Sunday, June 4, 2017

ভাগবত ধর্মের উদয় ও গীতা (Advent of Bhagavata Dharma & Gita)

ভাগবত ধর্মের উদয় ও গীতা


সূচি


1) গীতার আপাত পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের সমন্বয়
1.1) কর্মকাণ্ডের পর জ্ঞানকাণ্ডের উৎপত্তি
1.2) যজ্ঞরূপ কর্মমার্গের সহিত জ্ঞানমার্গের বিরোধ
1.3) জ্ঞানমাৰ্গ হইতে যোগ ও ভক্তির উৎপত্তি
1.4) সারকথা
2) গীতায় প্ৰতিপাদিত সমস্ত ধর্মাঙ্গের মুল কি ?
2.1) ভাগবতধর্মেরই গ্রন্থ গীতা
2.2) ভাগবতধর্মসংক্রান্ত গ্ৰন্থ
2.3) ভাগবতধর্মের উৎপত্তি – শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা
2.4) ভাগবতধর্মের আবির্ভাবকাল
2.4.1) গ্রন্থের কালনিৰ্ণয়ে জ্যোতিঃশাস্ত্র
2.5) বিভিন্ন ধর্মাঙ্গের সঙ্গে ভাগবতধর্মের সমন্বয়
2.5.1) পাঞ্চরাত্র
2.5.2) জ্ঞান ও ভক্তির সহিত কর্মের মিলন
2.6) মূল-গীতার কাল
2.7) সারকথা


1) গীতার আপাত পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তের সমন্বয়


গীতারহস্যের অনেক স্থানে এবং এই প্রকরণেরও প্ৰথমে বলিয়াছি যে, উপনিষদের ব্ৰহ্মজ্ঞান ও কাপিল সাংখ্যের ক্ষরাক্ষর-বিচারের সঙ্গে ভক্তির এবং বিশেষত নিষ্কাম কর্মের মিল স্থাপন করিয়া, শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে কর্মযোগের পূর্ণ সমৰ্থন করাই গীতা গ্রন্থের মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । কিন্তু এত বিষয়ের সমন্বয় করিবার গীতার পদ্ধতিটি যাহাদের সম্পূর্ণ হৃদ্গত হয় না, এবং এত বিষয়ের  সমন্বয় করাই অসম্ভব বলিয়া যাহাদের প্রথম হইতেই ধারণা হয়, তাহাদের নিকট গীতার অনেক সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী বলিয়া প্রতীয়মান হয় । উদাহরণ যথা – এই আপত্তিকারীদের মত এই যে, এই জগতে যাহা কিছু আছে সে সমস্তই নির্গুণ ব্রহ্ম, ত্রয়োদশ অধ্যায়ের এই উক্তি – এই সমস্ত সগুণ বাসুদেবই, সপ্তম অধ্যায়ের এই উক্তির সম্পূর্ণ বিরোধী; এই প্রকার ভগবান একস্থলে বলিতেছেন যে, “আমার নিকট শত্রুমিত্র দুই-ই সমান[৯|২৯], আবার অন্য স্থানে ইহাও বলিতেছেন যে, “জ্ঞানী ও ভক্তিমান পুরুষ আমার অত্যন্ত প্ৰিয়[৭|১৭; ১২; ১২|১৯] - এই দুই উক্তি পরস্পর বিরোধী । কিন্তু গীতারহস্যে আমি অনেক স্থানে স্পষ্ট দেখাইয়াছি যে, বস্তুত ইহা বিরোধ নহে, কিন্তু একই বিষয়সম্বন্ধে একবার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে, আর একবার ভক্তিদৃষ্টিতে বিচার করায়, আপাতত এই বিরোধী বিষয় বলা হইয়াছে মনে হইলেও, শেষে ব্যাপক তত্ত্বজ্ঞানের দৃষ্টিতে গীতায় উহাদের মিলও স্থাপিত করা হইয়াছে । ইহার পরেও কেহ কেহ এই আপত্তি করেন যে, অব্যক্ত ব্ৰহ্মজ্ঞান ও ব্যক্ত পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তির মধ্যে উক্ত প্রকার মিল স্থাপিত হইলেও মূল গীতায় এই মিল স্থাপিত হওয়া সম্ভব নহে; কারণ মূল গীতা বর্তমান গীতার ন্যায় পরস্পরবিরোধবহুল ছিল না, তাহার মধ্যে বেদান্তীরা কিংবা সাংখ্যশাস্ত্ৰাভিমানীরা নিজ নিজ শাস্ত্রের অংশ পরে ঢুকাইয়া দিয়াছেন । উদাহরণ যথা - প্রো. গার্বে বলেন যে, মূল গীতায় কেবল সাংখ্য ও যোগেরই সহিত ভক্তির মিল স্থাপিত হইয়াছে, বেদান্তের সহিত এবং মীমাংসকদিগের কর্মমার্গের সহিত ভক্তির মিল স্থাপনের কাজ কেহ পরে করিয়াছেন । মূল গীতায় এই প্ৰকার যে শ্লোক পরে সন্নিবেশিত হইয়াছে, তাহার, নিজ মতানুসারে, এক তালিকাও তিনি জর্মন ভাষায় অনুবাদিত নিজের গীতার শেষে দিয়াছেন ! আমার মতে এই সমস্ত কল্পনা ভ্ৰান্তিমূলক । বৈদিক ধর্মের বিভিন্ন অঙ্গের ঐতিহাসিক পরম্পরা এবং গীতার ‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’ এই দুই শব্দের প্রকৃত অর্থ ঠিক না বুঝিবার কারণে, এবং বিশেষতঃ তত্ত্বজ্ঞানবিরহিত অর্থাৎ শুধু ভক্তিমূলক খৃষ্টধর্মেরই ইতিহাস উক্ত লেখকদিগের (প্রো. গার্বে প্রভৃতির) সম্মুখে থাকায় এই প্ৰকার ভ্ৰম উৎপন্ন হইয়াছে । মূল খৃষ্টধর্ম নিছক ভক্তিমূলক ছিল; এবং গ্ৰীকদিগের এবং অন্যদের তত্ত্বজ্ঞানের সহিত উহার মিল স্থাপন করিবার কাৰ্য পরে করা হইয়াছে । কিন্তু আমাদের ধর্মের কথা তাহা নহে । হিন্দুস্থানে ভক্তিমার্গের আবির্ভাবের পূৰ্বেই মীমাংসকদিগের যজ্ঞমাৰ্গ, উপনিষৎকারদিগের জ্ঞান, এবং সাংখ্য ও যোগ - এই সমস্ত পরিপক্ক অবস্থায় উপনীত হইয়াছিল । সেইজন্য প্ৰথম হইতেই আমাদের দেশবাসীদের স্বতন্ত্র রীতিতে প্ৰতিপাদিত এমন ভক্তিমাৰ্গ কখনও মান্য হওয়া সম্ভব ছিল না, যাহা এই সমস্ত শাস্ত্ৰ হইতে এবং বিশেষত উপনিষদসমূহে বৰ্ণিত ব্ৰহ্মজ্ঞান হইতে পৃথক । ইহার প্রতি লক্ষ্য করিলে, গীতার ধর্ম প্রতিপাদনের স্বরূপ প্রথম হইতেই প্ৰায় বর্তমান গীতার প্রতিপাদনের সমানই ছিল ইহা না মানিয়া থাকা যায় না । গীতারহস্যের বিচারও এই বিষয়েরই উপর দৃষ্টি রাখিয়া করা হইয়াছে । কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ববিশিষ্ট বলিয়া গীতাধর্মের মূলস্বরূপ ও পরম্পরা-সম্বন্ধে, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিচার করিলে, আমাদের মতে কোন্‌ কোন্‌ বিষয় নিষ্পন্ন হয় এখানে তাহা সংক্ষেপে বলা আবশ্যক ।


1.1) কর্মকাণ্ডের পর জ্ঞানকাণ্ডের উৎপত্তি


গীতারহস্যের দশম প্ৰকরণে আমি দেখাইয়াছি যে, বৈদিক ধর্মের অত্যন্ত প্রাচীন স্বরূপ না ছিল ভক্তিপ্রধান, না ছিল জ্ঞানপ্ৰধান এবং না ছিল যোগপ্রধান; কিন্তু উহা যজ্ঞময় অর্থাৎ কর্ম প্রধান ছিল, এবং বেদসংহিতা ও ব্ৰাহ্মণসমূহে বিশেষভাবে এই যাগযজ্ঞাদি কর্মমূলক ধর্মই প্রতিপাদিত হইয়াছে । পরে এই ধর্মই জৈমিনীয় মীমাংসাসূত্রে সুব্যবস্থিতরূপে আলোচিত হইয়াছে বলিয়া তাহার নাম হইল ‘মীমাংসকমাৰ্গ’ । কিন্তু ‘মীমাংসক’ এই নাম নূতন হইলেও, ইহা নিঃসন্দেহ যে, যাগযজ্ঞাদিধর্ম অত্যন্ত প্রাচীন; এমন কি, ঐতিহাসিকদৃষ্টিতে ইহাকে বৈদিক ধর্মের প্রথম সোপান বলা যাইতে পারে । ‘মীমাংসকমাৰ্গ’ নাম প্ৰাপ্ত হইবার পূর্বে উহার নাম ছিল ত্ৰয়ীধর্ম, অর্থাৎ তিন বেদের দ্বারা প্ৰতিপাদিত ধর্ম; এবং এই নামই গীতাতেও প্রদত্ত হইয়াছে [গী|৯|২০ ও ২১ দেখ] । কর্মময় ত্ৰয়ীধর্ম এইরূপ বহুল প্ৰচলিত থাকিলে পর, কর্মের দ্বারা অর্থাৎ কেবল যাগযজ্ঞাদির বাহ্য অনুষ্ঠানের দ্বারা পরমেশ্বরের জ্ঞানলাভ কিরূপে হইবে ? জ্ঞান লাভ একটা মানসিক অবস্থা হওয়ায় পরমেশ্বর-স্বরূপের বিচার করা ব্যতীত জ্ঞান হওয়া সম্ভব নহে, ইত্যাদি বিষয় ও কল্পনা বাহির হইতে লাগিল এবং ক্ৰমে ক্ৰমে উহারই মধ্য হইতে ঔপনিষদিক জ্ঞানের প্রাদুর্ভাব হইল । এই বিষয় ছান্দোগ্যাদি উপনিষদের প্রারম্ভে প্ৰদত্ত অবতারণা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় । এই  ঔপনিষদিক ব্রহ্মজ্ঞানই পরে ‘বেদান্ত’ নাম প্রাপ্ত হয় । কিন্তু মীমাংসা শব্দের ন্যায় বেদান্ত নাম পরে প্রচলিত হইলেও ইহা বলা যায় না যে, ব্ৰহ্মজ্ঞান কিংবা জ্ঞানমাৰ্গও নূতন । ইহা সত্য যে, কর্মকাণ্ডের পরই জ্ঞানকাণ্ড উৎপন্ন হইয়াছে, কিন্তু এই উভয়ই প্ৰাচীন, এ কথা যেন মনে থাকে । 


1.2) যজ্ঞরূপ কর্মমার্গের সহিত জ্ঞানমার্গের বিরোধ


কাপিল সাংখ্য’ এই জ্ঞানমার্গেরই অপর, কিন্তু স্বতন্ত্র, শাখা । গীতারহস্যে ইহা উক্ত হইয়াছে যে, এদিকে ব্রহ্মজ্ঞান অদ্বৈতী, ওদিকে সাংখ্য দ্বৈতী; এবং সৃষ্টির উৎপত্তিক্রম সম্বন্ধে সাংখ্যাদিগের বিচার মুলে ভিন্ন । কিন্তু ঔপনিষদিক অদ্বৈতী ব্ৰহ্মজ্ঞান এবং সাংখ্যের দ্বৈতী জ্ঞান, দুই-ই মূলে বিভিন্ন হইলেও কেবল জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখিলে বুঝা যায় যে, এই দুই মার্গ তৎপূর্ববর্তী যাগযজ্ঞাদি কর্মমার্গের সমানই বিরোধী ছিল । তাই, কর্মের সহিত জ্ঞানের মিল কিরূপে স্থাপন করা যাইবে, এই প্রশ্ন স্বভাবত উত্থিত হইল । এই কারণেই উপনিষদের কালেই এই বিষয়ে দুই পক্ষ হইয়াছিল । তন্মধ্যে বৃহদারণ্যকাদি উপনিষৎ ও সাংখ্য বলিতে লাগিলেন যে, কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যে নিত্য বিরোধ থাকায়, জ্ঞান হইলে পর কর্ম ছাড়িয়া দেওয়া শুধু প্ৰশস্ত নহে, কিন্তু আবশ্যকও । পক্ষান্তরে, ঈশাবাশ্যাদি অন্য উপনিষৎ প্ৰতিপাদন করিতে লাগিলেন যে, জ্ঞানোদয়ের পরেও কর্ম ছাড়িয়া দেওয়া যায় না, বৈরাগ্যযোগে বুদ্ধিকে নিষ্কাম করিয়া জগতে ব্যবহারসিদ্ধির নিমিত্ত জ্ঞানী ব্যক্তির সমস্ত কর্ম করাই কর্তব্য । এই সকল উপনিষদের ভাষাসমূহে এই ভেদ দূর করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে । কিন্তু গীতারহস্যের একাদশ প্রকরণের শেষে যে বিচার আছে তাহা হইতে উপলব্ধি হইবে যে, শাঙ্করভাষ্যের এই সাম্প্রদায়িক অর্থ টানা-বোনা করিয়া করা; এবং এইজন্য এই সকল উপনিষদের উপর স্বতন্ত্র রীতিতে বিচার করিবার সময় ঐ অর্থ গ্ৰাহ্য বলিয়া মানা যাইতে পারে না । শুধু যাগযজ্ঞাদি কর্ম ও ব্ৰহ্মজ্ঞানেরই মধ্যে মিল স্থাপনের চেষ্টা হইয়াছিল তাহা নহে; কিন্তু মৈত্র্যুপনিষদের বিচার আলোচনা হইতে ইহাও সুস্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, কাপিল সাংখ্যে প্ৰথম প্ৰথম স্বতন্ত্ররীতিতে উৎপন্ন ক্ষরাক্ষরজ্ঞান এবং উপনিষদের ব্ৰহ্মজ্ঞানের সমন্বয় - যতটা সম্ভব - করিবারও প্ৰযত্ন এই সময়েই আরম্ভ হইয়াছিল । বৃহদারণ্যকাদি প্ৰাচীন উপনিষদসমূহে কাপিল সাংখ্যজ্ঞানের কোন প্রাধান্য দেওয়া হয় নাই । কিন্তু মৈক্র্যুপনিষদে সাংখ্যদিগের পরিভাষা সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করিয়া বলা হইয়াছে যে, শেষে এক পরব্রহ্ম হইতেই সাংখ্যদিগের চতুর্বিংশ তত্ত্ব নির্মিত হইয়াছে । তথাপি কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রও বৈরাগ্যমূলক অর্থাৎ কর্মের বিরুদ্ধ । তাৎপৰ্য এই যে, প্ৰাচীনকালেই বৈদিক ধর্মের তিন দল হইয়াছিল – 
(১) কেবল যাগযজ্ঞাদি কর্ম করিবার মার্গ;
(২) জ্ঞান ও বৈরাগ্যযোগে কর্মসন্ন্যাস করা অর্থাৎ জ্ঞাননিষ্ঠা বা সাংখ্যমার্গ;
(৩) জ্ঞানযোগে ও বৈরাগ্যবুদ্ধিতেই নিত্য কর্ম করিবার মার্গ অর্থাৎ জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়ের মাৰ্গ ।


1.3) জ্ঞানমাৰ্গ হইতে যোগ ও ভক্তির উৎপত্তি


উপরিউক্ত তিন দলের মধ্যে জ্ঞানমাৰ্গ হইতেই পরে অন্য দুই শাখা - যোগ ও ভক্তি - উৎপন্ন হইয়াছে । ছান্দোগ্যাদি প্ৰাচীন উপনিষদে উক্ত হইয়াছে যে, পরব্রহ্মের জ্ঞানলাভের জন্য ব্ৰহ্মচিন্তন অত্যন্ত আবশ্যক; এবং এই চিন্তন, মনন ও ধ্যান করিবার জন্য চিত্তকে একাগ্র করা আবশ্যক; এবং চিত্তকে স্থির করিবার জন্য পরব্রহ্মের কোন একটি সগুণ প্ৰতীক প্ৰথমে চোখের সম্মুখে রাখিবে । এই প্ৰকার ব্রহ্মোপাসনা করিতে থাকিলে চিত্তের যে একাগ্ৰতা হয়, পরে তাহাকেই বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হইতে লাগিল এবং চিত্তনিরোধ রূপ যোগ একটি ভিন্ন মার্গ হইয়া পড়িল; এবং যখন সগুণ প্রতীকের পরিবর্তে মানবরূপধারী ব্যক্ত প্রতীকের উপাসনা আরম্ভ হইতে লাগিল, তখন শেষে ভক্তিমাৰ্গ বাহির হইল । এই ভক্তিমাৰ্গ ঔপনিষদিক জ্ঞান হইতে পৃথক, মাঝখান হইতে স্বতন্ত্ররূপে উৎপন্ন হয় নাই; এবং ভক্তির কল্পনাও অন্য কোন দেশ হইতে ভারতবর্ষে আসে নাই । সমস্ত উপনিষদ দেখিলে এই ক্রম দেখা যায় যে, প্রথমে ব্ৰহ্মচিন্তনের নিমিত্ত যজ্ঞের অঙ্গসমূহের কিংবা ওঁকারের, পরে রুদ্র, বিষ্ণু ইত্যাদি বৈদিক দেবতার, অথবা আকাশাদি সগুণ ব্যক্ত ব্ৰহ্মপ্রতীকের উপাসনা শুরু হয়; এবং শেষে এই কারণেই অর্থাৎ ব্ৰহ্ম প্ৰাপ্তির জন্যই রাম, নৃসিংহ, শ্ৰীকৃষ্ণ, বাসুদেব প্রভৃতির ভজন, অর্থাৎ এক প্রকার উপাসনা, প্রচলিত হইয়াছে । উপনিষদসমূহের ভাষা হইতে ইহাও স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, উহাদের মধ্যে যোগতত্ত্বাদি যোগসম্বন্ধীয় উপনিষদ এবং নৃসিংহতাপনী, রামতাপনী প্রভৃতি ভক্তিসম্বন্ধীয় উপনিষৎ ছান্দোগ্যাদি উপনিষৎ অপেক্ষা অর্বাচীন । অতএব ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বলিতে হয় যে, ছান্দোগ্যাদি প্ৰাচীন উপনিষদে বর্ণিত কর্ম, জ্ঞান কিংবা সন্ন্যাস, এবং জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয় এই তিন দলের উদ্ভব হইবার পরেই যোগমার্গ ও ভক্তিমাৰ্গ প্ৰাধান্য লাভ করিয়াছিল । কিন্তু যোগ ও ভক্তি, এই দুই সাধন এই রূপে শ্রেষ্ঠ স্বীকৃত হইলেও তৎপূর্ববর্তী ব্ৰহ্মজ্ঞানের শ্রেষ্ঠতার কিছুমাত্র লাঘব হয় নাই এবং হইবার সম্ভাবনাই ছিল না । তাই, যোগপ্ৰধান ও ভক্তিপ্রধান উপনিষদেও ব্ৰহ্মজ্ঞানকে ভক্তি ও যোগের অন্তিম সাধ্য বলা হইয়াছে; এবং এরূপ বৰ্ণনাও কয়েক স্থলে পাওয়া যায় যে, যে রুদ্র, বিষ্ণু, অচ্যুত, নারায়ণ ও বাসুদেব প্রভৃতির ভজনা করা হয়, তাহাও পরমাত্মার কিংবা পরব্রহ্মের রূপ [মৈক্র্যু|৭|৭; রামপূ|১৬; অমৃতবিন্দু|২২ প্রভৃতি দেখ]


1.4) সারকথা


বৈদিক ধর্মে সময়ে সময়ে আত্মজ্ঞানী পুরুষেরা যে ধর্মাঙ্গসকল প্ৰবর্তিত করিয়াছিলেন, তাহা প্ৰাচীন সময়ে প্ৰচলিত ধর্মাঙ্গ হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে; এবং প্রাচীন কালে প্ৰচলিত ধর্মাঙ্গের সহিত নব ধর্মাঙ্গের মিল করাই বৈদিক ধর্মের অভিবৃদ্ধির আরম্ভ হইতে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল; এবং বিভিন্ন ধর্মাঙ্গের সমন্বয় করিবার এই উদ্দেশ্যকেই স্বীকার করিয়া পরে স্মৃতিকারেরা আশ্রমব্যবস্থাধর্মের প্রতিপাদন করিয়াছেন, বিভিন্ন ধর্মাঙ্গসমূহের সমন্বয় করিবার এই প্রাচীন পদ্ধতির প্রতি লক্ষ্য করিলে একমাত্র গীতাধর্মই উক্ত পূর্বাপর পদ্ধতিকে ছাড়িবার কার্যে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে এরূপ বলা সযুক্তিক নহে ।


2) গীতায় প্ৰতিপাদিত সমস্ত ধর্মাঙ্গের মুল কি ?


ব্ৰাহ্মণগ্রন্থের যাগযজ্ঞাদি কর্ম, উপনিষদের ব্ৰহ্মজ্ঞান, কাপিল সাংখ্য, চিত্তনিরোধরূপ যোগ ও ভক্তি, ইহাই বৈদিক ধর্মের মুখ্য মুখ্য অঙ্গ এবং ইহাদের উৎপত্তিক্রমের সাধারণ ইতিহাস উপরে বলা হইয়াছে । এক্ষণে, গীতায় প্ৰতিপাদিত এই সমস্ত ধর্মাঙ্গের মুল কি - অৰ্থাৎ ঐ প্রতিপাদন সাক্ষাৎ বিভিন্ন উপনিষৎ হইতে গীতায় গৃহীত হইয়াছে কিংবা মাঝে তাহার আরও দুই এক সোপান আছে - তাহার বিচার করিব । শুধু ব্ৰহ্মজ্ঞানের বিচারের সময় কঠাদি উপনিষদের কোন কোন শ্লোক গীতায় যেমনটি তেমনি গৃহীত হইয়াছে এবং জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়পক্ষের প্রতিপাদন করিবার সময় জনকাদির ঔপনিষদিক দৃষ্টান্তও প্রদত্ত হইয়াছে । ইহা হইতে প্ৰতীত হয় যে, গীতা গ্ৰন্থ সাক্ষাৎ উপনিষৎ অবলম্বনেই রচিত হইয়া থাকিবে । কিন্তু গীতাতেই প্রদত্ত গীতাধর্মের পরম্পরাতে তো কোথাও উপনিষদের উল্লেখ নাই । যেরূপ গীতায় দ্রব্যময় যজ্ঞাপেক্ষা জ্ঞানময় যজ্ঞ শ্রেষ্ঠ ধরা হইয়াছে [গী|৪|৩৩], সেইরূপ ছান্দোগ্যোপনিষদেও একস্থানে [ছাং|৩|১৬|১৭] মনুষ্যের জীবন এক প্রকার যজ্ঞই এইরূপ বলিয়া এই প্রকার যজ্ঞের মাহাত্ম্য বর্ণনা করিবার সময় “এই যজ্ঞবিদ্যা ঘোর আঙ্গিরস নামক ঋষি, দেবকী-পুত্র কৃষ্ণকে বলিয়াছিলেন” ইহাও উক্ত হইয়াছে । এই দেবকীপুত্ৰ কৃষ্ণ এবং গীতার শ্ৰীকৃষ্ণ একই মনে করিবার কোন প্ৰমাণ নাই । কিন্তু ক্ষণকালের জন্য উভয়কে একই ব্যক্তি মানিয়া লইলেও, যে গীতা জ্ঞানযজ্ঞকে প্রধান মনে করেন সেই গীতায় ঘোর আঙ্গিরসের কোথাও উল্লেখ নাই এ কথা মনে রাখা উচিত । তাছাড়া, বৃহদারণ্যকোপনিষৎ হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, জনকের মাৰ্গ জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক হইলেও, সে সময়ে এই মার্গে ভক্তির সমাবেশ হয় নাই । তাই, ভক্তিযুক্ত জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় পন্থার সাম্প্রদায়িক পরম্পরায় জনকের গণনা করা যাইতে পারে না - এবং তাহা গীতাতেও করা হয় নাই । 


2.1) ভাগবতধর্মেরই গ্রন্থ গীতা


গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের আরম্ভে উক্ত হইয়াছে [গী|৪|১-৩] যে, গীতাধর্ম যুগারম্ভে ভগবান প্ৰথমে বিবস্বানকে, বিবস্থান মনুকে, এবং মনু ইক্ষাকুকে উপদেশ করিয়াছিলেন; কিন্তু কালের হেরফেরে তাহা নষ্ট হইয়া যাওয়ায়, তাহা অর্জুনকে পুনর্বার বলিতে হইয়াছিল । গীতাধর্মের পরম্পরা বুঝিবার পক্ষে এই শ্লোক অত্যন্ত প্ৰয়োজনীয়; কিন্তু টীকাকারেরা উহাদের শব্দাৰ্থ বলা ছাড়া বেশী কিছু খুলিয়া বলেন নাই; এবং সেদিকে তাঁহাদের ইচ্ছাও ছিল না । কারণ, গীতাধর্ম মূলে কোন বিশিষ্ট পন্থার ছিল এরূপ বলিলে, উহা হইতে অন্য ধর্মপন্থার ন্যূনাধিক লাঘব না হইয়া যায় না । কিন্তু আমি গীতারহস্যের আরম্ভে এবং গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম দুই শ্লোকের টীকায় প্রমাণসহ স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছি যে, গীতার এই পরম্পরার মহাভারতের অন্তৰ্গত নারায়ণীয় উপাখ্যানে বর্ণিত ভাগবতধর্মের পরম্পরায় অন্তিম ত্রেতাযুগের যে পরম্পরা দেওয়া হইয়াছে তাহার সহিত সম্পূর্ণরূপে মিল আছে । ভাগবতধর্মের ও গীতাধর্মের পরম্পরার এই ঐক্য দেখিলে গীতা গ্ৰন্থকে ভাগবতধর্মেরই গ্রন্থ বলিতে হয়; এবং সেই সম্বন্ধে কোন সংশয় থাকিলে, “গীতায় ভাগবতধর্মই বিবৃত হইয়াছে[মভা|শাং|৩৪৭|১০] মহাভারতে প্রদত্ত বৈশম্পাতনের এই বাক্য হইতে তাহা সম্পূর্ণরূপে বিদূরিত হয় । গীতা ঔপনিষদিক জ্ঞানের অর্থাৎ বেদান্তের স্বতন্ত্র গ্ৰন্থ নহে - উহাতে ভাগবতধর্ম প্ৰতিপাদিত হইয়াছে এইরূপ সিদ্ধ হইলে পর, ভাগবতধর্ম হইতে পৃথক করিয়া গীতার যে কোন সমালোচনা হইবে তাহা অপূর্ণ ও ভ্রান্তিমূলক হইবে তাহা আর বলিতে হইবে না । অতএব ভাগবতধর্ম কখন্‌ উৎপন্ন হইয়াছে এবং তাহার মূলস্বরূপ কি ছিল ইত্যাদি প্রশ্ন সম্বন্ধে যে সকল বিষয় একালে উপলব্ধ হয়, তাহাদেরও বিচার সংক্ষেপে করিতে হইবে । এই ভাগবত ধর্মেরই অন্য নাম ছিল - নারায়ণীয়, সাত্বত, পাঞ্চরাত্ৰধর্ম ইত্যাদি, তাহা গীতারহস্যে আমি পূর্বেই বলিয়াছি ।


2.2) ভাগবতধর্মসংক্রান্ত গ্ৰন্থ


উপনিষৎকালের পর ও বুদ্ধের পূর্বে রচিত বৈদিক ধর্মগ্রন্থের মধ্যে অনেকগুলি লুপ্ত হওয়ায়, ভাগবতধর্মসংক্রান্ত গ্ৰন্থ যাহা এক্ষণে পাওয়া যায়, তন্মধ্যে, গীতা ব্যতীত মুখ্য গ্ৰন্থ হইতেছে —মহাভারতান্তর্গত শান্তিপর্বের শেষ অষ্টাদশ অধ্যায়ে নিরূপিত নারায়ণীয়োপাখ্যান [মভা|শা|৩৩৪-৩৫১], শাণ্ডিল্যসূত্র, ভাগবত-পুরাণ, নারদপাঞ্চরাত্ৰ, নারদসূত্র এবং রামানুজাচার্যাদির গ্ৰন্থ । তন্মধ্যে রামানুজাচার্যের গ্রন্থ তো প্ৰত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতেই অর্থাৎ ভাগবতধর্মের বিশিষ্টাদ্বৈত বেদান্তের সহিত মিল স্থাপনের জন্য ১৩৩৫ বিক্রম সম্বতে (শালিবাহন শকের প্রায় দ্বাদশ শতাব্দীতে) লিখিত হইয়াছে । তাই, ভাগবতধর্মের মূলস্বরূপ স্থির করিবার জন্য এই গ্রন্থের উপর নির্ভর করা যায় না; এবং মাধ্বাদি অন্য বৈষ্ণব গ্রন্থেরও এই কথাই । শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ ইহার পূর্ববর্তী; কিন্তু এই পুরাণের আরম্ভেই এই কথা আছে যে [ভাগ|স্কং|১অ|৪ ও ৫ দেখ]
“মহাভারতে সুতরাং গীতাতেও, নৈষ্কর্ম্যমূলক ভাগবতধর্মের যে নিরূপণ করা হইয়াছে তাহাতে ভক্তির যথোচিত বর্ণনা নাই, এবং ‘ভক্তি ব্যতীত শুধু নৈষ্কর্ম্য শোভা পায় না’ ইহা দেখিয়া ব্যাসের মন কিছু উদাস ও অপ্রসন্ন হইয়া গেল; এবং নিজের মনের এই বিক্ষোভ দূর করিবার জন্য নারদের কথা-মত তিনি ভক্তির মাহাত্ম্য প্ৰতিপাদক ভাগবত পুরাণ রচনা করিলেন ।”
ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে এই কথার বিচার করিলে দেখা যাইবে যে, মূল অর্থাৎ মহাভারতের ভাগবতধর্মে নৈষ্কর্মের যে প্রাধান্য দেওয়া হইয়াছিল তাহা কালান্তরে হ্রাস হইয়া এবং তাহার স্থানে ভক্তির প্রাধান্য যখন আসিল তখন ভাগবতধর্মের এই অন্য স্বরূপের (অর্থাৎ ভক্তি প্ৰধান ভাগবতধর্মের) প্ৰতিপাদন করিবার জন্য এই ভাগবত-পুরাণরূপ সুমধুর পুলীপিঠা পরে রচিত হইয়াছিল । নারদপঞ্চরাত্ৰ গ্ৰন্থ ও এই প্রকারের অর্থাৎ শুদ্ধ ভক্তিমূলক; এবং উহাতে দ্বাদশস্কন্ধীয় ভাগবতপুরাণের এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, গীতা ও মহাভারতের নামতঃ স্পষ্ট নির্দেশ করা হইয়াছে [না|পং|২|৭|২৮-৩২; ৩|১৪|৭৩; এবং ৪|৩|১৫৪ দেখ] । কাজেই ইহা সুস্পষ্ট যে, ভাগবতধর্মের মূলস্বরূপ স্থির করিবার পক্ষে এই গ্ৰন্থ ভাগবত-পুরাণ অপেক্ষাও কম উপযোগী । নারদসূত্র ও শাণ্ডিল্যসূত্র এই দুই গ্রন্থ নারদ-পঞ্চরাত্র অপেক্ষাও সম্ভবতঃ কিছু প্রাচীনতর; কিন্তু নারদসূত্রে ব্যাস ও শুকের [না|সূ|৮৩] উল্লেখ থাকায় উহা ভারত ও ভাগবতের পরবর্তী; এবং শাণ্ডিল্যসূত্রে ভগবদ্গীতার শ্লোকই গৃহীত হওয়ায় [শা|সূ|৯|১৫ ও ৮৩] এই সূত্র নারদসূত্রাপেক্ষা [না|সূ|৮৩] প্রাচীন হইলেও গীতা ও মহাভারতের যে পরবর্তী তাহাতে সন্দেহ নাই । তাই, ভাগবতধর্মের মূল ও প্রাচীন স্বরূপ কি তাহার নির্ণয় শেষে মহাভারতের অন্তৰ্গত নারায়ণীয় আখ্যানের ভিত্তিতেই করিতে হয় । ভাগবতপুরাণ [১|৩|২৪] এবং নারদপঞ্চরাত্র [৪|৩|১৫৬-১৫৯; ৪|৮|৮১] এই দুই গ্রন্থে বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার বলা হইয়াছে । কিন্তু নারায়ণীয় আখ্যানে বর্ণিত দশাবতারের মধ্যে বুদ্ধের গণনা নাই - প্ৰথম অবতার হংস এবং পরে কৃষ্ণের পর একেবারেই কল্কি অবতারের উল্লেখ করা হইয়াছে [মাভা|শাং|৩৩৯|১০০] । ইহা হইতেও সিদ্ধ হয় যে, নারায়ণীয় আখ্যান ভাগবতপুরাণ ও নারদপঞ্চরাত্র হইতে প্রাচীন । এই নারায়ণীয় আখ্যানে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, পরব্রহ্মেরই অবতার যে নরনারায়ণ নামক দুই ঋষি, তাঁহারাই নারায়ণীয় অর্থাৎ ভাগবতধর্ম সর্বপ্রথম প্ৰবর্তিত করেন, এবং তাঁহাদের কথামত নারদ ঋষি শ্বেতদ্বীপে গমন করিলে পর সেখানে স্বয়ং ভগবান নারদকে এই ধর্মের উপদেশ করেন । যে শ্বেতদ্বীপে ভগবান থাকেন সেই দ্বীপ ক্ষীরসমুদ্রে অবস্থিত, এবং সেই ক্ষীরসমুদ্র মেরুপর্বতের উত্তরে অবস্থিত, ইত্যাদি নারায়ণীয় আখ্যানের অন্তৰ্গত বৰ্ণনা প্ৰাচীন পৌরাণিক ব্ৰহ্মাণ্ডবৰ্ণনারই অনুযায়ী এবং সেই সম্বন্ধে আমাদের এখানে কাহারও কিছুই বলিবার নাই । কিন্তু বেবর নামক পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত এই কথার বিপৰ্যয় করিয়া এই এক দীর্ঘ আশঙ্কা করিয়াছিলেন যে, ভাগবতধর্মের ভক্তিতত্ত্ব শ্বেতদ্বীপ হইতে অর্থাৎ ভারতবর্ষবহির্ভূত কোন এক দেশ হইতে ভারতবর্ষে আনীত হইয়াছিল, এবং ভক্তির এই তত্ত্ব তৎকালে খৃষ্টধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্মে প্ৰচলিত ছিল না, অতএব খৃষ্টানদেশ হইতেই ভক্তির কল্পনা ভাগবদধর্মীদের মনে আসিয়াছিল ! কিন্তু পাণিনি বাসুদেবভক্তিতত্ত্বের কথা অবগত ছিলেন এবং বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেও ভাগবদধর্মের ও ভক্তির উল্লেখ আছে; এবং পাণিনি ও বুদ্ধ ইহাঁরা দুইজনেই খৃষ্টের পূর্ববর্তী লোক ছিলেন ইহা নির্বিবাদ । এইজন্য বেবরের উক্ত সংশয় পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাই এখন ভিত্তিহীন বলিয়া স্থির করিয়াছেন । ভক্তিরূপ ধর্মাঙ্গ আমাদের এখানে জ্ঞানমূলক উপনিষদের পরে বাহির হইয়াছে ইহা উপরে বলিয়াছি । তাই ইহা নির্বিবাদরূপে প্ৰকাশ পাইতেছে যে, জ্ঞানমূলক উপনিষদের পর এবং বুদ্ধের পূর্বে বাসুদেব-ভক্তিমূলক ভাগবতধর্ম বাহির হইয়াছে । এখন কেবল ইহাই প্রশ্ন যে, উহা বুদ্ধের কত শতাব্দী, পূর্বে উৎপন্ন হইয়াছে ? পরবর্তী আলোচনা হইতে ইহা উপলব্ধি হইবে যে, উক্ত প্রশ্নের সম্পূর্ণ নিশ্চয়াত্মক উত্তর দিতে না পারিলেও মোটামুটি ধরণে এই কালের অনুমান করা অসম্ভবও নহে ।

(ভক্তিমান্‌ (পালী - ভত্তিমা) শব্দ থেরগাথায় [শ্লো|৩৭০] প্রদত্ত হইয়াছে এবং একটি জাতকেও ভক্তির উল্লেখ আছে । তাছাড়া প্ৰসিদ্ধ ফ্রেঞ্চ পালীপণ্ডিত সেনার্ট (Senart) ‘বৌদ্ধধর্মের মূল’ এই বিষয়ের উপর ১৯০৯ অব্দে যে বক্তৃতা করেন তাহাতে বৌদ্ধধর্মের পূর্বে ভাগবতধর্ম বাহির হইয়াছে ইহা স্পষ্ট প্রতিপাদন করিয়াছেন । “No one will claim to derive from Buddhism, Vishnuism or the Yoga. Assuredly Buddhism is the borrower....... To sum up, if there had not previously existed a religion made up of doctrines of yoga, of Vishnuite legends, of devotion to Vishnu-Krishna, worshipped under the title of Bhagavata, Buddhism would not have come to birth at all.” সেনার্টের এই প্রবন্ধ, পুণায় প্রকাশিত “The Indian Interpreter” নামক মিশনারী ত্রৈমাসিকের অক্টোবর ১৯০৯ ও জানুয়ারী ১৯১০-এর সংখ্যায় ভাষান্তরে প্রকাশিত হয়; এবং উপরি-প্রদত্ত বাক্য জানুয়ারীর সংখ্যায় পৃঃ ১৭৭ ও ১৭৮ – পাওয়া ডাঃ বুহ্লরও বলিয়াছেন – “The ancient Bhagabata, Satvata of Pancha-ratra sect devoted to the worship of Narayan and his deified teacher Krishna-Devakiputra dates from a period long anterior to the rise of Jainas in the 8th Century B. C.”-Indian Antiquary Vol. XXIII (1894) P.248. এই সম্বন্ধে অধিক বিচার পরে এই পরিশিষ্টেরই ষষ্ঠ ভাগে করিয়াছি ।) 


2.3) ভাগবতধর্মের উৎপত্তি – শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা


গীতায় উক্ত হইয়াছে যে, শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে যে ভাগবতধর্মের উপদেশ করিয়াছেন তাহা প্ৰথমে লুপ্ত হইয়াছিল [গী|৪|২]ভাগবতধর্মের তত্ত্বজ্ঞানে পরমেশ্বর বাসুদেব নামে, জীবাত্মা সংকর্ষণ নামে, মন প্রদ্যুম্ন নামে এবং অনিরুদ্ধ নামে অভিহিত হইয়াছে । তন্মধ্যে বাসুদেব স্বয়ং শ্ৰীকৃষ্ণেরই নাম, সংকর্ষণ তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বলরামের, এবং প্রদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ শ্ৰীকৃষ্ণের পুত্র ও পৌত্রের নাম । ইহা ব্যতীত এই ধর্মের ‘সাত্বত’ বলিয়া যে আরও এক নাম আছে, তাহা শ্ৰীকৃষ্ণ যে যাদবজাতিতে জন্মিয়াছিলেন সেই জাতির নাম । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, শ্ৰীকৃষ্ণ যে কুলে ও জাতিতে জন্মিয়াছিলেন, তাহার মধ্যেই এই ধর্ম প্ৰচলিত হইয়া গিয়াছিল । এবং তখনই শ্ৰীকৃষ্ণ আপনার প্রিয়মিত্ৰ অর্জুনকে উহার উপদেশ করিয়া থাকিবেন; এবং ইহাই পৌরাণিক কথাতেও উক্ত হইয়াছে । এই কথাও প্রচলিত আছে যে, শ্ৰীকৃষ্ণের সঙ্গেই সাত্বত জাতির শেষ হইয়াছিল, এই কারণে শ্ৰীকৃষ্ণের পরে সাত্বত জাতির মধ্যে এই ধর্মের প্রসার হওয়াও সম্ভব ছিল না । ভাগবতধর্মের বিভিন্ন নামের সম্বন্ধে এই প্রকার ঐতিহাসিক উপপত্তি দেওয়া যাইতে পারে যে, শ্ৰীকৃষ্ণ যে ধর্ম প্ৰবর্তিত করিয়াছিলেন, তৎপূর্বে বোধ হয় তাহা নারায়ণীয় কিংবা পাঞ্চরাত্র নামে ন্যূনাধিক পরিমাণে প্রচলিত হইয়াছিল, এবং পরে সাত্বতজাতির মধ্যে উহার প্রসার হইলে পর, উহার ‘সাত্বত’ নাম হইয়া থাকিবে, এবং তাহার পর, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এবং অর্জুনকে নর-নারায়ণেরই অবতার মানিয়া লোকেরা এই ধর্মকে ‘ভাগবতধর্ম’ বলিতে আরম্ভ করিয়া থাকিবে । এই বিষয়ে ইহা মনে করিবার কোনই প্ৰয়োজন নাই যে, তিন বা চারি ভিন্ন ভিন্ন শ্ৰীকৃষ্ণ হইয়াছিলেন, তন্মধ্যে প্রত্যেকে এই ধর্ম প্রচার করিবার সময় নিজের দিক হইতে কিছু না-কিছু সংস্কার করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন - বস্তুত এরূপ মনে করিবার কোন প্রমাণও নাই । মূলধর্মে ন্যূনাধিক পরিবর্তন হইবার কারণেই এই কল্পনা উৎপন্ন হইয়াছে । বুদ্ধ, খৃষ্ট কিংবা মহম্মদ তো স্বয়ং একা-একাই নিজ নিজ ধর্মের সংস্থাপক হইয়াছিলেন এবং পরে তাঁহাদের ধর্মে ভালমন্দ অনেক পরিবর্তনও ঘটিয়াছিল; কিন্তু সেই কারণে কেহ স্বীকার করেন না যে, বুদ্ধ, খৃষ্ট বা মহম্মদ একাধিক ছিলেন । সেই প্রকার মূল ভাগবতধর্ম পরে ভিন্ন ভিন্ন রূপ প্ৰাপ্ত হইয়াছিল বলিয়া অথবা শ্ৰীকৃষ্ণ সম্বন্ধে পরে ভিন্ন ভিন্ন কল্পনা প্ৰসিদ্ধ হইয়াছিল বলিয়া ততগুলি শ্ৰীকৃষ্ণ ও হইয়াছিলেন, ইহা কিরূপে মানা যায় ? আমার মতে ইহা মনে করিবার কোনই কারণ নাই । যে কোন ধর্মই হোক না কেন, কালের হেরফেরে তাহার রূপান্তর হওয়া খুবই স্বাভাবিক; তাহার জন্য ভিন্ন ভিন্ন কৃষ্ণ, বুদ্ধ বা খৃষ্ট স্বীকার করিবার আবশ্যকতা নাই । 
(শ্ৰীকৃষ্ণের চরিত্রে পরাক্রম, ভক্তি ও বেদান্তের অতিরিক্ত গোপীদিগের রাসক্রীড়ার সমাবেশ হইয়া থাকে এবং এই সকল কথা পরস্পরবিরোধী, তাই মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ ভিন্ন, গীতার শ্ৰীকৃষ্ণ ভিন্ন, এবং গোকুলের কানাই ভিন্ন, এইরূপ আজকাল কতকগুলি বিদ্বান ব্যক্তি প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন । এই মতই ডাঃ ভাণ্ডারকর স্বকীয় ‘বৈষ্ণব শৈব প্রভৃতি পন্থা’ সম্বন্ধীয় ইংরাজী গ্রন্থে স্বীকার করিয়াছেন । কিন্তু আমার মতে ইহা ঠিক নহে । গোপীদের কথার মধ্যে যে সকল শৃঙ্গারের বর্ণনা আছে তাহা পরে আসে নাই, সে কথা নহে; কিন্তু সেই জন্যই শ্ৰীকৃষ্ণ নামের বিভিন্ন ব্যক্তি হইয়াছিলেন এরূপ মনে করিবার আবশ্যকতা নাই, এবং শুধু কল্পনা ছাড়া তাহার অন্য প্রমাণও নাই । তাছাড়া, গোপীদের কথা ভাগবতকালেই প্রথমে প্রচারিত হইয়াছিল এরূপও নহে; কিন্তু শক-কালের আরম্ভে, অর্থাৎ অনুমানিক বিক্ৰম ১৩৬ সম্বতে অশ্বঘোষ-লিখিত বুদ্ধচরিতে [৪|১৪] এবং ভাসের বালচরিত নাটকেও [৩|২] গোপীদের উল্লেখ আছে । অতএব এই বিষয়ে ভাণ্ডারকারের কথা অপেক্ষা, চিন্তামণি রাও বৈদ্যের কথাই আমার নিকট অধিক সযুক্তিক বলিয়া মনে হয় ।)

কোন কোন ব্যক্তি - বিশেষত কোন কোন পাশ্চাত্য তার্কিক - এই তর্ক করেন যে, শ্ৰীকৃষ্ণ, যাদব ও পাণ্ডব, এবং ভারতীয় যুদ্ধ প্ৰভৃতি ঐতিহাসিক ঘটনা নহে, এ সমস্ত কল্পিত কথা; এবং কাহারো কাহারো মতে, মহাভারত তো অধ্যাত্মমূলক একটি বৃহৎ ও মহৎ রূপক । কিন্তু আমাদিগের প্রাচীন গ্রন্থের প্রমাণ দেখিলে, এই সংশয় যে ভিত্তিহীন তাহা নিরপেক্ষ ব্যক্তিমাত্ৰকেই স্বীকার করিতে হইবে । এই সকল কথার মূলে ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, ইহা নির্বিবাদ । সারকথা, শ্ৰীকৃষ্ণ চার পাঁচ জন নহে, তিনি কেবল একই ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন । ইহাই আমার মত । এক্ষণে শ্ৰীকৃষ্ণের কালসম্বন্ধে বিচার করিবার সময় রা.ব.চিন্তামণি রাও বৈদ্য প্রতিপাদন করিয়াছেন যে শ্রীকৃষ্ণ, যাদব, পাণ্ডব ও ভারতীয় যুদ্ধ - ইহাদের কাল একই অর্থাৎ কলিযুগের আরম্ভ; পুরাণগণনানুসারে সেই সময় হইতে এখন পৰ্যন্ত পাচ হাজার বৎসরেরও অধিক চলিয়া গিয়াছে; এবং ইহাই শ্ৰীকৃষ্ণের প্রকৃত কাল ।
(রাওবাহাদুর চিন্তামণি রাও বৈদ্যের এই মত তাঁহার মহাভারতসম্বন্ধীয় টীকাত্মক ইংরেজী গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হইয়াছে । তাছাড়া, এই বিষয়ের উপরেই এখানকার, ডেক্যান কলেজের আনিভর্সরি প্রসঙ্গে তিনি যে বক্তৃতা করিয়াছিলেন তাহাতেও ইহার বিচার করা হইয়াছে ।)

কিন্তু পাণ্ডবগণ হইতে শক-কাল পর্যন্ত আবির্ভূত রাজাদিগের পুরাণে বৰ্ণিত বংশাবলী দেখিলে এই কালের মিল দেখা যায় না । তাই, ভাগবত ও বিষ্ণুপুরাণে এই যে বচন আছে যে, “পরীক্ষিত রাজার জন্ম হইতে নন্দের অভিষেক পৰ্যন্ত ১১১৫ কিংবা ১০১৫ বৎসর হয়” [ভাগ|১২|২|২৬; ও বিষ্ণু|৪|২৪|৩২], তাহারই প্রমাণমূলে বিদ্বানেরা এক্ষণে স্থির করিয়াছেন যে, খৃষ্টের প্রায় ১৪০০ বৎসর পূর্বে পাণ্ডব ও ভারতীয় যুদ্ধ হইয়া থাকিবে । সুতরাং শ্ৰীকৃষ্ণেরও ইহাই কাল; এবং এই কাল স্বীকার করিলে, খৃষ্টপূর্ব প্রায় ১৪০০ অব্দে অথবা বুদ্ধের প্রায় ৮০০ বৎসর পূর্বে শ্ৰীকৃষ্ণ ভাগবতধর্ম প্ৰবর্তিত করিয়া থাকিবেন, এইরূপ পাওয়া যায় । এই সম্বন্ধে কেহ কেহ আপত্তি করেন যে, শ্ৰীকৃষ্ণ ও পাণ্ডবদিগের ঐতিহাসিক ব্যক্তি হওয়া সম্বন্ধে আপত্তি না থাকিলেও শ্ৰীকৃষ্ণের জীবনচরিতে তাঁহার অনেক রূপান্তর দেখা যায় - শ্ৰীকৃষ্ণ নামক এক ক্ষত্ৰিয় যোদ্ধা প্ৰথমে মহাপুরুষের পদ প্ৰাপ্ত হন, তাহার পর বিষ্ণুর পদ প্ৰাপ্ত হন, এবং ক্ৰমে ক্ৰমে শেষে পরব্রহ্মরূপে কল্পিত হয়েন - এই সকল অবস্থার আরম্ভ হইতে শেষ পৰ্যন্ত অনেকটা কাল অতিবাহিত হইয়া থাকিবে, এবং সেই জন্য ভাগবতধর্মের আবির্ভাব-কাল এবং ভারতীয় যুদ্ধের কাল এক বলিয়া মানিতে পারা যায় না । কিন্তু এই আপত্তি নিরর্থক । ‘কাহাকে দেবতা বলিয়া মানিবে ও কাহাকে মানিবে না’ এই সম্বন্ধে আধুনিক তার্কিকদিগের ধারণা এবং দুই চারি হাজার বৎসর পূর্বেকার লোকদিগের ধারণার [গী|১০|৪১] মধ্যে অনেক প্ৰভেদ হইয়া গিয়াছে । শ্ৰীকৃষ্ণের পূর্বেই রচিত উপনিষদসমূহে এই সিদ্ধান্ত উক্ত হইয়াছে যে, জ্ঞানী ব্যক্তি স্বয়ং ব্ৰহ্মময় হইয়া যান [বৃ|৪|৪|৬]; এবং মৈত্র্যুপনিষদে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, রুদ্র, বিষ্ণু, অচ্যুত, নারায়ণ, ইহাঁরা ব্ৰহ্মই [মৈত্র্যু|৭|৭] । তবে শ্ৰীকৃষ্ণের পরব্রহ্মত্ব লাভে বিলম্ব হইবার কারণই কি ? ইতিহাসের দিকে দেখিলে বিশ্বসনীয় বৌদ্ধগ্ৰন্থসমূহেও দেখা যায় যে, বুদ্ধ আপনাকে ‘ব্ৰহ্মভুত’ বলিতেন [সেলসুত্ত|১৪; থেরগাথা|৮৩১]; তাঁহার জীবদ্দশাতেই তিনি দেবতার মান পাইতে আরম্ভ করেন; এবং তাঁহার মৃত্যুর পর শীঘ্রই তিনি ‘দেবাধিদেবের’ কিংবা বৈদিক ধর্মের পরমাত্মার স্বরূপ প্ৰাপ্ত হন ; এবং তাঁহার পূজাও শুরু হয় । খৃষ্টধুর্মের কথাও এইরূপ । ইহা সত্য যে, বুদ্ধ ও খৃষ্টর ন্যায় শ্ৰীকৃষ্ণ সন্ন্যাসী ছিলেন না এবং ভাগবতধর্মও নিবৃত্তিমূলক নহে । কিন্তু কেবল তাহারই ভিত্তিতে বৌদ্ধ ও খৃষ্টধর্মের মূল ব্যক্তিদিগের ন্যায় ভাগবতধর্মের প্ৰবর্তক শ্ৰীকৃষ্ণেরও প্রথম হইতেই ব্ৰহ্মর কিংবা দেবতার স্বরূপ প্ৰাপ্ত হইবার পক্ষে কোন ও বাধা উপস্থিত হইবার কোন কারণই দেখা যায় না ।


2.4) ভাগবতধর্মের আবির্ভাবকাল


শ্ৰীকৃষ্ণের কাল এইরূপে স্থির করিলে পর উহাকেই ভাগবতধর্মেরও আবির্ভাবকাল মনে করা প্রশস্ত ও সযুক্তিক । কিন্তু সাধারণতঃ পাশ্চাত্য পণ্ডিতের ঐরূপ মনে করিতে বিমুখ হইবার আরও কিছু কারণ আছে । এই পণ্ডিতদিগের মধ্যে অধিকাংশের অদ্যাপি এই ধারণাই আছে যে, স্বয়ং ঋগ্‌ বেদের কাল খৃষ্টপূর্ব আন্দাজ ১৫০০ কিংবা বড় জোর ২০০০ বৎসরের অধিক প্রাচীন নহে । তাই তাহাদের নিজেদের দৃষ্টিতে ইহা বলা অসম্ভব মনে হয় যে, ভাগবতধর্ম খৃষ্টপূর্ব প্ৰায় ১৪০ বৎসর পূর্বে প্রচলিত হইয়া থাকিবে । কারণ, বৈদিক ধর্ম-সাহিত্য হইতে এই ক্রম নির্বিবাদে সিদ্ধ হয় যে, ঋগ্বেদের পর যাগযজ্ঞাদি কর্ম প্রতিপাদক যজুর্বেদ ও ব্রাহ্মণ গ্ৰন্থ, তাহার পর জ্ঞান প্রধান উপনিষদ ও সাংখ্যশাস্ত্র এবং শেষে ভক্তিমূলক গ্ৰন্থ রচিত হইয়াছিল । এবং, শুধু ভাগবতধর্মের গ্ৰন্থসমূহ দেখিলেও স্পষ্ট দেখা যায় যে, ঔপনিষদিক জ্ঞান, সাংখ্যশাস্ত্র, চিত্তনিরোধরূপ যোগ প্রভৃতি ধর্মাঙ্গ, ভাগবতধর্ম বাহির হইবার পূর্বেই প্রচলিত হইয়াছিল । কালের ইচ্ছামত টানাটানি করিলেও স্বীকার করিতে হয় যে, ঋগ্বেদের পর এবং ভাগবতধর্ম উদয় হইবার পূর্বে উক্ত বিভিন্ন ধর্মাঙ্গের আবির্ভাব ও বৃদ্ধির মধ্যে অন্যূন দশ বারো শতাব্দী চলিয়া গিয়া থাকিবে । কিন্তু ভাগবতধর্ম শ্ৰীকৃষ্ণ আপনারই কালে অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্ৰায় ১৪০০ অব্দে প্ৰবর্তিত করিয়াছিলেন এইরূপ মনে করিলে, উক্ত বিভিন্ন ধর্মাঙ্গের অভিবৃদ্ধির পক্ষে উক্ত পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের মতে উপযুক্ত কালাবকাশ থাকে না । কারণ, এই সকল পণ্ডিত ঋগ্বেদের কালকেই খৃষ্টপূর্ব ১৫০০ কিংবা ২০০০ অব্দের অধিক প্রাচীন মনে করেন না; এই অবস্থায় তাহাদের ইহা মানিতে হয় যে, ভাগবতধর্ম এক শত কিংবা বড় জোর পাঁচ ছয় শত বৎসর পরেই আবির্ভূত হইয়াছিল ! এইজন্য উপরিউক্ত উক্তি অনুসারে কোন-না-কোন শুষ্ক হেতু দর্শাইয়া তাহারা শ্ৰীকৃষ্ণ ও ভাগবতধর্মের সমকালীনতা অস্বীকার করেন, এবং কোন কোন পাশ্চাত্য পণ্ডিত ভাগবতধর্মের আবির্ভাব বুদ্ধের পরে হইয়া থাকিবে, এইরূপ কথা বলিবার জন্যও উদ্যত । কিন্তু জৈন বৌদ্ধ গ্ৰন্থসমূহেই ভাগবতধর্মের যে উল্লেখ আছে তাহা হইতে স্পষ্টই দেখা যায় যে, ভাগবতধর্ম বুদ্ধ হইতে প্রাচীন । তাই ডাঃ বুহ্লর বলিয়াছেন যে, ভাগবতধর্মের আবির্ভাবকাল বুদ্ধের পরে ঠেলিয়া লইয়া যাইবার বদলে, আমার ‘ওরায়ণ’ গ্রন্থের প্রতিপাদন (ডাঃ বুহ্লর Indiain Antiquary, September 1894, Vol. XXIII. P. 238-249 ইহাতে, ‘ওরায়ণ’ গ্রন্থের যে সমালোচনা করিয়াছেন তাহা দেখ) অনুসারে ঋগ্বেদাদি গ্রন্থের কালই পিছনে হঠাইয়া লইয়া যাওয়া আবশ্যক । পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা ধাঁ করিয়া যাহা-তাহা একটা অনুমান করিয়া লইয়া বৈদিক গ্রন্থের যে কাল নির্ণয় করিারাছেন, তাহা ভ্ৰমমূলক; বৈদিক কালের পূর্ব সীমা খৃষ্টপূর্ব ৪৫০০ বৎসরের কম ধরিতে পারা যায় না; বেদের উত্তরায়ণ-স্থিতিপ্রদর্শক বাক্যের প্রমাণমূলে এই সকল বিষয় আমি আমার ‘ওরায়ণ’ গ্রন্থে সিদ্ধ করিয়া দেখাইয়াছি; এবং এই সিদ্ধান্তই এক্ষণে অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরও গ্রাহ্য হইয়াছে । ঋগ্বেদকালকে এইরূপে পিছাইয়া লইয়া গেলে বৈদিক ধর্মের সমস্ত অঙ্গের অভিবৃদ্ধির পক্ষে যথোচিত কালাবকাশ পাওয়া যায় এবং ভাগবতধর্মের আবির্ভাবকালের সঙ্কোচ করিবার কোনই কারণ থাকে না ।


2.4.1) গ্রন্থের কালনিৰ্ণয়ে জ্যোতিঃশাস্ত্র


মরাঠী ভাষায় ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বকীয় ভারতীয় জ্যোতিঃশাস্ত্রের ইতিহাসে দেখাইয়াছেন যে, ঋগ্বেদের পর ব্ৰাহ্মণাদি গ্রন্থে কৃত্তিকাদি নক্ষত্রের গণনা থাকায় উহাদের কাল খৃষ্টপূর্ব প্ৰায় ২৫০০ আদি ধরিতে হয় । কিন্তু আমি এ পৰ্যন্ত দেখি নাই যে, উত্তরায়ণ-স্থিতি হইতে গ্রন্থের কালনিৰ্ণয় করিবার এই পদ্ধতি উপনিষদের সম্বন্ধে প্ৰযুক্তি হইয়াছে । রামতাপনীর ন্যায় ভক্তি প্ৰধান এবং যোগতত্ত্বের ন্যায় যোগ-প্রধান উপনিষদের ভাষা ও রচনা প্রাচীন বলিয়া মনে হয় না, - কেবল এই ভিত্তির উপরেই কেহ কেহ অনুমান করিয়াছেন যে, সমস্ত উপনিষদই বুদ্ধের অপেক্ষা চারিপাঁচ শত বৎসরের অধিক প্রাচীন হইবে না । কিন্তু কালনির্ণয়ের উপরিউক্ত পদ্ধতি অনুসারে দেখিলে এই ধারণা ভ্ৰান্ত বলিয়া উপলব্ধি হইবে । জ্যোতিষের পদ্ধতিতে সমস্ত উপনিষদের কাল নির্ণয় করা যাইতে পারে না সত্য, তথাপি মুখ্য মুখ্য উপনিষদের কাল স্থির করিবার পক্ষে এই পদ্ধতিই সমধিক উপযোগী । ভাষার দৃষ্টিতে দেখিলে, মৈত্র্যুপনিষৎ পাণিনি অপেক্ষাও প্রাচীন, ইহা প্রোঃ মোক্ষমূলর বলিয়াছেন; (see Sacred Books of the East series, Vol. XV. Intro pp. xlviii lii.) কারণ এই উপনিষদে এরূপ কতকগুলি শব্দসন্ধির প্রয়োগ করা হইয়াছে যাহা শুধু মৈত্ৰায়ণী সংহিতাতেই পাওয়া যায় এবং যাহার প্রচলন পাণিনির সময়ে রহিত হইয়া গিয়াছিল (অর্থাৎ যাহাকে ছান্দস বলা যায়) । কিন্তু মৈত্র্যুপনিষৎ কিছু সর্বপূর্ব অর্থাৎ অতি প্রাচীন উপনিষৎ নহে । উহাতে কেবল ব্ৰহ্মজ্ঞান ও সাংখ্যের মিলন ঘটাইয়া দেওয়া হয় নাই, কিন্তু কয়েক স্থানে ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, তৈত্তিরীয়, কঠ ও ঈশাবাস্য উপনিষদসমূহের বাক্য এবং শ্লোকও উহাতে প্ৰমাণার্থ উদ্ধৃত হইয়াছে । হাঁ ইহা সত্য যে, এই সকল উপনিষদের নাম মৈত্র্যুপনিষদে স্পষ্টরূপে প্ৰদত্ত হয় নাই । কিন্তু এই সকল বাক্যের পূর্বে “এবং হ্যাহ” কিংবা ‘উক্তং চ’ (= এইরূপ উক্ত হইয়াছে), এই প্রকার পর-বাক্যপ্ৰদৰ্শক পদ সন্নিবেশিত হইয়াছে, কাজেই ঐ বাক্যসকল যে অন্য গ্ৰন্থ হইতে গৃহীত, মৈত্র্যুপনিষদকারের নিজের নহে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না; এবং ঐ সকল বাক্য কোন গ্রন্থের তাহা অন্য উপনিষদ্‌ দেখিলে সহজেই স্থির করা যায় । এক্ষণে এই মৈত্র্যুপনিষদে কালরূপ কিংবা সম্বৎসররূপ ব্ৰহ্মের বিচার করিবার সময় [মৈত্র্যু|৬|১৪] এইরূপ বৰ্ণনা পাওয়া যায় যে, “মঘা নক্ষত্রের আরম্ভ হইতে ক্রমশঃ শ্ৰবিষ্ঠা অর্থাৎ ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের অর্ধাংশের উপর আসা পর্যন্ত (মঘাদ্যং শ্রবিষ্টার্ধং) দক্ষিণায়ন হয়; এবং সার্প অর্থাৎ অশ্লেষা নক্ষত্ৰ হইতে বিপরীতক্রমে (অর্থাৎ অশ্লেষ, পুষ্যা, ইত্যাদি ক্ৰমে) পিছনে গণিত হইলে ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের অর্ধাংশ পর্যন্ত উত্তরায়ণ হয় । ইহা নিঃসন্দেহ যে, উত্তরায়ণ-স্থিতি প্ৰদৰ্শক এই বচন তৎকালীন উত্তরায়ণ স্থিতিকেই লক্ষ্য করিয়া উক্ত হইয়াছে, এবং ফের উহা হইতে এই উপনিষদের কালনির্ণয়ও গণিতপদ্ধতিতে সহজেই করা যাইতে পারে । কিন্তু এই দৃষ্টিতে কেহ তাহার বিচার করিয়াছেন বলিয়া দেখা যায় না । মৈত্র্যুপনিষদে বর্ণিত এই উত্তরায়ণ-স্থিতি বেদাঙ্গজ্যোতিষে কথিত উত্তরায়ণস্থিতির পূর্ববর্তী । কারণ, বেদাঙ্গজ্যোতিষে এইরূপ স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, উত্তরায়ণের আরম্ভ ধনিষ্ঠ নক্ষত্রের আরম্ভ হইতে হয়; এবং মৈত্র্যুপনিষদে উহার আরম্ভ ‘ধনিষ্ঠার্ধ’ হইতে করা হইয়াছে । এ বিষয়ে মতভেদ আছে যে, মৈত্র্যুপনিষদের ‘শ্রবিষ্ঠার্ধং’ শব্দে যে ‘অর্ধাং’ পদ আছে তাহার অর্থ ‘ঠিক অর্ধেক’ করিতে হইবে, কিংবা “ধনিষ্ঠা ও শত-তারকার মধ্যে কোন স্থানে” এইরূপ করিতে হইবে । কিন্তু যাহাই বলনা কেন, এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নাই যে বেদাঙ্গজ্যোতিষের পূর্বের উত্তরায়ণস্থিতি মৈত্র্যুপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে, এবং উহাই তৎকালীন স্থিতি হইবে । তাই বলিতে হয় যে, বেদাঙ্গজ্যোতিষকালের উত্তরায়ণ মৈত্র্যুপনিষৎকালীন উত্তরায়ণ অপেক্ষা প্ৰায় অর্ধ নক্ষত্ৰ পিছনে হটিয়া আসিয়াছিল । জোতিৰ্গণিত অনুসারে ইহা সিদ্ধ হয় যে, বেদাঙ্গজ্যোতিষে কথিত উত্তরায়ণস্থিতি খৃষ্টের প্রায় ১২০০ বা ১৪০০ বৎসর পূর্ববর্তী; এবং উত্তরায়ণের অর্ধ নক্ষত্ৰ পিছাইয়া পড়িতে প্ৰায় ৪৮০ বৎসর লাগে; তাই মৈত্র্যুপনিষৎ খৃষ্টপূর্ব ১৮৮০ হইতে ১৬৮০ বৎসরের মধ্যে কোন এক সময়ে রচিত হইয়া থাকিবে, এইরূপ গণিতের দ্বারা নিষ্পন্ন হয় ।
(বেদাঙ্গজ্যোতিষের কালসম্বন্ধীয় বিচার আমার ‘Orion’ ‘ওরায়ণ’ নামক ইংরেজী গ্রন্থে এবং মারাঠীতে ৺শঙ্করবালকৃষ্ণ দীক্ষিতের “ভারতীয় জ্যোতিঃশাস্ত্রের ইতিহাসে” (পৃঃ ৮৭-৯৪ ও ১২৭-১৩৯) করা হইয়াছে তাহা দেখ । তাহাতেই উত্তরায়ণ অনুসারে বৈদিক গ্রন্থের কালসম্বন্ধেও বিচার করা হইয়াছে ।)

নিদানপক্ষে, এই উপনিষৎ বেদাঙ্গজ্যোতিষের যে পূর্ববর্তী, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই । এখন, ছান্দোগ্যাদি যে সকল উপনিষদের উদ্ধৃতবাক্য মৈত্র্যুপনিষদে গৃহীত হইয়াছে সেগুলি উহা হইতেও প্রাচীন তাহা বলা বলা বাহুল্য । সার কথা, এই সকল গ্রন্থের কাল নির্ণয় এই ভাবে হইয়া গিয়াছে যে, ঋগ্বেদ খৃষ্টের প্রায় ৪৫০০ বৎসর পূর্ববর্তী; যজ্ঞযাগাদিবিষয়ক ব্ৰাহ্মণগ্রন্থ খৃষ্টের প্রায় ২৫০০ এবং ছান্দোগ্যাদি জ্ঞান প্ৰধান উপনিষৎ খৃষ্টের প্রায় ১৬০০ বৎসব পূর্ববর্তী । এখন, যে কারণে ভাগবতধর্মের আবির্ভাবকালকে পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা এই দিকে সরাইয়া আনিবার চেষ্টা করেন, প্ৰকৃতপক্ষে সে কারণ আর থাকে না; এবং শ্ৰীকৃষ্ণ ও ভাগবতধর্মকে গাভী ও বৎসের নৈসর্গিক যুগলের ন্যায় একই কালরজ্জুতে বাঁধিতে কোন ভয়ই দেখা যায় না; এবং বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারদিগের বর্ণিত এবং অন্য ঐতিহাসিক অবস্থারও সহিত ঠিক ঠিক মিল হয় । এই সময়েই বৈদিক কাল শেষ হইয়া সূত্র ও স্মৃতির কাল আরম্ভ হয় ।

উপরি-উক্ত কাল-গণনা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, ভাগবতধর্মের আবির্ভাব খৃষ্টপূর্ব প্রায় ১৪০০ অব্দে অর্থাৎ বুদ্ধের প্রায় সাত আঠশো বৎসর পূর্বে হইয়াছে । এই কাল অতি প্ৰাচীন; তথাপি ইহা উপরে বলিয়াছি যে, ব্ৰাহ্মণ-গ্রন্থের কর্মমার্গ ইহা অপেক্ষাও প্রাচীন এবং উপনিষদের ও সাংখ্য শাস্ত্রের জ্ঞান ও ভাগবতধর্মের আবির্ভাবের পূর্বেই প্ৰচলিত হইয়া সর্বমান্য হইয়াছিল ।


2.5) বিভিন্ন ধর্মাঙ্গের সঙ্গে ভাগবতধর্মের সমন্বয়


এই অবস্থায় এরূপ কল্পনা করা আমার মতে সর্বথা অনুচিত যে, উক্ত জ্ঞান ও ধর্মাঙ্গের অপেক্ষা না রাখিয়া শ্ৰীকৃষ্ণের ন্যায় চতুর ও জ্ঞানী ব্যক্তি নিজের ধর্ম প্ৰবর্তিত করিবেন, কিংবা তাহা করিলেও এই ধর্ম তৎকালীন রাজর্ষি ও ব্ৰহ্মর্ষিদিগের নিকট মান্য হইয়া লোকের মধ্যে উহার প্রসার হইয়া থাকিবে । খৃষ্ট স্বকীয় ভক্তিপ্ৰধান ধর্মের উপদেশ সর্বপ্রথম যে ইহুদিলোকের মধ্যে করিয়াছিলেন, তাহাদের মধ্যে তৎকালে ধর্মতত্ত্বজ্ঞানের প্রসার না হওয়ায় তত্ত্বজ্ঞানের সহিত তাঁহার নিজ ধর্মের মিল করিবার কোন প্রয়োজন ছিল না । কেবল ইহা দেখাইলে খৃষ্টের ধর্মোপদেশসম্বন্ধীয় কাজ সম্পূর্ণ হইতে পারিত যে, বাইবেলের পুরাতন অঙ্গীকারে যে কর্মময় ধর্ম বৰ্ণিত হইয়াছে তাহারই জন্য তাহার ভক্তিমাৰ্গও বাহির হইয়াছে; এবং তিনি এইটুকু চেষ্টাও করিয়াছেন । কিন্তু খৃষ্টধর্মের এই বৃত্তান্তের সহিত ভাগবতধর্মের ইতিহাস তুলনা করিবার সময় একথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই যে, ভাগবতধর্ম যে লোকের মধ্যে এবং যে কালে প্ৰবর্তিত হইয়াছিল, সেই লোকের মধ্যে সেই কালে শুধু কর্মমার্গই নহে, কিন্তু ব্ৰহ্মজ্ঞান ও কাপিল সাংখ্য শাস্ত্রেরও পুরাপুরি পরিচয় ছিল; এবং তিন ধর্মাঙ্গের সমন্বয় করিতেও তাহারা শিখিয়াছিল । এতরূপ লোকের নিকট ইহা বলা কোন প্রকারে যুক্তিসিদ্ধ হইত না যে, “তোমার কর্মকাণ্ড কিংবা ঔপনিষদিক ও সাংখ্য জ্ঞান ছাড়িয়া দাও, আর কেবল ভাগবত ধর্মই শ্ৰদ্ধার সহিত স্বীকার কর” । ব্ৰাহ্মণাদি বৈদিক গ্রন্থে বর্ণিত ও তৎকালে প্ৰচলিত যাগযজ্ঞাদি কর্মের ফল কি ? উপনিষদের কিংবা সাংখ্যশাস্ত্রের জ্ঞান কি নিরর্থক ? ভক্তি ও চিত্তনিরোধরূপ যোগের মিল কিরূপে হইতে পারে ? - ইত্যাদি প্রশ্ন যাহা সহজভাবে তখন উত্থিত হইয়াছিল তাহাদের ঠিক ঠিক উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত ভাগবতধর্মের প্রসার হওয়াও কখনই সম্ভব ছিল না । তাই ন্যায়তঃ ইহাই উপলব্ধি হয় যে, এই সমস্ত বিষয়ের আলোচনা ভাগবতধর্মে প্রথম হইতেই করা আবশ্যক ছিল; এবং মহাভারতের অন্তৰ্গত নারায়ণীয় উপাখ্যান হইতেও এই সিদ্ধান্তই দৃঢ় হয় । 


2.5.1) পাঞ্চরাত্র


এই নারায়ণীয় আখ্যানে ভাগবতধর্মের সঙ্গে ঔপনিষদিক ব্ৰহ্মজ্ঞান এবং সাংখ্য প্রতিপাদিত ক্ষরাক্ষরবিচারের মিল স্থাপন করা হইয়াছে; এবং ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, “চার বেদ এবং সাংখ্য বা যোগ এই পাঁচেরই তাহার (ভাগবতধর্ম) মধ্যে সমাবেশ হয় বলিয়া তাহার নাম হইয়াছে পাঞ্চরাত্রধর্ম [মভা|শাং|৩৩৯|১০৭]; এবং “বেদারণ্যকসমেত (অর্থাৎ উপনিষৎসমূহকেও লইয়া) এই সমস্ত (শাস্ত্ৰ) পরস্পরের অঙ্গ” [শাং|৩৪৮|৮২] । “পাঞ্চরাত্র” শব্দের এই নিরুক্তি ব্যাকরণদৃষ্টিতে শুদ্ধ না হইলেও উহা হইতে ইহা স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে, সর্বপ্রকার জ্ঞানের সমন্বয় ভাগবতধর্মে আরম্ভ হইতেই করা হইয়াছিল । 


2.5.2) জ্ঞান ও ভক্তির সহিত কর্মের মিলন


কিন্তু ভক্তির সঙ্গে অন্য সমস্ত ধর্মাঙ্গের সমন্বয় করাই কিছু ভাগবতধর্মের মুখ্য বিশেষত্ব নহে । ভক্তির ধর্মতত্ত্ব ভাগবতধর্মই যে সর্বপ্রথম প্ৰবর্তিত করেন তাহা নহে । মৈত্র্যুপনিষদের উপরি প্রদত্ত বাক্য হইতে [মৈত্র্যু|৭|৭] স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে, রূদ্রের কিংবা বিষ্ণুর কোন-না-কোন স্বরূপের উপাসনা ভাগবতধর্ম বাহির হইবার পূর্বেই শুরু হইয়াছিল; এবং উপাস্য যাহাই হউক না কেন, উহা ব্ৰহ্মেরই প্ৰতীক কিংবা একপ্রকার রূপ, এই কল্পনাও পূর্বেই বাহির হইয়াছিল । রুদ্রাদি উপাস্যের পরিবর্তে বাসুদেব উপাস্য বলিয়া ভাগবতধর্মে গৃহীত হইয়াছেন সত্য; কিন্তু ভক্তি যে কোন দেবতাকে করিলেও তাহা এক ভগবানকেই করা হয় – রুদ্র ও ভগবান বিভিন্ন নহেন, ইহা গীতায় ও নারায়ণীয় উপাখ্যানেও বর্ণিত হইয়াছে [গী|৯|২৩; মভা|শাং|৩৪১|২০-৩৬ দেখ] । তাই, শুধু বাসুদেবভক্তি ভাগবতধর্মের মুখ্য লক্ষণ বলিয়া মানা যায় না । যে সাত্বতজাতির মধ্যে ভাগবতধর্মের আবির্ভাব হইয়াছিল, সেই জাতির সাত্যকি আদি ব্যক্তি, পরম ভগবদ্ভক্ত ভীমার্জুন, এবং স্বয়ং শ্ৰীকৃষ্ণও খুব পরাক্রমী ছিলেন এবং অন্যের দ্বারা পরাক্রমের কাৰ্য করাইবার লোক ছিলেন । এইজন্য অন্য ভগবদ্ভক্তের উচিত যে, তাহারাও এই আদর্শকেই সম্মুখে রাখিয়া তৎকালে প্ৰচলিত চাতুর্বর্ণ্যানুসারে যুদ্ধাদি সমস্ত ব্যবহারিক ধর্ম করিবে - ইহাই মূল ভাগবতধর্মের মুখ্য বিষয় ছিল । ভক্তি-তত্ত্ব স্বীকার করিয়া বৈরাগ্যযুক্ত বুদ্ধিতে সংসারত্যাগী ব্যক্তি তখন একেবারেই ছিল না, এরূপ নহে । কিন্তু ইহা কিছু সাত্বতদিগের কিংবা শ্ৰীকৃষ্ণের ভাগবতধর্মের মুখ্য তত্ত্ব নহে । ভক্তি দ্বারা পরমেশ্বর-জ্ঞান হইলে ভগবদভক্তকে পরমেশ্বরের ন্যায় জগতের ধারণপোষণার্থ সর্বদা চেষ্টা করিতে হইবে, ইহাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশের সার । উপনিষৎকালে জনক প্রভৃতিই ইহাই স্থির করিয়া দিয়াছিলেন যে, ব্রহ্মজ্ঞানী পুরুষেরও নিষ্কাম ধর্ম করা অনুচিত নহে । কিন্তু সে সময় তাহার মধ্যে ভক্তির সমাবেশ করা হয় নাই; তাছাড়া জ্ঞানোদয়ের পর কর্ম করা কিংবা না করা, প্ৰত্যেকের ইচ্ছার উপর অবলম্বিত ছিল অর্থাৎ বৈকল্পিক বলিয়া ধরা হইত [বেসূ|৩|৪|১৫] । 

বৈদিক ধর্মের ইতিহাসে ভাগবতধর্ম এই একটী অত্যন্ত মহত্বপূর্ণ এ্বং স্মার্তধর্ম হইতে বিভিন্ন কাজ করিয়াছেন যে, উহা (ভাগবতধর্ম) আরও কয়েক পদ অগ্রসর হইয়া শুদ্ধ নিবৃত্তি অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মমূলক প্ৰবৃত্তিমাৰ্গকে (নৈষ্কর্ম্য) অধিক শ্ৰেয়স্কর বলিয়া স্থির করিয়াছেন, এবং জ্ঞানের সহিত শুধু নহে, ভক্তিরও সহিত কর্মের উচিত মিলন স্থাপন করিয়াছেন । এই ধর্মের মূল প্ৰবর্তক নর ও নারায়ণ ঋষিও এইরূপই সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতেন, এবং মহাভারতে বলা হইয়াছে যে, তাঁহাদের ন্যায় সকলেরই এইরূপ কর্ম করাই কর্তব্য [উদ্যো|৪৮|২১|২২] । নারায়ণীয় আখ্যানে তো ভাগবতধর্মের এই লক্ষণ স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, “প্রবৃত্তিলক্ষণশ্চৈব ধর্মো নারায়ণাত্মকঃ” [মভা|শাং|৩৪৭|৮১] - অর্থাৎ নারায়ণীয় কিংবা ভাগবতধর্ম প্ৰবৃত্তিমূলক বা কর্মমূলক । নারায়ণীয় কিংবা মূল ভাগবতধর্মের যে নিষ্কাম প্রবৃত্তিতত্ত্ব তাহারই নাম 'নৈষ্কর্ম্য’, এবং ইহাই মূল ভাগবতধর্মের মুখ্য তত্ত্ব । কিন্তু ভাগবত পুরাণে দেখা যায় যে, পরে কালান্তরে এই তত্ত্ব মন্দীভূত হইতে লাগিলে এই ধর্মে বৈরাগ্যমূলক বাসুদেবভক্তিকে শ্ৰেষ্ঠ মানা যাইতে লাগিল । নারদপঞ্চরাত্রে তো ভক্তির সঙ্গে সঙ্গেই ভাগবতধর্মে মন্ত্রতন্ত্রেরও সমাবেশ করা হইয়াছে । তথাপি এই সমস্ত এই ধর্মের মূল স্বরূপ নহে, ইহা ভাগবত হইতেই স্পষ্টই প্ৰকাশ পায় । যেখানে নারায়ণীয় কিংবা সাত্বত ধর্ম সম্বন্ধে কিছু বলিবার প্রসঙ্গ উপস্থিত হইয়াছে, সেইখানে সাত্বত ধর্ম কিংবা নারায়ণ ঋষির ধর্ম (অর্থাৎ ভাগবতধর্ম) ‘নৈষ্কর্ম্যলক্ষণ’ বলিয়া ভাগবতেই উক্ত হইয়াছে [ভাগ|১|৩|৮ ও ১১|৪|৬] এবং পরে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, এই নৈষ্কর্ম্য-ধর্মে ভক্তির যথোচিত প্ৰাধান্য না দেওয়ায়, ভক্তি প্ৰধান ভাগবত পুরাণ বিবৃত করা আবশ্যক হইল [ভাগ|১|৫|১২] । ইহা হইতে নির্বিবাদ সিদ্ধ হয় যে, মূল ভাগবতধর্ম নৈষ্কর্ম্যপ্ৰধান অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম প্ৰধান ছিল, কিন্তু পরে কালান্তরে তাহার স্বরূপ পরিবর্তিত হইয়া ভক্তিপ্রধান হইয়া দাড়ায় । গীতারহস্যে এইরূপ ঐতিহাসিক প্ৰশ্নসমূহের বিচার পূৰ্বেই করা হইয়াছে যে, জ্ঞান ও ভক্তির নিত্য মিল রক্ষাকারী মূল ভাগবতধর্ম ও আশ্ৰমব্যবস্থারূপ স্মার্ত্তমার্গের ভেদ কি, কেবল সন্ন্যাসপ্রধান জৈন ও বৌদ্ধধর্মের বিস্তারে ভাগবতধর্মের কর্মযোগ পিছাইয়া পড়িয়া উহা ভিন্ন স্বরূপ অর্থাৎ বৈরাগ্যযুক্ত ভক্তির স্বরূপই কিরূপে প্ৰাপ্ত হইল; এবং বৌদ্ধধর্মের হ্রাসের পর যে বৈদিক সম্প্রদায় প্ৰবর্তিত হইয়াছিল তন্মধ্যে কোন কোন সম্প্রদায় তো শেষে ভগবদ্গীতাকেই সন্ন্যাসপ্রধান, আবার কোন সম্প্রদায় কেবল ভক্তিপ্রধান এবং কতকগুলি বিশিষ্টাদ্বৈত-মূলক স্বরূপ কিরূপে দিয়াছিল ।


2.6) মূল-গীতার কাল


উপরি-প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত বিচার হইতে জানা যাইবে যে, বৈদিক ধর্মের সনাতন প্রবাহে ভাগবতধর্মের কবে আবির্ভাব হইল, এবং প্রথমে উহা প্ৰবৃত্তি প্ৰধান বা কর্মপ্ৰধান হইলেও পরে তাহাতে ভক্তি প্ৰধান এবং শেষে রামানুজাচার্যের কালে বিশিষ্টাদ্বৈত স্বরূপ কিরূপে আসিল । ভাগবতধর্মের এই বিভিন্ন স্বরূপের মধ্যে একেবারে গোড়ার অর্থাৎ নিষ্কাম কর্ম প্ৰধান যে স্বরূপ তাহাই গীতাধর্মেৱ স্বরূপ । এক্ষণে এই প্রকার মূল-গীতার কালসম্বন্ধে কি অনুমান করা যাইতে পারে তাহা সংক্ষেপে বলিতেছি । শ্ৰীকৃষ্ণ ও ভারতীয় যুদ্ধের কাল একই অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্ৰায় ১৪০০ অব্দ হইলেও মূলগীতা ও মূলভারত - ভাগবতধর্মের এই দুই প্ৰধান গ্ৰন্থও যে সেই সময়েই রচিত হইয়াছিল এরূপ বলিতে পারা যায় না । কোন ধর্মপন্থা বাহির হইলে তখনই তৎসম্বন্ধীয় গ্ৰন্থ প্ৰস্তুত হয় না । ভারত ও গীতা সম্বন্ধেও এই ন্যায়ই প্ৰযুক্ত হইতে পারে । বর্তমান মহাভারতের আরম্ভে আছে যে, ভারতীয় যুদ্ধ হইয়া গেলে যখন পাণ্ডবদিগের পৌত্ৰ জনমেজয় সৰ্পসত্ৰ করিতেছিলেন, তখন সেখানে বৈশম্পায়ন তাঁহার নিকট গীতা-সহিত ভারত সর্বপ্রথম বিবৃত করেন; এবং পরে যখন তাহাই সৌতি শৌনককে শোনান, তখন হইতেই ভারত প্রচলিত হয় । সৌতি প্ৰভৃতি পৌরাণিকদিগের মুখ হইতে বাহির হইয়া পরে ভারতের কাব্যগ্রন্থের স্থায়ী স্বরূপ লাভ করিতে মধ্যে কতকটা সময় যে অতিবাহিত হইয়া থাকিবে, তাহা স্পষ্টই দেখা যায় । কিন্তু সে কতটা সময় তাহা নিশ্চিতরূপে স্থির করিবার এখন কোন উপায় নাই । এই অবস্থায় যদি স্বীকার করা যায় যে, ভারতীয় যুদ্ধের পর প্রায় পাচশো বৎসরের ভিতরেই আর্ষ মহাকাব্যাত্মক মূল ভারত রচিত হইয়া থাকিবে, এরূপ মনে করিতে বিশেষ সাহসের দরকার হইবে না । কারণ, বৌদ্ধধর্মের গ্ৰন্থ, বুদ্ধের মৃত্যুর পর ইহা অপেক্ষাও শীঘ্ৰ প্ৰস্তুত হইয়াছে । এখন আর্ষ মহাকাব্যে নায়কের শুধু পরাক্রমেরই বর্ণনা করিলে চলে না; কিন্তু তাহাতে ইহাও দেখাইতে হয় যে, নায়ক যাহা কিছু করেন তাহা উচিত বা অনুচিত; অধিক কি, নায়কের কার্যের দোষ গুণ বিচার করা যে আর্ষ মহাকাব্যের এক মুখ্য অংশ - তাহা সংস্কৃত-ব্যতীত অন্য সাহিত্যের এইপ্ৰকার মহাকাব্য হইতেও জানা যায় । অর্বাচীন দৃষ্টিতে দেখিলে বলিতে হয় যে, নায়কের কার্যের সমর্থন শুধু নীতিশাস্ত্রের ভিত্তিতেই করিতে হইবে । কিন্তু প্ৰাচীনকালে, ধর্ম ও নীতির মধ্যে পৃথক ভেদ মানা যাইত না, অতএব ধর্মদৃষ্টি ব্যতীত উক্ত সমর্থনের অন্য মার্গ ছিল না । আবার, ভারতের নায়কদিগের গ্ৰাহ্য কিংবা তাহাদের প্ৰবর্তিত যে ভাগবত ধর্ম, তাহারই প্রমাণমূলে তাহাদের কার্যের সমর্থন করাও আবশ্যক ছিল ।

তাহা ছাড়া, আরও এক কারণ এই যে, ভাগবতধর্ম ব্যতীত তৎকালে প্রচলিত অন্য বৈদিক ধর্মপন্থা ন্যূনাধিক পরিমাণে কিংবা সর্বাংশে নিবৃত্তিমূলক ছিল, তাই তদন্তৰ্গত ধর্মতত্ত্বের প্রমাণে ভারতের নায়কদিগের পরাক্রমের পূর্ণরূপে সমৰ্থন করা সম্ভব ছিল না । অতএব মহাকাব্যাত্মক মূল ভারতেই কর্মযোগমূলক ভাগবতধর্মের নিরূপণ করা আবশ্যক ছিল । ইহাই মূলগীতা; এবং ভাগবতধর্মের মূল স্বরূপের সোপপত্তিক প্ৰতিপাদন করিবার সর্বপ্রথম গ্ৰন্থ না হইলেও ইহা আদিগ্রন্থাদিগের মধ্যে নিশ্চয়ই অন্যতর এবং ইহার কাল খৃষ্টপূর্ব প্ৰায় ৯০০ বৎসর হইবে, এই একটা স্থুল অনুমান করিতে কোন বাধা নাই ।

গীতা এইরূপে ভাগবতধর্মমূলক প্ৰথম গ্ৰন্থ না হইলেও উহা মুখ্য গ্ৰন্থসমূহের মধ্যে নিশ্চয়ই একটী; তাই উহাতে প্ৰতিপাদিত নিষ্কাম কর্মযোগ তৎকালে প্ৰচলিত অন্য ধর্মপন্থার সহিত - অৰ্থাৎ কর্মকাণ্ডের সহিত, ঔপনিষদিক জ্ঞানের সহিত, সাংখ্যের সহিত, চিত্তনিরোধরূপ যোগের সহিত এবং ভক্তিরও সহিত – অবিরুদ্ধ, ইহা দেখান আবশ্যক হইয়াছিল । অধিক কি, ইহাই এই গ্রন্থের মুখ্য প্রয়োজন বলিলেও চলে । বেদান্ত ও মীমাংসাশাস্ত্র পরে রচিত হওয়ায় মূল গীতায় উহাদের প্রতিপাদন আসিতে পারে না; এবং এই কারণেই গীতায় বেদান্ত পরে ঢুকাইয়া দেওয়া হইয়াছে, কেহ কেহ এইরূপ সংশয় করিয়া থাকেন । কিন্তু পদ্ধতিবদ্ধ বেদান্ত ও মীমাংসাশাস্ত্র পরে রচিত হইলেও উহাদের প্রতিপাদ্য বিষয় যে খুবই প্ৰাচীন তাহা নিঃসন্দেহ - এবং এই বিষয়ে আমি উপরে বলিয়াছি । তাই এই বিষয় মূল গীতায় আসিলে কালদৃষ্টিতে কোন প্ৰত্যবায় হয় না । তথাপি মূল-ভারত যখন মহাভারতে পরিণত হইল তখন মূল গীতায় একেবারেই কোন বদল হয় নাই এ কথাও আমি বলি না । যে কোন ধর্মপন্থা ধর না কেন, তাহার ইতিহাসে তো ইহাই দেখা যায় যে, তাহার মধ্যে সময়ে সময়ে মতভেদ হইয়া অনেক উপপন্থা বাহির হয় । ভাগবত ধর্ম সম্বন্ধেও এই কথা খাটে । নারায়ণীয় উপাখ্যানে এইরূপ স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে [মভা|শাং|৩৪৮|৫৭] যে, কোন কোন লোক ভাগবতধর্মকে চতুর্ব্যুহ অৰ্থাৎ বাসুদেব, সংকর্ষণ, প্ৰদ্যুম্ন ও অনিরুদ্ধ এই প্ৰকার চারি ব্যুহের; আবার কেহ কেহ ত্রিব্যুহ, দ্বিব্যুহ বা এক ব্যুহই মনে করিয়া থাকেন । পরে এই প্ৰকার আরও অনেক মতভেদ উপস্থিত হইয়া থাকিবে । সেইরূপ, ঔপনিষদিক সাংখ্যজ্ঞানেরও বৃদ্ধি হইতেই চলিয়াছিল । তাই মূলগীতায় যাহা কিছু বিভিন্নভা আছে, তাহা দূর হইয়া বৃদ্ধিশীল জড়ব্ৰহ্মাণ্ড-জ্ঞানের সহিত ভাগবতধর্মের সম্পূর্ণ মিল হইয়া যায়, এই বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা অস্বাভাবিক কিংবা মূল গীতার উদ্দেশ্যের বিরুদ্ধও ছিল না । সেইজন্যই বর্তমান গীতায় ব্ৰহ্মসূত্রের উল্লেখ আসিয়াছে ইহা পূর্বে “গীতা ও ব্ৰহ্মসূত্ৰ” শীৰ্ষক আলোচনায় প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে । ইহা ব্যতীত এই প্রকার অন্য পরিবর্তনও মূল গীতায় হইয়া থাকিবে । কিন্তু মূল গীতাগ্রন্থে এই প্রকার পরিবর্তন হওয়াও সম্ভব ছিল না । বর্তমানে গীতার যে প্ৰামাণিকতা আছে তাহা হইতে মনে হয় না যে, উহা ঐ বর্তমান মহাভারতের পরে প্রাপ্ত হইয়াছে । ব্ৰহ্মসুত্ৰে “স্মৃতি” শব্দে গীতাকে প্ৰমাণ ধরা হইয়াছে ইহা উপরে উক্ত হইয়াছে । মূল-ভারত মহাভারত হইবার সময় যদি মূল-গীতাতেও অনেক পরিবর্তন হইয়া থাকিত, তাহা হইলে এই প্রামাণ্য সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ কোন বাধা আসিতই । কিন্তু তাহা না হইয়া গীতাগ্রন্থের প্রামাণ্য আরও বর্ধিত হইয়াছে । তাই এই অনুমানই করিতে হয় যে, মূল-গীতায় যে কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছিল তাহা বড় রকমের নহে, কিন্তু মূল গ্রন্থের অর্থ যাহাতে পরিস্ফুট হয় এই প্রকারের হইয়া থাকিবে । বিভিন্ন পুরাণে বর্তমান ভগবদ্গীতার ধরণে যে অনেক গীতা বিবৃত হইয়াছে তাহা হইতে ইহা স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় যে, উক্ত প্রকারে মূল গীতা যে স্বরূপ একবার প্রাপ্ত হইয়াছিল তাহাই আজি পৰ্যন্ত বজায় আছে - উহার পরে উহাতে কোনই পরিবর্তন সংঘটিত হয় নাই । কারণ, এই সমস্ত পুরাণের মধ্যে অতি প্রাচীন পুরাণের কয়েক শতাব্দী পূৰ্বেই বর্তমান গীতা যদি সম্পূর্ণ প্ৰমাণভূত (সুতরাং অপরিবর্তনীয়) না হইয়া থাকিত তবে সেই নমুনাদৃষ্টে অন্য গীতা বিবৃত করিবার কল্পনাও মনে আসা সম্ভব ছিল না । সেইরূপ আবার, গীতার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা একই গীতার শব্দসমূহকে টানাবোনা করিয়া, গীতাৰ্থ নিজ নিজ সম্প্রদায়েরই অনুকুল দেখাইবার যে চেষ্টা করিয়াছেন, তাহারও কোন কারণ থাকিত না । বর্তমান গীতার কোন কোন সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরোধী দেখিয়া কেহ কেহ এই আশঙ্কা করেন যে, বর্তমান মহাভারতের অন্তর্গত গীতাতেও পরে সময়ে সময়ে কিছু পরিবর্তন হইয়া থাকিবে । কিন্তু এই বিরোধ বাস্তবিক নহে; ধর্মপ্রতিপাদক পূর্বাপর বৈদিক পদ্ধতির স্বরূপটি ঠিক লক্ষ্য না করায় এই ভ্ৰম উৎপন্ন হইয়াছে, ইহা আমি প্ৰথমেই বলিয়া দিয়াছি ।


2.7) সারকথা


উপযুক্ত বিচার আলোচনা হইতে উপলব্ধি হইবে যে, বিভিন্ন প্ৰাচীন বৈদিক ধর্মাঙ্গের সমন্বয় করিয়া প্ৰবৃত্তিমার্গের বিশেষ সমর্থক ভাগবতধর্মের আবির্ভাবের প্ৰায় পাঁচশো বৎসর পরে, (অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্রায় ৯০০ বৎসর) ঐ মূল ভাগবতধর্মেরই প্ৰতিপাদক মূলভারত ও মূলগীতা রচিত হয়; এবং ভারতের মহাভারত হইবার সময় এই মূল গীতায় তদৰ্থপোষক কিছু সংস্কার সাধিত হইলেও উহার প্রকৃতস্বরূপ তখনও কিছুমাত্র পরিবর্তিত হয় নাই; এবং বর্তমান মহাভারতে গীতা সংযোজিত হইবার সময়, এবং তাহার পরেও উহাতে কোন নূতন পরিবর্তন হয় নাই - এবং হওয়া সম্ভবও ছিল না । মূল গীতা এবং মূল ভারতের স্বরূপ ও কালসন্ধন্ধীয় এই নির্ণয় স্বভাবত মোটামুটিভাবে ও আন্দাজে করা হইয়াছে । কারণ এ সময়ে উহার জন্য কোন বিশেষ উপায় আমাদের উপলব্ধ হয় নাই । কিন্তু বর্তমান মহাভারত এবং বর্তমান গীতার কথা সেরূপ নহে; কারণ ইহাদের কালনির্ণয় করিবার অনেক উপায় আছে । তাই এই বিষয়ের আলোচনা পরবর্তী ভাগে স্বতন্ত্ররূপে করিয়াছি । এখানে পাঠকগণের মনে রাখিতে হইবে যে, বর্তমান গীতা ও বর্তমান মহাভারত এই দুইটী সেই গ্ৰন্থই, যাহার মূলস্বরূপে কালান্তরে পরিবর্তন হইয়াছে, এবং এক্ষণে গীতা ও মহাভারতের আকারে আমরা যাহা পাইয়াছি; এগুলি তৎপূর্বের মূল গ্ৰন্থ নহে ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment