Sunday, June 4, 2017

গীতা ও উপনিষৎ (Gita & Upanishads)

গীতা ও উপনিষৎ


সূচি


1)মহাভারতে উপনিষদের উল্লেখ
2)শব্দসাদৃশ্য
3)বিষয়সাদৃশ্য – প্রামাণ্য উপনিষদ নির্বাচন
4)বৈসাদৃশ্য
4.1)কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রর প্রাধান্য
4.2)ভক্তিমাৰ্গ
4.3)কর্মযোগের সহিত, ভক্তি ও ব্ৰহ্মজ্ঞানের মিলন
5)আপাত সাদৃশ্য : চিত্তনিরোধরূপ পাতঞ্জলযোগ
6)সিদ্ধান্ত


1) মহাভারতে উপনিষদের উল্লেখ


এক্ষণে দেখা যাক যে, গীতা ও বিভিন্ন উপনিষদের পরম্পর সম্বন্ধ কি । বর্তমান মহাভারতেই স্থানে স্থানে সাধারণভাবে উপনিষদের উল্লেখ করা হইয়াছে; এবং বৃহদারণ্যক ও ছন্দোগ্যে [বৃ|১|৩; ছা|১|২] প্ৰাণেন্দ্ৰিয়দিগের যুদ্ধের বৃত্তান্তও অনুগীতার [অশ্ব|২৩] প্রদত্ত হইয়াছে; এবং “ন মে স্তেনো জনপদে” ইত্যাদি কৈকেয়-অশ্বপতি রাজার মুখের শব্দও [ছাং|৫|১১|৫] শান্তিপর্বে উক্ত রাজার কথা বলিবার সময় ঠিক ঠিক আসিয়াছে [শাং|৭৭|৮] । সেইরূপ আবার, শান্তিপর্বের জনক পঞ্চশিখসংবাদে “ন প্রেত্য সংজ্ঞান্তি” অর্থাৎ মরিয়া যাইবার পর জ্ঞাতার কোন সংজ্ঞা থাকে না কারণ সে ব্রহ্মে মিশিয়া যায়, বৃহদারণ্যকের এই বিষয় [বৃ|৪|৫|১৩] পাওয়া যায়; সেইখানেই শেষে, প্রশ্ন এবং মুণ্ডক উপনিষদের [প্রশ্ন|৬|৫; মুং|৩|২|৮] নদী ও সমুদ্রের দৃষ্টান্ত নাম-রূপবিমুক্ত পুরুষের উদ্দেশে প্ৰযুক্ত হইয়াছে । ইন্দ্ৰিয়গণকে ঘোড়া বলিয়া ব্ৰাহ্মণব্যাধ-সংবাদে [বন|২১০] এবং অনুগীতায় বুদ্ধির সহিত সারথির যে উপমা দেওয়া হইয়াছে, তাহাও কঠোপনিষদ হইতেই লওয়া হইয়াছে [ক|১|৩|৩]; শান্তিপর্বে [১৮৭|২৯ ও ৩৩১|৪৪] দুই স্থানে “এষ সর্বেষু ভুতেষু গুঢ়াত্মা” [কঠ|৩|১২] এবং “অন্যত্ৰ ধর্মাদন্যত্ৰাধর্মাৎ” [কঠ|২|১৪] কঠোপনিষদের এই দুই শ্লোকও স্বল্পভেদে প্রদত্ত হইয়াছে । শ্বেতাশ্বতরের “সর্বতঃ পাণিপাদং” শ্লোকও মহাভারতে অনেক স্থানে এবং গীতাতেও প্রদত্ত হইয়াছে ইহা পূর্বেই বলিয়াছি । কিন্তু ইহাতেও এই সাদৃশ্য শেষ হয় নাই; ইহা ব্যতীত উপনিষদের আরও অনেক বাক্য মহাভারতের স্থানে স্থানে পাওয়া যায় । ইহাই কেন, মহাভারতের অধ্যাত্মজ্ঞান প্ৰায় উপনিষদ হইতেই লওয়া হইয়াছে ইহাও বলিতে বাধা নাই ।


2) শব্দসাদৃশ্য


গীতারহস্যের নবম ও ত্রয়োদশ প্রকরণে আমি সবিস্তার দেখাইয়াছি যে, মহাভারতের ন্যায়ই ভগবদ্‌গীতার অধ্যাত্মজ্ঞানও উপনিষদ্‌কে অবলম্বন করিয়া আছে; শুধু তাহা নহে, গীতার ভক্তি মাৰ্গও এই জ্ঞান হইতে নহে । তাই, তাহার পুনরুক্তি এখানে না করিয়া সংক্ষেপে ইহাই বলিতেছি যে, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে বর্ণিত আত্মার অশোচ্যত্ব, অষ্টম অধ্যায়ের অক্ষর-ব্রহ্মস্বরূপ এবং ত্রয়োদশ অধ্যায়ের ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার এবং বিশেষ করিয়া “জ্ঞেয়” পরব্রহ্মের স্বরূপ- এই সমস্ত বিষয় গীতায় অক্ষরশঃ উপনিষদের ভিত্তিতেই বর্ণিত হইয়াছে । কোন উপনিষৎ গদ্যে এবং কোন উপনিষৎ পদে রচিত । তন্মধ্যে গদ্যাত্মক উপনিষদের বাক্য পদ্যময় গীতায় যেমনটি তেমনি উদ্ধৃত করা সম্ভব নহে; তথাপি ছান্দোগ্য প্ৰভৃতি উপনিষদ যাঁহারা পাঠ করিয়াছেন তাঁহাদের সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, ‘যাহা আছে তাহা আছে, যাহা নাই তাহা নাই’ [গী|২|১৬], “যং যং বাপি স্মরন্‌ ভাবং” [গী|৮|৬], ইত্যাদি বিচার ছান্দোগ্যোপনিষদ হইতেআ; এবং “ক্ষীণে পুণ্যে” [গী|৯|২১] “জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ” [গী|১৩|১৭], এবং “মাত্ৰাস্পৰ্শাঃ” [গী|২|১৪] ইত্যাদি বিচার ও বাক্য বৃহদারণ্যক হইতে লওয়া হইয়াছে । কিন্তু গদ্যাত্মক উপনিষৎ ছাড়িয়া পদ্যাত্মক উপনিষদ্‌ গ্ৰহণ করিলে, এই সাম্য ইহা অপেক্ষাও অধিক স্পষ্ট ব্যক্ত হয় । কারণ, এই  পদ্যাত্মক উপনিষদের কোন কোন শ্লোক যেমন-তেমনটি  ভগবদ্গীতায় গৃহীত হইয়াছে । উদাহরণ যথা - কঠোপনিষদের ছয় সাত শ্লোক অক্ষরশঃ কিংবা অল্প শব্দভেদে গীতায় সন্নিবেশিত হইয়াছে । গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের “আশ্চর্য্যবৎ পশ্যতি” [২|২৯] শ্লোক, কঠোপনিষদের দ্বিতীয় বল্লীর “আশ্চর্য্যো বক্তা” [কঠ|২|৭] শ্লোকের সমান; এবং “ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ” [গী|২|২০] শ্লোক এবং “যদিচ্ছন্তো ব্ৰহ্মচৰ্য্যং চরন্তি” [গী|৮|১১] এই শ্লোকার্ধ গীতায় ও কঠোপনিষদে অক্ষরশঃ একই [কঠ|২|১৯; ২|১৫]“ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুঃ” [গী|৩|৪২] গীতার এই শ্লোক কঠোপনিষদ হইতে গৃহীত [কঠ|৩|১০] ইহা পূর্বেই বলিয়াছি । সেইরূপ গীতার পনেরো অধ্যায়ের অশ্বত্থ বৃক্ষের রূপকটি কঠোপনিষদ হইতে এবং “ন তদ্‌ভাসয়তে সুর্য্যো” [গী|১৫|৬] শ্লোক কঠ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ হইতে অল্প শব্দভেদে গৃহীত হইয়াছে । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের অনেক কল্পনা ও শ্লোক ও গীতায় আছে । নবম প্রকরণে আমি দেখাইয়াছি যে, মায়া শব্দ প্ৰথম প্ৰথম শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে প্ৰদত্ত হয় এবং তাহা হইতেই গীতা ও মহাভারতে উহা গৃহীত হইয়া থাকিবে । শব্দসাদৃশ্য হইতে ইহাও প্ৰকাশ পায় যে, গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে “শুচৌ দেশে প্ৰতিষ্ঠাপ্য” [গী|৬|১১] এইরূপ যে যোগাভ্যাসের যোগ্য স্থান বর্ণিত হইয়াছে তাহা “সমে শুচৌ” ইত্যাদি [শ্বে|২|১০] মন্ত্র হইতে এবং “সমং কায়শিরোগ্রীবং” [গী|৬|১৩] এই শব্দ “ত্রিরুন্নতং স্থাপ্য সমং শরীরং” [শ্বে|২|৮] এই মন্ত্র হইতে গৃহীত হইয়াছে । সেইরূপ আবার, “সর্বতঃ পাণিপাদং” শ্লোক এবং তাহার পরবর্তী শ্লোকার্ধও, গীতায় [১৩|১৩] ও শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে শব্দশঃ পাওয়া যায় [শ্বে|৩|১৬] এবং “অণোরণীয়াংসং” এবং “আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরন্তাৎ” পদও গীতায় [৮|৯] ও শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে একই আছে [শ্বে|৩|৯|২০] । ইহা ব্যতীত গীতার ও উপনিষদের শব্দসাদৃশ্য দেখিতে গেলে, “সর্বভুতস্থমাত্মানং” [গী|৬|২৯] এবং “দেবৈশ্চ সব্বৈরহমেব্বেদ্যো” [গী|১৫|১৫] এই দুই শ্লোকার্ধ কৈবল্যোপনিষদে [কৈ|১|১০; ২|৩] যেমনটি-তেমনটি পাওয়া যায় । কিন্তু এই শব্দসাদৃশ্য সম্বন্ধে বেশী বিচার করিবার প্রয়োজন নাই; কারণ, গীতার বেদান্ত, উপনিষৎ অবলম্বনে প্রতিপাদিত হইয়াছে এ সম্বন্ধে কিছুমাত্ৰ সন্দেহ নাই । উপনিষদের আলোচনা এবং গীতার আলোচনার মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি না, এবং থাকিলে কোন্‌ বিষয়ে আছে ইহাই মুখ্যরূপে দেখিতে হইবে । তাই, এখন সেই বিষয়েরই অভিমুখে যাওয়া যাক ।


3) বিষয়সাদৃশ্য – প্রামাণ্য উপনিষদ নির্বাচন


উপনিষদ অনেক । তন্মধ্যে কোন কোনটির ভাষা এতটা অর্বাচীন যে, সেই উপনিষৎগুলি ও পুরাতন উপনিষৎ যে সমকালীন নহে তাহ সহজেই দেখা যায় । তাই গীতা ও উপনিষদের প্রতিপাদ্য বিষয়ের সাদৃশ্য দেখিবার সময়, ব্ৰহ্মসুত্রে যে সকল উপনিষদের উল্লেখ আছে সেই উপনিষৎগুলিকেই মুখ্যরূপে আমি এই প্ৰকরণে তুলনার জন্য গ্ৰহণ করিয়াছি । এই উপনিষদসমূহের অর্থ এবং গীতার অধ্যাত্ম যখন মিলাইয়া দেখি, তখন প্রথম ইহাই মনে হয় যে, নির্গুণ পরব্রহ্মের স্বরূপ উভয়ের মধ্যে একই হইলেও, নির্গুণ হইতে সগুণের উৎপত্তি বৰ্ণনা করিবার সময়, ‘অবিদ্যা’ শব্দের বদলে ‘মায়া’ বা ‘অজ্ঞান’ শব্দই গীতায় প্রযুক্ত হইয়াছে । নবম প্ৰকরণে স্পষ্ট করিয়া দিয়াছি যে, ‘মায়া’ শব্দ শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে আসিয়াছে; এবং নাম রূপাত্মক অবিদ্যারই ইহা অন্য পর্যায়শব্দ; এবং ইহাও পুর্বে বলিয়া আসিয়াছি যে, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের কোন কোন শ্লোক গীতায় অক্ষরশঃ সন্নিবেশিত হইয়াছে । ইহা হইতে প্ৰথম অনুমান এই হয় যে, ‘সর্বং খল্বিদং ব্ৰহ্ম’ [ছাং|৩|১৪|১] বা “সর্বমাত্মানং পশ্যতি” [বৃ|৪|৪|২৩] অথবা “সর্বভুতেষু চাত্মানং” [ঈশ|৬] - এই সিদ্ধান্তের কিংবা উপনিষদের সমস্ত অধ্যাত্মজ্ঞান গীতায় সংগৃহীত হইলেও নামরূপাত্মক অবিদ্যার উপনিষদেই ‘মায়া’ নাম প্রচলিত হইবার পর গীতাগ্রন্থ রচিত হইয়াছে ।


4) বৈসাদৃশ্য



4.1) কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রর প্রাধান্য


এক্ষণে উপনিষদের ও গীতার উপদেশের মধ্যে ভেদ কি, তাহার বিচার করিলে দেখা যাইবে যে, গীতায় কাপিল সাংখ্যশাস্ত্রকে বিশেষ প্ৰাধান্য দেওয়া হইয়াছে । বৃহদারণ্যক এবং ছান্দোগ্য এই দুই উপনিষদ জ্ঞানপ্ৰধান, কিন্তু উহাদের মধ্যে তো সাংখ্যপ্রক্রিয়ার নামও পাওয়া যায় না; এবং কঠাদি উপনিষদে অব্যক্ত, মহান ইত্যাদি সাংখ্যাদিগের শব্দ সন্নিবেশিত হইলেও ইহা সুস্পষ্ট যে, তাহাদিগের অর্থ সাংখ্যপ্রক্রিয়া অনুসারে না করিয়া বেদান্তের পদ্ধতিতেই করিতে হইবে । মৈত্র্যুপনিষদের উপপাদনেও ঐ কথাই খাটে । এইরূপ সাংখ্যপ্রক্রিয়ার বহিষ্করণ এতদূৱ পৰ্যন্ত আসিয়া পৌঁছিয়াছে যে, বেদান্তসুত্রে পঞ্চীকরণের বদলে ছান্দোগ্যোপনিষদের মতানুযায়ী ত্ৰিবিৎ-করণ তত্ত্বানুসারেই জগতের নামরূপাত্মক বৈচিত্রের উপপত্তি বিবৃত হইয়াছে [বেসূ|২|৪|২০] । সাংখ্যকে একেবারে পৃথক করিয়া অধ্যাত্মের অন্তর্ভূত ক্ষরাক্ষর-বিচার করিবার এই পদ্ধতি গীতায় স্বীকৃত হয় নাই । তথাপি সাংখ্যাদিগের সিদ্ধান্ত যেমনটি - তেমনি গীতায় গৃহীত হয় নাই, ইহা মনে রাখিতে হইবে । ত্ৰিগুণাত্মক অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে, গুণোৎকর্ষের তত্ত্ব অনুসারে, সমস্ত ব্যক্তি জগৎ কিরূপে উৎপন্ন হইল সেই সম্বন্ধে সাংখ্যাদিগের সিদ্ধান্ত, এবং পুরুষ নির্গুণ হইয়া দ্রষ্টা, এই মতও গীতার গ্রাহ্য হইয়াছে । কিন্তু দ্বৈত-সাংখ্যজ্ঞানের উপর অদ্বৈতবেদান্তের প্রথমে এই প্ৰকার প্রাবল্য স্থাপিত করা হইয়াছে যে, প্ৰকৃতি ও পুরুষ স্বতন্ত্র নহে - ঐ উভয়ই উপনিষদের আত্মরূপ একই পরব্রহ্মের রূপ অর্থাৎ বিভূতি; এবং পুনরায় সাংখ্যদিগেরই ক্ষরাক্ষরবিচার গীতায় বিবৃত হইয়াছে । উপনিষদের ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ অদ্বৈত মতের সহিত স্থাপিত দ্বৈতী সাংখ্যাদিগের সৃষ্টি-উৎপত্তি ক্রমের এই সন্মিলন, গীতার ন্যায় মহাভারতের অন্যান্য স্থানের অধ্যাত্মবিচারেও পাওয়া যায় । এবং এই সম্মিলন হইতে, গীতা ও মহাভারত এই দুই গ্ৰন্থ যে একই হাতের রচিত, উপরে এই যে অনুমান করা হইয়াছে, তাহা আরও দৃঢ় হয় ।


4.2) ভক্তিমাৰ্গ


উপনিষৎ অপেক্ষা গীতার উপপাদনে আর এক বড় রকমের ষে বিশিষ্টতা আছে তাহা ব্যক্তোপাসনা কিংবা ভক্তিমাৰ্গ । ভগবদ্গীতার ন্যায় উপনিষদেও কেবল যাগযজ্ঞাদি কর্ম জ্ঞানদৃষ্টিতে গৌণ বলিয়াই স্বীকৃত হইয়াছে; কিন্তু ব্যক্ত মানবদেহধারী ঈশ্বরের উপাসনা প্ৰাচীন উপনিষদে দেখিতে পাওয়া যায় না । অব্যক্ত ও নির্গুণ পরব্রহ্মের ধারণা করা কঠিন হওয়ায়, মন, আকাশ, সূৰ্য, অগ্নি, যজ্ঞ ইত্যাদি সগুণ প্রতীকের উপাসনা করা অবশ্যক, এই তত্ত্ব উপনিষৎকারদিগের মান্য । কিন্তু উপাসনার জন্য প্রাচীন উপনিষদে যে সকল প্রতীকের কথা বলা হইয়াছে, তন্মধ্যে মনুষ্যদেহধারী পরমেশ্বরস্বরূপের প্রতীক ধরা হয় নাই । রুদ্র, শিব, বিষ্ণু, অচ্যুত, নারায়ণ এই সমস্ত পরমাত্মারই রূপ ইহা মৈত্রুপনিষদে [মৈ|৭|৭] উক্ত হইয়াছে; শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে ‘মহেশ্বর’ প্রভৃতি শব্দ প্রযুক্ত হইয়াছে; এবং “জ্ঞাতা দেবং মুচ্যতে সর্বপাশৈঃ” [শ্বে|৫|১৩] এবং “যস্য দেবে পরা ভক্তিঃ” [শ্বে|৬|২৩] প্রভৃতি বচনও শ্বেতাশ্বতরে পাওয়া যায় । কিন্তু এই সকল বচনে নারায়ণ, বিষ্ণু ইত্যাদি শব্দে বিষ্ণুর মানবদেহধারী অবতারই যে বিবক্ষিত তাহা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না । কারণ, রুদ্র ও বিষ্ণু এই দুই দেবতা বৈদিক অর্থাৎ প্রাচীন; তখন ইহা কিরূপে স্বীকার করা যায় যে, “যজ্ঞো বৈ বিষ্ণুঃ” [তৈ|সং|১|৭|৪] ইত্যাদি প্রকারে যাগযজ্ঞকেই বিষ্ণু-উপাসনার বে স্বরূপ পরে দেওয়া হইয়াছে, তাহাই উপর্যুক্ত উপনিষদের অভিপ্রেত নহে ? ভাল, যদি কেহ বলেন যে, মানব-দেহধারী অবতারের কল্পনা সেই সময়েও ছিল, তাহাও একেবারে অসম্ভব নহে । কারণ, শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে যে ‘ভক্তি’ শব্দ আছে তাহা যজ্ঞরূপ উপাসনা সম্বন্ধে প্রয়োগ করা সঙ্গত মনে হয় না । ইহা সত্য যে, মহানারায়ণ, নৃসিংহতাপনী, রামতাপনী এবং গোপালতাপনী প্রভৃতি উপনিষদের বচন শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের বচন অপেক্ষাও কোথাও অধিক স্পষ্ট, তাই উহাদের সম্বন্ধে এইরূপ সন্দেহ করিবার কোন অবসরই থাকে না । কিন্তু এই উপনিষদের কাল নিশ্চিতরূপে স্থির করিবার কোন উপায় না থাকায়, বৈদিক ধর্মে মানবরূপধারী বিষ্ণুর উপাসনার কখন আবির্ভাব হইল এই প্রশ্নের মীমাংসা এই উপনিষদসমূহের ভিত্তিতে ঠিক করিয়া করা যাইতে পারে না । তথাপি বৈদিক ভক্তিমার্গের প্রাচীনতা অন্য প্রকারে বেশ সিদ্ধ হয় । পাণিনির এক সুত্ৰ আছে “ভক্তিঃ” - অৰ্থাৎ যাহাতে ভক্তি হয় [পা|৪|৩|৯৫]; ইহার পরে “বাসুদেবার্জুনাভ্যাং বুন্‌” আছে [পা|৪|৩|৯৮] এই সূত্রে উক্ত হইয়াছে যে, বাসুদেবের প্রতি যাহার ভক্তি আছে তাহাকে ‘বাসুদেবক’ এবং অর্জুনের প্রতি যাহার ভক্তি আছে তাহাকে ‘অর্জুনক’ বলিবে; এবং পতঞ্জলির মহাভাষ্যে ইহার উপর টীকা করিবার সময় উক্ত হইয়াছে যে, এই সূত্রে ‘বাসুদেব’ ক্ষত্রিয়ের বা ভগবানের নাম । এই সকল গ্ৰন্থ হইতে পাতঞ্জলি ভাষ্য খৃষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০ বৎসর পূর্বে রচিত হইয়াছে, এইরূপ ডাঃ ভাণ্ডারকর সিদ্ধ করিয়াছেন; এবং পাণিনির কাল ইহা অপেক্ষাও যে অধিক প্রাচীন, এই সম্বন্ধে কোনই সন্দেহ নাই । তাছাড়া, বৌদ্ধধর্মের গ্রন্থেও ভক্তির উল্লেখ আছে; এবং শ্ৰীকৃষ্ণের ভাগবত ধর্মই বৌদ্ধধর্মের মহাযানপন্থায় ভক্তিতত্ত্ব প্রবেশের কারণ হওয়া সম্ভব ইহা আমি পরে সবিস্তার দেখাইয়াছি । তাই ইহা নির্বিবাদে সিদ্ধ হয় যে, নিদানপক্ষে বুদ্ধের পূর্বে, অর্থাৎ খৃষ্টাব্দের প্ৰায় ছয় শতাব্দীরও অধিক পূর্বে, আমাদের এখানে ভক্তিমাৰ্গ পুরামাত্রায় স্থাপিত হইয়াছিল । নারদপঞ্চরাত্র বা শাণ্ডিল্য অথবা নারদের ভক্তিসূত্র তদুত্তরকালীন । কিন্তু ইহা হইতে ভক্তিমার্গের কিংবা ভাগবতধর্মের প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে কোনও বাধা হইতে পারে না । গীতারহস্যের বিচার আলোচনা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে যে, প্ৰাচীন উপনিষদসমূহে যে সগুণোপাসনার বর্ণনা আছে তাহা হইতেই ক্ৰমে ক্ৰমে আমাদের ভক্তিমাৰ্গ নিঃসৃত হইয়াছে; পাতঞ্জলযোগে চিত্ত স্থির করিবার জন্য কোন-না-কোন ব্যক্ত ও প্রত্যক্ষ বস্তুকে চক্ষের সম্মুখে রাখা আবশ্যক হয় বলিয়া উহা হইতে ভক্তিমার্গের আরও পুষ্টিসাধন হইয়াছে; ভক্তিমার্গ অন্য কোন স্থান হইতে ভারতবর্ষে আনা হয় নাই – এবং আনিবার কোন প্রয়োজনই ছিল না । নিজ ভারতবর্ষে এই প্রকারে প্রাদুর্ভূত ভক্তিমার্গের ও বিশেষতঃ বাসুদেবভক্তির উপনিষদে বৰ্ণিত বেদান্তের দৃষ্টিতে সমর্থন করাই গীতার প্রতিপাদনের একটি বিশেষ অংশ ।


4.3) কর্মযোগের সহিত, ভক্তি ও ব্ৰহ্মজ্ঞানের মিলন


কিন্তু ইহা অপেক্ষাও গীতার অধিক মহত্বপূর্ণ অংশ হইতেছে কর্মযোগের সহিত, ভক্তি ও ব্ৰহ্মজ্ঞানের মিলন ঘটাইয়া দেওয়াই । চাতুৰ্বৰ্ণেয় কর্ম কিংবা শ্ৰৌত যাগযজ্ঞাদি কর্ম উপনিষদে গৌণ বলিয়া স্বীকৃত হইলেও, কোন কোন উপনিষৎকার বলেন যে, চিত্তশুদ্ধির জন্য তাহা করিতেই হইবে এবং চিত্তশুদ্ধি হইবার পরেও তাহা ত্যাগ করা উচিত নহে । তথাপি অনেক উপনিষদেরই প্রবণতা সাধারণতঃ কর্মসন্ন্যাসেরই দিকে, ইহা বলিতে পারা যায় । ঈশাবাস্যোপনিষদের ন্যায় অপর কোন কোন উপনিষদেও আমরণান্ত কর্ম করা সম্বন্ধে “কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি” এইরূপ বচন পাওয়া যায়; কিন্তু অধ্যাত্মজ্ঞান ও সাংসারিক কর্মের বিবাদ দূর করিয়া দিয়া প্ৰাচীনকাল হইতে প্ৰচলিত এই কর্মযোগের সমৰ্থন গীতায় যেমন করা হইয়াছে তেমন আমার কোন উপনিষদে পাওয়া যায় না । অথবা ইহাও বলা যাইতে পারে যে, এই বিষয়ে গীতার সিদ্ধান্ত অধিকাংশ উপনিষৎকারের সিদ্ধান্ত হইতে ভিন্ন । গীতারহস্যের একাদশ প্ৰকরণে এই বিষয়ের সবিস্তার বিচার করায় এখানে সেই সম্বন্ধে অধিক লিখিয়া জায়গা নষ্ট করি নাই ।


5) আপাত সাদৃশ্য : চিত্তনিরোধরূপ পাতঞ্জলযোগ


গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে যে যোগসাধনের নির্দেশ কয়া হইয়াছে পাতঞ্জলসূত্রে তাহার সবিস্তার ও পদ্ধতিযুক্ত আলোচনা পাওয়া যায়; এবং এক্ষণে পাতঞ্জলসূত্রই এই বিষয়ের প্রমাণগ্রন্থ বলিয়া বিবেচিত হইয়া থাকে । এই সূত্রের চারি অধ্যায় । প্ৰথম অধ্যায়ের আরম্ভে “যোগশ্চিত্তবৃত্তিনিরোধঃ” এইরূপ যোগের ব্যাখ্যা করিয়া “অভ্যাসবৈরাগ্যাভ্যাং তন্নিরোধঃ” - অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা এই নিরোধ সাধিত হয় - এইরূপ বলা হইয়াছে । তাহার পর, যমনিয়মাসন-প্ৰাণায়ামাদি যোগসাধনের বর্ণনা করিয়া, তৃতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ে ‘অসংপ্রজ্ঞাত’ অর্থাৎ নিৰ্বিকল্প সমাধির দ্বারা অণিমা লঘিমাদি অলৌকিক সিদ্ধি ও শক্তি কিরূপে প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং এই সমাধির দ্বারা শেষে কিরূপে ব্রহ্মনির্বাণরূপ মোক্ষ-লাভ হয় তাহার নিরূপণ করা হইয়াছে । ভগবদ্গীতাতেও প্রথমে চিত্ত-নিরোধ করিবার আবশ্যকতা [গী|৬|২৫] বলিয়া পরে অভ্যাস ও বৈরাগ্য এই দুই সাধনের দ্বারা চিত্তকে নিরোধ করিবে [গী|৬|৩৫] বলা হইয়াছে, এবং শেষে নির্বিকল্প সমাধি কিরূপে করিতে হইবে তাহা বলিয়া তাহাতে কি সুখ তাহা দেখানো হইয়াছে । কিন্তু কেবল ইহা হইতেই বলিতে পারা যায় না যে, পাতঞ্জল যোগমার্গ ভগবদ্গীতার অভিমত কিংবা পাতঞ্জলসূত্র ভগবদ্গীতা অপেক্ষা প্ৰাচীন । পাতঞ্জলসূত্রের ন্যায় ভগবান্‌ কোথাও বলেন নাই যে, সমাধিসিদ্ধ হইবার জন্য নাক ধরিয়া সমস্ত জীবন কাটাইতে হইবে । কর্মযোগে সিদ্ধির জন্য বুদ্ধির সমতা হওয়া চাই এবং এই সমতা প্ৰাপ্ত হইবার জন্য চিত্তনিরোধ ও সমাধি উভয়ই আবশ্যক, অতএব কেবল সাধন বলিয়া গীতায় চিত্তনিরোধ ও সমাধির বর্ণনা করা হইয়াছে । তাই বলিতে হয় যে, এই বিষয়ে পাতঞ্জলসূত্র অপেক্ষা শ্বেতাশ্বতর কিংবা কঠোপনিষদের সহিত গীতার অধিক সাম্য আছে । ধ্যানবিন্দু, ছুরিকা, এবং যোগতত্ত্ব এই উপনিষৎগুলিও যোগসংক্রান্তই বটে; কিন্তু উহাদের যোগই মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয়, এবং ঐগুলিতে কেবল যোগেরই মাহাত্ম্য কীর্তিত হওয়ায়, যে গীতা কর্মযোগকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে, সেই গীতার সহিত এই একপক্ষীয় উপনিষদ্‌গুলির সর্বাংশে মিল স্থাপন করা যুক্তিসিদ্ধ নহে এবং সেরূপ মিল হইতেই পারে না । টমসন্‌ সাহেব ইংরাজীতে গীতার যে ভাষান্তর করিয়াছেন তাহার উপোদ্‌ঘাতে তিনি বলিয়াছেন যে, গীতার কর্মযোগ পাতঞ্জলযোগেরই এক রূপান্ত,; কিন্তু ইহা অসম্ভব । এই বিষয়ে আমার মত এই যে, গীতার ‘যোগ’ শব্দের প্রকৃত অর্থের প্রতি লক্ষ্য না করায় এই ভ্ৰম উৎপন্ন হইয়াছে; কারণ এদিকে গীতার কর্মযোগ প্ৰবৃত্তিমূলক এবং ওদিকে পাতঞ্জলযোগ তাহার সম্পূর্ণ বিপরীত, অর্থাৎ নিবৃত্তিমূলক । তাই এই দুই গ্রন্থের একটীর অপর হইতে উদ্ভূত হওয়া কখনও সম্ভব নহে; এবং গীতাতেও সে কথা কোন স্থানে বলা হয় নাই । অধিক কি, ইহাও বলা যাইতে পারে যে, যোগ শব্দের পুরাতন অর্থ ‘কর্মযোগ’ই ছিল এবং সম্ভবত পাতঞ্জলসূত্রের পর ঐ শব্দই ‘চিত্তনিরোধরূপ যোগ’ অর্থে প্ৰচলিত হইয়া গিয়াছে । সে যাহাই হউক, ইহা নির্বিবাদ যে, প্ৰাচীনকালে জনকাদির আচরিত নিষ্কাম কর্মমার্গেরই সদৃশ গীতার যোগ অর্থাৎ কর্মযোগমাৰ্গও; এবং মনু ইক্ষ্বাকু প্ৰভৃতি মহাপুরুষদিগের পরম্পরাক্রমে প্রচলিত ভাগবত ধর্ম হইতে উহা গৃহীত হইয়াছে - পাতঞ্জলযোগ হইতে উহা উৎপন্ন হয় নাই ।


6) সিদ্ধান্ত


এ পৰ্যন্ত যে আলোচনা করা হইয়াছে তাহা হইতে উপলব্ধি হইবে যে, গীতাধর্ম ও উপনিষদ এই দুয়ের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য কোন কোন বিষয়ে আছে । তন্মধ্যে অধিকাংশ বিষয়ের বিচার গীতারহস্যের স্থানে স্থানে করা হইয়াছে । তাই এখানে সংক্ষেপে এইটুকু বলিতেছি যে, গীতার ব্ৰহ্মজ্ঞান উপনিষৎ অবলম্বনে বিবৃত হইলেও উপনিষদের অধ্যাত্মজ্ঞানেরই কেবল অনুবাদ না করিয়া, তাহার ভিতর বাসুদেবভক্তি এবং সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত জগদ্যুৎপত্তিক্রম অর্থাৎ ক্ষরাক্ষরজ্ঞানের কথাও সন্নিবেশিত করা হইয়াছে; এবং সাধারণ লোকের সহজসাধ্য এবং উভয় লোকের যাহা শ্রেয়স্কর সেই বৈদিক কর্মযোগধর্মই গীতায় মুখ্যরূপে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । উপনিষৎ হইতে গীতায় যে কিছু বিশেষত্ব আছে তাহা ইহাই । তাই ব্ৰহ্মজ্ঞানের অতিরিক্ত অন্য বিষয়েও সন্ন্যাসমূলক উপনিষদের সহিত গীতার মিল স্থাপন করিবার জন্য সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে টানাবোনা করিয়া গীতার অর্থ করা উচিত নহে । উভয়েতেই অধ্যাত্মজ্ঞান একই প্রকার সত্য; কিন্তু অধ্যাত্মরূপ মস্তক এক হইলেও সাংখ্য ও কর্মযোগ বৈদিকধর্মপুরুষের দুই তুল্যবল হস্ত আছে; এবং তন্মধ্যে ঈশাবাস্যোপনিষদের ন্যায় গীতায় জ্ঞানযুক্ত কর্মই মুক্ত কণ্ঠে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে; ইহা আমি গীতারহস্যের একাদশ প্রকরণে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছি ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment