Sunday, June 4, 2017

সুখদুঃখবিবেক (Consideration of Happiness & Unhappiness)

সুখদুঃখবিবেক


সুখমাত্যন্তিকং যত্তৎ বুদ্ধিগ্রাহ্যমতীন্দ্ৰিয়ম্‌ ৷ [গীতা |৬|২১]

(“যাহা কেবল বুদ্ধির দ্বারা গ্রাহ্য ও অতীন্দ্রিয় তাহাই আত্যন্তিক সুখ” ।)


সূচীপত্র



1) সুখের জন্য প্রত্যেকের প্রবৃত্তি
2) সুখদুঃখের লক্ষণ ও ভেদ
2.1) বেদান্তে সুখদুঃখের ভেদ
3) সুখ স্বতন্ত্র বা দুঃখাভাবরূপ ? সন্ন্যাসমার্গের মত
4) সন্ন্যাসমার্গের মতের খণ্ডন : গীতার সিদ্ধান্ত
5) সুখ ও দুঃখ, দুই স্বতন্ত্র ভাব
6) ইহলোক প্রাপ্ত সুখ-দুঃখবিপর্যয়
7) সংসারে সুখ অধিক বা দুঃখ ?
7.1) পাশ্চাত্য সুখাধিক্যবাদ
7.2) পাশ্চাত্য মতের খণ্ডন : আত্মহত্যার সাথে সুখের সম্বন্ধ নাই
7.3) সুখের ইচ্ছার অপার বৃদ্ধি
7.4) সুখের ইচ্ছা সুখোপভোগে তৃপ্ত হয় না ⇒ সংসারে দুঃখের আধিক্য
7.5) আমাদের শাস্ত্রকারদের তদনুকুল সিদ্ধান্ত
7.6) শোপেনহরের মত
8) অসন্তোষের উপযোগ
9) উহার দুষ্পরিণাম হটাইবার উপায়
10) সুখদুঃখ অনুভবের আত্মবশ্যতা, এবং ফলাশার লক্ষণ
11) ফলাশা ত্যাগ করিলেই দুঃখনিবারণ হয়, অতএব কর্মত্যাগের নিষেধ
12) ইন্দ্রিয়নিগ্রহের মর্যাদা
13) কর্মযোগের চতুঃসূত্র 
14) আত্মপ্রসাদজ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সুখের শ্রেষ্ঠতা ও নিত্যতা
15) এই দুই সুখের প্রাপ্তিই কর্মযোগদৃষ্টিতে পরম সাধ্য
16) বিষয়োপভোগসুখ অনিত্য এবং পরমধ্যেয় হইবার অযোগ্য
17) আধিভৌতিক সুখবাদের অপূর্ণতা



1) সুখের জন্য প্রত্যেকের প্রবৃত্তি



সুখ পাইবার জন্য কিংবা প্রাপ্ত সুখের বৃদ্ধির জন্য, দুঃখ নিবারণ বা লাঘব করিবার জন্য প্রত্যেক মনুষ্য এই জগতে সর্বদাই চেষ্টা করিয়া থাকে; এই সিদ্ধান্ত আমাদের শাস্ত্রকারদিগের অভিমত । “ইহ খলু অমৃষ্মিংশ্চ লোকে বস্তুপ্ৰবৃত্তয়ঃ সুখাৰ্থমভিধীয়ন্তে ৷ ন হ্যতঃপরং ত্ৰিবৰ্গফলং বিশিষ্টতর মস্তি ৷” [মভা|শা|১৯৯০|৯] । ইহলোকে কিংবা পরলোকে সমস্ত প্ৰবৃত্তি সুখের নিমিত্ত; ইহার অতিরিক্ত ধর্মার্থকামের আর কোন ফল নাই, ইহা শান্তিপর্বে ভৃগু ভরদ্বাজকে বলিয়াছেন । কিন্তু শাস্ত্রকারগণ বলিয়াছেন যে, মনুষ্য প্ৰকৃত সুখ কিসে হয় ইহা না বুঝিবার দরুন, মেকি মুদ্ৰা আঁচলে বাঁধিয়া তাহাই খাঁটি মনে করিয়া মিথ্যা সুখকেই সত্য সুখ মনে করে; এবং আজ না হয় কাল সুখ নিশ্চয়ই মিলিবে এই আশায় ভর করিয়া, জীবন কাটাইতে থাকে । ইহাতেই তাহাকে একদিন মৃত্যুর কবলে পড়িয়া সংসার ছাড়িয়া যাইতে হয় । তথাপি সে সাবধান না হইয়া পুনর্বার তাহারই অনুসরণ করিয়া থাকে । এই ভাবে এই ভাবচক্র চলিতেছে, কেহই প্রকৃত ও নিত্য সুখ কি, তাহার বিচার করে না । সংসার কেবল দুঃখময়, কিংবা সুখপ্রধান বা দুঃখপ্রধান, এই সম্বন্ধে প্রাচ্য ও পশ্চাত্য তত্ত্বজ্ঞানীদিগের মধ্যে খুবই মতভেদ আছে । কিন্তু এই সকল মতবাদীদিগের সকলেরই ইহা স্বীকৃত যে, দুঃখের অত্যন্ত নিবারণ পূর্বক অত্যন্ত সুখ প্ৰাপ্তির কার্যেই মনুষ্যের কল্যাণ ।


2) সুখদুঃখের লক্ষণ ও ভেদ



সুখ’ শব্দের পরিবর্তে প্ৰায় ‘হিত’, ‘শ্ৰেয়’, ‘কল্যাণ’ এই সকল শব্দ বেশী ব্যবহৃত হইয়া থাকে । উহাদের মধ্যে ভেদ কি, তাহা পরে বলা যাইবে । ‘সুখ’ শব্দের ভিতর সর্বপ্রকারের সুখ বা কল্যাণের সমাবেশ হয়, এ কথা মানিলে, সুখের নিমিত্ত প্রত্যেকের প্রযত্ন হইয়া থাকে, এ কথা সাধারণত বলা যাইতে পারে । কিন্তু ইহার মূলে “যদিষ্টং তৎসুখং প্রাহুঃ দ্বেষ্যং দুঃখমিহেষ্যতে” - আপনার যাহা কিছু ইষ্ট তাহাই সুখ এবং আমরা যাহার দ্বেষ করি অর্থাৎ যাহা কিছু আমরা চাহি না তাহাই দুঃখ - এইরূপ সুখদুঃখের যে লক্ষণ মহাভারতের অন্তর্গত পরাশরগীতায় বিবৃত হইয়াছে [মভা|শাং|২৯৫|২৭], শাস্ত্রদৃষ্টিতে তাহা সম্পূর্ণ নিৰ্দোষ নহে । কারণ এই ব্যাখ্যায় ‘ইষ্ট’ শব্দের অর্থ ইষ্ট বস্তু বা পদার্থ হইলেও হইতে পারে; এবং এইরূপ অর্থ ধরিলে, ইষ্ট পদার্থকেও সুখ বলিতে হয় । উদাহরণ যথা, তৃষ্ণার সময় জল ইষ্ট হইলেও, ‘জল’ এই বাহ্য পদার্থকে ‘সুখ’ নাম দেওয়া যাইতে পারে না । ওরূপ হইলে, নদীর জলে-ডোবা মানুষের বলিতে হয় যে, সে সুখেতে ডুবিতেছে । ইহাই সত্য যে, জলপানে যে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি হয় তাহাই সুখ । ইহাতে সন্দেহ নাই যে, মনুষ্য এই ইন্দ্ৰিয়তৃপ্তিকে বা সুখকেই চাহে; কিন্তু তাই বলিয়া মানুষ যাহা চাহিবে তাহাই যে সমস্ত সুখ হইবে, এরূপ ব্যাপক সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে না । এই কারণে নৈয়ায়িকেরা অনুকুল-বেদনীয়ং সুখং, যে বেদনা আমাদের অনুকূল তাহাই সুখ এবং প্ৰতিকুল-বেদনীয়ং দুঃখং - যে বেদনা আমাদের প্রতিকূল তাহাই দুঃখ, এইরূপ ব্যাখ্যা দিয়া সুখ ও দুঃখ উভয়ই একপ্রকার বেদনা বলিয়া স্থির করিয়াছেন । এই বেদনা মূলতঃ অর্থাৎ জন্ম হইতেই সিদ্ধ এবং অনুভবগম্য হওয়া প্ৰযুক্ত, নৈয়ায়িকদিগের এই ব্যাখ্যা অপেক্ষা সুখদুঃখের কোন সুন্দরতর লক্ষণ বলা যাইতে পারে না । এই বেদনারূপ সুখদুঃখ, কেবল মনুষ্যের ব্যাপারাদিতেই সমুদ্ভূত হয়, ইহা বলা ঠিক নহে; কারণ, কখন কখন দেবতাদের কোপ-প্ৰযুক্তও কঠিন রোগ উৎপন্ন হইবার ফলে মনুষ্যকে দুঃখ ভোগ করিতে হয় । 


2.1) বেদান্তে সুখদুঃখের ভেদ



তাই, বেদান্তগ্ৰন্থাদিতে সাধারণত, (i)আধিদৈবিক, (ii)আধিভৌতিক ও (iii)আধ্যাত্মিক - সুখদুঃখের এই তিন ভেদ করা হইয়াছে । 
(i)আধিদৈবিক : দেবতার প্রসাদে বা কোপে যে সুখদুঃখ অনুভূত হয় তাহাকে “আধিদৈবিক” এই সংজ্ঞা দেওয়া হয়; 
(ii)আধিভৌতিক : বাহ্য জগতের পৃথিবী প্রভৃতি পঞ্চ মহাভূতাত্মক পদার্থ মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের সহিত সংযুক্ত হইলে শীতোষ্ণাদিমূলক যে সুখদুঃখ হয় তাহাকে “আধিভৌতিক” নাম দেওয়া হয়; 
(iii)আধ্যাত্মিক : এবং এই প্রকারের বাহ্য সংযোগ ব্যতীত উৎপন্ন অন্য সমস্ত সুখদুঃখ “আধ্যাত্মিক” নামে অভিহিত হয় । 
এ সুখদুঃখের এই বৰ্গীকরণ স্বীকার করিলে শরীরান্তর্ভূত বাতপিত্তাদি দোষের পরিণাম বিকৃত হইয়া যে জরাদি দুঃখ উৎপন্ন হয়, এবং উহাদের পরিণাম ঠিক থাকিলে শরীরপ্ৰকৃতির যে স্বাস্থ্য উৎপন্ন হয়, তাহা আধ্যাত্মিক সুখদুঃখের মধ্যে পরিগণিত হইয়া থাকে । কারণ, এই সুখদুঃখ পঞ্চভূতাত্মা শরীরান্তর্ভূত হইলেও অর্থাৎ শারীরিক হইলেও, শরীরের বাহিরের পদার্থসংযোগে উহা উৎপন্ন হইয়াছে, এ কথা সব সময়ে বলা যাইতে পারে না; এবং সেই জন্য, বেদান্তদৃষ্টিতে আধ্যাত্মিক সুখদুঃখেরও পুনরায় কামিক ও মানসিক, এইরূপ ভেদ নির্ণয় করা আবশ্যক হয় । কিন্তু এইপ্ৰকার সুখদুঃখের কায়িক ও মানসিক এই দুই ভেদ করিলে, আবার আধিদৈবিক সুখদুঃখকে স্বতন্ত্র বলিয়া স্বীকার করিবার প্রয়োজন থাকে না । কারণ, দেবতার প্ৰসাদে কিংবা কোপে সমূৎপন্ন সুখদুঃখকেও, মনুষ্যের নিজের শরীরে কিংবা মনে ভোগ করিতে হয়, ইহা ত স্পষ্টই দেখা যায় । তাই আমি এই গ্রন্থে বেদান্তগ্রন্থের পরিভাষা অনুসারে সুখদুঃখের ত্ৰিবিধ বৰ্গীকরণ না করিয়া উহাদের বাহ্য বা কায়িক এবং আভ্যন্তর বা মানসিক এই দুই বৰ্গই কল্পনা করিয়া, প্ৰথম অর্থাৎ সর্বপ্রকার কায়িক সুখদুঃখকে “আধিভৌতিক” এবং সমস্ত মানসিক সুখদুঃখকে “আধ্যাত্মিক” এই নামে অভিহিত করিয়াছি । বেদান্তগ্রন্থের “আধিদৈবিক” বলিয়া স্বতন্ত্র তৃতীয় বর্গ আমি স্থাপন করি নাই । কারণ, আমার মতে সুখদুঃখের শাস্ত্রীয় বিচার করিবার পক্ষে এই দ্বিবিধ বৰ্গীকরণই অপেক্ষাকৃত অধিক সহজ । সুখদুঃখের পরবর্তী বিচার পড়িবার সময়, বেদান্তগ্রন্থের ও আমার পরিভাষার ভেদ সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক ।


3) সুখ স্বতন্ত্র বা দুঃখাভাবরূপ ? সন্ন্যাসমার্গের মত



সুখদুঃখ দ্বিবিধই স্বীকার কর, বা ত্ৰিবিধই স্বীকার কর, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, দুঃখ কেহই চাহে না । তাই সর্বপ্রকার দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি করা এবং আত্যন্তিক ও নিত্য সুখ অর্জন করাই মনুষ্যের পুরুষাৰ্থ, এইরূপ বেদান্ত ও সাংখ্য এই দুই শাস্ত্রেই উক্ত হইয়াছে [সাং|কা|১; গী|৬|২১,২২] । এইরূপ আত্যন্তিক সুখই মনুষ্যের পরম সাধ্য স্থির হইলে পর, এই প্রশ্ন সহজেই মনে আসে যে, অত্যন্ত সত্য ও নিত্য সুখ কাহাকে বলে, তাহা লাভ করা সাধ্যায়ত্ত কি না, সাধ্যায়ত্ত হইলে কিরূপে ও কখন লাভ হইতে পারে ইত্যাদি । এবং এই সকল বিষয়ের বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে প্ৰথমেই এই প্রশ্ন উঠে যে, নৈয়ায়িকদের প্রদত্ত লক্ষণ অনুসারে সুখ ও দুঃখ কি দুই প্রকার স্বতন্ত্র বেদনা, অনুভূতি বা বস্তু, অথবা “আলোক না হইলেই অন্ধকার” এই ন্যায় অনুসারে এই দুই বেদনার মধ্যে একের অভাব হইলেই কি দ্বিতীয় সংজ্ঞার উপযোগ করা হয় ? ভর্তৃহরি বলিয়াছেন -“তৃষ্ণায় ঠোঁট শুকাইয়া গেলে সেই দুঃখ নিবারণার্থ আমরা মিষ্ট জল পান করি, ক্ষুধায় পীড়িত হইলে সুগ্ৰাস অন্ন খাইয়া সেই ক্লেশ দূর করি, এবং কামবাসনা প্ৰদীপ্ত হইয়া দুঃসহ হইলে স্ত্রীসঙ্গের দ্বারা তাহা তৃপ্ত করি”; এই কথা বলিয়া শেষে বলিয়াছেন -
“প্ৰতীকারো ব্যাধেঃ সুখমিতি বিপর্যস্যতি জনঃ ৷”
কোন ব্যাধি বা দুঃখ হইলে, তাহার নিবারণ বা প্ৰতীকারকেই লোকে ভ্ৰম-ক্ৰমে সুখ বলে । দুঃখনিবারণের অতিরিক্ত সুখ বলিয়া কোন স্বতন্ত্র পদার্থ নাই । উক্ত সিদ্ধান্ত মনুষ্যের স্বার্থমূলক ব্যবহারসমূহের বিষয়েই যে কেবল খাটে, তাহা নহে । অন্যের উপকার করিবার সময়েও তাহার দুঃখ দেখিয়া আমাদের অন্তরে জাগ্ৰত কারুণ্যবৃত্তি আমাদের দুঃসহ হইয়া থাকে, এবং সেই দুঃসহত্বের ক্লেশ দূর করিবার জন্যই আমরা পরোপকার করি, - ইহা যে আনন্দগিরির মত, তাহা পূর্ব প্রকরণে বলিয়াছি । এই পক্ষ স্বীকার করিলে মহাভারতের অনুসরণে মানিতে হয় যে, 
“তৃষ্ণাৰ্ত্তিপ্ৰভবং দুঃখং দুঃখাৰ্ত্তিপ্রভবং সুখং ৷”
প্ৰথমে কোন বিষয়ের তৃষ্ণা উৎপন্ন হইলে, সেই তৃষ্ণার পীড়া হইতে দুঃখ হয় এবং সেই দুঃখের পীড়া হইতে পুনরায় সুখ উদ্ভূত হয় [শাং|২৫|২২; ১৭৪,১৯] । সংক্ষেপে এই মার্গের উক্তি এই যে, মনুষ্যের মনে প্ৰথমত কোন আশা, বাসনা বা তৃষ্ণা উৎপন্ন হইয়া তাহা হইতে দুঃখ উৎপন্ন হইলে পর, উক্ত দুঃখের নিবারণত সুখ; সুখ বলিয়া স্বতন্ত্র পৃথক কোন বস্তু নাই । অধিক কি, এই মার্গের লোকেরা এই অনুমানও বাহির করিয়াছেন যে, মনুষ্যের সাংসারিক সমস্ত প্ৰবৃত্তি বাসনাত্মক ও তৃষ্ণাত্মক; যে পৰ্যন্ত সমস্ত সাংসারিক কর্মের ত্যাগ করা না যায়, সে পৰ্যন্ত বাসনা বা তৃষ্ণা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয় না; তৃষ্ণার সম্পূর্ণ নিবৃত্তি ব্যতীত, সত্য ও নিত্য সুখ লাভ হইতে পারে না । বৃহদারণ্যকে [বৃ|৪|৪|২২; বেসু|৩|৪|১৫] বিকল্পভাবে এবং জাবালসন্ন্যাসাদি উপনিষদে মুখ্যভাবে এই মাৰ্গই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে; সেইরূপ অষ্টাবক্ৰগীতাতে [৯|৮; ১০|৩,৮] এবং অবধূতগীতাতে [৩|৪৬] ইহারই অনুবাদ করা হইয়াছে । এই মার্গের চরম সিদ্ধান্ত এই যে, যে ব্যক্তি আত্যন্তিক সুখ বা মোক্ষ লাভ করিতে চাহে, তাহার পক্ষে যত শীঘ্ৰ সম্ভব সংসার ছাড়িয়া সন্ন্যাস অবলম্বন করা আবশ্যক । স্মৃতিগ্ৰন্থসমূহে বর্ণিত এবং শ্ৰীশঙ্করাচার্য কর্তৃক কলিযুগে স্থাপিত শ্ৰৌত-স্মার্ত কর্ম-সন্ন্যাসমার্গ এই তত্ত্বের উপরেই দাঁড়াইয়া আছে । সত্য; সুখ বলিয়া যদি কোন স্বতন্ত্র পদাৰ্থ না থাকে, যাহা কিছু আছে তাহা যদি শুধু দুঃখই হয় এবং তাহাও তৃষ্ণামূলক হয়, তাহা হইলে এই তৃষ্ণাদিরই বিকার প্রথমত সমুলে উৎপাটিত করিয়া ফেলিলে স্বার্থের ও পরার্থের সমস্ত কচ্‌কচি আপনিই বিলুপ্ত হইবে, এবং মনের মূল সান্যাবস্থা ও শান্তি থাকিয়া যাইবে । এই অভিপ্ৰায়েই মহাভারতে শান্তিপর্বের অন্তৰ্গত পিঙ্গলগীতায় এবং মঙ্কিগীতাতেও উক্ত হইয়াছে যে, -
যচ্চ কামসুখং লোকে যচ্চ দিব্যং মহৎ সুখম্‌ ৷
তৃষ্ণাক্ষয়সুখস্যৈতে নাৰ্হতঃ ষোড়শীং কলাম্‌ ॥
“ইহলোকে কাম অর্থাৎ বাসনার তৃপ্তিতে যে সুখ হয় এবং স্বর্গের যে মহৎ সুখ - এই দুই সুখের যোগ্যতা, তৃষ্ণাক্ষয়জনিত সুখের ষোল কলারও সমান নহে” [শাং|১৭৪|৪৮; ১৭৭|৪৯] । পরে জৈন ও বৌদ্ধধর্মে বৈদিক সন্ন্যাসমার্গেরই অনুকরণ করা হইয়াছে । তাই, এই দুই ধর্মের গ্ৰন্থসমূহে তৃষ্ণার দুষ্পরিণাম ও ত্যাজ্যতা উপরি-উক্ত বচনের অনুরূপ এবং স্থানে স্থানে একটু বেশী করিয়া বর্ণিত হইয়াছে (উদাহরণার্থ, ধর্মপদের অন্তভূর্ত তৃষ্ণাবর্গ দেখ) । তিব্বতদেশস্থ বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থাদিতে ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, মহাভারতের উক্ত শ্লোক, বুদ্ধত্ব প্ৰাপ্ত হইবার পর গৌতম বুদ্ধের মুখ হইতে বাহির হইয়াছে । [Rockhill’s “Life of Budha”, P. 33, উদান নামক পালি গ্রন্থে [২|২] এই শ্লোকটি আছে । কিন্তু উহাতে এরূপ বলা হয় নাই যে, বুদ্ধত্ব প্রাপ্ত হইবার সময়, বুদ্ধের মুখ হইতে এই শ্লোক বাহির হইয়াছে । ইহা হইতে এই শ্লোক সর্বপ্রথম যে বুদ্ধের মুখ হইতে বাহির হয় নাই তা স্পষ্ট উপলব্ধি হয় ।]


4) সন্ন্যাসমার্গের মতের খণ্ডন : গীতার সিদ্ধান্ত



উপরি-উক্ত তৃষ্ণার দুষ্পরিণাম ভগবদ্‌গীতায় স্বীকৃত হয় নাই এরূপ নহে । তথাপি উহার নিবারণার্থ সমস্ত কর্ম ত্যাগ করা উচিত নহে, গীতার এইরূপ সিদ্ধান্ত হওয়ায়, সুখদুঃখের উক্ত উপপত্তি সম্বন্ধে একটু সূক্ষ্ম বিচার করা আবশ্যক । তৃষ্ণাদি দুঃখের নিবারণ হইতেই সমস্ত সুখ উৎপন্ন হয়, সন্ন্যাসমার্গের এই উক্তি সম্পূর্ণরূপে সত্য বলিয়া মানা যাইতে পারে না । একবার অনুভূত (দৃষ্ট শ্রুত প্রভৃতি) কোন বস্তু পুনৰ্বার চাহিলেই তাহাকে ‘কাম’, ‘বাসনা’ বা ‘ইচ্ছা’ বলা হইয়া থাকে । ঈপ্সিত বস্তু শীঘ্ৰ না পাইলে দুঃখ হয়; এবং এই ইচ্ছা আরও তীব্ৰ হইতে থাকিলে, কিংবা প্ৰাপ্ত সুখ পূর্ণ মাত্রায় না হওয়ায় উহার আকাঙ্ক্ষা ক্ৰমেই বাড়িতে থাকিলে সেই ইচ্ছাকে, তৃষ্ণা নাম দেওয়া হয় । কিন্তু কেবল ইচ্ছা এইরূপে তৃষ্ণার স্বরূপ প্ৰাপ্ত হইবার পূর্বে যদি সেই ইচ্ছা পূর্ণ হয়, তবে তজ্জনিত সুখ তৃষ্ণাদুঃখের ক্ষয় হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, একথা আমি বলিতে পারি না । উদাহরণ যথা – প্রতিদিন আহার যথা সময়ে প্রাপ্ত হইলে, আহারের পূর্বে দুঃখই হইয়া থাকে এরূপ আমাদের অনুভব হয় না । সময়মত আহার না মিলিলে প্ৰাণ ক্ষুধায় ব্যাকুল হইবে, নচেৎ হইবে না । ভাল; যদি স্বীকার করা যায় যে, তৃষ্ণা ও ইচ্ছা একই অর্থবাচক শব্দ, তাহা হইলেও সমস্ত সুখই তৃষ্ণামূলক, এ সিদ্ধান্ত সত্য বলিয়া মানা যাইতে পারে না । উদাহরণ যথা - এক ছোট ছেলের মুখে অকস্মাৎ মিছ্‌রীর এক টুকরো দিলে তাহার যে সুখ হয়, সে সুখ তাহার পূর্ব তৃষ্ণার ক্ষয়প্রযুক্ত হইয়াছে, এরূপ বলা যায় না । সেইরূপ, রাস্তায় চলিতে চলিতে কোন রমণীয় উদ্যান হইতে কোকিলের মধুর ডাক কানে আসিলে এ কথা বলা যায়ী না যে, সেই মধুর ধ্বনি শোনা প্ৰযুক্ত যে সুখ, সেই সুখ আমি পূৰ্বেই ইচ্ছা করিয়া বসিয়াছিলাম । এই কথাই ঠিক যে, সুঃখর ইচ্ছা না করিলেও ঐ সময়ে আমি সুখ পাইয়াছিলাম । এই উদাহরণের প্রতি লক্ষ্য করিলে এইরূপ বলিতে হয় যে, সন্ন্যাসমার্গের অবলম্বিত সুখের উপরি-উক্ত ব্যাখ্যা ঠিক নহে । 


5) সুখ ও দুঃখ, দুই স্বতন্ত্র ভাব



এবং ইহাও বলিতে হয় যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহের ভাল-মন্দ পদার্থের উপভোগ করিবার স্বাভাবিক শক্তি থাকাতে ইন্দ্ৰিয়গণ যখন আপনাপন ব্যাপার সম্পাদন করে, এবং যদি কোন সময়ে তাহাদের অনুকূল বা প্ৰতিকূল বিষয় প্ৰাপ্তি হয়, তখন গোড়ায় তৃষ্ণা বা ইচ্ছা না থাকিলেও, আমাদের সুখদুঃখের অনুভব হইয়া থাকে । এই অভিপ্ৰায়েই, “মাত্রাস্পর্শের” দ্বারা শীতোষ্ণাদির অনুভব ঘটলে সুখদুঃখ হয়, গীতাতে এইরূপ কথিত হইয়াছে [গী|২|১৪] । সৃষ্টির অন্তৰ্গত বাহ্য পদার্থের সংজ্ঞা হইতেছে ‘মাত্ৰা’ গীতার উক্ত পদের অর্থ এই যে, যখন ইন্দ্ৰিয়াদির সহিত বাহ্য পদার্থের স্পর্শ অর্থাৎ সংযোগ হয় তখন সুখদুঃখের বেদনা উৎপন্ন হয় । কর্মযোগশাস্ত্রেরও ইহাই সিদ্ধান্ত । কৰ্কশ আওয়াজ কানের কেন অপ্রিয় এবং জিহ্বার মধুর রস কেন প্রিয়, কিংবা পূর্ণিমার জ্যোৎস্না নয়নের কেন আনন্দদায়ক মনে হয়, এ সকলের কারণ কেহই বলিতে পারে না । মধুর রস পাইলে জিহ্বা পরিতুষ্ট হয়, এইটুকুই আমরা জানি । ইহা হইতে উপলব্ধি হইতেছে যে, আধিভৌতিক সুখের স্বরূপ কেবল ইন্দ্ৰিয়াধীন হওয়ায় অনেক সময় এই ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপার চালাইতে থাকিলেই সুখ অনুভূত হয়, পরে তাহার পরিণাম যাহাই হোক্‌ না কেন । উদাহরণ যথা - কখনো কখনো এমন হয় যে, কোন চিন্তা মনে আসিলে ঐ বিচারসূচক শব্দ আপনিই মুখ দিয়া বাহির হয় । এই শব্দ কাহাকে জানাইবার জন্য বাহির হয় না; উল্টা, কত সময় এই সকল স্বাভাবিক ব্যাপারে মনের গুপ্ত অভিপ্ৰায় বা মৎলব বাহিরে প্রকাশ হইয়া পড়ায় ক্ষতি হইবারও সম্ভাবনা হয় । ছোট ছেলেরা প্ৰথম চলিতে শিখিলে, সমস্ত দিন অকারণ যে ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহার কারণ এই যে, চলন ক্রিয়াতেই সেই সময় তাহাদের আনন্দ বোধ হয় । তাই, দুঃখের অভাবই সমস্ত সুখ এইরূপ না বলিয়া, “ইন্দ্ৰিয়স্যেন্দ্ৰিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ” [গী|৩|৩৪] ইন্দ্ৰিয়সমূহে ও তাহাদের শব্দস্পর্শদি বিষয়সমূহে যে রাগ (প্রেম) ও দ্বেষ থাকে, এই দুই প্ৰথম হইতেই ‘ব্যবস্থিত’ অর্থাৎ স্বতন্ত্রসিদ্ধ বলা হইয়াছে । এবং এখন আমাদের দেখিতে হইবে যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহের এই ব্যাপার কিরূপে আত্মার কল্যাণদায়ক হয় কিংবা সেগুলিকে আত্মার কল্যাণদায়ক করা যাইতে পারে । এই কারণে ভগবানের এই উপদেশ যে, ইন্দ্ৰিয় ও মনের বৃত্তিসমূহকে একেবারে বিনাশ করিবার চেষ্টা না করিয়া তাহাদিগকে আমাদের আত্মার উপকারে আনিবার জন্য আপনার অধীনে রাখিবে, স্বেচ্ছাচারী হইতে দিবে না । ভগবানের এই উপদেশ এবং তৃষ্ণা কিংবা তৃষ্ণারই ন্যায় অন্য সমস্ত মনোবৃত্তিকে সমূলে উচ্ছেদ করা, এই দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল প্ৰভেদ । জগতের সমস্ত কর্তৃত্ব ও পরাক্রম একেবারে উচ্ছিন্ন করিবে, গীতার তাহা তাৎপর্য নহে; বরং উহার অষ্টাদশ অধ্যায়ে [১৮|২৬] বলা হইয়াছে যে, কাৰ্যকর্তাতে সমবুদ্ধির সহিত ধৃতি ও উৎসাহ গুণও থাকা আবশ্যক । এই বিষয়ে অধিক বিচার আলোচনা পরে করিব । এখানে কেবল ইহাই আমাদের বিবেচ্য যে, ‘সুখ’ ও ‘দুঃখ’ দুই ভিন্ন বৃত্তি, কিংবা তন্মধ্যে একটি দ্বিতীয়টির অভাবমাত্র । এই বিষয়ে ভগবদ্‌গীতার অভিপ্রায় কি, তাহা উপরি-উক্ত আলোচনা হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইয়াছে । ‘ক্ষেত্র’ বস্তুটি কি তাহা বলিবার সময় সুখ ও দুঃখের পৃথক পৃথক গণনা করা হইয়াছে [গী|১৩|৬] । শুধু তাহা নহে, সুখ’ সত্ত্বগুণের লক্ষণ এবং ‘তৃষ্ণা’ রজোগুণের লক্ষণ [গী|১৪|৬,৭], ইহাও উক্ত হইয়াছে; এবং সত্ত্বগুণ ও রজোগুণ দুই পৃথক্‌ পৃথক্‌ । এই অনুসারেও, ভগবদ্‌গীতার এইমত স্পষ্ট জানা যাইতেছে যে, সুখ ও দুঃখ উভয়ে পরস্পরের প্রতিযোগী এবং দুই পৃথক্‌ পৃথক্‌ বৃত্তি । অষ্টাদশ অধ্যায়ে “কোন কর্ম দুঃখজনক বলিয়া ত্যাগ করিলে ত্যাগের ফল লাভ হয় না, কিন্তু এই প্ৰকার ত্যাগ রাজসিক উক্ত হয়” [গী|১৮|৮] এইরূপে যে রাজসিক ত্যাগের ন্যূনতা প্ৰদৰ্শিত হইয়াছে, তাহাও “সমস্ত সুখই তৃষ্ণাক্ষয়মূলক”, এই সিদ্ধান্তের বিরূদ্ধ ।


6) ইহলোক প্রাপ্ত সুখ-দুঃখবিপর্যয়



সমস্ত-সুখ তৃষ্ণাক্ষয়রূপ কিংবা দুঃখ-অভাবরূপ নহে এবং সুখ ও দুঃখ দুই স্বতন্ত্র বস্তু স্বীকার করিলেও এই দুই বেদনা পরম্পরবিরুদ্ধ বা প্ৰতিযোগী হওয়া প্ৰযুক্ত আর একটি প্রশ্ন এই উঠে যে, যাহার দুঃখের একটুও অনুভব নাই, সে সুখের মধুরতা উপলব্ধি করিতে পারে কি না ? কেহ কেহ বলেন যে, দুঃখানুভব না হইলে সুখের মধুরতা উপলব্ধি করা যায় না । উল্টাপক্ষে, স্বৰ্গস্থ দেবতাদিগের নিত্য সুখের দৃষ্টান্ত দিয়া অন্য পণ্ডিতেরা এইরূপ প্ৰতিপাদন করেন যে, সুখের মধুরতা উপলব্ধি করিবার জন্য দুঃখের পূর্বানুভব অত্যাবশ্যক নহে । লবণাক্ত পদার্থের আস্বাদন না হইলেও যেমন মধু, গুড়, চিনি, আম, কলা ইত্যাদি পদার্থের পৃথক্‌ পৃথক্‌ মিষ্টত্ব অনুভব করা যায়, সেইরূপ সুখেরও অনেক প্রকার ভেদ থাকার কারণে পূর্বদুঃখানুভব ব্যতীতও সব সময়েই ভিন্ন ভিন্ন সুখের - যথা তুলার গদির পর পালকের গদিতে বসা বা পাল্‌কীর পর তাঞ্জামে চড়া ইত্যাদি সুখের পর্যায়ে বিরক্তি না জন্মিয়া - অনুভব হওয়া অসম্ভব নহে । কিন্তু এই জগতের ব্যবহার দেখিলে এই তর্ক নিরর্থক বলিয়া বুঝা যাইবে । পুরাণে দেবতাদিগেরও সঙ্কটে পতিত হইবার অনেক উদাহরণ আছে; এবং পুণ্যাংশ চলিয়া গেলে স্বৰ্গসুখও কালান্তরে বিলুপ্ত হয় । অতএব স্বৰ্গসুখের দৃষ্টান্ত উপযোগী নহে; এবং উপযোগী হইলেও স্বর্গের দৃষ্টান্ত আমাদের কি উপযোগী ? “নিত্যমেব সুখং স্বৰ্গে” এই কথা সত্য বলিয়া স্বীকার করিলেও ইহার পরেই “সুখং দুঃখমিহোভয়ম্‌” [মভা|শা|১৯০|১৪] - এই সংসারে সুখ ও দুঃখ দুই মিশ্রিত হইয়া থাকে - ইহাও কথিত আছে । এই কথা অনুসরণ করিয়াই সমর্থ শ্রীরামদাস স্বামী বলিয়াছেন যে, “জগতে সৰ্বসুখী কোন্‌ জন, বিচারিয়া দেখরে মন” । তা ছাড়া দ্রৌপদী সত্যভামাকে উপদেশ দিয়াছেন যে, -
“সুখং সুখেনেহ ন জাতু লভ্যং
দুঃখেন সাধ্বী লভতে সুখানি ৷”
অর্থাৎ সুখের দ্বারা সুখ কখন মেলে না; সুখ পাইতে হইলে সাধ্বীকে কষ্ট সহ্য করিতে হয়” [মভা|বন|২৩৩|৪] । ইহা লোকের অনুভূতি অনুসারে সত্য, এইরূপ বলিতে হয় । কারণ, জাম ঠোঁটেতে পড়িলেও মুখের ভিতর দিতে হয়, এবং মুখের ভিতর গেলেও তাহা কষ্ট করিয়া চিবাইতে হয় । অন্ততঃ এইটুকু নির্বিবাদ যে, দুঃখের পর প্ৰাপ্ত সুখের মিষ্টতা এবং সকল সময়ে বিষয়ভোগে নিমগ্ন ব্যক্তির সুখের মিষ্টতা, এই দুয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে । কারণ, নিত্য সুখভোগে সুখানুভব করিবার ইন্দ্রিয়শক্তি মন্দীভূত হয় । কথিত আছে যে, -
“প্ৰায়েন শ্ৰীমতাং লোকে ভোক্তুং শক্তির্ন বিদ্যতে ৷
কাষ্ঠান্যপি হি জীর্যন্তে দরিদ্রাণাং চ সর্বশঃ ॥”
অর্থাৎ - শ্ৰীমন্তদিগের সুস্বাদু অন্ন সেবনেরও প্রায় শক্তি থাকে না এবং দরিদ্রের কাষ্ঠও জীর্ণ হইয়া যায় [মভা|শা|২৮|২৯] । তাই, ইহলোকের ব্যবহারের বিচার করিতে হইলে বলিতে হয় যে, দুঃখ ব্যতীত সুখ সব সময়ে অনুভূত হয়, কি হয় না, এই প্ৰশ্নকে লইয়া বেশী রগড়ারগড়ি করায় কোন ফল নাই । “সুখস্যানন্তরং দুঃখং দুঃখস্যানন্তরাং সুখম্‌” [বন|২৬০|৪৯; শা|২৫|২৩] সুখের পরে দুঃখ এবং দুঃখের পরে সুখ লাগিয়াই আছে । মহাকবি কালিদাসমেঘদূতে [মে|১১৪] বৰ্ণনা করিয়াছেন -
“কস্যৈকান্তং সুখমুপনতং দুঃখমেকান্ততো বা ৷
নীচৈর্গচ্ছত্যুপরি চ দশা চক্রনেমিক্রমেণ ॥”
“কাহারই নিয়ত সুখের কিংবা নিয়ত দুঃখের অবস্থা হয় না । সুখদুঃখের দশা চক্রগতির ন্যায় একবার নীচের দিকে, একবার উপর দিকে হইয়া থাকে ।” এই ক্ৰম সর্বদাই চলিতে থাকে । এখন এই দুঃখ আমাদের সুখের মিষ্টতা বাড়াইবার জন্য উৎপন্ন হউক কিংবা প্ৰকৃতিজগতে তাহার হয়ত অন্য কোন উপযোগ থাকুক, উক্ত অনুভবসিদ্ধ ক্ৰমবিষয়ে মতভেদ হইতে পারে না । হাঁ, একথা কখনো অসম্ভব নহে যে, কেহ সর্বদাই বিষয়সুখ উপভোগ করিবে, আর উহার ফলে তাহার প্রাণে বিরক্তি আসিবে না; কিন্তু এই কর্মভূমিতে (মৃত্যুলোক বা সংসারে) এ কথা অবশ্য অসম্ভব যে, দুঃখ সম্পূর্ণ নষ্ট হইবে এবং সর্বদা সুখেরই অনুভব হইবে ।


7) সংসারে সুখ অধিক বা দুঃখ ?



যদি এ কথা সিদ্ধ হয় যে, সংসার নিছক সুখময় নহে, কিন্তু সুখদুঃখাত্মক, তবে এক্ষণে তৃতীয় প্রশ্ন স্বতই মনে উদয় হয় যে, সংসারে সুখ অধিক বা দুঃখ অধিক ?


7.1) পাশ্চাত্য সুখাধিক্যবাদ



আধিভৌতিক সুখকেই যাহারা পরম সাধ্য বলিয়া মানেন সেই সকল পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের মধ্যে অনেকে এই কথা বলেন, যে, সংসারে সুখাপেক্ষা যদি দুঃখই অধিক হইত, তবে সংসারের গোলযোগের মধ্যে না থাকিয়া, সকলে না হৌক অধিকাংশ লোকই আত্মহত্যা করিত । কিন্তু যখন মনুষ্য নিজের জীবনে বিরক্ত হইয়াছে দেখা যায় না, তখন এই অনুমান ঠিক বলিয়া ধরা যাইতে পারে যে, সংসারে দুঃখাপেক্ষা সুখভোগই অধিক হয়; এবং মানুষ সুখকেই পরম সাধ্য মনে করিয়া ধর্মাধর্মের নির্ণয়ও সেই মাপকাঠীতে করিয়া থাকে । 


7.2) পাশ্চাত্য মতের খণ্ডন : আত্মহত্যার সাথে সুখের সম্বন্ধ নাই



এখন উপরি-উক্ত মতকে ভালরূপে পরীক্ষা করিলে বুঝা যাইবে যে, এখানে সংসারসুখের সহিত আত্মহত্যার যে সম্বন্ধ জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহা প্রকৃতপক্ষে দেখিতে গেলে সত্য-নহে । এ কথা সত্য যে, কোন কোন প্রসঙ্গে কোন মনুষ্য সংসারে ক্লান্ত হইয়া আত্মহত্যা করে; কিন্তু লোকে তাহা অপবাদ বা পাগলামির মধ্যে গণনা করে । ইহা হইতে বুঝা যায় যে, সর্বসাধারণ লোকও আত্মহত্যা করা বা না করার সহিত সংসার-সুখের কোন সম্বন্ধ রাখে না, উহাকে এক স্বতন্ত্র বিষয় বলিয়া মনে করে । সুসভ্য মনুষ্য যে অসভ্য সমাজকে অত্যন্ত কষ্টময় বলিয়া মনে করে, সেই অসভ্য মনুষ্যসমাজের বিষয় বিচার করিয়া দেখিলেও এই অনুমানই নিষ্পন্ন হয় । প্ৰসিদ্ধ সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞ চার্লস ডার্বিন আপন প্ৰবাস-গ্রন্থে, দক্ষিণ আমেরিকার অত্যন্ত দক্ষিণ প্ৰান্তে যে সব অসভ্য লোক দেখিয়া আসিয়াছিলেন সেই অসভ্য লোকদিগের বর্ণনা করিবার সময় এইরূপ লিখিতেছেন যে, এই অসভ্য লোক-পুরুষ ও স্ত্রী সকলেই অত্যন্ত শীতের সময়েও বিনা বস্ত্ৰে উলঙ্গ অবস্থাতেই বেড়ায়; এবং ইহাদের নিকটে অন্নের সংগ্ৰহ না থাকিলে, কখনো কখনো তাহাদিগকে বিনা অন্নেই ক্ষুধার্ত হইয়া মরিতে হয়; তথাপি তাহাদিগের সন্তান-সন্ততি বাড়িয়াই চলিয়াছে ! (Darwin’s Naturalist’s Voyage Round the World, Chap X). এই অসভ্য মনুষ্যও নিজের প্রাণ বিসর্জন করে না, কিন্তু ইহা হইতে এরূপ অনুমান করা কি ঠিক্‌ যে, তাহাদের সংসার বা জীবন সুখময় ? তাহারা আত্মহত্যা করে না, একথা ঠিক; কিন্তু তাহার কারণের বিষয়ে সূক্ষ্মবিচার করিলে দেখা যাইবে সভ্য বা অসভ্য প্রত্যেক মনুষ্যই “আমি পশু নহি, আমি মনুষ্য” এই কথাতেই অত্যন্ত আনন্দ অনুভব করে; এবং অন্য সমস্ত সুখ অপেক্ষা মনুষ্য হওয়ারূপ সুখকে এত বেশী মহত্বপূর্ণ বলিয়া মনে করে যে, এই সংসার যতই কষ্টময় হোক না কেন, সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া মনুষ্যত্বের এই শ্রেষ্ঠ আনন্দ হারাইতে সে কখনই প্ৰস্তুত থাকে না । মনুষ্য কেন, পশুপক্ষীও -আত্মহত্যা করে না । তাই, তাহাদের সংসারও সুখময় তাহা কি বলিতে পারি ? তাৎপর্য এই যে, মনুষ্য কিংবা পশুপক্ষী আত্মহত্যা করে না, তাই বলিয়া তাহাদের সংসার সুখময় এইরূপ ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত না করিয়া, সংসার যাহাই হউক, তাহার কোন অপেক্ষা না রাখিয়া নিছক্‌ অচেতনের সচেতন পরিণত হওয়াতেই অনুপম আনন্দ আছে, এবং তাহার মধ্যে মনুষ্যত্বের আনন্দ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, এই সিদ্ধান্ত করা ঠিক্‌ । 

আমাদের শাস্ত্রকারেরাও বলিয়াছেন -
ভূতানাং প্ৰাণিনঃ শ্রেষ্ঠাঃ প্ৰাণিনাং বুদ্ধিজীবিনঃ ৷
বুদ্ধিমৎসু নরাঃ শ্রেষ্ঠা নরেষু ব্ৰাহ্মণাঃ স্বতাঃ ॥
ব্ৰাহ্মণেষু চ বিদ্বাংসঃ বিদ্ধৎসু কৃতবুদ্ধয়ঃ ৷
কৃতবুদ্ধিষু কর্তারঃ কর্তৃষু ব্ৰহ্মবাদিনঃ ॥
অর্থাৎ অচেতনদিগের মধ্যে সচেতন, সচেতনের মধ্যে বুদ্ধিসম্পন্ন জীব, বুদ্ধিসম্পন্ন জীবদিগের মধ্যে মনুষ্য, মনুষ্যের মধ্যে ব্ৰাহ্মণ, ব্ৰাহ্মণের মধ্যে বিদ্বান, বিদ্বানের মধ্যে কৃতবুদ্ধি (যাহার সুসংস্কৃত বুদ্ধি), কৃতবুদ্ধির মধ্যে কর্তা এবং কর্তাদিগের মধ্যে ব্ৰহ্মবাদী শ্ৰেষ্ঠ । এইরূপ, শাস্ত্ৰে যে ক্ৰমোচ্চপদবীর বর্ণনা আছে তাহা এইভাবেই প্রযুক্ত হইয়াছে [মনু|১|৯৬,৯৭; মভা|উদ্যো|৫|১,২]; এবং এই নীতি অনুসারে ৮৪ লক্ষ যোনির মধ্যে নরদেহ শ্রেষ্ঠ, নরের মধ্যে মুমুক্ষু, মুমুক্ষুর মধ্যে সিদ্ধ শ্রেষ্ঠ – প্রাকৃত গ্রন্থাদিতেও এইরূপ কথিত হইয়াছে । “সবসেজীব্‌প্যারা” এই যে চলিত কথা আছে তাহারও তাৎপর্য এই; এবং এই কারণেই সংসার দুঃখময় হইলেও, কেহ আত্মহত্যা করিলে, লোকে তাহাকে পাগল বলে এবং ধর্মশাস্ত্র অনুসারে তাহাকে পাপী বলা হয় [মভা|কর্ণ|৭০|১৮]; এবং আত্মহত্যার চেষ্টাও আইনে অপরাধ বলিয়া ধরা হইয়া থাকে । সংক্ষেপে ইহা সিদ্ধ হইল যে, মনুষ্য আত্মহত্যা করে না, এই কথা ধরিয়া সংসারের সুখময়ত্বের সিদ্ধান্ত করা ঠিক নহে । এই অবস্থাতে ‘এই সংসার সুখময় বা দুঃখময়’, আমার এই প্রশ্নের নির্ণয়ের জন্য পূর্বকর্মানুসারে কোন বিশেষ পদবীতে-পতিত নরদেহ প্রাপ্তিরূপ নিজের নৈসর্গিক ভাগ্যের কথা একপাশে সরাইয়া রাখিয়া, তদুত্তরকালীন অর্থাৎ সংসার-ঘটিত বিষয়েরই আমাদের বিচার করা আবশ্যক । ‘মনুষ্য আত্মহত্যা করে না, বরঞ্চ বাঁচিবার ইচ্ছা করে’ ইহাই তো কেবল-সংসার-প্রবৃত্তির কারণ; আধিভৌতিক পণ্ডিতদিগের মতানুসারে সংসারের সুখময় হইবার পক্ষে ইহা কোন প্রমাণ নহে । এই কথা অন্যপ্রকারে ব্যক্ত করিতে চাহিলে বলিতে হয় যে, আত্মহত্যা না করিবার বুদ্ধি স্বাভাবিক, তাহা সাংসারিক সুখদুঃখের কোন প্রকার তারতম্য হইতে উৎপন্ন নহে, এবং সেই জন্যই ইহা হইতে এই কথা সিদ্ধ হইতে পারে না যে, সংসার সুখময় ।


7.3) সুখের ইচ্ছার অপার বৃদ্ধি



কেবলমাত্র মনুষ্যজন্ম পাইবার মহদ্‌ভাগ্য এবং তৎপরে মনুষ্যের সংসার এই উভয়কে ভ্রমবশত অভিন্ন মনে করিবে না; মনুষ্যত্ব ও মনুষ্যের সংসার অর্থাৎ নিত্য ব্যবহার, এই উভয় পৃথক, এই পার্থক্যের উপর লক্ষ্য রাখিয়া ইহা নিশ্চয় করিতে হইবে যে, এই সংসারে শ্রেষ্ঠ নরদেহধারী প্রাণির সুখ অধিক, কি দুঃখ অধিক ? এই প্রশ্নের যথার্থ সমাধান করিতে হইলে, প্রত্যেক মনুষ্যের ‘উপস্থিত’ বাসনার মধ্যে কত বাসনা সফল ও কত বাসনা নিষ্ফল হয়, ইহা দেখা ভিন্ন অন্য উপায় নাই । ‘উপস্থিত’ বলিবার কারণ এই যে, যে সব জিনিষ সভ্য অবস্থায় সকলেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে, তাহা নিত্য ব্যবহারে আসায় তদুৎপন্ন সুখ আমরা ভুলিয়া যাই, এবং যে বস্তুর গরজ নূতন উৎপন্ন হয়, তাহার মধ্যে কোন্‌টা পাওয়া গেল তাহা দেখিয়া এবং কেবল তাহা ধরিয়াই আমরা সংসারের সুখদুঃখের নির্ণয় করিয়া থাকি । বর্তমানকালে আমরা কত সুখসাধন প্রাপ্ত হইয়াছি তাহার তুলনা করা এবং শতবর্ষ পূর্বে এই সকলের মধ্যে কতকগুলি সুখসাধন পাওয়া গিয়াছিল; এবং আজিকার মুহূর্তে আমি সুখী কি সুখী নই তাহার বিচার করা – এই দুই বিষয় অত্যন্ত ভিন্ন । উদাহরণ যথা – শত বৎসর পূর্বের গরুর গাড়ীতে ভ্রমণ করা অপেক্ষা এখনকার আগ্‌গাড়ীতে ভ্রমণ করা অধিকতর সুখদায়ক, এ কথা সকলেই স্বীকার করিবে । কিন্তু এখন ‘আগ্‌গাড়ী’তে ভ্রমণ সুখের এই সুখত্ব আমরা ভুলিয়া গিয়া কোনদিন গাড়ী আসিতে বিলম্ব হওয়ায় ডাকে চিঠি পাইতে বিলম্ব হইলে আমাদের বড় খারাপ লাগে । তাই, মনুষ্যের উপস্থিত সুখদুঃখের বিচারে উপলব্ধ সুখসাধন ধর্তব্যের মধ্যে না আনিয়া, মনুষ্য উপস্থিত ‘গরজ’ অনুসারে সুখদুঃখের বিচার করিয়া থাকে । এবং, এই গরজ সম্বন্ধে বিচার করিলে, তাহার আর শেষ দেখা যায় না, - উহা অনন্ত ও সীমাহীন দেখিতে পাওয়া যায় । আজ এক ইচ্ছা সফল হইলে কাল আর এক নূতন ইচ্ছা উৎপন্ন হয় এবং এই নূতন ইচ্ছা সফল করিতেই হইবে, এইরূপ মনে হইতে থাকে । যখন যখন মনুষ্যের ইচ্ছা বা বাসনা সফল হইতে থাকে, তখন তখনই তাহার দৌড় এক পা সম্মুখে বাড়িয়া চলে, এবং যখন ইহা অনুভবসিদ্ধ হয় যে, সকল ইচ্ছা বা বাসনা সফল হওয়া সম্ভব নহে, তখন আর সন্দেহ থাকে না যে, মনুষ্যের অদৃষ্টে দুঃখ ছাড়িতে চাহে না । সমস্ত সুখই কেবল তৃষ্ণাক্ষয়রূপ এবং যতই সুখলাভ হোক না কেন, মনুষ্য অসন্তুষ্ট থাকে, এই দুই বিষয়ের ভেদের প্রতি এই স্থানে বিশেষ লক্ষ্য রাখা আবশ্যক । প্রত্যেক সুখ দুঃখাভাবরূপ নহে, কিন্তু সুখ ও দুঃখ ইন্দ্রিয়সমূহের দুই স্বতন্ত্র বেদনা, ইহা এক কথা, এবং মনুষ্য কোন এক সময়ে প্রাপ্ত সুখকে ভুল করিয়া ধর্তব্যের মধ্যে না আনিয়া এবং অধিকাধিক সুখলাভের উদ্দেশ্যে অসন্তুষ্ট থাকে, ইহা পূর্বোক্ত হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা । ইহাদের মধ্যে প্রথম তর্ক সুখের প্রকৃত স্বরূপ লইয়া; এবং দ্বিতীয় তর্ক এই যে, প্রাপ্ত সুখে মনুষ্যের পূর্ণ তৃপ্তি হয়, কি হয় না ।


7.4) সুখের ইচ্ছা সুখোপভোগে তৃপ্ত হয় না ⇒ সংসারে দুঃখের আধিক্য



বিষয়বাসনা সর্বদাই সমান বাড়িয়া যায় বলিয়া প্রতিদিন নূতন নূতন সুখ লাভ না হইলেও পূর্ব সুখ পুনঃ পুনঃ ভোগ করিব এইরূপ মনে করিয়া মনের আকাঙ্ক্ষার কিছুমাত্র হ্রাস হয় না । বিটেলিয়স্‌ নামে এক রোমক সম্রাটের সম্বন্ধে এইরূপ কথিত আছে যে, জিহ্বার সুখ পুনঃ পুনঃ পাইবার উদ্দেশ্যে ঔষধ সেবন করিয়া উদরস্থ অন্ন বাহির করিয়া ফেলিতেন এবং প্রতিদিন তিনি অনেকবার ভোজন করিতেন । কিন্তু এই প্রসঙ্গে যযাতি রাজার কথা ইহা অপেক্ষা আরও জ্ঞানপ্রদ । যযাতি রাজা শুক্রাচার্যের শাপে জরাগ্রস্ত হইলে, সেই জরা অন্যকে দিয়া তৎপরিবর্তে সেই ব্যক্তির তারুণ্য গ্রহণ করিতে পারিবেন বলিয়া শুক্রাচার্য কৃপা করিয়া তাঁহার সুবিধা করিয়া দিয়াছিলেন । তখন পুরু নামক নিজ পুত্রের যৌবন লইয়া, যযাতি এক হাজার বৎসর সমান বিষয়সুখ উপভোগ করিলেও পরিণামে তাঁহার উপলব্ধি হইল যে, পৃথিবীর সমস্ত পদার্থ একজন মনুষ্যেরও সুখবাসনা তৃপ্ত করিতে অসমর্থ । তখন তাঁহার মুখ হইতে এই কথা বাহির হইল –
ন জাতু কামঃ কামানাম্‌ উপভোগেন শাম্যতি ৷
হবিষা কৃষ্ণবর্ত্নেব ভুয় এবাভিবর্ধতে ॥
অর্থাৎ “সুখের উপভোগে বিষয়বাসনার তৃপ্তি না হইয়া হবন দ্রব্যের দ্বারা অগ্নির ন্যায় বিষয়ের উপভোগ বিষয়বাসনা আরও বৃদ্ধি পায়” [মভা|আ|৭৫|৪৯] । 


7.5) আমাদের শাস্ত্রকারদের তদনুকুল সিদ্ধান্ত



এই শ্লোকই মনুস্মৃতিতেও প্রদত্ত হইয়াছে [মনু|২|৯৪] । সুখসাধন যতই উপলব্ধি হউক না কেন, ইন্দ্ৰিয়ের লালসা সতত বর্ধিতই হইতে থাকে; তাই কেবল সুখভোগের দ্বারা সুখেচ্ছা কখনই তৃপ্ত হয় না, উহাকে প্রতিরুদ্ধ করিবার জন্য অন্য কোন উপায় অবলম্বন আবশ্যক হয়, ইহাই হইল তাৎপর্য । এই তত্ত্ব আমাদিগের ধর্মশাস্ত্ৰসম্বন্ধীয় সকল গ্ৰন্থকারদিগের অভিমত হওয়ায়, তাঁহাদের প্রথম বক্তব্য এই যে, প্ৰত্যেক ব্যক্তির নিজের কামোপভোগে সংযম অবলম্বন করা আবশ্যক । বিষয়োপভোগই এই সংসারের পরম সাধ্য, এইরূপ যাহারা বলেন তাহার এই অনুভূত সিদ্ধান্তের প্রতি একটুও লক্ষ্য করিলেই তাঁহাদের মতের অসারতা সহজেই উপলব্ধি করিবেন । বৈদিক ধর্মের, এই সিদ্ধান্ত বৌদ্ধধর্মেও স্বীকৃত; এবং যযাতির পরিবর্তে মান্ধাতা নামক পৌরাণিক রাজা মৃত্যুকালে বলিয়াছেন :- 
ন কহাপণবস্‌সেন তিত্তি কামেসু বিজতি ৷
অপি দিব্বেসু কামেসু রতিং সো নাধিগচ্ছতি ॥
“কার্ষাপণ নামক মোহরের বৃষ্টি হইলেও কামের তৃপ্তি হয় না, এবং স্বৰ্গসুখ মিলিলেও কামী পুরুষের কামের নিবৃত্তি হয় না” ইহা ধর্মপদ নামক বৌদ্ধগ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে [১৮৬, ১৮৭] । ইহা হইতে বলা যায় যে, বিষয়োপভোগসুখের পূর্ণতা কখনই হয় না, তাই প্ৰত্যেক মনুষ্য মনে করে - “আমি দুঃখী । মনুষ্যমাত্রের এই অবস্থা লক্ষ্য করিলে মহাভারতে কথিত সিদ্ধান্তই ঠিক মনে হয় যে -
সুখাদ্ বহুতরং দুঃখং জীবিতে নাস্তি সংশয়ঃ ॥
অর্থাৎ “এই জীবনে অর্থাৎ এই সংসারে সুখ অপেক্ষা দুঃখই অধিক” [শা|২০৫|৬ ; ৩৩০|১৬] । এই সিদ্ধান্ত সাধু তুকারাম এই প্রকারে বলিয়াছেন -
“সুখপাহতা জবাপাতেঁ ৷ দুঃখ পর্বতাএবঢেঁ ॥”
“সুখ যব প্রমাণ, দুঃখ পর্বত প্ৰমাণ” [তুকা|গা|২৯৮৮]
উপনিষৎকারদিগেরও ইহাই সিদ্ধান্ত [মৈত্র্যু|১|২|৪] । গীতাতেও মনুষ্যের জন্ম অ-শাশ্বত ও ‘দুঃখের ঘর’ এবং এই সংসার অনিত্য ও “সুখহীন” [গী|৮|১৫; ৯|৩৩] কথিত হইয়াছে । 


7.6) শোপেনহরের মত



জর্মন পণ্ডিত শোপেন্‌হৌয়েরেরও এই মত, এবং তাহা সপ্রমাণ করিবার জন্য তিনি এক বিচিত্র দৃষ্টান্ত যোজনা করিয়াছেন । তিনি বলেন যে, মনুষ্যের সমস্ত সুখেচ্ছার মধ্যে যত সুখের ইচ্ছা সফল হয় সেই পরিমাণে আমরা তাহাকে সুখী মনে করি; এবং সুখোপভোগ সুখেচ্ছা অপেক্ষা কম হইলে সেই মনুষ্যকে সেই পরিমাণে দুঃখী বলি । ইহা গণিতের রীতিতে দেখাইতে হইলে, সুখোপভোগকে সুখেচ্ছার দ্বারা ভাগ করিয়া ভগ্নাংশরূপে এইরূপ লিখিতে হয় যথা -
সুখোপভোগ (বিভাজ্য) / সুখেচ্ছা (বিভাজক)
কিন্তু এই ভগ্নাংশের এই একটু বিশেষত্ব যে, তাহার বিভাজক অর্থাৎ সুখেচ্ছা তাহার বিভাজ্য অপেক্ষা অর্থাৎ সুখোপভোগ অপেক্ষা বরাবরই অধিক পরিমাণে বাড়িতে থাকে । যদি এই ভগ্নাংশ প্রথমে ½ হয়, এবং পরে উহার বিভাজ্য 1 হইতে 3 হয়, তবে উহার বিভাজক 2 হইতে 10 হইবে - অর্থাৎ ঐ ভগ্নাংশ 3 হইয়া যায় । তাৎপর্য এই যে, যদি বিভাজ্য তিন গুণ বৃদ্ধি হয়, তবে বিভাজক পাঁচগুণ বাড়িয়া যায় । তাহার ফল এই যে, ঐ ভগ্নাংশ পূর্ণতার দিকে না যাইয়া অধিকাধিক অপূর্ণতার দিকেই চলিয়া যায় । অতএব মনুষ্যের পূর্ণ সুখ আশা করা বৃথা । প্রাচীনকালে সুখ কি পরিমাণ ছিল তাহার বিচার করিবার সময় এই ভগ্নাংশের বিভাজ্যের প্রতি আমরা পুর্ণ লক্ষ্য রাখি, কিন্তু বিভাজ্য অংশ অপেক্ষা বিভাজক যে বেশী বাড়িয়া গিয়াছে সেদিকে আমরা লক্ষ্য করি না । কিন্তু যখন সুখদুঃখের মাত্রারই নির্ণয় করিতে হইবে, তখন কোন কালের অপেক্ষা না করিয়া কেবল ইহাই দেখিতে হইবে যে, উক্ত ভগ্নাংশের বিভাজ্য ও বিভাজক এই উভয়ের মধ্যে সম্বন্ধ কিরূপ । আবার ইহা স্পষ্টই উপলব্ধ হইবে যে, এই অপূর্ণাঙ্ক কখনই পূর্ণ হইতে পারে না । “ন জাতু কামঃ কামানাং” এই মনুবচনের [২|৯৪] অর্থই এই ।

সুখদুঃখ মাপিবার উষ্ণতামাপক যন্ত্রের মত কোন নিশ্চিত সাধন না থাকায়, গণিতের পদ্ধতি অনুসারে এইরূপ সুখদুঃখের তারতম্য-বিন্যাস অনেকের পছন্দ না হওয়া সম্ভব । কিন্তু এই যুক্তিবাদ হইতে প্ৰকাশ পাইতেছে যে, সংসারে মনুষ্যের সুখ অধিক ইহা প্ৰমাণ করিবারও কোন নিশ্চিত উপায় নাই । এই আপত্তি উভয়পক্ষের নিকটেই সমান, তাই উক্ত সাধারণ সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অর্থাৎ সুখোপভোগ অপেক্ষা সুখেচ্ছার অসংযত বৃদ্ধি হয় এই যে সিদ্ধান্ত, এই সিদ্ধান্তের পক্ষে উহা কোনও বাধা আনিতে পারে না । ধর্মগ্রন্থসমূহে এবং জগতের ইতিহাসে এই ইতিহাসের পোষক অনেক উদাহরণ পাওয়া যায় । স্পেন দেশে যখন মুসলমান রাজ্য ছিল সেই সময় তৃতীয় আবদুল রহমান নামক তত্রস্থ এক ন্যায়পরায়ণ ও পরাক্রমী সম্রাট নিজের দিনগুলি কেমন কাটিতেছে তাহার রোজনাম্‌চা রাখিতেন এবং সেই রোজনাম্‌চা অনুসারে, তাহার রাজত্বের ৫০ বৎসরের মধ্যে ১৪ দিন মাত্র পুর্ণ সুখে কাটিয়াছে তিনি দেখিতে পাইলেন, এইরূপ মুসলমান ইতিহাসে কথিত হইয়াছে । [Moors in Spain, P.128, “Story of the Nations Series”]. একজন হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, জগতে, বিশেষতঃ য়ুরোপখণ্ডে, প্রাচীন ও অর্বাচীন তত্ত্বজ্ঞানীদের মত আলোচনা করিলে দেখা যায় যে, তাঁহাদের প্রায় অর্ধেক “সংসার সুখময়” প্ৰতিপাদন করিয়াছেন এবং অপর অর্ধেক “সংসার দুঃখময়” প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । অর্থাৎ সংসারকে সুখময় ও দুঃখময় প্রতিপাদনকারীর সংখ্যা প্ৰায় সমান । [Macmillan’s Promotion of Happiness, P.26.]. এই সংখ্যার উপর হিন্দু তত্ত্বজ্ঞানীর মতের ভার চাপাইলে, তৌল কোনদিকে ঝুঁকিবে তাহা আর বলিতে হইবে না ।


8) অসন্তোষের উপযোগ


সাংসারিক সুখদুঃখের উপরি-উক্ত বিচার শুনিয়া কোন সন্ন্যাসমার্গী ব্যক্তি এইরূপ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, “সুখ বাস্তবিক পদাৰ্থ না হওয়ায় তৃষ্ণাত্মক সমস্ত কর্ম না ছাড়িলে শান্তি নাই, এই কথা তুমি স্বীকার না করিলেও, তোমার কথা অনুসারেই তৃষ্ণা হইতে অসন্তোষ এবং অসন্তোষ হইতে পরে দুঃখ হয়; তাহা হইলে নিদেন এই অসন্তোষ দূর করিবার জন্য মনুষ্য, নিজের সমস্ত তৃষ্ণা এবং তৃষ্ণার সহিত সাংসারিক সমস্ত কর্ম - তাহা পরোপকারের জন্যই হৌক বা স্বার্থের জন্যই হৌক - ত্যাগ করিয়া সর্বদাই সন্তুষ্ট থাকিবে এইরূপ বলিতে বাধা কি ?” মহাভারতেও আছে - “অসন্তোষস্য নাস্ত্যন্তস্তুষ্টিন্তু পরমং সুখম্‌” অসন্তোষের অন্ত নাই, সন্তোষই পরম সুখ [মভা|বন|২১৫|২২] । জৈন ও বৌদ্ধধর্মের ভিত্ত্বিও এই তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত; এবং পাশ্চাত্য দেশে শোপেনহৌর অর্বাচীনকালে এই মত প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । [Schopenhauer’s World as will and Representation, Vol II. Chap.46. শোপেনহৌর কৃত সংসারের দুঃখময়ত্ব বর্ণনা অত্যন্ত সরস । মুলগ্রন্থ জর্মন ভাষায় লিখিত এবং ইংরাজীতে উহার অনুবাদ আছে ।] 

কিন্তু ইহার বিপরীতে এইরূপ প্রশ্নও করা যাইতে পারে যে, জিহ্বা দ্বারা কখন কখন অপশব্দ উচ্চারিত হয় বলিয়া জিহ্বার সহিত সমস্ত সম্বন্ধ উচ্ছেদ করিতে হইবে কি ? অগ্নির দ্বারা কখন কখন গৃহদাহ হয় বলিয়া কি সমস্ত অগ্নিকে বিসর্জন দিয়া লোকে রাঁধাবাড়াও ছাড়িয়া দিয়াছে ? অগ্নির কথা কি, বিদ্যুৎশক্তিকেও যোগ্য সীমার মধ্যে রাখিয়া আমরা যেমন তাহাকে নিত্য কাজে খাটাইয়া লই, সেইরূপ তৃষ্ণা কিংবা অসন্তোষেরও সুব্যবস্থিত কোন সীমা বাঁধিয়া দেওয়া অসম্ভব নহে । হাঁ, অসন্তোষ যদি সর্বাংশে ও সর্বপ্রসঙ্গে হানিজনক হয় তবে সে স্বতন্ত্র কথা । কিন্তু বিচারান্তে তাহা দেখা যায় না । অসন্তোষ অর্থে নিছক আকাঙ্ক্ষা বা হাহুতাশ নহে । এই অসন্তোষ শাস্ত্রকারেরাও গর্হিত বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন । কিন্তু অমোদের বর্তমান অবস্থাতে কেবলই আক্ষেপ করিতে না থাকিয়া শান্ত ও সমচিত্ততার সহিত যথাশক্তি ঐ অবস্থার উত্তরোত্তর সংশোধন করিয়া যথাসাধ্য উহাকে উত্তম অবস্থায় পরিণত করিবার যে ইচ্ছা সেই ইচ্ছার মূলভূত যে অসন্তোষ তাহা গৰ্হিত বলিয়া কখন স্বীকার করা বাইতে পারে না । চাতুর্বর্ণ্যের বন্ধনে আবদ্ধ সমাজে ব্ৰাহ্মণ যদি জ্ঞানের, ক্ষত্ৰিয় যদি ঐশ্বর্যের এবং বৈশ্য যদি ধনধান্যের এই প্ৰকার ইচ্ছা বা বাসনা ছাড়িয়া দেয় তাহা হইলে সমাজ যে শীঘ্রই অধোগতি প্ৰাপ্ত হয়, এ কথা আর বলিতে হইবে না । এই অভিপ্ৰায় মনেতে আনিয়া ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বলিয়াছেন যে, “যজ্ঞ-বিদ্যা-সমুখানমসন্তোষঃ শ্ৰিয়ং প্ৰতি” [শাং|২৩|৯] অর্থাৎ “যজ্ঞ, বিদ্যা, উদ্যোগ ও ঐশ্বর্য বিষয়ে অসন্তোষই ক্ষত্রিয়েয় গুণ” । সেইরূপ বিদুলও আপন পুত্রকে উপদেশ করিবার সময় বলিয়াছিলেন যে, “সন্তোষো বৈ শ্ৰিয়ং হন্তি” [মভা|উ|১৩২|৩৩] অৰ্থাৎ সন্তোষে ঐশ্বর্য নাশ হয় । অন্য এক প্রসঙ্গে ইহাও বলা হইয়াছে যে, “অসন্তোষঃ প্রিয়ো মূলং” [মভা|সভা|৫৫|১১] । ব্ৰাহ্মণধর্মে সন্তোষকে গুণ বলা হইয়াছে; তথাপি তাহার অর্থ চাতুর্বর্ণ্যধর্মানুসারে দ্রব্যবিষয়ে কিংবা ঐহিক ঐশ্বর্যসম্বন্ধে সন্তোষ ইহাই অভিপ্ৰেত । আমি যেটুকু জ্ঞানলাভ করিয়াছি তাহাতেই আমি সন্তুষ্ট এইরূপ যদি কোন ব্ৰাহ্মণ বলে, তাহা হইলে সে নিজেরই সর্বনাশ করিবে । সেইরূপ বৈশ্য কিংবা শূদ্র আপনি আপনি ধর্মানুসারে যাহা পাইয়াছে তাহাতেই যদি সন্তুষ্ট থাকে, তাহারও ঐরূপ দশা হইবে । সারাংশ, অসন্তোষই সকল ভাবী উৎকর্ষ, প্রযত্ন, ঐশ্বর্য এবং মোক্ষেরও বীজ । এই অসন্তোষ যদি আমরা সমূলে বিনষ্ট করি, তাহা হইলে ইহলোকে ও পরলোকে আমাদের দুৰ্গতি হইবে, ইহা আমাদের প্রত্যেকের সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক । [Cf. “Unhappiness is the cause of progress” Dr. Paul Carus’ “The Ethical Problem”, P.251, 2nd Ed.]

ভগবদ্‌গীতাতেও শ্ৰীকৃষ্ণের উপদেশ শুনিবার সময় অর্জুন বলিয়াছেন যে, “ভূয়ঃ কথয় তৃপ্তির্হি শৃণ্বতো নাস্তি মেহমৃতম্‌” [গী|১০|১৮], অর্থাৎ “তোমার অমৃতবাণী শুনিয়া আমার তৃপ্তি হইতেছে না, অতএব তোমার বিভূতির কথা পুনঃ পুনঃ আমাকে বল” । এই কথা অর্জুন বলিলে পর ভগবান আবার স্বীয় বিভূতির কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন; তিনি এরূপ উপদেশ করেন নাই যে, “তুমি আপন ইচ্ছা সম্বরণ কর, অতৃপ্তি বা অসন্তোষ ভাল নহে” । ইহা হইতে সিদ্ধ হইতেছে, ভাল কিংবা কল্যাণকর বিষয় সম্বন্ধে উচিত অসন্তোষ হওয়া ভগবানেরও অভীষ্ট । “যশসি চাভিরুচিৰ্ব্যসনং শ্রুতৌ” অর্থাৎ অভিরুচি হওয়া চাই - যশের অভিরুচি, ব্যসন হওয়া চাই - বিদ্যার ব্যসন; তাহা গৰ্হিত নহে । ভর্তৃহরিও এক শ্লোকে এইরূপ বলিয়াছেন । 


9) উহার দুষ্পরিণাম হটাইবার উপায়



কামক্রোধাদি বিকারের মত অসন্তোষকেও অসংযত হইতে দেওয়া ঠিক নহে । অসংযত হইলে তাহা সর্বস্ব নাশ করিবে নিঃসন্দেহ । এই হেতু কেবল বিষয়ভোগের জন্য তৃষ্ণার উপর তৃষ্ণা কিংবা আশার উপর আশা চাপাইয়া ঐহিক সুখের পশ্চাতে সর্বদা ছুটিয়া চলে যে ব্যক্তি তাহার সম্পদকে গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে “আসুরী সম্পদ্‌” বলা হইয়াছে । এইরূপ অসংযত লালসার দরুণ মানবমনের সাত্ত্বিক বৃত্তির উচ্ছেদ হইয়া মনুষ্য শুধু যে অধোগতি প্ৰাপ্ত হয় তাহা নহে, তৃষ্ণারও পুর্ণ তৃপ্তি অসম্ভব হওয়ায় কামোপভোগ-বাসনা অধিকাধিক বাড়িয়া গিয়া তাহাতেই শেষে মনুষ্যের বিনাশ হয় । কিন্তু উল্টা পক্ষে, তৃষ্ণা ও অসন্তোষের এই দুষ্পরিণাম পরিহার করিবার জন্য সর্বপ্রকার তৃষ্ণার সঙ্গে সমস্ত কর্ম একেবারে ত্যাগ করাও সাত্ত্বিক মার্গ নহে । উপরি-উক্ত কথা অনুসারে, তৃষ্ণা বা অসন্তোষই ভাবী উৎকর্ষের বীজ; তাই চোরের ভয়ে নিৰ্দোষকে মারিবার প্রযত্ন না করিয়া কোন্‌ তৃষ্ণা হইতে বা অসন্তোষ হইতে দুঃখ হয়, তাহার ঠিক বিচার করিয়া সেই দুঃখজনক আশা, তৃষ্ণা বা অসন্তোষ ত্যাগ করাই উচিত মার্গ স্বীকার করিতে হইবে । তাহার জন্য সমস্ত কর্মত্যাগ করিবার কোন কারণ নাই । দুঃখজনক আশা ছাড়িয়া দিয়া স্বধর্মানুসারে কর্ম করিবার এই যে যুক্তি বা কৌশল, তাহাকেই ‘যোগ’ বা ‘কর্মযোগ’ বলে [গী|২|৫০]; এবং তাহাই গীতার মুখ্যরূপে প্ৰতিপাদ্য হওয়ায় গীতাতে কোন্‌ প্রকারের আশা দুঃখজনক বলিয়া স্থিরীকৃত হইয়াছে, সেই সম্বন্ধে এইখানে আরও কিছু বিচার-আলোচনা করিব ।



10) সুখদুঃখ অনুভবের আত্মবশ্যতা, এবং ফলাশার লক্ষণ



মনুষ্য কানে শোনে, ত্বকের দ্বারা স্পর্শ করে, চোখে দেখে, জিহ্বার দ্বারা আস্বাদন করে ও নাকের দ্বারা আঘ্রাণ করে । ইন্দ্ৰিয়সমূহের এই ব্যাপার স্বাভাবিক বৃত্তির যেরূপ অনুকুল বা প্ৰতিকুল হয়, সেই অনুসারে মনুষ্যের সুখ বা দুঃখ হইয়া থাকে । সুখদুঃখের বস্তু-স্বরূপের এই লক্ষণ উপরে প্রদত্ত হইয়াছে । কিন্তু সুখদুঃখের বিচার কেবল এই ব্যাখ্যাতেই সম্পূর্ণ হয় না । আধিভৌতিক সুখদুঃখ উৎপন্ন হইবার পক্ষে ইন্দ্ৰিয়গণের সহিত বাহ্য পদার্থের সংযোগ প্ৰথমে নিতান্ত আবশ্যক হইলেও, সুখদুঃখের অনুভব মনুষ্যের নিকট পরে কি প্রকারে আসিয়া থাকে, তাহার বিচার করিলে উপলব্ধি হইবে যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহের স্বাভাবিক-ব্যাপার-নিষ্পন্ন এই সুখদুঃখ জানিবার কাজ অর্থাৎ নিজের জন্য তাহা স্বীকার বা অস্বীকার করিবার কাজ পরিশেষে প্ৰত্যেক মনুষ্যকে নিজের মনের দ্বারাই করিতে হয় । মহাভারতে উক্ত হইয়াছে যে, “চক্ষুঃ পশ্যতি রূপাণি মনসা ন তু চক্ষুষা” -  দেখিবার কাজ কেবল চোখের দ্বারা হয় না, তাহাতে মনের সাহায্য নিতান্তই আবশ্যক হয় [মভা|শা|৩১১|১৭], এবং সেই মন যদি ব্যাকুল থাকে, তবে চোখে দেখিলেও, না দেখিবার মতো হইয়া থাকে । বৃহদারণ্যক-উপনিষদেও [১|৫|৩] উক্ত দেখা যায় যে, “আমার মন অন্যদিকে থাকার দরুণ আমি দেখিতে পাই নাই (অন্যত্রমনা অভুবং নাদর্শম্‌) আমার মন অন্যত্র আছে বলিয়া আমি শুনিতে পাই নাই (অন্যত্রমনা অভুবং নাশ্রৌষম্‌)” । ইহা হইতে আধিভৌতিক সুখদুঃখের অনুভব ঘটিবার পক্ষে কেবল ইন্দ্ৰিয়গণই কারণ নহে, তাহার সঙ্গে মনেরও সাহায্য দরকার হয় - ইহা স্পষ্টই দেখা যাইতেছে; এবং আধ্যাত্মিক সুখদুঃখ তো মানসিক হইয়াই থাকে । এই সমস্ত হইতে দেখা যায়, - সর্বপ্রকার সুখদুঃখানুভূতি শেষে মনকেই অবলম্বন করিয়া থাকে । এবং ইহা যদি সত্য হয়, তবে মনোনিগ্রহের দ্বারা সুখদুঃখানুভূতিরও নিগ্ৰহ অসাধ্য নহে, ইহা স্বতই উপলব্ধি হইবে । ইহারই প্ৰতি লক্ষ্য রাখিয়া মনু সুখদুঃখের লক্ষণ, নৈয়ায়িকদিগের লক্ষণ হইতে ভিন্নরূপে বলিয়াছেন । তিনি বলেন -
সর্বং পরবশং দুঃখং সর্বমাত্মবশং সুখম্ ৷
এতদ্‌ বিদ্যাৎ সমাসেন লক্ষণং সুখদুঃখয়োঃ ॥
অর্থাৎ “যাহা কিছু পরবশ তাহাই দুঃখ, যাহা কিছু আপনার আয়ত্ত তাহাই সুখ - ইহাই সুখদুঃখের সংক্ষিপ্ত লক্ষণ” [মনু|৪|১৬০] । নৈয়ায়িকদিগের লক্ষণের অন্তর্ভূত ‘বেদনা’ শব্দে শারীরিক ও মানসিক উভয় বেদনারই সমাবেশ হয় এবং তাহা দ্বারা সুখদুঃখের বাহ্যবস্তুস্বরূপও দেখান হয়; মনু সুখদুঃখের কেবল আভ্যন্তরিক অনুভূতির উপরেই বিশেষ লক্ষ্য রাখিয়াছেন । এইটুকুর প্রতি লক্ষ্য রাখিলে, সুখদুঃখের উক্ত দুই লক্ষণের মধ্যে কোনই বিরোধ থাকে না । সুখদুঃখানুভূতির ইন্দ্রিয়াবলম্বিতা এইরূপে বিলুপ্ত হইলে বলিতে হয় যে -
“ভৈষজ্যমেতদ্‌ দুঃখস্য যদেতন্নানুচিস্তয়েৎ ৷”
অর্থাৎ - “দুঃখের চিন্তা না করাই দুঃখনিবারণের মহৌষধ” [মভা|শা|২০৫|২]; এবং এই নীতি অনুসারে মনকে দৃঢ় করিয়া সত্যের জন্য ও ধর্মের জন্য আহ্লাদের সহিত অগ্নিকাষ্ঠভক্ষণের অনেক উদাহরণ ইতিহাসেও আছে । 


11) ফলাশা ত্যাগ করিলেই দুঃখনিবারণ হয়, অতএব কর্মত্যাগের নিষেধ



অতএব গীতায় উক্ত হইয়াছে যে, যাহা কিছু করিবে, তাহা মনোনিগ্রহপূর্বক এবং তাহার ফলাশা ছাড়িয়া ও সুখদুঃখ সম্বন্ধে সমবুদ্ধি রাখিয়া করিবে; এই ভাবে কর্ম করিতে থাকিলে আমাদের কর্ম ছাড়িতেও হইবে না কিম্বা সেই কর্ম হইতে আমাদের দুঃখরূপ বাধাপ্ৰাপ্তির ভীতি বা সম্ভাবনা থাকিবে না । ফলাশাত্যাগের অর্থ ইহা নহে যে, ফল লাভ হইলে তাহা ত্যাগ করিতে হইবে, কিংবা সেই ফল কেহ কখনও না পায় এইরূপ ইচ্ছা করিবে । সেইপ্ৰকার ফলাশা এবং কর্ম করিবার নিছক ইচ্ছা, আশা, হেতু, কিংবা ফলে অন্য কোন বিষয়ের যোজনা করা, উভয়ের মধ্যে অনেক প্ৰভেদ । কেবল হাত পা নাড়ানোর ইচ্ছা হওয়া, আর অমুককে ধরিবার জন্য কিংবা অমুককে লাথি মারিবার জন্য হাত পা নাড়াইবার ইচ্ছা হওয়া, উভয়ের মধ্যে অনেক প্ৰভেদ । প্ৰথম ইচ্ছাটি কেবল কর্ম করিবারই ইচ্ছা, উহাতে অন্য কোন হেতু থাকে না; এবং এই ইচ্ছা চলিয়া গেলে সমস্ত কর্মই বন্ধ হয় । এই ইচ্ছার অতিরিক্ত প্রত্যেক মনুষ্যের এই জ্ঞানটি হওয়া চাই যে, প্রত্যেক কর্মের কোন-না-কোন পরিণাম বা ফল অবশ্যই হইবে । জ্ঞান হওয়া চাই শুধু নহে, এই প্রকার ইচ্ছাও হওয়া চাই যে, অমুক ফলের জন্য অমুক প্রকার যোজনা করিয়া অমুক কর্ম করিতে হইবে; নতুবা তাহার সমস্ত ক্রিয়া পাগলের মতো নিরর্থক হইবে । এই সমস্ত ইচ্ছা, হেতু বা যোজনা পরিণামে দুঃখজনক হয় না; এবং তাহা যে ছাড়িতে হইবে সে কথা গীতাও বলেন নাই । কিন্তু মনে রেখো যে, ইহাকে ছাড়াইয়া অনেক দূর অগ্রসর হইয়া যখন মনুষ্যের মনে এই ভাব হয় যে, “আমি যে কর্ম করিতেছি আমার সেই কর্মের অমুক ফল অবশ্যই আমার পাওয়া উচিত ।” অর্থাৎ যখন কর্মফলের প্রতি কর্তার বুদ্ধিতে মমত্বের এই আসক্তি, আকাঙ্ক্ষা, অভিমান, অভিনিবেশ বা আগ্রহ উৎপন্ন হয় এবং তাহা দ্বারা মন অধিকৃত হয়, এবং যখন বাঞ্ছিত ফল মিলিবার পক্ষে বাধা উপস্থিত হয়, তখনই দুঃখপরম্পরার সুত্রপাত হয় । এই বাধা অনিবার্য বা দৈবকৃত হইলে শুধু নৈরাশ্য উপস্থিত হয়; কিন্তু উহা মনুষ্যকৃত হইলে ক্রোধ ও দ্বেষ উৎপন্ন হইয়া তাহার ফলে কুকর্ম ঘটে এবং কুকর্মের দ্বারা বিনাশ উপস্থিত হয় । কর্মপরিণামের প্রতি যে মমত্বযুক্ত আসক্তি, উহার ‘ফলাশা’, ‘সঙ্গ’, ‘অহঙ্কার বুদ্ধি’ ও ‘কাম’, এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে; এবং এখান হইতেই সাংসারিক দুঃখপরম্পরার আরম্ভ, ইহা ব্যক্ত করিবার জন্য গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে কথিত হইয়াছে যে, বিষয়সঙ্গ হইতে কাম, কাম হইতে ক্ৰোধ, ক্রোধ হইতে মোহ এবং শেষে মনুষ্যের বিনাশও হইয়া থাকে [গী|২|৬২,৬৩] । এক্ষণে ইহা সিদ্ধ হইল যে, জড় জগতের অচেতন কর্ম স্বয়ং দুঃখের মূল কারণ নহে, কিন্তু মনুষ্য তাহাতে যে ফলাশা, কাম বা আসক্তি বা ইচ্ছা স্থাপন করে, তাহাই প্ৰকৃত দুঃখের মুল । এই দুঃখ হইতে পরিত্রাণ পাইবার সহজ উপায় এই যে, বিষয়ের ফলাশা, আসক্তি বা কাম মনোনিগ্রহের দ্বারা ত্যাগ করিতে হইবে; সন্ন্যাসমাৰ্গে যাহা বলা হয়, তদনুসারে সমস্ত বিষয় ও কর্ম অথবা সর্বপ্রকারের ইচ্ছাই ত্যাগ করিবার প্রয়োজন নাই । অতএব ফলাশা ছাড়িয়া নিষ্কাম ও নিঃসঙ্গ বুদ্ধিতে যে ব্যক্তি যথাপ্ৰাপ্ত বিষয়ের সেবা করে, সেই ব্যক্তিই প্ৰকৃত স্থিতপ্ৰজ্ঞ; ইহা পরে গীতাতে উক্ত হইয়াছে [গী|২|৬৪] । জগতের কর্মব্যবহার কখনই বন্ধ হইতে পারে না । মনুষ্য এই জগতে থাকুক আর নাই থাকুক, প্ৰকৃতি নিজ গুণধর্মানুসারে সততই নিজের কার্য করিতে থাকিবে । জড় প্ৰকৃতির ইহাতে সুখও নাই দুঃখও নাই । মনুষ্য নিজের মহত্ত্বকে ব্যর্থ জানিয়া প্ৰকৃতির ব্যাপারে আসক্ত হওয়া প্ৰযুক্ত সুখদুঃখভাগী হইয়া পড়ে । যদি সে এই আসক্তিবুদ্ধি দূরে নিক্ষেপ করিয়া “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” - প্রকৃতির গুণধর্মানুসারে সমস্ত ব্যাপার চলিতেছে [গী|৩|২৮] এইরূপ ভাবিয়া সমস্ত ব্যবহার করে, তাহা হইলে অসন্তোষ জন্য তাহার কোন দুঃখই হইতে পারে না । তাই প্ৰকৃতির ব্যাপার প্রকৃতি করিতেছেই ইহা বুঝিয়া তাহার জন্য সংসারকে দুঃখপ্রধান বলিয়া কাঁদিতে বসা কিংবা তাহা ত্যাগ করিবারও ইচ্ছা করা উচিত নয় । মহাভারতে [শান্তি|২৫|২৬] ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, -
সুখং বা যদি বা দুঃখং প্ৰিয়ং বা যদি বাহপ্ৰিয়ম্‌ ৷
প্ৰাপ্তং প্রাপ্তমুপাসীত হৃদয়েনাপরাজিতা ॥
অর্থাৎ - সুখই হউক বা দুঃখই হউক, প্ৰিয়ই হউক, বা অপ্ৰিয়ই হউক, যখন যাহা প্ৰাপ্ত হইবে, অপরাজিতচিত্তে তাহার সেবা করিবে । সংসারে অনেক কর্তব্য দুঃখ সহিয়াও করিতে হয় - এই তত্ত্বের প্রতি লক্ষ্য রাখিলে এই উপদেশের মহত্ব পূর্ণরূপে উপলদ্ধ হইবে । ভগবদ্‌গীতাতে স্থিতপ্রজ্ঞের এই লক্ষণ উক্ত হইয়াছে যে, “যঃ সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্ ৷” [২|৫৭] । অর্থাৎ শুভ অথবা অশুভ প্ৰাপ্ত হইয়া যে ব্যক্তি সর্বদা অনাসক্ত থাকিয়া তাহার অভিনন্দন বা দ্বেষ করে না সে-ই স্থিতপ্ৰজ্ঞ । আবার পঞ্চম অধ্যায়ে উক্ত হইয়াছে যে, “ন প্রহৃষ্যেৎ প্রিয়ং প্রাপ্য নোদ্বিজেৎ প্রাপ্য চাপ্রিয়ম্” [৫|২০] সুখ পাইয়া উল্লসিত হইবে না, এবং দুঃখে মুহ্যমানও হইবে না; এবং দ্বিতীয় অধ্যায়ে এই সুখদুঃখ নিষ্কাম বুদ্ধিতে ভোগ করিবার উপদেশ দেওয়া হইয়াছে [২|১৪,১৫] । ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এই উপদেশই বারম্বার পুনরুক্ত করিয়াছেন [গী|৫|৯; ১৩|৯] । বেদান্তশাস্ত্রের পরিভাষায় ইহাকে “সকল কর্মের ব্ৰহ্মাৰ্পণ করা” এই নাম প্রদত্ত হইয়াছে; এবং ভক্তিমার্গে ‘ব্ৰহ্মাৰ্পণের’ স্থলে ‘শ্ৰীকৃষ্ণাৰ্পণ’ এই শব্দ সংযোজিত হইয়া থাকে; ইহাই সমস্ত গীতার সারতত্ত্ব ।


12) ইন্দ্রিয়নিগ্রহের মর্যাদা



কর্ম যে প্রকারেরই হউক না, উহা করিবার ইচ্ছা ও উদ্যোগ না ছাড়িয়া এবং ফলপ্ৰাপ্তির আকাঙ্ক্ষা না রাখিয়া (অর্থাৎ নিঃশঙ্গবুদ্ধিতে) উহা করিতে হইবে, এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার ভবিষ্যতে পরিণামপ্রাপ্ত সুখ-দুঃখকে একই সমানভাবে ভোগ করিবার জন্য প্ৰস্তুত থাকিতে হইবে । এইভাবে কর্ম করিয়া গেলে অমর্যাদিত তৃষ্ণা ও অসন্তোষজনিত দুষ্পরিণাম শুধু যে নিবারিত হয় তাহা নহে, কিন্তু তৃষ্ণা বা অসন্তোষের সঙ্গে সঙ্গে কর্মেরও নাশ করিলে জীবন ধ্বংস হইবার যে প্ৰসঙ্গ উপস্থিত হইতে পারিত তাহাও অসিতে পরিবে না; এবং আমার মনোবৃত্তি শুদ্ধ হইয়া সর্বভূতহিতপ্ৰদ হইয়া যাইবে । ইহা নির্বিবাদ যে, এইরূপে ফলাশা ছাড়িতে হইলেও বৈরাগ্যের দ্বারা ইন্দ্ৰিয়সমূহের ও মনের পূর্ণ নিরোধ করিতে হয় । কিন্তু মনে রেখো যে, ইন্দ্ৰিয়সমূহকে বশে রাখিয়া, স্বার্থের বদলে বৈরাগ্য ও নিষ্কাম বুদ্ধি হইতেই লোকসংগ্ৰহাৰ্থ তাহাদিগকে আপন আপন কর্ম করিতে দেওয়া এক কথা; এবং সন্ন্যাসমার্গ অনুসারে তৃষ্ণাকে উচ্ছেদ করিবার জন্য সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ব্যাপারকে অর্থাৎ সমস্ত কর্মকে আগ্রহের সহিত সমূলে নাশ করা পৃথক কথা - এই দুয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল প্ৰভেদ । গীতায় যে বৈরাগ্য ও ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের উপদেশ করা হইয়াছে তাহা প্রথম প্রকারের, দ্বিতীয় প্রকারের নহে; এবং সেই অনুসারেই অনুগীতাতে জনক-ব্ৰাহ্মণ সংবাদে [মভা|অশ্ব|৩২|১৭-২৩] জনক রাজা ব্ৰাহ্মণের রূপধারী ধর্মকে এইরূপ বলিতেছেন যে -
শৃণু বুদ্ধিং যাং জ্ঞাত্বা সর্বত্র বিষয়ে মম ৷
নাহমাত্মার্থমিচ্ছামি গন্ধান্‌ ঘ্রাণগতানপি ॥
               ***
নাহমাত্মার্থমিচ্ছামি মনো নিত্যং মনোহন্তরে ৷
মনো মে নির্জিতং তস্মাৎ বশে তিষ্ঠতি সর্বদা ॥
অর্থাৎ - “যে (বৈরাগ্য) বুদ্ধি মনে রাখিয়া সমস্ত বিষয়ের আমি সেবন কারিয়া থাকি তাহা তোমাকে বলিতেছি, শোন । আমি নিজের জন্য গন্ধ আঘ্রাণ করি না (চোখে আপনার জন্য দেখি না ইত্যাদি) এবং মনকেও আত্মাৰ্থ অর্থাৎ, আপন লাভের জন্য ব্যবহার করি না; অতএব আমার নাক (চোখ ইত্যাদি) ও মনকে আমি জয় করিয়াছি, তাহারা আমার বশে আছে” । গীতারও বচনের [গী|৩|৬,৭] । ইহাই তাৎপর্য যে, যে মনুষ্য কেবল ইন্দ্ৰিয়সমূহের বৃত্তিকে দমন করিয়া মনের দ্বারা বিষয়সমূহের চিন্তা করিতে থাকে সে পুরো ভণ্ড, এবং যে ব্যক্তি মনোনিগ্রহের দ্বারা কাম্য বুদ্ধিকে জয় করিয়া সমস্ত মনোবৃত্তিকে লোকসংগ্ৰহাৰ্থ আপনি আপনি কাজ করিতে দেয় সেই ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ । বাহ্যজগত কিংবা ইন্দ্ৰিয়ব্যাপার আমরা উৎপন্ন করি নাই, তাহারা স্বভাবসিদ্ধ; আমি দেখি যে, কোন সন্ন্যাসী যতই নিগ্ৰহী হউক না কেন, ক্ষুধা জলিয়া উঠিলে ভিক্ষা করিতে বাহির হইবেই [গী|৩|৩৩]; কিংবা অনেকক্ষণ এক জায়গায় বসিইয়া থাকিলে, কখন বা দাঁড়াইয়া উঠে । তাৎপর্য এই যে, নিগ্ৰহ যতই হউক না কেন, ইন্দ্ৰিয়ের এই স্বভাবসিদ্ধ ব্যাপার কখনো রহিত হইতে পারে না; আর যদি একথা সত্য হয়, তবে ইন্দ্ৰিয়বৃত্তি ও সেই সঙ্গে সমস্ত কর্ম এবং সর্ব প্রকারের ইচ্ছা বা অসন্তোষ নষ্ট করিবার দুরাগ্রহে না পড়িয়া [গী|২|৪৭; ১৮|৫৯], মনোনিগ্রহের দ্বারা ফলাশা পরিত্যাগ পূর্বক এবং সুখদুঃখকে সমান জ্ঞানপূর্বক [গী|২|৩৮] নিষ্কাম বুদ্ধিতে লোকহিতার্থ সকল-কর্ম শাস্ত্রোক্ত রীতিতে করিতে থাকাই হইল শ্রেষ্ঠ ও আদর্শ মার্গ । তাই -


13) কর্মযোগের চতুঃসূত্র


কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্মফলহেতুর্ভূঃমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি ॥
এই শ্লোকে [গী|২|৪৭] ভগবান অর্জুনকে প্রথমে এইরূপ বলিতেছেন যে, তুমি এই কর্মভূমিতে জন্মগ্রহণ করিয়াছ, অতএব “তোমার কর্ম করিবার অধিকার আছে”; কিন্তু তোমার এই অধিকার কেবল (কর্তব্য) কর্ম করিবারই অধিকার, ইহা মনে রেখো । ‘এব’ পদের অর্থ ‘কেবল’; এই পদটির দ্বারা সহজেই জানা যাইতেছে যে, কর্ম ব্যতীত অন্য বিষয়ে - অর্থাৎ কর্মফলে - মনুষ্যের অধিকার নাই । এই গুরুতর বিষয় কেবল অনুমানের উপর অবলম্বিত না রাখিয়া দ্বিতীয় চরণে ভগবান স্পষ্ট ভাষায় বলিয়া দিয়াছেন যে, “কর্মফলে তোমার কোনই অধিকার নাই”, অর্থাৎ কোন কর্মের ফল পাওয়া, কি না পাওয়া, তোমার অধিকারের কথা নহে, উহা পরমেশ্বরের উপর কিংবা সৃষ্টির কর্মবিপাকের উপর অবলম্বিত আছে । যে বিষয়ে আমার অধিকার নাই, তাহার সম্বন্ধে আশা করা যে, উহা অমুক প্রকারে হউক, মূঢ়তার লক্ষণ । কিন্তু এই তৃতীয় বিষয়টিও অনুমানের উপর অবলম্বিত নহে । তৃতীয় চরণে উক্ত হইয়াছে যে, “অতএব তুমি কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা মনেতে রাখিয়া কোন কর্মই করিবে না” ; কর্মবিপাক অনুসারে তোমার কর্মের যে ফল হইবার তাহা হইবেই, তোমার ইচ্ছায় তাহা ন্যূনাধিক হওয়া অথবা শীঘ্ৰ বা বিলম্বে হওয়া অসম্ভব; কিন্তু যদি তুমি এইরূপ আশা রাখো বা আগ্ৰহ কর, তাহা হইলে তোমার কেবল ব্যৰ্থ দুঃখ ও কষ্ট হইবে মাত্র । এই স্থলে কোন কোন ব্যক্তি - বিশেষতঃ সন্ন্যাসমাৰ্গী - প্রশ্ন করিতে পারেন যে, কর্ম করিয়া ফলের আশা ছাড়িবার বৃথা চেষ্টা অপেক্ষা একেবারেই কর্ম ত্যাগ করা ভাল নহে কি ? এইজন্য ভগবান শেষে নিজের নিশ্চিত মতও বলিয়া দিয়াছেন যে, “কর্ম না করিবার (অকর্মের) আগ্রহ রাখিবে না”, তোমার যে অধিকার আছে তদনুসারে - কিন্তু ফলাশা ছাড়িয়া - কর্মই করিতে থাক । কর্মযোগদৃষ্টিতে এই সমস্ত সিদ্ধান্ত এত গুরুতর যে উপরি-উক্ত শ্লোকের চারি চরণ কর্মযোগশাস্ত্রের বা গীতাধর্মের চতুঃসূত্র বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না ।


14) আত্মপ্রসাদজ অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সুখের শ্রেষ্ঠতা ও নিত্যতা



ইহা বোঝা গিয়াছে যে, সংসারে সুখ দুঃখ সর্বদাই পৰ্যায়ক্রমে প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, এবং এখানে সুখ অপেক্ষা দুঃখেরই পরিমাণ অধিক । ইহা সিদ্ধ হইলেও যদি সাংসারিক কর্ম অপরিত্যাজ্য হয়, তবে দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তির এবং অত্যন্ত সুখপ্ৰাপ্তির জন্য মনুষ্যের সমস্ত প্ৰযত্ন ব্যর্থ, ইহা কাহারও কাহারও মনে হওয়া সম্ভব; এবং কেবল আধিভৌতিক অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়গম্য বাহ্য বিষয়োপভোগরূপ সুখেরই দিকে দৃষ্টি করিলে তাহাদের ধারণা অসঙ্গত বলা যায় না । সত্য, চাঁদকে ধরিবার জন্য ছোট ছেলে আকাশে হাত বাড়াইলেও সে যেরূপ চাঁদকে মুঠির ভিতর আনিতে পারে না, সেইরূপ আত্যন্তিক সুখের আশায় কেবল আধিভৌতিক সুখের অনুসরণ করিলেও অত্যন্ত সুখপ্ৰাপ্তি দুর্ঘট হয় । কিন্তু মনে রেখো, আধিভৌতিক সুখই সর্বপ্রকার সুখের ভাণ্ডার নহে, সেই কারণ উপরি-উক্ত বাধার ভিতরেও অত্যন্ত ও নিত্য সুখপ্রাপ্তির একটা পথ বাহির করা যাইতে পারে । উপরে বলা হইয়াছে যে, শারীরিক ও মানসিক - সুখের এই দুই ভেদ । শরীরের কিংবা ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপার অপেক্ষা শেষে মনেরই অধিক গুরুত্ব স্বীকার করিতে হয় । শারীরিক (অর্থাৎ আধিভৌতিক) সুখাপেক্ষা মানসিক সুখের যোগ্যতা অধিক, এই যে সিদ্ধান্ত জ্ঞানী ব্যক্তিরা করিয়া থাকেন, তাহা আপন জ্ঞানের অহঙ্কার বশতঃ তাঁহারা করেন না । এই সিদ্ধান্তেই শ্রেষ্ঠ মনুষ্যজন্মের যে প্রকৃত মহত্ব ও সার্থকতা, তাহা আধিভৌতিকবাদী “মিল” আপন উপযোগবাদ সম্বন্ধীয় গ্রন্থে স্পষ্টরূপে স্বীকার করিয়াছেন । (“It is better to be a human being dissatisfied than a pig satisfied; better to be Socrates dissatisfied than a fool satisfied. And if the fool or the pig, is of a different opinion, it is because they only know their own side of the question.” - Utilitarianism, P.14, Longmans 1907).

কুকুর, শূকর, বলদ প্রভৃতিরও ইন্দ্ৰিয়সুখের আনন্দ যদি মনুষ্যেরই সমানই হইত; এবং বিষয়োপভোগই এই জগতে প্রকৃত সুখ, মনুষ্যের যদি ইহাই ধারণা হইত, তাহা হইলে মনুষ্য পশু হইতেও রাজি হইত । কিন্তু পশুর সমস্ত বিষয়মুখ নিত্য পাইবার অবসর আসিলেও কোন মনুষ্য পশু হইতে রাজি হয় না; ইহাতেই জানা যাইতেছে যে, পশু ও মনুষ্যের মধ্যে একটা কিছু বিশেষত্ব আছে । এই বিশেষত্বটি কি, তাহা বুঝিতে গেলে মন ও বুদ্ধির দ্বারা আপনার ও বাহ্যজগতের জ্ঞান যাহার দ্বারা হয়, সেই আত্মার স্বরূপের বিচার করা আবশ্যক; এবং একবার এই বিচার শুরু হইলে স্পষ্ট বুঝা যাইবে যে, পশু ও মনুষ্য এই উভয়ের বিষয়োপভোগজনিত সুখ একই কিন্তু তাহা অপেক্ষা মনের ও বুদ্ধির অত্যন্ত উদাত্ত ব্যাপারে ও শুদ্ধাবস্থাতে যে সুখ, তাহাই মনুষ্যের শ্রেষ্ঠ ও আত্যন্তিক সুখ । এই সুখ আত্মবশ; ইহার প্রাপ্তি কোন বাহ্য বস্তুর অপেক্ষা করে না; ইহার প্রাপ্তির জন্য অন্যের সুখ হ্রাস করিবার প্রয়োজন হয় না; এই সুখ, আপনারই প্রযত্নে প্ৰাপ্ত হওয়া যায় এবং যেমন যেমন আমার উন্নতি হইতে থাকে, তেমনি তেমনি এই সুখের স্বরূপও অধিকাধিক শুদ্ধ ও নির্মল হইতে থাকে । ভর্তৃহরি সত্যই বলিয়াছেন যে, “মনসি চ পরিতুষ্টে কোহর্থবান্‌ কো দরিদ্রঃ”মন প্রসন্ন হইলে দরিদ্রই বা কে, ধনবানই বা কে, দুই-ই সমানপ্লেটো নামক প্ৰসিদ্ধ গ্ৰীক তত্ত্ববেত্তাও প্রতিপাদন করিয়াছেন যে, শারীরিক (অর্থাৎ বাহ্য বা আধিভৌতিক) সুখাপেক্ষা মনের সুখ শ্ৰেষ্ঠ, এবং মনের সুখাপেক্ষাও বুদ্ধিগ্ৰাহ্য (অর্থাৎ পরম আধ্যাত্মিক) সুখ শ্রেষ্ঠ [Republic Book IX] । তাই যদি আমি এখন মোক্ষের বিচার ছাড়িয়া দিই, তথাপি ইহাই সিদ্ধ হয় যে, আত্মবিচার নিমগ্ন বুদ্ধি হইতেই পরম সুখ লাভ হইতে পারে । 

সেই কারণে ভগবদ্‌গীতাতে সুখের (i)সাত্ত্বিক, (ii)রাজসিক ও (iii)তামসিক এই তিন ভেদ করা হইয়াছে, এবং ইহাদের লক্ষণও বলা হইয়াছে, যথা – 
(i)সাত্ত্বিক : আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির (অর্থাৎ সর্বভুতে একই আত্মাকে জানিয়া আত্মার ঐ প্রকৃত স্বরূপে রত বুদ্ধির) প্ৰসন্নতা হইতে যে আধ্যাত্মিক সুখ পাওয়া যায় তাহাই সাত্ত্বিক ও শ্রেষ্ঠ সুখ, “তৎসুখং সাত্ত্বিকং প্রোক্তং আত্মবুদ্ধিপ্ৰসাদজম্‌” [গী|১৮|৩৭]
(ii)রাজসিক : যে আধিভৌতিক সুখ ইন্দ্ৰিয় ও ইন্দ্ৰিয়ের বিষয়প্ৰসূত, তাহা সাত্ত্বিক সুখের নিম্ন পদবীস্থ এবং তাহাকে রাজসিক বলা যায় [গী|১৮|৩৮]
(iii)তামসিক : এবং যে সুখ হইতে চিত্তমোহ হয় এবং যে সুখ নিদ্রা বা আলস্য হইতে উৎপন্ন হয়, তাহার যোগ্যতা তামসিক অর্থাৎ কনিষ্ঠ শ্রেণীর । 
এই প্রকরণের আরম্ভে গীতার যে শ্লোক প্রদত্ত হইয়াছে, তাহার ইহাই তাৎপর্য; এবং গীতাও বলিয়াছেন [গী|৬|২২] যে, এই পরম সুখের উপলব্ধি একবার হইলে পরে যত বড় দুঃখ আসুক না কেন, তাহাতেও মনুষ্যের সুখময় স্থৈর্য কখনই বিচলিত হয় না । 

এই আত্যন্তিক সুখ স্বর্গেরও বিষয়োপভোগজনিত সুখে পাওয়া যায় না; ইহা লাভ করিবার জন্য নিজের বুদ্ধি প্ৰথমে প্ৰসন্ন হওয়া চাই । বুদ্ধিকে কেমন করিয়া প্ৰসন্ন রাখিবে তাহা না দেখিয়া, যে ব্যক্তি কেবল বিষয়োপভোগেই নিমগ্ন হয় তাহার সুখ ক্ষণিক ও অনিত্য । .কেবল ইহাই নহে; কিন্তু যাহা আজ ইন্দ্ৰিয়ের সুখজনক প্রতীত হইতেছে, তাহাই কোন কারণপ্রযুক্ত কল্য দুঃখজনক হইতে পারে । উদাহরণ যথা - গ্ৰীষ্মকালে যে ঠাণ্ডা জল মিষ্ট লাগে তাহাই শীতকালে আর পান করা যায় না । ভাল; এত করিয়াও তাহা হইতে সুখেচ্ছার পুর্ণ তৃপ্তি হইতেই পারে না । তাই, ‘সুখ’ শব্দের ব্যাপক অর্থ লইয়া যদি আমি ঐ শব্দের উপযোগ সর্বপ্রকার সুখ সম্বন্ধেই করি, তাহা হইলে সুখের মধ্যেও ভেদ করা আবশ্যক হয় । নিত্য ব্যবহারে সুখের অর্থে মুখ্যত ইন্দ্ৰিয়সুখই বুঝায় । কিন্তু যখন ইন্দ্ৰিয়াতীত ও নিছক আত্মনিষ্ঠ বুদ্ধির উপলব্ধ সুখ হইতে বিষয়োপভোগরূপ সুখের ভেদ প্ৰদৰ্শন করিতে হইবে, তখন বিষয়োপভোগের আধিভৌতিক সুখকে কেবলমাত্ৰ সুখ বা প্রেয় এবং আত্মবুদ্ধিপ্ৰসাদ হইতে উৎপন্ন অর্থাৎ আধ্যাত্মিক সুখকে শ্রেয়, কল্যাণ, হিত, আনন্দ অথবা শান্তি, এইরূপ বলিবার রীতি আছে । পূর্ব প্রকরণের শেষে প্রদত্ত কঠোপনিষদের বাক্যে প্রেয় ও শ্রেয় এই দুয়ের মধ্যে নচিকেতা যে ভেদ করিয়াছেন তাহাও এই মর্মেই করা হইয়াছে । মৃত্যু তাঁহাকে অগ্নির রহস্য প্রথমেই বলিয়াছিলেন । কিন্তু এই সুখ প্ৰাপ্ত হইবার পরেই যখন নচিকেতা, আত্মজ্ঞানপ্ৰাপ্তির বর চাহিলেন, তখন তাহার বদলে মৃত্যু তাঁহাকে অন্য অনেক ঐহিক সুখের লোভ দেখাইলেন । কিন্তু নচিকেতা অনিত্য আধিভৌতিক সুখে কিংবা আপাতদৃষ্ট মধুর (প্রেয়) বস্তুতে না ভুলিয়া, দূরদৃষ্টিপূর্বক, যাহাতে আত্মার শ্ৰেয় অর্থাৎ পরিণামে কল্যাণ হয়, সেই আত্মবিদ্যাকেই আগ্রহের সহিত ধরিয়া শেষে তাহাই সম্পাদনা করিলেন । সারকথা - আত্মবুদ্ধিপ্রসাদ হইতে উৎপন্ন নিছক বুদ্ধিগম্য সুখকেই অর্থাৎ আধ্যাত্মিক আনন্দকেই আমাদের শাস্ত্রকার শ্রেষ্ঠ সুখ বলিয়া মানেন; এই নিত্য সুখ আত্মবশ হওয়া প্ৰযুক্ত সকলেই পাইতে পারে এবং সকলেরই তাহা পাইবার জন্য প্ৰযত্ন করা কর্তব্য, ইহাই আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের অভিপ্ৰায় । পশুধর্ম হইতে প্ৰাপ্ত সুখ এবং মানবীয় সুখের মধ্যে যে কিছু বিশেষত্ব আছে তাহা ইহাই; এবং এই আত্মানন্দ কেবল বাহ্য উপাধিসমূহের উপর কখন নির্ভর না করিবার কারণে সমস্ত সুখের মধ্যে উহাই নিত্য, স্বতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠ । গীতাতে ইহারই নাম দেওয়া হইয়াছে – “নির্বাণের শান্তি” [গী|২|৭১; ৬|২৮; ১২|১২; ১৮|৬২ দেখ]


15) এই দুই সুখের প্রাপ্তিই কর্মযোগদৃষ্টিতে পরম সাধ্য



এখন স্থির হইল যে, আত্মার শান্তি বা সুখই অত্যন্ত শ্রেষ্ঠ সুখ, উহা আত্মবশ হওয়া প্রযুক্ত উহা লাভ করাও সকলের সাধ্যায়ত্ত । কিন্তু ইহা সুস্পষ্ট যে, সকল ধাতুর মধ্যে স্বর্ণ অত্যন্ত মূল্যবান হইলেও কেবল সুবৰ্ণ হইতেই লৌহ প্ৰভৃতি অন্য ধাতু বিনা যেমন সংসারের কাজ চলে না, কিংবা চিনি অত্যন্ত মিষ্ট হইলেও, লবণ বিনা যেমন কাজ চলে না; সেইরূপ আত্মসুখ বা শান্তির বিষয়েও বুঝতে হইবে । ইহা নিঃসন্দেহ যে, এই শান্তির সহিত অন্তত শরীরধারণার্থও কোন কোন ঐহিক পদার্থের প্রয়োজন আছে; এবং এই অভিপ্ৰায়েই আশীর্বাদের সঙ্কল্পে কেবল ‘শান্তিরস্তু’ বলিয়া “শান্তিঃ পুষ্টিস্তুষ্টিশ্চাস্তু” অর্থাৎ শান্তির সঙ্গে পুষ্টি ও তুষ্টিও চাই - এইরূপ বলিবার রীতি আছে । কেবল শান্তির দ্বারাই তুষ্টি পাওয়া যায়, ইহা যদি শাস্ত্রকারদিগের অভিপ্ৰায় হইত, তাহা হইলে এই সঙ্কল্পের মধ্যে ‘পুষ্টি’ শব্দের বৃথা সন্নিবেশ করিবার কোন হেতু থাকিত না । ইহার অভিপ্রার এরূপ নহে যে, পুষ্টির অর্থাৎ ঐহিক সুখবৃদ্ধির জন্য দিনরাত হায় হায় করিতে হইবে । উক্ত সঙ্কল্পের ভাবার্থ এই যে, শান্তি, পুষ্টি ও তুষ্টি (সন্তোষ) এই তিনই যোগ্য পরিমাণে তুমি প্রাপ্ত হও, এবং এই তিনিই পাইবার জন্য তোমায় যত্ন করা কর্তব্য । কঠোপনিষদেরও ইহাই তাৎপর্য । নচিকেতা যমলোকে গমন করিলে পর যম তাহাকে কোন তিনটী বর চাহিতে বলিলেন । তদনুসারে প্রার্থিত বর তাঁহাকে দিলেন, এই কথাই এই উপনিষদে সবিস্তার বৰ্ণিত হইয়াছে । সেই সময় নচিকেতা একেবারে প্রথম হইতে আমাকে “ব্ৰহ্মজ্ঞান দান কর” এইরূপ বর না চাহিয়া “আমার পিতা আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়াছেন, তিনি যেন আমার উপর প্রসন্ন হন”, এই বর চাহিলেন । পরে তিনি দ্বিতীয় বর চাহিলেন যে, “অগ্নি অর্থাৎ ঐহিক সমৃদ্ধিউৎপাদক যজ্ঞাদি কর্মের জ্ঞান আমাকে প্ৰদান কর” । এই দুই বর প্রাপ্ত হইলে পর, শেষে তিনি যমের নিকট তৃতীয় বর চাহিলেন যে, “আমাকে আত্মবিদ্যার উপদেশ দেও” । কিন্তু এই তৃতীয় বরের বদলে আরও অনেক সম্পদ দিতেছি - এই কথা যম যখন বলিলেন, তখন - অৰ্থাৎ প্ৰেয় (সুখ) প্ৰাপ্তির পক্ষে আবশ্যক যজ্ঞাদি কর্মের জ্ঞান লাভ হইলে পর, তাহার সম্বন্ধে অধিক আশা না করিয়া নচিকেতা এই বিষয়েই আগ্ৰহ প্ৰকাশ করিলেন যে, “এক্ষণে, যাহাতে শ্ৰেয় (আত্যন্তিক সুখ) লাভ হয় সেই ব্ৰহ্মজ্ঞানের কথা আমাকে বল” । সারকথা এই যে, এই উপনিষদের শেষভাগের মন্ত্রে যাহা বর্ণিত হইয়াছে তদনুসারে ‘ব্রহ্মবিদ্যা’ এবং ‘যোগবিধি’ অর্থাৎ যজ্ঞযাগাদি - এই দুই-ই লাভ করিয়া নচিকেতা মুক্ত হইয়াছিলেন [কঠ|৬|১৮] । ইহা হইতে জ্ঞান ও কর্ম এই দুয়ের সমুচ্চয়ই উপনিষদের তাৎপর্য, ইহাই সিদ্ধ হয় । এই বিষয়ে ইন্দ্রেরও এই প্রকারের একটা কথা আছে । ইন্দ্ৰ তো স্বয়ং ব্ৰহ্মজ্ঞানী ছিলেনই, কিন্তু আবার তিনি প্রতর্দ্দনকেও ব্ৰহ্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়াছিলেন, কৌষীতকী উপনিষদে এইরূপ বৰ্ণিত আছে । তথাপি ইন্দ্রের রাজ্য গিয়া প্ৰহ্লাদ ত্ৰৈলোক্যাধিপতি হইলে পর, ইন্দ্র, দেবগুরু বৃহস্পতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন যে, “শ্রেয় কিসে হয় তাহা আমাকে বল” । তখন বৃহস্পতি রাজ্যভ্ৰষ্ট ইন্দ্রকে ব্রহ্মবিদ্যা অর্থাৎ আত্মজ্ঞানের উপদেশ দিয়া বলিলেন যে, “ইহাই শ্ৰেয়” (এতাবচ্ছ্রেয় ইতি) । কিন্তু ইন্দ্র তাহাতে আশ্বস্ত না হইয়া “আরও বেশী কিছু আছে কি ?” (কো বিশেষো ভবেৎ ?) পুনরায় এইরূপ প্রশ্ন করিলে পর, বৃহস্পতি তাহাকে শুক্রাচার্যের নিকট পাঠাইলেন । সেখানেও ঐরূপ ঘটিলে পর, শুক্রাচার্য বলিলেন যে, “উহা প্ৰহ্লাদের ভাল জানা আছে” । তখন শেষে ব্ৰাহ্মণবেশে প্ৰহ্লাদের নিকট গিয়া ইন্দ্ৰ প্ৰহ্লাদের শিষ্য হইলেন এবং কিছুকাল তাঁহার সেবা করিতে লাগিলেন । একদিন প্ৰহ্লাদ তাঁহাকে বলিলেন যে, শীলই (সত্য ও ধর্মানুসারে আচরণ করিবার স্বভাব) ত্ৰৈলোক্যের রাজ্যলাভের নিগুঢ় তত্ত্ব এবং তাহাই শ্রেয় । তাহার পর, প্ৰহ্লাদ যখন বলিলেন যে, তোমার সেবায় আমি সন্তুষ্ট হইয়াছি, তুমি ভাগ্যবান, তোমাকে বর দান করিব, তখনী ব্রাহ্মণবেশধারী ইন্দ্র এই বর চাহিলেন যে, “তোমার ‘শীল’ আমাকে দেও” । প্ৰহলাদ ‘তথাস্তু’ বলিতেই তাহার ‘শীল’ ও তাহার সঙ্গে ধর্ম, সত্য, বৃত্ত, শ্ৰী অথবা ঐশ্বর্য প্ৰভৃতি সমস্ত দেবতা প্ৰহ্লাদের শরীর হইতে নিৰ্গত হইয়া ইন্দ্রের শরীরে প্রবেশ করিলেন । তাহার ফলে ইন্দ্র আপন রাজ্য প্রাপ্ত হইলেন । মহাভারতের শান্তিপর্বে [শা|১২৪] ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে এই প্ৰাচীন কথা বলিয়াছিলেন । এই সুন্দর ইন্দ্ৰ-প্ৰহ্লাদের কথা হইতে স্পষ্টই দেখা যায় যে, নিছক ঐশ্বর্য অপেক্ষা নিছক্ আত্মজ্ঞান যদি যোগ্যতরও হয়, তথাপি এ জগতে যাহার থাকিতে হইবে তাহার অন্য লোকেরই মতো আপনার জন্য এবং আপনার দেশের জন্য ঐহিক সমৃদ্ধি অর্জন করিবার আবশ্যকতা ও নৈতিক অধিকারও আছে; সেই কারণে যখন এই প্রশ্ন উঠে যে, এই জগতে মনুষ্যের পরম সাধ্য কি, তখন আমাদের কর্মযোগশাস্ত্ৰে শেষ উত্তর এই পাওয়া যায় যে, শান্তি ও পুষ্টি, শ্রেয় ও প্ৰেয় কিংবা জ্ঞান ও ঐশ্বর্য - দুই-ই এক সঙ্গে অর্জন কর । যে ভগবান অপেক্ষা এই জগতে, আর কেহই শ্রেষ্ঠ নাই এবং যাহার পথ ধরিয়া অন্য সকল লোকই চলিতেছে, [গী|৩|২৩] সেই ভগবানই কি ঐশ্বর্য ও সম্পদ, ত্যাগ করিয়াছেন ? -
ঐশ্বর্যস্য সমগ্ৰস্য ধর্মস্য যশস্যঃ শ্রিয়ঃ ৷
জ্ঞানবৈরাগ্যায়োশ্চৈব ষণ্ণাং ভগ ইতীরণা ॥
অর্থাৎ সমগ্ৰ ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, সম্পদ, জ্ঞানবৈরাগ্য, এই ছয় বিষয়কে ‘ভগ’ বলে - ভগ শব্দের এই ব্যাখ্যা পুরাণাদিতে প্ৰদত্ত হইয়াছে [বিষ্ণু|৬|৫|৭৪ দেখ] । কেহ কেহ এই শ্লোকের ঐশ্বৰ্য শব্দের অর্থ ‘যোগৈশ্বৰ্য’ করেন; কারণ, শ্রী অর্থাৎ সম্পদসূচক শব্দ পরে আসিয়াছে । কিন্তু ব্যবহারে, ঐশ্বর্যশব্দে সত্তা, যশ ও সম্পদ, এবং জ্ঞানে বৈরাগ্য ও ধর্মে্র সমাবেশ হয়, তাই অনায়াসে বলিতে পারি যে, লৌকিক দৃষ্টিতে উক্ত শ্লোকের সমস্ত অর্থ, জ্ঞান ও ঐশ্বর্য এই দুই পদেই ব্যক্ত হয় । আর যখন স্বয়ং ভগবানই জ্ঞান ও ঐশ্বর্য স্বীকার করিয়াছেন, তখন উহাই প্ৰমাণ মনে করিয়া লোকের কাজ করা আবশ্যক [গী|৩|২১; মভা|শাং|৩৪১|২৫] । নিছক আত্মজ্ঞানই এই সংসারে পরম সাধ্য বস্তু, ইহা কর্মযোগমার্গের সিদ্ধান্ত কখনই নহে; সংসার দুঃখময় বলিয়া উহা একেবারে ছাড়িয়া দিতে হইবে, ইহা সন্ন্যাসমার্গের সিদ্ধান্ত । ভিন্ন ভিন্ন মার্গের এই সিদ্ধান্তগুলি একত্ৰ করিয়া গীতার অর্থের বিপর্যয় করা উচিত নহে । তথাপি মনে রেখো, গীতাই বলিয়াছেন যে, জ্ঞান বিনা কেবল ঐশ্বর্য, আসুরী সম্পদ । তাই ঐশ্বর্যের সহিত জ্ঞান এবং জ্ঞানের সহিত ঐশ্বর্য কিংবা শান্তি ও পুষ্টি এই দুয়ের সংযোগ নিত্য স্থির রাখা আবশ্যক এইরূপ সিদ্ধ হইতেছে । জ্ঞানের সহিত ঐশ্বর্য হওয়া অত্যাবশ্যক বলাতেই, কর্ম করিবার আবশ্যকতা স্বতই আসিয়া পড়ে । কারণ মনু বলিয়াছেন, “কর্মাণ্যারভমাণং হি পুরুষং শ্ৰীর্নিষেবতে” [মনু|৯|৩০০] কর্মকারী ব্যক্তিই এই জগতে শ্ৰী অর্থাৎ ঐশ্বর্য লাভ করে । প্ৰত্যক্ষ অনুভূতিতেও এই বিষয় সিদ্ধ হয়; এবং গীতাতে অর্জুনকে যে উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছে সে উপদেশেও তাহাই উক্ত হইয়াছে [গী|৩|৮] । মোক্ষদৃষ্টিতে কর্মের আবশ্যকতা না থাকায় শেষে অর্থাৎ জ্ঞানলাভের পর সমস্ত কর্ম ত্যাগ করাই আবশ্যক, এইরূপ কেহ কেহ বলেন । কিন্তু আপাতত কেবল সুখদুঃখেরই বিচার করা কর্তব্য; এবং এ পর্যন্ত মোক্ষ ও কর্মের স্বরূপ পরীক্ষা করা হয় নাই, তাই এই আপত্তির উত্তর এখানে দেওয়া যাইতে পারে না । পরে নবম ও দশম প্রকরণে অধ্যাত্ম ও কর্মবিপাক সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে বিচার আলোচনা করিয়া পরে একাদশ প্রকরণে, এই আপত্তিও যে শূন্যগর্ভ তাহা দেখান যাইবে ।


16) বিষয়োপভোগসুখ অনিত্য এবং পরমধ্যেয় হইবার অযোগ্য



সুখ ও দুঃখ দুই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র অনুভূতি বা বেদনা; সুখেচ্ছা কেবল সুখোপভোগের দ্বারা তৃপ্ত হইতে পারে না, এই জন্য সংসারে মোটের হিসাবে দুঃখই অধিক অনুভূত হইয়া থাকে; কিন্তু এই দুঃখ এড়াইবার জন্য তৃষ্ণা বা অসন্তোষকে এবং তাহার সহিত সমস্ত কর্মকে সমূলে উচ্ছেদ করা উচিত নহে; কেবল ফলাশা ছাড়িয়া সমস্ত কর্ম করিতে থাকাই শ্ৰেয়স্কর । কেবল বিষয়োপভোগ সুখ কখনই পুর্ণ হয় না, উহা অনিত্য ও পশুধর্ম; অতএব এই সংসারে বুদ্ধীন্দ্ৰিয়বিশিষ্ট মনুষ্যের যাহা প্ৰকৃত ধ্যেয় তাহা উহা অপেক্ষা উচ্চ আদর্শের হওয়া চাই; আত্মবুদ্ধিপ্ৰসাদ হইতে যে শান্তিসুখ পাওয়া যায় সেই শান্তিসুখই মনুষ্যের প্রকৃত ধ্যেয়; কিন্তু আধ্যাত্মিক সুখই এই প্রকার শ্রেষ্ঠ হইলেও উহার সঙ্গে এই সাংসারিক জীবনে ঐহিক বস্তুসমূহেরও যথোচিত আবশ্যকতা আছে; এবং এই কারণে নিষ্কাম বুদ্ধিতে প্ৰযত্ন অর্থাৎ কর্ম করাও আবশ্যক; - এই কথাগুলি কর্মযোগশাস্ত্ৰানুসারে সিদ্ধ হইলে পর, সুখদৃষ্টিতে বিচার করিলেও ইহা বুঝাইবার প্রয়োজন হয় না যে, কেবল আধিভৌতিক সুখকেই পরম সাধ্য মনে করিয়া কর্মের কেবল সুখদুঃখাত্মক বাহ্য পরিণামের তারতম্য হইতেই নীতিমত্তার নির্ণয় করা উচিত নহে । কারণ, যে বস্তু পরিপূর্ণাবস্থায় কখনও স্বতঃ আসিতে পারে না, তাহাকে পরম সাধ্য মনে করা অর্থাৎ ‘পরম’ শব্দের অপব্যবহার করিয়া মৃগজলের স্থানে জলের ভাবনা করাটাই অসঙ্গত । পরম সাধ্যই যখন অনিত্য ও অপূর্ণ হইল, তখন তাহার আশায় থাকিলে অনিত্য বস্তু ছাড়া আর কি পাইবো ? “ধর্মো নিত্যঃ সুখদুঃখে ত্বনিত্যে” এই বচনের মর্মও ইহাই । 

অধিক লোকের অধিক সুখ” এই বাক্যের মধ্যে সুখশব্দের অর্থ কি বুঝিতে হইবে, তৎসম্বন্ধে আধিভৌতিকবাদীদিগের মধ্যেও অনেক মতভেদ আছে । তাঁহাদের মধ্যে অনেকে বলেন যে, অনেক সময় মনুষ্য সমস্ত বিষয়সুখকে পদাঘাত করিয়া কেবল সত্যের জন্য বা ধর্মের জন্য প্ৰাণ দিতেও প্ৰস্তুত হয়; কাজেই ইহা মনে করা অনুচিত যে, আধিভৌতিক সুখপ্ৰাপ্তির জন্যই মনুষ্যের সর্বদাই ইচ্ছা হয় । তাই, তাঁহারা সুচনা করিয়াছেন যে, সুখশব্দের বদলে হিত কিংবা কল্যাণ শব্দ জুড়িয়া দিয়া “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই সূত্রের “অধিক লোকের অধিক হিত বা কল্যাণ” এইরূপ রূপান্তর করিতে হইবে । কিন্তু এত করিয়াও এ মতে এই দোষ থাকিয়া যায় যে, কর্তার বুদ্ধির কোনই বিচার হয় না, এবং এই প্রকার অন্য দোষও এই মতে থাকিয়া যায় । ভাল, বিষয়সুখের সহিত মানসিক সুখেরও বিচার করিতে হইবে যদি বলা যায়, তাহা হইলে উহার আধিভৌতিক পক্ষের এই প্ৰথম প্ৰতিজ্ঞারই বিরোধ হয় যে, সকল কর্মেরই নীতিমত্তা কেবল তাহার বাহ্য পরিণাম ধরিয়াই স্থির করা আবশ্যক - এবং তখন তো কোন-না-কোন অংশে অধ্যাত্মপক্ষ একরকম স্বীকার করিতেই হয় । যখন এই প্রকারে শেষে অধ্যাত্মপক্ষ স্বীকার করিতেই হয়, তখন আধাআধি স্বীকার করিয়া লাভ কি ? অতএব আমাদের কর্মযোগশাস্ত্ৰে এই শেষ সিদ্ধান্ত স্থির করা হইয়াছে যে, সর্বভূতহিত, অধিক লোকের অধিক সুখ, এবং মনুষ্যত্বের পরম উৎকর্ষ প্রভৃতি নীতিনির্ণয়ের সমস্ত বাহ্য সাধন কিংবা আধিভৌতিক মাৰ্গ গৌণ জানিয়া এবং আত্মপ্ৰসাদরূপ আত্যন্তিক সুখ ও তাহার সহস্থায়ী কর্তার শুদ্ধ বুদ্ধিকেই আধ্যাত্মিক কষ্টিপাথর জানিয়া তাহা দ্বারাই কর্ম-অকর্মের পরীক্ষা করা আবশ্যক । 

দৃশ্য জগতের অতীত তত্ত্বজ্ঞানে প্রবেশ করিব না বলিয়া যাহারা শপথ গ্ৰহণ করিয়াছেন তাঁহাদের কথা ছাড়িয়া দাও । যাঁহারা এ প্রকার শপথ গ্ৰহণ করেন নাই, তাঁহাদের যুক্তি হইতে বুঝা যাইবে যে, মন ও বুদ্ধিরও অতীত নিত্য আত্মার নিত্য কল্যাণই কর্মযোগশাস্ত্ৰে মুখ্য বলিয়া স্বীকার করতে হয় । বেদান্তে একবার প্রবেশ করিলেই যাহা কিছু সমস্তই ব্ৰহ্মময় হইয়া যায়, সেখানে আর ব্যবহারের যুক্তি খাটে না, এইরূপ কাহারও কাহারও যে ধারণা, তাহা ভ্রান্ত ধারণা । আজকাল সাধারণতঃ বেদান্তবিষয়ক যে সকল গ্রন্থ পড়িতে পাওয়া যায়, সেগুলি সন্ন্যাসমাৰ্গ অনুযায়ী লিখিত হয় বলিয়া এবং সন্ন্যাসমার্গে তুষ্ণা-রূপী সংসারের সমস্ত ব্যবস্থারই অসার মনে করা হয় বলিয়া তাঁহাদের গ্রন্থাদিতে কর্মযোগের যথার্থ উপপত্তি ঠিক ঠিক পাওয়া যায় না । অধিক কি, এই পরসম্প্রদায়-অসহিষ্ণু গ্ৰন্থকারেরা সন্ন্যাসমার্গের যুক্তিক্ৰম কর্মযোগের মধ্যে গুঁজিয়া দিয়া যাহাতে সাধারণ লোকের ধারণা হয় যে, সন্ন্যাস ও কর্মযোগ এই দুই স্বতন্ত্র মার্গ নহে, সন্ন্যাসই একমাত্র শাস্ত্রোক্ত মোক্ষমাৰ্গ, তাহার জন্য প্ৰযত্ন করিয়াছেন । কিন্তু এরূপ ধারণা ঠিক নহে । সন্ন্যাসমার্গের ন্যায় কর্মযোগমাৰ্গও বৈদিক ধর্মে অনাদি কাল হইতে স্বতন্ত্ররূপে চলিয়া আসিতেছে; এবং এই মার্গের প্রচারকেরা বেদান্ততত্ত্ব না ছাড়িয়া দিয়াও কর্মযোগশাস্ত্রের উপপত্তি ঠিক ঠিক প্ৰদৰ্শন করিয়াছেন । ভগবদ্‌গীতা গ্ৰন্থ এই পন্থারই গ্ৰন্থ । গীতাকে ছাড়িয়া দিলেও জানা যাইবে যে, অধ্যাত্মদৃষ্টিতে কার্যাকার্যশাস্ত্রের বিচার আলোচনা করিবার পদ্ধতি স্বয়ং ইংলেণ্ডেগ্রীণের ন্যায় গ্ৰন্থকারেরা শুরু করিয়াছেন; [Prolegomena to Ethics, Book I; Kant’s Metaphysics of Morals, translated by Abbot in Kant’s theory of Ethics.] এবং জর্মনীতে তো গ্রীণের পূর্বেই এই পদ্ধতি প্ৰচলিত ছিল । 


17) আধিভৌতিক সুখবাদের অপূর্ণতা



দৃশ্য জগতের যতই বিচার আলোচনা করা হোক না কেন, কিন্তু এই জগতের সাক্ষী ও কর্মকর্তা কে, ইহা যে পর্যন্ত ঠিক ঠিক অবগত হওয়া না যায়, সে পৰ্যন্ত তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে এই জগতের মনুষ্যের পরম সাধ্য, শ্রেষ্ঠ কর্তব্য বা অন্তিম ধ্যেয় কি, তাহারও বিচার অপূর্ণই থাকিবে । তাই, “আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্ৰোতব্যে মন্তব্যো, নিদিধ্যাসিতব্যঃ” - যাজ্ঞবল্ক্যের এই উপদেশ উপস্থিত প্রকরণেও অক্ষরশঃ প্ৰযুক্ত হইতে পারে । দৃশ্য জগতের পরীক্ষা করিয়া যদি পরোপকাররূপ তত্ত্বই পরিশেষে নিষ্পন্ন হয়, তবে ইহা দ্বারা অধ্যাত্মবিদ্যার মাহাত্ম্য হ্রাস না হইয়া উল্টা উহা দ্বারা সর্বভুতে একই আত্মা থাকিবার আর এক প্ৰমাণ পাওয়া যায় । অ্যাধিভৌতিকবাদী যে স্বরচিত সীমার বাহিরে যাইতে পারেন না, তাহার কোন উপায় নাই । কিন্তু আমাদের শাস্ত্ৰকারদের দৃষ্টি এই সঙ্কীর্ণ সীমাকে ছাড়াইয়া গিয়াছে, এবং এই কারণে তাঁহারা অধ্যাত্মদৃষ্টিতেই কর্মযোগশাস্ত্রের সম্পূর্ণ উপপত্তি দিয়াছেন । এই উপপত্তির কথা বলিবার পূর্বে, কর্মাকর্মপরীক্ষা সম্বন্ধে আর এক পূর্বপক্ষেরও কিছু আলোচনা করা আবশ্যক, তাই এক্ষণে সেই পন্থা সম্বন্ধে বিচার আলোচনা করিতে প্ৰবৃত্ত হইব ।


ইতি পঞ্চম প্রকরণ সমাপ্ত ।
___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment