Sunday, June 4, 2017

গীতাধ্যায়সঙ্গতি (Continuity of the chapters of Gita)

গীতাধ্যায়সঙ্গতি


প্ৰবৃত্তিলক্ষণং ধৰ্ম্মং ঋষির্নারায়ণোহব্ৰবীৎ ৷ [মভা|শান্তি|২১৭|২]

(“নারায়ণ ঋষি, ধর্মকে প্রবৃত্তিমূলক বলিয়াছেন ।” নর ও নারায়ণ এই দুই ঋষিদের মধ্যেই এই নারায়ণ ঋষি ছিলেন; এবং এই দুয়েরই অনুক্ৰমে অর্জুনশ্ৰীকৃষ্ণ অবতার ছিলেন, ইহা পূর্বে বলা হইয়াছে । সেইরূপ আবার, নারায়ণীর ধর্মই গীতার প্রতিপাদ্য – এই সম্বন্ধে মহাভারতের বচনও পূর্বে দেওয়া হইয়াছে ।)


সূচীপত্র


1) বিষয়-প্রতিপাদনের দুই নীতি - শাস্ত্রীয় ও সম্বাদাত্মক
2) সম্বাদাত্মক পদ্ধতির গুণ-দোষ
3) গীতার প্রারম্ভ
4) গীতার প্রথমাধ্যায়
5) গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়
6) গীতার তৃতীয় অধ্যায়
7) গীতার চতুর্থ অধ্যায়
8) গীতার পঞ্চম অধ্যায়
9) গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়
10) কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, এই প্রকার গীতার তিন স্বতন্ত্র বিভাগ করা উচিত নহে
10.1) জ্ঞান ও কর্মের সমান ভক্তি কোন তৃতীয় স্বতন্ত্র নিষ্ঠা নহে
10.2) কর্ম ত্যাগ করিতেই হইবে – সন্ন্যাসমাৰ্গীর এই আপত্তি সত্য নহে
10.3) সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত একাদশ অধ্যায়ের সঙ্গতি
11) গীতার সপ্তম অধ্যায় হইতে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্তের সারাংশ
11.1) গীতার সপ্তম অধ্যায়
11.2) গীতার অষ্টম অধ্যায়
11.3) গীতার নবম অধ্যায়
11.4) গীতার দশম অধ্যায়
11.5) গীতার একাদশ অধ্যায়
11.6) গীতার দ্বাদশ অধ্যায়
12) ভক্তি ও জ্ঞান পৃথক পৃথক বর্ণিত নাই, অতএব ষড়ধ্যায়ী মত অসত্য
13) গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায় হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পর্যন্তের সারাংশ
13.1) গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়
13.2) গীতার চতুৰ্দশ অধ্যায়
13.3) গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়
13.4) গীতার ষোড়শ অধ্যায়
13.5) গীতার সপ্তদশ অধ্যায়
14) সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত এগারো অধ্যায়ের তাৎপৰ্য
15) অষ্টাদশের উপসংহার কর্মযোগপ্রধানই
16) মীমাংসকদের দৃষ্টিতেও গীতাতে কর্মযোগই প্রতিপাদ্য হইয়াছে
17) চতুর্বিধ পুরুষার্থ
18) গীতার সন্ন্যাসপ্রধান অর্থ কি প্রকারে করা গিয়াছে
19) সাংখ্য + নিষ্কাম কর্ম = কর্মযোগ
20) গীতাতে কি নাই ? তথাপি শেষে কর্মযোগই প্রতিপাদ্য
21) সন্ন্যাসমার্গীদের নিকটে প্রার্থনা



1) বিষয়-প্রতিপাদনের দুই নীতি - শাস্ত্রীয় ও সম্বাদাত্মক


কর্ম করিবার সময়েই অধ্যাত্ম বিচারের দ্বারা কিংবা ভক্তির দ্বারা সর্বাত্মৈক্যরূপ সাম্যবুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে সম্পাদন করা এবং তাহা প্ৰাপ্ত হইলেও সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা না করিয়া সংসারে শাস্ত্রতঃ প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম কেবল কর্তব্য বলিয়া সর্বদা করিতে থাকা, ইহাই এই জগতে মনুষ্যের পরম পুরুষাৰ্থ কিংবা জীবনযাপনের উত্তম মাৰ্গ, ইহাই ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষদ ভগবদ্‌গীতায় প্ৰতিপাদিত হইয়াছে - এ পৰ্যন্ত যে বিচার করা হইয়াছে তাহা হইতে ইহা উপলব্ধ হইবে । কিন্তু যে ক্রম অনুসারে আমি এই গ্রন্থে এই অর্থ বিবৃত করিয়াছি তাহা হইতে গীতা গ্রন্থের ক্রম ভিন্ন হওয়ায়, ভগবদ্‌গীতায় ইহার কিরূপ বিন্যাস করা হইয়াছে, এখানে তাহারও একটু আলোচনা করা আবশ্যক । কোনও বিষয়ের নিরূপণ দুই পদ্ধতি অনুসারে করা যাইতে পারে; এক শাস্ত্রীয়, আর-এক পৌরাণিক; তন্মধ্যে সমস্ত লোকের সহজবোধ্য বিষয় হইতে প্ৰতিপাদ্য বিষয়ের মূলতত্ত্ব কিরূপে নিষ্পন্ন হয় তর্কশাস্ত্রানুসারে সাধক-বাধক প্ৰমাণ যথাক্রমে উপস্থিত করিয়া তাহা দেখানো হইল শাস্ত্রীয় পদ্ধতিভূমিতিশাস্ত্র এই পদ্ধতির একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ; ন্যায়সূত্র কিংবা বেদান্তসূত্ৰ - ইহাদের উপপাদনও এই বর্গের মধ্যে আসে । তাই ভগবদ্‌গীতায় ব্ৰহ্মসূত্রের বা বেদান্তসূত্রের যেখানে উল্লেখ আছে সেখানে উহার বিষয়টি হেতু যুক্ত ও নিশ্চয়াত্মক প্রমাণের দ্বারা সিদ্ধ হইয়াছে এইরূপ বর্ণনাও দেখিতে পাওয়া যায় – “ব্রহ্মসূত্ৰপদৈশ্চৈব হেতুমদ্ভিৰ্বিনিশ্চিতৈঃ” [গী|১৩|৪]কিন্তু ভগবদ্‌গীতার নিরূপণ সশাস্ত্ৰ হইলেও উহা এই শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে করা হয় নাই । ভগবদ্‌গীতার বিষয় শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনরূপে সহজ ও মনোরঞ্জক রীতিতে বর্ণিত হইয়াছে । সেইজন্য প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে “ভগবদ্‌গীতাসূপনিষৎসু ব্ৰহ্মবিদ্যায়াং ষোগশাস্ত্ৰে” এইরূপ উল্লেখ করিয়া তাহার পর “শ্ৰীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে” এইরূপ গীতানিরূপণের স্বরূপ দ্যোতক শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে । এই নিরূপণ ও শাস্ত্রীয় নিরূপণের প্রভেদ স্পষ্টরূপে দেখাইবার জন্য আমি সম্বাদাত্মক নিরূপণকেই ‘পৌরাণিক’ নাম দিয়াছি । সাত শত শ্লোকের এই সম্বাদাত্মক বা পৌরাণিক নিরূপণে “ধর্ম” এই ব্যাপক শব্দের মধ্যে যে সকল বিষয়ের সমাবেশ হয়, তাহাদের সকলগুলির সবিস্তর বিচার আলোচনা করা কখনই সম্ভব নহে । কিন্তু (যত সংক্ষেপেই হউক না কেন) গীতায় অনেক বিষয় যাহা পাওয়া যায়, তাহাদেরই সংগ্ৰহ অবিরোধে কেমন করিয়া হইল ইহাই আশ্চৰ্য ! ইহা দ্বারাই গীতাকারের অলৌকিক শক্তি ব্যক্ত হইতেছে; এবং অনুগীতার আরম্ভে যে বলা হইয়াছে যে, গীতার উপদেশ “অত্যন্ত যোগযুক্ত চিত্তে কথিত হইয়াছে” তাহারও সত্যতায় বিশ্বাস হয় । 


2) সম্বাদাত্মক পদ্ধতির গুণ-দোষ


অর্জুন যাহা পূর্বেই অবগত ছিলেন তাহা পুনর্বার সবিস্তর বলিবার কোন প্রয়োজন ছিল না । আমি যুদ্ধের নিষ্ঠুর কর্ম করিব কি না, এবং করিলেও কিরূপে করিব ইহাই তাঁহার মুখ্য প্রশ্ন ছিল । শ্ৰীকৃষ্ণ নিজের উত্তরে দুএকটি যুক্তি দেখাইতে থাকিলে, অর্জুন সেই সম্বন্ধে কোন-না-কোন আপত্তি উত্থাপন করিতেছিলেন । এই প্রকার প্রশ্নোত্তররূপ সংবাদে গীতার বিচার-আলোচনা স্বভাবতই কখন ভাঙ্গাভর্তি কিংবা সংক্ষিপ্ত আর কখন বা পুনরুক্ত হইয়াছে । উদাহরণ যথা, - ত্রিগুণাত্মক প্ৰকৃতির বিস্তারের বর্ণনা স্বল্পভেদে দুইস্থানে [গী|অ|৭ ও ১৪] করা হইয়াছে; আবার স্থিতপ্রজ্ঞভগবদ্‌ভক্ত, ত্ৰিগুণাতীতব্ৰহ্মভূত - ইহাদের অবস্থার বর্ণনা এক হইলেও, বিভিন্ন দৃষ্টিতে প্ৰত্যেক প্রসঙ্গে অনেকবার করা হইয়াছে । উল্টাপক্ষে, ‘অর্থ ও কাম যদি ধর্মকে না ছাড়ে তবেই তাহা গ্ৰাহ্য হয়’, এই তত্ত্বের - “ধর্মাবিরুদ্ধঃ কামোহস্মি” [৭|১১] এই একটি বচনেই গীতা ইঙ্গিত করিয়াছেন । ইহার পরিণাম এই হয় যে, গীতার মধ্যে সমস্ত বিষয় সমাবেশ করা হইলেও শ্ৰৌতধর্ম, স্মার্তধর্ম, ভাগবতধর্ম, সাংখ্যশাস্ত্র, পূর্বমীমাংসা, বেদান্ত, কর্মবিপাক, ইত্যাদির যে সকল প্রাচীন সিদ্ধান্তসমূহের আধারের উপর গীতার জ্ঞানের নিরূপণ করা হইয়াছে, তাহাদের পরম্পরা যে ব্যক্তি অবগত নহে, গীতা পাঠ করিবার সময় তাহার মন ঘুলাইয়া যায় । এবং গীতার প্রতিপাদনের রীতি ঠিক্‌ ঠিক্‌ উপলব্ধি করিতে না পারায় এই লোকদিগের এইরূপ ধারণা হইয়া থাকে যে, গীতা একপ্রকার ভেল্কীবাজি, অথবা শাস্ত্রীয় পদ্ধতি প্ৰচলিত হইবার পূর্বে গীতা রচিত হইয়া থাকিবে, সেইজন্য গীতার স্থানে স্থানে অপূর্ণতা ও বিরোধ দেখিতে পাওয়া যায়, কিংবা নিদানপক্ষে গীতোক্ত জ্ঞানই আমাদের বুদ্ধির অগম্য । সংশয়নিবৃত্তির জন্য টীকা দেখিলেও বিশেষ লাভ হয় না; কারণ, তাহা অনেক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মতে রচিত হওয়ায়, টীকাকারদিগের মতসম্বন্ধীয় পরস্পর-বিরোধের সমন্বয় করা দুর্ঘট হয় এবং পাঠকদের মন অধিকাধিক বিভ্ৰান্ত হইয়া পড়ে । কোন কোন সুপ্রবুদ্ধ পাঠকও এইরূপ ভ্ৰান্তিতে পতিত হইয়াছেন আমি জানি । এই বাধা যাহাতে না থাকে সেইজন্য আমার নিজের ধারণা অনুসারে গীতার প্রতিপাদ্য বিষয়সমূহের শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে বিন্যাস করিয়া এ পর্যন্ত বিচার করিয়া আসিয়াছি । এখন এস্থলে আর একটু এই বলিতে চাহি যে, এই বিষয়ই শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুনের কথোপকথনে অর্জুনের প্রশ্ন কিংবা সংশয়ের প্রসঙ্গক্রমে ন্যূনাধি্ক পরিমাণে কি প্রকারে আসিয়া পড়িয়াছে তাহা বলিলে এই বিচার আলোচনা পূর্ণতা প্ৰাপ্ত হইবে এবং পরবর্তী প্রকরণে সমস্ত বিষয়ের উপসংহার করা সহজ হইবে ।


3) গীতার প্রারম্ভ


আমাদের ভারতবর্ষ যখন জ্ঞান, বৈভব, যশ ও পূর্ণস্বরাজ্যের সুখসম্ভোগ করিতেছিল, তখন এক সর্বজ্ঞ, মহাপরাক্রমী যশস্বী ও পরমপূজ্য ক্ষত্ৰিয় আর একজন মহাধনুর্ধর ক্ষত্রিয়কে ক্ষাত্ৰধর্মানুযায়ী স্বকর্তব্যে প্ৰবৃত্ত করাইবার জন্য গীতার উপদেশ করিয়াছিলেন, ইহার প্রতি পাঠকের প্রথমে লক্ষ্য করা আবশ্যক । জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্ৰবর্তক মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ, এই দুইজনও ক্ষত্ৰিয় ছিলেন । তথাপি ইহাঁরা উভয়েই বৈদিক ধর্মের কেবল সন্ন্যাসমাৰ্গকে স্বীকার করিয়া ক্ষত্ৰিয়াদি সমস্ত বর্ণের জন্য - সন্ন্যাসধর্মের দ্বার উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছিলেন । শ্ৰীকৃষ্ণ সেরূপ করেন নাই; কারণ, ভাগবতধর্মের উপদেশ এই যে, শুধু ক্ষত্ৰিয় কেন, ব্ৰাহ্মণদিগকেও নিবৃত্তিমার্গের শান্তির সঙ্গেসঙ্গেই নিষ্কামবুদ্ধিতে আমরণ সমস্ত কর্ম করিবার প্রযত্ন করিতে হইবে । যে কোন উপদেশই হউক না কেন, তাহার কোন-না-কোন কারণ অবশ্যই থাকে; এবং সেই উপদেশের সফলতা চাহিলে, শিষ্যের মনে উক্ত উপদেশের জ্ঞান অর্জন করিবার ইচ্ছাও প্ৰথম হইতেই জাগ্ৰত থাকা আবশ্যক । 


4) গীতার প্রথমাধ্যায়


তাই, এই দুই বিষয় স্পষ্ট করিবার জন্যই ব্যাসদেব গীতার প্ৰথম অধ্যায়ে শ্ৰীকৃষ্ণের অর্জুনকে এই উপদেশ দিবার কি কারণ হইয়াছিল, তাহা সবিস্তার বর্ণনা করিয়াছেন । কৌরব ও পাণ্ডবদিগের সৈন্য যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হইয়া কুরুক্ষেত্ৰে দণ্ডায়মান; এক্ষণে যুদ্ধ আরম্ভ হইবার অল্পই বিলম্ব আছে; ইতিমধ্যে অর্জুনের কথা অনুসারে শ্ৰীকৃষ্ণ তাঁহার রথ উভয় সৈন্যের মাঝখানে লইয়া গিয়া দাঁড় করাইলেন এবং অর্জুনকে বলিলেন, “যাঁহাদের সহিত তোমার যুদ্ধ করিতে হইবে সেই ভীষ্ম-দ্ৰোণাদিকে দেখ” । তখন অর্জুন উভয় সৈন্যের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া দেখিতে পাইলেন যে, আপনারই বাপ, কাকা, পিতামহ, মাতামহ, মামা, ভাই, পুত্র, পৌত্র, বন্ধু, আত্মীয়, গুরু, গুরুভাই প্ৰভৃতি দুইদিকে ভরিয়া আছে, এবং এই যুদ্ধে সকলেই বিনাশ প্ৰাপ্ত হইবে । যুদ্ধ করা পূর্ব হইতেই স্থির হইয়া গিয়াছিল এবং উভয় পক্ষেরই সৈন্যসংগ্ৰহ অনেক দিন হইতেই চলিতেছিল । তথাপি পরস্পরের মধ্যে এই যুদ্ধের ফলে কুলক্ষয়ের প্রত্যক্ষ স্বরূপ যখন সর্বপ্ৰথম অর্জুনের দৃষ্টিতে উপস্থিত হইল, তখন তাঁহার ন্যায় মহাযোদ্ধারও মনে বিষাদ আসিল এবং তাঁহার মুখ হইতে এই কথা বাহির হইল “রাজ্যলাভের জন্য এই ভয়ঙ্কর কুলক্ষয় আমরা করিতে বসিয়াছি; ইহা অপেক্ষা ভিক্ষা করাও কি শ্রেয়স্কর নহে ?” এবং পরে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে বলিলেন যে “শত্রুরা আমার প্রাণবধ করিলেও আমার কিছুই আসে যায় না, কিন্তু ত্ৰৈলোক্যের রাজ্যের জন্যও পিতৃহত্যা গুরুহত্যা ভ্ৰাতৃহত্যা বা কুলক্ষয়ের ন্যায় মহাপাপ করিতে আমি ইচ্ছা করি না ।” অর্জুনের সর্বাঙ্গ কাঁপিতে লাগিল, হাত-পা শিথিল হইয়া গেল, মুখ শুকাইয়া গেল, এবং বিষন্ন বদনে হস্ত হইতে ধনুর্বাণ নিঃক্ষেপ করিয়া বেচারা রথে চুপচাপ বসিয়া পড়িলেন - এই কথা প্ৰথম অধ্যায়ে আছে । এই অধ্যায়কে “অর্জুনবিষাদ-যোগ” বলে । কারণ, সমস্ত গীতায় ব্রহ্মবিদ্যান্তৰ্গত (কর্ম-)যোগশাস্ত্ৰ নামক একই বিষয় প্ৰতিপাদ্য হইলেও, প্ৰত্যেক অধ্যায়ে যে বিষয় মুখ্যরূপে বিবৃত হইয়াছে তাহাকে এই কর্মযোগশাস্ত্রেরই এক অংশ মনে করিয়াই প্ৰত্যেক অধ্যায়কে তাহার বিষয়ানুসারে বিষাদযোগ, সাংখ্যযোগ ইত্যাদি বিভিন্ন নাম দেওয়া হইয়াছে । এই সমস্ত ‘যোগ’ একত্র হইলে পর তাহাই “ব্রহ্মবিদ্যার অন্তৰ্গত কর্মযোগশাস্ত্ৰ” হইয়া দাঁড়ায় । প্ৰথম অধ্যায়ের অন্তৰ্গত কথার মহত্ত্ব কি, তাহা আমি এই গ্রন্থের আরম্ভে বলিয়াছি । কারণ, আমার সম্মুখে কি প্রশ্ন উপস্থিত তাহা ঠিক না জানিলে সেই প্রশ্নের উত্তরও সম্যক্‌রূপে আমার মনে আসে না । “সাংসারিক কর্ম হইতে নিবৃত্ত হইয়া ভগবদ্‌ভজনেই প্ৰবৃত্ত হওয়া কিংবা সন্ন্যাস গ্ৰহণ করা”, - ইহাই যদি গীতার তাৎপৰ্য বলিতে হয়, তাহা হইলে অর্জুন যুদ্ধের নিষ্ঠুর কর্ম ত্যাগ করিয়া ভিক্ষা মাগিতে তখনই প্ৰস্তুত থাকায় তাহাকে এই উপদেশ দিবার কোন আবশ্যকতা ছিল না । প্ৰথম অধ্যায়েরই শেষে “বাঃ ! বড় উত্তম কথা বলিয়াছ; তোমার এই উপরতি দেখিয়া আমার অত্যন্ত আনন্দ হইতেছে ! চল, আমরা দুজনেই এই কর্মময় সংসার ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসাশ্রম কিংবা ভক্তিযোগ অবলম্বন করিয়া আমাদের আত্মার কল্যাণ সাধন করি !” এইরূপ অর্থের দুই একটা শ্লোক শ্ৰীকৃষ্ণের মুখে পুরিয়া দিয়া সেইখানেই গীতা সমাপ্ত করা উচিত ছিল । আবার এদিকে যুদ্ধ হইয়া গেলে ব্যাস তাহার বর্ণনায় তিন বৎসর কাল [মভা|আ|৬২|৫২] যদি আপন বাণীর দুর্ব্যবহার করিতেন তাহা হইলে তাহার দোষ বেচারী অর্জুন ও শ্ৰীকৃষ্ণকে স্পর্শ করিত না । তাহা হইলে কুরুক্ষেত্রে সমবেত শত শত মহারথী অর্জুনকে ও শ্ৰীকৃষ্ণকে উপহাস করিতেন সত্য, কিন্তু যে আপনার আত্মার কল্যাণ সাধন করিবে সে এইরূপ উপহাসকে অল্পই ভয় করিবে । জগতের লোক যাহাই বলুক না; “যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্ৰব্ৰজেৎ” [জা|৪] - যখনই উপরতি হইবে, তখনই সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে, বিলম্ব করিবে না - উপনিষদে তো ইহাই উক্ত হইয়াছে । অর্জুনের উপরতি জ্ঞানমূলক ছিল না মোহমূলক ছিল, এইরূপ বলিলেও উপরতিই তো হইয়াছিল; তাহা হইলেই অর্ধেক কাজ হইল, এখন মোহকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া সেই উপরতিকেই পূর্ণ জ্ঞানমূলক করা ভগবানের পক্ষে কিছুমাত্র অসাধ্য ছিল না । কোন কারণে সংসারের উপর বিতৃষ্ণা জন্মিলে সেই বিতৃষ্ণার দরুণ প্ৰথমে সংসার ত্যাগ করিয়া পরে পূর্ণ সিদ্ধি লাভ করিবার অনেক উদাহরণ ভক্তিমার্গে বা সন্ন্যাসমার্গেও আছে । অর্জুনেরও এই প্রকার দশা হইত । সন্ন্যাস গ্রহণের সময় বস্ত্ৰ গেরুয়া করিবার জন্য এক মুঠ গেরুয়া মাটি কিংবা ভক্তিপূর্বক ভগবানের নাম সংকীর্তন করিবার জন্য তাল মৃদঙ্গাদি সরঞ্জামও সমস্ত কুরুক্ষেত্রে না মিলিত এমন নহে ।


5) গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়


কিন্তু সেরূপ কিছুই না করিয়া বরং দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভেই শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলিতেছেন — “অর্জুন, তোমার এই দুর্বুদ্ধি কি করিয়া আসিল ? এই ক্লৈব্য তোমার শোভা পায় না ! ইহা তোমার কীর্তিনাশ করিবে ! অতএব এই দৌর্বল্য ত্যাগ করিয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও !” তথাপি অর্জুন কাপুরুষের ন্যায় পুনর্বার প্রথমেই কান্নার সুর ধরিয়া অত্যন্ত দীনভাবে বলিলেন - “আমি ভীষ্ম-দ্রোণাদি মহাত্মাদিগকে কি করিয়া বধ করিব ? মরা ভাল কি মারা ভাল, এই সংশয়ে আমার মন বিভ্ৰান্ত হইতেছে; অতএব ইহাদের মধ্যে কোন ধর্ম শ্ৰেয়স্কর তাহা আমাকে বল; আমি তোমার শরণাপন্ন হইতেছি” । শ্ৰীকৃষ্ণ দেখিলেন, অর্জুন মায়ার বশীভূত হইয়াছেন এবং একটু হাসিয়া “অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং” ইত্যাদি জ্ঞানের কথা ভগবান তাঁহার নিকট বলিতে আরম্ভ করিলেন । অর্জুন জ্ঞানী পুরুষের ন্যায় ভড়ং দেখাইতে গিয়াছিলেন এবং কর্মসন্ন্যাসের কথাও পাড়িয়াছিলেন । তাই, জগতে ‘কর্মত্যাগ’ ও ‘কর্মসাধন’ - জ্ঞানীপুরুষদিগের এই যে দুই আচরণ-পন্থা অর্থাৎ নিষ্ঠা দেখিতে পাওয়া যায়, - তাহা হইতেই ভগবান নিজের উপদেশ শুরু করিলেন; এবং এই দুই নিষ্ঠার মধ্যে কোন একটী নিষ্ঠা গ্ৰহণ করিলেও তুমি ভুল করিতেছ ইহাই অর্জুনের প্রতি ভগবানের প্ৰথম উক্তি । তাহার পর, যে জ্ঞাননিষ্ঠা বা সাংখ্যনিষ্ঠার উপরে অর্জুন কর্মসন্ন্যাসের কথা বলিতেছিলেন সেই সাংখ্যনিষ্ঠার ভিত্তির উপরেই শ্ৰীকৃষ্ণ প্রথমে “এষা তেহভিহিতা বুদ্ধিঃ” [গী|২|১১-৩৯] পৰ্যন্ত উপদেশ করিলেন; এবং আবার অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত, কর্মযোগমার্গ অবলম্বন করিয়া যুদ্ধই তোমার প্রকৃত কর্তব্য এইরূপ অর্জুনকে বলিয়াছেন । “এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে” এইরূপ শ্লোক “অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং” এই শ্লোকের পূর্বে যদি আসিত তাহা হইলে এই অর্থই অধিকতর ব্যক্ত হইত । কিন্তু সম্ভাষণের প্রসঙ্গক্রমে সাংখ্যমার্গের প্ৰতিপাদন হইলে পর উহা এইরূপে আসিয়াছে – “ইহা তো সাংখ্যমাৰ্গ অনুসারে প্ৰতিপাদিত হইল; এক্ষণে যোগমার্গ অনুসারে প্রতিপাদন করিতেছি ।” যাহাই হউক না কেন, কিন্তু অর্থ একই । সাংখ্য (বা সন্ন্যাস) এবং যোগ (বা কর্মযোগ) ইহাদের মধ্যে যে প্ৰভেদ তাহা ১১শ প্রকরণে প্ৰথমেই আমি স্পষ্টরূপে দেখাইয়াছি । অতএব তাহার পুনরুক্তি না করিয়া ইহাই বলিতেছি যে, চিত্তশুদ্ধির জন্য স্বধর্মানুসারে বর্ণাশ্রমবিহিত কর্ম করিয়া জ্ঞানলাভ হইলে পর মোক্ষের জন্য শেষে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করাকেই “সাংখ্য” মাৰ্গ বলে; এবং কর্ম কদাপি ত্যাগ না করিয়া শেষ পৰ্যন্ত উহা নিষ্কামবুদ্ধিতে করিতে থাকাকেই যোগ কিংবা কর্মযোগ বলে ।

ভগবান অর্জুনকে প্ৰথমে এইরূপ বলিয়াছেন যে, সাংখ্যমার্গের অধ্যাত্মজ্ঞানানুসারে আত্মা অমর ও অবিনাশী হওয়ায় “ভীষ্মদ্ৰোণাদিকে আমি বধ করিব” তোমার এই ধারণাটাই মিথ্যা; কারণ, আত্মা মরেও না, মারেও না । মনুষ্য যেরূপ আপনার বস্ত্র বদলায় সেইরূপই আত্মা এক দেহ ছাড়িয়া দেহান্তরে যায় এইমাত্র; কিন্তু সেইজন্য সে মরিয়াছে মনে করিয়া শোক করা উচিত নহে । ভাল; “আমি বধ করিব” এই ভ্ৰম স্বীকার করিলেও যুদ্ধই কেন করিব এইরূপ যদি বল, তাহার উত্তর এই যে, শাস্ত্ৰত প্ৰাপ্ত যুদ্ধ হইতে পরাবৃত্ত না হওয়াই ক্ষাত্ৰধর্ম; এবং যখন এই সাংখ্যমার্গে প্রথমতঃ বৰ্ণাশ্রমবিহিত কর্ম করাই শ্ৰেয়স্কর বলিয়া বিবেচিত হয়, তখন তুমি যদি তাহা না কর তাহা হইলে লোকে তোমার নিন্দা করিবে; অধিক কি, যুদ্ধে মরাই ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম । অতএব কেন বৃথা শোক করিতেছ ? ‘আমি মারিব’, ‘সে মরিবে’ এই নিছক কর্মদৃষ্টি ছাড়িয়া দিয়া, আমি কেবল আপনার স্বধর্ম করিতেছি এই বুদ্ধিতে তুমি আপন প্রবাহপতিত কাৰ্য কর, তাহা হইলে কোন পাপই তোমাকে স্পর্শ করিবে না । সাংখ্যমাৰ্গানুসারে এই উপদেশ হইল । কিন্তু চিত্তশুদ্ধির জন্য প্রথমতঃ কর্ম করিয়া চিত্তশুদ্ধি হইলে পর শেষে সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করাই যদি এই মার্গ অনুসারে শ্রেষ্ঠ বিবেচিত হয়, তবে এই সংশয় থাকিয়া যায় যে, উপরতি হইবার সঙ্গে সঙ্গেই, যুদ্ধ ছাড়িয়া (সম্ভব হইলে) তখনই সন্ন্যাস গ্ৰহণ করা কি ভাল নয় ? পুরাপুরি গৃহস্থাশ্ৰম করিয়া তাহার পর বার্ধক্যে সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে; যৌবনে গৃহস্থাশ্রমই করিতে হইবে এইরূপ মন্বাদি স্মৃতিকারদিগের আদেশ, এ কথা বলিলে চলিবে না । কারণ, যখনই হউক সন্ন্যাসগ্রহণই যদি শ্রেষ্ঠ হয়, তাহা হইলে যখনই সংসারে বিতৃষ্ণা হইবে তখনই বিলম্ব না করিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করাই উচিত; এবং এই কারণেই উপনিষদেও “ব্রহ্মচৰ্য্যাদেব প্ৰব্ৰজেৎ গৃহাদ্বা বনাদ্ধা” [জা|৪] এইরূপ বচন পাওয়া যায় । সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিলে যে গতি হয়, রণক্ষেত্রে মৃত্যু হইলে ক্ষত্ৰিয় সেই গতিই প্ৰাপ্ত হয় ।
দ্বাবিমৌ পুরুষব্যাঘ্র সূৰ্যমণ্ডলভেদিনৌ ৷
পরিব্রাড্‌যোগযুক্তশ্চ রণে চাভিমুখো হতঃ ॥
“হে পুরুষব্যাঘ্র ! সূৰ্যমণ্ডলকে ভেদ করিয়া ব্ৰহ্মলোকে দুইজন গমন করেন; এক যোগযুক্ত সন্ন্যাসী, আর এক, যে ব্যক্তি রণে অভিমুখ হইয়া মরে”, এইরূপ মহাভারতে [উদ্যো|৩২|৬৫] উক্ত হইয়াছে । কৌটিল্যের অর্থাৎ চাণক্যের অর্থশাস্ত্ৰেও এই অর্থের এক শ্লোক আছে -
যান্‌ যজ্ঞসংঘৈস্তুপসা চ বিপ্রাঃ স্বর্গৈষিণঃ পাত্ৰচয়ৈশ্চ যান্তি ৷
ক্ষণেন তানপ্যতিযান্তি শুরাঃ প্ৰাণান্‌ সুযুদ্ধেষু পরিত্যজন্তঃ ॥
“স্বৰ্গেচ্ছু, ব্ৰাহ্মণ অনেক যজ্ঞের দ্বারা, নানা সরঞ্জামের দ্বারা ও তপস্যার দ্বারা যে লোকে গমন করে, যে ব্যক্তি যুদ্ধে প্ৰাণ দেয় সে তৎক্ষণাৎ সেই লোককেও ছাড়াইয়া যায়”; - অর্থাৎ শুধু তপস্বী বা সন্ন্যাসী এবং নানা যাগযজ্ঞদীক্ষিতেরাও যে গতি প্ৰাপ্ত হয়, রণক্ষেত্রে নিহত ক্ষত্ৰিয়ও সেই গতিই লাভ করে, [কৌটি|১০|৩|১৫০-১৫২ এবং নভা|শাং|৯৮-১০০ দেখ] । যুদ্ধরূপ স্বর্গের দ্বার ক্ষত্ৰিয়ের নিকট ক্কচিৎ উদ্‌ঘাটিত হয়; যুদ্ধে মরিলে স্বৰ্গ ও জয়লাভ করিলে পৃথিবীর রাজ্য পাওয়া যায়” [২|৩২,৩৭] গীতার এই উপদেশের তাৎপৰ্যও ইহাই । অতএব, ইহাও সাংখ্যমাৰ্গ অনুসারে প্রতিপাদন করা যাইতে পারে যে, সন্ন্যাস গ্ৰহণ কর কিংবা যুদ্ধ কর, ফল একই । কিন্তু ‘যাই বল না কেন, যুদ্ধ করিতেই হইবে’ এইরূপ নিশ্চিতাৰ্থ এই মার্গের যুক্তিবাদের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় না । সাংখ্যমার্গের এই বাধার প্রতি লক্ষ্য করিয়া পরে ভগবান্‌ কর্মযোগমার্গের প্রতিপাদন করিতে আরম্ভ করিলেন; এবং গীতার শেষ অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত এই কর্মযোগেরই - অর্থাৎ কর্ম করিতেই হইবে এবং তাহা মোক্ষের অন্তরায় না হইয়া বরং কর্ম করিলেই মোক্ষলাভ হয়, তাহার বিভিন্ন প্ৰমাণ দিয়া সংশয়নিবৃত্তিপূর্বক সমর্থন করিয়াছেন । কোনও কর্মই ভাল কি মন্দ ইহা স্থির করিবার জন্য সেই কর্মের বাহ্য পরিণাম অপেক্ষা কর্তার বাসনাত্মক বুদ্ধি শুদ্ধ কি অশুদ্ধ, ইহা প্ৰথমে দেখিতে হইবে, - ইহাই কর্মযোগতত্ত্বের প্রধান তত্ত্ব [গী|২|৪৯] । কিন্তু বাসনা শুদ্ধ কি অশুদ্ধ ইহা স্থির করাও শেষে ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধিরই কাজ হওয়ায়, নিৰ্বাচনকারী বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয়কে স্থির করিতে না পারিলে বাসনাও শুদ্ধ ও সম হয় না । এই জন্য সেই সঙ্গেই ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, বাসনাত্মক বুদ্ধিকে শুদ্ধ করিতে হইলে, সমাধির দ্বারা প্ৰথমে ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধি-ইন্দ্ৰিয়কেও স্থির করা আবশ্যক, [গী|২|৪১] । জগতের সাধারণ ব্যবহার দেখিলে প্ৰতীত হয় যে, অনেক লোক স্বৰ্গাদি বিভিন্ন কাম্য সুখ লাভ করিবার জন্যই যাগযজ্ঞাদি বৈদিক কাম্য কর্মের বৃথা উদ্যোগে প্ৰবৃত্ত হয়, এবং সেই জন্য তাহাদের বুদ্ধি - আজ এই ফল প্ৰাপ্তি হইবে, কাল আবার আর এক ফল পাওয়া যাইবে - এইরূপ চিন্তাতেই অর্থাৎ স্বার্থেতেই নিমগ্ন এবং সর্বদাই পরিবর্তনশীল ও চঞ্চল হইয়া থাকে । এই সব লোকেরা স্বৰ্গসুখাদি অনিত্য ফল অপেক্ষা বড় অর্থাৎ মোক্ষরূপ নিত্য সুখ কখনও লাভ করিতে পারে না । তাই, কর্মযোগমার্গের রহস্য অর্জুনকে এই বলা হইয়াছে যে, বৈদিক কর্মের কাম্য উদ্যোগ ছাড়িয়া নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিতে শিখ; কর্ম করিবার অধিকার তোমার আছে; কর্মের ফল পাওয়া কি না পাওয়ার - ইহা কখনই তোমার আয়ত্তাধীন নহে [২|৪৭]; ফলদাতা পরমেশ্বর, ইহা মনে করিয়া, কর্মের ফল পাওয়া যাক্‌ বা নাই যাক্‌ দুই সমান, এইরূপ সমবুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়াই যাহারা কর্ম করে তাহাদের পাপপুণ্য কর্তাকে স্পর্শ করে না; অতএব এই সমবুদ্ধিকেই তুমি আশ্ৰয় কর; এই সমবুদ্ধিকেই অর্থাৎ পাপস্পর্শ না লাগে এইরূপ কর্মের যুক্তি বা কৌশলকেই যোগ বলে; এই যোগ সাধন করিলে, কর্ম করিলেও তোমার মোক্ষ লাভ হইবে; মোক্ষের জন্য কর্মসন্ন্যাসই করিতে হইবে এরূপ নহে [২|৪৭-৫৩] । ভগবান যখন অর্জুনকে বলিলেন যে, যে ব্যক্তির বুদ্ধি এইরূপ সম হইয়াছে তাহাকে স্থিতপ্ৰজ্ঞ বলা যায় [২|৫৩], তখন অর্জুন প্রশ্ন করিলেন যে, “স্থিতপ্রজ্ঞের আচরণ কিরূপ হইবে তাহা আমাকে বল” । তাই, দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা করা হইয়াছে এবং শেষে স্থিতপ্রজ্ঞের অবস্থাকেই ব্ৰাহ্মী স্থিতি বলে এইরূপ বলা হইয়াছে । সারকথা, অর্জুনকে যুদ্ধে  প্রবৃত্ত করিবার জন্য গীতায় যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা এই জগতে জ্ঞানীপুরুষের গ্রাহ্য “কর্মত্যাগ” (সাংখ্য) ও “কর্মসাধন” (যোগ) এই দুই নিষ্ঠা হইতেই আরম্ভ করা হইয়াছেঃ; এবং যুদ্ধ কেন করিতে হইবে তাহার উপপত্তি প্ৰথমে সাংখ্যনিষ্ঠা অনুসারে কথিত হইয়াছে । কিন্তু এই উপপত্তি অসম্পূৰ্ণ হয় দেখিয়া, পরে তখনই যোগ কিংবা কর্মযোগমার্গানুসারে জ্ঞানের কথা বলিতে আরম্ভ করা হইয়াছে; এবং এই কর্মযোগের স্বল্পাচরণও কিরূপ শ্ৰেয়স্কর ইহা বলিয়া তাহার পর, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ভগবান স্বীয় উপদেশকে এই পৰ্যন্ত লইয়া চলিলেন যে, কর্মযোগমার্গে কর্মাপেক্ষা কর্মের প্রেরক বুদ্ধিকেই যখন শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানা হয়, তখন স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় তুমি নিজ বুদ্ধিকে সম করিয়া কর্ম কর, তাহা হইলে কোন পাপই তোমাকে স্পর্শ করিবে না । এক্ষণে দেখা যাক্‌ যে, পরে আরও কি কি প্রশ্ন বাহির হয় । দ্বিতীয় অধ্যায়েই গীতার সমস্ত উপপাদনের মূল থাকায় তৎসম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি ।


6) গীতার তৃতীয় অধ্যায়


তৃতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন প্রশ্ন করিয়াছেন যে, “কর্মযোগমার্গেও কর্মাপেক্ষা বুদ্ধিই যদি শ্রেষ্ঠ হয় তবে আমি এক্ষণে আমার বুদ্ধিকে স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় সম করিলেই হইল; আমাকে যুদ্ধের ন্যায় নিষ্ঠুর কর্ম করিতে কেন তবে বলিতেছ ?” ইহার কারণ এই যে, কর্মাপেক্ষা বুদ্ধিকে শ্রেষ্ঠ বলিলেই, “যুদ্ধ কেন করিবে ? বুদ্ধিকে সম রাখিয়া উদাসীন হইয়া কেন বসিয়া থাকিবে না,’’ এই প্রশ্নের নির্ণয় হয় না । বুদ্ধিকে সম রাখিয়াও কর্মসন্ন্যাস করিতে পারা যায় না এরূপ নহে । তারপর, সমবুদ্ধি পুরুষের সাংখ্যমাৰ্গানুসারে কর্ম ত্যাগ করিতে বাধা কি ? এই প্রশ্নের উত্তর ভগবান এইরূপ দিতেছেন যে, পুর্বে তোমাকে সাংখ্য ও যোগ এই দুই নিষ্ঠার কথা বলিয়াছি সত্য; কিন্তু ইহাও মনে রেখো যে, কোন মনুষ্যের পক্ষে কর্ম একেবারে ত্যাগ করা অসম্ভব । যে পৰ্যন্ত মনুষ্য দেহধারী হইয়া আছে সে পৰ্যন্ত প্ৰকৃতি স্বভাবতই তাহাকে কর্ম করিতে প্ৰবৃত্ত করিবেই; এবং প্রকৃতি যখন এই কর্ম ছাড়িতেই পারে না, তখন ইন্দ্ৰিয়সংযমের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির ও সম করিয়া কেবল কর্মেন্দ্রিয়ের দ্বারাই আপন কর্তব্য কর্ম করিতে থাকা অধিক শ্ৰেয়স্কর । এইজন্য তুমি কর্ম কর; কর্ম না করিলে তোমার খাওয়া পৰ্যন্ত চলিবে না [৩|৩-৮] ৷ পরমেশ্বরই কর্মের সৃষ্টি করিয়াছেন; মনুষ্য নহে । ব্ৰহ্মদেব যখন জগৎ ও প্ৰজা সৃষ্টি করিলেন সেই সময়েই তিনি ‘যজ্ঞে’রও সৃষ্টি করিয়াছিলেন এবং তিনি প্ৰজাদিগকে বলিয়াছিলেন যে, যজ্ঞের দ্বারা তুমি আপনার সমৃদ্ধি করিয়া লও । এই যজ্ঞ যখন কর্ম ব্যতীত সিদ্ধ হয় না, তখন যজ্ঞ অর্থে কর্মই বলিতে হয় । অতএব, মনুষ্য ও কর্ম দুই-ই এক সঙ্গে উৎপন্ন হইয়াছে, এইরূপ বলিতে হয় । কিন্তু এই কর্ম কেবল যজ্ঞেরই জন্য এবং যজ্ঞ করা মনুষ্যের কর্তব্য, এই কারণে এই কর্মের ফলে মনুষ্যের বন্ধন হয় না । এখন ইহা সত্য যে, যে ব্যক্তি পুর্ণ জ্ঞানী হইয়াছেন তাঁহার নিজের কোন কর্তব্য অবশিষ্ট থাকে না; এবং লোকদিগের নিকটেও তিনি কোন বাধা পান না । কিন্তু ইহা দ্বারা সিদ্ধ হয় না যে, কর্ম করিবে না; কারণ, কর্ম হইতে কেহ নিষ্কৃতি পায় না বলিয়া ইহাই অনুমান করিতে হয় যে, স্বার্থের জন্য না করিলেও সেই কর্ম লোকসংগ্ৰহাৰ্থ নিষ্কামবুদ্ধিতে করা আবশ্যক [গী|৩|১৭-১৯] । এই কথার প্রতি লক্ষ্য করিয়াই জনকাদি জ্ঞানীপুরুষ পূর্বে কর্ম করিয়াছিলেন এবং আমিও করিতেছি । তাছাড়া ইহাও মনে রেখো যে, ‘লোকসংগ্রহ’ করা অর্থাৎ নিজের আচরণের দ্বারা লোকদিগকে ভাল দৃষ্টান্ত দেখাইয়া তাহাদিগকে উন্নতির পথে লইয়া যাওয়া জ্ঞানী পুরুষদিগের অন্যতর মুখ্য কর্তব্য । মনুষ্য যতই জ্ঞানবান হউন না কেন, প্ৰকৃতির ব্যবহার হইতে তাঁহার মুক্তি হয় না; অতএব কর্মত্যাগ করা ত দুরের কথা, কর্তব্য বলিয়া স্বধর্মানুসারে কর্ম করিতে থাকা এবং আবশ্যক হইলে যদি তাহাতে মৃত্যুও হয় তাহাও শ্রেয়স্কর [৩|৩০-৩৫]; তৃতীয় অধ্যায়ে ভগবান এই প্রকার উপদেশ করিয়াছেন । ভগবান এইরূপ প্ৰকৃতিকে সমস্ত কর্মের কর্তৃত্ব দিয়াছেন দেখিয়া মনুষ্যের ইচ্ছা না থাকিলেও মনুষ্য পাপ কেন করে, অর্জুন এইরূপ প্রশ্ন করিলেন; তখন ভগবান এইরূপ উত্তর দিয়া অধ্যায় সমাপ্ত করিয়াছেন যে, কামক্রোধাদি বিকার বলপূর্বক মনকে ভ্ৰষ্ট করে; অতএব ইন্দ্ৰিয়সংযম করিয়া প্রত্যেক মনুষ্যের আপন মনকে বশে রাখিতে হইবে । সারকথা, স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় বুদ্ধি সমতাপ্ৰাপ্ত হইলেও কর্ম কাহাকেও ছাড়ে না; অতএব স্বার্থের জন্য না হউক, অন্তত লোকসংগ্রহের জন্যও নিষ্কাম-বুদ্ধিতে কর্ম করিতেই হইবে - এইরূপে কর্মযোগের আবশ্যকতা সিদ্ধ করা হইয়াছে; এবং ভক্তিমার্গের “আমাতে সমস্ত কর্ম অৰ্পণ কর” [৩|৩০-৩১] এইরূপ পরমেশ্বরার্পণ পূর্বক কর্ম করিবার তত্ত্বেরও এই অধ্যায়ে প্রথম উল্লেখ হইয়াছে ।


7) গীতার চতুর্থ অধ্যায়


কিন্তু এই বিচার-আলোচনা তৃতীয় অধ্যায়ে সম্পূর্ণ না হওয়ায় চতুর্থ অধ্যায়ও তাহারই আলোচনার জন্য আরম্ভ করা হইয়াছে । এখন পৰ্যন্ত যাহা প্ৰতিপাদন করা হইয়াছে তাহা কেবল অর্জুনকে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিবার নিমিত্তই নূতন রচিত এইরূপ সন্দেহ যেন কাহারও মনে না হয়; এইজন্য চতুর্থ অধ্যায়ের আরম্ভে এই কর্মযোগের অর্থাৎ ভাগবত বা নারায়ণীয় ধর্মের ত্রেতাযুগবাহী পরম্পরা প্রদত্ত হইয়াছে । শ্ৰীকৃষ্ণ যখন অর্জুনকে বলিলেন যে, আদিতে কিংবা যুগারম্ভে আমিই এই কর্মযোগমার্গ বিবস্বানকে, বিবস্বান মনুকে এবং মনু ইক্ষ্বাকুকে বলিয়াছিলেন, কিন্তু মধ্যে ইহা নষ্ট হইয়া যাওয়ায় ঐ যোগই (কর্মযোগমাৰ্গ) আমি এক্ষণে তোমাকে পুনর্বার বলিলাম; তখন অর্জুন প্রশ্ন করিলেন যে, বিবস্বানের আগে তুমি কি করিয়া আসিবে ? সেই প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় ভগবান বলিলেন যে, সাধুদিগের সংরক্ষণ, দুষ্টদিগের নাশ এবং ধর্মের স্থাপনা করাই আমার অনেক অবতারের প্রয়োজন; এবং এইরূপ লোকসংগ্ৰহকারক কর্ম আমি করিলেও আমার তাহাতে আসক্তি না থাকায় তাহার পাপপুণ্যাদি ফল আমাকে স্পর্শ করে না । এই প্রকারে কর্মযোগের সমর্থন করিয়া, এবং এই তত্ত্ব জানিয়াই জনকাদিও পুর্বে কর্মাচরণ করিয়াছিলেন এই উদাহরণ দিয়া তুমিও সেইরূপই কর্ম কর, ভগবান অর্জুনকে পুনর্বার এইরূপ উপদেশ করিলেন । তৃতীয় অধ্যায়ে মীমাংসকদিগের এই যে সিদ্ধান্ত বলা হইয়াছে যে, “যজ্ঞের জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধন হয় না” তাহাই পুনৰ্বার বলিয়া ‘যজ্ঞের’ বিস্তৃত ও ব্যাপক ব্যাখ্যা এইভাবে করা হইয়াছে যে, কেবল তিল-তণ্ডুল দগ্ধ করা কিংবা পশু বধ করা একপ্রকার যজ্ঞ সত্য, কিন্তু এই দ্রব্যময় যজ্ঞ হাল্‌কা-রকমের এবং সংযমাগ্নিতে কামক্রোধাদি ইন্দ্ৰিয়বৃত্তিকে দগ্ধ করা কিংবা ‘ন মম’ বলিয়া, ব্ৰহ্মেতে সমস্ত কর্ম আহুতি দেওয়া উচ্চ পৈঠার যজ্ঞ । তাই সেই উচ্চদরের যজ্ঞের জন্য ফলাশা ছাড়িয়া কর্ম কর অর্জুনকে এক্ষণে এইরূপ উপদেশ করিলেন । মীমাংসকদিগের ন্যায়ানুসারে যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠিত কর্ম স্বতন্ত্ররূপে বন্ধন না হইলেও, যজ্ঞের কোন না কোন ফল পাইতেই হইবে । তাই, যজ্ঞও নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিলেও তাহার জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম এবং স্বয়ং যজ্ঞ এই দুইই বন্ধন হয় না । শেষে বলা হইয়াছে যে, সর্বভূত আপনাতে বা ভগবানে আছে এই জ্ঞান যে বুদ্ধি হইতে হয়, তাহারই নাম সাম্যবুদ্ধি । এবং এই জ্ঞান উৎপন্ন হইলেই সমস্ত কর্ম ভস্ম হইয়া তাহাদের কোন বাধা কর্তায় অর্শে না । “সৰ্ব্বং কর্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে” - জ্ঞানে সমস্ত কর্মের লয় হয়; কর্ম স্বয়ং বন্ধন হয় না, অজ্ঞান হইতেই বন্ধনের উৎপত্তি । এইজন্য অজ্ঞান ত্যাগ কর এবং কর্মযোগকে আশ্ৰয় করিয়া যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও, অর্জুনকে এইরূপ উপদেশ দেওয়া হইয়াছে । সারকথা, কর্মযোগমার্গের সিদ্ধির জন্যই সাম্যবুদ্ধিরূপ জ্ঞান আবশ্যক, এই অধ্যায়ে জ্ঞানের এই প্রকার প্রস্তাবনা করা হইয়াছে ।


8) গীতার পঞ্চম অধ্যায়


কর্মযোগের আবশ্যকতা কি অর্থাৎ কর্ম কেন করিতে হইবে, তাহার কারণসমূহের বিচার তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে করা হইয়াছে সত্য; কিন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ে সাংখ্যজ্ঞানের কথা বলিয়া কর্মযোগের বিচার-আলোচনাতেও কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধিই শ্ৰেষ্ঠ বারংবার বলা হইয়াছে, তাই এই দুই মার্গের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মার্গ কোনটি তাহা বলা এক্ষণে আবশ্যক । কারণ, দুই মার্গের যোগ্যতা সমান বলিলেও পরিণাম হইবে এই যে, যাহার যে মার্গ ভাল মনে হইবে সে তাহাই স্বীকার করিবে, কেবল কর্মযোগকে স্বীকার করিবার কোন কারণ থাকিবে না । অর্জুনের মনে এই সংশয় উৎপন্ন হওয়ায় পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন ভগবানকে এই প্রশ্ন করিলেন যে, “সাংখ্য ও যোগ এই দুই নিষ্ঠা সম্বন্ধে মিশ্ৰিতভাবে আমাকে না বলিয়া এই দুয়ের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ মাৰ্গ কোনটী তাহা নিশ্চয় করিয়া আমাকে যদি বল, তাহা হইলে সেই অনুসারে চলিবার সুবিধা হয়” । ইহার উত্তরে ভগবান স্পষ্টরূপে ইহা বলিয়া অর্জুনের সন্দেহ দূর করিলেন যে, দুই মাৰ্গই নিঃশ্রেয়স্কর অর্থাৎ সমান মোক্ষ প্ৰদ হইলেও, তন্মধ্যে কর্মযোগেরই মহত্ব অধিক - “কর্মযোগো বিশিষ্যতে” - [৫|২] । এই সিদ্ধান্তেরই দ্রঢ়ীকরণার্থ ভগবান্‌ আরও বলিলেন যে, সন্ন্যাস বা সাংখ্যনিষ্ঠার দ্বারা যে মোক্ষলাভ হয় তাহাই কর্মযোগের দ্বারাও লাভ হয়ই; শুধু তাহাই নহে; কর্মযোগে যে নিষ্কাম বুদ্ধির কথা বলা হইয়াছে তাহা প্রাপ্ত না হইলে সন্ন্যাস সিদ্ধ হয় না; এবং তাহা প্ৰাপ্ত হইলে পর, যোগমার্গে কর্ম করিলেও ব্রহ্মলাভ না হইয়া যায় না । ইহার পর, এ বিবাদে লাভ কি - যে, সাংখ্য ও যোগ ইহারা ভিন্ন ? চলা, বলা, দেখা, শোনা, আঘ্রাণ করা ইত্যাদি শত শত কর্ম ছাড়িব বলিলেও যদি তাহা ছাড়া না যায়, তবে কর্মত্যাগের সঙ্কল্প না করিয়া, তাহা ব্ৰহ্মাৰ্পণবুদ্ধিতে করাই বুদ্ধিমানের মাৰ্গ । তাই, তত্ত্বজ্ঞানী পুরুষ নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিতে থাকিয়া শেষে উহা দ্বারাই শান্তি ও মোক্ষ লাভ করেন । ঈশ্বর তোমাকে কর্ম কর এইরূপও বলেন না, আর কর্ম ত্যাগ কর এ কথাও বলেন না । এই সমস্ত প্রকৃতিরই খেলা; এবং বন্ধন মনের ধর্ম; এই কারণে সমবুদ্ধি কিংবা ‘সর্বভূতাত্মভুতাত্মা’ হইয়া যে ব্যক্তি কর্ম করে, সেই কর্ম তাহার বাধা হয় না । অধিক কি, এই অধ্যায়ের শেষে ইহাও বলা হইয়াছে যে, কুকুর, চণ্ডাল, ব্ৰাহ্মণ, গরু, হাতী-ইহাদের সম্বন্ধে যাহার বুদ্ধি সম হইয়াছে এবং যে সর্বভূতান্তৰ্গত আত্মৈক্য উপলব্ধি করিয়া আপনার ব্যবহার করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে, তাহার যেখানে বসিয়া আছে সেইখানেই ব্ৰহ্মনিৰ্বাণরূপ মোক্ষলাভ হয়, মোক্ষলাভের জন্য তাহাকে আর কোথাও যাইতে হয় না, অথবা সাধন করিতেও হয় না, সে মুক্ত হইয়াই আছে ।


9) গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়


ষষ্ঠ অধ্যায়ে এই বিষয়টি আরও আগাইয়া চলিয়াছে; এবং এই অধ্যায়ে কর্মযোগে সিদ্ধির জন্য আবশ্যক সমবুদ্ধিপ্ৰাপ্তির উপায় কথিত হইয়াছে । প্ৰথম শ্লোকেই, ভগবান আপনার মত স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন যে, যে ব্যক্তি কর্মফলের আশা না রাখিয়া কর্তব্য বলিয়া সংসায়ের প্রাপ্ত কর্ম করে সেই প্ৰকৃত যোগী ও প্রকৃত সন্ন্যাসী; অগ্নিহোত্ৰাদি কর্ম ছাড়িয়া যে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে সে প্ৰকৃত সন্ন্যাসী নহে । তাহার পর, ভগবান আত্মস্বাতন্ত্র্যের এই প্ৰকার বর্ণনা করিয়াছেন যে, কর্মযোগমার্গে বুদ্ধিকে স্থির করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহরূপ যে কর্ম করিতে হয়, তাহা সে আপনা হইতেই করিবে; তাহা না করিলে তাহার দোষ অন্যের উপর দেওয়া যাইতে পারে না । ইহার পরে, এই অধ্যায়ে ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহরূপ যোগ কিরূপে সাধন করিবে, পাতঞ্জল দৃষ্টিতে, মুখ্যরূপে তাহার বর্ণনা আছে । কিন্তু যম-নিয়ম-আসনপ্রাণায়ামাদি সাধনের দ্বারা ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিলেও তাহাতেই কাৰ্যনিৰ্বাহ হয় না; সেই কারণে আত্মৈক্যজ্ঞানেরও আবশ্যকতা এই অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে যে, পরে সেই ব্যক্তির বৃত্তি “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” কিংবা “যো মাং পশ্যতি সর্বত্ৰ সৰ্ব্বং চ ময়ি পশ্যতি” [৬|২৯,৩০] এই প্রকার সর্বভূতে সম হওয়া চাই । ইতিমধ্যে অর্জুনের এই সংশয় উপস্থিত হইল যে, এই সাম্যবুদ্ধিরূপ যোগ এক জন্মে সিদ্ধ না হইলে আবার অন্য জন্মেও আরম্ভ হইতেই অভ্যাস করিতে হইবে - এবং পুনর্বার সেই দশাই হইবে - এবং এই প্ৰকার যদি এই চক্ৰ ক্ৰমাগতই চলিতেই থাকে, তবে এই মার্গের দ্বারা মনুষ্য কখনই সদ্‌গতি লাভ করিতে পারিবে না । এই সংশয় দূর করিবার জন্য ভগবান প্ৰথমে বলিলেন যে, যোগমার্গে কিছুই ব্যর্থ যায় না, প্রথম জন্মের সংস্কার থাকিয়া যায় এবং তাহার সহায়তায় অন্য জন্মে অধিক অভ্যাস হইয়া থাকে এবং ক্রমে ক্ৰমে শেষ সিদ্ধি লাভ হয় । এইরূপ বলিয়া ভগবান এই অধ্যায়ের শেষে অর্জুনকে পুনরায় এই নিশ্চিত ও স্পষ্ট উপদেশ দিলেন যে, কর্মযোগমার্গই শ্রেষ্ঠ ও ক্রমশঃ সুসাধ্য হওয়ায়, কেবল (অর্থাৎ ফলাশা না ছাড়িয়া) কর্ম করা, তপশ্চৰ্য্যা করা এবং জ্ঞানের দ্বারা কর্ম-সন্ন্যাস করা - এই সমস্ত মাৰ্গ ত্যাগ করিয়া তুমি যোগী হও, অৰ্থাৎ নিষ্কাম কর্মযোগমার্গের আচরণ কর ।


10) কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, এই প্রকার গীতার তিন স্বতন্ত্র বিভাগ করা উচিত নহে


কাহারো কাহারো মত এই যে, এইস্থলে অর্থাৎ প্ৰথম ছয় অধ্যায়ে কর্মযোগের বিচার সম্পূর্ণ হইয়াছে; ইহার পর জ্ঞান ও ভক্তিকে ‘স্বতন্ত্ৰ’ নিষ্ঠা মানিয়া ভগবান উহার বর্ণনা করিয়াছেন - অর্থাৎ এই দুই নিষ্ঠা পরস্পর নিরপেক্ষ বা কর্মযোগেরই তু্ল্যমূল্য, কিন্তু উহা হইতে পৃথক এবং উহার পরিবর্তে বিকল্পস্বরূপে আচরণীয়; সপ্তম অধ্যায় হইতে দ্বাদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত ভক্তি এবং পরে শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞানের কথা বলিয়াছেন; এবং এই প্রকারে আঠারো অধ্যায়ের বিভাগ করিলে কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান ইহাদের মধ্যে প্ৰত্যেকের অংশে ছয় ছয় অধ্যায় হইয়া গীতার সমান ভাগ হয় । কিন্তু এই মত ঠিক্‌ নহে । পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভের শ্লোক হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, “সাংখ্যনিষ্ঠা অনুসারে যুদ্ধ ছাড়িয়া দিব কিংবা যুদ্ধের ঘোরতর পরিণাম চক্ষের সম্মুখে দেখিয়াও যুদ্ধই করিব, এবং যুদ্ধই করিতে হইলে তাহার পাপ কি করিয়া এড়াইব”, যখন অর্জুনের এই মুখ্য সংশয় উপস্থিত হইয়াছিল, তখন “জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় এবং তাহা কর্মের দ্বারাও প্রাপ্ত হওয়া যায়; এবং তোমার যদি ইচ্ছা হয়, তবে ভক্তি নামে এক তৃতীয় নিষ্ঠাও আছে” এইরূপ ‘ধরাছাড়া’ ও নিষ্ফল উত্তরে সেই সংশয়ের সমাধান হইতেই পারিত না । তাহা ছাড়া, অর্জুন যখন একমাত্ৰ নিশ্চয়াত্মক মার্গের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, তখন সর্বজ্ঞ ও চতুর শ্ৰীকৃষ্ণ আসল কথা ছাড়িয়া তাঁহাকে তিন স্বতন্ত্র ও বিকল্পাত্মক মাৰ্গ দেখাইলেন, এ কথাও অসঙ্গত । ইহাই সত্য যে, গীতায় ‘সন্ন্যাস’ ও ‘কর্মযোগ’ এই দুই নিষ্ঠারই বিচার আছে [গী|৫|১]; তন্মধ্যে ‘কর্মযোগ’ যে অধিক শ্রেয়স্কর তাহাও স্পষ্ট বলা হইয়াছে [গী|৫|২] । ভক্তির তৃতীয় স্বতন্ত্র নিষ্ঠা তো কোথাও বলাই হয় নাই । সুতরাং জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি এই তিন স্বতন্ত্র নিষ্ঠার কল্পনা সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের নিজের মনগড়া; এবং গীতায় কেবল মোক্ষোপায়েরই বিচার করা হইয়াছে তাঁহাদিগের এইরূপ ধারণা থাকায় এই তিন নিষ্ঠার কথা কদাচিৎ ভাগবত হইতেই তাঁহাদের মনে আসিয়াছে [ভাগ|১১|২০, ৬] । কিন্তু ভাগবত পুরাণ ও ভগবদ্‌গীতার তাৎপৰ্য যে এক নহে, সে কথা টীকাকারদিগের মনে হয় নাই । শুধু কর্মের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় না, মোক্ষের জন্য জ্ঞান চাই, এই সিদ্ধান্ত ভাগবতকারেরও মান্য । কিন্তু ইহার অতিরিক্ত, ভাগবতকার এ কথা ও বলেন যে, জ্ঞান ও নৈষ্কর্ম্য মোক্ষপ্ৰদ হইলেও ঐ দুই-ই (অর্থাৎ গীতার নিষ্কাম কর্মযোগ) ভক্তি ব্যতীত শোভা পায় না - ‘নৈষ্কৰ্ম্ম্যমপ্যচুতভাববর্জিতং ন শোভতে জ্ঞানমলং নিরঞ্জনম্‌’ [ভাগ|১২|১২|৫২ এবং ১|২|১২] । এইরূপে স্পষ্ট দেখা যায় যে, ভাগবতকার কেবল ভক্তিকেই প্ৰকৃত নিষ্ঠা অর্থাৎ চরম মোক্ষপ্ৰদ অবস্থা মনে করেন । ভগবদ্‌ভক্তেরা ঈশ্বরার্পণ-বুদ্ধিতে কর্ম করিবেনই না, ভাগবত এরূপও বলেন না এবং করিতেই হইবে, এ কথাও বলেন না । নিষ্কাম কর্ম কর বা না কর, এ সমস্ত ভক্তিযোগেরই বিভিন্ন প্রকার মাত্র [ভাগ|৩|২৯|৭-১৯], ভক্তি না থাকিলে সমস্ত কর্মযোগ পুনর্বার সংসারে অর্থাৎ জন্মমরণের ফেরে আনিয়া ফেলে [ভাগ|১|৫|৩৪,৩৫], ভাগবত কেবল এই কথাই বলেন । সারকথা, ভাগবতকারের সমস্ত কটাক্ষ ভক্তির উপরেই থাকায়, তিনি নিষ্কাম কর্মযোগকেও ভক্তিযোগেই ঠেলিয়া দিয়া এইরূপ প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, ভক্তিই প্রকৃত নিষ্ঠা । কিন্তু ভক্তিই গীতার কিছু মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় নহে । তাই, ভাগবতের উপরি-উক্ত সিদ্ধান্ত বা পরিভাষা গীতার মধ্যে ঢুকাইয়া দেওয়া আতার গাছে আমের কলম লাগাইবার মত অনুচিত । 


10.1) জ্ঞান ও কর্মের সমান ভক্তি কোন তৃতীয় স্বতন্ত্র নিষ্ঠা নহে


পরমেশ্বরের জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষপ্ৰাপ্তি আর কিছুতেই হয় না, এবং এই জ্ঞান সম্পাদনে ভক্তি এক, সহজ মাৰ্গ - এ কথা গীতার সম্পূর্ণ মান্য । কিন্তু এই মার্গের সম্বন্ধে আগ্ৰহ না রাখিয়া, মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য যে জ্ঞান নিতান্ত আবশ্যক তাহার প্রাপ্তি যাহার যে মার্গ সহজ হইবে সেই মার্গের দ্বারা সে করিয়া লইবে, গীতা একথাও বলিয়াছেন । শেষে অর্থাৎ জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর মনুষ্য কর্ম করিবে কি করিবে না - ইহাই তো গীতার মুখ্য বিষয় । তাই, সংসারে কর্ম করা ও কর্ম ত্যাগ করা - জীবন্মুক্ত পুরুষদিগের জীবনে এই যে দুই মার্গ দেখিতে পাওয়া যায়, ঐ দুই মাৰ্গ হইতেই গীতার আরম্ভ হইয়াছে । তন্মধ্যে, ভাগবতকারের মত গীতা প্রথম মার্গের ‘ভক্তিযোগ’ এই নূতন নাম না দিয়া, নারায়ণীয় ধর্মে প্ৰচলিত প্ৰাচীন নামই অর্থাৎ ঈশ্বরার্পণ বুদ্ধিতে কর্ম করাকে ‘কর্মযোগ’ বা ‘কর্মনিষ্ঠা’ এবং জ্ঞানোত্তর কর্মত্যাগকে ‘সাংখ্য’ বা ‘জ্ঞাননিষ্ঠা’, এই নামই গীতাতে স্থির রাখা হইয়াছে । গীতার এই পরিভাষা স্বীকার করিয়া বিচার করিলে উপলব্ধি হইবে যে, জ্ঞান ও কর্মের সমান ভক্তি নামক কোন তৃতীয় স্বতন্ত্র নিষ্ঠা কখনই হইতে পারে না । কারণ, ‘কর্ম করা’ ও ‘না করা অর্থাৎ ছাড়া’ (যোগ ও সাংখ্য) এই অস্তিনাস্তিরূপ দুই পক্ষের অতিরিক্ত কর্মসম্বন্ধে তৃতীয় পক্ষই এক্ষণে অবশিষ্ট থাকে না । তাই, ভক্তিমান পুরুষের নিষ্ঠাটি কি, তাহা গীতা অনুসারে স্থির করিতে হইলে, উক্ত ব্যক্তি ভক্তিভাবে লাগিয়াছে, কেবল ইহা ধরিয়াই তাহার নির্ণয় না করিয়া, সেই ব্যক্তি কর্ম করে কি করে না তাহারই বিচার করা আবশ্যক । ভক্তি পরমেশ্বরপ্রাপ্তির এক সুগম সাধন; এবং সাধন অর্থে যদি ভক্তিকেই ‘যোগ’ বলা যায় [গী|১৪|২৬] তথাপি তাহা চরম ‘নিষ্ঠা’ হইতে পারে না । ভক্তি দ্বারা পরমেশ্বরের জ্ঞান উৎপন্ন হইলে পর কেহ কর্ম করিলে তাহাকে কর্মনিষ্ঠ এবং না করিলে তাহাকে সাংখ্যনিষ্ঠ বলিতে হয় । তন্মধ্যে কর্ম করিবার নিষ্ঠা অধিক শ্ৰেয়স্কর, ভগবান আপনার এই অভিপ্ৰায় পঞ্চম অধ্যায়ে স্পষ্টরূপে বলিয়াছেন । 


10.2) কর্ম ত্যাগ করিতেই হইবে – সন্ন্যাসমাৰ্গীর এই আপত্তি সত্য নহে


কিন্তু কর্ম পরমেশ্বরের জ্ঞান হইবার পক্ষে প্ৰতিবন্ধক হয়, এবং পরমেশ্বরের জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষ হয়ই না, তাই কর্ম ত্যাগ করিতেই হইবে; - সন্ন্যাসমাৰ্গীর কর্মসম্বন্ধে এই একটা বড় আপত্তি আছে । এই আপত্তি যে সত্য নহে এবং সন্ন্যাস মার্গের দ্বারা যে মোক্ষলাভ হয় তাহাই কর্মযোগের দ্বারাও প্ৰাপ্ত হওয়া যায় [গী|৫|৫], তাহা পঞ্চম অধ্যায়ে সাধারণভাবে বলা হইয়াছে । কিন্তু এখানে এই সাধারণ সিদ্ধান্তের কোনও খোলসা ব্যাখ্যা করা হয় নাই । তাই কর্ম করিতে করিতেই শেষে পরমেশ্বরের জ্ঞান লাভ হইয়া কিরূপে মোক্ষলাভ হয় এক্ষণে ভগবান সেই অবশিষ্ট ও মহত্বপূর্ণ বিষয়ের সবিস্তার নিরূপণ করিতেছেন । এই কারণেই সপ্তম অধ্যায়ের আরম্ভে ভক্তি নামক এক স্বতন্ত্র তৃতীয় নিষ্ঠা তোমাকে বলিতেছি এরূপ না বলিয়া ভগবান অর্জুনকে বলিতেছেন যে -
ময্যাসক্তমনাঃ পাৰ্থ যোগং যুঞ্জন্‌ মদাশ্রয়ঃ ৷
অসংশয়ং সমগ্ৰং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু ॥
“হে পাৰ্থ, আমাতে চিত্ত সংস্থাপন করিয়া এবং আমাকে আশ্রয় করিয়া যোগ অর্থাৎ কর্মযোগ সাধন করিবার সময় ‘যথা’ অর্থাৎ যে প্রকারে আমার সম্বন্ধে নিঃসংশয় পূর্ণ জ্ঞান হইবে তাহা (সেই প্ৰণালী তোমাকে বলিতেছি) তুমি শোন” [গী|৭|১]; এবং ইহাকেই পরের শ্লোকে ‘জ্ঞানবিজ্ঞান’ বলা হইয়াছে [গী|৭|২] । তন্মধ্যে প্ৰথম অর্থাৎ উপরি প্রদত্ত ‘ময্যাসক্তমনাঃ’ ইত্যাদি শ্লোকে ‘যোগং যুঞ্জন্‌’ অর্থাৎ “কর্মযোগ সাধন করিতে করিতে” এই পদের খুবই গুরুত্ব আছে । কিন্তু উহার প্রতি কোন টীকাকারই ভাল করিয়া মনোযোগ দেন নাই । ‘যোগং’ অর্থাৎ সেই কর্মযোগ, যাহা প্ৰথম ছয় অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে; এবং এই কর্মযোগ সাধন করিতে থাকিলে যে প্রকার বিধি বা রীতিতে ভগবানসম্বন্ধীয় পুর্ণ জ্ঞান হইতে পারে, সেই রীতি বা বিধির কথা এক্ষণে অর্থাৎ সপ্তম অধ্যায় হইতে আরম্ভ করিতেছি, ইহাই এই শ্লোকের অর্থ । অর্থাৎ প্ৰথম ছয় অধ্যায়ের পরবর্তী অধ্যায়ের সহিত সম্বন্ধ কি, তাহা দেখাইবার জন্য এই শ্লোক সপ্তম অধ্যায়ের আরম্ভে ইচ্ছাপূর্বকই দেওয়া হইয়াছে । তাই এই শ্লোকের অর্থের প্রতি উপেক্ষা করিয়া ‘প্ৰথম ছয় অধ্যায়ের পরে ভক্তিনিষ্ঠা স্বতন্ত্ররূপে বৰ্ণিত হইয়াছে’ এ কথা বলা নিতান্তই অসঙ্গত । অধিক কি, এইরূপ বলিলেও চলে যে, এইরূপ বিপরীত অর্থ যাহাতে কেহ না করে এইজন্যই এই শ্লোকে “যোগং যুঞ্জন্‌” পদ ইচ্ছা করিয়াই দেওয়া হইয়াছে । গীতার প্রথম পাঁচ অধ্যায়ে কর্মের আবশ্যকতা দেখাইয়া সাংখ্যমাৰ্গ অপেক্ষা কর্মযোগ শ্রেষ্ঠ বলা হইয়াছে; এবং তাহার পরে ষষ্ঠ অধ্যায়ে কর্মযোগে ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ করিবার জন্য যাহা আবশ্যক সেই পাতঞ্জল যোগের সাধন বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু ইহাতেই কর্মযোগের বর্ণনা সম্পূর্ণ হয় না । ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ অর্থে কর্মেন্দ্ৰিয়দিগের একপ্রকার কস্‌রত করানো । এই অভ্যাসের দ্বারা ইন্দ্ৰিয়দিগকে আপনার অধীনে রাখা যায় সত্য; কিন্তু মনুষ্যের বাসনাই যদি মন্দ হয় তবে ইন্দ্ৰিয়গণ অধীনে থাকিলেও কোনও লাভ হয় না । কারণ দেখা যায় যে, বাসনা দুষ্ট হইলে কোন কোন লোক জারণ-মারণরূপ দুষ্কর্মে এই ইন্দ্রিয়নিগ্রহরূপ সিদ্ধিরই উপযোগ করিয়া থাকে । তাই ষষ্ঠ অধ্যায়েই উক্ত হইয়াছে যে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের সঙ্গে সঙ্গেই বাসনাও “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” এইভাবে পরিশুদ্ধ হওয়া চাই [গী|৬|২৯]; এবং বাসনার এই শুদ্ধি ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ পরমেশ্বরের শুদ্ধস্বরূপ উপলব্ধি ব্যতীত হইতে পারে না । তাৎপৰ্য এই যে, কর্মযোগে যে ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ আবশ্যক তাহা সম্পাদন করিলেও ‘রস’ অর্থাৎ বিষয়ের অভিরুচি মন হইতে বিলুপ্ত হয় না । এই রস কিংবা বিষয়বাসনার উচ্ছেদ করিতে হইলে পরমেশ্বর সম্বন্ধে পুর্ণ জ্ঞান হওয়া চাই । এই কথা গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বলা হইয়াছে [গী|২|৫৯] । তাই, কর্মযোগ সাধন করিতে করিতেই পরমেশ্বরের এই জ্ঞান যে রীতি অথবা বিধির দ্বারা হইতে পারে এক্ষণে ভগবান সপ্তম অধ্যায় হইতে সেই বিধি বিবৃত করিতেছেন । ‘কর্মযোগ সাধন করিতে করিতে’ এই পদ হইতে ইহাও সিদ্ধ হয় যে, কর্মযোগ যখন চলিতে থাকে তখনই এই জ্ঞান সম্পাদনা করিতে হইবে; ইহার জন্য কর্ম ছাড়িয়া দিতে হয় না; এবং সেইজন্য ভক্তি ও জ্ঞানকে কর্মযোগের পরিবর্তে বিকল্প হিসাবে মানিয়া এই দুই স্বতন্ত্র মাৰ্গ সপ্তম অধ্যায় হইতে পরে বলা হইয়াছে, এ কথাও নির্মূল হইয়া পড়ে । গীতার কর্মযোগ ভাগবতধর্ম হইতেই গৃহীত হওয়ায়, কর্মযোগে জ্ঞানলাভবিধির যে বৰ্ণনা আছে তাহা ভাগবত ধর্ম কিংবা নারায়ণীয় ধর্মে কথিত বিধিরই বৰ্ণনা; এবং এই অভিপ্ৰায়েই শান্তিপর্বের শেষে বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বলিয়াছেন যে, “প্রবৃত্তিমূলক নারায়ণীয় ধর্ম এবং তাহার বিধি ভগবদ্‌গীতায় বর্ণিত হইয়াছে” (প্ৰথম প্রকরণের আরম্ভে প্রদত্ত শ্লোক দেখ) । বৈশম্পায়নের উক্তি অনুসারে সন্ন্যাসমার্গের বিধিও ইহারই অন্তর্ভূত । কারণ, ‘কর্ম করা ও কর্ম ত্যাগ করা’ - এই ভেদই এই দুই মার্গের মধ্যে থাকিলেও উভয়েরই একই জ্ঞানবিজ্ঞান আবশ্যক; সেইজন্য দুই মার্গেরই জ্ঞানপ্রাপ্তির বিধি একই হইয়া থাকে । কিন্তু ‘কর্মযোগ সাধন করিতে করিতে’ এইরূপ প্ৰত্যক্ষপদ যখন উপরি-উক্ত শ্লোকে প্ৰদত্ত হইয়াছে, তখন ইহাই স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে যে, গীতার সপ্তম ও তাহার পরবর্তী অধ্যায়সমূহে জ্ঞানবিজ্ঞানের নিরূপণ মুখ্যতঃ কর্মযোগেরই পরিপূর্তির জন্য করা হইয়াছে, উহার ব্যাপকতার কারণে উহাতে সন্ন্যাসমার্গেরও বিধিসমূহের সমাবেশ হয়, কর্মযোগ ছাড়িয়া কেবল সাংখ্যনিষ্ঠার সমর্থনের জন্য এই জ্ঞানবিজ্ঞান বলা হয় নাই । ইহাও বিবেচনার যোগ্য যে, সাংখ্যমার্গী জ্ঞানের গুরুত্ব স্বীকার করিলেও কর্ম বা ভক্তির কোনই গুরুত্ব দেন না; এবং গীতাতে তো ভক্তিকে সুগম ও প্রধান বলা হইয়াছে - ইহাই বা কেন; বরঞ্চ অধ্যাত্মজ্ঞান ও ভক্তির বর্ণন করিবার সময় শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে স্থানে স্থানে এই উপদেশ দিয়াছেন, যে, “তুমি কর্ম অর্থাৎ যুদ্ধ কর” [গী|৮|৭; ১১|৩৩; ১৬|২৪; ১৮|৬] । কাজেই সিদ্ধান্ত করিতেই হয় যে, গীতার সপ্তম ও পরবর্তী অধ্যায়সমূহে জ্ঞানবিজ্ঞানের যে নিরূপণ হইয়াছে, উহা পুর্ববর্তী ছয় অধ্যায়ে কথিত কর্মযোগেরই পরিপূর্তি ও সমর্থনের জন্যই বলা হইয়াছে; এখানে কেবল সাংখ্যনিষ্ঠ বা ভক্তির স্বতন্ত্র সমর্থন বিবক্ষিত নহে । এইরূপ সিদ্ধান্ত করিলে পর, কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান গীতার তিন পরস্পর-স্বতন্ত্র বিভাগ হইতে পারে না । শুধু ইহাই নহে; কিন্তু এখন বুঝা যাইবে যে, এই মতও (যাহা কোন কোন লোক প্রচার করেন) শুধু কাল্পনিক ও সুতরাং মিথ্যা । তাহারা বলেন যে, ‘তত্ত্বমসি’ এই মহাবাক্যে তিনটিই পদ আছে এবং গীতার অধ্যায়ও আঠারো; তাই, “তিন-ছয় আঠারো” এই হিসাবে গীতার ছয় ছয় অধ্যায়ের তিন সমান বিভাগ করিয়া প্ৰথম ছয় অধ্যায়ে ‘ত্বম’ পদের, দ্বিতীয় ছয় অধ্যায়ে ‘তৎ’ পদের এবং তৃতীয় ছয় অধ্যায়ে ‘মসি’ পদের বিচার করা হইয়াছে । এই মতকে কাল্পনিক বা মিথ্যা বলিবার কারণ এই যে, গীতায় কেবল ব্ৰহ্মজ্ঞানই প্ৰতিপাদ্য হইয়াছে এবং ‘তত্ত্বমসি’ এই মহাবাক্যের বিবৃতির বাহিরে গীতায় আর বেশী কিছু নাই, এই একদেশদর্শী পক্ষই এক্ষণে আর দাঁড়াইতে পারে না ।


10.3) সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত একাদশ অধ্যায়ের সঙ্গতি


ভগবদ্‌গীতায় ভক্তি ও জ্ঞানের বিচার কেন আসিল তাহার এইরূপ একবার মীমাংসা হইলে পর, সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত একাদশ অধ্যায়ের সঙ্গতি সহজে অবগত হইতে পারা যায় । পূর্বে ষষ্ঠ প্রকরণে কথিত হইয়াছে যে, যে পরমেশ্বরের জ্ঞান হইতে বুদ্ধি বাসনাবর্জিত ও সম হয়, সেই পরমেশ্বর-স্বরূপের বিচার একবার ক্ষরাক্ষর-দৃষ্টিতে এবং একবার ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞদৃষ্টিতে করা আবশ্যক, এবং তাহা হইতে শেষে এই চরম সিদ্ধান্ত করা হইয়া থাকে যে, যে তত্ত্ব পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে । এই বিষয়ই গীতাতে উক্ত হইয়াছে । কিন্তু পরমেশ্বর-স্বরূপের এইরূপ বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে দেখা যায় যে, পরমেশ্বরের স্বরূপ কখনও ব্যক্ত (ইন্দ্ৰিয়গোচর) হয়, আর কখন বা অব্যক্ত হইয়া থাকে । এবং তাহার পর, এই দুই স্বরূপের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কোন্‌টি, এবং এই শ্রেষ্ঠ স্বরূপ হইতে কনিষ্ঠ স্বরূপ কিরূপে উৎপন্ন হয় ইত্যাদি অনেক প্রশ্নেরও বিচার এই নিরূপণে করা আবশ্যক হয় । সেইরূপ আবার, পরমেশ্বরের পূর্ণ জ্ঞান হইতে বুদ্ধিকে স্থির, সম ও আত্মনিষ্ঠ করিবার জন্য পরমেশ্বরের যে উপাসনা করিতে হয় তাহার মধ্যে ব্যক্তের উপাসনা ভাল কি অব্যক্তের উপাসনা ভাল, তাহারও নির্ণয় করা অতি আবশ্যক হয় । এবং সেই সঙ্গে, পরমেশ্বর যখন একমাত্র, তখন ব্যক্ত জগতের মধ্যে নানাত্ব কেন দেখিতে পাওয়া যায় তাহারও উপপত্তি বোঝানো আবশ্যক । এই সমস্ত বিষয় সুব্যবস্থিতভাবে বুঝাইবার জন্য এগারো অধ্যায়ের যে প্রয়োজন হইয়াছে, ইহা আশ্চৰ্য নহে । গীতায় ভক্তি ও জ্ঞানের বিচার মোটেই করা হয় নাই এ কথা আমি বলি না । আমার শুধু বক্তব্য এই যে, কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, এই তিন বিষয় কিংবা নিষ্ঠা স্বতন্ত্র অর্থাৎ তুল্যবল বুঝিয়া গীতার আঠারো অধ্যায়ের ভাইদের ভাগবণ্টনের মতো এই তিনের মধ্যে যে সমান ভাগবণ্টন করা হইয়া থাকে তাহা উচিত নহে; কিন্তু জ্ঞানমূলক ও ভক্তিপ্রধান কর্মযোগরূপ একই নিষ্ঠা গীতার প্রতিপাদ্য; এবং সাংখ্যনিষ্ঠা, জ্ঞানবিজ্ঞান বা ভক্তি, ইহাদের যে নিরূপণ ভগবদ্‌গীতায় আছে তাহা কেবল কর্মযোগনিষ্ঠার পূর্তি ও সমর্থনাৰ্থ আনুষঙ্গিকভাবে প্রদত্ত হইয়াছে, স্বতন্ত্র বিষয় প্রতিপাদন করিবার জন্য নহে । এক্ষণে এই সিদ্ধান্তানুসারে কর্মযোগের পরিপূর্তি ও সমর্থনের জন্য কথিত জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভাগ গীতার অধ্যায়সমূহের ক্রমানুসারে কিরূপ করা হইয়াছে তাহা দেখা যাক ।


11) গীতার সপ্তম অধ্যায় হইতে দ্বাদশ অধ্যায় পর্যন্তের সারাংশ


11.1) গীতার সপ্তম অধ্যায়


সপ্তম অধ্যায়ে ক্ষরাক্ষর জগতের অর্থাৎ ব্রহ্মাণ্ডের বিচার আরম্ভ করিয়া ভগবান প্ৰথমে অব্যক্ত ও অক্ষর পরব্রহ্মের জ্ঞানের বিষয়ে বলিয়াছেন যে, যে এই সমস্ত সৃষ্টিকে - পুরুষ ও প্ৰকৃতিকে - আমারই পর ও অপর স্বরূপ জানে, এবং যে এই মায়ার বাহিরে অব্যক্ত রূপ উপলব্ধি করিয়া আমাকে ভজনা করে, তাহার বুদ্ধি সম হওয়ায় তাহাকে আমি সদ্‌গতি দিই; এবং পুনরায় তিনি আপন স্বরূপের এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন যে, সমস্ত দেবতা, সমস্ত ভূত, সমস্ত যজ্ঞ, সমস্ত কর্ম, এবং সমস্ত অধ্যাত্ম আমিই, আমা ছাড়া এই জগতে আর কিছুই নাই । 


11.2) গীতার অষ্টম অধ্যায়


তাহার পর, অষ্টম অধ্যায়ের আরম্ভে, অধ্যাত্ম, অধিযজ্ঞ, অধিদৈব ও অধিভূত কি, তাহার অর্থ আমাকে বল, অর্জুন এইরূপ প্রশ্ন করায়, এই সকল শব্দের অর্থ বলিয়া ভগবান বলিয়াছেন যে, এইরূপ আমার স্বরূপ যে ব্যক্তি উপলব্ধি করিয়াছে তাহাকে আমি কখনও বিস্মৃত হই না । এইরূপ বর্ণনার পর, সমস্ত জগতে অবিনাশী বা অক্ষর তত্ত্ব কি; সমস্ত জগতের সংহার কখন্‌ ও কিরূপে হয়; এবং পরমেশ্বরস্বরূপের জ্ঞান যাহার হইয়াছে সেই ব্যক্তি কোন গতি প্ৰাপ্ত হয়; এবং জ্ঞান ব্যতীত শুধু কাম্য কর্ম যে ব্যক্তি করে তাহার কোন গতি হয়, এই সকল বিষয়ের সংক্ষেপে বিচার আছে । 


11.3) গীতার নবম অধ্যায়


নবম অধ্যায়েও ঐ বিষয়ই চলিয়াছে । এই অধ্যায়ে ভগবান উপদেশ দিয়াছেন যে, চারিদিকে পূর্ণরূপে ব্যাপ্ত অব্যক্ত পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপকে ভক্তির দ্বারা উপলব্ধি করিয়া অনন্যভাবে তাহার শরণাপন্ন হওয়াই ব্ৰহ্মপ্ৰাপ্তির প্রত্যক্ষগম্য ও সুলভ মাৰ্গ বা রাজমাৰ্গ, এবং ইহাকেই রাজবিদ্যা বা রাজগুহ্য বলে । তথাপি এই তিন অধ্যায়ে মধ্যে মধ্যে, জ্ঞানবান বা ভক্তিমান ব্যক্তিকে কর্ম করিতেই হইবে, কর্মমার্গের এই প্ৰধান তত্ত্ব ভগবান বলিতে বিস্মৃত হন নাই । উদাহরণ যথা – “তস্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুদ্ধ্য চ” এই জন্য সর্বদা নিজের মনে আমাকে স্মরণ রেখো এবং যুদ্ধ কর, এইরূপ অষ্টম অধ্যায়ে বলিয়াছেন [৮|৭]; আবার “সমস্ত কর্ম আমাকে অৰ্পণ করিলে কর্মের শুভাশুভ ফল হইতে তুমি মুক্ত হইবে” এইরূপ নবম অধ্যায়ে বলিয়াছেন [৯|২৭,২৮] । 


11.4) গীতার দশম অধ্যায়


সমস্ত জগৎ আমা হইতে উৎপন্ন এবং উহা আমারই রূপ, উপরে এইরূপ যাহা বলা হইয়াছে তাহাই দশম অধ্যায়ে এইরূপ অনেক উদাহরণ দিয়া অর্জুনকে ভালরূপেই বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছে যে, ‘জগতের প্রত্যেক শ্রেষ্ঠ বস্তু আমারই বিভূতি’ । 


11.5) গীতার একাদশ অধ্যায়


অর্জুনের প্রার্থনা অনুসারে একাদশ অধ্যায়ে ভগবান তাঁহাকে নিজের বিশ্বরূপ প্ৰত্যক্ষ দেখাইয়া (আমিই) পরমেশ্বরই চারিদিকে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন এই কথার সত্যতা অর্জুনের চক্ষের সম্মুখে বিন্যাসপূর্বক তাহার সত্যতা উপলব্ধি করাইয়া  দিলেন । কিন্তু এই প্রকার বিশ্বরূপ দেখাইয়া এবং ‘সমস্ত কর্ম আমিই করাইতেছি’ অর্জুনের মধ্যে এইরূপ বিশ্বাস জন্মাইয়া, ভগবান তখনই বলিলেন যে, “প্রকৃত কর্তা তো আমিই, তুমি উপলক্ষ্য মাত্র, অতএব নিঃশঙ্ক হইয়া যুদ্ধ কর” [গী|১১|৩৩] । জগতে একই পরমেশ্বর আছেন, ইহা এই প্রকারে সিদ্ধ হইলেও অনেক স্থানে পরমেশ্বরের অব্যক্ত স্বরূপকেই মুখ্য মানিয়া বর্ণন করা হইয়াছে যে, “আমি অব্যক্ত, মূর্খ লোকেরা আমাকে ব্যক্ত মনে করে” [৭|২৪]; “যদক্ষরং বেদবিদো বদন্তি” [৮|১১] বেদবেত্তারা যাঁহাকে অক্ষর বলে; “অব্যক্তকেই অক্ষর বলে” [৮|২১]; “আমার প্রকৃত স্বরূপ না জানিয়া আমি মনুষ্যদেহধারী এইরূপ মূঢ় লোকেরা মনে করে” [৯|১১]; “বিদ্যার মধ্যে অধ্যাত্মবিদ্যা শ্রেষ্ঠ” [১০|৩২]; এবং অর্জুনের কথন অনুসারে “ত্বমক্ষরং সদসত্তৎপরং যৎ” [১১|৩৭] । 


11.6) গীতার দ্বাদশ অধ্যায়


এইজন্য দ্বাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন প্রশ্ন করিয়াছেন যে, “পরমেশ্বরের উপাসনা করিতে হইলে ব্যক্তের অথবা অব্যক্তের উপাসনা করিতে হইবে ?” তখন ভগবান নবম অধ্যায়ে বৰ্ণিত ব্যক্ত স্বরূপের উপাসনা সুগম, এইরূপ আপন মত বলিয়া, দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞের যেরূপ বর্ণনা আছে সেইরূপই পরম ভগবদভক্তের অবস্থার বর্ণনা করিয়া এই অধ্যায় সমাপ্ত করিয়াছেন ।


12) ভক্তি ও জ্ঞান পৃথক পৃথক বর্ণিত নাই, অতএব ষড়ধ্যায়ী মত অসত্য


কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান, গীতার এই তিন স্বতন্ত্র বিভাগ না করা হইলেও, সপ্তম অধ্যায় হইতে জ্ঞানবিজ্ঞানের যে বিষয় আরম্ভ হইয়াছে, তাহার ভক্তি ও জ্ঞান এই দুই পৃথক্ বিভাগ সহজেই হয়, এইরূপ কাহারও কাহারও মত । দ্বিতীয় ষড়ধ্যায়ী ভক্তিমূলক, এইরূপ তাহারা বলিয়া থাকেন । কিন্তু এই মতও যে সত্য নহে, একটু বিচার করিয়া দেখিলেই তাহা উপলব্ধি হইবে । কারণ, সপ্তম অধ্যায় ক্ষরাক্ষর জগতের জ্ঞান-বিজ্ঞান হইতে আরম্ভ করা হইয়াছে, ভক্তি হইতে নহে । এবং যদি বলা যায় যে, দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তির বর্ণনা সম্পূর্ণ হইয়াছে, তবে আমি দেখি যে, পরবর্তী অধ্যায়গুলির স্থানে স্থানে পুনঃ পুনঃ ভক্তির বিষয়ে উপদেশ করিয়াছেন যে, যে বুদ্ধির দ্বারা আমার স্বরূপ অবগত হয় নাই সে শ্রদ্ধাপূর্বক “অন্যের বাক্যে বিশ্বাস স্থাপন করিয়া আমার ধ্যান করিবে” [গী|১৩|২৫], “যে আমাকে অব্যভিচারিণী ভক্তি করে সে-ই ব্ৰহ্ম-ভূত হয়” [১৪|২৬], “যে আমাকেই পুরুষোত্তমরূপে জানে সে আমাকেই ভক্তি করে” [গী|১৫|১৯]; এবং শেষে অষ্টাদশ অধ্যায়ে পুনরায় ভক্তিরই এই প্ৰকার উপদেশ করিয়াছেন যে, “সর্বধর্ম ছাড়িয়া তুমি আমার ভজনা কর[গী|১৮|৬৬] । তাই, দ্বিতীয় ষড়ধ্যায়ীতেই ভক্তির উপদেশ আছে এরূপ বলিতে পারা যায় না । সেইরূপ আবার, জ্ঞান হইতে ভক্তি স্বতন্ত্র, ভগবানের যদি এইরূপ অভিপ্ৰায় হইত, তাহা হইলে চতুর্থ অধ্যায়ে জ্ঞানের প্রস্তাবনা করিয়া [৪|৩৪-৩৭], সপ্তম অধ্যায়ের অর্থাৎ উপরি-উক্ত আপত্তিকারীদিগের মতে ভক্তিমূলক ষড়ধ্যায়ীর আরম্ভে ভগবান বলিতেন না যে, সেই ‘জ্ঞান-বিজ্ঞানই’ তোমাকে এখন বলিতেছি [৭|২] । ইহার পরে নবম অধ্যায়ে রাজবিদ্যা ও রাজগুহ্য অর্থাৎ প্রত্যক্ষাবগম্য ভক্তিমার্গের কথা বলিয়াছেন সত্য; কিন্তু অধ্যায়ের আরম্ভেই “বিজ্ঞানের সহিত জ্ঞান তোমাকে বলিতেছি” [৯|১] এইরূপ বলিয়া দিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে যে, গীতাতে জ্ঞানের মধ্যেই ভক্তির সমাবেশ করা হইয়াছে । দশম অধ্যায়ে ভগবান্‌ স্বকীয় বিভূতির বর্ণনা করিয়াছেন; কিন্ত একাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন উহাকেই ‘অধ্যাত্ম’ বলিয়াছেন [১১|১]; এবং পরমেশ্বরের ব্যাক্ত স্বরূপের বর্ণনা করিতে করিতে মধ্যে মধ্যে ব্যক্ত স্বরূপ অপেক্ষা অব্যক্তস্বরূপের শ্রেষ্ঠতাও আসিয়াছে, ইহাও উপরে বলা হইয়াছে । এই সকল বিষয় হইতেই দ্বাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন এই প্রশ্ন করিলেন যে, উপাসনা ব্যক্ত অথবা অব্যক্ত পরমেশ্বরের করিতে হইবে ? তখন অব্যক্ত অপেক্ষা ব্যক্তের উপাসনা অর্থাৎ ভক্তি সুগম এইরূপ উত্তর দিয়া ভগবান ত্ৰয়োদশ অধ্যায়ে ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞের ‘জ্ঞানের’ কথা বলিতে আরম্ভ করিয়া সপ্তম অধ্যায়ের আরম্ভের ন্যায়, চতুৰ্দশতম অধ্যায়ের আরম্ভেও বলিলেন যে, “পরং ভূয়ঃ প্রবক্ষ্যামি জ্ঞানানাং জ্ঞানমুত্তমম্‌” [১৪|৪] – পুনর্বার তোমাকে সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানই সম্পূর্ণ করিয়া বলিতেছি । এই জ্ঞানের কথা বলিবার সময়, ভক্তির সূত্র বা সম্বন্ধও বজায় রাখিয়াছেন । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, জ্ঞান ও ভক্তির কথা পৃথকভাবে অর্থাৎ আলাদা আলাদা করিয়া বলা ভগবানের উদ্দেশ্য ছিল না; কিন্তু সপ্তম অধ্যায় হইতে আরব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যেই দুইটীকে একত্ৰ গাঁথা হইয়াছে । ভক্তি ভিন্ন এবং জ্ঞান ভিন্ন, ইহা বলা সেই সেই সম্প্রদায়ের অভিমানমত্ততার ভ্ৰান্ত উক্তি; গীতার অভিপ্ৰায় সেরূপ নহে । অব্যক্ত-উপাসনাতে (জ্ঞানমার্গে) অধ্যাত্মবিচারের দ্বারা পরমেশ্বর-স্বরূপের যে জ্ঞান অর্জন করিতে হয়, তাহাই ভক্তিমার্গেও আবশ্যক হয়; কিন্তু ব্যক্ত-উপাসনাতে (ভক্তিমাৰ্গে) আরম্ভে ঐ জ্ঞান অন্যের নিকট হইতে শ্ৰদ্ধার সহিত গ্ৰহণ করা যাইতে পারে [১৩|২৫], তাই ভক্তিমাৰ্গ প্ৰত্যক্ষাবগম্য এবং সাধারণতঃ সকল লোকেরই পক্ষে অনায়াসসাধ্য [৯|২], এবং জ্ঞানমাৰ্গ (বা অব্যক্ত-উপাসনা) কষ্টকর [১২|৫] - ইহা ছাড়া এই দুই সাধনের মধ্যে গীতা আর কোন ভেদ করেন নাই । পরমেশ্বর-স্বরূপের জ্ঞান লাভ করিয়া বুদ্ধিকে সম করা - কর্মযোগের এই যে সাধ্য বিষয়, তাহা এই দুই সাধনের দ্বারা সমানই প্রাপ্ত হওয়া যায় । তাই ব্যক্তোপাসনাই কর আর অব্যক্তোপাসনাই করা, দুই-ই ভগবানের সমান গ্ৰাহ্য । তথাপি জ্ঞানী ব্যক্তিরও উপাসনার ন্যূনাধিক আবশ্যকতা থাকায়, চতুর্বিধ ভক্তের মধ্যে ভক্তিমান জ্ঞানী শ্রেষ্ঠ এইরূপ বলিয়া [গী|৭|১৭], ভগবান জ্ঞান ও ভক্তির বিরোধ অপসারিত করিয়া দিয়াছেন । যাই হোক, জ্ঞানবিজ্ঞানের বর্ণনা যখন চলিতে থাকে তখন প্ৰসঙ্গক্রমে এক-আধ অধ্যায়ে ব্যক্তোপাসনার আর অপর কোন অধ্যায়ে অব্যক্তোপাসনার বিশেষ বর্ণনা অপরিহাৰ্য । কিন্তু তাই বলিয়া এরূপ সন্দেহ যেন না হয় যে, এই দুইটী পৃথক পৃথক, এই কারণে পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপের বর্ণনা যখন চলিতেছিল সেই সময়ে ব্যক্তস্বরূপ অপেক্ষা অব্যক্তের শ্রেষ্ঠতা, এবং অব্যক্তের বর্ণনা যখন চলিতেছিল সেই সময়ে ভক্তির আবশ্যকতা বলিতে ভগবান ভূলেন নাই । এখন বিশ্বরূপের ও বিভূতির বর্ণনাতেই তিন চার অধ্যায় লাগিয়া যাওয়ায় এই তিন চার অধ্যায়কে (যড়ধ্যায়ীকে নহে) মোটামুটিভাবে ‘ভক্তিমাৰ্গ’ নাম দেওয়া যদি কাহারও ভাল লাগে, তবে সেরূপ করিতে কোন বাধা নাই । কিন্তু যাহাই বল না কেন, ইহা নিশ্চিত স্বীকার করিতেই হইবে যে, গীতায় ভক্তি ও জ্ঞানকে না পৃথক করা হইয়াছে, না এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলা হইয়াছে । সংক্ষেপে উক্ত নিরূপণের এই ভাবার্থই মনে রাখিতে হইবে যে, কর্মযোগে যাহা প্ৰধান সেই সাম্যবুদ্ধি লাভ করিতে হইলে, পরমেশ্বরের সর্বব্যাপী স্বরূপের জ্ঞান হওয়া চাই; তারপর এই জ্ঞান ব্যক্তের উপাসনা দ্বারাই হউক বা অব্যক্তের উপাসনা দ্বারাই হউক, সুগমতা ছাড়া ইহার মধ্যে আর কোন ভেদ নাই; এবং গীতাতে সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত, সমস্ত বিষয়েরই ‘জ্ঞান-বিজ্ঞান’ বা ‘অধ্যাত্ম’ এই একই নাম প্ৰদত্ত হইয়াছে ।


13) গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায় হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পর্যন্তের সারাংশ


13.1) গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়


যাক; পরমেশ্বরই সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ডে বা ক্ষরাক্ষর জগতে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন, ভগবান তাহা বিশ্বরূপ প্রদর্শনের দ্বারা অর্জুনের ‘চর্মচক্ষুর’ প্ৰত্যক্ষ অনুভব করাইবার পর, এই পরমেশ্বরই পিণ্ডে অর্থাৎ মনুষ্যের শরীরে বা ক্ষেত্রে আত্মারূপে যে অবস্থিত এবং এই আত্মার অর্থাৎ ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞানই যে পরমেশ্বরেরও (পরমাত্মারও) জ্ঞান, এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বিবৃত করিয়াছেন । প্ৰথমে পরমাত্মার অর্থাৎ পরব্রহ্মের “অনাদিমৎ পরং ব্ৰহ্ম” ইত্যাদি উপনিষদের ভিত্তিতে বর্ণনা করিয়া পরে বলা হইয়াছে যে, এই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারই ‘প্রকৃতি’ ও ‘পুরুষ’ নামক সাংখ্যবিচারে অন্তর্ভূত হইয়াছে; এবং শেষে ইহা বলা হইয়াছে যে, ‘প্ৰকৃতি’ ও ‘পুরুষের’ ভেদ উপলব্ধি করিয়া সর্বগত নির্গুণ পরমাত্মাকে যিনি ‘জ্ঞানচক্ষু’র দ্বারা দেখিয়াছেন তিনি মুক্ত হন । কিন্তু তাহার মধ্যেও কর্মযোগের এই সূত্ৰ স্থির রাখা হইয়াছে যে, “সমস্ত কর্ম প্রকৃতি করে, আত্মা কর্তা নহে - ইহা জানিলে কর্ম বন্ধন হয় না” [১৩|২৯]; এবং “ধ্যানেনাত্মনি পশ্যন্তি” [১৩|২৪] ভক্তির এই সূত্ৰও বজায় রহিয়াছে । 


13.2) গীতার চতুৰ্দশ অধ্যায়


চতুৰ্দশ অধ্যায়ে এই জ্ঞানেরই কথা সাংখ্যশাস্ত্ৰ অনুসারে বর্ণন করা হইয়াছে যে, একই আত্মা বা পরমেশ্বর সর্বত্র থাকিলেও সত্ত্ব, রজ ও তম প্ৰকৃতির গুণসমূহের ভেদ প্ৰযুক্ত জগতে বৈচিত্ৰ্য উৎপন্ন হয় । পরে বলা হইয়াছে যে, প্ৰকৃতির এই খেলা জানিয়া এবং নিজেকে কর্তা নহে উপলব্ধি করিয়া ভক্তিযোগে যে পরমেশ্বরের সেবা করে সেই ব্যক্তিই প্ৰকৃত ত্ৰিগুণাতীত কিংবা মুক্ত । শেষে অর্জুনের প্রশ্নের উপর স্থিতপ্ৰজ্ঞ ও ভক্তিমান পুরুষের অবস্থার সমানই ত্ৰিগুণাতীতের অবস্থা বর্ণিত হইয়াছে । 


13.3) গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়


শ্রুতিগ্ৰন্থসমূহে পরমেশ্বরের কখন কখন বৃক্ষরূপে যে বৰ্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়, পঞ্চদশ অধ্যায়ের আরম্ভে তাহারই বর্ণনা করিয়া ভগবান বলিয়াছেন যে, সাংখ্য যাহাকে, ‘প্ৰকৃতির বিস্তার’ বলে, এই অশ্বত্থ বৃক্ষ সেই বিস্তারকেই বুঝায়; এবং শেষে ভগবান অর্জুনকে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, ক্ষর ও অক্ষর এই দুয়ের অতীত যে পুরুষোত্তম তাঁহাকে জানিয়া তাঁহাকেই ‘ভক্তি’ করিলে মনুষ্য কৃতকৃত্য হয় এবং তুমিও তাহাই কর । 


13.4) গীতার ষোড়শ অধ্যায়


ষোড়শ অধ্যায়ে বলা হইয়াছে যে, প্রকৃতিভেদ প্ৰযুক্ত জগতে যেরূপ বৈচিত্ৰ্য উৎপন্ন হয় সেইরূপই মনুষ্যের মধ্যেও দৈবী সম্পত্তিবিশিষ্ট ও আসুরী সম্পত্তিবিশিষ্ট, এই দুই ভেদ হয়; এইরূপ বলিয়া, তাহাদের কর্মের বর্ণনা এবং তাহারা কোন গতি প্ৰাপ্ত হয় তাহার বর্ণনা করা হইয়াছে । 


13.5) গীতার সপ্তদশ অধ্যায়


অর্জুন জিজ্ঞাসা করিলে পর সপ্তদশ অধ্যায়ে বিচার করা হইয়াছে যে, ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতির গুণবৈষম্য প্ৰযুক্ত যে বৈচিত্র হয় তাহা শ্ৰদ্ধা, দান, যজ্ঞ, তপ ইত্যাদি কর্মের মধ্যেও দৃষ্টিগোচর হয় । ইহার পর বলা হইয়াছে যে, ‘ওঁতৎসৎ’ এই ব্ৰহ্মনির্দেশের ‘তৎ’ পদের অর্থ ‘নিষ্কামবুদ্ধিতে কৃত কর্ম’, এবং ‘সৎ’ পদের অর্থ ‘ভাল, কিন্তু কাম্যবুদ্ধিতে কৃত কর্ম’, এবং এই অর্থ অনুসারে ঐ সাধারণ ব্ৰহ্মনির্দেশও কর্মযোগেরই অনুকুল । 


14) সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত এগারো অধ্যায়ের তাৎপৰ্য


সারকথা, সপ্তম অধ্যায় হইতে আরম্ভ করিয়া সপ্তদশ অধ্যায় পৰ্যন্ত এগারো অধ্যায়ের তাৎপৰ্য এই যে, জগতে চতুর্দিকে একই পরমেশ্বর ব্যাপ্ত আছেন — তুমি তাঁহাকে বিশ্বরূপদর্শনেই উপলব্ধি কর কিংবা জ্ঞানচক্ষুর দ্বারাই উপলব্ধি কর; শরীরের মধ্যে ক্ষেত্ৰজ্ঞও তিনিই এবং ক্ষর-জগতে অক্ষরও তিনিই; তিনিই দৃশ্যজগৎ ভরিয়া আছেন এবং তাহার বাহিরেও কিংবা অতীতও তিনি;  তিনি এক হইলেও প্ৰকৃতির গুণভেদ প্ৰযুক্ত ব্যক্ত জগতে নানাত্ব বা বৈচিত্র্য দেখিতে পাওয়া যায়; এবং এই মায়া হইতে কিংবা প্ৰকৃতির গুণভেদের কারণেই জ্ঞান, শ্ৰদ্ধা, তপ, যজ্ঞ, ধৃতি, দান ইত্যাদি এবং মনুষ্যের মধ্যেও অনেক ভেদ হইয়া থাকে; কিন্তু এই সমস্ত ভেদের মধ্যে যে ঐক্য আছে তাহা উপলব্ধি করিয়া সেই এক ও নিত্য তত্ত্বের উপাসনার দ্বারা - আবার সেই উপাসনা ব্যক্তেরই হউক বা অব্যক্তেরই হউক - প্ৰত্যেকের আপন বুদ্ধিকে স্থির ও সম করিয়া সেই নিষ্কাম, সাত্বিক কিংবা সাম্যবুদ্ধি হইতেই সংসারে স্বধর্মানুসারে প্ৰাপ্ত সমস্ত ব্যবহার জগতে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিতে হইবে । এই জ্ঞানবিজ্ঞান এই গ্রন্থের অর্থাৎ গীতারহস্যের পূর্ব পূর্ব প্রকরণে আমি সবিস্তর প্ৰতিপাদিত করিয়াছি বলিয়া, সপ্তম হইতে সপ্তদশ অধ্যায়ের সংক্ষিপ্তসারই এই প্ৰকরণে দিয়াছি - অধিক বিস্তৃতরূপে দিই নাই । গীতার অধ্যায়সঙ্গতি দেখানই উপস্থিত ক্ষেত্রে আমার উদ্দেশ্য হওয়ায়, তাহারই জন্য যেটুকু আবশ্যক সেইটুকুই এখানে প্রদত্ত হইয়াছে ।


15) অষ্টাদশের উপসংহার কর্মযোগপ্রধানই


কর্মযোগমার্গে কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধিই শ্ৰেষ্ঠ হওয়ায়, এই বুদ্ধিকে শুদ্ধ ও সম করিবার জন্য পরমেশ্বরের সর্বব্যাপিত্বের অর্থাৎ সর্বভূতান্তৰ্গত আত্মৈক্যের যে ‘জ্ঞানবিজ্ঞান’ আবশ্যক, তাহারই বিষয় বলিতে আরম্ভ করিয়া এ পর্যন্ত এই বিষয়ের নিরূপণ করা হইল যে অধিকার-ভেদানুসারে ব্যক্তের কিংবা অব্যক্তের উপাসনা দ্বারা এই জ্ঞান হৃদয়ে প্ৰতিভাত হইলে পর, বুদ্ধি স্থৈৰ্য ও সমতা প্ৰাপ্ত হয়, এবং কর্ম ত্যাগ না করিলেও শেষে মোক্ষ লাভ হয় । ইহারই সঙ্গে ক্ষরাক্ষর ও ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞেরও বিচার করা হইয়াছে । কিন্তু বুদ্ধি এইরূপ সম হইবার পরেও কর্ম ত্যাগ করা অপেক্ষা ফলাশা ছাড়িয়া লোকসংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ কর্ম করিতে থাকাই অধিক শ্ৰেয়স্কর, ইহা ভগবান নিশ্চিতরূপে বলিয়াছেন [গী|৫|২] । তাই স্মৃতিগ্ৰন্থসমূহে বৰ্ণিত ‘সন্ন্যাসাশ্রম’ এই কর্মযোগে নাই এবং সেইজন্য মন্বাদি স্মৃতিগ্ৰন্থ ও কর্মযোগের বিরোধ হওয়া সম্ভব । এই সংশয় মনে উপস্থিত করিয়া  ‘সন্ন্যাস’ ও ‘ত্যাগ’ - এই দুয়ের রহস্য কি, অর্জুন অষ্টাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে সেই প্রশ্ন করিয়াছেন । ভগবান ইহার এই উত্তর দিতেছেন যে, সন্ন্যাসের মূল অর্থ ‘ত্যাগ করা’ হওয়ায় এবং কর্মযোগমার্গে কর্ম ত্যাগ না করিলেও ফলাশা ত্যাগ করা হইয়া থাকে বলিয়া কর্মযোগ তত্ত্বতঃ সন্ন্যাসই; কারণ সন্ন্যাসীর ভেক ধারণ করিয়া ভিক্ষা না করিলেও বৈরাগ্য ও সন্ন্যাসের স্মৃত্যুক্ত তত্ত্ব অর্থাৎ বুদ্ধিকে নিষ্কাম রাখা - কর্মযোগেও বজায় থাকে । কিন্তু ফলাশা চলিয়া গেলে স্বৰ্গলাভেরও আশা না থাকায় আর এক সংশয় এখানে উপস্থিত হয় যে, এই অবস্থায় যাগযজ্ঞাদি শ্রোত কর্ম করিবার আবশ্যকতা কি ? ইহার উত্তরে ভগবান আপন নিশ্চিত মত ব্যক্ত করিয়াছেন যে, উক্ত কর্ম চিত্তশুদ্ধিকারক হওয়ায় তাহাও অন্য কর্মের সঙ্গেই নিষ্কামবুদ্ধিতে করিয়া লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যজ্ঞচক্ৰ সর্বদা বজায় রাখা আবশ্যক । অর্জুনের প্রশ্নের এই প্রকার উত্তর দেওয়া হইলে পর, প্ৰকৃতি-স্বভাবানুরূপ জ্ঞান, কর্ম, কর্তা, বুদ্ধি, ধৃতি ও সুখ, ইহাদের যে সাত্বিক, রাজসিক ও তামসিক ভেদ হইয়া থাকে তাহা নিরূপণ করিয়া গুণবৈচিত্র্যের বিষয়টি সম্পূৰ্ণ করিয়াছেন । তাহার পর স্থির করা হইয়াছে যে, নিষ্কাম কর্ম, নিষ্কাম কর্তা, আসক্তিরহিত বুদ্ধি, অনাসক্তিসম্ভূত সুখ এবং “অবিভক্তং বিভক্তেষু” এই নীতি অনুসারে উৎপন্ন আত্মৈক্যজ্ঞানই সাত্বিক বা শ্ৰেষ্ঠ । এই তত্ত্ব অনুসারেই চাতুর্বর্ণেরও উপপত্তি বিবৃত হইয়াছে এবং বলা হইয়াছে যে, চতুর্বৰ্ণ-ধর্ম হইতে প্ৰাপ্ত কর্ম সাত্বিক অর্থাৎ নিষ্কাম বুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিলেই মনুষ্য এই জগতে কৃতকৃত্য হইয়া শেষে শান্তি ও মোক্ষ লাভ করে । শেষে ভগবান অর্জুনকে ভক্তিমার্গের এই নিশ্চিত উপদেশ দিয়াছেন যে, কর্ম প্ৰকৃতির ধর্ম হওয়ায় তাহা ছাড়িব মনে করিলেও ছাড়া যায় না; তাই, পরমেশ্বরই সর্বকর্তা ও কারয়িতা ইহা বুঝিয়া তাঁহারই শরণাপন্ন হইয়া, সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে থাক; আমিই, সেই পরমেশ্বর, আমার উপর বিশ্বাস রাখিয়া আমাকে ভজনা কর, আমি সমস্ত পাপ হইতে তোমাকে মুক্ত করিব । এইরূপ উপদেশ করিয়া ভগবান গীতার প্রবৃত্তিমূলক ধর্মের নিরূপণ সম্পূর্ণ করিয়াছেন । সারকথা, ইহলোক ও পরলোক এই দুয়েরই বিচার করিয়া জ্ঞানবান ও শিষ্ট ব্যক্তির প্রচারিত ‘সাংখ্য’ ও ‘কর্মযোগ’, এই দুই নিষ্ঠা হইতেই গীতার উপদেশ শুরু হইয়াছে; তন্মধ্যে পঞ্চম অধ্যায়ের নির্ণয় অনুসারে যে কর্মযোগের মহত্ত্ব অধিক, যে কর্মযোগের সিদ্ধির নিমিত্ত ষষ্ঠ অধ্যায়ে পাতঞ্জল যোগের বর্ণনা করা হইয়াছে, যে কর্মযোগের আচরণবিধির বর্ণন পরবর্তী এগারো অধ্যায়ে [৭ম হইতে ১৭ তম পৰ্যন্ত] পিণ্ডব্ৰহ্মাণ্ডজ্ঞানপূর্বক সবিস্তর করা হইয়াছে, এবং ইহা বলা হইয়াছে যে ঐ বিধি আচরণ করিলে পর পরমেশ্বরের পুর্ণ জ্ঞান হয় এবং শেষে মোক্ষলাভ হয়, সেই কর্মযোগেরই সমর্থন অষ্টাদশ অধ্যায়ে অর্থাৎ শেষেও আছে; এবং মোক্ষরূপ আত্মকল্যাণের বাধা না হইয়া পরমেশ্বরার্পণপূর্বক কেবল কর্তব্যবুদ্ধিতে স্বধর্মানুসারে লোকসংগ্ৰহাৰ্থ সমস্ত কর্ম করিবার যে এই যোগ বা যুক্তি, তাহার শ্রেষ্ঠত্বের এই ভগবৎপ্রণীত উপপাদন অর্জুন যখন শুনিলেন, তখনই তিনি সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া ভিক্ষা করিবার স্বীয় প্ৰথম সঙ্কল্প ত্যাগ করিয়া এক্ষণে - কেবল ভগবান বলিতেছেন বলিয়া নহে, কিন্তু - কর্মাকর্মশাস্ত্রের পূর্ণ জ্ঞান হওয়ায় স্বেচ্ছাক্রমে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন । অর্জুনকে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্যই গীতার আরম্ভ হইয়াছিল এবং গীতার শেষও সেইরূপই হইয়াছে [গী|১৮|৭৩]


16) মীমাংসকদের দৃষ্টিতেও গীতাতে কর্মযোগই প্রতিপাদ্য হইয়াছে


গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ের যে সঙ্গতি উপরে বলা হইয়াছে তাহা হইতে বুঝা যাইবে যে, গীতা কিছু কর্ম ভক্তি ও জ্ঞান এই তিন স্বতন্ত্র নিষ্ঠার খিচুড়ী নহে; কিংবা উহা তুলা রেশম ও জরির সেলাই করা কাঁথা নহে; বরং দেখা যাইবে যে, তুলা, রেশম ও জরির বিভিন্ন সূত্র যথাস্থানে যোগ্যরূপে বসাইয়া কর্মযোগ নামক মূল্যবান ও মনোহর গীতারূপ বস্ত্ৰখণ্ড প্রথম হইতে শেষ পৰ্যন্ত ‘অত্যন্ত যোগযুক্ত চিত্তের দ্বারা’ ঠাসবুনানি হইয়াছে । নিরূপণের পদ্ধতি কথোপকথনমূলক হওয়ায় শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অপেক্ষা উহা একটু শিথিল হইয়াছে সত্য । কিন্তু কথোপকথনমূলক নিরূপণের দ্বারা শাস্ত্রীয় পদ্ধতির রুক্ষ্মতার পরিবর্তে গীতা সুলভতা ও প্রেমিকতায় পূর্ণ হইয়াছে, তাহা মনে করিলে শাস্ত্রীয় পদ্ধতির হেতু-অনুমানের কেবল বুদ্ধিগ্ৰাহ্য ও নীরস কথার অনস্তিত্ব কাহারও তিলমাত্র খারাপ লাগিবে না । সেইরূপ আবার, গীতানিরূপণের পদ্ধতি পৌরাণিক কিংবা সংবাদাত্মক হইলেও মীমাংসকদিগের গ্রন্থবিচারের সমস্ত কষ্টিপাথর অনুসারে গীতার তাৎপৰ্য নির্ধারণ করিতে কোনও বাধা হয় না । ইহা এই গ্রন্থের সমস্ত বিচার আলোচনা হইতে উপলব্ধি হইবে । গীতার প্রারম্ভ দেখিলে, ক্ষাত্ৰধর্মানুসারে যুদ্ধ করিবার জন্য নির্গত অর্জুন যখন ধর্মাধর্মবিচিকিৎসার চক্রের মধ্যে পড়িলেন, তখন বেদান্তশাস্ত্ৰ অনুসারে তাহাকে প্ৰবৃত্তিমূলক কর্মযোগধর্মের উপদেশ দিবার জন্য গীতা প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন এইরূপ স্পষ্ট দেখা যায়; এবং গীতায় উপসংহার ও ফল উভয়ই এই প্রকারের অর্থাৎ প্ৰবৃত্তিমূলকই ইহা প্ৰথম প্ৰকরণেই আমি দেখাইয়াছি । ইহার পর আমি বলিয়াছি যে, গীতায় অর্জুনকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহাতে “তুমি যুদ্ধ অর্থাৎ কর্মই কর” এইরূপ স্পষ্টরূপে দশবারোবার ও পর্যায়ক্রমে অনেকবার (অভ্যাস) বলা হইয়াছে; এবং আমি ইহাও বলিয়াছি যে, সংস্কৃতসাহিত্যে কর্মযোগের উপপত্তি গীতা ছাড়া অপর কোন গ্রন্থে না থাকায় অভ্যাস ও অপূর্বতা এই দুই প্ৰমাণের দ্বারা গীতায় কর্মযোগের প্রাধান্যই অধিক ব্যক্ত হয় । মীমাংসকগণ গ্ৰন্থতাৎপৰ্য নির্ণয়ার্থ যে সকল কষ্টিপাথরের কথা বলিয়াছেন তন্মধ্যে অর্থবাদ ও উপপত্তি এই দুই অবশিষ্ট থাকিয়া গিয়াছিল । ইহাদের সম্বন্ধে প্ৰথমে পৃথক পৃথক প্রকরণে এবং এক্ষণে গীতার অধ্যায়ক্রম অনুসারে এই প্ৰকরণে যে বিচার করা হইয়াছে তাহা হইতে ‘কর্মযোগ’ই গীতার একমাত্ৰ প্ৰতিপাদ্য বিষয়, ইহাই নিষ্পন্ন হইয়াছে । এই প্রকারে মীমাংসকদিগের গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ের সমস্ত নিয়ম প্রয়োগ করিলে গীতাগ্রন্থে জ্ঞানমূলক ও ভক্তি প্ৰধান কর্মযোগই যে প্রতিপাদিত হইয়াছে, তাহাই নির্বিবাদে সিদ্ধ হয় ৷ এখন সন্দেহ নাই যে, ইহার অতিরিক্ত বাকী সমস্ত গীতা-তাৎপৰ্য কেবল সাম্প্রদায়িক । এই সকল তাৎপৰ্য সাম্প্রদায়িক হইলেও এই প্রশ্ন করা যায় যে, গীতার এই সাম্প্রদায়িক অর্থ - বিশেষতঃ সন্ন্যাসমূলক অর্থ - সন্ধান করিবার কৌশল কেমন করিয়া কতক লোক পাইল ? এই প্রশ্নেরও বিচার না হওয়া পৰ্যন্ত এই সাম্প্রদায়িক অর্থের আলোচনা সম্পূর্ণ হইল, বলা যায় না । তাই এই সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা গীতার সন্ন্যাসমূলক অর্থ কিরূপে করেন, এক্ষণে তাহার একটু বিচার করিয়া এই প্রকরণ শেষ করিব ।


17) চতুর্বিধ পুরুষার্থ


মনুষ্য বুদ্ধিমান প্ৰাণী হওয়ায় পিণ্ডব্ৰহ্মাণ্ডের তত্ত্ব উপলব্ধি করাই তাহার মুখ্য কাৰ্য কিংবা পুরুষাৰ্থ, ইহা আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের সিদ্ধান্ত; এবং ধর্মশাস্ত্রে ইহাকেই ‘মোক্ষ’ বলে । কিন্তু দৃশ্যজগতের ব্যবহারের দিকে দৃষ্টি করিয়া শাস্ত্ৰে ইহাই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে, পুরুষাৰ্থ চারি প্রকার - ধর্ম, অর্থ, কামমোক্ষ । এইস্থলে ‘ধর্ম’ শব্দে ব্যবহারিক সামাজিক ও নৈতিক ধর্ম বুঝিতে হইবে, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । এখন পুরুষাৰ্থ এইরূপ চতুর্বিধ স্বীকার করিলে পর তাহার চারি অঙ্গ বা ভাগ পরস্পরের পোষক কিংবা পোষক নহে এই প্রশ্ন স্বতই উৎপন্ন হয় । এই জন্য যেন মনে থাকে যে, পিণ্ডে ও ব্ৰহ্মাণ্ডে যে তত্ত্ব আছে তাহার জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষ হয় না; ফের সেই জ্ঞান যে-কোন মার্গের দ্বারাই পাওয়া যাক না কেন । এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে শাব্দিক মতভেদ থাকিলেও তত্ত্বতঃ মতভেদ নাই । অন্ততঃ গীতাশাস্ত্রে এই সিদ্ধান্ত সৰ্বথাই গ্ৰাহ্য । সেইরূপ আবার, অর্থ ও কাম এই দুই পুরুষাৰ্থ সম্পাদন করিতে হইলে উহাও নাতিধর্মের দ্বারাই করিতে হইবে গীতার এই তত্ত্বও সম্পূর্ণ মান্য । এক্ষণে কেবল ধর্ম (অর্থাৎ ব্যবহারিক চাতুর্বৰ্ণধর্ম) ও মোক্ষের পরস্পর-সম্বন্ধ নির্ণয় করিতে বাকী আছে । তন্মধ্যে, ধর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি না হইলে মোক্ষের কথা বলাই ব্যর্থ, ধর্মবিষয়ে এই সিদ্ধান্ত সৰ্ববাদসম্মত । কিন্তু এই চিত্তশুদ্ধি করিতে অনেক সময় লাগে; তাই, মোক্ষদৃষ্টিতে বিচার করিলেও ইহাই সিদ্ধ হয় যে, তৎপূর্বে সর্বপ্রথম ‘ধর্মের দ্বারা’ সংসারের সমস্ত কর্তব্য সম্পূর্ণ করিয়া লইতে হইবে [মনু|৬|৩৫-৩৭] । 


18) গীতার সন্ন্যাসপ্রধান অর্থ কি প্রকারে করা গিয়াছে ?


সন্ন্যাস অর্থে ‘ত্যাগ করা’; এবং ধর্মের দ্বারা যাহার এই সংসারে কিছুই সিদ্ধ হয় নাই, সে ত্যাগ করিবেই বা কি ?  অথবা যে ব্যক্তি ‘প্ৰপঞ্চ’ই (সাংসারিক কর্ম) ঠিক ঠিক সাধন করিতে পারে না, সেই “হতভাগ্য” পরমার্থও কি প্রকারে ঠিক সাধন করিবে [দাস|১২|১|১-১০ এবং ১২|৮|২১-৩১] ? কাহারও চরম উদ্দেশ্য বা সাধ্য সাংসারিকই হউক বা পারমার্থিকই হউক, ইহা সুস্পষ্ট যে, তাহা সিদ্ধ করিবার জন্য দীর্ঘ প্ৰযত্ন, মনোনিগ্রহ ও সামর্থ্য ইত্যাদি গুণের সমানই প্ৰয়োজন থাকে; এবং এই সকল গুণ যাহার নাই, সে কোন সাধ্যই প্ৰাপ্ত হইতে পারে না । ইহা স্বীকার করিলেও কেহ কেহ ইহা হইতে সম্মুখে চলিয়া বলেন যে, যখন দীর্ঘ প্ৰযত্ন ও মনোনিগ্রহের দ্বারা আত্মজ্ঞান হয়, তখন শেষে জগতের বিষয়োপভোগরূপ সমস্ত ব্যবহার অসার বলিয়া মনে হয়; এবং সৰ্প যেরূপ আপনি অব্যবহাৰ্য চর্ম ফেলিয়া দেয় সেইরূপ জ্ঞানীপুরুষও সমস্ত ঐহিক বিষয় ত্যাগ করিয়া কেবল পরমেশ্বর স্বরূপেই লীন হইয়া থাকেন [বৃ|৪|৪|৭] । জীবনযাত্রার এই মার্গে সমস্ত ব্যবহার ত্যাগ করিয়া শেষে কেবল জ্ঞানকেই প্রাধান্য দেওয়ায়, ইহাকে জ্ঞাননিষ্ঠা, সাংখ্যনিষ্ঠা কিংবা সমস্ত ব্যবহার ত্যাগ করিলে সন্ন্যাসনিষ্ঠাও বলা হয় । কিন্তু ইহার উল্টা গীতাশাস্ত্র বলেন যে, প্রথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য ‘ধর্ম’ আবশ্যক তো বটেই, কিন্তু পরে চিত্তশুদ্ধি হইলে পরও - নিজের জন্য বিষয়োপভোগরূপ ব্যবহার তুচ্ছ হইলেও - ঐ সমস্ত ব্যবহারই কেবল স্বধর্ম ও কর্তব্য বলিয়া লোকসংগ্ৰহাৰ্থ নিষ্কাম বুদ্ধিতে করা আবশ্যক । জ্ঞানীপুরুষ এইরূপ না করিলে, দৃষ্টান্ত দেখাইবার কেহই থাকিবে না, এবং সংসার বিনষ্ট হইবে । এই কর্মভূমিতে কর্ম কাহাকেও ছাড়ে না; এবং বুদ্ধি নিষ্কাম হইলে কোন কর্মই মোক্ষের অন্তরায় হইতে পারে না । তাই সংসারের কর্ম ত্যাগ না করিয়া অন্য লোকের ন্যায় জগতের সমস্ত ব্যবহার বিরক্তবুদ্ধিতে আমরণ করাই জ্ঞানীপুরুষেরও কর্তব্য হইয়া পড়ে । জীবনযাত্রার গীতোপদিষ্ট এই মাৰ্গকেই কর্মনিষ্ঠা কিংবা কর্মযোগ বলে । কিন্তু কর্মযোগ এইরূপ শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া বিবেচিত হইলেও উহার জন্য গীতাতে কোথাও সন্ন্যাসমার্গের নিন্দা করা হয় নাই । বরং উহাও মোক্ষ প্ৰদ বলা হইয়াছে । স্পষ্টই দেখা যায় যে, জগতের আরম্ভে সনৎকুমারাদি এবং পরে শুকযাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষি যে মার্গ স্বীকার করিয়াছেন তাহাকে ভগবানও সর্বথৈব ত্যাজ্য কিরূপে বলিবেন ? সাংসারিক ব্যবহার কাহারও নিকট নীরস বা মিষ্ট লাগা অংশত উহার প্রারব্ধ কর্মানুসারে প্রাপ্ত জন্মস্বভাবের উপর নির্ভর করে । এবং জ্ঞান হইলেও প্রারব্ধ কর্মের ভোগ না হইলে নিষ্কৃতি নাই ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । তাই এই প্রারব্ধকর্মানুসারে প্ৰাপ্ত জন্মস্বভাব হেতু কোন জ্ঞানী পুরুষের মনে সংসারে বিরক্তি উৎপন্ন হওয়ায় তিনি যদি সংসার ত্যাগ করেন তাহা হইলে তাঁহাকে নিন্দা করিয়া কোন ফল নাই । আত্মজ্ঞানের দ্বারা যে সিদ্ধপুরুষের বুদ্ধি নিঃসঙ্গ ও পবিত্র হইয়াছে তিনি অন্য কিছু করুন, বা না করুন; কিন্তু ইহা ভুলিলে চলিবে না যে তিনি মানববুদ্ধির শুদ্ধতার পরম সীমা, এবং স্বভাবতই বিষয়লুব্ধ দুর্ধর মনোবৃত্তিকে আপনার অধীনে রাখিবার সামর্থ্যের পরাকাষ্ঠা সকল লোকের প্ৰত্যক্ষ দৃষ্টির সম্মুখে আনিয়া দেন । তাঁহার এই কাজ লোকসংগ্রহের দৃষ্টিতেও ছোট নহে । সন্ন্যাসধর্ম সম্বন্ধে লোকের মধ্যে যে আদরবুদ্ধি আছে, ইহাই তাহার প্রকৃত কারণ; এবং মোক্ষ দৃষ্টিতে গীতারও ইহাই অভিমত । কিন্তু শুধু জন্মস্বভাবের প্রতি অর্থাৎ প্রারব্ধ কর্মেরই প্ৰতি লক্ষ্য না করিয়া, যিনি পূর্ণ আত্মস্বাতন্ত্র্য প্রাপ্ত হইয়াছেন সেই জ্ঞানীপুরুষ এই কর্মভূমিতে কিরূপ ব্যবহার করিবেন এই বিষয়ের শাস্ত্রীয় পদ্ধতিক্ৰমে বিচার করিলে, কর্মত্যাগ পক্ষ গৌণ এবং জগতের আরম্ভে মরীচি প্ৰভৃতি এবং পরে জনকাদির আচরিত কর্মযোগই জ্ঞানীপুরুষ লোকসংগ্ৰহাৰ্থ স্বীকার করেন, গীতার অনুসরণে এই সিদ্ধান্তই করিতে হয় । কারণ, এক্ষণে ন্যায়ত ইহাই বলিতে হয় যে, পরমেশ্বরের সৃষ্ট জগতের পরিচালন কাৰ্যও জ্ঞানীপুরুষেরই করিতে হইবে, এবং এই মাৰ্গে জ্ঞানসামর্থ্যের সঙ্গেই কর্মসামর্থ্যও অবিরোধে মিলিত থাকিবার কারণে, এই কর্মযোগ শুধু সাংখ্যমাৰ্গ অপেক্ষা কোথাও অধিক যোগ্য বলিয়া বিবেচিত হয় ।


19) সাংখ্য + নিষ্কাম কর্ম = কর্মযোগ


সাংখ্য ও কর্মযোগ এই দুই নিষ্ঠার মধ্যে যে মুখ্য ভেদ আছে তাহার উক্ত রীতি অনুসারে বিচার করিলে সাংখ্য + নিষ্কামকর্ম = কর্মযোগ, এই সমীকরণ নিষ্পন্ন হয়; এবং বৈশম্পায়নের উক্তি অনুসারে গীতার প্রবৃত্তিমূলক কর্মযোগের প্রতিপাদনে সাংখ্যনিষ্ঠার নিরূপণেরও সমাবেশ স্বাভাবিকভাবে হইয়া যায় [মভা|শাং|৩৪৮|৫৩] । এবং সেইজন্যই গীতার সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকাকারদিগের ইহা দেখাইবার বেশ সুবিধা হইয়াছে যে, তাঁহাদের সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাসমাৰ্গই গীতার প্রতিপাদ্য । গীতার যে শ্লোকগুলিতে কর্ম শ্ৰেয়স্কর নির্ধারণ করিয়া কর্ম করিতে বলা হইয়াছে, সেই শ্লোকগুলির প্রতি উপেক্ষা করিলে, অথবা সে সমস্ত অর্থবাদাত্মক অর্থাৎ আনুষঙ্গিক ও প্ৰশংসাত্মক এইরূপ নিজের ইচ্ছামত টিপ্পনী কাটিলে কিংবা অন্য কোন যুক্তি অবলম্বন করিয়া উক্ত সমীকরণের ‘নিষ্কাম কর্ম’কে উৎপাটিত করিয়া ফেলিলে ঐ সমীকরণের সাংখ্য = কর্মযোগ এই রূপান্তর হইয়া যায়; এবং গীতায় সাংখ্যমাৰ্গই প্ৰতিপাদিত, এইরূপ বলিবার সুযোগ হয় । কিন্তু এই রীতিতে গীতার যে অর্থ করা হয় তাহা গীতার উপক্ৰমোপসংহারের অত্যন্ত বিরুদ্ধ; এবং আমি এই গ্রন্থের স্থানে স্থানে স্পষ্টরূপে দেখাইয়াছি যে, গীতায় কর্মযোগকে গৌণ এবং সন্ন্যাসকে মুখ্য মনে করা, গৃহকর্তার গৃহে গৃহকর্তাকে অতিথি এবং অতিথিকে গৃহকর্তা মনে করা যেরূপ অসঙ্গত, সেইরূপ অসঙ্গত । যাঁহাদের মত এই যে, গীতাতে নিছক বেদান্ত, কেবল ভক্তি কিংবা শুধু পাতঞ্জল-যোগই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে তাঁহাদের এই মতের খণ্ডন আমি করিয়াই আসিয়াছি । 


20) গীতাতে কি নাই ? তথাপি শেষে কর্মযোগই প্রতিপাদ্য


গীতায় কোন্‌ বিষয় নাই ? বৈদিক ধর্মে মোক্ষ প্ৰাপ্তির যতগুলি সাধন বা মাৰ্গ আছে তন্মধ্যে প্রত্যেক মার্গের কোন-না-কোন অংশ গীতায় গৃহীত হইয়াছে; এবং ইহার পরেও “ভূতভৃন্ন চ ভূতস্থঃ” [গী|৯|৫] এই নীতি অনুসারে গীতার প্রকৃত রহস্য এই সমস্ত মাৰ্গ হইতে ভিন্নই হইয়াছে । জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষ হয় না সন্ন্যাসমার্গের অর্থাৎ উপনিষদের এই তত্ত্ব গীতার গ্রাহ্য; কিন্তু নিষ্কাম কর্মের সহিত তাহা জুড়িয়া দেওয়ায় গীতার ভাগবত ধর্মেই যতিধর্মেরও সমাবেশ সহজেই হইয়াছে । তথাপি গীতায় সন্ন্যাস ও বৈরাগ্যের অর্থ কর্মত্যাগ না করিয়া, ফলাশা ত্যাগ করাই প্ৰকৃত বৈরাগ্য বা সন্ন্যাস এইরূপ বলিয়া শেষে উপনিষৎকারদিগের কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মযোগ অধিক শ্ৰেয়স্কর এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে । বেদবিহিত যাগযজ্ঞাদি কর্ম কেবল যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠান করিলে বন্ধন হয় না, কর্মকাণ্ডী মীমাংসকদিগের এই মতও গীতার মান্য । কিন্তু গীতা ‘যজ্ঞ’ শব্দের অর্থ বিস্তৃত করিয়া উক্ত মতে এই এক সিদ্ধান্ত জুড়িয়া দিয়াছেন যে, ফলাশা ত্যাগ করিয়া সম্পাদিত সমস্ত কর্মই এক বৃহৎ যজ্ঞ হওয়ায় বর্ণাশ্রমবিহিত সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে সতত করাই মনুষ্যমাত্রের কর্তব্য । জগদুৎপত্তিক্ৰমবিষয়ে উপনিষৎকারদিগের অপেক্ষা সাংখ্যদিগের মতকে গীতা প্ৰাধান্য দিয়াছেন; তথাপি প্ৰকৃতি ও পুরুষেতেই না থামিয়া জগদুৎপত্তিক্রমের পরম্পরাকে উপনিষদের নিত্য পরমাত্মা পৰ্যন্ত আনিয়া পৌঁছাইয়া দিয়াছেন । অধ্যাত্ম জ্ঞান কেবল বুদ্ধির দ্বারা অর্জন করা ক্লেশকর হওয়ায় ভক্তি ও শ্রদ্ধা দ্বারা উহা অর্জন করিবার বিধি ভাগবত বা নারায়ণীয় ধর্মে উক্ত হইয়াছে । বাসুদেবভক্তির সেই বিধি গীতাতেও বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু এই বিষয়েও ভাগবতধর্মের সর্বাংশে নকল না করিয়া, বরঞ্চ বাসুদেব হইতে সংকর্ষণ বা জীব উৎপন্ন হইয়াছে, ভাগবতধর্মোক্ত জীবের উৎপত্তিসম্বন্ধীয় এই মত বেদান্তসূত্রের ন্যায় গীতাও ত্যাজ্য স্থির করিয়া ভাগবতধর্মোক্ত ভক্তির এবং উপনিষদের ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞসম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তের সম্পূর্ণ মিল স্থাপন করিয়াছেন । ইহা ব্যতীত মোক্ষপ্ৰাপ্তির অন্য সাধন পাতঞ্জল যোগ । কিন্তু পাতঞ্জল যোগই জীবনের মুখ্য কর্তব্য ইহা গীতার বক্তব্য না হইলেও, বুদ্ধিকে সম করিবার জন্য ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ আবশ্যক হওয়ায় সেইটুকুরই জন্য পাতঞ্জল যোগের যমনিয়মসনাদির উপযোগ করিয়া লও এইরূপ গীতা বলিয়াছেন । সারকথা, বৈদিক ধর্মে মোক্ষ প্ৰাপ্তির যে যে সাধন কথিত হইয়াছে সে সমস্তই কর্মযোগের সাঙ্গোপাঙ্গ আলোচনা করিবার সময় প্রসঙ্গানুসারে ন্যূনাধিক অংশে গীতায় বর্ণিত হইয়াছে । এই সমস্ত বর্ণনাকে স্বতন্ত্র বলিলে অসঙ্গতি উৎপন্ন হইয়া গীতার সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী এইরূপ প্ৰতীয়মান হয়; এবং এই বিশ্বাস বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক টীকা হইতে আরও দৃঢ় হইয়া যায় । কিন্তু আমার উপরি-কথিত অনুসারে যদি এই সিদ্ধান্ত করা যায় যে, ব্ৰহ্মজ্ঞান ও ভক্তির মিলন করাইয়া শেষে তদ্বারা কর্মযোগের সমর্থন করাই গীতার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয়, তাহা হইলে এই সমস্ত বিরোধ বিলুপ্ত হয়; এবং গীতাতে যে অলৌকিক কৌশলে পূর্ণ ব্যাপক দৃষ্টিতে তত্ত্বজ্ঞানের সহিত ভক্তি ও কর্মযোগের যথোচিত মিল করা হইয়াছে, তাহা দেখিয়া অবাক না হইয়া থাকা যায় না । গঙ্গায় গিয়া অন্য যত নদী মিলুক না কেন, তথাপি গঙ্গার স্বরূপের যেরূপ বদল হয় না, সেই প্ৰকার গীতারও কথা । তাহাতে যাহা কিছু সমস্ত থাকিলেও কর্মযোগই তাহার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । কর্মযোগই এইরূপ মুখ্য বিষয় হইলেও কর্মের সঙ্গে সঙ্গেই মোক্ষধর্মের মর্মও উহাতে সুন্দর রূপে নিরূপিত হওয়ায় কাৰ্য্যাকাৰ্য নির্ণয়াৰ্থ কথিত এই গীতাধর্মই - “স হি ধৰ্ম্মঃ সুপৰ্যাপ্তো ব্ৰহ্মণঃ পদবেদনে” [মভা|অশ্ব|১৬|১২] - ব্রহ্ম প্ৰাপ্তি করাইয়া দিতেও পূর্ণ সমর্থ; এবং অনুগীতার আরম্ভে ভগবান অর্জুনকে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, এই মার্গের অনুসরণকারীর মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য অন্য কোন অনুষ্ঠানেরই আবশ্যকতা নাই । 


21) সন্ন্যাসমার্গীদের নিকটে প্রার্থনা



ব্যবহারিক সমস্ত কর্মের তাগ না করিলে মোক্ষলাভ হইতে পারে না এইরূপ প্ৰতিপাদন যাহারা করে সেই সন্ন্যাসমার্গের লোকদিগের আমার এই উক্তি ভাল লাগিবে না, তাহা আমি জানি; কিন্তু তাহার উপায় নাই । গীতা গ্ৰন্থ সন্ন্যাসমার্গেরও নহে কিংবা অন্য কোন নিবৃত্তিমূলক পন্থারও নহে । জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পরেও কর্মসন্ন্যাস কেন করিবে না তাহার ব্ৰহ্মজ্ঞানদৃষ্টিতে সযুক্তিক উত্তর দিবার জন্যই গীতাশাস্ত্রের প্ৰবৃত্তি । তাই, সন্ন্যাসমাৰ্গাবলম্বীদিগের উচিত যে, তাহারা গীতাকেও ‘সন্ন্যাস দিবার’ গোলযোগে না ফেলিয়া ‘সন্ন্যাস প্ৰতিপাদক’ অন্য যে সব বৈদিক গ্ৰন্থ আছে, তাহাতেই সন্তুষ্ট থাকুক । অথবা গীতায় সন্ন্যাসমার্গকেও ভগবান্‌ যে নিরাভিমান বুদ্ধিতে নিঃশ্ৰেয়স্কর বলিয়াছেন সেই সমবুদ্ধিতেই সাংখ্যমার্গীদিগেরও ইহাই বলা উচিত যে, “শুধু যাহাতে জগতের কাজ চলে এইজন্যই পরমেশ্বর; এবং যখন তিনি সময়ে সময়ে এই জন্যই অবতার ধারণ করেন, তখন জ্ঞানোত্তর নিষ্কামবুদ্ধিতে ব্যবহারিক কর্ম করিতে থাকিবার যে মার্গের উপদেশ ভগবান গীতায় করিয়াছেন সেই মাৰ্গই কলিকালে যুক্তিসঙ্গত” এবং এইরূপ বলাই উহাদিগের পক্ষে সর্বাপেক্ষা উত্তম ।


ইতি চতুর্দশ প্রকরণ সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment