Saturday, May 27, 2017

লোকমান্য তিলকের কর্মজীবন (Biography - Bal Gangadhar Tilak)

লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক (wiki, উইকি)

(1856-1920)


সূচি

 1)ভূমিকা
 2)শৈশব ও ছাত্রাবস্থা
 3)যৌবন ও কর্মজীবন
 4)দ্বিতীয় কারাবাস ও 'The Arctic Home in the Vedas' রচনা
 5)তিলকের চরমপন্থা
 6)তৃতীয় কারাবাস ও গীতারহস্য রচনা
 7)হোমরুল আন্দোলন ও মানহানি মামলা
 8)জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড
 9)অস্তাচল
10)জীবনাদর্শ ও মূল্যায়ন


1) ভূমিকা


পরাধীন ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের বলিষ্ঠ পুরোনায়ক লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক এক অসামান্য মনীষী । আমাদের সার্বিক জাতীয় জাগরণের তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রাণপুরুষ । মহারাষ্ট্রের গুরু সমর্থ রামদাস স্বামীর জ্ঞানসাধনা, ভক্ত সাধক একনাথের ভক্তিপ্রবাহ এবং ছত্রপতি শিবাজীর কর্মধারার ত্রিবেণী-সঙ্গম রচিত হয়েছিল যুগান্তরে এই মহাত্মার জীবনে । আপোষহীন রাজনৈতিক মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে গভীর সারস্বত সাধনার দুর্লভ সংযোগে তাঁর জীবন অনন্য । একদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনে চরমপন্থীদের মুখ্য পুরুষ, আর একদিকে জাতীয় জাগরণে অগ্নিক্ষরা বাণীবর্ষণকারী সাংবাদিক এবং অন্যদিকে জ্যোতিষ, গণিত, বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, তুলনামূলক ধৰ্মতত্ত্ব এবং ভক্তিশাস্ত্রের যুগন্ধর পণ্ডিতরূপে তাঁর বহু মুখী প্রতিভাদর্শনে বিস্মিত হতে হয় । আগারকর, রাণাডে এবং নওরোজী প্রমুখ মনীষীর প্রভাবে তিনি সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমসাময়িক কুসংস্কার দূরীকরণার্থে সংগ্রামে অবতীর্ণ হন । যুগের প্রয়োজনে আধুনিক শত্রুকে পরাজিত করার জন্য আধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা তিনি উপলব্ধি করেছিলেন । ইংরেজী শিক্ষার কাটাখালে যে প্রতীচ্যের ভোগবাদী, জড়বাদী, নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা কুমীরের বেশে ভারতের অন্তঃপুরে হানা দিয়েছিল, তা’র বিতাড়নেও যে ইংরেজী শিক্ষার প্রয়োজন তা’ তিনি অনুভব করেছিলেন । সেইজন্য আধুনিক আদর্শে ইংরেজী বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠায় পথিকৃদ রূপে তিনি পুণাতে ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে New English School এবং ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে Fergusson College স্থাপিত করেন । ঊনবিংশ শতকে ভারতের নবজাগরণে কলকাতার “হিন্দু কলেজ”-এর ন্যায় পুণার এই ফার্গুসন কলেজের অবদানও অনস্বীকরণীয় । “কেশরী” ও “মারহাট্টা” নামে দুটি সংবাদপত্রের প্রকাশনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি বহ্নিবিসারী ভাষায় গণচেতনাকে জাগ্রত করেন । বহু গোহত্যা-নিষেধ-সংস্থা আখাড়া এবং লাঠিখেলা সমিতি তিনি প্রতিষ্ঠা করেন । “গণপতি উৎসব” এবং “শিবাজী উৎসবের” তিনিই ছিলেন মুখ্য প্রবর্তক । ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বয়কট, স্বদেশী, জাতীয় শিক্ষা এবং স্বরাজের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদানে এগিয়ে এলেন । ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে লক্ষ্মৌ কংগ্রেসে তিনিই দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করেন - স্বাধীনতায় আমার জন্মগত অধিকার - "Swaraj is my birth right." এই চরমপন্থী মহানায়ক আবার ব্যক্তিগত আচরণে ছিলেন কারুণ্য-মূর্তি, সৌন্দর্য-সাধক । তাঁর লোকোত্তর চরিত-মহিমাকে বিশ্লেষণ করলে মনে পড়ে মহাকবি ভবভূতির রামচরিতের বর্ণনা -
“বজ্রাদপি কঠোরাণি মৃদুনি কুসুমাদপি ৷
লোকোত্তরাণাং চেতাংসি কো নু বিজ্ঞাতুমর্হতি ॥”
ইটালীর জাতীয় জাগরণে Josef Mazzini-র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তি-সংগ্রামে George Washington-এর ন্যায় ভারতেও শক্তিশালী জাতিগঠনে লোকমান্য তিলকের ছিল অনন্যসাধারণ ভূমিকা । নবজাগ্ৰত ভারতের মুকুটহীন সম্রাট রূপে তিনি সেদিন সর্বত্র বন্দিত হয়েছিলেন । আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মুলে ছিল তাঁর গতিশীল ব্যক্তিত্ব এবং বৈপ্লবিক কর্মধারা । ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে হতে ১৯২০ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের সঙ্গে ভারতের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে নিষ্কাম কর্মসাধনার দর্শনকে অবলম্বন করে আপোষহীন সংগ্রামের দ্বারা স্বরাজের নামে জনগণকে তিনি প্রবুদ্ধ করেন । প্রতীচ্য সাম্রাজ্যবাদীদের মৃগয়াক্ষেত্র এশিয়া ভূখেন্ডে অন্যান্য জাতিরও নবাভ্যুদয়ে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার ন্যায় বিরাজিত ছিল তিলক মহারাজের দার্শনিক প্রত্যয় ও সংগ্ৰামী কর্মৈষণা । বৃটিশ লেখক Sir Valentine Chirol এবং মহাত্মা গান্ধী তাঁকে যথাক্ৰমে “Father of Indian Unrest” এবং “Maker of Modern India” বলে যথার্থই চিহ্নিত করেছেন ।


2) শৈশব ও ছাত্রাবস্থা


ভারতের পশ্চিম উপকূলে মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে একটি ভাড়াটে বাড়ীতে ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দের ২৩শে জুলাই এক নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণপরিবারে এই অগ্নিশিশুর জন্ম । ১৭৫৭তে বাংলায় পলাশীর প্রান্তরে লর্ড ক্লাইবের জয়লাভের সঙ্গে ভারতে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হল । শতবর্ষ পরে ১৮৫৭তে সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে আবার স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হল ভারতে । শিবাজীর স্মৃতিবিজড়িত মহারাষ্ট্রের নানা সাহেব ছিলেন তার অন্যতম নায়ক । মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণেরা চিরকালই স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে জাতিকে দীক্ষিত করতে ছিলেন অগ্রণী । পৌরাণিক কাহিনী হল পরশুরাম চিতার পবিত্র ভস্মের দ্বারা যে ব্রাহ্মণদের সঞ্জীবিত করেছিলেন তাঁরাই হলেন চিৎপাবন । এমনি একজন চিৎপাবন ধর্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ ছিলেন রত্নগিরির স্কুলশিক্ষক গঙ্গাধর রামচন্দ্ৰ তিলক । তাঁর সহধর্মিণী পার্বতী বাঈও ছিলেন ধর্মপরায়ণা, শুচিব্রতা আর্যনারী । পর পর তিন কন্যার জন্মদান করে, অপুত্রক এই দম্পতী মনের দুঃখে পুত্রলাভের জন্য সূর্যদেবতার উপাসনায় ব্ৰতী হন । সূৰ্যোদয়ের ঠিক এক ঘন্টা পরে তাঁদের ঘর আলো ক’রে এই শিশুসূর্যের তিমিরবিদারী উদার আবির্ভাব । মনে হল “শূচীনাং শ্ৰীমতাং গেহে যোগভ্ৰষ্টোহভিজায়তে” । বালগঙ্গাধরের প্রপিতামহ কেশব রাও ছিলেন অসাধারণ তেজস্বী, স্বাধীনতাপ্রিয়, দৃঢ়চেতা ব্যক্তি । পেশোয়ার অধীনে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী রূপে তিনি রাজ্যশাসনে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন; “কিন্তু ১৮১৮’তে বৃটিশের হস্তে পেশোয়া পরাজিত হলে তিনি বৈদেশিকের নিকট দাসত্ব স্বীকার করবেন না বলে রাজকর্ম পরিত্যাগ করেন । তাঁর পুত্র রামচন্দ্ৰ পন্থ পরিণত জীবনে সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেন । এই পিতামহ রামচন্দ্র পন্থের নিকটেই বালগঙ্গাধরের শৈশব-শিক্ষা । সিপাহী বিদ্রোহের রোমহর্ষক ঘটনাবলী এবং প্রাচীন ভারতের পৌরাণিক কাহিনী পিতামহের কাছে শুনে শুনে শিশু বালগঙ্গাধর ধর্ম ও বীর্য ভাবনায় উদ্দীপ্ত হ’য়ে উঠতেন । আদর্শনিষ্ঠ পিতার প্রেরণায় নিয়মিত ভাবে প্রত্যহ কয়েকটি গীতার শ্লোক কন্ঠস্থ করা শুরু করে অচিরেই সমগ্র গীতা তিনি শৈশবেই হৃদ্‌গত করেন । তাঁর পিতৃদেব সংস্কৃত, গণিত এবং ব্যাকরণশাস্ত্রে সুপণ্ডিত হয়েও অত্যাচারী বৃটিশের অধীনতা গ্রহণ করবেন না বলেই মাসিক মাত্র ২৫ টাকা বেতনে সারা জীবন শিক্ষকতা করে গেছেন । মাত্র দশ বৎসর বয়সে মাতৃহারা এবং ১৫ বৎসর বয়সে তিনি পিতৃহারা হন । পিতৃবিয়োগের পূর্বে পিতৃদেবের আদেশে তিনি মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে তাপীবাঈ নাম্নী সৎকুলপ্তসুতা ধৰ্মনিষ্ঠা এক নারীরত্নকে বিবাহ করেন । বাল্যকালেই আদর্শনিষ্ঠ এই কিশোর অধ্যয়নে ছিলেন গভীর মনোযোগী । ১৮৭২’এ তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুণার বিখ্যাত ডেকান কলেজে প্রবিষ্ট হন । ১৮৭৬’এ মাত্র ৭ জন ছাত্র বোম্বে বিশ্বববিদ্যালয় হতে স্নাতক হন এবং তিলক তাঁদের অন্যতম । ১৮৮০তে তিনি আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । মনীষী Benjamin Disraeli বলেছিলেন - "The youth of a nation are the trustees of posterity” । সেদিনের তিলক প্রভৃতি তরুণের বিদেশের ভোগবিলাসের স্বেচ্ছাচারিতায় প্ৰমত্ত বা জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ক্যারিয়ার তৈরীর নেশায় মশগুল না হয়ে দেশের সমুন্নতি সাধনে আত্মনিয়োগের সংকল্প ঘোষণা করেন । দেশের সার্বিক দুর্গতির মূলীভূত কারণ উপযুক্ত শিক্ষার অভাব বলে মনে করে তিলক যৌবনের প্রারম্ভে সুহৃদ আগারকরকে বলেছিলেন - 
"We were men whose plans were at fever heat, whose thoughts were of the degraded condition of our Country, and after long thought we came to the conclusion that the salvation of our motherland lay in the education and only in the education of the people." 


3) যৌবন ও কর্মজীবন


আদর্শনিষ্ঠ শিক্ষাব্রতী বিষ্ণুশাস্ত্রী চিপলংকরের নেতৃত্বে তিলক এবং আরো কয়েকজন সহকর্মী তরুণ ১৮৮০তে একটি আদর্শ ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে মানুষ তৈরীর কাজে আত্মনিয়োগ করেন । সংস্কৃত শিক্ষার বিশেষ আবশ্যিক ব্যবস্থা ছিল ঐ ইংরেজী বিদ্যালয়ে । সর্বপ্রকার সরকারী সাহায্য প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের শ্রমে এবং আদর্শে তাঁরা এই বিদ্যালয়টিকে এমনভাবে উন্নীত করেছিলেন যে শিক্ষা কমিশনের সভাপতি Sir William Hunter ১৮৮২-এর সেপ্টেম্বরে এই বিদ্যালয় পরিদর্শন করে মন্তব্য করেছিলেন -
“Throughout the whole of India I have not yet witnessed a single institution of this nature which can be compared with this establishment. This institution, though not receiving any aid from the Government, can rival and compete with success, not only with the Govt. High Schools in this country, but may compare favourably with the Schools of other countries also.”
এই বিদ্যালয়ে বিদ্যার্থীদের জীবনে জ্বলন্ত দেশপ্রেম, প্রকৃত জ্ঞান, সুদৃঢ় চরিত্র এবং গভীর কর্মনিষ্ঠা জাগ্রত করার সাধনা তাঁরা করে চললেন ।

আবার বয়স্ক জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য মারাঠী ভাষায় “কেশরী’ এবং ইংরেজীতে “Marhatta” নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করার সংকল্প তাঁরা ১৮৮০র অক্টোবরে ঘোষণা করলেন । “কেশরী”তে ভারতের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বরাজনীতির বিশেষ সংবাদও পরিবেশনের ব্যবস্থা তাঁরা করেছিলেন । তৎকালীন অন্য পত্রিকাগুলি নিরপেক্ষভাবে সত্য সংবাদ নানা কারণে পরিবেশন করতে পারতো না বলে ১৮৮১র ৪ঠা জানুয়ারী শীর্ষে অর্থবহ সংস্কৃত শ্লোকে ভূষিত করে তিলক মারাঠী ভাষায় “কেশরী” পত্রিকা প্রথমে প্রকাশ করেন । ভারতে গণসংযোগের এবং গণচেতনা জাগরণের প্রথম মাসিক পত্রিকা রূপে “কেশরী”র উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ঘোষিত হল – 
“The mass of ignorant population who have generally no idea of what passes around them and who therefore must be given the Knowledge of such topics as concerned their everyday life by writings on literary, social, political, moral & economic subjects.”

লোকশিক্ষা ও গণজাগরণই ছিল কেশরীর লক্ষ । ইংরেজী "Marhatta’র লক্ষ্য ছিল উচ্চ শ্রেণীর জনগণকে স্বদেশী চিন্তায় প্রবুদ্ধ করা — “the more advanced portion of the Community, who require to be provided with material for thinking intelligently on the important topics of the day” । এই দুইটি পত্রিকার মাধ্যমে তিনি অগ্নিক্ষরা বাণীতে জনচিত্তকে জাগ্রত করেছিলেন । কয়েক বার রাজরোষে পড়ে তাঁকে কারাগারে যেতে হয় । ১৮৮২ এর ১৭ই জুলাই তিনি প্রথমে চারমাসের জন্য কারারুদ্ধ হন ।

১৮৮৩ তে তাঁরই নেতৃত্বে উচ্চতর এবং প্রসারিত শিক্ষার জন্য Deccan Education Society প্রতিষ্ঠিত হয় । সর্বশ্রেণীর প্রতিনিধি স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তিনি তাতে আকৃষ্ট করেন । এই সোসাইটির প্রাস্তাবিক সভায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা Sir William Wedderburn, পরবর্তী কালে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি ও সমাজসংস্কারক মহাদেবগোবিন্দ রাণাডে, বিশ্ববিখ্যাত প্রাচ্য তত্ত্ববেত্তা, সংস্কৃতজ্ঞ মনীষী ডঃ রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, এম্‌ এম্‌ কুন্তে, বিশিষ্ট ব্যারিষ্টার কে. পি. গ্যাড্‌গিল প্রমুখ মনস্বিবর্গ যোগদান করেন । তৎকালীন বোম্বে প্রদেশের গভর্ণর Sir James Fergusson ১২৫০ টাকা দান করে তার প্রথম পৃষ্ঠপোষক হন । ১৮৮৪’তে অবসরপ্রাপ্ত গভর্ণর জেনারেল Marquis of Riponও স্বেচ্ছায় এই সমিতির পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করেন । প্রস্তাবিত এই মহাবিদ্যালয়ের গৃহ নির্মাণের জন্য অক্লান্ত চেষ্টায় তিলক পঁচাত্তর হাজার টাকা স্বল্প সময়ে সংগ্রহ করেন । এইভাবে মহারাষ্ট্ৰে উচ্চশিক্ষার আদর্শ মহাবিদ্যালয় ফার্গুসন কলেজ এবং মারাঠী ভাষায় “কেশরী’ ও ইংরেজীতে “Marhatta” পত্রিকা দুইটি ঐ Deccan Education Societyর দ্বারা পরিচালিত হতে লাগ্‌লো । সংস্কৃতের অধ্যাপক বামন শিবরাম আপ্তে অধ্যক্ষ পদে বৃত হন । কেলকার ইংরেজী, আগারকর ইতিহাস এবং ন্যায়শাস্ত্র ও তিলক গণিতের অধ্যাপনায় নিরত হন । তবে তিলকই ছিলেন সোসাইটি কলেজের প্রাণপুরুষ । পরে আর একজন আদর্শ স্থানীয় পুরুষ মহামতি গোখেল এই সোসাইটির সদস্য পদ গ্রহণ করেন । কিন্তু বিধাতৃবিধানে গোখেল এবং তিলকের মধ্যে নানা বিষয়ে তীব্র মতভেদ দেখা যেতে লাগল । আপোষপন্থী গোখেল এবং চরমপন্থী জননেতা তিলকের সহাবস্থান সম্ভব হল না । নিষ্কাম কর্মযোগী তিলক ফার্গুসন কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে পত্রিকা দুইটির এবং আরো নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জাতীয় জাগরণে সর্ব শক্তি নিয়োগ করলেন । জাতীয় মুক্তি-সংগ্রামের প্রজ্ঞাবান নায়কের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য পালনে তিনি সেদিন এগিয়ে গেলেন ।

সঙ্গে সঙ্গে আইনশিক্ষার্থীদের জন্য তিনি একটি শিক্ষাসদন প্রতিষ্ঠা করে স্বয়ং তাতে Law of Evidence, Contact Law, Hindu Law এবং Law of Equity প্রভৃতি বিষয় অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে অধ্যাপনা করতে আরম্ভ করলেন । বিখ্যাত ব্যবহারজীবীরাও অনেক সময় তাঁর হিন্দু আইনের বিশ্লেষণাত্মক পাঠ শ্রবণে দলে দলে পাঠদানকালে সমবেত হতেন ।

তাঁর সাংবাদিকতা ছিল অর্থোপার্জনের বৃত্তি নয়, ছিল গণজাগরণের ব্রত তথা তপস্যা । ক্ষুরধার মেধা, বলিষ্ঠ লেখনী, দুর্লভ সত্যনিষ্ঠা,অতুলনীয় পাণ্ডিত্য, সমুন্নত চরিত্র এবং উত্তপ্ত দেশপ্রেম নিয়ে তিনি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন । তাঁর সাংবাদিকতা নিয়ে শ্রীযুক্ত D. V. Tahmankar লণ্ডন হতে প্রকাশিত তাঁর জীবনীতে লিখেছেন -
“It is not too much to say that his editorship forms a land mark in the development of true Indian nationalism… His style was always direct and his sentences short and crisp. His writings were crystal clear and went straight to the heart of his readers. They were full of quotations from the ancient Sanskrit works, popular sayings, historical parallels, apt metaphors and above all pregnant with forceful and original ideas… Kesari was produced not to entertain the people but to instruct and guide them. It was a newspaper for the people and it's purpose was to make them think and act. Tilak was an Editor-Philosopher who had a message to give to his readers and he gave it with fire and imagination. There was nothing mealy mouthed about his writing in a downright, frank and robust style week after week Tilak poured out his soul on day to day problems, economic questions, philosophical ideas, historical researches, literature and art.” 

সাংবাদিকতার মাধ্যমে মারাঠী ভাষায় তিনি যুগান্তরের সৃষ্টি করেন । যোগ্য সংবাদ পত্রের কী দূরপ্রসারী এবং বৈদ্যুতিক শক্তিসঞ্চারী প্রভাব রয়েছে তিলক তা কেশরীর মাধ্যমে প্রমাণিত করলেন । কেশরীর প্রথম পৃষ্ঠায় নিম্নোদ্ধৃত অর্থবহ সংস্কৃত শ্লোকটি প্রথম সংখ্যা হতেই মুদ্রিত থাকতো -
স্থিতিং নো রে দগ্ধাঃ ক্ষণমপি মদাংধেক্ষণসখে
গজশ্রেণীনাথ ত্বমিহ জটিলায়াং বনভুবি ৷
অসৌ কুংভিভ্রাংন্ত্যা খরনখরবিদ্রাবিতমহা
গুরুগ্রাবগ্ৰামঃ স্বপিতি গিরিগর্ভে হরিপতিঃ ॥
সাংবাদিকতার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে গভীর গবেষণারও তিনি অনন্যসাধারণ পথিকৃৎ । সফল সাংবাদিকের জীবনে একনিষ্ঠ জ্ঞানানুশীলনেরও যে একান্ত প্রয়োজন, তা তিনি নিজের জীবন দিয়ে দেখিয়ে গেছেন । বিদ্যার সামান্য মূলধন নিয়ে সমসাময়িক ঘটনার চটক্‌দারী বিশ্লেষণে তাঁর সাংবাদিকতা পর্যবসিত হয়নি । বিশ্বের ইতিহাসে এমন পণ্ডিত সাংবাদিক আর বিশেষ দেখা যায়নি । ভারতীয় শাশ্বত সংস্কৃতির ধাত্রী সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য, জ্যোতিষ শাস্ত্র, গণিত এবং ইতিহাসে তাঁর অতুলনীয় পাণ্ডিত্যের পরিচয় প্রোজ্জ্বল হয়ে আছে তাঁর লেখনী প্রসূত গ্ৰন্থরাজিতে । Orion or Researches Into the Antiquity of the Vedas এবং The Arctic Home in the Vedas নামক দুটি গ্রন্থে অত্যন্ত দুরুহ বিষয়কে মৌলিক এবং সাবলীল পদ্ধতিতে তিনি পরিবেশন করেন । খৃষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার শতাব্দীতে বেদের রচনা এবং উত্তর মেরু হতে আর্যদের আগমন তিনি ঐ গ্রন্থদ্বয়ে অকাট্য যুক্তি, জ্যোতিষিক বিচার এবং গভীর মনীষার দ্বারা প্রমাণিত করেন । তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ “গীতারহস্য” নিয়ে পরে আলোচনা করছি ।

যোগবাশিষ্ঠে আছে -
“উভাভ্যামেব পক্ষাভ্যাং যথা খে পক্ষিণাং গতিঃ ৷
তথৈব জ্ঞানকর্মাভ্যাং জায়তে পরমং পদম্‌ ॥”
দুটি ডানায় ভর করেই যেমন পাখী আকাশে উড়তে পারে তেমনি জ্ঞান এবং কর্ম দুইই সমভাবে অবলম্বন করেই মানুষকে পরম পদ পেতে হয় । তিলকের জীবনেও তাই দেখি জ্ঞান এবং কর্মের সম-সমাবেশ । ভারতে মিশনারী শক্ষাপ্রসারের মাধ্যমে খৃষ্টধর্ম প্রচার এবং পরিণামে সাংস্কৃতিক পরাধীনতার প্রতিষ্ঠা ও বৃটিশের রাজনৈতিক আধিপত্যকে চিরস্থায়ী করার অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে দূরপ্রসারী দৃষ্টি নিয়ে তিলক সর্বদাই সচেতন ছিলেন । সংস্কৃতজ্ঞা, বিধবা, খৃষ্টধর্ম অবলম্বনকারিণী, বিদূষী, পণ্ডিতা রমাবাঈ পুণাতে সারদাশ্রম নামে স্ত্রী-শিক্ষাকেন্দ্ৰ প্ৰতিষ্ঠা করে যখন সুকৌশলে তাঁর ছাত্রীদের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ধর্মান্তরিত করছিলেন, তার বিরুদ্ধে তিলক বলিষ্ঠ লেখনী ধারণ করে জনগণক সচেতন করেন । সমাজ-সংস্কার তাঁর যথেষ্টই অভিপ্রেত ছিল । কিন্তু আমাদের সামাজিক এবং ধর্মীয় সংস্কারে বিদেশী বিধর্মী শাসনের স্থুলহস্তাবলেপ তিনি একান্ত অবাঞ্ছনীয় মনে করতেন । পরে তাই সহবাস সম্মতি আইন মুক্তচেতা সংস্কারক পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও সমর্থন করেননি । বিদেশী শাসকের দ্বারা আইন প্রণয়ণের পরিবর্তে সুশিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমেই সমাজসংস্কার প্রকৃত ফলপ্রসু হবে মনে করে তিনি লিখেছিলেন -“Education and not legislation is the proper method for eradicating the evil” । তাঁর কথা ছিল – “Indian problems must be solved by Indians.” 

মদ্যপান বিরোধী এবং গোহত্যানিরোধের আন্দোলনেও তিনি ছিলেন পথিকৃৎ । পুণাতে এবং পরে সর্বভারতে “গণপতি উৎসব” এবং “শিবাজী উৎসব” প্রবর্তনের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গবদ্ধ এবং স্বরাজ্যপ্রতিষ্ঠায় বীর্যবত্তার পথে উদ্বুদ্ধ তিনি করেছিলেন । তাঁরই প্রেরণায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের “শিবাজী উৎসব” নামক বিখ্যাত কবিতা রচনা । ১৮৯৩ হতে ১৯০৫ পর্যন্ত এই উৎসব দুটির মাধ্যমে তিনি সমাজের সর্বশ্রেণীর নর-নারীকে স্বরাজসাধনায় একত্রিত করেন । তৎকালীন অন্য নেতৃবৃন্দের আবেদন ছিল শুধু সমাজের উচ্চ শ্রেণীর প্রতি । তাই তাঁরা তিলককে অনেক সময় উপহাস করে বলতেন -“A leader of oilmen and betelnutsellers.”

এই উৎসব দুটির প্রেরণা ভারতে ১৯০৫-এর সশস্ত্র বিপ্লবের ভূমিকা রচনা করেছিল । ১৮৯৬-৯৭ তে বৃটিশের নির্মম শোষণ এবং নির্দয় উপেক্ষায় দুর্ভিক্ষ ও প্লেগের মহামারীতে লক্ষ লক্ষ লোক মহারাষ্ট্রে করালগ্রাসে পতিত হয় । সরকারী অপশাসনের ফলে ১৮৭৬ হতে ১৯০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে ১৮ বার দুর্ভিক্ষে ১ কোটি ৯০ লক্ষ নর-নারী মৃত্যু বরণ করে বলে সরকারী তথ্যেই জানা যায় । কৃষকদের সংঘবদ্ধ করে সরকারী নির্মমতার বিরুদ্ধে তিনি সেদিন ঐতিহাসিক আন্দোলনের দ্বারা স্বদেশে ও বিদেশে জনমত সংগঠিত করেন । সেই সময় দুইজন বৃটিশ কর্মচারী Mr. Rand এবং Lt. Ayerst দামোদর চাপেকার নামক তরুণ বিপ্লবীর গুলিতে নিহত হন । বিচারে দামোদরের প্রাণদণ্ড হয় । সরকার এই কর্মের পশ্চাতে প্রকৃত নায়করূপে তিলককে প্রমাণিত করার বহু চেষ্টা করে মামলায় জড়িয়ে শেষে প্রমাণাভাবে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় । তিলক তাঁর “কেশরীতে” লেখনীমুখে কেশরীর ন্যায় গর্জন করেই চলেছেন । আর সেই গর্জনে সরকার ও তার সমর্থকবৃন্দের হৃদয় কম্পিত হচ্ছে । Anglo-Indian পত্রিকাগুলি তাঁর বিরুদ্ধে নিরন্তর বিষোদ্‌গার করে চলেছে । পরাধীন দেশে শাসকের অপশাসনই পরম্পরাক্রমে বিদ্রোহের মুল কারণ বলে তিনি ঘোষণা করে লিখলেন -
“Such crimes are natural consequences of the oppressive measures adopted by Govt. officials and so the ultimate responsibility for them must be placed at the door of the Government. To create or lead peaceful opposition to foreign rule and to rouse a spirit of in resistance is not sedition… The responsibility of avoiding an armed revolution is on the public leaders; so also is it on the Govt. officials, but if the latter do not do their duty and the people take to violence, it is sheer injustice to hold the leaders responsible for the violence, because they preach patriotism, devotion to religion and resistance to injustice which is not incitement...”

আর এক প্রবন্ধে শিবাজী কর্তৃক আফজল খাঁর হত্যাকে তিনি সমৰ্থন করেছিলেন । সুহৃদ্বর্গ তাঁর উদ্দীপনাময়ী বির্যময়ী লেখিনীকে সংযত করার পরামর্শ দিলে এই তেজস্বী সাংবাদিক সেদিন যা বলেছিলেন তা বিশ্বের নির্ভীক সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে চিরকালের জন্য স্মরণীয় –
“Doctors must not be afraid of any disease. If they show signs of fear the ordinary people become more frightened. How can a diver work if he is afraid of water ? The same is true of journalist, who fight for the people's rights. They must not be afraid of going to jail, but regard it as vocational risk which they must be prepared to accept without hesitation.”


4) দ্বিতীয় কারাবাস ও 'The Arctic Home in the Vedas' রচনা


১৮৯৭ এর ৮ই সেপ্টেম্বর তিলকের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগে বোম্বে হাইকোর্টে সরকার মামলা রুজু করলেন । বিচারপতি Strachey, ৬ জন ইউরোপীয় এবং ৩ জন ভারতীয় জুরী বিচারে অংশ গ্রহণ করলেন । সমগ্র ভারত তিলকের বিরদ্ধে এই মামলার সংবাদে সচকিত হয়ে উঠলো । কয়েক দিনের মধ্যেই চল্লিশ হাজার টাকা চাঁদা সংগৃহীত হল তাঁর মামলায় সহায়তার জন্য । কংগ্রেস-সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমৃতবাজার সম্পাদক মতিলাল ঘোষ এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি সমিতি গঠন করে ১৬,৭৬৮ টাকা আট আনা এবং তিন কৃতী ব্যারিষ্টারকে তিলকের মামলার জন্য বোম্বেতে প্রেরণ করেন । ভারতীয় জুরী তিনজনের আপত্তি সত্ত্বেও বিচারক তিলককে ১৮ মাসের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলেন । আসামীর কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান এই পাবকোপম নির্মলচরিত্র মনস্বীকে সরকারের C.I.D. রিপোর্টে বর্ণনা করা হয়েছে - 
“Mr. Tilak though legally convicted, has been morally acquitted and has risen ten times higher in public estimation by the bold stand he took during the trial. It was an ennobling sight, when he was standing at the Bar and reiterating his innocence in spite of the verdict of the jury. A pure conscience and a fixed resolution seemed to endow the man at the time with iron nerves and the people at once recognized in him a hero standing in defence of a national cause.’’

এই কারাদণ্ড তাঁকে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে মুকুটিহীন সম্রাট রূপে অভিষিক্ত করল । লণ্ডনে প্রিভি-কাউন্সিলে এই দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আপীল করা হল । তাতে ১৮ মাসের পরিবর্তে ১২ মাসের জন্য তাঁর কারাবাস সংক্ষিপ্ত করা হল । কারাগারে তিনি সানন্দে নারকেলের ছোবড়া বের করা প্রভৃতি শ্রমসাধ্য কাজ অন্যান্য অশিক্ষিত দণ্ডাপ্রাপ্ত অপরাধীদের সঙ্গে সমান ভাবেই করতেন । তিনি নিরামিশ ভোজী ছিলেন বলে রসুন পেঁয়াজ দিয়ে আলুর ডালনা ও রুটি তাঁকে খেতে দেওয়া হত । তিনি রসুন পোঁয়াজ খান না বলা হলেও ঐ দুটি উত্তেজক উগ্রগন্ধযুক্ত অশাস্ত্রীয় বস্তু ব্যতীত অন্য কোন ব্যঞ্জন তাঁকে দেওয়া হত না । তিনিও কোন বিশেষ ব্যবস্থার জন্য আবেদন করতেন না । ঠান্ডা জলে ডুবিয়ে শুধু রুটি লবণ দিয়ে সানন্দে গ্রহণ করে তিনি ঐ তৃতীয় শ্রেণীর কয়েদীর কাজই করে যেতেন । বর্তমানের জনগণনেতাদের খাদ্য আন্দোলনেও কারারুদ্ধ হয়ে কারাগারে মাছের টুকরোর আয়তন বড় করার আবেদন নিবেদনের কথা মনে পড়ে । তিনি যখন কারারুদ্ধ হন, তখনো তিনি গবর্ণরের আইন পরিষদের সদস্য, পুণা পৌরসভার সদস্য, বোম্বে বিশ্বববিদ্যালয়ের ফেলো ছিলেন । সম্পাদক, পণ্ডিত, জননেতা তো ছিলেনই; একমাত্র গীতার নিষ্কাম কর্মযোগ ও আত্মসমপর্ণযোগ অনুসরণের ফলেই এই মহাত্মাকে স্থিতপ্ৰজ্ঞ যোগীর মহিমায় তখনো মণ্ডিত দেখি । এই কারাবাসে শেষের দিকে রাত্রে ৩ ঘণ্টা করে তাঁকে পড়াশুনা করার অনুমতি দেওয়া হয় । তবে সাময়িক সংবাদপত্রাদি নিষিদ্ধ ছিল । এই সময়েই তিনি কারাগারে বসে “The Arctic Home in the Vedas” গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি রচনা করেন । এই গ্রন্থের ভিত্তিতে গবেষণার ফলে প্রতীচ্য পন্ডিতমণ্ডলী বেদ এবং আর্যজাতির ইতিহাস নিয়ে পূর্বকল্পিত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন । ইতঃপূর্বে তাঁর “Orion” গ্রন্থ পাশ্চাত্ত্যের বিবুধমণ্ডলীকে বি্মুগ্ধ করেছিল । তিলকের এই কারাদণ্ডের সংবাদে তাঁরা মর্মাহত হলেন । মনীষী ম্যাক্‌স্‌মূলার বৃটিশ পার্লামেণ্টের দুইজন সদস্য Sir William Hunter এবং Mr. William Cain -এর মাধ্যমে তিলকের মুক্তির জন্য বহু বিশিষ্ট ইংরেজের স্বাক্ষরিত আবেদন মহারাণীর কাছে উপস্থাপিত করেন । ফলে তাঁকে কারাগারে লেখাপড়ার নিশ্চিত সুযোগ দেওয়া হল । ৬ মাস পূর্বে ১৮৯৮-এর ৭ই সেপ্টেম্বর মুক্তিলাভ করলেন তিনি । “বিদ্বান্‌ সর্বত্র পূজ্যতে” - সদুক্তি অনেকটা সত্য হল ।

মুক্তিলাভের পর ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তিনি সহ্যাদ্রি পর্বতমালায় শিবাজীর স্মৃতিবিজড়িত সিংহগড় দুর্গে মাস দুই কাটিয়ে তারপর মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদানান্তে কলম্বো ভ্রমণে যান । সিংহলেব্রহ্মদেশে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির নানা স্মৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির নানা স্মৃতি এবং লিপি দর্শনে তিনি আনন্দিত হন । জুলাই হতে তিনি আবার পত্রিকা দুটির দায়িত্ব গ্রহণ করে রাজনৈতিক ও  সামাজিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । “শিবাজী উৎসব” ও “গণপতি উৎসব” পুনঃসঞ্জীবিত হল । ১৯০৩-এ একজন মৃত বন্ধুর সম্পত্তির উত্তরাধিকার বিষয়ক "তাই মহারাজ” মামলায় আবার জড়িয়ে তাঁকে ১ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ও ৬ মাসের কারাদণ্ডে বৃটিশ সরকার দণ্ডিত করে । কারাগার থেকেই তিনি লণ্ডনে প্রিভি-কাউন্সিলে আপীল করলে ইচ্ছা করে নানা ছলে দীর্ঘসূত্রিতার দ্বারা সরকার মামলার বিচারে বিলম্ব করে । ১৯১৫ তে প্রিভি-কাউন্সিলের বিচারে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন ।


5) তিলকের চরমপন্থা


১৯০৫ হতে ১৯০৮ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মধ্যাহ্ন । ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনকে অবলম্বন করে আসমুদ্র হিমাচল যে অত্যদ্‌ভূত গণজাগরণ দেখা দিয়েছিল, তার নেতৃত্বে এগিয়ে এলেন এই বলিষ্ঠ মহারাষ্ট্ৰ-ব্রাহ্মণ । স্বদেশী, বয়কট, জাতীয় শিক্ষা এবং স্বরাজ্য এই চারটি স্তম্ভের উপর তিনি জাতীয় আন্দোলনের সৌধকে প্রতিষ্ঠিত করলেন । তাঁর “National Boycott” প্রবন্ধ কলকাতা, পাটনা, বারাণসী, এলাহাবাদ এবং মাদ্রাজে বিভিন্ন পত্রে পুনঃ পুনঃ মুদ্রিত হয়ে জাতীয় আন্দোলনের মুক্তিবাণী রূপে সর্বত্র প্রচারিত হ’ল । শ্ৰীঅরবিন্দ, লালা লাজপত রায় এবং বিপিন চন্দ্র পাল এই আন্দোলনে তিলকের পতাকাতলে সমবেত হলেন । ১৯০৫-এ গোপাল কৃষ্ণ গোখেলের সভাপতিত্ত্বে অনুষ্ঠিত বারাণসী কংগ্রেসে তিলক আবেদন নিবেদনের পক্ষ পরিহার করে চরম সংগ্রামের পথে কংগ্রেসকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন । লাল-বাল-পালের  ত্রেতাগ্নিতে দেশে জাতীয় মুক্তি যজ্ঞ প্রজ্জ্বলিত হল । তিলকের সেদিন অগ্নিগর্ভ ঘোষণা – “Militancy - not mendicancy ।” মুক্তিসংগ্রামে “Passive resistance” বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের পন্থাকেই সেদিন তিনি গণ-আন্দোলনের পন্থারূপে ঘোষণা করলেন । পরবর্তী কালে এই নীতিকেই গান্ধীজী অহিংস অসহযোগ এবং আইন অমান্য আন্দোলনের ভিন্ন নামে অনুসরণ করেন । ১৮৭৫-এ তিলক খাদি, চরকা এবং স্বদেশী শিল্প গ্রহণ ও বিলাতী বর্জনের প্রয়োজনীয়তা বিশ্লেষণ করে বলেন – “Swadeshi is the only means for the salvation in India”.

তিলকের চরমপন্থা কংগ্রেসের নরমপন্থীদের বিভীষিকা উৎপাদন করতে লাগ্‌লো । তারই চরম পরিণতি ১৯০৭-এর ২৭শে ডিসেম্বরে সুরাট কংগ্রেসে তিলক তাঁর অগ্নিগৰ্ভ প্রস্তাব উপস্থাপিত করতে গেলে সভাপতি ডঃ রাসবিহারী ঘোষ আপত্তি জানান । এমন সময়ে চরম এবং নরম উভয় দলের স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দের দ্বারা সংঘটিত দক্ষযজ্ঞে অধিবেশন পণ্ড হ’য়ে গেল । সমচিত্ত সুহৃদ শ্ৰীঅরবিন্দ তিলকের পার্শ্বে উপবিষ্ট । কংগ্রেসের নরমপন্থীরা সংস্কারে এবং চরমপন্থীরা ছিলেন বিপ্লবে বিশ্বাসী । তিলক ছিলেন তাঁদের নায়ক । জবাহরলাল নেহেরু, “The Discovery of India”-তে লিখেছেন –
“The powerful agitation against the partition of Bengal had thrown up many able and aggressive leaders of this type in Bengal, but the real symbol of the new age was Bal Gangadhar Tilak from Maharashtra.”

সুরাট হ'তে ফিরে বোম্বেতে তিনি চরমপন্থী মতবাদ প্রচারের জন্য National Publishing Company প্রতিষ্ঠা করে “রাষ্ট্রমাতা” নামে আর একটি পত্রিকা প্রকাশের আয়োজন করলেন । পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে তিনি কারারুদ্ধ হলেন । ইতোমধ্যে ৩০’শে এপ্রিল ক্ষুদিরাম এবং প্রফুল্ল চাকী মজঃফরপুরে বোমা নিক্ষেপ করেন । তারই প্রতিক্রিয়ায় সরকারের এই ব্যবস্থা । তখন তিনি ‘সমর্থ বিদ্যালয়’ নামে আর একটি আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সেটি সরকার বন্ধ করে দিলো । সুরাপানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের জন্য তিনি এমনই স্বয়ংসেবকদের তৈরী করেছিলেন যে তাতে পুলিশ রিপোর্টে বলা হচ্ছে - ‘The British Raj has ceased to operate in Poona. The man whose authority rules the District is Mr. Tilak”. সরকারী বিস্ফোরক আইনের বিরুদ্ধে “কেশরীতে” ধারাবাহিক প্রবন্ধের জন্য ।


6) তৃতীয় কারাবাস ও গীতারহস্য রচনা


১৯০৮-এর ২৪’শে জুন তিলককে আবার কারারুদ্ধ করা হয় । সরকারের ধারণা হল দেশব্যাপী বিপ্লব আন্দোলনের মস্তিস্ক হচ্ছেন তিনি । এইবার মামলায় তিলকের পক্ষে ব্যবহারজীবীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না । ৬ বৎসরের জন্য নির্বাসনে যখন দণ্ডিত হলেন তখন শান্ত চিত্তে তিলক বিচারালয়ে বলে গেলেন - 
“All I wish to say is that in spite of the verdict of the jury I maintain that I am innocent. There are higher powers that rule the destiny of things and it may be the will of providence that the cause which i represent is proper more by my suffering than by my remaining free.”

এই তো গীতা শিক্ষার ফল । দেশের নানা প্রান্তে এর প্রতিবাদে সভা, বিক্ষোভ এবং ধর্মঘট হল । রাশিয়ার জননেতা লেনিন এই ঘটনাকে উল্লেখ করে “Inflammable Material in World Politics” গ্রন্থে লিখেছেন -
“The despicable sentence passed on the Indian Democrat Tilak, gave rise to street demonstrations and a strike in Bombay. The class conscious workers in Europe now have Asian comrades and their number will grow by leaps and bounds.”

২৩’শে জুলাই তাঁর ত্রিপঞ্চাশত্তম জন্মদিনে সাবরমতী জেলে তিনি নীত হলেন । স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বোম্বের শ্রমিকরা প্রতি বৎসরের জন্য একদিন করে ছয়দিন ধর্মঘট পালন করলেন । সমস্ত জনজীবন স্তব্ধ, হাট বাজার বন্ধ । দেশে এবং বিদেশে পত্র-পত্রিকায় এই নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদ ছাপা হতে লাগল । ১৯০৮’এর ১৩ই সেপ্টেম্বর তাঁকে সাবরমতী জেল থেকে মান্দালয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করানো হল । মান্দালয় জেল ছিল স্যাৎসেতে, অত্যন্ত অঙ্কবাস্থ্যকর এবং গুমোট । শীত এবং গ্রীষ্মের দুঃসহ তীব্রতায় অসহ্য কষ্ট ঐ কারাগারের খাঁচার মতো কাঠের তৈরী ঘরে সহ্য করতে হয় । গ্রীষ্মে ধূলির ঝড়ে বিপর্যস্ত হতে হয় । এই কারাগারে বসেই তিনি গীতার যুগান্তকারী ভাষ্য “গীতারহস্য” রচনায় নিমগ্ন হলেন । প্রথমে কোন বই বা কাগজ তাঁকে দেওয়া হত না । পরে অনেক বলা কওয়ার পর তাঁকে প্রাচীন পুস্তকাবলী দেওয়া হতে লাগ্‌লো । বিচ্ছিন্ন কাগজ এবং কালি ও কলম তাঁকে দেওয়া হত না । বাঁধানো খাতার প্রতি পৃষ্ঠা চিহ্নিত করে এবং একটি পেন্‌সিল তাঁকে লেখার সরঞ্জাম রূপে দেওয়া হত । মান্দালয়ে আসার পূর্বেই তিনি গীতা নিয়ে কিছু রচনা করেছিলেন । কিন্তু সরকার তা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আসতে দেয়নি । শৈশব থেকেই গীতা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে । বাল্যকালে পিতৃনির্দেশে গীতা কণ্ঠস্থ করার তাঁর প্রয়াসের কথা পূর্বেই উল্লেখ করেছি । মান্দালয়ে এসে তাঁরই ভাষায় তাঁর অবস্থা -
“I do not know what would have happened to me if I had not been allowed to have books,… Even before I was imprisoned, a conviction was growing on me that the meaning of the Gita, adumbrated by all the many commentaries and expositions, was not the correct one. I had long wanted to give a concrete shape to my ideas on the meaning of the Gita, together with a comparative study of the Eastern and western philosophies. I could do that only at Mandalay. I have now written a book on this subject in Marathi. It took me four to six months to write but much time was spent in thinking out, its plan and then again in reviving it. The manuscript is with the Government - they did not give it to me at the time of any release.”

অতি প্রত্যুষে শয্যাত্যাগ করে প্রাতঃকৃত্যের পর ১ ১/২ ঘন্টা তিনি নিমীলিত নয়নে ধ্যানাবিষ্ট থাকতেন । তারপর সংস্কৃত স্তবস্তুতি পাঠান্তে গীতার রহস্য উন্মোচনে নিরত হতেন । তাঁর ব্রাহ্মণ পাচককেও এই ভাবে অনুষ্ঠানে অভ্যস্ত করিয়েছিলেন । বিকেলে জার্মাণ, ফরাসী এবং পালি ভাষা অধ্যয়নে নিরত হতেন । ১৯১১-এর ২রা মার্চ “গীতারহস্য” রচনা সমাপ্ত করে তিনি লিখছেন -
“I have just finished writing my book on the Gita and I have given it the title ‘Gita-Rahasya’. In it I have expounded some original ideas, which, a many ways, will be presented to people for the first time. I have shown in this book how the Hindu religious philosophy helps to solve the moral issues (involved in everyday life.) To a certain extent my line of argument runs parallel to the line of thinking followed by Green in his book on Ethics. However, I do not accept the basis of morality is the greatest good of the greatest number on the human inspiration. What I have done in Gita-Rahasya is to prove, by comparing the philosophy of Gita and the philosophy of the West, that to put it at the lowest, is in no way inferior to theirs. I had been thinking about the Gita for the last twenty years, and the ideas which I propose to expound are challenging - So far no one has dared to put them forward. I have yet to cite quite a few supporting arguments from books which are not with me at present, which I can do only after my release.”

যখন এই মহা গ্রন্থ তিনি কারাগারে বসে রচনা করছেন, তখন সংবাদ পেলেন তাঁর সহধর্মিণী  পরলোকে প্রয়াণ করেছেন । তখন ভ্রাতুষ্পুত্রকে লেখা তাঁর মর্মস্পর্শী পত্রে তাঁর গীতালব্ধ জ্ঞানই পরিস্ফুট হয়েছে । গীতার প্রবক্তা ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণচন্দ্রের আবির্ভাব অত্যাচারী কংসের কারাগারে । যুগান্তরে অত্যাচারী বৃটিশের কারাগারে তার অভিনব রহস্য উন্মোচিত হ’ল তিলকের ন্যায় মনস্বীর নিকটে । পরবর্তী কালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র এই মান্দালয় কারাগারেই অবস্থান কালে এই কারাবাসকে তীর্থবাস রূপে বৰ্ণনা করে পত্র লিখেছেন তাঁর মাতৃদেবীকে । কারণ, তিলক মহারাজের গীতাভাষ্য রচনায় এই কারাগার আজ তীৰ্থভূমি হয়ে গেছে । কারামুক্ত হয়ে ১৯১৪-এর ১৭ই জুন তিনি পুণাতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন । সমগ্র দেশে আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল । ৫২ বৎসর বয়সে মান্দালয়ে তিনি নীত হন । ৫৮ বৎসর বয়সে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন । ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশে ঐ বয়সে কারাগারে বসে তিনি রচনা করলেন এই মহাগ্রন্থ ।


7) হোমরুল আন্দোলন ও মানহানি মামলা


কারামুক্ত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেই পুনরায় তিনি কর্মান্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন । কংগ্রেসের সংগঠন, প্রসার এবং চরম ও নরমপন্থীদের একত্রিত করার প্রয়াসে তিনি আত্মনিয়োগ করলেন । হোমরুল আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন – “Home Rule is my birth right and I will have it.” বস্তুতঃ তাঁরই অসাধারণ বাগ্মিতায় হোমরুল আন্দোলনের প্রসার । ১৯৯৬-তে তাঁর একষট্টিতম জন্মদিনে তাঁরই অজ্ঞাতে দেশবাসী তাঁর জন্মোৎসবের আয়োজন করে যজ্ঞ, দরিদ্রনারায়ণভোজনাদি সম্পন্ন করে তাঁর হাতে এক লক্ষ টাকার তোড়া শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে । অভিভূত হয়ে তিনি তাঁর নিজস্ব কিছু অর্থ ঐ অর্থসমষ্টির সঙ্গে যুক্ত করে সমুদয় হোমরুল আন্দোলনের অর্থ ভাণ্ডারে দান করেন । ঠিক সেই দিনই বৃটিশ সরকার তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক কার্যাবলীর জন্য চল্লিশ হাজার টাকা জামানত জমা দেবার জন্য আদেশ দেন । হাইকোর্টে মামলা করে তিনি মুক্তিলাভ করেন । তারপর লক্ষ্মৌ কংগ্রেসে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের জন্য তাঁর ঐতিহাসিক প্রস্তাব ও ভাষণ সকলকে মন্ত্রমুগ্ধ করে । ১৯৯৭-তে সারা ভারতে হোমরুল লীগের জন্য তিনি বিদ্যুদ্‌গতিতে ঘুরে বেড়ান । তারপর মণ্টেগুর ঘোষণান্তে নূতনভাবে জাতীয় আন্দোলনের ধারা তিনি শুরু করেন । কার্যতঃ লণ্ডনে হোমরুল আন্দোলনের প্রসারের জন্য প্রকাশ্যে সিরোল মানহানি মামলার জন্য ১৯১৮-এর ৩০শে অক্টোবর তিনি লণ্ডনে উপস্থিত হন । Sir Valentine Chirol নামক জনৈক ইংরেজ “Indian Unrest” নামক পুস্তকে তিলকের বিরুদ্ধে বহু মিথ্যা কুৎসা রটনা করেন ।
“Tilak's onslaught in Poona upon Ranade, his alliance with the bigots of orthodoxy, his appeals to popular superstition in the new Ganapati celebrations, to racial fanaticism in the ‘Anti-Cow-Killing movement’, to Mahratta sentiment in the cult which he introduced of Shivaji, his active propaganda amongst schoolboys and students, his gymnastic societies, his preaching in favour of physical training, and last but not least his control of the Press, and the note of personal violence which he imparted to newspaper polemics, represent the progressive stages af a highly-organised campaign which has served as a model to the apostles of unrest all over India ". This was a valuable piece of advice, for, if any one can claim to be truly the father of Indian unrest, it is Bal Gangadhar Tilak. – [“Indian Unrest” by Sir Valentine Chirol]

“কেশরীর” কেশরি-সদৃশ সম্পাদক মানহানি মামলা এনে তার বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন । বৃটিশের মূল ভুখণ্ডে তিলকের জীবনের নিরাপত্তা, সম্বন্ধে তাঁর প্রিয় সহৃদ্‌ মাধব দাস শ্ৰীহরি আগে দুশ্চিন্তিত হলে অকুতোভয় তিলক উত্তরে বললেন – “Don’t worry about me. I have no fear of death, I carry the destiny of my country in my hands and I have full faith in the future”. সরকারী কূটনীতি তাঁকে যতই বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করেছে, তিনিও ততই মাতৃভূমির মুক্তি সাধনের জন্য উদগ্র হয়ে উঠেছেন ।

Gottfried von Strassburg -এর কথাগুলি তাঁর সম্বন্ধে যথার্থই প্রযুক্ত হতে পারে – “The honest man must endure hatred and envy. It adds to a man's worth when hatred pursues him.” অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামে তিনি সর্বদাই অনুসরণ করেছেন তাঁরই প্রিয় বন্ধু কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মহতী বাণী – 
“ক্ষমা যথা ক্ষীণ দুর্বলতা, হে রুদ্র,
নিষ্ঠু্র যেন হতে পারি তথা তোমার আদেশে ।
যেন রসনায় মম সত্য বাক্য ঝলি,
উঠ্‌ খরখড়্গসম তোমার ইংগিতে ।
যেন রাখি তব মান,
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজস্থান ।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে,
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে ।”
মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণেরাই বৃটিশবিরোধী বিপ্লবী । তিলকও চিৎপাবন ব্রাহ্মণ । তাই, তিনিই ভারতে রাজদ্রোহের মুখ্য মস্তিষ্ক বলে নানা কল্পিত অভিযোগে তিলককে সিরোল অভিযুক্ত করেন । তিলক সিরোলের বিরদ্ধে লণ্ডনে মানহানির মামলা আনলেন । যথাযথভাবে বৃটিশ সরকার সিরোলকে অভিযোগ হতে মুক্তি দিলেন । দেশে বিদেশে সকলেই ভেবেছিলেন যে তিলক এই আঘাতে ভেঙে পড়বেন । কিন্তু, তিনি নবোদ্যমে লণ্ডনে হোমরুল আন্দোলনের প্রচার এবং বেদবিষয়ক গবেষণায় আত্মনিয়োগ করলেন । তিনি তখন বৃটিশ মিউজিয়াম, ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী, রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি অক্সফোর্ড ও কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপি এবং গ্রন্থাদি নিয়ে গবেষণা, বিদ্বন্‌মণ্ডলীর সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান এবং স্বগৃহে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির উপর নিয়মিত পাঠদান করছেন । পার্লামেন্টের শ্রমিকদলের সদস্যদের দিয়ে হোমরূলের সপক্ষে জনমত তৈরীর জন্যও অক্লান্ত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন ।


8) জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড


এই সময়েই ১৯১৯-এর এপ্রিলে ভারতে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় । এই মর্মান্তিক এবং আসুরিক আচরণের সংবাদ লণ্ডনে সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে তিনি বহু সভাসমিতির মাধ্যমে তত্রস্থ জনগণকে এই বিষয়ে জাগ্রত করেন । দেশের এই দুর্দশায় তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠল । দেশবাসীর সঙ্গে দুঃখের ভাগ গ্রহণ করার জন্য তিনি ১৯১৯-এর ২৭’শে নভেম্বর দেশে প্রত্যাবর্তন করলেন । তাঁর লণ্ডনে বৎসরাধিককাল বাসের সময়ে শ্রমিকদলকে তিনি এমন ভাবে অনুকুল করেছিলেন, যে তারই ফলে ১৯৪৭-এ ইংলণ্ডের শ্রমিক সরকারই মিঃ এ্যাটলীর নেতৃত্বে ভারতকে পূর্ণ স্বাধীনতা দান করেন ।


9) অস্তাচল


দেশে প্রত্যাবর্তনের পর খিলাফত আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধীর অদূরদর্শিতা এবং বৃটিশ সরকারকে বিশ্বাস করার ভুল সম্বন্ধে তিনি সকলকে অবহিত করেন । অমৃতসর কংগ্রেসেই তাঁর শেষ বারের মতো যোগদান । এরই মধ্যে তিনি সাঙ্গ্‌লিতে জ্যোতির্বিদ সম্মেলনে যোগ দিয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গণনার সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় গণনার সামঞ্জস্য স্থাপন করে পঞ্জিকা সংস্কারে ব্রতী হন । তারপরই তিনি ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েই সিন্ধুপ্রদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভাষণ পরিক্রমায় নিরত হয়ে এক একটি সভায় বজ্রকণ্ঠে সিংহের ন্যায় গর্জন করে একসঙ্গে অন্যুন দশ হাজার শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতেন । বিখ্যাত সিন্ধী নেতা ডঃ ছোটীরাম গিদোয়ানী তাঁর ভাষণের প্রভাব নিয়ে বলেছেন – 
“Lokamanya Tilak brought new life and dignity to our politically backward people. Now they will proudly march side by side with this fellow Indians, with their heads erect and their faces unabashed.”

অতিরিক্ত শ্রমে জুলাই মাসে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন । অসহযোগ আন্দোলন এবং ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার জন্য ২১’শে জুলাই তিনি জ্বর নিয়েই দেওয়ান চমনলালের সঙ্গে গাড়ীতে করে বের হন । ২২’শে জুলাই তাঁর জ্বর অত্যন্ত বেড়ে গেল । শুক্রবার ২৩’শে জুলাই তাঁর পঞ্চষষ্টিতম জন্মদিনে তিনি অস্বাভাবিকভাবে ভালো হয়ে উঠে দর্শনার্থীদের সঙ্গে হাস্য পরিহাসে সময় কাটালেন । এ যেন নির্বাণের পূর্বে প্রদীপের শেষ ঔজ্জ্বল্য । ২৬’শে জুলাই হতে তিনি গুরুতর ভাবে পীড়িত হলেন । ফুস্‌ফুস্‌ আক্রান্ত হল । মহাত্মা গান্ধী, মোহম্মদ আলি জিন্না প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ও অগণিত মানুষ তাঁর অবস্থা জানিবার জন্য উৎকণ্ঠিত প্রতীক্ষায় তাঁর আবাসস্থলে সমবেত হয়েছেন । ১৯২০-এর ১’লা আগস্ট, রবিবার, মধ্যরাত্রে ১২’টা ৪০ মিনিটে এই অক্লান্ত সংগ্রামী কর্মবীরের আত্মা নশ্বর দেহ ত্যাগ করে অমৃতলোকে প্রয়াণ করলেন । মহাত্মা গান্ধী, ডঃ মৌলানা শওকত আলি, কেল্‌কার এবং লালা লাজপত রায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দ তাঁর শবদেহ বহন করে আরব সাগরের তীরে শ্মশানে নিয়ে গেলেন । মিল শ্রমিক, ডক শ্রমিক হতে আরম্ভ করে হিন্দু, মুসলমান, পার্শী, খৃষ্টান, ব্রাহ্মণ, শূদ্র লক্ষ লক্ষ আপামর জনসাধারণ তাঁর শবানুগমন করে । চন্দন কাষ্ঠের চিতায় বিশুদ্ধ হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁর মরদেহ ভস্মীভূত হল । নির্বাপিত হল স্বাধীনতা সংগ্রামের পূত যজ্ঞাগ্নি, অবসিত হল ইতিহাসের একটি গৌরবময় যুগ । চলে গেলেন বিপ্লবের বহ্নিশিক্ষা-বহনকারী স্বনামধন্য অগ্নিহোত্রী নায়ক । তিলকের পরলোক-প্রয়াণে শাশ্বত ভারতের বাণী যেন স্তব্ধ হয়ে গেল ।


10) জীবনাদর্শ ও মূল্যায়ন


কায় মনো-বাক্যে ঐক্য রক্ষা করে চিন্তা ও চর্চায়, সংকল্পে ও সাধনায় তিনি যে জীবনাদর্শ রেখে গেছেন, তা ভাবী কালে মানুষকে মহত্তর জীবনের পথে পরিচালিত করবে । সমসাময়িক কালে তাঁকে অনেকে অবতার পুরুষ বলে মনে করতেন । পরবর্তীকালের রাজনৈতিক সাফল্যের মূলে ছিল তাঁর স্বপ্ন ও সাধনা । ঋষি অরবিন্দের ভাষায় – “A great worker and creator is not to be judged only by the work he himself did, but also by the greater work he made possible.”

জীবনের প্রথম থেকেই রাজনীতিকে ধর্মের নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন । পরবর্তী কালে বৈদেশিক ভোগবাদী দর্শনের আনুগত্যে ‘পাওয়া এবং পাইয়ে দেবার’ রাজনীতিকে অনুসরণ করার ফলেই নেতৃবন্দের অধঃপতন ও দেশের দুর্গতি । ব্যক্তিচরিত্রের বিশুদ্ধি, স্বদেশের অতীত সম্বন্ধে গৌরববোধ, স্বদেশীয় রীতি-নীতির সশ্রদ্ধ অনুসরণ নেতৃবৃন্দের জীবনে একান্ত অপেক্ষিত বলে তিনি মনে করতেন । তাঁর প্রত্যয় সম্বন্ধে শ্ৰী ডি-সি-তামানকারের বিশ্লেষ উল্লেখনীয় - 
“'Very early in his public career Tilak discovered the need for bringing a spiritual element to the politics of the country by infusing into them a religious fervour. He had seen how the Congress leaders of his time had failed to create a missionary enthusiasm for the national cause because of their spiritual surrender to an alien power and their ignorance of the true source of popular inspiration. He realised that no nation can hope to build a great and powerful movement without giving it a secure foundation in the spiritual life of the people. He achieved this vital taste through the festivals of Ganapati and Shivaji which helped India to shake off her inferiority-complex and re-assert her personality. He knew that once the spiritual and religious springs of India's great past were revitalized, the greatness and glory of her future were assured. To him India seemed to have a character, a tradition, a personality - as distinct as the characteristics and qualities of individual men and Women what mattered to him was the preservation of those ways of living which are peculiar to India through which alone, he said, she could rediscover her soul, her strength and attain her emancipation.”

মনিষী রাষ্ট্রপতি আচার্য রাধাকৃষ্ণন্‌ তিলকের চরিত্র বিশ্লেষণে বলেছেন – “The field of politics to which Mr. Tilak devoted the best years of his life was not the one for which he was made. He was by nature a scholar and only by necessity a politician.” জীবনে প্রথম তাঁর “A missing Verse in the Samkhyakarika” যেমন দার্শনিক জগৎকে বিমুগ্ধ করেছিল, তেমনি পরবর্তী কালে Orion, The Arctic Home in the Vedas এবং সর্বশেষে গীতারহস্য তাঁকে সারস্বত জগতে অমর করে রেখেছে । গীতা ছিল তাঁর জীবনবেদ ।

আধুনিক এবং বিশ্বের বিভিন্ন দর্শনের নিরিখে গীতার বিচার করে লোক-সংগ্রহার্থে নিষ্কাম কর্মযোগ, শ্রীভগবানে আত্মসমর্পণ এবং স্থিতপ্রজ্ঞতার মাধ্যমে জীবন-সাধনাই জগতের সকল সমস্যার সমাধানে সর্বোত্তম পন্থারূপে তিনি ঘোষণা করেন । জগতের বহু মানুষেকে তাঁর এই কর্মমুখীন গীতা,ব্যখ্যা অনুপ্রাণিত করেছে । সূত্রাকারে গীতার মূল বক্তব্য নিয়ে তিনি বল্‌ছেন - 
“The Gita asks as to work in imitation of the Lord for the purpose of Loka-samgraha or the greatest good of the greatest number - the unification of humanity in universal sympathy. The Gita is designed to provide a solution to all human problems. It reconciles and harmonizes spiritual freedom with work in the world.” 

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by scanning, then by running Google OCR and lastly by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Contents>

No comments:

Post a Comment