Sunday, June 4, 2017

কর্মযোগশাস্ত্র (Science of Right Action)

কর্মযোগশাস্ত্র


তস্মাদ্যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্ম্মসু কৌশলম্‌ ৷ [গীতা|২|৫০]

(“অতএব তুমি যোগ অবলম্বন কর । কর্ম করিবার যে শৈলী, চাতুর্য, কিংবা কুশলতা তাহাকেই যোগ বলে ।”)


সূচীপত্র



1) কর্মজিজ্ঞাসার মহত্ব
2) গীতার প্রথম অধ্যায় ও কর্মযোগশাস্ত্রের প্রয়োজন
3) গুঢ়াৰ্থ শব্দের অর্থনির্ণয়
3.1) কর্ম শব্দের অর্থনির্ণয়
3.1.1) শ্রৌত কর্ম
3.1.2) স্মার্ত কর্ম (চাতুর্বর্ণ্য)
3.1.3) পৌরাণিক কর্ম
3.1.4) গীতায় কর্মের ব্যাপক অর্থ
3.2) যোগ শব্দের অর্থনির্ণয়
3.2.1) গীতায় যোগ = কর্মযোগ
4) কর্ম-অকর্মের পর্যায় শব্দ
5) শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনের তিন পন্থা -
5.1) আধিভৌতিক পন্থা
5.2) আধিদৈবিক পন্থা
5.3) আধ্যাত্মিক পন্থা
6) শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনের এই পন্থাভেদের কারণ
6.1) কোঁতের মত
7) গীতা অনুসারে অধ্যাত্মদৃষ্টির শ্রেষ্ঠতা
8) ধর্ম শব্দের দুই অর্থ, পারলৌকিক ও ব্যবহারিক
9) চাতুর্বর্ণ্য আদি ধর্ম
10) জগতের ধারণ করে এই জন্য ধর্ম
11) চোদনালক্ষণ-ধর্ম
12) ধর্ম-অধর্মের নির্ণয় করিবার সাধারণ নিয়ম
12.1) ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ’
12.1.1) এই পন্থার দোষ
12.2) ‘অতি সর্বত্র’ এবং উহার অপূর্ণতা
12.3) অবিরোধের দ্বারা ধর্ম-নির্ণয়
13) কর্মযোগশাস্ত্রের কার্য


1) কর্মজিজ্ঞাসার মহত্ব


কোন শাস্ত্রের জ্ঞানলাভার্থ যদি কোন ব্যক্তির পূর্ব হইতে ইচ্ছা না থাকে, তবে সে ব্যক্তি সে শাস্ত্রের জ্ঞানলাভের অনধিকারী হয় । এইরূপ অনধিকারী ব্যক্তিকে ঐ শাস্ত্ৰ শিক্ষা দেওয়া আর উল্টানো কলসে জল ভরা - একই কথা । শিষ্যের তাহা হইতে কোন ফল হয় না, - শুধু তাহা নহে, গুরুরও অকারণ শ্রম হয়; উভয়েরই সময় ব্যর্থ হইয়া যায় । জৈমিনি এবং বাদরায়ণের সূত্রের আরম্ভে “অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা”“অথাতো ব্ৰহ্মজিজ্ঞাসা” এইরূপ সূত্র এই কারণেই স্থাপিত হইয়াছে । ব্ৰহ্মোপদেশ যেরূপ মুমুক্ষুকে, ধর্মোপদেশ যেরূপ ধর্মজিজ্ঞাসুকে দেওয়া উচিত, সেইরূপ, সংসারে কর্ম কিরূপে করিতে হইবে, ইহার তত্ত্ব জানিবার ইচ্ছা কিংবা জিজ্ঞাসা যাহার হইয়াছে, তাহাকেই কর্মশাস্ত্ৰোপদেশ দেওয়া উচিত; এবং এই জন্যই প্ৰথম প্ৰকরণে ‘অথাতো’ করিয়া, দ্বিতীয় প্রকরণে কর্মজিজ্ঞাসার স্বরূপ ও কর্মযোগশাস্ত্রের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমি একটা মোটামুটি আলোচনা করিয়াছি । অমুক স্থানে আমার আটকাইতেছে এইরূপ প্ৰথমেই অনুভবে আসা ব্যতীত, আটক বাধা হইতে মুক্তিলাভের পক্ষে শাস্ত্রের যে কতটা গুরুত্ব তাহা আমাদের উপলব্ধি হয় না এবং উহার গুরুত্ব উপলব্ধি না হওয়ায়, কেবল মুখে আওড়ানো শাস্ত্ৰ পরে মনে রাখাও কঠিন হইয়া পড়ে । এই জন্য সদগুরু শিষ্যের জিজ্ঞাসা অর্থাৎ জানিবার ইচ্ছা আছে কিনা তাহাই দেখেন, যদি না থাকে তবে তাহাকে জাগ্ৰত করিবার জন্য প্ৰযত্ন করিয়া থাকেন । 


2) গীতার প্রথম অধ্যায় ও কর্মযোগশাস্ত্রের প্রয়োজন


গীতার কর্মযোগশাস্ত্রের বিচার-আলোচনা এই পদ্ধতি অনুসারেই করা হইয়াছে । যে যুদ্ধে নিজের হাতে পিতৃবধ ও গুরুবধ হইয়া সকল রাজাদিগের ও ভ্রাতাদিগেরও ক্ষয় হইবার কথা, সেই ঘোরতর যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হওয়া উচিত কি অনুচিত, এই সংশয় অর্জুনের মনে উদয় হওয়ায় অর্জুন যুদ্ধ ছাড়িয়া সন্ন্যাস অবলম্বন করিতে যখন প্ৰস্তুত হইলেন, এবং প্ৰাপ্ত কর্ম ছাড়িয়া দেওয়া পাগলামি ও দুর্বলতার লক্ষণ হওয়ায় তাহাতে স্বৰ্গপ্রাপ্তি হওয়া দূরে থাকুক, উল্টা শুধু দুষ্কীর্তিই লাভ হইবে; এইরূপ সাধারণ ধরণের যুক্তিবাদেও যখন তাহার সমাধান হইল না, তখন “অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে” - তুমি অশোচ্যের জন্য শোক করিতেছ এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানের বড় বড় কথা আমাকে বলিতেছ - শ্ৰীকৃষ্ণ একটু উপহাসের ভাবে ইহা বলিয়া অর্জুনকে কর্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়াছেন । অর্জুনের সংশয় ভিত্তিহীন না হওয়ায়, বড় বড় পণ্ডিতেরাও প্ৰসঙ্গবিশেষে “কি করিবে কি করিবে না” এই বিষয়ে যেরূপ হতবুদ্ধি হইয়া পড়েন তাহা আমি পূর্ব প্রকরণে দেখাইয়াছি । কিন্তু কর্মাকর্মের বিচারে অনেক কঠিন সমস্যার উদ্ভব হয় বলিয়া কর্ম ত্যাগ করা যুক্তিসিদ্ধ নহে; যাহাতে জাগতিক কর্মের লোপ না হইয়া, কেবলমাত্ৰ কর্মজনিত পাপ বা বন্ধন আমাতে না লাগে, এই প্রকারের ‘যোগ’ অর্থাৎ যুক্তি বুদ্ধিমান ব্যক্তির মানিয়া লণ্ডয়া আবশ্যক । অতএব “হে অর্জুন তুমিও এই যুক্তি স্বীকার কর” – তস্মাদ্‌যোগায় যুজ্যস্ব - ইহা অর্জুনের প্রতি শ্ৰীকৃষ্ণের প্রথম বক্তব্য । এই ‘যোগ’ই “কর্মযোগশাস্ত্ৰ” । অর্জুন যে সমস্যায় পড়িয়াছিলেন, সেই সমস্যা-প্ৰসঙ্গ কিছু অলৌকিক ছিল না - সংসারে এই প্রকারের ছোট বড় অনেক সংকট সকলের নিকটেই উপস্থিত হয় । তাই ভগবদ্গীতায় কর্মযোগশাস্ত্রের যে বিচার করা হইয়াছে তাহা আমাদের সকলেরই শিক্ষণ করা অবশ্য কর্তব্য ।


3) গুঢ়াৰ্থ শব্দের অর্থনির্ণয়


কিন্তু যে কোন শাস্ত্ৰ হউক না, তাহার প্রতিপাদন কল্পে কতকগুলি মুখ্য এবং কতকগুলি গুঢ়াৰ্থ শব্দ প্ৰযুক্ত হয় । ঐ শাস্ত্রের অর্থ ঠিক বুঝিবার জন্য, সেই সকল শব্দের সরল অর্থ এবং সেই শাস্ত্ৰ প্ৰতিপাদনের মূল পন্থাটাও প্রথমে জানা আবশ্যক । নচেৎ পরে উহা বুঝিবার পক্ষে অনেক প্রকার ভুল ও গণ্ডগোল উৎপন্ন হইতে পারে । এই জন্য এই সাধারণ পদ্ধতি অনুসরণ করিয়া প্ৰথমে এই শাস্ত্ৰে ব্যবহৃত কতকগুলি শব্দের অর্থ-পরীক্ষা অগত্যা করিতে হইতেছে ।


3.1) কর্ম শব্দের অর্থনির্ণয়


তন্মধ্যে সর্বপ্রথম শব্দ ‘কর্ম’। ‘কর্ম’ শব্দ কৃ-ধাতু হইতে বাহির হওয়ায় তাহার অর্থ ‘করা’, ‘ব্যাপার’, ‘আচরণ’ - এইরূপ; এবং এই সাধারণ অর্থে ঐ শব্দ ভগবদ্গীতায় ব্যবহৃত হইয়াছে । ইহা বলিবার কারণ এই যে, মীমাংসা-শাস্ত্ৰে কিংবা অন্যত্র এই শব্দের যে সংকুচিত অর্থ প্রদত্ত হইয়াছে, তাহা মনে আনিয়া পাঠক যেন ভ্ৰমে পতিত না হন । 


3.1.1) শ্রৌত কর্ম


যে কোন ধর্মই ধর না কেন, তাহাতে ঈশ্বরকে লাভ করিবার জন্য কোন না কোন কর্ম করিতে বলা হইয়াছে । প্রাচীন বৈদিক ধর্ম অনুসারে বলিতে হইলে, যজ্ঞযাগই সেই কর্ম । বৈদিকগ্রন্থে এই যজ্ঞযাগেরই (অর্থাৎ শ্রৌত কর্ম) বিধি বৰ্ণিত হইয়াছে । কিন্তু এই সম্বন্ধে বৈদিক গ্ৰন্থাদির স্থানে স্থানে কখন কখন বিরোধী বচনও পাওয়া যায়; তাহাদিগের সঙ্গত সমন্বয় কিরূপে হইতে পারে তাহা জৈমিনীয় পূর্বমীমাংসা-শাস্ত্ৰ দেখাইতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন । জৈমিনীয় মতানুসারে, এই বৈদিক ও শ্রৌত যজ্ঞযাগের অনুষ্ঠান করাই মুখ্য প্রাচীন ধর্ম । মানুষ যাহা কিছু করে সবই যজ্ঞের জন্য করে । মানুষের ধন পাইতে হইলে, যজ্ঞের জন্যই পাওয়া চাই; এবং ধান্য সংগ্ৰহ করিলেও তাহা যজ্ঞেরই জন্য বুঝিতে হইবে [মভা|শাং|২৬|২৫] । যখন, যজ্ঞ করিবে – ইহাই বেদের দেবতাদিগের আদেশ, তখন যজ্ঞের জন্য অনুষ্ঠিত কোন কর্ম স্বতন্ত্ররূপে কোন মনুষ্যের বন্ধক ফলদায়ক হয় না । তাহা যজ্ঞের সাধন, স্বতন্ত্ৰ সাধ্য নহে । তাই, যজ্ঞ হইতে যে ফল পাওয়া যায় তাহা যজ্ঞেরই অন্তর্ভূত; উহার অন্য পৃথক্‌ ফল নাই । কিন্তু যজ্ঞার্থে অনুষ্ঠিত এই সকল কর্ম স্বতন্ত্র ফলদায়ক না হইলেও শুধু যজ্ঞের দ্বারাই স্বৰ্গ প্ৰাপ্তি (অর্থাৎ মীমাংসকের মতে একপ্রকারের সুখ প্ৰাপ্তি) হয় এবং সেই স্বৰ্গপ্ৰাপ্তির জন্যই যজ্ঞকর্তা পুরুষ অনুরাগের সহিত যজ্ঞ করিয়া থাকে । সুতরাং স্বয়ং যজ্ঞকর্মই পুরুষাৰ্থ ইহা স্পষ্ট উপলব্ধি হয় । যে বস্তু সম্বন্ধে মনুষ্যের প্রীতি থাকে ও পাইবার ইচ্ছা হয় তাহাকেই পুরুষাৰ্থ বলে [জৈ|সূ|৪|১|১ ও ২] । যজ্ঞের এক পর্যায় শব্দ ‘ক্রতু’; তাই যজ্ঞার্থের বদলে “ক্রত্বর্থ” এই শব্দও ব্যবহৃত হয় । এইরূপ সর্বকর্ম দুই বর্গে বিভক্ত হইয়া থাকে – 
(i) ‘যজ্ঞার্থ’ (ক্ৰত্বৰ্থ) কর্ম অর্থাৎ যাহা স্বতন্ত্ররূপে ফলদায়ক নহে বলিয়া অবন্ধক; এবং 
(ii) ‘পুরুষাৰ্থ’ কর্ম অর্থাৎ যাহা পুরুষের ফলদায়ক বলিয়া বন্ধক । 
সংহিতাব্রাহ্মণগ্রন্থে যাগযজ্ঞাদিরই বর্ণনা আছে । ঋগ্‌বেদ-সংহিতায় ইন্দ্ৰাদি দেবতাদিগের স্তুতিপর সূক্ত আছে সত্য, কিন্তু মীমাংসক বলেন যে তাহাদের বিনিয়োগ যজ্ঞের সময়েই কর্তব্য হওয়ায় সমস্ত শ্রুতিগ্ৰন্থ যজ্ঞাদি কর্মেরই প্ৰতিপাদক । বেদের অন্তর্ভূত যাগযজ্ঞাদি কর্মের অনুষ্ঠান করিলে স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি হয়, নতুবা হয় না; অতএব ঐ যাগযজ্ঞ তুমি অজ্ঞানে কর কিংবা ব্রহ্মজ্ঞানপূর্বক কর, একই ফল - এইরূপ এই কর্মনিষ্ঠ, যাজ্ঞিক ও নিছক্‌ কর্মবাদীরা বলিয়া থাকেন । উপনিষদে এই যজ্ঞ গ্ৰাহ্য বলিয়া ধৃত হইলেও, উহার যোগ্যতা ব্ৰহ্মজ্ঞান অপেক্ষা কম বলিয়া যজ্ঞের দ্বারা স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি হইলেও প্ৰকৃত মোক্ষলাভের পক্ষে ব্ৰহ্মজ্ঞানও আবশ্যক আছে এইরূপ প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে “বেদবাদরতাঃ পাৰ্থ নান্যদস্তীতিবাদিনঃ” [গী|২|৪২] প্ৰভৃতি বাক্যে যে যাগযজ্ঞাদি কাম্যকর্ম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে তাহা বিনা ব্ৰহ্মজ্ঞানে অনুষ্ঠিত উপরিউক্ত যাগযজ্ঞাদি কর্ম । সেইরূপ “যজ্ঞার্থাৎ কর্মণোহন্যত্ৰ লোকোহয়ং কর্মবন্ধনঃ” - যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধন হয় না, বাকী সব কর্ম বন্ধন হইয়া থাকে [গী|৩|৯], ইহাই মীমাংসকদিগের মতের অনুবাদ । 


3.1.2) স্মার্ত কর্ম (চাতুর্বর্ণ্য)


এই যাগযজ্ঞাদি বৈদিক অর্থাৎ শ্রৌত কর্ম ব্যতীত, ধর্মদৃষ্টিতে অন্য আবশ্যক কর্মও চাতুর্বর্ণ্যভেদে মনুস্মৃত্যাদি ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে, যথা - ক্ষত্ৰিয়ের যুদ্ধ, বৈশ্যের বাণিজ্য প্রভৃতি । এই সকল কর্ম প্রথমতঃ স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতেই পদ্ধতিপূর্বক প্রতিপাদিত হওয়ায়, ইহাদিগকে ‘স্মার্ত কর্ম’ কিংবা ‘স্মার্ত যজ্ঞ’ এমনও বলা হইয়া থাকে । 


3.1.3) পৌরাণিক কর্ম


এই শ্রৌত ও স্মার্ত কর্ম ব্যতীত অপর কতকগুলি ধর্মকর্ম - যথা, ব্ৰত উপবাস প্রভৃতি - কেবল পুরাণ গ্ৰন্থাদিতেই প্ৰথমে সবিস্তার প্রতিপাদিত হওয়ায় উহাদিগকে ‘পৌরাণিক কর্ম’ বলিতে পারিব । এই সমস্ত কর্মের আবার নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য, এই তিন ভেদ নিরূপিত হইয়াছে । 
(i) নিত্য কর্ম - আবশ্যক স্নান-সন্ধ্যাদি কর্মই নিত্য কর্ম । ইহা করিলে কোন বিশেষ ফল কিংবা অর্থসিদ্ধি হয় না; কিন্তু না করিলেই দোষ হয় । 
(ii) নৈমিত্তিক কর্ম - কোন কারণ উপস্থিত হওয়ায় যাহা করা আবশ্যক হয় সেই নৈমিত্তিক কর্ম, যথা – অনিষ্ট-গ্রহ-শান্তি, প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি । যে নিমিত্ত আমরা শান্তিশ্বস্ত্যয়ন করি, কিংবা প্রায়শ্চিত্ত করি, সেই ঘটনা পূর্বে না ঘটিলে এই সকল নৈমিত্তিক কর্ম করিবার প্রয়োজন নাই । 
(iii) কাম্য কর্ম - ইহা ব্যতীত, কোন বিশেষ বিষয়ের ইচ্ছা হইলে তাহার প্রাপ্তির নিমিত্ত আমরা অনেক সময় শাস্ত্রানুসারে যে সকল কাজ করি, তাহাই কাম্য কর্ম, যথা – বৃষ্টির জন্য কিংবা পুত্রলাভের জন্য যজ্ঞ করা । 
(iv) নিষিদ্ধ কর্ম - নিত্য, নৈমিত্তিক ও কাম্য - ইহা ব্যতীত অন্য কর্মকে নিষিদ্ধ কর্ম বলে, যথা - সুরাপান শাস্ত্ৰে একেবারেই ত্যাজ্য বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে । 


3.1.4) গীতায় কর্মের ব্যাপক অর্থ


কোনটা নিত্যকর্ম, কোনটা নৈমিত্তিক, কোনটা কাম্য এবং কোনটাই বা নিষিদ্ধ, তাহা ধর্মশাস্ত্ৰ নির্ধারিত করিয়া দিয়াছে । অমুক ব্যক্তির কৃত অমুক কর্ম পাপজনক না পুণ্যপ্ৰদ, কোন ধর্মশাস্ত্রীকে যদি এইরূপ প্রশ্ন করা যায়, তবে তিনি সেই শাস্ত্ৰ অনুসারে উক্ত কর্ম যজ্ঞার্থ বা পুরুষার্থ, নিত্য কি নৈমিত্তিক, কাম্য কি নিষিদ্ধ, ইত্যাদি বিচার করিয়া পরে তাঁহার নিজের নির্ণয়টা বলিবেন । কিন্তু ভগবদ্গীতার দৃষ্টি ইহা অপেক্ষাও ব্যাপক - অধিক কি, উহাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে বলিলেও হয় । মনে কর, শাস্ত্ৰে কোন-এক কর্ম নিষিদ্ধ বলিয়া স্বীকৃত হয় নাই, অধিক কি, উহা বিহিত বলিয়া আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পরিগণিত হইয়াছে; উদাহরণ যথা - উপস্থিত প্রসঙ্গে ক্ষাত্ৰধর্ম অর্জুনের পক্ষে বিহিত ছিল । কিন্তু ইহা হইতে এটুকু সিদ্ধ হইতেছে না যে ঐ সকল কর্ম আমরা সর্বদা করিব, অথবা ঐরূপ কর্ম করিলে তাহা সর্বদাই শ্ৰেয়স্কর হইবে । তাছাড়া, শাস্ত্রের আদেশও যে কোন কোন প্রসঙ্গে পরস্পরবিরুদ্ধ হইয়া থাকে তাহা পূর্বপ্ৰকরণে দেখাইয়াছি । এরূপ অবস্থায়, মানুষ কোন মাৰ্গ স্বীকার করিবে, তাহা স্থির করিবার কোন যুক্তি আছে কি না এবং যদি থাকে তো সে যুক্তিটি কি, - ইহাই গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় । এই বিষয়ে কর্মের যে নানা ভেদ উপরে বলা হইয়াছে, তৎপ্ৰতি বিশেষ লক্ষ্য করিবার প্রয়োজন নাই । যাগযজ্ঞাদি বৈদিক কর্ম সম্বন্ধে কিংবা চাতুৰ্বর্ণ্যের অন্য কর্ম সম্বন্ধে মীমাংসকগণ যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাহা গীতা-প্রতিপাদিত কর্মযোগ সম্বন্ধে কতটা প্ৰযুক্ত হইতে পারে তাহা দেখাইবার জন্য, মীমাংসকের উক্তিসকলও গীতায় প্রসঙ্গক্রমে বিচার করা হইয়াছে এবং শেষ অধ্যায়ে যাগযজ্ঞাদি কর্ম জ্ঞানীপুরুষের কর্তব্য কি কর্তব্য নহে, এই প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে [গী|১৮|৬] । কিন্তু গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ইহা অপেক্ষা বেশী ব্যাপক হওয়ায়, গীতাতে ‘কর্ম’ শব্দের অর্থ কেবল শ্রৌত বা স্মার্ত কর্ম, এইরূপ সঙ্কুচিত অর্থে না বুঝিয়া তাহা অপেক্ষা অধিকতর ব্যাপক অর্থে গ্ৰহণ করিতে হইবে । সার কথা, মানুষ যে-যে কাজ করে - খাওয়া, পরা, খেলা, বসা, ওঠা, থাকা, নিঃশ্বাস গ্রহণ করা, হাসা, কাঁদা, আঘ্রাণ করা, দেখা, বলা, শোনা, চলা, দেওয়া, লওয়া, ঘুমান, জাগিয়া থাকা, মারা, লড়াই করা, মনন বা ধ্যান করা, আজ্ঞা বা নিষেধ করা, দান করা, যাগযজ্ঞ করা, চাষ কিংবা বাণিজ্য ব্যবসায় করা, ইচ্ছা করা, নিশ্চয় করা, গল্প করা ইত্যাদি ইত্যাদি কর্ম কায়িকই হউক, বাচনিকই হউক, বা মানসিকই হউক সকল কর্মই এই শব্দের অন্তর্ভুক্ত [গীতা|৫|৮,৯] । অধিক কি, বাঁচা, মরা পৰ্যন্ত সমস্তই কর্মের অন্তর্ভূত; এবং প্রসঙ্গ অনুসারে “বাঁচা কিংবা মরা” এই দুয়ের মধ্যে কোন কর্মে প্ৰবৃত্ত হইবে ইহারও বিচার করা আবশ্যক হয় । এই বিচার উপস্থিত হইলে পর, ‘কর্ম’ শব্দের ‘কর্তব্য কর্ম’ অথবা ‘বিহিত কর্ম’ এই অর্থ হইয়া থাকে [গী|৪|১৬] । মনুষ্যের কর্মসম্বন্ধে এইরূপ বিচার হইল । ইহারও পরে, সমস্ত চরাচর সৃষ্টির, অর্থাৎ অচেতন পদার্থাদির ব্যাপার সম্বন্ধেও এই শব্দের প্রয়োগ হইয়া থাকে । কিন্তু তাহার বিচার পরে কর্মবিপাক প্ৰকরণে করা যাইবে ।


3.2) যোগ শব্দের অর্থনির্ণয়


কর্মাপেক্ষাও অধিক ‘গোলমেলে’ শব্দ হইতেছে – ‘যোগ’ । এই শব্দের বর্তমান প্ৰচলিত অর্থ “প্ৰাণায়ামাদির সাধনের দ্বারা চিত্তবৃত্তি কিংবা ইন্দ্ৰিয়াদির নিরোধ করা” অথবা “পাতঞ্জল সূত্ৰোক্ত সমাধি কিংবা ধ্যানযোগ” । এই অর্থে এই শব্দ উপনিষদেও প্ৰযুক্ত হইয়াছে [কঠ|৬|১১] । কিন্তু এই সঙ্কুচিত অর্থ ভগবদ্গীতাতে সাধারণভাবে বিবক্ষিত হয় নাই ইহা মনে রাখা আবশ্যক, ‘যোগ’ এই শব্দ ‘যুজ্‌’ অর্থাৎ যুড়িয়া দেওয়া এই ধাতু হইতে বাহির হইয়াছে, সুতরাং - উহার ধাত্বর্থ ‘যোড়’ যোড়া, মিলন, সঙ্গতি, একত্রাবস্থিতি ইত্যাদি; এবং ঐরূপ অবস্থা প্ৰাপ্ত হইবার ‘উপায়, সাধন, যুক্তি কিংবা কৌশল’-রূপ যে কর্ম তাহাকেও যোগ বলা হয় । এই সকল অর্থ অমরকোষেও প্রদত্ত হইয়াছে, “যোগঃ সংহননোপায়ধ্যানসঙ্গতিযুক্তিষু” [৩|৩|২২] । ফলিত জ্যোতিষে কোন গ্ৰহ ইষ্ট বা অনিষ্টজনক হইলে সেই গ্রহের ‘যোগ’ ইষ্ট বা অনিষ্টজনক এইরূপ আমরা বলিয়া থাকি; এবং ‘যোগক্ষেম’ এই পদে ‘যোগ’ শব্দের অর্থে অপ্রাপ্ত বস্তু প্ৰাপ্ত হওয়া ধরা গিয়াছে [গী|৯|২২] । মহাভারতীয় যুদ্ধে দ্ৰোণাচার্যকে পরাজয় করিতে পারা যাইতেছে না দেখিয়া তাহাকে পরাভূত করিবার জন্য একই ‘যোগ’ (সাধন বা যুক্তি) - একোহি যোগোহস্য ভবেদ্‌বধায় - এইরূপ শ্ৰীকৃষ্ণ বলিয়াছেন [মভা|দ্রো|১৮১|৩১]; এবং পরে তিনি ইহাও বলিয়াছেন, “আমি জরাসন্ধাদি রাজাদিগকে পূর্বকালে ধর্মরক্ষণার্থ ‘যোগের দ্বারাই’ কি করিয়া বধ করিয়াছিলাম” । ভীষ্ম অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে হরণ করিলে পর অন্য রাজগণ ‘যোগ, যোগ’ বলিয়া তাহাদিগের পশ্চাদ্ধাবন করিলেন এইরূপ উদ্যোগ পর্বে [অ|১৭২] উক্ত হইয়াছে । ইহা ব্যতীত মহাভারতের অনেক স্থানে এই অর্থেই ‘যোগ’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায় । গীতাতে ‘যোগ’, ‘যোগী’ কিংবা যোগ শব্দ হইতে নিষ্পন্ন সামাসিক শব্দ প্ৰায় ৮০ বার প্রযুক্ত হইয়াছে । কিন্তু, খুব যদি বেশী হয়, চারি পাঁচ [গী|৬|১২,২৩] স্থল ছাড়া ‘যোগ’ শব্দের ‘পাতঞ্জল যোগ’ এই অৰ্থ কোথাও অভিপ্রেত হয় নাই । ‘যুক্তি, কৌশল, সাধন, উপায়, যোড়া, মেলা’ এই অর্থই স্বল্পাধিক ভেদে গীতায় সর্বত্ৰ দেখিতে পাওয়া যায় । সুতরাং গীতাশাস্ত্রান্তর্ভূত ব্যাপক শব্দগুলির মধ্যে ইহাও একটি, ইহা বলিতে কোন বাধা নাই । তথাপি যোগ অর্থে সাধন, কৌশল বা যুক্তি, এইরূপ সাধারণভাবে বলিলেও চলে না । কারণ, বক্তার ইচ্ছানুসারে এই সাধন সন্ন্যাসের, কর্মের, চিত্তনিরোধের, মোক্ষের, কিংবা আর কোন কিছুরও হইতে পারে । দৃষ্টান্ত যথা - গীতাতেই দুই চারি স্থানে ভগবানের নানাবিধ ব্যক্ত সৃষ্টি নির্মাণ করিবার ঐশ্বরিক কৌশল বা অদ্ভুত সামর্থ্যের সম্বন্ধে যোগ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে [গী|৭|২৫; ৯|৫; ১০|৭; ১১|৮] । এই অর্থেই ভগবানকে “যোগেশ্বর” বলা হইয়াছে [গী|১৮|৭৫] । কিন্তু গীতান্তর্ভূত যোগশব্দের ইহা কিছু মুখ্যার্থ নহে । তাই গীতায় ‘যোগ’ শব্দের মুখ্য অর্থ কোন বিশেষ প্রকারের কৌশল, সাধন, যুক্তি বা উপায়, ইহা বলিবার জন্য “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” [গী|২|৫০] অর্থাৎ কর্ম করিবার কোন বিশেষ প্রকারের কুশলতা, যুক্তি, চাতুর্য বা শৈলী - এইরূপ এই শব্দের ব্যাখ্যা স্পষ্টরূপে করা হইয়াছে । শাঙ্করভাষ্যেও “কর্মসু কৌশলম্‌” এই পদের “কর্মের যে স্বাভাবিক বন্ধকত্ব তাহা বিনষ্ট করিবার যুক্তি” এইরূপ অর্থই করা হইয়াছে । সাধারণভাবে দেখিতে গেলে, একই কর্মের অনেক ‘যোগ’ বা ‘উপায়’ হইয়া থাকে । কিন্তু তাহার মধ্যে, উত্তম সাধনের সম্বন্ধেই ‘যোগ’ শব্দ বিশেষরূপে প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা - ধনলাভ করিতে হইলে তাহা চুরি করিয়া, ঠকাইয়া, ভিক্ষা করিয়া, সেবা করিয়া, কর্জ করিয়া, মেহনৎ করিয়া ইত্যাদি নানাবিধ সাধনের দ্বারা করা যাইতে পারে; এবং ইহার মধ্যে প্ৰত্যেক সাধনসম্বন্ধে ‘যোগ’ শব্দ ধাত্বর্থ অনুসারে প্রযুক্ত হইতে পারিলেও “আপনার স্বাতন্ত্র্য না হারাইয়া, মেহনৎ করিয়া পয়সা রোজগার করা” এই উপায়ই মুখ্যরূপে ‘ধনপ্রাপ্তি যোগ’ এইরূপ বলা প্রচলিত আছে ।


3.2.1) গীতায় যোগ = কর্মযোগ, এবং তাহাই প্রতিপাদ্য


“যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” - কর্ম করিবার একপ্রকার বিশেষ যুক্তি অর্থাৎ যোগ, যখন স্বয়ং ভগবান গীতায় যোগ শব্দের এইপ্ৰকার বিশেষ ব্যাখ্যা করিয়া দিয়াছেন, তখন বস্তুত গীতায় এই শব্দের মুখ্য অর্থ বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকিতে পারে না । কিন্তু ভগবানকৃত এই ব্যাখ্যার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া গীতার অনেক টীকাকার এই শব্দকে টানিয়া বুনিয়া নানাপ্রকারে গীতার মথিতার্থ বাহির করিয়াছেন; তাই, ভুল-বুঝা দূর করিবার জন্য এইখানে ‘যোগ’ শব্দের আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । সর্বপ্রথমে গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে যোগশব্দের প্রয়োগ হইয়াছে এবং সেই স্থানেই উহার অর্থ কি তাহাও স্পষ্টরূপে উক্ত হইয়াছে । যুদ্ধ করা কেন কর্তব্য, সাংখ্যমাৰ্গানুসারে ইহার যুক্তি বিবৃত করিবার পর, “এক্ষণে তোমাকে যোগশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত বলিতেছি” [গী|২|৩৯] এইরূপ ভগবান, বলিয়াছেন । আবার, যাগযজ্ঞাদি কাম্য কর্মেতে নিমগ্ন লোকদিগের বুদ্ধি , ফল-প্ৰত্যাশার দরুণ কিরূপ ব্যগ্ৰ হইয়া থাকে তাহারও বর্ণনা করিয়াছেন [গী|২|৪১-৪৬] । তাহার পর, তিনি উপদেশ দিয়াছেন যে, বুদ্ধিকে এরূপ ব্যগ্ৰ হইতে না দিয়া “আসক্তি ছাড়, কিন্তু কর্ম ছাড়িয়া দিতে ব্যগ্ৰ হইও না” এবং “যোগস্থ হইয়া কর্ম কর” [গী|২|৪৮] । এইখানেই “সিদ্ধি বা অসিদ্ধি উভয়ে সমত্ববুদ্ধি” ‘যোগ’ শব্দের এই অর্থ স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা হইয়াছে । তাহার পর, “ফলপ্ৰত্যাশায় কর্ম করা অপেক্ষা সমত্ববুদ্ধির যোগই শ্রেষ্ঠ” [গী|২|৪৮], “বুদ্ধি সমতা প্ৰাপ্ত হইলে কর্মের পাপ-পুণ্য-বাধা কর্তাকে স্পর্শ করে না অতএব তুমি এই ‘যোগ’ সম্পাদন কর”, এইরূপ বলিয়া তখনই আবার “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” [গী|২|৫০] যোগের এই লক্ষণ বলিয়াছেন । ইহাতে স্পষ্টই উপলব্ধি হয় যে, কর্মের পাপপুণ্যে লিপ্ত না থাকিয়া কর্ম করিবার সমত্ব-বুদ্ধিরূপ যে বিশেষ যুক্তি প্ৰথমে উক্ত হইয়াছে তাহারই নাম ‘কৌশল’, এবং এই কৌশলের দ্বারা অর্থাৎ যুক্তির দ্বারা কর্ম করা, ইহাকেই গীতাতে ‘যোগ’ বলা হইয়াছে । এই অর্থই পরে “যোহয়ং যোগস্ত্বয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসূদন” [গী|৬|৩৩] “সমতার অর্থাৎ সমত্ববুদ্ধির এই যে যোগ তুমি আমাকে বলিয়াছ”, - এই শ্লোকে অর্জুন আবার স্পষ্ট করিয়াছেন । 

জ্ঞানী মনুষ্য এই জগতে কিরূপভাবে চলিবেন তাহার সম্বন্ধে শ্ৰীশঙ্করাচার্যের পূর্ব অবধি প্ৰচলিত বৈদিক ধর্ম অনুসরণ করিয়া দুই মাৰ্গ আছে । তন্মধ্যে, জ্ঞানী ব্যক্তির সম্বন্ধে সর্ব কর্মের স্বরূপতঃ সন্ন্যাস অর্থাৎ ত্যাগ করা - এই এক মাৰ্গ; এবং জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পরেও কর্মত্যাগ না করিয়া, কর্মের পাপপুণ্য-বাধা না স্পর্শ করে সেইরূপ যুক্তি অনুসারে আমরণ কর্ম করিতে থাকা - এই দ্বিতীয় মার্গ । এই দুই মাৰ্গ গীতাতে [গী|৫|২] সন্ন্যাস ও কর্মযোগ বলিয়া উক্ত হইয়াছে । সন্ন্যাস অর্থাৎ ছাড়া এবং যোগ অর্থাৎ জোড়া; সুতরাং কর্মের ছাড়া ও জোড়াই এই দুই ভিন্ন ভিন্ন মার্গ । এই দুই ভিন্ন মাৰ্গ লক্ষ্য করিয়াই পরে “সাংখ্য ও যোগ” (সাংখ্যযোগৌ) এই সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞাও [গী|৫|১৪] প্রদত্ত হইয়াছে । 

বুদ্ধি স্থির করিবার জন্য পাতঞ্জল যোগান্তর্ভূত আসনাদির বর্ণনা ষষ্ঠ অধ্যায়ে আছে সত্য; কিন্তু তাহা কাহার জন্য ? তপস্বীর জন্য নহে, পরন্তু কর্মযোগীর অর্থাৎ যুক্তির দ্বারা কর্মশীল মনুষ্যের এই সমতারূপ যুক্তি সিদ্ধ করিবার জন্য বলা হইয়াছে । নচেৎ “তপস্বিভ্যোহধিকো যোগী” এই বাক্যের কোনই অর্থ হয় না । সেইরূপ আবার “তস্মাদ্যোগী ভবাৰ্জুন” [৬|৪৬] বলিয়া যে উপদেশ অধ্যায়ের শেষে আছে, তাহার অর্থ “পাতঞ্জল যোগের অভ্যাস করিতে থাক” এইরূপ হইতে পারে না । এই কারণে উক্ত উপদেশের অর্থ “যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি” [২|৪৮], অথবা, পরে “তস্মাদ্যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্” [গী|২|৫০] কিংবা চতুর্থ অধ্যায়ের শেষে “যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ ভারত” [৪|৪২] ইত্যাদি বাক্যের সমানার্থক হওয়া উচিত; অর্থাৎ “যুক্তির দ্বারা কর্মকারী যোগী অর্থাৎ কর্মযোগী হও” – এইরূপ অর্থই গ্ৰহণ করা সঙ্গত । কারণ, “পাতঞ্জল যোগের আশ্রয় করিয়া তুমি যুদ্ধে দাঁড়াও” এ কথা বলা কখনই সম্ভব হইতে পারে না । 

ইতিপূর্বে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, “কর্মযোগেন যোগিনাম্‌” [গী|৩|৩] অর্থাৎ যোগী পুরুষ কর্ম করিয়া থাকেন । মহাভারতে নারায়ণীয় ধর্ম কিংবা ভাগবতধর্মের বিচার-আলোচনাতেও উক্ত হইয়াছে যে, এই ধর্মাবলম্বী লোক আপনার কর্ম না ছাড়িয়াই যুক্তিপূর্বক কর্মসাধনের দ্বারা (সুপ্রযুক্তেন কর্মণা) পরমেশ্বরকে লাভ করে [মভা|শাং|৩৪৮|৫৬] । ইহাতে, যোগী ও কর্মযোগী এই দুই শব্দ গীতাতে সমানার্থক হওয়ায়, উহাদের “যুক্তিপূর্বক কর্মকারী” এইরূপ অর্থই সস্পষ্ট উপলব্ধ হয় । তথাপি ‘কর্মযোগ’ এই ঈষৎ দীর্ঘ শব্দের পরিবর্তে ‘যোগ’ এই সংক্ষিপ্ত শব্দই গীতাতে ও মহাভারতে অধিক ব্যবহৃত হইয়াছে । “আমি তোমাকে এই যে যোগের কথা বলিলাম তাহা পূর্বে বিবস্বানকে বলিয়াছিলাম [গী|৪|১]; বিবস্বান মনুকে বলিয়াছিলেন; কিন্তু ঐ যোগ ইতিপূর্বে নষ্ট হওয়ায় আজ নূতন করিয়া ঐ যোগের কথা তোমাকে বলিতে হইল”, ভগবান ‘যোগ’ শব্দের এই যে তিনবার উল্লেখ করিয়াছেন, এখানে পাতঞ্জল যোগ বিবক্ষিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না, - “কর্ম করিবার কোন এক প্রকারের বিশিষ্ট যুক্তি, সাধন বা মাৰ্গ” এই অর্থই সঙ্গত হয় । সেইরূপ আবার, গীতা-অন্তৰ্গত কৃষ্ণার্জুনসংবাদে সঞ্জয় যখন ‘যোগ’ শব্দ প্রয়োগ করিতেছেন [গী|১৮|৩৫], তখনও ঐ অর্থই অভিপ্ৰেত বলিয়া বুঝা যাইতেছে । 

শ্ৰীশঙ্করাচার্য নিজে সন্ন্যাসপন্থী হইলেও আপন গীতা-ভাষ্যের আরম্ভে বৈদিক ধর্মের নিবৃত্তি ও প্ৰবৃত্তি এইরূপ দুই ভেদ বলিয়া, ‘যোগ’ শব্দের অর্থ, ভগবান-প্রদত্ত ব্যাখ্যা অনুসারে কখন ‘সম্যগ্‌দর্শনোপায়কর্মানুষ্ঠানম্‌’ [গী|৪|৪২], আবার কখন ‘যোগ যুক্তিঃ’ [গী|১০|৭] এইরূপ করিয়াছেন । সেইপ্ৰকার মহাভারতেও যোগ ও জ্ঞান, এই দুই শব্দের অর্থ অনুগীতায় স্পষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে যে, “প্ৰবৃত্তিলক্ষণো যোগঃ জ্ঞানং সন্ন্যাস লক্ষণম্‌” - যোগ প্ৰবৃত্তিলক্ষণ এবং জ্ঞান সন্ন্যাস বা নিবৃত্তিলক্ষণ [মভা|অশ্ব|৪৩|২৫] । শান্তিপর্বের শেষে নারায়ণীয় উপখ্যানে সাংখ্য ও যোগ শব্দ এই অর্থেই অনেকবার প্রযুক্ত হইয়াছে এবং এই দুই শব্দ সৃষ্টির আরম্ভেই ভগবান কিরূপে ও কি-কারণে স্থাপন করিলেন তাহা বর্ণন করা হইয়াছে [মভা|শাং|২৪০ ও ৩৪৮ দেখ] । এই নারায়ণী কিংবা ভাগবত ধর্ম ভগবদ্গীতার প্রতিপাদ্য, তাহা প্ৰথম প্রকরণে প্রদত্ত মহাভারতের বচনাদি হইতে স্পষ্টরূপেই প্ৰকাশ পাইয়াছে । তাই, সাংখ্য অর্থাৎ নিবৃত্তি এবং যোগ অর্থাৎ প্ৰবৃত্তি, এই দুই শব্দের যে প্রাচীন ও পারিভাষিক অর্থ নারায়ণী ধর্মে আছে, তাহাই গীতাতেও বিবক্ষিত এরূপ বলা যাইতে পারে । এই সম্বন্ধে কাহারও কোন সংশয় থাকিলে “সমত্বং যোগ উচ্যতে” বা “যোগঃ কর্মসু কৌশলম্‌” গীতোক্ত এই ব্যাখ্যা দ্বারা এবং “কর্মযোগেন যোগিনাম্‌” ইত্যাদি উপরিউক্ত গীতোক্ত বচনাদি দ্বারা ঐ সংশয়ের সমাধান হইতে পারে । এই সকল হইতে ইহাই নির্বিবাদে সিদ্ধ হইবে যে, গীতাতে যোগশব্দ প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ অর্থাৎ, ‘কর্মযোগ’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়াছে । শুধু বৈদিক ধর্মগ্রন্থে নহে, পালি ও সংস্কৃত বৌদ্ধধর্মগ্রন্থেও এইরূপ অর্থেই যোগশব্দের প্রয়োগ দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - প্ৰায় ২০০ শকে (৩৩৫ সংবৎ) লিখিত মিলিন্দপ্রশ্ন নামক পালিগ্রন্থে “পূর্ব্বযোগো” (পূর্বযোগ) এইরূপ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে এবং সেইখানেই তাহার অর্থ ‘পূর্ব্বকর্ম’ (পূর্বকর্ম) এইরূপ প্রদত্ত হইয়াছে [মি|প্র|১|৪] সেইরূপ শালিবাহন শকের আরম্ভে আবির্ভূত অশ্বঘোষ কবির ‘বুদ্ধ চরিত’ নামক সংস্কৃত, কাব্যের প্রথম সর্গের ৫০ শ্লোকে বর্ণিত হইয়াছে
“আচাৰ্যকং যোগবিধৌ দ্বিজানামপ্ৰাপ্তমনৈর্জনকো জগাম ৷”
“ব্ৰাহ্মণদিগকে যোগবিধি শিক্ষাদানে জনকরাজা আচার্যা (উপদেষ্টা) হইয়াছিলেন, জনকের পূর্বে কেহই আচার্য পদ প্ৰাপ্ত হন নাই” । এইস্থানে যোগবিধির অর্থ নিষ্কাম কর্মযোগের বিধি করিতে হয় । কারণ, জনকের আচরণের ইহাই রহস্য এইরূপ গীতাদি গ্ৰন্থ উচ্চকণ্ঠে বলিয়াছেন; এবং অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিতেও [৯|১৯ ও ২০] “গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়াও মোক্ষসাধন কিরূপে করা যাইতে পারে” ইহা দেখাইবার জন্যই জনকের দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হইয়াছে । জনকপ্ৰদৰ্শিত মার্গের নামও ‘যোগ’ ছিল । এইরূপ যোগ বৌদ্ধগ্রন্থাদিতেও যখন সিদ্ধ হইয়াছে তখন গীতার যোগ শব্দেরও এই অর্থ গ্ৰহণ করিতে হয়; কারণ, জনকের মাৰ্গ গীতারও প্ৰতিপাদ্য এইরূপ গীতাই বলিতেছেন [গী|৩|২০] । সাংখ্য ও যোগ এই দুই মার্গ সম্বন্ধে বেশী বিচার আলোচনা পরে করা যাইবে । কোন অর্থে গীতায় যোগশব্দের প্রয়োগ হইয়াছে ইহাই এখনকার উপস্থিত প্রশ্ন ।

যোগ অর্থে কর্মযোগ এবং যোগী অর্থে কর্মযোগী, গীতার এই দুই শব্দের মুখ্য অর্থ এই অনুসারে একবার নির্ণয় হইলে পর, ভগবদ্গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় কোনটি ইহা আর স্বতন্ত্ররূপে বলিতে হইবে না । ভগবান নিজেই আপন উপদেশকে ‘যোগ’ নামে অভিহিত করিয়াছেন [গী|৪|১-৩], শুধু তাহা নহে, ষষ্ঠ অধ্যায়ে অর্জুন [গী|৬|৩৩] এবং গীতার শেষের উপসংহারে [গী|১৮|৭৫] সঞ্জয়ও গীতোক্ত উপদেশেওর নাম ‘যোগ’ দিয়াছেন । এইরূপে গীতার প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে অধ্যায়সমাপ্তিপ্রদর্শক যে সঙ্কল্প থাকে তাহাতেও স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে ‘যোগশাস্ত্ৰ’ই গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় । কিন্তু এই সঙ্কল্পের অন্তর্গত শব্দের অর্থের প্রতি বর্তমানের টীকাকারদিগের মধ্যে কেহই মনোযোগ দিয়াছেন বলিয়া মনে হয় না । আরম্ভের “শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতাসু উপনিষৎসু” এই দুই পদের পর, সঙ্কল্পে “ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে” এই দুই শব্দ সংযুক্ত হইয়াছে । তন্মধ্যে প্রথম দুই পদের অর্থ হইতেছে “ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষদে”; এবং পরবর্তী দুই শব্দের অর্থ হইতেছে “ব্রহ্মবিদ্যান্তর্গত যোগশাস্ত্রে” অর্থাৎ “কর্মযোগশাস্ত্ৰে”, যাহা এই গীতার বিষয় ।

ব্ৰহ্মবিদ্যার অর্থে ব্ৰহ্মজ্ঞান; ঐ জ্ঞান লাভ হইলে, জ্ঞানী পুরুষের নিকট দুই মার্গ উন্মুক্ত হয় [গী|৩|৩] — এক, সাংখ্য অথবা সন্ন্যাসমার্গ - যে মার্গে জ্ঞানলাভের পর, জাগতিক সর্বকর্ম ত্যাগ করিয়া বিরাগীর মত থাকিতে হয় । দ্বিতীয় যোগ কিংবা কর্মমার্গ - যে মার্গে কর্ম না ছাড়িয়া এরূপ যুক্তিপূর্বক নিত্য কর্ম করিতে হয় যাহার ফলে মোক্ষপ্ৰাপ্তির কোন বাধা না হয় । এই দুই মার্গের মধ্যে - প্রথমটির ‘জ্ঞাননিষ্ঠা’ এইরূপ অন্য নামও থাকায়, উপনিষদের অনেক ঋষি ও অপর গ্রন্থকারেরাও উহার আলোচনা করিয়াছেন । কিন্তু ব্ৰহ্মবিদ্যার অন্তৰ্গত কর্মযোগের বা যোগশাস্ত্রের তাত্ত্বিক আলোচনা ভগবদ্গীতা ব্যতীত অন্য কোথাও নাই । প্রথমেই ইহা বলা যাইতেছে যে, অধ্যায় সমাপ্তিদর্শক সংকল্প গীতার সকল সংস্করণেই দেখিতে পাওয়া যায় বলিয়া গীতার সকল টীকা লিখিত হইবার পূর্বেই উহা রচিত হইয়া থাকিবে এইরূপ অনুমান হয় । এই সংকল্পের রচয়িতা এই সংকল্পে “ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে” এই দুই পদ বৃথা জুড়িয়া দেন নাই; কিন্তু তিনি গীতাশাস্ত্ৰান্তর্গত বিষয়ের অপূর্বত দেখাইবার জন্যই ঐ পদগুলি সেই সঙ্কল্পের মধ্যে ভিত্তির উপরে যুক্তিপূর্বক স্থাপন করিয়াছেন । এখন ইহাও সহজে উপলব্ধি হইবে যে, গীতাসম্বন্ধে বিস্তর সাম্প্রদায়িক টীকা হইবার পূর্বে গীতার তাৎপৰ্য লোকে কি উপায়ে ও কি ভাবে বুঝিত । সৌভাগ্য আমাদের, এই যোগমার্গের প্ৰবর্তক এবং সমস্ত যোগের সাক্ষাৎ ঈশ্বর (যোগেশ্বর = যোগ+ঈশ্বর) স্বয়ং শ্ৰীকৃষ্ণ ভগবান এই কর্মযোগ প্ৰতিপাদন কাৰ্যের ভার গ্ৰহণ করিয়া, সর্বলোকের হিতার্থ অর্জুনকে তাহার রহস্য বুঝাইয়া দিয়াছেন । ‘যোগ’ ও ‘যোগশাস্ত্ৰ’ - গীতার এই দুইটি শব্দ অপেক্ষা ‘কর্মযোগ’ ও ‘কর্মযোগশাস্ত্ৰ’ এই দুই শব্দ একটু দীর্ঘ সত্য, কিন্তু গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় সম্বন্ধে আর কোন সন্দেহ না থাকে, এইজন্য এই গ্রন্থে ও প্রকরণে এই ঈষৎ দীর্ঘধরণের নাম দেওয়া আমি পছন্দ করিয়াছি ।


4) কর্ম-অকর্মের পর্যায় শব্দ


একই কর্ম করিবার যে অনেক যোগ, সাধন কিংবা মাৰ্গ আছে তন্মধ্যে সৰ্বশ্রেষ্ঠ সুন্দর ও শুদ্ধমার্গ কোন্‌টি; তাহা সর্বদা আচরিত হইতে পারে কি না; না পারিলে তাহার অপবাদ বা ব্যতিক্রম স্থলটি কি, এবং সেই ব্যতিক্রম কেন উৎপন্ন হয়; যে মাৰ্গ আমরা ভাল মনে করি, তাহা কেন ভাল, কিংবা যাহাকে মন্দ বলি তাহা কেন মন্দ এবং এই ভালমন্দ কি উপায়ে কেমন করিয়া স্থির করিবে, কিংবা তাহার বীজটি কি, ইত্যাদি বিষয়, যে শাস্ত্রের বনিয়াদে নিশ্চিত করা যাইতে পারে তাহাকে ‘কর্মযোগশাস্ত্ৰ’ কিংবা গীতান্তৰ্গত সংক্ষিপ্ত রূপ অনুসারে, ‘যোগশাস্ত্ৰ’ বলা হইয়া থাকে । ভাল ও মন্দ এই দুই শব্দ “সামান্য” শব্দ; এই দুই শব্দেরই সদৃশ অর্থে কখন শুভ ও অশুভ, কখন হিতকর ও অহিতকর, কখন শ্ৰেয়স্কর ও অশ্রেয়স্কর, কখন পাপ ও পুণ্য, কখন বা ধর্ম ও অধর্ম, ঐ সকল শব্দও ব্যবহৃত হইয়া থাকে । কাৰ্য-অকাৰ্য, কর্তব্য-অকর্তব্য, ন্যায্য-অন্যায্য ইত্যাদি শব্দগুলিরও অর্থ ঐ প্রকার । তথাপি এই শব্দব্যবহারকারীদিগের সৃষ্টি-রচনা সম্বন্ধীয় মত বিভিন্ন হওয়ায় ‘কর্মযোগ’ শাস্ত্রের নিরূপণ-পন্থাও বিভিন্ন হইয়াছে ।


5) শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনের তিন পন্থা -


যে কোন শাস্ত্ৰই ধর না কেন, তদন্তর্ভূত বিষয়ের চর্চা সাধারণতঃ তিন প্রকারে করা যাইতে পারে – 


5.1) আধিভৌতিক পন্থা


জড়সৃষ্টির অন্তৰ্গত পদাৰ্থ আমাদের ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে যেমনটি প্রকাশ পাইয়া থাকে, সেইরূপই তাহারা, তাহার ওদিকে আর কিছুই নাই, - এই দৃষ্টিতে তাহাদের সম্বন্ধে বিচার করা, ইহাই প্রথম পদ্ধতি, ইহাকে আধিভৌতিক বিচার বলা হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা - সূর্যকে দেবতা বলিয়া না মানিয়া, কেবল পাঞ্চভৌতিক জড় পদার্থের এক গোলা বলিয়া মানিয়া উহার উষ্ণতা, প্ৰকাশ, ওজন, দূরত্ব, আকর্ষণ প্ৰভৃতি তাহার গুণধর্মেরই যখন পরীক্ষা করা হয় তখন সূর্যসম্বন্ধে আধিভৌতিক আলোচনা করা হইতেছে বলিব । আর একটা গাছের উদাহরণ ধর । গাছের ডালপালা গজাইয়া উঠা প্রভৃতি ক্রিয়া কোন অন্তর্নিহিত শক্তির দ্বারা হইয়া থাকে । ইহার বিচার না করিয়া, জমিতে বীজ লাগাইলে অন্ধুর জন্মায় ও পরে তাহারই বৃদ্ধি হইয়া শাখা, পত্র, ফুল, ফল প্রভৃতি তাহার দৃশ্যমান বিকার উৎপন্ন হয়, ইত্যাদি বিষয় কেবল বাহ্যদৃষ্টিতে বিচার করিলে, ঐ গাছের আধিভৌতিক আলোচনা করা হয় বলিতে পারি । রসায়নশাস্ত্ৰ, পদার্থবিদ্যা, তড়িৎশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতি আধুনিক শাস্ত্ৰসম্বন্ধে আলোচনা এই ঢঙ্গেরই হইয়া থাকে । অধিক কি, এই প্রকারে কোন বস্তুর পরিদৃশ্যমান গুণের বিচার করিলেই আমাদের কাজ শেষ হইল, ইহা অপেক্ষা সৃষ্টির পদার্থের বেশী বিচার আলোচনা করা নিষ্ফল, ইহাই আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের মত ।


5.2) আধিদৈবিক পন্থা


উক্ত দৃষ্টি ছাড়িয়া, জড়পদার্থগুলি মূলতঃ কি, এই সকল পদার্থের ব্যবহার কেবল তাহাদের গুণধর্মের দ্বারাই হইয়া থাকে কিংবা তাহাদের পশ্চাতে অন্য কোন তত্ত্ব ভিত্তিস্বরূপে আছে, ইহা বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেই আধিভৌতিক বিচারকে ছাড়াইয়া সম্মুখে পা বাড়াইতে হয় । উদাহরণ যথা - এই পাঞ্চভৌতিক সূর্যের জড় কিংবা অচেতন গোলকের মধ্যে তদধিষ্ঠাত্রী সূর্য নামে এক দেবতা আছেন এবং তাঁহা দ্বারাই জড় সূর্যের ব্যাপার বা ব্যবহার চলিতেছে এইরূপ যখন মানি তখন তাহাকে আধিদৈবিক বিচার বলা যায় । এই মতানুসারে মানিতে হয় যে, বৃক্ষ, পত্র, বায়ু প্ৰভৃতি সর্বত্র সেই সেই জড়পদার্থ হইতে স্বতন্ত্র বিভিন্ন দেবতা আছেন এবং তাঁহারা উক্ত জড়পদার্থ সকলের কাজ চালাইয়া থাকেন ।


5.3) আধ্যাত্মিক পন্থা


কিন্তু যখন ইহা মানা যায় যে, জড় সৃষ্টির অন্তৰ্গত সহস্ৰ সহস্ৰ জড়পদার্থের মধ্যে এইরূপ সহস্ৰ সহস্ৰ স্বতন্ত্র, দেবতা নাই, কিন্তু বাহ্যসৃষ্টির সর্বকাৰ্যপরিচালক, মনুষ্যের শরীরে আত্মস্বরূপে অবস্থিত এবং মনুষ্যের সকল সৃষ্টিসম্বন্ধীয় জ্ঞানবিধায়ক, ইন্দ্রিয়াতীত একমাত্র চিৎশক্তি এই জগতে অধিষ্ঠিত আছেন, যে শক্তির দ্বারাই এই জগৎ চলিতেছে, তখন তাহাকে আধ্যাত্মিক বিচার বলা যায় । উদাহরণ যথা - সূর্যচন্দ্রাদির ক্রিয়া, অধিক কি, গাছের পাতাটি নড়া পৰ্যন্ত এই অচিন্ত্য শক্তিরই প্রেরণায় হইয়া থাকে, সুৰ্যচন্দ্ৰ প্ৰভৃতিতে বা অন্যস্থানে বিভিন্ন ও স্বতন্ত্র দেবতা নাই । 


6) শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনের এই পন্থাভেদের কারণ


যে কোন বিষয়েরই বিচার করা হউক না কেন, এই তিন মার্গ প্রাচীন কাল হইতে চলিয়া আসিতেছে, এবং উপনিষদ্‌গ্রন্থাদিতেও তাহা অনুসৃত হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - বৃহদারণ্যকাদি উপনিষদে জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সকল ও প্রাণ ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কে, ইহার বিচারকালে একবার ইন্দ্ৰিয়সমূহের অগ্নি-আদি দেবতাগণকে, আর একবার তাঁহাদের সূক্ষ্মস্বরূপ (অধ্যাত্ম) লইয়া উহাদের বলাবল সম্বন্ধে বিচার করা হইয়াছে [বৃ|১|৫|২১ ও ২২; ছাং|১|২ ও ৩; কৌষী|২|৮] । গীতার সপ্তম অধ্যায়ের শেষে ও অষ্টম অধ্যায়ের আরম্ভে ঈশ্বর-স্বরূপের যে বিচার আলোচনা করা হইয়াছে তাহাও এই দৃষ্টিতে করা হইয়াছে । তন্মধ্যে “অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যানাম্‌” [গী|১০|৩২] এই বাক্য অনুসারে আমাদের শাস্ত্রকারগণ আধ্যাত্মিক আলোচনাকেই উপরি-উক্ত তিন মার্গের মধ্যে অধিক গুরুত্ব দিয়া থাকেন । 


6.1) কোঁতের মত


কিন্তু আধুনিক কালে, উপরি-উক্ত তিন শব্দের অর্থ একটু বদলাইয়া প্ৰসিদ্ধ আধিভৌতিক ফরাসী পণ্ডিত “কোঁৎ” আধিভৌতিক প্ৰতিপাদনকেই সর্বত্র অধিক গুরুত্ব প্ৰদান করিয়াছেন । তিনি বলেন যে, সৃষ্টির মূলে কি তত্ত্ব আছে তাহার অনুসন্ধান করিতে যাওয়ায় কোন লাভ নাই; এই তত্ত্ব অনধিগম্য হওয়ায় কখনই আমাদের জানা সম্ভব নহে, সুতরাং সেই ভিত্তির উপর কোন শাস্ত্রের ইমারৎ খাড়া করা উচিত বা সাধ্যায়ত্ত নহে । বুনো লোকেরা গাছ, পাথর, জ্বালামুখী প্রভৃতি নড়াচড়া পদার্থ যখন প্ৰথম দেখিল তখন তাহারা ধর্মান্ধতাবশত এই সমস্তই দেবতা বলিয়া মনে করিতে লাগিল । কোঁতের মতে ইহাই আধিদৈবিক বিচার । কিন্তু মানুষ শীঘ্রই এই কল্পনাটি ছাড়িয়া দিয়া সকল পদার্থের মধ্যে কোন-না-কোন প্রকার আত্মতত্ত্ব নিশ্চয় পূর্ণ হইয়া আছে এইরূপ মনে করিতে লাগিল । কোঁতের মতে মানবীয় জ্ঞানের উন্নতির ইহাই দ্বিতীয় সোপান । এই ভিত্তিকে তিনি “আধ্যাত্মিক” এই নাম দিয়াছেন । কিন্তু এই মাৰ্গ ধরিয়া সৃষ্টির বিচার করিয়াও প্ৰত্যক্ষ-উপযোগী শাস্ত্রীয় জ্ঞানের যখন কোন বৃদ্ধি হয় না, তখন মানুষ শেষে সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থসমূহের দৃশ্য গুণধর্মেরই আরও বেশী অনুসন্ধান করিতে প্ৰবৃত্ত হইল; এবং তাহার ফলেই এক্ষণে আগগাড়ী, তার প্রভৃতির ন্যায় যন্ত্র আবিষ্কার করিয়া বাহ্য সৃষ্টির উপর মানুষ স্বীয় আধিপত্য অধিকতর স্থাপিত করিল । কোঁৎ ইহার আধিভৌতিক মার্গ নাম দিয়াছেন । তিনি স্থির করিয়াছেন যে, যে-কোন শাস্ত্রের কিংবা বিষয়ের বিচার আলোচনা করিবার সময় এই মাৰ্গই অন্যান্য মাৰ্গ অপেক্ষা অধিকতর লাভজনক ও শ্রেষ্ঠ । কোঁতের মতে, সমাজশাস্ত্ৰসম্বন্ধে কিংবা কর্মযোগশাস্ত্ৰসম্বন্ধে তাত্ত্বিক বিচারের এই দৃষ্টিভূমিকেই স্বীকার কৱিতে হইবে । এই মার্গ স্বীকার করিয়া এই পণ্ডিত ইতিহাস আলোচনা করিয়াছেন এবং সকল ব্যবহারশাস্ত্রের এই মথিতাৰ্থ বাহির করিয়াছেন যে, এই সংসারে প্রত্যেক মনুষ্য সমস্ত মানবজাতির উপর প্ৰেম স্থাপন করিয়া সতত সর্বলোকের কল্যাণ চেষ্টা করিবে, ইহাই তাহার পরমধর্ম । মিল, স্পেনসর, প্রভৃতি ইংরেজ পণ্ডিত এই মতের অগ্ৰণী বলিলেও চলে । উল্টাপক্ষে, কাণ্ট, হেগেল, শোপেন্‌হোর প্রভৃতি জর্মান তত্ত্বজ্ঞানী এই আধিভৌতিক পদ্ধতি নীতিশাস্ত্রের বিচারপক্ষে অপূর্ণ স্থির করিয়া আজকাল ইউরোপে আমাদের বেদান্তীদিগের ন্যায় অধ্যাত্মদৃষ্টির দ্বারাই নীতিসমর্থক মার্গ পুনরায় স্থাপন করিয়াছেন । তৎসম্বন্ধে আরও অনেক জ্ঞাতব্য কথা পরে বলা যাইবে ।
(ফান্সদেশে, গত শতাব্দীতে অগস্ত কোঁৎ এক বড় পণ্ডিত ছিলেন । ইনি সমাজশাস্ত্রের উপর এক বড় গ্ৰন্থ লিখিয়া, শাস্ত্রীয় রীতিতে সমাজ রচনায় কিরূপ বিচায় করিবে ইহাই প্ৰথম দেখাইয়াছেন । যে কোন শাস্ত্র ধর না কেন, তাহার আলোচনা প্রথম theological, তাহার পর metaphysical পদ্ধতিতে হইয়া থাকে এবং শেষে তাহার positive স্বরূপ প্রাপ্ত হওয়া যায় - অনেক শাস্ত্রের পৰ্যালোচনা করিয়া তিনি ইহা স্থির করিয়াছেন । এই তিন পদ্ধতির অনুক্ৰমে আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক ও আধিভৌতিক এই প্রাচীন নাম আমি এই গ্রন্থে দিয়াছি; কোঁৎ এই পদ্ধতি নূতন বাহির করেন নাই, উহা পুরাতনই । কিন্তু ঊহাদিগের ঐতিহাসিক ক্রমটি তাঁহার নূতন রচনা । সর্বাপেক্ষা positive (আধিভৌতিক) পদ্ধতিই শ্ৰেষ্ঠ ইহাই তাঁহার নূতন কথা । ইংরাজী ভাষায় ইঁহার প্রধান গ্রন্থের ভাশান্তর হইয়াছে ।)


7) গীতা অনুসারে অধ্যাত্মদৃষ্টির শ্রেষ্ঠতা


একই অর্থ বিবক্ষিত হইলেও ‘ভাল ও মন্দের’ পর্যায়বাচী ‘কাৰ্য ও অকাৰ্য’, ‘ধর্ম ও অধর্ম’, প্ৰভৃতি বিভিন্ন শব্দের ব্যবহার কেন প্ৰচলিত হইল ? ইহার কারণ এই যে, বিষয়প্ৰতিপাদনবিষয়ে প্রত্যেকের মার্গ বা দৃষ্টি ভিন্ন ভিন্ন । যে যুদ্ধে ভীষ্ম-দ্ৰোণাদিকে বধ করিতে হইবে সেই যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হওয়া আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর কিংবা শ্ৰেয়স্কর নহে, অর্জুনের এইরূপ প্রশ্ন ছিল [গী|২|৭] । কোন আধিভৌতিক পণ্ডিতের উপর যদি এই প্রশ্নের উত্তর দিবার ভার পড়িত, তবে মহাভারতীয় যুদ্ধ হইতে অর্জুনের নিজের লাভালাভ কতটুকু এবং সমস্ত সমাজের উপর তাহার পরিণামই বা কি ঘটতে পারে, তাহার সারাসার বিচার করিয়া, যুদ্ধ করা ‘ন্যায্য’ কি ‘অন্যায্য’ এই বিষয়ে তিনি নিষ্পত্তি করিতেন । ইহার কারণ এই যে, কোন কর্মের ভালমন্দ নির্ণয় করিবার সময় আধিভৌতিক পণ্ডিত চিন্তা করেন যে, এই সংসারে ঐ কর্মের আধিভৌতিক অর্থাৎ প্ৰত্যক্ষ বাহ্য পরিণাম কি ঘটিয়াছে বা ঘটতে পারে । উহা ব্যতীত উক্ত কর্মের ভালমন্দ নির্ণয় করিবার দ্বিতীয় সাধন বা কষ্টিপাথর এই সরল আধিভৌতিক পণ্ডিতের অভিমত নহে । কিন্তু এইরূপ উত্তরে অর্জুনের সমস্যার সমাধান হয় না । তাঁহার দৃষ্টি ইহা অপেক্ষা ব্যাপক ছিল । শুধু এই জগতের নহে, কিন্তু পারলৌকিক দৃষ্টিতেও এই যুদ্ধের পরিণামে আপনি আত্মার শ্ৰেয় হইবে কি হইবে না, তাঁহার নিকট ইহার নিষ্পত্তি হওয়া আবশ্যক ছিল । যুদ্ধে ভীষ্ম-দ্ৰোণাদি নিহত হইলে, আমাদের রাজ্যপ্রাপ্তি হইয়া সুখ লাভ হইবে কি না, কিংবা যুধিষ্ঠিরাদির শাসনকাল, দুর্যোধনের রাজত্ব অপেক্ষা লোকের পক্ষে অধিকতর সুখজনক হইবে কি না, সে সম্বন্ধে তাহার কোন সংশয় উপস্থিত হয় নাই । সুতরাং আমি যাহা করিতেছি তাহা ‘ধর্ম’ বা ‘অধর্ম’, ‘পুণ্য’ কি ‘পাপ’, ইহাই তাহার দেখিবার বিষয় ছিল । গীতার বিচার-আলোচনাও সেই দৃষ্টিতেই করা হইয়াছে । শুধু গীতায় নহে, মহাভারতের অন্যান্য কয়েক স্থানেও যে বিচার-আলোচনা আছে তাহাও এই পারলৌকিক ও অধ্যাত্মদৃষ্টিতে করা হইয়াছে । সেই সকল স্থলে কোন কর্মের ‘ভাল মন্দ’ দেখাইবার সময়, ‘ধর্ম’ ও ‘অধর্ম’ এই দুই শব্দই প্ৰায় ব্যবহৃত হইয়াছে । কিন্তু ‘ধর্ম’ ও তাহার প্রতিযোগী অর্থাৎ উল্টা ‘অধর্ম’ এই দুই শব্দ ব্যাপক অর্থে কখন কখন ভ্ৰম উৎপাদন করায়, কর্মযোগশাস্ত্ৰে মুখ্যরূপে কোন অর্থে উহাদের ব্যবহার হইতেছে তৎসম্বন্ধে এইখানে কিছু বিস্তৃতভাবে মীমাংসা করা আবশ্যক ।


8) ধর্ম শব্দের দুই অর্থ, পারলৌকিক ও ব্যবহারিক


নিত্যব্যবহারে, অনেক সময় ‘ধর্ম’ শব্দ নিছক ‘পারলৌকিক সুখের মাৰ্গ’ এই অর্থেই ব্যবহৃত হইয়া থাকে । আমরা যখন কাহাকেও প্রশ্ন করি যে “তোমার কোন্‌ ধর্ম”, তখন কেবল পারলৌকিক কল্যাণার্থ, তুমি কোন মার্গ অনুসরণ করিতেছ - বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন, খৃষ্টীয়, মহম্মদীয় বা পার্সী - ইহাই আমাদের প্রশ্নের হেতু; এবং উত্তরদাতাও তদনুসারে তাহার উত্তর দিয়া থাকে । সেই প্রকার স্বৰ্গপ্রাপ্তির সাধনভূত যাগযজ্ঞাদি বৈদিক বিষয়ের মীমাংসা করিবার সময়, “অথাতো ধর্মজিজ্ঞাসা” প্রভৃতি সূত্ৰেতেও ধর্মশব্দের এই অর্থই অভিপ্রেত হইয়াছে । কিন্তু ‘ধর্ম’ শব্দের এইমাত্র সঙ্কুচিত অর্থ নহে; ইহা ব্যতীত রাজধর্ম, প্রজাধর্ম, দেশধর্ম, জাতিধর্ম, কুলধর্ম, মিত্ৰধর্ম প্রভৃতি সাংসারিক নীতিবন্ধনেও ধর্মশব্দ প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । ধর্মশব্দের এই দুই অর্থ পৃথক করিয়া দেখাইতে হইলে পারলৌকিক ধর্মকে ‘মোক্ষধর্ম’ বা কেবল ‘মোক্ষ’, ব্যবহারিক ধর্ম বা নীতিকে ধর্ম বলা হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা - চতুর্বিধ পুরুষার্থের গণনা করিবার সময় আমরা ‘ধর্ম অৰ্থ কাম মোক্ষ’ বলি । ইহাদের প্রথম শব্দ ধর্মের ভিতর মোক্ষের সমাবেশ হইলে, শেষে মোক্ষকে পৃথক পুরুষাৰ্থ বলিবার প্রয়োজন ছিল না । সুতরাং এইস্থানে ধর্মশব্দে জগতের বা সংসারের শত শত নীতিধর্মই শাস্ত্ৰকারদিগের অভিপ্ৰেত এইরূপ বলিতে হয় । ইহাকেই আমরা আজকাল কর্তব্য কর্ম, নীতি, নীতিধর্ম কিংবা সদাচরণ বলিয়া থাকি । কিন্তু প্ৰাচীন সংস্কৃত গ্ৰন্থসমূহে ‘নীতি’ কিংবা ‘নীতিশাস্ত্ৰ’ শব্দ বিশেষরূপে রাজনীতির উদ্দেশেই প্ৰযুক্ত হইত বলিয়া কর্তব্য কর্ম কিংবা সদাচার সম্বন্ধীয় সাধারণ আলোচনাকে ‘নীতিপ্ৰবচন’ না বলিয়া ‘ধর্মপ্রবচন’ নাম দেওয়া হইত । কিন্তু নীতি ও ধর্ম এই দুই শব্দের এই পারিভাষিক ভেদ সকল সংস্কৃত গ্রন্থেই যে স্বীকৃত হইয়াছে তাহা নহে । তাই আমিও এই গ্রন্থে ‘নীতি’, ‘কর্তব্য’ ও ‘ধর্ম’ এই সকল শব্দ একই অর্থে ব্যবহার করিয়াছি; এবং মোক্ষের বিচার যেখানে করা হইয়াছে, সেই প্রকরণকে আমি ‘অধ্যাত্ম’ ও ‘ভক্তিমার্গ’ এইরূপ স্বতন্ত্র নাম দিয়াছি । মহাভারতে ধর্ম শব্দ অনেক স্থানেই পাওয়া যায়; এবং যে স্থানে বলা হইয়াছে যে, “কাহারও কোন কাৰ্য ধর্মসংগত হইয়াছে,” সেই স্থানে ধর্ম শব্দে কর্তব্য শাস্ত্ৰ কিংবা তৎকালীন সমাজব্যবস্থাশাস্ত্ৰ অৰ্থই অভিপ্রেত বুঝিতে হইবে; এবং যে স্থানে পারলৌকিক কল্যাণের মার্গ বিবৃত করিবার প্রসঙ্গ আসিয়াছে, সেই স্থানে অর্থাৎ শান্তিপর্বের উত্তরার্ধে “মোক্ষধর্ম” এই বিশিষ্ট শব্দের যোজনা করা হইয়াছে ।


9) চাতুর্বর্ণ্য আদি ধর্ম


সেইরূপ আবার মন্বাদি স্মৃতিশাস্ত্ৰে ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য ও শূদ্র ইহাদের বিশিষ্ট কর্ম অৰ্থাৎ চাতুৰ্বর্ণ্যের কর্ম বিবৃত করিবার সময়ে অনেকবার অনেক স্থানে কেবল ধর্মশব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে; ভগবদ্গীতাতেও যখন অর্জুনকে ভগবান “স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য” [গী|২|৩১] অর্থাৎ স্বধর্ম কি তাহা দেখিয়া যুদ্ধ করিতে বলিয়াছেন, তখন এবং তৎপূর্বে “স্বধর্মে নিধনং শ্ৰেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ” [গী|৩|৩৫], সেই স্থানেও ‘ধর্ম’ শব্দ “ইহলৌকিক চাতুর্বর্ণ্যের ধর্ম” এই অর্থেই প্ৰযুক্ত হইয়াছে । সমাজের সমস্ত ব্যবহার যাহাতে সুচারুরূপে পরিচালিত হয়, কোন এক বিশিষ্ট ব্যক্তির উপরে কিংবা মণ্ডলীর উপরেও সমস্ত ভার না পড়ে এবং সমাজের সকল পক্ষেরই ভালরূপে সংরক্ষণ ও পোষণ হয়, এই নিমিত্ত শ্রমবিভাগরূপ চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা পুরাকালীন ঋষিগণ কর্তৃক সংস্থাপিত হয় । ইহা পৃথক কথা যে, কিছুকাল পরে চতুর্বর্ণের লোক কেবল জাতিমাত্ৰোপজীবী অর্থাৎ প্রকৃত স্বকর্ম বিস্মৃত হইয়া কেবল নামধারী ব্ৰাহ্মণ ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য ও শূদ্র হইয়া পড়িল । ইহা নিঃসন্দেহ যে, গোড়ায় এই ব্যবস্থা সমাজধারণার্থ করা হইয়াছিল; এবং চতুর্বর্ণের মধ্যে যদি কোন বর্ণ আপনি ধর্ম অর্থাৎ কর্তব্য পরিাত্যাগ করে, কিংবা যদি কোন বর্ণ সমূলে বিনষ্ট হয়, ও তাহার স্থান অন্য লোক আসিয়া পূর্ণ না করে, তাহা হইলে সমস্ত সমাজ সেই পরিমাণেই পঙ্গু হইয়া ধীরে ধীরে বিনাশ প্রাপ্ত হয়, কিংবা উহা নিকৃষ্ট অবস্থাতে তো নিশ্চয়ই আসিয়া পৌঁছে । যদিও এ কথা সত্য যে, পাশ্চাত্য খণ্ডে চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা ব্যতীত অনেক সমাজের অভ্যুদয় হইয়াছে, তথাপি ইহা মনে রাখিতে হইবে যে, সে দেশে চাতুর্বর্ণ্য ব্যবস্থা না থাকিলেও চারিবর্ণের সমস্ত ধর্ম, জাতিরূপে না হউক, গুণবিভাগরূপে জাগ্ৰত রহিয়াছে । সারকথা, যখন আমরা ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ধর্মশব্দ ব্যবহার করি তখন সর্বসমাজের ধারণ ও পোষণ কিরূপে হইতে পারে, তাহাই আমরা দেখি । মনু বলিয়াছেন - “অসুখোদর্ক” অর্থাৎ যাহার পরিণামে দুঃখ হয় সেরূপ ধর্ম পরিত্যাগ করিবে [মনু|৪|১৩৬]; এবং শান্তিপর্বের সত্যানৃতাধ্যায়ে [শাং|১০৯|১২] ধর্মাধর্মের বিচারকালে ভীষ্ম ও তৎপূর্বে কৰ্ণপর্বে শ্ৰীকৃষ্ণ এইরূপ বলিতেছেন যে -
ধারণাদ্ধৰ্মমিত্যাহুঃ ধর্মো ধারয়তে প্ৰজাঃ ৷
যৎ স্যাদ্ধারণসংযুক্তং স ধর্ম ইতি নিশ্চয়ঃ ॥
অর্থাৎ “ধর্ম শব্দ ধৃধাতু (= ধারণ করা) হইতে বাহির হইয়াছে । ধর্মের দ্বারাই সমস্ত প্ৰজা বাঁধা রহিয়াছে । ইহাই স্থির হইয়াছে যে, যাহার দ্বারা (সকল প্ৰজার) ধারণ হয় তাহাই ধর্ম” [মভা|কৰ্ণ|৬৯|৫৯] । অতএব, এই ধর্ম চলিয়া গেলে সমাজের সমস্ত বন্ধন ছিন্ন হয় এইরূপ বুঝিতে হইবে; এবং সমাজের বন্ধন ছিন্ন হইলে আকর্ষণ শক্তি ব্যতীত আকাশস্থ সূর্যাদি গ্ৰহমালার কিংবা কর্ণধার ব্যতীত সমুদ্রের উপর জাহাজের যে অবস্থা হয়, সমাজেরও সেই অবস্থা হইয়া থাকে । এই শোচনীয় অবস্থায় উপনীত হইয়া যাহাতে সমাজের বিনাশ না হয়, সেই কারণে ব্যাসদেব কয়েক স্থানে বলিয়াছেন যে, যদি অর্থ বা দ্রব্য লাভ করিতে ইচ্ছা হয়, তবে তাহা ধর্মতঃ অর্থাৎ যাহাতে সমাজের গঠন বিগড়াইয়া না যায়, এইরূপ ভাবে করিবে, এবং কামাদি বাসনা তৃপ্ত করিতে হইলে তাহাও ধর্মতই করিবে । মহাভারতের শেষে ব্যাস বলিতেছেন যে -
উৰ্দ্ধবাহুর্বিরৌম্যেষঃ ন চ কশ্চিচ্ছৃণোতি মাম্‌ ৷
ধর্মাদর্থশ্চ কামশ্চ স ধৰ্ম্মঃ কিং ন সেব্যতে ॥
“ওরে ! বাহু তুলিয়া আমি চীৎকার করিতেছি, (কিন্তু) আমার কথা কেহই শুনে না ! ধর্ম হইতে অর্থ ও কাম উভয়ই প্ৰাপ্ত হওয়া যায়; (তথাপি) এইরূপ ধর্ম তুমি কেন আচরণ করিতেছ না ?” ইহা হইতে পাঠকের স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম হইবে যে, মহাভারতকে যে ধর্মদৃষ্টিতে পঞ্চম বেদ কিংবা ধর্মসংহিতা বলিয়া স্বীকার করা হয়, সেই ‘ধর্মসংহিতা’ শব্দের মধ্যে ‘ধর্ম’ এই শব্দের মুখ্য অর্থ কি । ইহাই কারণ যে, “নারায়ণং নমস্কৃত্য” এই প্ৰতীক শব্দগুলির দ্বারা ব্ৰহ্মযজ্ঞের নিত্যপাঠের মধ্যে পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা এই দুই পারলৌকিক অর্থপ্ৰতিপাদক গ্রন্থের ন্যায় ধর্মগ্ৰন্থরূপে মহাভারতেরও সমাবেশ করা হইয়াছে ।


10) জগতের ধারণ করে এই জন্য ধর্ম


ধর্মাধর্ম সম্বন্ধে উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত শুনিয়া কেহ এইরূপ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, যদি ‘সমাজধারণ’, এবং দ্বিতীয় প্রকরণের সত্যানৃতবিবেক প্রসঙ্গে কথিত ‘সর্বভূতহিত’, এই দুই তত্ত্ব যদি তুমি স্বীকার কর, তবে তোমার দৃষ্টিতে ও আধিভৌতিক দৃষ্টিতে প্ৰভেদ কি ? কারণ, এই দুই তত্ত্বই বাহ্যতঃ প্ৰত্যক্ষজ্ঞানমূলক ও আধিভৌতিক । এই প্রশ্নের সবিস্তার বিচার পরবর্তী প্ৰকরণে করা হইয়াছে । আপাতত এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, সমাজধারণই ধর্মের প্ৰধান বাহ্য উপযোগ; এই তত্ত্ব স্বীকার করিলেও, আমার মতের বিশেষত্ব এই যে, বৈদিক কিংবা অন্য সমস্ত ধর্মের পরম সাধ্য যে আত্মকল্যাণ কিংবা মোক্ষ তাহা হইতেও আমার দৃষ্টিকে কখনই বিচলিত হইতে দিই নাই । ‘সমাজধারণ’ই বল আর ‘সর্বভূতহিত’ই বল, এই দুই বাহ্যোপযোগী তত্ত্ব যদি আমাদের আত্মাকল্যাণের পথের অন্তরায় হয়, তবে তাহা আমরা চাহি না । আমাদের আয়ুৰ্বেদ যদি ইহাই প্ৰতিপাদন করে যে, বৈদ্যকশাস্ত্ৰও শরীররক্ষণ দ্বারা মোক্ষপ্ৰাপ্তির সাধন বলিয়াই সংগ্ৰহণীয়, তবে, ইহা কখনই সম্ভব নহে যে, এই জগতে কিরূপ ব্যবহার করিতে হইবে, এই গুরুতর বিষয়ের যে শাস্ত্ৰ বিচার-আলোচনা করে, সেই কর্মযোগশাস্ত্ৰকে আমাদের শাস্ত্রকার আধ্যাত্মিক মোক্ষজ্ঞান হইতে পৃথকরূপে ব্যাখ্যা করিবেন । অতএব আমি মনে করি যে, মোক্ষের অর্থাৎ আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির অনুকুল যে কর্ম তাহাই পুণ্য, ধর্ম, কিংবা শুভকর্ম এবং তাহার প্রতিকুল যে কর্ম তাহাই পাপ, অধর্ম কিংবা অশুভ । কর্তব্য ও কাৰ্য এবং অকর্তব্য ও অকাৰ্য এই সকল শব্দের পরিবর্তে একই অর্থে, (একটু সন্দিন্ধ হইলেও) আমরা ধর্ম ও অধর্ম এই দুই শব্দের ব্যবহার যে অধিক পছন্দ করি, তাহারও মর্ম ইহাই । বাহ্যসৃষ্টির অন্তর্ভূত ব্যবহারিক কর্ম ব্যাপার, মুখ্যরূপে আমাদের বিচারের বিষয় হইলেও, উক্ত কর্মসমূহের বাহ্য পরিণামের বিচারেরই ন্যায় এই সকল ব্যাপার আমাদের আত্মারও কল্যাণের অনুকুল কি প্ৰতিকুল, সে বিচারও আমরা সর্বদা করিয়া থাকি । আমি নিজের হিত ছাড়িয়া লোকের হিত কেন করিব, আধিভৌতিকবাদীকে এইরূপ কোন প্রশ্ন করিলে, “সাধারণতঃ ইহাই মানব-স্বভাব” - ইহা ব্যতীত আর কি উত্তর তিনি দিতে পারেন ? আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের দৃষ্টি ইহার অগ্ৰে পৌছিয়াছে; এবং সেই ব্যাপক আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতেই মহাভারতে কর্মযোগশাস্ত্রের বিচার করিয়াছেন; এইজন্য ভগবদ্গীতাতেও বেদান্তের নিরূপণও করা হইয়াছে । প্ৰাচীন গ্ৰীক পণ্ডিতদিগেরও এই মত যে মনুষ্যের ‘অত্যন্ত হিত’ কিংবা ‘সদগুণের পরাকাষ্ঠা’ এইরূপ কোন কিছু পরম সাধ্য কল্পনা করিয়া পরে সেই অনুসারে কর্মাকর্মের বিচার আলোচনা করিতে হইবে; এবং আরিষ্টটল স্বরচিত নীতিশাস্ত্ৰসংক্রান্ত গ্রন্থে বলিয়াছেন [১|৭|৮] যে, আত্মার কল্যাণের মধ্যেই এই সমস্ত বিষয়ের সমাবেশ হইয়া থাকে । তথাপি আত্মার হিত সম্বন্ধে যতটা প্ৰাধান্য দেওয়া আবশ্যক, আরিষ্টটল ততটা প্ৰাধান্য দেন নাই । 

আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের সম্বন্ধে এ কথা খাটে না । তাঁহারা স্থির করিয়াছেন যে, আত্মার কল্যাণ কিংবা আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থাই প্ৰত্যেক মনুষ্যের প্রথম ও পরম সাধনার বিষয়; অন্য প্রকারের হিত অপেক্ষা উহাকেই প্ৰধান স্বীকার করিয়া তদনুসারে কর্মাকর্মের বিচার করা আবশ্যক; অধ্যাত্মবিদ্যাকে ছাড়িয়া কর্মাকর্মের বিচার করা যুক্তিসিদ্ধ নহে । বর্তমানকালে পাশ্চাত্যদেশের কোন কোন পণ্ডিতও কর্মাকর্ম বিচারের এই পদ্ধতিই স্বীকার করিয়াছেন দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - জার্মান তত্ত্বজ্ঞানী কাণ্ট প্ৰথমে “শুদ্ধ (ব্যবসায়াত্মিক) বুদ্ধির মীমাংসা” নামক আধ্যাত্মিক গ্ৰন্থ লিখিয়া পরে তাহার পূরণস্বরূপে “ব্যবহারিক (বাসনাত্মক) বুদ্ধির মীমাংসা” নামক নীতিশাস্ত্ৰবিষয়ক গ্ৰন্থ লিখিয়াছেন [কাণ্ট জর্মন তত্ত্বজ্ঞানী; ইনি অর্বাচীন তত্ত্বজ্ঞানশাস্ত্রের জনক বলিয়া খ্যাত । ইহার “Critique of Pure Reason” (শুদ্ধ বুদ্ধির মীমাংসা) এবং “Critique of Practical Reason” (বাসনাত্মক বুদ্ধির মীমাংসা) এই দুই গ্ৰন্থ প্রসিদ্ধ ।];
এবং ইংলেণ্ডেও গ্রীন আপন “নীতিশাস্ত্রের উপোদ্‌ঘাত” স্থষ্টির মূলে অবস্থিত আত্মতত্ত্ব হইতেই আরম্ভ করিয়াছেন (গ্রীন এই গ্রন্থের নাম “Prolegomena to Ethics” এই নাম দিয়াছেন) । কিন্তু এই গ্ৰন্থসমূহের পরিবর্তে কেবল আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগেরই নীতিগ্ৰন্থ আজকাল আমাদের দেশে ইংরেজি পাঠশালায় পড়ান হয়; তাহারই পরিণামে দেখা যায় যে, গীতোক্ত কর্মযোগশাস্ত্রের মূলতত্ত্ব আমাদের মধ্যে অনেক ইংরেজিশিক্ষিত পণ্ডিতেরাও ভাল বুঝিতে পারেন না ।

‘ধর্ম’ এই সাধারণ শব্দ ব্যবহারিক নীতিবন্ধন সম্বন্ধে কিংবা সমাজধারণ ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমি কেন প্রয়োগ করিয়াছি, তাহা উপরি-উক্ত বিচার আলোচনা হইতে জানিতে পারা যাইবে । মহাভারত, ভগবদ্গীতা প্ৰভৃতি সংস্কৃত গ্ৰন্থসমূহে এবং ভাষাগ্রন্থেও ব্যবহারিক কর্তব্য কিংবা নিয়ম অর্থে ধর্মশব্দ সর্বদাই ব্যবহৃত হয় । কুলধর্ম ও কুলাচার এই দুই শব্দ আমরা সমানার্থক বলিয়া বুঝি । মহাভারতীয় যুদ্ধে একবার কর্ণের রথের চাকা পৃথিবী গ্ৰাস করিয়াছিলেন; সেই চাকা উঠাইয়া উপরে আনিবার জন্য কৰ্ণ আপন রথ হইতে নীচে নামিলে পর, অর্জুন তাঁহাকে বধ করিতে উদ্যত হইলেন । তাহা দেখিয়া কৰ্ণ বলিলেন - “শত্রু নিঃশস্ত্ৰ হইলে তাহাকে মারা ধর্মযুদ্ধ নহে” । তাহ শুনিয়া শ্ৰীকৃষ্ণ দ্ৰৌপদীর বস্ত্রহরণ, সকলে মিলিয়া একাকী অভিমন্যুর বধসাধন প্ৰভৃতি পূর্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়া প্ৰত্যেক প্রসঙ্গে কর্ণকে এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন যে “হে কৰ্ণ তখন তোমার ধর্ম কোথায় ছিল ?” মহারাষ্ট্রকবি মোরোপন্ত এই সকল বিষয়ের বর্ণনা করিয়াছেন । এবং মহাভারতেও এই প্রসঙ্গে “ক্ব তে ধর্মস্তদা গতঃ” এই প্রশ্নে ধর্ম শব্দেরই প্রয়োগ করা হইয়াছে । সেইরূপে শেষে বলা হইয়াছে যে, যে এই প্ৰকার অধর্ম করে তাহার সহিত ঐ প্রকারের ব্যবহার করাই তাহার উচিত দণ্ড । সার কথা, কি সংস্কৃত, কি ভাষাগ্ৰন্থ, সকল গ্রন্থেই, শিষ্টের নানা বিষয়সম্বন্ধে অধ্যাত্মদৃষ্টিতে সমাজ-বিধরণের জন্য যে নীতি-নিয়ম স্থাপন করিয়াছেন, সেই সকলেতেই ধর্মশব্দের প্রয়োগ আছে । এই কারণে ঐ শব্দ আমিও এই গ্রন্থে বজায় রাখিয়াছি । এই দৃষ্টিতে বিচার করিয়া সমাজবিধরণার্থ শিষ্টগণস্থাপিত ও সর্ববাদসম্মত নীতির ঐ সকল নিয়ম বা ‘শিষ্টাচার’কে ধর্মের মূলভিত্তি বলা যাইতে পারে । এবং সেই কারণে, মহাভারতে [অনু|১৫৪|১৫৭] ও স্মৃতিগ্রন্থে “আচারপ্রভবো ধৰ্ম্মঃ” অথবা “আচারঃ পরমো ধৰ্ম্মঃ” [মনু|১|১০৮], কিংবা ধর্মের মূল বুঝাইবার সময় “বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ” [মনু|২|১২], এই সকল বচন উক্ত হইয়াছে । কিন্তু কর্মযোগশাস্ত্রে এইটুকুতে কাজ চলে না; এই আচার প্রবর্তিত হইবার কারণ কি, তাহার পূর্ণ ও মার্মিক বিচার করা আবশ্যক । 


11) চোদনালক্ষণ-ধর্ম


ধর্মশব্দের আর এক যে ব্যাখ্যা প্রাচীন গ্ৰন্থাদিতে প্রদত্ত হয়, তাহারও কিছু বিচার করা এইখানে আবশ্যক । মীমাংসকেরা “চোদনালক্ষণোহর্থো ধৰ্ম্মঃ” এইরূপ বলিয়া থাকেন [জৈ|সূ|১|১|২] । কোন অধিকারী ব্যক্তি কর্তৃক “তুমি অমুক কাজ কর” বা “করিও না” এইরূপ বলা কিংবা আদেশ করার নাম চোদনা বা প্রেরণা । যে পর্যন্ত এই রকমের বিধান স্থাপিত না হয়, সে পর্যন্ত, যে কোন বিষয় যে কোন ব্যক্তির করিবার অধিকার আছে । ইহার ভাব এই যে, ধর্ম প্রথমতঃ নিয়মবিধানের হিসাবে প্ৰবর্তিত হইয়াছে; প্ৰসিদ্ধ ইংরেজ গ্ৰন্থকার হব্‌স’এর মতের সঙ্গে, ধর্মের এই ব্যাখ্যার কিয়দংশে মিল আছে । অসভ্য ও বন্য অবস্থায় প্ৰত্যেক মনুষ্য, যখন যে মনোবৃত্তি প্ৰবল হয়, তদনুসারে কাজ করে । কিন্তু পরে, ধীরে ধীরে এই প্রকারের স্বৈরাচার শ্রেয়স্কর নহে এইরূপ বুঝা যায়; এবং ইহা বিশ্বাস হয় যে, ইন্দ্ৰিয়গণের স্বাভাবিক ব্যাপারের একটা সীমা নির্দেশ করিয়া তাহারই পালনে সকলের কল্যাণ হয়; তখন শিষ্টাচার কিংবা অন্য কোন রীতির উপর দৃঢ়প্ৰতিষ্ঠ এই সীমা-মর্যাদা প্ৰত্যেক মনুষ্য আইনের ন্যায় পালন করিতে প্ৰবৃত্ত হয় । এবং এই প্রকারের সীমামৰ্যাদার সংখ্যা বেশী হইলে সেই সমস্ত লইয়াই এক শাস্ত্র রচিত হইয়া থাকে । বিবাহব্যবস্থা পূর্বে প্রচলিত ছিল না, শ্বেতকেতুই বিবাহব্যবস্থা সর্বপ্রথম আমলে আনিয়াছিলেন । সুরাপান শুক্রাচার্য নিষিদ্ধ বলিয়া স্থির করেন - ইহা আমি পূর্ব প্রকরণে বলিয়াছি । শ্বেতকেতুর কিংবা শুক্রাচার্যের এই সীমামর্যাদা স্থাপনে হেতু কি ছিল তাহা না দেখিয়া, এই প্রকার সীমা মর্যাদা স্থাপনের পক্ষে কেবল তাঁহাদের কর্তব্যকেই লক্ষ্যের মধ্যে আনিয়া ধর্মশব্দের “চোদনালক্ষণোহর্থো ধৰ্ম্মঃ” এইরূপ ব্যাখ্যা নিষ্পন্ন হইয়াছে । ধর্ম হইলেও প্রথমতঃ তাহার মহত্ব কাহারও লক্ষ্যের মধ্যে আসে এবং তখনই তাহাতে উহার প্রবৃত্তি হইয়া থাকে । ‘খাও, পিয়ো, মজা লোটো’ একথা কাহাকেও শিখাইতে হয় না; কারণ, উহা ইন্দ্ৰিয়সমূহের স্বাভাবিক ধর্ম । মনু বলিয়াছেন - “ন মাংসভক্ষণে দোষো ন মদ্যে ন চ মৈথুনে” [মনু|৫|৫৬] মাংসভক্ষণ, মদ্যপান ও মৈথুনে কোন দোষ নাই অর্থাৎ ঐ সকল কাৰ্যে সৃষ্টিকর্মের বিরুদ্ধ কোন দোষ নাই, ইহাই উহার তাৎপৰ্য । এই সব বিষয় শুধু মনুষ্যের নহে, কিন্তু প্রাণীমাত্রেরই স্বাভাবিক - “প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাম্‌” । সমাজধারণের জন্য অর্থাৎ সকল লোকের সুখের জন্য প্ৰবৃত্তি-সূত্রে প্রাপ্ত এই স্বৈরাচারকে যথোচিত সংযত করাই ধর্ম । মহাভারতেও উক্ত হইয়াছে [শান্তি|২৯৪|২৯] -
আহারনিদ্রাভিয়মৈথুনং চ সামান্যমেতৎ পশুভির্নরাণাম্‌ ৷
ধর্মো হি তেষামধিকো বিশেষো ধর্মেন হীনাঃ পশুভিঃ সমানঃ ॥
অর্থাৎ আহার, নিদ্রা, ভয় ও মৈথুন মনুষ্য ও পশু উভয়েরই সমান স্বাভাবিক । ধর্মেই (“অর্থাৎ এই সকল বিষয়ে নীতির সীমা স্থাপনে”) মনুষ্য ও পণ্ডতে ভেদ বুঝিতে হইবে । আহারবিহারের সংযম সম্বন্ধে ভাগবতের শ্লোক পূৰ্বপ্রকরণে প্রদত্ত হইয়াছে । সেইরূপ ভগবদ্গীতাতেও যখন অর্জুনকে ভগবান বলিতেছেন [গী|৩|৩৪] -
ইন্দ্ৰিয়স্যেন্দ্ৰিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ ৷
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ ॥
অর্থাৎ “প্ৰত্যেক ইন্দ্ৰিয়ে আপনাপন উপভোগ্য বা ত্যাজ্য পদার্থে প্রীতি ও দ্বেষ স্বভাবিসিদ্ধ । ইহাদের অধীন হওয়া আমাদের উচিত নহে; কারণ, রাগ ও দ্বেষ উভয়ই আমাদের শক্ৰ”, তখন ভগবান স্বাভাবিক মনোবৃত্তিকে সংযত করা যে ধর্মের লক্ষণ, তাহাই স্বীকার করিয়াছেন । মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়াদি তাহাকে পশুর ন্যায় আচরণ করিতে বলে এবং তাহার বুদ্ধি তাহাকে উল্টাদিকে আকর্ষণ করে । কলহানলে যে ব্যক্তি দেহের মধ্যে বিচরণকারী এই পশুত্বকে আহুতি দিয়া যজ্ঞানুষ্ঠান করে, সেই প্ৰকৃত যাজ্ঞিক ও সেই ধন্য হয় ।


12) ধর্ম-অধর্মের নির্ণয় করিবার সাধারণ নিয়ম


ধর্ম ‘আচার-মূলকই’ বল, ‘ধারণাৎ’ ধর্মই বল, বা ‘চোদনালক্ষণ’ ধর্মই বল, ধর্মের বা ব্যবহারিক নীতিবন্ধনের যে কোন ব্যাখ্যাই গ্ৰহণ কর না কেন, ধর্মাধর্মসম্বন্ধে সংশয় উপস্থিত হইলে তাহা নির্ণয় করিবার জন্য উপরি-উক্ত তিন লক্ষণের কোন উপযোগ হয় না । ধর্মের মূল স্বরূপ কি তাহাই শুধু প্ৰথম ব্যাখ্যাটিতে বুঝা যায়; উহার বাহ্য উপযোগ কি, তাহা দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটির দ্বারা জানা যায়; এবং ধর্মের সীমামর্যাদা প্ৰথমে কোন এক ব্যক্তি স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা তৃতীয় ব্যাখ্যার দ্বারা উপলব্ধি হইয়া থাকে । কিন্তু আচারে আচারে ভেদ দেখা যায়; একই কর্মের অনেক পরিণাম হয়; এবং অনেক ঋষির আদেশ অর্থাৎ ‘চোদনা’ও ভিন্ন ভিন্ন হয় । এই সকল কারণে সংশয়স্থলে ধর্মনির্ণয়ের অন্য মার্গ দেখা আবশ্যক । 


12.1) ‘মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ’


এই মার্গটা কি, যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে এই প্রশ্ন করিয়াছিলেন । যুধিষ্ঠির তাঁহাকে উত্তর দিয়াছিলেন -
তর্কোহপ্ৰতিষ্ঠঃ শ্রুতয়ো বিভিন্নাঃ নৈকো ঋষিৰ্যস্ত বচঃ প্রমাণম্‌ ৷
ধর্মস্য তত্ত্বং নিহিতং গুহায়াং মহাজনো যেন গতঃ সা পন্থা ॥
অর্থাৎ - “তর্ক অপ্রতিষ্ঠ, যাহার বুদ্ধি যেরূপ তীক্ষ্ণ তদনুসারে অনেক প্রকারের অনেক অনুমান তর্কের দ্বারা স্থাপিত হইতে পারে; শ্রুতি অর্থাৎ বেদেরও আদেশ ভিন্ন ভিন্ন; এবং স্মৃতিশাস্ত্রের কথা যদি বল, এমন এক ঋষিও নাই যাঁহার বচন আমরা অন্য অপেক্ষা অধিক প্রামাণ্য বলিয়া মনে করিতে পারি । ভাল, (এই ব্যবহারিক) ধর্মের মূলতত্ত্ব যদি দেখা যায় তবে তাহাও অন্ধকারের মধ্যে প্রচ্ছন্ন, অর্থাৎ সাধারণ লোকের বুদ্ধির অগম্য । এই জন্য মহাজন যে পথ দিয়া গিয়াছেন, সেই পথই পথ” [মভা|বন|৩১২|১১৫] । ঠিক কথা ! 


12.1.1) এই পন্থার দোষ


কিন্তু ‘মহাজন’ কাহাকে বলে ? উহার অর্থ “অধিক কিংবা বহু জনসমূহ” হইতে পারে না । কারণ, যে সাধারণ লোকের মনে ধর্মাধর্মের সংশয়ও কখন উৎপন্ন হয় না, তাহাদের প্রদর্শিত পথে চলা কি রকম ? - না যেমন, কঠোপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে, অন্ধ কেশিন্বিরের ন্যায় (“অন্ধেনৈব নীয়মানা যথান্ধাঃ”) অন্ধের দ্বারা নীয়মান অন্ধ ! মহাজনের অর্থ যদি “বড় বড় শিষ্ট ব্যক্তি” ধরা যায় এবং এই অর্থই যদি উপরি-উক্ত শ্লোকের অভিপ্রেত হয়, তাহা হইলেও ঐ সকল ব্যক্তির আচরণে মিল কোথায় ? নিষ্পাপ রামচন্দ্র আপন পত্নীকে অগ্নি হইতে শুদ্ধ হইয়া নিৰ্গত হইবার পরেও কেবল লোকাপবাদের জন্যই ত্যাগ করিলেন; এবং সুগ্ৰীবকে পাইবার জন্য, তাহার সহিত ‘তুল্যারিমিত্র’ অর্থাৎ তোমার শত্ৰু আমার শত্রু এবং তোমার মিত্র আমার মিত্র এই প্রকার অঙ্গীকারে বদ্ধ হইয়া রামচন্দ্ৰ বিনা অপরাধে বালিকে বধ করিলেন ! পরশুরাম পিতার আজ্ঞাক্ৰমে আপন মাতার শিরশেছদ করিলেন ! পাণ্ডবদিগের আচরণ দেখ - পাঁচজনের এক স্ত্রী ! স্বর্গের দেবতাদের প্রতি দৃষ্টিপাত কর, দেখিবে - কেহবা অহল্যার সতীত্ব নাশ করিয়াছেন, আর কেহ বা মৃগরূপ ধরিয়া আপন কন্যার প্ৰতি অভিলাষ করায় রুদ্রের বাণে বিদ্ধশরীর হইয়া আকাশে পড়িয়া আছেন [ঐ|ব্রা|৩|৩৩] । এই কথা মনে করিয়াই ‘উত্তররামচরিত’ নাটকে ভবভূতি লবের মুখ দিয়া “বৃদ্ধাস্তে ন বিচারণীয়চরিতাঃ” - অৰ্থাৎ এই বৃদ্ধদের চরিত্র বেশী বিচার করিয়া কাজ নাই - এই কথা বলাইয়াছেন । ইংরাজীতে শয়তানের ইতিহাসলেখক এক গ্ৰন্থকার বলিয়াছেন যে, শয়তানের অনুচর ও দেবদূত ইহাঁদের যুদ্ধবৃত্তান্তে দেখা যায় যে, অনেকবার দেবতারাই দৈত্যদিগকে কপটতা দ্বারা ঠকাইয়াছেন । সেইপ্ৰকার কৌষীতকী ব্ৰাহ্মণোপনিষদে [কোষী|৩|১ ও ঐ|ব্ৰা|৭|২৮ দেখ] ইন্দ্ৰ প্ৰতৰ্দনকে বলিতেছেন যে, “আমি বৃত্ৰকে (যদিও সে ব্ৰাহ্মণ ছিল) বধ করিয়াছি । অরুন্মুখ সন্ন্যাসীদিগকে আমি টুক্‌রা টুক্‌রা করিয়া বৃকদিগের নিকট ফেলিয়া দিয়াছি এবং আমার অনেক অঙ্গীকার ভঙ্গ করিয়া প্ৰহ্লাদের আত্মীয় ও গোত্রজদিগকে এবং পৌলোম ও কালখঞ্জ নামক দৈত্যদিগকে বধ করিয়াছি, তথাপি আমার এক গাছা চুলও বাঁকে নাই, - “তস্য মে তত্ৰ ন লোম চ মা মীয়াতে” ! যদি কেহ বলেন “তোমাদের এই মহাপুরুষদিগের মন্দ কর্মের প্রতি লক্ষ্য করিবার কোনই কারণ নাই; তৈত্তিরীয়োপনিষদের উক্তি অনুসারে [তৈত্তি|১|১১|২] তাঁহাদের যে সকল কর্ম ভাল, তোমরা তাহারই অনুকরণ কর, বাকী ছাড়িয়া দেও; উদাহরণ যথা - “পরশুরামের মতোই পিতার আজ্ঞা পালন কর, কিন্তু মাতাকে বধ করিও না”, তাহা হইলে ঐ প্রথম প্রশ্ন পুনরায়, উঠে যে ভালমন্দ কর্ম, বুঝিবার উপায় কি ? তাই, উপরি-উক্ত আপন কৃত্যাদি বর্ণনা করিয়া ইন্দ্ৰ প্ৰতৰ্দনকে পুনরায় বলিতেছেন যে, “যে পূর্ণ আত্মজ্ঞানী হইয়াছে, তাহাকে মাতৃবধ, পিতৃবধ, ভ্রূণহত্যা বা স্তেয় (চৌর্য) ইত্যাদি কোন কর্মেরই দোষ স্পর্শ করে না - এই কথাটী ভালরূপে বুঝিয়া লও এবং আত্মা কাহাকে বলে তাহাও তুমি বুঝিয়া লও; তাহা হইলেই তোমার সকল সংশয়ের নিবৃত্তি হইবে” । তাহার পর, ইন্দ্ৰ প্ৰতর্দনকে আত্মবিদ্যার উপদেশ দিয়াছেন ।

সারকথা এই যে, “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থা”, এই যুক্তি সাধারণ লোকদিগের পক্ষে সহজ হইলেও সকল কথার ইহা দ্বারা সমাধান হয় না; এবং শেষে মহাজনদিগের আচরণের প্রকৃত তত্ত্ব যতই গূঢ় হউক না কেন, বিচারক ব্যক্তিগণ আত্মজ্ঞানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া তাহা খুঁজিয়া বাহির করিতে বাধ্য হন । “ন দেবচরিতং চরেৎ” অর্থাৎ, দেবতাদের কেবল বাহ্য চরিত্র অনুসারে কাজ করিবে না - এই উপদেশের ও ইহাই রহস্য । 


12.2) ‘অতি সর্বত্র’ এবং উহার অপূর্ণতা


কর্মাকর্ম নির্ণয়ার্থ ইহা ব্যতীত আর এক সরল যুক্তি কেহ কেহ বাহির করিয়াছেন । তাহারা বলেন যে, যে কোন সদ্‌গুণ হউক না কেন, তাহার আধিক্য যাহাতে না হয় তাহার জন্য সর্বদা চেষ্টা করা আবশ্যক; কারণ, এইরূপ আধিক্যের কারণেই সদ্‌গুণও শেষে দুর্গুণ হইয়া পড়ে । দান করা একটা সদ্‌গুণ সত্য, কিন্তু “অতি দানাদ্‌ বলির্বদ্ধঃ” - অৰ্থাৎ অতিদানে বলি রাজা বাঁধা পড়িয়াছিলেন । প্ৰসিদ্ধ গ্ৰীক পণ্ডিত আরিষ্টটল আপন নীতিশাস্ত্রসংক্রান্ত গ্রন্থে কর্মাকর্মনির্ণয়ের এই যুক্তি ব্যাখ্যা করিয়াছেন এবং স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছেন যে প্রত্যেক সদ্‌গুণ ‘অতি’ হইলে কিরূপে ‘মাটি’ হয় । কালিদাসও রঘুবংশে বর্ণনা করিয়াছেন যে নিছক শৌৰ্য ব্যাঘ্রের ন্যায় হিংস্ৰ জন্তুদিগের ক্রুর কর্ম, এবং নিছক্‌ নীতি ভীরুতা, ইহা স্থির করিয়া অতিথি রাজা, তরবারি ও রাজনীতি এই উভয়ের যোগ্য মিশ্রণে আপন রাজ্য চালাইয়াছিলেন [রঘু|১৭|৪৭]ভর্তৃহরিও কতকগুলি গুণদোষের বর্ণনা করিয়া বলিয়াছেন যে, বেশী কথা বলা ‘বাচালতার’ লক্ষণ এবং অল্প কথা বলা মুকের লক্ষণ; বেশী খরচ করা ‘উড়োনচণ্ডীর’ লক্ষণ এবং কম খরচ করা কঞ্জুষের লক্ষণ, সম্মুখে অগ্রসর হইলে ‘প্ৰগল্‌ভতা’ এবং পিছাইয়া পড়িলে শিথিলতা; অতিশয় আগ্ৰহ করিলে জেদী এবং না করিলে চঞ্চল, বেশী তোষামোদ করিলে নীচ এবং চুপ করিয়া থাকিলে গর্বিত; কিন্তু এইরূপ স্থূলরকমের কষ্টিপাথরে শেষ পর্যন্ত কাজ হয় না । কারণ, ‘অতি’ই বা কি, আর ‘নিয়মিত’ই বা কি - ইহার তো কোন প্রকার নির্ণয় হওয়া আবশ্যক; আর সেই নির্ণয় কে করিবে, এবং কেমন করিয়াই বা করিবে ? এক জনের নিকট কিংবা এক প্রসঙ্গে যাহা ‘অতি’, তাহাই আর একজনের নিকট কিংবা আর এক প্রসঙ্গে ‘অনতি’ বা ন্যূন হইতে পারে । হনুমানজী জন্মগ্রহণ করিতেই সূর্যকে ধরিবার জন্য লম্ফ প্ৰদান করা কঠিন কার্য মনে করেন নাই [বা|রামা|৭|৩৫]; কিন্তু ইহা অন্যের পক্ষে কঠিন, এমন কি অসম্ভব । 


12.3) অবিরোধের দ্বারা ধর্ম-নির্ণয়


এইজন্য ধর্মাধর্মের সংশয় উপস্থিত হইলে প্রত্যেক মনুষ্যের শিবি রাজার প্রতি শ্যেনের উপদেশমত নির্ণয় করা উচিত -
অবিরোধাত্তু যো ধর্মঃ স ধৰ্ম্মঃ সত্যবিক্রম ৷
বিরোধিষু মহীপাল নিশ্চিত্য গুরুলাঘবম্‌ ৷
ন বাধা বিদ্যতে যত্ৰ তং ধৰ্ম্মং সমুপাচরেৎ ॥
পরস্পরবিরুদ্ধ ধর্মসকলের তারতম্য কিংবা, লাঘব-গৌরব দেখিয়াই প্ৰত্যেক প্রসঙ্গে আপন বুদ্ধি অনুসারে প্রকৃত ধর্মের কিংবা কর্মের নির্ণয় করা উচিত [মভা|বন|১৩১|১১, ১২ ও মনু|৯|২৯৯ দেখ] । কিন্তু এরূপও বলা যাইতে পারে না যে, ইহা দ্বারাই ধর্মাধর্মের সারাসার বিচার করাই সংশয়স্থলে ধর্মনির্ণয়ের এক প্রকৃত কষ্টিপাথর । কারণ, ব্যবহারে অনেকবার দেখা যায় যে, অনেক পণ্ডিত লোক আপনাপন বুদ্ধি অনুসারে সারাসারের বিচারও ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে করিয়া, একই বিষয়ের নীতিমত্তার নির্ণয়ও ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে করিয়া থাকেন । এই অর্থই উপরি-উক্ত “তর্কোহপ্ৰতিষ্ঠঃ” বচনে বলা হইয়াছে । 


13) কর্মযোগশাস্ত্রের কার্য


তাই, এক্ষণে আমাদের দেখিতে হইবে যে, ধর্মাধর্মসংশয়ের এই প্রশ্নের নির্ভুল মীমাংসা করিবার অন্য কোন উপায় আছে কি নাই; যদি থাকে, ত সেটা কি; আর যদি অনেক উপায় থাকে তবে তন্মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় কোনটি । এই বিষয়ের নির্ধারণ করাই হইল শাস্ত্রের কাৰ্য । শাস্ত্রের লক্ষণও এই যে, “অনেকসংশয়োচ্ছেদি পরোক্ষার্থস্য দর্শকম্‌” - অৰ্থাৎ অনেক সংশয় উৎপন্ন হইলে পর, সর্বপ্রথম ঐ সকল বিষয়ের পাকগুলি পৃথক পৃথক করিয়া দেয়; যে সকল বিষয় বুঝা যায় না, সেই সকল বিষয়ের অর্থ স্পষ্ট ও সুগম করিয়া দেয় এবং যে বিষয় প্রত্যক্ষ নহে কিংবা পরে প্রত্যক্ষ হইবে এরূপ বিষয়সমূহেরও যথার্থ জ্ঞান সম্পাদন করে । জ্যোতিষশাস্ত্ৰবেত্তা ভাবী গ্ৰহণও গণনা করিতে পারেন আলোচনা করিলে, উক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে “পরোক্ষার্থস্য দর্শকং” এই অংশটির সার্থকতা উপলব্ধি হইবে । কিন্তু অনেক সংশয়ের সমাধান করিতে হইলে প্রথমে জানা আবশ্যক যে উহা কোন প্রকারের সংশয় । তাই, প্রাচীন ও অর্বাচীন গ্ৰন্থকারদিগের এই পদ্ধতি প্রচলিত যে, কোন শাস্ত্রান্তর্গত সিদ্ধান্তপক্ষ বিবৃত করিবার পূর্বে, সেই বিষয়ে যতগুলি পক্ষ বাহির হইয়াছে সেগুলির বিচার করিয়া, তাহাদের দোষ ও ন্যূনতা প্ৰদৰ্শন করা হয় । এই পদ্ধতিই স্বীকার করিয়া লইয়া গীতাতে কর্মাকর্মনিৰ্ণয়াৰ্থ প্ৰতিপাদিত সিদ্ধান্তপক্ষীয় যোগ অর্থাৎ যুক্তি বিবৃত কবিবার পূর্বে, এই কাজের জন্যই অন্য যে কিছু যুক্তি পণ্ডিতলোকেরা ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন, এক্ষণে আমি সেগুলিরও বিচার করিব । এ কথা সত্য যে, এই সকল যুক্তি আমাদের মধ্যে পূর্বে বিশেষরূপে প্রচলিত ছিল না; বিশেষভাবে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাই বর্তমান সময়ে ঐ সকল যুক্তি প্ৰবর্তিত করিয়াছেন; কিন্তু তাহার দরুণ উহার বিচার এই গ্রন্থে করা উচিত নহে, একথা বলা যাইতে পারে না । কারণ, কেবল তুলনার জন্য নহে, কিন্তু গীতার অন্তর্গত আধ্যাত্মিক কর্মযোগের মহত্ব উপলব্ধি করিবার জন্যও এই সকল যুক্তি - যতই সংক্ষেপ হউক না কেন - অবগত হওয়া আবশ্যক ।
ইতি তৃতীয় প্রকরণ সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment