Sunday, June 4, 2017

গীতা ও মহাভারত (Gita & Mahabharat)

গীতা ও মহাভারত



সূচি


1)প্রামান্য পুস্তক নির্বাচন
2)মহাভারতে ভগবদ্গীতার উল্লেখ
3)শব্দসাদৃশ্য
4)অর্থসাদৃশ্য
5)সিদ্ধান্ত
6)‘ভারত’, ‘মহাভারত’ ও ‘জয়’

1) প্রামান্য পুস্তক নির্বাচন


উপরে এই অনুমান করা হইয়াছে যে শ্ৰীকৃষ্ণের ন্যায় মহাপুরুষদিগের চরিত্রের নৈতিক সমর্থনাৰ্থ কর্মযোগমূলক গীতা মহাভারতে উপযুক্ত কারণেই উপযুক্ত স্থানে সন্নিবেশিত হইয়াছে; এবং গীতা মহাভারতেরই এক অংশ হওয়া উচিত । সেই অনুমানই এই দুই গ্রন্থের রচনা তুলনা করিলেই অধিক দৃঢ় হয় । কিন্তু তুলনা করিবার পূর্বে, এই দুই গ্রন্থের বর্তমান স্বরূপ সম্বন্ধে একটু বিচার করা আবশ্যক প্ৰতীত হয় । শ্ৰীমৎশঙ্করাচাৰ্য স্বকীয় গীতাভাষ্যের আরম্ভে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, গীতাগ্রন্থে সাত শত শ্লোক আছে । এবং অধুনাপ্রাপ্ত সমস্ত সংস্করণেও অতগুলি শ্লোকই প্ৰাপ্ত হওয়া যায় । এই সাত শত শ্লোকের মধ্যে ১ শ্লোক ধৃতরাষ্ট্রের, ৪০ সঞ্জয়ের, ৮৪ অর্জুনের এবং ৫৭৫ ভগবানের । কিন্তু বোম্বাই নগরে গণপতি কৃষ্ণাজীর ছাপাখানায় মুদ্রিত মহাভারতের সংস্করণে, ভীষ্মপর্বে বর্ণিত গীতার আঠারো অধ্যায়ের পর যে অধ্যায় আরম্ভ হয়, তাহার (অর্থাৎ ভীষ্মপর্বের ৪৩ তম অধ্যায়ের) আরম্ভে সাড়ে পাঁচ শ্লোকে গীতামহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে, এবং উহাতে উক্ত হইয়াছে -
ষট্‌শতানি সবিংশানি শ্লোকানাং প্ৰাহ কেশবঃ ৷
অর্জ্জুনঃ সপ্তপঞ্চাশৎ সপ্তষষ্টিং তু সঞ্জয়ঃ ৷
ধৃতরাষ্ট্রঃ শ্লোকমেকং গীতায়া মানমুচ্যতে ॥
অর্থাৎ “গীতায় কেশবের ৬২০, অর্জুনের ৫৭, সঞ্জয়ের ৬৭ এবং ধৃতরাষ্ট্রের ১; মিলিয়া সর্বশুদ্ধ ৭৪৫ শ্লোক আছে ।” মাদ্রাজ এলাকার প্রচলিত পাঠানুসারে কৃষ্ণাচাৰ্য কর্তৃক প্ৰকাশিত মহাভারতের সংস্করণেও এই শ্লোক পাওয়া যায়; কিন্তু কলিকাতায় মুদ্রিত মহাভারতে ইহা পাওয়া যায় না; এবং ভারতটীকাকার নীলকণ্ঠ তো এই ৫॥• শ্লোক “গৌড়ৈঃ ন পঠ্যন্তে” এইরূপ লিখিয়াছেন । তাই উহা প্ৰক্ষিপ্ত বলিয়া মনে হয় । কিন্তু ইহা প্ৰক্ষিপ্ত মনে করিলেও গীতার মধ্যে ৭৪৫ শ্লোক (অর্থাৎ অধুনাপ্রাপ্ত গ্ৰন্থসমূহের অতিরিক্ত ৪৫ শ্লোক) কে কবে জুড়িয়া দিয়াছে তাহা বলা যায় না । মহাভারত বহুবিস্তৃত গ্ৰন্থ হওয়ায় তাহাতে মধ্যে মধ্যে অন্য শ্লোক সন্নিবেশিত হওয়া কিংবা কোন শ্লোক বাহির করিয়া লওয়া অসম্ভব নহে । কিন্তু একথা গীতার সম্বন্ধে বলা যায় না । গীতাগ্ৰন্থ সর্বদাই পঠিত হওয়ায় বেদের ন্যায় সমস্ত গীতাও কণ্ঠস্থ করিতে পারিত পূর্বে এরূপ অনেক লোকও ছিল, এবং আজ পৰ্যন্ত কেহ কেহ আছে ! এই কারণে বর্তমান গীতার বেশী পাঠান্তর দেখা যায় না, এবং অল্প যে-কিছু ভিন্ন পাঠ আছে, তাহা টীকাকারেরা জানেন । তাছাড়া, এরূপ বলিতেও বাধা নাই যে, এই কারণেই গীতাগ্রন্থে বরাবর ৭০০ শ্লোক রক্ষিত হইয়াছে যে উহার মধ্যে কেহ ফেরফার করিতে না পারে । এখন প্রশ্ন এই যে, বোম্বাই ও মাদ্রাজে মুদ্রিত মহাভারতের সংস্করণেই ৪৫ শ্লোক - এবং, সে সমস্তও ভগবানেরই বেশী কোথা হইতে আসিল ? সঞ্জয় ও অর্জুনের শ্লোকের মোট সংখ্যা বর্তমান সংস্করণে এবং এই গণনাতে একই অর্থাৎ ১২৪; এবং একাদশ অধ্যায়ের “পশ্যামি দেবান” (১১, ১৫-৩১) ইত্যাদি ১৭ শ্লোকের সঙ্গে মতভেদের কারণে অন্য দশ শ্লোকও সঞ্জয়ের বলিয়া বিবেচিত হওয়া সম্ভব, তাই বলা যাইতে পায়ে যে, সঞ্জয় ও অর্জুনের শ্লোকের মোট সংখ্যা একই হইলেও প্রত্যেকের শ্লোকগুলি পৃথক পৃথক গণনা করিতে অল্প পার্থক্য হইয়া থাকিবে । কিন্তু বর্তমান সংস্করণে ভগবানের যে ৫৭৫ শ্লোক আছে, তাহার বদলে ৬২০ অর্থাৎ ৪৫ অধিক শ্লোক কোথা হইতে আসিল তাহার কোন ঠিকানা পাওয়া যাইতেছে না ! গীতার ‘স্তোত্র’ বা ‘ধ্যান’ বা এই প্ৰকার অন্য কোন প্রকরণের সমাবেশ উহার মধ্যে করা হইয়া থাকিবে ইহা যদি বল, তবে দেখি যে বোম্বায়ে মুদ্রিত মহাভারতের গ্রন্থে ঐ প্রকরণ নাই শুধু নহে, ঐ গ্রন্থের গীতাতেও সাত শত শ্লোকই আছে । অতএব বর্তমান সাতশত শ্লোকের গীতাকেই প্ৰমাণ মানা ভিন্ন গত্যন্তর নাই ।

ইহা হইল গীতার কথা । কিন্তু মহাভারতের দিকে দেখিলে বলিতে হয় যে, এই বিরোধ কিছুই নহে । স্বয়ং ভারতেই উক্ত হইয়াছে যে, মহাভারতসংহিতার শ্লোকসংখ্যা এক লক্ষ । কিন্তু রাওবাহাদুর চিন্তামণি রাও বৈদ্য মহাভারতসম্বন্ধীয় স্বকীয় টীকাগ্রন্থে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, বর্তমান প্রকাশিত গ্ৰন্থসমূহে অতগুলি শ্লোক পাওয়া যায় না; এবং বিভিন্ন পর্বের অধ্যায়সংখ্যাও ভারতের আরম্ভে প্রদত্ত অনুক্ৰমণিকা অনুসারে নাই । এই অবস্থায়, গীতা ও মহাভারতের তুলনা করিবার জন্য এই গ্ৰন্থসমূহের কোন এক বিশেষ পুস্তক অবলম্বন করা ভিন্ন কাজ চলিতে পারে না; তাই, শ্ৰীমৎশঙ্করাচাৰ্য কর্তৃক প্ৰমাণ বলিয়া গৃহীত সপ্তশতশ্লোকী গীতাকে এবং কলিকাতার বাবু প্ৰতাপচন্দ্র রায়ের মুদ্রিত মহাভারতের পুস্তককে প্রমাণরূপে গ্ৰহণ করিয়া আমি এই দুই গ্রন্থের তুলনা করিয়াছি; এবং আমার এই গ্রন্থে উদ্ধৃত মহাভারতের শ্লোকসমূহের স্থাননির্দেশও কলিকাতার মুদ্রিত উক্ত মহাভারতের অনুসারেই করিয়াছি । এই শ্লোকগুলিকে বোম্বায়ের পুস্তকে কিংবা মাদ্রাজের পাঠক্রম অনুসরণ করিয়া মুদ্রিত কৃষ্ণাচাৰ্যের সংস্করণে দেখিতে হইবে, এবং যদি উহা আমার নির্দিষ্ট স্থানে না পাওয়া যায়, তবে একটু অগ্রপশ্চাৎ অনুসন্ধান করিলেই উহা পাওয়া যাইবে ।


2) মহাভারতে ভগবদ্গীতার উল্লেখ


সাতশো শ্লোকের গীতা এবং কলিকাতার বাবু প্ৰতাপচন্দ্র রায়ের মুদ্রিত মহাভারত তুলনা করিলে প্ৰথমেই দেখিতে পাওয়া যায় যে, ভগবদ্গীতা মহাভারতেরই এক অংশ; এবং স্বয়ং মহাভারতেই কয়েক স্থানে এই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায় । প্ৰথম উল্লেখ আদিপর্বের আরম্ভে দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রদত্ত অনুক্ৰমণিকায় করা হইয়াছে । “পূৰ্ব্বোক্তং ভগবদ্‌গীতাপর্ব্ব ভীষ্মবধস্ততঃ” [মভা|আ|২|৬৯] এইরূপ পৰ্ববৰ্ণনায় প্ৰথমে বলিয়া তাহার পর আঠারো পর্বের অধ্যায়সমূহের এবং শ্লোকসমূহের সংখ্যা বলিবার সময় ভীষ্মপর্বের বর্ণনায় পুনর্বার ভগবদ্গীতার স্পষ্ট উল্লেখ এই প্রকারে করা হইয়াছে -
কশ্মলং যত্র পার্থস্য বাসুদেবো মহামতিঃ ৷
মোহজং ন্যাশয়ামাস হেতুভির্মোক্ষদশিভিঃ ॥
“যাহাতে মোক্ষগৰ্ভ কারণ দেখাইয়া বাসুদেব অর্জুনের মনের মোহজ কশ্মল নাশ করিয়াছিলেন” [মভা|আ|২|২৪৭] । এই প্ৰকার আদিপর্বে [১|১৭৯] প্রথম অধ্যায়ে প্রত্যেক শ্লোকের আরম্ভে “যদাশ্রৌষং” বলিয়া, যখন ধৃতরাষ্ট্র বলিয়াছিলেন যে, দুর্যোধনাদির জয়প্রাপ্তিসম্বন্ধে কোন্‌ কোন্‌ প্রকারে আমার নিরাশা হইতেছে, তখন এই বর্ণনা আছে যে, “যখনই শুনিলাম যে, অর্জুনের মনে মোহ উৎপন্ন হইলে পর শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁহাকে বিশ্বরূপ দেখাইয়াছিলেন তখনই আমি জয়সম্বন্ধে নিরাশ হইলাম ।” আদিপর্বের এই তিন উল্লেখের পর শান্তিপর্বের শেষে নারায়ণীয় ধর্ম বলিবার সময় গীতার পুনর্বার নির্দেশ করিতে হইয়াছে । নারায়ণীয়, সাত্বত, ঐকান্তিকভাগবত, এই চারই নাম সমানার্থক । নারায়ণীয়োপাখ্যানে [শা|৩৩৪-৩৫১] নারায়ণ ঋষি কিংবা ভগবান শ্বেতদ্বীপে নারদকে যে উপদেশ করিয়াছিলেন, সেই ভক্তিমূলক প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ বর্ণিত হইয়াছে । বাসুদেবকে একান্তভাবে ভক্তি করিয়া জাগতিক ব্যবহার স্বধর্মানুসারে করিতে থাকিলেই মোক্ষলাভ হয়, ভাগবতধর্মের এই তত্ত্ব আমি পূর্ব প্রকরণসমূহে বলিয়া আসিয়াছি; এবং ইহাও বলা হইয়াছে যে, এই প্রকার ভগবদ্গীতাতেও কর্মযোগই সন্ন্যাসমার্গ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর প্রতিপাদিত হইয়াছে । এই নারায়ণীয় ধর্মের পরম্পরা বর্ণনা করিবার সময় বৈশম্পায়ন জন্মেজয়কে বলিতেছেন যে, এই ধর্ম সাক্ষাৎ নারায়ণ হইতে নারদ প্ৰাপ্ত হন, এবং এই ধর্মই “কথিতো হরিগীতাসু সমাসবিধিকল্পতঃ” [মভা|শাং|৩৪৬|১০] হরিগীতা কিংবা ভগবদ্গীতায় কথিত হইয়াছে । সেইরূপ আবার পরে ৩৪৮ অধ্যায়ের ৮ শ্লোকে উক্ত হইয়াছে -
সমুপোঢেষ্বনীকেষু কুরুপাণ্ডবয়োর্মৃধে ৷
অর্জ্জুনে বিমনস্কে চ গীতা ভগবতা স্বয়ম্‌ ॥

কৌরব ও পাণ্ডবদিগের যুদ্ধের সময় বিমনস্ক অর্জুনকে ভগবান ঐকান্তিক অথবা নারায়ণ-ধর্মের এই বিধিসমূহের উপদেশ করিয়াছিলেন; এবং সর্ব যুগে স্থিত নারায়ণ-ধর্মের পরম্পরা বলিয়া পুনরায় বলিয়াছেন যে, এই ধর্ম এবং যতিদিগের ধর্ম অর্থাৎ সন্ন্যাসধর্ম দুই-ই হরিগীতায় কথিত হইয়াছে [মভা|শাং|৩৪৮|৫৩] । আদিপর্বে ও শান্তিপর্বে প্ৰদত্ত এই ছয় উল্লেখের অতিরিক্ত অশ্বমেধ পর্বের অন্তর্ভূত অনুগীতাপর্বেও আর একবার ভগবদ্গীতার উল্লেখ আছে । ভারতীয় যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেকেরও পরে আর একদিন শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুন যখন একত্র বসিয়াছিলেন, তখন শ্ৰীকৃষ্ণ বলিলেন “এখন এখানে আমার থাকিবার কোন আবশ্যকতা নাই; দ্বারকায় যাইবার ইচ্ছা আছে”; ইহার উত্তরে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে অনুরোধ করিলেন যে, পূর্বে যুদ্ধের আরম্ভে তুমি আমাকে যে উপদেশ দিয়াছিলে তাহা আমি বিস্মৃত হইয়াছি, সেই জন্য পুনর্বার সেই উপদেশ আমাকে দাও [অশ্ব|১৬] । তখন এই অনুরোধ অনুসারে শ্ৰীকৃষ্ণ দ্বারকায় যাইবার পূর্বে অর্জুনকে অনুগীতা বলিয়াছিলেন । এই অনুগীতার প্রথমেই ভগবান বলিয়াছেন যে “যুদ্ধারম্ভে তোমাকে যে উপদেশ করিয়াছিলাম তুমি দুৰ্ভাগ্যবশত তাহা বিস্মৃত হইয়াছ । সেই উপদেশ পুনর্বার তোমাকে সেইরূপই বলা এখন আমার পক্ষেও অসম্ভব; তাই, তাহার বদলে আর কোন বিষয় তোমাকে বলিতেছি” [মভা|অশ্ব|অনুগীতা|১৬|৯-১৩] । ইহা চিন্তার যোগ্য যে, অনুগীতার কোন কোন প্রকরণ গীতার প্রকরণেরই অনুরূপ । অনুগীতার এই নির্দেশ-সমেত মহাভারতে ভগবদ্গীতার সাতবার স্পষ্ট উল্লেখ আছে । সুতরাং ভগবদ্গীতা বর্তমান মহাভারতেরই এক অংশ ইহা উহার আভ্যন্তরিন প্ৰমাণ হইতে স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে ।


3) শব্দসাদৃশ্য


কিন্তু সংশয়ের গতি নিরঙ্কুশ হয় এইজন্য উপর্যুক্ত সাত নির্দেশ হইতেও কাহারও কাহারও সন্তোষ হয় না । তাহারা বলেন যে, এই উল্লেখগুলিও ভারতে যে পরে ঢুকাইয়া দেওয়া হয় নাই তাহা কিরূপে সিদ্ধ হয় ? এই প্রকারে উঁহাদিগের মনে এই সংশয় যেমন-তেমনই থাকিয়া যায়, গীতা মহাভারতের এক অংশ কি না । গীতা গ্রন্থ ব্ৰহ্মজ্ঞানমূলক, এই ধারণা হইতেই এই সন্দেহ তো প্ৰথমে বাহির হয় । কিন্তু এই ধারণা ঠিক নহে, আমি পূর্বেই তাহা সবিস্তার দেখাইয়াছি; সুতরাং বস্তুত দেখিতে গেলে এই সন্দেহের কোন অবসরই থাকে না । তথাপি এই প্ৰমাণের উপরই নির্ভর না করিয়া, অন্য প্ৰমাণের দ্বারাও এই সন্দেহ কিরূপে মিথ্যা বলিয়া নির্ধারিত হয় তাহা এক্ষণে বলিতেছি । কোন দুই গ্ৰন্থ একই গ্ৰন্থকারের কি না এইরূপ সন্দেহ হইলে, কাব্যমীমাংসক প্রথমতঃ শব্দসাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য এই দুই বিষয়ের বিচার করিয়া থাকেন । তন্মধ্যে শব্দসাদৃশ্যে শুধু শব্দেরই সমাবেশ হয় না, কিন্তু উহাতে ভাষারীতিরও সমাবেশ করা হয় । এই দৃষ্টিতে বিচার করিবার সময় মহাভারতের ভাষার সহিত গীতার ভাষার মিল কতটা তাহা দেখা আবশ্যক । কিন্তু মহাভারত গ্ৰন্থ অতি বিস্তৃত হওয়ায়, উহাতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে ভাষার রচনা ও ভিন্ন ভিন্ন রীতিতে করা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - কর্ণপর্বে কৰ্ণার্জুনের যুদ্ধবৰ্ণনা দেখিলে, তাহার ভাষার ধরণ অন্য প্রকরণান্তৰ্গত ভাষা হইতে ভিন্ন লক্ষিত হইবে । তাই, মহাভারতের ভাষার সহিত গীতার ভাষার মিল আছে কিনা, তাহা নিশ্চিত বলা দুষ্কর । তথাপি সাধারণতঃ বিচার করিয়া দেখিলে পরলোকগত কাশীনাথপন্ত তৈলঙ্গ যেরূপ বলেন তদনুসারে গীতার ভাষা ও ছন্দোরচনা আর্ষ কিংবা প্রাচীন বলিতে হয় । 
(৺কাশীনাথ ত্ৰ্যম্বক তৈলঙ্গকৃত ভগবদ্গীতার ইংরাজী ভাষান্তর মোক্ষমূলর সাহেব সম্পাদিত প্রাচ্যধর্মপুস্তকমালার মধ্যে (Sacred Books of the East Series, Vol. VIII.) ছাপা হইয়াছে । এই গ্রন্থে ইংরাজি ভাষাতেই গীতাসম্বন্ধে এক টীকাত্মক প্রবন্ধ প্রস্তাবনার আকারে সংযোজিত হইয়াছে । এই প্রকরণে ৺তৈলঙ্গের মতানুসারে যে উল্লেখ আছে তাহা (এক জায়গা ছাড়া) এই প্রস্তাবনাকে লক্ষ্য করিয়াই হইয়াছে ।)

উদাহরণ যথা - কাশীনাথপন্ত দেখাইয়াছেন যে, অন্ত [গী|২|১৬], ভাষা [গী|২|৫৪], ব্ৰহ্ম (= প্ৰকৃতি গী|১৪|৩), যোগ (= কর্মযোগ), পাদপুরক অব্যয় ‘হ’ [গী|২|৯] প্রভৃতি শব্দ গীতায় যে অর্থে প্ৰযুক্ত হইয়াছে সে অর্থে উহা কালিদাসাদির কাব্যের মধ্যে পাওয়া যায় না । এবং পাঠভেদ বশতই হউক না কেন, কিন্তু গীতার ১১|৩৫ শ্লোকের ‘নমস্কৃত্বা’; এই অপাণিনীয় শব্দ রাখা হইয়াছে, সেইরূপ গী|১১|৪৮ শ্লোকে ‘শক্য অহং’ এইরূপ অ-পাণিনীয় সন্ধিও আছে । সেইরূপ আবার “সেনানীনামহং স্কন্দঃ” [গী|১০|২৪] ইহাতে ‘সেনানীনাং’ এই ষষ্ঠিকারকও পাণিনি অনুসারে শুদ্ধ নহে । আর্ষবৃত্ত রচনার উদাহরণ ৺তৈলঙ্গ স্পষ্ট করিয়া বুঝান নাই । কিন্তু আমার মনে হয় যে, একাদশ অধ্যায়ের বিশ্বরূপ-বৰ্ণনার [গী|১১|১৫-৫০] ৩৬ শ্লোককে লক্ষ্য করিয়াই তিনি গীতার ছন্দোরচনাকে আর্ষ বলিয়া থাকিবেন । এই শ্লোকগুলির প্রত্যেক চরণে এগারো অক্ষর আছে, কিন্তু গণনার কোন নিয়ম নাই; এক চরণ ইন্দ্ৰবজ্র হয় তো দ্বিতীয়টা উপেন্দ্ৰবজ্র, তৃতীয় শালিনী হয় তো চতুর্থটা অন্য কোন প্রকারের । এইরূপ উক্ত ৩৬ শ্লোকে অর্থাৎ ১৪৪ চরণে বিভিন্ন জাতীয় মোটে এগারো চরণ পাওয়া যায় । তথাপি সেখানে এই নিয়মও দেখা যায় যে, প্ৰত্যেক চরণে এগারো অক্ষর আছে, এবং উহাদের মধ্যে প্ৰথম, চতুর্থ, অষ্টম এবং শেষের দুই অক্ষর গুরু; এবং ষষ্ঠ অক্ষর প্রায়ই লঘু । ইহা হইতে এই অনুমান হয় যে, ঋগ্‌বেদ ও উপনিষদের ত্রিষ্টুপবৃত্তের ঢং অনুসারেই এই শ্লোক রচিত হইয়াছে । কালিদাসের কাব্যে এইরূপ ১১ অক্ষরের বিষমবৃত্ত দেখিতে পাওয়া যায় না । হাঁ, শকুন্তলা নাটকে “অমী বেদিং পরিতঃ ক?প্তধিষ্ণাঃ” এই শ্লোক এই ছন্দেরই; কিন্তু কালিদাসই উহাকে ‘ঋক্‌ছন্দ” অৰ্থাৎ ঋগ্বেদের ছন্দ বলিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, আর্ষবৃত্ত প্ৰচলিত থাকা কালেই গীতা গ্ৰন্থ রচিত হইয়াছিল । মহাভারতের অন্যত্রও এইরূপ আৰ্ষশব্দ ও বৈদিকবৃত্ত দেখিতে পাওয়া যায় । কিন্তু ইহার অতিরিক্ত এই দুই গ্রন্থের ভাষাসাদৃশ্যের দ্বিতীয় দৃঢ় প্রমাণ এই যে, মহাভারত ও গীতাতে একই রকম অনেক শ্লোক পাওয়া যায় । মহাভারতের সমস্ত শ্লোক অনুসন্ধান করিয়া তন্মধ্যে গীতায় কতগুলি আসিয়াছে, তাহা অভ্ৰান্তরূপে স্থির করা কঠিন । তথাপি মহাভারত পড়িবার সময় উহাতে যে শ্লোক ন্যুনাধিক পাঠভেদে গীতার শ্লোকের অনুরূপ আমি দেখিতে পাইয়াছি তাহারও সংখ্যা বড় কম নহে; এবং উহার ভিত্তিতে ভাষা সাদৃশ্যের প্রশ্নের সিদ্ধান্তও সহজেই হইতে পারে । নিম্নপ্রদত্ত শ্লোক ও শ্লোকার্ধ, গীতা ও মহাভারতে (কলিকাতা সংস্করণ) শব্দশ কিংবা দুই-এক শব্দের ভেদে একই রকম পাওয়া যায় –


উল্লেখ
মন্তব্য (গীতা)
 উল্লেখ
মন্তব্য (মহাভারত)
1|9
শ্লোকার্ধ
ভীষ্ম|51|4
গীতার মতই দুর্যোধন দ্রোণাচার্যের নিকট স্বীয় সৈন্যের বর্ণনা করিতেছেন
1|10
শ্লোক
ভীষ্ম|51|6

1|12-19
আট শ্লোক
ভীষ্ম|51|22-29
অল্প শব্দভেদে শেষ গীতার শ্লোকেরই মত
1|45
শ্লোক
দ্রোণ|197|50
অল্প শব্দভেদে শেষ গীতার শ্লোকের মত
2|19
শ্লোকার্ধ
শান্তি|224|14
অল্প পাঠভেদে বলিবাসাব-সংবাদে ও কঠোপনিষদে (2|18) আছে
2|28
শ্লোক
স্ত্রী|2|6; 9|11
অব্যক্তইহার বদলে অভাব’, বাকী একই
2|31
শ্লোকার্ধ
ভীষ্ম|124|36
ভীষ্ম কৰ্ণকে ইহাই বলিতেছেন
2|32
শ্লোক
কৰ্ণ|57|2
পার্থর বদলে'কর্ণপদ রাখিয়া দুৰ্যোধন কর্ণকে বলিতেছেন
2|46
শ্লোক
উদ্যোগ|45|26
সনৎসুজাতীয় প্ৰকরণে অল্প শব্দভেদে আসিয়াছে
2|59
শ্লোক
শান্তি|204|16
মনু-বৃহস্পতি-সংবাদে অক্ষরশ আসিয়াছে
2|67
শ্লোক
বন|214|26
অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে এবং প্রথমে রথের রূপকও প্ৰদত্ত হইয়াছে
2|70
শ্লোক
শান্তি|250|9
শুকানুপ্রশ্নে মধ্যে অক্ষরশ আসিয়াছে
3|42
শ্লোক
শান্তি|245|3; 247|2
অল্প পাঠভেদে শুকানুপ্রশ্নে দুইবার আসিয়াছে কিন্তু এই শ্লোকের মূল কঠোপনিষদে ।
4|7
শ্লোক
বন|189-27
মার্কণ্ডের প্রশ্নে অক্ষরশ আসিয়াছে
4|31
শ্লোকার্ধ
শান্তি|267|40
গোকাপিলীয়াখ্যানে আসিয়াছে এবং সমস্ত প্রকরণ যজ্ঞবিষয়কই
4|40
শ্লোকার্ধ
বন|199|110
মার্কণ্ডেয়সমস্যপর্বে শব্দশ প্রদত্ত হইয়াছে
5|5
শ্লোক
শান্তি|305|19; 316|4
এই দুই স্থানে অল্প পাঠভেদে বশিষ্ঠকরাল ও যাজ্ঞবল্ক্য-জনক সংবাদে আসিয়াছে
5|18
শ্লোক
শান্তি|238|19
শুকানুপ্রশ্নে অক্ষরশ আসিয়াছে
6|5
শ্লোকার্ধ এবং পরবর্তী শ্লোকের পূর্বার্ধ
উদ্যোগ|33|63-64
বিদুরনীতিতে অক্ষরশ আসিয়াছে
6|29
শ্লোকার্ধ
শান্তি|238|21
শুকানুপ্রশ্ন, মনুস্মৃতি (মনু|12|91), ঈশাবাস্যোপনিষদ (6) ও কৈবল্য উপনিষদে (1|10) অক্ষরশ আসিয়াছে
6|44
শ্লোকার্ধ
শান্তি|235|7
শুকানুপ্রশ্নে অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে
8|17
শ্লোক - প্ৰথমে যুগের অর্থ না বলিয়া গীতায় প্রদত্ত হইয়াছে
শান্তি|231|31
শুকানুপ্রশ্নে অক্ষরশ আসিয়াছে এবং যুগের অর্থবোধক তালিকাও প্ৰথমে প্রদত্ত হইয়াছে । মনুস্মৃতিতেও অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে (মনু|1|73)
8|20
শ্লোকার্ধ
শান্তি|339|23
নারায়ণীয় ধর্মে অল্প পাঠভেদে দুইবার আসিয়াছে
9|32
শ্লোক এবং পরবর্তী শ্লোকের পূর্বার্ধ
অশ্ব|19|61-62
অনুগীতায় অল্প পাঠভেদে আসিয়াছে
13|13
শ্লোক
শান্তি|238|29; অশ্ব|19|49
শুকানুপ্ৰশ্ন, অনুগীতা এবং অন্যত্রও অক্ষরশ আসিয়াছে । এই শ্লোকের মূল শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে (শ্বে|3|16)
13|30
শ্লোক
শান্তি|17|23
যুধিষ্ঠির অর্জুনকে এই শব্দই বলিয়াছেন
14|18
শ্লোক
অশ্ব|39|10
অনুগীতার গুরুশিষ্যসংবাদে অক্ষরশ প্রদত্ত হইয়াছে
16|21
শ্লোকার্ধ
উদ্যোগ|32|70
বিদূরনীতিতে অক্ষরশ আসিয়াছে
17|3
শ্লোক
শান্তি|263|17
তুলাধার-জাজলিসংবাদে শ্রদ্ধা প্ৰকরণে আসিয়াছে
18|14
শ্লোক
শান্তি|347|87
নারায়ণীয় ধর্মে অক্ষরশ আসিয়াছে

উক্ত তুলনা হইতে বুঝা যায় যে, ২৭ সমগ্ৰ শ্লোক, ১২ শ্লোকার্ধ গীতা ও মহাভারতের বিভিন্ন প্রকরণে কখনও কখনও  অক্ষরশ এবং কখন বা অল্প পাঠভেদে একই; এবং ভাল করিয়া খুঁজিলে আরও অনেক শ্লোক ও শ্লোকার্ধ পাওয়া সম্ভব । যদি ইহা দেখিতে চাও যে, দুই দুই কিংবা তিন তিন শব্দ অধবা শ্লোকের চতুর্থাংশ (চরণ) গীতা ও মহাভারতে কত স্থানে একই আছে, তাহা হইলে উপরের তালিকা খুবই বাড়াইতে হয় ।
(সমস্ত মহাভারত এই দৃষ্টিতে দেখিলে, গীতা ও মহাভারতে সমান শ্লোকপাদ অর্থাৎ চরণ একশতেরও অধিক পাওয়া যাইতে পারে । তন্মধ্যে কতকগুলি এখানে দিতেছি – কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা [গী|১|৩২], নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে [গী|২|৩], ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ [গী|২|৪০], অশান্তস্য কুতঃ সুখম্‌ [২|৬৬], উৎসীদেয়ুরিমে লোকাঃ [৩|২৪], মনো দুর্নিগ্রহং চলম্‌ [৬|৩৫], মমাত্মা ভূতভাবনঃ [৯|৫], মোঘাশা মোঘকর্ম্মাণঃ [৯|১২], সমঃ সর্ব্বেষু ভূতেষু [৯|২৯], দীপ্তানলার্কদ্যুর্তিং [১|১৭], সর্ব্বভূতহিতে রতাঃ [১২|৪], তুল্যনিন্দাস্তুতিঃ [১২|১৯], সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ [১২|১৯], সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ [১৪|২৪], ত্রিবিধা কর্মচোদনা [১৮|১৮], নির্ম্মমঃ শান্তঃ [১৮|৫৩], ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে [১৮|৫৩] ইত্যাদি ।)

কিন্তু এই শব্দসাম্যের অতিরিক্ত কেবল উপরিউক্ত তালিকার শ্লোক সাদৃশ্যই বিচার করিলে মহাভারতের অন্য প্রকরণ এবং গীতা যে একই হাতের, ইহা না বলিয়া থাকা যায় না । প্ৰত্যেক প্ৰকরণ ধরিয়া বিচার করিলেও উক্ত ৩৩ শ্লোকের মধ্যে 1 মার্কণ্ডেয় প্রশ্নে, ½ মার্কণ্ডেয়সমস্যাতে, 1 ব্ৰাহ্মণ-ব্যাধসংবাদে, 2 বিদুরনীতিতে, 1 সনৎসুজাতীয়ে, 1 মনুবৃহস্পতিসংবাদে, 6½ শুকানুপ্রশ্নে, 1 তুলাধার জাজিলিসংবাদে, 1 বশিষ্ঠকরাল ও যাজ্ঞবল্কজ্যনক সংবাদে, 1½ নারায়ণীয় ধর্মে, 2 অনুগীতায় এবং বাকি ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ ও স্ত্রীপর্বে প্রদত্ত হইয়াছে । তন্মধ্যে প্রায় সকল স্থানে এই শ্লোক পূর্বাপর সন্দর্ভ অনুসারে যথাযোগ্য স্থানেই সন্নিবেশিত হইয়াছে, - প্ৰক্ষিপ্ত নহে, এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায়; এবং ইহাও প্রতীত হয় যে, ইহাদের মধ্যে কোন কোন শ্লোক গীতাতেই সমারোপদৃষ্টিতে গৃহীত হইয়াছে । উদাহরণ যথা — “সহস্ৰযুগপৰ্যন্তং” [গী|৮|১৭] এই শ্লোক স্পষ্ট বুঝাইবার জন্য প্ৰথমে বৎসর ও যুগের ব্যাখ্যা দেওয়া আবশ্যক ছিল; এবং মহাভারতে [শাং|২৩১] ও মনুস্মৃতিতে এই শ্লোকের পুর্বে উহাদের লক্ষণও দেওয়া হইয়াছে । কিন্তু গীতায় এই শ্লোক যুগ প্ৰভৃতির ব্যাখ্যা না দিয়া একেবারেই উক্ত হইয়াছে । এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে মহাভারতের অন্য প্রকরণে এই শ্লোক গীতা হইতেই উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা বলিতে পারা যায় না; এবং এত বিভিন্ন প্রকরণ হইতে এই সমস্ত শ্লোক গীতায় গৃহীত হওয়া সম্ভব নহে । অতএব গীতা ও মহাভারতের এই সকল প্রকরণের লেখক একই ব্যক্তি, ইহাই অনুমান করিতে হয় । ইহাও এইস্থানে বলা আবশ্যক যে, মনুস্মৃতির অনেক শ্লোক যেরূপ মহাভারতে পাওয়া যায়, * সেইপ্ৰকার গীতার “সহস্ৰযুগপৰ্যন্তং” [৮|১৭] এই পুরো শ্লোকটি অল্প পাঠভেদে এবং “শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ” [গী|৩|৩৫ ও ১৮|৩৭] এই শ্লোকার্ধ – ‘শ্রেয়ান্‌’এর বদলে ‘বরং’ এই পাঠভেদে এবং “সর্ব্বভূতস্থমাত্মানং” এই শ্লোকার্ধও [গী|৬|২৯] “সর্ব্বভূতেষু চাত্মানং” এই রূপভেদে মনুস্মৃতিতে পাওয়া যায় [মনু|১|৭৩; ১০|৯৭; ১০|৯১] । মহাভারতের অনুশাসনপর্বে এইরূপ মনুস্মৃতির স্পষ্ট উল্লেখ আছে ।
(মনুস্মৃতির কোন্‌ কোন্‌ শ্লোক মহাভারতে পাওয়া যায় তাহার এক তালিকা, বুহ্লর সাহেবের ‘প্রাচ্যধর্মপুস্তকমালায়’ মুদ্রিত মনুর ইংরাজী ভাষান্তরে যোজিত হইয়াছে তাহা দেখ (S.B.E. Vol XXV. Pp.533.)


4) অর্থসাদৃশ্য


শব্দসাদৃশ্যের বদলে অর্থসাদৃশ্য দেখিলেও এই অনুমানই দৃঢ় হয় । গীতার কর্মযোগমার্গ ও প্ৰবৃত্তিমূলক ভাগবতধর্ম বা নারায়ণীয় ধর্মের সাম্য আমি পূর্ব প্রকরণসমূহে ইঙ্গিত করিয়া আসিয়াছি । বাসুদেব হইতে সংকর্ষণ, সংকর্ষণ হইতে প্ৰদ্যুম্ন, প্ৰদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধ এবং অনিরুদ্ধ হইতে ব্ৰহ্মদেব, ব্যক্ত সৃষ্টির উপপত্তির এই যে পরম্পরা নারায়ণীয় ধর্মে প্রদত্ত হইয়াছে তাহা গীতায় গৃহীত হয় নাই । ইহার অতিরিক্ত ইহাও সত্য যে, গীতাধর্ম ও নারায়ণীয় ধর্মে অনেক ভেদ আছে । কিন্তু চতুর্ব্যুহ পরমেশ্বরের কল্পনা গীতার মান্য না হইলেও গীতার নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তের উপর বিচার করিলে প্ৰতীত হয় যে, গীতাধর্ম ও ভাগবতধর্ম একই প্রকারের । সিদ্ধান্তটা এই - এক ব্যুহ বাসুদেবের প্রতি ভক্তিই রাজমাৰ্গ, অন্য কোন দেবতার প্রতি ভক্তি গেলেও তাহা বাসুদেবেরই প্ৰতি অৰ্পিত হয়; ‘ভক্ত চারি প্রকারের হইয়া থাকে; ভগবদভক্তকে স্বধর্মানুসারে সমস্ত কর্মের অনুষ্ঠান করিয়া যজ্ঞচক্ৰ বজায় রাখিতেই হইবে এবং সন্ন্যাসগ্রহণ করা উচিত নহে । ইহাও পূর্বে বলিয়াছি যে, বিবস্বান-মনু-ইক্ষ্বাকু প্ৰভৃতি সম্প্রদায়পরম্পরাও উভয় দিকে একই। সেইরূপ আবার সনৎসুজাতীয়, শুকানুপ্রশ্ন, যাজ্ঞবল্ক্যজনকসংবাদ, অনুগীতা ইত্যাদি প্রকরণ পড়িলে বুঝা যাইবে যে, গীতার বেদান্ত বা অধ্যাত্মজ্ঞানেরও উক্ত প্রকরণসমূহে প্ৰতিপাদিত ব্ৰহ্মজ্ঞানের সহিত মিল আছে । কাপিল-সাংখ্যশাস্ত্রের ২৫ তত্ত্ব ও গুণোৎকর্ষের সিদ্ধান্ত স্বীকার করিয়াও ভগবদ্গীতা যে প্রকার প্রকৃতি ও পুরুষেরও অতীত কোন নিত্য তত্ত্ব আছে বলিয়া মানিয়া থাকেন, সেইরূপই শান্তিপর্বের বশিষ্ঠকরালসংবাদে ও যাজ্ঞবল্ক্যজনকসংবাদে সবিস্তার ইহা প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে, সাংখ্যাদিগের ২৫ তত্ত্বের অতীত আর এক ‘ষড়্‌বিংশতিতম’ তত্ত্ব আছে, যাহার জ্ঞান না হইলে কৈবল্য লাভ হয় না ।

এই বিচারসাম্য কেবল কর্মযোগ বা অধ্যাত্ম এই দুই বিষয়ের সম্বন্ধেই দেখা যায় না; কিন্তু এই দুই মুখ্য বিষয়ের অতিরিক্ত গীতাতে যে অন্যান্য বিষয় আছে তাহাদেরই সদৃশ প্রকরণও মহাভারতে কয়েকস্থানে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - গীতার প্ৰথম অধ্যায়ের আরম্ভেই দুর্যোধন দ্ৰোণাচার্যের নিকট উভয় সৈন্যের যেরূপ বর্ণনা করিয়াছেন ঠিক সেইরূপ বৰ্ণনাই পরে ভীষ্মপর্বের ৫১ অধ্যায়ে তিনি পুনর্বার দ্রোণাচার্যেরই নিকট করিয়াছেন । প্ৰথম অধ্যায়ের উত্তরার্ধে অর্জুনের যেরূপ বিষাদ হইয়াছিল, সেইরূপই শান্তিপর্বের আরম্ভে যুধিষ্টিরের হইয়াছিল; এবং যখন ভীষ্ম ও দ্রোণের “যোগবলে” নিহত হইবার সময় নিকটবর্তী হইল, তখন অর্জুনের মুখ হইতে পুনর্বার ঐরূপই বিষাদপূৰ্ণ কথা বাহির হইয়াছিল [ভীষ্ম|৯৭|৪-৭; ১০৮|৮৮-৯৪] । অর্জুন গীতার আরম্ভে বলিয়াছেন যে, যাঁহাদের জন্য বিষয়োপভোগ করিতে হইবে তাহাদিগকে বধ করিয়া জয়লাভ করিলেই বা কি ফল [গী|১|৩২, ৩৩] আবার, যখন যুদ্ধে সমস্ত কৌরবের ক্ষয় হইল তখন ঐ কথাই দুৰ্যোধনের মুখ হইতেও বাহির হইয়াছে [শল্য|৩১|৪২-৫১] । দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে যেমন সাংখ্য ও কর্মযোগ এই দুই নিষ্ঠার কথা বলা হইয়াছে সেইরূপই নারায়ণীয় ধর্মে এবং শান্তিপর্বের জাপকোপাখ্যানে ও জনকসুলভাসংবাদেও এই নিষ্ঠার বর্ণনা আছে [শাং|১৯৬, ৩২০] । তৃতীয় অধ্যায়ের অকর্ম অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম না করিলে পেটও ভরে না, ইত্যাদি বিচার বনপর্বের আরম্ভে দ্ৰৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলিয়াছেন [বন|৩২]; এবং এই তত্ত্বেরই উল্লেখ অনুগীতাতেও পুনর্বার করা হইয়াছে । শ্রৌতধর্ম বা স্মার্তধর্ম যজ্ঞময়, যজ্ঞ ও প্রজা ব্ৰহ্মদেব একসঙ্গেই নির্মাণ করিয়াছেন, ইত্যাদি গীতার প্রবচন নারায়ণীয় ধর্ম ছাড়া শান্তিপর্বের অন্য স্থানে [শাং|২৪৭] এবং মনুস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|৩]; এবং স্বধর্মানুযায়ী কর্মসাধনে পাপ নাই এই বিচার তুলাধার জাজলি-সংবাদে ও ব্রাহ্মণ-ব্যাধসংবাদেও প্রদত্ত হইয়াছে [শাং|২৬০-২৬৩ এবং বন|২০৬-২১৫] । এতদ্ব্যতীত, গীতার সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে জগদ্যুৎপত্ত্বির যে অল্প কিছু বর্ণনা আছে, তাহারই অনুরূপ বৰ্ণনা শান্তিপর্বের শুকানুপ্রশ্নেও আছে [শাং|২৩১]; এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাতঞ্জল যোগের আসনের যে বৰ্ণনা আছে, তাহাই পুনৰ্বার শুকানুপ্রশ্নে [শান্তি|২৩৯] ও পরে শান্তিপর্বের ৩০০ অধ্যায়ে এবং অনুগীতাতেও সবিস্তার বিবৃত হইয়াছে [অশ্ব|১৯] । অনুগীতার গুরুশিষ্যসংবাদে কৃত মধ্যম-উত্তম বস্তুসমূহের বর্ণনা [অশ্ব|৪৩, ৪৪] এবং গীতার দশম অধ্যায়ের বিভূতি-বর্ণনা, এই উভয়ের প্রায় একই অর্থ, এরূপ বলিতে বাধা নাই । মহাভারতে উক্ত হইয়াছে যে, গীতায় ভগবান অর্জুনকে যে বিশ্বরূপ দেখাইয়াছিলেন, তাহাই সন্ধিপ্ৰস্তাবের সময় দুর্যোধনাদি কৌরবদিগকে এবং পরে যুদ্ধ শেষ হইলে দ্বারকায় ফিরিয়া যাইবার পথে উত্তঙ্ককে, এবং নারায়ণ নারদকে এবং দাশরথি রাম পরশুরামকে দেখাইয়াছিলেন [উ|১৩০; অশ্ব|৫৫; শাং|৩৩৯; বন|৯৯] । ইহা নিঃসন্দেহ যে, গীতার বিশ্বরূপ—বর্ণনা এই চারি স্থানের বর্ণনাপেক্ষা সরস ও বিস্তৃত; কিন্তু এই সমস্ত বর্ণনা পাঠ করিলে সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, অর্থসাদৃশ্যের দৃষ্টিতে সেগুলিতে কিছুই নূতনত্ব নাই । গীতার চতুর্দশ ও পঞ্চদশ অধ্যায়ে নিরূপণ করা হইয়াছে যে, সত্ব রজ ও তম এই তিন গুণ প্ৰযুক্ত জগতের মধ্যে বৈচিত্ৰ্য কিরূপে উৎপন্ন হয়, এই গুণত্রয়ের লক্ষণ কি, এবং সমস্ত কর্তৃত্ব গুণেরই, আত্মার নহে; ঠিক এই প্রকার এই তিন গুণের বর্ণনা অনুগীতায় [অশ্ব|৩৬-৩৯] এবং শান্তিপর্বেও অনেকস্থানে প্ৰদত্ত হইয়াছে [শাং|২৮৫ ও ৩০০-৩১১] । সারকথা, গীতার প্রসঙ্গ অনুসারে গীতায় কোন কোন বিষয়ের আলোচনা বিস্তৃত হইয়া গিয়াছে এবং গীতার বিষয়-বিচারপদ্ধতিও কিছু ভিন্ন, তথাপি দেখা যায় যে, গীতার সমস্ত বিচারের অনুরূপ বিচার মহাভারতেও পৃথক পৃথক কোথাও-না-কোথাও ন্যুনাধিক পরিমাণে পাওয়াই যায়; এবং বিচারসাম্যের সঙ্গে সঙ্গেই শব্দেরও ন্যুনাধিক সাম্য স্বতই সংঘটিত হয়, ইহা বলা বাহুল্য । মাৰ্গশীর্ষ মাসের সম্বন্ধে সাদৃশ্য তো বিলক্ষণই আছে । গীতায় “মাসানাং মাৰ্গশীর্ষোহহং” [গী|১০|৩৫] বলিয়া এই মাসকে যে প্ৰকার প্রথম স্থান দেওয়া হইয়াছে, সেইরূপই অনুশাসনপর্বের দানধর্ম প্ৰকরণে যেখানে উপবাসের জন্য মাসগুলির নাম বলিবার প্রসঙ্গ দুইবার আসিয়াছে, সেইখানে প্ৰত্যেকবার মাৰ্গশীর্ষ হইতেই মাসগুলির গণনা শুরু করা হইয়াছে [অনু|১০৬ ও ১০৯] । গীতার আত্মৌপম্যের কিংবা সর্বভূতহিতের দৃষ্টি, অথবা আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক ভেদ, এবং দেবযান ও পিতৃযান গতির উল্লেখ মহাভারতের অনেক স্থানে পাওয়া যায় । এই সম্বন্ধে পূর্বপ্রকরণসমূহে সবিস্তার আলোচনা করিয়াছি বলিয়া এখানে তাহার পুনরুক্তি করিলাম না ।


5) সিদ্ধান্ত


ভাষা সাদৃশ্যই ধর, বা অর্থসাদৃশ্যই ধর, কিংবা গীতাসম্বন্ধে মহাভারতে যে ছয় সাত বার উল্লেখ পাওয়া যায় তাহার উপর বিচার কর; এইরূপ অনুমান না করিয়া থাকা যায় না যে, গীতা বর্তমান মহাভারতেরই এক অংশ, এবং যে ব্যক্তি বর্তমান মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন তিনিই বর্তমান গীতাও বিবৃত করিয়াছেন । এই সমস্ত প্ৰমাণ উপেক্ষা করিয়া কিংবা কোন প্ৰকারে উহাদের মনগড়া অৰ্থ লাগাইয়া কোন কোন ব্যক্তি গীতাকে প্ৰক্ষিপ্ত দাঁড় করাইবার চেষ্টা করিয়াছেন তাহা আমি অবগত আছি । কিন্তু যাহারা বাহ্য প্রমাণকে মানেন না এবং নিজেরই সংশয়পিশাচকে অগ্ৰস্থান দেন, তাহাদের বিচারপদ্ধতি নিতান্ত অশাস্ত্রীয় সুতরাং অগ্ৰাহ্য । মহাভারতের মধ্যে গীতাকে কেন স্থান দেওয়া হইল ইহার কোন উপপত্তিই যদি প্ৰকাশ না পাইত, তাহা হইলে অন্য কথা ছিল । কিন্তু (এই প্রকরণের আরম্ভে যেমন বলা হইয়াছে) গীতা নিছক বেদান্তমূলক কিংবা ভক্তিমূলক নহে, কিন্তু যে প্ৰমাণভূত মহাপুরুষদিগের চরিত্র মহাভারতে বৰ্ণিত হইয়াছে, তাহাদিগের চরিত্রের নীতিতত্ত্ব বা মর্ম বলিবার জন্য মহাভারতে কর্মযোগমূলক গীতার নিরূপণ অত্যন্ত আবশ্যক ছিল; এবং বর্তমান সময়ে মহাভারতের যে স্থানে উহা বিবৃত হইয়াছে তাহা অপেক্ষা কাব্যদৃষ্টিতে ও উহার উল্লেখের জন্য অধিকতর কোন যোগ্যস্থল দেখা যায় না । ইহা সিদ্ধ হইলে পর, গীতা মহাভারতের মধ্যে যোগ্য কারণে ও যোগ্যস্থানেই সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, প্রক্ষিপ্ত নহে, এই সিদ্ধান্তই শেষে বজায় থাকে । মহাভারতের ন্যায় রামায়ণও একটি সর্বমান্য ও উৎকৃষ্ট আর্ষ মহাকাব্য; এবং তাহাতেও কথাপ্ৰসঙ্গানুসারে সত্য, পুত্ৰধর্ম, মাতৃধর্ম, রাজধর্ম প্রভৃতির মর্মস্পর্শী আলোচনা আছে । কিন্তু ইহা বলিবার প্রয়োজন নাই যে, নিজের কাব্যকে মহাভারতের ন্যায় “অনেক সময়ান্বিত, সূক্ষ্ম ধর্মাধর্মের অনেক নীতিতত্ত্বে পূর্ণ, এবং সমস্ত লোকের শীল ও সচ্চরিত্র-শিক্ষাবিধানে সর্বপ্রকারে সমৰ্থ” করা বাল্মীকি ঋষির মূল উদ্দেশ্য ছিল না; তাই ধর্মাধর্মের কার্যাকার্যের বা নীতির দৃষ্টিতে, মহাভারতের যোগ্যতা রামায়ণ অপেক্ষা অধিক । মহাভারত শুধু আর্ষ কাব্য বা শুধু ইতিহাস নহে; কিন্তু উহা ধর্মাধর্মের সূক্ষ্ম প্রসঙ্গের নির্ণয়কারী এক সংহিতা; এবং এই ধর্মসংহিতা র মধ্যে যদি কর্মযোগের শাস্ত্রীয় ও তাত্ত্বিক বিচার না করা হয়, তবে তাহা আর কোথায় করা যাইতে পারে ? শুধু বেদান্তসম্বন্ধীয় গ্রন্থে এই বিচার-আলোচনা করা যাইতে পারে না, ধর্মসংহিতাই উহার উপযুক্ত স্থান; এবং মহাভারতকার যদি এইরূপ আলোচনা না করিতেন তবে ধর্মাধর্মের এই বৃহৎ সংগ্ৰহ কিংবা পঞ্চম বেদ সেই পরিমাণেই অপূর্ণ থাকিয়া যাইত । এই ক্ৰটী পূর্ণ করিবার জন্যই ভগবদ্গীতা মহাভারতের মধ্যে সন্নিবেশিত হইয়াছে । সত্যসত্যই ইহা আমাদের বড় সৌভাগ্য যে, এই কর্মযোগশাস্ত্রের সমর্থনা করিতে বেদান্তশাস্ত্রের সমানই ব্যবহারেতেও অত্যন্ত নিপুণ মহাভারতকারের ন্যায় এক উত্তম সৎপুরুষকে আমরা লাভ করিয়াছি । এইরূপে সিদ্ধ হইল যে, বর্তমান ভগবদ্গীতা প্ৰচলিত মহাভারতেরই এক অংশ ।


6) ‘ভারত’, ‘মহাভারত’ ও ‘জয়’


এখন উহার অর্থ আর একটু স্পষ্ট করিয়া বলা আবশ্যক । ভারত ও মহাভারত এই দুই শব্দ আমরা সমানার্থক মনে করি; কিন্তু বস্তুত এই দুই শব্দ বিভিন্ন । ব্যাকরণদৃষ্টিতে দেখিলে, ভরতবংশীয় রাজাদিগের পরাক্রম যে গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে সেই গ্ৰন্থই ‘ভারত’ নাম প্ৰাপ্ত হইতে পারে । রামায়ণ, ভাগবত ইত্যাদি শব্দের বুৎপত্তি এইরূপই; এই রীতিতে যে গ্রন্থে ভারতীয় যুদ্ধের বর্ণনা আছে তাহাকে শুধু ‘ভারত’ বলিলেই যথেষ্ট হয়, সেই গ্ৰন্থ যতই বিস্তৃত হৌক না কেন তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না । রামায়ণ গ্ৰন্থ ক্ষুদ্র গ্ৰন্থ নহে; কিন্তু তাহাকে কেহ মহা-রামায়ণ বলে না । তবে ভারতেরই নাম ‘মহাভারত’ কেন হইল ? মহত্ত্ব ও গুরুত্ব এই দুই গুণপ্ৰযুক্ত এই গ্ৰন্থ ‘মহাভারত’ নাম পাইয়াছে, ইহা মহাভারতের শেষে উক্ত হইয়াছে [স্বৰ্গ|৫|৪৪] । কিন্তু সরল শব্দার্থে ‘মহাভারত’ অর্থে ‘বড় ভারত’ হয় । এবং এই অর্থ গ্রহণ করিলে, এই প্রশ্ন উঠে যে, ‘বড়’ ভারতের পূর্বে কোন ‘ছোট’ ভারতও ছিল কি ? এবং তাহার মধ্যে গীতা ছিল কি না ? বর্তমান মহাভারতের আদিপর্বে বর্ণিত হইয়াছে যে, উপাখ্যানসমূহের অতিরিক্ত মহাভারতের শ্লোকসংখ্যা চব্বিশ হাজার [আ|৬২|২০] । ‘জয়’ শব্দে ভারতীয় যুদ্ধে পাণ্ডবদিগের জয় বিবিক্ষিত বলিয়া মনে হয়; এবং ঐরূপ অর্থ গ্রহণ করিলে ইহাই প্ৰতীত হয় যে, ভারতীয় যুদ্ধের বর্ণনা প্ৰথমে “জয়” নামক গ্রন্থে করা হইয়াছিল, পরে সেই ঐতিহাসিক গ্রন্থের মধ্যেই অনেক উপাখ্যান সন্নিবেশিত হইয়া উহাই ইতিহাস ও ধর্মাধর্মবিচারেরও নির্ণয়কারী এই এক বড় গ্ৰন্থ মহাভারতে পরিণত হইয়াছে । অশ্বালয়নগৃহ্যসূত্রের ঋষিতর্পণে - “সমন্তু-জৈমিনি-বৈশম্পায়ন-পৈল-সুত্র-ভাষ্য-ভারত-মহাভারত-ধম্মাচাৰ্য্যাঃ” [আ.গৃ|৩,৪,৪] উল্লেখ আছে তাহা হইতেও এই অনুমানই দৃঢ় হয় । এই প্ৰকার বড় ভারতের মধ্যে ক্ষুদ্র ভারতের সমাবেশ হইলে পর, কিছু কাল বাদে ক্ষুদ্র ‘ভারত’ নামক স্বতন্ত্র গ্ৰন্থ না থাকায় স্বভাবত লোকদিগের এই ধারণা হইল যে, কেবল ‘মহাভারত’ই এক ভারত গ্ৰন্থ । বর্তমান মহাভারতের এই সংস্করণে বৰ্ণনা পাওয়া যায় যে, ব্যাস প্ৰথমে আপন পুত্র শুককে, এবং তাহার পর অন্য শিষ্যদিগকে ভারত পড়াইয়াছিলেন [আ|১|১০৩]; এবং পরে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, সমস্ত, জৈমিনি, পৈল, শুক ও বৈশম্পায়ন এই পাঁচ শিষ্য পাঁচ বিভিন্ন ভারতসংহিতা বা মহাভারত রচনা করিয়াছিলেন [আ|৬৩|৯০] । এই বিষয়ে এইরূপ কথা আছে যে, এই পাঁচ মহাভারতের মধ্যে বৈশম্পায়নের মহাভারতকে এবং জৈমিনীয় মহাভারতের মধ্যে অশ্বমেধ পর্বমাত্র ব্যাসদেব রাখিয়া লইয়াছিলেন । ইহা হইতে এখন ইহাও বুঝা যায় যে, ঋষিতর্পণে ‘ভারত-মহাভারত’ পূর্বে সমস্ত প্রভৃতি নাম কেন রাখা হইয়াছে । কিন্তু এখানে এই বিষয়ে এত গভীর বিচার করিবার কোন প্রয়োজন নাই । রা. বি. চিন্তামণি রাও বৈদ্য মহাভারতের স্বকীয় টীকাগ্রন্থে এই বিষয়ের বিচার করিয়া যে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন তাহাই আমার মতে সযুক্তিক । তাই এখানে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, আমরা যে মহাভারত বর্তমানে প্রাপ্ত হইয়াছি তাহা মূলে এরূপ ছিল না; ভারতের বা মহাভারতের অনেক রূপান্তর হইয়া গিয়াছে, এবং শেষে তাহার যে স্বরূপ দাঁড়াইয়াছে তাহাই আমাদের বর্তমান মহাভারত । মূল ভারতেও গীতা ছিল না এরূপ বলা যায় না । হাঁ, ইহা সুস্পষ্ট যে, সনৎসুজাতীয়, বিদুরনীতি, শুকানুপ্ৰশ্ন, যাজ্ঞবল্ক্যজনক-সংবাদ, বিষ্ণুসহস্ৰনাম, অনুগীতা, নারায়ণীয় ধর্ম প্রভৃতি প্রকরণের সমানই বর্তমান গীতাকেও মহাভারতকার পূর্ববর্তী গ্ৰন্থসমূহের ভিত্তির উপরেই লিখিয়াছেন, - নূতন রচনা করেন নাই । তথাপি ইহাও নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না যে, মহাভারতকার মূল গীতাতে কিছু ফেরফার করেন নাই । উপরি-উক্ত আলোচনা হইতে সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, বর্তমান সাতশত-শ্লোকী গীতা বর্তমান মহাভারতেরই এক ভাগ; উভয়েরই রচনা একই হাতের, এবং বর্তমান মহাভারতে বর্তমান গীতা কেহ পরে ঢুকাইয়া দেয় নাই । বর্তমান মহাভারতের কোন কাল, এবং মূল গীতাসম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য কি তাহাও পরে বলা যাইবে ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment