Sunday, June 4, 2017

বর্তমান গীতার কাল (Current age of Gita)

বর্তমান গীতার কাল


সূচি


1) ভূমিকা
2) মহাভারত-কাল নিৰ্ণয়
3) গীতার কাল নিৰ্ণয়
4) সিদ্ধান্ত


1) ভূমিকা


ইহা আলোচিত হইয়াছে যে, ভগবদ্গীতা ভাগবতধর্মের প্রধান গ্ৰন্থ, এবং এই ভাগবতধর্ম খৃষ্টের প্রায় ১৪০০ বৎসর পূর্বে প্ৰাদুর্ভূত হয়; এবং ইহাও মোটামুটিভাবে নির্ধারিত হইয়াছে যে, কয়েক শতাব্দী পরে মূল গীতা বাহির হইয়া থাকিবে । উহার এবং ইহাও বলিয়াছি যে, মূল ভাগবতধর্ম নিষ্কামপ্ৰধান হইলেও পরে ভক্তি প্ৰধান-স্বরূপ হইয়া শেষে উহাতে বিশিষ্টাদ্বৈতেরও সমাবেশ হইয়াছে । মূল গীতা এবং মূল ভাগবতধর্ম সম্বন্ধে ইহা অপেক্ষা বেশী জ্ঞাতব্য বিবরণ অন্ততঃ বর্তমান কালে তো পাওয়া যায় না; এবং এই দশাই পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে বর্তমান মহাভারত ও বর্তমান গীতারও ছিল । কিন্তু ডাঃ ভাণ্ডারকর, ৺কাশীনাথপন্ত তৈলং, ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত এবং রাওবাহাদুর চিন্তামণি রাও বৈদ্য প্রভৃতি বিদ্বান ব্যক্তিগণের উদ্যোগে বর্তমান মহাভারতের এবং বর্তমান গীতার কালনিৰ্ণয় সম্বন্ধে অনেক উপকরণ পাওয়া গিয়াছে; এবং সম্প্রতি, ‘আরও দুই একটা প্রমাণ ৺ত্র্যম্বক গুরুনাথ কালে প্ৰদৰ্শন করিয়াছেন । এই সমস্ত একত্র করিয়া, এবং আমার ধারণা অনুসারে তাহার মধ্যে আরও যাহা কিছু দিবার আছে তাহাও সন্নিবিষ্ট করিয়া পরিশিষ্টের এই ভাগ সংক্ষেপে লিখিয়াছি । এই পরিশিষ্ট প্রকরণের আরম্ভেই ইহা আমি প্রমাণসহ দেখাইয়াছি যে, বর্তমান মহাভারত ও বর্তমান গীতা, এই দুই গ্ৰন্থ এক হাতেরই রচনা । এই দুই গ্ৰন্থ একই হাতের সুতরাং একই কালের বলিয়া স্বীকার করিলে, মহাভারতের কাল হইতে গীতার কালও সহজেই নির্ণয় হয় । তাই, এই ভাগে প্রথমে বর্তমান, মহাভারতের কাল স্থির করিবার জন্য যে প্রমাণ অত্যন্ত প্ৰধান বলিয়া স্বীকৃত হয়, তাহাই দেওয়া হইয়াছে, এবং তাহার পর স্বতন্ত্ররূপে বর্তমান গীতার কাল স্থির করিবার উপযোগী প্ৰমাণ দেওয়া হইয়াছে । উদ্দেশ্য এই যে, মহাভারতের কালনির্ণয় করিবার প্রমাণগুলি কেহ সন্দেহমূলক মনে করিলেও তজ্জন্য গীতার কালনির্ণয়ে বাধা কোন হইবে না ।


2) মহাভারত-কাল নিৰ্ণয়


মহাভারত-গ্ৰন্থ অতি বিস্তীর্ণ এবং মহাভারতেই লিখিত হইয়াছে যে, উহা লক্ষ শ্লোকাত্মক । কিন্তু রাওবাহাদুর বৈদ্য মহাভারতের স্বকীয় টীকাত্মক ইংরাজী গ্রন্থের প্রথম পরিশিষ্টে দেখাইয়াছেন যে, এক্ষণে মহাভারতের যে গ্ৰন্থ পাওয়া যায় তাহাতে এই লক্ষ শ্লোক অপেক্ষা কিছু কমিবেশী হইয়া পড়িয়ছে, এবং উহার মধ্যে হরিবংশের শ্লোক সমাবেশ করিলেও লক্ষ অঙ্ক সম্পূর্ণ হয় না । (The Mahabharat : a criticism p. 185. রাওবাহাদুর বৈদ্যের মহাভারতসম্বন্ধীয় যে টীকাত্মক পুস্তকের আমি কোন কোন স্থলে উল্লেখ করিয়াছি, তাহা এই পুস্তক ।) তথাপি ভারত মহাভারতে পরিণত হইবার পর যে বৃহৎ গ্রন্থ রচিত হয়, তাহা অনেকটা বর্তমান মহাভারতেরই সদৃশ হইবে এরূপ মনে করিতে কোন বাধা নাই । এই মহাভারতে যাস্কের নিরুক্ত ও মনুসংহিতার উল্লেখ এবং ভগবদ্গীতাতে আবার ব্রহ্মসূত্রেরও উল্লেখ আছে, ইহা উপরে বলিয়াছি । এক্ষণে ইহা ব্যতীত মহাভারতের কালনিৰ্ণয়াৰ্থ যে প্রমাণ পাওয়া যায় তাহা এইরূপ -

(১) আঠারো পর্বের এই গ্রন্থ এবং হরিবংশ, এই দুই সম্বৎ ৫৩৫ ও ৬৩৫ অব্দের ভিতর জাবা ও বালীদ্বীপে ছিল, এবং তত্ৰত্য প্ৰাচীন ‘কবি’ নামক ভাষায় তাহার ভাষান্তর হইয়াছিল; এই ভাষান্তরের আদি, বিরাট, উদ্যোগ, ভীষ্ম, আশ্রমবাসী, মুষল, প্ৰস্থানিক ও স্বৰ্গারোহণ এই আট পর্ব বালীদ্বীপে এক্ষণে পাওয়া গিয়াছে এবং তন্মধ্যে কোন কোনটা ছাপাও হইয়াছে । কিন্তু ভাষান্তর ‘কবি’-ভাষাতে হইলেও উহাতে স্থানে স্থানে মহাভারতের মূল সংস্কৃত শ্লোকই রক্ষিত হইয়াছে । তন্মধ্যে উদ্যোগপর্বের শ্লোক আমি মিলাইয়া দেখিয়াছি । ওই সমস্ত শ্লোক বর্তমান মহাভারতের কলিকাতা-সংস্করণের উদ্যোগ পর্বের অধ্যায়ে - মধ্যে মধ্যে ক্রমশঃ - পাওয়া যায় । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, লক্ষ শ্লোকাত্মক মহাভারত ৪৩৫ সম্বতের পূর্বে প্ৰায় দুই শত বৎসর পৰ্যন্ত ভারতবর্ষে প্রমাণভূত মানা যাইত । কারণ তাহা না হইলে উহা জাবা ও বালীদ্বীপে লইয়া যাইবার কোন কারণ ছিল না । তিব্বতীয় ভাষাতেও মহাভারতের এক ভাষান্তর হইয়াছে, কিন্তু ইহা উহার পরবর্তী । (জাবাদ্বীপের মহাভারতসম্বন্ধীয় বৃত্তান্ত “The Modern Review”, July 1914 pp. 32-38-র মধ্যে প্রদত্ত হইয়াছে তাহা দেখ; এবং তিব্বতী ভাষায় মহাভারত সম্বন্ধীয় উল্লেখ Rockhill’s “Life of the Budha”, p. 228 note-এ আছে ।)

(২) চেদি-সম্বৎ ১৯৭ অর্থাৎ বিক্ৰমী ৫০২ সম্বতে লিখিত গুপ্ত-রাজাদিগের সময়ের এক শিলালিপি সম্প্রতি পাওয়া গিয়াছে । তাহাতে স্পষ্ট নির্দেশ আছে যে, মহাভারত গ্রন্থে তৎকালে এক লক্ষ শ্লোক ছিল; এবং ইহা হইতে দেখা যায় যে, বিক্রমী ৫০২ সম্বতের প্রায় দুই শত বৎসর পূর্বে উহার অস্তিত্ব নিশ্চয়ই ছিল । (এই শিলালিপি Inscriptionum Indicarum নামক পুস্তকের তৃতীয় খণ্ডে পৃ. ১০৪-তে সমগ্র প্রদত্ত হইয়াছে এবং ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বকীয় ভারতীয় জ্যোতিঃষশাস্ত্রে (পৃ.১০৮) তাহার উল্লেখ করিয়াছেন ।)

(৩) বৰ্তমানে ভাস কবির যে নাটক প্ৰকাশিত হইয়াছে তন্মধ্যে অধিকাংশ মহাভারতের আখ্যান অবলম্বনে রচিত । সুতরাং সেই সময়ে মহাভারত পাওয়া যাইত এবং লোকেরাও উহাকে প্ৰমাণ বলিয়া মনে করিত, ইহা সুস্পষ্ট । ভাস কবির বালচরিত নাটকে শ্ৰীকৃষ্ণের বাল্যকথা ও গোপীদিগের উল্লেখ আছে । তাই, বলিতে হয় যে, হরিবংশও তখন পাওয়া যাইত । ভাস কবি যে কালিদাসের পূর্ববর্তী তাহা নির্বিবাদ । ভাস কবির নাটকসমূহের সম্পাদক পণ্ডিত গণপতিশাস্ত্রী স্বপ্নবাসবদত্তা নামক নাটকের প্রস্তাবনায় লিখিয়াছেন যে, ভাস চাণক্যেরও পূর্বে আবিভূর্ত হইয়াছিলেন; কারণ, ভাস কবির নাটকের এক শ্লোক চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায়, এবং উহাতে বলা হইয়াছে যে, তাহা অন্য কাহারও । কিন্তু এই কাল সন্দিগ্ধ মনে করিলেও ভাস কবিকে যে খৃষ্টাব্দের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শতাব্দীর অধিক আধুনিক বলিয়া মানা যাইতে পারে না, তাহা আমার মতে নির্বিবাদ ।

(৪) অশ্বঘোষ নামে এক বৌদ্ধ কবি শালিবাহন শকের আরম্ভে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, ইহা বৌদ্ধ গ্রন্থের সাহায্যে স্থির হইয়াছে । এই অশ্বঘোষের বুদ্ধচরিত ও সৌন্দরানন্দ নামক দুই বৌদ্ধধর্মীয় সংস্কৃত মহাকাব্য ছিল । এই গ্ৰন্থ এক্ষণে মুদ্রিত হইয়া প্ৰকাশিত হইয়াছে । এই দুয়েতেও ভারতীয় কথার উল্লেখ আছে । তাছাড়া বজ্ৰসূচিকোপনিষদের উপর ব্যাখ্যানরূপ অশ্বঘোষের আর এক গ্ৰন্থ আছে; কিংবা বলিতে হয় যে, এই বজ্ৰসূচি উপনিষৎ তাঁহারই রচিত । প্রোঃ বেবর এই গ্ৰন্থ ১৮৬০ খৃষ্টাব্দে জর্মণীতে প্ৰকাশিত করিয়াছিলেন । তাহাতে হরিবংশের অন্তর্গত শ্ৰাদ্ধামাহাত্ম্যের মধ্যে “সপ্তব্যাধা দশার্ণেষু” [হরি|২৪|২০ ও ২১] ইত্যাদি শ্লোক এবং স্বয়ং  মহাভারতেরও অন্য কতকগুলি শ্লোক [যথা - মভা|শা|২৬১|১৭] সন্নিবিষ্ট হইয়াছে । ইহা হইতে দেখা যায় যে, শকারম্ভের পূর্বে হরিবংশসমেত বর্তমান লক্ষশ্লোকাত্মক মহাভারত প্ৰচলিত ছিল ।

(৫) আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রে [৩|৪|৪] ভারত এবং মহাভারতের পৃথক পৃথক উল্লেখ আছে; এবং বৌধায়ন ধর্মসূত্রের এক স্থানে [২|২|২৬] মহাভারতের অন্তর্গত যযাতি উপাখ্যানের এক শ্লোক পাওয়া যায় [মভা|আ|৭৮|১০] । কিন্তু কেবল এই একটী শ্লোকের ভিত্তিতে বৌধায়নের পূর্বে মহাভারত ছিল এই অনুমান দৃঢ় হয় না, এই কথা বুহ্লর সাহেব বলেন (See Sacred Books of the East Series, Vol. XIV. Intro. P. Xli.) । কিন্তু এই সন্দেহ ঠিক নহে; কারণ, বৌধায়নের গৃহ্যসূত্রে বিষ্ণুসহস্ৰনামের স্পষ্ট উল্লেখ আছে [বৌ|গৃ|শে|১|২২|৮], এবং পরে এই সূত্ৰেই [২|২২|৯] গীতার “পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং” শ্লোকও [গী|৯|২৬] পাওয়া যায় । বৌধায়নসূত্রের এই উল্লেখ সর্বপ্রথম ৺ত্র্যম্বক গুরুনাথ কালে প্ৰকাশ করেন । এই সকল উল্লেখ হইতে বলিতে হয় যে, বুহ্লের সাহেবের সন্দেহটা নির্মূল, এবং আশ্বলায়ন ও বৌধায়ন উভয়েই মহাভারতের সহিত পরিচিত ছিলেন । বৌধায়ন খৃষ্টের প্রায় ৪০০ বৎসর পূর্বে আবির্ভূত হইয়া থাকিবেন, বুহ্লরই তাহা অন্য প্রমাণাদি হইতে নির্ধারিত করিয়াছেন ।
(৺ত্র্যম্বক গুরুনাথকালের সম্পূর্ণ প্রবন্ধ “The Vedic Magazine and Gurukula Samnachar”, Vol. VII Nos 6, 7. pp. 528-532’তে প্রকাশিত হইয়াছে । লেখকের নাম দেওয়া হইয়াছে প্রোঃ কালে; উহা ভুল ।)

(৬) স্বয়ং মহাভারতে যেখানে বিষ্ণু-অবতারের বর্ণনা আছে, সেখানে বুদ্ধের নাম পৰ্যন্ত নাই; এবং নারায়ণীয় উপাখ্যানে [মভা|শাং|৩৯|১০০] যেখানে দেশ অবতারের নাম আছে সেখানে হংসকে প্ৰথম অবতার ধরিয়া এবং কৃষ্ণের পরই একেবারে কল্কির উল্লেখ করিয়া দশসংখ্যা পুরণ করা  হইয়াছে । কিন্তু বনপর্বে কলিযুগের ভবিষ্যৎ অবস্থার বর্ণনা করিবার সময় বলা হইয়াছে যে, “এডুকচিহ্না পৃথিবী ন দেবগৃহভূষিতা” অর্থাৎ পৃথিবীতে দেবালয়ের বদলে এডুক হইবে [মহা|বন|১৬০|৩৮]এডুক অর্থে বুদ্ধের কেশ দাঁত প্ৰভৃতি কোন স্মারক বস্তুকে জমীর ভিতরে পুঁতিয়া তাহার উপর যে স্তম্ভ, মিনার বা ইমারৎ নির্মিত হয়, তাহাই; এখন ইহাকে “ডাগোবা” বলা হয় । ডাগোবা শব্দ সংস্কৃত ‘ধাতুগর্ত’ (= পালী ডাগিব) শব্দের অপভ্রংশ, এবং ‘ধাতু’ অর্থে ‘ভিতরে রাখা স্মারক বস্তু’ । সিংহল ও ব্ৰহ্মদেশের স্থানে স্থানে এই ডাগোবা পাওয়া যায় । ইহা হইতে মনে হয় যে, বুদ্ধ আবির্ভূত হইবার পরে – কিন্তু তাঁহার অবতার মধ্যে পরিগণিত হইবার পূর্বেই – মহাভারত রচিত হইয়া থাকিবে । মহাভারতে, ‘বুদ্ধ’ ও ‘প্রতিবুদ্ধ’ শব্দ অনেক স্থানে পাওয়া যায় [শাং|১৯৪|৫৮; ৩০৭|৪৭; ৩৪৩|৫২] । কিন্তু এখানে জ্ঞানী, জ্ঞানবান অথবা স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তি – এই অর্থই ঐ সকল শব্দের অভিপ্রেত । বৌদ্ধধর্ম হইতে ঐ শব্দ গৃহীত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না; কিন্তু এরূপ মনে করিবার বলবৎ কারণও আছে যে, বৌদ্ধেরাই এই শব্দ বৈদিক ধর্ম হইতে গ্ৰহণ করিয়া থাকিবে ।

(৭) মহাভারতে নক্ষত্রগণনা অশ্বিনী প্রভৃতি হইতে নহে, কিন্তু কৃত্তিকা আদি হইতে হইয়াছে [মভা|অনু|৬৪ ও ৮৯], এবং মেষ-বৃষভাদি রাশির কোথাও কোথাও উল্লেখ নাই — এই কথাটি কালনির্ণয়ের দৃষ্টিতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । কারণ, ইহা হইতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, গ্ৰীক লোকদিগের সহবাসে, মেষ-বৃষভাদি রাশি ভারতবর্ষে আসিবার পূর্বে অর্থাৎ আলেকজাণ্ডরের পূৰ্বেই মহাভারত গ্ৰন্থ রচিত হইয়া থাকিবে । কিন্তু ইহা অপেক্ষাও প্রয়োজনীয় কথা হইতেছে - শ্রবণাদি নক্ষত্রগণনার কথা । অনুগীতায় [মভা|অশ্ব|৪৪|২ ও আদি|৭১|৩৪] উক্ত হইয়াছে যে, বিশ্বামিত্ৰ শ্ৰবণাদি নক্ষত্ৰগণনা শুরু করেন; এবং টীকাকার উহার এই অর্থ করিয়াছেন যে, তখন শ্রবণা নক্ষত্র হইতে উত্তরায়ণের শুরু হইত – ইহা ব্যতীত অন্য অর্থও ঠিক্‌ হয় না । বেদাঙ্গজ্যোতিষের কালে উত্তরায়ণের আরম্ভ ধনিষ্ঠা নক্ষত্ৰ হইতে হইত । ধনিষ্ঠায় উত্তরায়ণ হইবার কাল জ্যোতিৰ্গণিত-পদ্ধতি অনুসারে শকের পূর্বে প্ৰায় ১৫০০ বৎসর আসে; এবং জ্যোতিৰ্গণিত-পদ্ধতি অনুসারে উত্তরায়ণের এক নক্ষত্র পশ্চাতে হটিতে প্ৰায় হাজার বৎসর লাগে । এই হিসাবে, শ্রবণারম্ভে উত্তরায়ণ হইবার কাল শকের পূর্বে প্ৰায় ৫০০ বৎসর হয় । সার কথা, গণিতের দ্বারা দেখাইতে পারা যায় যে, শকের প্রায় ৫০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান মহাভারত রচিত হইয়া থাকিবে । ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বকীয় ভারতীয় জ্যোতিঃশাস্ত্রে এই অনুমানই করিয়াছেন [ভা|জ্যো|পৃঃ ৮৭-৯০, ১১১ ও ১৪৭ দেখ] । এই প্রমাণের বিশেষত্ব এই যে, এই কারণে বর্তমান মহাভারতের কাল শকপূর্ব ৫০০ বৎসরের অধিক পিছাইয়া লইতেই পারা যায় না ।

(৮) রাও বাহাদুর বৈদ্য, স্বকীয় মহাভারতের টীকাত্মক ইংরাজী পুস্তকে দেখাইয়াছেন যে, চন্দ্রগুপ্তের দরবারে (খৃঃ পূঃ প্ৰায় ৩২০ বৎসর) অবস্থিত মেগস্থনীস নামক গ্রীক দূতের নিকট মহাভারতের কথা বিদিত ছিল । মেগস্থনীসের সম্পূর্ণ গ্ৰন্থ এক্ষণে পাওয়া যায় না, কিন্তু তাহা হইতে অন্য ব্যক্তি কর্তৃক উদ্ধৃত অংশ একত্র করিয়া প্ৰথমে জর্মণ ভাষায় প্রকাশিত হয় এবং ম্যাকরিণ্ডল তাহারই ইংরাজী ভাষান্তর করিয়াছেন । এই পুস্তকে [পৃঃ ২০০-২০৫] উক্ত হইয়াছে যে, উহাতে বৰ্ণিত হেরক্লীজই শ্ৰীকৃষ্ণ এবং মেগস্থনীসের সময় মথুরানিবাসী শৌরসেনী লোকেরা তাঁহার পুজা করিত । হেরক্লীজ নিজের আদিপুরুষ ডায়োনিসস্‌ হইতে পঞ্চদশ পুরুষ ছিলেন, ইহাও তাহাতে লিখিত আছে । মহাভারতেও [মভা|অনু|১৪৭|২৫-৩৩] এইরূপ বর্ণনা আছে যে, শ্রীকৃষ্ণ দক্ষপ্রজাপতি হইতে পঞ্চদশ পুরুষ । এবং মেগস্থনীস কর্ণপ্রাবরণ, একপাদ, ললাটাক্ষ প্রভৃতি অদ্ভুত লোকদিগের কথা [পৃঃ ৭৪], এবং ভূগর্ভ হইতে সোনা বাহির করিবার পিপীলিকার কথা যাহা বৰ্ণনা করিয়াছেন তাহাও মহাভারতেই পাওয়া যায় [সভা|৫১ ও ৫২] । এই কথা এবং অন্য কথা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, শুধু মহাভারত গ্ৰন্থ নহে, শ্ৰীকৃষ্ণচরিত্র ও শ্ৰীকৃষ্ণের পূজাও মেগস্থনীসের সময়ে প্রচলিত ছিল ।
(See M’crindle's “Ancient India - Megasthenes and Arrian” pp. 200-205. মোগস্থনীসের এই কথা আজকাল এক গবেষণার দ্বারা আশ্চর্যরূপে দৃঢ় হইয়াছে । বোম্বাই সরকারের Archaeological Department’এর ১৯১৪ খৃষ্টাব্দের Progress Report সম্প্রতি প্রকাশিত হইয়াছে । তাহাতে এক শিলালিপি আছে, উহা গোয়ালিয়র-রাজ্যের ভিল্‌সা শহরের নিকট বেসনগর গ্রামে খাম্ববাবা বলিয়া এক গরুড়ধ্বজ স্তম্ভের উপর পাওয়া গিয়াছে । ইহাতে উক্ত হইয়াছে যে, উক্ত স্তম্ভের সম্মুখে বাসুদেবের দেবালয়, হেলিয়োডোরস্‌ নামক হিন্দু-ভূত এক যবন অর্থাৎ গ্ৰীক গড়িয়াছিল এবং সেই যবন তত্রস্থ ভগভদ্র নামক রাজার দরবারে তক্ষশিলার অন্টিয়াল্‌কিডস্‌ নামক গ্রীক রাজার দূত ছিল । খৃষ্টপূর্ব ১৪০ বৎসরে অন্টিয়াল্‌কিডস্‌ রাজত্ব করিতেন ইহা তাঁহার মুদ্রা হইতে এক্ষণে সিদ্ধ হইয়াছে । তখন, এই সময়ে বাসুদেবভক্তি প্রচলিত ছিল শুধু নহে, কিন্তু যবনও বাসুদেবের মন্দিরনির্মাণে প্ৰবৃত্ত হইয়াছিল ইহা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত হয় । মেগেস্থেনিসের শুধু নহে, বাসুদেবভক্তি পাণিনিরও বিদিত ছিল ইহা পূর্বেই বলিয়ছি ।) 

উপরি প্রদত্ত প্ৰমাণগুলি পরস্পরসাপেক্ষ নহে, স্বতন্ত্র - এই কথা মনে রাখিলে শকপূর্ব প্ৰায় ৫০০ অব্দে মহাভারতের অস্তিত্ব ছিল, ইহা নিঃসংশয়রূপে উপলব্ধি হয় । ইহার পর কখনও কেহ কোন নূতন শ্লোক উহাতে ঢুকাইয়া দিয়া থাকিবে কিংবা উহা হইতে কিছু বাহির করিয়া দিয়াও থাকিবে । কিন্তু উপস্থিত সময়ে কোন বিশিষ্ট শ্লোকের সম্বন্ধে কোনই প্রশ্ন নাই, - প্রশ্ন তো সমগ্র গ্রন্থেয়ই সম্বন্ধে; এবং এই সমগ্ৰ গ্ৰন্থ শকাব্দের অন্যূন পাঁচ শতাব্দী পূর্বেই রচিত হইয়াছে ইহা প্ৰমাণিত । এই প্রকরণের আরম্ভেই আমি সিদ্ধ করিয়াছি যে, গীতা সমগ্ৰ মহাভারত গ্রন্থেরই এক অংশ এবং উহা মহাভারতে পরে ঢুকাইয়া দেওয়া হয় নাই । অতএব মহাভারতের কাল গীতারও কাল ধরিতে হয় । সম্ভবত মূল গীতা ইহার পূর্ববর্তী, কারণ, এই প্রকরণেরই চতুর্থ ভাগে যেমন দেখাইয়াছি, উহার পরম্পরা অনেক প্রাচীনকাল পৰ্যন্ত পিছাইয়া লইয়া যাইতে হয় । কিন্তু যাহাই বল না কেন, ইহা নির্বিবাদ যে, গীতার কালকে মহাভারতের পরে লইয়া যাওয়া যায় না । কেবল উপরি-উক্ত প্ৰমাণ অনুসারেই এই কথা সিদ্ধ হয় এরূপ নহে; ঐ সম্বন্ধে স্বতন্ত্র প্রমাণও পাওয়া যায় । সে প্রমাণগুলি কি, এক্ষণে তাহা বলিতেছি ।


3) গীতার কাল নিৰ্ণয়


উপরে যে সকল প্ৰমাণ বলা হইয়াছে, তাহার মধ্যে গীতার নামতঃ স্পষ্ট নির্দেশ করা হয় নাই । উহাতে গীতার কালনির্ণয় মহাভারতের কাল ধরিয়াই করা হইয়াছে । এক্ষণে যে সকল প্রমাণে গীতার স্পষ্ট উল্লেখ আছে, সেইগুলি ক্ৰমান্বয়ে এখানে দিতেছি । কিন্তু তৎপূর্বে ইহা বলা আবশ্যক যে, ৺তৈলং গীতাকে আপস্তম্বের পূর্বের অর্থাৎ খৃষ্ট অপেক্ষা অন্যূন তিন শত বৎসরের অধিক প্রাচীন স্থির করিয়াছেন; এবং ডাঃ ভাণ্ডারকর স্বকীয় “বৈষ্ণব, শৈব প্ৰভৃতি পন্থা” এই ইংরেজী গ্রন্থে প্ৰায় এই কালই স্বীকার করিয়াছেন । প্রোঃ গার্বের মতে ৺তৈলঙ্গের নির্ধারিত কাল ঠিক নহে । তাহার মতে মূল গীতা খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত এবং খৃষ্টের পর দ্বিতীয় শতাব্দীতে ঐ গীতার কিছু সংশোধন করা হইবে । কিন্তু গার্বের এই কথা ঠিক নহে তাহা নিম্নলিখিত প্ৰমাণগুলি হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে :-
(See Telang's “Bhagabad Gita” S. B. E. Vol. VIII. Intro, pp. 21 and 34; Dr. Bhandarkar's Vaishnavism, Shaivism and other Sects, P. 13 ; Dr. Garbe's Die Bhagavadgita, P.64.)

(১) গীতার উপর যে টীকা ও ভাষ্য পাওয়া যায় তন্মধ্যে শাঙ্কর ভাষ্যই অত্যন্ত প্ৰাচীন । শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য মহাভারতের অন্তৰ্গত সনৎসুজাতীয় প্রকরণেরও ভাষ্য লিখিয়াছেন এবং তাঁহার সেই গ্রন্থে মহাভারতের অনুগীতা, মনু-বৃহস্পতিসংবাদ এবং শুকানুপ্রশ্ন হইতে অনেক বচন অনেক স্থানে প্ৰমাণার্থ গৃহীত হইয়াছে । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, মহাভারত ও গীতা এই দুই গ্ৰন্থ তাঁহার কালে প্ৰমাণ বলিয়া মানা হইত । এক সাম্প্রদায়িক শ্লোকের প্রমাণে প্রোঃ কাশীনাথ বাপু পাঠক শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্যের জন্মকাল ৮৪৫ বিক্রমী সম্বৎ (৭১০ শকাব্দ) স্থির করিয়াছেন । কিন্তু আমার মতে, এই কাল আরও একশত বৎসর পিছাইয়া দেওয়া আবশ্যক । কারণ মহানুভব পন্থার ‘দর্শনপ্রকাশ’ নামক গ্রন্থে উক্ত হইয়াছে যে, “যুগ্মপয়োধিয়সান্বিতশাকে” অর্থাৎ ৬৪২ শকে (বিক্ৰমী সম্বৎ ৭৭৭), শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য গুহাপ্ৰবেশ করিয়াছিলেন, এবং সেই সময়ে তাঁহার বয়স ৩২ বৎসর ছিল; অতএব তাঁহার জন্মকাল ৬১০ শকাব্দ (সম্বৎ ৭৪৫) এইরূপ সিদ্ধ হয় । আমার মতে এই কালই প্রোফেসর পাঠক-নির্ধারিত কাল অপেক্ষা অধিক সযুক্তিক । কিন্তু এই সম্বন্ধে সবিস্তার বিচার এখানে করিতে পারা যায় না । গীতার শাঙ্করভাষ্যে পূর্ববর্তী অধিকাংশ টীকাকারদিগের উল্লেখ আছে, এবং উক্ত ভাষ্যের আরম্ভেই শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য বলিয়াছেন যে, এই সকল টীকাকারদিগের মত খণ্ডন করিয়া আমি নুতন ভাষ্য লিখিয়াছি । অতএব আচার্যের জন্মকাল শকাব্দ ৬১০’ই ধর, কিংবা ৭১০’ই ধর, ইহা নির্বিবাদ যে, ঐ সময়ে অন্ততঃ দুই-তিনশত বৎসর পূর্বে অর্থাৎ ৪০০ শকের কাছাকাছি গীতা প্রচলিত ছিল । এক্ষণে দেখা যাক্‌, ইহারও পূর্বে কিরূপে এবং কতটা যাওয়া যাইতে পারে ।

(২) গীতা কালিদাসবাণভট্টের যে বিদিত ছিল, তাহা ৺তৈলঙ্গ দেখাইয়াছেন । কালিদাসের রঘুবংশে [১০|৩১] বিষ্ণুস্তুতিতে “অনবাপ্ত মবাপ্তব্যং ন তে কিঞ্চন বিদ্যতে” এই শ্লোক আছে, তাহা গীতার “অনবাপ্ত মবাপ্তব্যং” [৩|২২] এই শ্লোকে পাওয়া যায়; এবং বাণভট্টের কাদম্বরীর “মহাভারতমিবানন্তগীতাকর্ণনানন্দিততরং” এই এক শ্লেষপ্রধান বাক্যে গীতার স্পষ্ট উল্লেখ আসিয়াছে । কালিদাস এবং ভারবির স্পষ্টত উল্লেখ ৬৯১ সম্বতের (শকাব্দ ৫৫৬) এক শিলালিপিতে পাওয়া যায়; এবং এক্ষণে ইহাও নির্ধারিত হইয়াছে যে, বাণভট্ট ৬৬৩ সম্বতের (৫২৮ শকাব্দের) কাছাকাছি হর্ষরাজার নিকটে ছিলেন । ৺পাণ্ডুরং গোবিন্দ শাস্ত্রী পারখী স্বকীয় বাণভট্টসম্বন্ধীয় এক মারাঠী প্রবন্ধে ইহার বিচার করিয়াছেন ।

(৩) জাবা দ্বীপে যে মহাভারত এখান হইতে যায় তদন্তৰ্গত ভীষ্মপর্বে এক গীতা প্ৰকরণ আছে এবং তাহাতে গীতার বিভিন্ন অধ্যায়ের প্রায় একশো সওয়া-শো শ্লোক অক্ষরশঃ পাওয়া যায় । কেবল ১২, ১৫, ১৬ ও ১৭ এই চার অধ্যায়ের শ্লোক তাহাতে নাই । কাজেই এরূপ বলায় কোন  প্ৰত্যবায় নাই যে, তখনও গীতার স্বরূপ বর্তমানেরই সদৃশ ছিল । কারণ, কবিভাষার ইহা গীতার অনুবাদ এবং তাহাতে যে সংস্কৃত শ্লোক পাওয়া যায় তাহা মধ্যে মধ্যে উদাহরণ এবং প্রতীকস্বরূপে গৃহীত হইয়াছে । সুতরাং ঐ পরিমিত শ্লোকই যে সে সময়ে গীতায় ছিল এরূপ অনুমান করা যুক্তিসিদ্ধ নহে । ডাঃ নরহরি গোপাল সরদেশাই জাবা দ্বীপে যখন গিয়াছিলেন, তখন তিনি এই বিষয়ের অনুসন্ধান করিয়াছিলেন । কলিকাতার মডর্ণ রিভিউ” নামক মাসিকের ১৯১৪ জুলাই সংখ্যায় এবং তৎপূর্বে পুণারচিত্রময় জগৎ” মাসিকেও উহা প্ৰকাশিত হইয়াছে । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, ৪০০/৫০০ শকাব্দের পূর্বে অন্যূন ২০০ বৎসর পৰ্যন্ত, মহাভারতের ভীষ্মপর্বে গীতা ছিল এবং উহার শ্লোকও এখনকার গীতা-শ্লোকের ক্রমপরম্পরা অনুসারেই ছিল ।

(৪) বিষ্ণুপুরাণ, পদ্মপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থে ভগবদ্গীতার ধরণে রচিত অন্য যে সকল গীতা দেখা যায় কিংবা উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহাদের বিবরণ এই গ্রন্থের প্রথম প্ৰকরণে প্রদত্ত হইয়াছে । ইহা হইতে স্পষ্টই দেখা যাইতেছে যে, তখন ভগবদগীতা প্রমাণ ও পূজ্য বলিয়া বিবেচিত হইত । তাই তাহার উক্ত প্রকারে অনুকরণ করা হইয়াছে, এবং ঐরূপ না হইলে কেহই তাহার অনুকরণ করিত না । অতএব সিদ্ধ হয় যে, এই পুরাণসমূহের মধ্যে অত্যন্ত প্রাচীন যে পুরাণ তাহা অপেক্ষাও ভগবদ্গীতা অন্ততঃ দুই-একশো বৎসর অধিক প্রাচীন অবশ্য হইবে । পুরাণকালের প্রারম্ভ, খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দী অপেক্ষা অধিক আধুনিক বলিয়া মনে করা যায় না, অতএব গীতার কাল অন্যূন শকারম্ভের অল্প পূৰ্ববর্তী বলিয়াই স্বীকার করিতে হয় ।

(৫) উপরে বলিয়াছি যে, গীতা কালিদাসের ও বাণের বিদিত ছিল । কালিদাসের পূর্ববর্তী ভাস কবির নাটকগুলি সম্প্রতি ছাপা হইয়াছে । তন্মধ্যে ‘কৰ্ণভার’ নামক নাটকে দ্বাদশ শ্লোক এইরূপ আছে :-
হতোহপি লভতে স্বৰ্গং জিত্বা তু লভতে যশঃ ৷
উভে বহুমতে লোকে নাস্তি নিষ্ফলতা রণে ॥ 
এই শ্লোক গীতার “হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং” [গী|২|৩৭] এই শ্লোকের সহিত সমানার্থক । এবং যখন ভাস কবির অন্য নাটক হইতে দেখা যায় যে, তাঁহার মহাভারতের সহিত পূর্ণ পরিচয় ছিল, তখন তো ইহা অনুমান করিতে কোনও বাধা নাই যে, উপরিপ্রদত্ত শ্লোকটি লিখিবার সময় গীতার শ্লোকটি তাঁহার মনের সম্মুখে নিশ্চয়ই আসিয়াছিল । অর্থাৎ ইহা সিদ্ধ হইতেছে যে, ভাসকবির পূর্বেও মহাভারত ও গীতার অস্তিত্ব ছিল । পণ্ডিত ত• গণপতি শাস্ত্রী স্থির করিয়াছেন যে, ভাস কবির কাল শকপূর্ব দুই-তিনশত বৎসর হইবে । কিন্তু কেহ কেহ মনে করেন যে, তাঁহার কাল শকাব্দের দুই একশো বৎসর পরে হইবে । এই দ্বিতীয় মতকে ঠিক মনে করিলেও উপরি-উক্ত প্ৰমাণ হইতে সিদ্ধ হয় যে, ভাসের অন্যূন একশো দুশো বৎসর পূর্বে অর্থাৎ শককালের আরম্ভে মহাভারত ও গীতা এই দুই গ্ৰন্থ সৰ্বমান্য হইয়াছিল ।

(৬) কিন্তু প্ৰাচীন গ্ৰন্থকারগণ কর্তৃক গীতার শ্লোক গ্ৰহণ করিবার আরও বলবত্তর প্রমাণ ৺ত্র্যম্বক গুরুনাথ কালে গুরুকুলের ‘বৈদিক ম্যাগাজিন’ নামক ইংরেজী মাসিক পুস্তকে [পুস্তক|৭, সংখ্যা ৬৭ পৃঃ ৫২৮-৫৩২, অগ্রহায়ণ ও পৌষ, সংবৎ ১৯৭০] প্ৰকাশ করিয়াছেন । ইহার পূর্বে পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগের এইরূপ ধারণা ছিল যে, সংস্কৃত কাব্য কিংবা পুরাণ অপেক্ষা প্ৰাচীন কোন গ্রন্থে (উদাহরণার্থ সূত্রগ্রন্থেও) গীতার উল্লেখ পাওয়া যায় না; এবং সেইজন্য বলিতে হয় যে, সূত্রকালের পর, অর্থাৎ বড় জোর খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে গীতা রচিত হইয়া থাকিবে । কিন্তু ৺কালে সপ্ৰমাণ করিয়াছেন যে, এই ধারণা ভ্রান্ত । বৌধায়ন গৃহ্যশেষসূত্রে [২|২২|৯] গীতার [৯|২৬] শ্লোক “তদাহ ভগবান্‌” বলিয়া স্পষ্ট গৃহীত হইয়াছে, যথা - দেশাভাবে দ্রব্যাভাবে সাধারণে কুর্য্যান্মনসা বার্চয়েদিতি । তদাহ ভগবান -
পত্ৰং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্ৰযচ্ছতি ৷
তদহং ভক্ত্যুপহৃতমশ্নামি প্ৰযতাত্মনঃ ॥ ইতি
এবং পরে উক্ত হইয়াছে যে, ভক্তিনম্র হইয়া এই মন্ত্র বলিবে — “ভক্তিনম্রঃ এতান্‌ মন্ত্রানধীয়ীত” । এই গৃহ্যশেষসূত্রেরই তৃতীয় প্রশ্নের শেষে “ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়” এই দ্বাদশাক্ষর মন্ত্র জপ করিলে অশ্বমেধের ফললাভ হয়, ইহাও উক্ত হইয়াছে । ইহা হইতে সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় যে, বৌধায়নের পূর্বে গীতা প্ৰচলিত ছিল এবং বাসুদেব-পূজাও সর্বমান্য হইয়াছিল । ইহা ব্যতীত বৌধায়নের পিতৃমেধসূত্রের তৃতীয় প্রশ্নের আরম্ভেই এই বাক্য আছে :-
জাতস্য বৈ মনুষ্যস্য ধ্রুবং মরণমিতি বিজানীয়াত্তস্মাজ্জাতে 
ন প্ৰহৃষ্যেন্মৃতে চ ন বিষীদেত ।
ইহা হইতে সহজেই দেখা যায় যে, ইহা গীতার “জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুঃ ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ । তস্মাদপরিহাৰ্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমৰ্হসি” এই শ্লোক হইতে সূচিত হইয়া থাকিবে; এবং উহার সহিত উপরিপ্রদত্ত “পত্ৰং পুষ্পং” এই শ্লোক যোগ দিলে তো কোন সংশয়ই থাকে না । উপরে বলিয়াছি যে, স্বয়ং মহাভারতের এক শ্লোক বৌধায়নসূত্রে পাওয়া যায় । বুহ্লর সাহেব স্থির করিয়াছেন যে, বৌধায়নের কাল আপস্তম্বের দুই এক শত বৎসর পূর্ববর্তী হইবে এবং আপস্তম্বের কাল খৃষ্টপূর্ব তিন শত বৎসরের কম হইতে পারে না (See Sacred Books of the East Series. Vol ll. Intro p. xliii, and also the same Series Vol XIV, Intro, p. xliii.) । কিন্তু আমার মতে উহাকে একটু এদিকে পিছানো উচিত; কারণ মহাভারতে মেষবৃষভাদি রাশি নাই এবং কালমাধবে তো বৌধায়নের “মীন মেষয়োর্মেষবৃষভয়োর্বা বসন্তঃ” এই বচন প্ৰদত্ত হইয়াছে - এই বচনই ৺শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বকীয় ভারতীয় জ্যোতিঃশাস্ত্রেও [পৃঃ ১০২] গ্রহণ করিয়াছেন । ইহা হইতেও ইহাই নিশ্চিত অনুমান হয় যে, মহাভারত বৌধায়নেরও পূৰ্ববর্তী । শকপূর্ব নিদেন চারি শত বৎসর বৌধায়নের সময় হওয়া উচিত এবং শকারম্ভের পাঁচ শত বৎসর পূর্বে মহাভারত ও গীতার অস্তিত্ব ছিল । ৺কালে বৌধায়নের কালকে খৃষ্টপূর্ব সাত আট শত অব্দ ধরিয়াছেন; কিন্তু তাহা ঠিক নহে । বুঝা যায় যে, বৌধায়নের রাশিসম্বন্ধীয় বচন তাঁহার দৃষ্টিগোচর হয় নাই ।

(৭) উপরি-উক্ত প্ৰমাণাদি হইতে যে কোন ব্যক্তিরই ইহা স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে যে, শকপূর্ব প্রায় পাঁচশত অব্দে বর্তমান গীতার অস্তিত্ব ছিল; উহা বৌধায়ন ও আশ্বলায়নেরও বিদিত ছিল; এবং তখন হইতে শঙ্করাচার্যের সময় পৰ্যন্ত উহার পরম্পরা অবিচ্ছিন্নরূপে দেখান যাইতে পারে । কিন্তু এ পৰ্যন্ত যে সমস্ত প্ৰমাণ উল্লিখিত হইয়াছে, সে সমস্ত বৈদিক ধর্মগ্রন্থ হইতে গৃহীত । এক্ষণে সম্মুখে চলিয়া যে সকল প্ৰমাণ দেওয়া যাইবে সেগুলি বৈদিকেতর অর্থাৎ বৌদ্ধ সাহিত্যের । ইহা দ্বারা, গীতার উপরি-উক্ত প্ৰাচীনত্ব স্বতন্ত্রভাবে আরও অধিক বলবৎ ও নিঃসন্দিগ্ধ হইতেছে । বৌদ্ধধর্মের পূর্বেই ভাগবতধর্ম আবির্ভূত হইয়াছিল, এই সম্বন্ধে বুহ্লর ও প্রসিদ্ধ ফরাসী পণ্ডিত সেনার্টের মত পূর্বে প্রদত্ত হইয়াছে; এবং বর্তমান প্রকরণের পরবর্তী ভাগে বৌদ্ধধর্মের বৃদ্ধি কিরূপে হইল, এবং হিন্দুধর্মের সহিত তাহার সম্বন্ধ কি, ইত্যাদি বিষয়ের বিচার, স্বতন্ত্ররূপে করা হইবে । এখানে কেবল গীতার কালসম্বন্ধেই যাহা উল্লেখ করা আবশ্যক তাহাই সংক্ষেপে করা হইবে । ভাগবতধর্ম বৌদ্ধধর্মের পূৰ্ববর্তী, কেবল এইটুকু বলিলেই, গীতাও বুদ্ধের পূর্ববর্তী তাহা নিশ্চয় বলা যাইতে পারে না; কারণ, ভাগবতধর্ম ও গীতাগ্রন্থের আবির্ভাব যে এক সঙ্গেই হইয়াছিল ইহা বলিবার কোন প্রমাণ নাই । অতএব দেখা আবশ্যক যে, বৌদ্ধ গ্রন্থকারগণ গীতাগ্রন্থের স্পষ্ট উল্লেখ কোথাও করিয়াছেন কিনা । প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে স্পষ্ট লিখিত আছে যে, বুদ্ধের সময়ে চারি বেদ, বেদাঙ্গ, ব্যাকরণ, জ্যোতিষ, ইতিহাস, নিঘণ্টু প্রভৃতি বৈদিক ধর্মগ্রন্থ প্রচলিত হইয়া গিয়াছিল । তাই বৈদিক ধর্ম বুদ্ধের পূর্বেই যে পূৰ্ণতায় উপনীত হইয়াছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নাই । ইহার পর বুদ্ধ যে নুতন পন্থা চালাইয়াছেন, তাহা অধ্যাত্মদৃষ্টিতে অনাত্মবাদী ছিল, কিন্তু উহাতে - যাহা পরবর্তী ভাগে বলা যাইবে - আচরণদৃষ্টিতে উপনিষদেয় সন্ন্যাসমার্গেরই অনুকরণ করা হইয়াছিল । অশোকের সময়ে বৌদ্ধধর্মের এই অবস্থা পরিবর্তিত হয় । বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ বনবাস ত্যাগ করিয়া ধর্মপ্রচার ও পরোপকারের কাজ করিবার জন্য পূর্বদিকে চীনদেশে এবং পশ্চিমদিকে আলেকজান্দ্ৰিয়াগ্রীস পৰ্যন্ত গিয়াছিলেন । বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে এই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যে, বনবাস ছাড়িয়া লোক সংগ্রহের কাজ করিবার জন্য বৌদ্ধ যতি কিরূপে প্ৰবৃত্ত হইলেন ? বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন গ্ৰন্থ দেখ । সুত্তনিপাতের খগ্‌গবিসাণসুত্তে উক্ত হইয়াছে যে, যে ভিক্ষু পূৰ্ণ অর্হৎ অবস্থায় পৌঁছিয়াছেন তিনি কিছু না করিয়া গণ্ডারের মত বনে বাস করুন । এবং মহাবগ্‌গে [৫|১|২৭] বুদ্ধের শিষ্য সোনকোলীবিসের কথায় স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে “যে ভিক্ষু নির্বাণাবস্থায় পৌঁছিয়াছেন, তাঁহার না কিছুই করিবার থাকে, আর না তাঁহাকে কৃত কর্মই ভোগ করিতে করিতে হয়” - ‘কতস্‌স পটিচয়ো নত্থি করণীয়ং ন বিজ্জতি’ । ইহা শুদ্ধ সন্ন্যাসমার্গ; এবং আমাদিগের ঔপনিষদিক সন্ন্যাসমার্গের সহিত ইহার সম্পূর্ণ ঐক্য আছে । ‘করণীয়ং ন বিজ্জতি’ এই বাক্য “তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে” এই গীতাবাক্যের সহিত শুধু সমানার্থক নহে, কিন্তু শব্দশও একই । কিন্তু বৌদ্ধভিক্ষুর যখন এই মূল সন্ন্যাসমূলক আচার পরিবর্তিত হইল এবং যখন উহাঁরা পরোপকারের কাজে প্ৰবৃত্ত হইলেন তখন পুরাতন ও নূতন মতের মধ্যে বিবাদ বাধিল; পুরাতন লোকেরা আপনাদিগকে “থেরবাদ” (বৃদ্ধপন্থা) বলিতে লাগিল, এবং নূতন মতের লোকেরা আপন পন্থার ‘মহাযান’ এই নাম দিয়া পুরাতন পন্থাকে ‘হীনযান’ অর্থাৎ (হীন পন্থা) বলিতে লাগিল । অশ্বঘোষ মহাযানপন্থাবলম্বী ছিলেন; এবং বৌদ্ধ যতিরা পরোপকারের কাজ করিবে এই মত তাঁহার গ্রাহ্য ছিল; তাই, সৌন্দরানন্দ [১৮|৪৪] কাব্যের শেষে নন্দ অৰ্হৎ অবস্থায় পৌঁছিলে পর তাঁহাকে বুদ্ধ যে উপদেশ দিয়াছিলেন তাহার প্রথমে উক্ত হইয়াছে -
অবাপ্তকারয্যোহসি পরাং গতিং গতঃ
ন তেহস্তি কিঞ্চিৎ করণীয়মণ্বপি ৷
অর্থাৎ “তোমার কাৰ্য শেষ হইয়াছে; উত্তম গতি তুমি লাভ করিয়াছ, এখন তোমার (নিজের) তিলমাত্র কর্তব্যও অবশিষ্ট নাই”; এবং পরে এইরূপ স্পষ্ট উপদেশ করিয়াছেন যে, -
বিহার তস্মাদিহ কাৰ্যমাত্মনঃ 
কুরু স্থিরাত্মন্‌ পরকার্য্যমপ্যথো ॥ 
অতএব এখন তুমি আপন কাৰ্য ছাড়িয়া স্থিরবুদ্ধি হইয়া পরকাৰ্য করিতে থাক[সৌ|১৮|৫৭] । বুদ্ধের কর্মত্যাগমূলক উপদেশ - যাহা প্ৰাচীন ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় - এবং সৌন্দরানন্দ কাব্যে অশ্বঘোষ বুদ্ধের মুখ দিয়া যাহা বাহির করাইয়াছেন সেই উপদেশ, এই দুইয়ের মধ্যে অত্যন্ত ভিন্নতা আছে । আবার অশ্বঘোষের এই উক্তিসমূহে এবং গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে যে যুক্তি প্রয়োগ আছে, উহাতে ‘তস্য কাৰ্য্যং ন বিদ্যতে’ ‘তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর’ [গী|৩|১৭, ১৯] অর্থাৎ তোমার কিছুই বাকী নাই, তাই যে কর্ম প্ৰাপ্ত হইবে, তাহাই তুমি নিষ্কাম বুদ্ধিতে কর - কেবল অর্থদৃষ্টিতে নহে, শব্দশও সাম্য আছে । অতএব ইহা হইতে অনুমান হয় যে, অশ্বঘোষ এই যুক্তি গীতা হইতেই গ্ৰহণ করিয়াছেন । ইহার কারণ উপরে প্রদর্শিত হইয়াছে যে, অশ্বঘোষের পূর্বেও মহাভারত ছিল । কিন্তু ইহা কেবল অনুমানমাত্র নহে । বুদ্ধধর্মাবলম্বী তারানাথ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস সম্বন্ধে তিববতী ভাষায় যে গ্ৰন্থ লিখিয়াছেন, তাহাতে লিখিত হইয়াছে যে, বৌদ্ধদিগের পূর্বকালীন সন্ন্যাসমার্গে মহাযান পন্থা যে কর্মযোগমূলক সংস্কার করিয়াছিল উহা ‘জ্ঞানী শ্ৰীকৃষ্ণ ও গণেশ’ হইতে মহাযানপন্থার প্রধান প্ৰবর্তক নাগার্জুনের গুরু রাহুলভদ্র জানিতেন । এই গ্ৰন্থ রুষীয় ভাষার মধ্য দিয়া জর্মন ভাষায় ভাষান্তরিত হইয়াছে, ইংরাজীতে হয় নাই । ডাঃ কেৰ্ণ ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে যে পুস্তক লেখেন তাহাতে যাহা উদ্ধৃত হইয়াছে, সেই উদ্ধৃতাংশ হইতে আমি ইহা গ্ৰহণ করিয়াছি । (See Dr. Kern’s “Manual of India Buddhism”. Grundriss III, 8, p.122, মহাযান পন্থার ‘অমিতাযুসুত্ত’ নামক মুখ্য গ্রন্থ চিনীয় ভাষায় আনুমানিক ১৫৮ সনে ভাষান্তরিত হইয়াছে ।) এই স্থলে শ্ৰীকৃষ্ণের নামে ভগবদ্গীতারই উল্লেখ করা হইয়াছে, এইরূপ ডাঃ কের্ণেরও মত । মহাযানপন্থার বৌদ্ধগ্রন্থের মধ্যে ‘সদ্ধন্মপুণ্ডরীক’ নামক গ্রন্থেও ভগবদ্গীতার শ্লোকের মত কতকগুলি শ্লোক আছে । কিন্তু এই সমস্ত এবং অন্য সমস্ত বিষয়ের বিচার পরবর্তী ভাগে করা যাইবে । এখানে কেবল বলিতে হইবে যে, বৌদ্ধগ্রন্থকারদিগেরই মতে মূল বৌদ্ধধর্ম সন্ন্যাসপ্রধান হইলেও উহাতে ভক্তিপ্রধান ও কর্মপ্ৰধান মহাযানপন্থার উৎপত্তি ভগবদ্গীতারই কারণে হইয়াছে; এবং অশ্বঘোষের কাব্য ও গীতার মধ্যে যে সাম্য প্রদর্শিত হইয়াছে তাহা হইতেও এই অনুমান আরও দৃঢ় হয় । মহাযানপন্থার প্রথম প্ৰবর্তক নাগার্জুন শাকপূর্ব প্ৰায় একশো দেড়শো অব্দে আবির্ভূত হইয়া থাকিবেন, এইরূপ পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন; এবং এই পন্থার বীজারোপণ অশোকের আমলে অবশ্য হইয়াছিল, ইহা তো স্পষ্টই দেখা যায় । বৌদ্ধ গ্ৰন্থ হইতে এবং স্বয়ং বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারগণের লিখিত বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস হইতে, স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধ হয় যে, মহাযান বৌদ্ধপন্থা বাহির হইবার পূর্বে - অশোকেরও পূর্বে - অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্ৰায় ৩০০ বৎসর পূর্বেই ভগবদ্গীতার অস্তিত্ব ছিল ।


4) সিদ্ধান্ত


এই সকল প্ৰমাণের উপর বিচার করিলে, শালিবাহন শকের প্রায় ৫০০ বৎসর পূৰ্বেই বর্তমান ভগবদ্গীতার অস্তিত্ব ছিল, এ বিষয়ে কোন সন্দেহই থাকে না । ডাঃ ভাণ্ডারকর, ৺তৈলঙ্গ, রাও বাহাদুর চিন্তামণি রাও বৈদ্য এবং ৺দীক্ষিত, ইহাদের মতও অনেকটা এইরূপই এবং উহাই এই প্ৰকরণে গ্ৰাহ্য বলিয়া মানিতে হইবে । প্ৰোঃ গার্বের মত অন্যরূপ । তাহার মতের প্রমাণস্বরূপে তিনি গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের সম্প্রদায়পরম্পরার শ্লোকের মধ্যে, ‘যোগো নষ্টঃ’ যোগ নষ্ট হইল - এই বাক্য ধরিয়া যোগ শব্দের অর্থ ‘পাতঞ্জল যোগ’ করিয়াছেন । কিন্তু আমি প্ৰমাণসহ দেখাইয়াছি যে, যোগ শব্দের অর্থ সেখানে ‘পাতঞ্জল যোগ’ নহে, ‘কর্মযোগ’ । অতএব প্ৰোঃ গার্বের মত ভ্ৰান্তিমূলক ও অগ্ৰাহ্য । বর্তমান গীতার কাল শালিবাহন শকের পাঁচশত বৎসর পূর্বের অপেক্ষা আর কম স্বীকার করা যায় না, ইহা নির্বিবাদ । পূর্বভাগে ইহা বলিয়াই আসিয়াছি যে, মূলগীতা ইহা অপেক্ষাও আরও কয়েক শতাব্দী প্ৰাচীন হইবে ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment