Sunday, June 4, 2017

আধিদৈবতপক্ষ ও ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিচার (Intuitionist School - Body & Atman)

আধিদৈবতপক্ষ ও ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিচার


সত্যপূতাং বদেদ্‌ বাচম্‌ মনঃপুতং সমাচারেৎ ৷ [মনু|৬|৪৬]

(“সত্যের দ্বারা যাহা পূত অর্থাৎ শুদ্ধ হইয়াছে এইরূপ বাক্য বলিবেক এবং মন যাহা শুদ্ধ মনে করিবে তাহাই আচরণ করিবেক ।”


সূচীপত্র


1) পাশ্চাত্য সদসদ্বিবেকদেবতাপক্ষ
2) মনোদেবতা সম্বন্ধে আমাদের গ্রন্থসমূহের বচন
3) আধিদৈবত পক্ষের উপর আধিভৌতিক পক্ষের আপত্তি
4) সদসদ্বিবেক কোন নিছক শক্তি নহে
5) অধ্যাত্ম পক্ষের আপত্তি - ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার
6) মনুষ্যদেহরূপ বৃহৎকারখানা - কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়
7) মন ও বুদ্ধির পৃথক্‌ পৃথক্‌ কাজ
8) ব্যবসায়াত্মিকা ও বাসনাত্মক বুদ্ধির ভেদ ও সম্বন্ধ
9) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি একই, কিন্তু সাত্ত্বিক আদি ভেদে তিন প্রকারের
10) সদসদ্বিবেক বুদ্ধি ইহাতেই আছে, পৃথক নাই
11) আধ্যাত্মিক মাৰ্গ - কর্মযোগের সহিত সম্বন্ধ
11.1) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিচার - ক্ষেত্র শব্দের অর্থ
11.2) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিচার - ক্ষেত্রজ্ঞ শব্দের অর্থ
11.3) ক্ষর-অক্ষর বিচারের প্রস্তাবনা - “যাহা পিণ্ডে, তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে”
12) পাশ্চাত্যের ও বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সাদৃশ্য



1) পাশ্চাত্য সদসদ্বিবেকদেবতাপক্ষ


আধিভৌতিক মাৰ্গ ব্যতীত কর্মাকর্ম পরীক্ষণের আর এক মাৰ্গ আছে, তাহা আধিদৈবতবাদীদিগের মাৰ্গ । এই মার্গের লোকেরা বলেন যে, যে সময়ে মনুষ্য কর্মাকর্মের বা কার্যাকার্যের নির্ণয় করে সেই সময়ে কোন কর্ম হইতে, কাহার কত সুখ বা দুঃখ হইবে, অথবা সেগুলি হইতে সুখের মোট সংখ্যা বা দুঃখের মোট সংখ্যা অধিক হইবে, মনুষ্য এইরূপ গোলযোগের মধ্যে কিংবা আত্মানাত্মবিচারের মধ্যে কখনই পড়ে না । অনেকে, এইরূপ গোলযোগ আছে বলিয়াই জানে না । অধিকন্তু, প্ৰত্যেক প্ৰাণী প্ৰত্যেক কর্ম যে কেবল নিজের সুখেরই জন্য করে এরূপ নহে । আধিভৌতিকবাদী যাহাই বলুন না কেন । কিন্তু ধর্মাধর্মনিৰ্ণয় করিবার সময় মানব-মনের অবস্থা কিরূপ হয়, একটু বিচার করিলেই দেখা যায় যে, কারুণ্য, দয়া, পরোপকার ইত্যাদি মানব-মনের স্বাভাবিক ও উচ্চ মনোবৃত্তিসকলই কোন কার্য সম্পাদন করিবার জন্য মনুষ্যকে একেবারেই প্ৰবৃত্ত করায় । উদাহরণ যথা - কোন ভিখারীকে দেখিয়া তাহাকে কিছু ভিক্ষা দিলে জগতের কিংবা নিজের আত্মার কতটা কল্যাণ হইবে ইহার বিচার মনুষ্যের মনে আসিবায় পুর্বেই মনুষ্যহৃদয়ে কারুণ্যবৃত্তি জাগ্ৰত হয় এবং সে আপন শক্তি অনুসারে ভিখারীকে ভিক্ষা দিয়াই খালাস হয় । সেইরূপ ছেলে কাঁদিতে আরম্ভ করিলে তাহাকে দুধ দিবার সময়, কত, লোকের কতটা হিত হইবে ইহার কিছুমাত্ৰ বিচার না করিয়া, তাহার মা আহাকে দুধ দেয় । সুতরাং এই উচ্চ মনোবৃত্তিসমুহই কর্মযোগশাস্ত্রের প্রকৃত ভিত্তি । এই মনোবৃত্তিসকল আমাদিগকে কেহ দেয় নাই; কিন্তু এগুলি নিসর্গসিদ্ধ অর্থাৎ স্বাভাবিক, কিংবা এক ভাবে স্বয়ংভু দেবতা । বিচারপতি আপন বিচারআসনে বসিলে, তাঁহার বুদ্ধিতে ন্যায়দেবতার প্রেরণা হয় এবং তিনি সেই প্রেরণা অনুসারে ন্যায়-বিচার করেন; কিন্তু যখন কোন বিচারপতি এই প্রেরণাকে গ্রাহ্য না করেন, তখনই তাঁহার হাত দিয়া অন্যায়-বিচার বাহির হয় । ন্যায়-দেবতার মতোই কারুণ্য, দয়া, পরোপকার, কৃতজ্ঞতা, কৰ্তব্যানুরাগ, ধৈর্য ইত্যাদি সদ্‌গুণসমূহের যে সকল স্বাভাবিক মনোবৃত্তি তাহারাও দেবতা । এই দেবতাদিগের শুদ্ধস্বরূপ প্রত্যেকেরই স্বভাবত জানা আছে । কিন্তু লোভ, দ্বেষ, মাৎসৰ্য প্রভৃতি কোন কারণবশত যদি সে দেবতাদিগের প্রেরণা গ্ৰাহ্য না করে, তবে দেবতারা কি করিবেন ? ইহা সত্য যে, কখন কখন এই দেবতাদিগেরও মধ্যে লড়াই বাধিয়া যাওয়ায় কোন কার্য করিবার সময় কোন্‌ দেবতার প্রেরণা বলবত্তর বলিয়া স্বীকার করিব, সে বিষয়ে আমাদের সংশয় হয় । এই সংশয়ের নির্ণয়াৰ্থ ন্যায় কারুণ্যাদি দেবতাগণের অতিরিক্ত অপর কাহারো পরামর্শ গ্ৰহণ করা আবশ্যক বলিয়া মনে হয় । কিন্তু এই অবসরে অধ্যাত্মবিচারের কিংবা সুখদুঃখের তারতম্যের গোলযোগের মধ্যে না পড়িয়া আমরা আমাদের মনোদেবতার সাক্ষ্য গ্ৰহণ করিলে, সে-ই এই দুয়ের মধ্যে কোন মার্গ শ্রেয়স্কর, শীঘ্রই তাহার একটা নিষ্পত্তি করিয়া দেয় । তাহার কারণ এই যে, উপরি-উক্ত সমস্ত দেবতাদিগের মধ্যে মনোদেবতা শ্রেষ্ঠ । ‘মনোদেবতা’ শব্দে ইচ্ছা, ক্ৰোধ, লোভ প্রভৃতি সমস্ত মনোবিকারের সমাবেশ করা ঠিক নহে; কিন্তু এই শব্দের দ্বারা ভালমন্দ বাছাই করিবার যে ঈশ্বরদত্ত বা স্বাভাবিক শক্তি মনের মধ্যে আছে তাহাই ধরিতে হইবে । এই শক্তির ‘সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি(conscience, আধিদৈবতবাদ অর্থে Intuitionist School) এই এক বড় নাম আছে । কোন সংশয়প্রসঙ্গে মনুষ্য সুস্থ অন্তঃকরণে ও শান্তভাবে যদি ক্ষণমাত্র বিচার করিয়া দেখে তাহা হইলে এই সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি কখনই তাহাকে ধোখা লাগাইবে না বা পরিত্যাগ করিবে না । অধিক কি, এইরূপ প্রসঙ্গে “তুই আপনার মনকে জিজ্ঞাসা কর্‌” এইরূপই আমরা অন্যকে বলিয়া থাকি । কোন্‌ সদ্‌গুণের কোন্‌ সময়ে কতটা গুরুত্ব দিতে হইবে, এই বড় দেবতার নিকট সেই বিষয়ের একটা সুচী বা স্মারক লিপি সর্বদাই প্ৰস্তুত থাকে । সেই লিপি অনুসারে যথাসময়ে এই মনোদেবতা আপন নিষ্পত্তি ব্যক্ত করেন । মনে করা যে, কোন সময়ে আত্মসংরক্ষণ ও অহিংসার মধ্যে বিরোধ ঘটিল এবং দুর্ভিক্ষের সময়ে অভক্ষ্য ভক্ষণ করিবে কি না, এইরূপ সন্দেহ উপস্থিত হইল; তখন এই সংশয় নিবারণের জন্য শান্তচিত্তে এই মনোদেবতার পুজা অৰ্চনা করিলে তখনি “অভক্ষ্য ভক্ষণ কর” এই নিষ্পত্তি বাহির হইয়া পড়ে । সেইরূপ স্বার্থ ও পরার্থ বা পরেপকার ইহাদের মধ্যে বিরোধ হইলে তাহারও নির্ণয় এই মনোদেবতার অর্চনার দ্বারা করিতে হইবে । মনোদেবতার আপন ঘরের, ধর্মাধর্মের তারতম্যের এই সুচী বা স্মারকলিপি এক গ্ৰন্থকার শান্তভাবে বিচার করিয়া উপলব্ধি করিয়াছেন; এবং তাঁহার নিজ গ্রন্থে উহা প্ৰকাশ করিয়াছেন । (এই গ্ৰন্থকারের নাম James Martineau (জেমস্‌ মার্টিনো) । ইনি এই স্মারকলিপি নিজের Types of Ethical Theory (Vol II. P. 266. 3d Ed.) নামক গ্রন্থে দিয়াছেন । মার্টিনো আপন পন্থাকে Idiopsychological এই নাম দিয়াছেন কিন্তু আমি উহা আধিদৈবতবাদেরই সামিল করিতেছি ।) এই স্মারকলিপিতে, ভক্তিভাবকে প্রথম আসন অর্থাৎ অত্যুচ্চ স্থান দেওয়া হইয়াছে; এবং তাহার নীচে কারুণ্য, কৃতজ্ঞতা, ঔদার্য, বাৎসল্য প্রভৃতি ভাবসমূহকে ক্ৰমশঃ নীচের শ্রেণীতে ধরা হইয়াছে । নীচের ও উপরের ধাপের সদ্‌গুণের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইবামাত্ৰ অপেক্ষাকৃত উপরি-উপর ধাপের সদগুণগুলিকেই অধিকাধিক মান দেওয়া আবশ্যক, ইহাই এই গ্ৰন্থকারের অভিপ্ৰায় । কার্যাকার্যের বা ধর্মাধর্মের নির্ণয় করিতে হইলে, তাঁহার মতে, ইহা অপেক্ষা যোগ্য মাৰ্গ আর নাই । কারণ আমাদের দৃষ্টি খুব প্রসারিত করিয়া “অধিক লোকের অধিক সুখ” কিসে হয় তাহা সুনিশ্চিতরূপে নির্ধারিত করিলেও, এই তারতম্য বুদ্ধিতে ইহা বলিবার অধিকার নাই যে, অধিক লোকের যাহাতে সুখ হয় তুমি তাহা কর; তাই শেষে “অধিক লোকের অধিক হিত” আমি কেন করিব এই প্রশ্নের নিষ্পত্তি হয় না । সুতরাং সমস্ত ঝগড়া যেখানে ছিল সেইখানেই থাকিয়া যায় । কোন বিচারপতি রাজার নিকট অধিকার না পাইয়া কোন বিচার নিষ্পত্তি করিলে সেই নিষ্পত্তির যেরূপ পরিণাম হয়, দূরদৃষ্টিতে সুখদুঃখের বিচার করিয়া যে কার্যাকার্য নির্ণয় হয়, তাহারও সেইরূপ পরিণাম হইয়া থাকে । তুমি এইরূপ কর, এই কাজটা তোমায় করিতেই হইবে, একথা কেবল দূরদৃষ্টি কাহাকেও বলিয়া দিতে পারে না । কারণ, দূরদৃষ্টি যতই কেন হৌক না, তাহা মনুষ্যকৃত বলিয়া মনুষ্যের উপরে নিজের শাসনাধিকার বিস্তার করিতে পারে না । এইরূপ প্রসঙ্গে, আমি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ অধিকারবিশিষ্ট কাহারো নিকট হইতে আদেশ পাওয়া আবশ্যক । এবং ঐ কার্য ঈশ্বরদত্ত সদসদ্‌বিবেক-বুদ্ধিই করিতে পারে, কারণ উহা মনুষ্য অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ সুতরাং মনুষ্যের উপর নিজের অধিকার স্থাপনে সমর্থ । এই সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি বা ‘দেবতা’ স্বয়ম্ভূ হওয়াপ্রযুক্ত প্ৰচলিত ব্যবহারে এইরূপ বলিবার রীতি হইয়া গিয়াছে যে, আমার ‘মনোদেবতা’ আমাকে অমুক প্রকারের সাক্ষ্য দিতেছেন না । কেহ কোন দুষ্কর্ম করিলে পশ্চাত্তাপ বশত সে নিজেই লজ্জিত হয় এবং তাহার মনে সর্বদাই একটা যন্ত্রণা উপস্থিত হয় । ইহাও এই মনোদেবতার শাসনের ফল । ইহা দ্বারাও স্বতন্ত্ৰ মনোদেবতার অস্তিত্ব সিদ্ধ হয় । কারণ, আমার মন আমাকে কেন কষ্ট দেয়, আধিভৌতিক মতে উপরি-উক্ত সিদ্ধান্ত ব্যতীত এই প্রশ্নের আর কোন যুক্তি পাওয়া যায় না ।


2) মনোদেবতা সম্বন্ধে আমাদের গ্রন্থসমূহের বচন


পাশ্চাত্য আধিদৈবতবাদের সংক্ষিপ্ত সার উপরে প্রদত্ত হইল । পাশ্চাত্য দেশের এই মতবাদ প্ৰায় খৃষ্টধর্মের উপদেশকেরাই প্ৰবর্তিত করিয়াছেন । তাঁহাদের মতে ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে কেবল আধিভৌতিক সাধন অপেক্ষা এই ঈশ্বরদত্ত সাধন সুলভ ও শ্ৰেষ্ঠ অতএব গ্ৰাহ্য । আমাদের দেশে প্ৰাচীন কালে কর্মযোগশাস্ত্রের এইরূপ স্বতন্ত্র কোন পন্থা না থাকিলেও উক্ত প্রকারের মত প্রাচীন গ্ৰন্থসমূহের অনেক স্থানেই পাওয়া যায় । মনের বিভিন্ন বৃত্তিকে মহাভারতের অনেক স্থানে দেবতার স্বরূপ প্রদত্ত হইয়াছে দেখা যায় । পূর্ব প্রকরণে বলাও হইয়াছে যে, ধর্ম, সত্য, বৃত্ত, শীল, শ্রী প্রভৃতি দেবতা প্রহ্লাদের শরীর হইতে নিঃসৃত হইয়া ইন্দ্রের শরীরে কিরূপে প্রবেশ করিয়াছিল । কার্যাকার্য বা ধর্মাধর্মের নির্ণয়কারী দেবতার নামও ‘ধর্ম’ই দেওয়া হইয়াছে । শিবি রাজার আত্মবলের পরীক্ষা করিবার জন্য শ্যেনের রূপ ধরিয়া এবং যুধিষ্ঠিরের পরীক্ষা করিবার জন্য প্রথমে যক্ষের রূপ ধরিয়া ও শেষে কুকুরের রূপ ধরিয়া ধর্ম প্রকট হইয়াছিলেন এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে । এমন কি ভগবদ্‌গীতাতে[১০|৩৪] কীর্তি, শ্রী, বাক্‌, স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা ইহারা দেবতা বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে । তন্মধ্যে স্মৃতি, মেধা, ধৃতি ও ক্ষমা ইহারা মনের ধর্ম । মনও এক দেবতা এবং পরব্রহ্মের প্রতীক মানিয়া তাহার উপাসনাও উপনিষদে কথিত হইয়াছে [তৈ|৩|৪; ছা|৩|১৮]“মনঃপূতং সমাচরেৎ”, - মনে যাহা শুদ্ধ বলিয়া বুঝিবে তাহাই করিবে – মনু যখন ইহা বলিতেছেন [৬|৪৬], তখন ইহাই মনে হয় যে, ‘মন’ শব্দে মনোদেবতাই মনুর অভিপ্রেত । প্রচলিত ব্যবহারে আমি বলি যে, “যাহা ভাল লাগে তাহাই করিবে” ।

‘মনঃপূত’ এই শব্দের অর্থ মারাঠীতে উল্টা হইয়া গিয়াছে, এবং অনেক সময় যাহা মনে হয় তাহাই যদৃচ্ছাক্রমে করিতে প্রবৃত্ত হইলে তাহা ‘মনঃপূত’ আচরণ এইরূপ আমরা বলিয়া থাকি । কিন্তু এই শব্দের প্রকৃত অর্থ “মনেতে যাহা পবিত্র কিংবা শুদ্ধ বলিয়া উপলব্ধি হইবে তাহাই করিবে” – এইরূপ । মনুসংহিতার চতুর্থ অধ্যায়ে মনু এই বিষয় আরো স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন [মনু|৪|১৬১]
যৎকর্ম কুর্বতোহস্য স্যাৎ পরিতোষোহন্তরাত্মনঃ ৷
তৎ প্রযত্নেন কুবীর্ত বিপরীতং তু বর্জয়েৎ ॥
অর্থাৎ - “যে কর্ম করিলে আমার অন্তরাত্মা সন্তুষ্ট হয় তাহা সযত্নে করিবেক, এবং তাহার বিপরীত কর্ম পরিত্যাগ করিবেক” । সেইরূপ আবার চাতুর্বর্ণ্যধর্মাদির ব্যবহারিক নীতির মূলতত্ত্ব বলিবার সময় মনুযাজ্ঞবল্ক্যাদি স্মৃতিগ্রন্থকারও বলিতেছেন :-
বেদঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ ৷
এতচ্চতুর্বিধং প্রাহুসক্ষাদ্ধর্মস্য লক্ষণম্‌ ॥
অর্থাৎ - “বেদ, স্মৃতি, শিষ্টাচার এবং আপনার আত্মার ভাল লাগা, ধর্মের এই চারি মূলতত্ত্ব” [মনু|২|১২] । “আপনার আত্মার যাহা ভাল লাগে” ইহার অর্থ – মনে যাহা শুদ্ধ বলিয়া উপলব্ধি হয় । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে শ্রুতি, স্মৃতি ও সদাচার হইতে কোন কার্যের ধর্মাধর্মত্ব নির্ণয় হইতে না পারিলে তখন উহা নির্ণয় করিবার চতুর্থ সাধন হইতেছে ‘মনঃপূততা’ এইরূপ বুঝিতে হইবে । মহাভারতে প্রহ্লাদইন্দ্রের কথা বিবৃত করিবার পর “শীলের” লক্ষণ দিবার সময় ধৃতরাষ্ট্র এইরূপ বলিয়াছেন –
যদন্যেষাং হিতং ন স্যাৎ আত্মনঃ কর্ম পৌরুষম্‌ ৷
অপত্রপেত বা যেন ন তৎ কুর্য্যাৎ কথঞ্চন ॥
অর্থাৎ - আমার যে কর্ম লোকের হিতকর নহে কিংবা যাহার জন্য নিজেরই লজ্জা হয়, সে কর্ম কখনই করা উচিত নহে [মভা|শাং|১২৪|৬৬] । “লোকের হিতকর নহে” ও “লজ্জা হয়” এই দুই পদে, ‘অধিক লোকের অধিক হিত’ ও ‘মনোদেবতা’ এই দুই পক্ষেরই উল্লেখ এই শ্লোকে একত্র কিরূপ উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহার প্রতি পাঠক লক্ষ্য করিবেন । মনুস্মৃতিতে[১২|৩৫|৩৭] উক্ত হইয়াছে যে, যে কর্ম করিলে লজ্জা বোধ হয় তাহা তামসিক এবং যে কর্ম করিলে লজ্জা বোধ হয় না ও অন্তরাত্মা সন্তুষ্ট থাকে তাহা সাত্ত্বিকধম্মপদ নামক বৌদ্ধ গ্রন্থেরও এই প্রকার বিচার দৃষ্ট হয় [ধম্মপদ ৬৭ ও ৬৮ দেখ] । কর্মাকর্মের নির্ণয়ে কোন সংশয় উপস্থিত হইলে –
সতাং হি সান্দহপদেষু বস্তুষু প্রমাণমন্তঃকরণপ্রবৃত্তয়ঃ ॥
অর্থাৎ - “সৎব্যক্তি নিজের অন্তঃকরণের সাক্ষ্যই প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করেন” – কালিদাসও তাহা বলিয়াছেন [শকুং|১|২০] । পাতঞ্জলযোগ শিক্ষা দেয় যে, চিত্তবৃত্তির নিরোধ করিয়া একই বিষয়ের উপর মনকে স্থির রাখিতে হইবে । এই যোগশাস্ত্র আমাদের এখানে বহু প্রাচীন কাল হইতে প্রচলিত; তাই কর্মাকর্ম সম্বন্ধে কোন সন্দেহ উপস্থিত হইলে অন্তঃকরণকে স্বস্থ ও শান্ত করিয়া যাহা উচিত মনে হয় তাহাই করিবে – এ কথা আমাদের দেশের কাহাকেও শিখাইবার আবশ্যকতা নাই । সমস্ত স্মৃতিশাস্ত্রের আরম্ভে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, স্মৃতিকার ঋষি নিজের মনকে একাগ্র করিয়াই ধর্মাধর্ম বিবৃত করিতেন [মনু|১|১] । ‘যে কোন কর্মে মনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা উচিত’ – এই মার্গ প্রথম দৃষ্টিতে অত্যন্ত সুলভ বলিয়া মনে হয়, কিন্তু যখন তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে ‘শুদ্ধ মন’ কাহাকে বলে এ বিষয়ে সূক্ষ্ম বিচার করিতে থাকি; তখন এই সহজ মতটি শেষ পর্যন্ত কাজ দিতে পারে না; কারণ আমাদের শাস্ত্রকারেরা কর্মযোগশাস্ত্রের ইমারত এই কাঁচা ভিত্তির উপর দাঁড় করান নাই । এই তত্ত্বজ্ঞানটি কি, এক্ষণে তাহার বিচার করিতে হইবে । কিন্তু তৎপূর্বে পাশ্চাত্য আধিভৌতিকবাদীরা এই আধিদৈবত মতবাদের খণ্ডন কিরূপ করিয়াছেন তাহার উল্লেখ করা আবশ্যক । কারণ, এই বিষয়ে আধ্যাত্মিক ও আধিভৌতিক এই দুই পন্থার যুক্তিগুলি ভিন্ন হইলেও এই উভয়ের শেষ সিদ্ধান্ত একই প্রকার । অতএব প্রথমে আধিভৌতিক যুক্তিগুলি বলিলে আধ্যাত্মিক যুক্তিসমূহের গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা পাঠকদিগের শীঘ্র উপলব্ধি হইবে ।

উপরে বলা হইয়াছে যে, আধিদৈবিক পন্থায় শুদ্ধ মনকেই অগ্রস্থান দেওয়া হইয়াছে । ইহা হইতে প্রকট হইতেছে যে, ‘অধিক লোকের অধিক সুখ’ এই আধিভৌতিক নীতিপন্থায় কর্তার বুদ্ধি বা হেতুর কোন বিচার না করিবার যে দোষ পূর্বে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে তাহা এই আধিদৈবত মতে প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । কিন্তু সদসদ্‌বিবেকরূপী শুদ্ধ মনোদেবতা কাহাকে বলা হইবে তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে, এই পন্থাতেও অন্যান্য অনেক অপরিহার্য বাধা আসিয়া উপস্থিত হয় । যে কোন বিষয় ধর না কেন, তাহার সমস্ত দিক বিচার করিয়া তাহা গ্ৰাহ্য কি অগ্ৰাহ্য, করিবার যোগ্য কি অযোগ্য, অথবা তাহা লাভজনক বা সুখজনক কি না, তাহা নির্ধারণ করা, নাক কিংবা চোখের কাজ নহে; কিন্তু এই কাজ এক স্বতন্ত্র ইন্দ্ৰিয়ের, যাহাকে মন বলা যায় । অর্থাৎ কার্যাকার্যের কিংবা ধর্মাধর্মের নির্ণয় মনই করিয়া থাকে; - তাকে তুমি ইন্দ্ৰিয়ই বল আর দেবতাই বল । আধিদৈবতবাদের মত যদি এইমাত্র হয় তাহা হইলে কোনই আপত্তি নাই । কিন্তু পাশ্চাত্য আধিদৈবত পক্ষ ইহা অপেক্ষা আরও একপদ অগ্রসর হইয়াছেন । তাঁহারা বলেন যে, ভাল বা মন্দ (সৎ বা অসৎ) ন্যায্য বা অনায্য, ধর্ম বা অধর্মের নির্ণয় করা এক; আর কোন পদার্থ ভারী বা হাল্কা, সাদা বা কালো, কিংবা গণিতের কোন উদাহরণ ঠিক কি ভুল, তাহা নির্ণয় করা আর এক কথা । এই দুই বিষয় অত্যন্ত ভিন্ন । ইহার মধ্যে দ্বিতীয় প্রকার বিষয়ের নির্ণয় মন ন্যায়শাস্ত্রের পদ্ধতিক্রমে করিতে পারে; কিন্তু প্ৰথম প্রকার বিষয়ের নিষ্পত্তি কেবলমাত্ৰ মন করিতে অসমৰ্থ, অতএব সেই কার্য সদসদ্‌বিবেচনারূপ যে দেবতা মনেতে আছেন কেবল তিনিই করিয়া থাকেন । ইহার কারণ তাঁহারা এইরূপ বলেন যে, কোনও হিসাব ঠিক কি ভুল স্থির করিবার সময় আমরা সেই হিসাবের তেরিজ, গুণফল প্ৰভৃতি পরীক্ষা করিয়া তাহার পর আমাদের মত স্থির করি; অর্থাৎ এই বিষয়ের নির্ণয় করিবার পূর্বে মনের অন্য কোন ক্রিয়া বা ব্যাপার করা দরকার । কিন্তু ভাল মন্দের নির্ণয় সেরূপ নহে । কোন মনুষ্য কাহাকে খুন করিয়াছে শুনিবা মাত্র “ছি ! সে বড়ই মন্দ কাজ করিয়াছে” এই রূপ উচ্ছ্বাসোক্তি আমাদের মুখ দিয়া একেবারেই বাহির হইয়া পড়ে; সে সম্বন্ধে আমাদের কোন বিচার করিতে হয় না । সুতরাং কোনই বিচার না করিয়া আপনাপনি যে নির্ণয় করা যায়, এবং বিচার করিয়া যে নির্ণয় করা যায়, এই দুইই একই মনোবৃত্তির ব্যাপার, তাহা বলিতে পারা যায় না । সেই জন্য সদসদ্‌বিবেচনাশক্তিকেও এক স্বতন্ত্র মানসিক দেবতা মানিতে হয় । সকল মনুষ্যের অন্তঃকরণে এই শক্তি বা দেবতা সমানরূপে জাগ্ৰত থাকায় সকলেই হত্যাকাণ্ডকে অপরাধ মনে করে; এবং সে সম্বন্ধে কাহাকে কিছু শিখাইতেও হয় না । 


3) আধিদৈবত পক্ষের উপর আধিভৌতিক পক্ষের আপত্তি


আধিভৌতিক পন্থার লোকেরা এই আধিদৈবিক যুক্তিবাদের এই উত্তর দেন যে, কেবল “আমি দুএকটা বিষয়ের নির্ণয় একেবারেই করিতে পারি” এইটুকু হইতে স্বীকার করিতে পারা যায় না যে, যে বিষয়ের নির্ণয় আমাদের বিচার করিয়া করা হয়, তাহা উহা হইতে ভিন্ন । কোন কাজ দ্রুত বা রহিয়া বসিয়া করা অভ্যাসের কাজ । ধর, হিসাবের কথা । ব্যাপারী লোক মন থেকেই সেরছটাকের দর চট্‌ করিয়া মুখে মুখে গণিতের প্রণালীতে হিসাব করিয়া বলিতে পারে; তাই বলিয়া বলা যায় না যে, উত্তম গণিতবেত্তা হইতে তাহার গুণন করিবার শক্তি বা দেবতা ভিন্ন । সাধনায় দ্বারা কোন বিষয় এমনি অভ্যাস হইয়া যায় যে কিছু বিচার না করিয়াও মনুষ্য তাহা শীঘ্র ও সহজে করিয়া যায় । উত্তম লক্ষ্যভেদী মনুষ্য উড়োপাখী বন্দুকে সহজে মারিয়া থাকে, তাই বলিয়া লক্ষ্যভেদের এক স্বতন্ত্র দেবতা আছে এরূপ কেহ বলিতে পারে না । শুধু তাহাই নহে, কিরূপে ‘তাক’ করিতে হইবে, উড়োপাখীর বেগ কিরূপে গণনা করিতে হইবে ইত্যাদি শাস্ত্রীয় উপপত্তিও কেহ নিরর্থক ও ত্যাজ্য বলিতে পারে না । নেপোলিয়ন সম্বন্ধে এই কথা প্ৰসিদ্ধ আছে যে, রণক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া একবার চারিদিকে তাকাইয়া দেখিলেই শত্রুর ছিদ্র কোথায়, তাহা তৎক্ষণাৎ তাহার নজরে পড়িত । কিন্তু তাই বলিয়া যুদ্ধকলা এক স্বতন্ত্র দেবতা এবং অন্য মানসিক শক্তির সহিত তাহার কোন সম্বন্ধ নাই, এরূপ কেহ বলে না । কোন কাজে কাহারও বুদ্ধি স্বভাবত বেশী, আর কাহারও বা কম, ইহা সত্য । কিন্তু কেবল সেই কারণেই উভয়ের বুদ্ধি বস্তুত ভিন্ন, তাহা আমি বলিতে পারি না । তাছাড়া এ কথাও সত্য নহে যে, কার্যাকার্যের কিংবা ধর্মাধর্মের নির্ণয় একাএক হইয়া যায় । যদি তাহাই হইত, তবে এই প্ৰশ্নই কখনও উপস্থিত হইত না যে, “অমুক কাজ করা উচিত অথবা করা অনুচিত” । ইহা সুস্পষ্ট যে, এই প্রকার প্রশ্ন প্ৰসঙ্গ অনুসারে অর্জুনের ন্যায় সকলেরই সম্মুখে উপস্থিত হইয়া থাকে; এবং কার্যাকার্যনির্ণয়ের কোন বিষয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির অভিপ্রায়ও ভিন ভিন্ন হইয়া থাকে; সদসদ্‌বিবেচনশক্তিরূপ স্বয়ম্ভূ দেবতা যদি একই হন তবে এই ভেদ কেন ? কাজেই বলিতে হয় যে, মনুষ্যের বুদ্ধি যে পরিমাণে সুশিক্ষিত বা সুসংস্কৃত হইবে, সেই পরিমাণেই যোগ্যতার সহিত সে কোন বিষয়ের, নির্ণয় করিবে । এমন অনেক অসভ্য লোক আছে যাহারা মনুষ্যহত্যাকে অপরাধ মনে না করিয়া হত মনুষ্যের মাংসও আনন্দে আহার করে ! অসভ্য লোকের কথা ছাড়িয়া দাও । সভ্য দেশেও দেখা যায় যে, দেশাচার অনুসারে কোন এক দেশে যাহা গর্হিত বলিয়া মনে করে, অন্য এক দেশে তাহাই সর্বমান্য হইয়া থাকে । উদাহরণ - এক স্ত্রী থাকিতে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্ৰহণ করা বিলাতে অপরাধ বলিয়া গণ্য; কিন্তু হিন্দুস্থানে তাহা বিশেষ দুষণীয় বলিয়া বিবেচিত হয় না । ভরপুরসভার মধ্যে মাথা হইতে পাগড়ী খুলিয়া বসা হিন্দুলোকের নিকট লজ্জা ও অমৰ্যাদার কথা কিন্তু ইংরেজ লোক মাথা হইতে টুপি খোলাই সভ্যতার লক্ষণ মনে করে । যদি ঈশ্বরদত্ত বা স্বাভাবিক সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি প্ৰযুক্তই মন্দ কর্ম করিতে লজ্জাবোধ করা সত্য হয়, তাহা হইলে সকলেই একই কার্যে একই রকম লজ্জা বোধ করে না কেন ? বড় বড় দস্যুও যাহার অন্ন একবার গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা নিন্দনীয় মনে করে; কিন্তু বড় বড় সুসভ্য পাশ্চাত্য রাষ্ট্রেও, পার্শ্ববর্তী রাজ্যের লোকদিগকে যুদ্ধে বধ করা স্বদেশভক্তির লক্ষণ মনে করে । সদসদ্‌বিবেচনশক্তিরূপ দেবতা যদি একই হয় তাহা হইলে এই পার্থক্য কেন মানা যায় ? এবং যদি বলা যায় যে, সদসদ্‌বিবেচনাশক্তিরও শিক্ষা অনুসারে কিংবা দেশাচার অনুসারে ভেদ হয়, তাহা হইলে স্বয়ম্ভূ নিত্যত্ববিষয়ে বাধা আসে । অসভ্য অবস্থা ছাড়িয়া মনুষ্য যেমন-যেমন সভ্য হইতে থাকে সেই অনুসারে তাহার মন ও বুদ্ধি বিকশিত হইতে থাকে; এবং এই প্রকারে বুদ্ধির বিকাশ হইলে পর পূর্বে অসত্য অবস্থায় থাকিতে যে সকল বিষয়ে বিচার সে করিতে পারিত না, এক্ষণে সত্য অবস্থায় সেই সকল বিষয়েরই বিচার সে সত্বর করিতে প্ৰবৃত্ত হয় । অথবা বলিতে হয় যে, এই প্রকার বুদ্ধির বিকাশ হওয়াই সভ্যতার লক্ষণ । সুসভ্য কিংবা সুশিক্ষিত মনুষ্য যে অপরের কোন বস্তু দেখিবামাত্র চাহিয়া বসে না বা লইতে ইচ্ছা করে না, ইহা তাহার ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের পরিণাম । সেইরূপ ভালমন্দ নির্ণয় করিবার মনের শক্তিও আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পায়, এবং এখন তো কোন কোন বিষয়ে উহা এতটা অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে যে, কোন কোন বিষয়ে কিছুমাত্র বিচার করিবার অপেক্ষা না করিয়াই আমরা নিজের নৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করি । চক্ষু দ্বারা নিকটের কিংবা দূরের বস্তু দেখিতে হইলে চক্ষু, শিরা ও স্নায়ু ন্যুনাধিক পরিমাণে সঙ্কুচিত করিতে হয়; এবং এই সব ক্রিয়া এত দ্রুত হইয়া থাকে যে আমরা তাহা জানিতেও পারি না । কিন্তু তাহার দরুণ এই বিষয়ের উপপত্তি কেহ কি অনুপযোগী মনে করিয়াছে ? 


4) সদসদ্বিবেক কোন নিছক শক্তি নহে


সার কথা, মনুষ্যের মন বা বুদ্ধি সর্বকালে ও সর্বকাজে একই । কালো ও সাদার নির্ণয় এক প্রকারের বুদ্ধি করে এবং ভালমন্দের নির্ণয় অন্য প্রকারের বুদ্ধি করে, এ কথা ঠিক নহে । কাহার বুদ্ধি কম থাকে, আর কাহারও বুদ্ধি অশিক্ষিত বা অপরিণত থাকে, এইটুকুই যা প্ৰভেদ । এই ভেদের প্রতি, এবং কোন কার্য দ্রুত করিতে পারা যে অভ্যাস ও সাধনার ফল, এই উপলব্ধির প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া পাশ্চাত্য আধিভৌতিকবাদীরা স্থির করিয়াছেন যে, মনের যে স্বাভাবিক শক্তিসমূহ আছে তাহার ওদিকে সদসদ্‌বিচারশক্তি বলিয়া কোন আলাদা স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট শক্তি স্বীকার করিবার প্রয়োজন নাই ।


5) অধ্যাত্ম পক্ষের আপত্তি - ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার


আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রকারদিগের এই সম্বন্ধীয় চরম সিদ্ধান্তও পাশ্চাত্য আধিভৌতিকবাদীদিগেরই ন্যায় । স্বস্থ ও শান্ত চিত্তে সকল বিষয়ের বিচার করা আবশ্যক, ইহা তাহারা স্বীকার করেন । কিন্তু ধর্মাধর্মনির্ণয়ের বুদ্ধি এক, এবং কালোসাদা বুঝিবার বুদ্ধি আর-এক, এ মত তাঁহারা স্বীকার করেন না । তাঁহারা, ইহাও প্রতিপাদন করিয়াছেন যে, মন যে পরিমাণে সুশিক্ষিত হইবে সেই পরিমাণে সে ভালমন্দ নির্ণয় করিতে পারিবে, তাই মনের উন্নতিসাধনের জন্য প্ৰত্যেকের যত্ন করা আবশ্যক; এবং এই উৎকর্ষ কিরূপে সাধন করিতে হইবে তাহার নিয়মও উহারা বলিয়া দিয়াছেন । কিন্তু সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি সাধারণ বুদ্ধি হইতে কোন ভিন্ন বস্তু বা ঈশ্বরের দান, এ মত তাঁহারা মানেন না । মনুষ্য কিরূপে জ্ঞান লাভ করে এবং তাহার মন বা বুদ্ধির ব্যাপার কেমন করিয়া চলে, প্ৰাচীন কালে তাহার সূক্ষ আলোচনা হইয়া গিয়াছে । এই আলোচনা ‘ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার’ নামে অভিহিত হইয়া থাকে । ক্ষেত্র অর্থে শরীর এৰং ক্ষেত্ৰজ্ঞ অর্থে আত্মা । এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার আধ্যাত্মবিদ্যার মূল । এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞ বিদ্যার ঠিক্‌ জ্ঞান হইলে পর, শুধু সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি কেন, কোন মনোদেবতারই অস্তিত্ব আত্মা হইতে উৎকৃষ্ট বা স্বতন্ত্র বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না । এই অবস্থাতে আধিদৈবতপক্ষ স্বতই দুৰ্বল হইয়া পড়ে । তাই এক্ষণে এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিদ্যারই সংক্ষেপে বিচার করা হইবে । ভগবদগীতার অনেক সিদ্ধান্তেরই প্রকৃত অৰ্থও এই বিচারসূত্রে পাঠকের ঠিক উপলব্ধি হইবে । 


6) মনুষ্যদেহরূপ বৃহৎকারখানা - কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়


মনুষ্যের দেহ (পিণ্ড, ক্ষেত্র, বা শরীর) একটা মস্ত বড় কারখানা বলিলেও চলে । কোন কারখানায় যেরূপ বাহিরের পণ্যদ্রব্য প্রথমে ভিতরে লইয়া যাওয়া হয়, এবং তাহার পর সেই মালের বাছাই বা ব্যবস্থা করিয়া পরে কারখানার উপযোগী পদার্থ কোনগুলি এবং অনুপযোগী কোনগুলি তাহা স্থির করিয়া বাহির হইতে ভিতরে-আনা কাঁচা মাল হইতে নূতন পদার্থ প্রস্তুত করিয়া তাহা বাহিরে পাঠান হয়; সেইরূপ মনুষ্যের দেহের মধ্যেও প্রতিক্ষণে অনেক ব্যাপার চলিতে থাকে । এই জগতের পাঞ্চভৌতিক পদার্থসম্বন্ধে মনুষ্যের জ্ঞানপ্ৰাপ্তির জন্য মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমূহই প্ৰথম সাধন । এই ইন্দ্ৰিয়সমূহের দ্বারা জাগতিক পদার্থের প্রকৃত বা মূল স্বরূপ জানা যায় না । আধিভৌতিকবাদীগণের মত এই যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সমক্ষে পদার্থসমূহ যেরূপ প্ৰতিভাত হয়, তাহাদের যথার্থ স্বরূপ তাহাই । কিন্তু কাল যদি আমরা কোন নব ইন্দ্রিয় প্রাপ্ত হই, তাহা হইলে তাহার, দৃষ্টিতে জাগতিক পদার্থের গুণধর্ম বর্তমান হইতে যে ভিন্ন হইবে, তাহা আর বলিতে হইবে না । মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমূহের মধ্যেও দুই ভেদ আছে - এক কর্মেন্দ্ৰিয়, দ্বিতীয় জ্ঞানেন্দ্ৰিয় । হাত, পা, বাক-যন্ত্র, গুদ (পায়ু/মলদ্বার অর্থে ব্যবহৃত, স্ত্রী-যোনি অর্থে নয়) ও উপস্থ (জননেন্দ্ৰিয়) এই পাঁচটী কর্মেন্দ্ৰিয় । আমরা আমাদের শরীরের দ্বারা যে কোন ব্যবহার করি সে সমস্তই এই কর্মেন্দ্ৰিয়ের দ্বারাই করিয়া থাকি । নাক, চোখ, কান, জিভ ও ত্বক, এই পাঁচটী জ্ঞানেন্দ্রিয় । চক্ষু দ্বারা রূপ, জিহ্বা দ্বারা রস, কৰ্ণ দ্বারা শব্দ, নাসিকা দ্বারা গন্ধ ও ত্বক দ্বারা স্পর্শ উপলব্ধি করি । যে কোন বাহ্য পদার্থই ধর না কেন, তৎসম্বন্ধে আমাদের যে জ্ঞান হয়, তাহা উক্ত পদার্থের রূপ-রস শব্দ-গন্ধ-স্পর্শের বাহিরে আর কিছুই নহে । উদাহরণ যথা - ধর, এক টুকরা সোনা ? উহা চোখের দৃষ্টিতে পীতবর্ণ, ত্বকের নিকট কঠিন বলিয়া প্ৰতিভাত হয়, পিটিলে লম্বা হয়, ইত্যাদি তাহার যে গুণ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় তাহাকেই আমরা সোনা বলি এবং এই গুণসকল বারংবার এক পদার্থের মধ্যে একই রকমে দেখিতে পাওয়া গেলে, আমাদের দৃষ্টিতে সোনা এক স্বতন্ত্র পদার্থ হইয়া দাঁড়ায় । বাহিরের মাল ভিতরে নেওয়া এবং ভিতরের মাল বাহিরে পাঠিয়ে দিবার জন্য যেরূপ কোন কারখানার দরোজা থাকে, সেইরূপ মানবদেহে বাহিরের মাল ভিতরে আনিবার জন্য জ্ঞানেন্দ্ৰিয়রূপী দ্বার আছে এবং ভিতরের মাল বাহিরে পাঠাইবার জন্য কর্মেন্দ্ৰিয়রূপ দ্বার আছে । সূর্যের কিরণ কোন পদার্থের উপর পড়িয়া তথা হইতে আবার ফিরিয়া আমাদের চোখের মধ্যে প্ৰবেশ করিলে আমাদের আত্মায় সেই পদার্থের রূপসম্বন্ধে জ্ঞান হইয়া থাকে । কোন পদার্থ হইতে নিঃসৃত গন্ধের সূক্ষ্ম পরমাণু আমাদের নাকের মজ্জাতন্তুর উপর আসিয়া পড়িলে আমাদের নিকট তাহার গন্ধ আসে । অন্য জ্ঞানেন্দ্রিয়ের ব্যাপারও এইরূপেই চলিয়া থাকে । জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সকল এইরূপে ব্যাপার করিতে থাকিলে তাহাদের দ্বারা বাহ্য জগতের পদার্থের জ্ঞান হইতে থাকে । কিন্তু জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সকল যে কোন ব্যাপার করে তাহাদের জ্ঞান স্বতঃ তাহাদের হয় না, তাই জ্ঞানেন্দ্ৰিয়দিগকে ‘জ্ঞাতা’ না বলিয়া শুধু বাহিরের মাল ভিতরে আনিবার ‘দরোজা’ বলা হইয়াছে । এই দরোজা দিয়া মাল ভিতরে আসিয়া পড়িলে পর, তাহার পরবর্তী ব্যবস্থা করা মনের কাজ । উদাহরণ যথা – দ্বিপ্রহর হইলে ঘড়িতে ঘণ্টা বাজিতে থাকিলে তখনই আমাদের মন বুঝিতে পারে না যে কয়টা বাজিয়াছে । কিন্তু যেমন যেমন ঘড়িতে ‘ঠনঠন’ করিয়া এক একটী আওয়াজ হইতে থাকে, তেমনি তেমনি বায়ুতরঙ্গ আমাদের কানে আসিয়া আঘাত করে, এবং মজ্জাতন্তুর দ্বারা প্ৰত্যেক আওয়াজের পৃথক পৃথক সংস্কার প্রথমে আমাদের মনের উপর হয় এবং শেষে এই সকল মিলিত করিয়া কয়টা বাজিল তাহা আমরা স্থির করি । জ্ঞানেন্দ্ৰিয় পশুদিগেরও আছে; ঘড়ির এক এক ঠোকা যেমন যেমন পড়িতে থাকে, তেমনি তেমনি প্ৰত্যেক ধ্বনির সংস্কার তাহার কান দিয়া মন পর্যন্ত পৌঁছায়; কিন্তু তাহারা ঐ সমস্ত সংস্কারকে একত্র করিয়া বারোটা বাজিল বলিয়া স্থির যে করিতে পরিবে, তাহাদেৱ মন এতটা বিকশিত হয় নাই । এই শব্দ শাস্ত্রীয় পরিভাষায় বলিতে হইলে এইরূপ বলা হইয়া থাকে যে, পশুর একাধিক সংস্কারের পৃথক পৃথক জ্ঞান হইলেও তাহার সেই অনেকতার মধ্যে একত্বের বোধ হয় না । ভগবদ্‌গীতাতে আছে - “ইন্দ্ৰিয়াণি পরাণ্যাহুঃ ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ” - অৰ্থাৎ ইন্দ্ৰিয়সকল (বাহ্য) পদাৰ্থ অপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ এবং ইন্দ্ৰিয় অপেক্ষাও মন শ্রেষ্ঠ [গীতা|৩|৪২] । উপরে যাহা লিখিত হইয়াছে, তাহাই ইহারও ভাবার্থ । পূর্বে বলিয়া আসিয়াছি যে, মন স্থির না হইলে চোখ খোলা থাকিলেও কিছুই দেখা যায় না এবং কান খোলা থাকিলেও কিছুই শোনা যায় না । তাৎপর্য এই যৈ, এই দেহরূপী কারখানায় ‘মন’ একটী মুন্সী (কেরাণী), যাহার নিকট জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা বাহিরের সমস্ত মাল প্রেরিত হয়; এবং এই মুন্সী (মন) ঐ মালের যাচাই করে । এখন বিচার করিতে হইবে যে, এই যাচাই কিরূপে করা হয়, এবং এ পর্যন্ত আমরা যাহাকে সাধারণত ‘মন’ বলিয়া আসিয়াছি, তাহারও আর কত প্ৰকার ভেদ করা যাইতে পারে, কিংবা একই মন অধিকারভেদে কি-কি পৃথক নাম প্রাপ্ত হয় ।


7) মন ও বুদ্ধির পৃথক্‌ পৃথক্‌ কাজ


জ্ঞানেন্দ্ৰিয়যোগে মনের উপর যে সকল সংস্কার ঘটে সেগুলি প্ৰথমে একত্র করিয়া এবং তাহাদের পরস্পর তুলনা করিয়া নির্ণয় করিতে হয় যে, তাহাদের মধ্যে ভাল, আর কোন্‌টি মন্দ, কোন্‌টি গ্ৰাহ্য আর কোন্‌টি ত্যাজ্য, এবং কোন্‌টি লাভজনক ও কোন্‌টি ক্ষতিজনক । ইহা নিৰ্ণয় হইলে পর, তাহাদের মধ্যে যেটি ভাল, গ্ৰাহ্য, লাভজনক, উচিত বা করিবার যোগ্য তাহাই করিতে আমরা প্ৰবৃত্ত হই । ইহাই সাধারণ মানসিক ব্যবহার । উদাহরণ যথা - আমরা কোন বাগানে গমন করিলে, চক্ষু ও নাসিকা এই দুই ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা আমাদের মনের উপর বাগানের গাছ ও ফুলগুলির সংস্কার ঘটিয়া থাকে । কিন্তু এই ফুলগুলির মধ্যে কোন ফুলের গন্ধ ভাল ও কোন্‌টির গন্ধ খারাপ, এই জ্ঞান আমাদের আত্মাতে না হইলে, কোনও ফুল হস্তগত করিবার ইচ্ছা মনে উৎপন্ন হয় না এবং তাহা তুলিবার উদ্যোগও আমরা করি না । অতএব সমস্ত মনোব্যাপারকে মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত করা যাইতে পারে - (১) জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা বাহ্য পদার্থের জ্ঞান পাইয়া সেই সকল সংস্কারের তুলনার জন্য ব্যবস্থাপূর্বক সাজাইয়া রাখা; (২) এইরূপ ব্যবস্থার পর তাহাদের ভালমন্দের সারাসার বিচার করিয়া কোনটি গ্রাহ্য ও কোনটি ত্যাজ্য তাহা স্থির করা; এবং (৩) এই নিশ্চয় হইলে পর, গ্ৰাহ্য বস্তু গ্ৰহণ করিবার ও অগ্ৰাহ্য বস্তু ফেলিয়া দিবার ইচ্ছা উৎপন্ন হইয়া আবার সেই অনুসারে প্রবৃত্তি হওয়া । কিন্তু ইহা আবশ্যক নহে যে, এই তিন ক্রিয়া ব্যবধান বিনা সঙ্গে সঙ্গে একের পিছনে আর একটি হইতে থাকিবে । ইহা সম্ভব যে, পূর্বদৃষ্ট কোন বস্তুর ইচ্ছা আজ হইল; কিন্তু - ইহাতেই বলা যাইতে পারে না যে, উক্ত তিন ক্রিয়ার মধ্যে কোন একটি ক্রিয়ার প্ৰয়োজন নাই । বিচারের কাছারী এক হইলেও সেখানে যেমন কাজের এইরূপ বিভাগ আছে - প্ৰথমে বাদী ও প্ৰতিবাদী কিংবা তাহাদের উকিল আপন আপন সাক্ষ্য ও প্ৰমাণ বিচারপতির সমক্ষে উপস্থিত করে, তাহার পর উভয়পক্ষের সাক্ষীসাবুদ, দেখিয়া তাহার উপর বিচারপতি আপন বিচার নিষ্পত্তি করেন, এবং বিচারপতি-কৃত নিষ্পত্তি শেষে নাজির আমলে আনে; ঠিক সেইরূপ এ পৰ্যন্ত যে মুন্সীকে আমরা সাধারণত ‘মন’ বলিয়া আসিয়াছি, তাহার ব্যাপারসমূহেরও বিভাগ হইয়া থাকে । তন্মধ্যে সম্মুখে উপস্থিত বিষয়সমূহের সারাসার বিচার করিয়া কোন এক বিষয় অমুক প্রকারেরই (এবমেব) অন্য প্রকারের নহে (নাহন্যথা), এইরূপ নিশ্চয় করিবার কাজ (অর্থাৎ কেবল বিচারপতির কাজ) বুদ্ধি নামক ইন্দ্রিয়ের । উপরে কথিত সমস্ত মনোব্যাপার হইতে এই সারাসার বিবেকশক্তিকে পৃথক করিলে পর, কেবল বাকী সমস্ত ব্যাপারই যে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা হইয়া থাকে, তাহাকেই সাংখ্য ও বেদান্তশাস্ত্ৰে মন বলে [সাং|ক|২৩ ও ২৭ দেখ] । এই মন উকিলের মতো কোন বিষয় এইপ্রকার (সঙ্কল্প), কিংবা ইহার বিপরীতে ঐ প্রকার (বিকল্প), ইত্যাদি কল্পনাসমূহকে বুদ্ধির সমক্ষে নির্ণয়ের জন্য উপস্থিত করে । তাই ইহাকে ‘সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক’ অৰ্থাৎ নিশ্চয়কারী না বলিয়া শুধু কল্পনাকারী ইন্দ্রিয় বলা হইয়াছে । ‘সঙ্কল্প’ শব্দে কখন কখন ‘নিশ্চর্যের’ও অর্থ সমাবেশ করা যায় [ছন্দোগ্য|৭|৪|১ দেখ] । কিন্তু এখানে নিশ্চয়ের অপেক্ষা না রাখিয়া অমুক বিষয় অমুক প্রকারের মনে করা, মানা, কল্পনা করা, বুঝা কিংবা কিছু যোজনা করা, ইচ্ছা করা, চিন্তা করা, মনে আনা ইত্যাদি ব্যাপারের উদ্দেশ্যেই ‘সঙ্কল্প’ শব্দের উপযোগ করা হইয়াছে । কিন্তু উকিলের মতো এই প্রকার নিজ কল্পনাসমূহকে বুদ্ধিসমক্ষে নিষ্পত্তির জন্য কেবল উপস্থিত করাতেই মনের কাজ শেষ হয় না । বুদ্ধি দ্বারা ভালমন্দের নির্ণয় হইলে পর, যে বিষয় বুদ্ধি গ্রাহ্য মানিয়াছে, কর্মেন্দ্রিয় দ্বারা তাহারই আবরণ করা অর্থাৎ বুদ্ধির আজ্ঞাকে কার্যে পরিণত করা - এই নাজিরের কাজও মনেরই করিতে হয় । তাহার দরুণ মনের ব্যাখ্যা অন্য প্রকারেও করিতে পারা যায় । ইহা বলিতে কোনই আপত্তি নাই যে, বুদ্ধিকৃত নিৰ্ণয়কে কিরূপে আমলে আনিতে হইবে তাহার যে বিচার করিতে হয়, তাহাও একপ্রকার সঙ্কল্পবিকল্পাত্মকই । কিন্তু ইহার জন্য সংস্কৃতভাষায় ‘ব্যাকরণ-বিস্তার করা’ এই স্বতন্ত্র নাম দেওয়া হইয়াছে । ইহার অতিরিক্ত বাকী সমস্ত কাজ বুদ্ধিরই । এ পর্যন্ত মন নিজেই কল্পনাসমূহের সারাসার বিচার করে না । সারাসার বিচার করিয়া অমুক বস্তু অমুক প্রকারের তাহা নিশ্চয় করা বা তর্কের দ্বারা কার্যকারণসম্বন্ধ দেখিয়া নিশ্চিত অনুমান করা, অথবা কার্যাকার্য নির্ণয় করা, এই সমস্ত ব্যাপার বুদ্ধির । সংস্কৃত ভাষায় এই ব্যাপারসমূহকে ‘ব্যবসায়’ বা ‘অধ্যবসায়’ বলে । তাই, এই দুই শব্দের উপযোগ করিয়া ‘বুদ্ধি’ ও ‘মন’ ইহাদের ভেদ দেখাইবার জন্য মহাভারতে [শাং|২৫১|১১] এই ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে –
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ মনো ব্যাকরণাত্মকম্‌ ॥
“বুদ্ধি (ইন্দ্রিয়) ব্যবসায়কারী অর্থাৎ সারাসারবিচারপূর্বক নিশ্চয়কারী; এবং মন ব্যাকরণ অর্থাৎ বিস্তারকারী – সে পরবর্তী ব্যবস্থাকারী প্রবর্তক ইন্দ্রিয়, অর্থাৎ বুদ্ধি ব্যবসায়াত্মিকা এবং মন ব্যাকরণাত্মক” । ভগবদ্গীতাতে “ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ” এই শব্দের উল্লেখ আছে [গী|২|৪৪]; এবং সেই স্থানেও বুদ্ধির অর্থ ‘সারাসারবিচারপূর্বক নিশ্চয়কারী ইন্দ্রিয়ই ।  প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধি কেবল এক তলোয়ার মাত্র । যাহা কিছু তাহার সম্মুখে আসে বা আনীত হয়, তাহার কাটছাঁট করাই তাহার কাজ; তাহার অন্য কোনও গুণ বা ধর্ম নাই [মভা|বন|১৮১|২৬] । সঙ্কল্প, বাসনা, ইচ্ছা, স্মৃতি, ধৃতি, শ্ৰদ্ধা, উৎসাহ, কারুণ্য, উৎকণ্ঠা, প্ৰেম, দয়া, সহানুভূতি, কৃতজ্ঞতা, কাম, লজ্জা, আনন্দ, ভীতি, রাগ, সঙ্গ, দ্বেষ, লোভ, মদ, মাৎসর্য, ক্ৰোধ ইত্যাদি সমস্ত মনেরই গুণ বা ধর্ম [বৃ|৯|৫|২; মৈক্র্য|৬|৩০] । এই সকল মনোবৃত্তি যেমন যেমন জাগ্রত হয় তেমনি তেমনি কর্ম করিবার দিকে মনুষ্যের প্রবৃত্তি হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা — মনুষ্য যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন এবং যতই কেন ভালরূপ গরীব লোকদের অবস্থা জানুক না, তাহার মনে যদি করুণাবৃত্তি জাগ্ৰত না হয় তাহা হইলে তাহার গরীবদের সাহায্য করিবার ইচ্ছা কখনই হইবে না । অথবা, যুদ্ধ করিবার ইচ্ছা থাকিলেও ধৈর্য না থাকিলে সে যুদ্ধ করিবে না । তাৎপর্য এই যে, যে বিষয় আমরা করিতে ইচ্ছা করি তাহার পরিণাম কি হইবে বুদ্ধি কেবল তাহাই বলিয়া দেয় । ইচ্ছা কিংবা ধৈর্য প্ৰভৃতি গুণ বুদ্ধির ধর্ম না হওয়ায় বুদ্ধি আপনা হইতে অর্থাৎ মনের সাহায্য ব্যতীত কখনই ইন্দ্ৰিয়দিগকে প্রেরণা দিতে পারে না । উল্টাপক্ষে ক্রোধাদির বশীভুত হইয়া স্বয়ং মন ইন্দ্ৰিয়দিগকে প্রেরণা দিতে পারিলেও বুদ্ধির সারাসার বিচার ব্যতীত শুধু মনোবৃত্তিসমূহের প্রেরণার দ্বারা সংঘটিত কর্ম নীতিদৃষ্টিতে শুদ্ধ হইবেই, তাহা বলা যায় না । উদাহরণ যথা - বুদ্ধির উপযোগ না করিয়া শুধু করুণাবৃত্তি হইতে কোন দান করিলে তাহা কোন অপাত্রে পড়িয়া তাহার মন্দ পরিণাম হইবার সম্ভাবনা আছে । সার কথা - বুদ্ধির সাহায্যব্যতীত মনোবৃত্তি সকল অন্ধ । তাই মনুষ্যের কোন কাজ তখনই শুদ্ধ হইতে পারে, যখন বুদ্ধি শুদ্ধ থাকে, অর্থাৎ ভালমন্দের অভ্রান্ত নির্ণয় করিতে পারে; মন, বুদ্ধির অনুরোধে কার্য করে; এবং ইন্দ্ৰিয়গণ মনের অধীনে অবস্থিত । 

বুদ্ধি ও মন এই দুই শব্দ ব্যতীত ‘অন্তঃকরণ’ ও ‘চিত্ত’ এই দুই শব্দও প্রচলিত আছে । তন্মধ্যে ‘অন্তঃকরণ’ শব্দের ধাত্বর্থ “অন্তরস্থ করণ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়”, এই জন্য তাহার মধ্যে মন, বুদ্ধি, চিত্ত, অহংকার প্রভৃতি সমস্তেরই সাধারণত সমাবেশ করা হয়; এবং মন সর্বপ্রথম বাহ্যবিষয়ের গ্ৰহণ অর্থাৎ চিন্তন করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে তাহাই চিত্ত হয় [মভা|শা|২৭৪|১৭] । কিন্তু সাধারণ ব্যবহারে এই সমস্ত শব্দ প্ৰায় একই অর্থে প্ৰযুক্ত হওয়ায় অনেকসময় কোন অর্থ কোথায় বিবক্ষিত সে সম্বন্ধে গোলযোগ উপস্থিত হয় । এই গোলযোগ যাহাতে না হয়, তাই উক্ত অনেক শব্দের মধ্যে শাস্ত্রীয় পরিভাষায় মন ও বুদ্ধি এই দুই শব্দই উপরি-প্রদত্ত নিশ্চিত অর্থে প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । এই প্রকারে মন ও বুদ্ধির ভেদ স্থাপন করিলে, বিচারপতির অধিকারসূত্ৰে বুদ্ধিকেই মন অপেক্ষা কাজেকাজেই শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিতে হয়; এবং মন ঐ বিচারপতি বুদ্ধির মুন্সী বা কেরাণী হইয়া দাঁড়ায় । “মনসস্তু পাৱা বুদ্ধিঃ” - মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্ৰেষ্ঠ বা অতীত [গী|৩|৪২] — গীতাবাক্যের ভাবাৰ্থও এই । তথাপি উপরি-উক্ত অনুসারে ঐ কেরাণীকেও দুই প্রকারের কাজ করিতে হয় - এক, জ্ঞানেন্দ্রিয় দ্বারা অথবা বাহির হইতে ভিতরে আনীত সংস্কারসমূহের ব্যবস্থা করিয়া, উহাদিগকে নিষ্পত্তির জন্য বুদ্ধির সমক্ষে স্থাপন করা; এবং দ্বিতীয়, বুদ্ধির দ্বারা নিষ্পত্তি হইলে পর, বুদ্ধির হুকুম বা আদেশ কর্মেন্দ্রিয়ের নিকট পৌঁছাইয়া দিয়া, বুদ্ধির উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য আবশ্যক বাহ্যক্রিয়া করাইয়া লওয়া । দোকানের জন্য জিনিস খরিদ করা ও দোকানে বসিয়া বিক্ৰী করা, এই দুই কাজই অনেক সময় যেমন দোকানের একই কর্মচারীকে করিতে হয়, সেইরূপ মনেরও দুই কাজ করিতে হয় । আমাদের কোন স্নেহপাত্র আমাদের নজরে পড়িলে এবং তাহাকে ডাকিবার ইচ্ছা হইলে আমরা তাকে ‘ওরে’ বলিয়া ডাকি । এই ব্যাপারটিতে অন্তঃকরণের মধ্যে কত ব্যাপার হয় দেখ । প্ৰথমে চোখ অথবা জ্ঞানেন্দ্ৰিয় এই সংস্কার মনের মারফত বুদ্ধির নিকট পাঠাইল যে, আমাদের স্নেহপাত্র নিকটে আছে; আবার বুদ্ধির মারফত সেই জ্ঞান আত্মাতে উৎপন্ন হয় । ইহা হইল জ্ঞান হইবার ক্রিয়া । তাহার পর, সেই স্নেহপাত্রকে হাক দিয়া ডাকিতে হইবে, আত্মা বুদ্ধির দ্বারা ইহা স্থির করে; এবং বুদ্ধির এই অভিপ্ৰায় আমলে আনিবার জন্য মনের মধ্যে বলিবার ইচ্ছা হয় এবং মন আমার জিহ্বা (কর্মেন্দ্রিয়ের) দ্বারা ‘ওরে’ শব্দ বলাইয়া থাকে । পাণিনির শিক্ষাগ্রন্থে শব্দোচ্চারণক্রিয়ার বর্ণনা এই ভাবেই করা হইয়াছে ।
আত্মা বুদ্ধ্যা সমেত্যাহাৰ্থান্‌ মনো যুংক্তে বিবক্ষয়া
মনঃ কায়াগ্নিমাহন্তি সঃ প্রেরয়তি মারুতম্‌ ৷
মারুতন্তূরসি চরন্‌ মন্ত্ৰং জনয়তি স্বরম্‌ ॥
অর্থাৎ - “আত্মা প্ৰথমে বুদ্ধি দ্বারা সমস্ত বিষয় আত্মগত করিয়া মনোমধ্যে বলিবার ইচ্ছা উৎপন্ন করে; এবং মন কায়াগ্নিকে চালিত করিবার পর কায়াগ্নি বায়ুকে প্রেরিত করে । তদনন্তর, এই বায়ু বক্ষের মধ্যে প্ৰবেশ করিয়া মন্ত্রস্বর উৎপন্ন করে” । এই স্বর পরে কণ্ঠতালব্যাদিবৰ্ণভেদে মুখ হইতে নিঃসৃত হয় । উপরিউক্ত শ্লোকের শেষ দুই চরণ মৈত্র্যুপনিষদেও প্রদত্ত হইয়াছে [মৈত্রু|৭|১১]; এবং ইহা হইতে উপলব্ধি হয় যে, এই শ্লোক পাণিনি হইতেও প্রাচীন । (মৈত্র্যুপনিষৎ পানিনি হইতে প্রাচীন, এইরূপ মোক্ষমূলর সাহেব লিখিয়াছেন । “Sacred Books of the East series”, Vol. XV, PP.XL. V. II-LI, ইহার বিস্তৃত বিচার আমি পরে পরিশিষ্টপ্রকরণে করিয়াছি, তাহা দেখ ।) আধুনিক শারীরশাস্ত্ৰে কায়াগ্নিরই নাম ‘মজ্জাতন্তু’ । কিন্তু বহিঃপদার্থের জ্ঞান অন্তরে আনিবার জন্য যে মজ্জাতন্তু এবং বুদ্ধির আদেশ কর্মেন্দ্ৰিয়যোগে মনের দ্বারা সম্পাদন করিবার জন্য যে মজ্জাতন্তু, এই দুই মজ্জাতন্তু বিভিন্ন; তাই তদনুসারে মনও দুই বলিয়া মানিতে হইবে, এইরূপ পাশ্চাত্য শারীরশাস্ত্ৰজ্ঞদিগের উক্তি । আমাদের শাস্ত্রকারেরা দুই মন না মানিয়া, বুদ্ধি ও মনকে পৃথক করিয়া এইমাত্র বলিয়াছেন যে, মন উভয়াত্মক অর্থাৎ তাহা কর্মেন্দ্রিয়ের নিকট কর্মেন্দ্ৰিয়ের অনুরূপ ও জ্ঞানেন্দ্রিয়ের নিকট জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অনুরূপ কার্য করিয়া থাকে । উভয়ের তাৎপর্য একই । উভয়েরই দৃষ্টিতে বুদ্ধি নিশ্চয়কারী বিচারপতি এবং মন প্ৰথমে জ্ঞানেন্দ্রিয়ের নিকট সঙ্কল্প-বিকল্পাত্মক হইয়া যায় এবং কর্মেন্দ্রিয়ের নিকট ব্যাকরণাত্মক বা কার্যসম্পাদক অর্থাৎ কর্মেন্দ্ৰিয়ের সাক্ষাৎ প্ৰবর্তক হইয়া থাকে । কোন বিষয়ের ‘ব্যাকরণ’ অর্থাৎ কার্য সম্পাদনা করিবার সময়, বুদ্ধির হুকুম কি প্রকারে পালন করা যাইবে, সে সম্বন্ধে কখন কখন সঙ্কল্প-বিকল্প করাও মনের আবশ্যক হয় । তাই, মনের ব্যাখ্যা করিবার সময়, সাধারণত ‘সঙ্কল্পবিকল্পত্মিকং মনঃ’, এইরূপ বলিবারই রীতি আছে । কিন্তু মনে রেখো যে, সে সময়েও উহার মধ্যে মনের দুই ব্যাপারেরই সমাবেশ হইয়া থাকে ।


8) ব্যবসায়াত্মিকা ও বাসনাত্মক বুদ্ধির ভেদ ও সম্বন্ধ


‘বুদ্ধি কিনা নির্ণয়কারী ইন্দ্ৰিয়, এই যে অর্থ উপরে বলা হইয়াছে তাহা কেবল শাস্ত্রীয় ও সূক্ষ্ম বিচারের জন্য উপযোগী । কিন্তু এই শাস্ত্রীয় অর্থের নির্ণয় প্রায়ই পরে করা হয় । তাই, এখানে এই শাস্ত্রীয় অর্থ নিশ্চিত হইবার পুৰ্বেই ‘বুদ্ধি’ শব্দের যে ব্যবহারিক অর্থ প্রচলিত হইয়া গিয়াছে তাহাও এখানে বিচার করা আবশ্যক । ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি কোনও বিষয়ের প্রথম নির্ণয় না করিলে, সেই বস্তুর জ্ঞান আমাদের হয় না; এবং জ্ঞান না হইলে সেই বস্তু লাভ করিবার ইচ্ছা কিংবা বাসনাও হয় না । তাই ব্যবহারে, আম গাছ ও ফল উভয়েতেই যেরূপ ‘আম’ এই একই শব্দ প্ৰযুক্ত হয়, সেইরূপ ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি ও সেই বুদ্ধির বাসনাদি ফল, উভয়েতেই ব্যবহারে সাধারণ লোকে অনেক সময় এই একই বুদ্ধিশব্দ প্রয়োগ করিয়া থাকে । উদাহরণ যথা – অমুকের বুদ্ধি দুষ্ট এইরূপ যখন আমরা বলি তখন তাহার বাসনা দুষ্ট এইরূপ অৰ্থে বলিয়া থাকি । শাস্ত্রদৃষ্টিতে ইচ্ছা বা বাসনা মনের ধর্ম হওয়ায় তাহার নাম বুদ্ধি নাম দেওয়া সঙ্গত নহে । কিন্তু বুদ্ধি শব্দের শাস্ত্রীয় অর্থ নিষ্কর্ষিত হইবার পূর্ব হইতেই সাধারণ ব্যবহারে লোকেরা এই দুই অর্থে বুদ্ধি শব্দের প্রয়োগ করিয়া আসিয়াছে - (১) নির্ণয়কারী ইন্দ্ৰিয় এবং (২) সেই ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপার হইতে পরে মনুষ্যের মনে উৎপন্ন বাসনা বা ইচ্ছা । তাই আমের ভেদ দেখাইতে হইলে যেমন ‘গাছ’ ও ‘ফল’ এই শব্দগুলির প্রয়োগ করা হয়, সেইরূপ বুদ্ধির দুই অর্থের প্রভেদ দেখান যখন আবশ্যক হয় তখন নির্ণয়কারী অর্থাৎ শাস্ত্রীয় বুদ্ধির সহিত ‘ব্যবসায়াত্মিকা’ এই বিশেষণ সংযোজিত করা হয়, এবং বাসনাকে শুধু ‘বুদ্ধি’ বা বড় জোর ‘বাসনাত্মক’ বুদ্ধি বলা হইয়া থাকে । গীতাতে উপরি-উক্ত দুই অর্থেই ‘বুদ্ধি’ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে [গী|২|৪১,৪৪,৪৯; ৩|৪২] । কর্মযোগের বিচার ঠিক বুঝিতে হইলে ‘বুদ্ধি’ শব্দের উপরি-উক্ত দুই অর্থই সৰ্বদা মনে রাখা আবশ্যক । মনুষ্য যে-কোন কর্ম করুক না কেন, তাহার মনোব্যাপারের ফ্ৰেম এইরূপ - সেই কর্ম ভাল কি মন্দ, করণীয় কি করণীয় নহে ইত্যাদি বিষয়ের বিচার সে প্রথমে ‘ব্যবসায়াত্মিকা’ বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের দ্বারাই করিয়া থাকে, এবং পরে সেই কর্ম করিবার ইচ্ছা বা বাসনা (অর্থাৎ বাসনাত্মক বুদ্ধি) তাহার মনে উৎপন্ন হইয়া তাহাকে উক্ত কর্ম করিতে প্ৰবৃত্ত করে। কার্যাকার্যের নিষ্পত্তি করা, যাহা (ব্যবসায়াত্মিকা) বুদ্ধি ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার, উহা স্বস্থ ও শান্ত থাকিলে, নিরর্থক অন্য বাসনা (বুদ্ধি) মনেতে উৎপন্ন হইয়া মনকে বিগড়াইতে পারে না । তাই প্ৰথমে ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে শুদ্ধ ও স্থির করা গীতান্তৰ্গত কর্মযোগশাস্ত্রের প্রথম সিদ্ধান্ত [গী|২|৪১] । শুধু গীতায় নহে, ক্যান্টও বুদ্ধির এইরূপ দুই ভেদ করিয়া শুদ্ধ অর্থাৎ ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধির (Pure Reason) ও ব্যবহারিক অর্থাৎ বাসনাত্মক বুদ্ধির (Practical Reason) ব্যাপারাদি দুই স্বতন্ত্র গ্রন্থে বিচার করিয়াছেন । বস্তুত দেখিলে প্ৰতীতি হয় যে, ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে সুস্থির করা পাতঞ্জলযোগশাস্ত্রের বিষয়, কর্মযোগশাস্ত্রের নহে । কিন্তু কর্মের বিচার করিবার সময় কর্মের পরিণামের দিকে দৃষ্টি না করিয়া কর্মকর্তার বাসনা অর্থাৎ বাসনাত্মক বুদ্ধি কিরূপ তাহাই প্ৰথমে দেখিতে হইবে, ইহাই হইল গীতার সিদ্ধান্ত [গী|২|৪৯] । এবং এই প্রকারে বাসনার বিচার করিলে দেখা যায় যে, যাহার ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি সুস্থির ও শুদ্ধ হয় নাই, তাহার মনে বাসনার বিভিন্ন তরঙ্গ উৎপন্ন হইয়া থাকে । এবং সেইজন্য বলা যায় না যে, সেই বাসনা সর্বদা শুদ্ধ ও পবিত্র হইবেই [গী|২|৪১] । বাসনা শুদ্ধ না হইলে পরবর্তী কর্ম কি করিয়া শুদ্ধ হইবে ? তাই কর্মযোগশাস্ত্ৰেও ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি শুদ্ধ রাখিবার সাধনা অথবা উপায়সমূহের সবিস্তার বিচার করা আবশ্যক হয়; এবং এই জন্যই ভগবদ্‌গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে, বুদ্ধিকে শুদ্ধ করিবার এক সাধন, এই দৃষ্টিতে পাতঞ্জল যোগের বিচার করা হইয়াছে । কিন্তু এই সম্বন্ধের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া কোন কোন সাম্প্রদায়িক টীকাকার গীতার তাৎপর্য বাহির করিয়াছেন যে পাতঞ্জল যোগই গীতার প্রতিপাদ্য । এক্ষণে গীতাশাস্ত্রে ‘বুদ্ধি’ শব্দের উপরি-প্রদত্ত দুই অর্থ ও সেই দুই অর্থের পরস্পর সম্বন্ধ মনে রাখা আবশ্যক, তাহা পাঠকের উপলব্ধি হইবে ।


9) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি একই, কিন্তু সাত্ত্বিক আদি ভেদে তিন প্রকারের


সে যাক; মানব অন্তঃকরণের ব্যাপার কি প্রকারে চলে, তাহা লক্ষ্য করিয়া মন ও বুদ্ধির কাজ কি, এবং ‘বুদ্ধি’ শব্দের অন্য অর্থ কি, তাহা বলা হইয়াছে । এক্ষণে মন ও ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে এইরূপ পৃথক করিবার পর, সদসদ্‌বিবেকদেবতার কাজটা কি, তাহা দেখা যাক । ভালমন্দ নিৰ্বাচন করাই এই দেবতার কাজ হওয়ায় মনের মধ্যে তাহার সমাবেশ হইতে পারে না । এবং একমাত্র ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিই যে কোন বিষয়ের বিচার করিয়া নির্ণয় করে বলিয়া সদসদ্‌বিবেকরূপ দেবতার জন্য কোন স্বতন্ত্র স্থান থাকে না । ইহা নিঃসন্দেহ যে, যে কথার বা বিষয়ের সারাসার বিচার করিয়া নির্ণয় করিতে হইবে, সেই সমস্ত বিষয় অনেক হইতে পারে । যেমন বাণিজ্য, যুদ্ধ, ফৌজদারী বা দেওয়ানী মোকদ্দমা, মহাজনী, কৃষিকার্য ইত্যাদি অনেক ব্যবসায়ে বিবিধ প্রসঙ্গে সারাসার বিচার করা আবশ্যক হয় । কিন্তু তাহার দরূণ ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি বিভিন্ন হয় না । সারাসার বিবেক বলিয়া যে ক্রিয়া, তাহা সর্বত্র একই প্রকার; এবং সেই জন্য বিবেক অথবা নির্ণয়কারী বুদ্ধিও একই হওয়া চাই । কিন্তু মনের ন্যায় বুদ্ধিও শারীরধর্ম হওয়া প্ৰযুক্ত পূর্বকর্মের অনুসারে, বংশানুক্রমিক বা আনুসঙ্গিক সংস্কারবশতঃ বা শিক্ষাদি, অন্য কারণে, এই বুদ্ধি ন্যূনাধিক পরিমাণে সাত্ত্বিক, রাজসিক কিংবা তামসিক হইতে পারে । কারণ, একের বুদ্ধিতে যে বিষয় গ্ৰাহ্য প্রতীত হয়, তাহাই অন্যের বুদ্ধিতে অগ্ৰাহ্য বলিয়া মনে হয় । কিন্তু তাই বলিয়া বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয় প্রত্যেক সময়েই ভিন্ন ভিন্ন হইয়া থাকে, এরূপ বলা যায় না । উদাহরণ স্বরূপ, মনে কর চোখ । কাহারও চোখ ট্যারা, কাহারও বোজা, আর কাহারও বা কাণা; আবার কাহারও দৃষ্টি ঘোলাটে, আর কাহারও বা স্বচ্ছ হইয়া থাকে । তাই বলিয়া চোখের ইন্দ্ৰিয় এক নহে, বহু-তাহা আমরা বালতে পারি না । বুদ্ধি সম্বন্ধেও এই ন্যায় প্রয়োগ করা বাইতে পারে । যে বুদ্ধির দ্বারা চাউল কিংবা গম জানা যায়; যে বুদ্ধির দ্বারা পাথর ও হীরার প্রভেদ জানা যায়; যে বুদ্ধির দ্বারা কালো, সাদা বা মিষ্ট-কটুর জ্ঞান হয়, সেই বুদ্ধিই কাহাকে ভয় করিবে, কাহাকে ভয় করিবে না, কিংবা সৎ কি আর অসৎ কি, লাভ ও ক্ষতি কাহাকে বলে, ধর্ম ও অধর্ম এবং কার্য ও অকার্যের ভেদ কি, এই সমস্ত বিষয়ের তারতম্য বিচার করিয়া শেষ নির্ণয়ও করিয়া থাকে । সাধারণ ব্যবহারে ‘মনোদেবতা’ বলিয়া উহার যতই গৌরব করা হউক না কেন, তথাপি তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে উহা একই ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি । এই অভিপ্ৰায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া, গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে একই বুদ্ধির সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এই তিন ভেদ করিয়া ভগবান অর্জুনকে প্ৰথমে বলিয়াছেন -
প্ৰবৃত্তিং চ নিবৃত্তিং চ কার্যাকার্যে ভয়াভয়ে ৷
বন্ধং মোক্ষং চ যা বেত্তি বুদ্ধিঃ সা পাৰ্থ সাত্ত্বিকী ॥
অর্থাৎ “কোন্‌ কর্ম করিবে, কোন্‌ কর্ম করিবে না, কোন্‌ কর্ম করা উচিত, কোন্‌ কর্ম করা অনুচিত, কোন্‌ বিষয়ে ভয় করিযে, কোন্‌ বিষয়ে ভয় করিবে না, বন্ধন কিসে হয় আর মোক্ষ কিসে হয়, যে বুদ্ধি দ্বারা এই সকল বিষয়ের (যথাৰ্থ) জ্ঞান হয়, তাহাই সাত্ত্বিকী বুদ্ধি” [গী|১৮|৩০] । এইরূপ বলিবার পর বলিয়াছেন যে -
যয়া ধর্মমধৰ্ম্মং চ কাৰ্য্যং চাকার্যমেব চ ৷
অযথাবৎ প্ৰজানাতি বুদ্ধিঃ সা পার্থ রাজসী ॥
অর্থাৎ - “ধর্ম ও অধর্ম, কিংবা কার্য ও অকার্যের যথার্থ নির্ণয় যে বুদ্ধি করিতে পারে না, অর্থাৎ যে বুদ্ধি সর্বদা ভুল করিতে থাকে, সেই বুদ্ধিই রাজসিক” [১৮|৩১] । এবং শেষে বলিয়াছেন -
অধৰ্ম্মং ধর্মমিতি যা মন্যতে তমসাবৃতা ৷
সর্বাৰ্থান্বিপরীতাংশ্চ বুদ্ধিঃ সা পার্থ তামসী ॥
অর্থাৎ -“যে বুদ্ধি অধর্মকে ধর্ম বলে কিংবা সকল বিষয়ে বিপরীত বা উল্টা নির্ণয় করে সেই বুদ্ধি তামসী” [গী|১৮|৩২] । এই বিচার হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, কেবল ভালমন্দনির্ণয়কারী অর্থাৎ সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধিরূপ স্বতন্ত্র ও পৃথক দেবতা গীতার অভিমত নহে । বুদ্ধি নিয়ত ভালোর নির্ণয়কারী কখনই হইতে পারে না - এইরূপ ইহার অর্থ নহে । উপযুক্ত শ্লোকগুলির ভাবাৰ্থ এই যে, বুদ্ধি একই; এবং ঠিক ঠিক নির্ণয় করিবার সাত্ত্বিক ধর্ম ঐ এক বুদ্ধিতেই পূৰ্বসংস্কার, শিক্ষা, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ কিংবা আহারাদির কারণে উৎপন্ন হইয়া থাকে; এবং এই পূর্বসংস্কারাদি কারণের অভাবেই ঐ বুদ্ধি কার্যাকাৰ্যনির্ণয়ের ন্যায় অন্যান্য বিষয়েও রাজসিক কিংবা তামসিক হইতে পারে । চোর ও সাধুদের অথবা বিভিন্নদেশীয় মনুষ্যদিগের বুদ্ধির মধ্যে পার্থক্য কেন হয়, এই সিদ্ধান্তের দ্বারা তাহার যেরূপ উপপত্তি হয়, সদসদ্‌বিবেচনাশক্তিকে স্বতন্ত্র দেবতা বলিয়া মানিলে সেরূপ হয় না । আপনার বুদ্ধিকে সাত্ত্বিক করা প্ৰত্যেক মানুষ্যের কর্তব্য । ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ ব্যতীত এ কাজ হইতে পারে না । যে পৰ্যন্ত ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি, মনুষ্যের প্রকৃত হিত কিসে হয় জানিতে পারে না, এবং তাহার নির্ণয় বা পরীক্ষা না করিয়া কেবল ইন্দ্রিয়দের মর্জি অনুসারে চলে, সে পৰ্যন্ত সেই বুদ্ধিকে ‘শুদ্ধ’ বলা যাইতে পারে না । এইজন্য বুদ্ধিকে মন ও ইন্দ্ৰিয়ের অধীন হইতে না দিয়া, আমাদের এমন ব্যবস্থা করা উচিত, যাহাতে মন ও ইন্দ্রিয় বুদ্ধির অধীনে আসে । ভগবদ্‌গীতাতে অনেক স্থানে এই তত্ত্বই কথিত হইয়াছে [গী|২|৬৭,৬৮; ৩|৭,৪১; ৬|২৪,২৬]; এবং কারণ এই যে, কঠোপনিষদে শরীরের সহিত রথের উপমা দিয়া এই রূপক বাঁধা হইয়াছে যে, ঐ শরীররূপী রথে যোজিত ইন্দ্ৰিয়রূপ অশ্বকে বিষয়োপভোগমার্গে সুনিয়মে চালাইবার জন্য (ব্যবসায়াত্মক) বুদ্ধিরূপ সারথীকে মনোময় লাগাম ধৈর্য সহকারে খুব টানিয়া ধরিতে হইবে [কঠ|৩|৩|৯] । মহাভারতেও দুই তিন স্থানে এই রূপকই কিছু ন্যূনাধিক পরিবর্তনের সহিত গৃহীত হইয়াছে [মভা|বন|২১০,|২৫; স্ত্রী|৭|১৩; অশ্ব|৫১|৫] । ইন্দ্রিয়নিগ্ৰহ বৰ্ণনা করিবার পক্ষে এই দৃষ্টান্ত এরূপ উপযোগী যে, গ্রীসদেশীয় প্ৰসিদ্ধ তত্ত্ববেত্তা প্লেটোও আপন গ্রন্থে [ফীড়ুস|২৪৬] ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের বর্ণনা করিবার সময় এই দৃষ্টান্তই প্রয়োগ করিয়াছেন । ভগবদ্‌গীতাতে এই দৃষ্টান্তের প্রত্যক্ষ উল্লেখ নাই বটে; তথাপি উপরে নির্দেশিত গীতার শ্লোকে, ইন্দ্রিয়নিগ্রহের বর্ণনা যে এই দৃষ্টান্তটি মনে রাখিয়াই করা হইয়াছে, তাহা এই বিষয়ের পূর্বাপর ধারা যাহারা অবগত আছেন, তাহাদের চোখে ইহা না পড়িয়া থাকিতে পারে না । সাধারণতঃ অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সূক্ষ্মভেদ করিবার আবশ্যকতা যখন হয়, তখন উহাকেই মনোনিগ্রহ বলা হইয়া থাকে । কিন্তু উপরি-উক্ত অনুসারে মন ও বুদ্ধির যখন ভেদ করা হয়, তখন নিগ্রহের কর্তৃত্ব মনের হাতে না থাকিয়া ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধির হাতে চলিয়া যায় । এই ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিকে শুদ্ধ করিতে হইলে, পাতঞ্জলযোগের সমাধির দ্বারা, ভক্তির দ্বারা, জ্ঞানের দ্বারা কিংবা ধ্যানের দ্বারা পরমেশ্বরের স্বরূপ অবগত হইয়া, সমস্ত মনুষ্যের মধ্যে একই আত্মা আছে এই তত্ত্ব বুদ্ধির মধ্যে বদ্ধমূল হওয়া আবশ্যক । ইহাকেই আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধি বলে । ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধি এইরূপ আত্মনিষ্ঠ হইলে এবং মনোনিগ্রহের দ্বারা মন ও ইন্দ্ৰিয় তাহার অধীনে কাজ করিতে শিখিলে ইচ্ছা, বাসনা ইত্যাদি মনোধর্ম (কিংবা বাসনাত্মক বুদ্ধি) স্বতই শুদ্ধ ও পবিত্র হয়, এবং শুদ্ধ সাত্ত্বিক কর্মের দিকে ইন্দ্ৰিয়দিগের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিই হইয়া থাকে । অধ্যাত্মদৃষ্টিতে ইহাই সমস্ত সদাচরণের মূল অর্থাৎ কর্মযোগশাস্ত্রের রহস্য ।


10) সদসদ্বিবেক বুদ্ধি ইহাতেই আছে, পৃথক নাই


মন ও বুদ্ধির স্বাভাবিক বৃত্তিসমূহের অতিরিক্ত সদসদ্‌বিবেকাশক্তিরূপ স্বতন্ত্র দেবতার অস্তিত্ব আমাদের শাস্ত্রকারেরা কেন মানেন নাই তাহার কারণ উপরি-উক্ত বিচার-আলোচনা হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইবে । তাঁহাদের মতেও মনকে বা বুদ্ধিকে গৌরবার্থে দেবতা বলিতে কোন বাধা নাই; কিন্তু তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিচার করিয়া তাঁহারা স্থির করিয়াছেন যে, আমরা যাহাকে মন বা বুদ্ধি বলি, তাহা হইতে ভিন্ন ও স্বয়ম্ভূ সদসদ্‌বিবেক নামক কোন তৃতীয় দেবতার অস্তিত্ব থাকিতেই পারে না । ‘সতাং হি সন্দেহপদেষু’ এই বাক্যে ‘সতাং’ পদের উপযোগিতা ও গুরুত্ব এক্ষণে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে । যাঁহাদের মন শুদ্ধ ও আত্মনিষ্ঠ, তাঁহাদের পক্ষে অন্তঃকরণের সাক্ষ্য গ্ৰহণ করা কিছুই অসঙ্গত নহে; অধিক কি, অথবা ইহাও বলা যাইতে পারে যে, কোন কর্ম করিবার পূর্বে আপনার মনকে শুদ্ধ করিয়া তাহার সাক্ষ্য গ্ৰহণ করা উচিত । কিন্তু উচ্ছ্‌ঙ্খল চরিত্রের লোকের ‘আমরাও এই রকম করেই চলি’ বলিলে কখনই উচিত কথা হইবে না । কারণ, দুইজনের সদসদ্‌বিবেচনাশক্তি এক হয় না, - সাধু লোকদিগের সাত্ত্বিক এবং চোরদিগের তামসিক হইয়া থাকে । সার কথা - যাহাকে, আধিদৈবতপক্ষের লোক সদসদ্‌বিবেকদেবতা বলেন, তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে তাহার বিচার করিলে উহাকে স্বতন্ত্র দেবতা বলিয়া মনে হয় না; কিন্তু ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধির স্বরূপসমূহেরই মধ্যে উহা এক আত্মনিষ্ঠ অর্থাৎ, স্বাত্বিক স্বরূপ, ইহাই আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের সিদ্ধান্ত । এবং এই সিদ্ধান্ত স্থির হইলে, আধিদৈবতপক্ষ স্বতই খোঁড়া হইয়া পড়ে ।


11) আধ্যাত্মিক মাৰ্গ - কর্মযোগের সহিত সম্বন্ধ


আধিভৌতিক পক্ষ একদেশদর্শী ও অপূর্ণ এবং আধিদৈবতপক্ষের সহজ যুক্তিও অকর্মণ্য সিদ্ধ হইয়া গেলে, কর্মযোগশাস্ত্রের উপপত্তি নির্ধারণের অন্য কোন মাৰ্গ আছে কি না, দেখা আবশ্যক । অন্য এক মার্গ আছে – তাহাকে আধ্যাত্মিক মাৰ্গ বলে । কারণ, বাহ্যকর্মাপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ হইলেও যখন সদসদ্‌বিবেকবুদ্ধি বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্ভূ দেবতার অস্তিত্ব সিদ্ধ হইতে পারে না, তখন শুদ্ধ কর্ম সম্পাদনের বুদ্ধিকে কিরূপে শুদ্ধ রাখিতে হইবে, শুদ্ধ বুদ্ধি কাহাকে বলে, কিংবা বুদ্ধিকে শুদ্ধ কেমন করিয়া করা যায়, কর্মযোগশাস্ত্ৰেও এই সকল প্রশ্নের বিচার আবশ্যক হইয়া পড়ে । এবং এই বিচার শুধু বাহ্যজগতের বিচারকারী আধিভৌতিক শাস্ত্ৰকে ছাড়িয়া দিয়া অধ্যাত্মজ্ঞানে প্রবেশ না করিলে সম্পূর্ণ হইতে পারে না । আত্মা কিংবা পরমেশ্বরের সর্বব্যাপী প্ৰকৃত স্বরূপের জ্ঞান যে বুদ্ধির হয় নাই সে বুদ্ধি শুদ্ধ নহে, এই বিষয়ে আমাদের শাস্ত্রকারদিগের ইহাই চরম সিদ্ধান্ত । এই প্রকারের বুদ্ধিকে আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধি কেন বলা হয় তাহাই বলিবার জন্য গীতাতে অধ্যাত্মশাস্ত্রের নিরূপণ করা হইয়াছে । কিন্তু এই পূর্বাপর সম্বন্ধের প্রতি ঠিক লক্ষ্য না করিয়া গীতাসম্বন্ধীয় সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের মধ্যে কেহ কেহ স্থির করিয়াছেন যে, বেদান্তই গীতার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । গীতার প্রতিপাদ্যবিষয়সম্বন্ধে উক্ত টীকাকারদিগের কৃত এই নির্ণয় যে ঠিক নহে, তাহা পরে সবিস্তার দেখান। যাইবে । এখানে শুধু ইহাই দেখাইব যে, বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিবার জন্য আত্মারও বিচার করা নিশ্চয় আবশ্যক হয় । এই আত্মার বিষয়ে এই বিচার দুই দিক্‌ দিয়া করা হয় - (১) আপন পিণ্ডের, ক্ষেত্রের, বা শরীরের এবং মনের ব্যাপারসমূহ নিরীক্ষণ করিয়া উহা হইতে ক্ষেত্ৰজ্ঞরূপী আত্মা কিরূপে নিষ্পন্ন হয় তাহার বিচার করা – [গী|অ|১৩] । ইহারই সংজ্ঞা - শারীরক কিংবা ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার; এবং এই কারণেই বেদান্তসূত্রকে “শারীরক (শরীরের বিচারকারী) সূত্র” বলে । নিজের শরীর ও মনের এইরূপ বিচার হইলে পর (২) দেখা আবশ্যক যে, তাহা হইতে নিষ্পন্ন তত্ত্ব, এবং আমাদের চতু্র্দিকে যে দৃশ্য জগৎ বা ব্ৰহ্মাণ্ড আছে তাহার পৰ্যবেক্ষণের দ্বারা নিষ্পন্ন তত্ত্ব, এই দুই একই কিংবা বিভিন্ন । এই রীতি অনুসারে সম্পাদিত জগতের বিচার-আলোচনাকে “ক্ষরাক্ষরবিচার” কিংবা “ব্যক্তাব্যক্তবিচার” বলে । সৃষ্টির অন্তর্ভূত সমস্ত নশ্বর প্রদাৰ্থ ক্ষর কিংবা ব্যক্ত এবং সৃষ্টির অন্তর্গত নশ্বর পদার্থের মধ্যে যাহা সারভূত নিত্য তত্ত্ব তাহাই অক্ষর কিংবা অব্যক্ত [গী|৮|২১; ১৫|১৬] । ক্ষেত্রক্ষেত্রজ্ঞবিচারের দ্বারা এবং ক্ষরাক্ষরবিচারের দ্বারা নিষ্পন্ন এই দুই তত্ত্বের পুনৰ্বার বিচার করিলে দেখা যায় যে, এই দুই তত্ত্ব, যাহা হইতে নিষ্পন্ন হইয়াছে এবং এই দুয়ের অতীত (পর) সমস্তের মুলীভূত যে এক তত্ত্ব আছে তাহাকেই ‘পরমাত্মা’ বা ‘পুরুষোত্তম’ বলা হয় [গী|৮-২০] । ভগবদ্‌গীতাতে এই সকল বিষয়ের বিচার করা হইয়াছে; এবং পরিশেষে কর্মযোগশাস্ত্রের উপপত্তি বুঝাইবার জন্য দেখানো হইয়াছে যে, সকলের মুলীভূত পরমাত্মারূপ তত্ত্বের জ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধি কিরূপে শুদ্ধ হয় । তাই এই উপপত্তি আমাদের বুঝিতে হইলে আমাদেরও সেই মাৰ্গ দিয়া যাইতে হইবে । তন্মধ্যে ব্ৰহ্মাণ্ডজ্ঞান কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার পরবর্তী প্রকরণে বিবৃত হইবে । সদসদ্‌বিবেকদেবতার প্রকৃত স্বরূপনির্ণয় করিবার জন্য এই প্রকরণে যাহা শুরু করা হইয়াছে সেই পিণ্ডজ্ঞান কিংবা ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার অপুর্ণ থাকায় তাহা এক্ষণে পূরণ করিয়া লওয়া যাইবে ।


11.1) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিচার - ক্ষেত্র শব্দের অর্থ


পাঞ্চভৌতিক স্থূলদেহ, পঞ্চ কর্মেন্দ্ৰিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, শব্দ-স্পর্শ রূপ-রসগন্ধাত্মক জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের পাঁচ বিষয়, সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক মন এবং ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি, - এই সকল বিষয়ে বিচার আলোচনা হইয়া গিয়াছে । কিন্তু ইহাতেই শরীরসম্বন্ধীয় বিচার পুর্ণ হয় না । মন ও বুদ্ধি, ইহারা কেবল বিচার করিবার সাধন বা ইন্দ্ৰিয় । জড় শরীরের মধ্যে ইহার অতিরিক্ত প্ৰাণরূপী চেতনা অর্থাৎ চেষ্টাচাঞ্চল্য যদি না থাকিত তাহা হইলে মন ও বুদ্ধি থাকা ও না থাকা সমান অর্থাৎ অনাবশ্যক বুঝা যাইত । সুতরাং শরীরের মধ্যে উপরি-উক্ত বিষয়গুলির অতিরিক্ত চেতনা বলিয়া আর এক তত্ত্বেরও সমাবেশ করা চাই । কখন কখন চেতনাশব্দের অর্থ “চৈতন্য”ও করা হয় । কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে চেতনা শব্দ “চৈতন্য” অর্থে প্ৰযুক্ত হয় নাই । ইহা যেন মনে রাখা হয়; জড়দেহের মধ্যে যে প্ৰাণ-চেষ্টা বা জীবনব্যাপার দেখা যায় সেই অর্থই এখানে অভিপ্ৰেত । যে চিৎশক্তির দ্বারা জড়েরও মধ্যে চেষ্টা বা ব্যাপার উৎপন্ন হয় তাহাই চৈতন্য; এই শক্তিটি কি, এক্ষণে তাহারই বিচার করিব । শরীরের মধ্যে পরিদৃশ্যমান জীবনব্যাপার কিংবা চেতনার অতিরিক্ত বস্তু যাহাতে করিয়া আত্মপরভেদ উৎপন্ন হয় তাহাও এক পৃথক্‌ গুণ । কারণ, উপরি-কথিত বিচার অনুসারে বুদ্ধি সারাসারের বিচার পূর্বক নির্ণয়কারী এক ইন্দ্ৰিয় হওয়ায়, আত্মপর-ভেদের মূলস্বরূপ অহঙ্কারকে ঐ বুদ্ধি হইতে পৃথক্‌ স্বীকার করিতে হয় । ইচ্ছাদ্বেষ, সুখদুঃখ প্ৰভৃতি দ্বন্দ্বগুলি মনেরই গুণ; কিন্তু নৈয়ায়িক এই গুণ আত্মার বলিয়া মনে করায়, এই ভ্ৰম দূর করিবার জন্য বেদান্তশাস্ত্ৰ মনের মধ্যেই ইহার সমাবেশ করিয়া থাকে । রূপ পঞ্চমহাভূত যে মূল তত্ত্ব হইতে নিৰ্গত হইয়াছে সেই প্ৰকৃতিরূপ তত্ত্বেরও সমাবেশ শরীরেই করা হইয়া থাকে [গী|১৩|৫,৬] । এই সমস্ত তত্ত্ব যে শক্তির দ্বারা স্থির থাকে সেই শক্তিও আবার এই সকল হইতে পৃথক । তাহাকে ‘ধৃতি’ বলে [গী|১৮|৩৩] । এই সমস্ত বিষয় একত্ৰ করিলে যে সমুচ্চয়রূপ পদার্থ হইয়া দাঁড়ায় তাহা শাস্ত্ৰে সবিকার শরীর কিংবা ক্ষেত্র নামে অভিহিত হইয়াছে; এবং ইহাকে ব্যবহারে আমরা চলছে-ফিরছে’; (সবিকার) এইরূপ মনুষ্যশরীর বা পিণ্ড বলিয়া থাকি । ক্ষেত্র শব্দের এই ব্যাখ্যা আমি গীতা অবলম্বনেই করিয়াছি; কিন্তু ইচ্ছাদ্বেষাদিগুণ গণনা করিবার সময় কখনও এই ব্যাখ্যার অল্পস্বল্প ইতরবিশেষও করা হইয়া থাকে । উদাহরণ যথা – শান্তিপর্বের জনক-সুলভা-সংবাদে [শাং|৩২০] শরীরের ব্যাখা করিবার সময় পঞ্চকর্মেন্দ্ৰিয়ের পরিবর্তে কাল, সদসদ্‌ভাব, বিধি, শুক্র ও বলের সমাবেশ করা হইয়াছে । এই গণনা অনুসারে পঞ্চমহাভূতেই পঞ্চকর্মেন্দ্ৰিয়ের সমাবেশ করা আবশ্যক হয়; এবং স্বীকার করিতে হয় যে, গীতার গণনানুসারে কালের অন্তর্ভাব আকাশে এবং বিধিশুক্রবলাদির অন্তর্ভাব অন্য মহাভূতসমূহে করা হইয়াছে । যাহাই হউক, ইহা নিঃসন্দেহ যে, ক্ষেত্রশব্দের এক অর্থই সকলের অভিপ্ৰেত; অর্থাৎ মানসিক ও শারীরিক সমস্ত দ্রব্য ও গুণের প্রাণরূপী বিশিষ্ট-চেতনাযুক্ত যে ‘সমুদায়', তাহারই নাম ক্ষেত্র । শরীর শব্দ মৃত দেহ সম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হয় বলিয়া এই বিষয়ের বিচারকালে শরীর শব্দ হইতে ভিন্ন ক্ষেত্ৰশব্দই অধিক ব্যবহৃত হয় । ‘ক্ষেত্র’ শব্দের মূল অর্থ ক্ষেত; কিন্তু উপস্থিত প্রকরণে, ‘সবিকার ও সজীব মনুষ্যদেহ’ এই অর্থে তাহার লাক্ষণিক উপযোগ করা হইয়াছে । এই সবিকার ও সজীব মনুষ্যদেহই আমার উপরি-উক্ত ‘বড় কারখানা’ । বাহিরের মাল এই কারখানায় আনিবার এবং কারখানা হইতে ভিতরের মাল বাহিরে পাঠাইবার জন্য জ্ঞানেন্দ্ৰিয়সমূহ ঐ কারখানার যথাক্রম দ্বার; এবং মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার ও চেতনা ঐ কারখানার কর্মচারী । এই কর্মচারী যে কিছু ব্যবহার করে বা করায়, তাহাকে এই ক্ষেত্রের ব্যাপার, বিকার বা ধর্ম বলা যায় ।


11.2) ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞবিচার - ক্ষেত্রজ্ঞ শব্দের অর্থ


এই প্রকারে ক্ষেত্র শব্দের অর্থ নির্ধারিত হইলে পর এই প্রশ্ন সহজে উঠে যে, এই ক্ষেত্র কিংবা ক্ষেত কাহার, এই কারখানার কোন মালিক আছে কি না ? আত্মা শব্দ মন, অন্তঃকরণ কিংবা আমি স্বয়ং - এইরূপ নানা অর্থে ব্যবহৃত হইলেও তাহার মুখ্য অর্থ ক্ষেত্ৰজ্ঞ কিংবা শরীরের মালিক বা স্বামী । মনুষ্য যে যে ক্রিয়া করে, - তাহা মানসিক হোক বা শারীরিক হোক্‌ - সে সমস্ত তাহার বুদ্ধি-আদি অন্তরিন্দ্ৰিয়, চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, কিংবা হস্তপদাদি কর্মেন্দ্রিয় করিয়া থাকে । এই সমস্ত ইন্দ্ৰিয়সমূহের মধ্যে মন ও বুদ্ধি সর্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ । কিন্তু উহারা শ্রেষ্ঠ হইলেও অন্য ইন্দ্ৰিয়সমূহের ন্যায় উহারাও মূলে জড়দেহের কিংবা প্ৰকৃতিরই বিকার (পূর্ব প্রকরণ দেখ) । তাই, মন ও বুদ্ধি সর্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ হইলেও উহারা আপন-আপন বিশিষ্ট ব্যাপারের বাহিরে অন্য কিছুই করিতে পারে না; এবং পারাও সম্ভব নহে । মন চিন্তা করে এবং বুদ্ধি নিশ্চয় করে, ইহা সত্য; কিন্তু ইহা হইতে এ কথা স্থির হয় না যে, এই কাজ মন ও বুদ্ধি কি জন্য করে, অথবা বিভিন্ন সময়ে মন ও বুদ্ধির যে পৃথক্‌ পৃথক্‌ ব্যাপার ঘটিয়া থাকে, তাহাদের একত্বের দ্বারা জ্ঞান উৎপন্ন হইবার জন্য যে একীকরণ আবশ্যক হয় সেই একীকরণ কে করে, কিংবা তদনুসারে পরে সমস্ত ইন্দ্ৰিয় স্ব স্ব ব্যাপারকে তদনুকুল করিবার সন্ধান কি করিয়া পায় । মনুষ্যের জড়দেহই এই সমস্ত কাজ করে এ কথা বলা যাইতে পারে না । কারণ, শরীরের চেতনা অর্থাৎ নড়াচড়াব্যাপার নষ্ট হইলে যে জড়দেহ অবশিষ্ট থাকে, সে এ কাজ করিতে পারে না । জড়দেহের মাংস স্নায়ু ইত্যাদি উপাদানসমূহ অন্নেরই পরিণাম, এবং নিত্য ক্ষয়গ্ৰস্ত ও নিত্য নূতন নির্মিত হয়; সেইজন্য, কাল যে ‘আমি’ অমুক বিষয় দেখিয়াছিলাম, সেই আমি আজি অন্য বিষয় দেখিতেছি, এইরূপ যে একত্ববুদ্ধি তাহা নিত্যপরিবর্তনশীল জড়দেহের ধর্ম, এইরূপ মানিতে পারা যায় না । ভাল এখন জড়দেহ ছাড়িয়া চেতনাকেই যদি মালিক বলা যায় তাহা হইলে এই আপত্তি উঠে যে, গাঢ় নিদ্রাতে প্ৰাণাদি বায়ুর শ্বাসোচ্ছ্বাসাদি অথবা রক্তচলাচল-আদি ব্যাপার অর্থাৎ চেতনা বজায় থাকিলেও ‘আমি’-জ্ঞান থাকে না [বৃ|২|১|১৫,১৮] । তাই, চেতনা কিংবা প্ৰাণাদির ব্যাপারও কেবল জড়েরই একপ্রকার বিশিষ্ট গুণ; তাহা সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ব্যাপারের একীকরণ করিবার মূল প্ৰভুশক্তি নহে, এইরূপ সিদ্ধ হইতেছে [কঠ|৫|৫] । ‘আমার’ ও ‘তোমার’ এই সম্বন্ধবোধক শব্দের দ্বারা কেবল অহঙ্কাররূপী গুণের ৰোধ হইয়া থাকে; কিন্তু ‘অহং’ অর্থাৎ ‘আমি’ কে, এ বিষয়ের নির্ণয় হয় না । এই ‘আমি’কে যদি নিছক ভ্রম বল, তাহা হইলে বলিতে হয় যে, প্ৰত্যেকের প্রতীতি কিংবা অনুভূতি সেরূপ নহে; এবং এই অনুভূতিকে ছাড়িয়া অন্য কোন বিষয়ের কল্পনা করা কেমন ? না, যেমন শ্ৰীসমর্থ রামদাস স্বামী বলিয়াছেন -
“প্রতীতীবীণ জেঁ বোলণে ৷ তেঁ অবঘেচি কণ্টারবাপে ৷
তোঁড় পসরুণ চৈসেঁ সুণেঁ ৷ রডোন গেলে ॥”
অর্থাৎ - মুখব্যাদান করিয়া কুকুরের কান্না যেমন বিরক্তিকর, প্ৰতীতি বিনা যাহা কিছু বলা হয় সে সমস্তই তেমনি বিরক্তিকর [দা|৯|৫|১৫] । এত করিয়াও তবু ইন্দ্ৰিয়ব্যাপারের একীকরণের উপপত্তি কিছুই পাওয়া যায় না । কেহ কেহ এরূপ বলেন যে, ‘আমি’ বলিয়া কোন পৃথক পদার্থ নাই; কিন্তু ‘ক্ষেত্র’ শব্দে মন, বুদ্ধি, চেতনা, জড়দেহ প্ৰভৃতি যে সকল তত্ত্বের সমাবেশ করা হইয়া থাকে, সেই সমস্তের সংঘাতকে বা সমুচ্চয়কে ‘আমি’ বলা যায় । কিন্তু কাঠের উপর কাঠ চাপাইলেই বাক্স হয় না, কিংবা ঘড়ির সমস্ত চাকা একত্র যুক্ত করিলেই তাহাতে গতিও উৎপন্ন হয় না, ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । তাই, নিছক্‌ সংঘাতের দ্বারা বা সমুচ্চয়ের দ্বারাই কর্তৃত্ব আইসে এরূপ বলা চলে না । বলা বাহুল্য যে, ক্ষেত্রের সমস্ত ব্যাপার নিরর্থক পাগলামি নহে; কিন্তু তাহাতে কোন বিশিষ্ট অভিপ্ৰায়, উদ্দেশ্য বা হেতু থাকে । এই ক্ষেত্ররূপ কারখানার মন, বুদ্ধি আদি সমস্ত কর্মচারীকে এই বিশিষ্ট অভিপ্ৰায় বা উদ্দেশ্য কে বলিয়া দেয় ? - সংঘাত অর্থে শুধু সমূহ । কতকগুলি পদার্থ একত্ৰ করিলেও তাহার একপ্রাণত্ব বিধান করিতে হইলে, তাহার মধ্য দিয়া একটা যোগসূত্র স্থাপন করা আবশ্যক; নচেৎ উহা পুনৰ্বার কখন-না-কখন পৃথক পৃথক হইয়া যাইতে পারে । এই যোগসূত্রটি কি, এক্ষণে তাহাই আমাদের দেখিতে হইবে । সংঘাত গীতার স্বীকৃত নহে এরূপ নহে; তবে, তাহার গণনা ক্ষেত্রেই করা হইয়া থাকে [গী|১৩|৬] । ক্ষেত্রের মালিক কিংবা ক্ষেত্ৰজ্ঞ কে, সংঘাতের দ্বারা তাহার সিদ্ধান্ত হয় না । সমুচ্চয়ের মধ্যে কোন নূতন গুণ উৎপন্ন হয়, এইরূপ কেহ কেহ মনে করেন । কিন্তু প্ৰথমত এই মতই তো সত্য নহে, কারণ পুর্বে যাহার অস্তিত্ব কোন আকারে ছিল না, তাহা এ জগতে নূতন উৎপন্ন হয় না, ইহা তত্ত্বজ্ঞানীরা পূৰ্ণবিচারান্তে সিদ্ধ করিয়াছেন [গী|২|১৬] । কিন্তু এই সিদ্ধান্ত ক্ষণতরে একটু পাশে সরাইয়া রাখিলেও এই প্রশ্ন সহজেই উপস্থিত হয় যে, সংঘাতে উৎপন্ন নূতন গুণকেই ক্ষেত্রের মালিক বলিয়া কেন স্বীকার করা যাইবে না ? এই সম্বন্ধে কতকগুলি আধুনিক আধিভৌতিকশাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিতেরা বলেন যে, দ্রব্য ও তাহার গুণ ভিন্ন ভিন্ন থাকিতে পারে না, গুণের কোন-না- কোন অধিষ্ঠান থাকা চাই । এইজন্য সমুচ্চায়োৎপন্ন গুণের বদলে ইহাঁরা সমুচ্চয়কেই এই ক্ষেত্রের মালিক বলেন । ঠিক কথা; কিন্তু আবার ব্যবহারেও ‘অগ্নি’ শব্দের বদলে জ্বালানি কাঠ, ‘বিদ্যুৎ’ শব্দের বদলে মেঘ, কিংবা পৃথিবীর ‘আকর্ষণের’ বদলে পৃথিবী, কেন বলা যায় না ? ক্ষেত্রের সমস্ত ব্যাপার এক ব্যবস্থা ও এক পদ্ধতি অনুসারে চালাইবার জন্য, মন ও বুদ্ধি ব্যতীত কোন ভিন্ন শক্তি থাকা চাই, এই কথা যদি নির্বিবাদ হয়; এবং যদি ইহা সত্য হয় যে, ঐ শক্তির অধিষ্ঠান অদ্যাপি আমাদের অগম্য, কিংবা সেই শক্তি বা অধিষ্ঠানের পুর্ণস্বরূপ ঠিক বলিতে পারা যায় না; তবে সেই শক্তিই নাই এ কথা বলা কিরূপে ন্যায়সঙ্গত হয় ? যেমন কোনও মানুষ নিজের কাঁধের উপর বসিতে পারে না, সেইরূপই সংঘাতের জ্ঞান সংঘাত আপনিই সম্পাদন করিয়া লয় এরূপ বলা যাইতে পারে না । অতএব, দেহ ইন্দ্রিয়াদি সংঘাতের ব্যাপার যাহার উপভোগের জন্য কিংবা লাভের জন্য হইয়া থাকে, সে সংঘাত হইতে ভিন্ন, তর্কদৃষ্টিতেও এই দৃঢ় অনুমান হয় । সংঘাত হইতে ভিন্ন এই তত্ত্ব স্বয়ং সমস্ত তত্ত্বের জ্ঞাতা বলিয়া, জগতের অন্য পদার্থসমূহের ন্যায় ইহা নিজেই নিজের ‘জ্ঞেয়’ অর্থাৎ গোচর হইতে পারে না এ কথা সত্য; কিন্তু তাই বলিয়া তাহার অস্তিত্বসম্বন্ধে কোন বাধা হয় না, কারণ সমস্ত পদার্থকে এই একই ‘জ্ঞেয়’ কোঠারই শামিল করিতে হইবে এরূপ কোন কথা নাই । 

সকল পদার্থের বর্গ বা বিভাগ হয়; যেমন জ্ঞাতা, ও জ্ঞেয় - এই দুই বৰ্গ - অর্থাৎ যে জানে, আর জানিবার বিষয় । এবং যখন কোন বস্তু দ্বিতীয় বর্গের (জ্ঞেয়) শামিল না হয়, তখন প্ৰথম বর্গের মধ্যে তাহার সমাবেশ হয়, এবং তাহার সত্তাও জ্ঞেয়বস্তুর সমানই পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় । অধিক কি, ইহাও বলা যায় যে, সংঘাতের অতীত আত্মা স্বয়ং জ্ঞাত হওয়ায়, সে তাহার জ্ঞানের বিষয় না হইলে আশ্চর্য্যের বিষয় নহে । এই অভিপ্ৰায় অনুসারেই বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন [বৃ|২|৪|১৪] “ওরে ! যে সমস্ত বিষয় জানে তাহার জ্ঞাতা অন্য কোথা হইতে আসিবে” ? - বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজনীয়াৎ । তাই শেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হয় যে, এই চেতনাবিশিষ্ট সজীব শরীরে (ক্ষেত্রে) এমন এক শক্তি আছে, যাহা হস্তপদাদি ইন্দ্ৰিয়াদি হইতে উচ্চে উঠিতে উঠিতে প্ৰাণ, চেতনা, মন ও বুদ্ধি এই পরতন্ত্র ও একদেশদশী কর্মচারীদিগেরও বাহিরে থাকিয়া তাহাদের সমস্ত ব্যাপারের একীকরণ করে এবং তাহারা কিরূপ ভাবে কাজ করিবে তাহার নির্দেশ করিয়া দেয়; কিংবা যাহা তাহাদের কর্মের নিত্য সাক্ষীস্বরূপ থাকিলেও তাহাদের হইতে ভিন্ন, অধিক ব্যাপক ও সমর্থ । সাংখ্য ও বেদান্ত এই দুই শাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত মান্য; এবং অৰ্বাচীনকালে জর্মন তত্ত্বজ্ঞ ক্যান্টও বলিয়াছেন যে, বুদ্ধিব্যাপারের সূক্ষ্ম পরীক্ষা করিলে এই তত্ত্বই নিষ্পন্ন হয় । মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও চেতনা এই সমস্ত, দেহের অর্থাৎ ক্ষেত্রেরই গুণ বা অবয়ব । ইহাদের প্ৰবর্তক ইহাদের হইতে ভিন্ন, স্বতন্ত্র ও ইহাদের অতীত - “যো বুদ্ধেঃ পরতস্তু সঃ” [গী|৩|৪২]সাংখ্য-শাস্ত্ৰে ইহারই নাম পুরুষবেদান্তে ইহাকেই ক্ষেত্ৰজ্ঞ অর্থাৎ ক্ষেত্রের জ্ঞাত আত্মা বলে; এবং “আমি আছি” এই যে প্ৰত্যেক মনুষ্যের সাক্ষাৎপ্ৰতীতি, ইহাই আত্মার অস্তিত্বের সর্বোৎকৃষ্ট প্ৰমাণ [বেসু|শাং|ভা|৩|৩|৫৩,৫৪] । “আমি নাই” এরূপ কেহ মনে করে না । শুধু তাহা নহে; মুখে “আমি নাই” এইরূপ উচ্চারণ করিবার সময়েও ‘নাই’ এই ক্রিয়াপদের কর্তার অর্থাৎ ‘আমি’র কিংবা আত্মার বা ‘আপনার’ অস্তিত্ব সে প্ৰত্যক্ষ রীতিতে স্বীকার করিয়াই থাকে । এই প্রকারে ‘আমি’ এই অহঙ্কারযুক্ত সগুণরূপে, দেহের মধ্যে স্বয়ংপ্ৰকাশ আত্মতত্ত্বের অর্থাৎ ক্ষেত্রজ্ঞের মূলগত শুদ্ধ ও গুণবিরহিত স্বরূপটি কি, তাহারই যথাশক্তি নির্ণয়াৰ্থ বেদান্তশাস্ত্রের উৎপত্তি হইয়াছে [গী|১৩|৪] । 


11.3) ক্ষর-অক্ষর বিচারের প্রস্তাবনা - “যাহা পিণ্ডে, তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে”


তথাপি এই নির্ণয় কেবল দেহের অর্থাৎ ক্ষেত্রের বিচার করিয়াই স্থিরীকৃত হয় নাই । ক্ষেত্ৰক্ষেত্রজ্ঞের বিচার ব্যতীত বাহ্য জগতের অর্থাৎ ব্ৰহ্মাণ্ডেরও বিচার করিয়া কি নিষ্পন্ন হয় তাহা দেখা আবশ্যক, ইহা পুর্বে বলা হইয়াছে । এই ব্ৰহ্মাণ্ড-বিচারের নামই “ক্ষরাক্ষর বিচার” । ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞ-বিচারের দ্বারা নির্ণয় হয় যে, ক্ষেত্রে (অর্থাৎ দেহের মধ্যে বা পিণ্ডের মধ্যে) মূলতত্ত্ব (ক্ষেত্ৰজ্ঞ কিংবা আত্মা) কোনটী; এবং ক্ষরাক্ষর-বিচারের দ্বারা বাহ্য জগতের - অর্থাৎ ব্ৰহ্মাণ্ডের মূলতত্ত্বের জ্ঞান হয় । যখন এই  প্রকারে পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ডের মূলতত্ত্ব প্রথমে পৃথক পৃথক নির্ধারিত হয়, তখন বেদান্তশাস্ত্রে চরম সিদ্ধান্ত করা হয় যে, এই দুই তত্ত্ব একরূপ অৰ্থাৎ একই - কিংবা “যাহা পিণ্ডে আছে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে আছে” । ইহাই চরাচর সৃষ্টির চরম সত্য । 
(ক্ষরাক্ষর বিচার ও ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার - আমাদের শাস্ত্রের এই বর্গীকরণ, গ্ৰীণ সাহেবের জানা ছিল না । অথাপি আপন “Prolegomena to Ethics” গ্রন্থের আরম্ভে তিনি অধ্যাত্মের যে বিচার করিয়াছেন তাহাতে প্রথমে “Spiritual Principle in Nature” এবং “Spiritual Principle in Man” এই দুই পৃথক ভাগ করিয়া পরে তাহাদের ঐক্য দেখাইয়াছেন । ক্ষেত্ৰক্ষেত্রজ্ঞ-বিচারে Pshychology প্রভৃতি মানসশাস্ত্রের এবং ক্ষরাক্ষর বিচারে Physics, Metaphysics প্রভৃতি শাস্ত্রের সমাবেশ হইয়া থাকে । এই সমস্তের বিচার করিয়া পরে আত্মস্বরূপের বিচার করিতে হয়, ইহা পাশ্চাত্য বিদ্বানদিগেরও মান্য ।)


12) পাশ্চাত্যের ও বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সাদৃশ্য


পাশ্চাত্য দেশেও এই বিষয়ের বিচারালোচনা হইয়াছে, এবং ক্যাণ্ট প্রভৃতি কোন কোন তত্ত্বজ্ঞানীর সিদ্ধান্ত আমাদের বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সহিত অনেকাংশে যুড়ি মিলিয়া চলিয়াছে । ইহার প্রতি লক্ষ্য করিলে, এবং এখনকার মত পূর্বে আধিভৌতিক শাস্ত্রের উন্নতি না হইলেও যাঁহারা অন্তর্দৃষ্টির দ্বারা অতি প্ৰাচীনকালে বেদান্তের সিদ্ধান্ত বাহির করিয়াছেন, তাঁহাদের অলৌকিক বুদ্ধিবৈভক দেখিয়া আশ্চর্য না হইয়া থাকা যায় না । শুধু আশ্চর্য হইলে চলিবে না, সেই সম্বন্ধে আমাদের উচিত গর্ব অনুভব করাও আবশ্যক ।
ইতি ষষ্ঠ প্রকরণ সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment