Sunday, June 4, 2017

সন্ন্যাস ও কর্মযোগ (Renunciation and Karma-Yoga)

সন্ন্যাস ও কর্মযোগ


সন্ন্যাসঃ কর্মযোগশ্চ নিঃশ্ৰেয়সকরা বুভৌ ৷
তয়োস্তু কর্ম্মসন্ন্যাসাৎ কর্ম্মযোগো বিশিষ্যতে ॥ [গীতা |৫|২]

(“সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়ই নিঃশ্রেয়স্কর অর্থাৎ মোক্ষদায়ক; কিন্তু এই উভয়েরই মধ্যে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগই অধিক শ্ৰেষ্ঠ ।” দ্বিতীয় চরণের ‘কর্মসন্ন্যাস’ পদ হইতে বুঝা যায় যে, প্ৰথম চরণের ‘সন্ন্যাস’ শব্দের কি অর্থ করিতে হইবে । গণেশগীতায় চতুর্থ অধ্যায়ের আরম্ভে গীতার এই প্রশ্নোত্তরই লওয়া হইয়াছে । সেখানে এই শ্লোক অল্প শব্দভেদে এই প্রকারে আসিয়াছে -
“ক্রিয়াযোগো বিয়োগশ্চাৰ্গাপ্যুভৌ মোক্ষস্য সাধনে ৷
ভয়োর্মধ্যে ক্রিয়াযোগস্ত্যাগাত্তস্য বিশিষ্যতে ॥”)

সূচীপত্র

1) অর্জুনের প্রশ্ন এই যে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মার্গ কোন্‌টী
2) এই পন্থার অনুরূপই পাশ্চাত্য পন্থা
3) সন্ন্যাস ও কর্মযোগের পর্যায় শব্দ
4) কর্মযোগ সন্ন্যাসমার্গের অঙ্গ নহে, দুইই স্বতন্ত্র, এই সম্বন্ধে টীকাকারদের গোলমাল
5) গীতার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এই যে, এই দুই মার্গ মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ 
6) সন্ন্যাসমার্গী টীকাকারদের কৃত বিপর্য্যাস
7) তাহার উত্তর
8) অর্জুনকে অজ্ঞানী মানিতে পারি না
9) এই বিষয়ে গীতায় নির্দিষ্ট কারণ যে, কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ কেন
10) আচার অনাদিকাল হইতে দ্বিবিধ, অতএব উহা শ্রেষ্ঠতানির্ণয়ে উপযোগী নহে
11) জনকের তিন এবং গীতার দুই নিষ্ঠা
12) কর্মকে বন্ধক বলিলেই, ইহা সিদ্ধ হয় না যে, তাহা ত্যাগ করিতে হইবে; ফলাশা ছাড়িয়া দিলে নির্বাহ হইয়া যায়
13) কর্ম দূর হইতে পারে না
14) কর্ম ছাড়িয়া দিলে আহারও জুটিবে না
15) জ্ঞান হইলে নিজের কর্তব্য যদি না থাকে, অথবা বাসনার যদি ক্ষয় হইয়া যায়, তবু কর্ম দূর হয় না
16) অতএব জ্ঞানপ্রাপ্তির পরেও নিঃস্বার্থবুদ্ধিতে কর্ম অবশ্য করা চাই
17) ভগবানের এবং জনকের উদাহরণ
18) ফলাশাত্যাগ, বৈরাগ্য ও কর্মোৎসাহ
19) লোকসংগ্রহ ও তাহার লক্ষণ
20) ব্রহ্মজ্ঞানের ইহাই প্রকৃত পর্যবসান
21) তথাপি সেই লোকসংগ্রহও চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা অনুযায়ী ও নিষ্কাম হইবে
22) স্মৃতিগ্রন্থে বর্ণিত চার আশ্রমের, জীবনযাপনের মার্গ
23) গৃহস্থাশ্রমের মহত্ব
24) ভাগবত ধর্ম
25) ভাগবত ও স্মার্তের মূল অর্থ
26) গীতাতে কর্মযোগ অর্থাৎ ভাগবতধর্মই প্রতিপাদ্য
27) গীতার কর্মযোগ এবং মীমাংসকদের কর্মযোগের প্রভেদ
28) স্মার্ত সন্ন্যাস ও ভাগবত সন্ন্যাসের প্রভেদ
29) উভয়ের একতা
30) মনুস্মৃতির বৈদিক কর্মযোগের এবং ভাগবতধর্মের প্রাচীনতা
31) গীতার অধ্যায়সমাপ্তিসূচক সঙ্কল্পের অর্থ 
32) গীতার অপূর্বতা এবং প্রস্থানত্রয়ীর তিন ভাগের সার্থকতা
33) সন্ন্যাস (সাংখ্য) এবং কর্মযোগ (যোগ), উভয় মার্গের ভেদ-অভেদের নক্সার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
34) জীবনযাপনের বিভিন্ন মার্গ
35) গীতার সিদ্ধান্ত এই যে, এই সকলের মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ
36) এই সিদ্ধান্তের প্রতিপাদক ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্র
37) ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্রের শাঙ্করভাষ্যের বিচার
38) মনু ও অন্যান্য স্মৃতির জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয়াত্মক বচন


1) অর্জুনের প্রশ্ন এই যে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মার্গ কোন্‌টী



পূৰ্বপ্রকরণে সবিস্তর বিচার করিয়াছি যে, সর্বভুতে একত্বে অবস্থিত পরমেশ্বরের অনুভবাত্মক জ্ঞান হওয়াই অনাদি কর্মের ফের হইতে মুক্তিলাভের একমাত্র মাৰ্গ; এবং এই অমৃত ব্ৰহ্মের জ্ঞানলাভে মনুষ্যের স্বাতন্ত্র্য আছে কি না এবং এই জ্ঞান লাভ করিবার জন্য, মায়াজগতের অনিত্য ব্যবহার কিংবা কর্ম মনুষ্য কেন করিবে । শেষে এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছে যে, বন্ধন কর্মের ধর্ম বা গুণ নহে, উহা মনের ধর্ম; তাই ব্যবহারিক কর্মের ফলে আমাদের যে আসক্তি হইয়া থাকে তাহা ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা ক্ৰমশ হ্রাস করিয়া উক্ত কর্ম শুদ্ধ অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধিতে করিয়া গেলে, কিছুকাল পরে সাম্যবুদ্ধিরূপ আত্মজ্ঞান দেহেন্দ্ৰিয়াদি মধ্যে প্রবিষ্ট হয় ও পরিশেষে পূর্ণ সিদ্ধি লাভ হয় । মোক্ষরূপ পরম সাধ্য কিংবা আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থা লাভ করিতে হইলে তাহার জন্য কিরূপ সাধন করিতে হয়, ইহার নিষ্পক্তি এইরূপ হইয়াছে । এক্ষণে, এই প্ৰকার আচরণের দ্বারা অর্থাৎ যথাশক্তি ও যথাধিকার নিষ্কাম কর্ম করিতে থাকিলে, কর্মবন্ধন মোচন হইয়া চিত্তশুদ্ধির দ্বারা শেষে পুৰ্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞান প্ৰাপ্ত হইলে পর, সিদ্ধাবস্থায় জ্ঞানী বা স্থিতপ্ৰজ্ঞ ব্যক্তি কর্মই করিতে থাকিবে, কিংবা যাহা কিছু পাইবার তাহা পাইয়া কৃতকৃত্য হওয়ায় মায়া-জগতের সমস্ত ব্যবহার নিরর্থক ও জ্ঞানের বিরুদ্ধ বুঝিয়া সমস্ত ছাড়িয়া দিবে এই গুরুতর প্রশ্নের বিচার উপস্থিত হয় । কারণ, সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা (কর্মসন্ন্যাস) বা তাহাই আমরণ নিষ্কামবুদ্ধিতে করা (কর্মযোগ), এই দুই পক্ষ তর্কদৃষ্টিতে এই স্থলে সম্ভব । এবং ইহার মধ্যে যে পক্ষ শ্রেষ্ঠ স্থির হইবে, তাহারই দিকে দৃষ্টি রাখিয়া প্রথম হইতে অর্থাৎ সাধনাবস্থাতেই আচরণ করা সুবিধাজনক বলিয়া এই উভয়ের তারতম্যের বিচার ব্যতীত কর্মাকর্মের কোন আধ্যাত্মিক বিচারই সম্পূর্ণ হয় না । পূর্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞান প্রাপ্ত হইলে, কর্ম করা আমার না করা দুই-ই সমান [গী|৩|১৮], কারণ সমস্ত ব্যবহারে কর্ম অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ হওয়ায়, জ্ঞানের দ্বারা সর্বভূতে যাহার সমত্ব-বুদ্ধি হইয়াছে, তাহার উপর কোন কর্মেরই শুভাশুভত্বের লেপ লাগে না [গী|৪|২০,২১] - অর্জুনকে কেবল এইটুকু বলিলে কাৰ্যনিৰ্বাহ হইত না । তাঁহার প্রতি ভগবানের ইহাই নিশ্চিত উপদেশ ছিল যে, তুমি যুদ্ধ কর - যুদ্ধ্যস্ব ! [গী|২|১৮]; এবং এই বজ্রনাদী স্পষ্ট উপদেশের সমর্থনে ‘যুদ্ধ করিলেও ভাল এবং না করিলেও ভাল’ এইরূপ ধরা-ছাড়া উত্তর অপেক্ষা অন্য কোন বলবত্ত্বর কারণ দেখান আবশ্যক ছিল । অধিক কি, কোন কর্মের ভয়ঙ্কর পরিণাম চক্ষের সম্মুখে দেখা গেলেও, বুদ্ধিমান ব্যক্তি তাহা কেন করিবে, ইহা বলিবার জন্যই গীতাশাস্ত্রের সৃষ্টি; ইহাই গীতার বৈশিষ্ট্য । কর্মের দ্বারা জীব বদ্ধ হয় এবং জ্ঞানের দ্বারা মুক্ত হয়, ইহা সত্য হইলে, জ্ঞানী ব্যক্তির কর্ম করাই দরকার কেন ? কর্মক্ষয় অর্থে কর্মত্যাগ নহে; কেবল ফলাশা ছাড়িলেই কর্মের ক্ষয় হয়, সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা যায় না; ইত্যাদি সিদ্ধান্ত সত্য হইলেও, ইহা হইতে পুরাপুরি সিদ্ধ হয় না যে, যতটুকু কর্ম ত্যাগ করা যায় তাহাও ত্যাগ করিবে না । এবং ন্যায়তঃ দেখিলেও এই অর্থই নিষ্পন্ন হয় । কারণ, চতুৰ্দিক জলময় হইলে যেরূপ জলের জন্য কূপের দিকে কেহ ছুটিয়া যায় না, সেইরূপ কর্মের দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয় সেই জ্ঞান হইলে জ্ঞানী পুরুষকে কর্মের কোন অপেক্ষা রাখিতে হয় না, এইরূপ গীতাতেই উক্ত হইয়াছে [গী|২|৪৬] । এই জন্য তৃতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে প্রথমে ইহাই জিজ্ঞাসা করিলেন যে, তোমার মতে কর্মাপেক্ষা নিষ্কাম কিংবা সাম্যবুদ্ধি যদি শ্ৰেষ্ঠ হয়, তবে স্থিতপ্রজ্ঞের ন্যায় আমারও বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিলেই হইল; এই ঘোর যুদ্ধকর্মে কেন আমাকে স্থাপন করিলে ? [গী|৩|১] এই প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় ভগবান ‘কর্ম ত্যাগ করিতে কেহ পারে না’, ইত্যাদি কারণ বলিয়া চতুর্থ অধ্যায়ে কর্মের সমর্থন করিয়াছেন । কিন্তু সাংখ্য (সন্ন্যাস) ও কর্মযোগ এই দুই মাৰ্গই যদি শাস্ত্রে বলা হইয়া থাকে, তবে জ্ঞানলাভের পরে ইহাদের মধ্যে যাহার যে মাৰ্গ ভাল লাগিবে সে-ই সে মাৰ্গ স্বীকার করুক, এইরূপ বলিতে হয় । তাই পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন আবার এই প্রশ্ন করিলেন যে, দুই মাৰ্গ মিশা-মিশি করিয়া আমাকে না বলিয়া, এই দুয়ের মধ্যে ভালো যেটি তাহাই আমাকে ঠিক্‌ করিয়া বলো [গী|৫|১] । জ্ঞানোত্তর কর্ম করা কিংবা না করা যদি সমানই হয় তবে আমার ইচ্ছামত তাহা আমি করিব কিংবা করিব না । কর্ম করাই উত্তম পক্ষ হইলে, আমাকে তাহার কারণ বলো, তাহা হইলে আমি তোমার কথা অনুসারে চলিব । অর্জুনের এই প্রশ্ন কিছুই অপূর্ব নহে । যোগবাসিষ্ঠে রাম বসিষ্ঠকে [যো|৫|৫৬|৬] এবং গণেশগীতায় [৪|১] বরেণ্য নামক রাজা গণেশকে এই প্রশ্নই করিয়াছেন । 


2) এই পন্থার অনুরূপই পাশ্চাত্য পন্থা



কেবল, আমাদের দেশে নহে, যুরোপ-খণ্ডের যেখানে তত্ত্বজ্ঞানের বিচার সর্বপ্রথম শুরু হয় সেই গ্রীস দেশেও প্রাচীন কালে এই প্রশ্ন উপস্থিত হইয়াছিল, ইহা অ্যারিষ্টটলের গ্রন্থে দেখা যায় । এই প্ৰসিদ্ধ গ্ৰীক জ্ঞানীপুরুষ স্বীয় নীতিশাস্ত্ৰ সম্বন্ধীয় গ্রন্থের শেষে [১০|৭ ও ৮] এই প্রশ্নই উপস্থিত করিয়া, নিজের এই মত প্ৰথমে বলিয়াছেন যে, সংসারের কিংবা রাজকাৰ্য্যের ব্যস্ততায় আয়ুক্ষেপ করা অপেক্ষা জ্ঞানীপুরুষের শান্তভাবে তত্ত্ববিচারে আয়ুক্ষেপ করিলেই প্রকৃত ও পুর্ণ আনন্দ হয়, তথাপি, ইহার পর লিখিত স্বীয় রাজধর্মসম্বন্ধীয় গ্রন্থে [৭|২ ও ৩] অ্যারিষ্টটল বলিয়াছেন যে, “বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের মধ্যে কেহ কেহ তত্ত্ববিচারে এবং কেহ কেহ রাষ্ট্রকার্যে ব্যাপৃত দেখা যায়; এবং এই দুই মার্গের মধ্যে কোনটি ভাল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে হয় যে, প্ৰত্যেক মাৰ্গই অংশতঃ সত্য । তথাপি কর্ম অপেক্ষা অকর্মকে ভাল বলা ভুল । [“And it is equally a mistake to place inactivity above action for happiness is activity, and the actions of the just and wise are the realization of much that is noble” - Aristotle's Politics, translated by Jowett, Vol I. P.212. The italics are ours].

কারণ, আনন্দও এক কর্মই এবং প্রকৃত শ্রেয়োলাভও অনেকাংশে জ্ঞানযুক্ত ও নীতিযুক্ত কর্মেতেই আছে, এইরূপ বলিতে বাধা নাই" । অ্যারিষ্টটল দুই স্থানে দুই বিভিন্ন বিধান করিয়াছেন দেখিয়া “কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ” [গী|৩|৮], অকর্ম অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ - গীতার এই স্পষ্ট কথার গুরুত্ব পাঠকের উপলব্ধ হইবে । বিগত শতাব্দীর প্রসিদ্ধ ফরাসী পণ্ডিত অগষ্টম্‌ কোঁৎ স্বকীয় আধিভৌতিক তত্ত্বজ্ঞানে বলিয়াছেন যে, - “তত্ত্ববিচারেই নিমগ্ন হইয়া আয়ুক্ষেপণ শ্রেয়স্কর বলা ভ্রান্তিমূলক; যে তত্ত্বজ্ঞ পুরুষ এইপ্রকারে জীবন নিৰ্বাহ করিয়া সাধ্যমত লোকের কল্যাণসাধনে বিরত হন, তিনি নিজের সাধনগুলির অপব্যবহার করেন, এইরূপ বলিতে হইবে ।” উল্টাপক্ষে জর্মান তত্ত্ববেত্ত্বা শোপেনহর প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, জগতের সমস্ত ব্যবহার, এমন কি জীবনধারণ করাও, দুঃখময় হওয়ায় তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিয়া এই সমস্ত কর্মের যত শীঘ্ৰ সম্ভব নাশ করাই এই জগতে মনুষ্যের প্রকৃত কর্তব্য । কোঁতের মৃত্যু হয় ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে এবং শোপেনহরের মৃত্যু হয় ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে । শোপেনহরের পন্থা হার্টমান পরে বজায় রাখিয়াছেন । স্পেনসর মিল প্ৰভৃতি ইংরেজ-তত্ত্বশাস্ত্রজ্ঞের মত কোঁৎ-এরই ন্যায়, ইহা বলা বাহুল্য । কিন্তু ইহাঁদিগকেও ছাড়াইয়া গিয়া নিতান্ত আধুনিক আধিভৌতিক জর্মন পণ্ডিত নিংশে স্বকীয় গ্রন্থে সবলে বলিয়াছেন যে, “মুর্খশিরোমণি” অপেক্ষা সৌম্যতার নাম কর্মসন্ন্যাসীদিগের প্রতি প্ৰয়োগ করা যাইতে পারে না ।*
* [কর্মযোগ ও কর্মত্যাগ (সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাস) এই দুই মার্গের নাম ইনি আপন Pessimism নামক গ্রন্থে – অন্যক্রমে Optimism ও Pessimism দিয়াছেন । কিন্তু আমার মতে এই নাম ঠিক নহে । Pessimism শব্দের অর্থ – “উদাস্‌ নিরাশাবাদী কিম্বা কাঁদুনে কিংবা গোম্‌শা মুখো” । কিন্তু সংসার অনিত্য ভাবিয়া যাহারা সংসার ত্যাগ করে তাহারা আনন্দে থাকে এবং সংসার ত্যাগ করিলেও তাহা আনন্দের সহিতই ত্যাগ করে । তাই তাহাদের সম্বন্ধে Pessimist শব্দ প্রয়োগ করা আমার মতে ঠিক নহে । ইহা অপেক্ষা কর্মযোগের Energism এবং সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাসমার্গের Quietism এইরূপ নাম দেওয়াই অধিক প্রশস্ত । বৈদিক ধর্মানুসারে দুই মার্গে ব্ৰহ্মজ্ঞান একই হওয়ায় দুয়েতেই আনন্দ ও শান্তি একই হইয়া থাকে । এক মার্গ আনন্দময় এবং অন্য মার্গ দুঃখময় কিংবা এক আশাবাদী এবং অন্য নিরাশাবাদী এইরূপ ভেদ আমি করি না ।]


3) সন্ন্যাস ও কর্মযোগের পর্যায় শব্দ



য়ুরোপখণ্ডে আরিষ্টটল হইতে এখন পৰ্যন্ত এই বিষয়ে যেরূপ দুই পক্ষ আছে, সেইরূপ প্ৰাচীনকাল হইতে এখন পৰ্যন্ত হিন্দুস্থানের বৈদিক ধর্মেও এই সম্বন্ধে দুই মার্গ সমান চলিয়া আসিতেছে [মভা|শাং|৩৪৯|৭] । তন্মধ্যে এক মার্গের নাম সন্ন্যাসমাৰ্গ, সাংখ্যনিষ্ঠা কিংবা শুধু সাংখ্য (অথবা জ্ঞানেতেই নিত্য নিমগ্ন থাকায় জ্ঞাননিষ্ঠাও) বলা হয়; দ্বিতীয় মার্গের নাম কর্মযোগ, কিংবা সংক্ষেপে শুধু যোগ, অথবা কর্মনিষ্ঠা বলা হয় । সাংখ্য ও যোগ এই দুই শব্দে অনুক্ৰমে কাপিলসাংখ্য ও পাতঞ্জল যোগ অর্থ বিবক্ষিত নহে ইহা পূর্বে তৃতীয় প্রকরণেই আমি বলিয়াছি । কিন্তু ‘সন্ন্যাস’ শব্দও একটু সন্দিগ্ধ হওয়ায় তাহার অর্থ একটু বেশী ব্যাখ্যা করা এখানে আবশ্যক । ‘সন্ন্যাস’ শব্দে ‘বিবাহ না করা’ কিংবা বিবাহ করিলে, ‘স্ত্রীপুত্ৰ ত্যাগ করিয়া গেরুয়া বস্ত্র ধারণ করা’, অথবা ‘কেবল চতুর্থ আশ্রম গ্ৰহণ করা’ এইটুকু অর্থ এস্থানে বিবক্ষিত নহে । কারণ, বিবাহ না করিয়াও ভীষ্ম আমরণ রাজকাৰ্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন; এবং ব্ৰহ্মচৰ্য হইতে একেবারেই চতুর্থাশ্ৰম গ্ৰহণ করিয়া শ্ৰীমৎ শঙ্করাচাৰ্য, কিংবা আমাদের মহারাষ্ট্রদেশে আমরণ ব্ৰহ্মচারী গোস্বামী থাকিয়া শ্ৰীসমর্থ রামদাস জ্ঞানবিস্তারের দ্বারা জগতের উদ্ধার চেষ্টা করিয়াছেন । জ্ঞানোত্তর জগতের ব্যবহার কেবল কর্তব্য বলিয়া লোকের কল্যাণার্থ করিবে কিংবা তাহা মিথ্যা বলিয়া সমস্ত ছাড়িয়া দিবে ইহাই এখানে মুখ্য প্রশ্ন । এই ব্যবহার যে করে সে-ই কর্মযোগী; তারপর সে বিবাহ করুক বা না করুক অথবা গেরুয়া বসন পরুক বা না পরুক তাহাতে কিছুই আসে যায় না । একথা বলা যায় যে, এইরূপ কর্ম করিতে হইলে বিবাহ না করা কিংবা গেরুয়া বসন পরা কিংবা শহরের বাহিরে বৈরাগী হইয়া থাকাই অনেক সময় বিশেষ সুবিধাজনক হয় । কারণ, তাহা হইলে নিজের পশ্চাতে পরিবার-পোষণের ঝঞ্ঝাট না থাকায় আমাদের সমস্ত সময় ও পরিশ্রম লোককাৰ্য্যার্থে ব্যয় করিবার পক্ষে কোন বাধাই থাকে না । এইরূপ পুরুষের সন্ন্যাসী বেশ থাকিলেও, সে তত্ত্ব-দৃষ্টিতে কর্মযোগীই । কিন্তু উল্টাপক্ষে অর্থাৎ জাগতিক সমস্ত ব্যবহারকে অসার ভাবিয়া ও ত্যাগ করিয়া, যাহারা চুপ করিয়া বসিয়া থাকে তাহাদিগকে সন্ন্যাসী বলিতে হয়, চাই তাহারা প্রত্যক্ষ চতুর্থাশ্রম গ্ৰহণ করুক আর নাই করুক । মোদ্দা কথা, গীতার কটাক্ষ গেরুয়া বস্ত্রের উপরে কিংবা শুভ্ৰ বস্ত্রের উপরে, অথবা বিবাহ কিংবা ব্ৰহ্মচর্য্যের উপরেও নহে; জ্ঞানী পুরুষ জাগতিক ব্যবহার করে কিংবা করে না এই এক বিষয়ের উপরেই নজর রাখিয়া সন্ন্যাস ও কর্মযোগ, গীতায় এই দুই মার্গের ভেদ করা হইয়াছে । বাকী বিষয় গীতাধর্মে গুরুত্বসূচক নহে । সন্ন্যাস কিংবা চতুর্থাশ্রম শব্দ অপেক্ষা কর্মসন্ন্যাস কিংবা কর্মত্যাগ শব্দই এস্থলে অধিক অন্বৰ্থক ও নিঃসন্দিগ্ধ । কিন্তু এই দুই অপেক্ষা শুধু সন্ন্যাস শব্দ প্ৰয়োগ করিবারই অধিক চলন থাকায় তাহার পারিভাষিক অর্থ এইখানে খুলিয়া বলিয়াছি । যাহারা জাগতিক ব্যবহারকে অসার মনে করে তাহারা সংসার হইতে নিবৃত্ত হইয়া অরণ্যে গিয়া স্মৃতিধর্মানুসারে চতুর্থাশ্রম গ্ৰহণ করে বলিয়া কর্মত্যাগের এই মাৰ্গকে সন্ন্যাস বলে । কিন্তু তাহার প্ৰধান অংশ কর্মত্যাগই, গেরুয়া বসন নহে ।


4) কর্মযোগ সন্ন্যাসমার্গের অঙ্গ নহে, দুইই স্বতন্ত্র, এই সম্বন্ধে টীকাকারদের গোলমাল



পূর্ণজ্ঞান হইবার পর কর্ম করিবে (কর্মযোগ) কিংবা কর্ম ত্যাগ করিবে (কর্মসন্ন্যাস), এইরূপ দুই পক্ষ প্ৰচলিত থাকিলেও, শেষে মোক্ষলাভের দুই মার্গ স্বতন্ত্র অর্থাৎ সমানরূপেই সমর্থ; কিংবা কর্মযোগ পূর্বাঙ্গ অর্থাৎ প্ৰথম পৈঠামাত্র এবং শেষে মোক্ষলাভার্থ কর্ম ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসই গ্ৰহণ করিতে হইবে, এই প্রশ্ন গীতার সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা এই স্থানে উপস্থিত করিয়াছেন । গীতার দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের বর্ণন হইতে এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলিয়া জানা যায় । কিন্তু যখনই হউক না কেন, সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন করিয়া সাংসারিক কর্ম ত্যাগ না করিলে মোক্ষলাভ হইতে পারে না এইরূপ যাহাদের মত - এবং তাহাই গীতারও প্ৰতিপাদ্য হইবে এই বুদ্ধিতে গীতার টীকা করিতে যাহারা প্ৰবৃত্ত হইয়াছে - তাহারা গীতার এইরূপ তাৎপৰ্য্যাৰ্থ বাহির করিয়া থাকে যে, “কর্মযোগ স্বতন্ত্ররূপে মোক্ষলাভের মাৰ্গ নহে, প্ৰথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য কর্ম করিয়া শেষে সন্ন্যাসই গ্ৰহণ করিতে হইবে, সন্ন্যাসই চরম অর্থাৎ মুখ্য নিষ্ঠা ।” কিন্তু এই অর্থ স্বীকার করিলে ‘সাংখ্য (সন্ন্যাস) ও যোগ (কর্মযোগ) জগতে এই দ্বিবিধ নিষ্ঠা আছে’ [গী|৩|৩], এইরূপ ভগবান যাহা বলিয়াছেন, সেই দ্বিবিধ পদের সার্থকতা আদৌ থাকে না । কর্মযোগ শব্দের তিন অর্থ হইতে পারে - (১) জ্ঞান হউক বা না হউক, যাগযজ্ঞাদি চাতুর্বর্ণের কিংবা শ্রৌতস্মার্ত্ত কর্ম করিয়াও মোক্ষলাভ হয় - ইহাই প্ৰথম অর্থ । কিন্তু মীমাংসকদিগের এই পক্ষ গীতার মান্য নহে [গী|২|৪৫] । (২) চিত্তশুদ্ধির জন্য কর্ম করা (কর্মযোগ) আবশ্যক বলিয়া কেবল চিত্তশুদ্ধির জন্যই কর্ম করা – ইহাই দ্বিতীয় অর্থ । এই অর্থে কর্মযোগ সন্ন্যাসমার্গের পূর্বাঙ্গ কিংবা পূর্বায়োজন । কিন্তু গীতার বর্ণিত কর্মযোগ ইহা নহে । (৩) নিজের আত্মার কল্যাণ কিসে হয় তাহা যিনি জানেন সেই জ্ঞানী পুরুষ যুদ্ধাদি স্বধর্মোক্ত সাংসারিক কর্ম আমরণ করিবেন কি করিবেন না ইহাই গীতার মুখ্য প্রশ্ন; এবং ইহার উত্তর এই যে, জ্ঞানী পুরুষকেও চাতুর্বর্ণ্যের সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে হইবে, [গী|৩|২৫], - ইহাই কর্মযোগ শব্দের তৃতীয় অর্থ; এবং এই কর্মযোগই গীতাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । ইহা সন্ন্যাসমার্গের পূর্বাঙ্গ কখনই হইতে পারে না, কারণ এই মার্গে কর্ম হইতে কখনই মুক্তি নাই । এখন প্রশ্ন হইতেছে মোক্ষলাভের বিষয়ে । এই বিষয়ে গীতায় স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, জ্ঞানলাভ হইলে, নিষ্কাম কর্ম বন্ধন না হইয়া, সন্ন্যাসের দ্বারা যে মোক্ষ লাভ করিবার কথা, সেই মোক্ষ কর্মযোগের দ্বারাও প্ৰাপ্ত হওয়া যায় [গী|৫|৫] । তাই, গীতার কর্মযোগ সন্ন্যাসমার্গের পূর্বাঙ্গ নহে; কিন্তু জ্ঞানোত্তর এই দুই মাৰ্গই মোক্ষদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র অর্থাৎ তুল্যবল । [গী|৫|২]; “লোকেহস্মিন্‌ দ্বিবিধা নিষ্ঠা” [গী|৩|৩] এই গীতাবাক্যের এই অর্থই গ্ৰহণ করিতে হইবে । এবং এই কারণেই, ভগবান পরবর্তী চরণে “জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্মযোগেন যোগিনাং” এই দুই মার্গকে পৃথক রূপে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছেন । পরে ১৩ম অধ্যায়ে “অন্যে সাংখ্যেন যোগেন কর্মযোগেন চাপরে” [গী|১৩|২৪] এই শ্লোকের ‘অন্যে’ (এক) ও ‘অপর’ (দ্বিতীয়) এই দুই পদ উক্ত দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলিয়া না মানিলে অন্বৰ্থক হয় না । তাছাড়া, যে নারায়ণীয় ধর্মের প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ (যোগ) গীতায় প্রতিপাদিত হইয়াছে, মহাভারতে তাহার ইতিহাস দেখিলেও এই সিদ্ধান্তই দৃঢ় হয় । জগতের আরম্ভে ভগবান হিরণ্যগৰ্ভকে অর্থাৎ ব্ৰহ্মদেবকে জগৎ সৃষ্টি করিতে বলিলে, তাহা হইতে মরীচি-আদি সাত মানসপুত্ৰ উৎপন্ন হয় । তাঁহারা সৃষ্টিক্রম ঠিক শুরু করিবার জন্য যোগ অর্থাৎ কর্মময় প্রবৃত্তিমাৰ্গ অবলম্বন করিলেন । ব্ৰহ্মার সনৎকুমার, কপিল প্ৰভৃতি অন্য সাতপুত্র জন্মিলেই নিবৃত্তিমাৰ্গ অর্থাৎ সাংখ্য অবলম্বন করিলেন । এইরূপ দুই মার্গের উৎপত্তি বলিয়া, এই দুই মার্গ মোক্ষদৃষ্টিতে তুল্যবল অর্থাৎ বাসুদেবস্বরূপী একই পরমেশ্বর-প্ৰাপ্তির ভিন্ন ভিন্ন ও স্বতন্ত্র মাৰ্গ, এইরূপ পরে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে [মভা|শাং|৩৪৮|৭৪; ৩৪৯|৬৩-৭৩] । সেইরূপ আবার, যোগের অর্থাৎ প্রবৃত্তিমার্গের প্রবর্তক হিরণ্যগৰ্ভ এবং সাংখ্যমার্গের মূলপ্ৰবর্তক কপিল এইরূপ ভেদও করা হইয়াছে; কিন্তু হিরণ্যগৰ্ভ পরে কর্ম ত্যাগ করিয়াছেন এরূপ কোথাও উক্ত হয় নাই । উল্টা, জগতের ব্যবহার যাহাতে সুচারুরূপে চলে তজ্জন্য ভগবান কর্মরূপ যজ্ঞচক্র উৎপন্ন করিয়া তাহা সতত চলমান রাখিবার জন্য তাঁহাকে এবং অন্য দেবতাকে বলিয়াছিলেন, এইরূপ বর্ণনা আছে [মভা|শাং|৩৪০|৪৪-৭৫ ও ৩৩৯|৬৬,৬৭ দেখ] । ইহা হইতে সাংখ্য ও যোগ এই দুই মার্গ প্রথম হইতেই যে স্বতন্ত্র, তাহা নির্বিবাদে সিদ্ধ হয় । ইহা হইতে আরও দেখা যায় যে, গীতার সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা কর্মযোগকে যে গৌণত্ব দিবার চেষ্টা করিয়াছেন, তাহা নিছক সাম্প্রদায়িক আগ্রহের পরিণাম; এবং কর্মযোগ জ্ঞানলাভের কিংবা সন্ন্যাসের কেবল সাধন মাত্ৰ বলিয়া এই টীকাকারেরা স্থানে স্থানে যে ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন, তাহা তাঁহাদের নিজের কথা, গীতার প্রকৃত ভাবাৰ্থ সেরূপ নহে । আমার মতে, সন্ন্যাসমাৰ্গীয় গীতার টীকাসমূহের ইহাই মুখ্য দোষ । এবং টীকাকারদিগের এই সাম্প্রদায়িক আগ্ৰহ হইতে মুক্তি না হইলে গীতার প্রকৃত রহস্যের জ্ঞান হওয়া কখনই সম্ভব নহে ।


5) গীতার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত এই যে, এই দুই মার্গ মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ



কর্মসন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই-ই স্বতন্ত্রভাবে সমান মোক্ষপ্ৰদ, এক অন্যটির পূর্বাঙ্গ নহে এইরূপ নির্ধারিত হইলেও সব কথার মীমাংসা হয় না । কারণ, যদি দুই মাৰ্গই সমান মোক্ষপ্ৰদ হয় তবে উহাদের মধ্যে আমাদের যেটি ভাল লাগে আমরা তাহাই অবলম্বন করিব, এইরূপ বলিতে হয় । এবং তাহা হইলে, অর্জুনের যুদ্ধ করা কর্তব্য এইরূপ সিদ্ধ না হইয়া, ভগবানের উপদেশে পরমেশ্বরজ্ঞান হইলেও অর্জুন আপন অভিরুচি অনুসারে যুদ্ধ করিবে কিম্বা যুদ্ধ ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে, এইরূপ দুই পক্ষই সম্ভব হয় । তাই “এই দুই মার্গের মধ্যে অধিক প্রশস্ত যেটি সেই এক মার্গের কথাই আমাকে ঠিক করিয়া বল” [গী|৫|১] অর্থাৎ যে আচরণ করিলে গোলযোগ হইবে না, অর্জুন সহজভাবে ও সরলভাবে সেই প্রশ্ন করিয়াছেন । গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন এই প্রশ্ন করিলে পরবর্তী শ্লোকে ভগবান তাহার এই স্পষ্ট উত্তর দিয়াছেন যে “সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই মাৰ্গ নিঃশ্ৰেয়স অর্থাৎ মোক্ষপ্ৰদ কিংবা মোক্ষদৃষ্টিতে সমতুল্য হইলেও এই দুয়ের মধ্যে কর্মযোগের মাতব্বরী কিংবা যোগ্যতা বিশেষভাবে আছে (বিশিষ্যতে)” [গী|৫|২]; এবং এই শ্লোক আমি এই প্রকরণের আরম্ভেই দিয়াছি । কর্মযোগের শ্রেষ্ঠত্বসম্বন্ধে এই একটি মাত্ৰ বচন যে গীতায় আছে তাহা নহে; অনেক বচন আছে; যথা “তস্মাদ্‌যোগায় যুজ্যস্ব” [গী|২|৫০] - অতএব তুমি কর্মযোগই স্বীকার কর; “মা (কর্মফলহেতুর্ভূর্মা) তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি” [গী|২|৪৭] - কর্ম না করিবার আগ্রহ রাখিও না;
যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জুন ৷
কর্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে ॥
কর্ম একেবারে ছাড়িবার ঝগড়ায় না পড়িয়া “ইন্দ্রিয়দিগকে মনের দ্বারা নিয়মিত করিয়া অনাসক্তবুদ্ধিতে কর্মেন্দ্ৰিয়াদির দ্বারা কর্ম করিবার যোগ্যতা ‘বিশিষ্যতে’ অর্থাৎ বিশেষ” [গী|৩|৭]; কারণ যখন যাহাই হউক না কেন, “কর্ম জ্যায়ো হ্যকর্মণঃ” [গী|৩|৮] অকর্ম অপেক্ষা কর্ম শ্রেষ্ঠ; “অতএব তুমি কর্মই কর” [গী|৮|১৫]; কিংবা “যোগমাতিষ্ঠোত্তিষ্ঠ” [গী|৪|৪২] - কর্মযোগ স্বীকার করিয়া যুদ্ধার্থে দণ্ডায়মান হও; “(যোগী) জ্ঞানিভ্যোহপি মতোহধিকঃ” জ্ঞানমাৰ্গী (সন্ন্যাসী) অপেক্ষা কর্মযোগীর যোগ্যতা অধিক; “তস্মাদ্যোগী ভবাৰ্জুন” [গী|৬|৪৬] - অতএব হে অর্জুন ! তুমি (কর্ম-) যোগী হও; কিংবা “মামনুস্মর যুদ্ধ্য চ” [গী|৮|৭] - আমাকে স্মরণ করিয়া যুদ্ধ কর; এই প্রকার অনেক বচনে গীতায় অর্জুনকে স্থানে স্থানে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহাতেও সন্ন্যাস বা অকর্ম অপেক্ষা কর্মযোগ অধিক যোগ্য এইরূপ দেখাইবার জন্য ‘জ্যায়ঃ’, ‘অধিকঃ’, ‘বিশিষ্যতে’ এইরূপ স্পষ্ট পদ আছে । ১৮ম অধ্যায়ের উপসংহারেও “নিয়ত কর্মসন্ন্যাস করা উচিত নহে; আসক্তিবিরহিত হইয়া সমস্ত কর্ম সর্বদা করিতে হইবে, ইহাই আমার নিশ্চিত ও উত্তম মত,” এইরূপ ভগবান পুনর্বার বলিয়াছেন [গী|১৮|৬,৭] । ইহা হইতে নির্বিবাদ সিদ্ধ হয় যে, সন্ন্যাসমার্গ অপেক্ষা কর্মযোগই গীতায় শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্ধারিত হইয়াছে ।


6) সন্ন্যাসমার্গী টীকাকারদের কৃত বিপর্য্যাস



কিন্তু সন্ন্যাস কিংবা ভক্তিই চরম ও শ্রেষ্ঠ কর্তব্য; কর্ম চিত্তশুদ্ধির কেবল সাধনমাত্ৰ, মুখ্য সাধ্য বা কর্তব্য নহে, এইরূপ যাঁহাদের সাম্প্রদায়িক মত, এই সিদ্ধান্ত তাঁহাদের রুচিবে কি প্রকারে ? সন্ন্যাসমার্গ অপেক্ষা গীতায় কর্মযোগের অধিক গুরুত্ব স্পষ্টরূপে প্ৰদত্ত হইয়াছে, এই কথা তাঁহাদের যে মনে হয় নাই এরূপ নহে । কিন্তু ইহা মানিলে, নিজের সাম্প্রদায়িক যোগ্যতা কমিয়া যাইবে, স্পষ্টই দেখা যায় । তাই, পঞ্চম অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুনকৃত প্রশ্ন এবং ভগবান-প্রদত্ত উত্তর, দুই-ই সরল, সযুক্তিক ও স্পষ্টার্থক হইলেও, ইহার কোন অর্থ কি প্রকারে করা যাইবে, এই সম্বন্ধে সাম্প্রদায়িক টীকাকারগণ বড়ই মুষ্কিলে পড়িয়াছেন । প্ৰথম মুষ্কিল এই ছিল যে, ‘সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই মার্গের মধ্যে কোন্‌ মার্গ শ্রেষ্ঠ’ ? এই প্রশ্নই উপস্থিত হয়ই না, যদি না এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র বলিয়া মানা যায় । কারণ, টীকাকারদিগের কথা অনুসারে কর্মযোগ যদি জ্ঞানের কেবল পুর্বাঙ্গ হয়, তবে পুর্বাঙ্গ গৌণ এবং জ্ঞান কিংবা সন্ন্যাসই শ্ৰেষ্ঠ, ইহা স্বতই সিদ্ধ হয় । এবং তাহার পর, প্রশ্ন করিবার কোন অবসর থাকে না । ভাল; এই প্ৰশ্নকে উচিত প্রশ্ন বলিলেও, এই দুই মাৰ্গকে স্বতন্ত্র স্বীকার করিতে হয়; এবং এইরূপ স্বীকার করিলে, নিজের সম্প্রদায়ই একমাত্র মোক্ষমাৰ্গ, এই কথার সহিত বিরোধ উপস্থিত হয় ! এই জন্য, এই টীকাকারগণ অর্জুনের প্রশ্নই ঠিক নহে এইরূপ ব্যাখ্যা প্ৰথমে করিয়াছেন এবং ইহা দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, ভগবানের উত্তরের তাৎপৰ্যও এইরূপই । কিন্তু এত চেষ্টা করিয়াও তাঁহারা “কর্মযোগের যোগ্যতা কিংবা প্রামাণ্য অধিক” [গী|৫|২] ভগবানের এই স্পষ্ট উত্তরের অর্থ লাগাইতে পারেন নাই ! তাই, শেষে “কর্মযোগো বিশিষ্যতে” - কর্মযোগের প্রামাণ্য বিশেষ রকমের - এই বচন কর্মযোগের স্তুতিমাত্র অর্থাৎ অর্থবাদাত্মক, ভগবানেরও মতে সন্ন্যাসমাৰ্গই বাস্তবিক, শ্ৰেষ্ঠ, [গী|শাং ভা|৫|২; ৬|১,২; ১৮|১১ দেখ] এইরূপ পূর্বাপর সন্দর্ভবিরুদ্ধ নিজের মনগড়া আর একটা টিপ্পনী করিয়া কোন প্রকারে মনকে আশ্বস্ত করিতে হইয়াছে । শাঙ্করভাষ্যে শুধু নহে, রামানুজভাষ্যেও এই শ্লোক কর্মযোগের স্তুতিবাচক অর্থাৎ অর্থবাদাত্মক বলিয়াই স্বীকার করা হইয়াছে [গী|রা.ভা|৫|১] । রামানুজাচাৰ্য অদ্বৈতী না হইলেও তাঁহার মতে ভক্তিই মুখ্য সাধ্য হওয়ায়, কর্মযোগ জ্ঞানযুক্ত ভক্তির সাধনই হইয়া যায় [গী|রা.ভা|৩|১ দেখ] । 


7) তাহার উত্তর



মূলগ্ৰন্থ হইতে টীকাকারদিগের সম্প্রদায় ভিন্ন; কিন্তু টীকাকার, নিজের মাৰ্গই মূল গ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে এই দৃঢ় ধারণায় সেই গ্রন্থের টীকা করিতে প্ৰবৃত্ত হন । এই হেতু মূলগ্রন্থের কিরূপ টানা-বুনা ব্যাখ্যা হয় তাহা পাঠক দেখুন । “অর্জুন ! তোমার প্রশ্নটি ঠিক্‌ নহে” এইরূপ কৃষ্ণের কিংবা ব্যাসের সংস্কৃত ভাষায় স্পষ্টশব্দে বলা আসে নাই কি ? কিন্তু তাহা না করিয়া যখন “কর্মযোগই বিশেষরূপে যোগ্য” এইরূপ অনেক স্থানে স্পষ্ট বলিয়াছেন তখন সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের উক্ত অর্থ সরল নহে, এ কথা বলিতেই হয়; এবং পূর্বাপর সন্দর্ভ দেখিলেও এই অনুমান দৃঢ় হয় । কারণ গীতাতেই, জ্ঞানী পুরুষ কর্মের সন্ন্যাস না করিয়া, জ্ঞানোত্তরেও অনাসক্ত বুদ্ধিতে নিজের সমস্ত ব্যবহার করিয়া থাকেন, এইরূপ অনেক স্থানে বর্ণনা আছে [গী|২|৬৪; ৩|১৯; ৩|২৫; ১৮|৯ দেখ] । ইহার উপর শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য আপন ভাষ্যে প্ৰথমে এই প্রশ্ন করিয়াছেন যে, জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয়, কিংবা জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ে মোক্ষলাভ হয়; এবং পুনরায় এই গীতাৰ্থ স্থির করিয়াছেন যে, কেবল জ্ঞানেই সমস্ত কর্ম দগ্ধ হইয়া গিয়া মোক্ষলাভ হয়, মোক্ষলাভের জন্য কর্মের আবশ্যকতা নাই । ইহা হইতে পরে এই অনুমান করা হইয়াছে যে, যখন গীতার দৃষ্টিতেও মোক্ষের জন্য কর্মের আবশ্যকতা নাই, তখন চিত্তশুদ্ধি হইলে সমস্ত কর্ম নিরর্থকই হইয়া থাকে; এবং তাহা স্বভাবতই বন্ধক অর্থাৎ জ্ঞানের বিরুদ্ধ হওয়ায়, জ্ঞানোত্তর জ্ঞানী পুরুষকে কর্ম ত্যাগ করিতে হয়” - এই মতই গীতায় ভগবানেরও গ্রাহ্য হইয়াছে । ‘জ্ঞানোত্তর জ্ঞানী পুরুষকেও কর্ম করিতে হয়’ - এই মতের নাম “জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয় পক্ষ”; এবং শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের উপরি-উক্ত যুক্তিবাদই তদ্বিরুদ্ধে মুখ্য আপত্তি । এইরূপ যুক্তিবাদই মধ্বাচাৰ্যও স্বীকার করিয়াছেন [গী|মভা|৩|৩১ দেখ] । কিন্তু এই যুক্তিবাদ আমার মতে সন্তোষজনক কিংবা নিরুত্তরও নহে । কারণ, (১) কাম্য কর্ম বন্ধক হইয়া জ্ঞানের বিরূদ্ধ হইলেও এই যুক্তি নিষ্কাম কর্মের সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হয় না; এবং (২) জ্ঞানোত্তর মোক্ষের জন্য কর্ম অনাবশ্যক হইলেও ‘অন্য কোন বলবৎ কারণের জন্য জ্ঞানী পুরুষের জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গেই কর্ম করা অবশ্যক’, এইরূপ সিদ্ধ হইবার পক্ষে উহা দ্বারা কোন বাধা হয় না । মুমুক্ষুর চিত্ত শুদ্ধ করাই জগতে কর্মের উপযোগ নহে, কিংবা ইহারই জন্য কর্ম উৎপন্নও হয় নাই; তাই, মোক্ষ ব্যতীত অন্য কারণবশতঃ স্বধর্মানুসারে প্রাপ্ত কর্মজগতের সমস্ত ব্যবহার জ্ঞানী পুরুষেরও নিষ্কাম বুদ্ধিতে করা আবশ্যক, এইরূপ বলা যাইতে পারে । এই কারণগুলি কি, তাহার সবিস্তুর বিচার এই প্রকরণে পরে করা হইয়াছে । এক্ষণে এইটুকুই বলিতেছি যে, সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য প্ৰস্তুত অর্জুনকে এই সমস্ত কারণ বলিবার জন্যই গীতাশাস্ত্রের প্রবৃত্তি হইয়াছে; এবং এইরূপ অনুমান করিতে পারা যায় না যে, চিত্তশুদ্ধির পর মোক্ষের জন্য কর্মের অনাবশ্যকতা বুঝাইয়া গীতায় সন্ন্যাসমাৰ্গই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । জ্ঞানোত্তর সন্ন্যাসাশ্রম গ্ৰহণ করিয়া কর্মত্যাগ করিতেই হইবে ইহা শাঙ্কর-সম্প্রদায়ের মত সত্য; কিন্তু তাহা হইতে ইহা সিদ্ধ হয় না যে গীতার তাৎপৰ্যও তাহাই হইবে, কিংবা শাঙ্কর অথবা অন্য কোন সম্প্রদায়কে ‘ধর্ম’ মনে করিয়া তাহারই অনুকূলে গীতার কোনরূপ অর্থ করিতেই হইবে । জ্ঞান প্ৰাপ্তির পরেও সন্ন্যাসমার্গ অবলম্বন অপেক্ষা কর্মযোগ স্বীকার করাই উত্তম পক্ষ, ইহাই তো গীতার স্থির সিদ্ধান্ত । তারপর, তাহাকে তুমি পৃথক সম্প্রদায়ই বল, কিংবা তাহার আর কোন নাম দেও, তাহাতে কিছুই আসে যায় না । কিন্তু গীতা কর্মযোগকেই শ্ৰেষ্ঠ মনে করিলেও, সন্ন্যাসমার্গ সর্বথা পরিত্যাজ্য বলিয়া মনে করিতে হইবে, অন্য পরমতাসহিষ্ণু সম্প্রদায়ের ন্যায় গীতার এরূপ আগ্রহ নাই ইহা মনে রাখা আবশ্যক । সন্ন্যাসমার্গসম্বন্ধে গীতার কোথাও অনাদরবুদ্ধি প্ৰদৰ্শিত হয় নাই । পক্ষান্তরে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই মার্গ একই প্ৰকার নিঃশ্ৰেয়স্কর অর্থাৎ মোক্ষপ্রদ কিংবা মোক্ষদৃষ্টিতে সমান মূল্যবান, এইরূপ ভগবান স্পষ্ট বলিয়াছেন । এবং পরে “একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি” [গী|৫|৫] এই দুই মাৰ্গ একই অর্থাৎ তুল্যবল ইহা যে জানে সেই প্রকৃত তত্ত্ব জানে; কিংবা ‘কর্মযোগ’ হইলেও তাহাতে ফলাশার ‘সন্ন্যাস’ করাই আবশ্যক হয় - “ন হ্যসন্ন্যস্তসংকল্পো যোগী ভবতি কশ্চন” [গী|৬|২] - এইরূপ যুক্তি দ্বারা এই দুই ভিন্ন মার্গের একরূপতা করিয়াও দেখানো হইয়াছে । জ্ঞানোত্তর (প্ৰথমেই নহে) কর্ম ত্যাগ করা বা কর্মযোগ স্বীকার করা, দুই মার্গ মোক্ষদৃষ্টিতে একই যোগ্যতার হইলেও লোকব্যবহারদৃষ্টিতে বিচার করিলে বুদ্ধিতে সন্ন্যাস রাখিয়া অর্থাৎ বুদ্ধিকে নিষ্কাম করিয়া দেহেন্দ্ৰিয়াদিযোগে আমরণ লোকসংগ্ৰহকারী কর্ম করিতে থাকা, - এই মাৰ্গই সর্বাপেক্ষা শ্ৰেষ্ঠ হয় । কারণ, সন্ন্যাস ও কর্ম এই দুই-ই তাহাতে বজায় থাকে, এইরূপ ভগবানের নিশ্চিত উপদেশ; এবং তদনুসারে অর্জন পরে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হইলেন । জ্ঞানী ও অজ্ঞানী ইহাদের মধ্যে ইহাই যাহা কিছু ভেদ । কেবল শারীর কর্ম অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াদির দ্বারা সংঘটিত কর্ম দেখিলে, উভয়েই একই হইবেই; কিন্তু অজ্ঞান মনুষ্য তাহা আসক্ত বুদ্ধিতে এবং জ্ঞানী মনুষ্য অনাসক্ত বুদ্ধিতে করিয়া থাকে [গী|৩|২৫] । গীতার এই সিদ্ধান্তই ভাস কবি স্বীয় নাটকে বলিয়াছেন -
প্ৰাজ্ঞস্য মূর্খস্য চ কাৰ্যযোগে ৷
সমত্বমভ্যেতি তনুর্ন বুদ্ধিঃ ॥
“জ্ঞানী ও মূর্খ ইহাদের কর্ম করিবার পক্ষে দেহ একরকমই, কেবল বুদ্ধিই ভিন্ন হইয়া থাকে [অবিমার|৫|৫]


8) অর্জুনকে অজ্ঞানী মানিতে পারি না



কতকগুলি সন্ন্যাসমার্গের ক্ষুদ্রবুদ্ধি লোক এই সম্বন্ধে আরও এই কথা বলে যে “গীতায় অর্জুনকে কর্ম করিবার উপদেশ দেওয়া হইয়াছে সত্য; কিন্তু অর্জুন অজ্ঞান বলিয়া চিত্তশুদ্ধিকর কর্ম করিবারই তাঁহার অধিকার ছিল - এই কথা মনে রাখিয়াই ভগবান এই উপদেশ করিয়াছেন । সিদ্ধাবস্থায় ভগবানের মতেও কর্মত্যাগই শ্রেষ্ঠ” । এই যুক্তিবাদের সরল ভাবাৰ্থ ইহাই দেখা যায় যে, ভগবান অর্জুনকে যদি “তুমি অজ্ঞানী” এইরূপ বলিতেন, তবে কঠোপনিষদে নচিকেতা যেরূপ পূর্ণজ্ঞান লাভের জন্য জেদ করিয়াছিলেন, অর্জুন সেইরূপ জেদ করিতেন; এবং তাঁহাকে পুর্ণ জ্ঞানের কথা বলিতেই হইত; এবং সেইরূপ পুর্ণজ্ঞানের উপদেশ তাঁহাকে দিলে তিনি যুদ্ধ ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিতেন এবং তাহা হইলে তো ভগবানের ভারতীয় যুদ্ধ সম্বন্ধীয় সমস্ত উদ্দেশ্যই বিফল হইয়া যাইত এই ভয়ে আপনার অত্যন্ত প্রিয় ভক্তকে ঠকাইবার জন্য শ্ৰীকৃষ্ণ গীতার উপদেশ করিয়াছিলেন ! কেবল নিজ সম্প্রদায়ের সমর্থনার্থ ভগবানেরও উপর যাহারা এই প্রতারণারূপ গৰ্হিত কাৰ্য আরোপ করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছে তাহাদের সহিত কোন প্রকার বাদানুবাদ না করাই শ্ৰেয়স্কর । কিন্তু সাধারণ লোক এই ভ্ৰান্ত যুক্তিবাদের দ্বারা পাছে প্ৰতারিত হয় সেইজন্যই এইটুকু বলিতেছি যে “তুমি অজ্ঞানী, সেইজন্য কর্ম কর” অর্জুনকে এইরূপ স্পষ্টাক্ষরে বলিতে শ্ৰীকৃষ্ণের ভয় পাইবার কোন কারণ ছিল না; এবং ইহার পরেও যদি অর্জুন কোন গোলযোগ করিতেন, তাহা হইলে অর্জুনকে অজ্ঞানী রাখিয়াই তাঁহা দ্বারা প্রকৃতি-ধর্মানুসারে যুদ্ধ করাইবার সামর্থ্য শ্ৰীকৃষ্ণের ছিল [১৮|৫৯ ও ৬১ দেখ] । কিন্তু সেরূপ না করিয়া ‘জ্ঞান’ ও ‘বিজ্ঞান’ই পুনঃ পুনঃ বুঝাইয়া [গী|৭|২; ৯|১; ১০|১; ১৩|২; ১৪|১], ১৫ম অধ্যায়ের শেষে “এই শাস্ত্ৰ বুঝিয়া লইতে পারিলে মনুষ্য জ্ঞাতা ও কৃতাৰ্থ হয়” [গী|১৫|২০], এইরূপ ভগবান অর্জুনকে বলিয়াছেন । এইরূপে তাঁহাকে পূর্ণ জ্ঞানী করিয়া তাঁহা দ্বারা তাঁহার স্বেচ্ছাক্রমে যুদ্ধ করাইয়াছেন [গী|১৮|৬৩ দেখ] । ইহা হইতে স্পষ্ট সিদ্ধ হয় যে, জ্ঞাতা পুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও নিষ্কাম কর্ম করিতেই থাকিবে - এই মতই সর্বোত্তম, এবং ইহাই ভগবানের অভিপ্ৰায় । তাছাড়া, অর্জুন অজ্ঞানী ছিলেন ইহা একবার মানিয়া লইলেও, তাঁহাকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছিল তাহার সমর্থনার্থ, জনকাদি প্ৰাচীন কর্মযোগীদের এবং ভগবান নিজেরও যে দৃষ্টান্ত দেখাইয়াছেন, তাঁহারা সকলেই অজ্ঞানী ছিলেন এরূপ কখন বলা বাইতে পারে না । তাই, সাম্প্রদায়িক আগ্রহের এই শুষ্ক তর্ক সর্বথা অনুচিত ও ত্যাজ্য, এবং গীতায় জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগের উপদেশই দেওয়া হইয়াছে, একথা বলিতেই হয় ।


9) এই বিষয়ে গীতায় নির্দিষ্ট কারণ যে, কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ কেন



যাক্‌ । সিদ্ধাবস্থাতেও কর্মত্যাগ (সাংখ্য) ও কর্মযোগ (যোগ), এই দুই মার্গ শুধু আমাদের দেশে নয়, অন্য দেশেও পূর্বাপর চলিয়া আসিতেছে দেখা যায় । অনন্তর এই বিষয়ে, গীতাশাস্ত্রের দুই মুখ্য সিদ্ধান্ত বলা হইয়াছে - (১) এই দুই মার্গ স্বতন্ত্র অর্থাৎ মোক্ষদৃষ্টিতে পরস্পরনিরপেক্ষ ও তুল্যবল, একটি অপরটির অঙ্গ নহে; এবং (২) ইহাদের মধ্যে কর্মযোগই অধিক প্রশস্ত । এই দুই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত স্পষ্ট হইলেও টীকাকারেরা কেন ও কি প্রকারে তাহাদের বিপৰ্যয় করিয়াছে তাহাই ব্যক্ত করিবার জন্য এই সমস্ত প্ৰস্তাবনা লিখিতে হইয়াছে । এক্ষণে, সিদ্ধাবস্থাতেও কর্মত্যাগী অপেক্ষা নিষ্কামবুদ্ধিতে আমরণ কর্ম করিবার মার্গ অর্থাৎ কর্মযোগই অধিক শ্রেয়স্কর, এই যে উপস্থিত প্রকরণের মুখ্য উদ্দেশ্য তাহা সিদ্ধ করিবার জন্য গীতায় যে সকল কারণ প্রদত্ত হইয়াছে তাহাই নিরূপণ করিব । তন্মধ্যে দুই এক বিষয়ের ব্যাখ্যা পূর্বে সুখ-দুঃখ-বিবেচন-প্রকরণে করা হইয়াছে । কিন্তু এই বিচার কেবল সুখদুঃখসম্বন্ধেই হওয়ায় সেখানে এই বিষয়ের পূর্ণ আলোচনা করিতে পারা যায় নাই । তাই, তাহারই জন্য এই স্বতন্ত্র প্রকরণ আরম্ভ করা হইয়াছে । বৈদিক ধর্মের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই দুই ভাগ আছে । তাহাদের মধ্যে প্ৰভেদ কি তাই পূর্ব প্রকরণে বলিয়াছি । কর্মকাণ্ডে অর্থাৎ ব্ৰাহ্মণাদি শ্রৌতগ্রন্থে এবং অংশতঃ উপনিষদেও এইরূপ স্পষ্ট বচন আছে যে, প্রত্যেক গৃহস্থ – ব্রাহ্মণই হউক বা ক্ষত্রিয়ই হউক – অগ্নিহোত্র পালন করিয়া জ্যোতিষ্টোমাদি যাগযজ্ঞ অধিকারানুসারে করিবে এবং বিবাহ করিয়া বংশ বৃদ্ধি করিবে । উদাহরণ যথা - “এতদ্বৈ জরামর্য্যং সত্ৰং যদগ্নিহোত্ৰম্‌” - অগ্নিহোত্ররূপ এই সত্ৰ মরণ পৰ্যন্ত বজায় রাখিতে হইবে [শ|ব্ৰা|১২|৪|১|১]; “প্রজাতন্তুং মা ব্যবচ্ছেৎসীঃ” - বংশের ধারা ভঙ্গ করিবে না [তৈ উ|১|১১|১]; কিংবা “ঈশাবাস্যমিদং সৰ্ব্বং” — জগতে যাহা কিছু আছে তাহা পরমেশ্বরের দ্বারা অধিষ্ঠিত অর্থাৎ আমার নাহে তাঁহার, এইরূপ বুঝিবে, এবং এই নিষ্কাম বুদ্ধিতে
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেচ্ছতং সমাঃ ৷
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে নরে ॥
“কর্ম করিতে থাকিয়াই শত বৎসর অর্থাৎ পুরুষের পরমায়ুর শেষ সীমা পৰ্যন্ত বাঁচিবার ইচ্ছা করিবে, এবং এইরূপ ঈশাবাস্য বুদ্ধিতে কর্ম করিলে সেই কর্ম, তোমার (অর্থাৎ পুরুষের) বন্ধন হইবে না; ইহা ব্যতীত (উক্ত বন্ধন পরিহার করিবার জন্য) অন্য মার্গ নাই, [ঈশ|১ ও ২];” ইত্যাদি বচন দেখ । কিন্তু কর্মকাণ্ড হইতে জ্ঞানকাণ্ডে উঠিবার পথে “ব্রহ্মবিদ্যাপ্নোতি মোক্ষম্‌” [তৈ|২|১|১] - ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয়; “নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে হয়নায়” [শ্বে|৩|৮] - (জ্ঞান ব্যতীত) মোক্ষলাভের অন্য পন্থা নাই; “পূর্বে বিদ্বাংসঃ প্ৰজাং ন কাময়ন্তে । কিং প্ৰজয়া করিষ্যামো যেষাং নোহয়মাত্মাহয়ং লোক ইতি তে হ স্ম পুত্ৰৈষণায়াশ্চ বিত্তৈষণায়াশ্চ লোকৈষণায়াশ্চ ব্যুত্থায়াথ ভিক্ষাচৰ্য্যং চরন্তি” [বৃ|৪|৪|২২ ও ৩|৫|১] - পূর্বকালের জ্ঞানী পুরুষেরা পুত্ৰাদি ভাল বাসিতেন না, এবং সমস্ত লোকই যখন আমার আত্মা হইল, তখন আমার (অন্য) সন্তানের কি প্রয়োজন, এইরূপ বলিয়া তাঁহারা সন্ততি, সম্পত্তি ও স্বর্গাদির মধ্যে কোন কিছুরই ‘এষণা’ অর্থাৎ ইচ্ছা না করিয়া তাহা হইতে নিবৃত্ত হইয়া কেবল ভিক্ষা করিয়াই ঘুরিয়া বেড়াইতেন; কিংবা “এই প্রকারে বিরাগী পুরুষদিগের মোক্ষলাভ হয়” [মুং|১|২|১১]; অথবা পরিশেষে “যদহরেব বিরজেৎ তদহরেব প্ৰব্ৰজেৎ” [জাবা|৪] - যে দিন বুদ্ধি বিরক্ত হইবে সেই দিন সন্ন্যাস লইবে; - এইরূপ বিরুদ্ধপক্ষীয় বচনাদিও বৈদিক গ্রন্থেই পাওয়া যায় । এই প্রকার বেদাজ্ঞা দ্বিবিধ হওয়ায় [মভা|শাং|২৪০|৬] প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি কিংবা কর্মযোগ ও সাংখ্য, ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মার্গ কোনটি তাহা নির্ণয় করিবার জন্য অন্য কোন সাধন আছে কি নাই, ইহা দেখা আবশ্যক । 


10) আচার অনাদিকাল হইতে দ্বিবিধ, অতএব উহা শ্রেষ্ঠতানির্ণয়ে উপযোগী নহে



আচার অর্থাৎ শিষ্ট লোকদিগের আচরণ, রীতি কিংবা চাল কিরূপ, তাহা দেখিয়া এই প্রশ্নের নির্ণয় হইতে পারে । কিন্তু এই বিষয়ে শিষ্টাচারও উভয়বিধ । শুক, যাজ্ঞবল্ক্য প্ৰভৃতি সন্ন্যাসমাৰ্গ, এবং জনক, শ্ৰীকৃষ্ণ, জৈগীষব্য প্রভৃতি জ্ঞানীপুরুষ কর্মমাৰ্গই অবলম্বন করিয়াছিলেন, ইহা ইতিহাস হইতে প্ৰকাশ পায় । এই অভিপ্ৰায়েই “তুল্যং তু দর্শনং” [বেসূ|৩|৪|৯] অর্থাৎ আচারদৃষ্টিতে এই দুই পন্থা তুল্যবল, ইহা সিদ্ধান্তপক্ষে বাদরায়াণাচাৰ্য বলিয়াছেন - 
বিবেকী সর্বদা মুক্তঃ কুর্বতো নাস্তি কর্তৃতা ৷
অলেপবাদমাশ্ৰিত্য শ্ৰীকৃষ্ণজনকৌ যথা ॥
পুৰ্ণব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষ সমস্ত কর্ম করিয়াও শ্ৰীকৃষ্ণ ও জনকের ন্যায় অকর্তা, অলিপ্ত, ও সর্বদা মুক্তই থাকেন” - এইরূপ স্মৃতিবচনও আছে । (ইহা স্মৃতির বচন বলিয়া আনন্দগিরি কঠোপনিষদের [কঠ|২|১৯] শাঙ্করভাষ্যের টীকায় উদ্ধৃত করিয়াছেন । ইহার মূল বচনটি কোথাকার তাহা আমি জানি না ।) সেইরূপ আবার, ভগবদ্‌গীতাতেও কর্মযোগীদিগের পরম্পরা বলিতে গিয়া মনু, ইক্ষাকু ইত্যাদির নাম বলিয়া উক্ত হইয়াছে - “এবং জ্ঞাত্বা কৃতং কর্ম পূৰ্বৈরপি মুমুক্ষুভিঃ” [গী|৪|১৫] - ইহা জানিয়া পূর্বে জনকাদি জ্ঞানী পুরুষ কর্ম করিায়াছেন । জনক ব্যতীত এই প্রকার আরও অনেক উদাহরণ যোগবাসিষ্ঠে ও ভাগবতে প্ৰদত্ত হইয়াছে [যো|৫|৭৫; ভাগ|২|৮|৪৩-৪৫] । জনকাদির পূৰ্ণব্ৰহ্মজ্ঞান হয় নাই এইরূপ কাহারও সন্দেহ হইতে পারে । তাই বলিতেছি যে, ইহাঁরা সকলে জীবন্মুক্ত ছিলেন এইরূপ যোগবাসিষ্ঠে স্পষ্ট কথিত হইয়াছে । শুধু যোগবাসিষ্ঠে নহে, মহাভারতেও ব্যাস আপন পুত্র শুককে মোক্ষধর্মের পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিবার জন্য শেষে জনকের নিকট পাঠাইলেন এইরূপ কথা বিবৃত হইয়াছে [মভা|শাং|৩২৫ ও যো|২|১ দেখ] । সেইরূপ উপনিষদেও অশ্বপতি কৈকেয়ী রাজা উদ্দালক ঋষিকে [ছাং|৫|১১-২৪], এবং কাশিরাজ অজাতশত্রু গার্গ্য বালাকীকে [বৃ|২|১] ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ করিয়াছেন এইরূপ কথা আছে । তথাপি অশ্বপতি কিংবা জনক রাজকাৰ্য ছাড়িয়া দিয়া কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়াছেন এইরূপ কোথাও বৰ্ণনা নাই । 


11) জনকের তিন এবং গীতার দুই নিষ্ঠা



উল্টা, জনকসুলভা-সংবাদে জনক “আমি মুক্তসঙ্গ হইয়া আসক্তি না রাখিয়া রাজ্য করিতেছি এবং আমার এক হাতে চন্দন মাখিলেও, এবং অন্য হস্ত কাটিয়া ফেলিলেও আমার পক্ষে দুই-ই সমান” ইত্যাদি আপন অবস্থার বর্ণনা প্ৰথমে করিয়া [মভা|শাং|৩২০|৩৬] পরে সুলভাকে বলিতেছেন –
“মোক্ষে হি ত্ৰিবিধা নিষ্ঠা দৃষ্টাহন্যৈর্মোক্ষবিত্তমৈঃ ৷
জ্ঞানং লোকোত্তরঙ যচ্চ সর্বত্যাগশ্চ কর্মণাম্‌ ॥
জ্ঞাননিষ্ঠাং বদন্ত্যেকে মোক্ষশাস্ত্ৰবিদো জনাঃ ৷
কর্মনিষ্ঠাং তথৈবান্যে যতয়ঃ সূক্ষ্মদৰ্শিনঃ ॥
প্ৰহায়োভয়মপ্যেবং জ্ঞানং কর্ম চ কেবলম্‌ ॥
তৃতীয়েয়ং সমাখ্যাত নিষ্ঠা তেন মহাত্মনা ॥”
অর্থাৎ মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য তিন প্ৰকার নিষ্ঠা মোক্ষশাস্ত্রবেত্তারা বলিয়া থাকেন - (১) “জ্ঞান” লাভ করিয়া সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা; ইহাকেই কোন কোন মোক্ষশাস্ত্রজ্ঞ জ্ঞাননিষ্ঠা বলেন; (২) সেইরূপ আবার, অন্য সূক্ষ্মদৰ্শী লোকে কর্মনিষ্ঠা বলেন; কিন্তু কেবল জ্ঞান ও কেবল কর্ম এই দুই নিষ্ঠা ছাড়িয়া দিয়া, (৩) এই তৃতীয় (অর্থাৎ জ্ঞানের দ্বারা আসক্তির ক্ষয় করিয়া কর্ম করিবার) নিষ্ঠা (আমাকে) সেই মহাত্মা (পঞ্চশিখ) বলিয়াছেন” [মভা|শাং|৩২০|৩৮-৪০] । নিষ্ঠা শব্দের সাধারণ অর্থ অন্তিম স্থিতি, আধার কিংবা অবস্থা । কিন্তু এই স্থানে এবং গীতাতেও নিষ্ঠা শব্দের “যে প্রকার জীবন যাপন করিলে শেষে মোক্ষলাভ হয় সেইরূপ জীবনযাত্রার মাৰ্গ” এইরূপ অর্থ বিবক্ষিত । গীতার শাঙ্করভাষ্যেও নিষ্ঠা = অনুষ্ঠেয়তাৎপৰ্য - অর্থাৎ জীবনে যাহা কিছু অনুষ্ঠেয় অর্থাৎ আচরণীয় তাহার প্রতি তৎপরতা অর্থাৎ তাহাতে মগ্ন থাকা, এই অর্থই করা হইয়াছে । জীবনের এই মাৰ্গ মধ্যে জৈমিনি প্ৰভৃতি মীমাংসকেরা জ্ঞানের গুরুত্ব না দিয়া কেবল যাগযজ্ঞাদি কর্ম করিলেই মোক্ষলাভ হয় বলিয়াছেন –
ঈজানা বহুভিঃ যজ্ঞৈঃ ব্ৰাহ্মণা বেদপারগাঃ ৷
শাস্ত্ৰাণি চেৎ প্ৰমাণং স্যুঃ প্ৰাপ্তাস্তে পরমাং গতিম ॥
কারণ, ঐরূপ না মানিলে শাস্ত্রের অর্থাৎ বেদের আজ্ঞা ব্যর্থ হইবে, [জৈসূ|৫|২|২৩ শঙ্করভাষ্য দেখ] । এবং উপনিষৎকার ও বাদরায়ণাচাৰ্য সমস্ত যাগযজ্ঞাদি গৌণ স্থির করিয়া কেবল জ্ঞানের দ্বারা মোক্ষলাভ হয়, জ্ঞানব্যতীত আর কিছুরই দ্বারা ব্ৰহ্মলাভ হইতে পারে না, এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন [বেসূ|৩|৪|১,২] । কিন্তু এই দুই নিষ্ঠাকে ছাড়িয়া দিয়া আসক্তিবিরহিত কর্ম করিবার এক তৃতীয় নিষ্ঠাই পঞ্চশিখ (নিজে সাংখ্যমাৰ্গী হইলেও) আমাকে বলিয়ছেন, এইরূপ জনক বলেন । “দুই নিষ্ঠা ছাড়িয়া দিয়া” এই শব্দগুলি হইতে স্পষ্ট প্রকাশ পায় যে, এই তৃতীয় নিষ্ঠাটি পূর্বের দুই নিষ্ঠার মধ্যে কোন নিষ্ঠারই অঙ্গীভূত নহে, - প্ৰত্যুত স্বতন্ত্রভাবে বর্ণিত হইয়াছে । বেদান্তসূত্রেও [বেসূ|৩|৪|৩২-৩৫] জনকের এই তৃতীয় নিষ্ঠার উল্লেখ করা হইয়াছে; ভগবদ্‌গীতায় জনকের এই তৃতীয় নিষ্ঠাই — তাহার ভিতর ভক্তি নূতন যোগ করিয়া - বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু মীমাংসকদিগের নিছক কর্মমার্গ অর্থাৎ জ্ঞানবিরহিত কর্মমার্গ মোক্ষপ্ৰদ নহে, শুধু স্বৰ্গপ্ৰদ - এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত [গী|২|৪২-৪৪; ৯|২৭]; তাই যে মার্গ মোক্ষপ্ৰদ নহে তাহার ‘নিষ্ঠা’ নামই দেওয়া যায় না । কারণ, যাহার দ্বারা শেষে মোক্ষলাভ হয় সেই মাৰ্গকেই নিষ্ঠা বলা উচিত - এই ব্যাখ্যা সকলেরই স্বীকৃত । অতএব সকলের মতের সাধারণ বৰ্ণনা করিবার সময় জনক তিন নিষ্ঠার কথা বলিলেও মীমাংসকদিগের নিছক্‌ অর্থাৎ জ্ঞানবিরহিত কর্মমার্গ ‘নিষ্ঠা’ হইতে বাহির করিয়া দিয়া সিদ্ধান্তপক্ষে স্থির নির্ধারিত দুই নিষ্ঠাই গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের আরম্ভে বর্ণিত হইয়াছে [গী|৩|৩] । নিছক্‌ জ্ঞান (সাংখ্য) ও জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্ম (যোগ) এই দুই-ই নিষ্ঠা; এবং সিদ্ধান্তপক্ষীয় এই দুই নিষ্ঠার মধ্যে দ্বিতীয় (অর্থাৎ জনকের কথা অনুসারে তৃতীয়) নিষ্ঠার সমর্থনাৰ্থ “কর্মণৈব হি সংসিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ” [গী|৩|২৫] জনকাদি এইরূপ কর্ম করিয়াই সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন - এই পুরাতন দৃষ্টান্ত প্রদত্ত হইয়াছে । 

জনকাদি ক্ষত্রিয় রাজার কথা ছাড়িয়া দিলেও ব্যাস বিচিত্ৰবীৰ্যের বংশ বজায় রাখিবার জন্য ধৃতরাষ্ট্রপাণ্ডু দুই ক্ষেত্ৰজ পুত্র উৎপন্ন করিলেন এবং তিন বৎসর সতত পরিশ্রম করিয়া জগতের উদ্ধারার্থ মহাভারতও লিখিলেন; এবং কলিযুগে স্মার্ত অর্থাৎ সন্ন্যাসমার্গের প্রবর্তক শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্যও স্বকীয় অলৌকিক জ্ঞানের দ্বারা ও উদ্যোগে ধর্মসংস্থাপন করিলেন - ইহা সৰ্বশ্ৰুত কথা । অধিক কি, স্বয়ং ব্ৰহ্মদেব যখন কর্ম করিতে প্ৰবৃত্ত হন তখনই সৃষ্টির আরম্ভ হয়; ব্ৰহ্মদেব হইতেই মরীচি, আদি সাত মানসপুত্র উৎপন্ন হইয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ না করিয়া সৃষ্টিক্ৰম বজায় রাখিবার জন্য আমরণ প্ৰবৃত্তিমাৰ্গই অঙ্গীকার করেন; এবং সনৎকুমারাদি অন্য সাত মানসপুত্র জন্ম হইতেই বিরক্ত অর্থাৎ নিবৃত্তিপন্থী - এইরূপ মহাভারতে নারায়ণীয় ধর্মনিরূপণে বর্ণিত হইয়াছে [মভা|শাং|৩৩৯ ও ৩৪০] । ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষেরা এবং ব্ৰহ্মদেবও কর্ম করিবারই এই প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ কেন স্বীকার করিলেন ? বেদান্তসূত্রে তাহার এই প্ৰকার উপপত্তি কথিত হইয়াছে - “বাবদধিকারমবস্থিতিরাধিকারিণাম” [বেসূ|৩|৩|৩২] - যাহার ঈশ্বরপ্রদত্ত যে অধিকার, তাহা পূর্ণ না হওয়া পৰ্যন্ত কর্ম হইতে মুক্তি লাভ হয় না । এই উপপত্তির বিচার পরে করা যাইবে । উপপত্তি যাহাই হউক না কেন, প্ৰবৃত্তি ও নিবৃত্তি এই দুই পন্থা জগতের আরম্ভ হইতে ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষদিগের মধ্যে প্ৰচলিত আছে - এ কথাও নিৰ্বিবাদ । ইহা হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পাইতেছে যে, ইহাদের মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ তাহার নির্ণয় কেবল আচার দেখিয়াই করা যাইতে পারে না ।


12) কর্মকে বন্ধক বলিলেই, ইহা সিদ্ধ হয় না যে, তাহা ত্যাগ করিতে হইবে; ফলাশা ছাড়িয়া দিলে নির্বাহ হইয়া যায়



পূর্বাচার এইরূপ দ্বিবিধ হওয়ায় কেবল আচার দেখিয়াই নিবৃত্তি শ্ৰেষ্ঠ কিংবা প্ৰবৃত্তি শ্রেষ্ঠ ইহার নিষ্পত্তি করিতে না পারিলেও, সন্ন্যাসমার্গী লোকদিগের আর একটী যুক্তিক্ৰম এই যে, কর্মবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ ব্যতীত মোক্ষ হয় না ইহা যদি নির্বিবাদ হয়, তবে জ্ঞানলাভ হইলে পর তৃষ্ণামূলক কর্মের ঝঞ্চাট যত শীঘ্ৰ হয় দূর করিয়া দেওয়াই শ্রেয়ষ্কর । মহাভারতের শুকানুশাসনে - ইহাকেই ‘শুকানুপ্রশ্ন’ও বলে - সন্ন্যাসমার্গেরই প্ৰতিপাদন আছে । সেই স্থানে শুক ব্যাসকে প্রশ্ন করিতেছেন -
যদিদং বেদবচনং কুরু কর্ম ত্যজেতি চ ৷
কাং দিশং বিদ্যয়া যান্তি কাং চ গচ্ছন্তি কর্মণা ॥
“বেদ কর্মত্যাগ করিতেও বলেন আবার কর্ম করিতেও বলেন; এরূপ স্থলে, বিদ্যার দ্বারা অর্থাৎ কর্মারহিত জ্ঞানের দ্বারা এবং নিছক্‌ কর্মের দ্বারা কোন্‌ গতি লাভ হয়, তাহা আমাকে বল” [শাং|২৪০|১] তাহার উত্তরে ব্যাস বলিলেন -
কর্মণা বধ্যতে জন্তুর্বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে ৷
তস্মাৎ কর্ম ন কুৰ্বন্তি যতয়ঃ পারদর্শিনঃ ॥
“কর্মের দ্বারা জীব বদ্ধ হয় ও বিদ্যার দ্বারা মুক্ত হয়; তাই পারদর্শী যতি কিংবা সন্ন্যাসী কর্ম করে না” [শাং|২৪০|৭] । এই শ্লোকের প্রথম চরণের বিচার পূৰ্বপ্রকরণে আমি করিয়াছি । “কর্মণা বধ্যতে জন্তুর্বিদ্যয়া তু প্ৰমুচ্যতে” এই সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে কোন বিবাদ নাই । কিন্তু মনে থাকে যেন, সেখানে ইহাই দেখানো হইয়াছে যে, “কর্মণা বধ্যতে|” এই কথার বিচারে সিদ্ধ হয় যে, কর্মের দ্বারা জড় কিংবা চেতন, কেহ বদ্ধও হয় না, মুক্তও হয় না; মনুষ্য ফলাশায় কিংবা নিজের আসক্তিনিবন্ধন কর্মে বদ্ধ হয়; এই আসক্তির মোচন হইলে কেবল বাহ্যেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা কর্ম করিলেও সে মুক্ত । এই অর্থই মনে করিয়া অধ্যাত্মরামায়ণে [২|৪|৪২] রামচন্দ্ৰ লক্ষণকে বলিতেছেন যে -
প্ৰবাহপতিতঃ কাৰ্য্যং কুৰ্বন্নপি ন লিপ্যতে ৷
বাহ্যে সর্বত্র কর্তৃত্বমাবহন্নপি রাঘব ॥
“কর্মময় সংসারের প্রবাহে পতিত মনুষ্য বাহ্যতঃ সমস্ত কর্তব্য কর্ম করিয়াও অলিপ্ত থাকে” । অধ্যাত্মশাস্ত্রের এই সিদ্ধান্তের প্রতি লক্ষ্য করিলে দেখা যায় যে, কর্ম দুঃখময় বলিয়া ছাড়িবার আবশ্যকতা নাই; মনকে শুদ্ধ ও সম করিয়া ফলাশা ছাড়িলেই সমস্ত কাজ হয় । তাৎপৰ্য এই যে, জ্ঞান ও কাম্য কর্মের মধ্যে বিরোধ হইলেও নিষ্কাম কর্ম ও জ্ঞান ইহাদের মধ্যে কোনও বিরোধ হইতে পারে না । তাই অনুগীতায় “তস্মাৎ কর্ম ন কুৰ্বন্তি” – অতএব কর্ম করে না – এই বাক্যের বদলে -
তস্মাৎ কর্মসু নিঃস্নেহা যে কেচিৎ পারদর্শিনঃ ॥
“অতএব পারদর্শী পুরুষ কর্মেতে আসক্তি রাখে না” [অশ্ব|৫১|৩৩] এইরূপ বাক্য আসিয়াছে । তৎপুর্বে -
কুৰ্বতে যে তু কর্মাণি শ্ৰদ্দধানা বিপশ্চিতঃ ৷
অনাশীৰ্যোগসংযুক্তাস্তে ধীরাঃ সাধুদৰ্শিনঃ ॥
“যে সকল জ্ঞানী পুরুষ শ্ৰদ্ধাপূর্বক ফলাশা না রাখিয়া (কর্ম-) যোগমার্গ অবলম্বন করিয়া কর্ম করে তাহারাই সাধুৰ্দশী” [অশ্ব|৫০|৬, ৭] - এইরূপ কর্মযোগ স্পষ্ট প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । সেইরূপ -
যদিদং বেদবচনং কুরু কর্ম ত্যজোতি চ ৷
এই পূর্বার্ধে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে বনপর্বে যুধিষ্ঠিরের প্রতি শৌনকের এই উপদেশ -
তস্মাদ্ধর্মানিমান্‌ সর্বান্নাভিমানাৎ সমাচারেৎ ॥
“কর্ম কর এবং কর্ম ছাড়ো বেদ, উভয়ই বলেন; তাই (কর্তৃত্বের) অভিমান না রাখিয়া আমাদিগের সমস্ত কর্ম করিতে হইবে” [বন|২|৭৩] । শুকানুপ্রশ্নেও ব্যাসদেব শুককে দুইবার স্পষ্ট বলিয়াছেন -
এষা পূর্বতরা বৃত্তির্ব্রাহ্মণস্য বিধীয়তে ৷
জ্ঞানবানেব কর্মাণি কুৰ্বন্‌ সর্বত্ৰ সিধ্যতি ॥
“জ্ঞানবান্‌ হইয়া সমস্ত কর্ম করিয়াই সিদ্ধিলাভ করা, ইহাই ব্ৰাহ্মণের পূর্বকালের (পুর্বতন) পুরাতন বৃত্তি” [মভা|শাং|২৩৭|১; ২৩৪|২৯] । “জ্ঞানবানের” এই পদের দ্বারা জ্ঞানোত্তর ও জ্ঞানযুক্ত কর্মই এইস্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে, ইহা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে । যাক; দুই পক্ষের এই বচনগুলি নিরাগ্রহ বুদ্ধিতে শান্তভাবে বিচার কারলে বুঝা যাইবে যে, “কর্মণা বধ্যতে জন্তুঃ” এই যুক্তিক্ৰমে “তস্মাৎ কর্ম ন কুৰ্বন্তি” - অতএব কর্ম করে না - কর্মত্যাগমূলক এই একই অনুমান নিষ্পন্ন বা হইয়া, “তস্মাৎ কর্মসু নিঃস্নেহা” - অতএব কর্মে আসক্তি রাখে না - এই নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিবার অন্য অনুমানও ততটাই যোগ্য এইরূপ সিদ্ধ হয় । কেবল আমিই এইরূপ দুই অনুমান করিতেছি এরূপ নহে, স্বয়ং ব্যাসও এই অর্থই শুকানুপ্রশ্নের নিম্নোক্ত শ্লোকে স্পষ্টরূপে দেখাইয়াছেন -
দ্বাবিমাবথ পন্থার্নৌ যস্মিন্‌ বেদাঃ প্রতিষ্ঠিতাঃ ৷
প্ৰবৃত্তিলক্ষণো ধৰ্ম্মঃ নিবৃত্তিশ্চ বিভাষিতঃ ॥*
“এই দুই মার্গের উপর বেদ (একই রূপ) প্রতিষ্ঠিত - একটি প্রবৃত্তিমূলক ধর্ম, অন্যটি নিবৃত্তিমূলক অর্থাৎ সন্ন্যাসগ্রহণের ধর্ম” [মভা|শাং|২৪০-৬]*(এই চরণের ‘নিবৃত্তিশ্চ সুভাষিতঃ’ ‘নিবৃত্তিশ্চ বিভাবিতঃ' এইরূপ পাঠান্তৱও আছে । যে কোন পাঠই গ্ৰহণ করা না কেন, প্রথমে ‘দ্বাবিমৌ’ এইরূপ উক্ত হইয়াছে; ইহা হইতে দুই পন্থা যে স্বতন্ত্র তাহা নির্বিবাদরূপে সিদ্ধ হইতেছে ।)

সেইরূপ আবার নারায়ণীয় ধর্মেতেও এই দুই পন্থাই পৃথক পৃথক ও স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টির আরম্ভ হইতে প্ৰচলিত থাকার বর্ণনা আছে ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । কিন্তু মনে রেখো, মহাভারতে প্ৰসঙ্গানুসারে এই দুই পন্থা বর্ণিত হওয়ায় প্ৰবৃত্তিমার্গেরই ন্যায় নিবৃত্তিমার্গের সমর্থক বচনাদিও মহাভারতেই পাওয়া যায় । গীতার সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকায় নিবৃত্তিমার্গের এই বচনকেই মুখ্য মনে করিয়া, তাহা ছাড়া যেন আর কোন পন্থাই নাই কিংবা যদি থাকে তো সে গৌণ অর্থাৎ সন্ন্যাসমার্গের অঙ্গ, এইরূপ প্ৰতিপাদনের চেষ্টা করা হইয়া থাকে । কিন্তু এই প্রতিপাদন সাম্প্রদায়িক আগ্ৰহমূলক; এবং সেইজন্য গীতাৰ্থ সরল ও স্পষ্ট হইলেও আজিকার কালে তাহা অনেকের দুৰ্বোধ হইয়া পড়িয়াছে । “লোকেহস্মিন্‌ দ্বিবিধা নিষ্ঠা” [গী|৩|৩] গীতার এই শ্লোকের জুড়ী “দ্বাবিমাবথ পন্থানৌ” এই শ্লোক; এই স্থানে দুই তুল্যবল মাৰ্গ বুঝাইবার হেতু আছে, এইরূপ স্পষ্ট দেখা যায় । কিন্তু এই সুস্পষ্ট অর্থের প্রতি কিংবা পূর্বাপর সন্দর্ভের প্ৰতি লক্ষ্য না করিয়া এই শ্লোকেই দুয়ের বদলে এক মাৰ্গই প্ৰতিপাদ্য এইরূপ কেহ কেহ দেখাইবার চেষ্টা করিয়া থাকেন !


13) কর্ম দূর হইতে পারে না



এই প্রকারে সুস্পষ্ট হইল যে, কর্মসন্ন্যাস (সাংখ্য) ও নিষ্কাম কর্ম (যোগ) বৈদিক ধর্মের দুই স্বতন্ত্র মাৰ্গ এবং সে বিষয়ে গীতার এই সিদ্ধান্ত যে, উহারা বিকল্পাত্মক নহে, কিন্তু “সন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগের যোগ্যতা বিশেষ রকমের” । “এক্ষণে কর্মযোগ সম্বন্ধে গীতা পরে বলেন যে, যে জগতে আমরা থাকি সেই জগৎ এবং তাহাতে ক্ষণকাল জীবিত থাকাও যদি কর্ম হয়, তবে কর্ম ছাড়িয়া কোথায় যাইব ? এবং এই জগতে অর্থাৎ কর্মভূমিতেই যদি থাকিতেই হয় তবে কর্ম হইতে মুক্ত হইবই বা কি প্রকারে ? যতদিন দেহ থাকে সে পৰ্যন্ত, ক্ষুধা তৃষ্ণা প্ৰভৃতি বিকার আমাদিগকে যেমন ছাড়ে না প্ৰত্যক্ষ দেখি, [গী|৫|৮,৯], এবং তন্নিবারণার্থ ভিক্ষা মাগিবার লজ্জাজনক কর্ম করাও যদি সন্ন্যাসধর্মানুসারে বৈধ হয় তবে অনাসক্তবুদ্ধিতে অন্য ব্যবহারিক শাস্ত্ৰোক্ত কর্ম করিতেই কি প্রকারে প্রত্যবায় হয় ? কর্ম করিলে কর্মপাশে বদ্ধ হইয়া ব্ৰহ্মানন্দ হারাইবে কিংবা ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ অদ্বৈত বুদ্ধি বিচলিত হইবে এই ভয়ে অন্য কর্ম যদি কেহ ছাড়িয়া দেয়, তবে তাহার মনোনিগ্ৰহ অদ্যাপি দৃঢ় হয় নাই বলিতে হয়; এবং মনোনিগ্ৰহ অদৃঢ় থাকিতে যে কর্মত্যাগ, তাহা গীতানুসারে মোহাত্মক অর্থাৎ তামস কিংবা মিথ্যাচার [গী|১৮|৭; ৩|৬] । এই অবস্থায় এই অর্থ স্বতই প্ৰকাশ পায় যে, এইরূপ অদৃঢ় মনোনিগ্ৰহকে চিত্তশুদ্ধির দ্বারা পূর্ণ করিতে হইলে, নিষ্কামবুদ্ধিপরিবর্ধক যজ্ঞদানাদি গৃহস্থাশ্রমের শ্রৌত কিংবা স্মার্ত কর্মই মনুষ্যের করিতে হইবে । ফলকথা, এইপ্ৰকার কর্মত্যাগ কখনই শ্রেয়স্কর হয় না । ভাল; যদি বলো, মন নির্বিষয় এবং তাহা উহার অধীন, তবে উহার কর্মের ভয়ই কেন, কিংবা কর্ম না করিবার ব্যর্থ আগ্রহই বা সে করে কেন ? বর্ষার জন্য যে ছত্র, তাহার পরীক্ষা যেরূপ বর্ষাকালেই হইয়া থাকে, সেইপ্ৰকার কিংবা-
বিকারহেতৌ সতি বিক্রিয়ন্তে
যেষাং ন চেতাংর্সি ত এবং ধীরাঃ ॥
“যে সকল কারণে বিকার উৎপন্ন হয় সেই সব কারণ কিংবা বিষয় চোখের সামনে থাকিলেও যাঁহাদিগের অন্তঃকরণ মোহের বিকারে পতিত হয় না, সেই সকল পুরুষকেই ধৈৰ্যশালী বলা যায়” [কুমার|১|৫৯] - কালিদাসের এই ব্যাপক নীতিসূত্ৰ অনুসারে মনোনিগ্ৰহকে কর্মের কষ্টিপাথরেই পরোখ করিয়া, তাহা পূর্ণ হইয়াছে কিনা তাহার সাক্ষ্য শুধু অন্যের নিকট নহে, আপনার নিকটেও পাওয়া যায় । এই দৃষ্টিতেও শাস্ত্ৰত প্ৰাপ্ত অর্থাৎ প্রবাহপতিত কর্ম করাই কর্তব্য এইরূপ সিদ্ধ হয় [গী|১৮|৬] । ভাল; যদি বল, “মন বশে থাকায় শাস্ত্ৰোক্ত কর্ম করিলে চিত্তশুদ্ধি বিগড়াইয়া যাইবার কোন ভয় নাই; কিন্তু মোক্ষলাভের পক্ষে অনাবশ্যক ব্যর্থ কর্ম করিয়া দেহকে কষ্ট দিতে চাহি না”, তবে কায়ক্লেশভয়ে অর্থাৎ কেবল দেহের কষ্ট হইবে এই ক্ষুদ্র ভয়ে কৃত এই কর্মত্যাগ রাজসিক; ত্যাগের ফল এইরূপ রাজস কর্মত্যাগে পাওয়া যায় না [গী|১৮|৮] । তবে কর্মত্যাগই করিব কেন ? সমস্ত কর্ম মায়াজগতের অতএব অনিত্য হওয়া প্ৰযুক্ত ব্ৰহ্ম-জগতের নিত্য আত্মার উহার মধ্যে পতিত হওয়া উচিত নহে, এ কথা যদি কেহ বলেন, তাহাও ঠিক নহে । কারণ পরব্রহ্ম যদি নিজেই মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত থাকেন তবে এইরূপ মায়ায় মধ্যে মনুষ্যেরও কাজ করিতে বাধা কি ? ব্ৰহ্মজগৎ ও মায়াজগৎ, সমস্ত জগতের যেরূপ এই দুই ভাগ আছে, সেইরূপ মনুষ্যেরও আত্মা ও দেহেন্দ্ৰিয়াদি এইরূপ দুই ভাগ আছে । তন্মধ্যে আত্মা ও ব্রহ্মের যোগ করিয়া দিয়া ব্ৰহ্মেতে আত্মার লয় কর এবং এই ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধিকে নিঃসঙ্গ রাখিয়া কেবল মায়িক দেহেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা মায়া-জগতের ব্যবহার কর । এইরূপ করিলে, মোক্ষের কোন প্রতিবন্ধক আসিবে না; এবং উক্ত দুই ভাগের যোগ আপোষে নিবদ্ধ হইলে জগতের কোন ভাগের উপেক্ষা বা বিচ্ছেদ করিবার দোষও লাগিবে না; এবং ব্ৰহ্মজগৎ ও মায়াজগৎ - পরলোক ও ইহলোক - এই দুই লোকেরই কর্তব্য করাতে তোমার শ্ৰেয় লাভ হইবে । ঈশোপনিষদে এই তত্ত্বই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে [ঈশ|১১] । এই শ্রুতিবচনের সবিস্তার বিচার পরে করা যাইবে । এক্ষণে এইটুকুই বলিতেছি যে, ব্ৰহ্মাত্ম্যৈক্যের অনুভবকারী জ্ঞানী পুরুষ মায়াজগতের ব্যবহার কেবল শরীরের দ্বারা অথবা কেবল ইন্দ্ৰিয়াদির দ্বারাই করিয়া থাকে, এইরূপ গীতাতে যাহা বর্ণিত হইয়াছে [গী|৪|২১; ৫|১২] তাহার তাৎপৰ্যও ইহাই; এই হেতু, ১৮ম অধ্যায়ে “নিঃসঙ্গবুদ্ধিতে ফলাশা ছাড়িয়া কেবল কর্তব্য বলিয়া কর্ম করাই প্ৰকৃত ‘সাত্বিক’ কর্মত্যাগ” - কর্ম না করা প্রকৃত কর্মত্যাগ নহে, এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে [গী|১৮|৯] । কর্ম মায়াজগতের হইলেও তাহা পরমেশ্বরই কোন অজ্ঞেয় কারণে উৎপন্ন করিয়াছেন; তাহা বন্ধ করা মনুষ্যের সাধ্যায়ত্ত নহে, তাহা পরমেশ্বরেরই অধীন; অতএব বুদ্ধিকে নিঃসঙ্গ রাখিয়া কেবল শারীর কর্ম করিলে মোক্ষের বাধা হয় না, ইহা নির্বিবাদ । তবে, চিত্তেতে বৈরাগ্য রাখিয়া কেবল ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা শাস্ত্ৰ প্ৰাপ্ত কর্ম করিতে বাধাই বা কি ? 


14) কর্ম ছাড়িয়া দিলে আহারও জুটিবে না



“ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ” [গী|৩|৫; ১৮|১১] - এই জগতে ক্ষণকালও কর্ম ছাড়া থাকিতে পারা যায় না, এইরূপ গীতায় উক্ত হইয়াছে; আবার অনুগীতায় “নৈষ্কর্মং ন চ লোকেহস্মিন, মুহুর্তমপি লভ্যতে” [অশ্ব|২০|৭] - এই লোকে (কেহই) এক মুহূর্তও কর্ম হইতে মুক্ত নহে - এইরূপ বলা হইয়াছে । শুধু মনুষ্য কেন, সূৰ্যচন্দ্ৰাদি পৰ্যন্ত সকলে নিরন্তর কর্মই করিতেছে ! অধিক কি, কর্মই জগৎ, আর জগৎই কর্ম ইহা স্থির সিদ্ধান্ত; তাই জগতের ভাঙ্গাগড়ার কিংবা কর্মের ক্ষণমাত্র বিরাম নাই, ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । দেখ, একদিকে ভগবান গীতাতে বলিতেছেন - “কর্ম ছাড়িলে খাওয়া পৰ্যন্ত হইবে না” [গী|৩|৮]; অপরদিকে বনপর্বে দ্রৌপদী যুধিষ্টিরকে বলিতেছেন - “অকর্মণা বৈ ভূতানাং বৃত্তিঃ স্যান্ন হি কাচন” [বন|৩২|৮], কর্ম ব্যতীত প্রাণীমাত্রের জীবনযাত্রা নিৰ্বাহ হয় না; সেইরূপ দাসবোধেও প্ৰথমে ব্ৰহ্মজ্ঞান বলিয়া তাহার পর “প্রপঞ্চ সাঁতুন পরমার্থ কেলা । তরী অন্ন মিলে না খায়ালা ।” অর্থাৎ - “প্রপঞ্চ ছাড়িয়া পরমার্থ করিল, তবু খাইতে অন্ন মিলিল না” [দা|১২|১|৩] । এইরূপ শ্ৰীসমর্থ রামদাস স্বামীও বলিয়াছেন । ভাল; স্বয়ং ভগবানের চরিত্র আলোচনা কর; দেখিবে যে, ভগবান যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন অবতার হইয়া, এই মায়িক জগতে সাধুর পরিত্রাণ ও দুষ্টের বিনাশসাধন রূপ কর্ম করিয়াই আসিতেছেন [গী|৪|৮ ও মভা|শাং|৩৩৯|১০৩ দেখ] । এই এই কর্ম যদি আমি না করি তবে জগৎ ধ্বংস হইয়া বিনাশ প্রাপ্ত হয়, ইহা তিনি গীতাতে বলিয়াছেন [গী|৩|২৪] । ইহা হইতে সিদ্ধ হইতেছে যে, যখন স্বয়ং ভগবান জগতের ধারণার্থ কর্ম করিতেছেন, তখন জ্ঞানোত্তর কর্ম নিরর্থক, এই কথার কোন ফল নাই । তাই, “যঃ ক্রিয়াবান্‌ স পণ্ডিতঃ” [মভা|বন|৩১২|১০৮] - যে ক্রিয়াবান্‌ সে-ই পণ্ডিত - “এই নীতিসূত্র অনুসারে অর্জুনকে উপলক্ষ্য করিয়া ভগবান সকলকেই এই উপদেশ করিতেছেন যে, এই জগতে কর্ম হইতে কেহই মুক্ত হইতে পারে না; কর্মের বাধা হইতে বাঁচিবার জন্য মনুষ্যের সর্বদা নিজ ধর্মানুসারে প্রাপ্ত কর্তব্য, ফলাশা ছাড়িয়া, বিরক্ত বুদ্ধিতে করা - এই একমার্গ (যোগ) মনুষ্যের আয়ত্তাধীন এবং ইহাই উত্তমও বটে । প্ৰকৃতি তো নিজের কাজ সর্বদা করিতেই থাকিবে; কিন্তু উহাতে কর্তৃত্বের অভিমান-বুদ্ধি ছাড়িয়া দিলেই তুমি মুক্তই [গী|৩|২৭; ১৩|২৯; ১৪|১৯; ১৮|১৬] । মুক্তির জন্য কর্মত্যাগ কিংবা সাংখ্যের অনুসারে কর্মসন্ন্যাসরূপ বৈরাগ্যের আবশ্যকতা নাই; কারণ এই কর্মভূমিতে সম্পূর্ণ কর্মত্যাগ করা সম্ভবই নহে ।


15) জ্ঞান হইলে নিজের কর্তব্য যদি না থাকে, অথবা বাসনার যদি ক্ষয় হইয়া যায়, তবু কর্ম দূর হয় না



এই সম্বন্ধেও কেহ এইরূপ ফ্যাকড়া বাহির করেন যে, মানিলাম যে, কর্মবন্ধন ছেদন করিবার জন্য কর্ম ছাড়িবার আবশ্যকতা নাই, কেবল কর্মফলাশা ত্যাগ করিলেই সমস্ত নিৰ্বাহ হয়; কিন্তু যখন জ্ঞানের দ্বারা আমার বুদ্ধি নিষ্কাম হয় তখন সমস্ত বাসনা ক্ষয় হয় এবং কর্মে প্ৰবৃত্তি হইবার কোন কারণই অবশিষ্ট থাকে না; এবং এইরূপ অবস্থায় অর্থাৎ কায়ক্লেশভয়ে নহে - বাসনাক্ষয় প্ৰযুক্ত সমস্ত কর্ম আপনা হইতেই ছাড়িয়া যায় । এই জগতে মোক্ষই মনুষ্যের পরম পুরুষাৰ্থ । যে সেই মোক্ষ জ্ঞানের দ্বারা লাভ করে তাহার প্রজা, সম্পত্তি কিংবা স্বৰ্গলোকাদির সুখ - এই সমস্তের কোনও “এষণা” (ইচ্ছা) থাকে না [বৃ|৩|৫|১ ও ৪|৪|২২] বলিয়া কর্ম না ছাড়িলেও শেষে সেই জ্ঞানের স্বাভাবিক পরিণাম ইহাই হয় যে, কর্ম আপনিই ছুটিয়া যায় । এই অভিপ্রায়ে -
জ্ঞানামৃতেন তৃপ্তস্য কৃতকৃত্যস্য যোগিনঃ ৷
ন চাস্তি কিঞ্চিৎ কর্তব্যমস্তি চেন্ন স তত্ত্ববিৎ ॥
“জ্ঞানামৃত পান করিয়া যে কৃতকৃত্য হইয়াছে সেই পুরুষের পরে কোন কর্তব্যই অবশিষ্ট থাকে না; এবং যদি থাকে তো সে তত্ত্বজ্ঞানী নহে” এইরূপ উত্তরগীতায় [১|২৩] উক্ত হইয়াছে । [ইহা শ্রুতির শ্লোক – এই ধারণা ঠিক্‌ নহে । বেদান্তসূত্রের শাঙ্কর ভাষ্যে এই শ্লোকটি নাই । কিন্তু সনৎসুজাতীয়ের ভাষ্যে আচার্য তাহা গ্রহণ করিয়া সেখানে তিনি লিঙ্গপুরাণে ইহা আছে বলিয়াছেন । সুতরাং শ্লোকটি সন্ন্যাস মার্গের, কর্মযোগের নহে নিঃসন্দেহ । বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থেও এইরূপ বচনাদি আছে (পরিশিষ্ট প্রকরণ দেখ) ।] ইহা জ্ঞানী পুরুষের দোষ বলিয়া যদি কাহারও সন্দেহ হয়, তাহা ঠিক নহে; কারণ ইহাই ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষের এক অলঙ্কার - “অলঙ্কারো হ্যয়মস্মাকং যদ্‌ব্রহ্মাত্মাবগতৌ সত্যাং সর্বকর্তব্যতাহানিঃ” [বেসূ|শাং|ভা|১|১|৪] - এইরূপ শঙ্করাচাৰ্য বলিয়াছেন । সেইরূপ গীতাতেও “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” [গী|৩|১৭] জ্ঞানীর পরে আর কিছুই করিবার থাকে না; তাঁহার সমস্ত বৈদিক কর্মের কোনই প্রয়োজন নাই [গী|২|৪৬]; অথবা “যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে” [গী|৬|৩] । যে যোগারূঢ় তাহার শমই কারণ এইরূপ বচন আছে । তাছাড়া “সর্বারম্ভপরিত্যাগী” [গী|১২|১৬] অর্থাৎ সমস্ত উদ্যোগ যে ত্যাগ করে, এবং “অনিকেতঃ” [গী|১২|১৯] অর্থাৎ যাহার গৃহ নাই ইত্যাদি বিশেষণ ও জ্ঞানীপুরুষের বর্ণনায় গীতাতে সংযোজিত হইয়াছে । ইহা হইতে - জ্ঞানলাভের পর কর্মবন্ধন আপনা আপনিই মোচন হয় – এই কথা ভগবদ্‌গীতার মান্য এইরূপ কাহারও কাহারও মত । কিন্তু আমার মতে, গীতা-বাক্যগুলির এই অর্থ এবং উপরি-উক্ত যুক্তিবাদও ঠিক্‌ নহে । তাই তদ্বিরুদ্ধে আমার যাহা বক্তব্য তাহা এইখানে সংক্ষেপে বলিতেছি ।


16) অতএব জ্ঞানপ্রাপ্তির পরেও নিঃস্বার্থবুদ্ধিতে কর্ম অবশ্য করা চাই



মনুষ্য জ্ঞানী হইলে তাহার সকল প্রকার ইচ্ছা কিংবা বাসনা বিলুপ্ত হওয়া উচিত, এই কথা গীতার আদৌ মান্য নহে, ইহা সুখদুঃখবিবেকপ্রকরণে আমি দেখাইয়াছি । শুধু বাসনা বা ইচ্ছা থাকাতে কোন দুঃখ নাই, আসক্তিই দুঃখের প্ৰকৃত মূল । তাই, সর্বপ্রকার বাসনা বিনষ্ট না করিয়া জ্ঞানী কেবল আসক্তি ‘ছাড়িয়া সমস্ত কর্ম করিবে, ইহাই গীতার সিদ্ধান্ত । আসক্তি চলিয়া যাইবার সঙ্গেই সমস্ত কর্মও যে ছাড়িয়া যাইবে তাহা নহে । অধিক কি, বাসনা হইতে মুক্ত হইলেও সমস্ত কর্ম হইতে মুক্ত হওয়া যায় না । বাসনা থাক বা না থাক, শ্বাসোচ্ছাসাদি কর্ম নিত্য সমান চলিতে থাকে, এইরূপ আমরা দেখিতে পাই । বেশী দূরে যাইতে হইবে কেন ? ক্ষণমাত্র জীবিত থাকাও তো কর্মই; পূর্ণজ্ঞান হইলেও আপনার বাসনা দ্বারা কিংবা বাসনাক্ষয়ের দ্বারা উহা হইতে মুক্ত হওয়া যায় না । বাসনা হইতে মুক্ত বলিয়া কোনও জ্ঞানী পুরুষ প্রাণ বিসর্জন করে না, এ কথা প্ৰত্যক্ষসিদ্ধ; এবং সেইজন্যই “নহি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্মকৃৎ” [গী|৩|৫] যে-ই হউক না কেন, সে কর্ম না করিয়া থাকিতে পারে না - এই বচন গীতায় দেখিতে পাওয়া যায় । এই কর্মভূমিতে কর্ম তো নিসর্গতঃ প্ৰাপ্ত, প্ৰবাহপতিত ও অপরিহার্য, তাহা মনুষ্যের বাসনার উপর ঝুলিয়া নাই, ইহা গীতাশাস্ত্রের কর্মযোগের প্রথম সিদ্ধান্ত । কর্ম ও বাসনার পরস্পর নিত্যসম্বন্ধ নাই এইরূপে ইহা সিদ্ধ হইলে পর বাসনাক্ষয়ের সঙ্গেই কর্মেরও ক্ষয় স্বীকার করা ভিত্তিহীন হইয়া পড়ে । তাহার পর, বাসনাক্ষয়ের পরেও প্ৰাপ্ত কর্ম জ্ঞানীপুরুষের কি প্রকারে করিতে হইবে এই প্রশ্ন সহজেই উত্থিত হয় । এই প্রশ্নের উত্তর গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে প্রদত্ত হইয়াছে [গী|৩|১৭-১৯ ও তাহার উপর আমার টীকা দেখ] । জ্ঞানীপুরুষের জ্ঞানোত্তর নিজের বলিয়া কোন কর্তব্য থাকে না, এ কথা গীতার মান্য । ইহার পর গীতা ইহাও বলিতেছেন যে, যে কেহই হউক না কেন, কর্মবন্ধন হইতে কেহই মুক্ত হয় না । জ্ঞানীপুরুষের কর্তব্য থাকে না এবং কর্ম মোচন হয় না, এই দুই সিদ্ধান্ত কেহ কেহ পরস্পরবিরোধী বলিয়া মনে করেন; কিন্তু গীতার কথা সেরূপ নহে । গীতা উহাদের এই মিল করিয়া বলেন যে, যখন কর্ম অপরিহাৰ্য, তখন জ্ঞানী পুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও তাহা করিতেই হইবে । কিন্তু তাহার নিজের জন্য কোন কর্তব্য থাকে না, অতএব তাহার আপনার সমস্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করাই কর্তব্য । সার কথা, তৃতীয় অধ্যায়ের ১৭ম শ্লোকের “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই বাক্যে, ‘কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ এই শব্দগুলি অপেক্ষা ‘তস্য’ (অর্থাৎ সেই জ্ঞানী পুরুষের) এই শব্দ অধিক গুরুত্বসূচক; এবং তাহার ভাবাৰ্থ এই যে, ‘তাহার নিজের’ জন্য প্ৰাপ্ত কোন কর্ম থাকে না, এই কারণেই, এক্ষণে অর্থাৎ জ্ঞানোত্তর, তাহার আপন কর্তব্য তাহাকে নিরপেক্ষ বুদ্ধিতে করিতে হইবে । পরে ১৯ম শ্লোকে ‘তস্মাৎ’: এই কারণবোধক পদ প্রয়োগ করিয়া অর্জুনকে এই অর্থের উপদেশ করিয়াছেন, “তস্মাদসক্ত: সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর” [গী|৩|১৯] - তাই শাস্ত্ৰতঃ প্ৰাপ্ত নিজ কর্তব্য তুমি আসক্তি না রাখিয়া করিয়া যাও, কর্ম ছাড়িও না । তৃতীয় অধ্যায়ের ১৭-১৯ এই তিন শ্লোকে পরিব্যক্ত কার্যকারণভাব এবং অধ্যায়ান্তর্ভূত সমস্ত প্রকরণের সন্দর্ভের প্রতি লক্ষ্য করিলে, সন্ন্যাসমার্গীর কথা অনুসারে “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত মানা যুক্তিসিদ্ধ নহে এইরূপ উপলব্ধি হইবে । নিম্ন-প্রদত্ত দৃষ্টান্তই তাহার উত্তম প্ৰমাণ ।


17) ভগবানের এবং জনকের উদাহরণ



 ‘জ্ঞানলাভের পর কোন কর্তব্য অবশিষ্ট না থাকিলেও, শাস্ত্ৰতঃ প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম করিতে হয়’, এই সিদ্ধান্তের পুষ্টিসাধনাৰ্থ ভগবান্‌ বলিতেছেন -
ন মে পার্থাহস্তি কর্তব্যং ত্ৰিষু লোকেষু কিঞ্চন ৷
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত এব চ কর্মণি ॥
“হে পাৰ্থ ! ‘আমার’ বলিয়া ত্ৰিভুবনে কোন কর্তব্য (অবশিষ্ট) নাই, অথবা অপ্ৰাপ্ত কোন বস্তু পাইবার (বাসনা) নাই; তথাপি আমি কর্ম করিতেছি” [গী|৩|২২]‘ন মে কর্তব্যমস্তি’ - আমার কর্তব্য নাই - এই শব্দ পূৰ্বোক্ত শ্লোকের ‘তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ - তাহার কোন কর্তব্য থাকে না - এই শব্দগুলির প্রতি লক্ষ্য করিয়া বলা হইয়াছে । ইহা হইতে “জ্ঞানের দ্বারা কর্তব্য অবশিষ্ট থাকিলেও, অধিক কি, এই কারণে, শাস্ত্ৰতঃ প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম অনাসক্ত বুদ্ধিতে করিতেই হইবে” এই অর্থ এই চার পাঁচ শ্লোকের প্রতিপাদ্য এইরূপ স্পষ্ট সিদ্ধ হয় । নতুবা, ‘তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ ইত্যাদি শ্লোকে উক্ত সিদ্ধান্তের দৃঢ়ীকরণার্থ ভগবান্‌ নিজের যে দৃষ্টান্ত দিয়াছেন তাহা একেবারেই অসংবদ্ধ হইবে, এবং সিদ্ধান্ত এক আর তাহার উদাহরণ একেবারেই বিরুদ্ধ – এইরূপ অনবস্থা দোষ ঘটিবে । এই অনবস্থা পরিহারার্থ সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকাকার, ‘তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর’ ইহার মধ্যে ‘তস্মাৎ’ এই শব্দেরও অর্থ ভিন্ন প্রকার করিয়া থাকেন । তাঁহার কথন এই যে, জ্ঞানীপুরুষ কর্মত্যাগ করিবেন ইহাই গীতার মুখ্য সিদ্ধান্ত; কিন্তু অর্জুন সেরূপ জ্ঞানী ছিলেন না বলিয়া – ‘তস্মাৎ’ - তাঁহাকে ভগবান কর্ম করিতে বলিয়াছেন । ‘গীতা-উপদেশের পরেও অর্জুন অজ্ঞানীই ছিলেন’ এই যুক্তি ঠিক্‌ নহে আমি উপরে দেখাইয়াছি । তাছাড়া ‘তস্মাৎ’ এই শব্দের এইরূপ টানিয়া বুনিয়া অর্থ করিলেও “ন মে পার্থাস্তি কর্তব্যং” ইত্যাদি শ্লোকে ভগবান্‌ “আমার কোন কর্তব্য না থাকিলেও আমি কর্ম করিয়া থাকি” এই মুখ্য সিদ্ধান্তের সমর্থনার্থ আপনার যে দৃষ্টান্ত দিয়াছেন তাহার সঙ্গতিও এই পক্ষে সুচারুরূপে হয় না । তাই “তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই বাক্যে “কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে” এই শব্দগুলিকে মুখ্য বলিয়া না মানিয়া, ‘তস্য’ শব্দকেই প্ৰধান বলিয়া মানিতে হইবে; এবং তাহা করিলে “তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর” ইহার অর্থ “তুমি জ্ঞানী বলিয়াই তোমার স্বার্থের জন্য তোমার কর্ম নাই এ কথা সত্য; কিন্তু তোমার নিজের কর্ম নাই বলিয়াই, এক্ষণে শাস্ত্ৰত প্ৰাপ্ত কর্ম ‘আমার নহে’ এই বুদ্ধিতে অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধিতে কর” এইরূপ করিতে হয় । সংক্ষেপে এই অনুমান হয় যে, ‘আমার অনাবশ্যক’ ইহা কর্ম ছাড়িবার কারণ হইতে পারে না । কিন্তু কর্ম অপরিহাৰ্য অতএব শাস্ত্ৰতঃপ্রাপ্ত অপরিহাৰ্য কর্ম স্বাৰ্থত্যাগবুদ্ধিতে করাই উচিত । ইহাই গীতা বলেন; এবং প্রকরণের সমতার দিকে দেখিলেও, এই অর্থই গ্ৰহণ করিতে হয় । কর্মসন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুয়ের মধ্যে যে বড় রকম ভেদ আছে তাহা ইহাই । “তোমার কোন কর্তব্য অবশিষ্ট নাই; অতএব তুমি কোন কর্ম করিও না,” এইরূপ সন্ন্যাস-পক্ষীয় লোকেরা বলেন; এবং “তোমার কোন কর্তব্য অবশিষ্ট নাই বলিয়াই, এখন তোমার যে কর্ম করিতে হইবে তাহা স্বার্থপর বাসনা ছাড়িয়া অনাসক্ত বুদ্ধিতে কর” এইরূপ গীতা বলেন । একই হেতু বাক্য হইতে এই প্ৰকার দুই ভিন্ন ভিন্ন অনুমান কেন বাহির হয় ? ইহার উত্তর এই যে, গীতা কর্ম অপরিহাৰ্য মানেন বলিয়া, “কর্ম ছাড়ো” এই অনুমান, গীতার তত্ত্ববিচারানুসারে বাহির হইতেই পারে না । তাই, “তোমার অনাবশ্যক” এই হেতু বাক্য হইতেই স্বাৰ্থ বুদ্ধি ছাড়িয়া কর্ম কর, গীতায় এই অনুমান বাহির করা হইয়াছে । রামচন্দ্রকে সমস্ত ব্ৰহ্মজ্ঞান বলিবার পর, নিষ্কাম কর্মে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্য যোগবাসিষ্ঠে বসিষ্ঠ যে যুক্তি বলিয়াছেন তাহাও এই প্রকার । যোগবাসিষ্ঠ গ্রন্থের শেষে ভগবদ্‌গীতার উক্ত সিদ্ধান্তই অক্ষরশঃ প্রদত্ত হইয়াছে [যো|৬|উ|১৯৯ ও ২১৬|১৪; এবং গী|৩|১৯-এর অনুবাদের উপর আমার টিপ্পনী দেখ] । যোগবাসিষ্ঠেরই ন্যায় বৌদ্ধধর্মের মহাযানপন্থার গ্রন্থেও এই বিষয়ে গীতার অনুসরণ করা হইয়া হইয়াছে । কিন্তু বিষয়ান্তর হইবে বলিয়া তাহার আলোচনা এখানে না করিয়া তৎসম্বন্ধীয় বিচার আমি পরে পরিশিষ্ট প্রকরণে করিয়াছি ।

আত্মজ্ঞান হইলে পর ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই অহঙ্কারের ভাষাই থাকে না [গী|১৮|১৬ ও ২৬], এবং সেই জন্য জ্ঞানীপুরুষকে “নির্‌-মম” বলে । নির্মম অর্থে ‘যে আমার-আমার বলে না’ । জ্ঞানেশ্বর মহারাজ জ্ঞানী পুরুষের বর্ণনা করিবার সময় এই অর্থই এই আবী-শ্লোকে ব্যক্ত করিয়াছেন -
আণি মী হে ভাষ নেঁণে ৷ মাঝেঁ কাঁহিঁচ ন হ্মণে ৷
সুখ দুঃখ জাণণেঁ । নাহি জয়া ॥
অর্থাৎ - ‘আমি’ এই বাক্য জানি না, ‘আমার’ বলিয়া কিছুই নাই - সুখ দুঃখ জ্ঞান নাই । কিন্তু ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা ‘আমি’ ও ‘আমার’ এই বুদ্ধি চলিয়া গেলেও এই শব্দের বদলে ‘জগৎ’ ও 'জগতের’ - কিংবা ভক্তিদৃষ্টিতে ‘পরমেশ্বর’ ও ‘পরমেশ্বরের’ - এই শব্দ আসে, ইহা বিস্মৃত হইবে না । জগতের প্রত্যেক সাধারণ মনুষ্য নিজের সমন্ত কর্ম ‘আমার’ কিংবা ‘আমার জন্য’ বলিয়া করিয়া থাকে । কিন্তু যিনি জ্ঞানী হইয়াছেন তাঁহার মমত্ববুদ্ধি চলিয়া যাওয়ায় তিনি ঈশ্বরসৃষ্ট জগতের সমস্ত কর্ম পরমেশ্বরের এবং তাহা করিবার জন্যই পরমেশ্বর আমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন, এইরূপ বুদ্ধিতে (অর্থাৎ নির্মম বুদ্ধিতে) সেই কর্ম করিতে থাকেন । জ্ঞানী ও অজ্ঞানীর মধ্যে ইহাই ভেদ [গী|৩|২৭, ২৮] । গীতার এই সিদ্ধান্তের প্রতি লক্ষ্য করিলে জানা যায় যে, “যোগারূঢ় পুরুষের জন্য শমই কারণ হয়” [গী|৬|৩ ও তাহার উপর আমার টীকা দেখ] এই শ্লোকের সরল অর্থ কি । গীতার টীকাকার বলেন যে, এই শ্লোকে যোগারূঢ় ব্যক্তি পরে (জ্ঞান হইলে পর) শম অৰ্থাৎ শান্তি অবলম্বন করিবে, সে আর কিছু করিবে না, এইরূপ উক্ত হইয়াছে । কিন্তু এই অর্থ ঠিক্‌ নহে । শম মনের শান্তি; তাহাকে চরম ‘কাৰ্য’ না বলিয়া শম কিংবা শান্তি অন্য কিছুর কারণ - শমঃ কারণমুচ্যতে - ইহাই এই শ্লোকে উক্ত হইয়াছে । এখন শমকে কারণ বলিয়া মানিয়া পরে তাহার ‘কাৰ্য’ কি, দেখিতে হইবে । পূর্বাপর সন্দর্ভের বিচার করিলে, ‘কর্ম’ই সেই কাৰ্য এইরূপ নিষ্পন্ন হয় । এবং তখন যোগারূঢ় ব্যক্তি চিত্তকে শান্ত করিয়া সেই শান্তির বা শমের দ্বারাই পরে নিজের সমস্ত কর্ম করিবেক এইরূপ এই শ্লোকের অর্থ হয়; টীকাকারদিগের কল্পনানুসারে ‘যোগারূঢ় ব্যক্তি কর্ম ত্যাগ করিবে’ এই অর্থ করা যাইতে পারে না । সেইরূপ আবার, “সর্বারম্ভপরিত্যাগী” ও “অনিকেত” প্রভৃতি শব্দের অর্থও কর্মত্যাগমূলক নহে, ফলাশা-ত্যাগমূলকই করা উচিত; গীতার অনুবাদে যে সকলস্থলে এই পদ আসিয়াছে, সেই স্থলে সংযোজিত টিপ্পনীতে আমি এই বিষয় খুলিয়া দেখাইয়াছি । ফলাশা ছাড়িয়া জ্ঞানী পুরুষেরও চাতুর্বর্ণ্যাদি সমস্ত কর্ম যথাশাস্ত্র করা উচিত, ইহা সিদ্ধ করিবার জন্য আপনার নিজের দৃষ্টান্ত ছাড়া ভগবান্‌ আর একটা দৃষ্টান্ত জনকের দিয়াছেন । জনক একজন বড় কর্মযোগী ছিলেন । তাঁহার স্বাৰ্থ বুদ্ধি কতটা চলিয়া গিয়াছিল ‘আমার রাজধানী দগ্ধ হইলেও তাহাতে আমার কিছুই দগ্ধ হয় নাই’ - ‘মিথিলায়াং প্রদীপ্তায়াং ন মে দহ্যতি কিঞ্চন’ [শাং|২৭৫|৪ ও ২১৯|৫০] তাঁহার মুখের এই বাণী হইতেই তাহার পরিচয় পাওয়া যায় । এইরূপ নিজের স্বাৰ্থ কিংবা লাভালাভ কিছুই না থাকিলেও রাজ্যের সমস্ত কর্ম করিবার কারণ বলিবার সময় জনক নিজেই বলিতেছেন - 
দেবেভ্যশ্চ পিতৃভ্যশ্চ ভূতেভ্যোহতিথিভিঃ সহ ৷
ইত্যৰ্থং সর্ব এবৈতে সমারম্ভা ভবন্তি বৈ ॥
“দেবতা, পিতৃগণ, সমস্ত ভূত অর্থাৎ প্ৰাণী ও অতিথি ইহাদের জন্য এই সমস্ত কর্ম চলিতেছে, আমার জন্য নহে” [মভা|অশ্ব|৩২|২৪] । নিজের কোন কর্তব্য অবশিষ্ট না থাকিলেও কিংবা নিজের কোন বস্তু লাভ করিবার বাসনা না থাকিলেও জনক ও শ্ৰীকৃষ্ণের ন্যায় পুরুষ জগতের কল্যাণ করিতে যদি প্ৰবৃত্ত না হয়েন, তাহা হইলে এই জগৎ উৎসন্ন হইবে - উৎসীদেয়ুরিমে লোকাঃ[গী|৩|২৪]


18) ফলাশাত্যাগ, বৈরাগ্য ও কর্মোৎসাহ



কেহ কেহ এইরূপ বলেন যে, ‘ফলাশা ত্যাগ করিবে, সর্বপ্রকার ইচ্ছা ত্যাগ করিবার আবশ্যকতা নাই,’ গীতার এই সিদ্ধান্ত এবং বাসনাক্ষয়ের সিদ্ধান্তে অধিক তফাৎ করা যায় না । কারণ, বাসনাই ছাড়া হউক কি ফলাশাই ছাড়া হউক, উভয়পক্ষে কর্মের প্রবৃত্তি হইবার কোনও কারণ দেখা যায় না; তাই কোন এক পক্ষকে স্বীকার করিলেও শেষে তাহার পরিণাম কর্মত্যাগই ঘটে । কিন্তু এই আপত্তি অজ্ঞানমূলক, কারণ ‘ফলাশা’ শব্দের প্রকৃত অর্থ না বুঝিবার কারণেই ইহা উৎপন্ন হইয়াছে । ফলাশা ত্যাগের সর্বপ্রকার ইচ্ছা ত্যাগ কিংবা আমার কর্মের ফল কেহ কখনই পাইবে না, কিংবা পাইলেও কেহ গ্ৰহণ করিবে না - এই বুদ্ধি হওয়া অর্থ নহে; প্রত্যুত পঞ্চম প্রকরণে প্ৰথমেই আমি বলিয়াছি যে, - অমুক ফল পাইবার জন্যই আমি এই কর্ম করিতেছি এই প্রকার ফলবিষয়ক মমত্বযুক্ত আসক্তি কিংবা বুদ্ধির আগ্রহকে, - গীতা নাম দিয়াছেন ‘ফলাশা’, ‘সঙ্গ’ কিংবা ‘কাম’ । কিন্তু, ফললাভের আগ্ৰহ কিংবা বৃথা আসক্তি না রাখিলেও, প্ৰাপ্ত কর্ম কেবল কর্তব্য বলিয়া করিবার বুদ্ধি ও উৎসাহকেও উক্ত আগ্রহের সহিত আমাদের মন হইতে বিদূরিত করতে হইবে এরূপ নহে । নিজের লাভ ছাড়া এই জগতে যে আর কিছুই দেখে না, এবং যে কেবল ফলাশার আগ্রহেই কর্মে ব্যাপৃত থাকে, সে ফলাশা ছাড়িয়া কর্ম করা সম্ভব বলিয়া মনে করে না; কিন্তু জ্ঞানের দ্বারা যাঁহার বুদ্ধি সম ও বিরক্ত হইয়াছে তাঁহার পক্ষে কিছু কঠিন নহে । আমি কোন কর্মের যে ফল প্রাপ্ত হই তাহা কেবল আমারই কর্মের ফল এই ধারণাই প্রথমতঃ ভ্রান্তিমূলক । জলের দ্রবত্ব কিংবা অগ্নির উষ্ণতার সাহায্য না পাইলে, মনুষ্য যতই মাথা ঘামাক না কেন, তাহার চেষ্টায় পাক-কাৰ্য কখনও সম্পন্ন হইতে পারে না; এবং অগ্নিপ্রভৃতিতে এই গুণধর্ম থাকা বা না থাকা – মনুষ্যের আয়ত্তাধীন কিংবা প্রযত্নাধীন নহে । তাই, কর্মজগতের এই স্বতঃসিদ্ধ বিবিধ ব্যাপারের কিংবা ধর্মের প্রথমে যথাশক্তি জ্ঞান লাভ করিয়া যাহাতে উহা আমাদের প্রযত্নের অনুকুল হয় সেই ভাবেই মনুষ্যকে নিজের কর্মে প্রবৃত্ত হইতে হয় । সুতরাং মনুষ্য স্বীয় প্রযত্বের দ্বারা যে ফল লাভ করে তাহা কেবল তাহারই প্রযত্নের ফল নহে, বরং উহার কর্ম ও কর্ম জগতের তদনুকূল অনেক স্বতঃসিদ্ধ ধর্ম এই দুয়ের সংযোগজাত ফল, এইরূপ বলিতে হয় । কিন্তু মনুষ্যের প্ৰযত্ন সফল হইবার পক্ষে এইরূপ যে সমস্ত জগৎব্যাপারের অনুকূলতা আবশ্যক হয়, সেই সমস্তের যথার্থ জ্ঞান অনেক সময় মনুষ্যের থাকে না; এবং কোন কোন স্থলে, হওয়া সম্ভবও নহে । ইহাকেই “দৈব’ বলে । আমাদের আয়ত্তের বহির্ভূত এবং আমাদের অজ্ঞাত জগৎ-ব্যাপারের সাহায্য ফলসিদ্ধির জন্য যদি নিতান্তই আবশ্যক হয় তবে “কেবল নিজের প্রযত্নের দ্বারাই আমি অমুক কর্ম করিব” এইরূপ অভিমান পোষণ করা যে মূর্খতামাত্র, তাহা বলিতেই হইবে না [গী|১৮|১৪-১৬ দেখ] । কারণ, কর্মজগতের জ্ঞাত ও অজ্ঞাত ব্যাপারের মানবীয় প্রযত্নে সংযোগ সাধিত হইলে পর যে ফল হয়, তাহা কেবল কর্মের নিয়মেই হয় বলিয়া, আমরা ফলাশার আগ্ৰহ রাখি বা না রাখি, ফলসিদ্ধিসম্বন্ধে কোন তফাৎ হয় না; আমাদের ফলাশা অবশ্য আমাদের দুঃখজনক হয় । কিন্তু মনে রেখো যে, মনুষ্যের জন্য আবশ্যক বিষয় একা জগৎ-ব্যাপার আপনা হইতেই ঘটাইয়া আনে না । রুটি রুচিকর হইতে হইলে যেরূপ আটার নেচীতে একটু নুন দিতে হয় সেইরূপ কর্মজগতের এই স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার মনুষ্যের উপযোগী করিতে হইলে তাহার উপর মনুষ্যের একটু প্রযত্নের চাপ দিতে হয় । তাই জ্ঞানী ও বিবেকী ব্যক্তি সাধারণ লোকের ন্যায় ফলের আসক্তি কিংবা আগ্ৰহ না রাখিয়া জগতের কর্মসাধনাৰ্থ প্ৰবাহ-পতিত কর্মের (অর্থাৎ কর্মের অনাদি প্রবাহের মধ্যে শাস্ত্ৰতঃপ্ৰাপ্ত যথাধিকার কর্মের) ছোট বড় অংশ শান্তভাবে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিয়া থাকেন । এবং ফলপ্ৰাপ্তির জন্য কর্মসংযোগের উপর কিংবা ভক্তিদৃষ্টিতে পরমেশ্বরের ইচ্ছার উপর নির্ভর করিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন । “তোমার কেবল কর্ম করিবারই অধিকার আছে ফললাভ তোমার আয়ত্তাধীন নহে” [গী|২|৪৭] ইত্যাদি যে উপদেশ অর্জুনকে দেওয়া হইয়াছে তাহার বীজও ইহাই । এইরূপে ফলাশা না রাখিয়া কর্ম করিতে থাকিলে, পরে কোন কারণে কদাচিৎ কর্ম নিষ্ফল হয়; তবু উদ্যোগ করিয়া আমাদের নিজের অধিকারের কর্ম করায়, নিষ্ফলতা হইতে দুঃখ পাইবার কোন কারণ থাকে না । উদাহরণ যথা, পরমায়ুর বন্ধনরজ্জু (অর্থাৎ শরীরপোষক ধাতুসমূহের নৈসৰ্গিক শক্তি) দৃঢ় না থাকিলে শুধু ঔষধে রোগীর কখনই উপকার হয় না, এইরূপ বৈদ্যশাস্ত্ৰ স্পষ্ট বলে; এবং এই বন্ধনরজ্জুর দৃঢ়তা অনেক প্রাক্তন কিংবা বংশানুক্রমিক সংস্কারের ফল । এই বিষয় বৈদ্যের দ্বারা সিদ্ধ হইবার নহে, এবং তৎসম্বন্ধে বৈদ্যের নিশ্চ‍য়াত্মক জ্ঞানও হইতে পারে না । তথাপি, রোগীকে ঔষধ দেওয়া নিজের কর্তব্য মনে করিয়া কেবল পরোপকার-বুদ্ধিতে হাজার হাজার রোগীকে বৈদ্য যথাজ্ঞান ঔষধ দিয়া থাকেন, এইরূপ আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । এইরূপ কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে করিলে পর, কোন রোগী ভাল না হইলে তাহার দরুণ সেই বৈদ্য উদ্বিগ্ন হন না শুধু নহে, কিন্তু অমুক রোগে অমুক ঔষধের দ্বারা শতকরা লোকের উপকার হইয়া থাকে এইরূপ শাস্ত্রীয় নিয়মই তিনি অতীব শান্তচিত্তে খুঁজিয়া বাহির করেন । কিন্তু এই বৈদ্যের পুত্ৰ পীড়িত হইলে তাহাকে ঔষধ দিবার সময় তিনি পরমায়ুর বন্ধনরজ্জুর বিষয় ভুলিয়া গিয়া “আমার ছেলেকে আরাম করিতেই হইবে” এই মমত্বযুক্ত ফলাশাবশতঃ উৎকন্ঠিতচিত্ত হওয়ায় ওন্য বৈদ্য ডাকিতে হয়; কিংবা অন্য বৈদ্যের পরামর্শ লওয়া আবশ্যক হয় ! কর্মফলে মমত্বরূপ আসক্তি কাহাকে বলে এবং ফলাশা না থাকিলেও কেবল কর্তব্য বুদ্ধিতে কোনও কর্ম কিরূপে করিতে পারা যায়, এই ক্ষুদ্র উদাহরণ হইতে তাহা উপলব্ধি হইবে । এইরূপ ফলাশা বিলোপের জন্য জ্ঞানের দ্বারা মনে বৈরাগ্য অটল হইতে হইলেও কোন কাপড়ের রং (রাগ) উঠাইয়া ফেলিতে বলিলে যেমন সেই কাপড়কে নষ্ট করিতে বলা হয় না, সেইরূপ ‘কর্মে বাসনা, আসক্তি কিংবা অনুরাগ রাখিবে না’ এইরূপ বলিলে, সেই কর্ম ত্যাগ করিতে হইবে এমন নহে । বৈরাগ্য-বুদ্ধিতে কর্ম করাই যদি অসম্ভব হয় তো সে কথা আলাদা । কিন্তু বৈরাগ্যবুদ্ধিতে কর্ম করিতে পারা যায় শুধু নহে, কর্ম হইতে কেহই মুক্ত হইতে পারে না, ইহাও আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । তাই অজ্ঞানী লোক যে কর্ম ফলের আশায় করিয়া থাকে, তাহাই জ্ঞানী পুরুষ, জ্ঞানলাভের পরেও, লাভালাভ ও সুখদুঃখ সমান মনে করিয়া [গী|২|৩৮] ধৈৰ্য ও উৎসাহ-সহকারে, কিন্তু শুষ্ক বুদ্ধিতে অর্থাৎ ফলসম্বন্ধে বিরক্ত কিংবা উদাসীন থাকিয়া [গী|১৮|২৬], কেবল কর্তব্য বলিয়া আপন আপন অধিকারানুসারে শান্তচিত্তে করিতে থাকেন [গী|৬|৩] । ইহাই নীতিদৃষ্টিতে ও মোক্ষদৃষ্টিতে উত্তম জীবনযাপনের প্রকৃত তত্ত্ব । অনেক স্থিতপ্ৰজ্ঞ, মহাভগবদ্‌ভক্ত ও পরম জ্ঞানী পুরুষেরা, এমন-কি স্বয়ং ভগবানও এই মাৰ্গই স্বীকার করিয়াছেন । ইহা কর্ম-যোগশাস্ত্রেরই পুরুষার্থের পরাকাষ্ঠা বা পরমার্থ, এই ‘যোগে’র দ্বারাই পরমেশ্বরের ভজন-পূজন হয় এবং পরিশেষে সিদ্ধিলাভও হয় [গী|১৮|৪৬], ভগবদ্‌গীতা ইহা উচ্চৈঃস্বরে বলিতেছেন । তাহার পরেও যদি আপনা হইতে কেহ ভুল বুঝে তবে তাহা দুৰ্ভাগ্য বলিতে হইবে । আত্মদৃষ্টি স্পেন্‌সর সাহেবের অভিমত ছিল না, তথাপি তিনিও স্বপ্রণীত ‘সমাজশান্ত্রের অভ্যাস’ গ্রন্থের শেষে গীতার ন্যায়ই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন; এই বিষয় আধিভৌতিক পদ্ধতি অনুসারেও সিদ্ধ যে, এই জগতে কোন কিছুই একেবারে সংঘটিত করা সম্ভব নহে, তাহার কারণীভূত ও অবশ্যম্ভাবী অন্য হাজার বিষয় পূর্বে যেরূপ ঘটিয়াছে তদনুসারে মনুষ্যের প্রযত্ন সফল, নিষ্ফল কিংবা ন্যূনাধিক পরিমাণে সফল হইয়া থাকে; এই কারণে সাধারণ লোক ফলাশায় কোন কর্মে প্ৰবৃত্ত হইলেও, বুদ্ধিমান ব্যক্তির ফলের আশা না রাখিয়া শান্তভাবে ও উৎসাহ সহকারে কর্তব্য করাই উচিত । *
* (“Thus admitting that for the fanatic some wild anticipation is needful as a stimulus, and recognizing the usefuness of his delusion as adapted to his particular nature and his particular function, the man of higher type must be content with greatly moderated expectations, while he perseveres with undiminished efforts. He has to see how comparatively little can be done, and yet to find it worth while to do that little; so uniting philanthrophic energy with philosophic calm.” - Spencer's Study of Sociology. 8th Ed. P. 403. The italics are ours. এই বাক্যে fanatics এর বদলে ‘প্রকৃতির গুণের দ্বারা বিমূঢ়’ [গী|৩|২৯] কিংবা ‘অহঙ্কারবিমুঢ়’ [গী|৩|২৭] অথবা ভাসকবির ‘মুর্খ’ শব্দ এবং man of higher types এর স্থানে ‘বিদ্বান’ [গী|৩|২৭] এবং greatly moderated expectations এর স্থানে ‘ফলৌদাসীন্য’ অথবা ‘ফলাশাত্যাগ’ এই সমানার্থক শব্দ বসাইলে গীতা-সিন্ধান্তের স্পেন্‌সর সাহেব যেন একরকম অনুবাদ করিয়াছেন এইরূপ মনে হইবে !)


19) লোকসংগ্রহ ও তাহার লক্ষণ



ফলাশা ছাড়িয়া নিষ্কামবুদ্ধিতে সংসারে প্রাপ্ত কর্ম জ্ঞানীপুরুষকে অবশ্য আজীবন করিতে হইবে ইহা সিদ্ধ হইলেও এই কর্ম কিসের দরুণ ও কেন প্ৰাপ্ত হয় ইহা না বলিলে কর্মযোগের বিচার পুরাপুরি হয় না । তাই, “লোকসংগ্ৰহমেবাহপি সংপশ্যন্‌ কর্তুমর্হসি” [গী|৩|২০] - লোকসংগ্রহের হিসাবে দেখিলেও তোমার কর্ম করাই উচিত - কর্মযোগের সমর্থনে অর্জুনকে ভগবান শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ এই কথাটি বলিয়াছেন । লোকসংগ্রহের অর্থ ইহা নহে যে, ‘মনুষ্যদিগকে শুধু জমা করিবে’ কিংবা ‘নিজের কর্মত্যাগ করিবার অধিকার হইলেও, কর্মত্যাগ করা অজ্ঞানী লোকদের উচিত নহে এবং তাহাদের নিজের (জ্ঞানী পুরুষের) কর্মতৎপরতা ভাল লাগিবে এই কারণে জ্ঞানী পুরুষ কাজ করিবার ভাণ করুন’ । কারণ, লোকেরা অজ্ঞানী থাকিবে কিংবা তাহাদিগকে অজ্ঞানী রাখিবার জন্য জ্ঞানীপুরুষ কর্ম করিবার ভাণ করিবে, গীতার ইহা শিখাইবার কোন হেতু নাই । ভাণ করা দূরে থাক্‌; কিন্তু ‘লোকে তোমার অপকীর্তি গাহিবে’ [গী|২|৩৪] ইত্যাদি সাধারণ লোককে বুঝাইবার মতো যুক্তিবাদেও যখন অর্জুনের সন্তোষ হইল না তখন তাহা অপেক্ষা গুরুতর ও তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে বলবত্তর কারণ ভগবান এক্ষণে বলিতেছেন । তাই ‘সংগ্ৰহ’ এই শব্দের জমা করা, রাখা, পালন করা, নিয়ন্ত্রিত করা প্রভৃতি যে সকল অর্থ অভিধানে প্রদত্ত হইয়াছে, সেই সমস্ত অর্থ যথাসম্ভব গ্ৰহণ করিতে হয়; এবং ঐরূপ করিলে লোকসংগ্ৰহ করা অর্থাৎ “তাহাদিগকে একত্র সম্বন্ধ করিয়া তাহাদের পরস্পরানুকুল্যের দ্বারা যে সামর্থ্য উৎপন্ন হয় তাহা তাহাদের মধ্যে যাহাতে আসে এই প্রকারে তাহাদের পালন পোষণ কিংবা নিয়মন করা, এবং তদ্দারা তাহাদের সুস্থিতি বজায় রাখিয়া, তাহাদিগকে শ্রেয়োলাভের পথে প্রবর্তিত করা”, এইরূপ ইহার অর্থ হয় । ‘রাষ্ট্রের সংগ্রহ’ শব্দ এই অর্থে মনুস্মৃতিতে প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|৭|১৪], এবং শাঙ্কর ভাষ্যে লোকসংগ্ৰহ = লোকস্যোন্মাৰ্গপ্রবৃত্তিনিবারণং এইরূপ এই শব্দের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে । ইহা হইতে উপলব্ধি হইবে যে, সংগ্ৰহ শব্দের আমি যে অর্থ করিতেছি তাহা অপূর্ব কিংবা ভিত্তিহীন নহে । সংগ্ৰহ শব্দের অর্থ ত এই হইল; কিন্তু ‘লোকসংগ্রহ’ শব্দে ‘লোক’ শব্দ কেবল মনুষ্যবাচী নহে, ইহাও এখানে বলা আবশ্যক । জগতের ইতর প্রাণী অপেক্ষা মনুষ্য শ্রেষ্ঠ হওয়ায়, ‘লোকসংগ্রহ’ শব্দে মুখ্যরূপে মানবজাতিরই কল্যাণের সমাবেশ হয়, একথা সত্য; তথাপি ভূলোক, সত্য লোক, পিতৃলোক, দেবলোক প্রভৃতি যে অনেক লোক অর্থাৎ জগৎ ভগবান সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহাদেরও উত্তমরূপে ধারণ, পোষণ হইয়া সেই সমস্তও সুচারুরূপে চলিবে এইরূপ ভগবানের ইচ্ছা; তাই মনুষ্যলোকের ন্যায়ই এই সমস্ত লোকের ব্যবহারও সুব্যবস্থিত রূপে চলিবে (লোকানাং সংগ্ৰহঃ) এই ব্যাপক অর্থ ‘লোকসংগ্রহ’ পদের দ্বারা এই স্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে, এইরূপ বলিতে হয় । জনক-কৃত আপন কর্তব্যের যে বর্ণনা উপরে প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাতে দেবতা ও পিতৃগণেরও উল্লেখ আছে, এবং ভগবদ্‌গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে এবং মহাভারতের নারায়ণীয়-উপাখ্যানে যে যজ্ঞচক্রের বর্ণনা আছে তাহাতেও দেবলোক ও মনুষ্যলোক এই দুয়েরই ধারণপোষণ হইবে বলিয়া ব্ৰহ্মদেব যজ্ঞ উৎপন্ন করেন এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|৩|১০-১২] । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, শুধু মনুষ্যলোকের নহে, দেবাদি সমস্ত লোকের ধারণপোষণ হইয়া পরস্পর পরস্পরের শ্ৰেয়সম্পাদন করিবে, এই অর্থই লোকসংগ্রহপদে ভগবদ্‌গীতায় বিবক্ষিত হইয়াছে । সমস্ত জগতের পালন-পোষণ করিয়া লোকসংগ্ৰহ করিবার ভগবানের এই যে অধিকার, তাহাই জ্ঞানী পুরুষ নিজের জ্ঞানপ্ৰযুক্তই প্ৰাপ্ত হয়েন । জ্ঞানীপুরুষেরা যাহা প্রমাণ বলিয়া মনে করেন, তাহাই অন্য লোকেরাও প্রমাণ মনে করিয়া সেইরূপ আচরণ করিয়া থাকে [গী|৩|২১] । কারণ, সমস্ত জগতের ধারণ-পোষণ কিসে হইবে, শান্তচিত্তে ও সমবুদ্ধিতে তাহার বিচার করিয়া তদনুসারে ধর্মবন্ধন স্থাপন করা জ্ঞানীপুরুষদিগের কাজ, ইহা সাধারণ লোকের ধারণা । এই ধারণা ভ্ৰান্তিমূলকও নহে । অধিক কী, সাধারণ লোকের বুদ্ধিতে এই বিষয় ঠিক আসে না বলিয়া জ্ঞানীপুরুষদিগের উপর তাহারা ভরসা রাখে, এরূপ বলিলেও চলে । এই কথা মনে করিয়াই শান্তিপর্বে ভীষ্ম যুধিষ্টিরকে বলিয়াছেন -
লোকসংগ্ৰহসংযুক্তং বিধাত্রা বিহিতং পুরা ৷
সূক্ষ্মধর্মার্থনিয়তং সতাং চরিতমুত্তমম্‌ ॥
“লোকসংগ্ৰহকারক সূক্ষ্মীধর্মার্থনিয়ত সাধুদিগের উত্তম চরিত্র বিধাতারই বিধান”- [মভা|শাং|২৫৮|২৫] । লোকসংগ্ৰহ অর্থে, নিরর্থক কোন প্রকার মনগড় মিথ্যা কিংবা লোকদিগকে অজ্ঞানে রাখিবার কৌশল নহে; জ্ঞানযুক্ত কর্ম জগৎ হইতে বিলুপ্ত হইলে জগতের বিনাশ সম্ভাবনা হয় বলিয়া ইহাই সিদ্ধ হয় যে, বিধাতাবিহিত সাধুপুরুষদিগের কর্তব্যসমূহের মধ্যে ইহা এক মুখ্য কর্তব্য । এবং “আমি এই কর্ম না করিলে সমস্ত জগৎ ধ্বংস হইবে” [গী|৩|২৪] এই ভগবদ্‌বচনের ভাবার্থও এই । জ্ঞানীপুরুষ সমস্ত জগতের চক্ষু; ইহাঁরা যদি নিজের কর্ম ত্যাগ করেন তাহা হইলে অন্ধসমাচ্ছন্ন হইয়া সমস্ত জগৎ ধবংস না হইয়া যায় না । লোকদিগকে জ্ঞানী করিয়া উন্নতির পথে আনয়ন করা জ্ঞানীপুরুষদিগেরই কর্তব্য । কিন্তু এই কার্য কেবল মুখভারতীতে অর্থাৎ শুষ্ক উপদেশের দ্বারাই কখনও সিদ্ধ হয় না । কারণ যাহাদের সদাচরণের অভ্যাস নাই, যাহাদের বুদ্ধি সম্পূর্ণরূপে শুদ্ধ হয় নাই, তাহাদিগকে শুধু শুষ্ক ব্ৰহ্মজ্ঞান শুনাইলে, “তুমি সে আমি, আমি সে তুমি” এই প্রকারে তাহাদিগকে জ্ঞানের অপব্যবহার করিতে সর্বদাই দেখা যায় । তাছাড়া, কোন উপদেশের সত্যতার পরীক্ষাও লোকেরা তাহার আচরণ দেখিয়াই করিয়া থাকে । তাই, জ্ঞানী মনুষ্য নিজে কাজ যদি না করেন, তাহা হইলে তিনি সাধারণ লোককে অলস করিবার এক বড় কারণ হইবেন । ইহাকেই ‘বুদ্ধিভেদ’ বলে । এবং এই বুদ্ধিভেদ না হইয়া লোকেরা সত্যসত্যই নিষ্কাম হইয়া নিজেদের কর্তব্যসম্বন্ধে জাগৃত হইবে বলিয়া সংসারে থাকিয়াই নিজ কর্মের দ্বারা লোকদিগকে সদাচরণের অর্থাৎ নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর্ম করিবার প্রত্যক্ষ শিক্ষা দেওয়াই জ্ঞানীপুরুষের কর্তব্য (ভড়ং নহে) হইয়া পড়ে । তাই কর্মত্যাগের অধিকার তিনি (জ্ঞানীপুরুষ) কখনই প্ৰাপ্ত হন না; নিজের জন্য না হইলেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ চাতুর্বর্ণ্যের সমস্ত কর্ম যথাধিকার তাঁহার করিতে হইবে এইরূপ গীতার উপদেশ কিন্তু জ্ঞানীপুরুষের চাতুর্বর্ণ্যের কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে করাও আবশ্যক নহে, এমন-কি করা উচিত নহে, এইরূপ সন্ন্যাসমার্গীদের মত হওয়ায় “জ্ঞানীপুরুষ লোকসংগ্ৰহাৰ্থ কর্ম করিবেন” এই গীতাসিদ্ধান্তের সন্ন্যাসমাৰ্গীয় টীকাকারেরা কতকগুলো গোলমেলে অর্থ করিয়া, প্ৰত্যক্ষভাবে নহে পরন্তু পৰ্যায়ক্রমে এইরূপ কথা বলিতেও তাঁহারা প্ৰস্তুত যে, স্বয়ং ভগবানও ভড়ং করিবার উপদেশ করিতেছেন । কিন্তু গীতার লোকসংগ্ৰহ শব্দের এই তৈলাক্ত রকমের অর্থ ঠিক নহে, ইহা পূর্বাপর সন্দর্ভ হইতে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । জ্ঞানী পুরুষ কর্মত্যাগের অধিকার প্রাপ্ত হন এই মতই গীতার আদৌ মান্য নহে; এবং তাহার সমর্থনে গীতার যে সকল কারণ দেওয়া হইয়াছে তন্মধ্যে লোকসংগ্রহ একটি মুখ্য কারণ । তাই, জ্ঞানীপুরুষের কর্ম থাকে না ইহা প্ৰথমে মানিয়া লইয়া লোকসংগ্ৰহ পদের ভড়ং-মূলক অর্থ করা সর্বথাই অনায্য । 


20) ব্রহ্মজ্ঞানের ইহাই প্রকৃত পর্যবসান



মনুষ্য এই জগতে কেবল নিজের জন্যই জন্মে নাই । অজ্ঞতাবশতঃ সাধারণ লোক নিজ স্বার্থের মধ্যেই নিমজ্জিত থাকে ইহা সত্য । কিন্তু “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” [গী|৬|২৯] – আমি সমস্ত ভূতে এবং সমস্ত ভূত আমাতে – এই প্রকার সমস্ত জগৎই যাঁহার আত্মভূত হইয়াছে তিনি “আমার মোক্ষ লাভ হইয়াছে, এক্ষণে লোকেরা দুঃখী হইলেও আমার তাহাতে কিসের ভাবনা” এইরূপ কথা বলিলে, তাঁহার নিজমুখেই জ্ঞানের হীনতা স্বীকার করা হয় । জ্ঞানীপুরুষের আত্মা বলিয়া কোন স্বতন্ত্র ব্যক্তি আছে কি ? তাঁহার আত্মার উপর যে পৰ্যন্ত অজ্ঞানের আবরণ ছিল সে পৰ্যন্ত “আমি” ও “লোক” এই ভেদ বজায় ছিল । কিন্তু জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর সমস্ত “লোকের আত্মাই তাঁহার আত্মা । তাই যোগবাসিষ্ঠে বসিষ্ঠ রামকে এইরূপ বলিয়াছেন -
যাবল্লোকপরামর্শো নিরূঢ়ো নাস্তি যোগিনঃ ৷
তাবদ্‌রূঢ়সমাধিত্বং ন ভবেত্যেব নির্মালম্‌ ॥
“যে পৰ্যন্ত লোকের পরামর্শ লইবার (অর্থাৎ লোকসংগ্রহের) কাজ একটুও অবশিষ্ট থাকে, সমাপ্ত না হয়, সে পৰ্যন্ত যোগারূঢ় পুরুষের অবস্থা নির্দোষ, এরূপ কখনই বলা যাইতে পারে না” [যো|৬; পূ|১২৮|৯৭] । কেবল আপন সমাধিসুখেই নিমগ্ন থাকা এক প্রকার নিজের স্বার্থসাধনা মনে হয় । সন্ন্যাসমাৰ্গীয় লোকেরা ইহার প্রতি লক্ষ্য করে না, ইহাই তাঁহাদের যুক্তিবাদের মুখ্য দোষ । ভগবান অপেক্ষা কেহই অধিক জ্ঞানী, অধিক নিষ্কাম কিংবা অধিক যোগারূঢ় হইতে পারে না । কিন্তু ভগবানও “সাধুদিগের সংরক্ষণ, দুষ্টদিগের নাশ ও ধর্মসংস্থাপন” এইপ্ৰকার লোকসংগ্রহের কাজ করিবার জন্যই যদি সময়ে সময়ে অবতার হন [গী|৪|৮], তবে জ্ঞানী পুরুষের লোকসংগ্রহের কাজ ছাড়িয়া দিয়া “যে পরমেশ্বর এই সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি তাঁহার ইচ্ছামতো ভরণপোষণ করিবেন, সে দিক্‌ দেখা আমাদের কাজ নহে” এইরূপ বলা সর্বথাই অনুচিত । কারণ জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর, পরমেশ্বর, “আমি” ও “জগ,” - এই ভেদই থাকে না; এবং যদি থাকে, তবে তিনি জ্ঞানী নহেন, তিনি জ্ঞানী বলিয়া ভড়ং করেন বলিতে হইবে । জ্ঞানের দ্বারা জ্ঞানী পুরুষ যদি পরমেশ্বররূপী হন, তবে পরমেশ্বর যে কাজ করেন তাহা পরমেশ্বরের ন্যায় অর্থাৎ নিঃসঙ্গ বুদ্ধিতে করিবার অবশ্যকতা হইতে জ্ঞানী পুরুষ কি করিয়া অব্যাহতি পাইবেন [গী|৩|২২ ও ৪|১৪ ও ১৫] ? তাছাড়া, পরমেশ্বর যাহা কিছু করেন তাহাও জ্ঞানীপুরুষের রূপে কিংবা জ্ঞানীপুরুষের দ্বারাই করিয়া থাকেন । তাই, “সকল ভূতে এক আত্মা” পরমেশ্বরের স্বরূপের এইরূপ অপরোক্ষ জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তাঁহার মনে সর্বভূতের প্রতি অনুকম্পাদি উচ্চবৃত্তি পূৰ্ণ জাগৃত থাকিয়া স্বভাবতই লোককল্যাণের দিকে তাঁহার মনের প্রবৃত্তি হইবে । এই অভিপ্ৰায়ে তুকারাম বাবা সাধুপুরুষের লক্ষণ এই প্রকার বলিয়াছেন -
জে কা রজলে গাঁজলে ৷ তাঁসি ভণে জো আছুলে ৷
তোচি সাধু ওড়্‌খাবা ৷ দেব তেথেঁ চি জাণাবা ॥ [গা|৯৬৫|১-২]
অর্থাৎ “সকলের সুখদুঃখকে যে আপনার বলে তাহাকেই সাধু বলিয়া জানিবে - দেবতা সেইখানেই জানিবে;” কিংবা - 
পরউপকারী বেঁচিয়েল্যা শক্তী ৷ তেণে আত্মস্থিতী জাণীতলী [গা|৪৫৬২]
অর্থাৎ “পরোপকারে যিনি নিজশক্তি ব্যয় করিয়াছেন তিনিই আত্মস্থিতি জানেন;” এবং শেষে সাধুদিগের (অর্থাৎ ভক্তির দ্বারা পরমেশ্বরের পূর্ণজ্ঞান যাঁহারা লাভ করিয়াছেন সেই সকল মহাত্মাদের) কাৰ্য্যের বর্ণনা এই প্ৰকার করিয়াছেন -
জগাচ্যা কল্যাণা সস্তাঞ্চা বিভূতি ৷
দহে কষ্টবিতো উপকারেঁ ॥
অর্থাৎ “জগতের কল্যাণই সাধুদিগের বিভূতি, উহাঁরা কষ্ট করিয়াও দশজনের উপকার করেন” [গা|৯২৯]; “স্বার্থো যস্য পরার্থ এবং স পুমানেকঃ সতামগ্ৰণীঃ”- পরার্থই যাহার স্বাৰ্থ হইয়াছে সেই ব্যক্তিই সাধুদিগের মধ্যে শ্রেষ্ঠ - এইরূপ ভর্তৃহরি বলিয়াছেন । 


21) তথাপি সেই লোকসংগ্রহও চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থা অনুযায়ী ও নিষ্কাম হইবে



মনু প্ৰভৃতি শাস্ত্রকার কি জ্ঞানী ছিলেন না ? কিন্তু তৃষ্ণাদুঃখরূপ রজ্জুর একটা মস্ত জুজু তৈরি করিয়া তৃষ্ণার সঙ্গে সঙ্গেই পরোপকারবুদ্ধি প্ৰভৃতি সমস্ত উচ্চ বৃত্তিকে বিদলিত না করিয়া তাহারা লোকসংগ্ৰহকারক চাতুর্বর্ণ্যাদি শাস্ত্রীয় সীমা স্থাপনের কাৰ্য করিয়াছেন । ব্ৰাহ্মণের জ্ঞান, ক্ষত্ৰিয়ের যুদ্ধ, বৈশ্যের কৃষি, গোরক্ষণ ও বাণিজ্যব্যবসায় কিংবা শূদ্রের সেবা, এই যে গুণকর্মস্বভাবানুরূপ ভিন্ন ভিন্ন কর্ম শাস্ত্ৰে বৰ্ণিত হইয়াছে তাহা কেবল প্ৰত্যেক ব্যক্তির হিতেরই জন্য এরূপ নহে; প্রত্যুত মনুস্মৃতিতে আছে [মনু|১|৮৭] যে, চাতুর্বর্ণ্যের ব্যবসায়বিভাগ লোকসংগ্ৰহাৰ্থই প্ৰবৃত্ত হইয়াছে; সমস্ত সমাজের রক্ষণার্থে কতকগুলি ব্যক্তির যুদ্ধকলা নিত্য অভ্যাস করিয়া প্ৰস্তুত থাকা আবশ্যক এবং কাহারও কাহারও কৃষিকর্ম, বাণিজ্য, জ্ঞানার্জন প্রভৃতি কার্যের দ্বারা সমাজের অন্য অভাব পূর্ণ করা আবশ্যক গীতার অভিপ্রায়ও ঐরূপ [গী|৪|১৩; ১৮|৪|১ দেখ] । এই চাতুর্বর্ণ্যধর্মের মধ্যে কোন এক ধর্ম বিলুপ্ত হইলে সমাজ ততটুকু পঙ্গু হইয়া যাইবে এবং শেষে তাহার নাশ হহবারও সম্ভাবনা থাকে ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । কর্মবিভাগের এই ব্যবস্থা একই প্রকার থাকে না, যেন স্মরণ থাকে । প্ৰাচীন গ্রীক তত্ত্বজ্ঞ প্লেটো এই বিষয়ক আপন গ্রন্থে এবং আধুনিক ফরাসী শাস্ত্রজ্ঞ কোঁৎ আপন “আধিভৌতিক তত্ত্বজ্ঞানে” সমাজধারণার্থ যে ব্যবস্থা সূচিত করিয়াছেন, তাহা চাতুর্বর্ণ্যের সদৃশ হইলেও বৈদিক ধর্মের, চাতুর্বণ্য ব্যবস্থা, হইতে উহা অল্পাধিক অংশে যে ভিন্ন, ইহা উক্ত গ্ৰন্থ পাঠ করিলেই উপলব্ধি হইবে । ইহার মধ্যে কোন্‌ সমাজব্যবস্থা উত্তম, অথবা এই উত্তমতা আপেক্ষিক, এবং যুগকালানুসারে ইহাতে কোন ফেরফার হইতে পারে কি না, ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন এইস্থানে উঠে; এবং ‘লোকসংগ্ৰহ’ এখনকার কালে পাশ্চাত্যদেশে একটা বড় রকমের শাস্ত্ৰ হইয়া দাঁড়াইয়াছে । কিন্তু গীতার তাৎপৰ্যনিৰ্ণয়ই আমাদের উপস্থিত বিষয় হওয়ায় এখানে এই প্রশ্নের বিচারে প্ৰবৃত্ত হইবার কারণ নাই । গীতাকালে চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা জারী ছিল এবং উহা গোড়ায় লোকসংগ্ৰহ করিবার জন্যই প্ৰবৃত্ত হয়, ইহা নির্বিবাদ । তাই চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা অনুসারে নিজনিজ প্ৰাপ্ত কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে যেরূপ করিতে হইবে তাহার প্রত্যক্ষ শিক্ষা নির্দেশ করাই গীতার এই লোকসংগ্ৰহ পদের অর্থ । ইহাই এখানে মুখ্য বক্তব্য । জ্ঞানী পুরুষ সমাজের শুধু চক্ষু নহে, সমাজের গুরুও বটে । তাই ইহা স্বতই সিদ্ধ হয় যে, উক্ত প্রকার লোকসংগ্রহ করিবার জন্য তিনি আপন কালের সমাজব্যবস্থায় যদি কোন ত্রুটি দেখেন, তবে তিনি তাহা শ্বেতকেতুর ন্যায় দেশকালানুরূপ পরিমার্জিত করিবেন এবং সমাজের ধারণ-পোষণ শক্তিকে হ্রাস হইতে না দিয়া, তাহা যাহাতে বর্ধিত হইতে পারে এইরূপ উদ্যোগ করিবেন । এই প্রকার লোকসংগ্রহের জন্যই জনক সন্ন্যাস গ্ৰহণ না করিয়া আমরণ রাজত্ব করিতে থাকিলেন এবং মনু প্ৰথম রাজা হইবেন বলিয়া স্বীকার করিলেন; এবং এই কারণেই “স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমৰ্হসি [গী|২|৩১] স্বধর্মানুসারে প্রাপ্ত কর্ম সম্বন্ধে কাঁদিতে বসা তোমার উচিত নহে; কিংবা “স্বভাবনিয়তং কর্ম কুৰ্বন্নাপ্নোতি কিল্বিষম্‌ [গী|১৮|৪৭] স্বভাব ও গুণানুরূপ নির্ধারিত চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা অনুসারে নির্দিষ্ট কর্ম সাধন করিলে তোমার কোন পাপ হইবে না, ইত্যাদি প্রকার চাতুর্বর্ণকর্মানুসারে প্রাপ্ত যুদ্ধ করিতে অর্জুনকে গীতায় বারংবার উপদেশ করা হইয়াছে । পরমেশ্বরের জ্ঞান যথাশক্তি অর্জন করিও না, এরূপ কেহই বলে না । অধিক-কি, এই জ্ঞান অর্জন করাই এই জগতে মনুষ্যের ইতিকর্তব্য, ইহা গীতারও সিদ্ধান্ত । কিন্তু পরে গীতার বিশেষ উক্তি এই যে, নিজের আত্মার কল্যাণেই সমষ্টিরূপ আত্মার কল্যাণার্থ যথাশক্তি চেষ্টারও সমাবেশ হয় বলিয়া লোকসংগ্ৰহ করাই ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞানের প্রকৃত পৰ্যবসান । তথাপি, কোন ব্যক্তি ব্ৰহ্মজ্ঞানী হইলেই সমস্ত ব্যবহারিক কর্ম স্বহস্তে করিবার যোগ্য হয় এরূপ নহে ৷ ভীষ্মব্যাস দুইজনেই মহাজ্ঞানী ও পরম ভগবদ্‌ভক্ত ছিলেন । কিন্তু ব্যাসও ভীষ্মের ন্যায় যুদ্ধের কাজই করিয়াছেন, এরূপ কেহ বলে না । দেবতাদের দিকে দেখিলে, সেখানেও জগতের সংহার করিবার কাজ শঙ্করের বদলে বিষ্ণুর উপর সমৰ্পিত হইয়াছে এরূপ দেখা যায় না । জীবন্মুক্তাবস্থা — মনের নির্বিষয়তার, সম ও শুদ্ধবুদ্ধির এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির শেষ পৈঠা; উহা আধিভৌতিক কর্মবুদ্ধির পরীক্ষা নহে । তাই, স্বভাব ও গুণানুরূপ প্ৰবৃত্ত চাতুর্বর্ণ্যাদি ব্যবস্থা অনুসারে যে কর্ম আমরা চিরজন্ম করিয়া আসিতেছি, স্বভাব অনুসারে সেই কর্ম বা ব্যবসায় জ্ঞানীপুরুষকে জ্ঞানলাভের পরেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ চলিত রাখিতে হইবে, কারণ তাহার ভিতরেই বিশেষজ্ঞ হইবার সম্ভাবনা থাকে, অন্য ফালতো ব্যবসায় করিলে তাহাতে সমাজের ক্ষতি হইবে, গীতার এই বিশেষ উপদেশ পুনৰ্বার এই প্ৰকরণেই বিচার করা হইয়াছে [গী|৩|৩৫; ১৮-৪৭] । প্ৰত্যেক মনুষ্যে ঈশ্বরসৃষ্ট প্রকৃতি, স্বভাব ও গুণের অনুরূপ ভিন্ন ভিন্ন যোগ্যতাকেই অধিকার বলা হয়; এবং “পুরুষ ব্ৰহ্মজ্ঞানী হইলেও এই অধিকার অনুসারে নির্দিষ্ট কর্ম, লোকসংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ করিয়া যাইবে, কর্মত্যাগ করিবে না”- “যাবদধিকারমবস্থিতিরাধিকারিণাম্‌” [বেসূ|৩|৩|৩২] এইরূপ বেদান্তশাস্ত্ৰে উক্ত হইয়াছে । বেদান্তসূত্রকারের এই উপপত্তি কেবল বড়-অধিকারের ব্যক্তিদের সম্বন্ধেই খাটে, কেহ কেহ এইরূপ বলেন; এবং এই সূত্রের ভাষ্যে, তৎসমর্থনাৰ্থ যে উদাহরণ দেওয়া হইয়াছে তাহাতে দেখা যায় যে, সমস্ত উদহরণই ব্যাস-আদি বড় বড় অধিকারী পুরুষদিগেরই দেওয়া আছে । কিন্তু মূলসূত্রে অধিকারের ছোট-বড়ত্ব সম্বন্ধে কোন উল্লেখ নাই, তাই “অধিকার” শব্দে ছোট-বড় সমস্ত অধিকার ধরিতে হয়; এবং এই অধিকার কে কি প্রকারে প্রাপ্ত হয় ইহার সুক্ষ্ম ও স্বতন্ত্র বিচার করিলে দেখা যায় যে, মনুষ্যের সঙ্গেই সমাজ ও সমাজের সঙ্গেই মনুষ্য পরমেশ্বর উৎপন্ন করায়, যাহার যতটা বুদ্ধিবল, প্ৰাণবল, দ্রব্যবল কিংবা শরীরবল স্বভাবত হইতে পারে কিংবা স্বধর্মের দ্বারা অর্জন করা যাইতে পারে, সেই হিসাবেই যথাশক্তি জগতের ধারণপোষণ ক্ষরিবার ন্যূনাধি্ক অধিকার (চাতুর্বর্ণ্যাদি কিংবা অন্য গুণকর্মবিভাগরূপ সামাজিক ব্যবস্থা হইতেই) প্ৰত্যেকেই জন্মত প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । কল ভাল চালাইবার জন্য বড় চাকার মতো খুব ছোট চাকারও যেমন দরকার হয়, সেইরূপই সমস্ত জগতের এই বৃহৎ বিরাট সৃষ্টিসংহারের কাজ অথবা চক্ৰ সুব্যবস্থিতিরূপে চলমান রাখিবার জন্য ব্যাস আদির বড় বড় অধিকারের সমানই অন্য মনুষ্যের ছোট ছোট অধিকারও পূর্ণ ও যোগ্যরীতিতে করিয়া আমলে আনা কর্তব্য । কুমার ঘট এবং তাঁতি বস্ত্ৰ তৈয়ার না করিলে, রাজা দ্বারা যথোচিত রাজ্যরক্ষণ হইলেও লোকসংগ্রহের কাজ পূরাপুরি হইতে পারে না; কিংবা আগ্‌-গাড়ীতে সামান্য নিশান-ওয়ালা কিংবা পয়েণ্টন্মেন (রেল-জুড়িবার শিপাই) যদি নিজের কর্তব্য না করে, তবে এখন যেমন আগ্‌গাড়ী বায়ুবেগে নিৰ্ভয়ে ছুটিয়া চলে, সেরূপ আর চলিতে পরিবে না । তাই বেদান্তসূত্রকারেরই উপরি-উক্ত যুক্তিবাদের দ্বারা এক্ষণে নিষ্পন্ন হইল যে, ব্যাস-আদি বড় বড় অধিকারী শুধু নহে অন্য লোকেরও – তা তিনি রাজাই হউন বা প্ৰজাই হউন - লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যথানিৰ্দিষ্ট ছোটবড় অধিকারের কর্ম জ্ঞানলাভের পরেও ত্যাগ না করিয়া নিষ্কামবুদ্ধিতে কর্তব্য জানিয়া যথাশক্তি, যথামতি ও যথাসম্ভব করিয়া যাওয়া উচিত । আমি না করি, অন্য কেহ এই কাজ করিবে এরূপ বলা উচিত নহে । কারণ, তাহা হইলে সমগ্ৰ কর্মে আবশ্যক ব্যক্তির মধ্যে একজন কম হইয়া যায় এবং সংঘশক্তি কমিয়া যায় শুধু নহে কিন্তু জ্ঞানীপুরুষ সেই কর্ম যতটা বিশুদ্ধভাবে করিবেন সেরূপ অন্যের সাধ্যায়ত্ত নহে; ফলত এই হিসাবে লোকসংগ্রহও খোঁড়াই থাকিয়া যাইবে । তাছাড়া জ্ঞানী পুরুষের কর্মত্যাগরূপ উদাহরণ হইতে লোকের বুদ্ধিও বিগ্‌ড়াইয়া যায় ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে । কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হইবার পর নিজের আত্মার মোক্ষলাভ হইলেই সন্তুষ্ট হইয়া জগতের উচ্ছেদ হইলেও তাহার পরোয় না রাখিয়া “লোকসংগ্ৰহধৰ্ম্মং চ নৈব কুৰ্য্যান্ন কারয়েৎ” - লোকসংগ্ৰহ করিবে না, করাইবেও না [মভা|অশ্ব|অনুগীতা|৪৬|৩৯] এইরূপ সন্ন্যাসমাৰ্গীয় লোক কখন কখন বলিয়া থাকেন সত্য । কিন্তু ব্যাসাদির আচরণের তাঁহারা যে উপপত্তি দেন তাহা হইতে, এবং বসিষ্ঠ ও পঞ্চশিখ প্ৰভৃতি রাম-জনকাদিকে আপনাপন অধিকার অনুসারে সমাজের ধারণ-পোষণাদি কর্মই আমরণ করিতে যে বলিয়াছেন তাহা হইতে স্পষ্টই উপলব্ধি হয় যে, সন্ন্যাসমার্গীর কর্মত্যাগের উপদেশ একদেশদর্শী, সর্বথা-সিদ্ধ শাস্ত্রীয় সত্য নহে । তাই বলিতে হয় যে, এই প্রকার একপক্ষীয় উপদেশের প্রতি লক্ষ্য না করিয়া, ভগবানের নিজেরই উদাহরণ অনুসারে জ্ঞানলাভের পরেও আপন অধিকার বুঝিয়া তদনুসারে লোকসংগ্ৰহকারী কর্ম আমরণ করিতে থাকাই শাস্ত্রোক্ত ও উত্তম মাৰ্গ; তথাপি এই লোকসংগ্ৰহ ফলাশা রাখিয়া করিতে নাই । কারণ, লোকসংগ্রহই হউক না কেন, ফলের আশা রাখিলে কর্ম নিষ্ফল হইলে দুঃখ না হইয়া যায় না । তাই আমি “লোকসংগ্ৰহ করিব” এই অভিমান, বা ফলাশার বুদ্ধি মনে না রাখিয়া, লোকসংগ্রহও কেবল কর্তব্য বুদ্ধিতেই করিতে হয় । সেই কারণে ‘লোকসংগ্ৰহাৰ্থ অর্থাৎ লোকসংগ্ৰহরূপ ফললাভের জন্য কর্ম করিতে হইবে, গীতা এইরূপ না বলিয়া ‘লোকসংগ্ৰহমেবাপি সংপশ্যন্‌’ লোকসংগ্রহের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়াও (সংপশ্যন্‌) তোমাকে কর্ম করিতে হইবে এইরূপ বলিয়াছেন [গী|৩|২০] । এই প্রকার গীতায় যে একটু লম্বাচৌড়া শব্দযোজনা করা হইয়াছে - ইহাই তাহার বীজ । লোকসংগ্ৰহ মহৎ কর্তব্য সত্য; কিন্তু এই শ্লোকের পূর্ব শ্লোকে [গী|৩|১৯] অনাসক্তবুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম করিবার ভগবান্ অর্জুনকে যে উপদেশ করিয়াছেন সেই উপদেশ লোকসংগ্রহের জন্যও উপযুক্ত, ইহা বিস্মৃত হইবে না ।” 


22) স্মৃতিগ্রন্থে বর্ণিত চার আশ্রমের, জীবনযাপনের মার্গ



জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে যে বিরোধ তাহা জ্ঞান ও কাম্য কর্মেরই বিরোধ; জ্ঞান ও নিষ্কাম কর্মে অধ্যাত্মদৃষ্টিতেও কোন বিরোধ নাই । কর্ম অপরিহার্য এবং লোকসংগ্ৰহ-দৃষ্টিতে উহার আবশ্যকতাও যথেষ্ট হওয়ায়, যাবজ্জীবন যথাধিকার নিঃসঙ্গবুদ্ধিতে চাতুৰ্বর্ণের কর্ম জ্ঞানীপুরুষের করিতেই হইবে । যদি এই বিষয়ই শাস্ত্রীয় যুক্তিবাদের দ্বারা সিদ্ধ হয়, এবং গীতারও যদি ইহাই অর্থ হয়, তবে বৈদিক ধর্মের স্মৃতিগ্রন্থে কথিত চারি আশ্রমের মধ্যে সন্ন্যাসাশ্রমের কি দশা হইবে, এই সন্দেহ সহজেই মনে উদয় হয় । মনু প্ৰভৃতি স্মৃতিসমূহে ব্ৰহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্ৰস্থ ও সন্ন্যাসী - এই চারি আশ্রমের কথা বলিয়া অধ্যয়ন, যাগ-যজ্ঞ, দান কিংবা চাতুর্বর্ণ্য ধর্মানুসারে নির্দিষ্ট অন্য কর্মের শাস্ত্রোক্ত আচরণের দ্বারা, প্ৰথম তিন আশ্রমে আস্তে আস্তে চিত্তশুদ্ধি হওয়া চাই এবং শেষে সমস্ত কর্ম স্বরূপত ত্যাগ করিবে ও সন্ন্যাস লইয়া মোক্ষ অর্জন করিবে এইরূপ উক্ত হইয়াছে [মনু|৬|১ ও ৩৩-৩৭ দেখ] । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, যাগযজ্ঞ ও দানাদি কর্ম গৃহস্থাশ্রমে বিহিত হইলেও তাহা চিত্তশুদ্ধির জন্য অর্থাৎ সেগুলির ইহাই উদ্দেশ্য যে, বিষয়াসক্তি বা স্বার্থপরবুদ্ধি চলিয়া গিয়া পরোপকারবুদ্ধি বাড়িয়া বাড়িয়া সর্বভূতে একই আত্মা রহিয়াছে এই উপলব্ধির শক্তি পাওয়া যাইবে; এবং এই অবস্থা প্ৰাপ্ত হইলে পর মোক্ষপ্ৰাপ্তির জন্য শেষে সমস্ত কর্ম স্বরূপত ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসাশ্রমই গ্ৰহণ করিবে, ইহাই সমস্ত স্মৃতিকারদিগের অভিপ্ৰায় । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য কলিযুগে যে সন্ন্যাসধর্মের স্থাপনা করিয়াছেন, সেই মার্গ ইহাই; এবং স্মার্তমাৰ্গীয় কালিদাসও রঘুবংশের আরম্ভে
শৈশবেহভ্যস্তবিদ্যানাং যৌবনে বিষয়ৈষিণাম্‌ ৷
বার্ধক্যে মুনিবৃত্তীনাং যোগেনান্তে তনুত্যজাম্‌ ॥
“বাল্যকালে অভ্যাস (ব্রহ্মচৰ্য) কারী, যৌবনে বিষয়োপভোগরূপ সংসার (গৃহস্থাশ্ৰম) কারী, শেষ বয়সে মুনিবৃত্তি কিংবা বানপ্ৰস্থ ধর্ম অবলম্বনকারী এবং শেষে (পাতঞ্জল) যোগের দ্বারা সন্ন্যাসধর্মানুসারে ব্ৰহ্মাণ্ডের মধ্যে আত্মাকে লইয়া গিয়া প্ৰাণত্যাগকারী” এইরূপ পরাক্রান্ত, সূৰ্যবংশীয় রাজাদের বর্ণনা প্রদত্ত হইয়াছে [রঘু|১|৮] । সেইরূপ আবার মহাভারতে শুকানুপ্রশ্নে -
চতুষ্পদী হি নিঃশ্রেণী ব্ৰহ্মণ্যেষা প্রতিষ্ঠিতা ৷
এতামারুহ্য নিঃশ্রেণীং ব্ৰহ্মলোকে মহীয়তে ॥
“চারি আশ্রমরূপ চারি পৈঁঠার এই সোপান শেষে ব্ৰহ্মপদে আসিয়া পৌঁছিয়াছে; এই পৈঁঠা দ্বারা অর্থাৎ এক আশ্রম হইতে অন্য উপরের আশ্রমে আরোহণ করিতে থাকিলে পর মনুষ্য শেষে ব্ৰহ্মলোকে মহত্ব লাভ করে [শাং|২৪১|১৫] এই কথা বলিয়া, পরে এই ক্রমপরম্পরার বর্ণনা করিয়াছেন -
কষায়ং পাচয়িত্বাশু শ্রেণিস্থানেষু চ ত্ৰিষু ৷
প্ৰব্ৰজেচ্চ পরং স্থানং পারিব্রাজ্যমনুত্তমম্‌ ॥
“এই সোপানের তিন পৈঁঠায় মনুষ্য আপদ কিল্বিষের (পাপের) অর্থাৎ স্বার্থপর আত্মবুদ্ধিৱ কিংবা বিষয়াসক্তিরূপ দোষের শীঘ্রই ক্ষয় করিয়া আবার সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে; পারিব্রাজ্য অর্থাৎ সন্ন্যাসই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ স্থান” [শাং|২৪৪|৩] । এক আশ্রম হইতে অন্য আশ্রমে যাইবার এই ক্রমপরম্পরাই মনুস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|৬|৩৪] । কিন্তু ইহার মধ্যে অন্তিম অর্থাৎ সন্ন্যাস আশ্রমের দিকে লোকের অতিরিক্ত প্ৰবৃত্তি হইলে সংসারের কর্তৃত্ব নষ্ট হইয়া সমাজও পঙ্গু হইবে এই কথা মনুর খুব উপলব্ধি হইয়াছিল । তাই, পূর্বাশ্রমে গৃহধর্ম অনুসারে পরাক্রমের ও লোকসংগ্রহের সমস্ত কাৰ্য অবশ্য কর্তব্য, মনু এই কথা বলিয়া, পরে -
গৃহস্থস্তু যদা পশ্যেদ্বলীপলিতমাত্মনঃ ৷
অপত্যেস্যৈব চাপত্যং তদারণ্যং সমাশ্রয়েৎ ॥
“শরীরে বলি পড়িতে আরম্ভ হইলে ও পৌত্রমুখ দেখিতে পাইলে গৃহস্থ বানপ্ৰস্থ হইয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে” - এইরূপ মনু স্পষ্ট সীমা নির্দেশ করিয়াছেন [মনু|৬|২] । এই সীমা পালন করিতে হইবে, কারণ মনুস্মৃতিতেই উক্ত হইয়াছে যে, প্ৰত্যেক মনুষ্য জন্মতই আপন পৃষ্ঠের উপর ঋষিগণ, পিতৃগণ ও দেবগণের তিন ঋণভার (কর্তব্য) লইয়াই উৎপন্ন হইয়াছে । তাই, বেদাধ্যয়নের দ্বারা ঋষিঋণ, পুত্রোৎপাদনের দ্বারা পিতৃঋণ এবং যজ্ঞকর্মের দ্বারা দেবঋণ এইরূপ তিনি ঋণই প্ৰথমে পরিশোধ না করিয়া মনুষ্য সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিতে পারে না । সেরূপ করিলে (অর্থাৎ সন্ন্যাস লইলে) জন্মত-প্ৰাপ্ত এই ঋণ শোধ না করিবার দরুণ সে অধোগতি প্ৰাপ্ত হইবে [মনু|৬|৩৫-৩৭ ও পূর্বপ্রকরণে প্ৰদত্ত তৈ. সং. মন্ত্র দেখ] । প্ৰাচীন হিন্দুধর্মশাস্ত্রানুসারে পিতার ঋণের পরিশোধের কালসীমা নির্দেশ করা নাই, তাহা পুত্রের ও পৌত্রেরও শোধ করিতে হইবে; এবং কাহারও ঋণ রাখিয়া মরা অত্যন্ত দুৰ্গতি বলিয়া স্বীকৃত হইয়া থাকে, এই কথা মনে করিলে জন্মতঃ প্ৰাপ্ত উক্ত বড় রকমের সামাজিক কর্তব্যকে ‘ঋণ’ বলায় আমাদের শাস্ত্রকারদিগের কি হেতু ছিল, তাহা পাঠকের সহজেই উপলব্ধি হইবে । স্মৃতিকারদিগের নির্দিষ্ট এই সীমা অনুসারে সূৰ্যবংশীয় রাজারা কাজ করিতেন, এবং পুত্র রাজ্য চালাইতে সমর্থ হইলে তাহাকে সিংহাসনে বসাইয়া (প্ৰথম হইতেই নহে) নিজে গৃহস্থাশ্ৰম হইতে নিবৃত্ত হইতেন এইরূপ কালিদাস রঘুবংশে বলিয়াছেন [রঘু|৭|৬৮] । এই নিয়ম পালন না করিয়া দক্ষপ্ৰজাপতির হৰ্যশ্ব নামক পুত্রদিগকে প্রথমে এবং তাহার পর শবলাশ্ব নামক অন্য পুত্রদিগকেও, তাহাদের বিবাহের পূর্বেই, নারদ নিবৃত্তি-মার্গের উপদেশ করিয়া ভিক্ষু করিয়া তুলিয়াছিলেন বলিয়া এই অশাস্ত্র ও গৰ্হিত আচরণ সম্বন্ধে নারদকে ভৎসনা করিয়া দক্ষপ্ৰজাপতি তাঁহাকে শাপ দিয়াছিলেন; ভাগবতে এইরূপ বৰ্ণিত হইয়াছে [ভাগ|৬|৫|৩৫-৪২] । ইহা হইতে উপলব্ধি হয় যে, আমরা গাৰ্হস্থ্য জীবন যথাশাস্ত্র সম্পূর্ণ করিয়া আমাদের ছেলেরা সন্ত্রীক কর্তা হইলে, বার্ধক্যের অনর্থক আশায় কারণে তাহাদের কর্তৃত্বের বাধা না আনিয়া নিছক্ মোক্ষপরায়ণ হইয়া আপনা হইতেই আনন্দের সহিত সংসার হইতে নিবৃত্ত হইব, ইহাই এই আশ্রম ব্যবস্থার মূল হেতু ছিল । এই হেতুই বিদুরনীতিতে বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলিয়াছেন -
উৎপাদ্য পুত্রাননৃণাংশ্চ কৃত্বা বৃত্তিং চ তেভ্যোহনুবিধায় কাঞ্চিৎ ৷
স্থানে কুমারীঃ প্রতিপাদ্য সর্ব্বা অরণ্যসংস্থোহয়ং মুনিৰ্বুভূষেৎ ॥
“গৃহস্থাশ্রমে পুত্র উৎপাদন করিয়া, তাহাদিগকে অঋণী করিয়া, তাহাদের জীবিকার কিছু সুবিধা করিয়া দিয়া, এবং কন্যাদিগকে যোগ্য পাত্রে ন্যস্ত করিয়া, পরে বানপ্ৰস্থ হইয়া সন্ন্যাস গ্রহণের ইচ্ছা করিবে” [মভা|উ|৩৬|৩৯] । আমাদিগের মধ্যে সাধারণ লোকের সংসারসম্বন্ধে বর্তমান ধারণাও প্ৰায় বিদুরের কথারই মতো । তথাপি কখন-না-কখন সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণই মনুষ্যমাত্রের পরমসাধ্য বলিয়া স্বীকৃত হওয়ায়, জাগতিক কর্মের সংসিদ্ধির জন্য স্মৃতিকারদিগের নির্দিষ্ট প্রথম তিন আশ্রমের শ্ৰেয়স্কর সীমা আস্তে আস্তে পিছাইয়া পড়িতে পড়িতে, কেহ জন্ম হইতেই, কিংবা অল্পবয়সেই জ্ঞানলাভ করিলে, তাহার এই তিন পৈঁঠায় ক্ৰমে ক্ৰমে আরোহণ করিবার আবশ্যকতা নাই - একবারেই সন্ন্যাসগ্রহণে তাহার কোন বাধা নাই – ‘ব্ৰহ্মচৰ্য্যাদেব প্ৰব্ৰজেদ্‌গৃহাদ্‌বা বনাদ্‌বা[জাবা|8] এই শেষের পৈঁঠায় আসিয়া থামিয়াছে ! এই অভিপ্ৰায়েই মহাভারতে গোকাপিলীয় সংবাদে কপিল স্যুরস্মিকে বলিয়াছেন -
শরীরপক্তিঃ কর্মাণি জ্ঞানং তু পরমা গতিঃ ৷
কষায়ে কর্মভিঃ পক্কে রসজ্ঞানে চ তিষ্ঠতি ॥ *
* (বেদান্ত-সূত্রের শাঙ্কর ভাষ্যে [৩|৪|২৪] এই শ্লোক গৃহীত হইয়াছে; তাহাতে উহার পাঠ “কষায়পক্তিঃ কর্মাণি জ্ঞানং তু পরমা গতিঃ ৷ কষায়ে কর্মভিঃ পক্কে ততো জ্ঞানং প্রবর্ততে ॥” – এইরূপ আছে । আমি এই শ্লোক, মহাভারতে যেমনটি পাইয়াছি তাহাই দিয়াছি ।)
“সকল কর্ম, শারীরিক (বিষয়াসক্তিরূপ) রোগ বহিষ্কৃত করিবার জন্য আছে, জ্ঞানই সর্বোত্তম এবং চরম গতি; কর্মের দ্বারা শরীরের কষায় কিংবা অজ্ঞানরূপ রোগ বিনষ্ট হইলে পর, রসজ্ঞানের আকাংক্ষা উৎপন্ন হয়” [শাং|২৬৯|৩৮] । সেইরূপ এই প্ৰকার মোক্ষধর্মে পিঙ্গলগীতাতেও “নৈরাশ্যং পরমং সুখং” - কিংবা “যোহসৌ প্ৰাণান্তিকো রোগস্তাং তৃষ্ণাং ত্যজতঃ সুখম্” - তৃষ্ণারূপ প্রাণান্তিক রোগ না গেলে সুখ নাই [শাং|১৭৪|৬৫ ও ৫৮] এইরূপ উক্ত হইয়াছে । জাবাল ও বৃহদারণ্যক উপনিষদের বচন ব্যতীত কৈবল্য ও নারায়ণোপনিষদেও  বর্ণিত হইয়াছে যে, “ন কর্মণা না প্ৰজয়া ন ধনেন ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ” কর্মের দ্বারা, প্ৰজার দ্বারা, অথবা ধনের দ্বারা নহে - ত্যাগের দ্বারাই (কিংবা ন্যাসের দ্বারা) কোন কোন ব্যক্তি মোক্ষ অর্জন করে – [কৈ|১|২; নারা.উ.|১২|৩ ও ৭৮ দেখ] । জ্ঞানী পুরুষকেও শেষ পৰ্যন্ত কর্মই করিতে হইবে ইহাই যদি গীতার সিদ্ধান্ত হয় তবে এই বচনগুলির কি প্রকার প্ৰয়োগ কি ভাবে লাগাইতে হইবে তাহা বলা আবশ্যক । অর্জুনের মনে এই সন্দেহ উপস্থিত হওয়াতেই অষ্টাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে “তাহা হইলে আমাকে সন্ন্যাস কি, ও ত্যাগ কি, তাহা পৃথক্‌ করিয়া বলো” [১৮|১] এইরূপ ভগবানকে অর্জুন জিজ্ঞাসা করিয়াছেন । কিন্তু ভগবান এই প্রশ্নের কি উত্তর দিলেন তাহা দেখিবার পূর্বে স্মৃতিগ্রন্থে প্রতিপাদিত এই আশ্ৰমমার্গ ব্যতীত অন্য এক তুল্যবল বৈদিক মার্গেরও বিচার এখানে কিছু করা আবশ্যক ।


23) গৃহস্থাশ্রমের মহত্ব



ব্ৰহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্ৰস্থ ও শেষে সন্ন্যাসী এইরূপ আশ্রমের পর-পর-উচ্চ চার পৈঁঠার এই যে সোপান তাহাকেই ‘স্মার্ত’ অর্থাৎ ‘স্মৃতিকারগণের প্রতিপাদিত মাৰ্গ’ বলে । কর্ম কর ও কর্ম ছাড়ো - এইরূপ উভয় প্রকারের পরস্পরবিরুদ্ধ বেদের যে আজ্ঞা তাহার সমন্বয়ার্থ স্মৃতিকারের বয়োভেদানুরূপ আশ্রমের এই ব্যবস্থা করিয়াছেন; এবং স্বরূপত কর্মসন্ন্যাসকেই যদি চরম ধ্যেয় বলিয়া মানা যায় তবে সেই ধ্যেয়সিদ্ধির জন্য স্মৃতিকারগণের অঙ্কিত জীবনের চারি পৈঁঠার এই মার্গে সাধ্যের পূর্বায়োজন অর্থাৎ সাধনরূপে কিছু অসঙ্গত বলা যায় না । জীবনের এই প্রকার ক্রমোচ্চ পৈঁঠার ব্যবস্থা দ্বারা জাগতিক ব্যবহারের লোপ না ঘটিয়া, যদিও বৈদিক কর্ম ও ঔপনিষদিক জ্ঞানকে একত্র সংযুক্ত করিতে পারা যায় সত্য; তথাপি গৃহস্থাশ্রমই অন্য তিন আশ্রমের পরিপোষক হওয়ায় [মনু|৬|৮৯] মনুস্মৃতিতে ও মহাভারতেও শেষে গৃহস্থাশ্রমেরই মাহাত্ম্য স্পষ্ট স্বীকার করা হইয়াছে -
যথা মাতরমাশ্রিত্য সর্বে জীবন্তি জন্তবঃ ৷
এবং গাৰ্হস্থ্যমাশ্ৰিত্য বৰ্তন্ত ইতরাশ্রমাঃ ॥
“মায়ের (পৃথিবীর) আশ্রয়ে সমস্ত জন্তু যেরূপ জীবিত থাকে, সেইরূপ গৃহস্থাশ্রমের আশ্রয়ে অন্য আশ্রম সকল রহিয়াছে” [শাং|২৬৮|৬; ও মনু|৩|৭৭ দেখ] । মনু তো অন্য আশ্রমগুলিকে নদী এবং গৃহস্থাশ্রমকে সাগর বালয়াছেন [মনু|৬|৯০; মভা. শাং|২৯৫|৩৯] । গৃহস্থাশ্রমের শ্রেষ্ঠত্ব এইরূপে যদি নির্বিবাদ হইল তবে গৃহস্থাশ্রম ছাড়িয়া ‘কর্ম সন্ন্যাস কর’ এইরূপ উপদেশ করায় লাভ কি ? জ্ঞানলাভের পরে গৃহস্থাশ্রমের কর্ম করা কি অসম্ভব ? অসম্ভব না হইলে জ্ঞানী পুরুষ সংসার হইতে নিবৃত্ত হইবেক এইরূপ বলার অর্থ কি ? ন্যূনাধি্ক স্বাৰ্থ বুদ্ধিতে যাহারা কাজ করে সেই সাধারণ লোকদিগের অপেক্ষা পূর্ণ নিষ্কামবুদ্ধিতে যাঁহারা কাজ করেন সেই জ্ঞানীপুরুষেরা কাজে কাজেই লোকসংগ্ৰহে অধিক সমর্থ ও যোগ্য হইয়া থাকেন । তাই, জ্ঞানের দ্বারা যখন জ্ঞানীপুরুষের এই সামৰ্থ্য পূর্ণাবস্থায় উপনীত হয় তখনও সমাজ ছাড়িয়া যাইবার স্বাধীনতা জ্ঞানীপু্রুষের জন্য রাখিলে, চাতুর্বর্ণ্যব্যবস্থা যাহার হিতের জন্য করা হইয়াছে সেই সমাজেরই তাহাতে অত্যন্ত ক্ষতি করা হয় । শরীরের সামর্থ্য না থাকিলে কেহ যদি সমাজ ছাড়িয়া বনে যায়, তো সে আলাদা কথা; তাহা দ্বারা সমাজের কোন বিশেষ হানি হইবে না । অনুমান হয় যে, সন্ন্যাসাশ্রমের সীমা বৃদ্ধকালে নির্দেশ করায় মনুর বোধ হয় এই অভিপ্রায়ই ছিল । কিন্তু এই শ্রেয়স্কর সীমা পরে ব্যবহারে বজায় থাকে নাই ইহা উপরে বলিয়াছি । 


24) ভাগবত ধর্ম



তাই, কর্ম কর ও কর্ম ছাড়ো এই উভয়বিধ বেদবচনের মিল করিবার জন্যই স্মৃতিকারগণ আশ্রমের ক্ৰমোচ্চ শ্রেণীপরম্পরা স্থাপন করিলেও এই বিভিন্ন বেদবাক্যসকলের সমন্বয় করিবার নির্বিবাদ অধিকার স্মৃতিকারদিগেরই ন্যায়, - এমনকি তাঁহাদের হইতেও অধিক - যে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের আছে, তিনিই ভাগবত ধর্মের নামে জনকাদির প্রাচীন জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক মার্গের পুনরুজ্জীবন ও পূর্ণ সমর্থন করিয়াছেন । ভাগবতধর্মে শুধু অধ্যাত্মবিচারের উপরেই নির্ভর না করিয়া বাসুদেবভক্তির সুলভ সাধনারও উপর ভর দেওয়া হইয়াছে । এই বিষয় পরে ত্ৰয়োদশ প্রকরণে সবিস্তার বিচার করা যাইবে । ভাগবতধর্ম ভক্তিমূলক হইলেও, তাহাতেও পরমেশ্বরের জ্ঞানলাভ হইলে পর কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস না লইয়া, কেবল ফলাশা ছাড়িয়া জ্ঞানীপুরুষদিগকেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ সমস্ত কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে আচরণ করিতে হইবে, জনকমার্গের এই মহৎ তত্ত্বটি বজায় আছে; তাই কর্মদৃষ্টিতে এই দুই মার্গ একই প্রকার অর্থাৎ জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক কিংবা প্ৰবৃত্তিমূলক । পরব্রহ্মেরই সাক্ষাৎ অবতার নর ও নারায়ণ ঋষি এই প্ৰবৃত্তিমূলক ধর্মের প্রথম প্ৰবর্তক এবং সেইজন্যই এই ধর্মের প্রাচীন নাম – নারায়ণীয় ধর্ম । এই দুই ঋষি পরম জ্ঞানী ও নিষ্কাম কর্মের উপদেষ্টা ছিলেন এবং নিষ্কাম কর্ম নিজেও করিতেন [মভা.উ|৪৮|২১]; এবং সেইজন্যই “প্রবৃত্তিলক্ষণশ্চৈব ধর্মো নারায়ণাত্মকঃ”, [মভা.শাং|৩৪৭|৮১], কিংবা “প্ৰবৃত্তিলক্ষণং ধৰ্ম্মং ঋষির্নারায়ণোহব্ৰবীৎ” - নারায়ণ ঋষিপ্ৰবর্তিত ধর্ম আমরণ প্ৰবৃত্তিমূলক [মভা.শাং|২১৭|২], মহাভারতে এই ধর্মের এইরূপ বৰ্ণনা করা হইয়াছে । ভাগবতে স্পষ্ট উক্ত হহয়াছে যে, ইহাই সাত্ত্বত কিংবা ভাগবতধর্ম; এবং এই সাত্ত্বত কিংবা মূল ভাগবত ধর্মের স্বরূপ ‘নৈষ্কর্ম্যলক্ষণ’ - অৰ্থাৎ নিষ্কাম প্ৰবৃত্তিমূলক [ভাগ|১|৩|৮ ও ১১|৪|৬ দেখ] । এই প্ৰবৃত্তিমার্গেরই আর এক নাম ছিল ‘যোগ’, তাহা “প্রবৃত্তিলক্ষণো যোগঃ জ্ঞানং সন্ন্যাসলক্ষণং” অনুগীতার এই শ্লোক হইতে স্পষ্ট দেখা যায় [মভা.অশ্ব|৪৩|২৫] । এইজন্যই নারায়ণের অবতার শ্ৰীকৃষ্ণ নরের অবতার অর্জুনকে গীতায় যে ধর্ম উপদেশ করিয়াছেন, গীতাতেই তাহার নাম ‘যোগ’ উক্ত হইয়াছে । 


25) ভাগবত ও স্মার্তের মূল অর্থ



ভাগবত ও স্মার্ত, দুই পথ উপাস্য-ভেদপ্রযুক্ত প্রথমে উৎপন্ন হয়, অধুনা কাহারও কাহারও এইরূপ ধারণা । কিন্তু আমাদের মতে এই ধারণা ভ্ৰান্তিমূলক । কারণ এই দুই মার্গের উপাস্য ভিন্ন হইলেও উহাদের ‘অন্তর্ভূত অধ্যাত্মজ্ঞান একই । এবং অধ্যাত্মজ্ঞানের ভিত্তি একই হইলে এই উচ্চাঙ্গ জ্ঞানে পারদর্শী প্ৰাচীন জ্ঞানী পুরুষ কেবল উপাস্যভেদের জন্য বিবাদ করিতে বসিবেন ইহা সম্ভব নহে । এই কারণেই, যাহাকেই ভক্তি কর না কেন, সেই ভক্তি একমাত্র পরমেশ্বরেই গিয়া পৌঁছায়, ভগবদ্‌গীতা [৯|১৪] ও শিবগীতা [১২|৪] এই দুই গ্রন্থে এইরূপ উক্ত হইয়াছে । নারায়ণ ও রুদ্র একই, যাহারা রুদ্রের ভক্ত তাহারা নারায়ণেরও ভক্ত এবং যাহারা রুদ্রের দ্বেষী তাহার নারায়ণেরও দ্বেষী, - এইরূপে মহাভারতের নারায়ণীয় ধর্মে তো এই দুই দেবতার অভেদ বর্ণিত হইয়াছে [মভা.শাং|৩৪১|২০-২৬ ও ৩৪২|১২৯ দেখ] । শৈব ও বৈষ্ণব এই ভেদ প্ৰাচীনকালে ছিল না এ কথা আমি বলি না । কিন্তু স্মার্ত ও ভাগবত এই দুই ভিন্ন পন্থা হইবার পক্ষে, শিব কিংবা বিষ্ণু এই উপাস্যভেদ কারণ নহে; জ্ঞানোত্তর নিবৃত্তি কিংবা প্ৰবৃত্তি, কর্ম ত্যাগ করিবে কি করিবে না, কেবল ইহারই মহত্ত্বের সম্বন্ধে মতভেদ হওয়ায় এই দুই পন্থা প্ৰথমে উৎপন্ন হয়, ইহাই আমার বলিবার তাৎপৰ্য । পরে, কালক্রমে যখন মূল ভাগবতধর্মের প্ৰবৃত্তি-মার্গ কিংবা কর্মযোগ লুপ্ত হইয়া তাহাও কেবল বিষ্ণুভক্তিমূলক অর্থাৎ বহু-অংশে নিবৃত্তিমূলক আধুনিক স্বরূপ প্রাপ্ত হইল এবং তৎপ্রযুক্ত তোমার দেবতা ‘শিব’, আমার দেবতা ‘বিষ্ণু’ রকম বৃথাভিমানে মনুষ্যেরা যখন ঝগড়া করিতে লাগিল, তখন ‘স্মার্ত’ ও ‘ভাগবত’ শব্দ অনুক্রমে ‘শৈব’ ও ‘বৈষ্ণব’ শব্দের সহিত সমানার্থক হইয়া পরিশেষে এই আধুনিক ভাগবতধর্মীদিগের বেদান্ত (দ্বৈত কিংবা বিশিষ্টাদ্বৈত) ভিন্ন হইল এবং বেদান্তেরই ন্যায় জ্যোতিষের রীতিও অর্থাৎ একাদশী করিবার ও কপালে ফোঁটা কাটিবার রীতিও স্মার্ত্তমাৰ্গ হইতে ভিন্ন হইল ! কিন্তু এইভেদ প্ৰকৃত ভেদ নাহে অৰ্থাৎ মূলগত প্ৰাচীন ভেদ নহে - ইহা ‘স্মার্ত্ত’ শব্দ হইতেই ব্যক্ত হইতেছে । ভাগবতধর্ম ভগবানই প্ৰবর্তিত করায়, তাহার উপাস্য দেবতাও যে শ্ৰীকৃষ্ণ কিংবা বিষ্ণু, তাহা কিছু আশ্চৰ্য নহে । কিন্তু ‘স্মার্ত্ত’ শব্দের ধাত্বর্থ ‘স্মৃত্যুক্ত’ - কেবল এটুকুই – হওয়ায় স্মার্তধর্মের উপাস্য দেবতা শিবই হইবেন এরূপ বলা যায় না । কারণ, মন্বাদি প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থে একমাত্র শিবেরই উপাসনা করিতে হইবে এরূপ কোন নিয়ম প্রদত্ত হয় নাই । উল্টা, বিষ্ণুরই অধিক বর্ণনা আছে; কোন কোন স্থানে গণপতি প্ৰভৃতি উপাস্য দেবতার কথাও উক্ত হইয়াছে । তাছাড়া শিব ও বিষ্ণু এই দুই দেবতা বৈদিক অর্থাৎ বেদেতেই বর্ণিত হওয়ায় ইহাদের মধ্যে একটিকেই স্মার্ত্ত বলা যুক্তিসিদ্ধ নহে । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্যকে স্মার্তমতের প্রবর্তক বলা হইয়া থাকে । কিন্তু শাঙ্করমঠে উপাস্য দেবতা - শারদা এবং শাঙ্করভাষ্যে প্ৰতিমাপূজার যেখানে যেখানে প্ৰসঙ্গ উপস্থিত হইয়াছে, সেইখানে সেইখানেই শিবলিঙ্গের নির্দেশ না করিয়া শালগ্রামের অর্থাৎ বিষ্ণুপ্ৰতিমারই উল্লেখ আচাৰ্য করিয়াছেন [বেসূ|শাংভা|১|২|৭; ১|৩|১৮ ও ৪|১|৩; ছাং|শাংভা|৮|১|১] । সেইরূপ পঞ্চায়তনপূজাও প্রথমে শঙ্করাচাৰ্যই প্ৰবর্তিত করেন, এইরূপ কথা প্রচলিত আছে । ইহা হইতে ইহাই সিদ্ধ হয় যে, প্রথম প্রথম স্মার্ত্ত ও ভাগবত পন্থার মধ্যে ‘শিবভক্ত’ কিংবা ‘বিষ্ণুভক্ত’ এই সব উপাস্যভেদের কোন ঝগড়া ছিল না; কিন্তু যাহার দৃষ্টিতে স্মৃতিগ্রন্থে সুস্পষ্টরূপে বৰ্ণিত আশ্রম-ব্যবস্থানুসারে যৌবনকালে যথাশাস্ত্ৰ সংসার করিবার পর, বার্ধক্যে সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া চতুর্থাশ্রম কিংবা সন্ন্যাস গ্রহণ চরম সাধ্য ছিল তিনিই স্মার্ত, এবং ভগবানের উপদেশ অনুসারে জ্ঞান ও উজ্জ্বল ভগবদ্‌ভক্তির সঙ্গে সঙ্গেই আমরণ গৃহস্থাশ্রমের কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে করিতে হইবে এইরূপ যিনি বুঝিতেন তিনিই ভাগবত বলিয়া উক্ত হইতেন । ইহাই এই দুই শব্দের মূল অর্থ; এবং এই হেতু এই দুই শব্দ, সাংখ্য ও যোগ কিংবা সন্ন্যাস ও কর্মযোগের সহিত অনুক্রমে সমানার্থক । ভগবানের অবতার-কাৰ্য্যের কথা ধরিয়াই বলো, কিংবা জ্ঞানযুক্ত গাৰ্হস্থ্যধর্মের মহত্বের প্ৰতি লক্ষ্য করিয়াই বলো, সন্ন্যাসাশ্রম লুপ্তপ্রায় হইয়াছিল; এবং কলি-বর্জিতের প্রকরণে অর্থাৎ কলিযুগে যে সকল বিষয় শাস্ত্ৰে নিষিদ্ধ বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে তাহাদের মধ্যে সন্ন্যাস পরিগণিত হইয়াছিল । [নির্ণয়সিন্ধু, তৃতীয় পরিচ্ছেদ, কলিবর্জ্য প্রকরণ দেখ । উহাতে “অগ্নিহোত্ৰং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্ ৷ দেবরাচ্চ সুতোৎপত্তিঃ কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ ॥” এবং “সন্ন্যাসশ্চন কর্তব্যো ব্ৰাহ্মণেন বিজানতা” ইত্যাদি স্মৃতিবচন প্রদত্ত হইয়াছে । ইহার অর্থ, - অগ্নিহোত্র, গোবধ, সন্ন্যাস, শ্রাদ্ধপ্রসঙ্গে মাংস ভক্ষণ ও নিয়োগ, কলিযুগে নিষিদ্ধ । তন্মধ্যে সন্ন্যাসের নিষিদ্ধতাও শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য পূৰ্ব হইতে ছাঁটিয়া ফেলিয়াছেন ।] আবার জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্ৰবর্তকেরা কাপিল সাংখ্যের মত স্বীকার করিয়া, সংসার হইতে বাহির হইয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ ব্যতীত মোক্ষ নাই এই মত বিশেষরূপে প্ৰচলিত করেন । স্বয়ং বুদ্ধ ত যৌবনেই রাজ্য ও স্ত্রীপুত্র ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস-দীক্ষা গ্ৰহণ করিয়াছিলেন; ইহা ইতিহাসে প্ৰসিদ্ধ আছে । 


26) গীতাতে কর্মযোগ অর্থাৎ ভাগবতধর্মই প্রতিপাদ্য



জৈন ও বৌদ্ধ মত শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য খণ্ডন করিলেও জৈন ও বৌদ্ধের যে সন্ন্যাসধর্ম বিশেষরূপে প্ৰচলিত করিয়াছিলেন তাহাই শ্রৌতস্মার্ত সন্ন্যাস বলিয়া আচাৰ্য বজায় রাখিয়াছেন এবং গীতায় সেই সন্ন্যাসধর্মই প্ৰতিপাদ্য বিষয়, গীতার এইরূপ অৰ্থও তিনি বাহির করিয়াছেন । কিন্তু বস্তুত গীতা স্মার্তমার্গের গ্ৰন্থ নহে; সাংখ্য কিংবা সন্ন্যাসমাৰ্গ হইতেই গীতার আরম্ভ হইলেও পরে সিদ্ধান্তপক্ষে প্রবৃত্তিমূলক ভাগবতধর্মই তাহাতে প্ৰতিপাদ্য হইয়াছে । ইহা স্বয়ং মহাভারতকারের বচন এবং প্রথম প্ৰকরণেই আমি তাহা দিয়াছি । এই দুই পন্থাই বৈদিক হওয়ায় সৰ্ব্বাংশে না হউক বহুলাংশে উভয়ের সমন্বয় করিতে পারা যায় । কিন্তু এইরূপ সমন্বয় করা এক কথা; এবং গীতায় সন্ন্যাসমাৰ্গই প্ৰতিপাদ্য হইয়াছে, কর্মমাৰ্গকে যদি কোথাও মোক্ষপ্ৰদ বলা হইয়া থাকে তো সে শুধু অর্থবাদ কিংবা ফাঁকা স্তুতিমাত্ৰ, এইরূপ বলা আর এক কথা । রুচিবৈচিত্ৰ্যপ্রযুক্ত ভাগবত ধর্মাপেক্ষা স্মার্তধর্মই কাহার বেশী মিষ্ট লাগিবে না কিংবা কর্মসন্ন্যাস পক্ষে সাধারণতঃ যে সকল কারণ বলা হইয়া থাকে, তাহাই যে কেহ অধিক বলবত্তর মনে করিবে না তাহা কে বলিতে পারে ? উদাহরণ যথা – 
স্মার্ত কিংবা সন্ন্যাসধর্মই যে শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের মান্য ছিল, অন্য সমস্ত মাৰ্গ তিনি অজ্ঞানমূলক বলিয়া মনে করিতেন, এ বিষয়ে কাহারও সন্দেহ নাই । কিন্তু সেই জন্যই যে গীতার ভাবাৰ্থও তাঁহাই হইবে তাহা বলিতে পারা যায় না । গীতার সিদ্ধান্ত তোমার মানা না হয়, তুমি তাহা স্বীকার করিও না । কিন্তু নিজের জেদ বজায় রাখিবার জন্য “এই জগতে জীবনের দুই প্রকার স্বতন্ত্র মোক্ষপ্ৰদ মাৰ্গ কিংবা নিষ্ঠা আছে” এইরূপ যাহা গীতার আরম্ভে উক্ত হইয়াছে তাহার অর্থ “সন্ন্যাসনিষ্ঠাই একমাত্ৰ প্ৰকৃত ও শ্রেষ্ঠ মাৰ্গ” এরূপ করা সঙ্গত নহে । গীতায় বর্ণিত এই দুই মাৰ্গ বৈদিক ধর্মে জনক-যাজ্ঞবল্ক্যের পূর্ব হইতেই স্বতন্ত্রভাবে চলিয়া অ্যাসিয়াছে । তন্মধ্যে জনকের ন্যায় সমাজের ধারণপোষণ করিবার অধিকার ক্ষাত্ৰধর্মানুসারে, বংশপরম্পরাক্রমে কিংবা নিজ সামর্থ্যে যিনি প্ৰাপ্ত হইতেন তিনি জ্ঞানলাভের পরেও আপন কর্ম নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে থাকিয়া জগতের কল্যাণসাধনেই নিজের সমস্ত জীবিতকাল ক্ষেপণ করিতেন, এইরূপ পাওয়া যায় । সমাজের এই অধিকারের প্রতি দৃষ্টি করিয়াই “সুখং জীবন্তি মুনয়ো ভৈক্ষ্যবৃত্তিং সমাশ্ৰিতাঃ” [শাং|১৭৮|১১] - অরণ্যবাসী মুনি আনন্দে ভিক্ষাবৃত্তি স্বীকার করিয়া থাকেন - আবার, “দণ্ড এব হি রাজেন্দ্ৰ ক্ষত্রধর্মো ন মুণ্ডনম্‌” [শাং|২৩|৪৬] - দণ্ডের দ্বারা লোকের ধারণপোষণ করাই ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম, মুণ্ডন করাইয়া লওয়া নহে - এইরূপ মহাভারতে অধিকারভেদে দুয়েরই বর্ণনা আছে । কিন্তু ইহা হইতে এমনও বুঝিতে হইবে না যে, কেবল প্ৰজাপালনের অধিকারী ক্ষত্ৰিয়েরই নিজের অধিকার হেতুই কর্মযোগ বিহিত ছিল । যে, যে কর্ম করিবার অধিকারী, জ্ঞানলাভের পরেও তাহাকে সেই কর্ম করিতে হইবে ইহাই কর্মযোগের উক্ত বচনের প্রকৃত ভাবাৰ্থ; এবং এই কারণেই “এষা পূর্বতরা বৃত্তি ব্ৰাহ্মণস্য বিধীয়তে” [শান্তি|২৩৭] - জ্ঞানলাভের পর ব্ৰাহ্মণও আপন অধিকারানুসারে যাগযজ্ঞাদি কর্ম প্ৰাচীন কালে বজায় রাখিতেন - এইরূপ মহাভারতে উক্ত হইয়াছে । মনুস্মৃতিতেও সন্ন্যাসাশ্রমের বদলে সমস্ত বর্ণের পক্ষে বৈদিক কর্মযোগই বিকল্পে বিহিত বলিয়া ধৃত হইয়াছে [মনু|৬|৮৬-৯৬] । ভাগবত ধর্ম কেবল ক্ষত্ৰিয়ের জন্যই, এরূপ কোথাও উক্ত হয় নাই; উল্টা, স্ত্রীশূদ্রাদি সমস্ত, লোকের উহা সুলভ এইরূপে তাহার মাহাত্ম্য কীর্তিত হইয়াছে [গী|৯|৩২] । মহাভারতে তুলাধার (বৈশ্য) ও ব্যাধ (বহেলিয়া) এই ধর্মই আচরণ করিত, এবং তাহারা ব্ৰাহ্মণদিগকেও ঐধর্ম উপদেশ দিয়াছে এইরূপ আখ্যায়িকা আছে [শাং|২৬১; বন|২১৫] । নিষ্কাম কর্মযোগের আচরণ করিতে অগ্রসর পুরুষদিগের যে সকল উদাহরণ ভাগবত ধর্মগ্রন্থে প্রদত্ত হয় তাহা কেবল জনকশ্ৰীকৃষ্ণআদি ক্ষত্রিয়দেরই নহে - তাহাতে বসিষ্ঠ, জৈগীষব্য ওব্যাস প্রভৃতি জ্ঞানী ব্ৰাহ্মণদিগেরও সমাবেশ করা কইয়া থাকে । 


27) গীতার কর্মযোগ এবং মীমাংসকদের কর্মযোগের প্রভেদ



গীতায় কর্মমার্গই প্ৰতিপাদ্য হইলেও শুধু অর্থাৎ জ্ঞানবর্জিত কর্ম করিবার মার্গকে মোক্ষপ্ৰদ বলিয়া গীতা স্বীকার করেন না এ কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই । জ্ঞানবর্জিত কর্ম করিবারও দুই প্ৰকারভেদ আছে । এক, দম্ভের সহিত কিংবা আসুরী বুদ্ধিতে কর্ম করা এবং অন্যটি শ্রদ্ধার সহিত । তন্মধ্যে দম্ভের মাৰ্গ কিংবা আসুরী মাৰ্গকে গীতা [গী|১৬|১৬ ও ১৭|২৮], এবং মীমাংসকেরাও গৰ্হিত ও নরকপ্ৰদ বলিয়া স্বীকার করেন; ঋগ্‌বেদেও অনেক স্থানে শ্রদ্ধার মাহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে [ঋ|১০|১৫১; ৯|১১৩|২ ও ২|১২|৫] । কিন্তু দ্বিতীয় অর্থাৎ জ্ঞানব্যতীত অথচ শাস্ত্রের উপর শ্রদ্ধা রাখিয়া কর্ম করিবার মাৰ্গসম্বন্ধে মীমাংসকেরা বলেন যে, পরমেশ্বর-স্বরূপের যথার্থ জ্ঞান না হইলেও শাস্ত্রের উপর বিশ্বাস রাখিয়া কেবল শ্ৰদ্ধার সহিত যাগযজ্ঞাদি কর্ম আমরণ করতে থাকিলে শেষে মোক্ষলাভই হয় । মীমাংসকদিগের এই মাৰ্গ যে কর্মকাণ্ডরূপে বহু প্ৰাচীনকাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে তাহা পূর্ব প্ৰকরণে বলিয়াছি । বেদসংহিতা ও ব্রাহ্মণসমূহে সন্ন্যাসাশ্রম অবশ্যকর্তব্য বলিয়া কোথাও উক্ত হয় নাই । বরঞ্চ, গৃহস্থাশ্রমে থাকিয়াই যে মোক্ষলাভ হয় এইরূপ বেদের স্পষ্ট বিধান থাকার কথা জৈমিনি বলিয়াছেন [বেসূ|৩|৪|১৭-২০ দেখ]; তাঁহার এই উক্তি কিছু ভিত্তিহীনও নহে । কারণ, কর্মকাণ্ডের এই প্ৰাচীন মাৰ্গকে গৌণ বলিয়া স্বীকার করা উপনিষদেই প্ৰথমে আরম্ভ হইয়াছে, দেখা যায় । উপনিষদ্‌ বৈদিক হইলেও যে সংহিতা ও ব্ৰাহ্মণের পরবর্তী, তাহা উপনিষদের বিষয়-প্ৰতিপাদন হইতেই প্ৰকাশ পায় । ইহার অর্থ এরূপ নহে যে পরমেশ্বরের জ্ঞান তৎপূর্বে হয়ই নাই । হাঁ; মোক্ষলাভের জন্য, জ্ঞানোত্তর বৈরাগ্যের দ্বারা কর্মসন্ন্যাস করা বিধেয়, এই মত উপনিষৎকালেই অবশ্য প্ৰথমে আমলে আসে; এবং তদনন্তর সংহিতা ও ব্রাহ্মণে বর্ণিত কর্মকাণ্ডের গৌণত্ব আসিয়াছে । তৎপূর্বে কর্মকেই প্রধান বলিয়া মানা হইত । উপনিষদের কালে বৈরাগ্যযুক্ত জ্ঞানের অর্থাৎ সন্ন্যাসমার্গের এইরূপ প্রাধান্য হইতে থাকিলে, যাগযজ্ঞাদি কর্মের প্ৰতি কিংবা চাতুর্বর্ণ্যধর্মেরও প্রতি জ্ঞানীপুরুষ উপেক্ষা করিতে লাগিলেন; এবং সেই অবধিই লোকসংগ্ৰহ করা আমাদের কর্তব্য এই ধারণা মন্দীভূত হইল । স্মৃতিকারেরা স্বস্ব গ্রন্থে, গৃহস্থাশ্রমে যাগযজ্ঞাদি শ্রৌত কিংবা চাতুৰ্বর্ণ্যের স্মার্তকর্ম করাই কর্তব্য, এইরূপ বলিয়া গৃহস্থাশ্রমের মাহাত্ম্য কীর্তন করিয়াছেন সত্য; কিন্তু স্মৃতিকারদিগের মতেও শেষে বৈরাগ্য বা সন্ন্যাসাশ্রমই শ্ৰেষ্ঠ হওয়ায়, উপনিষদের জ্ঞানপ্রভাবে কর্মকাণ্ডের যে গৌণত্ব আসিয়াছিল, স্মৃতিকারদিগের আশ্রমব্যবস্থায় সেই গৌণত্ব হ্রাস হইতে পারে নাই । এই ব্যবস্থায় জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে কাহাকেই গৌণত্ব না দিয়া, ভক্তির সহিত এই দুয়েরই সমন্বয় করিবার জন্য গীতা প্ৰবৃত্ত হইলেন । জ্ঞানব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না এবং যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা বড়জোর স্বর্গপ্রাপ্তি হয়, উপনিষদের এই সিদ্ধান্ত গীতার মান্য [মুণ্ড|১|২|১০; গী|২|৪১-৪৫] । কিন্তু ইহাও গীতার সিদ্ধান্ত যে, সৃষ্টিক্রম চলিত রাখিতে হইলে যজ্ঞ কিংবা কর্মচক্রকেও বজায় রাখা আবশ্যক, কর্ম ত্যাগ করা নিছক পাগ্‌লামি বা মূর্খতা । তাই যাগযজ্ঞাদি শ্রৌত কর্ম কিংবা চাতুর্বর্ণ্যাদি ব্যবহারিক কর্ম অজ্ঞানপূর্বক শ্ৰদ্ধার সহিত না করিয়া জ্ঞানবৈরাগ্যযুক্ত বুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া কর; তাহা হইলে এই চক্রও বিস্খলিত হইবে না, এবং তোমার অনুষ্ঠিত কর্ম মোক্ষের প্রতিবন্ধকও হইবে না, এইরূপ গীতার উপদেশ । জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ডের (সন্ন্যাস ও কর্মের) সমন্বয় করিবার গীতার এই নৈপুণ্য স্মৃতিকারদিগের অপেক্ষা যে অধিক সরস তাহা আর বলিতে হইবে না । কারণ, ব্যষ্টিরূপ আত্মার কল্যাণ একটুও কম না করিয়া তাহার সঙ্গে জগতের সমষ্টিরূপ আত্মার কল্যাণও গীতামার্গের দ্বারা সংসাধিত হয় । কর্ম অনাদি ও বেদপ্ৰতিপাদিত হওয়ায় তোমার জ্ঞান না হইলেও শ্রদ্ধার সহিত তাহা করাই আবশ্যক, এইরূপ মীমাংসক বলেন । অনেকগুলি উপনিষৎকার (সকলে নহে) কর্মকে গৌণ স্থির করিয়া বলেন যে, বৈরাগ্যের দ্বারা কর্ম ত্যাগ করা কর্তব্য; নিদানপক্ষে তাঁহাদের সেই দিকে যে ঝোঁক্‌ তাহা মানিতে বাধা নাই । এবং স্মৃতিকার বয়োভেদ অর্থাৎ আশ্ৰমব্যবস্থা দ্বারা উক্ত দুই মতের এইরূপ সমন্বয় করেন যে, পূর্ব আশ্রমে এই সকল কর্ম করিতে থাকিয়া চিত্তশুদ্ধি হইলে পর বার্ধক্যে বৈরাগ্যের দ্বারা সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া সন্ন্যাস লাইবে । কিন্তু গীতার পন্থা এই তিন পন্থা হইতে ভিন্ন । জ্ঞান ও কাম্যকর্মের মধ্যে বিরোধ থাকিলেও, জ্ঞান ও নিষ্কাম কর্মের মধ্যে কোনই বিরোধ নাই; তাই, নিষ্কামবুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম সর্বদা করিরা যাও, তাহা কখনও ছাড়িও না, গীতা এইরূপ বলেন । এখন এই চারি মতের তুলনা করিলে দেখা যায় যে, জ্ঞান হইবার পূর্বে কর্মের আবশ্যকতা আছে ইহা সকলেরই মান্য কিন্তু এইরূপ অবস্থায় শ্রদ্ধার সহিত অনুষ্ঠিত কর্মের ফল স্বৰ্গ ছাড়া আর কিছু নহে, এইরূপ উপনিষদে ও গীতায় উক্ত হইয়াছে । ইহার পরে অর্থাৎ জ্ঞান-লাভ হইলে পর কর্ম করিবে কি করিবে না এই সম্বন্ধে উপনিষৎকারদিগের মধ্যেও মতভেদ আছে । জ্ঞানের দ্বারা সমস্ত কাম্যবুদ্ধির হ্রাস হইলে পর যে ব্যক্তি মোক্ষের অধিকারী হইয়াছেন তাঁহার কেবল স্বর্গপ্রাপ্তিকর কাম্য কর্ম করিবার কোন প্রয়োজনই থাকে না এইরূপ কোন কোন উপনিষৎকার বলেন; কিন্তু ঈশাবাস্যাদি অন্য কতকগুলি উপনিষৎ, মৃত্যুলোকের ব্যবহার বজায় রাখিবার জন্য কর্ম করাই আবশ্যক, এইরূপ প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । উপনিষদে বর্ণিত এই দুই মার্গের মধ্যে দ্বিতীয় মাৰ্গই গীতার প্রতিপাদ্য, ইহা স্পষ্ট দেখা যায় [গী|৫|২] । কিন্তু মোক্ষের অধিকারী জ্ঞানী পুরুষ লোকসংগ্ৰহাৰ্থ নিষ্কামবুদ্ধিতে সমস্ত কর্ম করিবেক এইরূপ বলিলেও, যে যাগযজ্ঞাদি কর্মের স্বৰ্গপ্ৰাপ্তি ছাড়া অন্য কোন ফল নাই সেই কর্ম তিনি কেনই বা করিবেন এই প্রশ্ন এই স্থানে স্বভাবতই উপস্থিত হয় । তাই ১৮শ অধ্যায়ের আরম্ভে ঐ প্রশ্নই উপস্থিত করিয়া, ভগবান স্পষ্ট নির্ণয় করিয়া দিয়াছেন যে, “যজ্ঞ, দান, তপ” প্ৰভৃতি কর্ম সর্বদাই চিত্তশুদ্ধিকারক অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধি উৎপাদক ও বর্ধক হওয়া প্ৰযুক্ত “এই সকল কর্মও” (এতান্যপি) অন্য নিষ্কাম কর্মেরই ন্যায় লোকসংগ্ৰহাৰ্থ, ফলাশা ও আসক্তি ত্যাগ করিয়া জ্ঞানীপুরুষের নিয়ত করা কর্তব্য [গী|১৮|৬] । পরমেশ্বরে সমর্পণ করিয়া সমস্ত কর্ম এইরূপ নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিতে থাকিলে, ব্যাপকার্থে ইহাই এক বড়রকমের যজ্ঞ হইয়া যায়; এবং তাহার পর, এই যজ্ঞের জন্য অনুষ্ঠিত কর্ম বন্ধনস্বরূপ হয় না [গী|৪|২৩]; কিন্তু সমস্ত কর্মই নিষ্কাম বুদ্ধিতে অনুষ্ঠিত হওয়ায়, যজ্ঞ হইতে স্বৰ্গপ্ৰাপ্তিরূপ যে বন্ধনাত্মক ফল পাইবার কথা ছিল তাহাও পাওয়া যায় না, এবং এই সকল কর্ম মোক্ষের অন্তরায় হইতে পারে না । মোদ্দা কথা, মীমাংসকদিগের কর্মকাণ্ড গীতায় বজায় রাখা হইলেও এরূপ কৌশলে বজায় রাখা হইয়াছে যে তাহার দরুন স্বৰ্গে গমনাগমন না ঘটিয়া সমস্ত কর্মই নিষ্কাম বুদ্ধিতে অনুষ্ঠিত হওয়ায় শেষে মোক্ষলাভ না হইয়া যায় না । মীমাংসকদিগের কর্মমার্গ এবং গীতার কর্মযোগের মধ্যে ইহাই গুরুতর ভেদ - দুই এক নহে, ইহা মনে রাখিতে হইবে ।


28) স্মার্ত সন্ন্যাস ও ভাগবত সন্ন্যাসের প্রভেদ



ভগবদ্‌গীতায় প্রবৃত্তিমূলক ভাগবতধর্ম কিংবা কর্মযোগই যে প্ৰতিপাদ্য, এবং এই কর্মযোগে ও মীমাংসকদিগের কর্মকাণ্ডে যে কি প্ৰভেদ তাহা এখানে বলিয়াছি । এক্ষণে গীতার কর্মযোগ এবং জ্ঞানকাণ্ডকে ধরিয়া স্মৃতিকারদিগের বর্ণিত আশ্রমব্যবস্থার মধ্যে প্ৰভেদ কি, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে তাহার একটু বিচার করিব । এই ভেদ অতীব সূক্ষ্ম এবং বাস্তবিক বলিতে হইলে এই সম্বন্ধে বাদবিতণ্ডা করিবার কোন কারণ নাই । জ্ঞানলাভ হওয়া পর্যন্ত চিত্তশুদ্ধির জন্য প্রথম দুই (ব্রহ্মচারী ও গৃহস্থ) আশ্রমের কাৰ্য সকলেরই করা কর্তব্য ইহা উভয় পক্ষেরই মান্য । পূর্ণ জ্ঞান হইলে পর কার্য করিবেক কিংবা সন্ন্যাস লইবেক এইটুকুই যা মতভেদ । কিন্তু এইরূপ জ্ঞানী পুরুষ যে কোন সমাজে অল্পই দেখা যায়; তাই, এই অল্পসংখ্যক জ্ঞানী লোকের কর্ম করা বা না করা একই, সে সম্বন্ধে বিশেষ দাপাদাপি করিবার আবশ্যকতা নাই, এইরূপ কেহ কেহ মনে করিতে পারেন । কিন্তু এ কথা বলা ঠিক নহে । কারণ জ্ঞানী পুরুষের আচরণ অন্য সমস্ত লোক প্ৰমাণ বলিয়া মানে এবং নিজের চরম সাধ্য অনুসারে মনুষ্য প্রথম হইতেই আপন আচরণের গতিপথ নির্ধারণ করায় “জ্ঞানী পুরুষের কি করা কর্তব্য’ এই প্রশ্ন লৌকিক দৃষ্টিতে একটা বড় প্রশ্ন হইয়া পড়ে । জ্ঞানীপুরুষ শেষে সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবেক স্মৃতিগ্রন্থে ইহা বলা হইয়াছে সত্য; কিন্তু স্মার্তমার্গের অনুসারেই এই নিয়মের ব্যতিক্রমও আছে তাহা উপরে বলা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য জনককে ব্ৰহ্মজ্ঞানের অনেক উপদেশ করিয়াছেন; কিন্তু তিনি জনককে কোথাও বলেন নাই যে, “তুমি এখন রাজ্য ছাড়িয়া সন্ন্যাস গ্রহণ কর” । বরং, যে জ্ঞানী পুরুষ জ্ঞানোত্তর সংসার ত্যাগ করেন, সংসার তাঁর ভাল লাগে না (ন কাময়ন্তে) বলিয়াই তিনি ত্যাগ করেন – এইরূপ বলিয়াছেন [বৃ|৪|৪|২২] । ইহা হইতে বৃহদারণ্যকের এই অভিপ্রায় প্ৰকাশ পায় যে, জ্ঞানোত্তর সন্ন্যাস গ্ৰহণ করা বা না করা প্ৰত্যেকের ইচ্ছাধীন অর্থাৎ বৈকল্পিক বিষয়, ব্ৰহ্মজ্ঞান ও সন্ন্যাসের মধ্যে কোন নিত্য সম্বন্ধ নাই; এবং বেদান্তসূত্রে বৃহদারণ্যক-উপনিষদের এই বচনের অর্থ ঐরূপই করা হইয়াছে [বেসূ|৩|৪|১৫] । জ্ঞানোত্তর কর্মসন্ন্যাস ব্যতীত মোক্ষলাভ হইতে পারে না, ইহা শঙ্করাচাৰ্য্যেয় স্থির সিদ্ধান্ত; এই জন্য আপন ভাষ্যে তিনি সমস্ত উপনিষদ এই সিদ্ধান্তের অনুকুল দেখাইবার জন্য চেষ্টা করিায়াছেন । তথাপি জনকাদির ন্যায় জ্ঞানোত্তরও যথাধিকার আমরণ কর্ম করিবার কোন বাধা নাই ইহা শ্রীশঙ্করাচার্যও স্বীকার করিয়াছেন [বেসূ|শাংভা|৩|৩|৩২; এবং গী|শাংভা|২|১১ ও ৩|২০ দেখ] । ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, সন্ন্যাস কিম্বা স্মার্তমার্গেও জ্ঞানোত্তর কর্ম সম্পূর্ণই ত্যাজ্য বলা যায় না; কোন কোন জ্ঞানী পুরুষকে ব্যতিক্ৰমস্থল মানিয়া, এই মার্গেও যথাধিকার কর্ম করিবার স্বাধীনতা দেওয়া হইয়াছে । এই ব্যতিক্রমের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করিয়া গীতা বলেন যে, চাতুর্বর্ণ্যবিহিত কর্ম জ্ঞানলাভ হবার পরেও লোকসংগ্ৰহাৰ্থ কর্তব্য বলিয়া নিষ্কাম বুদ্ধিতে প্ৰত্যেক জ্ঞানী পুরুষের করা কর্তব্য । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, গীতাধর্ম ব্যাপক হইলেও তাহার তত্ত্ব সন্ন্যাসমার্গীদিগের দৃষ্টিতেও নিৰ্দোষ; এবং বেদান্তসূত্র স্বতন্ত্রভাবে পাঠ করিলে বুঝা যাইবে যে, উহাতেও জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগ সন্ন্যাসের বিকল্প বলিয়া গৃহীত হইয়াছে [বেসূ|৩|৪|২৬; ৩|৪|৩২-৩৫] । [বেদান্তসূত্রের এই অধিকরণের অর্থ শাঙ্করভাষ্যে একটু ভিন্নরূপে করা হইয়াছে । কিন্তু ‘বিহিতত্বাচ্চাশ্রমকর্মাপি’ [৩|৪|৩২] ইহার অর্থ আমাদের মতে, “জ্ঞানীপুরুষ আশ্রমকর্মও করিলেও উত্তম, কারণ উহা বিহিত” । মোদ্দাকথা, জ্ঞানীপুরুষ কর্ম করুন বা না করুন, দুই পক্ষই আমার মতে বেদান্তসূত্রে স্বীকৃত হইয়াছে ।]


29) উভয়ের একতা



নিষ্কামবুদ্ধিতেই হউক যদি আমরণ কর্মই করিতে হয় তবে স্মৃতিগ্রন্থে কথিত কর্মত্যাগীরূপ চতুর্থাশ্রম কিংবা সন্ন্যাসাশ্রমের কি অবস্থা হইবে তাহা এক্ষণে বলা আবশ্যক । অর্জুন মনে ভাবিয়াছিলেন যে, ভগবান কখন-না-কখন কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ ব্যতীত মোক্ষলাভ হয় না বলিবেনই; এবং তখন ভগবানের মুখেই যুদ্ধ ছাড়িয়া দিবার পক্ষে আমি স্বাধীনতা পাইব । কিন্তু যখন অর্জুন দেখিলেন যে, ১৭শ অধ্যায়ের শেষ পৰ্যন্ত ভগবান কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাসাশ্রমের একটি কথাও বলিলেন না, সর্বক্ষণ এই উপদেশই করিলেন যে, ফলের আশা ত্যাগ কর, তখন ১৮শ অধ্যায়ের আরম্ভে অর্জুন ভগবানকে প্রশ্ন করিলেন – “তবে, সন্ন্যাস ও ত্যাগের ভেদ কি তাহা আমাকে আবার বলো” । অর্জুনকে এই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান বলিতেছেন, “অর্জুন, এতক্ষণ তোমাকে যে কর্মযোগের কথা বলিয়াছি তাহার মধ্যে সন্ন্যাস নাই এরূপ যদি তোমার ধারণা হয় তবে তাহা ভুল । কর্মযোগী পুরুষ সমস্ত কর্মের ‘কাম্য’ অর্থাৎ আসক্তবুদ্ধিতে কৃত কর্ম এবং ‘নিষ্কাম’ অর্থাৎ আসক্তি ছাড়িয়া কৃত কর্ম এই দুই ভেদ করেন । (ইহাকেই মনুস্মৃতি ২৩|৮৯-এ অনুক্রমে ‘প্রবৃত্ত’ ও ‘নিবৃত্ত’ নাম দিয়াছেন) । তন্মধ্যে ‘কাম্য’ বর্গের সমস্ত কর্ম কর্মযোগী একেবারেই ত্যাগ করেন, অর্থাৎ সেই সমস্ত কর্মের ‘সন্ন্যাস’ করেন । বাকী রহিল ‘নিষ্কাম’ কিংবা ‘নিবৃত্ত’ কর্ম; এই নিষ্কাম কর্ম কর্মযোগী করেনই তো, কিন্তু সেই সমস্তের মধ্যে তিনি ফলাশা সর্বথাই ত্যাগ করিয়া থাকেন । সারকথা, কর্মযোগমার্গেও ‘সন্ন্যাস’ ও ‘ত্যাগ’ হইতে অব্যাহতি হইল কৈ ? স্মার্তমাৰ্গী স্বরূপতঃ কর্মসন্ন্যাস করিয়া থাকেন, আর কর্মমার্গের যোগী তাহা না করিয়া কর্মের ফলাশা সন্ন্যাস করেন । সন্ন্যাস দুই পক্ষেই বজায় আছে [গী|১৮|১-৬ এর উপর আমার টীকা দেখ] । সমস্ত কর্ম যিনি পরমেশ্বরে অর্পণপূর্বক নিষ্কামবুদ্ধিতে করেন, গৃহস্থাশ্রমী হইলেও তাঁহাকে ‘নিত্যসন্ন্যাসীই’ বলিতে হইবে [গী|৫|৩], ইহাই ভাগবত ধর্মের মুখ্য তত্ত্ব; এবং ভাগবত পুরাণেও সমস্ত আশ্ৰমধর্মের কথা প্ৰথমে বলিয়া, শেষে নারদ যুধিষ্ঠিরকে এই তত্ত্বই উপদেশ করিয়াছেন । বামন পণ্ডিত গীতাসম্বন্ধীয় স্বলিখিত টীকা যথার্থদীপিকায় [১৮|২] যাহা বলিয়াছেন তদনুসারে “শিখা বোডুনী তোডিলা দোরা” - মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী কিম্বা হস্তে দণ্ড গ্রহণ করিয়া ভিক্ষা মাগিতে লাগিল, অথবা সমস্ত কর্ম ত্যাগ করিয়া অরণ্যে গিয়া বাস করিল, এইরূপ করিলেই যে সন্ন্যাস হয় তাহা নহে । সন্ন্যাস ও বৈরাগ্য বুদ্ধির ধর্ম; দণ্ড, শিখা বা পৈতার নহে । বুদ্ধির অর্থাৎ জ্ঞানের ধর্ম নহে, দণ্ড আদিরই ধর্ম যদি বলো, তবে যে ব্যক্তি রাজচ্ছত্র কিংবা ছত্ৰদণ্ড হস্তে ধারণ করে তাহাদেরও সন্ন্যাসীর মোক্ষলাভ করিতে হয়; জনক-সুলভ-সংবাদে এইরূপই উক্ত হইয়াছে -
ত্ৰিদণ্ডাদিষু যদ্যস্তি মোক্ষো জ্ঞানে ন কস্যচিৎ ৷
ছত্রাদিষু কথং ন স্যাৎ তুল্যহেতৌ পরিগ্ৰহে ॥ [শাং|৩২০|২]
কারণ, হস্তে দণ্ডপরিগ্রহে এই মোক্ষের হেতু উভয় স্থানে একই । তাৎপৰ্য, - কায়িক, বাচিক ও মানসিক সংযমই প্রকৃত ত্রিদণ্ড [মনু|১২|২০]; এবং কাম্যবুদ্ধির সন্ন্যাসই প্ৰকৃত সন্ন্যাস [গী|১৮|২]; এবং ভাগবতধর্মে উহা হইতে যেরূপ নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না [গী|৬|২] সেইরূপই বুদ্ধি স্থির রাখিবার কর্ম কিংবা ভোজনাদি কর্ম হইতেও সাংখ্য মার্গে শেষ পৰ্যন্ত নিষ্কৃতি পাওয়া যায় না । আবার ত্ৰিদণ্ডী কিংবা কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস কর্মযোগমার্গে নাই বলিয়া ঐ মার্গ স্মৃতিবিরুদ্ধ কিংবা ত্যাজ্য, এইরূপ বৃথা সন্দেহ করিয়া গেরুয়া বস্ত্র কিংবা সাদা বস্ত্রের জন্য ঝগড়া করিতে বসায় লাভ কি ?

ভগবান্‌ খুব নিরভিমান বুদ্ধিতে ইহাই বলিয়াছেন –
একং সাংখ্যং চ যোগং চ যঃ পশ্যতি স পশ্যতি ৷
সাংখ্য ও (কর্ম) যোগ মোক্ষদৃষ্টিতে দুই নহে, একই, ইহা যিনি জানিয়াছেন তিনিই পণ্ডিত [গী|৫|৫] । এবং মহাভারতেও, একান্তিক অর্থাৎ ভাগবত ধর্ম সাংখ্যধর্মের সমানই, “সাংখ্যযোগেন তুল্যে হি ধর্ম একান্ত-সেবিতঃ” [শাং|৩৪৮|৭৪] - এইরূপ উক্ত হইয়াছে । মোদ্দা কথা, পরার্থে সমস্ত স্বার্থের লয় করিয়া, আপনি আপনি যোগ্যতানুরূপ ব্যবহারে প্রাপ্ত সমস্ত কর্মই সর্বভূতহিতার্থ আমরণ নিষ্কামবুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া করিতে থাকাই প্রকৃত বৈরাগ্য কিংবা ‘নিত্য সন্ন্যাস’ [৫|৩]; এই কারণেই কর্মযোগমার্গে স্বরূপতঃ কর্মের সন্ন্যাস করিয়া কখনই ভিক্ষা মাগে না । কিন্তু বাহ্যাচরণ দ্বারা দেখিলে এইরূপ ভেদ প্রতীয়মান হইলেও সন্ন্যাস ও ত্যাগের প্রকৃত তত্ত্ব কর্মযোগমার্গেও বজায় থাকে । তাই, স্মৃতিগ্রন্থের আশ্রম ব্যবস্থা ও নিষ্কাম কর্মযোগের মধ্যে বিরোধ নাই, ইহাই গীতার শেষ সিদ্ধান্ত । 


30) মনুস্মৃতির বৈদিক কর্মযোগের এবং ভাগবতধর্মের প্রাচীনতা



উপরি-উক্ত বিচার-আলোচনা হইতে কাহারও কাহারও এইরূপ ধারণা হইতে পারে যে, সন্ন্যাসধর্মের সহিত কর্মযোগের সমন্বয় করিবার জন্য গীতার মধ্যে যে এতটা ধস্তাধস্তি করা হইয়াছে, স্মার্ত কিংবা সন্ন্যাসধর্ম প্রাচীন হওয়া এবং কর্মযোগমার্গ তাহার পরে নিঃসৃত হওয়াই তাহার কারণ । কিন্তু ইতিহাসদৃষ্টিতে বিচার করিলে সকলেরই উপলব্ধি হইবে যে, প্ৰকৃত অবস্থা তাহা নহে । বৈদিক ধর্মের অত্যন্ত প্ৰাচীন স্বরূপ কর্মকাণ্ডাত্মকই ছিল, তাহা পূর্বে বলিয়া আসিয়াছি । পরে ঔপনিষদিক জ্ঞানের দ্বারা কর্মকাণ্ডের গৌণতা প্ৰচলিত হইতে থাকে এবং কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস আস্তে আস্তে প্রচারিত হইতে আরম্ভ হয় । বৈদিক ধর্মবৃক্ষের বৃদ্ধির কিন্তু এই দ্বিতীয় সোপান । কিন্তু এই সময়েও ঔপনিষদিক জ্ঞানের কর্মকাণ্ডের সহিত মিল করিয়া জনকাদি জ্ঞানীপুরুষ আপন কর্ম আমরণ নিষ্কাম বুদ্ধিতে করিয়া আসিয়াছেন । সুতরাং বলিতে হয় যে, বৈদিক ধর্মবৃক্ষের এই দ্বিতীয় সোপান দুই প্রকার ছিল – এক জনকাদির, এবং দ্বিতীয়টী যাজ্ঞবল্ক্যাদির । স্মার্ত আশ্রম-ব্যবস্থা ইহার পরবরতী কিংবা তৃতীয় সোপান । কিন্তু দ্বিতীয় সোপানের ন্যায় তৃতীয়টিরও দুই ভেদ আছে । স্মৃতিগ্রন্থে কর্মত্যাগরূপ চতুর্থাশ্রমের মাহাত্ম্য কীর্তিত হইয়াছে সত্য; কিন্তু তাহারই সঙ্গে জনকাদির জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগেরও - সন্ন্যাসাশ্রমের বিকল্প সুত্ৰে - স্মৃতিকারেরা বর্ণনা করিয়াছেন । উদাহরণ যথা - সমস্ত স্মৃতিগ্রন্থে মূলীভূত মনুস্মৃতিই ধর না কেন । ঐই স্মৃতির ষষ্ঠ অধ্যায়ে মনুষ্য ব্ৰহ্মচৰ্য, গাৰ্হস্থ্য ও বানপ্ৰস্থ আশ্রম সমূহে উঠিতে উঠিতে, শেষে কর্মত্যাগরূপ চতুর্থ আশ্রম গ্ৰহণ করিবে এইরূপ উক্ত হইয়াছে । কিন্তু সন্ন্যাসাশ্রম অর্থাৎ যতিধর্মের নিরূপণ শেষ করিবার পর “যতিদিগের অর্থাৎ সন্ন্যাসীদিগের এই ধর্ম বলিলাম, এক্ষণে বেদসন্ন্যাসিকদিগের কর্মযোগ বলিতেছি” এইরূপ প্রস্তাবনা করিয়া এবং গৃহস্থাশ্রম অন্য আশ্রম হইতে কেন শ্রেষ্ঠ তাহা বলিয়া, মনু সন্ন্যাসাশ্রম কিংবা যতিধর্মকে বৈকল্পিক মানিয়া নিষ্কাম গাৰ্হস্থ্যবৃত্তির কর্মযোগ বৰ্ণনা করিয়াছেন, [মনু|৬|৮৬-৯৬]; এবং পরে দ্বাদশ অধ্যায়ে তাহারই “বৈদিক কর্মযোগ” নাম দিয়া, এই মাৰ্গও চতুর্থাশ্রমেরই ন্যায় নিঃশ্রেয়ষ্কর অর্থাৎ মোক্ষপ্ৰদ এইরূপ বলিয়াছেন [মনু|১২|৮৬-৯০] । মনুর এই সিদ্ধান্ত যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে । এই স্মৃতির তৃতীয় অধ্যায়ে যতিধর্মের নিরূপণ শেষ হইলে পর, ‘অথবা’ পদ প্রয়োগ করিয়া লিখিত হইয়াছে যে, পরে জ্ঞাননিষ্ঠ ও সত্যবাদী গৃহস্থও (সন্ন্যাস গ্রহণ না করিয়া) মুক্তি লাভ করে [যাজ্ঞ|৩|২০৪ ও ২০৫] । সেইরূপ, যাষ্কও স্বীয় নিরুক্তে লিখিয়াছেন যে, কর্মত্যাগী তপস্বী ও জ্ঞানযুক্ত কর্মকারী কর্মযোগী একই দেবযান গতি প্ৰাপ্ত হন [নি|১৪|৯] । এতদ্‌ব্যতীত এই বিষয়ে অন্য প্রমাণ ধর্মসূত্ৰকারদিগের । এই ধর্মসূত্র গদ্যাত্মক হওয়ায় শ্লোকে লিখিত স্মৃতিগ্রন্থের পূর্ববৰ্ত্তী হইবে, এইরূপ বিদ্বানদিগের মত । এই মত ঠিক কি ভুল, তাহা এক্ষণে আমাদের দ্রষ্টব্য নহে । তাহা ঠিক্ই হউক বা ভুলই হউক, এই প্রসঙ্গের মুখ্য বিষয় এই যে, উপরে প্রদত্ত মনুযাজ্ঞবল্ক্যাদি স্মৃতির বচন প্ৰদৰ্শিত গৃহাস্থাশ্রমের কিংবা কর্মযোগের মহত্ত্ব অপেক্ষাও ধর্মসূত্রে অধিক মহত্ত্ব বর্ণিত হইয়াছে । মনু ও যাজ্ঞবল্ক্য কর্মযোগকে চতুর্থাশ্রমের বিকল্প বলিয়াছেন । কিন্তু বৌধায়ন ও আপস্তম্ব সেরূপ না বলিয়া গৃহস্থাশ্ৰমই মুখ্য ও তাহার দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ হয় এইরূপ স্পষ্ট বিধান করিয়াছেন । বৌধায়ন ধর্মসূত্রে “জায়মানো বৈ ব্ৰাহ্মণস্ত্রিভিঋর্ণবা জায়াতে” প্ৰত্যেক ব্ৰাহ্মণ জন্মতই তিন ঋণ আপন পৃষ্ঠে গ্ৰহণ করিয়াছে - ইত্যাদি তৈত্তিরীয় সংহিতার বচন প্রথমে দিয়া তাহার পর এই সকল ঋণ শোধ করিবার জন্য যাগযজ্ঞাদিপূর্বক গৃহস্থাশ্রমের আশ্রয়কারী মনুষ্য ব্ৰহ্মলোকে উপনীত হয়, এবং ব্ৰহ্মচৰ্য কিংবা সন্ন্যাসের যাহারা প্ৰশংসা করে সেই সব ইতর লোক ধূলিতে মিলিত হয়, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [বৌ|২|৬|১১|৩৩ ও ৩৪]; এবং আপস্তম্বসূত্রেও ঐরূপ বিধানই আছে [আপ|২|৯|২৪|৫] । এই দুই ধর্মসূত্রে সন্ন্যাসাশ্রম বর্ণিত হয় নাই - এরূপ নহে; কিন্তু উহার বর্ণন করিয়াও গৃহস্থাশ্রমেরই মহত্ব অধিক স্বীকৃত হইয়াছে । ইহা হইতে, এবং বিশেষত মনুস্মৃতিতে কর্মযোগকে ‘বৈদিক’ বিশেষণে বিশিষ্ট করাতে স্পষ্ট সিদ্ধ হইতেছে যে, মনুস্মৃতির সময়েও কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাস আশ্রম অপেক্ষা, নিষ্কাম কর্মযোগরূপ গৃহস্থাশ্ৰম প্রাচীন বলিয়া ধারণা ছিল এবং মোক্ষদৃষ্টিতে তাহার যোগ্যতা চতুর্থাশ্রমেরই ন্যায় পরিগণিত হইত । গীতার টীকাকারদিগের ঝোঁক সন্ন্যাস কিংবা কর্মত্যাগযুক্ত ভক্তির উপরেই থাকা প্ৰযুক্ত তাঁহাদের টীকায় উপরোক্ত স্মৃতিবচনসমূহের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় না । কিন্তু তাঁহারা ইহার প্রতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিলেও কর্মযোগের প্রাচীনত্ব তাহাতে কমে না । কর্মযোগমার্গ এইরূপ প্ৰাচীন হওয়াতেই উহাকে যতিধর্মের বিকল্প বলিয়া স্মৃতিকারদিগের মানিতে হইয়াছে, এইরূপ বলিতে বাধা নাই । ইহা হইল বৈদিক কর্মযোগের কথা ৷ শ্ৰীকৃষ্ণের পূর্বে জনকাদি এই পন্থা অনুসারেই আচরণ করিতেন । কিন্তু পরে ভগবান তাহাতে ভক্তিকেও মিলাইয়া দিয়া তাহার প্রচার অধিক বিস্তৃত করায় তাহাই ‘ভাগবতধর্ম’ নাম পাইয়াছে । ভগবদ্‌গীতা এই প্ৰকারে সন্ন্যাসাপেক্ষাও কর্মযোগকে অধিক মান্য বলিয়া স্থির করিলেও তা হাতে পরে গৌণত্ব আসিয়া সন্ন্যাসমার্গেরই প্ৰাধান্য কেন হইল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ইহার বিচার পরে করা যাইবে । কর্মযোগ স্মার্তমার্গের পরবর্তী নহে, পুরাতন বৈদিক কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে, ইহাই এখানে বক্তব্য ।


31) গীতার অধ্যায়সমাপ্তিসূচক সঙ্কল্পের অর্থ



ভগবদ্‌গীতার প্রতি অধ্যায়ের শেষে “ইতি শ্ৰীমদ্ভগবদগীতাসু উপনিষৎস, ব্ৰহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে” এই যে সঙ্কল্প থাকে, তাহার মর্ম এক্ষণে পাঠকের উপলব্ধি হইবে । এই সঙ্কল্পের অর্থ এই যে, ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষদে অন্য উপনিষদের ন্যায় ব্রহ্মবিদ্যা ত আছেই, কিন্তু শুধু ব্ৰহ্মবিদ্যাই নহে; প্রত্যুত ব্ৰহ্মবিদ্যার মধ্যে ‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’ (বেদান্তী সন্ন্যাসী ও বেদান্তী কর্ম-যোগী) এই যে দুই পন্থা উৎপন্ন হয় তন্মধ্যে যোগের অর্থাৎ কর্মযোগের প্ৰতিপাদনই ভগবদ্‌গীতার মুখ্য বিষয় । অধিক-কি, ভগবদ্‌গীতোপনিষৎই কর্মযোগের মুখ্য গ্ৰন্থ, ইহা বলিতেও কোনই বাধা নাই । কারণ, কর্মযোগ বৈদিক কাল হইতেই চলিয়া আসিলেও “কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি” [ঈশ|২], কিংবা “আরভ্য কর্মাণি গুণান্বিতানি” [শ্বে|৬|৪], অথবা “বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গেই স্বাধ্যায় আদি কর্ম করিবে” [তৈ|১|৯], এই প্রকার কতকগুলি সংক্ষিপ্ত উল্লেখ ব্যতীত উপনিষদে এই কর্মযোগের সবিস্তর বিচার কোথাও করা হয় নাই । এ বিষয়ে ভগবদ্‌গীতাই মুখ্য ও প্রামাণিক গ্ৰন্থ; এবং কাব্যদৃষ্টিতেও ইহাই সঙ্গত মনে হয় যে, ভারতভূমির কর্তৃপুরুষদিগের চরিত্র যে মহাভারতে বর্ণিত হইয়াছে তাহাতেই অধ্যাত্মশাস্ত্ৰকে ধরিয়া কর্মযোগেরও উপপত্তি ব্যাখ্যাত হইবে । 


32) গীতার অপূর্বতা এবং প্রস্থানত্রয়ীর তিন ভাগের সার্থকতা



প্ৰস্থানত্রয়ের মধ্যে ভগবদ্‌গীতার সমাবেশ কেন করা হইয়াছে তাহারও উপপত্তি এক্ষণে ঠিক বুঝা যাইতেছে । উপনিষদ মুলীভুত হইলেও উহা বহু ঋষি কর্তৃক কথিত হওয়ায় উহার বিচার সংকীর্ণ ও কোন কোন স্থানে পরস্পরবিরুদ্ধ বলিয়া প্ৰতীয়মান হয় । তাই, উপনিষদের সঙ্গে সঙ্গেই উহাদের সমন্বয়কারী বেদান্তসূত্রেরও প্রস্থানত্রয়ের মধ্যে গণনা করা অবশ্যক ছিল । কিন্তু উপনিষদ ও বেদান্তসূত্র এই দুয়ের অপেক্ষা গীতায় বেশী কিছু না থাকিলে, প্ৰস্থানত্রয়ের মধ্যে গীতাকে ধরিবার কোনই কারণ ছিল না । কিন্তু উপনিষদেয়র টান প্রায়ই সন্ন্যাসমার্গের দিকে, এবং তাহাতে বিশেষ করিয়া জ্ঞানমাৰ্গই প্রতিপাদিত হইয়াছে; এবং ভগবদ্গীতায় এই জ্ঞানকে ধরিয়া ভক্তিযুক্ত কর্মযোগের সমর্থন আছে, - বস্‌, এইটুকু বলিলে, গীতাগ্রন্থের অপূর্বত সিদ্ধ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্ৰস্থানত্রয়ের তিন ভাগের সার্থকতাও পরিব্যক্ত হয় । কারণ বৈদিক ধর্মের প্রামাণিক গ্রন্থে জ্ঞান ও কর্ম (সাংখ্য ও যোগ) এই দুই বৈদিক মার্গের বিচার না থাকিলে প্ৰস্থানত্রয় ততটা অপূর্ণই রহিয়া যাইত । কাহার কাহার এইরূপ ধারণা আছে যে, উপনিষদ যখন সাধারণতঃ নিবৃত্তিমূলক, তখন গীতার প্রবৃত্তিমূলক অর্থ ধরিলে প্ৰস্থানত্রয়ের তিন ভাগের মধ্যে বিরোধ উৎপন্ন হইয়া তাহাদের প্রামাণ্যও কমিয়া যাইবে । সাংখ্য অর্থাৎ সন্ন্যাসই যদি একমাত্র বৈদিক মোক্ষমার্গ হয় তবেই এই সন্দেহ ঠিক্‌ হইবে । কিন্তু উপরে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে যে, নিদানপক্ষে ঈশাবাস্যাদি কোন কোন উপনিষদে কর্মযোগের স্পষ্ট উল্লেখ আছে । তাই, বৈদিক ধর্মপুরুষকে কেবল এক-হস্তবিশিষ্ট অর্থাৎ সন্ন্যাসপ্রধান না বুঝিয়া, তাহার ব্রহ্মবিদ্যারূপ একই মস্তক এবং মোক্ষদৃষ্টিতে তুল্যবল সাংখ্য ও কর্মযোগ তাহার দক্ষিণ ও বাম দুই হস্ত, এইরূপ গীতার ন্যায় সিদ্ধান্ত করিলে, উপনিষদ ও গীতার মধ্যে কোনই বিরোধ থাকে না । উপনিষদে এক মার্গের এবং গীতায় অন্য মার্গের সমর্থন আছে; তাই প্ৰস্থানত্রয়ীর এই দুই ভাগও দুই হস্তের ন্যায়  পরস্পরবিরুদ্ধ না হইয়া সাহায্যকারী বলিয়াই উপলব্ধি হইবে । এইরূপই গীতায় কেবল উপনিষদই প্রতিপাদিত হইয়াছে মানিলে, চর্বিতচর্বণের যে ব্যর্থতা গীতায় প্রযুক্ত হইত, তাহাও হয় না । 


33) সন্ন্যাস (সাংখ্য) এবং কর্মযোগ (যোগ), উভয় মার্গের ভেদ-অভেদের নক্সার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা



যাক্‌ । গীতার সাম্প্রদায়িক টীকাকারেরা এই বিষয় উপেক্ষা করায় সাংখ্য ও যোগ এই দুই স্বতন্ত্র মার্গের প্রবর্তক স্ব স্ব গ্রন্থের সমর্থনার্থ যে সকল মুখ্য কারণ বলেন, তাহাদের সাম্য ও বৈষম্য শীঘ্ৰ নজরে পড়িবে বলিয়া, নিম্নলিখিত যুগল তালিকায় উক্ত কারণসকল পরস্পরের পাশাপাশি সংক্ষেপে প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে । স্মৃতিগ্রন্থে প্রতিপাদিত স্মার্ত আশ্ৰমব্যবস্থা ও মূল ভাগবত ধর্মের মুখ্য প্রভেদগুলি কি তাহাও উহা হইতে দৃষ্ট হইবে -
ব্ৰহ্মবিদ্যা কিংবা আত্মজ্ঞান লাভ হইলে পর ।

ক্রঃসংকর্মসন্ন্যাস (সাংখ্য)কর্মযোগ (যোগ)
মোক্ষ আত্মজ্ঞানের দ্বারাই লাভ হয়, কর্মের দ্বারা নহে । জ্ঞান-বিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা যে স্বৰ্গসুখ লাভ হয় তাহা অনিত্য । আত্মজ্ঞানের দ্বারাই মোক্ষ লাভ হয়, কর্মের দ্বারা নহে । জ্ঞান-বিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কর্মের দ্বারা যে স্বৰ্গসুখ লাভ হয় তাহা অনিত্য ।
আত্মজ্ঞান পাইতে হইলে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির, নিষ্কাম, বিরক্ত ও সম করা চাই । আত্মজ্ঞান পাইতে হইলে, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের দ্বারা বুদ্ধিকে স্থির, নিষ্কাম, বিরক্ত ও সম করা আবশ্যক ।
তাই, ইন্দ্রিয়ের বিষয়পাশ হইতে মুক্ত (স্বতন্ত্র) হও । তাই, ইন্দ্ৰিয়ের বিষয় ত্যাগ না করিয়া, তাহাতেই বৈরাগ্য অর্থাৎ নিষ্কামবুদ্ধিতে কর্ম করিয়া, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহরূপ কষ্টিপাথর প্রয়োগ কর । নিষ্কামের অর্থ নিষ্ক্রিয় নহে ।
তৃষ্ণামূলক কর্ম দুঃখময় ও বন্ধনস্বরূপ । দুঃখ ও বন্ধন কেন হয় ইহার ঠিক বিচার করিলে এরূপ দেখা যাইবে যে, অচেতন কর্ম কাহাকেও বন্ধন করে না, কিংবা ছাড়ে না, তাহার প্ৰতি কর্তার মনে যে কামনা কিংবা ফলাশা হয় তাহাই বন্ধন ও দুঃখের মূল ।
তাই, চিত্তশুদ্ধি হওয়া পৰ্যন্ত, কর্ম করিলেও শেষে ত্যাগ করিতে হইবে । তাই চিত্তশুদ্ধি হইবার পরেও, ফলাশা ছাড়িয়া সমস্ত কর্ম ধৈৰ্য ও উৎসাহের সহিত কর । কর্ম ছাড়িব বলিলেও কর্ম কাহাকেও ছাড়ে না । সৃষ্টির অর্থই কর্ম, তাহার বিরাম নাই ।
যজ্ঞার্থ অনুষ্ঠিত কর্ম, বন্ধন না হওয়ায় গৃহস্থাশ্রমে উহা করিতে বাধা নাই । নিষ্কামবুদ্ধিতে কিংবা ব্ৰহ্মার্পণবিধির দ্বারা অনুষ্ঠিত সমস্ত কর্মই এক বৃহৎ ‘যজ্ঞ’ । ইহার জন্য স্বধর্মবিহিত সমস্ত কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে কেবল কর্তব্য বলিয়া সর্বদা করিতে হইবে ।
দেহের ধর্ম দেহ ছাড়ে না বলিয়া সন্ন্যাস গ্রহণের পর উদরের জন্য ভিক্ষা করা অসঙ্গত নহে । উদরের জন্য ভিক্ষা করাও কর্ম এবং তাহা ‘লজ্জাজনক’ । এই সব কর্ম যদি করিতেই হয় তবে অন্য কর্ম নিষ্কামবুদ্ধিতে কেন না করিবে ? তাছাড়া, গৃহস্থাশ্রমী ব্যতীত ভিক্ষা আর কে দিবে ?
জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর নিজের কর্তব্য অবশিষ্ট থাকে না এবং লোকসংগ্রহ করিবারও আবশ্যকতা নাই । জ্ঞানলাভের পর, আপনার জন্য কিছু অর্জন করিবার না থাকিলেও, কর্ম ছাড়ে না । এই জন্য যাহা কিছু শাস্ত্রতঃ প্ৰাপ্ত হইবে, তাহা ‘আমার নহে’ ? এইরূপ নির্মমবুদ্ধিতে লোকসংগ্রহের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া করিয়া যাও । লোকসংগ্রহ কাহাকেও ছাড়ে না । উদাহরণ যথা - ভগবানের চরিত্র দেখ ।
কিন্তু ব্যতিক্রমস্থলরূপে অধিকারী কোন পুরুষের জ্ঞানলাভের পরেও নিজের ব্যবহারিক অধিকার জনকাদির ন্যায় আমরণ বজায় রাখিতে বাধা নাই । গুণবিভাগরূপ চাতুর্বর্ণ্য-ব্যবস্থানুসারে ছোট-বড় অধিকার সকলেই জন্মত প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । স্ব-ধর্মানুসারে প্রাপ্ত এই অধিকার, লোকসংগ্ৰহাৰ্থ সকলকেই অনাসক্তবুদ্ধিতে আমরণ অব্যতিক্রমে চালাইতে হইবে । কারণ, এই চক্র জগতের ধারণার্থ পরমেশ্বরই সৃষ্টি করিয়াছেন ।
১০ কিন্তু যাহাই কর না কেন, কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাসই শ্ৰেষ্ঠ । অন্য অন্য আশ্রমের কর্ম চিত্তশুদ্ধির সাধনমাত্র কিংবা পূর্বায়োজন, জ্ঞান ও কর্মের মধ্যে তো স্বভাবতই বিরোধ আছে । তাই পূর্বাশ্রমে যত শীঘ্ৰ পারা যায় চিত্তশুদ্ধি সম্পাদন করিয়া শেষে কর্মত্যাগ রূপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিবে । চিত্তশুদ্ধি জন্মতই কিংবা পূর্ববয়সে হইয়া থাকিলে, গৃহস্থাশ্রমের কর্ম করা অবশ্যক নহে । স্বরূপতঃ কর্মত্যাগ করাই প্রকৃত সন্ন্যাসাশ্রম । সাংসারিক কর্ম শাস্ত্রোক্ত রীতিতে করিলে চিত্তশুদ্ধি হয় সত্য । কিন্তু চিত্তশুদ্ধিই কর্মের একমাত্ৰ উপযোগ নহে । জাগতিক কর্ম চালাইবার জন্যও কর্ম আবশ্যক । সেইরূপ আবার, কাম্য কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যে বিরোধ থাকিলেও নিষ্কাম কর্ম ও জ্ঞানের মধ্যেয়াদৌ বিরোধ নাই । তাই, চিত্তশুদ্ধির পরেও ফলাশা ত্যাগ করিয়া চাতুৰ্বর্ণ্যের সমস্ত কর্ম আমরণ নিষ্কামবুদ্ধিতে জগতের সংগ্ৰহাৰ্থ করিতে থাকো । ইহাই প্ৰকৃত সন্ন্যাস । স্বরূপতঃ কর্ম ত্যাগ করা কখনও উচিত নহে, আর সাধ্যাত্তও নহে ।
১১ কর্মসন্ন্যাস গ্রহণের পরও শমদমাদি ধর্ম পালন করিতে হইবে । জ্ঞানপ্ৰাপ্তির পর, ফলাশা ত্যাগরপ সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়া শমদমাদি ধর্ম ব্যতীত আত্মৌপম্যদৃষ্টিতে প্রাপ্ত সমস্ত ধর্ম পালন কর; এবং এই শমের দ্বারা অর্থাৎ শান্তবুদ্ধি হইতেই শাস্ত্ৰতঃ-প্ৰাপ্ত সমস্ত কর্ম লোক-সংগ্ৰহাৰ্থ আমরণ করিয়া যাও । নিষ্কাম কর্ম ছাড়িও না ।
১২ এই মার্গ অনাদি ও শ্রুতি-স্মৃতি-প্ৰতিপাদিত । এই ধর্ম অনাদি ও শ্রুতি-স্মৃতি-প্ৰতিপাদিত ।
১৩ শুক-যাজ্ঞবল্ক্যাদি এই মার্গ অনুসরণ করিয়াছেন । ব্যাস-বসিষ্ঠজৈগীষব্যাদি এবং জনক-শ্ৰীকৃষ্ণাদি এই মার্গ অনুসরণ করিয়াছেন ।
শেষে মোক্ষ ।

এই দুই মার্গ কিংবা নিষ্ঠা ব্রহ্মবিদ্যামূলক; দুয়েরই প্ৰতি মনের নিষ্কাম অবস্থা ও শান্তি একই প্রকার হওয়া প্ৰযুক্ত, দুই মার্গের দ্বারাই শেষে একই মোক্ষ লাভ হইয়া থাকে [গী|৫|৫] । জ্ঞানলাভের পর কর্মত্যাগ এবং কাম্যকর্ম ছাড়িয়া নিষ্কাম কর্ম নিত্য করিতে থাকা, এই দুইয়ের মধ্যে ইহাই মুখ্য ভেদ ।


34) জীবনযাপনের বিভিন্ন মার্গ



কর্ম ত্যাগ করা ও কর্ম করা, উপরি-উক্ত দুই মার্গ জ্ঞানমূলক অর্থাৎ জ্ঞানলাভের পর জ্ঞানীপুরুষ কর্তৃক স্বীকৃত ও আচরিত হয় । কিন্তু কর্ম ত্যাগ করা ও কর্ম করা এই দুই বিষয় জ্ঞান না হইলেও হইতে পারে । তাই অজ্ঞানমূলক কর্মের এবং কর্মত্যাগেরও এখানে কিছু বিচার করা আবশ্যক । গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে ত্যাগের যে তিন প্রকার ভেদ বলা হইয়াছে ইহাই তাহার বীজ । জ্ঞান না হইলেও কোন কোন লোক কেবল কায়ক্লেশভয়ে কর্ম ত্যাগ করিয়া থাকে । ইহাকে গীতায় রাজসিক ত্যাগ বলা হইয়াছে [গী|১৮|৮] । সেইরূপ আবার, জ্ঞান না হইলেও শুধু শ্ৰদ্ধার সহিত কতকগুলি লোক যাগযজ্ঞাদি কর্ম করিয়া থাকে । কিন্তু কর্ম করিবার, এই মার্গ মোক্ষপ্রদ নহে, শুধু স্বর্গপ্রদ এইরূপ গীতায় উক্ত হইয়াছে [গী|৯|২০] । যাগযজ্ঞাদি শ্রৌতধর্ম অধুনা প্রচলিত না থাকায়, মীমাংসকদিগের এই নিছক কর্মমাৰ্গসম্মন্ধে গীতার সিদ্ধান্ত এক্ষণে তেমন উপযোগী নহে, এইরূপ কাহারো কাহারো ধারণা । কিন্তু তাহা ঠিক নহে । কারণ, শ্রৌত যাগযজ্ঞ লুপ্ত হইলেও স্মার্ত যজ্ঞ অর্থাৎ চাতুৰ্বর্ণের কর্ম অদ্যাপি চলিতেছে । তাই, অজ্ঞানবশতঃ কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত যাগযজ্ঞাদি কাম্যকর্ম যাহারা করে তাহাদের সম্বন্ধে গীতার যে সিদ্ধান্ত, তাহা জ্ঞান-বিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত চাতুৰ্বর্ণের কর্মকর্তাদিগেরও সম্বন্ধে বর্তমান অবস্থায় সম্পূর্ণরূপে খাটে । জগতের ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি করিলে জানা যাইবে যে সমাজে এই প্রকার শাস্ত্রের উপর শ্রদ্ধা রাখিয়া যাহারা নিয়মপূর্বক নিজ নিজ কর্ম করে তাহাদেরই বিশেষ আদর হইয়া থাকে, কিন্তু তাহারা পরমেশ্বরের স্বরূপ পূর্ণরূপে অবগত নহে । তাই, গণিতশাস্ত্রের সম্পূর্ণ উপপত্তি না বুঝিয়া কেবল মুখের হিসাবের উপর যাহারা গণনা করে তাহাদের ন্যায় এই শ্রদ্ধালু ও কর্মঠ লোকদিগের অবস্থা । সমস্তু কর্ম  শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে ও শ্রদ্ধাসহকারে অনুষ্ঠান করা হেতু তাহা নির্ভুল (শুদ্ধ) হইয়া পুণ্যপ্ৰদ অৰ্থাৎ স্বৰ্গপ্রদ হয় ইহাতে কোন সন্দেহ নাই । কিন্তু জ্ঞান ব্যতীত মোক্ষলাভ হইতে পারে না এইরূপ শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত হওয়ায়, স্বর্গলাভ অপেক্ষা মহত্তর ফললাভ এই কর্মঠ লোকদিগের সাধ্যায়ত্ত নহে । এইজন্য স্বৰ্গসুখেরও অতীত অমৃতত্ব যিনি অর্জন করিবেন — এবং ইহাই এক পরম পুরুষাৰ্থ - তাঁহার উহাকে প্ৰথম সাধন বলিয়া এবং পরে সিদ্ধাবস্থায় লোকসংগ্ৰহাৰ্থ অর্থাৎ আমরণ “সর্বভুতে একই আত্মা” এই জ্ঞানযুক্ত বুদ্ধিতে নিষ্কাম কর্ম করিবার মাৰ্গকেই স্বীকার করিতে হইবে । জীবনের সমস্ত মাৰ্গ অপেক্ষা এই মাৰ্গ উত্তম । গীতাকে অনুসরণ করিয়া উপরি-উক্ত তালিকায় এই মাৰ্গকে কর্মযোগ বলা হইয়াছে; এবং ইহাকেই কেহ কেহ কর্মমার্গ কিংবা প্ৰবৃত্তিমাৰ্গও বলেন । কিন্তু কর্মমার্গ বা প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ, এই দুই শব্দের দ্বারা জ্ঞানবিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধার সহিত কর্ম করিবার স্বৰ্গপ্রদ মাৰ্গই সাধারণত বুঝায় - এই এক দোষ । তাই জ্ঞানবিরহিত কিন্তু শ্ৰদ্ধাযুক্ত কর্ম এবং জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্ম এই দুয়ের ভেদ দেখাইবার জন্য দুই ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করা আবশ্যক হয় । এবং এই কারণেই মনুস্মৃতিতে এবং ভাগবতেও প্ৰথম প্রকারের অর্থাৎ জ্ঞানবিরহিত কর্মকে ‘প্রবৃত্ত কর্ম’ এবং দ্বিতীয় প্রকারের অর্থাৎ জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্মকে ‘নিবৃত্ত কর্ম’ নাম দেওয়া হইয়াছে [মনু|১২|৮৯; ভাগ|৭১৫|৪৭] । কিন্তু এই দুই শব্দও আমার মতে যতটা হওয়া উচিত ততটা নিঃসন্দিগ্ধ নহে । কারণ, ‘কর্ম হইতে পরাবৃত্ত হওয়া’, ‘নিবৃত্তি’ শব্দের সাধারণ অর্থ । এই সন্দেহ দূর করিবার জন্য ‘নিবৃত্ত’ শব্দের পরে ‘কর্ম’ এই বিশেষণ যুক্ত হইয়াছে; এবং এইরূপ করায়, ‘নিবৃত্ত’ এই বিশেষণের অর্থ ‘কর্ম হইতে পরাবৃত্ত’ না হইয়া নিবৃত্ত কর্ম = নিষ্কাম কর্ম, এই অর্থ নিষ্পন্ন হয় । কিন্তু যাহাই বল না কেন, ‘নিবৃত্ত’ এই শব্দ যে পৰ্যন্ত উহাতে আছে সে পৰ্যন্ত কর্মত্যাগের কল্পনা মনে না আসিয়া ক্ষান্ত হয় না । এইজন্য জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্ম করিবার মাৰ্গকে ‘নিবৃত্তি কিংবা নিবৃত্ত কর্ম’ না বলিয়া কর্মযোগ নাম দেওয়া আমার মতে উত্তম । কারণ, কর্মের পরে যোগ শব্দ যুক্ত থাকিলে স্বভাবতই তাহার ‘মোক্ষের অন্তরায় না হইয়া কর্ম করিবার কৌশল’ এই অৰ্থ হয়; এবং অজ্ঞানযুক্ত কর্মের নিরাসও আপনা-আপনি হয় । তথাপি ইহা বিস্মৃত হইবে না যে, গীতার কর্মযোগ জ্ঞানমূলক এবং ইহাকেই কর্মমার্গ কিংবা প্ৰবৃত্তিমাৰ্গ বলা কেহ যদি ইষ্ট মনে করেন তাহাতে বাধা নাই । কোন কোন স্থলে আমিও ভাষাবৈচিত্রের জন্য এই শব্দ গীতার কর্মযোগের বর্ণনায় প্রয়োগ করিয়াছি । যাক্‌ । কর্ম করা কিংবা কর্ম ত্যাগ করা, ইহাদের এইরূপ জ্ঞানমূলক ও অজ্ঞানমূলক যে ভেদ আছে, তন্মধ্যে প্রত্যেকের সম্বন্ধে গীতাশাস্ত্রের অভিপ্ৰায় এইরূপ -

ক্রঃসংজীবনের মার্গশ্ৰেণীগতি
কামোপভোগকেই পুরুষাৰ্থ মনে করিয়া অহঙ্কারবশতঃ আসুরী বুদ্ধিতে, দম্ভ কিংবা লোভবশে কেবল আত্মসুখের জন্য কর্ম করা, [গী|১৬|১৬] - আসুর কিংবা রাক্ষস মার্গঅধম নরক
সর্বভুতে এক আত্মা এইরূপ, পরমেশ্বরস্বরূপের যথার্থ জ্ঞান না হইলেও বেদাজ্ঞাকে কিংবা শাস্ত্ৰাজ্ঞাকে অনুসরণ করিয়া শ্ৰদ্ধার সহিত ও নীতি অনুসারে নিজ নিজ কাম্য কর্ম করা [গী|২|৪১, ৪৪ ও ৯-২০] – কেবল কর্ম, ত্রয়ী ধর্ম, কিংবা মীমাংসক মার্গমধ্যম (মীমাংসকমতে উত্তম)স্বর্গ (মীমাংসকমতে মোক্ষ)
শাস্ত্রোক্ত নিষ্কাম কর্মের দ্বারা পরমেশ্বরের জ্ঞান হইলে, শেষে বৈরাগ্যের দ্বারা সমস্ত কর্ম ছাড়িয়া কেবল জ্ঞানেই তৃপ্ত হইয়া থাকা [গী|৫|২] – কেবল জ্ঞান, সাংখ্য কিংবা স্মার্ত্ত মাৰ্গউত্তম মোক্ষ
প্রথমে চিত্তশুদ্ধির জন্য এবং তাহার দ্বারা পরমেশ্বরের জ্ঞান লাভ করিয়া পরে কেবল লোকসংগ্ৰহার্থ আমরণ ভগবানের ন্যায় নিষ্কাম কর্ম করিতে থাকা [গী|৪|২] – জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয়, কর্মযোগ কিংবা ভাগবত মার্গসৰ্ব্বোত্তম মোক্ষ

(জনকবর্ণিত তিন নিষ্ঠা - ২, ৩ ও ৪; গীতার দুই নিষ্ঠা - ৩ ও ৪)


35) গীতার সিদ্ধান্ত এই যে, এই সকলের মধ্যে কর্মযোগই শ্রেষ্ঠ



সার-কথা, - মোক্ষলাভের জন্য কর্মের আবশ্যকতা না থাকিলেও উহার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য কারণে - এক তো অপরিহার্য বলিয়া এবং তাছাড়া জগতের ধারণপোষণার্থ আৰশ্যক বলিয়া - নিষ্কাম বুদ্ধিতে সর্বদাই সমস্ত কর্ম করিতে থাকা - ইহাই গীতায় সর্বোত্তম বলিয়া নির্ধারিত হইয়াছে । অথবা “কৃতবুদ্ধিষু কর্তারঃ কর্তৃষু ব্ৰহ্মবাদিনঃ” [মনু|১|৯৭] এই মনুবচনানুসারে কর্তৃত্ব ও ব্ৰহ্মজ্ঞানের সংযোগই সর্বাপেক্ষা উত্তম, এবং শুধু কর্তৃত্ব কিংবা শুধু ব্ৰহ্মজ্ঞান ইহাদের প্রত্যেকটাই একদেশদর্শী, এইরূপ গীতার শেষ সিদ্ধান্ত ।

বাস্তবিক বলিতে গেলে, এই প্রকরণ এইখানেই শেষ হইল । কিন্তু গীতার সিদ্ধান্ত যে শ্রুতিস্মৃতিপ্রতিপাদিত তাহাই দেখাইবার জন্য উপরে স্থানে স্থানে যে সকল বচন উদ্ধৃত হইয়াছে তৎসম্বন্ধে দুই একটি কথা বলা আবশ্যক । কারণ, উপনিষদের সাম্প্রদায়িক ভাষ্য হইতে সমস্ত উপনিষদ সন্ন্যাসমূলক কিংবা নিবৃত্তিমূলক, অনেকের এইরূপ ধারণা হইয়াছে । উপনিষদে সন্ন্যাসমার্গ আদৌ নাই সে কথা আমি বলি না । বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্ত হইয়াছে - পরব্রহ্ম ব্যতীত অন্য কোন বস্তু সত্য নহে এইরূপ অনুভূতি হইলে পর “কোন কোন জ্ঞানী পুরুষ পুত্ৰৈষণা, বিত্তৈষণা এবং লোকৈষণার পরোয়া না করিয়া “সন্তানসন্ততিতে আমার কি প্রয়োজন ? সংসারই আমার আত্মা’ এইরূপ বলিয়া ভিক্ষা মাগিয়া আনন্দে ইতস্ততঃ ঘুরিয়া বেড়ায়” [বৃ|৪|৪|২২] । কিন্তু সমস্ত ব্ৰহ্মজ্ঞানীকে এই পক্ষই স্বীকার করিতে হইবে এরূপ নিয়ম বৃহদারণ্যকে কোথাও প্রদত্ত হয় নাই । অধিক কি, যাহাকে এই উপদেশ দেওয়া হইয়াছে সেই জনক রাজা ব্ৰহ্মজ্ঞানের শিখরে পৌঁছিয়া অমৃত হইয়াছিলেন এইরূপ তাঁহার বর্ণনা এই উপনিষদে করা হইয়াছে । কিন্তু তিনি যাজ্ঞবল্ক্যের ন্যায় জগৎ ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ করিয়াছিলেন সে কথা কোথাও বলা নাই । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, জনকের নিষ্কামকর্মমার্গ এবং যাজ্ঞবল্ক্যের কর্মসন্ন্যাসমার্গ এই দুই মার্গ সম্বন্ধে বৃহদারণ্যকের বিকল্পে সম্মতি আছে এবং বেদান্তসূত্রকারও এই অনুমানই করিয়াছেন [বেসু|৩|৪|১৫] । কঠোপনিষৎ ইহা অপেক্ষাও অগ্রসর হইয়াছেন । আমার মতে কঠোপনিষদে যে নিষ্কামকর্মযোগই প্রতিপাদ্য হইয়াছে ইহা পূর্বে পঞ্চম প্রকরণে আমি দেখাইয়াছি । ছান্দোগ্য উপনিষদে [৮|১৫|১] এই অর্থই প্ৰতিপাদ্য, এবং শেষে “গুরুর নিকট অধ্যয়ন করিয়া পরে পরিবারের মধ্যে থাকিয়া ধর্মাচরণকারী, জ্ঞানী পুরুষ ব্ৰহ্মলোক প্ৰাপ্ত হয়, পুনৰ্বার ফিরিয়া আসে না”, এইরূপ স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । তৈত্তিরীয় ও শ্বেতাশ্বতর এই দুই উপনিষদের এই অর্থেরই বাক্য উপরে প্রদত্ত হইয়াছে [তৈ|১|৯ ও শ্বে|৬|৪] । তাছাড়া, ইহাও ভাবিবার বিষয় যে, উপনিষদে যাঁহারা অপরকে ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে অথবা তাঁহাদের ব্ৰহ্মজ্ঞানী শিষ্যদের মধ্যে যাজ্ঞবল্ক্যের ন্যায় দুই-এক জন ব্যক্তি ছাড়া কাহাকেই সন্ন্যাস গ্রহণ করিতে দেখা যায় না । বরং তাঁহারা গৃহস্থাশ্রমীই ছিলেন তাঁহাদের বৰ্ণনা হইতে ইহাই দেখিতে পাওয়া যায় । তাই, সমস্ত উপনিষদই সন্ন্যাসমূলক নহে এইরূপ মানিতে হয় । কোন কোন উপনিষদে সন্ন্যাস ও কর্মযোগের বিকল্প এবং কাহারও কাহারও মধ্যে কেবল জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়ই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । 


36) এই সিদ্ধান্তের প্রতিপাদক ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্র



কিন্তু উপনিষদের সাম্প্রদায়িক ভাষ্যে এই ভেদ না দেখাইয়া, সমস্ত উপনিষদ কেবল একই অৰ্থ - বিশেষতঃ সন্ন্যাস - প্রতিপাদক এইরূপ উক্ত হইয়া থাকে । সারকথা, সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের হাতে গীতা ও উপনিষদেরও একই অবস্থা হইয়াছে; অর্থাৎ গীতার কতকগুলি শ্লোকের ন্যায় উপনিষদের কতকগুলি মন্ত্রেরও এই ভাষ্যকারেরা টানাবুনা অর্থ করিয়াছেন । উদাহরণ যথা - ঈশাবাস্য উপনিষৎ ধর না কেন । এই উপনিষৎ ছোট অর্থাৎ শুধু অষ্টাদশ শ্লোকের হইলেও ইহার যোগ্যতা অন্য উপনিষদ অপেক্ষা অধিক বলিয়া সকলে বুঝিয়ে থাকে । কারণ, এই উপনিষৎ স্বয়ং বাজসনেয়ী সংহিতাতেই কথিত হইয়াছে, এবং অন্যান্য উপনিষদ আরণ্যক গ্রন্থে কথিত হইয়াছে । সংহিতা অপেক্ষা ব্ৰাহ্মণ এবং ব্ৰাহ্মণ অপেক্ষা আরণ্যক গ্ৰন্থ উত্তরোত্তর কম প্রামাণ্য, এ কথা সর্বমান্য । এই সমুদয় ঈশাবাস্যোপনিষৎ অথ হইতে ইতি পৰ্যন্ত জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক । ইহার প্রথম মন্ত্রে (শ্লোকে) “জগতে যাহা কিছু আছে তাহা ঈশাবাস্য অর্থাৎ পরমেশ্বরাধিষ্ঠিত বলিয়া বুঝিবে” এইরূপ বলিয়া দ্বিতীয় মন্ত্রে “যাবজ্জীবন শত বৎসর নিষ্কাম কর্ম করিতে থাকিয়াই বাঁচিবার বাসনা মনে পোষণ করিবে” এইরূপ স্পষ্ট বিধান আছে । বেদান্তসূত্রে, কর্মযোগের বিচার করিবার সময় এবং অন্যান্য গ্রন্থেও ঈশাবাস্যের এই বচনই জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় পক্ষের সমর্থক বলিয়া প্রদত্ত হইয়া থাকে । কিন্তু ঈশাবাস্যোপনিষৎ ইহাতেই পৰ্য্যাপ্ত হয় না । দ্বিতীয় মন্ত্রে উক্ত বিধানের সমর্থনার্থ পরে ‘অবিদ্যা’ (কর্ম) ও ‘বিদ্যা’ (জ্ঞান) ইহাদের বিচার আরম্ভ করিয়া, নবম মন্ত্রে “শুধু অবিদ্যা-(কর্ম) সেবক পুরুষ অন্ধকারে প্রবেশ করে এবং শুধু বিদ্যা অর্থাৎ ব্ৰহ্মজ্ঞানে নিমজ্জিত পুরুষ আরও অধিক অন্ধকারে পতিত হয় ?” এইরূপ উক্ত হইয়াছে । শুধু অবিদ্যা (কর্ম) এবং শুধু বিদ্যা (জ্ঞান) ইহাদের প্ৰত্যেকের পৃথকভাবে এইরূপ ন্যূনতা দেখাইয়া, একাদশ মন্ত্রে নিম্নলিখিত অনুসারে ‘বিদ্যা’ ও ‘অবিদ্যা’ এই দুয়ের সমুচ্চায়ের অবশ্যকতা এই উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে -
বিদ্যাং, চাহবিদ্যাং চ যস্তদ্বেদোভয়ং সহ ৷
অবিদ্যয়া মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াংমৃতমশ্নুতে ॥
“বিদ্যা (জ্ঞান) ও অবিদ্যা (কর্ম) উভয়কে পরস্পরের সহিত যে ব্যক্তি জানে, সে অবিদ্যার (কর্মের) দ্বারা মৃত্যু অর্থাৎ নশ্বর মায়া জগত্তের প্রপঞ্চ (উত্তমরূপে) পার হইয়া, বিদ্যার (ব্রহ্মজ্ঞানের) দ্বারা অমৃতত্ব লাভ করে” । এই মন্ত্রের ইহাই স্পষ্ট ও সরল অর্থ । এবং এই অর্থই বিদ্যায় ‘সংভূতি’, অর্থাৎ জগতের আদিকারণ এবং তাহা হইতে ভিন্ন অবিদ্যায় ‘অসংভূতি’ কিংবা ‘বিনাশ’ এইরূপ অন্য নাম দিয়া ইহার পরবর্তী তিন মন্ত্রে পুনর্বার বর্ণিত হইয়াছে [ঈশ|১২-১৪] । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, সমস্ত ঈশাবাস্যোপানিষৎ বিদ্যা ও অবিদ্যার এককালীন (উভয়ং সহ) সমুচ্চয়  প্রতিপাদন করিয়াছে । উপরি-উক্ত মন্ত্রে বিদ্যা ও অবিদ্যা, এই দুই শব্দেরই ন্যায় মৃত্যু ও অমৃত এই দুই শব্দ পরস্পর-প্রতিযোগী । তন্মধ্যে অমৃত শব্দে অবিনাশী ব্ৰহ্ম অৰ্থ স্পষ্ট, এবং তদ্বিরুদ্ধ মৃত্যু শব্দে নশ্বর, মৃত্যুলোক অথবা ঐহিক সংসার এই অর্থ নিষ্পন্ন হয় । এই অর্থেই, এই দুই শব্দ ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তেও প্রদত্ত হইয়াছে [ঋ|১০|১২৯|২] । বিদ্যাদি শব্দের এই সরল অর্থ গ্ৰহণ করিয়া (অর্থাৎ বিদ্যা = জ্ঞান, অবিদ্যা = কর্ম, অমৃত = ব্ৰহ্ম এবং মৃত্যু = মৃত্যুলোক এইরূপ বুঝিয়া)  ঈশাবাস্যের উপরিপ্রদত্ত একাদশ মন্ত্রের অর্থ করিলে, প্ৰথমে দেখিতে পাওয়া যায় যে, এই মন্ত্রেীয় প্রথম চরণে বিদ্যা ও অবিদ্যার এককালীন সমুচ্চয় বর্ণিত হইয়াছে; ঐ বিষয়ই দৃঢ় করিবার জন্য দ্বিতীয় চরণে এই দুয়ের মধ্যে প্ৰত্যেকের ফল কি তাহা পৃথক করিয়া কথিত হইয়াছে । ঈশাবাস্য-উপনিষদের এই দুই ফল ইষ্ট এবং সেই জন্যই জ্ঞান ও কর্ম এই দুইয়েরই এককালীন সমুচ্চয় এই উপনিষদে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । মৃত্যুলোকের প্রপঞ্চ ঠিক্‌ চালানো কিংবা তাহা হইতে উত্তমরূপে পার হওয়াকেই গীতায় ‘লোকসংগ্ৰহ’ নাম প্রদত্ত হইয়াছে । মোক্ষলাভ মনুষ্যের কর্তব্য সত্য, - কিন্তু তাহারই সঙ্গে সঙ্গেই তাহার লোকসংগ্ৰহও আবশ্যক । এই হেতু জ্ঞানী পুরুষ লোকসংগ্ৰাহক কর্ম ত্যাগ করিবেক না এইরূপ গীতার সিদ্ধান্ত; এবং এই সিদ্ধান্তই শব্দভেদে “অবিদ্যয়া মৃত্যুৎ তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” এই উপরি-উক্ত মন্ত্রে প্রদত্ত হইয়াছে । সারকথা – গীতা উপনিষদ্‌কে অবলম্বন করিয়া আছে শুধু নহে, ঈশাবাস্যোপনিষদে স্পষ্টরূপে বর্ণিত অর্থই গীতায় সবিস্তর প্রতিপাদিত হইয়াছে, এইরূপ ইহা হইতে উপলব্ধি হইবে । ঈশাবাস্যোপনিষৎ যে বাজসনেয়ী সংহিতায় আছে, তাহাই বাজসনেয়ী সংহিতার শতপথ ব্ৰাহ্মণভাগ । এই শতপথব্রাহ্মণের আরণ্যকে বৃহদারণ্যকোপনিষৎ প্রদত্ত হইয়াছে; তাহাতে “শুধু বিদ্যায় অর্থাৎ ব্ৰহ্মজ্ঞানে নিমগ্ন-পুরুষ আরও অধিক অন্ধকারে প্রবেশ করে” ঈশাবাস্যের এই নবম মন্ত্র অক্ষরশঃ “গৃহীত হইয়াছে [বৃ|৪|৪|১০] । এই বৃহদারণ্যকোপনিষদেই জনকের কথা আছে; এবং সেই জনকের দৃষ্টান্ত কর্মযোগসমর্থনাৰ্থ ভগবান কর্তৃক গীতায় গৃহীত হইয়াছে [গী|৩|২০] । ইহা হইতে - ঈশাবাস্যের ও ভগবদ্গীতার কর্মযোগের যে সম্বন্ধ আমি উপরে দেখাইয়াছি, তাহাই অধিক দৃঢ় ও নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হয় । 


37) ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্রের শাঙ্করভাষ্যের বিচার



কিন্তু সমস্ত উপনিষদেই মোক্ষপ্রাপ্তির একই মার্গ প্রতিপাদ্য হইয়াছে এবং তাহাই বৈরাগোর কিংবা সন্ন্যাসেরই মাৰ্গ, উপনিষদে দুই দুই মার্গ প্ৰতিপাদিত হইতে পারে না, এইরূপ যাঁহাদিগের সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত, তাঁহদিগকে ঈশাবাস্যোপনিষদের স্পষ্টার্থক মন্ত্রগুলিকেও টানিয়াবুনিয়া কোন প্রকারে পৃথক অর্থ লাগাইয়া দিতে হয়, নচেৎ এই সকল মন্ত্ৰ তাঁহাদের সম্প্রদায়ের প্রতিকুলে যায়; এবং সেরূপ হওয়া তাঁহাদেৱ ইষ্ট নহে । এই জন্য একাদশ মন্ত্রের ব্যাখ্যা করিবার সময় শাঙ্করভাষ্যে ‘বিদ্যা’ এই শব্দের অর্থ ‘জ্ঞান’ এইরূপ না করিয়া উপাসনা করা হইয়াছে । বিদ্যা শব্দের অর্থ যে উপাসনা হয় না এমন নহে । শাণ্ডিল্যবিদ্যা প্ৰভৃতি স্থানে তাহার উপাসনা অৰ্থই বিবক্ষিত হইয়াছে; কিন্তু তাহা মুখ্য অর্থ নহে । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের মনে একথা যে উদয় হয় নাই তাহাও নহে; অধিক কি, উদয় না হওয়া অসম্ভব ছিল । “বিদ্যয়া বিন্দতেহমৃতং” [কেন|২|১২], কিংবা “প্ৰাণসাধ্যাত্মং বিজ্ঞায়ামৃতমশ্নুতে” [প্রশ্ন|৩|১২], এইরূপ বচন অন্যান্য উপনিষদেও আছে । মৈত্র্যুপনিষদের সপ্তম প্ৰপাঠকে “বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ” ইত্যাদি উপরিপ্ৰদত্ত ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রই অক্ষরশঃ গৃহীত হইয়াছে; তাহারই সংলগ্ন তাহার পূর্বে কঠ|২|৪ ও পরে কঠ|২|৫ - এই মন্ত্র প্রদত্ত হইয়াছে । অর্থাৎ এই তিন মন্ত্রই এক স্থানে পর-পর প্রদত্ত হইয়াছে; মধ্যের মন্ত্রটি ঈশাবাস্যের মন্ত্র । তিনটীতেই ‘বিদ্যা’ শব্দ আছে । তাই কঠোপনিষদে বিদ্যা শব্দের যে অর্থ, সেই (জ্ঞান) অর্থই ঈশাবাস্যেও গ্ৰহণ করিতে হইবে - মৈত্র্যুপনিষদের ইহাই অভিপ্ৰায়, স্পষ্ট দেখা যায় । কিন্তু ঈশাবাস্যের শাঙ্করভাষ্যে উক্ত হইয়াছে যে “বিদ্যা = আত্মজ্ঞান ও অমৃত = মোক্ষ এই অর্থই যদি ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রে গ্রহণ করা যায় তবে জ্ঞান (বিদ্যা) ও কর্ম (অবিদ্যা) ইহাদের সমুচ্চয় এই উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে এইরূপ বলিতে হয়; কিন্তু যখন এই সমুচ্চয় ন্যায়সিদ্ধ নহে, তখন বিদ্যা = দেবতার উপাসনা এবং অমৃত = দেবলোক এই গৌণ অর্থই এই স্থানে গ্ৰহণ করিতে হইবে” । সার-কথা, ইহা সুস্পষ্ট যে “জ্ঞান হইলে পর, সন্ন্যাস লইবে, কর্ম করিবে না; কারণ, জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয় কোথাও ন্যায্য নহে” - “শাঙ্করসম্প্রদায়ের এই মুখ্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ ঈশাবাস্যের মন্ত্র যাহাতে না হয় তাহার জন্য বিদ্যা শব্দের গৌণার্থ স্বীকার করিয়া সমস্ত শ্রুতিবচনের নিজ সম্প্রদায়ানুরূপ সমন্বয় করিবার জন্য শাঙ্করভাষ্যে ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রে উপরিলিখিতানুসারে অর্থ করা হইয়াছে । সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখিলে, এই অর্থ গুরুত্বব্যঞ্জক না হইলেও আবশ্যক বটে । কিন্তু সম্বস্ত উপনিষদে এক অর্থই প্ৰতিপাদিত হওয়া উচিত, - দুই মাৰ্গ শ্রুতিপ্ৰতিপাদিত হইতে পারে না - এই মূলসিদ্ধান্তই যাঁহাদের মান্য নহে, তাঁহাদের পক্ষে - উক্ত মন্ত্রে ‘বিদ্যা’ ও ‘অমৃত’ শব্দদ্বয়ের অর্থ উল্টাইবার কোনই কারণই থাকে না । পরব্রহ্ম ‘একমেবাদ্বিতীয়ং’ এই তত্ত্ব মানিলেও তাঁহার জ্ঞান হইবার উপায় একাধিক হইবে না, এইরূপ সিদ্ধ হয় না । একই ছাদের উপর যাইবার দুই সিঁড়ি কিংবা একই শহরে যাইবার দুই রাস্তা যেরূপ থাকিতে পারে, সেইরূপ মোক্ষলাভের উপায় কিংবা নিষ্ঠার কথা; এবং এই অভিপ্ৰায়েই “লোকোহস্মিন্‌ দ্বিবিধা নিষ্ঠা” এইরূপ ভগবদ্‌গীতায় স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে । নিষ্ঠা দুই প্ৰকার হওয়া সম্ভব কহিলে পর কোন কোন উপনিষদে শুধু জ্ঞাননিষ্ঠার, আবার কতকগুলি উপনিষদে জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়নিষ্ঠার বর্ণন আসা কিছুমাত্র অসম্ভব নহে । অর্থাৎ জ্ঞাননিষ্ঠার বিরোধ আসে বলিয়া ঈশাবাস্যোপনিষদের শব্দের সরল, সহজ ও স্পষ্ট অর্থ ছাড়িয়া দিবার কোন কারণ থাকে না । শ্ৰীমৎ শঙ্করাচাৰ্যোর দৃষ্টি সরল অর্থাপেক্ষা সন্ন্যাসনিষ্ঠামূলক সমন্বয়ের দিকে বিশেষভাবে ছিল, ইহা বলিবার আরও এক কারণ আছে । তৈত্তিরীয়-উপনিষদের শাঙ্করভাষ্যে [তৈ|২|১১] “অবিদ্যা মৃত্যুং তীর্ত্বা বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” ঈশাবাস্যের এইটুকু অংশই প্রদত্ত হইয়াছে, এবং তাহারই সহিত “তপস্যা কল্মষং হন্তি বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” এই মনুবচনও [মনু|১২|১০৪] দেওয়া হইয়াছে; এবং এই দুই বচনে “বিদ্যা” শব্দের একই মুখ্যার্থ (অর্থাৎ ব্ৰহ্মজ্ঞান) আচাৰ্য স্বীকার করিয়াছেন । কিন্তু আচাৰ্য এইস্থানে এইরূপ বলেন যে “তীর্ত্বা =  তরিয়া যাওয়া” এই পদ হইতে প্ৰথমে মৃত্যুলোক পার হইবার ক্রিয়া সম্পূর্ণ হইলে তাহার পরে (একই সময়ে নহে বিদ্যার ধারা অমৃতত্ব লাভ করিবার ক্রিয়া সংঘটিত হয় । কিন্তু এই অর্থ পূর্বার্ধের “উভয়ং সহ” শব্দগুলির বিরুদ্ধ হয়, ইহা বলা বাহুল্য; এবং প্ৰায় এই কারণেই ঈশাবাস্যের শাঙ্করভাষ্যে এই অর্থ পরিত্যক্তও হইয়া থাকিবে । যাহাই হউক, ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রের শাঙ্করভাষ্যে পৃথক ব্যাখ্যা করিবার কারণ কি, তাহা ইহা হইতে ব্যক্ত হয় । এই কারণ সাম্প্রদায়িক; এবং ভাষ্যকারের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকে যাঁহারা স্বীকার না করেন তাঁহাদের নিকট প্ৰস্তুত ভাষ্যের এই ব্যাখ্যা মান্য হইবে না । শ্ৰীমৎশঙ্করাচাৰ্য্যের ন্যায় অলৌকিক-জ্ঞানীপুরুষ-প্রতিপাদিত অর্থ ছাড়িয়া দিবার প্রসঙ্গ যতই পরিহার করা যায় ততই ভাল, এ কথা আমিও স্বীকার করি । কিন্তু সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ছাড়িলে, এই প্রসঙ্গ তো আসিবেই; এবং এই জন্যই আমার পূর্বেও ঈশাবাস্য মন্ত্রের অর্থ শাঙ্কর ভাষ্য হইতে ভিন্ন প্রকারে (আমি যেরূপ বলিতেছি সেইরূপই) অন্য ভাষ্যকারেরাও প্রয়োগ করিয়াছেন । উদাহরণ যথা - বাজসনেয়ী সংহিতার সুতরাং ঈশাবাস্যোপনিষদের উপরও উবটাচাৰ্য্যের যে ভাষ্য আছে তাহাতে “বিদ্যাং চাবিদ্যাং চ” এই মন্ত্রর ব্যাখ্যাঃ করিবার সময় “বিদ্যা = আত্মজ্ঞান ও অবিদ্যা = কর্ম এই দুয়ের সমন্বয়ের দ্বারাই অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ লাভ হয়” এইরূপ অর্থ প্রদত্ত হইয়াছে । অনন্তাচাৰ্য এই উপনিষদের নিজ ভাষ্যে এই জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক অর্থই স্বীকার করিয়া শেষে স্পষ্ট লিখিয়াছেন যে, “এই মন্ত্রের সিদ্ধান্ত এবং “যৎসাংখ্যৈঃ প্ৰাপ্যতে স্থানং তদ্‌যোগৈরপি গম্যতে” [গী|৫|৫] এই গীতা বচনের অর্থ একই; এবং গীতার এই শ্লোকের ‘সাংখ্য’ ও ‘যোগ’ শব্দ অনুক্ৰমে ‘জ্ঞান’ ও ‘কর্মের’ বাচক” ।* সেইরূপ আবার, যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির উপর [যা|৩|৫৭ ও ২০৫] আপন টীকায় আপরার্কদেবও ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্ৰ দিয়া অনন্তাচাৰ্য্যেরই ন্যায় তাহার জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়াত্মক অৰ্থ করিয়াছেন । ইহা হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইবে যে, আমি আজ নূতন করিয়া ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্রের শাস্করভাষ্য হইতে ভিন্ন অর্থ করি নাই ।
*(ঈশাবাস্যোপনিষদের এই সব ভাষ্য পুণার আনন্দাশ্রমে মুদ্রিত ঈশাবাস্যোপনিষদের সংস্করণে প্রদত্ত হইয়াছে; যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির অপরার্কের টীকাও আনন্দাশ্রমেই আলাদা ছাপা হইয়াছে । প্ৰো. মোক্ষমূলর উপনিষদের যে ভাষান্তর করিয়াছেন তাহাতে ঈশাবাস্যের ভাষান্তর শাঙ্করভাষ্যকে অবলম্বন করিয়া করা হয় নাই । ইহার কারণ তিনি ভাষান্তরের শেষে দিয়াছেন (Sacred Books of the East Series Vol. 1. pp. 314-320) অনন্তাচার্যের ভাষ্য মোক্ষমূলর সাহেবের জানা ছিল না; এবং শাঙ্করভাষ্যে পৃথক অর্থ কেন করা হইয়াছে, তাহার মর্মও মোক্ষমুলার সাহেবের উপলব্ধি হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না ।)


38) মনু ও অন্যান্য স্মৃতির জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয়াত্মক বচন



স্বয়ং ঈশাবাস্যোপনিষদের মন্ত্র সম্বন্ধে এই বিচার হইল । এক্ষণে শঙ্করভাষ্যে “তপসা কল্মষং হন্তি বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে” এই যে মনুবচন প্রদত্ত হইয়াছে তাহার, একটু বিচার করিব । মনুস্মৃতির দ্বাদশ অধ্যায়ে এই শ্লোক ১০৪ সংখ্যার, এবং মনু ১২|৮৬ হইতে উপলব্ধি হইবে যে, ঐ প্রকরণ বৈদিক কর্মযোগের । কর্মযোগের এই বিচার-আলোচনায় -
তপো বিদ্যা চ বিপ্ৰস্য নিঃশ্ৰেয়সকরং পরম্‌ ৷
তপসা কল্মষং হন্তি বিদ্যয়াহমৃতমশ্নুতে ॥
প্রথম চরণে “তপ ও (চ) বিদ্যা (অর্থাৎ দুই-ই) ব্রাহ্মণের উত্তম মোক্ষপ্রদ” এইরূপ বলিয়া আবার প্রত্যেকের উপযোগ দেখাইবার জন্য “তপস্যার দ্বারা দোষ নষ্ট হইয়া বিদ্যার দ্বারা অমৃত লাভ হয়” এইরূপ দ্বিতীয় চরণে উক্ত হুইয়াছে । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, এই স্থানে জ্ঞানকর্মসমুচ্চয়ই মনুর অভিপ্ৰেত, এবং ঈশাবাস্যের একাদশ মন্ত্রের অর্থই মনু এই শ্লোকে বর্ণন করিয়াছেন । হারীতস্মৃতির বচন হইতেও এই অর্থই অধিক দৃঢ় হয় । এই হারীতস্মৃতি স্বতন্ত্র তো উপলব্ধি হয়ই এবং তাছাড়া নৃসিংহপুরাণেও [নৃ|পু|অ|৫৭|৬১] প্রদত্ত হইয়াছে । এই নৃসিংহপুরাণে [৬১|৯-১১] এবং হারীতস্মৃতিতে [৭|৯-১১] জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় সম্বন্ধে এই এক শ্লোক আছে -
যথাশ্বা রথহীনাশ্চ রথাশ্চাশ্বৈর্বিনা যথা ৷
এবং তপশ্চ বিদ্যা চ উভাবপি তপস্বিনঃ ॥
যথান্নং মধুসংযুক্তং মধুচান্নেন সংযুতম্‌ ৷
এবং তপশ্চ বিদ্যা চ সংযুক্তং ভেষজং মহৎ ॥
দ্বাভ্যামেব হি পক্ষাভ্যাং যথা বৈ পক্ষিণাং গতিঃ ৷
তথৈব জ্ঞানকর্মাভ্যাং প্রাপ্যতে ব্ৰহ্ম শাশ্বতম্ ॥
“যেরূপ রথ ব্যতীত অশ্ব ও অশ্ব ব্যতীত রথ (চলে না) তপস্বীর তপস্বা ও বিদ্যারও সেই অবস্থা । যেরূপ অন্ন মধুসংযুক্ত এবং মধু অন্নসংযুক্ত, সেইরূপ তপস্যা ও বিদ্যা সংযুক্ত হইলে এক মহা ঔষধ প্ৰস্তুত হয় । যেরূপ পক্ষীর গতি দুই পক্ষ-যোগেই হইয়া থাকে সেইরূপই জ্ঞান ও কর্ম (এই দুয়ের) দ্বারা শাশ্বত ব্ৰহ্ম লাভ হয়” । হারীতস্মৃতির এই বচন বৃদ্ধাত্ৰেয়স্মৃতির দ্বিতীয় অধ্যায়েও পাওয়া যায় । এই সকল বচন হইতে, এবং বিশেষতঃ তৎপ্রদত্ত দৃষ্টান্ত হইতে মনুস্মৃতির বচনের কি অর্থ করা উচিত, তাহা স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । তপ শব্দের মধ্যেই মনু চাতুর্বর্ণের কর্মের সমাবেশ করিয়াছেন । ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে [মনু|১১|২৩৬]; এবং এক্ষণে উপলব্ধি হইবে যে, তৈত্তিরীয় উপনিষদে “তপ ও স্বাধ্যায়প্রবচন” ইত্যাদি যে সকল আচরণ করিতে বলা হইয়াছে [তৈ|১|৯] তাহাও জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় পক্ষ স্বীকার করিয়াই বলা হইয়াছে । সমগ্ৰ যোগবাসিষ্ট গ্রন্থের তাৎপৰ্যই এই । কারণ, এই গ্রন্থের আরম্ভেই সুতীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন যে, শুধু জ্ঞানের দ্বারা, কেবল কর্মের দ্বারা কিংবা দুয়ের সমুচ্চয়ের দ্বারা মোক্ষলাভ হয় তাহা আমাকে বলো । এবং তাহার উত্তর দিবার সময়, হারীতস্মৃতির পক্ষীদৃষ্টান্ত গ্ৰহণ করিয়া “আকাশে পক্ষীদের গতি যেরূপ দুই পক্ষযোগেই হইয়া থাকে সেইরূপ জ্ঞান ও কর্ম এই দুয়ের দ্বারাই মোক্ষলাভ হয়, কেবল একটির দ্বারা এই সিদ্ধি লাভ হয় না” এইরূপ বলিয়া, পরে সেই অর্থকেই সবিস্তর সপ্রমাণ করিবার জন্য সমস্ত যোগবাসিষ্ঠ গ্ৰন্থ উক্ত হইয়াছে [যো|১|১|৬-৯] । সেইরূপ মুখ্য কথার মধ্যে বসিষ্ঠ রামকে “জীবন্মুক্তের ন্যায় বুদ্ধিকে শুদ্ধ রাখিয়া তুমি সমস্ত কর্ম কর” [যো|৫|১৮|১৭-২৬] কিংবা “কর্ম ত্যাগ করা আমরণ যুক্তিসিদ্ধ না হওয়ায় [যো|৬|উ|২|৪২], স্বধর্মানুসারে নির্দিষ্ট রাজ্যপালনের কাজ কর” [যো|৫|৫|৫৪ ও ৬|উ|২১৩|৫০], এইরূপ স্থানে স্থানে পুনঃ পুনঃ উপদেশ করিয়াছেন । এই গ্রন্থের উপসংহার এবং পরে রামচন্দ্রের অনুষ্ঠিত কাৰ্যও এই উপদেশেরই অনুরূপ । কিন্তু যোগবাসিষ্ঠের টীকাকার সন্ন্যাসমার্গীয় ছিলেন, তাই পক্ষীর দুই পক্ষের উপমা স্পষ্ট হইলেও, তিনি জ্ঞান ও কর্ম এই দুই যুগপৎ অর্থাৎ একই কালে বিহিত নহে, এইরূপ নিজের অভিপ্রেত মত লাগাহিয়া দিয়াছেন । কিন্তু এই অর্থ যে টানাবুনা, ক্লিষ্ট ও সাম্প্রদায়িক, তাহা টীকা ছাড়িয়া দিয়া মূলগ্ৰন্থ পাঠ করিলেই যে-কোন ব্যক্তিরই সহজে উপলব্ধি হইবে । যোগবাসিষ্ঠেরই ন্যায় মাদ্রাজ প্রান্তে গুরুজ্ঞানবাসিষ্ঠ-তত্ত্বসারায়ণ নামক এক গ্ৰন্থ প্ৰসিদ্ধ আছে । তাহার জ্ঞানকাণ্ড, উপাসনাকাণ্ড ও কর্মকাও, এই তিন ভাগ আছে । এই গ্ৰন্থকে যতটা পুরাতন বলা হয় তত পুরাতন মনে করি না, ইহা আমি পূর্বে বলিয়াছি । কিন্তু প্ৰাচীন না হইলেও জ্ঞানকর্মসমুচ্চয় পক্ষই তাহাতে প্ৰতিপাদ্য হওয়ায়, এই স্থানে তাহার উল্লেখ করা আবশ্যক । ইহাতে অদ্বৈত বেদান্ত আছে; এবং নিষ্কাম কর্মের উপরই ইহা বিশেষ ঝোঁক দেওয়ায় ইহার সম্প্রদায় শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য্যের সম্প্রদায় হইতে যে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র, ইহা বলিতে বাধা নাই । মাদ্রাজ অঞ্চলে এই সম্প্রদায়ের নাম ‘অনুভবাদ্বৈত’; এবং বস্তুত দেখিতে গেলে, ইহা গীতার কর্মযোগেরই এক নকল মাত্ৰ, এইরূপ উপলব্ধি হইবে । কিন্তু কেবল ভগবদ্‌গীতারই ভিত্তিতে এই সম্প্রদায় সিদ্ধ না করিয়া, ইহাতে বলা হইয়াছে যে, সমস্ত ১০৮ উপনিষদ হইতে ঐ অর্থই সিদ্ধ হয় । এইরূপ রামগীতা ও সূৰ্যগীতা এই দুই নূতন গীতাও ইহাতে প্রদত্ত হইয়াছে । অদ্বৈত মত স্বীকার করা অর্থে কর্মসন্ন্যাস-পক্ষকেই স্বীকার করা এইরূপ যে কাহারও কাহারও ধারণা, তাহা এই গ্ৰন্থ হইতে দূর হইবে । উপরিপ্রদত্ত প্ৰমাণে এক্ষণে স্পষ্ট বুঝা যাইবে যে, যে নিষ্কাম কর্মযোগ, সংহিতা, ব্ৰাহ্মণ, উপনিষৎ, ধর্মসূত্ৰ, মনুযাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতি, মহাভারত, ভগবদ্‌গীতা, যোগবাসিষ্ঠ ও পরিশেষে তত্ত্বসারায়ণ প্ৰভৃতি গ্রন্থেও প্রতিপাদিত হইয়াছে, তাহাকে শ্রুতিস্মৃতি-প্রতিপাদিত না মানিয়া কেবল সন্ন্যাসমার্গকেই শ্রুতিস্মৃতি-প্ৰতিপাদিত বলা সর্বথা ভিত্তিহীন ।

এই মৃত্যুলোকের ব্যবহার চালাইবার জন্য কিংবা লোকসংগ্ৰহাৰ্থ যথাধিকার নিষ্কাম কর্ম, এবং মোক্ষলাভার্থ জ্ঞান, এই দুয়ের এককালীন সমুচ্চয়ই, অথবা মহারাষ্ট্র কবি শিবদিন-কেসরীর বর্ণনা অনুসারে -
প্ৰপঞ্চ সাধুনি পরমার্থচ লাহো জ্যানে কেলাঁ ৷
তো নর ভলা ভলা রে ভলা ভলা ॥
“যিনি প্ৰপঞ্চ সাধন করিয়া (সংসারের সমস্ত কর্তব্য যথোচিত পালন করিয়া) পরমার্থ লাভ করিয়াছেন তিনিই ভালো, ভালো, ভালো ভালো” - এই অর্থই গীতায় প্রতিপাদিত হইয়াছে । কর্মযোগের এই মাৰ্গ প্ৰাচীনকাল হইতে প্রচার হইয়া আসিতেছে; জনক প্রভৃতি ইহাই আচরণ করায় এবং স্বয়ং ভগবানের দ্বারা উহার প্রসার ও পুনরুজ্জীবন হওয়া প্ৰযুক্ত, ইহাকেই ভাগবতধর্ম বলা হয় । এই সকল বিষয় ভালরূপে সিদ্ধ হইল । এই মার্গের জ্ঞানীপুরুষ পরমার্থযুক্ত স্বকীয় প্রপঞ্চ - জাগতিক ব্যবহার - কিরূপভাবে চালান, লোকসংগ্ৰহদৃষ্টিতে, ইহা দেখাও আবশ্যক । কিন্তু উপস্থিত প্রকরণ অত্যন্ত দীর্ঘ হওয়া প্ৰযুক্ত পরবর্তী প্রকরণে তাহার স্পষ্টীকরণ করিব ।


ইতি একাদশ প্রকরণ সমাপ্ত ।


___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment