Sunday, June 4, 2017

কর্মজিজ্ঞাসা (Desire to know the Right Action)

কর্মজিজ্ঞাসা


কিং কর্ম কিমকর্ম্মেতি কবয়োহপ্যত্র মোহিতাঃ ৷ [গীতা|৩|১৬]

(“কর্ম কোনটি এবং অকর্ম কোনটি এই সম্বন্ধে পণ্ডিদিগেরও মোহ হইয়া থাকে ।” এই স্থলে অকর্ম শব্দ ‘কর্মের অভাব’ ও ‘মন্দ কর্ম’ এই দুই অর্থেই যথাসম্ভব গ্রহণ করিতে হইবে । মুল শ্লোক সম্বন্ধে আমার টীকা দেখ ।)


সূচীপত্র



1) ভূমিকা
2) কর্তব্যমূঢ়তার দুই ইংরাজী উদাহরণ
3) এই দৃষ্টিতে মহাভারতের মহত্ব
4) অহিংসা-ধর্ম তাহার অপবাদ
5) ক্ষমা ও তাহার অপবাদ
6) আমাদের শাস্ত্রের সত্যানূতবিবেক
7) ইংরেজী নীতিশাস্ত্রের বিবেকের সঙ্গে উহার তুলনা
8) আমাদের শাস্ত্রকারদের দৃষ্টির শ্রেষ্ঠতা ও মহত্ব
9) প্রতিজ্ঞাপালন ও তাহার মর্যাদা
10) অস্তেয় ও তাহার অপবাদ
10.1) আত্মরক্ষা
11) ‘মৃত্যু অপেক্ষা বাঁচিয়া থাকা শ্রেয়স্কর’ ইহার অপবাদ
12) মাতা, পিতা, গুরু প্রভৃতি পূজ্য পুরুষদের সম্বন্ধে কর্তব্য ও তাহার অপবাদ
13) কাম, ক্রোধ ও লোভের নিগ্রহের তারতম্য
14) ধৈর্য আদি গুণের অবসর এবং দেশ-কাল আদি মর্যাদা
15) যুগানুসারে আচারের তারতম্য
16) ধর্ম অধর্মের সূক্ষ্মতা
16.1) নীতিশাস্ত্ৰ
16.2) গীতার অপূর্বতা


1) ভূমিকা



ভগবদ্গীতার আরম্ভে, পরস্পরবিরুদ্ধ দুই ধর্মের কাঁইচীর মধ্যে আসিয়া পড়ায় কর্তব্যবিমূঢ় অর্জুনের মনে যে চিন্তা উপস্থিত হইয়াছিল তাহা কিছুই আশ্চৰ্য নহে । যে সকল অসমর্থ ও আত্মম্ভরী ব্যক্তি সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া সংসার ত্যাগপূর্বক বনে গমন করে, অথবা যাহারা শক্তির অভাবে জগতের অনেক অন্যায় নীরবে সহ্য করে, সে সকল লোকের কথা স্বতন্ত্র । কিন্তু সমাজে থাকিয়া যে সকল শ্ৰদ্ধাভাজন ধীর কর্মকর্তা পুরুষদিগের স্বকীয় সাংসারিক কর্তব্যসকল যথাধর্ম ও যথানীতি সম্পাদনা করিতে হয়, তাঁহাদেরও মনে এইরূপ চিন্তা অনেক সময় উপস্থিত হইয়া থাকে । যুদ্ধের আরম্ভেই অর্জুনের কর্তব্যজিজ্ঞাসা ও মোহ হইয়াছিল । পরে, যুদ্ধে নিহত অনেক আত্মীয়ের শ্ৰাদ্ধ করিবার সময় উপস্থিত হইলে যুধিষ্ঠিরেরও এইরূপ মোহ আসিয়াছিল । সেই মোহ নিবৃত্তি করিবার জন্যই ‘শান্তিপর্ব’ কথিত হইয়াছে । অধিক কি, কর্মাকর্ম সংশয়ের এই প্রকার অনেক প্রসঙ্গ খুঁজিয়া বাহির করিয়া কল্পনা করিয়া সেই বিষয়ে বড় বড় কবিরা সুরস কাব্য ও উত্তম নাটকাদি রচনা করিয়াছেন ।


2) কর্তব্যমূঢ়তার দুই ইংরাজী উদাহরণ



যেমন মনে কর, প্ৰসিদ্ধ ইংরেজ নাটককার শেক্সপীয়রের হেম্‌লেট নামক নাটক । ডেনমার্ক দেশের প্রাচীন রাজপুত্ৰ হেম্‌লেটের খুল্লতাত, আপন ভাইকে - ডেনমার্কের রাজাকে অর্থাৎ হেম্‌লেটের পিতাকে - খুন করিয়া ও হেম্‌লেটের মাতাকে পুনর্বিবাহ করিয়া, সিংহাসন পৰ্যন্ত দখল করিয়াছিলেন । তখন এইরূপ পাপাচারী খুল্লতাতকে হত্যা করিয়া পুত্ৰধর্মানুসারে পিতৃঋণ হইতে মুক্ত হইবে, - কিম্বা মায়ের দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে বাপ বলিয়া ও সিংহাসনের দখলকারী রাজা বলিয়া তাহার অধীনতা স্বীকার করিবে, এই সংশয়মোহে পড়িয়া কোমলান্তঃকরণ হেম্‌লেটের মনের অবস্থা কিরূপ হইয়াছিল ? শ্ৰীকৃষ্ণের ন্যায় উপযুক্ত কোন হিতৈষী পথপ্রদর্শক না থাকায় উন্মাদগ্রস্ত হইয়া শেষে “বাঁচিয়া থাকা, কি না থাকা” এইরূপ বিচার-বিবেচনার পর হেম্‌লেটের কি পরিণাম হইয়াছিল, এই নাটকে তাহার চিত্র উৎকৃষ্টরূপে রঞ্জিত হইয়াছে । ‘কোরায়লেনস্‌’ নামক আর এক নাটকেও এই প্রকারের আর এক প্রসঙ্গ শেক্‌সপীয়ার বৰ্ণনা করিয়াছেন । কোরায়লেনস্‌ নামক বীরপুরূষ এক রোমক সর্দারকে রোমনগরের লোকেরা নগর হইতে নিৰ্বাসিত করায়, সেই রোমক বীর রোমনগরের শত্রুদিগের সহিত গিয়া মিলিয়াছিলেন, এবং “তোমাদিগকে আমি কখনই পরিত্যাগ করিব না” এইরূপ তিনি তাহাদিগের নিকট অঙ্গীকার করেন । কিয়ৎকাল পরে তিনি সেই শত্রুদিগের সাহায্যে রোমান লোকদিগের উপর আক্রমণ করিয়া, দেশ জয় করিতে করিতে অবশেষে একেবারে রোমনগরের দরজার সামনে তাহার শিবির স্থাপন করিলেন । তখন, রোম-নগরের রমণীগণ কোরায়লেনসের স্ত্রী ও মাতাকে সম্মুখে রাখিয়া, মাতৃভূমি সম্বন্ধে তাহার কর্তব্য কি, সেই বিষয় তাহাকে উপদেশ দিলেন এবং রোমান-লোকদিগের শত্রুপক্ষের সমীপে তিনি যে অঙ্গীকার করিয়াছিলেন, তাহার সেই অঙ্গীকার-বাক্য ভাঙ্গাইয়া দিলেন ! কর্তব্যাকর্তব্যের সংশয়-মোহে পতিত হইবার এইরূপ দৃষ্টান্ত জগতের প্রাচীন কিংবা অর্বাচীন ইতিহাসে অনেক আছে । 


3) এই দৃষ্টিতে মহাভারতের মহত্ব



কিন্তু এত দূরে যাইবার আমাদের কোন প্রয়োজন নাই । আমাদের মহাভারত গ্ৰন্থই এইরূপ প্রসঙ্গের এক খনি বলিলেও হয় । গ্রন্থারম্ভে [আ|২] ভারতের বর্ণনা করিতে করিতে স্বয়ং ব্যাস ‘সূক্ষ্মাৰ্থ ন্যায়যুক্ত’, ‘অনেকসময়ান্বিত’, প্রভৃতি তাহার বিশেষণ দিয়াছেন । উহাতে সমস্ত ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্ৰ আছে । শুধু তাহাই নয়, - “যদিহাস্তি তদন্যত্র যন্নোহান্ত্রিন তৎকাচিৎ”-ইহাতে যাহা আছে তাহা অন্যত্রও আছে, এবং ইহাতে যাহা নাই তাহা অন্য কোথাও নাই [আ|৬২|৫৩] - এইরূপ মহাভারতের মাহাত্ম্য কীর্তন করিয়াছেন । অধিক কি, সংসারের অনেক কঠিন প্ৰসঙ্গ প্ৰাচীন মহাত্মা পুরুষেরা কিরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, ইহা সুবোধ্য কাহিনীর আকারে, সামান্য লোকদিগের বোধ-সৌকর্য্যার্থে, ভারত ‘মহাভারতে’ পরিণত হইয়াছে । নতুবা কেবল ভারতীয় যুদ্ধের কিংবা ‘জয়’ নামক ইতিহাসের বর্ণনা করিবার জন্য আঠারো পর্ব বিবৃত করিবার কোন প্রয়োজন ছিল না ।

কেহ এইরূপ প্রশ্ন করিতে পারে যে, শ্ৰীকৃষ্ণ-অর্জুনের কথা ছাড়িয়া দেও; কিন্তু তোমার আমার এতটা গভীর জলে প্ৰবেশ করিবার প্রয়োজন কি ? মনু প্রভৃতি স্মৃতিকারেরা আপনি আপন গ্রন্থে, মনুষ্যেরা সংসারে কিরূপভাবে চলিবে এই বিষয়ে কি স্পষ্ট নিয়ম নির্দেশ করিয়া দেন নাই ? কাহারো হিংসা করিবে না, প্ৰাণনাশ করিবে না, নীতিরক্ষা করিয়া চলিবে, সত্য বলিবে, গুরুজনদিগকে সম্মান করিবে, চুরি কিংবা ব্যভিচার করিবে না, প্রভৃতি সর্বধর্মের সাধারণ নিয়মগুলি সকলে যদি পালন করে, তাহা হইলে তোমার এই গোলযোগের মধ্যে পড়িবার কারণ কি ? কিন্তু উল্টা এইরূপ বিচারও করা যাইতে পারে যে, জগতের যাবতীয় লোক যে পৰ্যন্ত না এই নিয়মানুসারে চলে সেই পৰ্যন্ত সজ্জনেরা সদাচরণের দ্বারা দুষ্ট লোকদিগের জালে আপনাদিগকে জড়াইয়া ফেলিবেন, না, তাহার প্রতিকারার্থ যে প্রকারেই, হউক আপনাদিগকে রক্ষা করিবেন ? ইহা ব্যতীত এই সাধারণ নিয়মগুলিকে নিত্য ও প্রামাণিক বলিয়া মানিয়া লইলেও, অনেক সময় কর্তাপুরুষের সম্মুখে এইরূপ প্ৰসঙ্গও আসিয়া পড়ে যেস্থলে এই সাধারণ নিয়মগুলির মধ্যে দুই কিংবা ততোধিক নিয়ম একসঙ্গে একই সময়ে আমরা প্ৰাপ্ত হই । তখন “এটা করিব কি ওটা করিব” এইরূপ বিচারের মধ্যে পড়িয়া মানুষ পাগল হইয়া যায় । অর্জুনের অবস্থা এইরূপই হইয়াছিল । কিন্তু অর্জুন ব্যতীত অন্য মহৎ ব্যক্তির নিকটেও এইরূপ কঠিন সমস্যা উপস্থিত হইয়া থাকে । এই সম্বন্ধে মহাভারতের অনেক স্থানে মর্মস্পর্শী বিচার-আলোচনা আছে । তাহার দৃষ্টান্ত - মনু সর্ববর্ণের পক্ষে সাধারণ বলিয়া যাহা বলিয়াছেন “অহিংসাসত্যমস্তেয়ং শৌচমিন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহঃ” - অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, কায়মনোবাক্যের শুদ্ধতা ও ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ [মনু|১০|৬৩] - এই সনাতন নীতিধর্মগুলির মধ্যে অহিংসার কথাটাই ধরা যাক । 


4) অহিংসা-ধর্ম তাহার অপবাদ



“অহিংসা পরমোধর্ম” [মভা|আ|১১|১৩] এই তত্ত্বটি কেবল আমাদের বৈদিক ধর্মের মধ্যে নাই, কিন্তু অন্য সকল ধর্মের মধ্যেই ইহা মুখ্যরূপে পরিগণিত হইয়াছে । বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদিগের ধর্মগ্রন্থে যে সকল আদেশ আছে তন্মধ্যে “হিংসা করিবে না,” এই আদেশ-বচনটিকে মনুর মতই প্ৰথম স্থান দেওয়া হইয়াছে । হিংসা শুধু জীব-হত্যা নহে, অন্য প্ৰাণীদের মনে কিংবা শরীরে কষ্ট দেওয়াও এই হিংসার ভিতরে ধরা যায় । সুতরাং অহিংসা অর্থে, কোন সচেতন প্ৰাণীকে কোন প্রকার দুঃখ না দেওয়া বুঝায় । পিতৃ-হত্যা, মাতৃ-হত্যা, নর-হত্যা এই সকল হিংসা জগতের সকল লোকেরই মতে বড় রকমের হিংসা হওয়ায়, সকল ধর্মের মধ্যেই এই সকল হিংসাকেই প্ৰধান স্থান দেওয়া হইয়াছে । কিন্তু মনে কর, আমার প্রাণ নাশ করিবার জন্য, কিংবা আমার পত্নী বা কন্যার উপর বলাৎকার করিবার জন্য, অথবা আমার ঘরে আগুন লাগাইবার জন্য, অথবা আমার সমস্ত ধনসম্পত্তি, স্থাবর অস্থাবর সমস্ত হরণ করিবার জন্য কোন দুষ্ট মনুষ্য হাতে অস্ত্রশস্ত্ৰ লইয়া সুসজ্জিত; নিকটে পরিত্রাতা লোক কেহই নাই; তখন এইরূপ ‘আততায়ী’ মনুষ্যকে আমরা কি - “অহিংসা পরমো ধৰ্ম্মঃ” বলিয়া চক্ষু বুজিয়া উপেক্ষা করিব ? না - এই দুষ্ট লোক সাম-উপচারের কথা যদি না শুনে তবে উহাকে যথাশক্তি শাসন করিব ? মনু বলেন
গুরুং বা বালবৃদ্ধৌ বা ব্ৰাহ্মণং বা বহুশ্রুতম্ ৷
আততায়িনমায়ান্তং হন্যাদেবাবিচারয়ন্‌ ॥
“এইরূপ আততায়ী বা দুষ্ট মনুষকে - সে গুরুই হউক, বৃদ্ধই হউক, ছেলেই হউক, বা বিদ্বান ব্ৰাহ্মণই হউক, সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া, নিশ্চয়ই বধ করিবে । কারণ, এরূপ স্থলে, হত্যার পাপ হত্যাকারীকে স্পর্শ করে না, আততায়ী নিজের অধর্মাচরণেই নিহত হয়, এইরূপ শাস্ত্রকারেরা বলেন [মনু|৮|৩৫০] । শুধু মনু নহে, অর্বাচীন ফৌজদারী আইনও একটা সীমার ভিতর আত্মরক্ষার এই অধিকার স্বীকার করিয়াছে । এইরূপ প্রসঙ্গে, অহিংসা অপেক্ষা আত্মসংরক্ষণের ঔচিত্যই অধিকতর বুঝিতে হইবে । ভ্ৰূণ-হত্যা সকলেই অতি গৰ্হিত বলিয়া স্বীকার করে; কিন্তু গর্ভে আটকাইয়া গেলে কাটিয়া বাহির করা হয় না কি ? যজ্ঞে পশুবধ প্ৰশস্ত বলিয়া বেদও স্বীকার করেন [মনু|৫|৩১]; তথাপি পিষ্টপশু নির্মাণ করিয়া তাহাও এক সময় এড়াইতে পারা যায় [মভা|শাং|৩৩৭|অনু|১১৫|৫৬] কিন্তু বায়ু, জল, ফল প্রভৃতি সর্বস্থান ছোট ছোট ক্ষুদ্র জীবে যে ভরিয়া আছে, তাহাদের হত্যা কিরূপে বন্ধ হইবে ? মহাভারতে [শাং|১৫|২৬] অর্জুন বলিতেছেন :-
সুক্ষ্মযোনীনি ভূতানি তর্কগম্যানি কানিচিৎ ৷
পক্ষ্মনোহপি নিপাতেন, যেষাং স্যাৎ স্কন্ধপর্য্যয়ঃ ॥
“চক্ষে না দেখিতে পাইলেও তর্কের দ্বারা যাহার অস্তিত্ব বুঝা যায় এইরূপ সুক্ষ জীবে জগৎ এতটা ভরিয়া আছে যে, আমরা আমাদের চোখের পাতা ফেলিলেও এই সকল জীবের হাত পা ভাঙ্গিয়া যায় !” অতএব হিংসা করিবে না, এই কথা শুধু মুখে বলিলে কি ফল হইবে ? এইরূপ সারাসার বিচার করিয়া অনুশাসন পর্বে [অনু|১১৬] মৃগয়ার সমর্থন করা হইয়াছে । বনপর্বে এইরূপ কাহিনী আছে যে, এক ব্ৰাহ্মণ ক্ৰোধের দ্বারা কোন পতিব্ৰতা রমণীকে ভস্ম করিতে উদ্যত হইয়া যখন নিষ্ফলপ্রযত্ন হইলেন, তখন তিনি সেই রমণীর শরণাপন্ন হইলেন; তাহার পর, ধর্মের প্রকৃত রহস্য বুঝাইবার জন্য ঐ রমণী উক্ত ব্ৰাহ্মণকে এক ব্যাধের নিকট পাঠাইলেন । ঐ ব্যাধ মাংস বিক্রয় করিত ও পরম মাতৃ-পিতৃভক্ত ছিল । ব্যাধের এই ব্যবসা দেখিয়া ব্ৰাহ্মণের অত্যন্ত বিস্ময় ও খেদ উপস্থিত হইল । তখন ব্যাধ অহিংসার প্রকৃত তত্ত্ব তাঁহাকে বলিয়া তাঁহার জ্ঞান সম্পাদন করিল ! জগতের মধ্যে কে কাহাকে না খায় ? “জীবো জীবস্য জীবনম্‌” [তাগ|১|১৩|৪৬] এই ব্যবহার নিত্য চলিতেছে । আপৎকালে “প্ৰাণস্যান্নমিদং সর্বম্‌” - ইহা শুধু স্মৃতিকারগণই যে বলেন তাহা নহে [মনু|৫|২৮; মভা|শাং|১৫|২১], ইহা উপনিষদের মধ্যেও স্পষ্ট কথিত হইয়াছে [বেসূ|৩|৪|২৮; ছাং|৫|২|১; বৃ|৬|১|১৪] । সকলেই হিংসা ছাড়িয়া দিলে ক্ষাত্ৰধর্ম কিরূপে থাকিবে ? এবং ক্ষাত্ৰধর্ম চলিয়া গেলে প্ৰজাদিগের পরিত্রাতার বিনাশ ঘটিয়া, যে যাহাকে ইচ্ছা বিনাশ করিবে, এইরূপ অবস্থা দাঁড়াইবে । সার কথা, নীতির সাধারণ নিয়মের দ্বারা সকল সময়ে কর্মের বিচার চলে না; নীতিশাস্ত্রের মুখ্য নিয়ম যে, অহিংসা, সেই অহিংসার নিয়মেতেও কর্তব্যাকর্তব্যের সুক্ষ বিচার করা আবশ্যক হয় ।


5) ক্ষমা ও তাহার অপবাদ



যেমন অহিংসা ধর্ম; তেমনি ক্ষমা, শান্তি, দয়া - এই সকল গুণও শাস্ত্ৰে কথিত হইয়াছে । কিন্তু সর্ব সময়ে এই শান্তি কিরূপে রক্ষিত হইবে ? নিয়ত যাহারা শান্তি অবলম্বন করিয়া থাকে তাহাদের স্ত্রীপুত্ৰাদিকেও ইতর লোকেরা প্ৰকাশ্যভাবে নিশ্চয়ই হরণ করে - এইরূপ কারণ প্ৰথমে দেখাইয়া, প্ৰহ্লাদ আপন নাতি বলিরাজাকে এইরূপ বলিতেছেন -
ন শ্ৰেয়ঃ সততং তেজো ন নিত্যং শ্ৰেয়সী ক্ষমা ৷
তস্মান্নিত্যং ক্ষমা তাত পণ্ডিতৈরপবাদিতা ॥
নিয়ত তেজস্বিতা ও নিয়ত ক্ষমা শ্রেয়ষ্কর হয় না; এইজন্যই হে বৎস জ্ঞানীরা ক্ষমারও অপবাদ করিয়াছেন” [মভা|বন|২৮|৬|৮] । অনন্তর, ক্ষমার যোগ্যস্থলরূপে কতকগুলি প্রসঙ্গের মধ্যে একটি প্রসঙ্গ প্ৰহ্লাদ বিবৃত করিলেন । তথাপি, প্ৰহ্লাদ ক্ষমার যোগ্যস্থল বুঝিবার তত্ত্ব বা নিয়ম কি তাহা বলেন নাই । যোগ্যপ্ৰসঙ্গ বুঝিতে না পারিয়া যদি কেহ অপবাদেরই প্রয়োগ করে, তাহা হইলে তাহার সেই আচরণ দুর্নীতির আচরণ হয় । অতএব, এই যোগ্য প্ৰসঙ্গ কিরূপে নির্ণয় করা যাইতে পারে, তাহার তত্ত্বটি বুঝিয়া লওয়া খুবই আবশ্যক ।


6) আমাদের শাস্ত্রের সত্যানূতবিবেক



সকল দেশের ও সকল ধর্মের আবালবৃদ্ধবনিতা, অপর যে তত্ত্বটিকে সর্বোপরি প্রামাণিক বলিয়া মান্য করে - সেটি ‘সত্য’ । সত্যের মাহাত্ম্য কি আর বর্ণনা করিব ? সমস্ত সৃষ্টি উৎপন্ন হইবার পূর্বে ‘ঋত’ ও ‘সত্য” উৎপন্ন হয় । সেই সত্যেতেই আকাশ, পৃথ্বী, বায়ু প্ৰভৃতি পঞ্চমহাভূত আবৃত ও ধৃত হইয়া আছে - এইরূপ দেবতারা সত্যের মহিমা কীর্তন করিয়াছেন । “ঋতং চ সত্যং চাভীদ্ধাত্তপসোহধ্যহায়ত” [ঋ|১০|১৯০|১], “সত্যেনোত্তভিতা ভূমিঃ” [ঋ|১০|৮৫|১, ইত্যাদি মন্ত্র দেখ] । ‘সত্য’ এই শব্দের ধাত্বর্থও ‘হওয়া’ অৰ্থাৎ “কখনই বিনাশ হইবার নহে” অথবা যাহা ত্রিকালে অবাধিতভাবে থাকে”; সুতরাং “সত্যপরতা নাহি ধর্ম । সত্য তেঁচি পরব্রহ্ম ।” (সত্য অপেক্ষা ধর্ম নাই, সত্যই পরব্ৰহ্ম) এইরূপ সত্যের প্রকৃত মহিমা বর্ণিত হইয়াছে । “নাস্তি সত্যাৎপরোধৰ্ম্মঃ” [শাং|১৬২|২৪], এই বচন মহাভারতের অনেক স্থানে পাওয়া যায় এবং ইহাও লিখিত হইয়াছে যে -
অশ্বমেধসহস্ৰাং চ সত্যং চ তুলিয়া ধৃতম্ ৷
অশ্বমেধসহস্রাদ্ধি সত্যমেব বিশিষ্যতে ॥
“সহস্ৰ অশ্বমেধ ও সত্য এই উভয়ের তৌল করিলে সত্যেরই গুরুত্ব উপলব্ধি হয়” [আ|৭৪|১০২] । সাধারণ সত্য সম্বন্ধে এইরূপ বর্ণনা আছে । সত্য সম্বন্ধে মনু বিশেষ করিয়া আর এক কথা এই বলেন -
বাচ্যৰ্থা নিয়তাঃ সর্বে বাঙ্‌মূলা বাগ্‌বিনিঃসৃতাঃ ৷
তাং তু যঃ স্তেনয়েদ্বাচং স সর্বস্তেয়কৃন্নরঃ ॥
“মনুষ্য মাত্রেরই সমস্ত ব্যবহার বাক্যের দ্বারা পরিচালিত হয় । পরস্পরের বিচার-আলোচনা পরস্পরকে জানাইবার পক্ষে শব্দের ন্যায় দ্বিতীয় সাধন নাই । কিন্তু এই সমস্ত ব্যবহারের আশ্রয়স্থান ও বাক্যের যে মূল উৎস, তাহাকে যে ব্যক্তি ঘোলাইয়া ফেলে অর্থাৎ বাক্যের সহিত প্ৰতারণা করে, সে ব্যক্তি সর্বচোর ব্যতীত আর কিছুই নহে ।” অতএব “সত্যপূতাং বদেদ্বাচং” [মনু|৬|৪৬] সত্যপূত বাক্যই বলিবে - এইরূপ মনু বলিয়াছেন । উপনিষদেও “সত্যং বদ । ধৰ্ম্মং চর ।” [তৈ|১|১১|১] এইরূপে অন্য ধর্ম অপেক্ষা সত্যকেই প্ৰথম স্থান দেওয়া হইয়াছে । শরশয্যাশায়ী ভীষ্মদেব, শান্তি ও অনুশাসন পর্বে, যুধিষ্ঠিরকে সর্বধর্মের উপদেশ দিয়া, প্ৰাণত্যাগের পূর্বে “সত্যেষু যতিতব্যং যঃ সত্যং হি পরমং বলং” এই বাক্যকে সকল ধর্মের সারভূত বলিয়া এক সত্যকেই পালন করিতে বলিয়াছেন [মভা|অনু|১৬৮|৫০] । বৌদ্ধ ও খৃষ্টান ধর্মেও এই ধর্মেরই অনুরূপ বচন দেখিতে পাওয়া যায় ।

এই প্রকারে সর্বোপরি সিদ্ধ ও চিরস্থায়ী সত্যের কোন অপবাদ হইতে পারে ইহা কি কেহ স্বপ্নেও মনে করিতে পারে ? কিন্তু দুষ্টলোকে পূর্ণ এই জগতের ব্যবহার বড়ই কঠিন ! মনে কর, কোন ব্যক্তি দস্যুহস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া তোমার চক্ষুর গোচরে নিবিড় বনে লুকাইয়া আছে; পরে তরবার-হস্তে সেই ডাকাত “সেই ব্যক্তি কোথায়” বলিয়া তোমাকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, তখন তুমি কি উত্তর দিবে ? সত্য বলিবে, না, সেই নিরপরাধ প্ৰাণীর প্রাণ বাঁচাইবে ? কারণ, নিরপরাধ প্ৰাণীর হিংসা নিবারণ করা, ইহা শাস্ত্ৰানুসারে সত্যেরই ন্যায় মহৎ ধর্ম । মনু বলেন, “নাপৃষ্টঃ কস্যচিদ্‌ব্রুয়ান্ন চান্যায়েন পৃচ্ছতঃ” [মনু|২|১১০; মভা|শাং|২৮৭|৩৪] - জিজ্ঞাসা ব্যতীত কাহারও সহিত কথা কহিবে না, এবং অন্যায়পূর্বক যদি কেহ প্রশ্ন করে, জিজ্ঞাসা করিলেও তাহার উত্তর দিবে না; জানা থাকিলেও পাগলের মত কেবল হুঁ হুঁ করিয়াই কালক্ষেপ করিবে - "জানন্নপি হি মেধাবী জড়বল্লোক আচরেৎ ।” ঠিক্‌ কথা । কিন্তু হুঁ হুঁ বলা ও মিথ্যা বলা পর্যায়ক্রমে একই নহে কি ? “ন ব্যাজেন চরেদ্ধর্মং” - ধর্মের সহিত প্রতারণা করিয়া মনকে বুঝাইও না -তাহাতে ধর্ম প্ৰতারিত হয় না, তুমিই প্ৰতারিত হইবে; মহাভারতের অনেক স্থানে এইরূপ কথিত হইয়াছে । [মভা|আ|২১৫|৩৪] । কিন্তু হুঁ হুঁ করিয়া কালক্ষেপ করিবার মতও যদি অবস্থা না হয় ? দস্যু হাতে তরবার লইয়া, তোমার বুকের উপর বসিয়া, ধন রত্ন কোথায় আছে বলিয়া তোমাকে জিজ্ঞাসা করিল, এবং উত্তর না দিলে তোমার প্রাণ যাইবে, - এই অবস্থায় তুমি কি বলিবে ? সকল ধর্মের রহস্যজ্ঞ ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এই প্রকার দস্যুর দৃষ্টান্ত দিয়া কৰ্ণপর্বে অর্জুনকে [কর্ণ|৬৯|৬১], এবং পরে, শান্তিপর্বে, সত্যানৃতাধ্যায়ে [শাং|১০৯|১৫|১৬] ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে এইরূপ বলিতেছেন :-
অকূজনেন চেন্মোক্ষো নাবকূজেৎ কথংচন ৷
অবশ্যং কূজিতব্যে বা শঙ্কেরন্বাপ্যকূজনাৎ ৷
শ্ৰেয়স্তত্রানৃতং বক্তং সত্যাদিতি বিচারিতম্‌ ॥
“না বলিলে যদি মুক্তি পাইবায় সম্ভাবনা থাকে তবে কোন কথাই বলিবে না; বলা যদি নিতান্তই আবশ্যক হয়, কিংবা না বলিবার দরুণ কোন বিপদের আশঙ্কা থাকে, তবে সেই সময় মিথ্যা বলা অধিক প্রশস্ত, বিচারে এইরূপ স্থির হইয়াছে ।” কারণ, সত্য-ধর্ম কেবল শব্দোচ্চারণ-নিঃসৃত বাক্য নহে, কিন্তু যে ব্যবহারে সকলের কল্যাণ হয় সেই ব্যবহার শুধু শব্দোচ্চারণ অযথার্থ হইয়াছে বলিয়া গৰ্হিত বলা যাইতে পারে না । যাহাতে সকলোয় ক্ষতি হয় তাহা সত্যও নহে, অহিংসাও নহে :-
সত্যস্য বচনং শ্রেয়ঃ সত্যাদপি হিতং বদেৎ ৷
যদ্ভূতহিতমত্যন্তং এতৎসত্যং মতং মম ॥
“সত্য বলা প্রশস্ত বটে; কিন্তু সত্য অপেক্ষাও সর্বভূতের যাহাতে হিত হয় সেইরূপ বাক্যই বলিবে কারণ, সর্বভূতের যাহা অত্যন্ত হিত তাহাই আমায় মতে প্রকৃত সত্য” - এইরূপ শান্তিপর্বে [শাং|৩২৯|১৩; ২৮৭|১৯] সনৎকুমারের প্রসঙ্গে নারদ শুককে বলিয়াছেন । “যদ্ভূতহিতং” এই পদটি দেখিয়া আধুনিক ইংরেজী উপযোগীতাবাদী স্মরণে আসায় যদি কোন ব্যক্তি এই বচনটি প্রক্ষিপ্ত মনে করেন, তবে তাঁর ইহা ভুলিলে চলিবে না যে, এই বচনটি মহাভারতের বনপর্বে ব্ৰাহ্মণব্যাধ-সম্বাদে, দুই তিনবার আসিয়াছে । তন্মধ্যে একস্থানে “অহিংসা সত্যবচনং সর্বভূতহিতং পরং” [বন|২০৬|৭৩] এবং আর এক স্থানে “যদ্ভূতহিতমত্যন্তং তৎসত্যমিতি ধারণা” [বন|২০৮|৪], এইরূপ কিছু কিছু পাঠভেদ আছে । সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির দ্রোণাচার্যকে “নরো বা কুঞ্জরো বা” - অশ্বত্থামা হত ইতি গজ - এইরূপ উত্তর দিয়া যে সংশয়-মোহ উৎপাদন করিয়াছিলেন, - ইহাই তাহার একমাত্র কারণ । এই প্রকারে অন্যান্য বিষয়েও এই নীতি প্ৰযুক্ত হইতে পারে । হত্যাকারী মনুষ্যের প্রাণ মিথ্যা বলিয়া বাঁচাইবে, আমাদের শাস্ত্ৰ একথা বলে না । কারণ, শাস্ত্ৰেই হত্যাকারী মনুষ্যের দেহান্ত প্ৰায়শ্চিত্ত কিংবা বধদণ্ড কথিত হইয়াছে; সুতরাং. উক্ত মনুষ্য দণ্ডার্হ কিংবা বধ্য । এই অবস্থায় কিংবা ইহার ন্যায় অন্য কোন অবস্থায় মিথ্যা-সাক্ষ্য-দাতা মনুষ্যের সাত কিংবা ততোধিক পূর্বপুরুষ ও সে ব্যাক্তি স্বয়ং নরকগামী হয়, - ইহা সকল শাস্ত্রকারেরা বলিয়াছেন [মনু|৮|৮৯-৯৯; মভা|আ|৭|৩] । কিন্তু কর্ণপর্বে উপরি-উক্ত দস্যুর দৃষ্টান্ত অনুসারে, যদি সত্য কথা বলার দরুণ নিরপরাধ মনুষ্যের প্রাণ বিনা কারণে বিনষ্ট হয় - তখন কি করা যাইবে ? গ্ৰীন-নামক এক ইংরাজ গ্রন্থকার স্বকীয় “নীতিশাস্ত্ৰেয় উপোদ্‌ঘাত” গ্রন্থে এই প্রসঙ্গে বলিয়াছেন যে এইরূপ স্থলে সমস্ত নীতিশাস্ত্ৰ নিরুত্তর ও নীরব হইয়া যায় । মনুযাজ্ঞবল্ক্য এইরূপ প্রসঙ্গকে সত্যাপবাদের মধ্যে পরিগণিত করেন সত্য; কিন্তু এইরূপ গণনা তাঁহাদের মতে সাধারণতঃ গৌণ - তাই তাঁহারা শেষে এরূপ অপবাদের জন্য প্ৰায়শ্চিত্ত্বেরও উপদেশ দিয়াছেন -
তৎপাবনায় নির্বাপ্যশ্চরুঃ সারস্বতো দ্বিজৈঃ ॥
[যাজ্ঞ|২|৮৩; মনু|৮|১০৪-১০৬]


7) ইংরেজী নীতিশাস্ত্রের বিবেকের সঙ্গে উহার তুলনা



অহিংসার অপবাদে যিনি বিস্মিত হন নাই এইরূপ কোন বড় ইংরেজ সত্য সম্বন্ধে আমাদের ধর্মশাস্ত্রকারদিগকে নীচে নামাইয়া রাখিবার প্রযত্ন করিয়াছেন । তাই, প্রামাণিক খৃষ্টান ধর্মোপদেশক ও নীতিশাস্ত্ৰসম্বন্ধীয় ইংরেজ গ্রন্থকার এই সম্বন্ধে কি বলেন তাহা এইখানে বলিতেছি । “আমি মিথ্যা বলিলে, প্রভুর সত্যের মহিমা যদি অধিক বর্ধিত হয় (অর্থাৎ খৃষ্টধর্মের অধিক প্রচার হয়) তাহা হইলে আমাকে কিরূপে পাপী বলিয়া স্থির করিবে ? [রোম|৩|৭] এইরূপ খৃষ্ট-শিষ্য পলের মুখোচ্চারিত বাণী বাইবেলের নূতন অঙ্গীকারের মধ্যে প্রদত্ত হইয়াছে । খৃষ্টধর্মের ইতিহাসকার মিলম্যান বলিয়াছেন যে প্রাচীন খৃষ্টধর্মোপদেশক কয়েকবার এই অনুসারে কাজ করিয়াছেন । কাহাকে ভোগা দেওয়া কিংবা ভুল বুঝানো - ইহা বর্তমান কালের পাশ্চাত্য নীতিশাস্ত্ৰজ্ঞ পণ্ডিতেরা প্রায়ই ন্যায্য বলিয়া স্বীকার করেন না । তথাপি, সত্যধর্মনীতি যে একেবারে নিরপবাদ এ কথাও তাঁহারা বলেন না । যে সিজ্বিক্‌ নামক পণ্ডিতের নীতিশাস্ত্ৰসম্বন্ধীয় গ্ৰন্থ অধুনা আমাদের স্কুলে পড়ান হয়, তাহারই কথা ধর না কেন । সিজ্বিক্‌ এই কর্মাকর্মসংশয় স্থলে, “অধিকতম লোকের অধিক সুখ” এই তত্ত্বের বনিয়াদে নীতি নির্ণয় করিয়াছেন এবং ঐ কষ্টিপাথর প্রয়োগ করিয়াই, তিনি শেষে এইরূপ স্থির করিয়াছেন যে, “ছোট ছেলে, পাগল, রুগ্ন ব্যক্তি (সত্য বলিলে যদি তাহার শরীর খারাপ হয়), নিজের শত্ৰু, চোর - ইহাদের নিকট এবং অন্যায়পূর্বক যে ব্যক্তি প্রশ্ন করে তাহাকে উত্তর দিবার সময়, কিংবা উকীলের পক্ষে নিজ ব্যবসায়ে, - মিথ্যা কথা বলা অন্যায় নহে ।” (Sidgwick's “Methods of Ethics”, Book III, Chap.XI, $6, p.355, 7th Ed. Also see pp.315-317, same ed.) মিলের নীতিশাস্ত্ৰসম্বন্ধীয় গ্রন্থেও এই অপবাদের কথা অর্থাৎ ব্যতিক্রমস্থলের কথা আছে । (Mill's “Utilitarianism”, Chap.II, pp.33-34, 15th Ed. Longmans 1907.) এই অপবাদ ব্যতীত সিজ্বিক্‌ নিজ গ্রন্থে আরও এই কথা লিখিয়াছেন যে, “সকলেই সত্যাচরণ, করিবেক এইরূপ যদিও আমরা বলি, তথাপি যে রাজকীয় পুরুষকে নিজ কাজকর্ম গুপ্ত রাখিতে হয় তিনি অন্যের নিকট কিংবা কোন ব্যাপারী খরিদ্দারের নিকট সব সময় সত্যই বলিবেন এ কথা আমরা বলিতে পারি না ।” (Sidgwick's “Methods of Ethics”, Book IV. Chap.III, $7, p.454, 7th Ed. and Book II Chap.V, $3, p.169.) আর এক স্থানে, তিনি বলিয়াছেন যে, এই প্ৰকার নিজের সুবিধামত কাজ করা পাদ্রি ভট্টদিগের ও সৈনিকদিগের মধ্যে দেখা যায় । আধিভৌতিক দৃষ্টিতে যিনি নীতিশাস্ত্রের বিচার-আলোচনা করিয়াছেন সেই লেস্‌লি ষ্টিফেন নামক আর এক ইংরেজ গ্রন্থকার এই প্রকারের অন্য উদাহরণ দিয়া শেষে এইরূপ লিখিয়াছেন যে, “আমার মতে, কোন কাৰ্যের পরিণামের দিকে লক্ষ্য করিয়াই তাহার নীতিমত্তা স্থির করা আবশ্যক । মিথ্যা বলিলে যদি সর্বসমেত অধিক কল্যাণ হইবে আমার বিশ্বাস হয় তাহা হইলে সত্য বলিবার জন্য আমি কখনও প্ৰস্তুত থাকিব না । এবং এই প্ৰকার বিশ্বাস হইলে সম্ভবতঃ মিথ্যা বলাই আমার কর্তব্য - এইরূপ আমি বুঝিব ।” (Leslie Stephen's “Science of Ethics” Chap.IX, $29, p.369, 2nd Ed. - “And the certainty may be of such a kind as to make me think it a duty to lie.”) যিনি অধ্যাত্মদৃষ্টিতে নীতিশাস্ত্রের বিচার করিয়াছেন সেই গ্ৰীন সাহেব এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করিয়া, এই সময়ে নীতিশাস্ত্ৰ মনুষ্যের সংশয় নিবৃত্তি করিতে পারে না, এইরূপ স্পষ্ট বলিয়াছেন; এবং শেষে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে “কোন সাধারণ নিয়ম কেবল নিয়ম বলিয়াই পালন করিতে হইবে এই কথার কোন গুরুত্ব নাই; ‘সাধারণতঃ’ তাহার পালনে আমার শ্ৰেয় হইবে এইটুকুই নীতিশাস্ত্রের কথা । কারণ, এই স্থলে আমরা কেবল নীতির উপদেশে আমাদের লোভমূলক লঘু মনোবৃত্তি সকল ত্যাগ করিতে শিখিয়া থাকি ।” (Green's “Prolegomena to Ethics”, $315, p.379, 5th cheaper edition). নীতিশাস্ত্রবেত্তা বেন্‌, হ্বেবেল্‌ প্রভৃতি ইংরেজ পণ্ডিতদিগেরও মত এইরূপ । (Bain's “Mental and Moral Science”, p.445, Ed.1875; and Whewell's “Elements of Morality”, Book II, Chaps.XIII & XIV, 4th Ed. 1864).


8) আমাদের শাস্ত্রকারদের দৃষ্টির শ্রেষ্ঠতা ও মহত্ব



উপরি-উক্ত গ্ৰন্থকারদিগের মতের সহিত আমাদের ধর্মশাস্ত্রকারদিগের প্রবর্তিত নিয়মগুলির তুলনা করিলে সত্য সম্বন্ধে অধিক অভিমানী কে, তাহা সহজেই উপলব্ধি হইবে । আমাদের শাস্ত্ৰে কথিত হইয়াছে সত্য
ন নর্মযুক্তং বচনং হিনস্তি ন স্ত্রীযু রাজন্ন বিবাহকালে ৷
প্ৰাণাতায়ে সর্বধনাপহারে পঞ্চানৃতান্যাহুরপাতকানি ॥
“ঠাট্টা করিয়া, স্ত্রীলোকের নিকট, বিবাহকালে, প্রাণসঙ্কট উপস্থিত হইলে এবং সঞ্চিত ধন বাঁচাইবার জন্য - সর্ব-সমেত এই পাঁচ স্থলে অনৃত বলায় পাতক নাই” [মভা|আ|৮২|১৬; শাং|১০৯ ও মনু|৮|১১০ দেখ] । কিন্তু তাহার অর্থ, স্ত্রীলোকের নিকট সব সময়েই মিথ্যা বলিবে, এরূপ নহে । সিজ্বিক্‌ সাহেব যে অর্থে “ছোট ছেলে, পাগল, কিংবা রুগ্ন” ইহাদের সম্বন্ধে অপবাদ কহিয়াছেন সেই অর্থই মহাভারতের অভিপ্রেত । কিন্তু পারলৌকিক ও আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকে যাহারা গুটাইয়া রাখিয়াছেন, সেই ইংরেজ গ্রন্থকারেরা আরো বেশী দূর গিয়া, ব্যাপারীরা পর্যন্ত নিজের লাভের জন্য মিথ্যা বলিতে পারে - এই যে কথা স্পষ্টরূপে প্ৰতিপাদনা করিয়াছেন, এ কথা আমাদের শাস্ত্রকারেরা কখনই স্বীকার করেন নাই । কেবল সত্যশব্দ উচ্চারণ অর্থাৎ শুধু বাচিক সত্য এবং সর্বভূতহিত অর্থাৎ বাস্তবিক সত্য এই দুয়ের মধ্যে যে স্থলে বিরোধ হয় এবং যে স্থলে ব্যবহার-দৃষ্টিতে অসত্য বলা অপরিহার্য হয়, সেই সেই স্থলেই ইহারা কাৰ্য সিদ্ধ করিতে কোন কোন স্থানে অনুমতি দিয়াছেন । সত্যাদি নীতিধর্ম তাহাদিগের মতে নিত্য, অর্থাৎ সর্বকালে সমান অবাধিত; সুতরাং পারলৌকিক দৃষ্টিতে সাধারণত ইহাতে কিঞ্চিৎ পাপ আছে স্থির করিয়া তজ্জন্য তাঁহারা প্ৰায়শ্চিত্তেরও বিধান করিয়াছেন । এই সকল প্ৰায়শ্চিত্ত নিরর্থক ও শূন্যগর্ভ, এই কথা বর্তমানের আধিভৌতিক শাস্ত্রকারেরা বলিলেও বলিতে পারেন । কিন্তু যাঁহারা এই সকল প্ৰায়শ্চিত্তের বিধান করিয়াছেন তাঁহাদিগের ধারণা কিংবা যাহাদের জন্য এইরূপ বিধান হইয়াছে তাহাদের ধারণা সেরূপ না হওয়ায়, উভয়েই উক্ত সত্যাপবাদ গৌণ বলিয়াই স্বীকার করেন, এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হইবে; এবং এই অর্থই এই প্রসঙ্গের কথা কাহিনীতেও প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । উদাহরণ যথা - যুধিষ্ঠির “নরো বা কুঞ্জরো বা” এইরূপ কঠিন সমস্যার স্থলে একবার মাত্র ইতস্তত করিয়া বলিয়াছেন; কিন্তু তাহার দরুণ, পূর্বে তাঁহার যে রথ জমি হইতে চারি আঙ্গুল উপরে অন্তরীক্ষে চলিত, সেই রথ পরে অন্য লোকের রথের ন্যায় জমির উপর দিয়া চলিতে লাগিল এবং শেষে তাহার দরুণ ঘণ্টাখানেকের জন্যও নরকলোকে তাঁহাকে বাস করিতে হইল - এইরূপ মহাভারতেই কথিত হইয়াছে [দ্রোণ|১৯১|৫৭|৫৮ ও স্বৰ্গা|৩|১৫] । সেইরূপ, ক্ষাত্ৰধর্মানুসারে, কিন্তু শিখণ্ডীকে সামনে রাখিয়া ভীষ্মের বধসাধন করিবার দরুণ, অর্জুন” আপন পুত্র বদ্রুবাহনের হাতে পরাভূত হন এইরূপ অশ্বমেধপর্বে বর্ণিত হইয়াছে [মভা|অশ্ব|৮১|১০] । এই সকল কথা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, প্রসঙ্গবিশেষে কথিত উপরি-উক্ত অপবাদ মুখ্য বা প্ৰামাণিক স্বীকার করা যায় না । আমাদের শাস্ত্রকারগণের যাহা অন্তিম ও তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত তাহা মহাদেব পার্বতীকে বলিয়াছেন -
আত্মহেতোঃ পরার্থে বা নর্মহাস্যাশ্রয়াত্তথা ৷
যে মৃষা ন বদন্তীহ তে নরাঃ স্বর্গগামিনঃ ॥
“স্বার্থের জন্য, পরহিতের জন্য, কিংবা ঠাট্টা করিয়া যে সকল ব্যক্তি এই জগতে কখন মিথ্যা বলে না, তাহারা স্বৰ্গগামী হয়” [মভা|অনু|১৪৪|১৯] ।


9) প্রতিজ্ঞাপালন ও তাহার মর্যাদা



আপন বাক্য বা প্ৰতিজ্ঞাপালন ইহা সত্যেরই অন্তর্ভূত । “হিমাচল বিচলিত হইতে পারে, কিংবা অগ্নি শীতল হইতে পারে, কিন্তু আমার মুখের কথা অন্যথা হইবার নহে” এইরূপ শ্ৰীকৃষ্ণ ও ভীষ্ম বলিয়াছেন [মভা|আ|১০৩ ও উ|৮১|৪৮]ভর্তৃহরিও সৎপুরুষের এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন -
তেজস্বিনঃ সুখমসূনপি সন্ত্যজন্তি
সত্যব্ৰতব্যসনিনো ন পুনঃ প্ৰতিজ্ঞাম ॥
“সত্যব্ৰত তেজস্বী পুরুষ আপনার প্রাণ পৰ্যন্ত পরিত্যাগ করেন, তথাপি প্ৰতিজ্ঞা ত্যাগ করেন না” [নীতিশ|১১০] । সেইরূপ, দাশরথি রামচন্দ্ৰের একপত্নীব্ৰতের মতই তাঁহার একবাণ ও একবাক্যব্রত্যেরও খ্যাতি আছে - “দ্বিঃ শরং নভিসন্ধত্তে রামো দ্বির্নাভিভাষতে”হরিশ্চন্দ্ৰ স্বপ্নদত্ত বাক্যকে সত্য করিবার জন্য ডোমের ঘরেও জল বহন করিয়াছিলেন, এইরূপ পুরাণের কথা আছে । কিন্তু উল্টাপক্ষে, ইন্দ্ৰাদি দেবতারাও বৃত্ৰাসুরের সহিত প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়া তাহার বধসাধন করিয়াছিলেন, এইরূপ বেদে বর্ণিত হইয়াছে । হিরণ্যকশিপুবধ-সম্বন্ধে ঐ ধরণের কথা আছে । তদ্ব্যতীত আইনের ভিতরেও এমন কতকগুলা কড়ার দেখা যায় যাহা ন্যায়বিচারে বে-আইনী ও পালনের অযোগ্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়া থাকে । অর্জুনসম্বন্ধে এইরূপ একটা বিষয় মহাভারতের কৰ্ণপর্বে বর্ণিত হইয়াছে [কর্ণ|৬৯] । অর্জুনের এইরূপ প্ৰতিজ্ঞা ছিল যে, ‘তুমি আপন হাতের গাণ্ডীব ধনু অন্যকে দেও’ এই কথা যে কেহ আমাকে বলিবে আমি তখনি তার শিরশ্ছেদ করিব ।” অনন্তর কর্ণ যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিলে পর, যুধিষ্ঠিরের মুখ হইতে অর্জুনকে উদ্দেশ করিয়া যখন নৈরাশ্যজনিত স্বাভাবিক উচ্ছাসোক্তি বাহির হইল যে “তোমার গাণ্ডীবে আমাদের কি কাজ হইল ? উহা হাত হইতে ফেলিয়া দেও” তখন অর্জুন হাতে তরবার লইয়া যুধিষ্ঠিরকে বধ করিতে উদ্যত হইলেন । কিন্তু শ্ৰীকৃষ্ণ সেই সময় নিকটে থাকায়, সত্যধর্ম কাহাকে বলে, তত্ত্বজ্ঞান-দৃষ্টিতে ইহার মার্মিক বিচার করিয়া, “তুমি মূঢ়, সূক্ষ্ম ধর্ম এখনও তুমি জান না, বৃদ্ধদের নিকট তোমার উহা শিক্ষা করা আবশ্যক, “ন বৃদ্ধাঃ সেবিতাস্ত্বয়া –তু মি বৃদ্ধদের সেবা কর নাই, তোমার প্ৰতিজ্ঞা যদি রাখিতে হয় তবে তুমি যুধিষ্ঠিরকে ভর্ৎসনা কর, কারণ মানী ব্যক্তির পক্ষে ভর্ৎসনা বধেরই তুল্য,” ইত্যাদি প্রকারে তিনি অর্জুনকে বুঝাইলেন; এবং নিৰ্বিচারে জ্যেষ্ঠভ্ৰাতৃহত্যারূপ পাতক হইতে তাঁহাকে রক্ষা করিলেন । শ্ৰীকৃষ্ণ এই সময়ে সত্যানৃতের বিচার করিয়া অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়াছিলেন পরে শান্তিপর্বে সত্যানৃতাধ্যায়ে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকেও সেই উপদেশ দিয়াছিলেন [শাং|১০৯] । ব্যবহারক্ষেত্রে সকলেরই এই উপদেশের প্রতি লক্ষ্য কল্প আবশ্যক। এই সূক্ষ্ম প্রসঙ্গ নির্ণয় করা বড়ই কঠিন সন্দেহ নাই । দেখ এই স্থলে ভ্ৰাতৃধর্ম সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইলেও ইহার বিপরীতে গীতায় ভ্রাতৃপ্ৰেম অপেক্ষা ক্ষাত্রধর্ম তথায় বলবত্তর বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে, ইহা পাঠকদিগের সহজেই উপলব্ধি হইবে ।


10) অস্তেয় ও তাহার অপবাদ



অহিংসা ও সত্য - ইহাদের সম্বন্ধেই যদি এত বাদানুবাদ তখন তৃতীয় সাধারণ তত্ত্ব অস্তেয় সম্বন্ধেও যে এই প্ৰকার বাদানুবাদ হইবে তাহাতে আর আশ্চৰ্য কি ? একজনের ন্যায়োপার্জিত সম্পত্তি অন্যেরা যদি অবাধে চুরি বা লুট করিতে পায়, তবে ধনসঞ্চয় বন্ধ হইয়া সকলেরই ক্ষতি হইবে, ইহা নির্বিবাদ । কিন্তু এ নিয়মেরও ব্যতিক্রম আছে ।


10.1) আত্মরক্ষা



চারিদিকে দুর্ভিক্ষ হইবার দরুণ, মূল্য দিয়া, মজুরী করিয়া, কিংবা ভিক্ষা করিয়াও অন্ন সংগ্ৰহ হইতেছে না, এইরূপ বিপত্তি উপস্থিত হইলে পর, যদি কেহ চুরি করিয়া আত্মরক্ষা করিবে মনে করে, তাহাকে কি পাপী ঠাওরাইবে ? বারো বৎসর ধরিয়া অকাল পড়ায়, বিশ্বামিত্রের নিকট এইরূপ এক কঠিন সমস্যা উপস্থিত হয়; এই বিপত্তিকালে, চণ্ডালের ঘরের কুকুরমাংসের ঠ্যাং চুরি করিয়া সেই অভক্ষ্য অন্নে স্বীয় প্রাণ বাঁচাইবার প্রবৃত্তি তাঁহার হইয়াছিল, এইরূপ মহাভারতে আছে [শাং|১৪১] ৷ “পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ” [মনু|৫|১৮ দেখ] প্ৰভৃতি বহু শাস্ত্রার্থের ব্যাখ্যা করিয়া অভক্ষ্য ভক্ষণ, আর তাহাও চুরি করিয়া ভক্ষণ, না করিবার জন্য, শান্ত্রপ্রমাণের উপর ভর করিয়া অনেক উপদেশ উক্ত চণ্ডাল বিশ্বামিত্রকে দিয়াছিল । (কুকুর, বানর প্রভৃতি যে সকল প্রাণীয় ৫টা করিয়া নখ আছে, সেই সকল প্ৰাণীর মধ্যে যাদের গায়ে কণ্টক আছে সেই সজারু, শল্লক (সজারুর এক জাত), গোধা, কূর্ম, শশক – এই পাঁচ প্রাণীর মাংস ভক্ষ্য – এইরূপ মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন [মনু|৫|১৮; যাজ্ঞ|১|১৭৭] । ইহা ব্যতীত মনু খড়্গ অর্থাৎ গণ্ডারেরও উল্লেখ করিয়াছেন । কিন্তু সে বিষয়ে বিকল্প আছে – এইরূপ টীকাকার বলেন । এই বিকল্প ছাড়িয়া দিলে, পাঁচ প্রাণীই থাকিয়া যায় এবং তাহাদের মাংসই ভক্ষ্য – এইরূপ ‘পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ’র অর্থ । তথাপি মাংস পাইবার যাহার প্রতি অনুমতি আছে সে উল্লিখিত প্রাণীর মাংস ছাড়া অপর পাঁচনখী প্রাণীর মাংস খাইবেক না, এইটুকু মাত্র বলা হইয়াছে, উহাদের মাংস খাইবেই এরূপ বিধান নাই, - মীমাংসক ইহার এইরূপ অর্থ করেন; এই পারিভাষিক অর্থকে তিনি “পরিসংখ্যা” এই নাম দিয়াছেন । “পঞ্চ পঞ্চনখা ভক্ষ্যাঃ” – ইহাই এই পরিসংখ্যার মুখ্য উদাহরণ । মাংস খাওয়াটাই যদি নিষিদ্ধ বলিয়া মানিতে হয়, তাহা হইলে উহাদের মাংস খাওয়াও নিষিদ্ধ হইতেছে ।)
কিন্তু -
পিবন্ত্যেবোদকং গাবো মণ্ডুকেষু রুবৎস্বপি ৷
ন তেহধিকারো ধর্মেহস্তি মা ভূরাত্মপ্রশংসকঃ ॥
“ওরে ! ভেকেরা ডাকিলেও গাভীরা জল পান করিতে ছাড়ে না; চুপ কর ! আমাকে ধর্ম শেখাবার তোর অধিকার নাই, মিছামিছি বড়াই করিস নে” এই কথা বলিয়া বিশ্বামিত্ৰ তাহা অবজ্ঞা করিয়াছেন । বিশ্বামিত্ৰ বলিয়াছেন - “জীবিতং মরণাৎ শ্ৰেয়ো জীবন্ধৰ্মমবাপ্নুয়াৎ” - “বাঁচিলে তবে ধর্ম লাভ হয়, অতএব জীবন মরণাপেক্ষা শ্ৰেয়” । কেবল বিশ্বামিত্ৰ নহে, এই প্রসঙ্গে অজীগর্ত, বামদেব প্রভৃতি অপর অনেক ঋষিও এইরূপ আচরণ করিয়াছিলেন বলিয়া মনু উদাহরণ দিয়াছেন [মনু|১০|১০৫-১০৮] । হব্‌স্‌ নামক ইংরেজ গ্রন্থকার আপনি গ্রন্থে এইরূপ বলেন যে, “দুর্ভিক্ষের সময়, মূল্য দিয়া বা ভিক্ষার দ্বারা অন্ন সংগ্ৰহ করিতে না পারিয়া যদি কেহ পেটের দায়ে চুরি বা ডাকাতি করে তবে তাহার সে অপরাধ সর্বথা মার্জনীয় ।” (Hobbes’ “Leviathan”, Part II, Chap. XXVII, P.139, Mörley's Universal Library Edition). মিল্‌ও লিখিয়াছেন যে এই প্রকার অবস্থায় চুরি করিয়াও আপনার প্রাণ রক্ষা করা মানুষের কর্তব্য । (Mill’s “Utilitariamism”, Chap.V, P.95, 15th ed. – “Thus, to save a life, it may not only be allowable but a duty to steal &c.”).


11) ‘মৃত্যু অপেক্ষা বাঁচিয়া থাকা শ্রেয়স্কর’ ইহার অপবাদ



“মরণ অপেক্ষা জীবন শ্ৰেয়” বিশ্বামিত্রের এই তত্ত্বটি কি সর্বথা অব্যভিচারী নয় ? এই জগতে কেবল বাঁচিয়া থাকাটাই কিছু পুরুষাৰ্থ নহে । বলি খাইয়া কাকেরাও অনেক বৎসর বাচিয়া থাকে । তাই, বীরপত্নী বিদুলা আপন পুত্রকে এইরূপ বলিয়াছেন যে, শয্যার উপর জড়বৎ পড়িয়া থাকা অপেক্ষা, মুহুর্তকালের জন্য জলিয়া উঠাও শ্ৰেয় - “মুহূৰ্ত্তং জ্বলিতং শ্রেয়ো ন চ ধূমায়িতং চিরং” [মভা|উ|১৩২|১৫] । আজ নহে কাল, অন্তত শত বৎসরের পরে মৃত্যু নিশ্চিত, ইহাই যদি সত্য হয় [ভাগ|১০|১|৩৮; গী|২|২৭] তাহার জন্য ভয় বা কান্না কেন ? অধ্যাত্মশাস্ত্রানুসারে আত্মা নিত্য ও অমর । তাই, মৃত্যুর বিচার করিবার সময়, প্রারব্ধ কর্মানুসারে প্রাপ্ত যে শরীর সেই শরীরের কি হয় - এই প্রশ্নটায় মীমাংসা বাকী থাকিয়া যায় । চলা-বলা করিতেছে এই যে শরীর ইহা নশ্বর, কিন্তু আত্মার কল্যাণার্থ যাহা কিছু এ জগতে করিবার আছে, এই শরীরই তাহার একমাত্র সাধন; তাই মনুও বলিয়াছেন, - “আত্মানং সততং রক্ষেৎ দারৈরপি ধনৈরপি” ধন, দারা প্রভৃতির দ্বারা আপনাকে সতত রক্ষা করিবে [মনু|৭২১৩] । এই মানবদেহ দুর্লভ ও নশ্বর হইলেও তাহা বিসর্জন করিয়া যদি তাহা অপেক্ষা অধিক শাশ্বত কোন বস্তু কখন লাভ করিতে হয়, তখন দৃষ্টান্ত প্রদর্শনের জন্য, দেশের জন্য, ধর্মের জন্য, সত্যের জন্য, আপন ব্যবসায়, ব্ৰত, কিংবা দাবী বজায় রাখিবার জন্য; মানের জন্য, যশের জন্য অথবা সর্বভূতের হিতের জন্য অনেক মহাত্মাই অনেক সময়ে এই তীব্ৰ কর্তব্যবহ্নিতে আপনার প্রাণকেও আনন্দের সহিত আহুতি দিয়াছেন । বশিষ্ঠের ধেনুকে সিংহ হইতে রক্ষা করিবার মানসে সিংহের নিকট আপন দেহকে বলি দিবার জন্য প্ৰস্তুত দিলীপ - “আমার ন্যায় পুরুষদিগের পাঞ্চভৌতিক শরীর সম্বন্ধে অনাস্থা হইয়া থাকে, এইজন্য তুই আমার জড় শরীর অপেক্ষা আমার যশঃ-শরীরের দিকে চাহিয়া দেখ্‌” [রঘু|২|৫৭], এই কথা সিংহকে বলিয়াছিলেন, রঘুবংশে আছে; সৰ্পের প্রাণ বাঁচাইবার জন্য গরুড়কে জীমূতবাহনের স্বীয় দেহ অৰ্পণ করিবার কথা কথাসরিৎসাগরে ও নাগানন্দ নাটকে বর্ণিত হইয়াছে । মৃচ্ছকটিক নাটকে [১০|২৭] চারুদত্ত এইরূপ বলিতেছেন :-
ন ভীতো মরণাদস্মি কেবলং দুষিতং যশঃ ৷
বিশুদ্ধস্য হি মে মৃত্যুঃ পুত্ৰজন্মসমঃ কিল ॥
“আমি মরণে ভীত নহি; কেবল যশ দুষিত হইয়াছে এই জন্যই আমি দুঃখিত । বিশুদ্ধ থাকিয়া আমার যে মৃত্যু, তাহা নিশ্চয়ই আমার পক্ষে পুত্ৰজন্মজন্য উৎসবের তুল্য ।” এই তত্ত্বের উপরে শিবি রাজা, শরণাগত কপোতের রক্ষণার্থ শ্যেন পক্ষীর রূপধারী উক্ত কপোতের অনুধাবক ধর্মকে নিজ শরীরের মাংস কাটিয়া দিয়াছিলেন । দেবতাদিগের শত্রু যে বৃত্ৰাসুর, তাহাকে মারিবার জন্য দধীচি ঋষির অস্থি হইতে এক বজ্র করিবার কথা হইল । তখন সকল দেবতারা উক্ত ঋষির নিকট গিয়া “শরীরত্যাগং লোকহিতাৰ্থং ভবান্‌ কর্তুম্‌ অর্হতি” - “মহর্ষি, সর্বলোকের কল্যাণার্থ আপনার দেহত্যাগ করা কর্তব্য” এইরূপ তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিলে পর, দধীচি ঋষি পরমানন্দে প্ৰাণত্যাগ করিলেন এবং দেবতাদিগকে আপন অস্থি দান করিলেন । এই কাহিনীটি মহাভারতের বনপর্বে ও শান্তিপর্বে প্রদত্ত হইয়াছে [বন|১০০, ১৩১; শাং|৩৪২] । কর্ণের জন্মের সঙ্গে সহজাত কবচ ও কুণ্ডল হরণ করিবার জন্য ইন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণের রূপ ধারণ করিয়া দানশূর কর্ণের নিকট ভিক্ষা মাগিতে আসিবেন জানিতে পারিয়া, উক্ত কবচ-কুণ্ডল কাহাকে দান না করা হয়, সুৰ্য পূর্ব হইতেই তাহাকে ইঙ্গিতে জানাইয়া দিলেন এবং এইরূপ আদেশ করিলেন যে, “তুই দানশূর বলিয়া যদিও তোর কীর্তি আছে, তথাপি কবচ-কুণ্ডল দান করিলে তোর প্রাণ সংশয় হইবে অতএব উহা কাহাকেও দিবি না ।” কারণ মরিয়া গেলে কীর্তি কি কাজে লাগিবে ? মৃতস্য কীর্তা কিং কাৰ্য্যং’ ? সূর্যের এই কথা শুনিয়া - “জীবিতেনাপি মে রক্ষ্যা কীর্তিস্তৎবিদ্ধি মে ব্ৰতম্” - প্ৰাণ গেলেও কীর্তি রক্ষা করিতে হইবে, ইহাই আমার ব্ৰত জানিবে, কৰ্ণ তাঁহাকে এইরূপ স্পষ্ট জবাব দিয়াছিলেন [মভা|বন|২৯৯|৩৮] । সারকথা এই যে, মরিলে স্বর্গে যাইবে এবং বাঁচিয়া থাকিলে পৃথিবী ভোগ করিবে ইত্যাদি ক্ষাত্ৰধর্ম [গী|২|৩৭] এবং “স্বধর্মে নিধনং শ্ৰেয়ঃ” [গী|৩|৩৮] এই সিদ্ধান্ত ঐ তত্ত্বকেই অবলম্বন করিয়া আছে; এবং তাহার অনুসরণ করিয়াই শ্ৰীসমর্থ রামদাস স্বামী বলিয়াছৈন - “কীর্তি পাহোঁ, জাতাঁ সুখ নাহি । সুখ পাহ তাঁ কীর্তি নাহি ॥” কীর্তি দেখিয়া চলিলে সুখ নাই, সুখ দেখিলে কীর্তি নাই” । [দাস|১২|১০|১৯; ১৮|১০২৫] । আরও বলিয়াছেন - “দেহ ত্যাগিতাঁ কীর্তি মাগে উরাবী । মনা সজ্জনা হেচি ক্রিয়া করাবী ॥” দেহ ত্যাগ করিবার সময় কীর্তি সম্মুখে রাখিবে, রে মন ! সজ্জনদিগের এইরূপই আচরণ জানিবে ।” কিন্তু পরোপকারের দ্বারা কীর্তি অর্জিত হয় এ কথা সত্য হইলেও, মরিয়া গেলে কীর্তি কি কাজে লাগিবে ? অথবা মানী পুরুষের অপকীর্তি অপেক্ষা প্রাণত্যাগ করা [গী|২|৩৪], কিংবা জীবন অপেক্ষা পরোপকার করা অধিকতর প্রিয় - কেন মনে করিবে ? এই প্রশ্নের যোগ্য উত্তর দিতে হইলে, আত্ম-অনাত্মবিচারক্ষেত্রে প্রবেশ ভিন্ন দ্বিতীয় উপায় নাই । এবং ইহারই সঙ্গে কর্ম অকর্ম শাস্ত্রেরও বিচার করিয়া জানা উচিত যে, কোন্‌ প্রসঙ্গে প্ৰাণ বিসর্জন করিতে প্ৰস্তুত হওয়া উচিত এবং কোন্‌ প্রসঙ্গে অনুচিত । নচেৎ, প্ৰাণ বিসর্জনের কারণে যশোলাভ দূরের কথা, মূর্খতা করিয়া আত্মহত্যা করিবার পাপে লিপ্ত হইবার সম্ভাবনা আসে ।


12) মাতা, পিতা, গুরু প্রভৃতি পূজ্য পুরুষদের সম্বন্ধে কর্তব্য ও তাহার অপবাদ



মাতা, পিতা, গুরু প্ৰভৃতি বন্দ্য ও পূজ্য পুরুষদিগকে দেবতার ন্যায় পূজা ও সেবা করা - ইহাও সাধারণ ও সর্বমান্য ধর্মসমূহের মধ্যে এক প্রধানধর্ম বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে । কারণ, সেরূপ না হইলে, কুটুম্বদিগের, গুরুকুলের কিংবা সমস্ত সমাজেরও ঠিক ব্যবস্থা কখনই থাকিতে পারে না । তাই, শুধু স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতে নহে, উপনিষদেও “সত্যং বদ ধৰ্ম্মং চর” এইরূপ বলিয়া তাহার পর আছে “মাতৃদেবো ভব । পিতৃদেবো ভব । আচার্যদেবো ভব ।” অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করিয়া গৃহে ফিরিবার মুখে প্ৰত্যেক গুরু শিষ্যকে এইরূপ উপদেশ করিতেন, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [তৈ|১|১১|১ ও ২] এবং মহাভারতের ব্ৰাহ্মণব্যাধ আখ্যানেরও ইহাই তাৎপৰ্য [বন|অ|২১৩] । কিন্তু এই ধর্মেও কতকগুলি অকল্পিত, কঠিন সমস্যা উপস্থিত হইয়া থাকে -
উপাধ্যায়ান্দশাচাৰ্য্যঃ আচাৰ্য্যাণাং শতং পিতা ৷
সহস্রং তু পিতুৰ্ম্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে ॥
অর্থাৎ “দশ উপাধ্যায় অপেক্ষা আচার্য, শত আচার্য অপেক্ষা পিতা ও সহস্ৰ পিতা অপেক্ষা মাতা গৌরবে অধিক” এইরূপ মনু বলেন [২|১৪৫] । তথাপি মাতা এক গুরুতর অপরাধ করিয়াছিলেন বলিয়া পিতার আদেশক্রমে পরশুরাম তাঁহার কণ্ঠচ্ছেদ করেন, এই কথা প্ৰসিদ্ধ আছে [বন|১১৬-১৪]; এবং শান্তিপর্বে চিরকারিকোপাখ্যানে [শাং|২৬৫] এই প্রকারের আর এক প্রসঙ্গে, পিতার আজ্ঞানুসারে মাতাকে বধ করা শ্ৰেয়স্কর কিংবা পিতার আজ্ঞা লঙ্ঘন করা শ্ৰেয়স্কর - অনেক সাধক-বাধক প্ৰমাণ দিয়া এক স্বতন্ত্র অধ্যায়ে এই বিষয়ের সবিস্তার বিচার করা হইয়াছে । এইরূপ সূক্ষ্ম প্রসঙ্গসমূহের নীতিশাস্ত্রদৃষ্টিতে মীমাংসা করিবার প্রথা মহাভারতের কালে পূর্ণরূপে প্রচলিত ছিল, এইরূপ স্পষ্ট দেখা যায় । পিতার প্রতিজ্ঞা সত্য করিবার জন্য তাঁহার আদেশে রামচন্দ্ৰের চৌদ্দ বৎসর বনবাস স্বীকার করিবার কথা আবালবৃদ্ধ সকলেই অবগত আছে । কিন্তু উপরে মাতা সম্বন্ধে যে নীতি কথিত হইল, তাহা পিতার সম্বন্ধেও কখন, কখন প্ৰযুক্ত হইবার অবসর আসিতে পারে । তাহার উদাহরণ যথা - পুত্র আপন পরাক্ৰমে রাজা হইলে পর, তাহার পিতা অপরাধী হইয়া বিচার-নিষ্পত্তির জন্য তাহার সম্মুখে উপনীত হইল; তখন রাজা এই সূত্রে তাহার বাপকে শাসন করিবে কিংবা বাপ বলিয়া ছাড়িয়া দিবে ? মনু বলেন :-
পিতাচাৰ্য্যঃ সুহৃন্মাতা ভাৰ্য্যা পুত্ৰঃ পুরোহিতঃ ৷
নাদণ্ড্যো নাম রাজ্ঞোহস্তি যঃ স্বধর্মে নাতিষ্ঠতি ॥
অর্থাৎ - “পিতা, আচার্য, মিত্র, মাতা, পত্নী, পুত্র কিংবা পুরোহিত যেই হউক না কেন, যদি সে আপন ধর্ম অনুসারে আচরণ না করে, তবে সে অদণ্ড্য নহে, অর্থাৎ উচিত শাসন করা রাজার কর্তব্য” [মনু|৮|৩৩৫; মভা|শাং|১২১|৬০] । কারণ, এইস্থলে পুত্ৰধর্মাপেক্ষা রাজধর্মের ঔচিত্য অধিক । এই নীতি অনুসারে মহাপরাক্রমী সূর্যবংশীয় সগর রাজা, আপনি দুরাচারী পুত্ৰ অসমঞ্জস প্ৰজাবৰ্গকে কষ্ট দিতেছে দেখিয়া তাহাকে রাজ্য হইতে নিৰ্বাসিত করিলেন, এইরূপ মহাভারত ও রামায়ণ এই দুই গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে [মভা|ব|১০৭; রামা|১|৩৮]  মনুস্মৃতিতেও এইরূপ এক কথা আছে যে, আঙ্গিরস নামে এক ঋষির অল্প বয়সে উত্তম জ্ঞানলাভ হওয়ায় তাহার কাকা, মামা প্ৰভৃতি গুরুজনেরা তাহার নিকট অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন; অধ্যয়নের সময় শিষ্যকে গুরু প্রায়ই যে ভাবে বলিয়া থাকেন সেইভাবে কোন এক প্রসঙ্গে আঙ্গিরসের মুখ হইতে তাঁহাদিগের উদ্দেশে “পুত্ৰগণ” এই শব্দটা সহজভাবে মুখ হইতে বাহির হইয়া পড়িল - “পুত্ৰক ইতি হোবাচ জ্ঞানেন পরিগৃহ্য তান্‌ ।” কিন্তু কি জিজ্ঞাসা করিতেছ ? সেই সকল বৃদ্ধেরা অতিশয় রুষ্ট হইয়া, “ছোঁড়াটার ভারী দেমাক্‌ হইয়াছে” ঠাওরাইলেন; এবং তাহার যাহাতে সমুচিত শাসন হয়, এই নিমিত্ত দেবতাদিগের নিকট নালিস করিলেন । দেবতারা উভয় পক্ষের কথা শুনিয়া “আঙ্গিরস তোমাদিগকে যাহা বলিয়াছে তাহা ন্যায্য” - এইরূপ বিচারনিষ্পত্তি করিলেন । কারণ -
ন তেন বৃদ্ধো ভবতি যেনাস্য পলিতং শিরঃ ৷
যো বৈ যুবাপ্যধীয়ানস্তং দেবাঃ স্থবিরং বিদ্যুঃ ॥
অর্থাৎ চুল পাকিলেই কোন মনুষ্য বৃদ্ধ হয় না, যুবা হইয়াও যে অধীয়ান্‌ তাহাকেই দেবতারা বৃদ্ধ বলিয়া জানেন” [মনু|২|১৫৬; সেইরূপ মভা|বন|১৩৩|১১; শল্য|৫১|৪৭ দেখ] । শুধু মনু ও ব্যাস নহে, বুদ্ধদেবও এই তত্ত্ব মান্য করিয়াছিলেন । কারণ, মনুসংহিতার উপরি-উক্ত শ্লোকের প্রথম চরণ অক্ষরশঃ ‘ধম্মপদ’ নামে প্ৰসিদ্ধ নীতিবিষয়ক বৌদ্ধ পালি গ্রন্থে আছে [ধম্মপদ|২৬০] । পরে ঐ গ্রন্থে, - “কেবল বয়সেই যে পরিপক্ক হইয়াছে তাহার জীবন ব্যর্থ এবং প্রকৃত ধার্মিক ও বৃদ্ধ হইতে হইলে, অহিংসা ইত্যাদি সদ্‌গুণ থাকা নিতান্তই আবশ্যক” এইরূপ কথিত হইয়াছে । (‘ধম্মপদ’ গ্রন্থের ভাষান্তর “Sacred Books of the East” (প্রাচ্য ধর্মপুস্তকমালা) Vol. X এ করা হইয়াছে; চুল্লবগ্‌গের ইংরেজী ভাষান্তর ঐ মালার Vol XVII ও XX এ প্রকাশিত হইয়াছে । মারাঠীতেও, রা,রা, যাদব রাও বার্বাকর ধম্মপদের ভাষান্তর করিয়াছেন - তাহা কোহ্লাপুরের গ্রন্থমালায় ও পরে পুস্তকাকারে ছাপা হইয়াছে । ধম্মপদেয় পালি শ্লোকটী নিম্নে দিতেছি :-
ন তেন থেরো হোতি যেনস্‌স পলিতং সিরো ৷
পরিপক্কো বয়ো তস্‌স মোঘজিন্নো তি বুচ্চতি ॥
“থের” এই শব্দ বৌদ্ধ ভিক্ষুর সম্বন্ধে প্রযুক্ত হয়, উহা সংস্কৃত ‘স্থবিরের’ অপভ্রংশ ।)

এবং ‘চুল্লবগ্‌গ’ নামক অপর গ্রন্থে, ধর্মনিদর্শনকারী ভিক্ষু তরুণবয়স্ক হইলেও স্বয়ং উচ্চ আসনে বসিয়া, আপনার পূর্বে দীক্ষিত বয়োবৃদ্ধ ভিক্ষুকে ধর্মোপদেশ করিবে, এইরূপ বৃদ্ধেরা অনুমতি দিয়াছেন [চুল্লবগ্যা|৬|১৩|১ দেখ]প্ৰহ্লাদ আপন পিতা হিরণ্যকশিপুকে অবজ্ঞা করিয়া ভগবানকে কিরূপে লাভ করিয়াছিলেন, সেই পৌরাণিক কথা সর্ববিশ্রুত আছে । এই সকল হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, সময়ে সময়ে যখন পিতাপুত্রের সর্বমান্য সম্বন্ধ অপেক্ষা গুরুতর অপর কোন সম্বন্ধ উপস্থিত হয়, তখন পিতাপুত্রেরও সম্বন্ধ ক্ষণকালের জন্য ভুলিয়া যাইতে হয় । কিন্তু এইরূপ অবসর উপস্থিত না হইলেও, এই নিয়ম অবলম্বন করিয়া কোন ছোট ছেলে আপনি বাপকে যদি গালি দেয়, তবে আমরা সেই ছেলেকে পশুর মধ্যে গণনা করি না কি ? “গুরুর্গরীয়ান্‌ পিতৃতো মাতৃতশ্চেতি মে মতিঃ” [শাং|১০৮|১৭] মা বাপ অপেক্ষা গুরু শ্রেষ্ঠ - এইরূপ ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলিয়াছেন । কিন্তু “মরুত্ত” রাজার গুরু লোভবশ হইয়া স্বার্থের জন্য তাঁহাকে ত্যাগ করিলে পর -
গুরোরপ্যবলিপ্তস্য কাৰ্য্যাকাৰ্য্যমজানতঃ ৷
উৎপথপ্ৰতিপন্নস্য ন্যায্যং ভবতি শাসনম্‌ ॥
“কার্যাকাৰ্য জ্ঞানরহিত ও আপন দোষে উন্মাৰ্গগামী গুরুকেও শাসন করা ন্যায়সঙ্গত” এইরূপ উচ্ছ্বাসবাক্য মরুত্ত বাহির করিয়াছিলেন, এইরূপ মহাভারতে কথিত হইয়াছে । মহাভারতের এই শ্লোক চারি স্থানে লিখিত হইয়াছে [মভা|আ|১৪২|৫২|৩; উ|১৭৯|২৪; ৫৭|৭; ১৪০|৪৮] । তন্মধ্যে প্ৰথম স্থলের পাঠ উপরে লিখিত হইয়াছে; অন্যান্য স্থলে চতুর্থ চরণের পরিবর্তে “দণ্ডো ভবতি শাশ্বতঃ” কিংবা “পরিত্যাগো বিধীয়তে” – এইরূপ পাঠান্তর আছে । কিন্তু বাল্মীকিরামায়ণের যে স্থানে [রামা|২|২১|১৩] এই শ্লোকটি আছে সেখানে একই অর্থাৎ উপরি-উক্ত পাঠই পাওয়া যায় বলিয়া আমি তাহাই এই গ্রন্থে মানিয়া লইয়াছি । ভীষ্ম পরশুরামের সহিত এবং অর্জুন দ্রোণের সহিত যে যুদ্ধ করিয়াছিলেন তাহা এই তত্ত্বেরই বনিয়াদে হইয়াছিল । হিরণ্যকশিপু কর্তৃক নিয়োজিত প্ৰহ্লাদের গুরু যখন প্ৰহ্লাদকে ভগবৎপ্ৰাপ্তির বিরুদ্ধ উপদেশ দিতে আরম্ভ করিলেন তখন এই তত্ত্বের বনিয়াদেই প্ৰহ্লাদ তাহাকে নিষেধ করেন । শান্তিপর্বে ভীষ্ম স্বয়ংই শ্ৰীকৃষ্ণকে বলিতেছেন যে, গুরুলোক পূজ্য সত্য; কিন্তু তাঁহাদেরও নীতির মর্যাদা পালন করা কর্তব্য; নচেৎ
সময়ত্যাগিনো লুব্ধান্‌ গুরূনপি চ কেশব ৷
নিহন্তি সমরে পাপান্‌ ক্ষত্ৰিয়ঃ স হি ধর্মবিৎ ॥
হে কেশব, মর্যাদা, নীতি, কিংবা শিষ্টাচার যাহারা পালন করে না সেই লোভী ও পাপিষ্ঠ লোকেরা গুরু হইলেও, যে ক্ষত্ৰিয় যুদ্ধে তাহাদিগকে বধ করে সে, ধর্মজ্ঞ ।” [শাং|৫৫|১৬] । সেইরূপ, তৈত্তিয়ীয়োপনিষদেও “আচাৰ্য্যদেবো ভব” এইরূপ প্ৰথম বলিয়া তাহারই ঠিক পরে “আমাদের যে সকল আচরণ ভাল তাহারই অনুকরণ করিবে, অন্য আচরণ পরিত্যাগ করিবে” - “যান্যস্মাকং সুচরিতানি তানি ত্বয়োপাস্যানি । নো ইতরাণি ৷” - এইরূপ উক্ত হইয়াছে [তৈ|১|১১|২] । ইহা হইতে পিতা কিংবা আচার্য দেবতার সমান পূজনীয় হইলেও, যদি তাঁহারা সুরা পান করেন তথাপি তুমি সুরা পান করিবে না, কারণ নীতির মর্যাদার ও ধর্মের অধিকার, পিতামাতা, গুরু প্ৰভৃতির অপেক্ষা অধিকতর বলবান, ইহাই উপনিষদের সিদ্ধান্ত বলিয়া স্পষ্ট উপলব্ধি হয় । “ধর্ম পালন কর, ধর্মকে যে নাশ করে অর্থাৎ ত্যাগ করে, ধর্ম তাহাকে নাশ না করিয়া ক্ষান্ত হয় না,” মনু এইরূপ যে বিধান করিয়াছেন, তাহারও অন্তর্নিহিত বীজ ইহাই [মনু|৮|১৪-১৬]  । রাজা তো গুরু অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ – একরূপ দেবতা [মনু|৭|৮ ও মভা|শাং|৬৮|৪০] । কিন্তু তাঁহাকেও ধর্ম ছাড়ে না, ছাড়িলে তিনিও বিনাশ প্ৰাপ্ত হন এইরূপ মনুস্মৃতিতে উক্ত হইয়াছে । মহাভারতে বেনখনীনেত্র এই দুই রাজার আখ্যানে এই অর্থই ব্যক্ত হইয়াছে [মনু|৭|৪১ ও ৮|১২৮; মভা|শাং|৫৯|৯২-১০০ ও অশ্ব|৪ দেখ]


13) কাম, ক্রোধ ও লোভের নিগ্রহের তারতম্য



অহিংসা, সত্য ও অস্তেয় - ইহাদের ন্যায় ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহও সাধারণ ধর্মের মধ্যে পরিগণিত হইয়া থাকে [মনু|১০|৬৩] । কাম, ক্ৰোধ, লোভ প্রভৃতি মনুষ্যের শত্রু হওয়ায়, মানব উহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে জয় করিতে না পারিলে তাহার কিংবা সমাজের কল্যাণ হয় না, এইরূপ উপদেশ সকল শাস্ত্ৰেই আছে । বিদুরনীতি এবং ভগবদ্গীতাতেও এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে -
ত্ৰিবিধং নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ ৷
কামঃ ক্ৰোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতৎ ত্রয়ং ত্যজোৎ ॥
“কাম, ক্রোধ ও লোভ এই তিন নরকের দ্বার ও আত্মবিনাশের সাধক হওয়ায় উহাদিগকে ত্যাগ করিবেক” [গীতা১৬|২১; মভা|উ|৩২|৭০] । কিন্তু গীতাতেই ভগবান্‌ “ধর্মাবিরুদ্ধো ভুতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভ” - হে অর্জুন, প্ৰাণীদিগের মধ্যে, ধর্মের অবিরুদ্ধ যে কাম সে আমিই [গীতা|৭|১১] এইরূপে আপন স্বরূপের বর্ণনা করিয়াছেন । ইহা হইতে ধর্মের বিরুদ্ধ যে কাম তাহাই নরকের দ্বার, উহা ব্যতীত অন্য প্রকারের কাম ভগবানের নিকট মান্য, ইহাই প্ৰতিপন্ন হইতেছে । মনুও বলিয়াছেন যে “পরিত্যজেদর্থকামৌ যৌ স্যাতাং ধর্মবর্জিতৌ” - অৰ্থাৎ ধর্মবর্জিত যে অর্থ-কাম তাহাই পরিত্যাগ করিবে [মনু|৪|১৭৬] । সকল প্ৰাণী যদি কল্য অবধি কাম-মহারাজকে একেবারে ছুটি দিয়া আমরণ ব্ৰহ্মচর্য ব্ৰত পালনের সঙ্কল্প করে, তাহা হইলে ৫০ বৎসর কিংবা খুববেশী ১০০ বৎসরের মধ্যেই জীবসৃষ্টির লয় হইয়া সমস্ত নিস্তব্ধ হইয়া যাইবে । এবং যে সৃষ্টি উৎসন্ন না হয় বলিয়া বারবার ভগবান্‌ অবতার ধারণ করেন, স্বল্পকালের মধ্যেই সেই স্থষ্টির উচ্ছেদ হইয়া যাইবে । কাম ও ক্ৰোধ এ দুই শত্রু বটে, কিন্তু কখন ? যখন সংযত না থাকে তখনই । সৃষ্টির ক্রমগতির উচিত সীমার মধ্যে উহাদিগের বিশেষ প্রয়োজন আছে, ইহা মনু প্ৰভৃতি শাস্ত্রকারদিগেরও সম্মত [মনু|৫|৫৬] । এই প্ৰবল দুই মনোবৃত্তিকে উচিত শাসনে রাখিলে, উহার দ্বারা সমস্ত স্বষ্টি বিধৃত হইয়া থাকে, বিনষ্ট হয় না । ভাগবতে আছে -
লোকে ব্যবায়ামিষমদ্যসেবা নিত্যাস্তি জন্তোর্নহি তত্ৰ চোদনা ৷
ব্যবস্থিতিস্তেষু বিবাহযজ্ঞসুরাগ্রহৈরাসু নিবৃত্তিরিষ্টা ॥
“এই জগতে, মৈথুন, মাংস ও মদ্য সেবন কর বলিয়া কাহাকেও বলিতে হয় না; উহা মনুষ্যের স্বাভাবিক । এই তিনের কোন প্ৰকার ব্যবস্থা করিবে অর্থাৎ উহাদিগকে সীমার মধ্যে রাখিয়া, সংযত করিয়া, সুব্যবস্থিত কৱিবে; এই কারণেই, বিবাহ, সোমযাগ ও সৌত্ৰামনী যজ্ঞ - শাস্ত্রকারেরা যথানুক্ৰমে ইহাদের যোজনা করিয়াছেন । কিন্তু তাহাতেও নিবৃত্তি অর্থাৎ নিষ্কাম আচরণই ইষ্ট হয়” - এইরূপ ভাগবতে উক্ত হইয়াছে [ভাগ|১১|৫|১১] । ‘নিবৃত্তি’ এই শব্দের, পঞ্চমী-অন্ত পদের সহিত সম্বন্ধ থাকিলে “অমুক হইতে নিবৃত্তি অর্থাৎ অমুক কর্ম সর্বথা ত্যাগ করা” এইরূপ অর্থ হয়; তথাপি কর্মযোগে ‘নিবৃত্ত’ এই বিশেষণ কর্মের সম্বন্ধেই প্ৰযুক্ত হওয়ায় ‘নিবৃত্তকর্ম’ অর্থাৎ নিষ্কাম বুদ্ধিতে কৃত কর্ম - এইরূপ এই পদের অর্থ ইহা যেন এখানে মনে রাখা হয় । ঐরূপ অর্থ মনুস্মৃতি ও ভাগবত পুরাণে স্পষ্টরূপে প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|১২|৮৯; ভাগ|১১|১০|১ ও ৭|১৫|৪৭ দেখ] ক্ৰোধসম্বন্ধে ভারবি কিরাতকাব্যে এইরূপ বলিতেছেন -
অমর্ষশূন্যেন জনস্য জন্তুনা ন জাতহার্দেন ন বিদ্বিষাদরঃ ॥
অর্থাৎ — অবমানিত হইলেও যে পুরুষের ক্ৰোধ বা রাগ হয় না সে পুরুষের আদরই বা কি, দ্বেষই বা কি –দু ই সমান ! ক্ষাত্ৰধর্মানুসারে দেখিতে গেলে -
এতাবানেব পুরুষো যদমর্ষী যদক্ষমী ৷
ক্ষমাবান্নিরমর্ষশ্চ নৈব স্ত্রী ন পুনঃ পুমান্‌ ॥
অর্থাৎ - “অন্যায় দেখিলে যাহার রাগ হয়, অপমান যাহার অসহ্য হয় সেই পুরুষ; যাহার ক্ৰোধ হয় না, রাগ হয় না, সে স্ত্রীও নহে পুরুষও নহে” এইরূপ বিদুলা বিবৃত করিয়াছেন । [মভা|১৩২|৩৩] ৷ উপরে উক্ত হইয়াছে যে, জগতের ব্যবহারে সকল সময়ে ক্রোধ কিংবা তেজও উপযোগী নহে, সকল সময়ে ক্ষমাও উপযোগী নহে । লোভের সম্বন্ধেও এই কথা বলা যাইতে পারে; কারণ, সন্ন্যাসী হইলেও মোক্ষের বাসনা সে ত্যাগ করিতে পারে না ।


14) ধৈর্য আদি গুণের অবসর এবং দেশ-কাল আদি মর্যাদা



শৌৰ্য, ধৈর্য, দয়া, শীল, মৈত্রী, সমতা ইত্যাদি সমস্ত সদ্‌গুণ পরস্পর বিরোধের অতিরিক্ত দেশকালাদির দ্বারা মৰ্যাদাবদ্ধ হয়, ইহা ব্যাসদেব মহাভারতের অনেক স্থানে বিভিন্ন আখ্যানে প্রতিপাদন করিয়াছেন । যে কোন সদ্‌গুণই হউক না কেন, উহা সর্বপ্রসঙ্গেই উপযোগী হইবে এরূপ নহে । তর্ত্তৃহরি বলেন -
বিপদি ধৈৰ্য্যমথাভ্যুদয়ে ক্ষমা সদসি বাক্‌পটুতা যুধি বিক্রমঃ
অর্থাৎ “বিপদে ধৈর্য, অভ্যুদয়ে (অর্থাৎ শাসন করিবার ক্ষমতা থাকিবার সময়) ক্ষমা, সভায় বক্তৃতা-শক্তি ও যুদ্ধে শৌর্য - এই সকল সদ্‌গুণ” [নীতি|৬৩] । শান্তির সময় উত্তরের মত বড়্‌ বড়্‌ করিয়া বকিবার লোকের অভাব নাই । ঘরে বসিয়া স্ত্রীর উপর বীরত্ব ফলাইবার লোক অনেক আছে; তাহাদের মধ্যে রণাঙ্গনে প্ৰকৃত ধনুর্ধর বীর দুই একজনই বাহির হয় । ধৈর্যাদি গুণ উপরি-উক্ত সময়েই শোভা পায় । শুধু তাহাই নহে, এই প্রকারের প্রসঙ্গ ব্যতীত তাঁহাদের প্রকৃত পরীক্ষাও হয় না । ক্ষণেকের নর্মসুহৃৎ, অনেক থাকে; কিন্তু “নিকষগ্ৰাবা তু তেষাং বিপৎ” - সঙ্কটকালই তাহাদিগের পরীক্ষার প্রকৃত কষ্টিপাথর । ‘প্ৰসঙ্গ’ এই শব্দের ভিতর দেশকাল ব্যতীত পাত্ৰাপাত্ৰাদি বিষয়েরও সমাবেশ হয় । সমতা অপেক্ষা অন্য কোন গুণই শ্ৰেষ্ঠ নহে । ভগবদ্গীতা স্পষ্ট বলিয়াছেন যে “সমঃ সর্বেষু ভুতেষু - ইহা সিদ্ধপুরুষের লক্ষণ । কিন্তু সমতার অর্থ কি ? কোন ব্যক্তি যোগ্যতা অযোগ্যতার বিচার না করিয়া সকলকেই সমান দান করিতে থাকিলে আমরা তাহাকে বুদ্ধিমান বলিব, না নিৰ্বোধ বলিব ? ভগবদ্গীতাতেই এই প্রকার নির্ণয় করা হইয়াছে যে, “দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্বিকং বিদুঃ” - দেশ-কাল বিবেচনা করিয়া যে দান করা হয় তাহাই সাত্বিক দান [গীতা|১৭|২০] । কালের সীমা শুধু বৰ্তমান কাল পর্যন্তই, এরূপ নহে । কালের যেমন যেমন বদল হয়, সেই সঙ্গে ব্যবহারিক ধর্মেতেও পার্থক্য আসিয়া পড়ে, এবং তাহার দরুণ কোন প্রাচীনকালের বিষয়ের যোগ্যতা অযোগ্যতা সম্বন্ধে নির্ণয় করিতে হইলে, তৎকালীন ধর্মাধর্ম-সম্বন্ধীয় ধারণার বিচার করা নিতান্তই আবশ্যক হয় ।
অন্যে কৃতযুগে ধর্মান্ত্রেতায়াং দ্বাপরেহপরে ৷
অন্যে কলিযুগে নৃ ণাং যুগহাসানুরূপতঃ ॥


15) যুগানুসারে আচারের তারতম্য



“যুগ-মান অনুসারে কৃত ত্রেতা দ্বাপর ও কলি, ইহাদের ধর্মও ভিন্ন ভিন্ন হইয়া থাকে”, এইরূপ মনু [১|৮৫]ব্যাস বলিয়াছেন [মভা|শাং|২|৫৯|৮] । পূর্বকালে স্ত্রীলোকদিগের বিবাহের সীমা না থাকায় তাহারা এই বিষয়ে স্বতন্ত্র ও অসংযত ছিল; কিন্তু পরে এই আচারের দুষ্পরিণাম নজরে আসিলে পর, শ্বেতকেতু বিবাহের সীমা স্থাপন করিলেন [মভা|আ|১২২], এবং সুরাপান সম্বন্ধে নিষেধ শুক্রাচার্য প্রথম প্ৰবৰ্তিত করেন, এইরূপ কথা মহাভারতে বর্ণিত হইয়াছে [মভা|আ|৭৬] । সুতরাং এই নিয়ম যে সময়ে আমলে আসে নাই সেই সময়কার ধর্মাধর্ম ও তাহার পরবর্তীকালের ধর্মাধর্ম, ইহাদের নির্ণয় ভিন্ন রীতিতে করা অবশ্যক । সেই প্রকার বর্তমানকালের ধর্ম যদি পরে বদল হয় তবে সেই অনুসারে ভবিষ্যৎকালের ধর্মাধর্ম-বিবেচনাও বিভিন্ন ধরণে করা যাইবে । কালমান অনুসারে দেশাচার, কুলাচার ও জাতিধর্মেরও বিচার করা আবশ্যক, কারণ আচারই সর্বধর্মের মূল । তথাপি আচার-বিচারাদির মধ্যেও মিল থাকে না । পিতামহ ভীষ্ম বলিতেছেন -
ন হি সৰ্বহিতঃ কশ্চিদাচারঃ সংপ্ৰবর্ততে ৷
তেনৈবানাঃ প্ৰভাবতি সোৎপরং বাধতে পুনঃ ॥
“সকলের সকল সময়ে সমান হিতকর, এরূপ আচার দেখিতে পাওয়া যায় না । এক আচার যদি অবলম্বন কর, তার উপরেও উচ্চতর আচার আছে দেখা যায় এবং দ্বিতীয় আচার যদি গ্ৰহণ করা, তবে তাহা আবার তৃতীয় কোন আচারের বিরুদ্ধ হইয়া পড়ে” [শাং|২৫৮|১৭, ১৮] । যখন আচারসমূহের মধ্যে এত পার্থক্য, তখন ভীষ্মের উক্তি অনুসারে আচার-অনাচারও তারতম্য অথবা সার-অসার দৃষ্টিতে বিচার করা আবশ্যক ।


16) ধর্ম অধর্মের সূক্ষ্মতা



সে যাক্‌ । কর্মাকর্ম কিংবা ধর্মাধর্ম সংক্রান্ত সংসারের সমস্ত সমস্যা এইরূপে সমাধান করিতে বসিলে দ্বিতীয় মহাভারত লিখিতে হয় । গীতার আরম্ভে ক্ষাত্ৰধর্ম ও ভ্রাতৃপ্ৰেম এই দুয়ের মধ্যে যুঝাবুঝি করিয়া অর্জুনের ষে অবস্থা হইয়াছিল তাহা অ-লোকসাধারণ অবস্থা নহে; ঐরূপ অবস্থা সংসারে কর্তৃপুরুষদিগের ও মহাত্মা ব্যক্তিদিগের অনেক সময়ে উপস্থিত হইয়া থাকে । এইরূপ অবস্থা আসিলে পর যখন অহিংসা ও আত্মরক্ষণ, সত্য ও সর্বভূতহিত, দেহসংরক্ষণ ও যশ, এবং ভিন্ন ভিন্ন সম্বন্ধসূত্ৰে উপস্থিত কর্তব্যসমূহের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয় তখন শাস্ত্ৰোক্ত সাধারণ ও সর্বমান্য নীতিনিয়মের দ্বারা কর্মের বিভাগ না হওয়ায়, উহাদিগের অনেক অপবাদ বা ব্যতিক্রম উৎপন্ন হয়; এবং এইরূপ সংকটকালে সাধারণ মুনুষ্যের শুধু নহে, বড় বড় পণ্ডিতেরও কার্যাকাৰ্য-ব্যবস্থিতি, অর্থাৎ কর্তব্যাকর্তব্য ধর্মের নির্ণয় করিবার কোন স্থায়ী পদ্ধতি কিংবা যুক্তি আছে কি নাই, ইহা জানিবার ইচ্ছা স্বভাবতই হইয়া থাকে । এই সকল বিষয়ের প্রতি পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করিবার জন্য উপরিলিখিত বিচার আলোচনা করা হইয়াছে । দুর্ভিক্ষের মত সঙ্কটকালে ‘আপদ্ধর্ম’ বলিয়া শাস্ত্ৰে কতকগুলি সুবিধার কথা বলা হইয়াছে সত্য । দৃষ্টান্ত যথা - আপৎকালে ব্ৰাহ্মণ যে-কোন স্থানেই অন্ন গ্ৰহণ করুক না কেন, তাহাতে দোষ বর্তে না এইরূপ স্মৃতিকারেরা বলিয়াছেন । উষস্তি-চাক্রায়ণ এই প্রকার আচরণ করিয়াছিলেন বলিয়া ছান্দোগ্য উপনিষদে কথিত হইয়াছে [যাজ্ঞ|৩|৪১; ছাং|১|১০] । কিন্তু ঐ প্রসঙ্গ ও উপরোক্ত প্রসঙ্গ, এই দুয়ের মধ্যে অনেক প্ৰভেদ আছে । দুর্ভিক্ষের মত আপৎকালে শাস্ত্ৰধর্ম ও ক্ষুধা তৃষ্ণা প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বৃত্তি, ইহাঁদের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়া ইন্দ্রিয়গণ একদিকে ও শাস্ত্রধর্ম অন্যদিকে টানিয়া থাকে । কিন্তু উপরে যে সকল সমস্যা উল্লিখিত হইয়াছে, তন্মধ্যে অনেক স্থলেই ইন্দ্রিয়বৃত্তি ও শাস্ত্রের পরস্পর বিরোধ নাই । কিন্তু দুই ধর্মের এরূপ পরস্পরবিরোধ হয়, যাহার প্রসঙ্গে শাস্ত্ৰে কর্তব্য নির্দিষ্ট হইয়াছে । এবং সেই সময় ইহা করিব কি উহা করিব - তাহার সূক্ষ্ম বিচার করা আবশ্যক হয় । পূৰ্ববর্তী সাধু পুরুষেরা এইরূপ প্রসঙ্গে যেরূপ আচরণ করিয়াছিলেন, তদনুসারে কোন কোন ব্যক্তি এই বিষয়গুলির মধ্যে কোন কোন বিষয় নিজ বুদ্ধিমত নির্ণয় করিতে পারিলেও এমন অনেক প্রসঙ্গ উপস্থিত হয় যেখানে অনেক বুদ্ধিমানেরও চিত্ত বিহ্বল হয়ে পড়ে । কারণ, যতই অধিক বিচার করিবে ততই যুক্তি ও উপপত্তি অধিকাধিক উৎপন্ন হইয়া শেষের নির্ণয় দুর্ঘট হইয়া পড়ে । যথাযুক্ত নির্ণয় না হইলেও আমাদের দ্বারা অধর্ম কিংবা অপরাধ ঘটিবারও সম্ভাবনা হইয়া থাকে । এই দৃষ্টিতে দেখিলে উপলব্ধি হইবে যে, ধর্মাধর্মের বা কর্মাকর্মের বিচার-আলোচনা এক স্বতন্ত্র শাস্ত্র – উহা ন্যায় ও ব্যাকরণ অপেক্ষাও গভীর ।


16.1) নীতিশাস্ত্ৰ



প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থাদিতে ‘নীতিশাস্ত্ৰ’ এই শব্দ প্রায়ই রাজনীতি শাস্ত্ৰেই প্ৰযুক্ত হয়; এবং কর্তব্যাকর্তব্য শাস্ত্ৰকে ‘ধর্মশাস্ত্ৰ’ বলাই প্ৰাচীন পদ্ধতি । কিন্তু আজকাল ‘নীতি’ এই শব্দেই কর্তব্য বা সদাচরণের সমাবেশ হওয়ায়, আধুনিক পদ্ধতি অনুসারে আমি এই গ্রন্থে ধর্মাধর্মের বা কর্মাকর্মের বিচার-আলোচনাকেই ‘নীতিশাস্ত্ৰ’ বলিয়াছি । নীতি, কর্মাকর্ম বা ধর্মাধর্মের বিচার সংক্রান্ত এই শাস্ত্র অতি গভীর, ইহা দেখাইবার জন্যই “সূক্ষ্মা গতির্হি ধর্মস্য” - ধর্মের বা ব্যবহারিক নীতিধর্মের স্বরূপ অতিসূক্ষ্ম - এই বচনটি মহাভারতের অনেক স্থানে পাওয়া যায় । পঞ্চপাণ্ডব কেমন করিয়া এক দ্রৌপদীকে বিবাহ করিলেন ? দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময় ভীষ্ম-দ্রোণাদি শূন্যহৃদয় হইয়া চুপ করিয়া কেন বসিয়া রহিলেন ? কিংবা দুষ্ট দুৰ্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করিবার সময় ভীষ্মদ্রোণাদি আত্মসমর্থনাৰ্থ বলিয়াছেন “অর্থস্য পুরুষো দাসঃ দাসন্ত্বর্থো ন কস্যচিৎ” - পুরুষ অর্থের দাস, অর্থ কাহারও দাস নহে [মভা|ভীষ্ম|৪৩|৩৫], এই তত্ত্বটি ঠিক্‌ না ভুল ? যখনই হোক্‌ না কেন, “সেবাশ্ববৃত্তিরাখা তা” [মনু|8০৬] সেবাধর্ম যদি কুকুরবৃত্তির ন্যায় গৰ্হিত বলিয়া স্বীকৃত হয়, তবে অর্থের দাস না হইয়া ভীষ্মাদি কৌরবেরা দুৰ্যোধনের সেবা কেন পরিত্যাগ করেন নাই ? এই সকল প্রশ্নের উচিত নিৰ্ণয় করা বড়ই কঠিন । কারণ, এরূপ স্থলে ভিন্ন ভিন্ন মনুষ্য প্রসঙ্গানুসারে ভিন্ন ভিন্ন অনুমান বা নির্ণয় করিয়া থাকে । “সূক্ষ্মা গতির্হি ধর্মস্য” [মভা|অনু|১০|৭০] ধর্মের তত্ত্ব সুক্ষ্ম, শুধু ইহাই বলিতে হইবে না; কিন্তু “বহুশাখা হ্যনন্তিকা” [বন|২০৮|২] উহা হইতে বহু শাখা প্ৰশাখা-বাহির হওয়ায়, তাহা হইতে নিম্পন্ন অনুমানও বিভিন্ন হইয়া থাকে, এইরূপ মহাভারতে উক্ত হইয়াছে । তুলাধার-জাজলি-সংবাদে তুলাধারও ধর্ম সম্বন্ধে বিচার আলোচনা করিবার সময় বলিয়াছেন যে, “সূক্ষ্মত্বান্ন স বিজ্ঞাতুং শক্যতে বহনিহ্নবঃ” - ধর্ম সূক্ষ্ম ও অতীব জটিল হওয়ায় অনেক সময় বুঝা যায় না [শাং|২৬১|৩৭] । 


16.2) গীতার অপূর্বতা



মহাভারতকার এই সূক্ষ্ম প্রসঙ্গ সম্পূর্ণরূপে অবগত থাকায়, এইরূপ প্রসঙ্গে প্রাচীন মহাত্মারা কি করিয়াছিলেন, তাহা বলিবার জন্যই তিনি মহাভারতে নানা উপাখ্যান সংগ্রহ করিয়াছেন । কিন্তু শাস্ত্ররীতি অনুসারে সমস্ত বিষয়ের বিচার করিয়া তাহার সাধারণ মর্ম মহাভারতের ন্যায় ধর্মগ্রন্থে কোথাও না কোথাও বলা আবশ্যক হইয়াছিল । এই মর্ম, অর্জুনের কর্তব্যমূঢ়তা অপসারিত করিবার নিমিত্ত শ্ৰীকৃষ্ণ পূর্বে যে উপদেশ করিয়াছিলেন তাহারই বনিয়াদে ব্যাস ভগবদ্গীতায় প্রতিপাদিত করিয়াছেন । তাহার দরুণ গীতা, মহাভারতের রহস্যোপনিষৎ ও শিরোভূষণ হইয়াছে । মহাভারতও গীতা প্ৰতিপাদিত মূলভূত কর্মতত্ত্বসমূহের সোদাহরণ বিস্তৃত ব্যাখ্যানে পরিণত হইয়াছে । গীতাগ্রন্থ মহাভারতের মধ্যে পরে ঢুকাইয়া দেওয়া হইয়াছে, এরূপ সন্দেহ যাহারা করেন, তাহারা আমার এই কথার প্রতি লক্ষ্য করিবেন । অধিক কি, গীতাগ্রন্থের যদি কিছু অপূর্বতা বা বিশিষ্টতা থাকে তবে সে উহাই । কারণ, শুধু মোক্ষশাস্ত্রের অর্থাৎ বেদান্তের প্রতিপাদক উপনিষদাদি এবং অহিংসাদি সদাচরণের শুধু নিয়ম-উপদেষ্টা স্মৃতিশাস্ত্ৰাদি অনেক থাকিলেও বেদান্তের গভীর তত্ত্বজ্ঞানের বনিয়াদে, ‘কার্যাকাৰ্য-ব্যবস্থিতি’-প্ৰবর্তক গীতার ন্যায় অপর প্রাচীন গ্রন্থ, অন্তত বর্তমান সংস্কৃত বাঙ্ময়ে (সাহিত্যে) প্রাপ্ত হওয়া যায় না । ‘কার্যাকাৰ্য-ব্যবস্থিতি’ এই শব্দ আমাদের ঘর-গড়া নহে, উহা গীতাতেই আছে [গীতা|১৬|২৪] – এ কথা গীতাভক্তদিগকে বলা বাহুল্য । ভগবদ্গীতার ন্যায় যোগব্যাসিষ্ঠেও, বসিষ্ঠ রামচন্দ্ৰকে জ্ঞানমূলক প্রবৃত্তিমার্গেরই চরম উপদেশ করিয়াছেন । কিন্তু যোগব্যাসিষ্ঠের ন্যায় যে সকল গ্রন্থ গীতার পরে বা তাহার অনুকরণে রচিত হইয়াছে, সেই সকল গ্রন্থের দ্বারা, গীতার উপরোক্ত অপূর্বতা বা বিশেষত্ব-বিষয়ে কোনই বাধা হয় না । 
কর্মজিজ্ঞাসা সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment