Sunday, June 4, 2017

গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ (Gita & Buddhist Literature)

গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ


সূচি


1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য
2) বুদ্ধের নির্বাণকাল
3) বুদ্ধের পূর্বেই বৈদিকধর্মের পুর্ণাবস্থা-প্রাপ্তি
4) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - সন্ন্যাসমার্গের বিচার
4.1) প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি ? চারি আৰ্যসত্য :
4.2) সার কথা
5) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - গাৰ্হস্থ্যমার্গের বিচার
6) গীতার প্রাচীনত্ব প্রমাণে শ্লোকসাদৃশ্যই যথেষ্ট নয়
7) বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপের পরিবর্তন
7.1) ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা
8) বৌদ্ধধর্মে ভক্তিমার্গের উন্মেষে ভগবদ্গীতার প্রভাব ?
9) সার কথা


1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য


বর্তমান গীতার কালনির্ণয়ের জন্য উপরে যে বৌদ্ধগ্রন্থের প্রমাণ দেওয়া গিয়াছে, তাহার পূর্ণ গুরুত্ব উপলব্ধি করিবার জন্য গীতা ও বৌদ্ধগ্রন্থ বা বৌদ্ধধর্মের সাধারণ সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সম্বন্ধেও এখানে একটু বিচার করা আবশ্যক । গীতার স্থিতপ্ৰজ্ঞ প্ৰবৃত্তিমার্গেরই অনুসরণ করেন - ইহাই গীতাধর্মের বিশেষত্ব, ইহা পূর্বে অনেকবার বলিয়াছি । কিন্তু এই বিশেষ গুণটিকে ক্ষণকাল একপাশে রাখিয়া, এইরূপ পুরুষের কেবল মানসিক ও নৈতিক গুণসমূহেরই বিচার করিলে, গীতার স্থিতপ্ৰজ্ঞ [গী|২|৫৫, ৭২], ব্ৰহ্মনিষ্ঠ পুরুষ [৪|১৯-২৩; ৫|১৮-২৮] এবং ভক্তিযোগী পুরুষের [১২|১৩-১৯] যে লক্ষণ বলা হইয়াছে, সেই সব লক্ষণ এবং নির্বাণ-পদের অধিকারী অৰ্হৎদিগের অর্থাৎ পূর্ণ অবস্থায় উপনীত বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভিন্ন ভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থে যে সকল লক্ষণ প্রদত্ত হইয়াছে সেই সব লক্ষণ - এই উভয়ের মধ্যে বিলক্ষণ সাম্য আছে দেখিতে পাওয়া যায় [ধম্মপদ শ্লো|৩৬০-৪২৩ ও সুত্তনিপাতের মধ্যে মুনিসুত্ত ও ধম্মিকসুত্ত দেখ] । অধিক কি, এই বর্ণনাসমূহের শব্দসাম্য হইতে দেখা যায় যে, স্থিতপ্রজ্ঞ এবং ভক্তিমান ব্যক্তির সমানই প্রকৃত ভিক্ষুও ‘শান্ত’, ‘নিষ্কাম’, ‘নির্মম’, ‘নিরাশী’ (নিরিস্‌সিত), ‘সমদূঃখসুখ’, ‘নিরারম্ভ’, ‘অনিকেতন’, বা ‘অনিবেশন’ অথবা ‘সমনিন্দাস্তুতি’, এবং ‘মানাপমান ও লাভালাভে সমদর্শী’ থাকে [ধম্মপদ|৪০, ৪১ ও ৯১; সুত্তনি|মুনিসুত্ত|১|৭ ও ১৪; দ্বয়তানুপস্‌সনসুত্ত ২১-২৩; ও বিনয়পিটক চুল্লবগ্‌গ|৭|৪|৭ দেখ] । জ্ঞানী পুরুষের নিকট যাহা আলোক অজ্ঞানের নিকট তাহাই অন্ধকার, দ্বয়তানুপস্‌সনসুত্তের ৪০ শ্লোকের এই বিচার “যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী” [গী|২|৩৯] গীতার এই বিচারের অনুরূপ; এবং “অরোসনেয্যো ন রোসেতি” - অৰ্থাৎ, নিজেও কষ্ট পায় না, অন্যকেও কষ্ট দেয় না, মুনিসুত্তের ১০ শ্লোকের এই বর্ণনা গীতার “যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ” [গী|১২|১৫] এই বর্ণনার সদৃশ । সেইরূপ সল্লসুত্তের “যাহার জন্ম তাহারই মৃত্যু” এবং “ভূতদিগের আদি ও অন্ত অব্যক্ত হওয়ায় তাহার জন্য শোক করা বৃথা” [সল্লমুত্ত|১ ও ৯ এবং গী|২|২৭ ও ২৮] ইত্যাদি বিচার অল্প শব্দভেদে গীতারই বিচার । গীতার দশম অধ্যায়ে কিংবা অনুগীতার [মভা|অশ্ব|৪৩|৪৪] “জ্যোতিষ্মানদিগের মধ্যে সূৰ্য, নক্ষত্রদিগের মধ্যে চন্দ্র, এবং বেদমন্ত্রের মধ্যে গায়ত্ৰী” ইত্যাদি যে বৰ্ণনা আছে তাহাই অবিকল সেলসুত্তের ২৭ ও ২২ শ্লোকে এবং মহাবগ্‌গে [৬|৩৫|৮] পাওয়া যায় । ইহা ব্যতীত ছোট-খাটো শব্দ সাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য, ৺তৈলং স্বকীয় গীতার ইংরাজী ভাষান্তরের টিপ্পনীতে দেখাইয়াছেন । তথাপি প্রশ্ন উঠে যে, এই সাদৃশ্য কিরূপে উৎপন্ন হইল ? এই বিচার মূলে বৌদ্ধদিগের, বা বৈদিক ধর্মের ? এবং ইহা হইতে কি অনুমান হয় ? কিন্তু এই প্ৰশ্নসমূহের নির্ণয় করিবার জন্য সে সময়ে যে সাধন পাওয়া গিয়াছিল, তাহা অপূর্ণ থাকায় উপরিউক্ত আশ্চৰ্য শব্দসাদৃশ্য ও অর্থসাদৃশ্য প্রদর্শন অপেক্ষা আর বেশী কিছু এই বিষয়ে ৺ তৈলং লিখিতে পারেন নাই । কিন্তু এক্ষণে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে যে সকল নানা বিবরণ পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে এই সমস্ত প্রশ্নের মীমাংসা হইতে পারে বলিয়া এখানে বৌদ্ধধর্মের সেই সকল বিষয় সংক্ষেপে বলিতেছি । ৺তৈলং-কৃত গীতার ইংরাজী ভাষান্তর যাহা ‘প্ৰাচ্যধর্মগ্রন্থমালায়’ প্ৰকাশিত হইয়াছে, উহাতে পরে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বৌদ্ধধর্মগ্রন্থসমূহের ইংরাজী অনুবাদ প্ৰকাশ করিয়াছেন । এই সকল বিষয় প্রায় সেই সকল গ্ৰন্থ হইতে সংগ্ৰহ করা হইয়াছে এবং প্রমাণার্থ উপস্থাপিত বৌদ্ধগ্রন্থের স্থলনির্দেশও এই সকল ভাষান্তরেরই অনুযায়ী করা হইয়াছে । কোন কোন স্থলে পালী শব্দ ও বাক্য মূল পালী গ্ৰন্থ হইতেই গৃহীত হইয়াছে ।


2) বুদ্ধের নির্বাণকাল


এই কথা এখন নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হইয়াছে যে, জৈনধর্মের ন্যায় বৌদ্ধধর্মও আপন বৈদিক ধর্মরূপ পিতারই পুত্র, যে নিজের সম্পত্তির অংশ লইয়া কোন কারণে পৃথক হইয়া গিয়াছে; অর্থাৎ উহা পরকীয় নহে, কিন্তু তৎপূর্বে এখানে যে ব্ৰাহ্মণধর্ম ছিল, উহারই এখানেই উৎপন্ন এক শাখা । সিংহল দ্বীপের মহাবংস কিংবা দীপবংসাদি পুরাতন পালীগ্রন্থে, বুদ্ধের পরবর্তী রাজাদিগের ও বৌদ্ধ আচাৰ্য-পরম্পরার যে বৰ্ণনা আছে, তাহা হইতে হিসাব করিয়া দেখিলে নিষ্পন্ন হয় যে, ৮০ বৎসর বয়সে খৃষ্টপূর্ব ৫৪৩ অব্দে, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যু হয় । কিন্তু ইহাতে কতকগুলি কথা অসম্বদ্ধ আছে; এইজন্য প্ৰোঃ মোক্ষমুলার এই গণনাসম্বন্ধে সূক্ষ্ম বিচার করিয়া বুদ্ধের প্রকৃত নিৰ্বাণকাল খৃষ্টপূর্ব ৪৭৩ অব্দে হইয়াছিল বলিয়াছেন; এবং ঐ কালই অশোকের শিলালিপি হইতে সিদ্ধ হয় ইহা বুহ্লরও দেখাইয়াছেন । তথাপি প্রোঃ রিজ-ডেভিড্‌স্‌ এবং ডাঃ কের্ণ-এর ন্যায় কোন কোন তত্ত্বানুসন্ধায়ী, ইহা অপেক্ষা ৬৫ ও ১০০ বৎসর আরও পরের দিকে হটাইতে চাহেন । প্ৰোঃ গায়গর সম্প্রতিই এই সমস্ত মতের বিচার করিয়া খৃঃ পুঃ ৪৮৩ অব্দকে বুদ্ধের নির্বাণকাল স্থির করিয়াছেন । (প্রোঃ মোক্ষমূলর স্বকীয় ধর্মপদের ইংরাজী ভাষান্তরের প্রস্তাবনায় বুদ্ধের নির্বাণকাল-সম্বন্ধীয় বিবরণ দিয়াছেন S. B. E. Vọl. X. Intro. pp. xxxv-xiv এবং ডাঃ গায়গর ১৯১২ অব্দে প্রকাশিত স্বীয় মহাবংসের ভাষান্তরের প্রস্তাবনায় উহার সমালোচনা করিয়াছেন – তাহা দেখ - The Mahavamsa by Dr. Geiger Pali Text Society Intro p. xxiif.)


3) বুদ্ধের পূর্বেই বৈদিকধর্মের পুর্ণাবস্থা-প্রাপ্তি


তন্মধ্যে যে কালই স্বীকার কর না কেন, বুদ্ধের জন্ম হইবার পূর্বেই বৈদিকধর্ম পুর্ণাবস্থায় উপনীত হইয়াছিল, এবং শুধু উপনিষদ নহে, কিন্তু ধর্মসূত্রের ন্যায় গ্ৰন্থও তাহার পূর্বেই রচিত হইয়াছিল, ইহা নির্বিবাদ । কারণ, পালী ভাষার প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহেই লিখিত আছে যে, “চারি বেদ, বেদাঙ্গ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ইতিহাস ও নিঘণ্টু” প্রভৃতি বিষয়ে পারদর্শী সাত্ত্বিক গৃহস্থ ব্ৰাহ্মণদিগকে এবং জটাধারী তপস্বীদিগকে গৌতম বুদ্ধ তর্ক করিয়া আপন ধর্মে দীক্ষিত করেন (সুত্ত্বনিপাতের মধ্যে সেলসুত্তের সেলের বর্ণনা ও বথ্‌থু গাথা ৩০-৪৫) । কঠাদি উপনিষদে [কঠ|১|১৮; মুণ্ড|১|২|১০]; এবং উহাদিগকেই লক্ষ্য করিয়া গীতায় [২|৪০-৪৫; ৯|২০, ২১] যাগযজ্ঞাদি শ্রৌতকর্মের যেরূপ লঘুতা বর্ণিত হইয়াছে, সেইরূপ এবং কোন কোন অংশে সেই সকল শব্দেরই দ্বারা তেবিজ্জসুত্তে (ত্রৈবিদ্য সূত্রে) বুদ্ধও স্বমতানুসারে ‘যাগযজ্ঞাদিকে’ অনুপযোগী ও ত্যাজ্য স্থির করিয়াছেন এবং ব্ৰাহ্মণ যাহাকে ‘ব্ৰহ্মসহব্যতায়’ (ব্ৰহ্মসহব্যতায় = ব্ৰহ্মসাযুজ্যতা) বলেন সেই অবস্থা কিরূপে প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, তাহার নিরূপণ করিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড - কিংবা গাৰ্হস্থ্যধর্ম ও সন্ন্যাসধর্ম, অর্থাৎ প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি - এই দুই শাখা সম্পূর্ণরূপে প্ৰচলিত হইবার পর, তাহার সংস্কার-সাধনের জন্য বৌদ্ধধর্ম উৎপন্ন হয় । সংস্কার-সাধনের সাধারণ নিয়ম এই যে, উহাতে পূর্বের কোন কোন বিষয় বজায় থাকে এবং কোন কোন বিষয় পরিবর্তিত হয় । তাই এই নিয়মানুসারে, বৌদ্ধধর্মে বৈদিক ধর্মের কোন কোন কথা বজায় রাখা হইয়াছে এবং কোন কোন বিষয় পরিত্যক্ত হইয়াছে, এক্ষণে তাহার বিচার করিব । এই বিচার গাৰ্হস্থ্যধর্ম ও সন্ন্যাস এই দুইয়ের পৃথক পৃথক দৃষ্টিতে করিতে হইবে । কিন্তু বৌদ্ধধর্ম মূলে সন্ন্যাসমাৰ্গীয় কিংবা নিবৃত্তিপ্রধানই হওয়ায় প্ৰথমে দুইয়ের সন্ন্যাসমার্গের বিচার করিয়া তাহার পর উভয়ের গাৰ্হস্থ্যধর্মের তারতম্য সম্বন্ধে বিচার করিব ।


4) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - সন্ন্যাসমার্গের বিচার


বৈদিক সন্ন্যাসধর্মের প্রতি লক্ষ্য করিলে উপলব্ধি হইবে যে, কর্মময় জগতের সমস্ত ব্যবহার তৃষ্ণামূলক সুতরাং দুঃখময়; উহা হইতে অর্থাৎ জন্মমরণের ভবচক্র হইতে আত্মার চিরমুক্তি সাধনের জন্য মনকে নিষ্কাম ও বিরক্ত করিয়া উহাকে দৃশ্য জগতের মূলে অবস্থিত আত্মস্বরূপ নিত্য পরব্রহ্মে সমাধান পূর্বক সাংসারিক কর্মসকল সর্বথা ত্যাগ করা উচিত; এই আত্মনিষ্ঠ অবস্থাতেই সর্বদা নিমগ্ন থাকা সন্ন্যাসধর্মের মুখ্য তত্ত্ব । দৃশ্যজগৎ নামরূপাত্মক ও নশ্বর; এবং তাহার অখণ্ডিত ব্যাপার কর্মবিপাক প্ৰযুক্তই বরাবর বজায় আছে ।
কম্মনা বত্ততী লোকো কম্মনা বত্ততী পজা (প্ৰজা) ৷
কম্মনিবন্ধনা সত্তা (সত্ত্বখানি) রথস্‌সাহণীব যায়তো ॥
অর্থাৎ “কর্মের দ্বারাই লোক ও প্ৰজা বজায় আছে; চল্‌তি গাড়ী যেরূপ রথের কীলকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, সেইপ্ৰকার প্রাণীমাত্র কর্মের দ্বারা বদ্ধ হইয়া আছে” [সুত্তনি|বাসেঠসুত্ত|৬১] । বৈদিক ধর্মের জ্ঞানকাণ্ডের উক্ত তত্ত্ব, অথবা জন্ম-মরণের চক্র বা ব্রহ্মা, ইন্দ্র, মহেশ্বর, ঈশ্বর, যম, প্রভৃতি অনেক দেবতা এবং উঁহাদের বিভিন্ন স্বর্গপাতালাদি লোকসমূহের ব্রাহ্মণধর্মে বর্ণিত অস্তিত্ব বুদ্ধের মান্য ছিল; এবং সেইজন্যই নামরূপ, কর্মবিপাক, অবিদ্যা, উপাদান ও প্ৰকৃতি প্ৰভৃতি বেদান্ত বা সাংখ্যশাস্ত্রের শব্দ ও ব্ৰহ্মাদি বৈদিক দেবতাদিগের কথাও (বুদ্ধের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিয়া) ন্যূনাধিক ভেদে বৌদ্ধগ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় । দৃশ্য জগৎ নশ্বর ও অনিত্য এবং উহার ব্যবহার কর্ম-বিপাকনিবন্ধন চলিতেছে, ইত্যাদি কর্মজগৎসংক্রান্ত বৈদিক ধর্মের সিদ্ধান্ত বুদ্ধের মান্য হইলেও নামরূপাত্মক নশ্বর জগতের মূলে নামরূপের অতিরিক্ত আত্মস্বরূপ পরব্রহ্মের সমান এক নিত্য ও সর্বব্যাপী বস্তু আছে, বৈদিক ধর্মের অর্থাৎ উপনিষদের এই সিদ্ধান্ত বুদ্ধ স্বীকার করিতেন না । এই দুই ধর্মের মধ্যে ইহাই শুরুতর প্রভেদ । গৌতম বুদ্ধ স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, আত্মা বা ব্ৰহ্ম বস্তুত কিছু নাই - কেবল ভ্রম; তাই আত্মানাত্মবিচারে বা ব্ৰহ্মচিন্তনের গোলযোগে পড়িয়া বৃথা সময় নষ্ট করা কাহারও উচিত নহে [সব্বাসবসুত্ত|৯-১৩ দেখ] । আত্মার সম্বন্ধে কোন প্রকার কল্পনাই বুদ্ধের মান্য ছিল না,ইহা দীঘ্‌ঘনিকায়ের অন্তর্গত ব্ৰহ্মজালসুত্ত হইতেও স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । (ব্ৰহ্মজালসুত্তের ভাষান্তর ইংরাজীতে হয় নাই, কিন্তু তাহার সংক্ষিপ্ত সার রিজ্‌-ডেভিড্‌স্‌ S. B. E. Vol XXVI Intro, pp, xxiii-xxv-এ দিয়াছেন – তাহা দেখ ।)

এই সকল সুত্তে প্ৰথমে বলা হইয়াছে যে, আত্মা ও ব্ৰহ্ম এক কি দুই; আবার এই প্ৰকার ভেদই বলিবার সময় আত্মার ৬২ প্রকার বিভিন্ন কল্পনার কথা বলিয়া বলা হইয়াছে যে, এই সমস্তই মিথ্যা ‘দৃষ্টি’; এবং মিলিন্দ-প্রশ্নেও বৌদ্ধধর্মানুসারে “আত্মা বলিয়া কোন যথার্থ বস্তু নাই” এইরূপ নাগসেন গ্ৰীক মিলিন্দকে (Minander) স্পষ্ট বলিয়াছেন [মি|প্র|২|৩|৬ ও ২|৭|১৫] । আত্মা ও তদ্বৎ ব্ৰহ্ম দুইই ভ্ৰম, সত্য নহে, এইরূপ স্বীকার করিলে তো ধর্মের ভিত্তিই ধসিয়া যায় । কারণ, তাহলে তো সমস্ত অনিত্য বস্তুই অবশিষ্ট থাকে, এবং নিত্য সুখ বা সেই সুখের ভোক্তাও কেহ থাকে না; এবং এই কারণেই তৰ্কদৃষ্টিতে এই মত শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য অগ্ৰাহ্য করিয়াছেন ।


4.1) প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি ? চারি আৰ্যসত্য :


কিন্তু এখন আমাকে কেবল ইহাই দেখিতে হইবে যে, প্ৰকৃত বৌদ্ধধর্ম কি, এইজন্য এই তর্ক এখানেই ছাড়িয়া দেখিব যে, বুদ্ধ স্বকীয় ধর্মের কি উপপত্তি বলিয়াছেন । আত্মার অস্তিত্ব বুদ্ধের মান্য না হইলেও, 
(১) কর্ম-বিপাক নিবন্ধন নামরূপাত্মক দেহকে (আত্মাকে নহে) নশ্বর জগতের প্রপঞ্চে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করিতে হয়, এবং 
(২) পুনর্জন্মের এই চক্র বা সমস্ত সংসারই দুঃখময়, এই দুই বিষয়ে তিনি সম্পূর্ণ একমত ছিলেন; ইহা হইতে মুক্তি লাভ করিয়া চিরন্তন শান্তি বা সুখ অর্জন করা অত্যাবশ্যক । এই প্ৰকার সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব এবং তন্নিবারণের আবশ্যকতা, এই দুই বিষয় স্বীকার করিলে বৈদিক ধর্মের এই প্রশ্নটি সমান থাকিয়া যায় যে, দুঃখ নিবারণ করিয়া অত্যন্ত সুখলাভের পন্থাটি কি; এবং উহার কোন-না-কোন সন্তোষজনক ঠিক্‌ ঠিক্‌ উত্তর দেওয়া আবশ্যক হয় । উপনিষৎকারেরা বলিয়াছেন যে, যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা ভবচক্র হইতে মুক্তি লাভ করা যায় না এবং বুদ্ধ আরও একটু বেশী অগ্রসর হইয়া এই সমস্ত কর্মকে হিংসাত্মক সুতরাং সর্বথা ত্যাজ্য ও নিষিদ্ধ বলিয়াছেন । সেইরূপ স্বয়ং ‘ব্ৰহ্মকেই’ এক মহা ভ্ৰম বলিয়া মনে করিলে, দুঃখনিবারণার্থ ব্ৰহ্মজ্ঞানের মাৰ্গকেও ভ্ৰান্তিমূলক ও অসম্ভব বলিয়া স্থির করিতে হয় । তাহা হইলে দুঃখময় ভবচক্র হইতে মুক্তিলাভের মার্গটি কি ? বুদ্ধ ইহার উত্তর দিয়াছেন যে, কোন রোগ দূর করিতে হইলে সেই রোগের মূল কি তাহা স্থির করিয়া সেই মূল কারণকেই উন্মূলিত করিবার জন্য সৎবৈদ্য যেরূপ চেষ্টা করিয়া থাকেন, সেইরূপ সাংসারিক দুঃখের রোগ দূর করিবার জন্য 
(৩) উহার কারণ অবগত হইয়া 
(৪) সেই কারণকেই দূর করিবার মার্গ বুদ্ধিমান ব্যক্তির অবলম্বন করা উচিত ।

এই কারণ-সমূহের বিচার করিলে দেখা যায় যে, তৃষ্ণা বা বাসনাই এই জগতের সমস্ত দুঃখের মূল; এবং এক, নাম-রূপাত্মক দেহের নাশ হইলে, অবশিষ্ট এই বাসনাত্মক বীজ হইতেই অন্যান্য নাম রূপাত্মক দেহ পুনঃপুনঃ উৎপন্ন হইয়া থাকে । এবং তাহার পর বুদ্ধ স্থির করিয়াছেন যে, পুনর্জন্মের দুঃখময় সংসার হইতে মুক্তি লাভ করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ, ধ্যান ও বৈরাগ্যের দ্বারা তৃষ্ণার সম্পূর্ণ ক্ষয় করিয়া সন্ন্যাসী বা ভিক্ষু হওয়াই এক প্ৰকৃত মাৰ্গ, এবং এই বৈরাগ্যযুক্ত সন্ন্যাস হইতেই চিরন্তন শান্তি ও নিত্য সুখ লাভ করা যায় । তাৎপৰ্য এই যে, যাগযজ্ঞাদির এবং আত্মানাত্মবিচারের গোলযোগে না পড়িয়া, নিম্নোক্ত চারি প্রত্যক্ষ বিষয়ের উপরেই বৌদ্ধধর্ম খাড়া করা হইয়াছে - সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব, তাহার কারণ, তাহার নিরোধ বা নিবারণ করিবার আবশ্যকতা, এবং উহা সমূলে বিনষ্ট করিবার জন্য বৈরাগ্যরূপ সাধন; কিংবা বৌদ্ধ পরিভাষা অনুসারে অনুক্ৰমে দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ ও মার্গ । নিজ ধর্মের এই চারি মূলতত্ত্বকেই বুদ্ধ ‘আৰ্যসত্য’ নাম দিয়াছেন । উপনিষদের আত্মজ্ঞানের বদলে চারি আৰ্যসত্যের প্রত্যক্ষ ভিত্তির উপর এই প্রকারে বৌদ্ধধর্মকে দাঁড় করাইলেও নিত্য শান্তি বা সুখ লাভ করিবার জন্য তৃষ্ণা কিংবা বাসনার ক্ষয় করিয়া মনকে নিষ্কাম করিবার যে মাৰ্গ বুদ্ধের উপদিষ্ট সেই মার্গ (চতুর্থ সত্য), এবং মোক্ষলাভের জন্য উপনিষদের বর্ণিত মার্গ - এই দুই মাৰ্গ বস্তুত একই হওয়ায়, দুই ধর্মের চরম দৃশ্যসাধ্য মনের নির্বিষয় অবস্থাই, ইহা স্পষ্ট দেখা যায় । কিন্তু এই দুই ধর্মের মধ্যে প্ৰভেদ এই যে, ব্ৰহ্ম ও আত্মাকে যাঁহারা এক বলিয়া মানেন সেই উপনিষৎকারেরা মনের এই নিষ্কাম অবস্থাকে ‘আত্মনিষ্টা’, ‘ব্রহ্মসংস্থা’, ‘ব্ৰহ্মভূততা’, ‘ব্রহ্মনিৰ্বাণ’ [গী|৫|১৭-২৫; ছাং|২|২৩|১], অর্থাৎ ব্রহ্মেতে আত্মার লয় হওয়া, ইত্যাদি চরম আধারসূচক নাম দিয়াছেন, এবং বুদ্ধ উহাকে কেবল ‘নির্বাণ’ অর্থাৎ “বিরাম পাওয়া বা প্রদীপ নিভিবার ন্যায় বাসনার নাশ হওয়া” এই ক্রিয়াপ্রদর্শক নাম দিয়াছেন । কারণ, ব্ৰহ্ম বা আত্মা ভ্ৰম, ইহা বলিবার পর এই প্ৰশ্নই আর থাকে না যে, “বিরাম কে পায়, ও কেমন করিয়া পায়” [সুত্তনিপাতে রতনসুত্ত|১৪ ও বঙ্গীসসুত্ত|১২ ও ১৩ দেখ]; এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তির এই গুঢ় প্রশ্নের বিচারও করা উচিত নহে, ইহা বুদ্ধ স্পষ্ট বলিয়াছেন [সব্বাসবসুক্ত|৯-১৩ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৪|২|৪ ও ৫ দেখ] । এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে আর পুনর্জন্ম হয় না, এই জন্য এক দেহের নাশ হইয়া অন্য দেহ প্ৰাপ্ত হইবার সাধারণ ক্রিয়া সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত ‘মরণ’ শব্দের উপযোগ বৌদ্ধধর্মের অনুসারে ‘নির্বাণ’ সম্বন্ধে করিতেও পারা যায় না । নির্বাণ তো ‘মরণের মরণ’ কিংবা উপনিষদের বর্ণনা অনুসারে “মৃত্যু পার হইবার পথ” - শুধু মরণ নহে । সাপ যেরূপ আপন নির্মোক পরিত্যাগ করিতে ভয় পায় না, সেইরূপ এই অবস্থায় উপনীত মনুষ্য নিজের শরীরের জন্য ভাবে না, বৃহদারণ্যক-উপনিষদে [৪|৪|৭] এই যে দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে, তাহাই প্রকৃত বৌদ্ধভিক্ষুর বর্ণনা করিবার সময় সুত্তনিপাতের অন্তৰ্গত উরগসুত্তের প্রত্যেক শ্লোকে গৃহীত হইয়াছে । “আত্মনিষ্ঠ ব্যক্তি পাপপুণ্যে সর্বদাই অলিপ্ত থাকায় [বৃ|৪|৪|২৩] মাতৃবধ কিংবা পিতৃবধের সদৃশ পাতকেরও দোষ তাহাকে স্পর্শ করে না”, বৈদিক ধর্মের এই তত্ত্ব [কৌষী|ব্রা|৩|১] ধম্মপদে শব্দশঃ যেমনটি-তেমনি বলা হইরাছে [ধম্ম|২৯৪ ও ২৯৫ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৪|৫|৭ দেখ]


4.2) সার কথা


ব্ৰহ্ম ও আত্মার অস্তিত্ব বুদ্ধ স্বীকার না করিলেও মনকে শান্ত, বিরক্ত ও নিষ্কাম করা প্রভৃতি মোক্ষলাভের যে সকল সাধন উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে, সেই সকল সাধনই বুদ্ধের মতে নির্বাণলাভের পক্ষেও আবশ্যক, এই জন্য বৌদ্ধ যতি ও বৈদিক সন্ন্যাসীর বৰ্ণনা মানসিক অবস্থার দৃষ্টিতে একই রকমের; এবং সেই কারণেই পাপপুণ্যের দায়িত্ব সম্বন্ধে, এবং জন্ম-মরণের চক্ৰ হইতে মুক্তিলাভ বিষয়ে বৈদিক সন্ন্যাসধর্মের সিদ্ধান্তই বৌদ্ধধর্মেও বজায় রাখা হইয়াছে । কিন্তু বৈদিক ধর্ম গৌতম বুদ্ধের পূর্ববর্তী হওয়ায়, এই বিচার আসলে যে বৈদিক ধর্মেরই সে বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই ।


5) ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম - গাৰ্হস্থ্যমার্গের বিচার



বৈদিক ও বৌদ্ধ সন্ন্যাসধর্মের ভেদাভেদ কি, তাহা বলিয়াছি । এক্ষণে গাৰ্হস্থ্যধর্ম সম্বন্ধে বুদ্ধ কি বলিয়াছেন তাহা দেখা যাক । আত্মানাত্মবিচারের তত্ত্ব জ্ঞানকে প্রাধান্য না দিয়া সাংসারিক দুঃখের অস্তিত্ব প্রভৃতি দৃশ্য ভিত্তির উপরেই বৌদ্ধধর্মকে খাড়া করা হইলেও, মনে থাকে যেন, কোঁতের ন্যায় আধুনিক পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের নিছক আধিভৌতিক ধর্মের সদৃশ - কিংবা গীতাধর্মেরও মত - বৌদ্ধধর্ম মূলে প্ৰবৃত্তিমূলক নহে । ইহা সত্য যে, উপনিষদের আত্মজ্ঞানের তাত্ত্বিক ‘দৃষ্টি’ বুদ্ধের মান্য নহে, কিন্তু “সংসার সম্পূর্ণ ত্যাগ করিয়া মনকে নির্বিষয় ও নিষ্কাম করাই এই জগতে মনুষ্যের একমাত্র পরম কর্তব্য”, বৃহদারণ্যক উপনিষদে বর্ণিত যাজ্ঞবল্ক্যের এই সিদ্ধান্ত [বৃ|৪|৪|৬] বৌদ্ধধর্মে সম্পূর্ণরূপে বজায় রাখা হইয়াছে । এই জন্য বৌদ্ধধর্ম মূলে কেবল সন্ন্যাসপ্ৰধান হইয়াছে । সংসারকে ত্যাগ না করিয়া, কেবল গৃহস্থাশ্রমেই থাকিলে, পরম সুখ ও অৰ্হতাবস্থা লাভ করা কখনই সম্ভব নহে, ইহাই বুদ্ধের সমস্ত উপদেশের তাৎপৰ্য হইলেও ইহা বুঝিতে হইবে না যে, উহাতে গাৰ্হস্থ্যবৃত্তির কিছুমাত্র বিচারই নাই । ভিক্ষু না হইয়া, বুদ্ধ, বুদ্ধের ধর্ম ও বৌদ্ধভিক্ষুদিগের সংঘ বা মণ্ডলী - এই তিনের উপর বিশ্বাস স্থাপন করিয়া, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধৰ্ম্মং শরণং গচ্ছামি, সংঘং শরণং গচ্ছামি”, এই সংকল্প উচ্চারণের দ্বারা যাহারা ঐ তিনের শরণাপন্ন হয়, বৌদ্ধগ্রন্থে তাহাদিগকে ‘উপাসক’ বলা হয় । ইহারাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী গৃহস্থ ।” এই উপাসকেরা স্বকীয় গাৰ্হস্থ্যবৃত্তি কিরূপে নিৰ্বাহ করিবে তৎসম্বন্ধে বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্বয়ং বুদ্ধ কোন কোন স্থানে উপদেশ করিয়াছেন [মহাপরিনিব্বাণসুত্ত|১|২৪] । বৈদিক গাৰ্হস্থ্যধর্মের মধ্যে হিংসাত্মক শ্রৌত যাগযজ্ঞ ও চাতুর্বর্ণ্যভেদ বুদ্ধ স্বীকার করিতেন না । এই বিষয়গুলি ছাড়িয়া দিলে, স্মার্ত্ত পঞ্চ মহাযজ্ঞ, দানাদি পরোপকারধর্ম ও নৈতিক আচরণ করাই গৃহস্থের কর্তব্য থাকিয়া যায়; এবং গৃহস্থ ধর্ম বর্ণনা করিবার সময় বৌদ্ধধর্মগ্রন্থে কেবল এই সকল বিষয়েরই উল্লেখ করা হয় । পঞ্চমহাযজ্ঞ প্রত্যেক গৃহস্থ অর্থাৎ উপাসকের অনুষ্ঠান করিতেই হইবে, ইহা বুদ্ধের মত । তিনি স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, অহিংসা, সত্য, অস্তেয়, সর্বভুতে দয়া ও (আত্মা স্বীকৃত না হইলেও) আত্মৌপম্যদৃষ্টি, শৌচ বা মনের পবিত্রতা, এবং বিশেষ করিয়া সৎপাত্রে অর্থাৎ বৌদ্ধ-ভিক্ষুকে এবং বৌদ্ধ-ভিক্ষু-সংঘকে অন্নবস্ত্ৰাদি দান করা প্ৰভৃতি নীতিধর্মের পালন বৌদ্ধ উপাসককে করিতে হইবে । বৌদ্ধধর্মে ইহাকেই ‘শীল’ বলে; এবং উভয়ের তুলনা করিলে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, পঞ্চমহাযজ্ঞের ন্যায় এই নীতিধর্মও ব্রাহ্মণধর্মের ধর্মসূত্র এবং প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থ [মনু|৬৯২ ও ১০, ৬৩ দেখ] হইতে বুদ্ধ গ্ৰহণ করিয়াছেন (See Dr. Kern's “Manual of Buddhism”, Grundriss III, 8; p.68.) । অধিক কি, স্বয়ং বুদ্ধ এই আচরণ বিষয়ে প্ৰাচীন ব্ৰাহ্মণ-ধম্মিকসুত্তে প্ৰাচীন ব্ৰাহ্মণদিগের স্তুতি করিয়াছেন; এবং মনুস্মৃতির কতক শ্লোক তো ধম্মপদে অক্ষরশ পাওয়া যায় [মনু|২|১২১ ও ৫|৪৫ এবং ধম্মপদ|১০৯ ও ১৩১ দেখ] । বৈদিকগ্ৰন্থ হইতে বৌদ্ধধর্মে কেবল পঞ্চমহাযজ্ঞ ও নীতিধর্মই লওয়া হইয়াছে তাহা নহে, কিন্তু গৃহস্থাশ্রমে সম্পূৰ্ণ মোক্ষলাভ কখনও হয় না, বৈদিকধর্মে পূর্বে কোন কোন উপনিষৎকার কর্তৃক প্রতিপাদিত এই মতও বুদ্ধ স্বীকার করিয়াছেন । উদাহরণ যথা – সুত্তনিপাতের ধম্মিকসুত্তে ভিক্ষুর সঙ্গে উপাসকের তুলনা করিয়া বুদ্ধ স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, উত্তম শীলের দ্বারা গৃহস্থ বড় জোর ‘স্বয়ংপ্রকাশ’ দেবলোক প্ৰাপ্ত হইবে, কিন্তু জন্মমরণের চক্ৰ হইতে সম্পূর্ণ মুক্তি লাভের জন্য সংসার ও পুত্ৰকলত্ৰাদি ত্যাগ করিয়া শেষে উহাকে ভিক্ষু-ধর্মই স্বীকার করিতে হইবে [ধম্মিক সুত্ত|১৭|২৯; ও বৃ|৪|৪|৬ ও মভা|বন|২|৬৩ দেখ] । তেবিজ্জসুত্তে বৰ্ণিত হইয়াছে [তে|সু|১|৩৫; ৩|৫] যে, কর্মমাৰ্গীয় বৈদিক ব্ৰাহ্মণদিগের সহিত তর্ক করিবার সময় নিজের উক্ত সন্ন্যাসপ্রধান মত সিদ্ধ করিবার জন্য বুদ্ধ “তোমার ব্ৰহ্মের যদি স্ত্রীপুত্র ও ক্ৰোধ-লোভ নাই, তবে স্ত্রী-পুত্রের মধ্যে থাকিয়া ও যাগযজ্ঞাদি কাম্য কর্ম করিয়া তোমাদের ব্ৰহ্মপ্ৰাপ্তি কিরূপে হইবে” এই প্ৰকার যুক্তিবাদ করিতেন । এবং এই কথাও প্ৰসিদ্ধ আছে যে, স্বয়ং বুদ্ধ যৌবনকালেই নিজের স্ত্ৰীপুত্র ও রাজ্য ত্যাগ করিয়া ভিক্ষুধর্ম অঙ্গীকার করিবার ছয় বৎসর পরে তিনি বুদ্ধাবস্থা প্ৰাপ্ত হন । বুদ্ধের সমকালীন, কিন্তু তাঁহার পূর্বেই সমাধিপ্রাপ্ত, মহাবীর নামক শেষ জৈন তীর্থঙ্করেরও উপদেশ এইরূপই । কিন্তু তিনি বুদ্ধের ন্যায় অনাত্মবাদী ছিলেন না; এবং এই দুই ধর্মের মধ্যে গুরুতর, প্ৰভেদ এই যে, বস্ত্ৰপ্ৰাবরণাদি ঐহিক সুখত্যাগ এবং অহিংসা ব্ৰত প্ৰভৃতি ধর্মপালন জৈন যতি বৌদ্ধভিক্ষু অপেক্ষা অধিক কড়াকড়িভাবে পালন করিতেন; এবং অদ্যাপি পালন করিয়া থাকেন । আহারেরই জন্য ইচ্ছাপূর্বক মারা হয় নাই এইরূপ প্ৰাণীদিগের ‘পবত্ত’ (সং, প্ৰবৃত্ত) অর্থাৎ ‘তৈয়ারী মাংস’ (হাতী, সিংহ প্ৰভৃতি কোন কোন প্ৰাণীকে বর্জন করিয়া) বুদ্ধ স্বয়ং খাইতেন এবং ‘পবত্ত’ মাংস ও মৎস্য বৌদ্ধভিক্ষুদিগকেও তিনি খাইতে অনুমতি দিয়াছেন; এবং বস্ত্ৰ ব্যতীত নগ্ন হইয়া ভ্ৰমণ করা বৌদ্ধভিক্ষুধর্মের নিয়মানুসারে দোষ [মহাবগ্‌গ|৬|৩১|১৪ ও ৮|২৮|১] । সারকথা, অনাত্মবাদী ভিক্ষু হও, ইহা বুদ্ধের নিশ্চিত উপদেশ হইলেও, কায়ক্লেশময় উগ্র তপ সম্বন্ধে বুদ্ধের অভিমত ছিল না [মহাবগ্‌গ|৫|১|১৬ ও গী|৬|১৬]; বৌদ্ধভিক্ষুদিগের বিহারের অর্থাৎ তাহাদের থাকিবার মঠের সমস্ত ব্যবস্থাও এরূপ রাখা হইত যাহাতে শরীরের বেশী কষ্ট না হয় এবং প্ৰাণায়ামাদি যোগাভ্যাস সহজে হইতে পারে । তথাপি অৰ্হতাবস্থা বা নিৰ্বাণসুখ প্ৰাপ্তির জন্য গৃহস্থাশ্রম ছাড়িতেই হইবে, এই তত্ত্ব বৌদ্ধধর্মে পুরাপুরি বজায় থাকায় বৌদ্ধধর্ম যে সন্ন্যাসপ্রধান, ইহা বলিতে কোন প্ৰত্যবায় নাই ।


6) গীতার প্রাচীনত্ব প্রমাণে শ্লোকসাদৃশ্যই যথেষ্ট নয়


ব্ৰহ্মজ্ঞান ও আত্মানাত্ম-বিচার ভ্ৰমের একটা বড় জালমাত্ৰ, ইহাই যদিও বুদ্ধের স্থির মত ছিল, তথাপি এই প্ৰত্যক্ষ কারণের জন্য অর্থাৎ দুঃখময় সংসারচক্র হইতে মুক্ত হইয়া নিরন্তর শান্তি ও সুখ লাভ করিবার জন্য উপনিষদে বর্ণিত সন্ন্যাসমার্গীদিগের সাধন - বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে নিৰ্বিষয় করা - তাঁহার স্বীকৃত হইয়াছিল । এবং চাতুর্বর্ণ্যভেদ ও হিংসাত্মক যাগযজ্ঞ ত্যাগ করিয়া বৌদ্ধধর্মে বৈদিক গাৰ্হস্থ্যধর্মের নীতিনিয়মই অল্প হেরফেরে গৃহীত হইয়াছে, ইহা যখন সিদ্ধ হইল, তখন যদি উপনিষদ ও মনুস্মৃতি ইত্যাদি গ্রন্থে বৈদিক সন্ন্যাসীদিগের যে বৰ্ণনা আছে তাহা, এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বা অৰ্হৎদিগের বর্ণনা অথবা অহিংসাদি নীতিধর্ম, দুই ধর্মে একই সমান - কখন কখন শব্দশও একই - দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কিছু আশ্চর্য্যের বিষয় নহে, এই সমস্ত কথা মূল বৈদিক ধর্মেরই । কিন্তু কেবল এই বিষয়গুলিই বৌদ্ধেরা বৈদিকধর্ম হইতে গ্ৰহণ করে নাই, প্ৰত্যুত দশরথজাতকের মত বৌদ্ধধর্মের জাতকগ্ৰন্থও প্রাচীন বৈদিক পুরাণ-ইতিহাসকথার বৌদ্ধধর্মানুকুল করিয়া রচিত রূপান্তরমাত্র । শুধু বৌদ্ধেরা কেন, জৈনেরাও স্বকীয় অভিনব পুরাণসমূহে বৈদিক কথা-সকলের এইরূপ রূপান্তর করিয়াছে । খৃষ্টের পর আবির্ভূত মহম্মদীয় ধর্মে খৃষ্টচরিত্রের এইরূপ এক বিপৰ্যয় করা হইয়াছে, ইহা সেল সাহেব লিখিয়াছেন (See Sale's Koran “To the Reader” (Preface) p. x and the Preliminary Discourse, Sec, IV, p.58; Chandos Classics Ed.). আধুনিক গবেষণা হইতে সিদ্ধ হইয়াছে যে, বাইবেলের পুরাতন অঙ্গীকারের অন্তৰ্গত সৃষ্টির উৎপত্তি, প্ৰলয় ও নোয়া প্রভৃতির কথা, প্রাচীন খাল্‌দীয় জাতির ধর্মকথার এইরূপ রূপান্তর করিয়া ইহুদীরা বর্ণনা করিয়াছে । উপনিষৎ, প্ৰাচীন ধর্মসূত্র ও মনুস্মৃতিতে বর্ণিত কথা কিংবা বিচার যখন বৌদ্ধগ্রন্থে এইরূপ – অনেক সময় একেবারে শব্দশ – গৃহীত হইয়াছে, তখন সহজেই এই অনুমান হয় যে, ইহা আসলে মহাভারতেরই । বৌদ্ধগ্রন্থকারেরা এই সকল উহা হইতেই উদ্ধৃত করিয়া থাকিবেন । বৈদিক ধর্মগ্রন্থের যে ভাব ও শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহার কয়েকটি উদাহরণ প্রদত্ত হইল — “জয়ের দ্বারা বৈরতা বৃদ্ধি হয়; এবং বৈরতা দ্বারা বৈরতার উপশম হয় না” [মভা|উদ্যো|৭১|৫৯ ও ৬৩] “অন্যের ক্রোধকে শান্তির দ্বারা জয় করিবে” ইত্যাদি বিদুরনীতির উপদেশ [মভা|উদ্যো|৩৮|৭৯], এবং জনকের এই উক্তি - “আমার এক বাহু চন্দনে চর্চিত করা ও অন্য বাহু কাটিয়া ফেলা আমার নিকট উভয়ই সমান” [মভা|শাং|৩২০|৩৬]; ইহার অতিরিক্ত মহাভারতের আরও অনেক শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে শব্দশ পাওয়া যায় [ধম্মপদ|৫ ও ২২৩ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৭|৩|৫] । ইহা নিঃসন্দেহ যে, উপনিষৎ, ব্রহ্মসূত্র ও মনুস্মৃতি প্রভৃতি বৈদিক গ্রন্থ বুদ্ধাপেক্ষা প্রাচীন, তাই উহাদের যে সকল শ্লোক বা বিচার বৌদ্ধগ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহাদের বিষয়ে নিঃসংশয়ে বলিতে পারা যায় যে, বৌদ্ধগ্রন্থকারেরা সেগুলি উক্ত বৈদিক গ্ৰন্থ হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন । কিন্তু এই কথা মহাভারতের বিষয়ে বলিতে পারা যায় না । মহাভারতেই বৌদ্ধ ‘ডাগোবাদিগের’ যে উল্লেখ আছে, তাহা হইতে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, মহাভারতের শেষ সংস্করণ বুদ্ধের পরে হইয়াছে । অতএব কেবল শ্লোকসাদৃশ্য হইতে স্থির সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে না যে, বর্তমান মহাভারত বৌদ্ধগ্রন্থের পূর্ববর্তীই, এবং গীতা মহাভারতেরই এক অংশ হওয়ায় ঐ ন্যায়ই গীতাসম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হইতে পারে । তাছাড়া, গীতাতেই ব্ৰহ্মসূত্রের উল্লেখ আছে এবং ব্ৰহ্মসূত্রে বৌদ্ধমতের খণ্ডন আছে, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । অতএব স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা প্ৰভৃতি সম্বন্ধে (বৈদিক ও বৌদ্ধ) উভয়ের সাদৃশ্য ছাড়িয়া দিয়া এখানে বিচার করিব যে, উক্ত সংশয় দূর করিবার এবং গীতাকে নির্বিবাদরূপে বৌদ্ধগ্রন্থ হইতে প্রাচীন প্রমাণিত করিবার জন্য বৌদ্ধগ্রন্থে অন্য কোন উপকরণ পাওয়া যায় কি না ।


7) বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপের পরিবর্তন


বৌদ্ধধর্মের মূল স্বরূপ নিছক নিরাত্মবাদী ও নিবৃত্তিমূলক, ইহা উপরে বলা হইয়াছে । কিন্তু উহার এই স্বরূপ বেশী দিন টিকে নাই । ভিক্ষুদিগের আচার সম্বন্ধে মতভেদ ঘটিল এবং বুদ্ধের মৃত্যুর পর তাহার মধ্যে কেবল অনেক উপপন্থাই গঠিত হইতে আরম্ভ হয় নাই, কিন্তু ধর্মতত্ত্বজ্ঞান সম্বন্ধেও এইরূপ মতভেদ উৎপন্ন হইল । আজকাল কেহ কেহ এই তর্কও করিতে আরম্ভ করিয়াছেন যে, ‘আত্মা নাই’ এই উক্তি দ্বারা এই কথা বলাই বুদ্ধের মনোগত অভিপ্ৰায় যে, “অচিন্ত্য আত্মজ্ঞানের শুষ্ক তর্কের মধ্যে না গিয়া বৈরাগ্য ও অভ্যাসের দ্বারা মনকে নিষ্কাম করিতে প্ৰথমে চেষ্টা কর, আত্মা থাক্‌ বা নাই থাক্‌; মনোনিগ্রহের কাজই মুখ্য এবং তাহা সিদ্ধ করিবার চেষ্টা প্ৰথমে করা আবশ্যক”; ব্ৰহ্ম বা আত্মার আদৌ অস্তিত্ব নাই এরূপ বলা তাহার অভিপ্ৰায় নহে । কারণ, তেবিজ্জসুত্তে স্বয়ং বুদ্ধ ‘ব্রহ্মসব্যতায়’ অবস্থার উল্লেখ করিয়াছেন এবং সেলসুত্তে ও থের-গাথাতে “আমি ব্ৰহ্মভুত” এইরূপ তিনি স্বয়ং বলিয়াছেন [সেলসু|১৪; থেরগা|৮৩১ দেখ]  । কিন্তু মূল কারণ যাহাই হৌক, ইহা নির্বিবাদ যে, এই প্রকার নানাবিধ মত, তর্ক ও উৎসাহী পন্থা তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে রচিত হইয়া প্রচার করিতেছিল যে, “আত্মা বা ব্ৰহ্মের মধ্যে কোন নিত্য বস্তুই জগতের মূলে নাই, যাহা কিছু দেখা যায় তাহা ক্ষণিক বা শূন্য” অথবা “যাহা কিছু দেখা যায় তাহা জ্ঞান, জ্ঞান-ছাড়া জগতে কিছুই নাই” ইত্যাদি [বেসূ|শাং ভা|২|২|১৮-২৬ দেখ] । এই নিরীশ্বর ও অনাত্মবাদী বৌদ্ধ মতকেই ক্ষণিকবাদ, শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ বলা হয় । এই সমস্ত পন্থার এখানে বিচার করিবার কোন প্ৰয়োজন নাই । আমাদের প্রশ্ন ঐতিহাসিক । তাই, উহার মীমাংসা পক্ষে ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা যতটুকু আবশ্যক তাহাই এখানে করা হইতেছে । 


7.1) ‘মহাযান’ নামক পন্থার বর্ণনা


বুদ্ধের মূল উপদেশে আত্মা বা ব্ৰহ্মের (অর্থাৎ পরমাত্মা বা পরমেশ্বরের) অস্তিত্বই অস্বীকৃত কিংবা গৌণ বলিয়া স্বীকৃত হওয়ায় স্বয়ং বুদ্ধের জীবদ্দশায় ভক্তি দ্বারা পরমেশ্বরকে লাভ করিবার মার্গের উপদেশ করা সম্ভব ছিল না; এবং তাঁহার ভব্য মূর্তি ও চরিত্র লোকদিগের চক্ষের সম্মুখে যে পৰ্যন্ত প্ৰত্যক্ষ ছিল সে পৰ্যন্ত এই মার্গের কোন আবশ্যকতাই ছিল না । কিন্তু পরে ইহা আবশ্যক হইল যে, এই ধর্ম সাধারণ লোকের প্রিয় হউক এবং ইহার আরও বেশী প্রচারও হউক । অতএব সংসার ত্যাগ করিয়া ও ভিক্ষু হইয়া মনোনিগ্রহের দ্বারা স্বস্থানে থাকিয়াই নিৰ্বাণ লাভ করিবার - কিসে তাহা না বুঝিয়া - এই নিরীশ্বর নিবৃত্তিমাৰ্গ অপেক্ষা কোন সহজ ও প্ৰত্যক্ষ-মার্গের প্রয়োজন হইল । খুব সম্ভব যে, সাধারণ বুদ্ধভক্তেরা তৎকালে প্ৰচলিত বৈদিক ভক্তিমার্গের অনুকরণ করিয়া, আপনারাই বুদ্ধের উপাসনা প্ৰথম প্ৰথম আরম্ভ করিয়া থাকিবে । অতএব বুদ্ধের নির্বাণের পর শীঘ্রই বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা বুদ্ধকেই “স্বয়ম্ভূ ও অনাদ্যনন্ত পুরুষোত্তমের” রূপ প্ৰদান করেন; এবং তাঁহারা বলিতে লাগিলেন যে, বুদ্ধের নির্বাণ পাওয়াও বুদ্ধেরই লীলা; “প্রকৃত বুদ্ধের কখনও বিনাশ হয় না - তাঁহার অস্তিত্ব চিরস্থায়ী” । সেইরূপ আবার, বৌদ্ধগ্রন্থে প্ৰতিপাদিত হইতে লাগিল যে, প্রকৃত বুদ্ধ “সর্বজগতের পিতা এবং লোকেরা তাঁহারই সন্তান” অতএব তিনি সকলের প্রতিই “সমদৃষ্টি, কাহাকেও তিনি প্রীতি করেন না, কাহাকেও তিনি দ্বেষও করেন না”, “ধর্মের ব্যবস্থা বিগ্‌ড়াইয়া গেলে তিনি ‘ধর্ম কার্যের’ জন্যই সময়ে সময়ে বুদ্ধের রূপে প্ৰকট হইয়া থাকেন”, এবং এই দেবাদিদেব বুদ্ধের প্রতি “ভক্তি করিলে, তাঁহার গ্রন্থের পুজা করিলে এবং তাঁহার ডাগোবার সম্মুখে কীর্তন করিলে” অথবা “তাঁকে ভক্তি-পূর্বক দুই-চারি কমল বা একটী ফুল দিলেই” মনুষ্য সদ্‌গতিলাভ করে [সদ্ধর্মপুণ্ডরীক|২|৭৭-৯৮; ৫|২২; ১৫|৫-২২ ও মিলিন্দপ্রশ্ন|৩|৭|৭ দেখ](সদ্ধর্মপুণ্ডরীক গ্রন্থের প্রাচ্যধর্মপুস্তকমালার ২১ খণ্ডে ভাষান্তর হইয়াছে । এই গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় লিখিত । এক্ষণে মূল সংস্কৃত ভাষার গ্ৰন্থও ছাপা হইয়াছে ।) মিলিন্দপ্রশ্নে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, “মনুষ্যের সমস্ত জীবিতকাল দুরাচরণে অতিবাহিত হইলেও মৃত্যুসময়ে যদি সে বুদ্ধের শরণ লয়, তাহা হইলে তাহার স্বৰ্গলাভ না হইয়া যায় না” [মি|প্র|৩|৭|২]; এবং  সদ্ধর্মপুণ্ডরীকের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ে সবিস্তার বর্ণিত হইয়াছে যে, সমস্ত লোকের “অধিকার, স্বভাব ও জ্ঞান একই প্ৰকার না হওয়ায়, অনাত্মপর নিবৃত্তিপ্রধান মাৰ্গ ব্যতীত ভক্তির এই মাৰ্গ (যান) বুদ্ধই কৃপা করিয়া স্বকীয় ‘উপায়কুশলতা দ্বারা’ নির্মাণ করিয়াছেন” । নিৰ্বাণাবস্থা প্ৰাপ্তির জন্য ভিক্ষুধর্মকেই স্বীকার করিতে হইবে, বুদ্ধ স্বয়ং এই যে ধর্মতত্ত্ব উপদেশ করিয়াছেন, ইহা একেবারে ছাড়িয়া দেওয়া সম্ভব ছিল না; কারণ, তাহা করিলে বুদ্ধের মূল উপদেশেই হরতাল লাগানো হইত । কিন্তু ইহা বলা কিছু অনুচিত ছিল না যে, ভিক্ষু হইল তো কি হইল, অরণ্যে ‘গণ্ডারের’ মত একাকী ও উদাসীনভাবে না থাকিয়া ধর্মপ্রচারাদি লোকহিতকর ও পরোপকার-কার্য ‘নিরিস্‌সিত’ বুদ্ধিতে করাই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কর্তব্য; এই মতই মহাযান পন্থার সদ্ধর্মপুণ্ডরীকাদি গ্রন্থে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে (সুত্ত-নিপাতে খগ্‌গ-বিসাণসুত্তের ৪১ শ্লোকের ধ্রুবপদ “একো চরে খগ্‌গবিসাণ কপ্পো” এইরূপ আছে । খগ্‌গবিসাণ অর্থাৎ গণ্ডার, এবং উহারই ন্যায় বৌদ্ধ ভিক্ষুর বনে একাকী বাস করিতে হয়, উহার এই অর্থ ।) । এবং নাগসেন মিলিন্দিকে বলিয়াছেন যে, “গৃহস্থাশ্ৰম নিৰ্বাহ করিয়া নিৰ্বাণপদ লাভ করা একেবারেই অসম্ভব নহে, - এবং ইহার অনেক উদাহরণও আছে ।” [মি|প্ৰ|৬|২|৪] । ইহা যে-কোন-লোকের সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, এই বিচার অনাত্মবাদী ও নিছক্‌ সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্মের নহে, অথবা শূন্যবাদ বা বিজ্ঞানবাদ স্বীকার করিয়াও ইহার উপপত্তি জানা যায় না; এবং প্রথম প্রথম অধিকাংশ বৌদ্ধধর্মীর নিজেদেরই মনে হইত যে এই বিচার বুদ্ধের মূল উপদেশের বিরুদ্ধ । কিন্তু আবার এই নূতন মতটিই স্বভাবত অধিকাধিক লোকপ্রিয় হইতে লাগিল; এবং বুদ্ধের মূল উপদেশ অনুসারে যাহারা চলিত তাহাদেব নাম হইল “হীনযান” (হাল্কা মাৰ্গ) এবং এই নূতন পন্থার নাম হইল ‘মহাযান’ (বড় মার্গ) । 
(হীনযান ও মহাযান এই দুই পন্থায় ভেদ-বৰ্ণনা-কালে ডাঃ কেৰ্ণ বলেন - Not the Arhat who has shaken off all human feeling, but the generous, self-sacrificing, active Bodhisattva is the ideal of the Mahayanists, and this attractive side of the creed has, more perhaps than anything else, contributed to their wide conquests, whereas S. Buddhism has not been able to make converts except where the soil had been prepared by Hinduism and Mahayanism,” - Manual of Indian Buddhism. 69. Southern Buddhism অর্থাৎ হীনযান । মহাযানপন্থায় ভক্তিরও সমাবেশ হইয়াছিল Mahayanism lays a great stress on devotion, in this respect as in many others harmonising with the current of feeling in India which led to the growing importance of Bhakti.” Ibid p.124.)

চীন, তিব্বৎ জাপান প্রভৃতি দেশে আজকাল যে বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত আছে তাহা মহাযান পন্থার; এবং বুদ্ধের নির্বাণের পরে মহাযানপন্থী ভিক্ষু-সংঘের দীর্ঘ উদ্যোগেই বৌদ্ধধর্মের এত শীঘ্ৰ বিস্তার হয় । বৌদ্ধধর্মে এই যে সংস্কার সাধিত হইয়াছিল, তাহা শালিবাহন শকের প্রায় ৩০০ বৎসর পূর্বে হইয়া থাকিবে এইরূপ ডাঃ কেৰ্ণ স্থির করিয়াছেন । (See Dr. Kern's “Manual of Indian Buddhism”, pp.6, 69 and 119, মিলিন্দ, মিনণ্ডর নামক গ্রীক রাজা, প্রায় খৃঃ পূঃ ১৪০ কিংবা ১৫০ অব্দে ভারতবর্ষের বায়ুকোণে ব্যাক্‌ট্ৰীয়া দেশে রাজত্ব করিতেন । তাঁহাকে নাগসেন বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন ইহা মিলিন্দপ্রশ্নে উক্ত হইয়াছে । মহাযানপন্থার লোকেরাই বৌদ্ধধর্মের এই প্ৰচার কাৰ্য করিত, তাই ইহা সুস্পষ্ট যে, মহাযানপন্থা তখন আবির্ভূত হইয়াছিল ।) কারণ, শক রাজা কনিষ্কের শাসনকালে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের যে এক মহাপরিষৎ বসিয়াছিল উহাতে মহাযানপন্থার ভিক্ষুরা উপস্থিত ছিল, এইরূপ বৌদ্ধগ্রন্থে উল্লেখ আছে । এই মহাযানপন্থার ‘অমিতায়ুসুত্ত’ নামক প্রধান সুত্ৰগ্রন্থের চিনীয় ভাষায় ভাষান্তর প্রায় ১৪৮ খৃষ্টাব্দে করা হয়; তাহা এখন পাওয়া গিয়াছে । কিন্তু আমার মতে, এই কাল ইহা হইতেও প্ৰাচীন হইবে । কারণ, খৃষ্টের প্রায় ২৩০ বৎসর পূর্বে প্ৰকাশিত অশোকের শিলালিপিতে সন্ন্যাসমূলক নিরীশ্বর বৌদ্ধধর্মের বিশেষ ভাবে কোনই উল্লেখ নাই; উহাতে সর্বত্র প্রাণীমাত্রের প্রতি দয়াপর প্রবৃত্তিমূলক বৌদ্ধধর্মই উপদিষ্ট হইয়াছে । তখন ইহা সুস্পষ্ট যে, তৎপূর্বেই বৌদ্ধধর্মের মহাযান পন্থায় প্রবৃত্তিপ্রধান স্বরূপ আসিতে আরম্ভ হইয়াছিল । বৌদ্ধ যতি নাগার্জুন এই পথের মুখ্য প্ৰবর্তক ছিলেন, মূল সংস্থাপক নহে ।


8) বৌদ্ধধর্মে ভক্তিমার্গের উন্মেষে ভগবদ্গীতার প্রভাব ?


ব্ৰহ্ম বা পরমাত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করিয়া, উপনিষদের মতানুসারে কেবল নিবৃত্তিমার্গের মনকে নিৰ্বিষয় করিবার উপদেশ যে মূল নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধধর্ম গ্ৰহণ করিয়াছে, তাহা হইতেই পরে ক্রমশ স্বাভাবিকভাবে ভক্তিপর প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ বাহির হওয়া কখনও কি সম্ভব ছিল; এই জন্য বুদ্ধের নির্বাণের পর, শীঘ্রই বৌদ্ধধর্ম যে এই কর্মপ্রধান ভক্তির স্বরূপ প্রাপ্ত হইল, ইহা হইতে প্ৰকাশ পাইতেছে যে, ইহার জন্য বৌদ্ধধর্মের বাহিরের তৎকালীন কোন-না-কোন অন্য কারণ থাকিবে; এবং এই কারণের বিচারে প্রবৃত্ত হইলে, ভগবদ্গীতার উপর দৃষ্টি না পড়িয়া থাকিতে পারে না । কারণ, ভারতবর্ষে তৎকালে প্ৰচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে জৈন ও উপনিষদ্‌ধর্ম সম্পূর্ণরূপে নিবৃত্তিপরই ছিল, ইহা আমি গীতারহস্যের একাদশ প্ৰকরণে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছি; এবং বৈদিক ধর্মান্তৰ্গত পাশুপত কিংবা শৈব ও প্রভৃতি পন্থা ভক্তিপর হইলেও প্রবৃত্তিমাৰ্গ ও ভক্তির মিলন ভগবদ্গীতা ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাইতেছিল না । গীতায় ভগবান আপনাকে পুরুষোত্তম নামে অভিহিত করিয়াছেন এবং এই বিচার ভগবদ্গীতাতেই আসিয়াছে যে, “আমি পুরুষোত্তমই সমস্ত লোকের ‘পিতা’ ও ‘পিতামহ’ [৯|১৭]; আমার নিকট সকলেই সমান (‘সম’), আমার কেহ দ্বেষ্যও নাই, কেহ প্রিয়ও নাই [৯|২৯]; আমি অজ ও অব্যয় হইয়াও ধর্মসংরক্ষণার্থ সময়ে সময়ে অবতার ধারণ করি [৪|৬-৮]; মনুষ্য যতই দুরাচারী হোক না, আমাকে ভজনা করিলে সে সাধু হইয়া যায় [৯|৩০], কিংবা আমাকে ভক্তিপূর্বক ফুল, পত্র কিংবা একটু জলও দিলে আমি তাহা সন্তোষের সহিত গ্ৰহণ করি [৯|২৬]; এবং অজ্ঞলোকের জন্য ভক্তি এক সুলভ মাৰ্গ” [১২|৫]; ইত্যাদি । এই প্ৰকারই ব্ৰহ্মনিষ্ঠ ব্যক্তির লোকসংগ্ৰহাৰ্থ প্ৰবৃত্তিধর্মকেই স্বীকার করা কর্তব্য, এই তত্ত্ব গীতা ছাড়া অন্য কোথাও সবিস্তার প্রতিপাদিত হয় নাই । তাই, এইরূপ অনুমান অগত্যা করিতে হয় যে, মূল বৌদ্ধধর্মে যেরূপ বাসনাক্ষয়ের নিছক নিবৃত্তিপর মাৰ্গ উপনিষৎ হইতে গৃহীত হইয়াছে, সেইরূপই পরে মহাযানপন্থা বাহির হইলে পর উহাতে প্ৰবৃত্তি প্ৰধান ভক্তিতত্ত্বও ভগবদ্গীতা হইতেই গৃহীত হইয়া থাকিবে । কিন্তু এই কথাটা কিছু অনুমানের উপরেই অবলম্বিত নহে । তিববতীয় ভাষায় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সম্বন্ধে বৌদ্ধধর্মী তারানাথের যে এক গ্ৰন্থ আছে তাহাতে স্পষ্ট লিখিত হইয়াছে যে, মহাযানপন্থার মুখ্য প্ৰবর্তকের অর্থাৎ “নাগার্জুনের গুরু রাহুলভদ্র নামক বৌদ্ধ প্ৰথমে ব্ৰাহ্মণ ছিলেন, এবং জ্ঞানী শ্ৰীকৃষ্ণগণেশ এই ব্ৰাহ্মণের (মহাযানপন্থার) কল্পনা উদ্রেক করিবার কারণ হইয়াছিলেন” । ইহা ব্যতীত অন্য এক তিব্বতীয় গ্রন্থেও এইরূপ উল্লেখই পাওয়া যায় ।
(See Dr. Kern's “Manual of Indian Buddhism” p. 122. “He (Nagarjuna) was a pupil of the Brahmana Rahulabhadra, who himself was a Mahayanist. This Brahmana was much indebted to sage Krishna and still more to Ganesha. This quasi-historical notice, reduced to its less allegorical expression, means that Mahayanisim is much indebted to the Bhagabadgita and more even to Shivaism.” ‘গণেশ’ শব্দে ডাঃ কের্ণ শৈবপন্থা বুঝিয়াছেন মনে হয় । ডাঃ কের্ণ, প্রাচ্যধর্মপুস্তক-মালায় সদ্ধর্মপুণ্ডরীকগ্রন্থের ভাষান্তর করিয়াছেন এবং তাঁহার প্রস্তাবনায় এই মতই তিনি প্রতিপাদন করিয়াছেন (S.B.E. Vol. XXI, Intro. pp. xxv-xxviii.)

তারানাথের গ্ৰন্থ প্রাচীন নহে, একথা সত্য; কিন্তু উহার বর্ণনা প্রাচীন গ্রন্থের ভিত্তি ছাড়িয়া হয় নাই ইহা বলা বাহুল্য । কারণ, কোনও বৌদ্ধ গ্ৰন্থকার স্বকীয় ধর্মপন্থার তত্ত্ব বলিবার সময় বিনা, কোন কারণে পরধর্মীর এই প্রকার উল্লেখ করিবে ইহা সম্ভবপর নহে । এইজন্য স্বয়ং বৌদ্ধগ্রন্থকারগণ কর্তৃক এই বিষয়ে শ্ৰীকৃষ্ণের নামোল্লেখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য । কারণ ভগবদ্গীতা ব্যতীক্ত শ্ৰীকৃষ্ণোক্ত অন্য প্ৰবৃত্তিপর ভক্তিগ্ৰন্থ বৈদিক ধর্মেই নাই; অতএব ইহা হইতে সম্পূর্ণ সিদ্ধ হয় যে, মহাযানপন্থার আবির্ভাবের পূর্বেই শুধু ভাগবতধর্ম নহে, ভাগবতধর্মসম্বন্ধীয় শ্ৰীকৃষ্ণোক্ত গ্ৰন্থ অর্থাৎ ভগবদ্গীতাও সে সময়ে প্রচলিত ছিল; এবং ডাঃ কেৰ্ণও এই মত সমর্থন করেন । গীতার অস্তিত্ব যখন বৌদ্ধধর্মীয় মহাযানপন্থার পূর্ববর্তী স্থির হইল, তখন মহাভারতও উহার সঙ্গে ছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে । বুদ্ধের মৃত্যুর পর সত্বরই তাঁহার মত সকল একত্ৰ সংগ্ৰহ করা হইয়াছিল, ইহা বৌদ্ধগ্রন্থে উক্ত হইয়াছে; কিন্তু ইহা হইতে সিদ্ধ হয় না যে, বর্তমান কালে প্ৰাপ্ত অতি প্ৰাচীন বৌদ্ধগ্ৰন্থও সেই সময়েই রচিত হইয়াছিল । মহাপরিনিব্বাণসুত্ত বর্তমান বৌদ্ধ গ্ৰন্থসমূহের মধ্যে প্ৰাচীন গ্ৰন্থ বলিয়া স্বীকৃত হয় । কিন্তু উহাতে পাটলিপুত্র নগর সম্বন্ধে যে উল্লেখ আছে, তাহা হইবে প্রোফেসর রিস্‌-ডেভিড্‌স্‌ দেখাইয়াছেন যে, এই গ্ৰন্থ বুদ্ধের নির্বাণের অন্যূন শত বৎসর পূর্বেও বোধ হয় রচিত হয় নাই । এবং বুদ্ধের শত বৎসর পরে, বৌদ্ধধর্মীয় ভিক্ষুদের যে দ্বিতীয় পরিষদের অধিবেশন হইয়াছিল, তাহার বর্ণনা বিনয়পিটকের অন্তর্গত চুল্লবগ্‌গ গ্রন্থের শেষে দেওয়া হইয়াছে । ইহা হইতে জানা যায় যে, সিংহলদ্বীপের পালিভাষায় লিখিত বিনয়পিটকাদি প্ৰাচীন বৌদ্ধ গ্ৰন্থ, এই পরিষদের পরে রচিত (See S.B.E. Vol. XI. Intro. pp, xv xx and p.58.) । এই বিষয়ে বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারেরাই বলিয়াছেন যে, অশোকের পুত্ৰ মহেন্দ্ৰ খৃঃ পূঃ প্ৰায় ২৪১ অব্দে সিংহল দ্বীপে যখন বৌদ্ধধর্ম প্রচার করিতে আরম্ভ করেন, সেই সময় এই গ্ৰন্থও সেখানে গিয়াছে, এবং তাহার প্রায় ১৫০ বৎসর পরে ইহা সেখানে সর্বপ্রথম পুস্তকাকারে লিখিত হয় । এই গ্ৰন্থ কণ্ঠস্থ করিবার রীতি ছিল, তৎপ্রযুক্ত মহেন্দ্রের কাল হইতে উহাতে কোনও পরিবর্তন হয় নাই, ইহা মনে করিলেও, কি প্রকারে বলা যাইতে পারে যে, বুদ্ধের নির্বাণের পরে এই গ্ৰন্থ যখন সর্বপ্রথম রচিত হয় তখন, অথবা পরে মহেন্দ্ৰ বা অশোকের কাল পৰ্যন্ত, তৎকালে প্ৰচলিত বৈদিক গ্ৰন্থ হইতে ইহাতে কোন কিছুই গৃহীত হয় নাই ? অতএব মহাভারত বুদ্ধের পরে হইলেও অন্য প্ৰমাণ হইতে উহার, আলেক্‌জণ্ডর বাদ্‌শার পূৰ্ববর্তী, অর্থাৎ খৃঃ পূঃ ৩২৫ অব্দের পূর্ববর্তী হওয়া সিদ্ধ হয়; এইজন্য মনুস্মৃতির শ্লোকের ন্যায় মহাভারতের শ্লোকও মহেন্দ্রের সিংহলে নীত পুস্তকসমূহের মধ্যে পাওয়া সম্ভব ।


9) সার কথা


বুদ্ধের মৃত্যুর পরে তাঁহার ধর্মের প্রসার হইতেছে দেখিয়া শীঘ্রই প্ৰাচীন বৈদিক গাথা ও কথাসমূহ মহাভারতে একত্র সংগ্ৰহ করা হয়; উহার যে শ্লোক বৌদ্ধগ্রন্থে শব্দশঃ পাওয়া যায় তাহা বৌদ্ধ গ্রন্থকারেরা মহাভারত হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন, মহাভারতকার বৌদ্ধ গ্ৰন্থ হইতে গ্ৰহণ করেন নাই । কিন্তু যদি স্বীকার করা যায় যে, বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারেরা এই সকল শ্লোক মহাভারত হইতে না লইয়া মহাভারতেরও আধারভূত কিন্তু এক্ষণে বিলুপ্ত তৎপূর্ববর্তী প্রাচীন বৈদিক গ্ৰন্থাদি হইতে লইয়া থাকিবেন; এবং সেইজন্য মহাভারতের কালনির্ণয় উপযুক্ত শ্লোকসাদৃশ্য হইতে সম্পূর্ণরূপে হয় না, তথাপি নিম্নোক্ত চারি বিষয় হইতে ইহা তো নিঃসন্দেহ সিদ্ধ হয় যে, বৌদ্ধধর্মে মহাযানপন্থার প্রাদুর্ভাব হইবার পূর্বে কেবল ভাগবতধর্মই প্ৰচলিত ছিল না, বরং সে সময় ভগবদ্গীতাও সর্বমান্য হইয়াছিল, এবং এই গীতারই আধারে মহাযানপন্থা বাহির হইয়াছে, এবং শ্ৰীকৃষ্ণপ্রণীত গীতার তত্ত্ব বৌদ্ধধর্ম হইতে গৃহীত হয় নাই । এই চারিটি বিষয় হইতেছে –
(১) নিছক্‌ অনাত্মবাদী ও সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্ম হইতেই পরে ক্রমশঃ স্বাভাবিকভাবে ভক্তিপ্রধান ও প্ৰবৃত্তিপ্ৰধান তত্ত্ব বাহির হওয়া অসম্ভব,
(২) মহাযানপন্থার উৎপত্তি সম্বন্ধে স্বয়ং বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারগণ শ্ৰীকৃষ্ণের নাম স্পষ্ট নির্দেশ করিয়াছেন,
(৩) মহাযানপন্থার মতের সহিত গীতার ভক্তিপর ও প্ৰবৃত্তিপর তত্ত্বের অৰ্থতঃ ও শব্দশঃ সাদৃশ্যআছে, এবং
(৪) বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গেই তৎকালে প্ৰচলিত অন্যান্য জৈন ও বৈদিক পন্থায় প্রবৃত্তিপর ভক্তিমার্গের প্রচার ছিল না ।
উপযুক্ত প্ৰমাণসমূহ হইতে বর্তমান গীতার যে কাল নির্ণীত হইয়াছে তাহার সহিত ইহার সম্পূর্ণ ঐক্য আছে ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment