Sunday, June 4, 2017

গীতার বহিরঙ্গপরীক্ষা (External examination of Gita)

গীতার বহিরঙ্গপরীক্ষা


অবিদিত্বা ঋষিং ছন্দো দৈবতং যোগমেব চ
যোহধ্যাপয়োজ্জপেদ্বাহপি পাপীয়ান্‌ জায়তে তু সঃ ॥ - [স্মৃতি]

(“কোন মন্ত্রের ঋষি, ছন্দ, দৈবত ও বিনিয়োগ না জানিয়া (উক্ত মন্ত্র) যে শিক্ষা দেয় কিংবা তাহার জপ করে সে পাপী হয় ।” ইহা কোন এক স্মৃতিগ্রন্থের বচন, কিন্তু কোন গ্রন্থের তাহা জানি না । হাঁ, তাহার মূল আর্ষেয়ব্রাহ্মণ [আর্ষেয় |১] শ্রুতিগ্রন্থে আছে; তাহা এই – “যো হ বা অবিদিতার্যেয়চ্ছন্দোদৈবতব্রাহ্মণেন মন্ত্রেণ যাজয়তি বাহধ্যাপয়তি বা স্থাণুং বর্চ্ছতি গৰ্ত্তং বা প্ৰতিপদ্যতে ॥” কোন মন্ত্রের ঋষি, ছন্দ প্রভৃতি বহিরঙ্গ; উহা না জানিয়া মন্ত্র বলিবেক না । এই নীতিই গীতার ন্যায় গ্রন্থ সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা যায় ।)

পূর্ব পূর্ব প্ৰকারণে ইহা সবিস্তার বলিয়াছি যে, যখন ভারতীয় যুদ্ধে কুলক্ষয় ও জ্ঞাতিক্ষয়ের প্রত্যক্ষ স্বরূপ সর্বপ্রথম নেত্ৰসমক্ষে আসিল, তখন অর্জুন স্বকীয় ক্ষাত্ৰধর্ম ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসগ্রহণে উদ্যত হইলেন এবং সেই সময়ে তাঁহাকে ঠিক পথে ফিরাইয়া আনিবার জন্য বেদান্তশাস্ত্রের ভিত্তির উপর শ্ৰীকৃষ্ণ প্ৰতিপাদন করিলেন যে, কর্মযোগই অধিক শ্ৰেয়স্কর, কর্মযোগে বুদ্ধিরই প্ৰাধান্য, এইজন্য ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান কিংবা পরমেশ্বরভক্তির দ্বারা নিজের বুদ্ধিকে সাম্যাবস্থায় রাখিয়া সেই বুদ্ধি দ্বারা স্বধর্মানুসারে সকল কর্ম করিতে থাকিলেই মোক্ষলাভ হয়, ইহা ব্যতীত মোক্ষলাভের জন্য আর কিছুরই আবশ্যকতা নাই; এবং এইরূপ উপদেশ করিয়া শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করিতে প্ৰবৃত্ত করিলেন । গীতার ইহাই প্ৰকৃত তাৎপৰ্য । গীতাগ্রন্থ কেবল বেদান্তবিষয়ক ও নিবৃত্তিমূলক, এইরূপ ভ্ৰান্ত সংস্কারের দরুণ “মহাভারতের ভিতর গীতাকে সন্নিবিষ্ট করিবার কোন প্রয়োজন নাই” ইত্যাদি যে সন্দেহ উৎপন্ন হইয়াছে তাহাও এক্ষণে সহজে নিরাকৃত হয় । কারণ কর্ণপর্বে সত্যানুত্যের আলোচনা করিয়া শ্ৰীকৃষ্ণ যেরূপ অর্জুনকে যুধিষ্ঠির-বধ হইতে নিবৃত্ত করিয়াছিলেন, সেইরূপ যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্য গীতার উপদেশও আবশ্যক হইয়াছিল । এবং কাব্যদৃষ্টিতে দেখিলেও, ইহাই সিদ্ধ হয় যে, মহাভারতে অনেক স্থলে এই প্ৰকারই অন্য যে সকল প্ৰসঙ্গ আসিয়াছে সেই সমস্তের মূলতত্ত্ব কোথাও-না-কোথাও বলা আবশ্যক ছিল, তাই উহা ভগবদ্‌গীতাতে বলিয়া ব্যবহারিক ধর্মাধর্মের কিংবা কার্যাকাৰ্যব্যবস্থিতির নিরূপণের পুর্ণতা গীতাতেই করা হইয়াছে । বনপর্বের ব্ৰাহ্মণব্যাধ-সংবাদে ব্যাধ বেদান্তের ভিত্তিতে “আমি মাংসবিক্রয়ের ব্যবসায় কেন করিতেছি ।” তাহার বিচার করিয়াছে; এবং শান্তিপর্বের তুলাধার-জাজলি-সংবাদেও ঐ প্রকারেই তুলাধার স্বকীয় বাণিজ্যব্যবসায়ের সমর্থন করিয়াছে [বন |২০৬-২১৫ ও শাং |২৬০-২৬৩] । কিন্তু এই উপপত্তি সেই সেই বিশিষ্ট ব্যবসায়েরই করা হইয়াছিল । এই প্ৰকার অহিংসা, সত্য প্ৰভৃতি বিষয়ের আলোচনা মহাভারতে কয়েকস্থানে আসিলেও তাহাও একদেশদর্শী অর্থাৎ সেই সেই বিশিষ্ট বিষয়ের জন্যই হইয়াছিল, তাই উহাকে মহাভারতের প্রধান ভাগ ধরা যাইতে পারে না । এইরূপ একদেশদর্শী আলোচনা দ্বারা ইহাও নির্ণয় করা যায় না যে, যে শ্ৰীকৃষ্ণের এবং পাণ্ডবদিগের মহৎ কাৰ্যসমূহের বর্ণনা করিবার জন্য ব্যাস মহাভারত লিখিয়াছিলেন, সেই মহাত্মা ব্যক্তিদের চরিত্রকে আদর্শ ধরিয়া মনুষ্য সেই প্ৰকার আচরণ করিবে কি না । সংসার অসার এবং কোন-এক সময়ে সন্ন্যাসগ্রহণই শ্রেষ্ঠ যদি ধরা হয় তবে স্বভাবত এই প্রশ্ন আসে যে, শ্ৰীকৃষ্ণ এবং পাণ্ডবদিগের এত ঝঞ্ঝাটে পড়িবার কারণ কি ছিল ? এবং যদি তাহাদের প্রযত্নের কোন কারণ স্বীকারও করা যায়, তবে লোকসংগ্ৰহাৰ্থ তাহাদের গৌরবকীর্তন করিয়া ব্যাসের তিন বৎসরকাল সমান পরিশ্রম করিয়া [মভা |আ|৬২|৫২] এক লাখ শ্লোকের বৃহৎ গ্ৰন্থ লিখিবার প্রয়োজনই বা কি ছিল ? বৰ্ণাশ্ৰমকর্ম চিত্তশুদ্ধির জন্য করা হয়, কেবল এইটুকু বলিলেই এই প্রশ্নের ঠিক মীমাংসা হয় না; কারণ, যাহাই বল না কেন, স্বধর্মাচরণ কিংবা জগতের অন্য সমস্ত ব্যবহার তো সন্ন্যাসদৃষ্টিতে গৌণ বলিয়াই মানা হয় । এই জন্য মহাভারতে যে মহাপুরুষদিগের চরিত্র বর্ণিত হইয়াছে, সেই মহাপুরুষদিগের আচরণের উপর “মূলে কুঠার” নীতি-অনুযায়ী আপত্তির নিরসন করিয়া উক্ত গ্রন্থে কোন-না-কোন স্থানে সবিস্তার ইহা বলা আবশ্যক ছিল যে, সংসারের সমস্ত কাজ করিতে হইবে কি না; এবং করিতে হইবে বলিলেও প্ৰত্যেক মনুষ্য কিরূপে সংসারে নিজ নিজ কর্ম চালাইলে সেই সব কর্ম মোক্ষলাভের অন্তরায় হইবে না। নলোপাখ্যান, রামোপাখ্যান প্ৰভৃতি যে সব উপাখ্যান মহাভারতে আছে তাহাতে এই সকল বিষয়ের আলোচনা উচিত বলিয়া বিবেচিত হয় নাই; কারণ, এইরূপ করিলে সেই উপাঙ্গগুলির ন্যায় এই আলোচনাও গৌণ বলিয়াই বিবেচিত হইত । সেইরূপ বনপর্ব কিংবা শান্তিপর্বের অনেক বিষয়ের খিচুড়ীর মধ্যে গীতাকেও সন্নিবিষ্ট করিলে উহার মহত্বের লাঘব না হইয়া যাইত না । তাই, উদ্যোগপর্ব শেষ করিয়া মহাভারতের প্রধান কাৰ্য - ভারতীয় যুদ্ধ - আরম্ভ হইবার ঠিক প্রসঙ্গেই, সেই সম্বন্ধে এরূপ আপত্তি করা হইয়াছে, যাহা নীতিধর্মদৃষ্টিতে অপরিহাৰ্য দেখায়, এবং সেইখানেই এই কর্মাকর্মবিচারের স্বতন্ত্র শাস্ত্ৰ উপপত্তির সহিত কথিত হইয়াছে । সার কথা, পাঠক কিছু বিলম্বের কারণে যদি এই পরম্পরাগত কথা ভুলিয়া যান যে, শ্ৰীকৃষ্ণ যুদ্ধারম্ভেই অর্জুনকে গীতা শুনাইয়াছিলেন, এবং যদি তিনি এই বুদ্ধিতেই বিচার করেন যে, মহাভারতে ধর্মাধর্মনিরূপণার্থ বিরচিত ইহা এক আর্ষ মহাকাব্য, তথাপি ইহাই উপলব্ধি হইবে যে, গীতার জন্য মহাভারতে যে স্থান নিযুক্ত করা হইয়াছে তাহাই গীতার মহত্ব প্ৰকাশ করিবার জন্য কাব্যদৃষ্টিতেও সঙ্গত হইয়াছে । গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় কি এবং মহাভারতে কোন স্থানে গীতা বিবৃত হইয়াছে, এই সকল বিষয়ের ঠিক ঠিক উপপত্তি যখন বুঝা গেল. তখন এই সকল প্রশ্নের কোনই গুরুত্ব দেখা যায় না যে “গীতোক্ত জ্ঞান রণভূমিতে বিবৃত করিবার কি প্রয়োজন ছিল ? কোন সময়ে কেহ এই গ্ৰন্থ পরে মহাভারতে ঢুকাইয়া দিয়া থাকিবে অথবা ভগবদ্‌গীতার দশ শ্লোকই মুখ্য কিংবা শত শ্লোকই মুখ্য ?” কারণ অন্য প্রকরণসমূহ হইতেও উপলব্ধি হইবে যে, যখন একবার ইহা স্থির হইল যে ধর্মনিরূপণার্থ ‘ভারত’কে ‘মহাভারত’ করিবার জন্য অমুক বিষয় মহাভারতে অমুক কারণে অমুক স্থানে সন্নিবেশ করা আবশ্যক, তখন মহাভারতকার সেই বিষয়ের নিরূপণে কত স্থান লাগিবে তাহার জন্য কোন চিন্তা করেন না । তথাপি গীতার বহিরঙ্গপরীক্ষা সম্বন্ধে অন্য যে সকল তর্ক উপস্থিত করা হয় তাহার উপরেও এক্ষণে প্ৰসঙ্গানুসারে বিচার করিয়া তাহার মধ্যে কতটা তথ্য আছে তাহা দেখা আবশ্যক, তাই তন্মধ্যে 
(১) গীতা ও মহাভারত
(২) গীতা ও উপনিষৎ
(৩) গীতা ও ব্ৰহ্মসূত্র
(৪) ভাগবত ধর্মের উদয় ও গীতা
(৫) বর্তমান গীতার কাল
(৬) গীতা ও বৌদ্ধ গ্ৰন্থ, এবং 
(৭) গীতা ও খৃষ্টানদিগের বাইবেল,
-“এই সাত বিষয়ের আলোচনা এই প্ৰকারণের সাত ভাগে যথাক্রমে করা হইয়াছে । স্মরণ থাকে যেন, এই বিচার করিবার সময় কেবল কাব্যের হিসাবে অর্থাৎ ব্যবহারিক এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেই মহাভারত, গীতা, ব্ৰহ্মসূত্র, উপনিষৎ প্রভৃতি গ্রন্থের আলোচনা বহিরঙ্গসমালোচক করিয়া থাকেন, অতএব আমিও সেই দৃষ্টিতেই এক্ষণে উক্ত প্রশ্ন সমূহের বিচার করিব ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment