এই চার অধ্যায়ের শ্লোক তাহাতে নাই । কাজেই এরূপ বলায় কোন  প্ৰত্যবায় নাই যে, তখনও গীতার স্বরূপ বর্তমানেরই সদৃশ ছিল । কারণ, কবিভাষার ইহা গীতার অনুবাদ এবং তাহাতে যে সংস্কৃত শ্লোক পাওয়া যায় তাহা মধ্যে মধ্যে উদাহরণ এবং প্রতীকস্বরূপে গৃহীত হইয়াছে । সুতরাং ঐ পরিমিত শ্লোকই যে সে সময়ে গীতায় ছিল এরূপ অনুমান করা যুক্তিসিদ্ধ নহে । ডাঃ নরহরি গোপাল সরদেশাই জাবা দ্বীপে যখন গিয়াছিলেন, তখন তিনি এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিয়াছিলেন । কলিকাতার মডর্ণ রিভিউ” নামক মাসিকের ১৯১৪ জুলাই সংখ্যায় এবং তৎপূর্বে পুণারচিত্রময় জগৎ” মাসিকেও উহা প্ৰকাশিত হইয়াছে । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, ৪০০/৫০০ শকাব্দের পূর্বে অন্যূন ২০০ বৎসর পৰ্যন্ত, মহাভারতের ভীষ্মপর্বে গীতা ছিল এবং উহার শ্লোকও এখনকার গীতা-শ্লোকের ক্রমপরম্পরা অনুসারেই ছিল ।

(৪) বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে ভগবদ্গীতার ধরণে রচিত অন্য যে সকল গীতা দেখা যায় কিংবা উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহাদের বিবরণ এই গ্রন্থের প্রথম প্ৰকরণে প্রদত্ত হইয়াছে । ইহা হইতে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, তখন ভগবদগীতা প্রমাণ ও পূজ্য বলিয়া বিবেচিত হইত । তাই তাহার উক্ত প্রকারে অনুকরণ করা হইয়াছে, এবং ঐরূপ না হইলে কেহই তাহার অনুকরণ করিত না । অতএব সিদ্ধ হয় যে, এই পুরাণসমূহের মধ্যে অত্যন্ত প্রাচীন যে পুরাণ তাহা অপেক্ষাও ভগবদ্গীতা অন্ততঃ দুই-একশো বৎসর অধিক প্রাচীন অবশ্য হইবে । পুরাণকালের প্রারম্ভ, খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী অপেক্ষা অধিক আধুনিক বলিয়া মনে করা যায় না, অতএব গীতার কাল অন্যূন শকারম্ভের অল্প পূৰ্ববর্তী বলিয়াই স্বীকার করিতে হয় ।

(৫) উপরে বলিয়াছি যে, গীতা কালিদাসের ও বাণের বিদিত ছিল । কালিদাসের পূর্ববর্তী ভাস কবির নাটকগুলি সম্প্রতি ছাপা হইয়াছে । তন্মধ্যে ‘কৰ্ণভার’ নামক নাটকে দ্বাদশ শ্লোক এইরূপ আছে :-
হতোহপি লভতে স্বৰ্গং জিত্বা তু লভতে যশঃ ৷
উভে বহুমতে লোকে নাস্তি নিষ্ফলতা রণে ॥ 
এই শ্লোক গীতার “হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং” [গী|২|৩৭] এই শ্লোকের সহিত সমানার্থক । এবং যখন ভাস কবির অন্য নাটক হইতে দেখা যায় যে, তাঁহার মহাভারতের সহিত পূর্ণ পরিচয় ছিল, তখন তো ইহা অনুমান করিতে কোনও বাধা নাই যে, উপরিপ্রদত্ত শ্লোকটি লিখিবার সময় গীতার শ্লোকটি তাঁহার মনের সম্মুখে নিশ্চয়ই আসিয়াছিল । অর্থাৎ ইহা সিদ্ধ হইতেছে যে, ভাসকবির পূর্বেও মহাভারত ও গীতার অস্তিত্ব ছিল । পণ্ডিত ত• গণপতি শাস্ত্রী স্থির করিয়াছেন যে, ভাস কবির কাল শকপূর্ব দুই-তিনশত বৎসর হইবে । কিন্তু কেহ কেহ মনে করেন যে, তাঁহার কাল শকাব্দের দুই একশো বৎসর পরে হইবে । এই দ্বিতীয় মতকে ঠিক মনে করিলেও উপরি-উক্ত প্ৰমাণ হইতে সিদ্ধ হয় যে, ভাসের অন্যূন একশো দুশো বৎসর পূর্বে অর্থাৎ শককালের আরম্ভে মহাভারত ও গীতা এই দুই গ্ৰন্থ সৰ্বমান্য হইয়াছিল ।

(৬) কিন্তু প্ৰাচীন গ্ৰন্থকারগণ কর্তৃক গীতার শ্লোক গ্ৰহণ করিবার আরও বলবত্তর প্রমাণ ৺ত্র্যম্বক গুরুনাথ কালে গুরুকুলের ‘বৈদিক ম্যাগাজিন’ নামক ইংরেজী মাসিক পুস্তকে [পুস্তক|৭, সংখ্যা ৬৭ পৃঃ ৫২৮-৫৩২, অগ্রহায়ণ ও পৌষ, সংবৎ ১৯৭০] প্ৰকাশ করিয়াছেন । ইহার পূর্বে পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগের এইরূপ ধারণা ছিল যে, সংস্কৃত কাব্য কিংবা পুরাণ অপেক্ষা প্ৰাচীন কোন গ্রন্থে (উদাহরণার্থ সূত্রগ্রন্থেও) গীতার উল্লেখ পাওয়া যায় না; এবং সেইজন্য বলিতে হয় যে, সূত্রকালের পর, অর্থাৎ বড় জোর খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে গীতা রচিত হইয়া থাকিবে । কিন্তু ৺কালে সপ্ৰমাণ করিয়াছেন যে, এই ধারণা ভ্রান্ত । বৌধায়ন গৃহ্যশেষসূত্রে [২|২২|৯] গীতার [৯|২৬] শ্লোক “তদাহ ভগবান্‌” বলিয়া স্পষ্ট গৃহীত হইয়াছে, যথা - দেশাভাবে দ্রব্যাভাবে সাধারণে কুর্য্যান্মনসা বার্চয়েদিতি । তদাহ ভগবান -
পত্ৰং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্ৰযচ্ছতি ৷
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্ৰযতাত্মনঃ ॥ ইতি
এবং পরে উক্ত হইয়াছে যে, ভক্তিনম্র হইয়া এই মন্ত্র বলিবে — “ভক্তিনম্রঃ এতান্‌ মন্ত্রানধীয়ীত” । এই গৃহ্যশেষসূত্রেরই তৃতীয় প্রশ্নের শেষে “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” এই দ্বাদশাক্ষর মন্ত্র জপ করিলে অশ্বমেধের ফললাভ হয়, ইহাও উক্ত হইয়াছে । ইহা হইতে সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় যে, বৌধায়নের পূর্বে গীতা প্ৰচলিত ছিল এবং বাসুদেব-পূজাও সর্বমান্য হইয়াছিল । ইহা ব্যতীত বৌধায়নের পিতৃমেধসূত্রের তৃতীয় প্রশ্নের আরম্ভেই এই বাক্য আছে :-
জাতস্য বৈ মনুষ্যস্য ধ্রুবং মরণমিতি বিজানীয়াত্তস্মাজ্জাতে 
ন প্ৰহৃষ্যেন্মৃতে চ ন বিষীদেত ।
ইহা হইতে সহজেই দেখা যায় যে, ইহা গীতার “জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুঃ ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ । তস্মাদপরিহাৰ্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমৰ্হসি” এই শ্লোক হইতে সূচিত হইয়া থাকিবে; এবং উহার সহিত উপরিপ্রদত্ত “পত্ৰং পুষ্পং” এই শ্লোক যোগ দিলে তো কোন সংশয়ই থাকে না । উপরে বলিয়াছি যে, স্বয়ং মহাভারতের এক শ্লোক বৌধায়নসূত্রে পাওয়া যায় । বুহ্লর সাহেব স্থির করিয়াছেন যে, বৌধায়নের কাল আপস্তম্বের দুই এক শত বৎসর পূর্ববর্তী হইবে এবং আপস্তম্বের কাল খৃষ্টপূর্ব তিন শত বৎসরের কম হইতে পারে না (See Sacred Books of the East Series. Vol ll. Intro p. xliii, and also the same Series Vol XIV, Intro, p. xliii.) । কিন্তু আমার মতে উহাকে একটু এদিকে পিছানো উচিত; কারণ মহাভারতে মেষবৃষভাদি রাশি নাই এবং কালমাধবে তো বৌধায়নের “মীন মেষয়োর্মেষবৃষভয়োর্বা বসন্তঃ” এই বচন প্ৰদত্ত হইয়াছে - এই বচনই ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বকীয় ভারতীয় জ্যোতিঃশাস্ত্রেও [পৃঃ ১০২] গ্রহণ করিয়াছেন । ইহা হইতেও ইহাই নিশ্চিত অনুমান হয় যে, মহাভারত বৌধায়নেরও পূৰ্ববর্তী । শকপূর্ব নিদেন চারি শত বৎসর বৌধায়নের সময় হওয়া উচিত এবং শকারম্ভের পাঁচ শত বৎসর পূর্বে মহাভারত ও গীতার অস্তিত্ব ছিল । ৺কালে বৌধায়নের কালকে খৃষ্টপূর্ব সাত আট শত অব্দ ধরিয়াছেন; কিন্তু তাহা ঠিক নহে । বুঝা যায় যে, বৌধায়নের রাশিসম্বন্ধীয় বচন তাঁহার দৃষ্টিগোচর হয় নাই ।

(৭) উপরি-উক্ত প্ৰমাণাদি হইতে যে কোন ব্যক্তিরই ইহা স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে যে, শকপূর্ব প্রায় পাঁচশত অব্দে বর্তমান গীতার অস্তিত্ব ছিল; উহা বৌধায়ন ও আশ্বলায়নেরও বিদিত ছিল; এবং তখন হইতে শঙ্করাচার্যের সময় পৰ্যন্ত উহার পরম্পরা অবিচ্ছিন্নরূপে দেখান যাইতে পারে । কিন্তু এ পৰ্যন্ত যে সমস্ত প্ৰমাণ উল্লিখিত হইয়াছে, সে সমস্ত বৈদিক ধর্মগ্রন্থ হইতে গৃহীত । এক্ষণে সম্মুখে চলিয়া যে সকল প্ৰমাণ দেওয়া যাইবে সেগুলি বৈদিকেতর অর্থাৎ বৌদ্ধ সাহিত্যের । ইহা দ্বারা, গীতার উপরি-উক্ত প্ৰাচীনত্ব স্বতন্ত্রভাবে আরও অধিক বলবৎ ও নিঃসন্দিগ্ধ হইতেছে । বৌদ্ধধর্মের পূর্বেই ভাগবতধর্ম আবির্ভূত হইয়াছিল, এই সম্বন্ধে বুহ্লর ও প্রসিদ্ধ ফরাসী পণ্ডিত সেনার্টের মত পূর্বে প্রদত্ত হইয়াছে; এবং বর্তমান প্রকরণের পরবর্তী ভাগে বৌদ্ধধর্মের বৃদ্ধি কিরূপে হইল, এবং হিন্দুধর্মের সহিত তাহার সম্বন্ধ কি, ইত্যাদি বিষয়ের বিচার, স্বতন্ত্ররূপে করা হইবে । এখানে কেবল গীতার কালসম্বন্ধেই যাহা উল্লেখ করা আবশ্যক তাহাই সংক্ষেপে করা হইবে । ভাগবতধর্ম বৌদ্ধধর্মের পূৰ্ববর্তী, কেবল এইটুকু বলিলেই, গীতাও বুদ্ধের পূর্ববর্তী তাহা নিশ্চয় বলা যাইতে পারে না; কারণ, ভাগবতধর্ম ও গীতাগ্রন্থের আবির্ভাব যে এক সঙ্গেই হইয়াছিল ইহা বলিবার কোন প্রমাণ নাই । অতএব দেখা আবশ্যক যে, বৌদ্ধ গ্রন্থকারগণ গীতাগ্রন্থের স্পষ্ট উল্লেখ কোথাও করিয়াছেন কিনা । প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে স্পষ্ট লিখিত আছে যে, বুদ্ধের সময়ে চারি বেদ, বেদাঙ্গ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ইতিহাস, নিঘণ্টু প্রভৃতি বৈদিক ধর্মগ্রন্থ প্রচলিত হইয়া গিয়াছিল । তাই বৈদিক ধর্ম বুদ্ধের পূর্বেই যে পূৰ্ণতায় উপনীত হইয়াছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নাই । ইহার পর বুদ্ধ যে নুতন পন্থা চালাইয়াছেন, তাহা অধ্যাত্মদৃষ্টিতে অনাত্মবাদী ছিল, কিন্তু উহাতে - যাহা পরবর্তী ভাগে বলা যাইবে - আচরণদৃষ্টিতে উপনিষদেয় সন্ন্যাসমার্গেরই অনুকরণ করা হইয়াছিল । অশোকের সময়ে বৌদ্ধধর্মের এই অবস্থা পরিবর্তিত হয় । বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ বনবাস ত্যাগ করিয়া ধর্মপ্রচার ও পরোপকারের কাজ করিবার জন্য পূর্বদিকে চীনদেশে এবং পশ্চিমদিকে আলেকজান্দ্ৰিয়াগ্রীস পৰ্যন্ত গিয়াছিলেন । বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে, বনবাস ছাড়িয়া লোক সংগ্রহের কাজ করিবার জন্য বৌদ্ধ যতি কিরূপে প্ৰবৃত্ত হইলেন ? বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন গ্ৰন্থ দেখ । সুত্তনিপাতের খগ্‌গবিসাণসুত্তে উক্ত হইয়াছে যে, যে ভিক্ষু পূৰ্ণ অর্হৎ অবস্থায় পৌঁছিয়াছেন তিনি কিছু না করিয়া গণ্ডারের মত বনে বাস করুন । এবং মহাবগ্‌গে [৫|১|২৭] বুদ্ধের শিষ্য সোনকোলীবিসের কথায় স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে “যে ভিক্ষু নির্বাণাবস্থায় পৌঁছিয়াছেন, তাঁহার না কিছুই করিবার থাকে, আর না তাঁহাকে কৃত কর্মই ভোগ করিতে করিতে হয়” - ‘কতস্‌স পটিচয়ো নত্থি করণীয়ং ন বিজ্জতি’ । ইহা শুদ্ধ সন্ন্যাসমার্গ; এবং আমাদিগের ঔপনিষদিক সন্ন্যাসমার্গের সহিত ইহার সম্পূর্ণ ঐক্য আছে । ‘করণীয়ং ন বিজ্জতি’ এই বাক্য “তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে” এই গীতাবাক্যের সহিত শুধু সমানার্থক নহে, কিন্তু শব্দশও একই । কিন্তু বৌদ্ধভিক্ষুর যখন এই মূল সন্ন্যাসমূলক আচার পরিবর্তিত হইল এবং যখন উহাঁরা পরোপকারের কাজে প্ৰবৃত্ত হইলেন তখন পুরাতন ও নূতন মতের মধ্যে বিবাদ বাধিল; পুরাতন লোকেরা আপনাদিগকে “থেরবাদ” (বৃদ্ধপন্থা) বলিতে লাগিল, এবং নূতন মতের লোকেরা আপন পন্থার ‘মহাযান’ এই নাম দিয়া পুরাতন পন্থাকে ‘হীনযান’ অর্থাৎ (হীন পন্থা) বলিতে লাগিল । অশ্বঘোষ মহাযানপন্থাবলম্বী ছিলেন; এবং বৌদ্ধ যতিরা পরোপকারের কাজ করিবে এই মত তাঁহার গ্রাহ্য ছিল; তাই, সৌন্দরানন্দ [১৮|৪৪] কাব্যের শেষে নন্দ অৰ্হৎ অবস্থায় পৌঁছিলে পর তাঁহাকে বুদ্ধ যে উপদেশ দিয়াছিলেন তাহার প্রথমে উক্ত হইয়াছে -
অবাপ্তকারয্যোহসি পরাং গতিং গতঃ
ন তেহস্তি কিঞ্চিৎ করণীয়মণ্বপি ৷
অর্থাৎ “তোমার কাৰ্য শেষ হইয়াছে; উত্তম গতি তুমি লাভ করিয়াছ, এখন তোমার (নিজের) তিলমাত্র কর্তব্যও অবশিষ্ট নাই”; এবং পরে এইরূপ স্পষ্ট উপদেশ করিয়াছেন যে, -
বিহার তস্মাদিহ কাৰ্যমাত্মনঃ 
কুরু স্থিরাত্মন্‌ পরকার্য্যমপ্যথো ॥ 
অতএব এখন তুমি আপন কাৰ্য ছাড়িয়া স্থিরবুদ্ধি হইয়া পরকাৰ্য করিতে থাক[সৌ|১৮|৫৭] । বুদ্ধের কর্মত্যাগমূলক উপদেশ - যাহা প্ৰাচীন ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় - এবং সৌন্দরানন্দ কাব্যে অশ্বঘোষ বুদ্ধের মুখ দিয়া যাহা বাহির করাইয়াছেন সেই উপদেশ, এই দুইয়ের মধ্যে অত্যন্ত ভিন্নতা আছে । আবার অশ্বঘোষের এই উক্তিসমূহে এবং গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে যে যুক্তি প্রয়োগ আছে, উহাতে ‘তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ ‘তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর’ [গী|৩|১৭, ১৯] অর্থাৎ তোমার কিছুই বাকী নাই, তাই যে কর্ম প্ৰাপ্ত হইবে, তাহাই তুমি নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর - কেবল অর্থদৃষ্টিতে নহে, শব্দশও সাম্য আছে । অতএব ইহা হইতে অনুমান হয় যে, অশ্বঘোষ এই যুক্তি গীতা হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন । ইহার কারণ উপরে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, অশ্বঘোষের পূর্বেও মহাভারত ছিল । কিন্তু ইহা কেবল অনুমানমাত্র নহে । বুদ্ধধর্মাবলম্বী তারানাথ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সম্বন্ধে তিববতী ভাষায় যে গ্ৰন্থ লিখিয়াছেন, তাহাতে লিখিত হইয়াছে যে, বৌদ্ধদিগের পূর্বকালীন সন্ন্যাসমার্গে মহাযান পন্থা যে কর্মযোগমূলক সংস্কার করিয়াছিল উহা ‘জ্ঞানী শ্ৰীকৃষ্ণ ও গণেশ’ হইতে মহাযানপন্থার প্রধান প্ৰবর্তক নাগার্জুনের গুরু রাহুলভদ্র জানিতেন । এই গ্ৰন্থ রুষীয় ভাষার মধ্য দিয়া জর্মন ভাষায় ভাষান্তরিত হইয়াছে, ইংরাজীতে হয় নাই । ডাঃ কেৰ্ণ ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে যে পুস্তক লেখেন তাহাতে যাহা উদ্ধৃত হইয়াছে, সেই উদ্ধৃতাংশ হইতে আমি ইহা গ্ৰহণ করিয়াছি । (See Dr. Kern’s “Manual of India Buddhism”. Grundriss III, 8, p.122, মহাযান পন্থার ‘অমিতাযুসুত্ত’ নামক মুখ্য গ্রন্থ চিনীয় ভাষায় আনুমানিক ১৫৮ সনে ভাষান্তরিত হইয়াছে ।) এই স্থলে শ্ৰীকৃষ্ণের নামে ভগবদ্গীতারই উল্লেখ করা হইয়াছে, এইরূপ ডাঃ কের্ণেরও মত । মহাযানপন্থার বৌদ্ধগ্রন্থের মধ্যে ‘সদ্ধন্মপুণ্ডরীক’ নামক গ্রন্থেও ভগবদ্গীতার শ্লোকের মত কতকগুলি শ্লোক আছে । কিন্তু এই সমস্ত এবং অন্য সমস্ত বিষয়ের বিচার পরবর্তী ভাগে করা যাইবে । এখানে কেবল বলিতে হইবে যে, বৌদ্ধগ্রন্থকারদিগেরই মতে মূল বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসপ্রধান হইলেও উহাতে ভক্তিপ্রধান ও কর্মপ্ৰধান মহাযানপন্থার উৎপত্তি ভগবদ্গীতারই কারণে হইয়াছে; এবং অশ্বঘোষের কাব্য ও গীতার মধ্যে যে সাম্য প্রদর্শিত হইয়াছে তাহা হইতেও এই অনুমান আরও দৃঢ় হয় । মহাযানপন্থার প্রথম প্ৰবর্তক নাগার্জুন শাকপূর্ব প্ৰায় একশো দেড়শো অব্দে আবির্ভূত হইয়া থাকিবেন, এইরূপ পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন; এবং এই পন্থার বীজারোপণ অশোকের আমলে অবশ্য হইয়াছিল, ইহা তো স্পষ্টই দেখা যায় । বৌদ্ধ গ্ৰন্থ হইতে এবং স্বয়ং বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারগণের লিখিত বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস হইতে, স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধ হয় যে, মহাযান বৌদ্ধপন্থা বাহির হইবার পূর্বে - অশোকেরও পূর্বে - অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্ৰায় ৩০০ বৎসর পূর্বেই ভগবদ্গীতার অস্তিত্ব ছিল ।


4) সিদ্ধান্ত


এই সকল প্ৰমাণের উপর বিচার করিলে, শালিবাহন শকের প্রায় ৫০০ বৎসর পূৰ্বেই বর্তমান ভগবদ্গীতার অস্তিত্ব ছিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকে না । ডাঃ ভাণ্ডারকর, ৺তৈলঙ্গ, রাও বাহাদুর চিন্তামণি রাও বৈদ্য এবং ৺দীক্ষিত, ইহাদের মতও অনেকটা এইরূপই এবং উহাই এই প্ৰকরণে গ্ৰাহ্য বলিয়া মানিতে হইবে । প্ৰোঃ গার্বের মত অন্যরূপ । তাহার মতের প্রমাণস্বরূপে তিনি গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সম্প্রদায়পরম্পরার শ্লোকের মধ্যে, ‘যোগো নষ্টঃ’ যোগ নষ্ট হইল - এই বাক্য ধরিয়া যোগ শব্দের অর্থ ‘পাতঞ্জল যোগ’ করিয়াছেন । কিন্তু আমি প্ৰমাণসহ দেখাইয়াছি যে, যোগ শব্দের অর্থ সেখানে ‘পাতঞ্জল যোগ’ নহে, ‘কর্মযোগ’ । অতএব প্ৰোঃ গার্বের মত ভ্ৰান্তিমূলক ও অগ্ৰাহ্য । বর্তমান গীতার কাল শালিবাহন শকের পাঁচশত বৎসর পূর্বের অপেক্ষা আর কম স্বীকার করা যায় না, ইহা নির্বিবাদ । পূর্বভাগে ইহা বলিয়াই আসিয়াছি যে, মূলগীতা ইহা অপেক্ষাও আরও কয়েক শতাব্দী প্ৰাচীন হইবে ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>