Sunday, June 4, 2017

কর্মবিপাক ও আত্মস্বাতন্ত্র্য (Effect of Karma and Freedom of Will)

কর্মবিপাক ও আত্মস্বাতন্ত্র্য


কর্ম্মণা বধ্যতে জন্তু বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে ৷ [মভা|শান্তি |২৪0|৭]

(“কর্ম দ্বারা জীব বদ্ধ হয় এবং বিদ্যার দ্বারা তাহার মুক্তি হয়” ।)


সূচীপত্র


1) মায়াসৃষ্টি ও ব্রহ্মসৃষ্টি
2) দেহের কোষ ও কর্মাশ্রয়ীভূত লিঙ্গশরীর
3) কর্ম, নামরূপ ও মায়ার পারস্পরিক সম্বন্ধ
3a) কর্ম ও মায়ার ব্যাখ্যা
4) মায়ার মূল অগম্য - অতএব মায়াত্মক কর্মও অনাদি
5) কর্মের অখণ্ডিত প্রযত্ন
6) পরমেশ্বর কর্মচক্রেহস্তক্ষেপ করেন না
7) কর্মবন্ধের সুদৃঢ়তা 
8) প্রবৃত্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রস্তাবনা
9) কর্মবিভাগ
9a) অশুভ কর্মবিভাগ : কায়িক, বাচিক ও মানসিক (মনু)
9b) সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক (ভগবদ্গীতা)
9c) সঞ্চিত, প্রারব্ধ ও ক্রিয়মাণ (কর্মবিপাক)
9d) প্রারব্ধ (আরব্ধ) ও অনারব্ধ
10) 'প্রারব্ধকর্মনাং ভোগাদেব ক্ষয়ঃ'
11) মীমাংসকদের নৈষ্কর্ম্য-সিদ্ধিভাব বেদান্তের অগ্রাহ্য
11a) মীমাংসকদের কর্মবিভাগ : নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ
12) জ্ঞান বিনা কর্মবন্ধ হইতে মুক্তি নাই
13) জ্ঞান শব্দের অর্থ
14) জ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য শারীর আত্মা স্বতন্ত্র
15) পরন্তু কর্ম করিবার সাধন জীবাত্মার নিজের কাছে নাই
16) মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য আচরিত স্বল্প কর্মও ব্যর্থ যায় না
17) কর্মক্ষয়ের স্বরূপ
18) কর্ম দূর হয় না, ফলাশা ছাড়
19) কর্মের বন্ধকত্ব মনে, কর্মে নহে
20) জ্ঞান হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ অনারব্ধ কর্মক্ষয়
20a) মৃত্যুকালের গুরুত্ব
21) কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড
21a) কর্মকাণ্ড – শ্রৌতযজ্ঞ ধর্ম বা ত্রয়ীধর্ম
21b) জৈমিনির ‘পূর্বমীমাংসা’
21c) বাদরায়ণাচার্যর ‘উত্তরমীমাংসা’
21d) স্মার্তযজ্ঞ (পঞ্চমহাযজ্ঞ)
22) কর্মপ্রধান গার্হস্থ্যবৃত্তি
23) জ্ঞানযুক্ত ও জ্ঞানরহিত কর্ম
24) মৃত্যুর পর বিভিন্ন গতি - দেবযান ও পিতৃযান
25) দেবযান ও পিতৃযান - কালবাচক বা দেবতাবাচক ?
26) তৃতীয় নরকের গতি
27) ব্ৰহ্মজ্ঞানী এইখানেই মোক্ষ লাভ করেন


1) মায়াসৃষ্টি ও ব্রহ্মসৃষ্টি


এই জগতে যাহা কিছু আছে তাহা পরব্রহ্মই, পরব্রহ্ম ব্যতীত স্বতন্ত্র অন্য কিছু নাই, এই সিদ্ধান্ত পরিণামে সত্য হইলেও মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়-গোচর দৃশ্যজগতের পদার্থসমূহ অধ্যাত্মশাস্ত্রের চালুনী দিয়া সংশোধন করিতে গেলে উক্ত পদাৰ্থ সকলের ইন্দ্ৰিয়প্ৰত্যক্ষ কিন্তু চিরবর্তনশীল সুতরাং অনিত্য নামরূপাত্মক আবির্ভাব, এবং সেই নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত অদৃশ্য “অথচ নিত্য পরমাত্মতত্ত্ব, এইরূপ নিত্য-অনিত্য-রূপী দুই বিভাগ হইয়া যায় । রসায়নশাস্ত্ৰে কোন পদার্থের বিশ্লেষণ করিয়া তাহার উপাদান দ্রব্য যেরূপ পৃথকরূপে বাহির করা হয় সেই প্ৰকার এই দুই বিভাগকে চক্ষের সম্মুখে পৃথকরূপে স্থাপন করা যাইতে পারে না সত্য । কিন্তু জ্ঞানদৃষ্টিতে সেই দুইকে পৃথক করিয়া শাস্ত্রীয় উপপত্তির সুবিধার জন্য উহাদিগকে অনুক্রমে ‘ব্ৰহ্ম’ ও ‘মায়া’ এবং কখন কখন ‘ব্ৰহ্ম-জগৎ’ ও ‘মায়াজগত’ এইরূপ নাম দেওয়া হইয়া থাকে । তথাপি ইহা যেন মনে থাকে, ব্ৰহ্ম মূলেই নিত্য ও সত্য হওয়া প্ৰযুক্ত তাহার সঙ্গে ‘জগৎ’ শব্দ এইরূপ প্রসঙ্গে অনুপ্রাসার্থ প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে । ‘ব্ৰহ্ম-জগৎ’ এই শব্দের দ্বারা, ব্ৰহ্মকে কেহ উৎপন্ন করিয়াছে, এরূপ বুঝিতে হইবে না । এই দুই জগতের মধ্যে, দেশকালাদি নামরূপের দ্বারা অনাবদ্ধ অনাদি নিত্য, অবিনাশী, অমৃত, স্বতন্ত্র, এবং সমস্ত দৃশ্য জগতের আধারভুত হইয়া তাহার অন্তৰ্যামীরূপে অবস্থিত ব্ৰহ্মজগতে জ্ঞানচক্ষু দ্বারা বিচরণ করিয়া, আত্মার শুদ্ধ স্বরূপ কিংবা আপনার পরম সাধ্যের বিচার পূর্ব প্রকরণে করা হইয়াছে; এবং বস্তুত বলিতে গেলে শুদ্ধ অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ ঐখানে শেষ হইয়াছে । কিন্তু মনুষ্যের আত্মা মূলে ব্ৰহ্মজগতের হইলেও দৃশ্যজগতের অন্য বস্তুর ন্যায় তাহাও নামরূপাত্মক দেহেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা আচ্ছাদিত এবং এই দেহেন্দ্ৰিয়াদি নামরূপ নশ্বর হওয়ায় তাহা হইতে মুক্ত হইয়া অমৃতত্ব কিরূপে প্ৰাপ্ত হইবে, ইহাই প্ৰত্যেক মনুষ্যের স্বাভাবিক ইচ্ছা হয় । এবং সেই ইচ্ছা পূর্ণ করিবার জন্য মনুষ্য কিরূপ আচরণ করিবে, কর্মযোগশাস্ত্রের এই বিষয়ের বিচারার্থ, কর্মের নিয়মে বদ্ধ, অনিত্য মায়া-জগতের দ্বৈতী রাজ্যেও আমাদিগকে প্ৰবেশ করিতে হইবে । পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ড, দুয়েরই মূলে যদি একই নিত্য ও স্বতন্ত্র আত্মা থাকে তবে পিণ্ডের অর্থাৎ শরীরের আত্মাকে ব্ৰহ্মাণ্ডের আত্মা বলিয়া জানায় কি বাধা আছে, এবং তাহা কিরূপে দূর হইতে পারে, এই প্রশ্ন সহজেই উত্থিত হয় । এ প্রশ্ন নিরসন করিতে হইলে নামরূপের বিচার করা আবশ্যক হয় । কারণ, বেদান্তদৃষ্টিতে আত্মা কিংবা পরমাত্মা এবং তৎসম্বন্ধীয় নামরূপের আবরণ, সমস্ত পদার্থ এই দুই বর্গে বিভক্ত হওয়ায়, নামরূপাত্মক আবরণ ব্যতীত এক্ষণে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না । নামরূপের এই আবরণ কোন স্থানে ঘন, কোন স্থানে তরল হওয়া প্ৰযুক্ত দৃশ্যজগতের পদার্থসমূহের মধ্যে সচেতন ও অচেতন, এবং সচেতনের মধ্যেও পশু, পক্ষী, মনুষ্য, দেব, গন্ধর্ব, রাক্ষস ইত্যাদি ভেদ হয়, - বেদান্তের এইরূপ মত । আত্মারূপী ব্ৰহ্ম কোথাও নাই এরূপ নহে । ব্রহ্ম প্রস্তরের মধ্যেও আছেন, মনুষ্যের মধ্যেও আছেন । কিন্তু দীপ একই হইলেও লোহার ভিতর কিংবা ন্যূনাধিক স্বচ্ছ কাচের লন্ঠনের মধ্যে রক্ষিত হইলে তাহার যেরূপ ভেদ হইয়া থাকে সেইরূপ আত্মতত্ত্ব সর্বত্র একই হইলেও তৎসম্বন্ধীয় কোষের অর্থাৎ নামরূপাত্মক আবরণের তারতম্যভেদে অচেতন ও সচেতন এই ভেদ হইয়া থাকে । অধিক কি, সচেতনের মধ্যেও মনুষ্য ও পশুর জ্ঞানসম্পাদনা করিবার সমান সামর্থ্য কেন নাই, উহাই তাহার কারণ । 


2) দেহের কোষ ও কর্মাশ্রয়ীভূত লিঙ্গশরীর


আত্মা সর্বত্র একই সত্য; তথাপি তাহা মূলে নির্গুণ ও উদাসীন হওয়ায় মন, বুদ্ধি প্ৰভৃতি নামরূপাত্মক সাধন ব্যতীত আপনা হইতে কিছুই করিতে পারে না; এবং এই সকল সাধন মনুষ্য-যোনি ব্যতীত অন্যত্র পূর্ণরূপে না থাকায়, মনুষ্যজন্ম সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া উক্ত হইয়াছে । এই শ্রেষ্ঠ জন্ম লাভ হইলে, আত্মার নামরূপাত্মক আবরণের স্থূল ও সূক্ষ্ম এই দুই ভেদ হইয়া থাকে । তন্মধ্যে স্থূল আবরণ মনুষ্যের শুক্ৰশোণিতাত্মক স্থূল দেহই । শুক্র হইতে পরে স্নায়ু, অস্থি ও মজ্জা এবং শোণিত হইতে ত্বক, মাংস ও কেশ উৎপন্ন হয়, এইরূপ মানিয়া এই সমস্তকে বেদান্তী ‘অন্নময় কোষ’ বলেন । এই স্থূল কোষ ছাড়িয়া তাহার ভিতরে কি আছে দেখিলে, অনুক্ৰমে বায়ুরূপী প্ৰাণ অর্থাৎ ‘প্ৰাণময় কোষ’, মন অর্থাৎ ‘মনোময় কোষ’, বুদ্ধি অর্থাৎ ‘জ্ঞানময় কোষ’ ও শেষে ‘আনন্দময় কোষ’ পাওয়া যায় । আত্মা তাহারও অতীত । তাই তৈত্তিরীয় উপনিষদে, অন্নময় কোষ হইতে উর্ধে উঠিতে উঠিতে, শেষে আনন্দময় কোষের কথা বলিয়া, বরুণ ভৃগুকে আত্মস্বরূপের পরিচয় করাইয়া দিয়াছেন [তৈ|২|১-৫; ৩|২-৬] । এই সমস্ত কোষের মধ্যে স্থূলদেহের কোষ ছাড়িয়া অবশিষ্ট প্ৰাণাদি কোষ, সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়াদি ও পঞ্চতন্মাত্রকে বেদান্তী ‘লিঙ্গ’ কিংবা ‘সূক্ষ্ম শরীর’ বলেন । তাঁহারা ‘একই আত্মার বিভিন্ন যোনিতে কিরূপে জন্ম লাভ হয়’ সাংখ্য শাস্ত্রের ন্যায় বুদ্ধির অনেক ‘ভাব’ মানিয়া ইহার উপপত্তি করেন না; তাহার বদলে এই সমস্ত কর্মবিপাকের কিংবা কর্মফলের পরিণাম, - ইহাই বেদান্তের সিদ্ধান্ত । এই কর্ম লিঙ্গশরীরের আশ্রয়ে অর্থাৎ আধারে অবস্থিতি করে, এবং আত্মা স্থূলদেহ ছাড়িয়া গেলে এই কর্মও লিঙ্গশরীর দ্বারা তাহার সঙ্গে গিয়া আত্মাকে পুনঃ পুনঃ বিভিন্ন জন্ম গ্ৰহণ করায়, এইরূপ গীতাতে, বেদান্তসূত্রে ও উপনিষদে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । তাই, নামরূপাত্মক জন্মমরণের পুনরাবৃত্তি হইতে মুক্ত হইয়া নিত্য পরমেশ্বরস্বরূপী হইবার পক্ষে কিংবা মোক্ষলাভের পক্ষে দেহস্থ আত্মার প্রতিবন্ধক কি ইহার বিচার করিবার সময় লিঙ্গশরীর ও কর্ম এই দুয়েরই বিচার করা আবশ্যক হয় । তন্মধ্যে সাংখ্য ও বেদান্ত এই দুইয়ের দৃষ্টিতেই পূর্বেই লিঙ্গশরীরের বিচার করা হইয়াছে; সুতরাং ইহার পুনরালোচনা এখানে করিব না । 


3) কর্ম, নামরূপ ও মায়ার পারস্পরিক সম্বন্ধ


যে কর্মের দরুণ আত্মার ব্ৰহ্মজ্ঞান না হইয়া অনেক জন্মের ফেরে পড়িতে হয় সেই কর্মের স্বরূপ কি এবং তাহা হইতে মুক্ত হইয়া অমৃতত্ব লাভ করিবার জন্য এই জগতে মনুষ্যের কিরূপ আচরণ করা উচিত, এই প্রকরণে তাহাই বিচার করিয়াছি ।

সৃষ্টির আরম্ভকালে মূল অব্যক্ত ও নির্গুণ পরব্ৰহ্ম যে-দেশকালাদি নানারূপাত্মক সগুণ শক্তি দ্বারা ব্যক্ত অর্থাৎ দৃশ্যজগৎরূপে প্ৰতীয়মান হয় বেদান্তশাস্ত্ৰে তাহারই নাম ‘মায়া[গী|৭|২৪,২৫]; এবং তাহার মধ্যে কর্মেরও সমাবেশ হয় [বৃ|১|৬|১] । অধিক কি, ‘মায়া’ ও ‘কর্ম’ দুই-ই সমানার্থক বলিলেও চলে । কারণ, প্ৰথমে কোন-না-কোন কর্ম অৰ্থাৎ, ব্যাপার হওয়া ব্যতীত অব্যক্তের ব্যক্ত হওয়া কিংবা নির্গুণের সগুণ হওয়া সম্ভব নহে । এইজন্য আমি আমার মায়া দ্বারা প্ৰকৃতিতে জন্মিয়া থাকি [গী|৪,৬], প্ৰথমে ইহা বলিয়া পরে অষ্টম অধ্যায়ে গীতাতেই “অক্ষর পরব্রহ্ম হইতে পঞ্চমহাভূতাদি বিবিধ সৃষ্টি হইবার যে ক্রিয়া তাহাই কর্ম” এইরূপ কর্মের লক্ষণ প্রদত্ত হইয়াছে [গী|৮|৩] । 


3a) কর্ম ও মায়ার ব্যাখ্যা


কর্ম অর্থে ব্যাপার কিংবা ক্রিয়া; কিন্তু তাহা মনুষ্যকৃতই হউক, জগতের অন্য পদার্থেরই ক্রিয়া হউক, অথবা মূল জগৎ উৎপন্ন হইবারই হউক - এইরূপ ব্যাপক অর্থ এই স্থানে বিবক্ষিত । কিন্তু যে কোন কর্মই ধর না কেন, তাহার পরিণাম সর্বদা ইহাই হয় যে, এক প্রকারের নামরূপ বদলাইয়া তাহার স্থানে অন্য নামরূপ করা; কারণ, এই নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত মূল দ্রব্য কখন বদলায় না, - একই রকম থাকে । উদাহরণ যথা – বয়নক্রিয়া দ্বারা ‘সুতা’ এই নাম গিয়া সেই দ্রব্যের নাম হয় ‘বস্ত্র’; এবং কুম্ভকারী ব্যাপারে ‘মাটি’ এই নামের বদলে ‘ঘট’ এই নাম হয় । তাই মায়ার ব্যাখ্যা করিবার সময় কর্মকে ছাড়িয়া দিয়া নাম ও রূপ এই দুইকেই কেহ কেহ ‘মায়া’ বলেন । তথাপি যখন কর্মের স্বতন্ত্র বিচার করিতে হয় তখন কর্মস্বরূপ ও মায়াস্বরূপ একই, তাহা বলিবার সময় উপস্থিত হয় । তাই মায়া, নামরূপ ও কর্ম, এই তিনিই মূলে একস্বরূপই, - ইহা আরম্ভেই বলা অধিক সুবিধা । উহার মধ্যেও এই সূক্ষ্মভেদ করা যাইতে পারে, যে, মায়া একটি সামান্য শব্দ; এই মায়ার আবির্ভাবের বিশিষ্টাৰ্থক নাম “নামরূপ” এবং মায়ার ব্যাপারের বিশিষ্টাৰ্থক নাম “কর্ম” । কিন্তু সাধারণতঃ এই ভেদ দেখাইবার আবশ্যকতা না থাকায়, তিন শব্দকেই অনেক সময় সমান অর্থে প্রয়োগ করা হইয়া থাকে । 


4) মায়ার মূল অগম্য - অতএব মায়াত্মক কর্মও অনাদি


পরব্রহ্মের এক অংশের উপর নশ্বর মায়ার এই যে আচ্ছাদন (কিংবা উপাধি = উপরে স্থাপিত আবরণ) আমাদের চোখে দেখা যায় তাহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি’ বলে । সাংখ্যবাদী পুরুষ ও প্ৰকৃতি এই দুই তত্ত্বকে স্বয়ম্ভু, স্বতন্ত্র ও অনাদি বলিয়া মানেন । কিন্তু মায়া, নামরূপ কিংবা কর্ম, ক্ষণপরিবর্তনশীল হওয়ায় উহাকে নিত্য ও অবিনাশী পরব্রহ্মের ন্যায় স্বয়ম্ভু ও স্বতন্ত্র বলিয়া মানা ন্যায়দৃষ্টিতে অসঙ্গত । কারণ, নিত্য ও অনিত্য এই দুই কল্পনা পরস্পরবিরুদ্ধ হওয়ায়, দুয়ের অস্তিত্ব একই সময়ে স্বীকার করা যায় না । তাই বেদান্তীরা নির্ধারণ করিয়াছেন যে, বিনাশী প্ৰকৃতি কিংবা কর্মাত্মক মায়া স্বতন্ত্র নহে; কিন্তু এক নিত্য সর্বব্যাপী ও নির্গুণ পরব্রহ্মেতেই মনুষ্যের দুর্বল ইন্দ্ৰিয় সমূহ মায়া-দৃশ্য দর্শন করে । 

কিন্তু মায়া পরতন্ত্র এবং পরব্রহ্মেতেই এই মায়াদৃশ্য দেখা যায় বলিলেই সমস্ত কথার মীমাংসা হয় না । গুণপরিণামে না হইলেও বিবর্তবাদে নির্গুণ ও নিত্য ব্ৰহ্মেতে নশ্বর সগুণ নামরূপের অর্থাৎ মায়ার রূপ দেখা সম্ভব হইলেও এখানে এই আর এক প্রশ্ন উপস্থিত হয় যে, মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়গোচর এই সগুণ রূপ, নিগুৰ্ণ পরব্রহ্মের মধ্যে মূলারম্ভে, কিরূপ অনুক্রমে, কখন্‌ ও কেন প্ৰকাশ পাইল ? অথবা এই অর্থই ব্যবহারিক ভাষায় বলিতে হইলে, নিত্য ও চিদরূপী পরমেশ্বর, নামরূপাত্মক বিনাশী ও জড় জগৎ কখন্‌ ও কেন উৎপন্ন করিলেন ? কিন্তু ঋগবেদের নাসদীয় সূক্তের বর্ণনানুসারে এই বিষয় শুধু মনুষ্যের নহে, দেবতা ও বেদেরও অগম্য হওয়ায় [ঋ|১০|১২৯; তৈ ব্ৰা|২|৮|৯], এই প্রশ্নের - “জ্ঞানদৃষ্টিতে নির্ধারিত নির্গুণ পরব্রহ্মেরই ইহা এক অচিন্ত্য লীলা” - ইহা অপেক্ষা বেশী কোন উত্তর দেওয়া যায় না [বেসূ|২|১|৩৩] । যখন অবধি দেখিতেছি তখন অবধিই নির্গুণ ব্ৰহ্মের সঙ্গে সঙ্গেই নামরূপাত্মক নশ্বর কর্ম কিংবা সগুণ মায়া আমাদের দৃষ্টিগোচর হইতেছে - এইরূপ গোড়ায় ধরিয়া লইয়াই আমাকে অগ্রসর হইতে হইবে । এইজন্য মায়াত্মক কর্ম অনাদি এইরূপ বেদান্ত-সূত্রে উক্ত হইয়াছে [বেসূ|২|১, ৩৫-৩৭]; ভগবদ্‌গীতাতেও ভগবান, প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র নহে, উহা ‘আমারই মায়া’ [গী|৭|১৪] এইরূপ বর্ণনা করিয়া পরে এই প্ৰকৃতি অর্থাৎ মায়া ও পুরুষ উভয়ই ‘অনাদি’ বলিয়াছেন [গী|১৩|১৯] । 

সেইরূপ আবার শ্ৰীশঙ্করাচার্য আপন ভাষ্যে মায়ার লক্ষণ দিবার সময় বলিয়াছেন যে, “সর্বজ্ঞেশ্বরস্যাহত্মভুতে ইবাহবিদ্যাকল্পিতে নামরূপে তত্ত্বান্যত্বাভ্যামনির্বচনীয়ে সংসারপ্ৰপঞ্চবীজভুতে সর্বজ্ঞস্যেশ্বরস্য ‘মায়া’, ‘শক্তি’, ‘প্রকৃতি’রিতি চ শ্রুতিস্মৃত্যোরভিলপ্যেতে” [বেসূ|শাং ভা|২|১|১৪] । “(ইন্দ্রিয়গণের) অজ্ঞানবশত মূলব্ৰহ্মেতে কল্পিত নামরূপকেই শ্রুতি ও স্মৃতি গ্রন্থে সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের ‘মায়া’ ‘শক্তি’ কিংবা ‘প্রকৃতি’ বলা হয়”; এই নামরূপ সর্বজ্ঞ পরমেশ্বরের আত্মভূত দ্বারা জানা যায়, কিন্তু ইহা জড় হওয়া প্রযুক্ত ইহা পরমেশ্বর হইতে ভিন্ন বা অভিন্ন (তত্ত্বান্যত্ব), এবং ইহাই জড় জগতের (দৃশ্য) বিস্তারের মূল, তাহা বলিতে পারা যায় না”; এবং “এই মায়ার যোগেই পরমেশ্বর হইতে এই জগত সৃষ্ট হইয়াছে এইরূপ দেখা যায় বলিয়া এই মায়া নশ্বর হইলেও দৃশ্য জগতের উৎপত্তির পক্ষে আবশ্যক ও অত্যন্ত উপযুক্ত এবং ইহাকেই উপনিষদে অব্যক্ত, আকাশ, অক্ষর, এই সকল নাম দেওয়া হইয়াছে” [বেসূ|শাং ভা|১|৪|৩] । ইহা হইতে দেখিতে পাওয়া যায় যে চিন্ময় (পুরুষ) ও অচেতন মায়া (প্রকৃতি), এই দুই তত্ত্বকে সাংখ্যবাদী স্বয়ম্ভূ, স্বতন্ত্র ও অনাদি বলিয়া মানেন; কিন্তু বেদান্তী মায়ার অনাদিত্ব একভাবে স্বীকার করিলেও মায়াকে স্বয়ম্ভূ ও স্বতন্ত্র স্বীকার করেন না; এবং এই কারণে সংসারাত্মক মায়াকে বৃক্ষরূপে বর্ণনা করিবার সময় এইরূপ গীতায় উল্লেখ আছে - “ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে নান্তো নচাদির্ন চ সংপ্ৰতিষ্ঠা” [গী|১৫|৩] - এই সংসারবৃক্ষের রূপ, অন্ত, আদি, মূল কিংবা তল পাওয়া যায় না । সেইরূপ তৃতীয় অধ্যায়ে ‘কর্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি’ [গী|৩|১৫] ব্ৰহ্ম হইতে কর্ম উৎপন্ন হইয়াছে ; ‘যজ্ঞঃ কর্মসমুদ্ভবঃ’ [৩|১৪] যজ্ঞও কর্ম হইতেই উৎপন্ন হয়; কিংবা ‘সহযজ্ঞাঃ প্ৰজাঃ সৃষ্ট্বা’ [গী|৩|১০] ব্ৰহ্মদেব প্ৰজা (জগৎ) ও যজ্ঞ (কর্ম) একসঙ্গেই সৃষ্টি করিয়াছেন - এইরূপ যে বৰ্ণনা আছে তাহার তাৎপর্যও এই যে, “কর্ম কিংবা কর্মরূপী যজ্ঞ, জগৎ অর্থাৎ প্ৰজা, এই সমস্ত এক সঙ্গেই সৃষ্ট হইয়াছে” । এখন এই জগৎ প্ৰত্যক্ষ ব্ৰহ্মদেব হইতে সৃষ্ট হইয়াছেই বলো কিংবা মীমাংসকের মতানুসারে সেই ব্ৰহ্মদেব নিত্য বেদশব্দ হইতে উহা উৎপন্ন করিয়াছেনই বলো, উভয়ের অর্থ একই [মভা শাং|২৩১; মনু|১|২১] । সারকথা, কর্ম অর্থে দৃশ্য জগতের সৃষ্টি হইবার সময় মূল নির্গুণ ব্রহ্মেতেই দৃশ্যমান ব্যাপার । এই ব্যাপারকেই নামরূপাত্মক মায়া বলা হয়; এবং এই মূলকর্ম হইতেই চন্দ্ৰসূর্যাদি জাগতিক সমস্ত পদার্থের ব্যাপার পরে পরম্পরাক্রমে উৎপন্ন হইয়াছে [বৃ|৩|৮|৯] । জাগতিক সমস্ত ব্যাপারের মূলভূত এই যে জগৎ উৎপত্তিকালের কর্ম কিংবা মায়া তাহা ব্ৰহ্মেরই কোন এক অচিন্ত্য লীলা, স্বতন্ত্র বস্তু নহে, এইরূপ জ্ঞানীপুরুষেরা বুদ্ধির দ্বারা নিরূপণ করিয়াছেন । [“What belongs to mere appearance is necessarily subordinated to the nature of the thing in itself”. Kant's Metaphysics of Morals (Abbot's translation, in Kant's “Theory of Ethics” P.81)]

কিন্তু জ্ঞানের গতি এখানে বাধিত হওয়া প্ৰযুক্ত এই লীলা, নামরূপ কিংবা মায়াত্মক কর্ম ‘কখন্‌’ উৎপন্ন হইয়াছে তাহার সন্ধান পাওয়া যায় না । তাই, কেবল কর্মজগতেরই বিচার যখন করিতে হইবে, তখন এই পরতন্ত্র ও নশ্বর মায়া এবং মায়ার সঙ্গে সঙ্গে তদঙ্গভূত কর্মকেও ‘অনাদি’ বলা বেদান্তশাস্ত্রের রীতি [বেসূ|২|১|৩৫] । ইহা মনে রাখা আবশ্যক - যে, সাংখ্যবাদীর ন্যায় অনাদি বলিবার এরূপ অর্থ নহে যে, মায়া মূলেতেই পরমেশ্বরের সমানই নিরারম্ভ ও স্বতন্ত্র; - অনাদি শব্দে দুর্জ্ঞেয়ারম্ভ আর্থাৎ যাহার আদি (আরম্ভ) জানা যায় না, এইরূপ অর্থ এই স্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে । 


5) কর্মের অখণ্ডিত প্রযত্ন - কর্মবিপাক


কিন্তু চিদ্‌রূপ ব্ৰহ্ম কর্মাত্মক অর্থাৎ দৃশ্যজগৎরূপে কখন্‌ ও কেন প্ৰকাশিত হইলেন ইহার সন্ধান আমরা না পাইলেও এই মায়াত্মক কর্মের পরবর্তী সমস্ত ব্যাপারের নিয়ম নির্ধারিত আছে এবং তন্মধ্যে অনেক নিয়মই আমরা নিশ্চিত রূপে জানিতে পারি । মূল প্রকৃতি হইতে অৰ্থাৎ অনাদি মায়াত্মক কর্ম হইতে জগতের নামরূপাত্মক বিবিধ পদার্থ কিরূপ অনুক্রমে উৎপন্ন হইল, অষ্টম প্রকরণে সাংখ্যশাস্ত্রানুসারে ইহার বিচার করা হইয়াছে; সেইখানেই আধুনিক আধিভৌতিক শাস্ত্রের সিদ্ধান্তও তুলনার জন্য কথিত হইয়াছে । বেদান্তশাস্ত্ৰ প্রকৃতিকে পরব্রহ্মের ন্যায় স্বয়ম্ভূ বলিয়া মানে না সত্য; কিন্তু প্ৰকৃতির পরবর্তী বিস্তারের সাংখোক্ত ক্রম বেদান্তেরও স্বীকৃত বলিয়া এখানে তাহার পুনরুক্তি করি নাই । কর্মাত্মক মূল প্রকৃতি হইতে বিশ্বোৎপত্তির যে ক্ৰম পূর্বে বলা হইয়াছে তাহাতে যে সাধারণ নিয়মে মনুষ্যকে কর্মফল ভোগ করিতে হয় তাহার কোনই বিচার করা হয় নাই । তাই এই সকল নিয়ম এক্ষণে বিচার করা আবশ্যক । ইহাকেই ‘কর্মবিপাক’ বলে । এই কর্মবিপাকের প্ৰথম নিয়ম এই যে, কর্ম একবার শুরু হইলে তাহার ব্যাপার কিংবা চেষ্টা পরে অখণ্ডরূপে সমান চলিতে থাকে; এবং ব্ৰহ্মার দিন শেষ হইয়া জগতের সংহার হইলেও এই কর্ম বীজ রূপে অবশিষ্ট থাকে এবং পুনর্বার জগতের আরম্ভ হইলে সেই কর্মবীজ হইতেই পুনৰ্বার অঙ্কুর পূর্ববৎ উদ্গত হয় । মহাভারতে উক্ত আছে যে,-
যেষাং যে যানি কর্মাণি প্ৰাক্‌সৃষ্ট্যাং প্রতিপেদিরে ৷
তান্যেব প্ৰতিপদ্যন্তে সৃজ্যমানাঃ পুনঃ পুনঃ ॥
অর্থাৎ “প্ৰত্যেক প্ৰাণী পূর্বের সৃষ্টিতে যে যে কর্ম করিয়াছে সেই সেই কর্ম (তাহার ইচ্ছা হউক বা না হউক) সে যথাপূর্ব প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে” [মভা শাং|২৩১|৪৮,৪৯ ও গী|৮|১৮ ও ১৯ দেখ]“গহনা কর্মণো গতিঃ” [গী|৪|১১] - কর্মের গতি কঠিন; শুধু তাহাই নহে, কর্মের বন্ধনও অতীব কঠিন । কেহই কর্ম হইতে মুক্ত হয় না । কর্মবশতই বায়ু বহিতেছে, কর্মবশতই সূৰ্যচন্দ্রাদি পরিভ্রমণ করিতেছে; এবং ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও শঙ্কর আদি সগুণ দেবতারাও কর্মবশতই কার্যে নিমগ্ন রহিয়াছেন, ইন্দ্রাদির কথা দূরে থাক্‌ ! সগুণ অর্থে নামরূপাত্মক, এবং নামরূপাত্মক অর্থে কর্ম কিংবা কর্মের পরিণাম । মায়াত্মক কর্ম মূলারম্ভে কোথা হইতে আসিল ইহা যখন বলা যায় না, তখন তদঙ্গভূত মনুষ্য এই কর্মের ফেরে প্রথমে কিরূপে আবদ্ধ হইল তাহাই বা কি প্রকারে বলা যায় ? কিন্তু যে কোন প্রকারেই হউক না, সেই কর্মের ফেরে একবার আট্‌কা পড়িলে পরে, তাহার এক নামরূপাত্মক দেহের নাশ হইলে কর্মের পরিণাম বশতঃ তাহাকে পরে এই জগতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করিতে হয় । কারণ, আধুনিক আধিভৌতিক শাস্ত্রীরাও এক্ষণে স্থিরসিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, কর্মশক্তির কখনই নাশ হয় না; যে শক্তি আজ এক নামরূপে দেখা যায় তাহাই সেই নামরূপের নাশ হইলে অন্য নামরূপে প্রকট হইয়া থাকে ।* 
* [এই কল্পনা কেবল হিন্দুধর্মের কিংবা আস্তিকবাদীদিগেরই স্বীকৃত এরূপ নহে । বৌদ্ধেরা আত্মা না মানিলেও বৈদিক ধর্মান্তর্গত পুনর্জন্মের কল্পনা তাহারা সম্পূৰ্ণরূপে আপন ধর্মের মধ্যে গ্ৰহণ করিয়াছে; বিংশতি শতাব্দীতে “পরমেশ্বর মরিয়াছেন” এইরূপ যিনি বলেন সেই পাক্কা নিরীশ্বরবাদী জর্মণ পণ্ডিত নিৎসেও পুনর্জন্মবাদ স্বীকার করিয়াছেন । কর্মশক্তির যে রূপান্তর নিয়ত হইয়া থাকে তাহা সীমাবিশিষ্ট এবং কাল অনন্ত হওয়া প্রযুক্ত, যে নামরূপ একবার হইয়াছে তাহা কখন না কখন পরে উৎপন্ন হইবেই এবং সেই জন্য কর্মের চক্র কিংবা ফের নিছক্‌ আধিভৌতিক দৃষ্টিতেই সিদ্ধ হয়, এবং এইরূপ কল্পনা ও উপপত্তি আমাদের বুদ্ধিতে স্বতঃস্ফুর্ত হয় - এইরূপ তিনি লিখিয়াছেন ! Nietzsche’s “Eternal Recurrence, (Complete Works, Engl. Trans. Vol. X I, PP, 235 256.)]

এবং এক নামরূপের নাশ হইলে পর তাহাকে যখন ভিন্ন ভিন্ন নামরূপ প্ৰাপ্ত হইতেই হয় তখন এই ভিন্ন ভিন্ন নামরূপ নিৰ্জীবই হইবে, তাহা হইতে ভিন্ন প্রকারের কখনই হইতে পারে না, এইরূপও মানিতে পারা যায় না । অধ্যাত্মদৃষ্টিতে এই নামরূপাত্মক পরম্পরাকেই জন্ম-মরণের ফের কিংবা সংসার বলে; এবং এই নামরূপের আধারভূত শক্তির নাম সমষ্টিরূপে ব্ৰহ্ম ও ব্যাষ্টিরূপে জীবাত্মা হইয়াছে । বস্তুত দেখিতে গেলে, এই আত্মা জন্মেও না মরেও না; ইহা নিত্য ও চিরস্থায়ী । কিন্তু কর্মের ফেরে আটকা পড়ায় এক নামরূপের নাশ হইলে পর তাহাকেই অন্য নামরূপ প্ৰাপ্ত হইতেই হয় । আজ যাহা করিবে তাহার ভোগ কাল হইবে, কাল যাহা করিবে পরশ্ব তাহার ভোগ হইবে; — শুধু তাহা নহে, এই জন্মে যাহা করিবে তাহা পরজন্মে ভোগ করিতে হইবে, - এইরূপে এই ভবচক্র সর্বদাই চলিতেছে । কেবল আমাদের নহে, কখন কখন আমাদের নামরূপাত্মক দেহ হইতে উৎপন্ন আপন পুত্ৰ, পৌত্র ও প্রপৌত্রদেরও এই কর্মফল ভোগ করিতে হয় এইরূপ মনুস্মৃতিতে ও মহাভারতে উক্ত হইয়াছে [মনু|৪|১৭৩; মভা|আ|৮০|৩] । শান্তিপর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলিতেছেন; -
পাপং কর্ম কৃতং কিঞ্চিদ্‌যদি তস্মিন্ন দৃশ্যতে ৷ 
নৃপতে তস্য পুত্ৰেষু পৌত্রেন্বপি চ নপ্তৃষু ॥
“হে রাজন্‌ ! কোন পাপকর্মের ফল পাওয়া গেল না এইরূপ দেখা গেলেও সেই কর্মফল পুত্র, পৌত্র ও প্রপৌত্রের ভুগিতে হয়” [শাং|১২৯|২১] । কোন কোন উৎকট রোগ বংশপরম্পরাক্রমে চলিতে থাকে, এইরূপ আমরাও প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । সেইরূপ আবার, কেহ জন্ম হইতেই দরিদ্র হয় এবং কেহ রাজকুলে জন্মগ্রহণ করে । ইহারও উপপত্তি কর্মবাদের দ্বারাই নিষ্পন্ন হইয়া থাকে; এবং অনেকের মতে, ইহাই কর্মবাদের সত্যতা সম্বন্ধে প্ৰমাণ । 


6) পরমেশ্বর কর্মচক্রে হস্তক্ষেপ করেন না


কর্মের এই চক্র ‘বা চাকীকল’ একবার ঘুরিতে আরম্ভ করিলে পরমেশ্বরও তাহা বন্ধ করিতে পারেন না । সমস্ত জগৎ পরমেশ্বরের ইচ্ছাতেই চলিতেছে, এই দৃষ্টিতে দেখিলে বলিতে হয় যে, কর্মফলের বিধাতা পরমেশ্বর হইতে ভিন্ন আর কেহ হইতে পারে না [বেসূ|৩|২|৩৮; কৌ|৩|৮]; এবং সেই জন্য, “লভতে চ ততঃ কামান্‌ ময়ৈব বিহিতান্‌ হি তান্‌” [গী|৭|২২] – আমার নির্দিষ্ট বাঞ্ছিত ফল মনুষ্য প্রাপ্ত হয় — এইরূপ ভগবান বলিয়াছেন । কিন্তু কর্মফল নির্দিষ্ট করিয়া দিবার কাজ পরমেশ্বরের হইলেও যাহার যেরূপ ভালমন্দ কর্ম, কর্মাকর্মের যোগ্যতা, তদনুরূপই এই ফল নির্দিষ্ট হইয়া থাকে; পরমেশ্বর এই বিষয়ে বস্তুত উদাসীন; মনুষ্যে মনুষ্যে ভালমন্দের ভেদ হইলেও পরমেশ্বর বৈষম্য (বিষম বুদ্ধি) ও নৈঘৃণ্য (নিৰ্দয়তা) দোষের পাত্র হন না, এইরূপ বেদান্তশাস্ত্রের চরম সিদ্ধান্ত [বেসূ|২|১|৩৪] । এই অর্থেই গীতাতেও উক্ত হইয়াছে – “সমোহহং সর্বভূতেষু” [গী|৯|২৯] – ঈশ্বর সকলের সম্বন্ধেই সমান; কিংবা -
নাদত্তে কস্যচিৎ পাপং ন চৈব সুকৃতং বিভূঃ ॥
পরমেশ্বর কাহারও পাপ গ্ৰহণ করেন না, পুণ্যও গ্ৰহণ করেন না, কর্ম কিংবা মায়ার স্বাভাবিক চক্ৰ চলিতে থাকায় প্রাণীমাত্রেরই আপনি আপন কর্মানুরূপ সুখদুঃখ ভোগ করিতে হয়, [গী|৫|১৪,১৫] । সারকথা, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় জাগতিক কর্মের কখন্‌ আরম্ভ হইয়াছে কিংবা তদঙ্গভূত মনুষ্য, প্ৰথমে কর্মের চক্রে কিরূপে পতিত হইল ইহার উত্তর দেওয়া আমাদের বুদ্ধির অসাধ্য হইলেও কর্মের পরবর্তী পরিণাম অর্থাৎ ফল কেবল কর্মের নিয়মেই হইয়া থাকে এইরূপ যখন দেখা যায়, তখন জগতের আরম্ভ হইতে প্রত্যেক প্রাণী নামরূপাত্মক অনাদি কর্মের নিয়মের মধ্যে আটকাইয়া পড়িয়াছে তাহা আমাদের বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারণ করিতে পারি । ‘কর্মণা বধ্যতে জন্তুঃ’ এই যে বচন এই প্রকরণের আরম্ভেই দেওয়া হইয়াছে, তাহার অর্থই এই ।


7) কর্মবন্ধের সুদৃঢ়তা


এই অনাদি কর্মপ্রবাহের পর্য্যায়শব্দ অনেক, যথা, সংসার, প্রকৃতি, মায়া, দৃশ্য জগৎ, জাগতিক নিয়ম ইত্যাদি । কারণ সৃষ্টিশাস্ত্রের নিয়ম নামরূপের মধ্যে অবস্থিত পরিবর্তনেরই নিয়ম; এবং এই দৃষ্টিতে দেখিলে, সমস্ত আধিভৌতিক, শান্ত্র নামরূপাত্মক মায়াপ্রপঞ্চের মধ্যেই আসে । এই মায়ার নিয়ম ও বন্ধন সুদৃঢ় ও সর্বব্যাপী । তাই, এই নামরূপাত্মক মায়ার কিংবা দৃশ্যজগতের অতীত অথবা মূলস্থ অন্য কোন নিত্য তত্ত্ব নাই এইরূপ যিনি মানেন সেই হেকেলের ন্যায় নিছক আধিভৌতিক শাস্ত্ৰজ্ঞ এই জগৎচক্ৰ যে দিকে টানিবে মনুষ্যকে সেইদিকেই যাইতে হইবে, এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । এই সকল পণ্ডিত এইরূপ বলেন যে, নামরূপাত্মক নশ্বর স্বরূপ হইতে আমি মুক্ত হইব কিংবা অমুক কাজ করিলে আমার অমৃতত্ব লাভ হইবে, এইরূপ প্ৰত্যেক মানুষ্যের যে ধারণা, তাহা নিছক ভ্ৰান্তি; আত্মা কিংবা পরমাত্মা বলিয়া স্বতন্ত্র পদার্থ নাই, এবং অমৃতত্বও মিথ্যা; শুধু তাহাই নহে, এই জগতে কোন মনুষ্যই আপনি ইচ্ছাতে কিছুই করিতে পারে না - তাহার সে স্বাতন্ত্র্য নাই । মনুষ্য আজ যে কাজ করে, তাহা পূর্বে তাহার নিজের কিংবা তাহার পূর্বপুরুষের দ্বারা কৃত কর্মেরই পরিণাম; সুতরাং উক্ত কাজ করা কিংবা না করা, তাহার ইচ্ছার উপর নির্ভর করে না । উদাহরণ যথা - অন্যের কোন ভাল জিনিস দেখিলে উহা চুরি করিব এইরূপ বুদ্ধি পূর্বকর্মবশতঃ কিংবা বংশপরম্পরাগত সংস্কারবশতঃ কোন কোন ব্যক্তির মনে, তাহার ইচ্ছা না হইলেও, উৎপন্ন হইয়া উক্ত ব্যক্তিকে ঐ বস্তু চুরি করিতে প্ৰবৃত্ত করে । সারকথা, ‘অনিচ্ছন্‌,অপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ’ [গী|৩|৩৬] ইচ্ছা না থাকিলেও মনুষ্য পাপ করে - এইরূপ গীতাতে যাহা উক্ত হইয়াছে সেই তত্ত্ব সর্বত্র একইরূপ উপযোগী, তাহার ব্যতিক্রম নাই, তাহা হইতে মুক্ত হইবারও পথ নাই, ইহাই এই আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের মত । এই মতানুসারে দেখিলে মানিতে হয় যে, মনুষ্যের আজ যে বুদ্ধি কিংবা ইচ্ছা হইতেছে তাহা কল্যকার কর্মের ফল, এবং কল্যকার বুদ্ধি পরশ্বের কর্মের ফলঃ এবং শেষে এই কারণপম্পরার অন্ত না পাওয়ায় মনুষ্য নিজের স্বতন্ত্র বুদ্ধতে কখনই কিছু করিতে পারে না, যাহা কিছু ঘটে তাহা পূর্বকর্মের অর্থাৎ দৈবেরই ফলকারণ, প্ৰাক্তন কর্মেরই লোকে “দৈব” নাম দিয়া থাকে । এইরূপ, যদি কোন কাজ করিবার কিংবা না করিবার স্বাতন্ত্র্যই মনুষ্যের নাই, তবে মনুষ্য আপন আচরণ অমুক প্রকারে সংশোধন করিবে, অমুক প্রকারে ব্ৰহ্মাত্মৈক্য-জ্ঞান সম্পাদন করিয়া বুদ্ধিকে পরিশুদ্ধ করিবে, এ কথাও ব্যর্থ হইয়া পড়ে । নদীর প্রবাহে পতিত কাষ্ঠখণ্ডের ন্যায়, মায়া, প্রকৃতি, সৃষ্টিক্রম, কিংবা কর্মপ্রবাহ যেদিকে তাহাকে টানিবে নীরবে সেই দিকেই যাইতে হইবে - তাহাতে প্ৰগতিই হউক বা অধোগতিই হউক । এই সম্বন্ধে অন্য কতকগুলি উৎক্রান্তিবাদী এইরূপ বলেন যে, প্ৰকৃতির স্বরূপ স্থির নহে, নামরূপ ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়; এই কারণে যে জাগতিক নিয়মে পরিবর্তন ঘটিয়া থাকে তাহা দেখিয়া, মনুষ্য আপনার লাভ যাহাতে হয় এইরূপে বাহ্য জগতকে বদলাইয়া লইবে; এবং প্রত্যক্ষ ব্যবহারে এই নীতিসূত্ৰ-অনুসারেই অগ্নি কিংবা বিদ্যুৎ-শক্তিকে মনুষ্য আপনার কাজে লাগাইয়া থাকে, এইরূপ আমরা দেখিতে পাই । সেইরূপ আবার, চেষ্টার দ্বারা মনুষ্যস্বভাবও ন্যূনাধিক পরিমাণে পরিবর্তিত হয়, ইহাও অনুভূতির বিষয় । 


8) প্রবৃত্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রস্তাবনা


কিন্তু জগৎসৃষ্টির কার্যে কিংবা মনুষ্যের স্বভাব পরিবর্তন হয় বা হয় না, কিংবা পরিবর্তন করিতে হইবে কি না - ইহা উপস্থিত প্রশ্ন নহে; এই পরিবর্তন করিবার যে বুদ্ধি বা ইচ্ছা মনুষ্যের হইয়া থাকে, সেই বিষয়ে তাহার স্বাধীনতা আছে কি না ইহাই অগ্ৰে স্থির করিতে হইবে । এবং আধিভৌতিক শাস্ত্রদৃষ্টিতে, এই বুদ্ধি হওয়া বা না-হওয়াই যদি ‘বুদ্ধিঃ কর্মানুসারিণী’ এই নীতি অনুসারে প্ৰকৃতির, কর্মের, কিংবা জগতের নিয়মে প্ৰথমেই নির্ধারিত হইয়া থাকে তবে এই আধিভৌতিক শাস্ত্ৰানুসারে কোন কর্ম করিবার কিংবা না করিবার স্বাতন্ত্র্য মনুষ্যের নাই, এইরূপই নিষ্পন্ন হয় । এই মতবাদকে ‘বাসনা-স্বাতন্ত্র্য’, ‘ইচ্ছা-স্বাতন্ত্র’, কিংবা ‘প্রবৃত্তি-স্বাতন্ত্র্য’ বলে । শুধু কর্মবিপাকের কিংবা শুধু আধিভৌতিক শাস্ত্রের দৃষ্টিতেই যদি বিচার করা যায় তবে কোন মনুষ্যেরই কোন প্ৰকার প্ৰবৃত্তি-স্বাতন্ত্র্য বা ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্য নাই - কর্মের অভেদ্য লৌহবেষ্টনে গাড়ীর চাকার মতো প্ৰত্যেক মনুষ্য চারিদিকে দৃঢ় রূপে আবদ্ধ রহিয়াছে, পরিণামে এইরূপ সিদ্ধান্ত করিতে হয় । কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সত্যতার পক্ষে মনুষ্যের অন্তঃকরণ সাক্ষ্য দিতে প্ৰস্তুত নহে । প্রত্যেক মনুষ্যের অন্তঃকরণ বলে যে, সূর্যকে পশ্চিমদিকে উদিত করিবার সামৰ্থ্য আমার না থাকিলেও আমার এইটুকু শক্তি নিশ্চয়ই আছে যে, আমি নিজে যে কাজ করিতে পারি, তাহার সারাসার বিচারপূর্বক করা বা না করা, কিংবা যখন আমার সম্মুখে পাপ ও পুণ্যের বা ধর্ম অধর্মের দুই মার্গ উপস্থিত হয়, সেই দুই মার্গের মধ্যে ভাল কিংবা মন্দকে স্বীকার করা আমার ইচ্ছাধীন অর্থাৎ আয়ত্তের মধ্যে । এই ধারণা সত্য কি মিথ্যা, এক্ষণে তাহাই আমাদের দেখিতে হইবে । যদি মিথ্যা বলো, তবে এই ধারণাকেই ভিত্তি করিয়া হত্যা প্রভৃতি অপরাধকারীকে অপরাধ স্থির করিয়া দণ্ড দেওয়া হয়; আর যদি সত্য বলিয়া মানো তবে কর্মবাদ, কর্মবিপাক, কিংবা দৃশ্যজগতের নিয়ম মিথ্যা প্ৰতীত হয় । আধিভৌতিক শাস্ত্রে কেবল জড়পদার্থ সংক্রান্ত ব্যাপারেরই বিচার করা হয় বলিয়া এই প্রশ্ন উত্থিত হয় না । কিন্তু যে কর্মযোগশাস্ত্ৰে জ্ঞানবান মনুষ্যকে কর্তব্যাকর্তব্যের বিচার করিতে হয়, তাহাতে এই প্রশ্নটি গুরুতর হওয়ায় তাহার উত্তর দেওয়া আবশ্যক । কারণ, মনুষ্যের কোনই প্রবৃত্তিস্বাতন্ত্র্য নাই এইরূপ একবার স্থির সিদ্ধান্ত হইলে, অমুক প্রকারে বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিবে, কিংবা অমুক কার্য করিবে এবং অমুক কার্য করিবে না, অমুক ধর্ম, অমুক অধর্ম ইত্যাদি বিধিনিষেধশাস্ত্রের সমস্ত গোলযোগই স্বতঃই অন্তৰ্হিত হইবে [বেসূ|২|৩|৩৩],* এবং তখন পরম্পরাক্রমে কিংবা প্রত্যক্ষ রীতিতে মহামায়া প্রকৃতির দাসত্বে থাকাই পরম পুরুষার্থ হইবে । অথবা পুরুষার্থ’ই কেন ? - আপনার অধীনে থাকার কথা হয় তো পুরুষাৰ্থ ঠিক । কিন্তু যেখানে আপনার বলিয়া তিলমাত্ৰ সত্তা বা ইচ্ছা রহিল না, সেখানে পরতন্ত্রতা কিংবা দাস্য ছাড়া আর অন্য কি হইতে পারে ? লাঙ্গলে জোড়া গরুর মতো সকলে প্ৰকৃতির হুকুমে খাটিয়া মরে, তাই শঙ্কর কবি বলেন “পদার্থধর্মের শৃঙ্খল” নিত্য আমাদের পায়ে পরিতে হয় । আমাদের দেশে কর্মবাদে কিংবা দৈববাদে এবং পাশ্চাত্য দেশে প্রথম প্রথম খৃষ্টধর্মান্তর্গত ভবিতবাতাবাদে এবং আধুনিককালে শুদ্ধ আধিভৌতিক শাস্ত্রের সৃষ্টিক্রমবাদে ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্যের দিকে পণ্ডিতগণের মনোযোগ আকৃষ্ট হওয়ায় এই বিষয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হইয়া গিয়াছে; এখনও চলিতেছে । কিন্তু ঐ সমস্ত এইখানে বলা অসম্ভব বলিয়া বেদান্তশাস্ত্রে ও ভগবদ্গীতায় এই প্রশ্নের কি উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে, কেবল তাহারই বিচার এই প্রকরণে করিয়াছি । 
*(বেদান্তসূত্রের এই অধিকরণকে ‘জীবকর্তৃত্বাধিকরণ’ বলে । তাহার প্রথম সূত্রই ‘কর্তা শাস্ত্রার্থবস্বাৎ” অর্থাৎ বিধিনিষেধশাস্ত্রে অর্থবস্তু হইবার জন্য জীবকে কর্তা বলিয়া মানা আবশ্যক হয় । পাণিনির “স্বতন্ত্রঃ কর্তা” সূত্রের [পা|১|৪|৫৪] ‘কর্তা’ শব্দেই আত্মস্বাতন্ত্র বুঝায় এবং ইহা হইতে দেখা যাইতেছে যে, এই অধিকরণ ইহারই সংক্রান্ত ।)


9) কর্মবিভাগ


কর্ম প্ৰবাহ অনাদি এবং কর্ম একবার শুরু হইলে কর্মচক্রের উপর পরমেশ্বরও হস্তক্ষেপ করেন না সত্য । তথাপি অধ্যাত্মশাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত যে, দৃশ্যজগৎ শুধু নামরূপ অথবা কর্মমাত্র নহে; কিন্তু এই নামরূপাত্মক আবরণের নীচে আধারভূত এক আত্মরূপী স্বতন্ত্র ও অবিনাশী ব্ৰহ্মজগৎ আছে এবং মনুষ্যের দেহান্তর্ভূত আত্মা সেই নিত্য ও স্বতন্ত্র পরব্রহ্মেরই অংশ । এই সিদ্ধান্তের সহায়তায় প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে যাহা অনিবাৰ্য বাধা বলিয়া মনে হয় সেই বাধা হইতেও মুক্ত হইবার এক পন্থা আছে, এইরূপ আমাদের শাস্ত্রকারেরা স্থির করিয়াছেন । কিন্তু ইহার বিচার করিবার পূর্বে কর্মবিপাক-প্রক্রিয়ার শেষ অংশের বর্ণনা সম্পূর্ণ করা আবশ্যক । যেরূপ কর্ম করিবে সেইরূপ ভোগ হইবে, এই নিয়ম কেবল এক ব্যক্তির প্রতিই প্ৰযুক্ত হয় না; পরিবার, জাতি, রাষ্ট্র, এমন-কি সমস্ত জগতের পক্ষেও ইহা উপযোগী । নিজ কর্মানুসারে ফলভোগ করিতেই হয় । এবং পরিবারের মধ্যে, জাতির মধ্যে কিংবা দেশের মধ্যে প্ৰত্যেক মনুষ্যের সমাবেশ হওয়া প্ৰযুক্ত প্ৰত্যেক মনুষ্যকে স্বীকৃত কর্মের ফল শুধু নহে, পারিবারিক, সামাজিক কর্মের ফলও অংশতঃ ভোগ করিতে হয় । কিন্তু প্ৰচলিত ব্যবহারে প্রায় এক মনুষ্যের কর্মসম্বন্ধেই বিচার করা হয় বলিয়া কর্মবিপাক প্রক্রিয়াতে কর্মবিভাগ প্ৰায় একটী মনুষ্যকে লক্ষ্য করিয়াই করা হয় । 


9a) অশুভ কর্মবিভাগ : কায়িক, বাচিক ও মানসিক (মনু)


উদাহরণ যথা, - মনুষ্যকৃত অশুভ কর্মের – কায়িক, বাচিক ও মানসিক - মনু এই তিন ভেদ করিয়া, ব্যভিচার, হিংসা ও চৌর্য এই তিনটীকে কায়িক; কটু, মিথ্যা, কম করিয়া বলা ও প্রলাপ বকা এই চারিটীকে বাচিক; এবং পরদ্রব্যাভিলাষ, অন্যের মন্দ চিন্তা এবং মিথ্যা আগ্রহ করা এই তিনটীকে মানসিক - এই প্রকারে সবশুদ্ধ দশ প্রকার অশুভ কিংবা পাপ কর্মের উল্লেখ করিয়া [মনু|১২|৫-৭; মভা|অনু|১৩], সেই সব কর্মের ফলও বলিয়াছেন । তথাপি এই ভেদ চিরস্থির নহে । 


9b) সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক (ভগবদ্গীতা)


কারণ এই অধ্যায়েই পরে সমস্ত কর্মের - সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক - এই তিন ভেদ করা হইয়াছে এবং প্রায় ভগবদ্গীতার বর্ণনানুসারেই এই তিন প্রকার গুণের কিংবা কর্মের লক্ষণও প্রদত্ত হইয়াছে [গী|১৪|১১-১৫; ১৮|২৩-২৫; মনু|১২|৩১-৩৪] । 


9c) সঞ্চিত, প্রারব্ধ ও ক্রিয়মাণ (কর্মবিপাক)


কিন্তু কর্মবিপাক প্রকরণে কর্মের যে বিভাগ সাধারণত পাওয়া যায় তাহা এই দুই হইতেও ভিন্ন; তাহাতে কর্মের সঞ্চিত, প্রারব্ধ, ও ক্রিয়মাণ, এই তিন ভেদ করা হইয়া থাকে । কোন মনুষ্য এই ক্ষণ পর্যন্ত যে কর্ম করিয়াছে — তাহা এই জন্মেই করা হউক বা পূর্ব জন্মেই হউক - সে সমস্তকে তাহার ‘সঞ্চিত’ কর্ম বলে । এই ‘সঞ্চিতের’ অপর নাম ‘অদৃষ্ট’ এবং মীমাংসকদিগের পরিভাষায়, ইহারই নাম ‘অপূর্ব’ । এই নাম হইবার কারণ এই যে, কর্ম কিংবা ক্রিয়া যে সময় করা হয়, শুধু সেই সময়েই তাহা দৃশ্য হইয়া থাকে, এবং সেই সময় চলিয়া গেলে পরে সেই কর্ম স্বরূপত অবশিষ্ট না থাকায় তাহার সূক্ষ্ম সুতরাং অদৃশ্য অর্থাৎ অপূর্ব বিশিষ্ট পরিণামই অবশিষ্ট থাকিয়া যায় [বেসূ|শাং ভা|৩|২|৩৯,৪০] । যাহাই বলনা কেন, ইহা নির্বিবাদ যে, ‘সঞ্চিত’, ‘অদৃষ্ট’ কিংবা ‘অপূর্ব’ শব্দের অর্থে এই ক্ষণ পৰ্যন্ত যে যে কর্ম করা হইয়াছে সেই সমস্তের পরিণামের সমষ্টি । এই সঞ্চিত কর্ম সমস্ত একেবারে ভোগ করা যায় না । কারণ, এই সঞ্চিত কর্মের মধ্যে কিছু ভাল ও কিছু মন্দ অর্থাৎ পরস্পরবিরোধী ফলপ্ৰদ থাকিতে পারে । উদাহরণ যথা - কোন সঞ্চিত কর্ম স্বৰ্গপ্রদ এবং কোনটী নরকপ্ৰদ হওয়া প্ৰযুক্ত সেই সমস্তের ফল একই সময়ে ভোগ করা যায় না - একটার পর একটা ভোগ করিতে হয় । তাই ‘সঞ্চিতের’ মধ্যে যে কর্মের ফল প্ৰথম আরম্ভ হয়, তাহাকেই ‘প্রারব্ধ’ অর্থাৎ শুরু-হওয়া ‘সঞ্চিত’ বলে । ব্যবহারে সঞ্চিতের অর্থেই ‘প্রারব্ধ’ শব্দের অনেক প্রকার প্রয়োগ হইয়া থাকে । কিন্তু ইহা ভুল । শাস্ত্রদৃষ্টিতে দেখিলে, ‘সঞ্চিতের’ অর্থাৎ সমস্ত ভূতপূর্ব কর্মের যে সমষ্টি, তাহারই এক অবান্তর ভেদকেই ‘প্রারব্ধ’ বলিয়া উপলব্ধি হয় । প্রারদ্ধ কিছু সমস্ত সঞ্চিত নহে; সঞ্চিতের মধ্যে যে অংশের ফলের (কার্যের) ভোগ আরম্ভ হইয়াছে তাহাই প্রারব্ধ; এবং সেইজন্য এই প্রারদ্ধেরই আর এক নাম - আরব্ধ কার্য । প্রারব্ধ ও সঞ্চিত ব্যতীত ক্রিয়মাণ বলিয়া কর্মের তৃতীয় আর এক ভেদ আছে । ‘ক্রিয়মাণ’ - ইহা বর্তমান কালবাচক ধাতু সাধিত শব্দ এবং তাহার অর্থ - “যাহা এক্ষণে হইতেছে কিংবা যাহা এক্ষণে করিতেছি সেই কর্ম ।” কিন্তু এক্ষণে আমরা যাহা কিছু করিতেছি তাহা সঞ্চিত কর্মের মধ্যে যে কর্মের ভোগ আরম্ভ হইয়াছে তাহারই অর্থাৎ প্রারব্ধেরই পরিণাম; তাই কর্মের এই তৃতীয় ‘ক্রিয়মাণ’ ভেদ মানিবার আমি কোন কারণ দেখিতে পাই না । প্রারব্ধ কারণ এবং ক্রিয়মাণ তাহার ফল অর্থাৎ কাৰ্য, দুয়ের মধ্যে এই ভেদ করা যাইতে পারে সত্য; কিন্তু কর্মবিপাক প্রক্রিয়ায় এই ভেদের কোন উপযোগ হইতে পারে না । সঞ্চিতের মধ্যে প্রারব্ধ বাদ দিলে বাকী যে কর্ম থাকে তাহা দেখাইবার জন্য ভিন্ন শব্দের প্রয়োজন হয় । 


9d) প্রারব্ধ (আরব্ধ) ও অনারব্ধ


তাই, বেদান্তসূত্রে প্রারব্ধকেই ‘প্রারব্ধকার্য’ এবং যাহা প্রারব্ধ নহে, তাহাকে অনারব্ধ কার্য বলা হইয়াছে [বেসূ|৪|১|১৫] । আমার মতে, সঞ্চিত কর্মে এই প্ৰকার অর্থাৎ প্রারব্ধকার্য ও অনারব্ধকার্য এইরূপ দ্বিধা ভেদ করাই শাস্ত্রদৃষ্টিতে অধিক যুক্তিসঙ্গত । তাই, ‘ক্রিয়মাণ’কে ধাতু সাধিত বর্তমানকালবাচক মনে না করিরা “বর্তমানসামীপ্যে বর্তমান্‌বদবা” এই পাণিনিসূত্র অনুসারে [পা|৩|৩|১৩১] ভবিষ্যৎকালবাচক মনে করিলে তাহার অর্থ “যাহা শীঘ্রই পরে ভোগ করিতে হইবে” এইরূপ করিতে পারা যায়; এবং তখন ‘ক্রিয়মাণ’ এরই অর্থ ‘অনারব্ধ কার্য’ এইরূপ হইবে; ‘প্রারব্ধ’ ও ‘ক্রিয়মাণ’ এই দুই শব্দ অনুক্ৰমে বেদান্তসূত্রের ‘আরব্ধকার্য’ ও ‘অনারব্ধকাৰ্য’ এই দুই শব্দের সহিত সমানার্থক হইবে । কিন্তু ‘ক্রিয়মাণ’ এর সেরূপ অর্থ অধুনা কেহ করে না; ক্রিয়মাণ অর্থে চলিতেছে যে কর্ম এইরূপ অর্থই করা হয় । কিন্তু এইরূপ অর্থ গ্ৰহণ করিলে প্রারব্ধের ফলকেই ক্রিয়মাণ বলিতে হয় - এবং যে কর্ম অনারব্ধকার্য তাহা বুঝাইবার জন্য সঞ্চিত, প্রারব্ধ ও ক্রিয়মাণ এই তিন শব্দের মধ্যে কোন শব্দই পর্যাপ্ত হয় না, এই একটা বড় রকমের আপত্তি উত্থিত হয় । ইহা ছাড়া, ক্রিয়মাণশব্দের রূঢ়ার্থ ছাড়াও ভাল নহে । তাই কর্মবিপাক প্রক্রিয়ায় সঞ্চিত, প্রারব্ধ ও ক্রিয়মাণ কর্মের এই লৌকিক ভেদ স্বীকার না করিয়া, প্রারব্ধকার্য ও অনারব্ধকার্য এই দুই বর্গে আমি উহাদিগকে বিভক্ত করিয়াছি এবং তাহাই শাস্ত্রদৃষ্টিতেও সুবিধাজনক বলিয়া মনে হয় । ‘ভোগ করা’ এই ক্রিয়ার, ভুক্ত (অতীত), ভোগ করা এক্ষণে আরম্ভ হইয়াছে (বর্তমান) এবং পরে ভোগ করিতে হইবে (ভবিষ্যৎ), এইরূপ কালকৃত তিন ভেদ হয় । কিন্তু কর্মবিপাকপ্রক্রিয়াতে এইরূপ কর্মের তিন প্ৰকার ভেদ হইতে পারে না । কারণ, সঞ্চিতের মধ্যে যে কর্ম প্রারব্ধ হইয়া ভোগ করা যায়, তাহার ফল পুনৰ্বার সঞ্চিতের মধ্যে গিয়াই মিলিত হয় । তাই কর্মভোগের বিচার করিবার সময় সঞ্চিতের (১) ভোগ আরম্ভ হইলে প্রারব্ধ এবং (২) আরম্ভ না হইলে অনারব্ধ - এই দুই ভেদ হইতে পারে; ইহার অধিক বর্গে ‘সঞ্চিত’কে বিভক্ত করিবার কোন প্রয়োজন নাই । 


10) 'প্রারব্ধকর্মনাং ভোগাদেব ক্ষয়ঃ'


এইরূপ সমস্ত কর্মফলের দ্বিধা বৰ্গীকরণ করিবার পর, তাহার উপভোগ সম্বন্ধে কর্মবিপাক প্রক্রিয়া এই বলে যে, সঞ্চিত সমস্তই ভোগ্য । তন্মধ্যে যে কর্মফলের ভোগ আরম্ভ হইয়া এই দেহ কিংবা জন্ম প্রাপ্ত হওয়া যায়, অর্থাৎ সঞ্চিতের মধ্যে যে কর্ম প্রারব্ধ হইয়াছে তাহার ভোগ ব্যতীত অব্যাহতি নাই — “প্রারব্ধকর্মণাং ভোগাদেব ক্ষয়ঃ” । হাত হইতে বাণ একবার মুক্ত হইলে তাহা যেমন আর ফিরিয়া পাওয়া যায় না, শেষ পর্যন্ত তাহা চলিয়াই যায়; কিংবা কুম্ভকারের চাকা একবার গতিপ্রাপ্ত হইলে তাহা যেরূপ উক্ত গতির শেষ হওয়া পৰ্যন্ত ঘুরিতেই থাকে, প্রারব্ধ অর্থাৎ যাহার ফলভোগ আরম্ভ হইয়াছে সেই কর্মেরও ঠিক সেইরূপ অবস্থা । যাহা শুরু হইয়াছে তাহার শেষ হওয়া চাই; নচেৎ তাহা হইতে অব্যাহতি নাই । কিন্তু অনারব্ধকার্য-কর্মের বিষয় সে বিধি নহে — এই সমস্ত কর্মকে জ্ঞানের দ্বারা সম্পূর্ণ নাশ করা যাইতে পারে । প্রারব্ধকার্য ও অনারব্ধকার্যে এই যে গুরুতর ভেদ আছে সেই কারণে জ্ঞানীপুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও স্বাভাবিকভাবে মৃত্যু আসা পর্যন্ত অর্থাৎ দেহের জন্মাবধি প্রারব্ধ কর্ম শেষ হওয়া পর্যন্ত, - শান্তভাবে অপেক্ষা করিয়া থাকিতে হয় । সেইরূপ না করিয়া হঠাৎ দেহত্যাগ করিলে - জ্ঞানের দ্বারা তাহার অনারব্ধকর্মের ক্ষয় হইলেও - দেহারম্ভক প্রারব্ধকর্মের ভোগ অপূর্ণ থাকে এবং তাহা ভোগ করিবার জন্য পুনৰ্বার জন্মগ্রহণ করিতে হয় এবং তাহার মোক্ষও দূরে পড়িয়া যায় । বেদান্ত ও সাংখ্য এই দুই শাস্ত্ৰেই এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছে [বেসূ|৪|১|১৩-১৫; সা. কা|৬৭] । ইহা ব্যতীত হঠাৎ আত্মহত্যা করা এক নূতন কর্ম হইবে এবং তাহার ফল ভোগ করিবার জন্য নব জন্ম গ্ৰহণ করা পুনরায় আবশ্যক হইবে । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, কর্মশাস্ত্রদৃষ্টিতেও আত্মহত্যা করা নির্বুদ্ধিতা ।


11) মীমাংসকদের নৈষ্কর্ম্য-সিদ্ধিভাব বেদান্তের অগ্রাহ্য


কর্মফলভোগদৃষ্টিতে কর্মের কি কি ভেদ তাহা বলা হইল । এক্ষণে, কর্মের বন্ধন হইতে কিরূপে অর্থাৎ কোন যুক্তিতে মুক্ত হওয়া যায় তাহার বিচার করিব । প্রথম যুক্তি কর্মবাদীদিগেরই । অনারব্ধকার্য অর্থে পরে ভোগার্থ সঞ্চিত কর্ম, তাহা উপরে বলিয়াছি - তাহা এ জন্মেই ভোগ করিতে হউক কিংবা অন্য জন্মেই ভোগ হউক । কিন্তু এই অর্থের দিকে লক্ষ্য না রাখিয়া কোন কোন মীমাংসক কর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া আপনার মতে মোক্ষলাভের এক সহজ উপায় বাহির করিয়াছেন । 


11a) মীমাংসকদের কর্মবিভাগ : নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ


তৃতীয় প্রকরণে কথিত অনুসারে মীমাংসক দৃষ্টিতে সমস্ত কর্মের নিত্য, নৈমিত্তিক, কাম্য ও নিষিদ্ধ এই চারি ভেদ হয় । তন্মধ্যে সন্ধ্যাদি নিত্যকর্ম না করিলে পাপ হয় এবং নৈমিত্তিক কর্ম নিমিত্ত উপস্থিত হইলেই করিতে হইবে । তাই, এই দুই কর্ম করিতেই হইবে, এইরূপ মীমাংসকেরা বলেন । বাকী রহিল কাম্য ও নিষিদ্ধ কর্ম । তন্মধ্যে নিষিদ্ধ কর্ম করিলে পাপ হয় বলিয়া করিতে নাই; এবং কাম্য কর্ম করিলে তাহার ফলভোগ করিবার জন্য পুনর্বার জন্মগ্রহণ করিতে হয় বলিয়া তাহাও করিতে নাই । 

এই প্রকার বিভিন্ন কর্মের পরিণামের তারতম্য বিচার করিয়া মনুষ্য কোন কর্ম ছাড়িয়া দিলে এবং কোন কর্ম যথাশাস্ত্ৰ করিতে থাকিলে সে আপনাপনিই মুক্ত হইবে । কারণ, এই জন্মের ভোগের দ্বারাই প্রারব্ধকর্মের অবসান হয়; এবং এই জন্মে সমস্ত নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম সাধন করিলে ও নিষিদ্ধ কর্ম পরিহার করিলে নরকগতি ঘটে না, এবং কাম্য কর্ম ত্যাগ করিলে স্বৰ্গাদি সুখভোগেরও আবশ্যকতা থাকে না । ইহলোক, নরক ও স্বৰ্গ এই তিন গতি হইতে এইরূপে অব্যাহতি পাইলে মোক্ষ ব্যতীত আত্মার আর কোন গতি থাকে না । এই মতবাদকে ‘কর্মমুক্তি’ কিংবা ‘নৈষ্কর্ম্য সিদ্ধি’ বলে । কর্ম করিলেও যাহা না করার সমান হয়, অর্থাৎ যখন কর্মের পাপপুণ্যের বন্ধন কর্তার হয় না, সেই অবস্থাকে ‘নৈষ্কর্ম্য’ বলে । কিন্তু মীমাংসকদিগের উপরিউক্ত যুক্তিতে এই নৈষ্কর্ম্য পূর্ণরূপে সাধিত হয় না, ইহা বেদান্তশাস্ত্ৰ স্থির করিয়াছেন [বেসূ|শাং|ভা|৪|৩|১৪]; এবং গীতাতেও এই অভিপ্ৰায়েই “কর্ম না করিলে নৈষ্কর্ম্য হয় না, এবং কর্ম ছাড়িলে সিদ্ধিও হয় না” - উক্ত হইয়াছে [গী|৩|৪] । ধর্মশাস্ত্ৰে উক্ত হইয়াছে যে, গোড়ায় সমস্ত নিষিদ্ধ কর্ম বর্জন করাই দুঃসাধ্য; এবং কোন নিষিদ্ধ কর্ম করিলে শুধু নৈমিত্তিক প্ৰায়শ্চিত্তের দ্বারা তাহার সমস্ত দোষ খণ্ডিত হয় না । তথাপি উক্ত বিষয় সম্ভব বলিয়া মানিলে ও প্রারব্ধ কর্ম ভোগের দ্বারা এবং এ জন্মে কর্তব্য কর্ম উপরি-উক্ত অনুসারে করিলে কিংবা না করিলে সমস্ত সঞ্চিত কর্মের সমষ্টি শেষ হয়, মীমাংসকদিগের এই কথা আদৌ ঠিক মনে হয় না । কারণ, দুই ‘সঞ্চিত’ কর্মের ফল পরস্পরবিরোধী - উদাহরণ যথা, একের ফল স্বৰ্গসুখ এবং অন্যটির ফল নরকযাতনা হইলে, তাহা একই কালে ও একই স্থলে ভোগ করা অসম্ভব হওয়ায়, কেবল এই জন্মে প্রারব্ধ কর্মের দ্বারা এবং এই জন্মে কর্তব্য কর্মের দ্বারা সমস্ত সঞ্চিত কর্মের ফলভোগ সম্পূর্ণ হইতে পারে না । মহাভারতের পরাশরগীতায় আছে –
কদাচিৎ সুকৃতং তাত কুটস্থমিব তিষ্ঠতি ৷
মজ্জামানস্য সংসারে যাবদ্‌ দুঃখাদ্‌ বিমুচ্যতে ॥
কখন কখন মানুষের সাংসারিক দুঃখ হইতে মুক্তিলাভ করা পর্যন্ত তাহার পূর্বকৃত পুণ্য (উহা নিজের ফল দিবার পথ দেখিয়া) চুপ করিয়া বসিয়া থাকে” [মভা|শাং|২৯০|১৭]; এবং এই নীতিসুত্ৰই সঞ্চিত পাপকর্মের সম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হইতে পারে । সঞ্চিতকর্মভোগ এইরূপে একই জন্মে শেষ না হইয়া এই সঞ্চিত’ কর্মের মধ্যে অনারব্ধকার্যরূপ এক অংশ সর্বদা অবশিষ্টই থাকে; এবং এই জন্মের সমস্ত কর্ম উপরি-উক্ত যুক্তিতে সাধন করিলেও অবশিষ্ট অনারব্ধকার্যের সঞ্চিত ভোগ করিবার জন্য পুনরায় জন্ম গ্ৰহণ করিতেই হয় । তাই, মীমাংসকদিগের উপরি-উক্ত সহজ মোক্ষ-উপায়টি মিথ্যা ও ভ্রান্তিমূলক, এইরূপ বেদান্তের সিদ্ধান্ত । কোন উপনিষদেই কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভের এই পথের কথা বলা হয় নাই । কেবল তর্কের জোরে ইহাকে খাড়া করা হইয়াছে; ঐ তর্কও শেষ পর্যন্ত টিকে না । সারকথা, কর্মের দ্বারা কর্ম হইতে মুক্ত হইবার আশা অন্ধের অন্ধকে পথ দেখাইয়া পার করাইবার আশার ন্যায় ব্যর্থ । ভাল, মীমাংসকদিগের এই যুক্তি স্বীকার না করিয়া, আগ্রহের সহিত সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া নিরুদ্যোগী হইয়া বসিয়া থাকিলো কর্মের বন্ধন ঘুচিবে এইরূপ যদি বলো, তবে তাহাও হইতে পারে না । কারণ, অনারব্ধকর্মের ফলভোগ তখনও অবশিষ্ট থাকে শুধু নহে, কর্মত্যাগের আগ্ৰহ ও চুপ করিয়া বসিয়া থাকা — এই দুই-ই তামসিক কর্ম হইয়া যায়; এবং এই তামসিক কর্মের ফল ভোগ করিবার জন্য পুনৰ্বার জন্ম গ্ৰহণ করিতেই হয় [গী|১৮|৭ ও ৮ দেখ] । তাছাড়া, যতদিন দেহ থাকে সেই পৰ্যন্ত শ্বাসোচ্ছ্বাস কিংবা শোওয়া, বসা ইত্যাদি কর্ম চলিতে থাকায় সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া দিবার আগ্রহও ব্যর্থই হয়, - এই জগতে কেহ ক্ষণকালের জন্যও কর্ম ছাড়িতে পারে না, গীতার অনেক স্থলে এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|৩|৫; ১৮|১১ দেখ]


12) জ্ঞান বিনা কর্মবন্ধ হইতে মুক্তি নাই


কর্ম ভালোই হউক বা মন্দই হউক, তাহার ফলভোগের জন্য কোন-না-কোন জন্ম গ্ৰহণ করিয়া মনুষ্যকে সর্বদাই প্ৰস্তুত থাকিতে হইবে; কর্ম অনাদি, তাহার অবিছিন্ন ধারাবাহিক ব্যাপারে পরমেশ্বরও হস্তক্ষেপ করেন না; সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া দেওয়া অসম্ভব; এবং মীমাংসকের কথা অনুসারে কোন কর্ম করিলে এবং কোন কর্ম ছাড়িয়া দিলেও কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হওয়া যায় না - ইত্যাদি বিষয় সিদ্ধ হইলে পর, কর্মাত্মক নামরূপের নশ্বর চক্ৰ হইতে মুক্ত হইয়া, তাহার মূলে স্থিত অমৃত ও অবিনাশী তত্ত্বে মিলিত হইবার জন্য মনুষ্যের যে স্বাভাবিক ইচ্ছা হয়, তাহা তৃপ্ত করিবার কোন পথ, এই প্রথম প্রশ্নটী পুনর্বার উপস্থিত হয় । বেদে ও স্মৃতিগ্ৰন্থসমূহে যাগযজ্ঞাদি পারলৌকিক কল্যাণের বহুবিধ সাধন বর্ণিত হইয়াছে; কিন্তু মোক্ষশাস্ত্রদৃষ্টিতে সে সমস্ত নিম্ন শ্রেণীর সাধন । কারণ যাগযজ্ঞাদি পুণ্যকর্মের দ্বারা স্বৰ্গ প্ৰাপ্তি হইলেও পুণ্যকর্মের ফল শেষ হইলে, দীর্ঘকালেই হউক না কেন - কখন-না-কখন নীচের কর্মভূমিতে পুনৰ্বার ফিরিয়া আসিতেই হয় [মভা|বন|২৫৯|২৬০; গী|৮|২৫ ও ৯|২০] । স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, কর্মের কাঁইচী হইতে সম্পূর্ণ মুক্ত হইয়া অমৃততত্ত্বে মিশিয়া যাইবার এবং জন্মমরণের ঝঞ্ঝাট চিরকালের জন্য পরিহার করিবার পক্ষে ইহা প্ৰকৃত মার্গ নহে; এই ঝঞ্ঝাট দূর করিবার অর্থাৎ মোক্ষ প্ৰাপ্তির অধ্যাত্মশাস্ত্ৰানুসারে জ্ঞানই একমাত্র পন্থা । 


13) জ্ঞান শব্দের অর্থ


‘জ্ঞান’ অর্থে ব্যবহার-জ্ঞান বা নামরূপাত্মক সৃষ্টিশাস্ত্রের জ্ঞান নহে; এস্থলে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানই উহার অর্থ । ইহাকে ‘বিদ্যা’ও বলে; এবং “কর্মণা বধ্যতে জন্তুঃ বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে” - মনুষ্য কর্মের দ্বারাই বদ্ধ হয় এবং বিদ্যার দ্বারা মুক্ত হয় - এই প্রকরণের আরম্ভে এই যে বচন প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাতে ‘বিদ্যা’ শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ই বিবক্ষিত হইয়াছে । ভগবদ্গীতাতে -
জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জুন ৷
“জ্ঞানরূপ অগ্নির দ্বারা সমস্ত কর্ম ভস্ম হয়” [গী|৪|৩৭], ইহা ভগবান অর্জুনকে বলিয়াছেন; মহাভারতেরও দুই স্থলে উক্ত হইয়াছে যে, -
বীজান্যগ্নু পদগ্ধানি ন রোহন্তি যথা পুনঃ ৷
জ্ঞানদগ্ধৈস্তথা ক্লেশৈৰ্নাত্মা সম্পদ্যতে পুনঃ ॥
“দগ্ধ বীজ যেরূপ গজায় না সেইরূপ জ্ঞানের দ্বারা (কর্মের) ক্লেশ দগ্ধ হইলে তাহা আত্মাকে পুনঃ প্ৰাপ্ত হয় না” [মভা|বন|১৯৯|১০৬|১০৭; শা|২১১|১৭] । উপনিষদেও এইরূপ জ্ঞানের মাহাত্ম্য প্রতিপাদন করিবার অনেক বচন আছে – “য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদং সর্বং ভবতি” [বৃ|১|৪|১০], - আমিই ব্ৰহ্ম এইরূপ যে জানে সেই অমৃত ব্ৰহ্ম হয়; যেমন পদ্মাপত্রে জল লাগিয়া থাকে না সেইরূপ যাহার ব্ৰহ্মজ্ঞান হইয়াছে তাহাকে কর্ম দূষিত করিতে পারে না [ছাং|৪|১৪|৩]; ব্ৰহ্মজ্ঞানী ব্ৰহ্মকে লাভ করে [তৈ|২|১]; যে সমস্তই আত্মময় জানিয়াছে তাহাকে পাপ স্পর্শ করে না [বৃ|৪|৪|২৩]; “জ্ঞাত্বা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ” [শ্বে|৫|১৩; ৬|১৩] পরমেশ্বরের জ্ঞান হইলে পর সমস্ত পাশ হইতে মুক্ত হয়; “ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্দৃষ্টে পরাবরে” [মুং|২|২|৮] - পরব্রহ্মের জ্ঞান হইলে পর তাহার সমস্ত কর্মের ক্ষয় হয়; ‘বিদ্যয়ামৃতমশ্নুতে’ [ঈশা|১১, মৈত্র্যু|৭|৯] বিদ্যার দ্বারা অমৃত লাভ হয়; “তমেব বিদিত্বাহতিমৃত্যুমেতি নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেহয়নায়” [শ্বে|৩|৮] পরমেশ্বরকে জানিলে অমর হয়, ইহা ব্যতীত মোক্ষলাভের অন্য পন্থা নাই । এবং শাস্ত্রদৃষ্টিতে বিচার করিলেও এই সিদ্ধান্তই দৃঢ় হয় । কারণ, দৃশ্য জগতে যাহা কিছু আছে তৎসমস্ত কর্মময় হইলেও তাহা এই জগতের আধারভুত পরব্রহ্মেরই লীলা হওয়া প্ৰযুক্ত কোন কর্মই পরব্রহ্মকে যে বন্ধন করিতে পারে না তাহা সুস্পষ্ট - অর্থাৎ সমস্ত কর্ম করিলেও পরব্রহ্ম অলিপ্তই থাকেন । অধ্যাত্মশাস্ত্ৰানুসারে এই জগতের সমস্ত পদার্থ কর্ম (মায়া) এবং ব্ৰহ্ম এই দুই বর্গে বিভক্ত, ইহা এই প্রকরণের আরম্ভেই বলা হইয়াছে । তাই স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে, এই দুই বর্গের মধ্যে কোন এক বৰ্গ হইতে অর্থাৎ কর্ম হইতে মুক্ত হইতে ইচ্ছা করিলে দ্বিতীয় বর্গের মধ্যে অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপে প্ৰবেশ করিতে হইবে । এই এক মাৰ্গই তাহার নিকট উন্মুক্ত । কারণ, সমস্ত বিষয়ের কেবল দুই বৰ্গ হওয়ায় কর্ম হইতে মুক্ত হওয়া ব্যতীত ব্ৰহ্মস্বরূপের অন্য কিছুই অবশিষ্ট থাকে না । কিন্তু ব্ৰহ্মস্বরূপের এই অবস্থা লাভ করিতে হইলে ব্ৰহ্মস্বরূপ কি, আগে তাহা ঠিক জানা আবশ্যক; নচেৎ এক করিতে গিয়া আর এক হইয়া সমস্তই ব্যর্থ হইবে ! “বিনায়কং প্রকুর্বাণো রচয়ামাস বানরম্‌” - অৰ্থাৎ “গণেশ করিতে বানর” হইবে ! এইজন্য, অধ্যাত্মশাস্ত্রের যুক্তিবাদেও প্ৰাপ্ত হওয়া যায় যে, ব্ৰহ্মস্বরূপের অর্থাৎ ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের ও ব্ৰহ্মের অলিপ্ততার জ্ঞান পাইয়া তাহাই বিশেষরূপে মরণ পৰ্যন্ত দৃঢ় করিয়া ধরিয়া রাখাই কর্মপাশ হইতে মুক্ত হইবার প্রকৃত সাধন । “কর্মে আমার কোনই আসক্তি নাই; তাই কর্ম আমাকে বদ্ধ করিতে পারে না - এবং এই তত্ত্ব যে জানিয়াছে সে কর্মপাশ হইতে মুক্ত হয়” এইরূপ ভগবান্‌ গীতায় বলিয়াছেন [গী|৪|১৪; ১৩|২৩] তাহার তাৎপৰ্যও এই । এই স্থানে ‘জ্ঞান’ অর্থে শুধু শাব্দিক জ্ঞান কিংবা শুধু মানসিক ক্রিয়া নহে; কিন্তু বেদান্তসূত্রের শঙ্করভাষ্যের আরম্ভেই কথিত-অনুসারে ‘জ্ঞান’ অর্থে “মানসিক জ্ঞান প্ৰথমে হইলে পর এবং ইন্দ্ৰিয়দিগকে জয় করিলে পর ব্ৰহ্মীভূত হইবার অবস্থা বা ব্ৰাহ্মী স্থিতি” - এই অর্থই সকল সময়ে ও সকল স্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে, ইহা বিস্মৃত হইবে না । পূর্বপ্রকরণের শেষে জ্ঞানসম্বন্ধে অধ্যাত্মশাস্ত্রের এই সিদ্ধান্তই দেওয়া হইয়াছে; মহাভারতেও “জ্ঞানেন কুরুতে যত্নং যন্ত্রেন প্ৰাপ্যতে মহৎ” - জ্ঞান অর্থাৎ মানসিক ক্রিয়ারূপ জ্ঞান হইলে পর মনুষ্য যত্ন করে এবং এই যত্নের দ্বারাই মহৎতত্ত্ব (পরমেশ্বর) প্ৰাপ্ত হয় - এইরূপ জনক সুলভাকে বলিয়াছেন [শাং|৩২০|৩০] । মোক্ষ প্রাপ্তির জন্য কোন পথ দিয়া কোথায় যাইতে হইবে - ইহা অপেক্ষা অধ্যাত্মশাস্ত্র কখনই বেশী বলিতে পারে না । শাস্ত্রের দ্বারা এই বিষয় ব্যক্ত হইলে পর, শাস্ত্ৰোক্ত মার্গে কোন কণ্টক বা বাধা থাকিলে তাহা অপসারিত করিয়া পথ পরিষ্কার করা এবং সেই পথে চলিতে চলিতে শেষে ধ্যেয় বস্তুকে লাভ করা - এই সমস্ত কার্য প্ৰত্যেককে নিজের চেষ্টায় করিতে হইবে । কিন্তু এই প্ৰযত্নও পাতঞ্জল যোগ, অধ্যাত্মবিচার, ভক্তি, কর্মফলত্যাগ ইত্যাদি অনেক প্রকারে করা যাইতে পারে [গী|১২|৮-১২], এবং সেই জন্য, অনেক সময় মনুষ্য গোলযোগে পড়িয়া যায় । তাই গীতায় প্ৰথমে নিষ্কাম কর্মযোগের মুখ্যমাৰ্গ বলিয়া তৎসিদ্ধির জন্য ষষ্ঠ অধ্যায়ে যম-নিয়ম আসন-প্ৰাণায়াম-প্রত্যাহার-ধারণা-ধ্যান-সমাধিরূপ অঙ্গভূত সাধনাদিরও বর্ণনা করা হইয়াছে; এবং পরে সপ্তম অধ্যায় হইতে, কর্মযোগ আচরণ করিয়াই অধ্যাত্মবিচারের দ্বারা কিংবা তাহা অপেক্ষা সহজ উপায় ভক্তিমার্গে এই পরমেশ্বরের জ্ঞান কিরূপে উৎপন্ন হয় তাহা উক্ত হইয়াছে [গী|১৮|৫৬]


14) জ্ঞানপ্রাপ্তির জন্য শারীর আত্মা স্বতন্ত্র


কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভের উপায় কর্মত্যাগ নহে; ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধিকে পরিশুদ্ধ রাখিয়া পরমেশ্বরের ন্যায় কার্য করিতে থাকিলেই শেষে মোক্ষলাভ হয়; কর্মত্যাগ করা ভ্ৰম; কারণ কর্ম হইতে কেহই অব্যাহতি পায় না; - ইত্যাদি বিষয় এক্ষণে নির্বিবাদ নির্ধারিত হইলেও এই প্ৰথমকার প্রশ্নটি আবারও উপস্থিত হয় যে, এই মার্গে সিদ্ধ হইবার জন্য জ্ঞানলাভের যে চেষ্টা আবশ্যক সেই চেষ্টা কি মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত ? কিংবা নামরূপ কর্মাত্মক প্ৰকৃতি যে দিকে টানিবে সেই দিকেই যাহতে হইবে ? ভগবান গীতাতে বলিয়াছেন যে, “প্ৰকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্ৰহঃ কিং করিষ্যতি” [গী|৩|৩৩] - নিগ্ৰহ কি করিবে ? প্ৰাণিমাত্ৰই আপন আপন প্ৰকৃতির পথেই চলিয়া থাকে; “মিথ্যৈষ ব্যবসায়স্তে প্রকৃতিস্ত্বাং নিযোক্ষ্যতি” - তোমার প্রতিজ্ঞা নিরর্থক; তুমি যেদিকে যাইতে চাহিবে না, সেইদিকে প্রকৃতি তোমাকে টানিবে [গী|১৮|৫৯; ২|৬০] বলিয়াছেন; আবার মনুও - “বলবান্‌ ইন্দ্ৰিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি” [মনু|২|২১৫] - বিদ্বানকেও ইন্দ্ৰিয়গণ আকর্ষণ করে - এইরূপ বলিয়াছেন । কর্মবিপাক প্রক্রিয়ার সিদ্ধান্তও তাহাই । কারণ, মনুষ্যের মনের সমস্ত প্রেরণা পূর্বকৰ্মবশতই উৎপন্ন হয় এইরূপ মানিলে, এক কর্ম হইতে অন্য কর্মে, এইরূপে সর্বদাই তাহাকে ভবচক্রের মধ্যে থাকিতে হয়, এইরূপ অনুমান না করিলে চলে না । অধিক কি, কর্ম হইতে মুক্ত হইবার প্রেরণা ও কর্ম ইহারা পরস্পরবিরুদ্ধ এইরূপ বলিলেও চলে । এবং ইহা যদি সত্য হয় তবে জ্ঞানলাভার্থ কেহই স্বতন্ত্র নহে এইরূপ আপত্তি আসে । অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ এই প্রশ্নের এই উত্তর দেন যে, নামরূপাত্মক সমস্ত দৃশ্য-জগতের আধারভুত যে তত্ত্ব তাহাই মনুষ্যের দেহের মধ্যেও আত্মরূপে ক্রীড়া করে বলিয়া মনুষ্যের কার্যের যে বিচার করিতে হইবে তাহা দেহ ও আত্মা এই দুই দিক হইতেই করা আবশ্যক । তন্মধ্যে, আত্মস্বরূপী ব্ৰহ্ম মূলে একমাত্র,অদ্বিতীয় হওয়া প্ৰযুক্ত কখনই পরতন্ত্র হইতে পারেন না । কারণ, এক অপরের অধীনে আসিতে হইলে এক ও অন্য এই ভেদ নিয়ত স্থায়ী হওয়া চাই ৷ প্ৰকৃতপক্ষে নামরূপাত্মক কর্মই সেই অন্য পদার্থ । কিন্তু এই কর্ম অনিত্য ও মূলে পরব্রহ্মেরই লীলা হওয়ায়, পরব্রহ্মের এক অংশের উপর তাহার আবরণ থাকিলেও তাহা পরব্ৰহ্মকে কখনই দাস করিতে পারে না, ইহা নির্বিবাদ । তাছাড়া, যে আত্মা কর্মজগতের ব্যাপারাদির একীকরণ করিয়া জগৎ-জ্ঞান উৎপন্ন করে তাহার কর্মজগৎ হইতে ভিন্ন অর্থাৎ ব্ৰহ্মজগতেরই হওয়া চাই ইহা পূর্বেই উক্ত হইয়াছে । তাই পরব্রহ্ম ও তাহার অংশ শারীর আত্মা এই দুই-ই মূলে স্বতন্ত্র অর্থাৎ কর্মাত্মক প্রকৃতিসত্তার বাহিরের বস্তু, এইরূপ নিষ্পন্ন হয় । তন্মধ্যে পরমাত্মা অনন্ত, সর্বব্যাপী, নিত্য, শুদ্ধ ও মুক্ত, ইঁহার বাহিরে পরমাত্মা সম্বন্ধীয় জ্ঞান মনুষ্যের বুদ্ধিতে উৎপন্ন হইতে পারে না । কিন্তু এই পরমাত্মারই অংশ জীবাত্মা মূলে শুদ্ধ, মুক্তস্বভাব, নির্গুণ ও অকর্তা হইলেও দেহ ও বুদ্ধি-আদি ইন্দ্ৰিয়গণের গণ্ডীর মধ্যে আটকাইয়া পড়ায় তাহা মনুষ্যের মনে যে স্ফুরণ উৎপন্ন করে তাহার প্রত্যক্ষ অনুভবরূপী জ্ঞান আমাদের হইতে পারে । মুক্ত বাষ্পের মধ্যে কোন বল না থাকিলেও তাহা কোন ভাণ্ডের ভিতর আবদ্ধ হইলে পরে তাহার উপর যেরূপ সেই চাপ পড়ে, সেই নিয়মেই অনাদি-পূর্ব-কর্মাৰ্জিত জড় দেহ ও ইন্দ্ৰিয়াদির দ্বারা পরমাত্মারই অংশভুত জীব [গী|১৫|৭] আবদ্ধ হইয়া পড়িলে এই গণ্ডী হইতে তাহাকে মুক্তি দিবার মতো অর্থাৎ মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রবৃত্তি দেহেন্দ্ৰিয়দিগের হয়; এবং ইহাকেই ব্যবহারিক দৃষ্টিতে ‘আত্মার স্বতন্ত্র প্রবৃত্তি’ বলে । ‘ব্যবহার দৃষ্টিতে’ বলিবার কারণ এই যে, শুদ্ধ মুক্তাবস্থায় কিংবা ‘তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে’ আত্মা ইচ্ছারহিত ও অকর্তা, সমস্ত কর্তৃত্ব প্ৰকৃতিরই [গী|১৩|২৯; বেসূ|শাংতা|২|৩|৪০] । কিন্তু এই প্রকৃতি আপনা হইতে মোক্ষানুকুল কর্ম করে, সাংখ্যের ন্যায় বেদান্ত এইরূপ বলে না । কারণ তাহা মানিলে, জড়প্রকৃতি অন্ধভাবে অজ্ঞানীদিগকেও মুক্ত করিতে পারে এইরূপ বলিতে হয় । এবং মূলে যে আত্মা অকর্তা সে স্বতন্ত্রভাবে অর্থাৎ নিমিত্ত ব্যতীত আপনার স্বাভাবিকগুণেই কর্মপ্ৰবর্তক  হয়, ইহাও বলিতে পারা যায় না । তাই, আত্মা মূলে অকর্তা হইলেও বন্ধনের নিমিত্ত সে এইটুকুর জন্য চক্ষুগোচর ও কর্মপ্ৰবর্তক  হইয়া পড়ে, এবং যে নিমিত্তেই হউক একবার এইরূপ আগন্তুক প্ৰবৰ্ত্তকতা তাহাতে আসিলে, তাহা কর্মের নিয়ম হইতে ভিন্ন অর্থাৎ স্বতন্ত্র হইয়া পড়ে, বেদান্তশাস্ত্ৰে আত্মস্বাতন্ত্র্যের উক্ত সিদ্ধান্ত এই প্রকারে বিবৃত হইয়া থাকে । “স্বতন্ত্ৰ” অর্থে নির্নিমিত্তক নহে এবং আত্মা আপনার মূল শুদ্ধাবস্থায় কর্তাও হয় না । কিন্তু বারম্বার এই লম্বা চৌড়া কর্মকথা বলিতে না বসিয়া, ইহাকেই সংক্ষেপে আত্মার স্বতন্ত্র প্রবৃত্তি কিংবা প্রেরণা এইরূপ বলিবার রীতি হইয়াছে । আত্মা বন্ধনের উপাধিতে বদ্ধ হওয়ায়, তদ্বারা ইন্দ্ৰিয় গৃহীত স্বতন্ত্র প্রেরণা এবং বাহ্যজগতের পদার্থসমূহের সংযোগে ইন্দ্রিয়ে উৎপন্ন প্রেরণা এই দুই একেবারে ভিন্ন । ‘খাও, পিয়ো, মজা লুটো’ - ইহা ইন্দ্ৰিয়ের প্রেরণা; এবং আত্মার প্রেরণা মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার জন্য হয় । প্ৰথম প্রেরণাটি শুধু বাহ্য অর্থাৎ কর্মজগতের; দ্বিতীয় প্রেরণা আত্মার অর্থাৎ ব্রহ্মজগতের; এবং এই দুই প্রেরণা প্ৰায় পরস্পরবিরোধী হওয়ায় তাহাদের ঝগড়াতেই মনুষ্যের সমস্ত জীবন কাটিয়া যায় । ইহাদের ঝগড়ার সময় যখন মনে সন্দেহ হয় তখন কর্মজগতের প্রেরণাকে স্বীকার না করিয়া [ভাগ|১১|১০|৪], যদি মনুষ্য শুদ্ধ আত্মার স্বতন্ত্র প্রেরণা অনুসারে কাজ করে - এবং ইহাকেই প্ৰকৃত আত্মজ্ঞান কিংবা প্ৰকৃত আত্মনিষ্ঠা বলে - তবে তাহার সমস্ত আচরণ স্বভাবতই মোক্ষানুকূলই হইবে; এবং শেষে
বিশুদ্ধধর্মা শুদ্ধেন বুদ্ধেন চ স বুদ্ধিমান্‌ ৷
বিমলাত্মা চ ভবতি সমেত্য বিমলাত্মনা ৷
স্বতন্ত্রশ্চ স্বতন্ত্রেণ স্বতন্ত্রত্বমবাপণুতে ॥
“মূলে স্বতন্ত্র শারীর আত্মা, নিত্য শুদ্ধ বুদ্ধ নির্মল ও স্বতন্ত্র পরমাত্মাতে মিলিত হয় [মভা|শাং|৩০৮|২৭-৩০] । জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় এইরূপ যাহা উপরে বলা হইয়াছে তাহার অর্থই এই । কিন্তু উল্টাপক্ষে, জড় ইন্দ্রিয়গণের প্ৰাকৃত ধর্মের অর্থাৎ কর্মজগতের প্রেরণার প্রাবল্য হইলে মনুষ্য অধোগতি প্রাপ্ত হয় । বদ্ধ শারীর আত্মার ইন্দ্রিয়দিগকে মোক্ষানুকুল কর্ম করাইতে এবং ব্ৰক্ষাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভের এই যে স্বতন্ত্র শক্তি তাহা মনে করিয়াই ভগবান
উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ ৷
আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ ॥
“মনুষ্য আপনিই আপনাকে উদ্ধার করিবে; আপনি আপনাকে অবসন্ন করিবে না; কারণ (প্ৰত্যেকেই) আপনি আপনার বন্ধু (হিতকারী) এবং আপনিই আপনার শত্ৰু (অনিষ্টকারী)” [গী|৬|৫], এইরূপ আত্মস্বাতন্ত্র্যের অর্থাৎ স্বাবলম্বনের তত্ত্ব অর্জুনকে উপদেশ দিয়াছেন । এবং এই হেতুই যোগবাসিষ্টে দৈবের নিরাকরণ করিয়া পৌরুষের মাহাত্ম্য সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে [যো|২|সর্গ ৪-৮] । সর্বভূতে একই আত্মা, এই তত্ত্বটি বুঝিয়া এই অনুসারে যে মনুষ্য আচরণ করে তাহারই আচরণকে সদাচরণ কিংবা মোক্ষানুকূল আচরণ বলে; এবং এই প্রকার আচরণের দিকে দেহেন্দ্ৰিয়াদির প্রবৃত্তি উৎপাদন করাই বদ্ধ জীবাত্মারও স্বতন্ত্র ধর্ম হওয়ায় দুরাচারী মনুষ্যের অন্তঃকরণ সদাচারের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয় এবং সেই হেতু নিজ কর্মের জন্য, দুরাচারী ব্যক্তিরও পশ্চাত্তাপ হইয়া থাকে । আধিদৈবতবাদী পণ্ডিত ইহাকে সদসদ্‌বিবেক-বুদ্ধিরূপ দেবতার স্বতন্ত্র স্ফুরণ বলেন । কিন্তু তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বিচার করিলে বুঝা যাইবে যে, বুদ্ধি-ইন্দ্রিয় জড়প্রকৃতিরই বিকার হওয়ায় উহা আপনারই প্রেরণা হইতে কর্মের বন্ধন হইতে মুক্ত হইতে পারে না, এই প্রেরণা উহা কর্মজগতের বাহিরের আত্মা হইতে পায় । এই প্ৰকার এই পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের ‘ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্য’ শব্দও বেদান্ত-দৃষ্টিতে ঠিক নহে । কারণ ইচ্ছা মনের ধর্ম । পূর্বে অষ্টম প্রকরণে বর্ণিত অনুসারে বুদ্ধি ও বুদ্ধির সঙ্গে মনও কর্মাত্মক জড়প্রকৃতির অসম্বেদ্য বিকার হওয়া-প্ৰযুক্ত এই দুই আপনা হইতে কর্মের বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিতে পারে না । তাই প্ৰকৃত স্বাতন্ত্র্য মনেরও নহে কিংবা বুদ্ধিরও নহে, তাহা আত্মারই – এইরূপ বেদান্তশাস্ত্রে নির্ধারিত হইয়াছে । আত্মার এই স্বাতন্ত্র্য কেহ দিতে পারে না, কেহ কাড়িয়াও লইতে পারে না । স্বতন্ত্র পরমাত্মার অংশরূপ জীবাত্মা বন্ধনের উপাধিতে আটকিয়া পড়িলে সে আপনা হইতেই স্বতন্ত্রভাবে উপরি-উক্ত অনুসারে বুদ্ধি ও মন প্রেরণা করিয়া থাকে । অন্তঃকরণের এই প্রেরণার প্রতি উপেক্ষা করিয়া যদি কেহ কাজ করে তাহা হইলে
যে যেঁ কোণাচেঁ কায় বা গেলে ৷
জ্যাচে ত্যানেঁ অনহিত কেলেঁ ॥
‘সে আপনার পায়ে আপনি কুঠার মারিতে প্রস্তুত’ এইরূপ তুকারামবাবার মতো বলিতে হয় [গা|৪৪৪৮] ! ভগবদ্গীতায় ‘ন হিনস্ত্যাত্মনাহত্মানং’ - যে আপনাকে আপনি হনন করে না তাহার উত্তম গতি লাভ হয়, এই তত্ত্বের উল্লেখ পরে করা হইয়াছে [গী|১৩|২৮]; “দাসবোধে”ও ইহার স্পষ্ট অনুবাদ করা হইয়াছে [দাস|১৭|৭|৭-১০ দেখ] । যদিও দেখা যায় যে, মনুষ্য কর্ম জগতের অভেদ্য বন্ধনের দ্বারা আবদ্ধ, তথাপি মনুষ্য স্বভাবতই মনে করে যে, আমি যে কোন কর্ম স্বতন্ত্ৰভাবে করিতে পারি । অনুভবের এই তত্ত্বের উপপত্তি উপরিউক্ত-অনুসারে জড়-জগৎ হইতে ব্ৰহ্মজগৎ ভিন্ন বলিয়া না মানিলে অন্য কোনরূপেই সঙ্গত হয় না । তাই, যে অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ মানে না তাহাকে এই বিষয়ে মনুষ্যের নিত্য দাসত্ব স্বীকার করিতে হইবে অথবা প্ৰকৃতিস্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন বুদ্ধির অগম্য বলিয়া ছাড়িয়া দিতে হইবে; অন্য পন্থা নাই । প্ৰকৃতিস্বাতন্ত্র্যের কিংবা ইচ্ছাস্বাতন্ত্রোর এই উপপত্তি, - জীবাত্মা ও পরমাত্মা মূলে একরূপ অদ্বৈতবাদের এই সিদ্ধান্তের অনুসরণ করিয়া দিয়াছি [বেসূ|শাং ভা|২|৩|৪০] । কিন্তু এই অদ্বৈত মত যিনি মানেন না, কিংবা ভক্তির জন্য যিনি দ্বৈত স্বীকার করেন, তিনি বলেন যে, জীবাত্মার এই সামর্থ্য তাহার নিজের নহে, উহা পরমেশ্বর হইতে ইহা প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । তথাপি কখনও “ন ঋতে শ্ৰান্তস্য সখ্যায় দেবাঃ” [ঋ|৪|৩৩|১১] - শ্ৰান্ত হওয়া পর্যন্ত প্ৰযত্নকারী মনুষ্য ছাড়া অন্যকে দেবতার সাহায্য করেন না - ঋগ্বেদের এই তত্ত্ব অনুসরণ করিয়া বলা যায় যে, এই সামর্থ্য লাভের জন্য জীবাত্মার প্রথমে আপনা হইতেই প্ৰযত্ন করা আবশ্যক, অর্থাৎ আত্ম প্রযত্নের এবং পর্যায়ক্ৰমে আত্মস্বাতন্ত্র্যের তত্ত্ব পুনরপি দৃঢ়রূপে স্থাপিতই থাকে [বেসূ|২|৩|৪১,৪২; গী|১০|৫ ও ১০] । আর কত বলিব ? বৌদ্ধেরা আত্মার কিংবা পরব্রহ্মের অস্তিত্ব মানে না; কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান ও আত্মজ্ঞান তাহারা না মানিলেও তাহাদের ধর্মগ্রন্থেই “অত্তনা (আত্মনা) চোদয়হত্তানং” – আপনাকে আপনিই মার্গে প্রবৃত্ত করিতে হইবে - এই উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে, এবং তাহার সমর্থনাৰ্থ বলা হইয়াছে -
অত্তা (আত্মা) হি অত্তনো নাথো অত্তা হি অত্তনো গতি ৷
তস্মা সঞ্জময়হত্তানং অসূসং (অশ্বং) ভদ্দং ব বাণিজো ॥
আপনিই আপনার কর্তা, আপনার আত্মা ছাড়া অন্য ত্ৰাণকর্তা নাই; অতএব কোন বণিক যেরূপ আপনার উত্তম অশ্বকে সংযত করে সেইরূপ আপনিই আপনাকে সংযমন করিবে” [ধর্মপদ|৩৮০]; গীতার ন্যায় আত্মস্বাতন্ত্র্যের অস্তিত্ব ও আবশ্যকতাও বর্ণিত হইয়াছে [মহাপরিনিব্বাণসুত্ত|২|৩৩-৩৫ দেখ] । আধিভৌতিক ফরাসী পণ্ডিত কোঁৎ-এর নির্ধারণও এই বর্গের মধ্যে ধরিতে হইবে । কারণ কোন অধ্যাত্মবাদকেই তিনি না মানিলেও, কোন উপপত্তি বিনা কেবল প্রত্যক্ষ সিদ্ধ বলিয়া, প্রযত্নের দ্বারা মনুষ্য নিজের আচরণ ও পরিস্থিতি সংশোধন করিতে পারে ইহা তিনি স্বীকার করিয়াছেন ।


15) পরন্তু কর্ম করিবার সাধন জীবাত্মার নিজের কাছে নাই


কর্ম হইতে মুক্ত হইয়া সর্বভুতে এক আত্মা উপলব্ধি করিবার যে আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থা তাহা প্রাপ্ত হইবার ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানই একমাত্ৰ মহৌষধ, এবং এই জ্ঞান লাভ করা আমাদের আয়ত্তাধীন, ইহা সিদ্ধ হইলেও আর একটি কথাও মনে রাখা আবশ্যক যে, এই স্বতন্ত্র আত্মাও আপনার বক্ষস্থিত প্ৰকৃতির বোঝাকে একেবারে অর্থাৎ ক্ষণমাত্রে ফেলিয়া দিতে পারে না । কোন কারিগরের নিজের দক্ষতা থাকিলেও যন্ত্র না হইলে যেমন তাহার চলে না এবং যন্ত্র খারাপ হইলে তাহা মেরামৎ করিতে তাহার সময় লাগে, জীবাত্মারও সেইরূপ অবস্থা । জ্ঞানলাভের প্রেরণা করিবার সময় জীবাত্মা স্বতন্ত্র একথা সত্য, কিন্তু জীবাত্মা তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে মূলে নিগুৰ্ণ ও কেবল কিংবা পূর্বে সপ্তম প্রকরণে ইক্ত-অনুসারে চক্ষুমান্‌ কিন্তু খঞ্জ হওয়া প্রযুক্ত [মৈক্র্যু|৩|২,৩; গী|১৩|২০], উক্ত প্রেরণা অনুসারে পরে কোন কর্ম করিতে হইলে যে সামগ্রী কিংবা যে সাধন আবশ্যক হয় (যথা কুম্ভকারের চাকা ইত্যাদি) তাহা এই আত্মার নিজের নিকট থাকে না – যে সাধন উপলব্ধ হয় যথা দেহ ও বুদ্ধি-আদি ইন্দ্রিয় সেই সমস্ত মায়াত্মক প্ৰকৃতির বিকার । তাই, নিজের মুক্তির কার্য ও জীবাত্মাকে প্রারব্ধকর্মানুসারে প্রাপ্ত দেহেন্দ্ৰিয়াদি সাধন বা উপাধির দ্বারাই করিয়া লইতে হয় । এই সাধনগুলির মধ্যে বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয় মুখ্য হওয়ায় কোন কার্য করিতে হইলে, আত্মা বুদ্ধিকেই সমুচিত প্রেরণা করে । কিন্তু পূর্বকর্মানুসারে এবং প্ৰকৃতি-স্বভাব-বশতঃ এই বুদ্ধি যে সর্বদা শুদ্ধ ও সাত্ত্বিকই থাকিবে এরূপ কোন নিয়ম নাই । তাই, প্ৰথমে ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির প্রপঞ্চ হইতে মুক্ত হইয়া এই বুদ্ধি অন্তর্মুখ, শুদ্ধ, সাত্ত্বিক কিংবা আত্মনিষ্ঠ হইতে হইবে; অর্থাৎ এই বুদ্ধি এরূপ হইবে যে, জীবাত্মার প্রেরণার হুকুম শুনিয়া তাহার যাহাতে কল্যাণ হয় এইরূপ কর্ম করিবে । ইহা হইতে গেলে বহুকাল বৈরাগ্য অভ্যাস করা আবশ্যক । এতটা করিয়াও ক্ষুধাতৃষ্ণা প্ৰভৃতি দেহ ধর্ম এবং যে সঞ্চিত কর্মের ফলভোগ আরম্ভ হইয়াছে সেই কর্ম হইতে মুক্ত হওয়া ত যায়ই না । তাই, বন্ধন-উপাধি-বদ্ধ জীবাত্মার দেহেন্দ্ৰিয়াদিগকে মোক্ষানুকূল কর্ম করিবার প্রেরণা করিবার স্বাতন্ত্র্য থাকিলেও পরে প্রকৃতির যোগেই সমস্ত কার্য করাই হয় বলিয়া সেই পরিমাণে ছুতার কুমোর প্রভৃতি কারিগরের ন্যায় সেই আত্মা পরাবলম্বী হইয়া যায় এবং তাহাকে দেহেন্দ্ৰিয়াদি যন্ত্র প্রথমে সাফ্‌ করিয়া তাহাদিগকে নিজের অধীনে আনিতে হইবে [বেসূ|২|৩|৪০] । এই কার্য একবারে হইতে পারে না; ধৈর্য সহকারে ধীরে ধীরে করিতে হইবে; নচেৎ অশায়েস্তা ঘোড়ার মত ইন্দ্ৰিয় সকল খানার ভিতর নিশ্চয়ই পতিত হইবে । এই জন্য ভগবান বলিয়াছেন - ইন্দ্ৰিয়-নিগ্ৰহাৰ্থ বুদ্ধিকে ধৃতির অর্থাৎ ধৈর্যের সাহায্য গ্ৰহণ করিতে হইবে [গী|৬|২৫]; এবং পরে অষ্টাদশ অধ্যায়ে বুদ্ধির ন্যায় ধৃতির সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক এই তিন নৈসর্গিক ভেদ প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে [গী|১৮|৩৩-৩৫] । তন্মধ্যে তামসিক ও রাজসিক পৈঠাকে ছাড়িয়া দিয়া বুদ্ধিকে সাত্বিক করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিতে হয়; তাই ষষ্ঠ অধ্যায়ে এই প্রকার ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহাভ্যাসরূপ যোগের উপযুক্ত স্থান, আসন ও আহার কি, তাহার সংক্ষিপ্ত বৰ্ণনা আছে । এইরূপ গীতায় উক্ত হইয়াছে যে, ‘শনৈঃ শনৈঃ’ [গী|৬|২৫] অভ্যাস করিলে পর, চিত্ত স্থির হইয়া ইন্দ্রিয়গণ আয়ত্তাধীন হয় এবং পরে কালক্রমে (একেবারে নহে) ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান উৎপন্ন হইয়া, “আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধুন্তি ধনঞ্জয়” - সেই জ্ঞানের দ্বারা কর্মের বন্ধন মোচন হয় [গী|৪|৩৮-৪১] । কিন্তু ভগবান একান্তে যোগাভ্যাস করিতে বলিতেছেন বলিয়া [গী|৬|১০] জগতের সমস্ত ব্যবহার ছাড়িয়া যোগাভ্যাসেই সমস্ত জীবন ক্ষেপণ করাই গীতার তাৎপর্য এইরূপ অর্থ বুঝিতে হইবে না । কোন ব্যবসায়ী যেরূপ নিজের অল্পস্বল্প যাহা কিছু থাকে তাহা লইয়াই প্ৰথমে ব্যবসা আস্তে আন্তে শুরু করিয়া দিয়া শেষে অপার সম্পত্তি লাভ করে, সেইরূপই গীতার কর্মযোগেরও কথা । আপনার যতটা সাধ্য ততটা ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিয়া প্ৰথমে কর্মযোগ শুরু করিতে হইবে, এবং তাহার দ্বারাই শেষে অধিকাধিক ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহসামর্থ্য লাভ করা যায় । তথাপি একেবারে হাত গুটাইয়া বসিয়াও যোগাভ্যাস করিলে চলে না । কারণ, তাহার ফলে বুদ্ধির একাগ্রতার অভ্যাস কমিয়া যাইবার আশঙ্কা থাকে । তাই, যাহাতে কর্মযোগ বরাবর সমান চালাইতে পারা যায় এইজন্য অল্প সময় নিত্য-নিয়মিত কিংবা মাঝে মাঝে কিছুকাল একান্তে থাকাও আবশ্যক হয় [গী|১৩|১০] । তাহার জন্য জাগতিক ব্যবহার ছাড়িবে এরূপ ভগবান্‌ কোথাও বলেন নাই । উল্টা, জাগতিক ব্যবহার নিষ্কামবুদ্ধিতে করিতে থাকিবে, তাহার জন্যই ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের অভ্যাস করিতে বলিয়াছেন । এই ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের সঙ্গেই নিষ্কাম কর্মযোগও যথাশক্তি প্ৰতোকের করিতে হইবে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহে সম্পূর্ণ সিদ্ধ হওয়া পৰ্যন্ত প্ৰতীক্ষা করিয়া থাকিবে না, এইরূপ গীতার উপদেশ । মৈক্র্যপনিষদে এবং মহাভারতে উক্ত হইয়াছে যে, মনুষ্য বুদ্ধিমান ও নিগ্রহী হইলে এইপ্ৰকার যোগাভ্যাসে ছয় মাসের মধ্যে সাম্যবুদ্ধি প্রাপ্ত হইতে পারে; [মৈক্র্যু|৬|২৮; মভা|শাং|২৩৯|৩২; অশ্ব|অনুগীতা|১৯|৬৬] । 


16) মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য আচরিত স্বল্প কর্মও ব্যর্থ যায় না


কিন্তু ভগবান কর্তৃক বর্ণিত বুদ্ধির এই সাত্ত্বিক, সম কিংবা আত্মনিষ্ঠা অবস্থা ছয়মাসে কেন, ছয় বৎসরেও প্রাপ্ত হয় না; এবং এই অভ্যাস অপূর্ণ থাকিবার কারণে এই জন্মে পূর্ণ সিদ্ধি প্রাপ্ত হইবে না শুধু নহে, পরজন্মে গোড়া হইতে আবার শুরু করিতে হইবে বলিয়া, পরজন্মের যোগাভ্যাসও পুনৰ্বার পূর্বের মতোই অপূর্ণ থাকিবে; তাই এইরূপ আশঙ্কা হয় যে, এইপ্ৰকার পুরুষ পূর্ণসিদ্ধি কখনই লাভ করিতে পরিবে না; ফলতঃ এইরূপ মনে করাও সম্ভব যে, কর্মযোগের আচরণ করিবার পূর্বে পাতঞ্জলযোগের দ্বারা সম্পূর্ণ নিৰ্বিকল্প সমাধির শিক্ষা করা প্ৰথমে আবশ্যক । অর্জুনের মনে এই সন্দেহ উপস্থিত হওয়ায়, এই প্রসঙ্গে মনুষ্যের কি করা উচিত এইরূপ শ্ৰীকৃষ্ণকে অর্জুন গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে [গী|৬|৩৭-৩৯] প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন । ভগবান এই প্রশ্নের এইরূপ উত্তর দিয়াছেন যে, আত্মা অমর হওয়ায় তাহার উপর লিঙ্গশরীর দ্বারা এই জন্মে যে অল্প-বিস্তর সংস্কার উৎপন্ন হইয়া থাকে, তাহাই পরে দৃঢ়স্থায়ী হয় এবং এই ‘যোগভ্ৰষ্ট’ ব্যক্তি অৰ্থাৎ কর্মযোগ সম্পূৰ্ণ সাধন না করিয়া তাহা হইতে যে ভ্ৰষ্ট হইয়াছে সেই ব্যক্তি পরজন্মে আপন প্ৰযত্নে সেখান হইতেই পরে আরম্ভ করে এবং এইরূপ হইতে হইতে ক্ৰমে “অনেকজন্মসংসিদ্ধ-স্ততো-যাতি পরাং গতিম্‌” - [গী|৬|৪৫] - অনেক জন্মের পর, শেষে পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করিয়া সে মোক্ষ প্রাপ্ত হয় । “স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্ৰায়তে মহতো ভয়াৎ” [গী|২|৪০] এই ধর্মের অর্থাৎ কর্মযোগমার্গের স্বল্প আচরণেই মহা সঙ্কট হইতে উদ্ধার হয় - এইরূপ দ্বিতীয় অধ্যায়ে যাহা উক্ত হইয়াছে তাহা এই সিদ্ধান্তেরই অনুরূপ বাক্য । সারকথা, মনুষ্যের আত্মা মূলে স্বতন্ত্র হইলেও পূর্বকর্মানুসারে আপন প্রাপ্ত দেহের অশুদ্ধ প্ৰকৃতি-স্বভাব-বশতঃ একজন্মেই মনুষ্যের পূর্ণ সিদ্ধি লাভ হইতে পারে না । কিন্তু তাহাতেও “নাত্মানমবমন্যেত পূর্বাভিরসমৃদ্ধিভিঃ” [মনু|৪|১৩৭] কেহ যেন নিরাশ না হয়; একজন্মেই পরমসিদ্ধি লাভ করিবার দুরাগ্রহে পতিত হইয়া, পাতঞ্জল যোগাভ্যাসে অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের নিছক্‌ কসরৎ-কার্যেই সমস্ত জীবন যেন অনর্থক কাটিয়া না যায় । আত্মার কোন ত্বরা নাই, আজ যাহা সাধ্য ততটা যোগবলই আয়ত্ত করিয়া কর্মযোগের আচরণ শুরু করিয়া দিবে অৰ্থাৎ তাহা দ্বারাই ধীরে ধীরে বুদ্ধি অধিকাধিক সাত্ত্বিক ও শুদ্ধ হইয়া কর্মযোগের এই স্বল্পাচরণ কেন, জিজ্ঞাসা পৰ্যন্ত, - চৰ্কায় অৰ্পিতের ন্যায়, মনুষ্যকে বলপূর্বক সামনে ক্রমশঃ ঠেলিতে ঠেলিতে শেষে, - আজ নয় তো কাল, এ জন্মে নয় তো পরজন্মে, তাহার আত্মাকে পূৰ্ণব্ৰহ্ম-প্ৰাপ্তি করাইয়া দেয় । সেইজন্য কর্মযোগমার্গের অত্যন্ত স্বল্পাচরণ কিংবা জিজ্ঞাসা পর্যন্তও কখনই ব্যর্থ হয় না, ইহাই কর্মযোগশাস্ত্রের বিশেষ গুণ — এইরূপ গীতাতেই ভগবান স্পষ্ট বলিয়াছেন [গী|৬|১৫ সম্বন্ধে আমার টীকা দেখ] । কেবল এই জন্মের দিকে দৃষ্টি না দিয়া এবং ধৈর্যত্যাগ না করিয়া নিষ্কাম কর্ম করিবার উদ্যোগ স্বাতন্ত্র্যসহকারে ও ধীরে ধীরে যথাশক্তি আমাদের করা কৰ্তব্য । প্রাক্তন সংস্কারবশতঃ প্ৰকৃতির বন্ধন এই জন্মে আজ মোচন হইবার নহে বলিয়া মনে হয়; কিন্তু তাহাই ক্রমে ক্রমে বিবৃদ্ধমান কর্মযোগের অভ্যাসে কাল কিংবা পরজন্মে আপনা-আপনিই শিথিল হইয়া যায় এবং এইরূপ হইতে হইতে “বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্‌ মাং প্ৰপদ্যতে” [গী|৭|১৯] - কখন না কখন পূর্ণ জ্ঞান প্ৰাপ্তি দ্বারা প্ৰকৃতির বন্ধন কিংবা পরাধীনতা হইতে মুক্ত হইয়া আত্মা অবশেষে আপন মূল পূর্ণ নির্গুণ মুক্তাবস্থা অর্থাৎ মোক্ষ প্রাপ্ত হয় । মনুষ্য কি না পারে ? “নর করণী করে তো নরসে নারায়ণ হোয়” নর যদি উচিত কাজ করে সে নর নারায়ণ হয় - এই যে চলিত কথা আছে তাই এই বেদান্তসিদ্ধান্তেরই অনুরূপ বাক্য; যোগবাসিষ্ঠকার এই কারণেই মুমুক্ষু-প্রকরণে উদ্যোগের প্রশংসা করিয়া, উদ্যোগের দ্বারাই সমস্তই প্ৰাপ্ত হওয়া যায় এইরূপ নিঃসন্দিগ্ধ বিধান করিয়াছেন [যো|২|৪|১৬-১৮]


17) কর্মক্ষয়ের স্বরূপ


যাক্‌ । জ্ঞানলাভার্থ প্ৰযত্ন করিবার জন্য জীবাত্মা মূলে স্বতন্ত্র এবং স্বাবলম্বনপূর্বক দীর্ঘ উদ্যোগের দ্বারা শেষে কখন-না-কখন প্ৰাক্তন কর্মের বন্ধনপাশ হইতে মুক্ত হয়, ইহা সিদ্ধ হইলেও কর্মক্ষয় কি, ও কখন কর্মক্ষয় হয় এবিষয়ে আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । কর্মক্ষয় অর্থে সমস্ত কর্মের বন্ধন হইতে পূর্ণরূপে অর্থাৎ নিঃশেষে মুক্ত হওয়া । কিন্তু পুরুষ জ্ঞানী হইলেও তাহার যতদিন দেহ থাকে ততদিন পর্যন্ত সে তৃষ্ণা, ক্ষুধা, শোয়া, বসা ইত্যাদি কর্ম হইতে মুক্ত হয় না এবং প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয়ও ভোগ ব্যতীত হয় না, তাই সে আগ্রহপূর্বক দেহত্যাগাদি করিতে পারে না ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । জ্ঞান হইবার পূর্বে কৃতকর্ম জ্ঞানের দ্বারা নাশ নিঃসন্দেহ হয়; কিন্তু যখন জ্ঞানী পুরুষের যাবজ্জীবন জ্ঞানোত্তরকালেও ন্যূনাধিক কর্ম করিতেই হয় তখন এইরূপ কর্ম হইতে তাহার মুক্তি কি করিয়া হইবে ? এবং মুক্ত না হইলে, পূর্বকর্মক্ষয় কিংবা পরে মোক্ষও হয় না, এই সংশয় উঠতে পারে । ইহার উত্তরে বেদান্তশাস্ত্র এইরূপ বলেন যে, নামরূপাত্মক কর্ম জ্ঞানী ব্যক্তির নামরূপাত্মক দেহ হইতে মুক্ত না হইতে পারিলেও, আত্মার সেই কর্ম আপনাতে গ্ৰহণ করা বা না করা বিষয়ে স্বাধীনতা থাকায়, ইন্দ্ৰিয়দিগকে জয় করিয়া, কর্মে প্রাণীমাত্রের যে আসক্তি থাকে তাহাকে যদি ক্ষয় করা যায় তাহা হইলে কর্ম করিলেও তাহার অঙ্কুর বিনষ্ট প্রায় হয় । কর্ম স্বভাবতঃ অন্ধ, অচেতন, কিংবা মৃত । কর্ম আপনা হইতে কাহাকে ধরে না এবং ছাড়েও না; উহা স্বত ভালোও নহে, মন্দও নহে । মনুষ্য আপনাকে এই কর্মে আবদ্ধ রাখিয়া নিজ আসক্তির দ্বারা উহাকে ভালো কিংবা মন্দ, শুভ কিংবা অশুভ প্ৰস্তুত করিয়া লয় । তাই, এই মমত্বযুক্ত আসক্তি হইতে মুক্ত হইলে, কর্মের বন্ধন স্বতই ভাঙ্গিয়া যায় এইরূপ বলা যায়; - তারপর সেই কর্ম থাকুক বা চলিয়া যাক্‌ । 


18) কর্ম দূর হয় না, ফলাশা ছাড়


গীতারও স্থানে স্থানে এই উপদেশই দেওয়া হইয়াছে - প্ৰকৃত নৈষ্কর্ম ইহাতেই, কর্মত্যাগে নহে [গী|৩|৪]; কর্মেই তোমার অধিকার, ফল লাভ করা বা না করা তোমার অধিকারের বিষয় নহে [গী|২|৪৭]; “কর্মেন্দ্ৰিয়ৈঃ কর্মযোগমসত্তঃ” [গী|৩|৭] - ফলের আশা না রাখিয়া কর্মেন্দ্ৰিয়দিগকে কর্ম করিতে দেও; “ত্যক্ত্বা কর্মফলাসঙ্গম্‌” [গী|৪|২০] - কর্মফল ত্যাগ করিয়া “সর্বভুতাত্মভূতাত্মা কুৰ্বন্নপি ন লিপ্যতে” [গী|৫|৭] - সমস্ত ভূতে যাহার সমদৃষ্টি হইয়াছে সেই পুরুষ কর্ম করিলেও কর্মের দ্বারা বদ্ধ হয় না; “সৰ্বকর্মফলত্যাগং কুরু” [গী|১২|১১] - সমস্ত কর্মফল ত্যাগ কর; “কার্যমিত্যেব যৎকর্ম নিয়তং ক্রিয়তে” [গী|১৮|৯] -  কেবল কৰ্তব্য বলিয়া যে ব্যক্তি কর্ম করে সে সাত্ত্বিক; “চেতসা সর্বকর্মাণি ময়ি সংন্যস্য” [গী|১৮|৫৭] - সমস্ত কর্ম আমাকে অৰ্পণ করিয়া কাজ কর । উপরে যাহা বলিয়া আসিলাম, তাহাদের ইহাই বীজ । 


19) কর্মের বন্ধকত্ব মনে, কর্মে নহে


জ্ঞানী মনুষ্য সমস্ত ব্যবহারিক কর্ম করিবে কি করিবে না, এই প্রশ্ন স্বতন্ত্র । তৎসম্বন্ধে গীতাশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত কি, তাহার বিচার পরবর্তী প্রকরণে করা যাইবে । এখন কেবল ইহাই দেখিতে হইবে যে, জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত কর্ম ভস্ম হইয়া যায় । ইহার প্রকৃত অর্থ কি; এবং উপরি-প্রদত্ত বচনাদি হইতে, এই বিষয়ে গীতার কি অভিপ্রায় তাহা ব্যক্ত হয় । ব্যবহারেও এই নীতিসূত্রই আমরা প্রয়োগ করি । উদাহরণ যথা – অজ্ঞাতসারে কোন ব্যক্তি যদি কাহাকে ধাক্কা মারে তাহা হইলে আমরা সেই ব্যক্তিকে গুণ্ডা বলি না; এবং ফৌজদারী আইনেও নিছক্‌ অপঘাতঘটিত হত্যাকে হত্যা বলিয়া ধরে না । আগুনে ঘর পুড়িয়া গেলে, কিংবা বৃষ্টির বন্যায় ক্ষেত ভাসিয়া গেলে, আগুনকে কিংবা বৃষ্টিকে কি কেহ অপরাধী মনে করে ? শুধু কর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করিলে, প্ৰত্যেক কর্মে মনুষ্যের দৃষ্টিতে কিছু না কিছু দোষ কিংবা মন্দ পাওয়া যাইবেই যাইবে, - “সর্বারম্ভা হি দোষেণ ধুমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ” [গী|১৮|৪৮] । কিন্তু গীতা যে দোষকে ছাড়িতে বলে তাহা ইহা নহে । মনুষ্যের কোন কর্মকে আমরা যে শুভাশুভ বলি, তাহার ভালমন্দত্ব কর্মে থাকে না, তাহা সেই কর্মের কর্তার বুদ্ধিতে থাকে । ইহা মনে রাখিয়া গীতায় সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে, কর্মের মন্দত্ব ঘুচাইতে হইলে কর্তার আপনি বুদ্ধি ও মনকে শুদ্ধ রাখিতে হইবে, [গী|২|৪৯-৫১]; এবং উপনিষদেও -
মনএব মনুষ্যাণাং কারণং বন্ধমোক্ষয়োঃ ৷
বন্ধায় বিষয়াসঙ্গি মোক্ষে নির্বিষয়ং স্মৃতম ॥
“মনুষ্যের (কর্মের) বন্ধন কিংবা মোক্ষ প্ৰাপ্তির পক্ষে মনই (এব) কারণ; মন বিষয়াসক্ত হইলে, বন্ধন এবং নিষ্কাম কিংবা নির্বিষয় অর্থাৎ নিঃসঙ্গ হইলে মোক্ষ” - এইরূপে কর্মকর্তা মনুষ্যের বুদ্ধিকেই প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছে [মৈক্র্য|৬|৩৪; অমৃতবিন্দু|২] । ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান লাভ করিয়া বুদ্ধির এই সাম্যাবস্থা কিরূপে সম্পাদন করিবে ইহাই ভগবদ্গীতায় মুখ্যরূপে উক্ত হইয়াছে । এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে কর্ম করিলেও সম্পূর্ণ কর্মক্ষয় হইয়া থাকে । নিরগ্নি হইয়া অর্থাৎ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া অগ্নিহোত্ৰাদি কর্ম ত্যাগ করিলে কিংবা অক্রিয় থাকিলে অর্থাৎ কোন কর্ম না করিয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিলে কর্মের ক্ষয় হয় না [গী|৬|১] । মনুষ্যের ইচ্ছা থাক্‌ বা না থাক্‌, প্ৰকৃতির চক্ৰ সর্বদা ঘুরিতে থাকায় মনুষ্যকেও সেই সঙ্গে চলিতে হয় [গী|৩|৩৩; ১৮|৬০] । কিন্তু অজ্ঞান লোকেরা এইরূপ অবস্থায় প্রকৃতির অধীনে থাকিয়া যেরূপ নাচিতে থাকে সেরূপ না করিয়া ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির ও শুদ্ধ রাখিয়া যে ব্যক্তি সৃষ্টিক্রমানুসারে প্রাপ্ত কর্ম কেবল কৰ্তব্য বলিয়া অনাসক্ত বুদ্ধিতে ও শান্তভাবে করে সে-ই প্ৰকৃত বৈরাগী, প্ৰকৃত স্থিতপ্ৰজ্ঞ ও ব্রহ্মপদপ্রাপ্ত পুরুষ [গী|৩|৭; ৪|২১; ৫|৭-৯; ১৮|১১] । যদি কোন জ্ঞানী পুরুষ কোনও ব্যবহারিক কর্ম না করিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া বনে গমন করেন, তাহা হইলে এই প্রকার ব্যবহারিক কর্ম ত্যাগ করায় তাহার কর্মের ক্ষয় হইল এরূপ মনে করা বড় ভুল [গী|৩|৪] । সে কর্ম করুক বা না করুক, তাহার কর্মের যে ক্ষয় হয়, তাহা তাহার বুদ্ধি সাম্যাবস্থায় পৌঁছিয়াছে বলিয়াই হয়, কর্ম ছাড়িবার দরুন কিংবা না করিবার দরুন নহে, এই তত্ত্বটি সর্বদা মনে রাখা উচিত । অগ্নির দ্বারা যেরূপ কাষ্ঠ দগ্ধ হয় সেইরূপ জ্ঞানের দ্বারা কর্ম দগ্ধ হয়; এই দৃষ্টান্ত অপেক্ষা, পদ্মপত্রের উপর জল থাকিলেও উক্ত পত্রে যেমন জল লাগিয়া থাকে না সেইরূপ জ্ঞানী পুরুষকে - অৰ্থাৎ ব্ৰহ্মাৰ্পণ করিয়া অথবা আসক্তি ছাড়িয়া যে ব্যক্তি কর্ম করে তাহাকে কর্ম লেপিয়া ধরে না, উপনিষদের ও গীতার এই দৃষ্টান্ত [ছাং|৪|১৪|৩; গী|৫|১০] কর্মক্ষয়ের প্রকৃত স্বরূপ দেখাইবার পক্ষে অধিক উপযোগী । কর্ম স্বরূপত কখনই দগ্ধ হয় না; এবং উহাকে দগ্ধ করিবার কোন আবশ্যকতাও হয় না । কর্ম নামরূপ এবং নামরূপ দৃশ্য জগৎ ইহা যদি সিদ্ধ হয় তবে এই সমস্ত দৃশ্য জগৎ দগ্ধ হইবে কি করিয়া ? এবং কচিৎ কখন দগ্ধ হইলেও সৎকার্যবাদ অনুসারে বড় জোর তাহার নামরূপই পরিবর্তিত হইবে । নামরূপাত্মক স্বকর্ম কিংবা মায়া নিত্য বদলায় বলিয়া নামরূপকে আপন রুচি অনুসারে মনুষ্য যদি বদলাইয়া লয়, তাহা হইলেও মনুষ্য যতই আত্মজ্ঞানী হউক না কেন, এই নামরূপাত্মক কর্মের সমূলে নাশ করিতে পারে না; তাহা কেবল পরমেশ্বরই করিতে পারেন, এ কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই [বেসূ|৪|৪|১৭ দেখ] । কিন্তু মূলে এই জড় কর্মের মধ্যে ভালমন্দের যে বীজ অবস্থিতই নাই এবং মনুষ্য আপন মমত্ববুদ্ধির দ্বারা তাহার মধ্যে যাহাকে উৎপাদন করিয়া থাকে তাহার নাশ করা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত, এবং তাহার দ্বারা যাহা দগ্ধ করা যাইতে পারে তাহা ইহাই । সমস্ত ভূতে সমত্ববুদ্ধি স্থাপন করিয়া আপনার সমস্ত কর্মের এই মমত্ববুদ্ধি যিনি দগ্ধ করিয়াছেন তিনিই ধন্য, কৃতকৃত্য ও মুক্ত; সমস্ত কর্ম করিতে থাকা সত্ত্বেও তাহার কর্ম জ্ঞানাগ্নির দ্বারা দগ্ধ হইয়াছে, এইরূপ উক্ত হয় [গী|৪|১৯; ১৮|৫৬] । 


20) জ্ঞান হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ অনারব্ধ কর্মক্ষয়


এই প্রকারে কর্ম দগ্ধ হওয়া সম্পূর্ণরূপে মনের নির্বিষয়তার উপর এবং ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের অনুভূতির উপর নির্ভর করে বলিয়া, অগ্নি কখনও উৎপন্ন হইলেই যেরূপ তাহার দহন করিবার ধর্ম তাহাকে ছাড়ে না, সেইরূপ ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান যখনই হউক না কেন, তাহার উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই তাহার কর্মক্ষয়রূপ পরিণাম সংঘটিত হইতে কালের অপেক্ষায় থাকিতে হয় না । জ্ঞান হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ কর্মক্ষয় হইয়া থাকে । 


20a) মৃত্যুকালের গুরুত্ব


তথাপি অন্য সমস্ত কাল অপেক্ষা মৃত্যুকাল এই বিষয়ে অত্যন্ত গুরুতর বলিয়া ধরা যায় । কারণ, মৃত্যুই আয়ুর চরম কাল; এবং তাহার পূর্বে কোন এক সময়ে ব্ৰহ্মজ্ঞান হইয়া অনারব্ধ সঞ্চিতের ক্ষয় হইলেও প্ৰারব্ধ নষ্ট হয় না । তাই, এই ব্ৰহ্মজ্ঞান যদি শেষ পৰ্যন্ত বরাবর সমানভাব স্থায়ী না হয়, তাহা হইলে প্ৰারব্ধ কর্মানুসারে মরণ পৰ্যন্ত ভালমন্দ, কর্ম যাহা ঘটিবে সে সমস্ত সকাম হইবে এবং তাহার ফলভোগ করিবার জন্য পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করিতেই হইবে । যে সম্পূর্ণ জীবন্মুক্ত হইয়াছে তাহার এই ভয় থাকে না, ইহা স্বীকার করি । কিন্তু এই বিষয়ের শাস্ত্রদৃষ্টিতে যখন বিচার করিতে হয় তখন মৃত্যুর পূর্বে উৎপন্ন ব্ৰহ্মজ্ঞান কখনও বা শেষ পৰ্যন্ত টিকিয়া না-ও থাকিতে পারে এ বিষয়ের বিচার করা নিশ্চয় অবশ্যক । তাই মৃত্যুর পূর্বের কাল অপেক্ষা শাস্ত্রকার মৃত্যুকালকেই বিশেষরূপে গুরুতর কাল বলিয়া মনে করেন; এবং তখন অর্থাৎ মৃত্যুকালে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের অনুভূতি সংঘটিত হওয়া আবশ্যক, নচেৎ মোক্ষলাভ সম্ভব নহে, এইরূপ নির্ধারণ করেন । এই অভিপ্ৰায়েই “অন্তকালে অনন্যভাবে আমাকে স্মরণ করিলে মনুষ্য মুক্ত হয়” এইরূপ উপনিষদের ভিত্তিতে গীতায় উক্ত হইয়াছে [গী|৮|৫] । এই সিদ্ধান্তানুসারে বলিতে হয় যে, যাহার সমস্ত জীবন দুরাচারে কাটিয়াছে, কেবল মৃত্যুসময়ে তাহার পরমেশ্বরের জ্ঞান হইলে সেও মুক্ত হয় । অনেকের মতে এরূপ হওয়া যুক্তিসিদ্ধ নহে । কিন্তু একটু বিচার করিয়া দেখিলে, ইহাতে অসঙ্গত কিছুই নাই, এইরূপ প্ৰতীতি হইবে । যাহার সমস্ত জীবন দুরাচারে কাটিয়াছে তাহার কেবল মৃত্যুকালেই সুবুদ্ধি ও ব্ৰহ্মজ্ঞান উৎপন্ন হইতে পারে না । অন্য বিষয়ের ন্যায় মনকে ব্ৰহ্মনিষ্ঠ করিবার অভ্যাস করা চাই; এবং সমস্ত জীবনের মধ্যে একবারও যাহার ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অনুভূতি হয় নাই তাহার কেবল অন্তকালেই তাহা একবারে পাওয়া পরম দুর্ঘট, এমন কি, অসম্ভব । তাই, এই সম্বন্ধে গীতার আর একটা বড় কথা আছে – প্রত্যেকেই মনকে বিষয়-বাসনা-শূন্য করিবার অভ্যাস নিত্যকাল রাখিবে, যাহার ফলে অন্তকালেও সেই অবস্থাটীই বজায় রাখিবার পক্ষে কোন বাধা ঘটিবে না, এবং মনুষ্য শেষে মুক্ত হইবে [গী|৮|৬,৭ ও ২|৭২] । কিন্তু শাস্ত্ৰ ছাঁকিয়া সত্য নিৰ্বাচনের জন্য স্বীকার করা যাউক যে, পূর্বসংস্কারাদি কারণবশতঃ কাহারও কেবল মৃত্যুকালেই সহসা পরমেশ্বরের জ্ঞানলাভ হইল । লক্ষ লক্ষ এমনকি কোটি কোটি মনুষ্যের মধ্যে এই প্রকারের এক-আধটা উদাহরণ পাওয়া যাইবে সন্দেহ নাই । 

কিন্তু তাহা কত দুর্লভ বা দুর্ঘট তাহার বিচার একপাশে রাখিয়া দিয়া, এইরূপ অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে কি হইবে, এক্ষণে আমাদের ইহাই আলোচ্য । মৃত্যুকালেই জ্ঞান হোক্‌ না কেন, তাহা দ্বারা মনুষ্যের অনারব্ধ সঞ্চিতের ক্ষয় হইবেই; এবং আরব্ধকার্য-সঞ্চিতের ক্ষয় এই জন্মের ভোগের দ্বারা মৃত্যুকালে হয় । তাই, তাহার কোন কর্ম ভোগ করাই অবশিষ্ট থাকে না; এবং এইরূপ অগত্যা সিদ্ধান্ত করিতে হয় যে, সমস্ত কর্ম হইতে অর্থাৎ সংসারচক্ৰ হইতে সে মুক্ত হয় । এই সিদ্ধান্ত “অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক্‌” ইত্যাদি [গী|৯|৩০] – খুব দুরাচারী মনুষ্যও পরমেশ্বরকে অনন্যভাবে ভজনা করিলে মুক্ত হয়ই হয় - এই গীতাবাক্যে উক্ত হইয়াছে; এবং এই সিদ্ধান্ত জগতের অন্য ধর্মেও গ্ৰাহ্য হইয়াছে । ‘অনন্যভাব’ অর্থে পরমেশ্বরে মানুষের চিত্তবৃত্তি পূর্ণরূপে লীন হওয়া; চিত্তবৃত্তি অন্যদিকে রাখিয়া মুখে “রাম রাম” বিড়্‌ বিড়্‌ করা নয়, এইটুকু মাত্র এই স্থানে মনে রাখা চাই । মোট কথা, ব্ৰহ্মজ্ঞানের মহিমাই এইরূপ যে, জ্ঞান হইলেই সমস্ত অনারব্ধ সঞ্চিতের একেবারেই ক্ষয় হয় । এই অবস্থা যখনই প্রাপ্ত হই না কেন, সর্বদা ইষ্ট তো বটেই । কিন্তু সেই অবস্থাকেই মৃত্যুকালে স্থির রাখা, কিংবা পূর্বে প্ৰাপ্ত না হইলেও অন্তত অন্তকালে প্ৰাপ্ত হওয়া নিতান্তই অবশ্যক । নতুবা মৃত্যুকালে কিছু বাসনা অবশিষ্ট থাকিলে পুনর্জন্ম এড়ানো যাইবে না, এবং পুনর্জন্ম এড়াইতে না পারিলে মোক্ষও পিছাইয়া পড়িবে এইরূপ আমাদের শাস্ত্রকারেরা স্থির করিয়াছেন ।


21) কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড


কর্মবন্ধন কি, কর্মক্ষয় কাহাকে বলে এবং তাহা কি প্রকারে ও কখন্‌ হয়, ইহা বলিয়াছি । এখন উপস্থিতপ্ৰসঙ্গে, যাহাদের কর্মফল নষ্ট হইয়াছে তাহারা এবং যাহারা কর্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয় নাই তাহারা মৃত্যুর পর বৈদিক ধর্মানুসারে কোন গতি প্রাপ্ত হয় ইহার একটু বিচার করিয়া এই প্রকরণ শেষ করিব । এই সম্বন্ধে উপনিষদে অনেক আলোচনা হইয়াছে [ছাং|৪|১৫; ৫|১০; বৃ|৬|২, ২-১৬; কৌ|১|২-৩] । তাহাদের একবাক্যতা বেদান্তসূত্রের চতুর্থ অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে করা হইয়াছে । কিন্তু এই সমস্ত আলোচনা বিবৃত করিবার এখানে কোন প্রয়োজনই নাই । কেবল ভগবদ্গীতায় যে দুই মাৰ্গ [গী|৮|২৩-২৭] প্রদত্ত হইয়াছে সেই সম্বন্ধেই এক্ষণে আমাদের বিচার কৰ্তব্য । বৈদিক ধর্মের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই দুই প্ৰসিদ্ধ ভেদ আছে । 


21a) শ্রৌতযজ্ঞ ধর্ম বা ত্রয়ীধর্ম


তন্মধ্যে, কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য সূর্য, অগ্নি, ইন্দ্ৰ, বরুণ, রুদ্র ইত্যাদি বৈদিক দেবতাদিগকে যজ্ঞের দ্বারা পূজা করিয়া, তাহাদের প্রসাদে ইহলোকে পুত্ৰ-পৌত্ৰাদি সন্ততি এবং গো অশ্ব ধনধান্যাদি সম্পত্তি লাভ করিয়া শেষে মৃত্যুর পর সদ্‌গতি লাভ করা । বর্তমানকালে এই যাগযজ্ঞাদি শ্রৌত ধর্ম লুপ্তপ্ৰায় হওয়ায় উক্ত উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য দেবভক্তি ও দানধর্মাদি শাস্ত্রোক্ত পুণ্যকর্ম লোকে করিয়া থাকে । ঋগ্‌বেদ হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, প্ৰাচীনকালে লোক শুধু স্বার্থের জন্য নহে, সমস্ত সমাজের কল্যাণার্থও যজ্ঞের দ্বারাই, দেবতাদের আরাধনা করিত । উক্ত কার্যের জন্য যে দেবতার আনুকুল্য সম্পাদন করিতে হয় সেই ইন্দ্রাদি দেবতাদের স্তবস্তুতির দ্বারাই ঋগবেদের সূক্তগুলি পূর্ণ; এবং তাহাতে স্থানে স্থানে “হে দেব ! আমাদিগকে সন্ততি দেও, সমৃদ্ধি দেও” “আমাদিগকে শতায়ু কর” “আমাদিগকে, আমাদের সন্তানসন্ততিকে, আমাদের বীরপুরুষদিগকে এবং আমাদের গরু-বাছুরকে মারিও না” এইরূপ প্রার্থনা করা হইয়াছে । (এই মন্ত্র অনেক স্থানে প্রদত্ত হইয়াছে; কিন্তু সে সমস্ত না দিয়া এই বহুল প্রচলিত মন্ত্রটি এই স্থানে বলিলেই যথেষ্ট — “মা নস্তোকে তনয়ে মা ন আয়ৌ মা নো গোষু মা নো অশ্বেষু রীরিষঃ । বীরান্মা নো রুদ্র ভামিতো বর্ধীর্হবিষ্মন্তঃ সদমিত্বা হবমাহে ॥” [ঋ|১|১১৪|৮]) এই যাগযজ্ঞ তিন বেদেরই বিধান হওয়ায় এই মার্গের পুরাতন নাম – ‘ত্রয়ীধর্ম’; এই যজ্ঞ কিরূপে করিতে হইবে ব্ৰাহ্মণগ্রন্থে তাহার বিস্তৃত বর্ণনা আছে । 


21b) জৈমিনির ‘পূর্বমীমাংসা’


কিন্তু বিভিন্ন ব্ৰাহ্মণগ্রন্থে যজ্ঞের বিভিন্ন বিধি বর্ণিত থাকায় কোনটি গ্রাহ্য তৎসম্বন্ধে সন্দেহ উপস্থিত হইতে লাগিল; তাই জৈমিনি এই পরস্পরবিরুদ্ধ বাক্যগুলির সমন্বয় কিরূপে করা যাইবে তৎসম্বন্ধীয় অর্থনির্ণায়ক নিয়মসমূহের সংগ্ৰহ করিলেন । জৈমিনির এই নিয়মকেই ‘মীমাংসাসূত্র’ কিংবা ‘পূর্বমীমাংসা’ বলে; এবং সেই জন্য এই প্ৰাচীন কর্মকাণ্ডের নাম পরে ‘মীমাংসক মাৰ্গ’ হইয়াছে; ঐ নামই এক্ষণে প্ৰচলিত হওয়ায় আমিও এই গ্রন্থে অনেকবার উহার উপযোগ করিয়াছি । কিন্তু ‘মীমাংসা’ শব্দই পরে প্রচলিত হইলেও যাগযজ্ঞাদির এই মার্গ অতি প্ৰাচীন কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে, ইহা মনে রাখা উচিত । এই কারণে গীতায় ‘মীমাংসা’ শব্দ কোথাও আসে নাই; তাহার বদলে ‘ত্ৰয়ীধর্ম[গী|৯|২০,২১] কিংবা ‘ত্ৰয়ী বিদ্যা’ নাম আসিয়াছে । 


21c) বাদরায়ণাচার্যর ‘উত্তরমীমাংসা’


যাগযজ্ঞাদি শ্রৌতকর্মপ্ৰতিপাদক ব্ৰাহ্মণগ্ৰন্থাদির পরে আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত । ইহাতে যাগযজ্ঞাদি কর্ম গৌণ ও ব্ৰহ্মজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ এইরূপ প্ৰতিপাদিত হওয়ায় ইহার ধর্মকে ‘জ্ঞানকাণ্ড’ বলা হয় । তথাপি, বিভিন্ন উপনিষদে বিভিন্ন বিচার থাকায় উহাদেরও সমন্বয় করা আবশ্যক । এই কার্য বাদরায়ণাচার্য স্বকীয় বেদান্তসূত্ৰে করিয়াছেন । এই গ্ৰন্থকে ব্ৰহ্মসূত্র কিংবা শারীরসূত্র বা ‘উত্তরমীমাংসা’ বলে ।

এই প্রকার পূর্বমীমাংসা ও উত্তরমীমাংসা অনুক্ৰমে কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড সম্বন্ধে প্ৰধান গ্ৰন্থ । বস্তুতঃ এই দুই গ্ৰন্থ মূলে মীমাংসারই অর্থাৎ বৈদিক বচনাদির অর্থের আলোচনা করিয়াছে । তথাপি কর্মকাণ্ড প্ৰতিপাদককে শুধু ‘মীমাংসক’ এবং জ্ঞানকাণ্ড-প্রতিপাদককে ‘বেদান্তী’ বলাই এক্ষণে রীতি হইয়াছে । কর্মকাণ্ডীরা অর্থাৎ মীমাংসকেরা বলেন যে শ্রৌতধর্মে চাতুর্মাস্য, জ্যোতিষ্টোম প্রভৃতি যাগযজ্ঞাদি কর্মই প্ৰধান; এবং তাহা যে ব্যক্তি করিবে, সে-ই বেদের আদেশ অনুসারে মোক্ষলাভ করে । এই যাগযজ্ঞাদি কর্ম কেহই ছাড়িতে পারিবে না । যদি ছাড়ে, তবে শ্রৌতধর্ম হইতে সে বিচ্ছিন্ন হইল এইরূপ বুঝিতে হইবে । কারণ, জগতের উৎপত্তির সঙ্গে বৈদিক যজ্ঞের উৎপত্তি হইয়াছে; এবং মনুষ্য যজ্ঞ করিয়া দেবতাদিগকে তৃপ্ত করিবে, এবং দেবতারাও মনুষ্যের যে যে বিষয় আবশ্যক তাহা পুরণ করিবেন, এই চক্ৰ অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে । এক্ষণে আমি এই বিচারের বিশেষ গুরুত্ব আছে বলিয়া মনে করি না, কারণ যাগযজ্ঞরূপ শ্রৌতধর্ম এক্ষণে প্রচলিত নাই । কিন্তু গীতাকালের অবস্থা ভিন্ন হওয়ায় ভগবদ্গীতাও [গী|৩|১৬-২৫] যজ্ঞকর্মের মাহাত্ম্য উপরি-উক্ত-অনুসারেই বর্ণিত হইয়াছে । তথাপি গীতা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, সে সময়েও উপনিষদের জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষদৃষ্টিতে এই যজ্ঞকর্মাদির গৌণত্ব উপলব্ধ হইয়াছিল [গী|২|৪১-৪৬] । এই গৌণত্বই অহিংসাধর্মের, বিস্তারের পর ক্রমেই বাড়িয়া গিয়াছিল । যাগযজ্ঞ বেদবিহিত হইলেও তাহার জন্য পশুবধ প্ৰশস্ত নহে, ধান্যের দ্বারাই যজ্ঞ করিবে, এইরূপ ভাগবতধর্মে স্পষ্ট প্ৰতিপাদন করা হইয়াছে [মভা|শাং|৩৩৬|১০ ও ৩৩৭ দেখ] । সেই জন্য (এবং কিয়দংশে পরে জৈনেরাও এইরূপ কথাই উত্থাপন করায়) এখনকার কালে শ্রৌতযজ্ঞমার্গের এইরূপ অবস্থা হইয়াছে যে, নিত্য শ্রৌতাগ্নিহোত্ৰপালনকারী অগ্নিহোত্রী কাশীর ন্যায় বড় বড় ধর্মক্ষেত্রেও খুব কমই দেখিতে পাওয়া যায়; এবং দশ কুড়ি বৎসরের মধ্যে একটী জ্যোতিষ্টোমাদি পশুযজ্ঞ হইয়াছে বলিয়া কদাচিৎ শুনিতে পাওয়া যায় । তথাপি শ্রৌতধর্মই সমস্ত বৈদিক ধর্মের মূল হওয়ায় তৎসম্বন্ধে আদরবুদ্ধি অদ্যাপি বজায় আছে এবং জৈমিনীয় সূত্র অৰ্থনির্ণায়ক শাস্ত্রের তৌলের উপর প্রমাণ গণ্য হয় । 


21d) স্মার্তযজ্ঞ (পঞ্চমহাযজ্ঞ)


শ্রৌত যাগযজ্ঞাদি ধর্ম এইরূপ শিথিল হইলেও মন্বাদি স্মৃতিগ্রন্থে বর্ণিত অন্য যজ্ঞ - যাহাকে পঞ্চমহাযজ্ঞ বলে - অদ্যাপি প্ৰচলিত আছে এবং এই সম্বন্ধেও শ্রৌতযাগযজ্ঞচক্রাদিরই উক্ত নিয়ম প্ৰযুক্ত হয় । উদাহরণ যথা, মম্বাদি স্মৃতিকারেরা বেদাধ্যয়নরূপ ব্ৰহ্মযজ্ঞ, তৰ্পণরূপ পিতৃযজ্ঞ, হোমরূপ দেবযজ্ঞ, বলিরূপ ভূতযজ্ঞ এবং অতিথিসন্তৰ্পণরূপ মনুষ্যযজ্ঞ, এইরূপ পাঁচ অহিংসাত্মক ও নিত্য গৃহযজ্ঞের কথা বলিয়াছেন; এই পাঁচ যজ্ঞেই অনুক্ৰমে ঋষিগণ, পিতৃগণ, দেবতাগণ, ভূতগণ ও মনুষ্যগণকে প্রথমে তৃপ্ত করিয়া তাহার পর গৃহস্থ নিজে অন্ন গ্ৰহণ করিবে এইরূপ গাৰ্হস্থ্যধর্মের বিধি প্ৰদত্ত হইয়াছে [মনু|৩|৬৮-১২৩] । এই যজ্ঞ করিয়া যে অন্ন অবশিষ্ট থাকে তাহার নাম ‘অমৃত’; এবং সমস্ত,লোকের আহার হইয়া যে অন্ন উদ্‌বৃত্ত হয় তাহাকে ‘বিঘস’ বলে [মনু|৩|২৮৫] । এই ‘অমৃত’ ও ‘বিঘস’ অন্নই গৃহস্থের পক্ষে বিহিত ও শ্রেয়স্কর ৷ এইরূপ না করিয়া যে কেহ কেবল আপনার উদরের জন্য অন্ন পাক করিয়া খায় সে অঘ অর্থাৎ পাপ ভক্ষণ করে, এবং তাহাকে মনুস্মৃতি ঋগ্‌বেদ ও গীতা প্রভৃতি সকল গ্রন্থেই ‘অঘাশী’ বলা হইয়াছে [ঋ|১০|১১৭|৬; মনু|৩|১১৮; গী|৩|১৩] । এই স্মাৰ্ত্ত পঞ্চমহাযজ্ঞ ছাড়া দান, সত্য, দয়া, অহিংসা প্ৰভৃতি সর্বভূতহিতপ্ৰদ অন্য ধর্মও উপনিষদে ও স্মৃতিগ্রন্থে গৃহস্থের পক্ষে বিহিত বলিয়া নির্ধারিত হইয়াছে [তৈ|১|১১]; এবং তাহাতেই, পরিবারের বৃদ্ধি করিয়া বংশ বজায় রাখিবে – ‘প্রজাতন্তুং মা ব্যাবচ্ছেৎসীঃ’ - এইরূপ স্পষ্ট উল্লেখ আছে । এই সমস্ত কর্মকে একপ্রকার যজ্ঞ বলিয়াই মানা যায় এবং তাহা করিবার কারণ তৈত্তিরীয় সংহিতায় এইরূপ উক্ত হইয়াছে যে, ব্ৰাহ্মণ জন্মতই আপনার পৃষ্ঠের উপর তিন প্রকার ঋণ লইয়া আসে - এক ঋষিদের, দ্বিতীয় দেবতাদিগের ও তৃতীয় পিতৃগণের । তন্মধ্যে ঋষিদের ঋণ বেদাভ্যাসে, দেবতাদের ঋণ যজ্ঞের দ্বারা এবং পিতৃগণের ঋণ পুত্রোৎপত্তির দ্বারা শোধ করা আবশ্যক, নচেৎ তাহার সদ্‌গতি হইবে না [তৈ|সং|৬|৩|১০|৫](তৈত্তিরীয় সংহিতার বচনটি এই – “জায়মানো বৈ ব্রাহ্মণস্ত্রিভিঋর্ণবা জায়তে ব্রহ্মচর্য্যেণর্ষিভ্যো যজ্ঞেন দেবেভ্যঃ প্রজয়া পিতৃভ্য এব বা অনৃণে যঃ পুত্রী বজ্বা ব্রহ্মচারিবাসাতি” ।) জরৎকারু যখন এই প্ৰকার না করিয়া বিবাহ করিবার পূর্বেই কঠোর তপশ্চর্যায় প্রবৃত্ত হইলেন তখন সন্তানক্ষয় প্ৰযুক্ত তাঁহার যাযাবর নামক পিতৃপুরুষ আকাশে ঝুলিয়া আছেন তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল এবং তাঁহার আদেশক্রমে পরে তিনি বিবাহ করিলেন, এইরূপ মহাভারতের আদি পর্বে এক কথা আছে [মভা|আ|১৩] । 


22) কর্মপ্রধান গার্হস্থ্যবৃত্তি


এই সমস্ত কর্ম অথবা যজ্ঞ কেবল ব্ৰাহ্মণদিগেরই করিতে হইবে এরূপ নহে । বৈদিক যাগযজ্ঞ ব্যতীত অন্য সমস্ত কর্ম যথাধিকার স্ত্রী ও শূদ্রের পক্ষেও বিহিত হওয়ায় স্মৃতিকারদিগের কথিত চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা অনুসারে অনুষ্ঠিত সমস্ত কর্মই যজ্ঞ; উদাহরণ যথা, ক্ষত্ৰিয়দিগের যুদ্ধও এক যজ্ঞ; এবং যজ্ঞ শব্দের এই ব্যাপক অর্থই এই প্রকরণে বিবক্ষিত হইয়াছে । যাহার পক্ষে যাহা বিহিত তাহাই তাহার তপ [১১|২৩৬] এইরূপ মনু বলিয়াছেন । মহাভারতেও -
আরম্ভযজ্ঞাঃ ক্ষত্ৰাশ্চ হবিৰ্যজ্ঞা বিশঃ স্মৃতাঃ ৷
পরিচারযজ্ঞাঃ শূদ্ৰাশ্চ জপযজ্ঞা দ্বিজাতয়ঃ ॥
আরম্ভ (উদ্যোগ), হবি, সেবা ও জপ এই চার যজ্ঞ, ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য শূদ্র ও ব্রাহ্মণ এই চার বর্ণের পক্ষে যথানুক্ৰমে বিহিত এইরূপ উক্ত হইয়াছে [মভা|শাং|২৩৭|১২] । সার কথা, এই জগতের সমন্ত মনুষ্যকে যজ্ঞার্থই ব্ৰহ্মদেব সৃষ্টি করিয়াছেন [মভা|অনু|৪৮|৩; ও গী|৩|১০ ও ৪|৩২ দেখ] । ফলত চাতুর্বর্ণ্যাদি সমস্ত শাস্ত্রোক্ত কর্মই একপ্রকার যজ্ঞ; এবং প্রত্যেকের নিজ নিজ অধিকারানুসারে এই যজ্ঞ অর্থাৎ শাস্ত্রোক্ত কর্ম - ধন্ধা, ব্যবসায় বা কৰ্তব্যব্যবহার - যদি তাহারা প্ৰচলিত না রাখে তাহা হইলে সমস্ত সমাজের ক্ষতি হইয়া অবশেষে তাহার ধ্বংস হইবারও সম্ভাবনা হইয়া থাকে । তাই এই ব্যাপক অর্থে সিদ্ধ হইতেছে যে, লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যজ্ঞের আবশ্যকতা সর্বদাই হইয়া থাকে ।


23) জ্ঞানযুক্ত ও জ্ঞানরহিত কর্ম


এক্ষণে এই প্রশ্ন উত্থিত হইতেছে যে, যদি বেদ-অনুসারে এবং চাতুর্বর্ণাদি স্মাৰ্ত্ত ব্যবস্থানুসারে গৃহস্থের পক্ষে সেই কেবল কর্মময়, যজ্ঞপ্রধান বৃত্তি বিহিত বলিয়া স্বীকৃত হইল, তবে কি এই সাংসারিক কর্ম ধর্ম-শাস্ত্ৰানুসারে যথা-বিধি (অর্থাৎ নীতি ও ধর্মের আদেশ অনুসারে) করিলে তাহার দ্বারাই মনুষ্য জন্মমরণের ফের হইতে মুক্ত হয় ? আর যদি বলা যায় যে সে মুক্ত হয়, তাহা হইলে জ্ঞানের মাতব্বরী ও যোগ্যতা কি রহিল ? ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান হইয়া কর্মে বিরক্ত না হইলে নামরূপাত্মক মায়া হইতে কিংবা জন্মমরণের ফের হইতে মুক্তি নাই, এইরূপ জ্ঞানকাণ্ড অর্থাৎ উপনিষদ্‌ স্পষ্ট বলেন; এবং শ্রৌতস্মার্ত ধর্ম যদি দেখ, তবে প্রত্যেকের সমস্ত জীবন কর্মপ্ৰধান কিংবা ব্যাপকার্থে যজ্ঞময়, এইরূপ দেখা যায় । তাছাড়া যজ্ঞার্থে অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধক হয় না এবং যজ্ঞের দ্বারাই স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি হয় এইরূপ বেদও স্পষ্ট বলিয়াছেন । স্বর্গের কথা একপাশে সরাইয়া রাখিলেও ইন্দ্ৰাদি দেবতারা সন্তুষ্ট না হইলে বৃষ্টি পড়ে না এবং যজ্ঞ না করিলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন না, এইরূপ নিয়ম ব্ৰহ্মদেবই স্থাপন করিয়াছেন । তবে যজ্ঞ অর্থাৎ কর্ম ব্যতীত মনুষ্যের কাজ চলিবে কি করিয়া ?
আগ্নৌ প্রাস্তাহুতিঃ সম্যগাদিত্যমুপাতিষ্ঠাতে ৷
আদিত্যাজ্জায়তে বৃষ্টি বৃর্ষ্টেরন্নং ততঃ প্ৰজাঃ ॥
“যজ্ঞে হুত দ্রব্যাদি অগ্নি দ্বারা সূর্যের নিকট পৌছায় এবং সূর্য হইতে পর্জন্য, পর্জন্য হইতে অন্ন, এবং অন্ন হইতে প্রজা উৎপন্ন হয়” ইহলোকে মনুস্মৃতি, মহাভারত, উপনিষদ ও গীতাতে এইরূপ ক্রম দেওয়া হইয়াছে [মনু|৩|৭৬; মভা|শাং|২৬২|১১; মৈক্র্যু|৬৩৭; ও গী|৩|১৪ দেখ] । এবং এই যজ্ঞ যদি কর্মের দ্বারাই সাধ্য হয় তবে কর্ম ছাড়িলে কাজ চলিবে কি করিয়া ? যজ্ঞময় কর্ম ছাড়িলে সংসারচক্র বন্ধ হইয়া যাইবে, কেহ খাইতেও পাইবে না ! ইহার উত্তরে ভাগবত ধর্ম ও গীতাশাস্ত্র বলেন যে, যাগযজ্ঞাদি বৈদিক কিংবা অন্য কোন স্মাৰ্ত্ত বা ব্যবহারিক যজ্ঞময় কর্ম ছাড়ো আমরা এ কথা বলি না; অধিক কি, পুর্বাপর চলিয়া আসিতেছে এই যে যজ্ঞের চক্র ইহা বন্ধ হইয়া গেলে জগৎ উৎসন্ন হইবে, তোমাদের এই কথা আমাদেরও মান্য । তাই, কর্মময় যজ্ঞ কখনই ত্যাগ করা উচিত নহে ইহাই আমাদের সিদ্ধান্ত [মভা|শাং|৩৪০; গী|৩|১৬] । কিন্তু জ্ঞান ও বৈরাগ্যের দ্বারা কর্মময় না হইলে মোক্ষ নাই এইরূপ জ্ঞানকাণ্ডে অর্থাৎ উপনিষদে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । তাই, এই দুই সিদ্ধান্ত মিলাইয়া সমস্ত কর্ম জ্ঞানের সহিত অর্থাৎ ফলাশা ছাড়িয়া নিষ্কাম কিংবা বিরক্ত বুদ্ধিতে করিতে হইবে ইহাই আমাদের শেষ কথা [গী|৩|১৭-১৯ দেখ] । স্বৰ্গফলের কাম্যবুদ্ধি মনে স্থাপন করিয়া জ্যোতিষ্টোমাদি যাগযজ্ঞ করিলে, বেদের কথা অনুসারে তুমি স্বৰ্গফল পাইবে ইহাতে সন্দেহ নাই; কারণ, বেদাজ্ঞা কখনই মিথ্যা হইতে পারে না । কিন্তু স্বৰ্গফল নিত্য অর্থাৎ স্থায়ী হয় না বলিয়া উক্ত হইয়াছে যে, -
প্ৰাপ্যান্তং কর্মণস্তস্য যৎকিঞ্চেহ করোত্যয়ম্‌ ৷
তস্মাল্লোকাৎ পুনরেত্যস্মৈ লোকায় কর্মণে ॥ *
* (এই মন্ত্রের দ্বিতীয় চরণ পড়িবার সময় ‘পুনরেতি’ এবং ‘অস্মৈ’ এইরূপ পদচ্ছেদ করিয়া পড়িলে এই চরণে অক্ষরের কমী পড়িবে না । বৈদিক গ্ৰন্থ পড়িবার সময় অনেক সময় এইরূপ করা আবশ্যক হয় ।)

“ইহলোকে অনুষ্টিত যাগযজ্ঞাদি পুণ্যকর্মের ফল স্বৰ্গভোগের দ্বারা শেষ হইলে, যজ্ঞকারী কর্মকাণ্ডী মনুষ্যকে স্বৰ্গলোকে হইতে এই কর্মলোকে অর্থাৎ ভূলোকে পুনর্বার আসিতে হয়” [বৃ|৪|৪|৬; বেসূ|৩|১|৮; মভা|বন|২৬০|৩৯] । স্বৰ্গ হইতে নীচে আসিবার কোন্‌ পথ তাহাও ছান্দোগ্যউপনিষদে উক্ত হইয়াছে [ছাং|৫|১০|৩-৯]“কামাত্মানঃ স্বৰ্গপরাঃ” কিংবা “ত্ৰৈগুণ্যবিষয়া বেদাঃ” [গী|২|৪৩,৪৫] এইরূপ কিছু গৌণত্বসূচক যে বর্ণনা ভগবদ্গীতায় আছে তাহা এই কর্মকাণ্ডী লোকদিগকেই লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছে; এবং নবম অধ্যায়ে আরও স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, “গতাগতং কামকামা লভন্তে” [গী|৯|২১] - তাহাদিগকে স্বৰ্গলোকে ও ইহলোকে বারবার যাতায়াত করিতে হয় । এই যাতায়াত না ঘুচিলে আত্মার প্রকৃত শান্তি, পুর্ণাবস্থা কিংবা মোক্ষলাভ হয় না । তাই, গীতার সমস্ত উপদেশের সার এই যে, শুধু যাগযজ্ঞাদি কেন, চাতুর্বর্ণের সমস্ত কর্মই তুমি ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা ও সাম্যবুদ্ধির দ্বারা আসক্তি ছাড়িয়া কর, এই প্রকারে কর্মচক্ৰ বজায় রাখিয়াও তুমি মুক্ত হইবে [গী|১৮|৫|৬] । দেবতাদের উদ্দেশে, তিল তণ্ডুল কিংবা পশু “ইদং অমুকদেবতায়ৈ ন মম” বলিয়া অগ্নিতে হবন করিলেই যজ্ঞ হয় এরূপ নহে । প্ৰত্যক্ষ পশু বধ করা অপেক্ষা প্ৰত্যেকের শরীরে কাম-ক্ৰোধাদি যে পশুবৃত্তি আছে, সাম্যবুদ্ধিরূপ সংযম-অগ্নিতে তাহাদের হোম করাই অধিক শ্রেয়ষ্কর যজ্ঞ [গী|৪|৩৩] । এই অভিপ্ৰায়েই “যজ্ঞসমূহের মধ্যে আমি জপযজ্ঞ” অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ, এইরূপ গীতায় ও নায়ায়ণীয় ধর্মে ভগবান্‌ বলিয়াছেন [গী|১০|২৫; মভা|শাং|৩|৩৭] । মনুস্মৃতিতেও জপের দ্বারাই ব্ৰাহ্মণ সিদ্ধিলাভ করিতে পারে - তারপর আর যাহা করুক বা না করুক, - এইরূপ উক্ত হইয়াছে [মনু|২|৮৭] । অগ্নিতে আহুতি দিবার সময় ‘ন মম’ - ইহা আমার নয় - এইরূপ বলিয়া উক্ত দ্রব্যের উপর নিজের মমত্ববুদ্ধি ত্যাগ করাই যজ্ঞের মুখ্য তত্ত্ব; এবং দানাদি কর্মেরও ইহাই বীজ, তাই এই কর্মের যোগ্যতাও যজ্ঞের সহিত সমান । অধিক কি, যাহাতে নিজের কিছু মাত্র স্বার্থ নাই এইরূপ কর্ম শুদ্ধ বুদ্ধিতে করিলে তাহাকে যজ্ঞ বলিলেও চলে । যজ্ঞের এই ব্যাখ্যা স্বীকার করিলে, বুদ্ধিকে নির্মম কিংবা নিষ্কাম রাখিয়া অনুষ্ঠিত সমস্ত কর্মকেই ব্যাপক অর্থে যজ্ঞ বলা যায়; এবং দ্রব্যময় যজ্ঞের পক্ষপাতী মীমাংসকের ‘যজ্ঞার্থে অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধনকারণ হয় না’ এই নিয়মসূত্র ঐ সমস্ত নিষ্কাম কর্মেও প্রযুক্ত হয় । এই কর্ম করিবার সময় ফলাশাও ত্যাগ করা প্ৰযুক্ত স্বর্গের যাতায়াতও ঘটে না এবং এই কর্ম করিলেও শেষে মোক্ষরূপ সদ্‌গতি লাভ হয় [গী|৩|৯] ৷ সার কথা, সংসার যজ্ঞময় কিংবা কর্মময় হইলৈও কর্ম-অনুষ্ঠানকারীদিগকে দুই বর্গে বিভক্ত করা হইয়া থাকে । এক, শাস্ত্ৰোক্ত রীতিতে কিন্তু ফলাশা রাখিয়া যাহারা সংসারযাত্রা নিৰ্বাহ করে (কর্মকাণ্ডী লোক); আর দুই, নিষ্কাম বুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া যাহারা জীবনযাত্রা নির্বাহ করে (জ্ঞানী লোক) । তন্মধ্যে প্ৰথম অর্থাৎ নিছক কর্মকাণ্ডী লোকদিগের স্বৰ্গপ্ৰাপ্তিরূপ অনিত্য ফল, এবং দ্বিতীয় অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা কিংবা নিষ্কামবুদ্ধিতে কর্মকারী জ্ঞানী ব্যক্তিদিগের নিত্য মোক্ষফল লাভ হয়, এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত । মোক্ষের জন্য কর্ম ছাড়িতে গীতা কোথাও বলেন নাই । উল্টা, অষ্টাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে স্পষ্টরূপে উক্ত হইয়াছে যে, ‘ত্যাগ = ছাড়া’ শব্দে গীতাতে কর্মত্যাগের পরিবর্তে ‘ফলত্যাগ’ই সর্বত্র বিবক্ষিত ।


24) মৃত্যুর পর বিভিন্ন গতি - দেবযান ও পিতৃযান


কর্মকাণ্ডী ও কর্মযোগীদিগের প্রাপ্য ফল এইপ্ৰকারে বিভিন্ন হওয়ায়, প্ৰত্যেককে মৃত্যুর পর ভিন্ন ভিন্ন পথ দিয়া ভিন্ন ভিন্ন লোকে যাইতে হয় । এই মার্গের নাম অনুক্রমে ‘পিতৃযান’ ও ‘দেবযান’ [শাং|১৭|১৫|১৬] । এবং উপনিষদের ভিত্তিতে এই দুই মাৰ্গই গীতার অষ্টম অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে । যাহার জ্ঞানলাভ হইয়াছে সেই ব্যক্তির - এবং এই জ্ঞান অন্ততঃ অন্তিমকালে তো অবশ্যই হইয়া গিয়াছে [গী|২|৭২] - শরীর মৃত্যুর পর চিতায় দগ্ধ হইলে, সেই অগ্নি হইতে জ্যোতি (জ্বালা), দিবা, শুক্লপক্ষ, এবং উত্তরায়ণের ছয় মাসে - প্ৰয়াণ করিতে করিতে সেই ব্যক্তি ব্ৰহ্মপদে গিয়া পৌছায় এবং সেখানে তাহার মোক্ষলাভ হওয়ায় সে পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করিয়া এই মৃত্যুলোকে ফিরিয়া আসে না; কিন্তু যে ব্যক্তি শুধু কর্মকাণ্ডী অর্থাৎ যাহার জ্ঞান হয় নাই, সে সেই অগ্নি হইতে ধূম, রাত্রি, কৃষ্ণপক্ষ ও দক্ষিণায়নের ছয় মাস এই ক্রমানুসারে চলিয়া চন্দ্ৰলোকে পৌঁছিয়া তাহার কৃত পুণ্যের সমস্ত ফল ভোগ করিয়া পুনর্বার ইহলোকে জন্মগ্রহণ করে; এই দুই মার্গের এইরূপ ভেদ [গী|৮|২৩-২৭] । ‘জ্যোতি’ (জ্বালা) শব্দের স্থানে উপনিষদে ‘অৰ্চি’ (জ্বালা) এই শব্দ থাকায় প্রথম মার্গের ‘অৰ্চিরাদি’ এবং দ্বিতীয়ের ‘ধূম্রাদি’ এইরূপ নামও আছে । আমাদের উত্তরায়ণ উত্তর ধ্রুবস্থানে অবস্থিত দেবতাদের দিন এবং আমাদের দক্ষিণায়নই তাঁহাদের রাত্রি, এই পরিভাষার প্ৰতি লক্ষ্য করিলে, এই দুই মার্গের মধ্যে অৰ্চিরাদি (জ্যোতিরাদি) কিংবা প্ৰথম মার্গ আরম্ভ হইতে শেষ পৰ্যন্ত প্ৰকাশময় এবং দ্বিতীয় অর্থাৎ ধূম্রাদি মার্গ অন্ধকারময়, ইহা স্পষ্টই দেখা যায় । জ্ঞান প্ৰকাশময় এবং পরব্রহ্ম ‘জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ’ [গী|১৩|১৭] - জ্যোতির জ্যোতি - হওয়া প্ৰযুক্ত মৃত্যুর পর জ্ঞানী ব্যক্তির মাৰ্গ প্ৰকাশময় হওয়াই সঙ্গত; গীতায় এই দুই মার্গের – ‘শুক্ল’ ও ‘কৃষ্ণ’ এই যে দুই সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে, প্ৰকাশময় ও অন্ধকারময়ই তাহার অর্থ । গীতায় উত্তরায়ণের পরবর্তী পৈঠার উল্লেখ নাই । কিন্তু যাস্কের নিরুক্তে উত্তরায়ণের পর দেবলোক, সূর্য, বৈদ্যুত, ও মানস পুরুষের বর্ণনা আছে [নিরুক্ত|১|৯]; এবং উপনিষদে দেবযানের যে বৰ্ণনা আছে তাহার সমন্বয় করিয়া বেদান্তসূত্রে উত্তরায়ণের পরে সম্বৎসর, বায়ুলোক, সূর্য, চন্দ্র, বিদ্যুৎ, বরুণলোক, ইন্দ্রলোক, প্রজাপতিলোক ও পরিশেষে ব্ৰহ্মলোক এইরূপ পরবর্তী সমস্ত পৈঠা প্ৰদত্ত হইয়াছে [বৃহ|৫|১০; ৬|২|১৫; ছাৎ|৫|১০; কৌষী|১|৩; বেসূ|৪|৩|১-৬]


25) দেবযান ও পিতৃযান - কালবাচক বা দেবতাবাচক ?


দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের পৈঠা বা আড্ডার বর্ণনা করা হইল । কিন্তু ইহাদের মধ্যে দিবস, শুক্ল পক্ষ, উত্তরায়ণ প্ৰভৃতির যে বৰ্ণনা আছে তাহার সাধারণ অর্থ কালবাচক হওয়ায় দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের সহিত কালের কোন সম্বন্ধ আছে কিংবা প্ৰথমে কখন ছিল কি না, এই প্রশ্ন স্বভাবতঃ উপস্থিত হয় । দিন, রাত্রি, শুক্লপক্ষ প্ৰভৃতি শব্দের অর্থ কালবাচক হইলেও অগ্নি, জ্যোতি, বায়ুলোক, বিদ্যুৎ প্রভৃতি অন্য যে সকল পৈঠা বর্ণিত হইয়াছে তাহাদের অর্থ কালবাচক হইতে পারে না; এবং জ্ঞানী ব্যক্তি দিন কিংবা রাত্রে মরিলে তাহার ভিন্ন ভিন্ন গতি লাভ হয় এইরূপ মানিলে জ্ঞানেরও কোন মাহাত্ম্য থাকে না । তাই, অগ্নি দিন উত্তরায়ণ প্ৰভৃতি সমস্ত শব্দই কালবাচক স্বীকার না করিয়া বেদান্তসূত্রে ঐ সকল শব্দের দ্বারা তত্তদাভিমানী দেবতা কল্পনা করিয়া এই সকল দেবতা, জ্ঞানী ও কর্মকাণ্ডী ব্যক্তির আত্মাকে বিভিন্ন মাৰ্গ দিয়া ব্ৰহ্মলোকে ও চন্দ্ৰলোকে লইয়া যান, এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে [বেসূ|৪|২০|১৯-২১; ৪|৩|৪] । কিন্তু এই মর ভগবদ্গীতার অভিমত কি না সে বিষয়ে সন্দেহ হয় । কারণ, উত্তরায়ণের পরবর্তী পৈঠা যাহা কালবাচক নহে, গীতায় বর্ণিত হয় নাই । তাহাই নহে, এই মার্গ বলিবার পূর্বেই - “যে সময়ে মরিলে কর্মযোগী ফিরিয়া আসে কিংবা আসে না, সেই কালের কথা এক্ষণে তোমাকে বলিব” [গী|৮|২৩] এইরূপ ভগবান কালের বিষয় স্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন; এবং মহাভারতেও ভীষ্ম শরশয্যায় পড়িলে দেহত্যাগ করিবার জন্য উত্তরায়ণ কালের অর্থাৎ সূর্যের উত্তরদিকে গমনের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন [ভীম|১২০; অনু|১৬৭] । ইহা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, দিন, শুক্লপক্ষ ও উত্তরায়ণ কালই কোন-না-কোন সময়ে মরণের প্রশস্ত কাল বলিয়া মানা হইত । ঋগ্‌বেদেও দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের যেখানে বর্ণনা আছে [ঋ|১০|৮৮|১৫ ও বৃ|৬|২|১৫], সেখানে কালবাচক অর্থই বিবক্ষিত । এই এবং অন্য অনেক প্ৰমাণ হইতে আমি স্থির করিয়াছি যে, উত্তর গোলার্ধের যে স্থানে সূর্য ক্ষিতিজের উপর বরাবর ছয় মাস দৃশ্য হইয়া থাকে সেই স্থানে অর্থাৎ উত্তর ধ্রুবের নিকট অথবা মেরুস্থানে বৈদিক ঋষিদিগের যখন বসতি ছিল তখন হইতেই ছয় মাস উত্তরায়ণের প্রকাশকালকেই মৃত্যুর প্রশস্ত কাল বলিয়া মানিবার প্ৰথা প্রচলিত হইয়া থাকিবে । ইহার সবিস্তর বিচার আমি আমার অন্য গ্রন্থে করিয়াছি কারণ যাহাই হউক না কেন, এই ধারণাটি যে খুবই প্ৰাচীন, তাহাতে সন্দেহ নাই; এবং এই ধারণাই দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গের মধ্যে স্পষ্ট পরিস্ফুট না থাকিলেও পর্যায়ক্রমে উহাদের অন্তর্ভূত হইয়া গিয়াছে । অধিক-কি, এই দুই মার্গেরই মূল এই প্ৰাচীন ধারণার ভিতরেই আছে, এইরূপ আমার মনে হয় । নচেৎ ভগবদ্গীতায় দেবযান ও পিতৃযান লক্ষ্য করিয়া একবার যে ‘কাল’ [গী|৮|২৩] এবং অপর একবার ‘গতি’ বা ‘সৃতি’ অর্থাৎ মাৰ্গ [গী|৮|২৬ ও ২৭] বলা হইয়াছে, অর্থাৎ এই দুই ভিন্ন ভিন্ন অর্থের শব্দ যে প্ৰযুক্ত হইয়াছে, তাহাদের উপপত্তি ঠিক লাগানো যায় না । বেদান্তসূত্রের শাঙ্করভাষ্যে দেবযান ও পিতৃযানের কালবাচক অর্থ স্মাৰ্ত্ত, যাহা কর্মযোগের পক্ষেই খাটে; এবং প্ৰকৃত ব্ৰহ্মজ্ঞানী উপনিষদে বর্ণিত শ্রৌত অর্থাৎ দেবতা প্ৰদৰ্শিত প্ৰকাশময় মার্গের দ্বারা ব্ৰহ্মলোকে গমন করেন এইরূপ ভেদ করিয়া ‘কালবাচক’ ও ‘দেবতাবাচক’ অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে [বেসূ|শাং ভা|৪|২|১৮-২১] । কিন্তু মূল সূত্রে দেখা যায়, যেন কালের অপেক্ষা না রাখিয়া উত্তরায়ণাদি শব্দের দ্বারা দেবতা কল্পনা করিয়া দেবযানের যে দেবতাবাচক অর্থ বাদরায়ণাচার্য নির্ধারণ করিয়াছেন তাহাই তাঁহার মতে সর্বত্র অভিপ্রেত হইয়া থাকিবে; এবং গীতায় বর্ণিত মার্গ উপনিষদের এই দেবযান গতিকে ছাড়িয়া স্বতন্ত্র হইতে পারে এরূপ মনে করাও সঙ্গত নহে । কিন্তু এ স্থলে এত গভীর জলে প্ৰবেশ করিবার আবশ্যকতা নাই । কারণ দেবযান ও পিতৃযানের দিন, রাত্রি, উত্তরায়ণ প্রভৃতি শব্দ ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে মূলারম্ভে কালবাচক ছিল কি না এই সম্বন্ধে মতভেদ থাকিলেও এই কালবাচক অর্থ পরে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল, ইহা নির্বিবাদ । কালের অপেক্ষা না রাখিয়া মনুষ্য যে সময়েই মরুক না কেন, জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের কর্মানুসারে প্রকাশময় মাৰ্গ দিয়া এবং নিছক কর্মকাণ্ডী ব্যক্তি অন্ধকারময় মাৰ্গ দিয়া পরলোকে যাত্রা করে, দেবযান ও পিতৃযান এই দুই শব্দের এই অর্থই শেষে নির্ধারিত ও রূঢ় হইয়া গিয়াছে । তাহার পর, দিন ও উত্তরায়ণ প্ৰভৃতি শব্দে বাদরায়ণাচার্যের কথা অনুসারে দেবতাই মনে কর কিংবা উহার লক্ষণ হইতে প্ৰকাশময় মার্গের ক্ৰমবর্ধনশীল পৈঠাই মনে কর, দেবযান ও পিতৃযান ইহাদের রূঢ় অর্থ যে মাৰ্গবাচক এই সিদ্ধান্তে কোন প্রকার ভেদ হয় না ।


26) তৃতীয় গতি - নরক


কিন্তু কি দেবযান, কি পিতৃযান, - শাস্ত্রোক্ত পুণ্যকর্মকারীই ঐ দুই মাৰ্গ প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । কারণ, পিতৃযানমাৰ্গ দেবযান অপেক্ষা নিম্ন পৈঠার হইলেও, তাহাও চন্দ্ৰলোকে অর্থাৎ একপ্ৰকার স্বৰ্গলোকেই উপনীত হইবার মাৰ্গ । তাই ইহলোকে শাস্ত্রোক্ত কোনপ্রকার পুণ্য কর্ম করিলেই সেখানকার সুখভোগের যোগ্যতা হয়, ইহা স্পষ্টই দেখা যায় [গী|৯|২০|২১] । যাহারা কিছুমাত্র শাস্ত্রোক্ত পুণ্যকর্ম না করিয়া সংসারে যাবজ্জীবন পাপাচরণে নিমগ্ন থাকে তাহারা ঐ দুয়ের মধ্যে কোন মার্গ দিয়াই যাইতে পারে না । তাহারা মৃত্যুর পর একেবারেই পশুপক্ষী আদি তির্যক যোনিতে জন্মগ্রহণ করে, এবং পুনঃ পুনঃ যমলোকে অর্থাৎ নরকে গমন করে এইরূপ উপনিষদে স্পষ্ট বর্ণিত হইয়াছে । ইহাকেই ‘তৃতীয়’ মাৰ্গ বলে [ছাং|৫|১০|৮; কঠ|২|৬|৭]; এবং ভগবদ্গীতাতেও নিছক্‌ পাপী অর্থাৎ আসুরী পুরুষেরা এই নিরয়গতিই প্ৰাপ্ত হয়, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|১৬|১৯-২১; ৯|১২; বেসূ|৩|১|১২,১৩; নিরুক্ত|১৪|৯]


27) ব্ৰহ্মজ্ঞানী এইখানেই মোক্ষ লাভ করেন


বৈদিক ধর্মের প্রাচীন পরম্পরাক্রমে মনুষ্য স্বীয় কর্মানুরূপ মরণান্তর তিনপ্রকার গতি কি ক্ৰম-অনুসারে প্রাপ্ত হয় তাহা উপরে উক্ত হইয়াছে । তন্মধ্যে দেবযান মার্গের দ্বারাই মোক্ষ লাভ হয়; তথাপি ক্রমে ক্রমে অর্থাৎ অৰ্চিরাদি সোপানে পর-পর আরোহণ করিয়া পরিশেষে এই মোক্ষ লাভ হয়; তাই এই মার্গের আর এক নাম ‘ক্রমমুক্তি’, এবং মরণান্তর ব্ৰহ্মলোকে গিয়া সেখানে শেষে মুক্তিলাভ হয় বলিয়া ইহার ‘বিদেহমুক্তি’ এই নামও হইয়াছে । কিন্তু খাঁটি অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ ইহার পরে আরও এই কথা বলেন যে, ব্ৰহ্ম ও নিজের আত্মা এক - এই পূর্ণ সাক্ষাৎকার যাহার মনে নিত্য জাগৃত আছে সেই ব্যক্তি ব্ৰহ্মকে লাভ করিবার জন্য অন্য কোন স্থানে কেন যাইবে ? কিংবা মরণেরও পথই বা সে কেন দেখিবে ? উপাসনার জন্য স্বীকৃত সূর্যাদি প্রতীকের অর্থাৎ সগুণ ব্ৰহ্মের উপাসনার দ্বারা যে ব্ৰহ্মজ্ঞান হয় তাহা প্ৰথমে একটু অপূর্ণ থাকে সত্য, কারণ, তাহার দরুণ সূর্যলোক কিংবা ব্ৰহ্মলোক ইত্যাদির কল্পনা মনে উদিত হইয়া তাহাই মরণ সময়েও ন্যূনাধিক পরিমাণে মনে স্থায়ী হইয়া থাকে । তাই, এই ক্ৰটি পরিহার করিয়া মোক্ষলাভার্থ এই সকল লোককে দেবযান মাৰ্গ দিয়াই যাইতে হয়, - [বেসূ|৪|৩|১৫] । কারণ, মরণ সময়ে যাহার যেরূপ ভাবনা কিংবা ক্ৰতু হয় তাহার সেইরূপ গতি হয় ইহা অধ্যাত্মশাস্ত্রের স্থির সিদ্ধান্ত [ছাং|৩|১৪|১] । কিন্তু সগুণোপাসনা কিংবা অন্য কোন কারণে ব্ৰহ্ম ও নিজের আত্মার মধ্যে কোন দ্বৈতী অন্তরাল [তৈ|২|৭] যাহার মনে একটুও অবশিষ্ট থাকে না, সেই ব্যক্তি সর্বদাই ব্ৰহ্মরূপে থাকায় তাঁহাকে ব্ৰহ্মলাভের জন্য অন্য কোথাও যাইতে হয়ে না, ইহা স্পষ্টই রহিয়াছে । এইজন্য শুদ্ধ ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা যে ব্যক্তি পূর্ণ নিষ্কাম হইয়াছে, “ন তস্য প্ৰাণা উৎক্রামন্তি ব্রহ্মৈব সন্‌ ব্ৰহ্মাপ্যেতি” — তাঁহার প্রাণ আর কোথাও যায় না, সে নিত্য ব্ৰহ্মভূত হইয়া ব্ৰহ্মেতেই লয় প্ৰাপ্ত হয় - এইরূপ বৃহদারণ্যকে [বৃ|৪|৪|৬] যাজ্ঞবল্ক্য জনককে বলিয়াছেন; এই প্রকার ব্যক্তি “অত্র ব্ৰহ্ম সমশ্নুতে”, [কঠ|৬|১৪] এইখানেই ব্ৰহ্ম লাভ করেন, এইরূপ বৃহদারণ্যক ও কঠোপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে । এই শ্রুতির ভিত্তিতে, মোক্ষার্থে স্থানান্তরে যাইবার প্রয়োজন নাই এইরূপ শিবগীতাতেও উক্ত হইয়াছে । ব্ৰহ্ম এরূপ কোন বস্তু নহে যে, তাহা অমুক স্থানে আছে ও অমুক স্থানে নাই [ছাং|৭|২৫; মুং|২|২|১১] । তবে, কোন সময়ে পূর্ণ ব্ৰহ্ম প্রাপ্তির জন্য পূর্ণজ্ঞানী পুরুষকে উত্তরায়ণ, সূর্যলোক আদি মাৰ্গ দিয়া ক্রমে  ক্রমে যাইতে হইবে কেন ? “ব্ৰহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” [মুং|৩|২|৯] যে ব্ৰহ্মকে জানে সে এখানেই, এই লোকেই ব্ৰহ্ম হইয়া গিয়াছে । একজনের অপরের কাছে যাইতে হইলে, ‘এক’ ও ‘অন্য’ এই স্থলকৃত কিংবা কালকৃত ভেদ থাকে; এবং এই ভেদ, শেষের অদ্বৈত ও শ্রেষ্ঠ ব্ৰহ্মোপলব্ধির মধ্যে থাকিতে পারে না । তাই, “যস্য সর্বমাত্মৈবাহভূৎ” [বৃ|২|৪|১৪], কিম্বা “সৰ্ব্বং খল্বিদং ব্ৰহ্ম” [ছাং|৩|১৪|১], অথবা আমিই ব্ৰহ্ম -“অহং ব্ৰহ্মাস্মি” [বৃ|৪|১০] এইরূপ যাহার মনের নিত্য অবস্থা দাঁড়াইয়াছে সে ব্ৰহ্ম-প্ৰাপ্তির জন্য অন্যস্থানে কেন যাইবে ? - সে সর্বদাই ব্ৰহ্মভূতই হইয়া থাকে । পূর্বপ্রকরণের শেষে যাহা বলা হইয়াছে গীতাতে সেই ভাবেই পরম জ্ঞানীপুরুষের এই প্রকার বর্ণন করা হইয়াছে যে, “অভিতো ব্ৰহ্মনিৰ্বাণং বৰ্ত্ততে বিদিতাত্মনাম্‌” [গী|৫|২৬] - যাঁহারা দ্বৈতভাব ত্যাগ করিয়া আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন তাঁহাদিগের প্রারব্ধকর্মক্ষয়ার্থ মৃত্যুর পথ দেখিতে হইলেও মোক্ষলাভের জন্য কোথাও যাইতে হয় না, কারণ ব্ৰহ্মনিৰ্বাণরূপ মোক্ষ তো সর্বদাই তাঁহাদের সম্মুখে হাত জোড় করিয়া দণ্ডায়মান; কিংবা “ইহৈব তৈর্জিতঃ সৰ্গো যেষাং সাম্যে স্থিতং মনঃ” [গী|৫|১৯] - যাঁহাদিগের মনে সর্বভূতান্তৰ্গত ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ সাম্য প্ৰতিভাত হয় তাঁহারা (দেবযান মার্গের অপেক্ষা না রাখিয়া) এখানেই জন্মমরণকে জয় করিয়াছেন; অথবা “ভূতপৃথগ্‌ভাবমেকস্থমনুপশ্যতি” - সমস্ত ভূতের নানাত্ব নষ্ট হইয়া সেই সমস্ত একস্থ অর্থাৎ ব্ৰহ্মরূপ বলিয়া যাহারা মনে হয়, সে-ই ‘ব্ৰহ্ম সম্পদ্যতে’ – ব্রহ্মে মিলিত হয় [গী|১৩|৩০] । সেরূপ আবার, “দেবযান ও পিতৃযান এই দুই মার্গ তত্ত্বতঃ যাহারা জানে সেই কর্মযোগীরা মোহ প্ৰাপ্ত হয় না” [গী|৮|২৭], এইরূপ গীতার যে বচন উপরে প্রদত্ত হইয়াছে তাহার মধ্যেও “তত্ত্বত যাহারা জানে” এই পদের অর্থ “পরম ব্ৰহ্মস্বরূপ যাহারা জানে” ইহাই বিবক্ষিত [ভাগ|৭|১৫|৫৬ দেখ] । ইহাই পূর্ণ ব্ৰহ্মীভুত কিংবা পরাকাষ্ঠা ব্রহ্মস্থিতি; এবং শ্ৰীমৎ শঙ্করাচার্য আপন শারীরক ভাষ্যে [বেসূ|৪|৩|১৪] ইহাই অধ্যাত্মজ্ঞানের অত্যন্ত পরাকাষ্ঠা কিংবা পূর্ণাবস্থা এইরূপ প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । অধিক কি, এই অবস্থা লাভ করিতে হইলে একপ্রকার পরমেশ্বরই হইতে হয়, এইরূপ বলাতেও কোন অতিশয়োক্তি হইবে না । এবং এই প্রকারে ব্ৰহ্মীভূত ব্যক্তি কর্মজগতের সমস্ত বিধিনিষেধের অতীত অবস্থায় উপনীত হন, ইহাও আর বলিতে হইবে না; কারণ তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞান সর্বদাই জাগৃত থাকা প্ৰযুক্ত তাঁহারা যাহা কিছু করেন তাহা সর্বদাই নিষ্কাম বুদ্ধির দ্বারা প্রেরিত হয় বলিয়া পাপপুণ্যের দ্বারা নির্লিপ্ত থাকে । এই অবস্থা প্রাপ্ত হইলে, ব্ৰহ্মপ্রাপ্তির জন্য অন্য কোথাও যাইবার কিংবা মরণেরও কোন আবশ্যকতা না থাকায় এইরূপ স্থিতপ্ৰজ্ঞ ব্ৰহ্মনিষ্ঠ পুরুষকে ‘জীবন্মুক্ত’ বলে [যো|৩|৯ দেখ] । বৌদ্ধেরা আত্মা কিংবা ব্ৰহ্ম না মানিলেও জীবন্মুক্তের এই নিষ্কাম অবস্থাই মনুষ্যের পরম সাধ্য এই কথা তাঁহারা স্বীকার করেন । অল্প শব্দভেদে এই মতকে তাঁহারা আপন ধর্মে গ্ৰহণ করিয়াছেন (পরিশিষ্ট প্রকরণ দেখ) । পরাকাষ্ঠার নিষ্কামত্বের এই অবস্থা এবং সাংসারিক কর্ম ইহাদের মধ্যে স্বভাবতই পরস্পর-বিরোধ থাকা প্ৰযুক্ত যে এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইয়াছে সে কর্ম হইতে স্বতই মুক্ত হইয়া সন্ন্যাসী হইয়া যায়, এইরূপ অনেকে বলেন । কিন্তু এ মত গীতার মান্য নহে; স্বয়ং পরমেশ্বর যেরূপ কর্ম করেন সেইরূপ জীবন্মুক্তেরও নিষ্কামবুদ্ধিতে লোক-সংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ সমস্ত ব্যবহার করাই অধিক শ্রেয়স্কর, কারণ, নিষ্কামত্ব ও কর্ম এই দুয়ের মধ্যে বিরোধ নাই, এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত । ইহা পরবর্তী প্রকরণের নিরূপণে স্পষ্ট দেখা যাইবে । গীতার এই তত্ত্ব যোগবাসিষ্ঠেও স্বীকৃত হইয়াছে [যো|৬|উ|১৯৯]


ইতি দশম প্রকরণ সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment