Sunday, June 4, 2017

কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার বিচার (Kapila-Samkhya Philosophy - Mutable & Immutable)

কাপিলসাংখ্যশাস্ত্র কিংবা ক্ষরাক্ষরবিচার বিচার


প্রকৃতিং পুরুষং চৈব বিদ্ধ্যনাদী উভাবপি ৷ [গীতা |১৩|১৯]

(“প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়কে অনাদি বলিয়া জান ।”)


সূচীপত্র


1) ক্ষর ও অক্ষরের বিচারমূলক শাস্ত্র
2) কাণাদদিগের পরমাণুবাদ
3) কাপিল সাংখ্য
3.1) ‘সাংখ্য’ শব্দের অর্থ
3.2) কাপিল সাংখ্যবিষয়ক গ্রন্থ
3.3) কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্ত
3.3.1) সৎকার্যবাদ
3.3.2) জগতের মূল দ্রব্য অথবা প্রকৃতি একই
3.3.3) সত্ত্ব, রজ ও তম উহার তিন গুণ
3.3.4) ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা ও পারস্পরিক সংঘর্ষ-বিবাদে নানা পদার্থের উৎপত্তি
3.3.5) প্রকৃতি অব্যক্ত, অখণ্ডিত, একই ও অচেতন
3.3.6) অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত
3.3.7) হেকেলের জড়াদ্বৈত
3.3.8) প্রকৃতি হইতেই মন ও বুদ্ধির উৎপত্তি
3.3.9) প্রকৃতি ও পুরুষ দুই স্বতন্ত্র তত্ত্ব
3.3.10) পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগে সৃষ্টির বিস্তার
3.3.11) কৈবল্য অর্থাৎ মোক্ষ-প্রাপ্তি
3.4) মোক্ষ কাহার হয়, প্রকৃতির বা পুরুষের ?
3.5) সাংখ্যের অসংখ্য পুরুষ এবং বেদান্তীদিগের এক পুরুষ
4) ত্রিগুণাতীত অবস্থা
5) সাংখ্যের ও তৎসদৃশ গীতার সিদ্ধান্তের ভেদ



1) ক্ষর ও অক্ষরের বিচারমূলক শাস্ত্র



শরীর এবং শরীরের অধিস্বামী বা অধিষ্ঠাতা-ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞ-ইহাদের বিচারের সঙ্গে সঙ্গেই দৃশ্য জগৎ এবং তাহার মূলতত্ত্ব - ক্ষর ও অক্ষর - ইহাদেরও বিচার করিবার পশ্চাৎ আবার আত্মার স্বরূপ নির্ণয় করা আবশ্যক, ইহা পূর্ব প্ৰকরণে বলা হইয়াছে । যোগ্য রীতিতে এই ক্ষরাক্ষর জগতের বিচার করিবার তিন শাস্ত্র আছে । প্রথম ন্যায়শাস্ত্র এবং দ্বিতীয় কাপিল সাংখ্যশাস্ত্র; কিন্তু এই দুই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত অপূর্ণ স্থির করিয়া বেদান্তশাস্ত্ৰ ব্ৰহ্মস্বরূপের নির্ণয় তৃতীয় রীতিতে করিয়াছেন । তাই বেদান্তের উপপত্তি দেখিবার পূর্বে, ন্যায় ও সাংখ্যের সিদ্ধান্ত কি, তাহা আমাদের দেখা আবশ্যক । বাদরায়ণাচার্যের বেদান্তসূত্রে এই পদ্ধতিই স্বীকৃত হইয়াছে এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে ন্যায় ও সাংখ্যের মতকে খণ্ডন করা হইয়াছে । এই বিষয়ের বিস্তৃত বিবরণ এখানে করিতে না পারিলেও ভগবদ্‌গীতার রহস্য বুঝাইবার জন্য যতটা আবশ্যক ততটুকু এ বিষয়ের উল্লেখ এই প্রকরণে ও পরবর্তী প্রকরণে আমি স্পষ্টরূপে করিয়াছি । নৈয়ায়িক সিদ্ধান্ত অপেক্ষা সাংখ্য সিদ্ধান্তের অধিক গুরুত্ব আছে । কারণ, কোন শিষ্ট ও প্রমুখ বেদান্তী কাণাদ-ন্যায়মত স্বীকার না করিলেও কাপিলসাংখ্যশাস্ত্রের অনেক সিদ্ধান্ত মনু-আদি স্মৃতি-গ্রন্থে এবং গীতাতেও সন্নিবিষ্ট হইয়াছে । এই কথা বাদরায়ণাচার্যও বলিয়াছেন [বে|সূ|২|১|১২ ও ২|২|১৭] । তাই প্রথমেই পাঠকের সাংখ্যসিদ্ধান্ত জানা আবশ্যক । তথাপি সাংখ্যশাস্ত্রের অনেক সিদ্ধান্ত বেদান্তে নিঃসন্দেহ পাওয়া গেলেও সাংখ্য ও বেদান্তের শেষ সিদ্ধান্ত পরস্পর অত্যন্ত ভিন্ন, ইহা পাঠক যেন বিস্মৃত না হন । এখানে এক প্রশ্ন উপস্থিত হয় এই যে, বেদান্ত ও সাংখ্যের যে সিদ্ধান্ত সাধারণ, তাহা প্ৰথমে কে আবিষ্কার করে – বেদান্ত না সাংখ্য ? কিন্তু এই গ্রন্থে, এত গভীর বিচারে প্রবেশ করা আবশ্যক নহে । এই প্রশ্নের উত্তর তিনপ্রকারে দেওয়া যাইতে পারে । প্রথম এই যে, উপনিষৎ (বেদান্ত) ও সাংখ্য, ইহাদের বৃদ্ধি দুই বৈমাত্ৰ ভাইয়ের মতো এক সঙ্গেই হওয়ায়, উপনিষদের যে সিদ্ধান্ত সাংখ্য মতের অনুরূপ দৃষ্ট হয়, তাহা উপনিষৎকারেরা স্বতন্ত্র রীতিতে অন্বেষণ করিয়া বাহির করিয়াছেন । দ্বিতীয় এই যে, বেদান্তী কখনও কোন সিদ্ধান্ত সাংখ্যশাস্ত্ৰ হইতে লইয়া সেগুলিকে বেদান্তের অনুকুল স্বরূপ প্ৰদান করিয়াছেন । তৃতীয় এই যে, কপিলাচাৰ্য আপন মত অনুসারে প্রাচীন বেদান্তের সিদ্ধান্তেই কতক পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করিয়া সাংখ্যশাস্ত্র রচনা করিয়াছেন । এই তিনটী মতের মধ্যে তৃতীয় মতই অধিক বিশ্বাস্য বলিয়া মনে হয়; কারণ বেদান্ত ও সাংখ্য উভয়ই খুব প্রাচীন হইলেও তাহাদের মধ্যে বেদান্ত বা উপনিষৎ সাংখ্য অপেক্ষাও অধিক প্ৰাচীন (শ্রৌত) । সে যাহাই হোক্‌, প্ৰথমে ন্যায় ও সাংখ্যের সিদ্ধান্তগুলির সহিত আমাদের ভালরূপ পরিচয় হইলে, বেদান্তের - বিশেষত গীতান্তৰ্গত বেদান্তের - তত্ত্বসকল শীঘ্রই আমাদের উপলব্ধি হইবে । এই জন্য, ক্ষরাক্ষর জগতের রচনা সম্বন্ধে এই দুই স্মার্তশাস্ত্রের কি মত, প্ৰথমে তাহার বিচার করিব ।


2) কাণাদদিগের পরমাণুবাদ



কোনো বিবক্ষিত কিংবা গৃহীত বিষয় হইতে তর্কের দ্বারা কোন অনুমান কেমন করিয়া বাহির করিতে হইবে; এবং এই অনুমানগুলির মধ্যে কোন্‌টি সত্য ও কোন্‌টি ভ্রান্ত, ইহা কি প্রকারে নির্ণয় করা যাইবে, ন্যায়শাস্ত্রের ইহাই উপযুক্ত বিষয় - এইরূপ অনেকে মনে করেন, কিন্তু তাহা ঠিক নহে । অনুমানাদি প্ৰমাণখণ্ড ন্যায়শাস্ত্রের এক ভাগ সত্য, কিন্তু ইহা তাহার মুখ্য বিষয় নহে; প্রমাণসমূহের অতিরিক্ত, জগতের অন্তর্ভূত অনেক বস্তুর, অর্থাৎ প্রমেয় পদার্থের শ্রেণীবন্ধন বা বৰ্গীকরণ করিয়া, নিম্ন বর্গ হইতে উচ্চতর বর্গে আরোহণ করিতে করিতে, সৃষ্টির অন্তর্গত সমস্ত পদার্থের মূল বর্গ কিংবা পদার্থ কত, তাহাদের গুণধর্ম কি, তাহা হইতে পরে অন্য পদার্থের উৎপত্তি কেমন করিয়া হয় এবং এই বিষয় কি প্রকারে সিদ্ধ হইতে পারে, ইত্যাদি অনেক প্রশ্নেরও বিচার ন্যায়শাস্ত্রে করা হইয়াছে । ইহাই বলা উচিত যে, শুধু অনুমানখণ্ডের বিচার করিবার জন্য নহে, বরঞ্চ উক্ত প্ৰশ্নসমূহের বিচার করিবার জন্যই ন্যায়শাস্ত্র রচিত হইয়াছে । কণাদকৃত ন্যায়সূত্রের আরম্ভ ও পরবর্তী রচনাও এইপ্রকার । কণাদের অনুযায়ীদিগকে কাণাদ বলা যায় । ইহাদের মত এই যে, পরমাণুই জগতের মূল কারণ । কণাদের পরমাণুর ব্যাখ্যা ও পাশ্চাত্য আধিভৌতিকশাস্ত্রকারদিগের পরমাণুব্যাখ্যা একই প্রকার । যে কোন পদার্থের বিভাগ করিতে করিতে শেষে যখন আর বিভাগ হইতে পারে না তখন তাহাকে (পরম-অণু) পরমাণু বলে । এই পরমাণু যেমন-যেমন একত্র হয়, তেমনি-তেমনি সংযোগের কারণ তাহাদের মধ্যে নূতন নূতন গুণ উৎপন্ন হইয়া ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ হইয়া দাঁড়ায় । মন ও আত্মারও পরমাণু আছে; এবং উহা একত্ৰ হইলেই চৈতন্য হয় । পৃথিবী, জল, তেজ ও বায়ু, ইহাদের পরমাণু স্বভাবতই পৃথক পৃথক বা ভিন্ন ভিন্ন । পৃথিবীর মূল পরমাণুতে চার প্রকার গুণ (রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ), জলের পরমাণুতে তিন গুণ, তেজের পরমাণুতে দুই গুণ, এবং বায়ুর পরমাণুতে একটি গুণ আছে । এইরূপ সমস্ত জগৎ প্রথম হইতেই সূক্ষ্ম ও নিত্য পরমাণুর দ্বারা পরিপূর্ণ । পরমাণু ব্যতীত জগতের অন্য কোন মূল কারণ নাই । সূক্ষ্ম ও নিত্য পরমাণুগণের পরস্পরসংযোগ যখন ‘আরম্ভ’ হয়, তখন সৃষ্টির অন্তর্গত ব্যক্ত পদার্থ সকল রচিত হইতে থাকে । ব্যক্ত সৃষ্টির উৎপত্তি সম্বন্ধে নৈয়ায়িক-প্রতিপাদিত এই কল্পনার পারিভাষিক সংজ্ঞা – ‘আরম্ভ-বাদ’ । কোনো নৈয়ায়িক ইহা ছাড়াইয়া কখন যান না । এক জনের সম্বন্ধে এইরূপ একটা গল্প আছে যে, মরণসময়ে ঈশ্বরের নাম লইতে বলিলে তিনি চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “পীলবঃ ! পীলবঃ !” পরমাণু ! পরমাণু ! পরমাণু ! অন্য কোন নৈয়ায়িক স্বীকার করেন যে, পরমাণুর সংযোগের নিমিত্তকারণ ঈশ্বর । এইপ্রকারে তিনি সৃষ্টির কারণপরম্পরার শৃঙ্খলটি পূর্ণ করিয়া লন । এই প্ৰকার নৈয়ায়িকদিগকে “সেশ্বর নৈয়ায়িক” বলা হয় । বেদান্তসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে, এই পরমাণুবাদের [২|২|১১-১৭] এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গেই “ঈশ্বর কেবল নিমিত্ত কারণ” এই মতেরও খণ্ডন করা হইয়াছে ।

উপরি-উক্ত পরমাণুবাদ পাঠ করিয়া, রসায়নশাস্ত্ৰজ্ঞ ডাল্টন নামক পণ্ডিতপ্ৰতিপাদিত পরমাণুবাদ, ইংরেজিশিক্ষিত পাঠক স্মরণ না করিয়া থাকিতে পারেন না । কিন্তু পাশ্চাত্য দেশে ডাল্টনের পরমাণুবাদকে ডার্বিন নামক প্ৰসিদ্ধ সৃষ্টিশাস্ত্রজ্ঞের উৎক্রান্তিবাদ যেরূপ এক্ষণে পশ্চাতে ফেলিয়াছে, সেইরূপ আমাদের দেশেও প্রাচীনকালে সাংখ্যমত কণাদের মতকে পশ্চাতে নিঃক্ষেপ করিয়াছিল । মূল পরমাণুতে গতি কিরূপে আসিল ইহা কাণাদেরা বলিতে পারে না । তদ্ব্যতীত, বৃক্ষ পশু মনুষ্য ইত্যাদি সচেতন প্ৰাণীদিগের পর-পর উচ্চতর পদবী কি করিয়া হইল এবং অচেতনে সচেতনত্ব কি করিয়া আসিল, এ সকল বিষয়েরও তাহারা যথোচিত নিৰ্ণয় করিতে পারে না । পাশ্চাত্য দেশে উনবিংশ শতাব্দীতে লামার্কডার্বিন এবং আমাদের দেশে পুরাকালে কপিল মুনি এই নির্ণয় করিয়াছেন । একই মূলপদার্থের গুণসমূহের বিকাশ হইয়া জগতের সমস্ত রচনা হইয়াছে, এই দুই মতের ইহাই তাৎপর্য । সেইজন্য প্রথমে হিন্দুস্থানে এবং সমস্ত পাশ্চাত্যদেশেও পরমাণুবাদের উপর বিশ্বাস দাঁড়ায় নাই । এখন তো আধুনিক পদার্থশাস্ত্ৰজ্ঞেরা সিদ্ধ করিয়াছেন যে, পরমাণু অবিভাজ্য নহে । আজকাল যেরূপ সৃষ্টির অনেক পদার্থের পৃথক্‌করণ ও পরীক্ষণ করিয়া অনেক সৃষ্টিশাস্ত্রের প্রমাণ অনুসারে পরমাণুবাদ বা উৎক্রান্তিবাদ সিদ্ধ করা হইয়া থাকে, পূর্বে সেরূপ অবস্থা ছিল না । সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থের উপর নূতন নূতন ও ভিন্ন ভিন্ন পরীক্ষা প্রয়োগ করিয়া দেখা, কিংবা তাহাদিগকে অনেক প্রকারে পৃথক্কৃত করিয়া তাহাদের গুণধর্ম নির্ধারণ করা, কিংবা সজীব জগতের প্রাচীন ও নূতন অনেক প্রাণীদিগের শারীরিক অবয়বসমূহের একত্র তুলনা করা, ইত্যাদি আধিভৌতিকশাস্ত্রের অর্বাচীন যুক্তি কণাদের কিংবা কপিলের উপলদ্ধ ছিল না । তাঁহাদের দৃষ্টির সম্মুখে সেই সময় যে সকল সামগ্ৰী ছিল তাহা হইতেই তাঁহারা আপন সিদ্ধান্ত বাহির করিয়াছিলেন । তথাপি আশ্চর্যের বিষয় যে, সৃষ্টির অভিবৃদ্ধি ও তাহার সংগঠন কি করিয়া হইয়াছিল এই সম্বন্ধে সাংখ্যশাস্ত্রকারগণ কর্তৃক প্রদত্ত তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে এবং অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্রের তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তে অধিক প্ৰভেদ নাই ।


3) কাপিল সাংখ্য 


সৃষ্টিশাস্ত্রের জ্ঞান বৃদ্ধি হওয়া প্ৰযুক্ত এই মতের (আধিভৌতিক শাস্ত্রের) আধিভৌতিক উপপত্তির বর্ণন বর্তমানকালে অধিক নিয়মবদ্ধ প্ৰণালীতে করা যাইতে পারে, এবং আধিভৌতিক জ্ঞানের বৃদ্ধির দরুন ব্যবহারিক দৃষ্টিতেও মনুষ্যের অনেক লাভ হইয়াছে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । কিন্তু ‘একই অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে নানাবিধ ব্যক্ত সৃষ্টি কি করিয়া হইল’ এই বিষয়ে অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্ৰকারও কপিল অপেক্ষা বেশী কিছুই বলিতে পারেন নাই । ইহার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করিবার জন্যই পরে আমি কপিলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গেই তুলনা করিবার অভিপ্ৰায়ে স্থানে স্থানে হেকেলের সিদ্ধান্তগুলিরও সংক্ষেপে বৰ্ণনা করিয়াছি । হেকেল নিজ গ্রন্থে স্পষ্ট লিখিয়া দিয়াছেন যে, তিনি এই সিদ্ধান্ত নূতন বাহির করেন নাই; ডার্বিন, স্পেনসর প্রভৃতি তৎপূর্ববৰ্তী আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের গ্রন্থের প্রমাণ অনুসারেই নিজের সিদ্ধান্তসমূহ প্ৰতিপাদনা করিয়াছেন । তথাপি সিদ্ধান্ত যথাযথ নিয়মানুসারে লিখিয়া সর্বপ্রথম তিনিই এই সকল, একত্ৰ জুড়িয়া “বিশ্বের রহস্য” নামক গ্রন্থে সেগুলিকে একত্ৰ করিয়া সরল প্ৰণালীতে বিবৃত করিয়াছেন । (“The Riddle of the Universe”, by Earnest Hackel, এই গ্রন্থের R. P. A. Cheap reprint সংস্করণের আমি সর্বত্র উপযোগ করিয়াছি ।) এই কারণে সুবিধার জন্য হেকেলকেই আধিভৌতিক তত্ত্বজ্ঞদিগের প্রধান মানিয়া তাঁহারই মত এই প্রকরণে ও পরবর্তী প্রকরণে বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছি । এই উল্লেখ খুবই যে সংক্ষিপ্ত, তাহা আর বলিয়া দিতে হইবে না । কিন্তু এখানে ইহা অপেক্ষা এই সকল সিদ্ধান্তের অধিক বিচার করা যাইতে পারে না । যাহারা এই সম্বন্ধে সবিস্তার জানিতে চাহেন তাহাদের স্পেনসর, ডার্বিন, হেকেল প্রভৃতির মূলগ্রন্থ অবলোকন করা আবশ্যক । 


3.1) ‘সাংখ্য’ শব্দের অর্থ



কাপিলসাংখ্যশাস্ত্রের বিচার করিবার পূর্বে, ‘সাংখ্য’ শব্দের ভিন্ন ভিন্ন দুইটী অর্থ আছে তাহা এখানে বলা আবশ্যক । প্ৰথম অর্থ কপিলাচার্যপ্ৰতিপাদিত সাংখ্যশাস্ত্ৰ । তাহাই এই প্রকরণে এবং ভগবদ্‌গীতাতেও একবার [গী|১৮|১৩] উল্লেখ করা হইয়াছে । কিন্তু, এই বিশিষ্ট অর্থ ব্যতীত সর্বপ্রকারের তত্ত্বজ্ঞানেরও সাধারণত এই নামই দিবার রীতি আছে; এবং এই ‘সাংখ্য’ শব্দে বেদান্তশাস্ত্রেরও সমাবেশ হয় । ‘সাংখ্যনিষ্ঠা’ কিম্বা ‘সাংখ্যযোগ’ শব্দে, ‘সাংখ্য’ শব্দের এই সাধারণ অর্থই বিবক্ষিত হইয়া থাকে । এই নিষ্ঠার অন্তর্গত জ্ঞানীপুরুষদিগকেও ভগবদ্‌গীতাতে যেখানে [গী|২|৩৯; ৩|৩; ৫|৪,৫ ও ১৩|১৪] ‘সাংখ্য’ বলা হইয়াছে, সেই স্থানে ‘সাংখ্য’ শব্দের অর্থ কেবল ক্যাপিলসাংখ্যমার্গীই নহে; বরঞ্চ উহাতে আত্মানাত্মবিচারের দ্বারা সন্ন্যাসপূর্বক ব্ৰহ্মজ্ঞানেতেই যাহারা নিমগ্ন থাকে সেই সকল বৈদান্তিকেরও সমস্ত কর্মের সমাবেশ করা হইয়া থাকে । শব্দশাস্ত্রজ্ঞদিগের মত এই যে, ‘সাংখ্য’ শব্দ ‘সং-খ্যা’ ধাতু হইতে বাহির হওয়া প্ৰযুক্ত তাহার প্রথম অর্থ ‘গণনাকারী’; এবং কপিলশাস্ত্রের মূলতত্ত্ব গণনায় পঞ্চবিংশতি হওয়াতেই ঐ ‘গণনাকারী’র অর্থে এই বিশিষ্ট ‘সাংখ্য’ নাম দেওয়া হইয়াছে; তাহার পর আবার ‘সাংখ্য’ অর্থাৎ সাধারণতঃ সমস্ত প্ৰকার তত্ত্বজ্ঞান — এই ব্যাপক অর্থ দাঁড়াইয়া গিয়াছে — এইরূপ শব্দশাস্ত্ৰ সমূহের মত । তাই, কপিলভিক্ষুকে ‘সাংখ্য’ বলিবার রীতি প্ৰথমে দাঁড়াইয়া গেলে, পরে বেদান্তী সন্ন্যাসীকেও ঐ নাম দেওয়া হইয়া থাকিবে ইহাই কারণ মনে হয় । যাহাই হৌক, সাংখ্য শব্দের এই অৰ্থভেদ প্ৰযুক্ত পাছে গোলযোগ হয় এইজন্য ইচ্ছা করিয়াই আমি এই প্ৰকরণের “কাপিলসাংখ্যশাস্ত্ৰ” এই লম্বাচৌড়া নাম দিয়াছি ।


3.2) কাপিল সাংখ্যবিষয়ক গ্রন্থ



কাণাদ ন্যায়শাস্ত্রের ন্যায় এই কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রেরও সূত্ৰ আছে । কিন্তু গৌড়পাদ বা শারীরকভাষ্যকার শ্ৰীশঙ্করাচার্য এই সকল সূত্র আপন গ্রন্থের প্রমাণ স্বরূপে গ্ৰহণ করেন নাই বলিয়া ঐ সকল সূত্র প্ৰাচীন না হইতে পারে এইরূপ অনেক বিদ্বান লোকের মত । ঈশ্বরকৃষ্ণের* সাংখ্যকারিকা তদপেক্ষা প্রাচীন বলিয়া তাহারা মনে করেন এবং তাহার উপর শঙ্করাচার্যের গুরু গৌড়পাদ ভাষ্য লিখিয়াছেন । শঙ্করভাষ্যে এই কারিকা হইতেও অনেক কথা উদ্ধৃত হইয়াছে । ৫৭০ খৃষ্টাব্দের পূর্বে চিনীয় ভাষায় অনূদিত উক্ত গ্রন্থের ভাষান্তর অধুনা পাওয়া গিয়াছে । ‘ষষ্ঠিতন্ত্র’ নামক ষাট প্রকরণের এক প্রাচীন ও বিস্তৃত গ্রন্থের তাৎপর্য (কোন কোন প্রকরণ ছাড়িয়া দিয়া) সত্তর আর্য্যাশ্লোকে এই গ্রন্থে দেওয়া হইয়াছে, ইহা ঈশ্বরকৃষ্ণ নিজের কারিকার শেষভাগে বলিয়াছেন । এই ষষ্ঠিতন্ত্র গ্রন্থ এখন পাওয়া যায় না । তাই এই কারিকার আধারেই কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্তগুলি আমি এখানে আলোচনা করিয়াছি । 

*(ঈশ্বরকৃষ্ণ সম্বন্ধে এক্ষণে বৌদ্ধগ্রন্থাদি হইতে অনেক বিবরণ পাওয়া গিয়াছে । বৌদ্ধ-পণ্ডিত বসুবন্ধুর গুরু এই ঈশ্বরকৃষ্ণের সমকালীন প্রতিপক্ষ ছিলেন; এই বসুবন্ধুর পরমাৰ্থ কর্তৃক (খৃষ্টাব্দ ৪৯৯-৫৬৯) চিনীয় ভাষায় লিখিত চরিত্র এক্ষণে প্রকাশিত হইয়াছে । তাহা হইতে ঈশ্বরকৃষ্ণের কাল প্রায় খৃষ্টাব্দ ৪৫০ হইবে, এইরূপ ডাক্তার টককসু স্থির করিয়াছেন । Journal of the Royal Asiatic Society of Great Britain & Ireland, 1905, PP. 33-53, কিন্তু ডাক্তার ভিন্সেন্ট স্মিথের মতে স্বয়ং বসুবন্ধুর কালই খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে (প্রায় ২৮০-৩৬০) ধরিতে হয় । কারণ সেই গ্রন্থের ভাষান্তর খৃঃ ৪০৪এ চিনীয় ভাষায় হইয়াছে । বসুবন্ধুর কাল এইরূপ পিছাইয়া পড়ায় ঈশ্বরকৃষ্ণের কালও সেইরূপ প্ৰায় দুইশত বৎসর পশ্চাৎ অর্থাৎ খঃ ২৪০ ধরিতে হয় । Vincent Smith's “Early History pf India”, 3d Ed, P.328.)


মহাভারতে কয়েক অধ্যায়ে সাংখ্যমতের নিরূপণ করা হইয়াছে । কিন্তু তাহাতে বৈদান্তিকমতের মিশ্রণ থাকায় শুদ্ধ কাপিল সাংখ্যমতটি কি তাহা স্থির করিবার জন্য অন্য গ্ৰন্থও দেখা আবশ্যক হয় । এই কার্যে উক্ত সাংখ্যকারিকা অপেক্ষা অধিকতর প্রাচীন অন্য গ্ৰন্থ, এক্ষণে পাওয়া যায় না । “সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ” [গী|১০|২৬] সিদ্ধদিগের মধ্যে কপিল মুনি আমি - ভগবান গীতায় যে এইরূপ বলিয়াছেন তাহা হইতে কপিলের যোগ্যতা সিদ্ধ হইতেছে । তথাপি কপিল ঋষি কোথায় এবং কখন আবির্ভূত হইয়াছিলেন তাহার ঠিকানা নাই । শান্তিপর্বের একস্থলে [৩৪০|৬৭] উল্লেখ আছে যে, সনৎকুমার, সনক, সনন্দন, সনৎসুজাত, সন, সনাতন এবং কপিল - ব্ৰহ্মদেবের এই সাত মানসপুত্র । জন্মিবামাত্রই তাঁহাদের জ্ঞান হইয়াছিল । আর এক স্থানে [শাং|২১৮] । কপিল-শিষ্য আসুরির শিষ্য পঞ্চশিখ জনককে সাংখ্যশাস্ত্রের উপদেশ দিয়াছিলেন তাহার উল্লেখ আছে । সেইরূপ আবার, শান্তিপর্বে [৩০১|১০৮|১০৯] ভীষ্ম বলিয়াছেন যে, সাংখ্যেরা সৃষ্টিরচনা সম্বন্ধে যে জ্ঞান এক সময় প্ৰবর্তিত করিয়াছেন, তাহাই “পুরাণে, ইতিহাসে, অর্থশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতি সর্বস্থানে” দেখিতে পাওয়া যায় । অধিক কি, “জ্ঞানং চ লোকে যদিহাস্তি কিঞ্চিৎ সাংখ্যগতং তচ্চ মহন্মহাত্মন্‌” — এই জগতের সমস্ত জ্ঞান সাংখ্যগণ হইতেই নিঃসৃত হইয়াছে । পাশ্চাত্য গ্ৰন্থকার অধুনা সকল স্থলে উৎক্রান্তিবাদের কিরূপ উপযোগ করিতেছেন তাহার প্রতি লক্ষ্য করিলে উৎক্রান্তিশাস্ত্রেরই অনুরূপ আমাদের প্রাচীন সাংখ্যশাস্ত্রেরও ন্যূনাধিক অংশ এদেশবাসী সকলেই যে স্বীকার করিয়াছিলেন তাহা কিছুই আশ্চর্য মনে হইবে না । ‘গুরুত্বাকর্ষণ’, জগৎরচনার ‘উৎক্রান্তিতত্ত্ব’* বা ব্ৰহ্মাত্মৈক্য, এই রকমের উচ্চ কল্পনা শত শত বৎসরেই কোন এক মহাত্মার মনে উদয় হইয়া থাকে । তাই, যে সময়ে যে সাধারণ সিদ্ধান্ত বা ব্যাপক তত্ত্ব সমাজে প্রচলিত থাকে, তাহারই উপর ভিত্তিস্থাপন করিয়া কোন গ্রন্থের তত্ত্ব প্রতিপাদন করিবার রীতি সাধারণত সর্বদেশের গ্রন্থেই দেখিতে পাওয়া যায় ।

*(উৎক্রান্তিবাদ এই শব্দ Evolution Theory এই অর্থে আজকাল প্রচলিত হওয়া প্রযুক্ত আমি এখানে ব্যবহার করিয়াছি । কিন্তু ‘উৎক্রাক্তি’ এই শব্দের অর্থ সংস্কৃত ভাষায় ‘মরণ’ । তাই উৎক্রান্তিতত্ত্বশব্দ অপেক্ষা গুণবিকাশ, গুণৎকর্ষ কিংবা গুণপরিণাম প্রভৃতি সাংখ্যদিগের শব্দের উপযোগ করা আমার মতে অধিক প্রশস্ত ।)

3.3) কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রের মূল সিদ্ধান্ত


3.3.1) সৎকার্যবাদ

সে যাক; কাপিলসাংখ্যশাস্ত্রের অভ্যাস আজকাল প্রায় লুপ্ত হওয়া প্রযুক্ত এই প্রস্তাবনা করা আবশ্যক হইয়াছে । এক্ষণে কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রের মুখ্য সিদ্ধান্তগুলি কি তাহা দেখা যাক্‌ । সাংখ্যশাস্ত্রের প্রথম সিদ্ধান্ত এই যে, এই জগতে নূতন কিছুই উৎপন্ন হয় না; কারণ, শূন্য অর্থাৎ যাহা পুর্বে ছিলই না তাহা হইতে শূন্য ছাড়া অন্য কিছুই নিষ্পন্ন হইতে পারে না । তাই, উৎপন্ন বস্তুতে অর্থাৎ কার্যে যে গুণ দৃষ্টিগোচর হয় তাহা, যাহা হইতে উক্ত বস্তু উৎপন্ন হইয়াছিল তাহাতে অর্থাৎ কারণে সূক্ষ্ম আকারে অবশ্যই ছিল, ইহা সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে [সাং|কা|৯] । বৌদ্ধ ও কাণাদদিগের মতে, এক পদার্থের নাশ হইয়া তাহা হইতে অন্য নূতন পদার্থ প্রস্তুত হয়; উদাহরণ যথা – বীজের নাশ হইয়া তাহা হইতে অঙ্কুর এবং অঙ্কুরের নাশ হইয়া তাহা হইতে বৃক্ষ ইত্যাদি হয় । কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রী ও বেদান্তীগণ এ মত স্বীকার করেন না । তাঁহারা প্ৰতিপাদন করেন যে, বৃক্ষের বীজে যে দ্রব্য আছে তাহা বিনষ্ট না হইয়া তাহাই ভূমি হইতে ও বায়ু হইতে অন্য দ্রব্য আকর্ষণ করিয়া লওয়া প্ৰযুক্ত বীজ অঙ্কুরের নূতন রূপ বা অবস্থা প্ৰাপ্ত হয় [বেসূ|শাং|ভা|২|১|২৮] । সেইরূপ কাঠ জ্বলিলে তাহারই ছাই, ধোঁয়া ইত্যাদি রূপান্তর হয়; কাঠের মূল দ্রব্য বিনষ্ট হইয়া ধূম নামক কোন নুতন পদার্থ উৎপন্ন হয় না । ছান্দোগ্যোপনিষদে উক্ত হইয়াছে [ছাং|৬|২|২] যে, “কথমসতঃ সজ্জায়েত” – যাহা নাই তাহা হইতে যাহা আছে তাহা কি প্রকারে উৎপন্ন হইবে ? জগতের মূল কারণের প্রতি ‘অসৎ’ শব্দের উপযোগ কখনো কখনো উপনিষদে করা হইয়াছে [ছাং|৩|১৯|১; তৈ|২|৭|১]; কিন্তু এখানে অসৎ শব্দের অর্থ ‘অভাব = নাই’ নহে; বেদান্তসূত্রে স্থিরীকৃত হইয়াছে যে, [বেসু|২|১|১৬, ১৭] কেবল নাম রূপাত্মক ব্যক্ত স্বরূপের বা অবস্থার অভাবই বিবক্ষিত । দুগ্ধ হইতেই দধি হয়, জল হইতে হয় না; তিল হইতে তৈল্য বাহির হয়, বালুকা হইতে বাহির হয় না; ইত্যাদি প্ৰত্যক্ষ অনুভব হইতেও এই সিদ্ধান্ত প্ৰকাশ পাইতেছে । কারণে যে গুণ নাই সেই গুণ ‘কার্যে’ স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হয় ইহা যদি স্বীকার করা যায়, তবে জল হইতে দধি কেন হয় না, ইহার কারণ আমি বলিতে পারি না । সার কথা - যাহা মূলেতেই নাই তাহ হইতে, যাহা এক্ষণে অস্তিত্বে আছে তাহা উৎপন্ন হইতে পারে না । তাই, যে কোন কার্য ধর না কেন, তাহার বর্তমান দ্রব্যাংশ ও গুণ মূল কারণেও কোন না কোন আকারে থাকা চাই, সাংখ্যেরা এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । এই সিদ্ধান্তেরই নাম ‘সৎকার্যবাদ’ । অর্বাচীন পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্রীরাও এই সিদ্ধান্ত খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন যে, পদার্থসমূহের জড়দ্রব্য ও কর্মশক্তি উভয়ই চিরস্থায়ী; কোন পদার্থের যতই রূপান্তর হোক না কেন, শেষে সৃষ্টির সমগ্র দ্রব্যাংশের ও কর্মশক্তির মোট পরিমাণ নিয়ত সমানই থাকে । উদাহরণ যথা - দীপ জ্বলিয়া তৈল বিনষ্ট হইতেছে মনে হইলেও আসলে তৈলের পরমাণু মোটেই বিনষ্ট হয় না । কাজল, ধোঁয়া বা অন্য সূক্ষ্ম দ্রব্যের আকারে ঐ পরমাণুর অস্তিত্ব থাকে । এই সূক্ষ্ম দ্রব্যসকল একত্ৰ করিয়া ওজন করিলে তাহা এবং তৈল পুড়িবার সময় তাহার সহিত মিশ্ৰিত বায়ুস্থিত পদার্থ এই দুইয়ের ওজন সমান হইয়া থাকে । এক্ষণে ইহাও সিদ্ধ হইয়াছে যে, এই নিয়ম কর্মশক্তিসম্বন্ধেও প্ৰযুক্ত হইতে পারে । কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে, আধুনিক পদার্থবিদ্যাশাস্ত্রের এবং সাংখ্যের সিদ্ধান্ত দেখিতে এক হইলেও সাংখ্যগণের সিদ্ধান্ত এক পদার্থ হইতে অন্য পদার্থ উৎপত্তি বিষয়ে অর্থাৎ কেবল কার্যকারণভাবেরই সম্বন্ধে উপযুক্ত । কিন্তু অর্বাচীন পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত ইহা হইতে অধিক ব্যাপক । ‘কার্যের’ কোন গুণই ‘কারণ’-বহির্ভূত গুণ হইতে উৎপন্ন হইতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, যখন কারণ কার্যের স্বরূপ প্ৰাপ্ত হয়, তখন সেই কার্যের দ্রব্যাংশ ও কর্মশক্তির একটুও নাশ হয় না; পদার্থের বিভিন্ন অবস্থার দ্রব্যাংশ ও কর্মশক্তির মোট পরিমাণ সর্বদাই একই থাকে, বাড়েও না কমেও না । এই বিষয় প্ৰত্যক্ষ পরীক্ষার দ্বারা গণিতপদ্ধতি অনুসারে এক্ষণে স্থিরীকৃত হইয়াছে । ইহাই উক্ত দুই সিদ্ধান্তের গুরুতর বিশেষত্ব । এই প্রকার দৃষ্টিতে দেখিলে জানা যায় যে, ভগবদ্‌গীতার “নাসতো বিদ্যতে ভাবঃ” - যাহা মূলেই নাই তাহার কখন অস্তিত্ব আসিতে পারে না - ইত্যাদি যে সিদ্ধান্ত দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে প্ৰদত্ত হইয়াছে [গী|২|১৬] তাহা সৎকার্যবাদের মতো দেখিতে হইলেও, কেবল কার্যকারণাত্মক সৎকার্যবাদ অপেক্ষা অর্বাচীন পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সহিত তাহার সাদৃশ্য অধিক । উপরে প্রদত্ত ছান্দোগ্য-উপনিষদের বচনেরও ইহাই ভাবার্থ । সার কথা - সৎকার্যবাদের সিদ্ধান্ত বেদান্তীরা স্বীকার করেন । কিন্তু অদ্বৈত বেদাস্তশাস্ত্রের মত এই যে, এই সিদ্ধান্ত সগুণ সৃষ্টির বাহিরে একটুও প্রযুক্ত হইতে পারে না, এবং নির্গুণ হইতে সগুণের উৎপত্তি কিরূপ দেখায় তাহার উপপত্তি অন্য প্রকারে লাগাইতে হইবে । এই বেদান্তমতের বিচার পরে অধ্যাত্মপ্রকরণে বিস্তৃতভাবে করা যাইবে । আপাতত সাংখ্যমতবাদের দৌড় কোন পর্যন্ত, তাহারই বিচার করা কর্তব্য হওয়ায় সৎকাৰ্যবাদের সিদ্ধান্ত মানিয়া লইয়া ক্ষরাক্ষরশাস্ত্ৰে সাংখ্যেরা তাহার কিরূপ উপযোগ করিয়াছেন তাহার বিচার করিব ।

3.3.2) জগতের মূল দ্রব্য অথবা প্রকৃতি একই

সাংখ্যমতানুসারে সৎকার্যবাদ সিদ্ধ হইলে পর, এই মতটি আপনা-আপনিই খণ্ডিত হইয়া যায় যে, দৃশ্য জগতের উৎপত্তির পুর্বে কোন পদার্থই ছিল না, উহা শূন্য হইতে উৎপন্ন হইয়াছে । কারণ, শূন্য অর্থে – ‘যাহা কিছুই নাই’ বুঝায়; এবং যাহা নাই তাহা তইতে ‘যাহা অস্তিত্বে আছে’ তাহা কখনই উৎপন্ন হইতে পারে না । ইহা হইতে স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে যে, জগৎ কোন না কোন পদার্থ হইতে অবশ্য উৎপন্ন হইয়াছে; এবং এক্ষণে জগতের যে গুণ দেখিতে পাই তাহাই এই মূল পদার্থেও অবশ্য থাকা চাই । এক্ষণে জগতের দিকে চাহিয়া দেখিলে বৃক্ষ, পশু, মনুষ্য, পাথর, সোনা, রূপা, হীরা, জল, বায়ু প্ৰভৃতি অনেক পদার্থ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় । এবং এই সকলের রূপ ও গুণও বিভিন্ন । সাংখ্যদিগের সিদ্ধান্ত এই যে, এই বিভিন্নতা বা নানাত্ব আদিতে অর্থাৎ মূল পদার্থে নাই; মূলে সমস্ত পদার্থের মূলবস্তু একই । অৰ্বাচীন রসায়নশাস্ত্ৰজ্ঞগণ বিভিন্ন দ্রব্যের পৃথককরণ করিয়া প্ৰথমে বাষট্টি (৬২) মূল তত্ত্ব বাহির করিয়াছিলেন; কিন্তু এখন পাশ্চাত্য পদার্থশাস্ত্রবেত্তারাও স্থির করিয়াছেন যে, এই ৬২ মূল তত্ত্ব স্বতন্ত্র বা স্বয়ং সিদ্ধ নহে, কিন্তু এই সকলের মূলে একটি কোন পদার্থ আছে এবং সেই পদার্থ হইতেই সূর্য, চন্দ্র, তারকা, পৃথ্বী প্রভৃতি সমস্ত সৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে । সেই কারণে এক্ষণে এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অধিক বিচার আলোচনা আবশ্যক নাই । জগতের সমস্ত পদার্থের এই যে মূল বস্তু তাহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘প্রকৃতি’ বলে । প্ৰকৃতির অর্থ ‘মূলের’ । এই প্রকৃতি হইতে পরে যে সকল পদার্থ উৎপন্ন হয় তাহাকে ‘বিকৃতি’ অর্থাৎ মূল বস্তুর বিকার নাম দেওয়া হইয়াছে ।

3.3.3) সত্ত্ব, রজ ও তম উহার তিন গুণ

কিন্তু সমস্ত পদার্থের মধ্যে মূল বস্তু একই হইলেও যদি এই মূল বস্তুর গুণও একই হয়, তবে সৎকার্যবাদ অনুসারে এই একই গুণ হইতে অনেক গুণ উৎপন্ন হওয়া সম্ভব নহে । এবং এদিকে যখন এই জগতের পাথর, মাটি, জল, সোণা ইত্যাদি বিভিন্ন পদার্থ দেখি, তখন ঐ সকলে বিভিন্ন অনেক গুণ চোখে পড়ে । তাই প্রথমে পদার্থসমূহের গুণ সকল নিরীক্ষণ করিয়া সাংখ্যেরা এই গুণসমূহের সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন ভেদ বা বর্গ নির্ধারণ করিয়াছেন । কারণ যে কোন পদার্থ ধর না কেন, তাহার শুদ্ধ, নির্মল কিংবা পূৰ্ণাবস্থা, এবং তদ্বিরুদ্ধ নিকৃষ্টাবস্থা এই দুই ভেদ স্বভাবতই দৃষ্টিগোচর হয় । কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সেই পদার্থের নিকৃষ্ট অবস্থা হইতে পুর্ণাবস্থার দিকে উন্নত হইবার প্রবৃত্তিও দৃষ্টিগোচর হয় । ইহাই তৃতীয় অবস্থা । এই তিন অবস্থার মধ্যে শুদ্ধাবস্থা বা পূৰ্ণাবস্থাকে সাত্ত্বিক, নিকৃষ্টাবস্থাকে তামসিক ও প্ৰবর্তক অবস্থাকে রাজসিক বলা যায় । সাংখ্যগণ বলিয়া থাকেন যে, সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ সমস্ত পদার্থের মূলবস্তুরও অর্থাৎ প্ৰকৃতিতে প্রারম্ভ হইতেই আছে । অধিক কি, এই তিন গুণকেই প্রকৃতি বলিলে অনুচিত হইবে না । 

3.3.4) ত্রিগুণের সাম্যাবস্থা ও পারস্পরিক সংঘর্ষ-বিবাদে নানা পদার্থের উৎপত্তি

এই তিন গুণের মধ্যে প্ৰত্যেকেরই বল আরম্ভে একইরূপ থাকায় প্রথম প্রথম এই প্ৰকৃতি সাম্যাবস্থায় থাকে । এই সাম্যাবস্থা জগতের আরম্ভে ছিল; এবং জগতের লয় হইলে পুনৰ্বার হইবে । সাম্যাবস্থাতে কোন নড়াচড়া নাই, যাহা কিছু সমস্ত স্তব্ধ থাকে । কিন্তু যখন এই তিন গুণ কম বেশী হইতে আরম্ভ হয়, তখন প্রবৃত্তাত্মক রজোগুণের দরুণ, মূল প্রকৃতি হইতে বিভিন্ন পদার্থ উৎপন্ন হইয়া সৃষ্টির আরম্ভ হয় । এখন এখানে এই প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ প্রথমে সাম্যাবস্থায় থাকিলে তাহার মধ্যে ন্যূনাধিক্য কিরূপ উৎপন্ন হইল ? সাংখ্যেরা তাহার উত্তরে বলেন যে, ইহা প্ৰকৃতির মূল ধর্মই [সাং|কা|৬১] । প্রকৃতি জড় হইলেও, তাহা আপনা-আপনিই সমস্ত ব্যবহার করিতে থাকে । এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণের লক্ষণই জ্ঞান অর্থাৎ জানা এবং তমোগুণের লক্ষণ অজ্ঞান । রজোগুণ ভালমন্দ কর্মের প্ৰবর্তক । এই তিন গুণ কখনই পৃথক পৃথক থাকিতে পারে না । সকল পদার্থে সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের মিশ্রণ থাকে; এবং এই মিশ্ৰণ নিয়তই এই তিনের অন্যোন্য-ন্যূনাধিক্য অনুসারে হয় । তাই মূলবস্তু এক হইলেও গুণভেদের দরুণ এক মূল বস্তুরই সোনা, লোহা, মাটি, জল, আকাশ, মানবশরীর ইত্যাদি অনেক বিভিন্ন বিকার হইয়া থাকে । যাহাকে আমরা সাত্ত্বিক গুণের পদাৰ্থ বলি, তাহাতে রজ ও তম এই দুই গুণ অপেক্ষা সত্ত্বের বল বা পরিমাণ অধিক থাকায়, সেই পদার্থে সদাবস্থিত রজ ও তম চাপা পড়ে, কাজেই আমাদের চোখে পড়ে না । বস্তুত সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণ অন্য পদার্থের ন্যায় সাত্ত্বিক পদার্থেও থাকে । নিছক্‌ সত্ত্বগুণী, নিছক রজোগুনী, কিংবা নিছক তমোগুণী কোন পদার্থই নাই । প্ৰত্যেক পদার্থে তিন গুণেরই সংঘর্ষ চলিতে থাকে; এবং এই সংঘর্ষে যে গুণ প্ৰবল হয় তদনুসারে প্রত্যেক সাত্ত্বিক, রাজসিক বা তামসিক বলা যায় [সাং|কা|১২; মভা|অশ্ব-অনুগীতা-৩৬ ও শাং|৩০৫] । উদাহরণ যথা - নিজের শরীরে রজ ও তম এই দুইয়ের উপর সত্ত্বের প্রাধান্য হইলে আমাদের অন্তঃকরণে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, সত্য কি তাহা আমরা জানিতে পারি, এবং চিত্তবৃত্তি শান্ত হয় । সেই সময়ে ইহা বুঝিতে হইবে না যে, নিজের রজোগুণ ও তমোগুণ একেবারেই থাকে না; তবে কিনা, সেগুলি সত্ত্বগুণের প্রভাবে দমিয়া থাকায় তাহাদের কোন অধিকার দাঁড়াইতে পারে না [গী|১৪|১০] । সত্ত্বের বদলে রজোগুণ যদি প্ৰবল হয় তবে ওন্তঃকরণে লোভ জাগ্রত হইয়া আকাঙ্ক্ষা বাড়িতে থাকে এবং তাহা আমাকে অনেক কার্যে প্ৰবৃত্ত করায় । সেইরূপ সত্ত্ব ও রজ এই দুইয়ের উপর তমোগুণের প্ৰাধান্য হইলে নিদ্রা, আলস্য, স্মৃতিভ্ৰংশ প্রভৃতি দোষ শরীরে উৎপন্ন হয় । তাৎপর্য এই যে, জাগতিক পদার্থে সোনা, লোহা, পারা ইত্যাদি যে নানাত্ব বা প্ৰভেদ দৃষ্ট হয়, তাহা প্ৰকৃতির সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণেরই পরস্পর ন্যূনাধিকতার ফল । মূল প্ৰকৃতি এক হইলেও জানা চাই যে, এই নানাত্ব বা ভিন্নতা কিরূপে উৎপন্ন হয় । ইহারই যে বিচার তাহাকে বিজ্ঞান বলে । ইহাতেই সমস্ত আধিভৌতিক শাস্ত্রেরও সমাবেশ হয় । উদাহরণ যথা - রসায়নশাস্ত্ৰ, বিদ্যুৎশাস্ত্ৰ, পদার্থবিজ্ঞানশাস্ত্ৰ, এই সমস্ত বিবিধ জ্ঞানই বিজ্ঞান ।

3.3.5) প্রকৃতি অব্যক্ত, অখণ্ডিত, একই ও অচেতন

সাম্যাবস্থায় প্ৰকৃতি সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘অব্যক্ত’ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর কথিত হইয়াছে । এই প্রকৃতির সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিন গুণের পরস্পর ন্যূনাধিকতার কারণে যে অনেক পদাৰ্থ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় অর্থাৎ যাহা আমরা দেখি, শুনি, আস্বাদ করি, আঘ্রাণ করি বা স্পর্শ করি, সাংখ্যশাস্ত্রে তাহাই ‘ব্যক্ত’ বলা হইয়াছে । ‘ব্যক্ত’ অর্থে স্পষ্টরূপে আমাদের ইন্দ্ৰিয়গোচর পদার্থ; তাহা আকৃতির দ্বারা, রূপের দ্বারা গন্ধের দ্বারা বা অন্য কোন যে গুণের দ্বারাই ব্যক্তি হউক । ব্যক্ত পদার্থ অনেক । তন্মধ্যে গাছ পাথর প্রভৃতি কতকগুলি স্থূল; আর মন, বুদ্ধি, আকাশ প্ৰভৃতি কতকগুলি ইন্দ্ৰিয়গোচর অর্থাৎ ব্যক্ত হইলেও সূক্ষ্ম । সুক্ষ্মের অর্থ এ স্থলে ক্ষুদ্র নহে; কারণ, আকাশ সূক্ষ্ম হইলেও সমস্ত জগৎ ব্যাপ্ত করিয়া রহিয়াছে । তাই, সূক্ষ্ম অর্থে স্থূলের বিপরীত, বা বায়ু হইতেও অনেক সূক্ষ্ম, এইরূপ বুঝিতে হইবে । ‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থূল” এই দুই শব্দের দ্বারা যে-কোন বস্তুর শরীররচনার জ্ঞান হয়; এবং ‘ব্যক্ত’ ও ‘অব্যক্ত’ এই দুই শব্দের দ্বারা, উক্ত বস্তুর প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করা আমাদের পক্ষে সন্তব বা সম্ভব নহে, ইহাই বোধগম্য হয় । তাই, দুই বিভিন্ন পদার্থের (উভয়ই সূক্ষ্ম হইলেও) মধ্যে একটি ব্যক্ত এবং অন্যটি অব্যক্ত হইতে পারে । উদাহরণ যথা - বায়ু সূক্ষ্ম হইলেও স্পর্শেন্দ্রিয় তাহা জানিতে পারে বলিয়া তাহাকে ব্যক্ত বলি; এবং সমস্ত পদার্থের মূলবস্তু বা মূল প্রকৃতি, বায়ু অপেক্ষাও অত্যন্ত সূক্ষ্ম হওয়া প্ৰযুক্ত কোন ইন্দ্রিয়ই তাহাকে জানিতে পারে না, তাই প্ৰকৃতিকে অব্যক্ত বলি । প্ৰকৃতি যদি কোন ইন্দ্রিয়েরই গোচর না হয়, তবে প্রকৃতি আছে কি না তাহার প্রমাণ কি, এই প্রশ্ন আসিয়া উপস্থিত হয় । সাংখ্যেরা এই প্রশ্নের উত্তর দেন যে, অনেক ব্যক্ত পদার্থের অবলোকন হইতে সৎকার্যবাদ অনুসারে এই অনুমান সিদ্ধ হয় যে, এই সকল পদার্থের মূল রূপ (প্ৰকৃতি) ইন্দ্ৰিয়সমক্ষে প্ৰতিভাত না হইলেও সূক্ষ্মরূপে তাহার অস্তিত্ব অবশ্য থাকাই চাই [সাং|কা|৮] । বেদান্তীরাও ব্ৰহ্মের অস্তিত্ব সিদ্ধ করিবার সময় এই যুক্তিই স্বীকার করিয়াছেন [কঠ|৬|১২, ১৩ উহার শাঙ্কর ভাষ্য দেখ] । প্ৰকৃতিকে এই প্রকার অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত স্বীকার করিলে নৈয়ায়িকদিগের পরমাণুবাদ আপনা-আপনিই সমূলে খণ্ডিত হইয়া যায় । কারণ পরমাণু অব্যক্ত ও অসংখ্য হইলেও, প্রত্যেক পরমাণুর স্বতন্ত্র ব্যক্তি বা অবয়ব হওয়া প্ৰযুক্ত এই প্রশ্ন আবার বাকী থাকিয়া যায় যে, দুই পরমাণুর মধ্যস্থলে কোন পদার্থ আছে । এইজন্য সাংখ্যশাস্ত্রের এইরূপ সিদ্ধান্ত যে প্রকৃতিতে পরমাণুরূপ অবয়বভেদ নাই; কিন্তু উহা সর্বদাই একসংলগ্ন, মধ্যে একটুও ব্যবধান থাকে না, এক-সমান; অথবা ইহা বলা যায় যে, উহা অব্যক্ত (অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অগোচর) ও নিরবয়বরূপে নিরন্তর সর্বত্র পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে । পরব্রহ্মের বর্ণনা করিবার সময় দাসবোধে [দা|২০|২|৩] শ্রীসমর্থ রামদাস স্বামী বলেন -
জিকড়ে পহাবে তিকড়ে অপার ৷
কোনীকড়ে নাহি পার ॥
এক জিনসী স্বতন্ত্র ৷ দুসরে নাহীঁ ॥
অর্থাৎ - যে দিকে দেখিবে সেই দিকেই অসীম, কোন দিকেই সীমা নাই; একমাত্ৰ বস্তু ও স্বতন্ত্র, তাঁহাতে দ্বৈত বা অন্য কিছুই নাই । সাংখ্যদিগের প্রকৃতি সম্বন্ধেও এই বর্ণনা প্ৰযুক্ত হইতে পারে । ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতি অব্যক্ত, স্বয়ম্ভূ, ও একই প্ৰকার; এবং উহা চারিদিকে নিরন্তর নিবিড়ভাবে পূর্ণ । আকাশ, বায়ু ইত্যাদি ভেদ পরে হইয়াছে এবং তাহা সূক্ষ্ম হইলেও ব্যক্ত; এই সমস্তের মূল প্রকৃতি এইরূপ এবং সর্বব্যাপী ও অব্যক্ত । মনে থাকে যেন, বেদান্তীদিগের পরব্রহ্মে এবং সাংখ্যদিগের প্রকৃতিতে আকাশ পাতাল ব্যবধান । কারণ, পরব্ৰহ্ম চৈতন্যরূপ ও নির্গুণ; কিন্তু প্ৰকৃতি জড়রূপ ও সত্ত্বরজস্তমোময় অর্থাৎ সগুণ । এই সম্বন্ধে অধিক বিচার পরে করা যাইবে । এক্ষণে সাংখ্যদিগের মত কি, তাহাই আমাদের আলোচ্য । 

3.3.6) অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত

‘সূক্ষ্ম’ ও ‘স্থূল’, ‘ব্যক্ত’ ও ‘অব্যক্ত’, ইহাদের এইরূপ অর্থ করিলে, সৃষ্টির আরম্ভে প্ৰত্যেক পদার্থ সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত প্ৰকৃতির রূপে থাকে, তাহার পর উহা (স্থূল হোক বা সূক্ষ্মই হোক) ব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়গোচর হইয়া থাকে, এবং প্ৰলয়কালে এই ব্যক্তস্বরূপের নাশ হইলে আবার উহা অব্যক্ত প্ৰকৃতির মধ্যে মিশিয়া গিয়া অব্যক্ত হইয়া পড়ে, এইরূপ বলিতে হয় । গীতাতেও এই মত ব্যক্ত হইয়াছে [গী|২|২৮ ও ৮|১৮] । সাংখ্যশাস্ত্ৰে এই অব্যক্ত প্ৰকৃতিকে ‘অক্ষর’, এবং প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন সমস্ত পদার্থকে ‘ক্ষর’ সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে । এখানে ক্ষর অর্থে সম্পূর্ণ নাশ নহে; কেবল ব্যক্তরূপের নাশই এস্থলে বিবক্ষিত । প্ৰধান, গুণক্ষোভিণী, বহুধানক, প্রসবধর্মিণী, ইত্যাদি প্ৰকৃতির আরও অনেক নাম আছে । সৃষ্টির সমস্ত পদার্থের মুখ্য মূল হওয়া প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতিকে প্রধান বলা হয় । ত্ৰিগুণের সাম্যাবস্থা আপনিই আপনাকে ভাঙ্গিয়া ফেলে বলিয়া উহাকে গুণক্ষোভিণী বলে । গুণত্ৰয়রূপী পদার্থ ভেদের বীজ প্ৰকৃতিতে আছে বলিয়া উহাকে বহুধানক বলে এবং প্রকৃতি হইতেই সমস্ত পদার্থ প্ৰসূত হয় বা উৎপন্ন হয় বলিয়া উহাকে প্রসবধর্মিণী বলে । বেদান্তশান্ত্রে এই প্ৰকৃতিকেই ‘মায়া’ অর্থাৎ মায়িক অবভাস বলা হইয়াছে ।

3.3.7) হেকেলের জড়াদ্বৈত

সৃষ্টির সমস্ত পদার্থকে ‘ব্যক্ত’ ও ‘অব্যক্ত’ বা ‘ক্ষর’ ও ‘অক্ষর’ এই দুই বিভাগে বিভক্ত করিলে পর দেখিতে হইবে যে, ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞ বিচারে কথিত আত্মা, মন, বুদ্ধি, অহংকার ও ইন্দ্ৰিয়াদি সাংখ্যমতে কোন বিভাগে বা বর্গে ফেলিতে হইবে । ক্ষেত্র ও ইন্দ্ৰিসমূহ তো জড়ই, তাই ব্যক্ত পদার্থে উহাদের সমাবেশ হইতে পারে; কিন্তু মন, অহঙ্কার, বুদ্ধি ও বিশেষত আত্মা, ইহাদের কিরূপ ব্যবস্থা করা যাইবে ? যুরোপ খণ্ডের আধুনিককালের প্রসিদ্ধ সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞ হেকেল আপন গ্রন্থে প্ৰতিপাদন করিয়াছেন, যে, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার ও আত্মা, এ সমস্তই শারীরধর্মা । উদাহরণ যথা - মনুষ্যের মস্তিষ্ক বিগড়াইয়া গেলে তাহার স্মরণশক্তি লোপ পায় এবং সে উন্মাদগ্ৰস্তও হয়, ইহা আমরা দেখিতে পাই । সেইরূপ মাথায় গুরুতর আঘাত লাগিয়া মস্তিষ্কের কোন অংশ অসাড় হইয়া গেলেও সেই অংশের মানসিক শক্তি বিলুপ্ত হয়, এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায় । সারকথা এই যে, মনোধর্মও মস্তিষ্কেরই গুণ; অতএব উহাকে জড়বস্তু হইতে কখনই পৃথক করা যায় না, এবং সেইজন্য মস্তিষ্কের সঙ্গে সঙ্গেই মনোধর্ম ও আত্মাকেও, ‘ব্যক্তি’ পদার্থের বর্গে ফেলা আবশ্যক । এই জড়বাদ মানিয়া লইলে শেষে কেবল অব্যক্ত ও জড় প্রকৃতিই অবশিষ্ট থাকিয়া যায় । কারণ, সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ এই মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে । এই অবস্থায় প্রকৃতি ব্যতীত জগতের কর্তা বা উৎপাদক আর কেহই হইতে পারে না । তখন তো ইহাই বলিতে হয় যে, মূল প্ৰকৃতির শক্তি বাড়িতে বাড়িতেই তাহাই চৈতন্য বা আত্মার স্বরূপ প্ৰাপ্ত হইয়াছে । সৎকার্যবাদের ন্যায় এই মূল প্ৰকৃতির কতকগুলি নিয়ম প্রস্তুত হইয়াছে; এবং তদনুসারে সমস্ত জগৎ ও তাহার সঙ্গে সঙ্গেই মনুষ্যও এই নিয়মানুসারে জীবন নির্বাহ করিতেছে । জড় প্রকৃতি ব্যতীত আত্মা বলিয়া কোন পৃথক পদাৰ্থ নাই, কাজেই উহা অবিনাশীও নহে, স্বতন্ত্রও নহে । তবে মোক্ষের আবশ্যকতা কি ? আমার ইচ্ছানুসারে আমি অমুক কর্ম করিব এইরূপ প্ৰত্যেকে যে মনে করে তাহা নিছক ভ্ৰম । প্ৰকৃতি তাহাকে যে দিকে টানিবে সেই দিকেই তাহাকে যাইতে হইবে । সারকথা - ৺শঙ্করমোরো রান্‌ডে কলহপুরী নাটকের আরম্ভের ধ্রুপদে যাহা বলিয়াছেন তদনুসারে বলিতে হয় -
বিশ্ব সর্ব হেঁ তুরুঙ্গ মোঠো প্ৰাণীমাত্র কৈদী ৷
পদার্থধর্মাঞ্চিয়া শৃঙ্খলা ত্যাঁতেঁ কোণি ন ভেদী ॥
এই সমস্ত বিশ্ব এক বৃহৎ কারাগার, প্রাণীমাত্রই কয়েদী এবং পদার্থের গুণধর্ম শৃঙ্খল — এই শৃঙ্খল কেহ ভাঙ্গিতে পারে না । ইহাই হেকেলের মতের সারাংশ । ঐ মতানুসারে একমাত্র জড় ও অব্যক্ত প্ৰকৃতিই সমস্ত সৃষ্টির মূল হওয়া প্ৰযুক্ত হেকেল আপন মতের নাম দিয়াছেন – ‘অদ্বৈত’ ! কিন্তু এই অদ্বৈত জড়মূলক অর্থাৎ একমাত্র জড়প্রকৃতিতেই সমস্ত বিষয়ের সমাবেশ করে বলিয়া য়ামি উহাকে জড়াদ্বৈত বা আধিভৌতিকশাস্ত্রাদ্বৈত বলিব ।

3.3.8) প্রকৃতি হইতেই মন ও বুদ্ধির উৎপত্তি

কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্রকারেরা এই জড়াদ্বৈত স্বীকার করেন না । তাঁহারা বলেন যে, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার, ইহারা পঞ্চভূতাত্মক জড়প্রকৃতিরই ধর্ম, এবং অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতেই বুদ্ধি, অহঙ্কার প্রভৃতি গুণ ক্রমে ক্রমে উৎপন্ন হয় । কিন্তু তাহার মত এই যে, জড় প্রকৃতি হইতে চৈতন্য উৎপন্ন হইতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, যেমন কোন মনুষ্য আপন কাঁধের উপর বসিতে পারে না, সেইরূপ প্ৰকৃতির জ্ঞাতা বা দ্রষ্টা প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন না হইলে ‘আমি ইহা জানিতেছি, উহা জানিতেছি’ এইপ্ৰকার ভাষাও প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । এবং জগতের ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি করিলে সকলেরই ইহা অনুভূত হয় যে, আমি যাহা কিছু জানিতেছি বা দেখিতেছি, তাহা আমা হইতে ভিন্ন । তাই জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়, দ্রষ্টা ও দৃষ্টবস্তু কিংবা প্ৰকৃতির দ্রষ্টা ও জড়প্রকৃতি এই দুই পদার্থ মূলতই ভিন্ন ভিন্ন মানিতে হয়, এইরূপ সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন [সাং|কা|১৭] । পূর্বপ্রকরণে যাহাকে ক্ষেত্ৰজ্ঞ কিংবা আত্মা বলা হইয়াছে তাহাই এই দ্রষ্টা, জ্ঞাতা বা উপভোক্তা, এবং ইহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘পুরুষ’ বা ‘জ্ঞ’ (জ্ঞাতা) বলা হইয়াছে । এই জ্ঞাতা প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন হওয়া প্রযুক্ত স্বভাবতই তাহা সত্ত্ব, রজ ও তম, প্রকৃতির এই তিন গুণের বাহিরে অর্থাৎ উহা নির্গুণ ও অবিকারী এবং জানা দেখা ব্যতীত অন্য কোন কাজ করে না । অতএব জগতে যাহা কিছু ভাঙ্গাগড়া চলিতেছে তৎসমস্ত একমাত্র প্রকৃতিরই কাজ, এইরূপ নিষ্পন্ন হয় । সারকথা - প্রকৃতি অচেতন, পুরুষ সচেতন; প্রকৃতিই সমস্ত কর্মচেষ্টা করিতেছে, পুরুষ উদাসীন ও অকর্তা; প্রকৃতি ত্ৰিগুণাত্মক, পুরুষ নিগুৰ্ণ; প্রকৃতি অন্ধ, পুরুষ সাক্ষী । এই প্রকারে এই সৃষ্টির মধ্যে এই দুই ভিন্ন ভিন্ন তত্ত্ব অনাদিসিদ্ধ, স্বতন্ত্র ও স্বয়ম্ভু, ইহাই সাংখ্যশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত । ইহারই প্ৰতি লক্ষ্য রাখিয়া ভগবদ্‌গীতাতে প্ৰথমে বলা হইয়াছে “প্ৰকৃতিং পুরুষং চৈব বিন্ধ্যনাদী উভাবপি” - প্ৰকৃতি ও পুরুষ ইহারা উভয়েই অনাদি [গী|১৩|১৯/২০]; ইহার পরে উহাদের এইরূপ বর্ণনা করা হইয়াছে যে, “কার্যকারণকর্তৃত্বে হেতুঃ প্রকৃতিরুচ্যতে” অর্থাৎ দেহ ও ইন্দ্রিয়সমূহের ব্যাপার প্রকৃতি করিয়া থাকে; এবং “পুরুষঃ সুখদুঃখানাং ভোক্তৃত্বে হেতুরুচ্যতে” অর্থাৎ পুরুষ সুখদুঃখের উপভোগ করিবার কারণ । গীতাতে প্ৰকৃতি ও পুরুষ অনাদি স্বীকৃত হইলেও এই বিষয়ে দৃষ্টি রাখা চাই যে, সাংখ্যদের ন্যায় গীতাতে এই দুই তত্ত্ব স্বতন্ত্র কিংবা স্বয়ম্ভূ বলিয়া স্বীকৃত নহে । কারণ, গীতাতে ভগবান প্ৰকৃতিকে আপন মায়া বলিয়াছেন [গী|৭|১৪; ১৪|৩]; এবং পুরুষসম্বন্ধেও “মমৈবাংশো জীবলোকে” [গী|১৫|৭] - উহা আমারই অংশ, এইরূপ বলিয়াছেন । ইহা হইতে বুঝা যাইতেছে যে, গীতা সাংখ্যশাস্ত্ৰকেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন । কিন্তু আপাতত সেদিকে লক্ষ্য না করিয়া শুধু সাংখ্যশাস্ত্র পরে কি বলিতেছেন তাহাই দেখিব ।

3.3.9) প্রকৃতি ও পুরুষ দুই স্বতন্ত্র তত্ত্ব

সাংখ্যশাস্ত্ৰ অনুসারে, সৃষ্টির সমস্ত পদার্থ তিন বর্গে বিভক্ত । প্ৰথম অব্যক্ত (মূল প্রকৃতি), দ্বিতীয় ব্যক্ত (প্রকৃতির বিকার) এবং তৃতীয় পুরুষ অর্থাৎ ‘জ্ঞ’ । কিন্তু ইহাদের মধ্যে প্ৰলয়কালে ব্যক্ত পদার্থের স্বরূপ নষ্ট হয়; তাই এখন কেবল মূলে প্ৰকৃতি ও পুরুষ, এই দুই তত্ত্বই বাকী রহিয়া যায় । এই দুই মূলতত্ত্ব সাংখ্যদিগের মতে অনাদি ও স্বয়ম্ভূ; তাই সাংখ্যদিগকে দ্বৈতবাদী (এই দুই মূলতত্ত্ব যাঁহারা স্বীকার করেন) বলা হইয়া থাকে । ইহাঁরা প্ৰকৃতি ও পুরুষের বাহিরে ঈশ্বর, কাল, স্বভাব বা অন্য কোন মূল তত্ত্বই মানেন না । *
*(ঈশ্বরকৃষ্ণ একজন পাকা নিরীশ্বরবাদী । তিনি নিজের সাংখ্যকারিকার উপসংহারাত্মক তিন আৰ্য্যাতে বলিয়াছেন যে, মূলবিষয়ের উপর ৭০ আৰ্য্যা শ্লোক ছিল । কিন্তু কোলব্রুক ও উইলসনের অনুবাদের সহিত বোম্বায়ে রা, রা, তুকারাম-তাত্যা যে সংস্করণ ছাপাইয়াছেন তাহাতে মূলবিষয়ের উপর কেবল মাত্ৰ ৬৯ আৰ্য্যা আছে । এই হেতু ৭০ম আৰ্য্যা কোন্‌টি, এইরূপ উইলসন্‌ সাহেবের সন্দেহ হইল । কিন্তু ঐ আৰ্য্যাটি না পাওয়ায় তাঁহার সন্দেহের সমাধান হয় নাই । আমার মতে, এই আৰ্য্যা এখনকার ৬১ম আৰ্য্যার পরে হইবে । কারণ,  ৬১ম আৰ্য্যার উপর গৌড়পাদের যে ভাষ্য আছে তাহা এক আৰ্য্যার উপর নহে, দুই আৰ্য্যার উপর । এবং এই ভাষ্যের মূলশ্লোকের পদগুলি লইয়া আৰ্য্যা রচনা করিলে তাহা -
কারণমীশ্বরমেকে ব্রুবন্তি কালং পরে স্বভাবং বা ৷
প্ৰজাঃ কথং নির্গুণতো ব্যক্তঃ কালঃ স্বভাবশ্চ ॥
এইরূপ দাঁড়ায় । এই আৰ্য্যা অগ্রপশ্চাৎ সন্দর্ভেরও (অর্থ বা ভাবের) সহিত ঠিকঠিক মিলেও । এই আৰ্য্যা নিরীশ্বর মতের প্রতিপাদক হওয়ায় মনে হয় যে, কেহ ইহা পরে ছাঁটিয়া ফেলিয়াছে । কিন্তু এই আর্য্যার শোধনকারী মনুষ্য সেই আৰ্য্যার ভাষ্যও ছাঁটিয়া ফেলিতে বিস্মৃত হইয়া গিয়াছেন, তাই এক্ষণে এই আৰ্য্যা আমরা খুঁজিয়া বাহির করিতে পারিলাম; এবং এই জন্য ঐ মনুষ্যকে আমাদের ধন্যবাদ দিতে হয় । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রথম মন্ত্র হইতে দেখিতে পাওয়া যায় যে, প্ৰাচীনকালে কোন কোন লোক স্বভাব ও কালকে এবং বেদান্তী তাহাদিগকেও ছাড়াইয়া গিয়া ঈশ্বরকে জগতের মূল কারণ মানিতেন । মন্ত্রটা এই -
স্বভাবমেকে কবয়ো বদন্তি কালং তথান্যে পরিমুহ্যমানাঃ ৷
দেবস্যৈষা মহিমা তু লোকে যেনেদং ভ্রাম্যতে ব্রহ্মচক্রম্‌ ॥
কিন্তু ইহা দেখাইবার জন্যই ঈশ্বরকৃষ্ণ উপরি-উক্ত আর্য্যাকে বর্তমান ৬১ম আর্য্যার পরে বসাইয়াছেন যে, এই তিন মূল কারণ (অর্থাৎ স্বভাব, কাল ও ঈশ্বর) সাংখ্যেরা স্বীকার করেন না ।)


কারণ, সগুণ ঈশ্বর, কাল ও স্বভাব, এই সমস্ত ব্যক্ত হওয়া প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতি হইতে উৎপন্ন ব্যক্ত পদার্থের মধ্যেই তাহাদের সমাবেশ হইয়া থাকে; এবং নির্গুণ বলিয়া মানিলে, সৎকার্যবাদ অনুসারে নির্গুণ মূলতত্ত্ব হইতে ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতি কখনই উৎপন্ন হইতে পারে না । তাই, তাঁহারা স্থির নির্ধারণ করিয়াছেন যে, প্রকৃতি ও পুরুষকে ছাড়িয়া এই সৃষ্টির তৃতীয় কোন মূলতত্ত্ব নাই । এই প্রকারে তাঁহারা দুই মূলতত্ত্ব নির্ধারণ করিলে পর, তাঁহারা আপন মতানুসারে ইহাও সিদ্ধ করিলেন যে, সেই দুই মূলতত্ত্ব হইতে সৃষ্টি কিরূপে উৎপন্ন হইল । 


3.3.10) পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগে সৃষ্টির বিস্তার

তাঁহারা বলেন যে, নির্গুণ পুরুষ স্বতঃ কিছু করিতে না পারিলেও প্ৰকৃতির সঙ্গে উহার সংযোগ হইলে, যেমন গরু নিজের বাছুরের জন্য দুধ দেয় কিংবা লৌহ চুম্বকের সন্নিধানে আসিলে লৌহে আকর্ষণশক্তি আসে, সেইরূপ মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি স্বকীয় গুণসমূহের (সূক্ষ্ম ও স্থুল) ব্যক্ত বিস্তার পুরুষের সন্মুখে স্থাপন করে [সাং|কা|৫৭] । পুরুষ সচেতন ও জ্ঞাতা হইলেও, কেবল অর্থাৎ নির্গুণ হওয়া প্ৰযুক্ত, তাহার নিকট স্বতঃ কর্ম করিবার কোন সাধন নাই; এবং প্রকৃতি কর্মকর্তা হইলেও জড় বা অচেতন হওয়া প্ৰযুক্ত, সে জানে না যে কোন্‌ কাজ করিতে হইবে । এই কারণে ইহা খঞ্জ ও অন্ধের জুড়ী; অন্ধের কাঁধের উপর খঞ্জ বসিয়া অন্যোন্যসহায়তায় দুজনেই যেরূপ পথ চলিতে থাকে, সেইরূপই জড় প্ৰকৃতি ও সচেতন পুরুষের সংযোগ হইলে সৃষ্টির সকল কর্মের আরম্ভ হইয়া থাকে [সাং|কা|২১] । এবং যেমন নাটকে প্রেক্ষকদিগের মনোরঞ্জনার্থ রঙ্গভূমির উপর একই নটী এখন এক বেশে, খানিক পরে আর এক বেশে নাচিতে থাকে, সেইরূপ পুরুষের লাভের জন্য (পুরুষার্থের জন্য) পুরুষ কোন রকম প্ৰতিদান না করিলেও, এই প্ৰকৃতি সত্ত্বরজতম গুণসমূহের ন্যূনাধিক্য অনুসারে অনেক রূপ গ্রহণ করিয়া তাহার সম্মুখে সমান নাচিতে থাকে [সাং|কা|৫৯] । প্ৰকৃতির এই নৃত্যে মোহবশত ভুলিয়া বা বৃথাভিমানবশত যে পর্যন্ত পুরুষ এই প্ৰকৃতির কর্তৃত্ব আপনারই কর্তৃত্ব বলিয়া স্বীকার করে এবং সুখদুঃখের জালে আপনাকে যে পর্যন্ত জড়াইয়া রাখে, সে পর্যন্ত কখনো তাহার মোক্ষপ্ৰাপ্তি হইতে পারে না [গী|৩|২৭] । 

3.3.11) কৈবল্য অর্থাৎ মোক্ষ-প্রাপ্তি

কিন্তু যে সময়ে পুরুষের এই জ্ঞান হয় যে, ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি পৃথক এবং আমি পৃথক, সেই সময়ে সে মুক্ত হয় [গী|১৩|২৯,৩০; ১৪|২০]; কারণ বস্তুত পুরুষ কর্তাও নহে, বদ্ধও নহে – সে তো স্বপ্তন্ত্র ও স্বভাবতই কৈবল্য-অবস্থাপন্ন বা অকর্তা । যাহা কিছু হয় সে সমস্ত প্ৰকৃতিরই খেলা । অধিক কি, মন ও বুদ্ধিও প্রকৃতিরই বিকার হওয়া প্ৰযুক্ত বুদ্ধির যে জ্ঞান হয় তাহাও প্ৰকৃতির কার্যেরই ফল । এই জ্ঞান তিন প্রকারের – সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক [গী|১৮|২০-২২] । তন্মধ্যে বুদ্ধির সাত্ত্বিক জ্ঞান হইলে পুরুষ জানিতে পারে যে, আমি প্রকৃতি হইতে পৃথক্‌ । সত্ত্ব, রজঃ ও তম এই গুণত্ৰয় প্রকৃতিরই ধর্ম, পুরুষের নহে । পুরুষ নির্গুণ এবং ত্ৰিগুণাত্মক, প্ৰকৃতি উহার দর্পণ [মভা|শাং|২০৪|৮] । এই দর্পণ যখন স্বচ্ছ বা নির্মল থাকে, অর্থাৎ যখন নিজের এই বুদ্ধি, যাহা প্ৰকৃতির বিকার, সাত্ত্বিক হয়, তখন এই স্বচ্ছ দর্পণে পুরুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপ দেখিতে থাকে এবং উহার এই বোধ হয় যে আমি প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন । সেই সময়ে এই প্ৰকৃতি লজ্জিত হইয়া ঐ পুরুষের সম্মুখে নৃত্য, খেলা ও জালবিস্তার বন্ধ করিয়া দেয় । এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে পুরুষ সমস্ত পাশ ও জাল হইতে মুক্ত হইয়া নিজের স্বাভাবিক কৈবল্যপদ প্ৰাপ্ত হয় । ‘কৈবল্য’ অর্থাৎ কেবলত্ব, একাকীত্ব বা প্ৰকৃতির সহিত সংযোগ না থাকা । পুরুষের এই নৈসৰ্গিক বা স্বাভাবিক অবস্থাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে মোক্ষ (বন্ধন-মোচন) বলে । 

3.4) মোক্ষ কাহার হয়, প্রকৃতির বা পুরুষের ?



এই (মোক্ষ) অবস্থার বিষয়ে সাংখ্যবাদী এক সুক্ষ্ম প্রশ্ন উপস্থিত করিয়াছেন । তাঁহাদের প্রশ্ন এই যে, পুরুষ প্ৰকৃতিকে ছাড়ে, না প্ৰকৃতি পুরুষকে ছাড়ে । অনেকের নিকট এই প্রশ্ন, বর অপেক্ষা কনে ঢ্যাঙা কিংবা কনে অপেক্ষা বর বেঁটে, এইরূপ ধরণের প্রশ্নের ন্যায় নিরর্থক প্ৰতীত হইবে । কারণ, দুই বস্তুর এক বস্তু হইতে অপরটীর বিয়োগ হইলে পর কে কাহাকে ছাড়িল ইহা দেখার কোন ফল নাই; উভয়ই পরস্পরকে ছাড়ে, ইহাই আমরা দেখিতে পাই । কিন্তু একটু সুক্ষ্ম বিচার, করিয়া দেখিলে সাংখ্যদিগের এই প্রশ্ন তাঁহাদের দৃষ্টিতে অযোগ্য নহে, এইরূপ উপলব্ধি হইবে । সাংখ্যশাস্ত্ৰানুসারে পুরুষ নির্গুণ, অকর্তা ও উদাসীন হওয়া প্ৰযুক্ত তত্ত্বদৃষ্টিতে ‘ছাড়া’ বা ‘ধরা’ এই দুই ক্রিয়ার কর্তৃত্ব পুরুষে বৰ্ত্তিতে পারে না [গী|১৩|৩১, ৩২] । তাই, সাংখ্যবাদী স্থির করিয়াছেন যে, সেই প্রকৃতিই ‘পুরুষ’কে ছাড়িয়া যায়, অর্থাৎ প্ৰকৃতিই ‘পুরুষ’ হইতে আপনার মোক্ষসাধন করিয়া লয়, কারণ কর্তৃত্ব প্রকৃতিরই ধর্ম, [সাং|কা|৬২ ও গী|১৩|৩৪] । সার কথা, পুরুষের মোক্ষ নামে এমন কোন পৃথক অবস্থা নাই যাহা ‘পুরুষ’ বাহির হইতে প্রাপ্ত হয়; কিংবা পুরুষের মূল ও স্বাভাবিক অবস্থা হইতে ভিন্ন কোন অবস্থাই নাই । ঘাসের উপরকার ছাল হইতে ভিতরকার শাঁস যেরূপ পৃথক্‌ কিংবা জলস্থ মাছ যেরূপ জল হইতে পৃথক্‌, সেইরূপ প্রকৃতি ও পুরুষের সম্বন্ধ । প্রকৃতির গুণের দ্বারা মুগ্ধ হইয়া সাধারণ কোন ব্যক্তি নিজের এই স্বাভাবিক বিভিন্নতা বুঝিতে পারে না, তাই সংসার চক্রে নিমগ্ন থাকে । কিন্তু এই ভিন্নতা যে জানিতে পারে সে মুক্তই হয় । এই প্রকার পুরুষকে ‘জ্ঞানী’ বা ‘বুদ্ধ’ ও ‘কৃতকৃত্য’ বলে, ইহা মহাভারতে উক্ত হইয়াছে [মভা|শাং|১৯৪|৫৮; ২৪৮|১১ ও ৩০৬-৩০৮]“এতদ্‌বুদ্ধা বুদ্ধিমান্‌ স্যাৎ” [গী|১৫|২০] এই গীতা বচনে ‘বুদ্ধিমান’ শব্দেরও এই অর্থ । অধ্যাত্মশাস্ত্রদৃষ্টিতে মোক্ষের প্রকৃত স্বরূপও ইহাই [বেসু|শাং|ভা|১|১|৪] । কিন্তু সাংখ্য হইতে অদ্বৈত বেদান্তের বিশেষ উক্তি এই যে, পুরুষ স্বভাবত কৈবল্য অবস্থায় আছে এইরূপ কারণ না দিয়া, আত্মা মূলেই পরব্রহ্মস্বরূপ এবং যখন সে আপন মূলস্বরূপ, অর্থাৎ পরব্রহ্মকে জানিতে পারে তখন তাহাই উহার মোক্ষ । সাংখ্য ও ও বেদান্ত, ইহাদের মধ্যে এই ভেদ পরবর্তী প্রকরণে স্পষ্ট করিয়া দেখান যাইবে ।


3.5) সাংখ্যের অসংখ্য পুরুষ এবং বেদান্তীদিগের এক পুরুষ



পুরুষ (আত্মা) নির্গুণ, উদাসীন ও অকর্তা - সাংখ্যদিগের এই মত যদিও অদ্বৈত বেদান্তের সম্পূর্ণ মান্য, তথাপি একই প্ৰকৃতির দ্রষ্টা স্বতন্ত্র পুরুষ মুলেই অসংখ্য, - পুরুষসম্বন্ধে সাংখ্যদিগের এই দ্বিতীয় কল্পনা বেদান্তীরা স্বীকার করেন না [গী|৮|৪; ১৩|২০-২২; মভা|শাং|৩৫১; এবং বেসূ|শাং|ভা|২|১|১] । বেদান্তীরা বলেন যে, উপাধিভেদপ্ৰযুক্ত সমস্ত জীব ভিন্ন ভিন্ন প্ৰতিভাত হয়, বস্তুত সমস্তই ব্ৰহ্ম । সাংখ্যদিগের মত এই যে, যখন দেখি যে, প্ৰত্যেক মনুষ্যের জন্ম, মরণ ও জীবন ভিন্ন ভিন্ন এবং যখন এই জগতে ভেদ দেখিতে পাওয়া যায় যে, কেহ সুখী, কেহ দুঃখী, তখন মানিতে হয় যে, প্ৰত্যেক আত্মা বা পুরুষ মূলেই ভিন্ন এবং তাহাদের সংখ্যাও অনন্ত [সাং|কা|১৮] । কেবল প্রকৃতি ও পুরুষই সমস্ত সৃষ্টির মূলতত্ত্ব ধরিলাম; কিন্তু উহাদের মধ্যে, পুরুষ শব্দে সাংখ্যদিগের মতানুসারে ‘অসংখ্য পুরুষের সমুদায়’ এর সমাবেশ হয় । এই সকল অসংখ্য পুরুষ ও ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতির সংযোগ হইতে সৃষ্টির সমস্ত ব্যবহার চলিতেছে । প্ৰত্যেক পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ হইলে পর প্রকৃতি আপন গুণের বিস্তার সেই পুরুষের সন্মুখে স্থাপন করে, এবং পুরুষ তাহা উপভোগ করিতে থাকে । এইরূপ হইতে হইতে, যে পুরুষের আশপাশের প্রকৃতির খেলা সাত্ত্বিক হয়, সেই পুরুষেরই (সকল পুরুষের নহে) যথার্থ জ্ঞান লাভ হয়; এবং তাহারই নিকটে প্রকৃতির সমস্ত খেলা বন্ধ হইয়া যায়, আর সে আপনার মূল ও কৈবল্য স্বরূপে উপনীত হয় । কিন্তু তাহার মোক্ষলাভ হইলেও অবশিষ্ট পুরুষদিগের সংসারে আবদ্ধ থাকিতেই হয় । পুরুষ এইরূপ কৈবল্যপদে উপনীত হইলেই সে প্রকৃতির জাল হইতে একেবারেই মুক্ত হইয়া যায় - কেহ কেহ এরূপ মনে করিতে পারেন কিন্তু সাংখ্যমতানুসারে এরূপ বুঝিলে ভুল হইবে । 



দেহ ও ইন্দ্রিয়রূপী প্রকৃতির বিকার মনুষ্যকে তাহার মরণ পর্যন্ত ছাড়ে না । সাংখ্যবাদীরা ইহার এই কারণ বলেন যে, “যেরূপ কুমারের চাকা হইতে কলসী তৈয়ার করিয়া বাহির করিয়া লইলেও পূর্বসংস্কারবশতঃ তাহা কিয়ৎক্ষণ পর্যন্ত ঘুরিতেই থাকে, সেইরূপ কৈবল্যপ্রাপ্ত মনুষ্যেরও শরীর কিছুদিন অবশিষ্ট থাকে” [সাং|কা|৬৭] । তথাপি সেই শরীর হইতে কৈবল্যপ্ৰাপ্ত পুরুষের কোন প্ৰতিবন্ধক কিংবা সুখদুঃখের বাধা হয় না । কারণ, এই শরীর জড়প্রকৃতির বিকার হওয়া প্ৰযুক্ত, স্বয়ং জড়ই, সেইজন্য সুখই বা কি, দুঃখই বা কি, তাহার নিকট দুই-ই সমান; এবং যদি ইহা বলা যায় যে পুরুষের সুখদুঃখের বাধা হয়, তবে ইহাও ঠিক নহে; কারণ সে জানে যে, প্ৰকৃতি হইতে আমি ভিন্ন, সমস্ত কর্তৃত্ব প্রকৃতিরই, আমার নহে । এই অবস্থাতে প্ৰকৃতির যতই খেলা হউক না কেন, পুরুষের সুখদুঃখ হয় না, সে সর্বদা উদাসীনই থাকে । প্ৰকৃতির ত্ৰিগুণ হইতে মুক্ত হইয়া যে পুরুষের এই জ্ঞান হয় নাই, তাহার জন্মমরণের পুনরাবৃত্তির একেবারে শেষ হয় না; চাই সে, সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ প্ৰযুক্ত দেবযোনিতে জন্মগ্রহণ করুক কিংবা রজোগুণের উৎকর্ষ হেতু মানব-যোনিতে, অথবা তমোগুণের প্রাবল্যে পশুর শ্রেণীতে উৎপন্ন হউক [সাং|কা|৪৪|৫৪] ৷ জন্মমরণরূপী চক্রের এই ফল, প্ৰত্যেক মনুষ্য তাহার চতুঃপার্শ্বস্থ প্ৰকৃতি অর্থাৎ তাহার বুদ্ধির সত্ত্ব্রজতমোগুণের উৎকর্ষ অপকর্ষ প্ৰযুক্ত প্ৰাপ্ত হয় । “উৰ্দ্ধং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থাঃ” - সাত্তিক বৃত্তির পুরুষ স্বর্গে যায় এবং তামসিক পুরুষ অধোগতি প্ৰাপ্ত হয়, ইহা গীতাতেও উক্ত হইয়াছে [গী|১৪|১৮] । কিন্তু এই স্বৰ্গাদি ফল অনিত্য । জন্মমরণ হইতে যে আপনাকে মুক্ত করিতে চাহে, কিংবা সাংখ্যদিগের পরিভাষায়, যে প্রকৃতি হইতে আপনার ভিন্নতা অর্থাৎ কৈবল্য চিরস্থির রাখিতে চাহে, তাহার ত্ৰিগুণাতীত হইয়া বিরক্ত (সন্ন্যস্ত) হওয়া ভিন্ন অন্য মাৰ্গ নাই । এই বৈরাগ্য ও জ্ঞান কপিলাচার্য জন্ম হইতেই প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন । কিন্তু সকলেই এই অবস্থা, জন্ম হইতেই পাইতে পারে না । তাই, তত্ত্ববিবেকরূপ সাধনের দ্বারা প্ৰকৃতি ও পুরুষের ভেদ উপলব্ধি করিয়া আপন বুদ্ধিকে পরিশুদ্ধ করিবার প্রযত্ন প্ৰত্যেকের করা আবশ্যক । এইরূপ প্ৰযত্নের দ্বারা বুদ্ধি সাত্ত্বিক হইলে পরে সেই বুদ্ধিরই জ্ঞান, বৈরাগ্য, ও ঐশ্বর্য প্রভৃতি গুণ সকল উৎপন্ন হয় এবং শেষে মনুষ্য কৈবল্য প্ৰাপ্ত হয় । মনুষ্য যাহা পাইতে ইচ্ছা করিবে তাহাই প্ৰাপ্ত হইবার যোগসামর্থ্যকেই এইস্থানে ঐশ্বর্য বলা হইয়াছে । সাংখ্যমতানুসারে, ধর্মের গণনা সাত্ত্বিক গুণের মধ্যেই করা হয়; কিন্তু শুধু ধর্মের দ্বারা কেবল স্বৰ্গপ্রাপ্তি হয় মাত্র, এবং জ্ঞান ও বৈরাগ্যের (সন্ন্যাস) দ্বারা মোক্ষ কিংবা কৈবল্য প্ৰাপ্ত হইয়া পুরুষের দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি হয়, কপিলাচার্য, শেষে এইরূপ ভেদ করিয়াছেন ।


4) ত্রিগুণাতীত অবস্থা



ইন্দ্রিয়সমূহে ও বুদ্ধিতে প্ৰথমে সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ হইয়া উপরে উঠতে উঠিতে পরিশেষে পুরুষের এই জ্ঞান যখন হয় যে, ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি পৃথক্‌ ও আমি পৃথক্‌, তখন সে ত্ৰিগুণাতীত অর্থাৎ সত্ত্ব রজ ও তম এই তিন গুণেরই বাহিরে পৌঁছিয়াছে ইহা সাংখ্যবাদী বলেন । এই ত্ৰিগুণাতীত অবস্থায় সত্ত্ব, রজ ও তম ইহাদের মধ্যে কোন গুণই অবশিষ্ট থাকে না । তাই, সূক্ষ্মরূপে বিচার করিলে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এই তিন অবস্থা হইতে এই ত্রিগুণাতীত অবস্থা ভিন্ন, স্বীকার করিতে হয় এবং এই অভিপ্ৰায়েই ভাগবতে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক, - ভক্তির এই তিন ভেদ করিবার পর চতুর্থ আর এক ভেদ করা হইয়াছে । তিন গুণেরই পারগামী পুরুষ নির্হেতুক ও অভেদভাবে যে ভক্তি করিয়া থাকেন তাহাকে নির্গুণ ভক্তি বলে [ভাগ|৩|২৯|৭-১৪] । কিন্তু সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক এই তিন বর্গ অপেক্ষা বৰ্গীকরণের তত্ত্বসকলের ফাজিল বৃথা, বৃদ্ধি করা যুক্তিসিদ্ধ নহে । তাই সাংখ্যবাদী বলেন যে সত্ত্বগুণের অত্যন্ত উৎকর্ষের দ্বারাই শেষে ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং এই জন্য তিনি এই অবস্থার গণনা সাত্ত্বিক বৰ্গেই করিয়া থাকেন । গীতাতেও এই মত স্বীকৃত হইয়াছে । উদাহরণ যথা - যে অভেদাত্মক জ্ঞানের দ্বারা জানা যায় যে, যাহা কিছু সমস্তই এক তাহাকেই “সাত্ত্বিক জ্ঞান” বলে এইরূপ গীতাতে উক্ত হইয়াছে [গী|১৮|২০] । ইহা ব্যতীত সত্ত্বগুণের বর্ণনার পরেই গীতার ১৪ম অধ্যায়ের শেষে ত্রিগুণাতীত অবস্থার বর্ণনা আসিয়াছে । 


5) সাংখ্যের ও তৎসদৃশ গীতার সিদ্ধান্তের ভেদ



কিন্তু ভগবদ্‌গীতার প্রকৃতি ও পুরুষ বিশিষ্টাদ্বৈত স্বীকৃত নহে, তাই মনে রাখা আবশ্যক যে, গীতাতে ‘প্ৰকৃতি’, ‘পুরুষ’, ‘ত্ৰিগুণাতীত’ ইত্যাদি সাংখ্যদিগের পারিভাষিক শব্দের প্রয়োগ একটু ভিন্ন অর্থে করা হইয়াছে; কিংবা ইহা বলিতে হয় যে, গীতাতে সাংখ্যের দ্বৈতের উপর অদ্বৈত পরব্রহ্মের ছাপ সর্বত্র লাগাইয়া রাখা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - সাংখ্যদিগের প্রকৃতিপুরুষ-ভেদই গীতার ১৩ম অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে [গীতা|১৩|১৯-৩৪] । কিন্তু সেস্থলে ‘প্ৰকৃতি’ ও ‘পুরুষ’ এই দুই শব্দ ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্রজ্ঞের সহিত সমানার্থক । সেইরূপ, ১৪ম অধ্যায়ের ত্রিগুণাতীত অবস্থার বর্ণনও [গী|১৪|২২-২৭] ত্রিগুণাত্মক মায়াজাল হইতে মুক্ত এবং প্রকৃতি ও পুরুষেরও অতীত পরমাত্মার জ্ঞাত সিদ্ধ পুরুষের, বিষয়ে করা হইয়াছে । প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই পৃথক্‌ তত্ত্ব স্বীকার করিয়া পুরুষের কৈবল্যই ত্ৰিগুণাতীত অবস্থা যাহারা মানে, এই বৰ্ণন সাংখ্যদের ঐ সিদ্ধান্তের অনুযায়ী নহে । এই ভেদ পরে অধ্যাত্মপ্রকরণে আমি স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছি । কিন্তু গীতাতে অধ্যাত্মবাদই প্রতিপাদিত হইলেও অধ্যাত্মতত্ত্বসকল বিবৃত করিবার সময় ভগবান, সাংখ্যপরিভাষার ও যুক্তিবাদের উপযোগ স্থানে স্থানে করিয়াছেন বলিয়া, গীতায় কেবল সাংখ্যমতই গ্ৰাহ্য, এইরূপ কোন কোন পাঠকের ভুল বুঝিবার সম্ভাবনা আছে । এই ভ্রম দূর করিবার জন্য সাংখ্যশাস্ত্র ও গীতার তৎসদৃশ সিদ্ধান্তের ভেদ পুনর্বার এখানে বলা হইয়াছে । বেদান্তসূত্ৰভাষ্যে শ্ৰীশঙ্করাচার্য বলিয়াছেন যে, “প্ৰকৃতি ও পুরুষের বাহিরে এই জগতের পরব্রহ্মরূপী একই মূল তত্ত্ব আছে এবং তাহা হইতে প্রকৃতি-পুরষাদি সমস্ত সৃষ্টিই উৎপন্ন হইয়াছে”, উপনিষদের এই অদ্বৈত, সিদ্ধান্তকে না ছাড়িয়া সাংখ্যদিগের শেষ সিদ্ধান্ত আমার অগ্ৰাহ্য নহে [বেসু|শাং|ভা|২|১|৩] । এই বিষয় গীতার উপপাদনের বিষয়েও চরিতার্থ হয় । ইতি


সপ্তম প্রকরণ সমাপ্ত

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment