Sunday, June 4, 2017

বিশ্বের রচনা ও সংহার (Creation & Destruction)

বিশ্বের রচনা ও সংহার


গুণা গুণেষু জায়ন্তে তত্রৈব নিবিশন্তি চ ৷ [মভা|শান্তি|৩|৫|২৩]

(“গুণ হইতেই গুণ উৎপন্ন হয় এবং গুণেতেই গুণ লয় পায়” ।)


সূচীপত্র


1) প্রকৃতির বিস্তার ও জ্ঞানবিজ্ঞান
2) বিভিন্ন সৃষ্ট্যুৎপত্তিক্রম এবং উহাদের অন্তিম একবাক্যতা
3) আধুনিক উৎক্রান্তিবাদের সহিত সাংখ্যের গুণোৎকর্ষতত্ত্বের সাম্য
3.1) আধিভৌতিকবাদী ও অধ্যাত্মবাদীর মধ্যে মতভেদ
4) গুণোৎকর্ষের অথবা গুণ-পরিণামবাদের নিরুপণ
4.1) ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধির উৎপত্তি
4.2) অহঙ্কারের উৎপত্তি
4.3) সেন্দ্ৰিয় এগারো তত্ত্বের ও নিরিন্দ্রিয় পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি
4.4) তন্মাত্র পাঁচই কেন এবং সূক্ষ্মেন্দ্রিয় এগারোই কেন, তাহার নিরুপণ
4.5) সূক্ষ্ম সৃষ্টি হইতে স্থুল বিশেষের উৎপত্তি
5) পঁচিশ তত্ত্বের ব্রহ্মাণ্ডবৃক্ষ
6) সাংখ্যের ব্রহ্মবৃক্ষ এবং গীতার অশ্বত্থ-বৃক্ষ
7) পঁচিশ তত্ত্বের বর্গীকরণ
7.1) সাংখ্যের বর্গীকরণের রীতি
7.2) বেদান্তীদিগের ও গীতার বর্গীকরণের রীতি
8) বেদান্তগ্রন্থে বর্ণিত স্থূল পঞ্চ মহাভুতের উৎপত্তিক্রম
9) পঞ্চীকরণ ও চুরাশি লক্ষ জীবযোনি
10) ত্রিবৃৎকরণের সহিত পঞ্চীকরণের তুলনা
11) সজীব সৃষ্টি ও সাংখ্যশাস্ত্রে বর্ণিত লিঙ্গশরীর
12) বেদান্তে বর্ণিত লিঙ্গশরীর
13) লিঙ্গশরীর ভিন্ন ভিন্ন দেহ কেন উৎপন্ন করে ?
14) উৎপত্তি-প্রলয়-কাল
15) কালগণনা
15.1) দেবতাদের দিবারাত্রি ও বৎসর
15.2) চারিযুগ + সন্ধিকাল = মহাযুগ
15.3) মন্বন্তর ও কল্প
16) সৃষ্টির উৎপত্তির অন্য ক্রমের সহিত বিরোধ ও একতা



1) প্রকৃতির বিস্তার ও জ্ঞানবিজ্ঞান


কাপিলসাংখ্য অনুসারে, প্ৰকৃতি ও পুরুষ, জগতের এই যে দুই স্বতন্ত্ৰ মূলতত্ত্ব আছে তাহাদের স্বরূপ কি, এবং দুয়ের সংযোগরূপ নিমিত্ত-কারণ ঘটিলে পর, পুরুষের সম্মুখে প্ৰকৃতি আপন গুণত্রয়ের যে বাজার বসাইয়া থাকে, তাহা হইতে কিরূপে মুক্তিলাভ করা যাইবে, ইহার বিচার করা হইয়াছে । কিন্তু এই প্ৰকৃতির বাজার-লীলা, মরাঠী কবি যাহার ভাবব্যঞ্জক নাম দিয়াছেন “সংসারের খেলা” এবং জ্ঞানেশ্বর মহারাজও যাহাকে “প্রকৃতির টাকশাল” বলিয়াছেন, সেই প্ৰকৃতির সংসার কি অনুক্ৰম অনুসারে পুরুষের সম্মুখে বিস্তৃত হইয়া থাকে ও তাহার লয় কিরূপে হয় ইহার ব্যাখ্যা এখনো বাকী রহিয়া গিয়াছে; এই প্ৰকরণে সেই ব্যাখ্যা করিব । প্রকৃতির এই ব্যাপারকেই “বিশ্বের রচনা ও সংহার” বলে । সাংখ্যমতানুসারে এই সমস্ত জগৎ বা সৃষ্টি অসংখ্য পুরুষের লাভের জন্যই প্ৰকৃতি নির্মাণ করিয়াছেন । প্রকৃতি হইতে সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ড কিরূপে নির্মাণ হয়, ‘দাসবোধের’ দুই তিন স্থানে শ্ৰীসমর্থ রামদাসস্বামীও তাহার সুরস বর্ণনা করিয়াছেন; এবং সেই বৰ্ণনা হইতেই “বিশ্বের রচনা ও সংহার” এই নাম আমি গ্রহণ করিয়াছি । সেইরূপ, ভগবদ্গীতার সপ্তম ও অষ্টম অধ্যায়ে এই বিষয় মুখ্যভাবে প্ৰতিপাদ্য হইয়া পরে একাদশ অধ্যায়ের আরম্ভে - “ভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাং শ্ৰতৌ বিস্তরশো ময়া” [গী|১১|২] ভূতসকলের উৎপত্তি ও প্রলয় (যাহা আপনি) বিস্তারিতরূপে (বলিয়াছেন তাহা) আমি শুনিয়াছি, এক্ষণে আপনার বিশ্বরূপ দেখাইয়া আমাকে কৃতাৰ্থ করুন - এই যে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট প্রার্থনা করিয়াছেন, তাহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, বিশ্বের রচনা ও সংহার ক্ষর-অক্ষর-বিচারের এক মুখ্য ভাগ । সৃষ্টির অন্তর্গত অনেক (নানা) ব্যক্ত পদার্থের মধ্যে একই অব্যক্ত মূল দ্রব্য আছে ইহা যাহা দ্বারা বুঝা যায় তাহাই জ্ঞান [গী|১৮|২০]; এবং যাহা দ্বারা একই মূলভূত অব্যক্ত দ্রব্য হইতে ভিন্ন ভিন্ন অনেক ব্যক্ত পদার্থসকল কিরূপে পৃথকতাবে নির্মিত হইয়াছে বুঝা যায় তাহাই বিজ্ঞান [গী|১৩|৩০]; এবং ইহার মধ্যে কেবল ক্ষরাক্ষর বিচারের সমাবেশ হয় না, ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্ৰজ্ঞজ্ঞান ও অধ্যাত্মবিষয়াসকলেরও সমাবেশ হয় ।


2) বিভিন্ন সৃষ্ট্যুৎপত্তিক্রম এবং উহাদের অন্তিম একবাক্যতা


ভগবদ্‌গীতার মতে প্রকৃতি, আপন সংসারের কাৰ্য স্বতন্ত্ররূপে নিৰ্বাহ করেন না, পরন্তু তিনি পরমেশ্বরের ইচ্ছায় এই কার্য নিৰ্বাহ করিয়া থাকেন [গী|৯|১০] । সাংখ্যশাস্ত্রের মতে পুরুষের সংযোগরূপ নিমিত্ত-কারণই প্রকৃতির সংসারকার্য আরম্ভ করিবার পক্ষে যথেষ্ট । প্ৰকৃতি এই বিষয়ে আর কাহারও অপেক্ষা রাখেন না । সাংখ্যের ব্যক্তব্য এই যে, পুরুষ ও প্ৰকৃতির সংযোগ হইলেই, প্ৰকৃতি-টাকশালের কাজ আরম্ভ হয় এবং বসন্ত ঋতুতে যেরূপ পল্লব ফুটিয়া ক্ৰমে ক্রমে পাতা, ফুল ও ফল বাহির হয় [মভা|শাং|২৩১|৭৩; মনু|১|৩০] সেইরূপ প্ৰকৃতির মূল সাম্যাবস্থা ভাঙ্গিয়া তাহার গুণসমূহের বিস্তার হইতে থাকে । ইহার বিপরীতে বেদসংহিতাতে, উপনিষদে ও স্মৃতিগ্ৰন্থাদিতে প্রকৃতিকে মূল বলিয়া স্বীকার না করিয়া, পরব্ৰহ্মকে মূল বলিয়া স্বীকার করিয়া তাহা হইতে স্থষ্টির উৎপত্তি হইবার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা করা হইয়াছে; যথা — “হিরণ্যগৰ্ভঃ সমবৰ্ত্ততাগ্ৰে ভুতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ” প্রথমে হিরণ্যগৰ্ভ [ঋ|১০|১২১|১], এবং এই হিরণ্যগৰ্ভ হইতে কিংবা সত্য হইতে সমস্ত সৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৭২; ১০|১৯০]; কিংবা প্ৰথমে জল উৎপন্ন হইয়া [ঋ|১০|৮২|৬; তৈ|ব্রা|১|১|৩|৭; ঐ|উ|১|১|২] তাহা হইতে সৃষ্টি হইল; এই জলেতে এক অণ্ড উৎপন্ন হইবার পর তাহা হইতে ব্ৰহ্মা, এবং ব্ৰহ্মা হইতে কিংবা মূল অণ্ড হইতেই সমস্ত জগৎ উৎপন্ন হইল [মনু|১|৮|১৩; ছাং|৩|১৯]; কিংবা সেই ব্ৰহ্মাই (পুরুষ) অর্ধভাগে স্ত্রী হইয়াছিলেন [বৃ|১|৪|৩; মনু|১|৩২]; কিংবা জল উৎপন্ন হইবার পূর্বেই পুরুষ হইয়াছিল [কঠ|৪|৬]; অথবা প্ৰথমে পরব্ৰহ্ম হইতে তেজ, জল ও পৃথ্বী (অন্ন) এই তিন তত্ত্ব উৎপন্ন হইবার পরে তাহাদের মিশ্রণে সমস্ত পদার্থ নির্মিত হইয়াছিল [ছাং|৬|২-৬] । উপরোক্ত বর্ণনাসমূহে অনেক ভিন্নতা থাকিলেও পরিশেষে বেদান্তে স্থিরীকৃত হইয়াছে যে [বেসূ|২|৩|১-১৫], আত্মরূপী মূল ব্ৰহ্ম হইতেই আকাশাদিক্ৰমে পঞ্চমহাভূত নিঃসৃত হইয়াছে [তৈ|উ|২|১], কঠ [৩|১১], মৈত্রায়ণী [৬|১০], শ্বেতাশ্বর [৪|১০; ৬|১৬], প্রভৃতি উপনিষদেও, প্ৰকৃতি মহৎ ইত্যাদি তত্ত্বেরও স্পষ্ট উল্লেখ আছে । ইহা হইতে দেখা যাইতেছে যে, বেদান্তী প্ৰকৃতিকে স্বতন্ত্র বলিয়া স্বীকার না করিলেও, একবার যখন শুদ্ধ ব্ৰহ্মেতেই মায়াত্মক প্ৰকৃতিরূপ বিকার প্রকাশ পায়, তখন পরে সৃষ্টির উৎপত্তিক্রমসম্বন্ধে তাহার ও সাংখ্যবাদীর পরিণাম একবাক্যতা হইয়া গিয়াছে, এবং এই কারণেই মহাভারতে উক্ত হইয়াছে [শাং|৩০১|১০৮|১০৯] । “ইতিহাস, পুরাণ অর্থশাস্ত্ৰ প্ৰভৃতিতে যে কিছু জ্ঞান আছে সে সমস্ত সাংখ্য হইতেই আসিয়াছে” - কপিল হইতে এই জ্ঞান বেদান্তীরা কিংবা পৌরাণিকেরা গ্ৰহণ করিয়াছে এরূপ তাহার অর্থ নহে; কিন্তু সৃষ্টির উৎপত্তিক্রমের জ্ঞান সর্বত্রই এক প্ৰকার, এই অর্থই এখানে অভিপ্ৰেত । কেবল তাহাই নহে, ‘জ্ঞান’ এই ব্যাপক অর্থেই, এই স্থানে ‘সাংখ্য’ শব্দ প্রয়োগ করা হইয়াছে, এ কথা বলিলেও চলে । কপিলাচাৰ্য শাস্ত্রদৃষ্টিতে সৃষ্টির উৎপত্তিক্রম বিশেষ পদ্ধতিসহকারে বিবৃত করিয়াছেন, এবং ভগবদ্‌গীতাতেও এই সাংখ্যক্রম মুখ্যরূপে স্বীকৃত হওয়ায়, এই প্রকরণে তাহারই বিচার করা হইয়াছে ।


3) আধুনিক উৎক্রান্তিবাদের সহিত সাংখ্যের গুণোৎকর্ষতত্ত্বের সাম্য


ইন্দ্রিয়ের অগোচর অর্থাৎ অব্যক্ত, সূক্ষ্ম একবস্তুমাত্র এবং চারিদিকে অখণ্ডরূপে পরিপূর্ণ এক নিরবয়ব মূল দ্রব্য হইতে সমস্ত ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে, সাংখ্যদিগের এই সিদ্ধান্ত পাশ্চাত্যদেশের অর্বাচীন আধিভৌতিক শাস্ত্ৰজ্ঞদিগের শুধু গ্ৰাহ্য নহে, পরন্তু এই মূল দ্রব্যের অন্তৰ্ভুত শক্তির ক্রমশ বিকাশ হইয়া আসিতেছে এবং এই পূর্বাপর ক্রম কিংবা ধারা ছাড়িয়া মাঝখানে উপরি-পড়ার মতন হঠাৎ কিছুই নির্মাণ হয় নাই, ইহাও তাঁহারা এক্ষণে স্থির করিয়াছেন । এই মতকে উৎক্রান্তিবাদ বা বিকাশ-সিদ্ধান্ত বলে । এই সিদ্ধান্ত পাশ্চাত্যরাষ্ট্রে বিগত শতাব্দীতে যখন প্ৰথম আবিষ্কৃত হইল, তখন সেখানে খুব গোলযোগ বাধিয়া গিয়াছিল । খৃষ্টধর্মের পুস্তকসমূহে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, ঈশ্বর পঞ্চ মহাভূত ও জঙ্গমশ্রেণীর প্রত্যেক জাতীয় প্ৰাণীকে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পৃথক পৃথক ও স্বতন্ত্ৰভাবে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং এই মতই উৎক্রান্তিবাদ বাহির হহবার পূর্বে সমস্ত খৃষ্টানমণ্ডলী সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিত । তাই, যখন উৎক্রান্তিবাদ এই সিদ্ধান্তকে মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন করিল তখন চারিদিক হইতে উৎক্রান্তিবাদের উপর আক্ৰমণ আরম্ভ হইল এবং অদ্যাপি ঐ আক্রমণ অল্পবিস্তর চলিতেছে । তথাপি বৈজ্ঞানিক সত্যের বল অধিক হওয়ায়, সৃষ্টির উৎপত্তিসম্বন্ধে উৎক্রান্তি মতটাই সমস্ত বিদ্বানের নিকট এক্ষণে গ্ৰাহ্য হইতে চলিয়াছে । এই মতানুসারে সৌর জগতে প্ৰথমে একই বস্তুসার সূক্ষ্ম দ্রব্য ভরিয়াছিল; উহার গতি বা উষ্ণতার পরিমাণ ক্ৰমে ক্ৰমে কমিতে লাগিল; তখন উক্ত দ্রব্যের অধিকাধিক সঙ্কোচ হইয়া পৃথ্বীসমেত সমস্ত গ্ৰহ ক্ৰমে ক্ৰমে সৃষ্ট হইল এবং সূর্যই শেষ অবশিষ্ট অংশ রহিল । পৃথিবীও সূর্যের ন্যায় প্ৰথমে এক উষ্ণ গোলক ছিল; কিন্তু যেখানে যেখানে তাহার উষ্ণতা কম হইতে লাগিল সেইখানে সেইখানেই মূল দ্রব্যসমূহের কোন দ্রব্য পাতলা ছিল এবং কোন দ্রব্য ঘন হইয়া, পৃথিবীর উপর বায়ু ও জল এবং তাহার নীচে পৃথিবীর কঠিন জড় গোলার সৃষ্টি হইল; এবং পরে, এই সকল বস্তুর সংমিশ্রণে বা সংযোগে সমস্ত সজীব ও নির্জীব সৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে । এই প্রকারে ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্যও ক্রমে ক্ৰমে বৃদ্ধি পাইয়া বৰ্তমান অবস্থায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে ডার্বিনপ্রভৃতি পণ্ডিতেরা এইরূপ প্রতিদিন করিয়াছেন । 


3.1) আধিভৌতিকবাদী ও অধ্যাত্মবাদীর মধ্যে মতভেদ


তথাপি আত্মা বলিয়া মূলে পৃথক কোন তত্ত্ব স্বীকার করা যাইবে কি, যাইবে না, এই সম্বন্ধে আধিভৌতিকবাদী ও অধ্যাত্মবাদীর মধ্যে এখনও অনেক মতভেদ আছে । হেকেল প্রভৃতি কোন কোন পণ্ডিত জড় হইতেই বাড়িতে বাড়িতে আত্মা ও চৈতন্য উৎপন্ন হইয়াছে এইরূপ স্বীকার করিয়া জড়াদ্বৈত প্ৰতিপাদন করেন; এবং ইহার বিপরীতে ক্যাণ্ট প্রভৃতি অধ্যাত্মজ্ঞানী বলেন যে, জগৎসম্বন্ধে আমাদের যে জ্ঞান তাহা আমাদের আত্মার একীকরণ ব্যাপারের ফল হওয়ায় আত্মাকে এক স্বতন্ত্র তত্ত্ব বলিয়া মানিতে হয় । কারণ, বাহ্য জগতের জ্ঞাতা যে আত্মা সেই আত্মা স্বতঃ গোচরীভূত জগতের এক ভাগ কিংবা এই বাহ্য জগৎ হইতেই তাহা উৎপন্ন হইয়াছে এই কথা বলা, - “আপন স্কন্ধের উপরে আপনি বসিতে পারি” - এই কথার ন্যায় তর্কদৃষ্টিতে অসম্ভব । এই কারণেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই দুই স্বতন্ত্র তত্ত্ব স্বীকৃত হইয়াছে । সারকথা এই যে, আধিভৌতিক জগৎজ্ঞান যতই বাড়ুক না কেন, জাগতিক মূলতত্ত্বের স্বরূপের বিচার সর্বদাই বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসারেই করিতে হইবে, অদ্যাপি পাশ্চাত্য দেশের অনেক বড় বড় পণ্ডিত ইহা প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । কিন্তু এক জড় প্রকৃতি হইতে পরে সমস্ত ব্যক্ত পদাৰ্থ কি ক্রম-অনুসারে নিঃসৃত হইয়াছে, ইহা বিচার করিয়া দেখিলে, পাশ্চাত্য উৎক্রান্তিমত ও সাংখশাস্ত্ৰে বৰ্ণিত প্ৰকৃতির প্রপঞ্চতত্ত্ব, এই উভয়ের মধ্যে বিশেষ কোন ভেদ উপলব্ধ হইবে না । কারণ, অব্যক্ত, সূক্ষ্ম ও একবস্তুসার মূল প্ৰকৃতি হইতেই ক্ৰমে ক্ৰমে (সূক্ষ্ম ও স্থুল) বস্তুবহুল ব্যক্ত জগৎ নির্মাণ হইয়াছে, এই মুখ্য সিদ্ধান্ত উভয়েরই সমান সম্মত । কিন্তু আধিভৌতিক শাস্ত্রের জ্ঞান এক্ষণে অত্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ায় সাংখ্যদিগের “সত্ত্ব, রজ, তম” এই তিন গুণের বদলে অর্বাচীন সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞগণ গতি, উষ্ণতা ও আকর্ষণশক্তিকেই প্ৰধান গুণ বলিয়া ধরিয়াছেন । এ কথা সত্য যে, সত্ত্ব, রজ ও তম এই ত্ৰিগুণের ন্যূনাধিক্যের পরিমাণ অপেক্ষা উষ্ণতা কিংবা আকর্ষণশক্তির ন্যূনাধিক্যের ধারণা আধিভৌতিকশাস্ত্রদৃষ্টিতে অপেক্ষাকৃত শীঘ্ৰ বোধগম্য হয় । তথাপি “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” [গী|৩|২৮] এইরূপ যে গুণত্রয়ের বিকাশ কিংবা গুণোৎকর্ষের তত্ত্ব তাহা উভয়দিকেই এক । ঘড়ির পাখা বন্ধ হইয়া গেলে তাহা যেরূপ আস্তে আস্তে খোলা যায়, সেইরূপ সত্ত্ব, রজ ও তম ইহাদের সাম্যাবস্থা হইলে প্রকৃতির ঘড়ি আস্তে আস্তে খুলিয়া চলিতে থাকিলে সমস্ত ব্যক্ত জগৎ সৃষ্টি হয়, ইহাই হইল - সাংখ্যশাস্ত্রের কথা; এই কথায় ও উৎক্রান্তিবাদে বস্তুত কোন ভেদ নাই । তথাপি খৃষ্টধর্মের ন্যায় গুণোৎকর্ষতত্ত্বকে উপেক্ষা না করিয়া গীতাতে এবং অংশত উপনিষদাদি বৈদিক গ্রন্থেও অদ্বৈত বেদান্ত মতের অবিরোধই স্বীকৃত হইয়াছে; এই ভেদ তাত্ত্বিক ধর্মদৃষ্টিতে মনে রাখিবার যোগ্য ।


4) গুণোৎকর্ষের অথবা গুণ-পরিণামবাদের নিরুপণ



4.1) ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধির উৎপত্তি


ভাল, প্ৰকৃতি-কলিকা-বিকাশের ক্রমসম্বন্ধে সাংখ্যকারের কি মত এখন দেখা যাক্‌ । এই ক্রমকেই গুণোৎকর্ষ কিংবা গুণপরিণামবাদ বলে কোনও কাজ করিবার পূর্বে মনুষ্য উক্ত কাজ করিবে বলিয়া আপন বুদ্ধির দ্বারা নিশ্চয় করিয়া থাকে, কিংবা তাহা করিবার বুদ্ধি বা সঙ্কল্প তাহার প্রথমে হওয়া চাই, ইহা আর কাহাকেও বলিতে হইবে না । অধিক কি, উপনিষদেও এইরূপ বর্ণনা আছে যে, মূল এক পরমাত্মারও “আমি বহু হইব” - এই বুদ্ধি বা সঙ্কল্প হইবার পর, জগৎ উৎপন্ন হইল [ছাং|৬|২|৩; তৈ|২|৩] । এই ন্যায় অনুসারে অব্যক্ত প্রকৃতিও আপনা হইতেই সাম্যাবস্থা ভাঙ্গিয়া পরে ব্যক্ত জগৎ নির্মাণ করিবে বলিয়া নিশ্চয় করে । নিশ্চয় অর্থাৎ ব্যবসায় এবং তাহা করা বুদ্ধিরই লক্ষণ । তাই প্ৰকৃতিতে ব্যবসায়াত্মিক বুদ্ধিরূপ গুণ প্ৰথমে উৎপন্ন হয়, এইরূপ সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন । সারকথা, এই যে মনুষ্যের যেরূপ কোন কার্য করিবার বুদ্ধি প্রথমে হয়, সেইরূপ প্রকৃতিরও স্বকীয় বিস্তার করিবার বুদ্ধি প্ৰথমে হওয়া চাই । কিন্তু মনুষ্যপ্ৰাণী সচেতন হওয়া প্ৰযুক্ত, অর্থাৎ সেই স্থলে প্ৰকৃতির বুদ্ধির সহিত সচেতন পুরুষের (আত্মার) সংযোগ প্ৰযুক্ত, মনুষ্যের ব্যবসায়াত্মিক বুদ্ধি মনুষ্য বুঝে, এবং প্রকৃতি স্বয়ং অচেতন অর্থাৎ জড় হওয়া প্ৰযুক্ত, তাহার নিজের বুদ্ধির কোন জ্ঞান থাকে না । এই দুয়ের মধ্যে বিলক্ষণ পার্থক্য আছে । এই পার্থক্য, পুরুষের সংযোগ দ্বারা প্ৰকৃতিতে উৎপন্ন চৈতন্যপ্রযুক্ত হইয়া থাকে; তাহা শুধু জড় বা অচেতন প্ৰকৃতির গুণ নহে । মানবী ইচ্ছার অনুরূপ কিন্তু অস্বয়ংবেদ্যশক্তি জড়পদার্থেও আছে এইরূপ না মানিলে গুরুত্বাকর্ষণ কিংবা রসায়নক্রিয়ার বা লৌহচুম্বকের আকর্ষণ ও বিকর্ষণ ইত্যাদি গুণসকল কেবল জড় জগতের স্বেচ্ছানির্বাচনের কার্য এ যুক্তি খাটে না । এই কথা অর্বাচীন আধিভৌতিক সূষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞও এক্ষণে বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন । * 
*(Without the assumption of an atomic soul the commonest and the most general phenomena of chemistry are inexplicable. Pleasure and pain, desire and aversion, attraction and repulsion must be common to all atoms of an aggregate; for the movements of atoms which must take place in the formation and dissolution of a chemical compound can be explained only by attributing to them Sensation and Will” - Haeckel in the "Perigenesis of the Plastidule" cited in Martineau’s Types of Ethical Theory, Vol II, P. 399, 3rd Ed.

Haeckel himself explains this statement as follows : “I explicitly stated that I conceived the elementary psychic qualities of sensation and will which may be attributed to atoms, to be unconscious - just as unconscious as the elementary memory, which I in common with the distinguished psychologist Ewald Hering consider to be a common function of all organised matter, or more correctly the living substances” - The Riddle of the Universe, Chap. IX. P. 63, R. P. A. Cheap. Ed.)

আধুনিক সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞদিগের এই মতের প্রতি লক্ষ্য করিলে, প্ৰকৃতিতে প্ৰথম বুদ্ধি উৎপন্ন হয়, সাংখ্যের এই সিদ্ধান্তে আশ্চর্য হইবার কোন কারণ থাকিবে না । প্রকৃতির মধ্যে প্রথম উৎপন্ন এই গুণকে ইচ্ছা হয় তো অচেতন বা অস্বয়ংবেদ্য বা আপনাকে আপনি জানিতে অক্ষম বল, - যাহাই বল না কেন, মনুষ্যের বুদ্ধি ও প্ৰকৃতির বুদ্ধি, এ উভয়ই মূলে সে একই বর্গের অন্তভূর্ক্ত তাহা সুস্পষ্ট; এবং সেইজন্য উহাদের ব্যাখ্যাও, উভয়স্থলে একই প্রকার করা হইয়াছে । এই বুদ্ধিরই – ‘মহৎ, জ্ঞান, মতি, আসুরী, প্ৰজ্ঞা, খ্যাতি,’ প্রভৃতি অন্য নামও আছে । অনুমান হয় যে, তন্মধ্যে মহৎ (পুংলিঙ্গী প্রথমার একবচন মহান্‌ - বড়) এই নাম, প্ৰকৃতি এক্ষণে বড় হওয়ায় তাহার প্রতি প্ৰযুক্ত হইয়াছে কিংবা এই গুণের শ্রেষ্ঠত্ত প্ৰযুক্ত এই নাম দেওয়া হইয়াছে । প্রকৃতির মধ্যে প্রথম উৎপন্ন মহান্‌ কিংবা বুদ্ধিগুণ সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিনের মিশ্রণেরই পরিণাম হওয়ায়, প্রকৃতির এই বুদ্ধি দেখিতে এক হইলেও পরে উহা অনেক প্রকারের হইতে পারে । কারণ, এই সত্ত্ব, রজ ও তম গুণ প্ৰথম দৃষ্টিতে তিন হইলেও বিচারদৃষ্টিতে প্ৰতীত হয় যে, উহাদের মিশ্রণে প্ৰত্যেকের পরিমাণ অনন্তরূপে ভিন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত এই তিন হইতেই প্ৰত্যেকগুণের অনন্ত ভিন্ন পরিমাণে উৎপন্ন বুদ্ধির প্রকারও তিন গুণ অনন্ত হইতে পারে । অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে উৎপন্ন এই বুদ্ধিও প্রকৃতির ন্যায় সূক্ষ্ম । কিন্তু পূৰ্বপ্রকরণে ব্যক্ত ও অব্যক্ত, সূক্ষ্ম ও স্থূল, ইহাদের যে অর্থ বলা হইয়াছে, তদনুসারে এই বুদ্ধি প্ৰকৃতির ন্যায় সূক্ষ্ম হইলেও প্রকৃতির ন্যায় অব্যক্ত নহে - তাহা মনুষ্যের জ্ঞানগম্য হইতে পারে । তাই, এক্ষণে সিদ্ধ হইল যে, ‘ব্যক্ত’ এই মনুষ্যগোচর বৃহৎ পদাৰ্থবর্গের মধ্যে বুদ্ধির সমাবেশ হয়; এবং শুধু বুদ্ধি নহে, বুদ্ধির পরে, প্ৰকৃতির সমস্ত বিকারই সাংখ্যশাস্ত্ৰে ব্যক্ত বলিয়াই স্বীকৃত হয় । এক মূল প্রকৃতি ব্যতীত কোন তত্ত্বই অব্যক্ত নহে ।


4.2) অহঙ্কারের উৎপত্তি


অব্যক্ত প্ৰকৃতির মধ্যে এই প্রকারে ব্যক্ত ব্যবসায়াত্মিক বুদ্ধি উৎপন্ন হইলেও প্রকৃতি এখনও এক বস্তুসারই রহিয়াছে । এই এক বস্তুপরতা ভাঙ্গিয়া বস্তুপরতা উৎপন্ন হওয়াকেই ‘পৃথকত্ব’ বলে । উদাহরণ যথা - পারা জমির উপর পড়িয়া ছোট ছোট গোলায় পরিণত হওয়া । বুদ্ধির পর, এই পৃথকত্ব বা বহুত্ব উৎপন্ন না হইলে একই প্রকৃতির অনেক পদার্থ হওয়া সম্ভব নহে । বুদ্ধির পরে উৎপন্ন পৃথকত্ব গুণকেই ‘অহঙ্কার’ বলে কারণ, পৃথকত্ব ‘আমি-তুমি’ এই সকল শব্দের দ্বারাই প্ৰথমে ব্যক্ত করা হইয়া থাকে; এবং ‘আমি-তুমি’র অর্থই অহংকার, - অহং অহং (আমি আমি) করা । প্রকৃতির মধ্যে উৎপন্ন অহঙ্কার গুণকে ইচ্ছা হয় তো অ-স্বয়ংবেদ্য বা আপনাকে আপনি জানিতে অসমৰ্থ বল । কিন্তু মনুষ্যে প্ৰকটীভূত অহঙ্কার এবং যে অহঙ্কার প্রযুক্ত গাছ, পাথর, জল কিংবা ভিন্ন ভিন্ন মূল পরমাণু একবস্তসার প্রকৃতি হইতে নির্মিত হয়, ইহাদের জাতি একই । প্ৰভেদ এই যে, পাথরের চৈতন্য না থাকায় তাহার ‘অহং'এর জ্ঞান হয় না এবং মুখ না থাকায় ‘আমি পৃথক্‌ তুমি পৃথক্‌’ এইরূপ স্বাভিমানসহকারে সে নিজের পার্থক্য অন্যকে বলিতে পারে না । অন্য হইতে পৃথকরূপে থাকিবার তত্ত্ব অৰ্থাৎ অভিমানের কিংবা অহঙ্কারের তত্ত্ব সকল স্থানেই এক । এই অহঙ্কারকেই তৈজস, অভিমান, ভুতাদি, ধাতুপ্রভৃতিও বলা যায় । অহঙ্কার বুদ্ধিরই এক উপভেদ হওয়া প্ৰযুক্ত বুদ্ধি না হইলে অহঙ্কার উৎপন্ন হইতে পারে না । তাই অহঙ্কার অন্য একটী গুণ অর্থাৎ বুদ্ধির পরবর্তী এক গুণ ইহা সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন । সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক-ভেদে বুদ্ধির ন্যায় অহঙ্কারেরও অনন্ত প্রকার হইয়া থাকে ইহা বলা বাহুল্য । এই প্রকারে পরবর্তী গুণসমূহেরও প্ৰত্যেকের তিন-গুণ অনন্তম্ভেদ । অধিক কি, ব্যক্ত জগতে প্ৰত্যেক বস্তুর এইরূপ অনন্ত সাত্ত্বিক রাজসিক ও তামসিক ভেদ হইয়া থাকে; এবং এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করিয়াই গীতাতে গুণত্রয়-বিভাগ ও শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ উক্ত হইয়াছে [গী|অ|১৪ ও ১৭]


4.3) সেন্দ্ৰিয় এগারো তত্ত্বের ও নিরিন্দ্রিয় পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি


ব্যবসায়িক বুদ্ধি ও অহঙ্কার এই দুই ব্যক্ত গুণ, মূল সাম্যাবস্থা প্ৰকৃতিতে উৎপন্ন হইলে প্ৰকৃতির একত্ব ভাঙ্গিয়া গিয়া, তাহার অনেক পদার্থ নির্মাণের সূত্রপাত হয় । তথাপি তাহার সূক্ষ্মত্ব অদ্যাপি বজায় আছে । অর্থাৎ নৈয়ায়িকদিগের সূক্ষ্ম পরমাণু এক্ষণে আরম্ভ হয়, এইরূপ বলিলেও চলে । কারণ অহঙ্কার উৎপন্ন হইবার পূর্বে প্রকৃতি অখণ্ড ও নিরবয়ব ছিল । নিছক্‌ বুদ্ধি ও নিছক্‌ অহঙ্কার - বস্তুতঃ দেখিতে গেলে ইহারা কেবল গুণ । তাই, প্ৰকৃতির দ্রব্য হইতে উহারা পৃথক থাকে, উপরি-উক্ত সিদ্ধান্তের এরূপ অর্থ গ্ৰহণ করিতে হইবে না । আসল কথা এই যে, যখন মূল ও নিরবয়ব একই প্রকৃতিতে এই গুণগুলি উৎপন্ন হয়, তখন উহারই বিবিধ ও সাবয়ব-দ্রব্যাত্মক ব্যক্ত রূপ উৎপন্ন হয় । এইপ্ৰকার যখন মূল প্ৰকৃতিতে অহঙ্কারের ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ নির্মাণ করিবার শক্তি আসে তখন পরে উহার বৃদ্ধি দুই শাখায় বিভক্ত হয় । এক শাখা, মনুষ্যপ্ৰভৃতি সেন্দ্ৰিয় প্রাণীগণের সৃষ্টি; এবং দ্বিতীয়, নিরিন্দ্রিয় পদার্থের সৃষ্টি । এই স্থানে ইন্দ্রিয়শব্দে “ইন্দ্রিয়বান্‌ প্ৰাণীদিগের ইন্দ্রিয়ের শক্তি” এই অর্থই বুঝিতে হইবে । কারণ, সেন্দ্রিয় প্ৰাণীদিগের জড়দেহের সমাবেশ জড়ে অর্থাৎ নিরিন্দ্রিয় সৃষ্টিতে হইয়া থাকে, এবং এই প্ৰাণীদিগের আত্মা ‘পুরুষ’ নামক পৃথক বর্গের ভিতরেই পড়ে । তাই সাংখ্যশাস্ত্রে সেন্দ্রিয় জগতের বিচার করিবার সময় দেহ ও আত্মা ছাড়িয়া কেবল ইন্দ্রিয়েরই বিচার করা হইয়াছে । জগতে সেন্দ্রিয় ও নিরিন্দ্রিয় পদার্থের অতিরিক্ত তৃতীয় পদার্থ থাকা সম্ভব না হওয়ায় অহঙ্কার হইতে দুইয়ের অধিক শাখা বাহির হইতে পারে না ইহা বলিতে হইবে না । তন্মধ্যে নিরিন্দ্রিয় পদার্থ অপেক্ষা ইন্দ্রিয়শক্তি শ্রেষ্ঠ হওয়া, প্ৰযুক্ত ইন্দ্ৰিয়জগতের সাত্ত্বিক অর্থাৎ সত্ত্বগুণের উৎকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন এবং নিরিন্দ্রিয় জগতের তামসিক অর্থাৎ তমোগুণের উৎকর্ষের দ্বারা উৎপন্ন, এইরূপ নাম আছে । সারকথা এই যে, অহঙ্কায় আপন শক্তির দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ উৎপন্ন করিতে আরম্ভ করিলে তাহাতেই এক সময় সত্ত্বগুণের উৎকর্ষ হইয়া একদিকে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয় ও মন মিলিয়া ইন্দ্রিয়জগতের মূলভূত এগারো ইন্দ্ৰিয় এবং অন্যদিকে তমোগুণের উৎকর্ষ হইয়া তাহা হইতে নিরিন্দ্রিয় জগতের মূলভূত পাঁচ তন্মাত্র দ্রব্য উৎপন্ন হয় । কিন্তু প্ৰকৃতির সূক্ষ্মত্ব অদ্যাপি বজায় থাকা প্ৰযুক্ত অহঙ্কার হইতে উৎপন্ন এই ১৬ তত্ত্বও সূক্ষ্ম হইয়াই থাকে । *
*(ইংরাজি ভাষায় এই অর্থই সংক্ষেপে বলিতে হইলে এইরূপ বলিতে হয় -
The Primeval matter (Prakriti) was at first homogeneous. It resolved (Buddhi) to unfold itself, and by the Principle of differentiation (Ahankara) became heterogeneous. It then, branched off into two sections - one organic (Sendriya) and the other inorganic (Nirindriya). There are eleven elements of the organic and five of the inorganic creation. Purusha or the observer is different from all these and falls under none of the above, categories.)


4.4) তন্মাত্র পাঁচই কেন এবং সূক্ষ্মেন্দ্রিয় এগারোই কেন, তাহার নিরুপণ


শব্দ, স্পৰ্শ, রূপ, রস ও গন্ধ - ইহাদের তন্মাত্র, অর্থাৎ মিশ্রণ না হইয়া প্ৰত্যেক গুণের পৃথক পৃথক অতিসূক্ষ্ম মূলস্বরূপ-নিরিন্দ্ৰিয় জগতের মূলতত্ত্ব এবং মনসমেত এগারো ইন্দ্ৰিয় সেন্দ্ৰিয় জগতের বীজ । এই বিষয়ে সাংখ্যশাস্ত্ৰপ্ৰদত্ত উপপত্তি যে, নিরিন্দ্রিয় সৃষ্টির মূলতত্ত্ব পাঁচই বা কেন এবং সেন্দ্ৰিয় সৃষ্টির মূলতত্ত্ব এগারোই বা কেন মানা আবশ্যক হয় তাহা বিচার করিবার যোগ্য বিষয় । অর্বাচীন সৃষ্টিশাস্ত্ৰজ্ঞানী জাগতিক পদার্থের ঘন, তরল ও বায়ুরূপী তিন প্রকার ভেদ করিয়াছেন । কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্ৰে পদার্থসমূহের বর্গীকরণ ইহা হইতে ভিন্ন । সাংখ্য বলেন যে জাগতিক সমস্ত পদার্থের জ্ঞান মনুষ্যের পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা হইয়া থাকে; এবং এই জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের রচনায় এইরূপ কিছু বিশেষত্ব আছে যে, এক ইন্দ্রিয়ের একই গুণ জ্ঞানগোচর হইয়া থাকে । চোখে আঘ্রাণ হয় না, কানেও দেখা যায় না; এবং ত্বকের মিষ্টতিক্ত জ্ঞান হয় না, জিহ্বার শব্দ জ্ঞান হয় না; নাক সাদা-কালো বুঝিতে পারে না । পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয় ও তাহাদের শব্দ, স্পৰ্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পাঁচ বিষয়, এইরূপ যদি স্থির হইয়া থাকে, তবে জগতের সমস্ত গুণ ইহা অপেক্ষা অধিক স্বীকার করিতে পারা যায় না । কারণ, পাঁচ অপেক্ষা অধিক গুণ যদি কল্পনা করাও যায় তাহা হইলে তাহা জানিবার কোন উপায় আমাদের নাই । এই পাঁচ গুণের মধ্যে প্ৰত্যেকের অনেক ভেদ হইতে পারে । উদাহরণ যথা - শব্দ, এই গুণ একই হইলেও ছোট, বড়, কৰ্কশ, ভাঙ্গা চেরা, মধুর কিংবা সঙ্গীতশাস্ত্রের বর্ণনা অনুসারে নিষাদ, গান্ধার, ষড়জ ইত্যাদি অথবা ব্যাকরণশাস্ত্ৰ অনুসারে কণ্ঠ্য, তালব্য, ওষ্ঠ্য প্ৰভৃতি এক শব্দেরই অনেক প্রকার ভেদ হইয়া থাকে । রস কিংবা রুচি, ইহারা বস্তুত এক হইলেও তাহারও মধুর, টক্, নোনতা, ঝাল, তিতো কিংবা কষা ইত্যাদি অনেক ভেদ হইয়া থাকে; এবং রূপ একটি গুণ হইলেও, সাদা, কালো, সবুজ, নীল, হলদে, তাঁবাটে এই প্ৰকার অনেক প্রকারেরও হইয়া থাকে । সেইরূপ আবার মিষ্টতা, এই এক বিশিষ্ট রুচির কথা যদি ধর, তাহাতেও আখের মিষ্টতা ভিন্ন, দুধের ভিন্ন, গুড়ের ভিন্ন, চিনির ভিন্ন, এইরূপ তাহারও আবার অনেক ভেদ আছে; এবং পৃথক পৃথক গুণের ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণ যদি ধর – এই গুণবৈচিত্র অনন্তপ্রকারে অন্ত হইতে পারে । কিন্তু যাহাই হউক না কেন, পদার্থসকলের মূল গুণ পাঁচ অপেক্ষা কখনই অধিক হইতে পারে না । কারণ, ইন্দ্ৰিয় পাঁচই এবং প্ৰত্যেকের এক এক গুণই বোধগম্য হয় । এইজন্য, কেবলমাত্র শব্দগুণের কিংবা কেবলমাত্র স্পর্শগুণের এইরূপ পৃথক্‌ পৃথক্‌ পদার্থ অর্থাৎ অন্য গুণের মিশ্রণরহিত পদার্থ আমাদের নজরে না আসিলেও মূলে কেবলমাত্র শব্দ, কেবলমাত্র স্পৰ্শ, কেবলমাত্র রূপ, কেবলমাত্র রস ও কেবলমাত্ৰ গন্ধ অর্থাৎ শব্দতন্মাত্র, স্পৰ্শতন্মাত্র, রূপতন্মাত্র, রসতন্মাত্র ও গন্ধতন্মাত্র – এইরূপ মূল প্রকৃতির পাঁচ ভিন্ন ভিন্ন সূক্ষ্ম তন্মাত্ৰবিকার কিংবা দ্রব্য অবশ্যই আছে, এইরূপ সাংখ্যেরা স্থির করিয়াছেন । পঞ্চতন্মাত্র কিংবা তাহা হইতে উৎপন্ন পঞ্চ মহাভূত সম্বন্ধে উপনিষৎকারেরা কি বলেন তাহার বিচার পরে করিয়াছি ।


4.5) সূক্ষ্ম সৃষ্টি হইতে স্থুল বিশেষের উৎপত্তি


নিরিন্দ্রিয় জগতের এইপ্ৰকার বিচার করিয়া উহাতে পাঁচটিমাত্ৰ সূক্ষ্ম মূলতত্ত্ব আছে এইরূপ নির্ধারণ করা হইয়াছে । এবং যখন সেন্দ্ৰিয় জগৎ দেখি, তখনও পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয় ও মন - এই এগারোর অধিক ইন্দ্ৰিয় কাহারও নাই এইরূপ প্ৰতীতি হয় । স্থূল দেহে হস্তপদাদি ইন্দ্ৰিয় স্থূল প্ৰতীত হইলেও ইহাদের মধ্যে প্রত্যেকের মূলে কোনপ্রকার সূক্ষ্ম মূলতত্ত্ব না মানিলে ইন্দ্রিয়সমূহের বিভিন্নতার যথোচিত কারণ বুঝা যায় না । পাশ্চাত্য আধিভৌতিক উৎক্রান্তিবাদে এই সম্বন্ধে খুবই আলোচনা হইয়াছে । এই মতে আদিম ক্ষুদ্রতম গোলাকার জন্তুর ত্বকই একমাত্র ইন্দ্ৰিয়; এবং এই ত্বক হইতে অন্য ইন্দ্ৰিয় ক্ৰমে ক্রমে উৎপন্ন হইয়াছে । উদাহরণ যথা - মূল-জন্তুর ত্বকের সহিত আলোকের সংযোগ হইলে পর চোখ হইল ইত্যাদি । আলোকাদির সংযোগে স্থূল ইন্দ্ৰিয়াদির প্ৰাদুর্ভাব হইয়া থাকে, - আধিভৌতিকবাদীদিগের এই তত্ত্ব সাংখ্যদিগেরও গ্ৰাহ্য । মহাভারতে [শাং|২১৩|১৬] সাংখ্যপ্রক্রিয়ানুসারে ইন্দ্রিয়সমূহের আবির্ভাবের এই প্রকার বর্ণনা আছে :- 
শব্দরাগাৎ শ্রোত্রমস্য জায়তে ভাবিতাত্মনঃ ৷
রূপরাগাৎ তথা চক্ষুঃ ঘ্রাণং গন্ধজিঘৃক্ষয়া ॥
অর্থাৎ “প্রাণীর আত্মায় শব্দ শুনিবার ভাবনা হইলে পর কান, রূপ চিনিবার ইচ্ছার চোখ, এবং গন্ধ আঘ্রাণ করিবার বুদ্ধি হইতে নাক উৎপন্ন হয়” । কিন্তু সাংখ্যেরা এইরূপ বলেন যে, ত্বকের আবির্ভাব প্ৰথমে হইলেও মূল-প্রকৃতিতেই যদি ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্ৰিয় উৎপন্ন হইবার নৈসৰ্গিক শক্তি না থাকে, তবে সজীব জগতের অন্তর্ভূত অত্যন্ত ক্ষুদ্র কীটের চর্মের উপর সূর্যালোকের যতই আঘাত বা সংযোগ হউক না, তাহার চোখ – এবং চোখ শরীরের এক বিশিষ্ট অংশ - কোথা হইতে আসিবে ? ডার্বিনের সিদ্ধান্ত এইমাত্র বলে যে, এক চক্ষুযুক্ত এবং দ্বিতীয় চক্ষুহীন – এই দুই প্রাণী সৃষ্ট হইলে পর, জড়জগতের যুঝাযুঝি বা ঝটাপটিতে চক্ষুযুক্ত প্রাণী অধিককাল টিকিয়া থাকে এবং দ্বিতীয় বিনষ্ট হয় । কিন্তু নেত্ৰাদি ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্ৰিয় প্ৰথমে উৎপন্ন কেন হয়, ইহার উপপত্তি পাশ্চাত্য আধিভৌতিক সৃষ্টিশাস্ত্ৰ, বলেন নাই । সাংখ্যদিগের মত এই যে, এই সমস্ত ইন্দ্ৰিয় এক মূল ইন্দ্ৰিয় হইতেই পরম্পরায় উৎপন্ন না হইয়া, অহঙ্কার প্রযুক্তি প্ৰকৃতির বহুত্ব আরম্ভ হইলে পর, প্ৰথমে সেই অহঙ্কার হইতে পাঁচ সূক্ষ্ম কর্মেন্দ্ৰিয়, পাঁচ সূক্ষ্ম জ্ঞানেন্দ্ৰিয় ও মন মিলিয়া এগারো ভিন্ন ভিন্ন শক্তি বা গুণ, মূল প্রকৃতিতেই যুগপৎ স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্ট হইয়া পরে তাহা হইতে স্থূল সেন্দ্ৰিয় জগৎ উৎপন্ন হইয়া থাকে । এই এগারটির মধ্যে মন, জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের যোগে সঙ্কল্পবিকল্পাত্মক কাজ অর্থাৎ জ্ঞানেন্দ্ৰিয় গৃহীত সংস্কারসকলের যোগাযোগ করিয়া বুদ্ধির সম্মুখে নিৰ্গমার্থ স্থাপন করে; এবং কর্মেন্দ্ৰিয়ের যোগে ব্যাকরণাত্মক কাজ অর্থাৎ বুদ্ধিকৃত নির্ণয় কর্মেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা কাজে প্রয়োগ করে - এই প্রকারে উহা উভয়বিধ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন দুই প্রকারের কাজ করিয়া থাকে, ইহা পূর্বে ষষ্ঠ প্রকরণে কথিত হইয়াছে । উপনিষদেও ইন্দ্ৰিসমূহেরই প্ৰাণ এই নাম দেওয়া হয়; এবং সাংখ্যদিগের মতানুসারে উপনিষৎকারদিগেরও এই মত যে, এই প্ৰাণ পঞ্চ মহাভূতাত্মক না হইয়া পরমাত্মা হইতে পৃথক, উৎপন্ন হইয়াছে [মুণ্ড|২|১|৩] । এই প্রাণের অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা উপনিষদে কোথাও সাত, কোথাও দশ, এগার, বার বা তের বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু, উপনিষদের এই সমস্ত বাক্যের একবাক্যতা করিলে ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা এগারই সিদ্ধ হয়, বেদান্তসূত্রের ভিত্তিতে শ্ৰীশঙ্করাচার্য ইহাই স্থির করিয়াছেন [বেসু|শাংভা|২|৪|৫|৬]; এবং গীতাতে “ইন্দ্রিয়াণি দশৈকং চ” [গী|১৩|৫] - ইন্দ্রিয় দশ এবং এক অর্থাৎ এগার - এইরূপ স্পষ্টই উক্ত হইয়াছে । অতএব এই বিষয়ে সাংখ্য ও বেদান্ত এই দুই শাস্ত্ৰেই কোন মতভেদ নাই ।

সাংখ্যদিগের সিদ্ধান্তের সারাংশ এই যে, সেন্দ্ৰিয় জগতের মূলভূত এগায় ইন্দ্ৰিয়াশক্তি বা গুণ সাত্ত্বিক অহংকার হইতে উৎপন্ন হয়; এবং নিরিন্দ্রিয়-জগতের মূলভূত পাঁচ তন্মাত্র দ্রব্য তামস অহঙ্কার হইতে উৎপন্ন হয়; পরে পঞ্চতন্মাত্র দ্রব্য হইতে ক্ৰমান্বয়ে স্থূল পঞ্চমহাভূত (ইহার ‘বিশেষ’ এইরূপ নামও আছে) এবং স্থূল নিরিন্দ্রিয় পদাৰ্থ উৎপন্ন হইয়া থাকে, এবং এই পদার্থসমূহের সহিত যথাসম্ভব এগার সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হইলে সেন্দ্ৰিয় জগৎ সৃষ্ট হয় ।


5) পঁচিশ তত্ত্বের ব্রহ্মাণ্ডবৃক্ষ


সাংখ্যমতে প্ৰকৃতি হইতে আবিভূর্ত তত্ত্বসমূহের ক্রম - যাহার বর্ণনা এতক্ষণ করা হইয়াছে - নিম্নপ্রদত্ত বংশবৃক্ষ হইতে স্পষ্ট দৃষ্ট হইবে –
ব্রহ্মাণ্ডবৃক্ষ

6) সাংখ্যের ব্রহ্মবৃক্ষ এবং গীতার অশ্বত্থ-বৃক্ষ


স্থূল পঞ্চ-মহাভূত ও পুরুষ ধরিয়া সর্ব-সমেত ২৫ তত্ত্ব । ইহার মধ্যে মহান্‌ কিংবা বুদ্ধি হইতে পরবর্তী ২৩ গুণ-মূল প্রকৃতির বিকার । কিন্তু তাহার মধ্যেও এই প্ৰভেদ যে, সূক্ষ্ম তন্মাত্র ও পাঁচ স্থূল মহাভূত, এ সকল দ্রব্যাত্মক বিকার; এবং বুদ্ধি, অহঙ্কার ও ইন্দ্ৰিয়, ইহারা কেবল শক্তি বা গুণ; এই ২৩ তত্ত্ব ব্যক্ত এবং মূল প্রকৃতি অব্যক্ত । এই ২৩ তত্ত্বের মধ্যে সাংখ্য আকাশেই দিক্‌ ও-কালেরও সমাবেশ করিয়া থাকেন । প্রাণকে পৃথক্‌ স্বীকার না করিয়া, যখন সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার শুরু হয় তখন উহাদিগকেই সাংখ্য প্ৰাণ বলেন [সাং|কা|২৯] । কিন্তু বেদান্তী এ মত স্বীকার করেন না, তাঁহারা প্রাণকে স্বতন্ত্র তত্ত্ব বলিয়া বুঝেন [বেসু|২|৪,৯] । ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে যে, সাংখ্যেরা যেরূপ বলেন যে, প্ৰকৃতি ও পুরুষ উভয়ই স্বয়ম্ভূ ও স্বতন্ত্র, বেদান্তীরা তাহা না বলিয়া উভয়কে এক পরমেশ্বরেরই দুই বিভূতি বলিয়া মানিয়া থাকেন । সাংখ্য ও বেদান্ত ইহাদের মধ্যে এই ভেদ বাদে বাকী জগদুৎপত্তিক্রম উভয়েরই গ্রাহ্য । উদাহরণ যথা - মহাভারতের অনুগীতায় ‘ব্ৰহ্মবৃক্ষ’ কিংবা ‘ব্ৰহ্মবন’ - ইহাদের যে দুইবার বর্ণন আছে [মভা|অশ্ব|৩৫|২০-২৩; ৪৭|১২-১৫] তাহা সাংখ্যদিগের তত্ত্ব অবলম্বন করিয়াই করা হইয়াছে - 
অব্যক্তবীজপ্রভবো বুদ্ধিস্কন্ধময়ো মহান্‌ ৷
মহাহংকারবিটপ ইন্দ্ৰিয়ান্তরকোটরঃ ॥
মহাভূতবিশাখশ্চ বিশেষপ্রতিশাখবান্‌ ৷
সদাপর্ণঃ সদাপুস্পঃ শুভাশুভফলোদয়ঃ ॥
আজীব্যঃ সর্বভূতানাং ব্রহ্মবৃক্ষঃ সনাতনঃ ৷
এনং ছিত্বা চ ভিত্ত্বা চ তত্ত্বজ্ঞানাসিনা বুধঃ ॥
হিত্বা সঙ্গময়ান্‌ পাশান্‌ মৃত্যুজন্মজরোদয়ান্‌ ৷
নির্মমো নিরহঙ্কারো মুচ্যতে নাত্ৰ সংশয়ঃ ॥
অর্থাৎ “অব্যক্ত (প্ৰকৃতি) যাহার বীজ, বুদ্ধি (মহান্‌) যাহার স্কন্ধ, অহঙ্কার যাহার মুখ্য পল্লব, মন ও দশ ইন্দ্রিয় যাহার ভিতরকার কোটর, সূক্ষ্ম মহাভূত (পঞ্চতন্মাত্র) যাহার বড় বড় শাখা এবং বিশেষ অর্থাৎ স্থূল মহাভূত যাহার ছোট ছোট ডাল-পালা, এইরূপ সদা-পুষ্পপত্ৰধারী ও শুভাশুভফলধারী, সমস্ত প্ৰাণীমাত্রের আধারভূত পুরাতন বৃহৎ ব্ৰহ্মবৃক্ষ । ইহাকে তত্ত্বজ্ঞানরূপ তরবারির দ্বারা ছেদন করিয়া, ও টুকরা টুকরা করিয়া, জ্ঞানী পুরুষ জন্ম, জরা ও মৃত্যুর সঙ্গময় পাশকে ছিন্ন করিবেন এবং মমত্ববুদ্ধি ও অহঙ্কার ত্যাগ করিবেন, তাহা হইলেই তিনি মুক্ত হইবেন, ইহাতে সংশয়মাত্ৰ নাই ।” সংক্ষেপে এই ব্ৰহ্মবৃক্ষই “সংসারের লীলা” কিংবা প্ৰকৃতির বা মায়ার ‘প্ৰপঞ্চ’ । ইহাকে ‘বৃক্ষ’ বলিবার রীতি বহু প্ৰাচীনকাল - ঋগ্বেদের কাল - হইতেই চলিয়া আসিয়াছে; ইহাকেই উপনিষদে ‘সনাতন অশ্বত্থ বৃক্ষ’ বলা হইয়াছে [কঠ|৬|১] । কিন্তু বেদে এই বৃক্ষের মুল (পরব্রহ্ম) উপরে এবং শাখা (দৃশ্য জগতের বিস্তার) নীচে, এইরূপ বৰ্ণিত হইয়াছে । এই বৈদিক বর্ণনা এবং সাংখ্যদিগের তত্ত্ব, ইহাদিগকে একত্র জুড়িয়া গীতায় অশ্বত্থ বৃক্ষের বর্ণনা রচিত হইয়াছে, ইহা গীতার, ১৫|১ ও ২ শ্লোকসম্বন্ধীয় আমার টীকাতে স্পষ্ট করিয়া দেখান হইয়াছে ।


7) পঁচিশ তত্ত্বের বর্গীকরণ



7.1) সাংখ্যের বর্গীকরণের রীতি


সাংখ্য ও বেদান্তী উপরি-প্রদত্ত পঁচিশ তত্ত্বের ভিন্ন ভিন্ন প্রকারে বৰ্গীকরণ করা প্ৰযুক্ত, এই বৰ্গীকরণ সম্বন্ধেও কিঞ্চিৎ বিবরণ এখানে দেওয়া আবশ্যক । সাংখ্য বলেন যে, এই পঁচিশ তত্ত্বের মূল-প্রকৃতি, প্রকৃতি-বিকৃতি, বিকৃতি এবং অ-প্রকৃতি-অ-বিকৃতি এই চারি বর্গ । (1) প্রকৃতিতত্ত্ব অন্য কাহা হইতে উৎপন্ন হয় নাই বলিয়া উহা মূলপ্রকৃতি এই নাম প্ৰাপ্ত হইয়াছে । (2) এই মূলপ্রকৃতি ছাড়িয়া অন্য ভিত্তির উপর আসিলে “মহান্‌” তত্ত্বের সন্ধান পাওয়া যায় । এই মহান্‌ তত্ত্ব প্রকৃতি হইতে নিঃসৃত বলিয়া ‘মহান্‌’ অহঙ্কারের প্রকৃতি বা মূল । এই প্রকারে মহান্‌ অথবা বুদ্ধি একপক্ষে অহঙ্কারের প্রকৃতি বা মূল; এবং অন্যপক্ষে মূল প্রকৃতির বিকৃতি কিংবা বিকার । তাই সাংখ্যেরা তাহাকে ‘প্রকৃতি-বিকৃতি এই বর্গের মধ্যে ফেলিয়াছে; এবং এই ন্যায়-অনুসারে অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্ৰ, ইহাদের সমাবেশও ‘প্ৰকৃতি-বিকৃতি’ এই বর্গের মধ্যেই করিতে পারা যায় । যে তত্ত্ব বা গুণ স্বয়ং অন্য হইতে নিঃসৃত (বিকৃতি) হইবার পরে নিজেই অন্য তত্ত্বের মূলভূত (প্রকৃতি) হয়, তাহাকে ‘প্রকৃতি-বিকৃতি’ বলা যায় । এই বর্গের সাত তত্ত্ব – মহান্‌, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র । (3) কিন্তু পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয়, পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয়, মন এবং স্থূল পঞ্চ মহাভূত এই ষোল তত্ত্ব হইতে পরে অন্য কোন তত্ত্বই নিঃসৃত হয় নাই । উল্টা, তাহাই অন্য তত্ত্ব হইতে নিঃসৃত হইয়াছে । তাই, এই ষোল তত্ত্বকে ‘প্রকৃতি-বিকৃতি’ না বলিয়া কেবল ‘বিকৃতি’ কিংবা ‘বিকার’ বলা হয় । (4) পুরুষ প্ৰকৃতিও নহে এবং বিকৃতিও নহে; উহা স্বতন্ত্র ও উদাসীন দ্রষ্টা । ঈশ্বরকৃষ্ণ এইরূপ বর্গীকরণ করিয়া আবার উহার এইরূপে স্পষ্টীকরণ করিয়াছেন :-
মূলপ্ৰকৃতিরবিকৃতিঃ মহদাদ্যাঃ প্রকৃতি-বিকৃতয়ঃ সপ্ত ৷
ষোড়শকন্তু বিকারো ন প্ৰকৃতি র্ন বিকৃতিঃ পুরুষঃ ॥
অর্থাৎ - “এই মূল প্ৰকৃতি অবিকৃতি অর্থাৎ কোনরূপ বিকার নহে । মহদাদি সাত (অর্থাৎ মহৎ, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র) তত্ত্ব প্ৰকৃতি-বিকৃতি; এবং মনসমেত এগার ইন্দ্ৰিয় ও স্থূল পঞ্চ মহাভূত মিলাইয়া ষোল তত্ত্বকে শুধু বিকৃতি কিংবা বিকার বলা হয় । পুরুষ প্ৰকৃতি নহে এবং বিকৃতিও নহে” [সাং|কা|৩] । পরে এই পঞ্চবিংশ তত্ত্বের আবার অব্যক্ত, ব্যক্তজ্ঞ এই তিন ভেদ করা হইয়াছে । তন্মধ্যে এক মূল প্রকৃতিই অব্যক্ত, প্ৰকৃতি হইতে উৎপন্ন তেইশ তত্ত্ব ব্যক্ত, এবং পুরুষ জ্ঞ । সাংখ্যদিগের বর্গীকরণের ইহাই ভেদ । পুরাণ, স্মৃতি, মহাভারত প্রভৃতি বৈদিকমার্গীয় গ্ৰন্থসমূহে প্ৰায় এই পঁচিশ তত্ত্বই কথিত হইয়া থাকে [মৈক্র্য|৬|১০; মনু|১|১৪|১৫ দেখ] । কিন্তু উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে যে, এই সমস্ত তত্ত্ব পরব্রহ্ম হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; কিন্তু তাহাতে উহাদের বিশেষ বিচার বা বর্গীকরণও করা হয় নাই । উপনিষদের পরবর্তী গ্রন্থাদিতে মাত্র উহাদের বর্গীকরণ করা হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায় । কিন্তু উপরিউক্ত সাংখ্যদিগের বর্গীকরণ হইতে তাহা ভিন্ন । সমস্ত ধরিয়া পঁচিশ তত্ত্ব; তন্মধ্যে ষোল তত্ত্ব (11 ইন্দ্রিয় + 5 মহাভূত) সাংখ্য মতানুসারেই স্পষ্টই অন্য তত্ত্ব হইতে উৎপন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত বিকার বলিয়া তাহাকে প্রকৃতি কিংবা মূলভূত পদার্থ বর্গের মধ্যে ধরা হয় নাই । বাকী নয় তত্ত্ব অবশিষ্ট রহিল – (1)পুরুষ, (2)প্রকৃতি, (3)মহৎ, (4)অহঙ্কার, ও (5-9) পাঁচ তন্মাত্র । ইহার মধ্যে পুরুষ ও প্রকৃতিকে ছাড়িয়া, দিয়া, সাংখ্য বাকী সাতকে প্ৰকৃতি-বিকৃতি বলেন । 


7.2) বেদান্তীদিগের ও গীতার বর্গীকরণের রীতি


কিন্তু বেদান্তশাস্ত্ৰে প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র স্বীকৃত হয় না; এক পরমেশ্বর হইতেই পুরুষ ও প্রকৃতি উৎপন্ন হয় এই রূপ তাঁহাদের সিদ্ধান্ত । এই সিদ্ধান্ত স্বীকার করিলে মূলপ্রকৃতি ও প্রকৃতি-বিকৃতি, এই যে ভেদ সাংখ্য করেন তাহার অবকাশ থাকে না । কারণ, প্রকৃতিও পরমেশ্বর হইতে উৎপন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত তাহাকে মূল বলা যাইতে পারে না, তাহা প্রকৃতি-বিকৃতির বর্গের মধ্যেই আইসে । তাই সৃষ্টি উৎপত্তি বৰ্ণনা করিবার সময় বেদান্তী বলেন যে, এক পরমেশ্বর হইতেই এক পক্ষে জীব ও অন্য পক্ষে (মহদাদি সাত প্ৰকৃতি-বিকৃতিসহ) অষ্টধা অর্থাৎ আট প্রকারের প্রকৃতি নির্মিত হইয়াছে [মভা|শাং|৩০৬|২৯ ও ৩১০|১০ দেখ] । অর্থাৎ বেদান্তীদিগের মতে পঁচিশ তত্ত্বের মধ্যে ষোল তত্ত্ব ছাড়িয়া দিয়া বাকী নয় তত্ত্বের ‘জীব’ ও ‘অষ্টধা প্ৰকৃতি’ এই দুই প্ৰকার বর্গীকরণই হইয়া থাকে । বেদান্তীদিগের এই বৰ্গীকরণ ভগবদ্‌গীতাতে স্বীকৃত হইয়াছে । কিন্তু ইহাতেও শেষে একটু পার্থক্য ঘটিয়াছে । সাংখ্য যাহাকে পুরুষ বলেন তাহাকেই গীতায় জীব বলা হয়; এবং জীবই ঈশ্বরের পরা প্ৰকৃতি অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ স্বরূপ এইরূপ উক্ত হইয়াছে, এবং সাংখ্য যাহাকে মূল প্রকৃতি বলেন তাহাকেই গীতাতে পরমেশ্বরের ‘অপর’ অর্থাৎ কনিষ্ঠ স্বরূপ বলা হইয়াছে [গী|৭|৪,৫] । এই প্রকার প্রথমে দুই বৃহৎ বর্গ করিবার পর, উহার মধ্যে দ্বিতীয় বর্গের অর্থাৎ কনিষ্ঠ স্বরূপের পরবর্তী ভেদ কিংবা প্রকার যেখানে বলতে হইবে সেখানে এই কনিষ্ট স্বরূপের অতিরিক্ত ও তাহা হইতে নিঃসৃত বাকী তত্ত্ব বিবৃত করা আবশ্যক । কারণ, এই কনিষ্ঠ স্বরূপ (অৰ্থাৎ সাংখ্যদিদের মূলপ্রকৃতি) স্বয়ং আপনারই এক প্রকার বা ভেদ হইতে পারে না । উদাহরণ যথা, বাপের কত ছেলে যখন বলিতে হয় তখন তাহার মধ্যে বাপকে গণনা করা যাইতে পারে না । তাই, পরমেশ্বরের কনিষ্ঠ স্বরূপের ভেদ কত হইয়াছে তাহা বলিবার সময় বেদান্তীরা অষ্টধা প্রকৃতির মধ্যে মূলপ্রকৃতিকে ছাড়িয়া দেওয়ায় বাকী মহান্‌, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র এই সাতটী সেই মূলপ্রকৃতির ভেদ কিংবা প্রকার বলিতে হয় । কিন্তু এইরূপ করিলে পরমেশ্বরের কনিষ্ঠ স্বরূপ বা মূল প্রকৃতি সাত প্ৰকার বলিতে হয়; এবং উপরে বলা হইয়াছে যে, বেদান্তী প্ৰকৃতিকে অষ্টধা অর্থাৎ আট প্রকারের বলিয়া স্বীকার করেন । বেদান্তী যে প্ৰকৃতিকে আট প্রকারের বলেন, গীতা কি তাহাকেই সাত প্ৰকারের বলেন - এই স্থানে এই বিরোধ দেখা যায় । এই বিরোধ না রাখিয়া ‘অষ্টধা প্ৰকৃতি’র বর্ণনাকেই বজায় রাখা গীতার অভীষ্ট । তাই মহান্‌, অহঙ্কার ও পঞ্চতন্মাত্র এই সাতের মধ্যেই অষ্টম তত্ত্ব মনকে পুরিয়া দিয়া পরমেশ্বরের কনিষ্ঠ স্বরূপ অর্থাৎ মূল প্রকৃতিকে অষ্টধা করিয়াই গীতায় বর্ণিত হইয়াছে [গী|৭|৫] । তন্মধ্যে মনের ভিতরেই দশ ইন্দ্রিয়ের এবং পঞ্চতন্মাত্রের মধ্যে পঞ্চ মহাভূতের সমাবেশ করা হইয়াছে । এখন ইহা প্রতীত হইবে যে, গীতার বর্গীকরণ সাংখ্যদিগের ও বেদান্তীদিগের বর্গীকরণ হইতে ভিন্ন দেখিতে হইলেও সমস্ত তত্ত্বগুলির সংখ্যা তৎপ্রযুক্ত ন্যূনাধিক হয় না । স্বীকৃত হইয়াছে, তত্ত্ব সর্বত্র পঞ্চবিংশতিই । তথাপি বর্গীকরণের উক্ত ভিন্নতার কারণে পাছে ভ্ৰমে পড়িতে হয় বলিয়া এই তিন বর্গীকরণ কোষ্টকের আকারে একত্র করিয়া পরে দেওয়া হইয়াছে । গীতার ১৩ অধ্যায়ে [১৩|৫] বৰ্গীকরণের বিষয় বলিবার সময় সাংখ্যদিগের পঁচিশ তত্ত্ব যেমনটি তেমনিই পৃথক্‌ পৃথক্‌ বর্ণিত হইয়াছে; এবং তাহা ধরিয়া বৰ্গীকরণ ভিন্ন হইলেও দুই স্থানেই তত্ত্বসংখ্যা একই - ইহা স্পষ্ট দেখা যায় ।
পঁচিশ তত্ত্বের বর্গীকরণ

8) বেদান্তগ্রন্থে বর্ণিত স্থূল পঞ্চ মহাভুতের উৎপত্তিক্রম


যাক্‌ এই পৰ্যন্ত বিচার করা হইয়াছে যে, মূল সাম্যাবস্থায় অবস্থিত একমাত্র নিরবয়ব অব্যক্ত জড় প্ৰকৃতিতে ব্যক্ত সৃষ্টি উৎপন্ন করিবার অস্বয়ংবেদ্য বুদ্ধি কিরূপে প্রকট হইল; আবার ‘অহঙ্কার’ দ্বারা সেই প্ৰকৃতির মধ্যেই সাবয়ব বহুবস্তুত্ব কিরূপে আসিল; এবং পরে ‘গুণ হইতে গুণ’, এই গুণপরিণামবাদ অনুসারে একপক্ষে সাত্ত্বিক অর্থাৎ সেন্দ্রিয় সৃষ্টির মূলভূত সূক্ষ্ম এগার ইন্দ্রিয় এবং অপর পক্ষে তামসিক অর্থাৎ নিরিন্দ্রিয় সৃষ্টির মূলভূত পাঁচ সূক্ষ্ম তন্মাত্র কিরূপে নির্মিত হইল । এখন ইহার পরবর্তী সৃষ্টি অর্থাৎ স্থূল পঞ্চমহাভূত বা তাহা হইতে উৎপন্ন অন্য জড়পদার্থ কি ক্রম-অনুসারে নির্মিত হইল, তাহার ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । সূক্ষ্ম-তন্মাত্র হইতেই ‘স্থূল পঞ্চ মহাভূত’ অথবা ‘বিশেষ’, গুনপরিণামে উৎপন্ন হইয়াছে, ইহাই সাংখ্যশাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে । কিন্তু বেদান্তশাস্ত্রসম্বন্ধীয় গ্ৰন্থাদিতে এ প্রশ্নের অধিক বিচার করা প্ৰযুক্ত প্রসঙ্গক্রমে তাহারও সংক্ষেপে বর্ণন - এই সুচনারই সঙ্গে ইহা যে বেদান্তশাস্ত্রের মত, সাংখ্যদিগের নহে – করা আবশ্যক মনে হয় । ‘স্থূল পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু ও আকাশ, ইহাদিগকে পঞ্চ মহাভূত বা বিশেষ বলে । ইহাদের উৎপত্তিক্রম তৈত্তিরীয় উপনিষদে এইরূপ প্রদত্ত হইয়াছে যে - “আত্মনঃ আকাশঃ সম্ভূতঃ । আকাশাদ্‌ বায়ুঃ । বায়োরগ্নিঃ । অগ্নেরাপঃ । অদ্ভ্যঃ পৃথিবী । পৃথিব্যা ওষধয়ঃ । ইত্যাদি” [তৈ|উ|২|১] – অর্থাৎ প্ৰথমে পরমাত্মা হইতে (সাংখ্যদের কথামত জড় মূল প্ৰকৃতি হইতে নহে) আকাশ, আকাশ হইতে বায়ু, বায়ু হইতে অগ্নি, অগ্নি হইতে জল এবং জল হইতে পরে পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে । তৈত্তিরীয় উপনিষদে এই ক্রমের কারণ কি তাহা কথিত হয় নাই । কিন্তু উত্তর-বেদান্তগ্রন্থসমূহে পঞ্চমহাভূতের উৎপত্তিক্রমের কারণ-বিচার সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত গুণপরিণামের তত্ত্বের উপরেই করা হইয়াছে দেখা যায় । এই উত্তরবেদান্তীগণ বলেন যে, “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” এই ন্যায় অনুসারে প্রথমে একই গুণের পদার্থ উৎপন্ন হইয়া তাহা হইতে দুই গুণের, তিন গুণের পদার্থ উৎপন্ন হইতে হইতে ক্রমেই বাড়িয়া চলিয়াছে । পঞ্চমহাভূতের মধ্যে আকাশের শব্দ এই একই মুখ্য গুণ থাকা প্ৰযুক্ত আকাশ প্ৰথমে উৎপন্ন হইল । তাহার পর বায়ু; কারণ, বায়ুর শব্দ ও স্পর্শ এই দুই গুণ আছে । বারটা বাজিলে শুধু শোনা যায় নহে, উহা স্পর্শেন্দ্ৰিয়েরও গোচর হয় । বায়ুর পর অগ্নি । কারণ, শব্দ ও স্পর্শ এই দুই ছাড়া অগ্নিতে রূপ, এই তৃতীয় গুণ আছে । এই তিন গুণের সঙ্গেই রুচি বা রস, ইহা জলের চতুর্থ গুণ হওয়া প্ৰযুক্ত অগ্নির পরে জল হওয়া আবশ্যক; এবং শেষে পৃথিবীতে এই চারিগুণ অপেক্ষা গন্ধ এই গুণটি বিশেষ হওয়া প্ৰযুক্ত জল হইতে পরে পৃথিবী উৎপন্ন হইয়াছে এইরূপ সিদ্ধ হয় । যাস্ক এই সিদ্ধান্তই দিয়াছেন [নিরুক্ত|১৪|৪] । 


9) পঞ্চীকরণ ও চুরাশি লক্ষ জীবযোনি


স্থূল পঞ্চ মহাভূত এই ক্ৰম-অনুসারে উৎপন্ন হইলে পর “পৃথিব্যা ওষধয়ঃ । ওষধিভ্যোহন্নম্‌ । অন্নাৎ পুরুষঃ” [তৈ|২|১] । অর্থাৎ - পৃথিবী হইতে বনস্পতি, বনস্পতি হইতে অন্ন, এবং অন্ন হইতে পুরুষ উৎপন্ন হইল, - এইরূপ তৈত্তিরীয়োপনিষদেও পরে বর্ণিত হইয়াছে । এই সৃষ্টি পঞ্চমহাভূতের মিশ্রণে উৎপন্ন হওয়ায় সেই মিশ্ৰণক্রিয়াকে বেদান্তগ্রন্থে ‘পঞ্চীকরণ’ এই নাম প্রদত্ত হইয়াছে । পঞ্চীকরণের অর্থে “পাঁচ মহাভূতের মধ্যে প্রত্যেকের ন্যূনাধিক অংশ লইয়া সেই সমস্তের মিশ্রণে নূতন পদার্থ প্ৰস্তুত হওয়া” । এই পঞ্চীকরণ কাজেই অনেক প্রকারের হইতে পারে । শ্ৰীসমর্থ রামদাস স্বামীদাসবোধ” গ্রন্থে এই কথারই সমর্থন করিয়া বৰ্ণন করিয়াছেন -
কালেঁ পাঁঢরে মেলবিতাঁ । পাববেঁ হোতেঁ তত্ত্বত ।
কালেঁ পিবলেঁ মেলবিতাঁ । হিববেঁ হোয় ॥
অর্থাৎ “কালো ও সাদা মিলিয়া নীল রং হয়, কালো হল্‌দে মিশিয়া সবুজ রং হয় ।” দাসবোধের নবম দশকে [দা|৯|৬|৪০] এইরূপ বলিয়া তেরো দশকে [দা|১৩|৩|১০-১৫]
ত্যা ভূগোরাচে পোটী । অনন্ত বীজাঁচিয়া কোটী ৷
পৃথ্বী মান্যা হোতাঁ ভেটী । অঙ্কুর নিবতী ॥
পৃথ্বী বল্লী নানা রঙ্গ । পত্ৰেঁ পুষ্পাঁচে তরঙ্গ ।
নানা স্বাদ তে মগ । ফলেঁ জালীঁ ॥
* * *
অণ্ডজ, জারজ, স্বেদজ উদ্ভীজ ।
পৃথ্বী পানী সকলাচে বীজ ঐসে হে মরম চীজ । সৃষ্টি বচনেচে ॥
চারি খানী চরি বাণী । 
চৌর‍্যাশী লক্ষ জীব যোনী
নির্মাণ ঝালে লোক তিহ্নী । পিণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ড ॥
অর্থাৎ — সেই ভূগোলের উদরে অনন্ত কোটি বীজ রহিয়াছে । মাটির সহিত মিলন হইয়া অঙ্কুরের উৎপত্তি হয় । পৃথিবীতে লতার নানা রঙ্গ, পত্রপুষ্পের তরঙ্গ । তারপর নানা আস্বাদের নানা ফল । অণ্ডজ, জারজ, স্বেদজ উদ্ভিদ - পৃথ্বী ও জল সকলের বীজ । এই সৃষ্টি-রচনা আশ্চর্য । এই প্রকার চারি খণ্ড, চারি বাণী, চুরাশি লক্ষ * জীবযোনি, তিন লোক, পিণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ড নির্মিত হয় । কিন্তু পঞ্চীকরণের দ্বারা শুধু জড় পদার্থ কিংবা জড় দেহই উৎপন্ন হয় । এই জড় দেহের সচেতন প্ৰাণী হইতে হইলে প্ৰথমে সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়ের সহিত এবং পরে আত্মার সহিত অর্থাৎ পুরুষের সহিত তাহার সংযোগ হওয়া আবশ্যক ইহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না ।
*(চৌরাশী লক্ষ যোনির কল্পনা পৌরাণিক হওয়ায় ইহা আনুমানিক স্পষ্টই দেখা যাইতেছে তথাপি ইহা একেবারেই ভিত্তিহীন নহে । পাশ্চাত্য আধিভৌতিকশাস্ত্রী উৎক্রান্তিবাদ-অনুসারে সৃষ্টির আরম্ভে উৎপন্ন এক ক্ষুদ্র গোল সজীব জন্তু হইতে মনুষ্য প্ৰাণী উৎপন্ন হষ্টয়াছে, এইরূপ মানেন । এই কল্পনা অনুসারে সূক্ষ্ম গোল জন্তু হইতে স্থূল গোল জন্তুর উৎপত্তি, এই স্থূল জন্তু হইতে পুনরায় ক্ষুদ্র কীটের উৎপত্তি, ক্ষুদ্র কীট হইতে তাহার পরবর্তী প্রাণীর উৎপত্তি; প্ৰত্যেক যোনি অর্থাৎ জাতির মধ্যে এইরূপ অনেক ধাপ চলিয়া গিয়াছে, স্পষ্টই দেখা যাইতেছে । এই সম্বন্ধে এক ইংরেজ জীবশাস্ত্ৰজ্ঞ এইরূপ গণনা করিয়াছেন যে, জলের ক্ষুদ্ৰ মৎসদিগের গুণধর্ম বাড়িতে বাড়িতে তাহাদের মনুষ্যের স্বরূপ প্রাপ্ত হইবার পূর্বে মধ্যবর্তী বিভিন্ন জাতির মোট সংখ্যা ৫৩ লক্ষ ৭৫ হাজার ধাপ চলিয়া গিয়াছে; এবং কখনও বা এই সংখ্যার দশগুণও হইতে পারে । জলের ক্ষুদ্ৰ জলচর হইতে মনুষ্য পৰ্যন্ত এই যোনি উৎপন্ন হয় । ইহার মধ্যেও ক্ষুদ্র জলচরের পূর্ববর্তী সজীব জন্তু ধরিলে আরো কত লক্ষ বংশ ধরিতে হয় তাহার কল্পনাও করা যায় না । ইহা হইতে অবগত হওয়া যায় যে আমাদের পুরাণের চৌরাশী লক্ষ যোনির কল্পনা অপেক্ষা আধিভৌতিক শাস্ত্রের পৌরাণিক বংশকল্পনা কত বাড়িয়া গিয়াছে । কালের কল্পনা সম্বন্ধেও এই ন্যায়ই প্রযুক্ত হইতে পারে । সজীব জগতের সূক্ষ্ম জন্তু এই পৃথিবীতে কখন্‌ উৎপন্ন হইল, স্থূল পরিমাণেও তাহা নিশ্চয় করিতে না পারায় সূক্ষ্ম জলচরের উৎপত্তিও কোটি বৎসর পূর্বে হইয়াছে এইরূপ ভূগর্ভগত জীবশাস্ত্রজ্ঞেরা বলেন । এই সম্বন্ধে সংক্ষেপে জ্ঞানলাভ করিতে হইলে “The Last Link” by Ernst Haeckel with notes & c by Dr. Gadow (1898) এই পুস্তক দেখিবে । এই পুস্তকে ডঃ গাডো যে দুই তিন উপযুক্ত পরিশিষ্ট যোজিত করিয়াছেন তাহাতে উপরি-উক্ত অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় আছে । পুরাণের চৌরাশী লক্ষ যোনির হিসাব এই প্রকারে করা হইয়াছে - ৯ লক্ষ জলচর, ১০ লক্ষ পক্ষী, ১১ লক্ষ কৃমি, ২০ লক্ষ পশু, ৩০ লক্ষ স্থাবর ও ৪ চার লক্ষ মনুষ্য [দাস|২০|৬ দেখ])


10) ত্রিবৃৎকরণের সহিত পঞ্চীকরণের তুলনা


উত্তর বেদান্ত-গ্ৰন্থসমূহে বর্ণিত এই পঞ্চীকরণ প্ৰাচীন উপনিষদের নহে ইহাও এখানে বলা আবশ্যক । পঞ্চতন্মাত্র বা পাঁচ মহাভূত স্বীকার না করিয়া ছান্দোগ্যোপনিষদে ‘তেজ, জল ও অন্ন (পৃথ্বী)’ এই তিন সূক্ষ্ম মূলতত্ত্বের মিশ্রণ অর্থাৎ ‘ত্ৰিবিৎকরণ’ হইতে বিবিধ সৃষ্টি উৎপন্ন হইল এইরূপ বৰ্ণনা আছে । এবং “অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্ৰজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ” [শ্বেতা|৪|৫] অর্থাৎ - লাল বা তেজরূপী, সাদা বা জলরূপী এবং কালো বা পৃথ্বীরূপী, এই তিন রং-বিশিষ্ট তিন তত্ত্বের এক যে প্ৰজা (সৃষ্টি) উৎপন্ন হইয়াছে - এইরূপ শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে উক্ত হইয়াছে । ছান্দোগ্যোপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্বেতকেতু ও তাঁহার পিতার সংবাদ (কথোপকথন) প্রদত্ত হইয়াছে । তাহার আরম্ভেই শ্বেতকেতুকে তাহার পিতা স্পষ্ট বলিতেছেন যে, “বৎস ! জগতের আরম্ভে ‘একমেবাদ্বিতীয়ং সৎ’ ব্যতীত অর্থাৎ যথা তথা সমস্ত একবস্তুময় ও নিত্য পরব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই ছিল না । যাহা অসৎ (অর্থাৎ ‘নাই’) তাহা হইতে সৎ কিরূপে উৎপন্ন হইবে ? তাই আরম্ভে সৎ-ই সর্বত্র ব্যাপ্ত ছিল । তাহার পর, উহা, অনেক অর্থাৎ বহু বস্তু হইবে মনে করাতে তাহা হইতে ক্ৰমে সূক্ষ্ম তেজ (অগ্নি), জল, ও পৃথিবী উৎপন্ন হইল । তাহার পর এই তিন তত্ত্বের মধ্যেই জীবরূপে পরব্রহ্ম প্ৰবেশ করিলে, তাহাদের ত্ৰিবিৎকরণের দ্বারা জগতের অনেক নাম রূপাত্মক বস্তু নির্মিত হইল । স্থূল অগ্নি, সূর্য বা বিদ্যুৎ ইহাদের জ্যোতিতে যে তাম্র (লোহিত) রং আছে তাহা সূক্ষ্ম তেজোরূপী মূলতত্ত্বের পরিণাম, যে সাদা (শুক্ল) রং আছে তাহা সূক্ষ্ম জলতত্ত্বের এবং যে কালো (কৃষ্ণ) রং আছে তাহা সূক্ষ্ম পৃথ্বীতত্ত্বের পরিণাম । সেইরূপ আবার মনুষ্য যে অল্প ভক্ষণ করে তাহাতেও সূক্ষ্ম তেজ, সূক্ষ্ম জল ও সূক্ষ্ম অন্ন (পৃথ্বী) এই তিন মূলতত্ত্বই ভরিয়া থাকে । দধি ঘুঁটিলে যেমন মাখন উপরে আইসে সেইরূপ উপরি-উক্ত তিন সূক্ষ্ম তত্ত্বের দ্বারা উৎপন্ন অন্ন উদরে গেলে, তন্মধ্যে তেজতত্ত্ব হইতে মনুষ্যের দেহে অস্থি, মজ্জা ও বাণীরূপে অনুক্ৰমে স্থূল, মধ্যম ও সূক্ষ্ম পরিণাম উৎপন্ন হয়; এবং সেইরূপ জল এই তত্ত্ব হইতে মূত্র, রক্ত ও প্ৰাণ; এবং অন্ন অর্থাৎ পৃথ্বী এই তত্ত্ব হইতে পুরীষ, মাংস ও মন এই তিন দ্রব্য নির্মিত হইয়া থাকে” [ছাং|৬,২-৬] । মূল মহাভূত পাঁচ না মানিয়া তিনই মানিয়া ত্রিবিৎকরণের দ্বারা সমস্ত দৃশ্য পদার্থের উৎপত্তির ব্যবস্থা করিবার ছান্দোগ্যোপনিষদের এই পদ্ধতিই বেদান্তসূত্রেও [২|৪|২০] উক্ত হইয়াছে । বাদরায়ণাচার্য পঞ্চীকরণের নামও করেন নাই । তথাপি তৈত্তিরীয় [২|১], প্রশ্ন [৪|৮], বৃহদারণ্যক [৪|৪|৫] প্রভৃতি অন্য উপনিষদে এবং বিশেষত শ্বেতাশ্বতর [২|১২], বেদান্তসূত্র [২|৩|১-১৪] ও পরিশেষে গীতাতেও [৭|৪; ১৩|৫] তিনের বদলে পাঁচ মহাভূত উক্ত হইয়াছে । গর্ভোপনিষদের আরম্ভেই মনুষ্যদেহ ‘পঞ্চাত্মক’ কথিত হইয়াছে; মহাভারত ও পুরাণে তো পঞ্চীকরণ স্পষ্টই বর্ণিত হইয়াছে [মভা|শাং|১৮৪-১৮৬] । ইহা হইতে প্ৰতিপন্ন হইতেছে যে, ত্ৰিবিৎকরণ প্রাচীন হইলেও যখন মহাভূতের সংখ্যা তিনের বদলে পাঁচ স্বীকৃত হইতে লাগিল, তখন ত্রিবিৎকরণের দৃষ্টান্তেই পঞ্চীকরণের কল্পনার প্রাদুর্ভাব হইল এবং ত্ৰিবিৎকরণ পশ্চাতে পড়িয়া রহিল; এবং পরিশেষে পঞ্চীকরণের কল্পনা বেদান্তীদিগের গ্ৰাহ্য হইল । পরে এই পঞ্চকীকরণ শব্দের অর্থে এই কথাও বলা হইয়াছে যে, মনুষ্যের শরীর কেবল পঞ্চমহাভূতে গঠিত নহে, কিন্তু শরীরের মধ্যে ঐ পঞ্চ মহাভূতের প্রত্যেক পাঁচ প্রকার বিভক্তও হইয়াছে । উদাহরণ যথা – ত্বক্‌ মাংস, অস্থি, মজ্জা ও স্নায়ু এই পাঁচটি বিভাগ অন্নময় পৃথ্বীতত্ত্বের ইত্যাদি ইত্যাদি [মভা|শাং|১৮৪|২০-২৫; ও দাসবোধে|১৭|৮ দেখ] । এই কল্পনাও উপরিপ্রদত্ত ছান্দোগ্যোপনিষদের ত্ৰিবিৎকরণের বর্ণনা হইতে সূচিত দেখা যায় । কারণ, সেখানেও শেষে এইরূপ বৰ্ণিত হইয়াছে যে ‘তেজ, জল, ও পৃথ্বী’ এই তত্ত্বগুলির প্রত্যেকের তিন তিন প্ৰকার মনুষ্যের দেহে প্ৰাপ্ত হওয়া যায় ।


11) সজীব সৃষ্টি ও সাংখ্যশাস্ত্রে বর্ণিত লিঙ্গশরীর


মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে কিংবা বেদান্তসিদ্ধান্তু অনুসারে পরব্রহ্ম হইতে অনেক নামরূপধারী জগতের অচেতন অর্থাৎ নির্জীব বা জড়পদার্থ কিরূপে উৎপন্ন হইয়াছে তাহার বিচার শেষ করা গিয়াছে । এক্ষণে বিচার করিব যে, জগতের সচেতন অর্থাৎ সজীব প্ৰাণীদিগের উৎপত্তি সম্বন্ধে সাংখ্যশাস্ত্রের বিশেষ বক্তব্য কি আছে; তাহার পর দেখিতে হইবে যে, বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তের সহিত তাহার কতটা মিল আছে । সূক্ষ্ম ইন্দ্ৰিয়াদির সহিত মূল প্ৰকৃতি হইতে নিঃসৃত পৃথিব্যাদি স্থূল পঞ্চমহাভূতের সংযোগ হইলে সজীব প্রাণীর শরীর প্রস্তুত হয় । কিন্তু এই শরীর সেন্দ্ৰিয় হইলেও জড় ছাড়া আর কিছুই নহে । এই ইন্দ্ৰিয়দিগকে প্রেরিত করিবার তত্ত্ব জড় প্রকৃতি হইতে ভিন্ন এবং তাহাকে ‘পুরুষ’ বলা হয় । সাংখ্যের এই সিদ্ধান্ত পূর্বপ্রকরণে বর্ণন করিয়াছি যে, যদিও ‘পুরুষ’ মূলে অকর্তা, তথাপি প্ৰকৃতির সহিত তাহার সংযোগ হইলে পর সজীব সৃষ্টির আরম্ভ হয়; এবং “আমি পৃথক ও প্রকৃতি পৃথক” এই জ্ঞান হইলে পর প্রকৃতির সহিত পুরুষের সংযোগ চলিয়া যায় এবং সে মুক্ত হয়; এরূপ না হইলে জন্মমরণের ফেরের মধ্যে তাহাকে পড়িতে হয় । কিন্তু পুরুষ পৃথক্‌ ও প্ৰকৃতি পৃথক্‌ এই জ্ঞান হইবার পূর্বেই যাহার মরণ হয়, তাহার নব নব জন্ম কিরূপে হয়, তাহার বিচার করা হয় নাই । অতএব এখানে তৎসম্বন্ধে বেশী বিচার করা আবশ্যক বলিয়া মনে হয় । জ্ঞান প্রাপ্ত না হইয়া যে মনুষ্য মরে, তাহার আত্মা প্ৰকৃতিচক্র হইতে একেবারে ছাড়ান পায় না, ইহা সুস্পষ্ট । কারণ ছাড়ান পাইলে, জ্ঞানের কিংবা পাপপুণ্যের কোনই মাতব্বরী থাকে না; চার্বাকের ন্যায় ইহাও বলিতে হয় যে, মরিবার পর প্রত্যেক ব্যক্তিই প্ৰকৃতি হইতে ছাড়ান পায় বা মোক্ষ লাভ করে । ভাল; যদি বলা যায় যে, মরিবার, পর শুধু আত্মা অর্থাৎ পুরুষ অবশিষ্ট থাকিয়া আপনা হইতেই নব নব জন্ম গ্ৰহণ করে, তাহা হইলে পুরুষ অকর্তা ও উদাসীন এবং সমস্ত কর্তৃত্ব প্ৰকৃতির - এই মূলভূত সিদ্ধান্তের বাধা হয় । তাছাড়া যখন আমি মানিতেছি যে, আত্মা আপনা হইতেই নব নব জন্মগ্রহণ করে, তখন ইহা তাহার গুণ বা ধর্ম হইয়া যাইতেছে; এবং তখন তো এরূপ অনবস্থা প্ৰাপ্ত হয় যে, জন্মমরণের ফের হইতে সে কখনই মুক্তি পাইতে পারে না । অতএব সিদ্ধ হইতেছে যে, যদি জ্ঞান প্ৰাপ্ত না হইয়াই কোন মনুষ্য মরিয়া যায়, তথাপি পরে নব নব জন্ম প্ৰাপ্ত করাইবার জন্য উহার আত্মার সহিত প্ৰকৃতির সম্বন্ধ অবশ্যই থাকা চাই । মৃত্যুর পর স্থূল দেহের নাশ হওয়া প্ৰযুক্ত উক্ত সম্বন্ধ এক্ষণে স্থূল মহাভূতাত্মক প্রকৃতির সহিত থাকিতে পারে না, ইহা স্পষ্টই রহিয়াছে । কিন্তু এ কথা বলা যায় না যে, প্ৰকৃতি কেবল স্থূল পঞ্চ মহাভূত হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে । প্ৰকৃতি হইতে সমস্ত তেইস তত্ত্ব উৎপন্ন হয়; এবং স্থূল পঞ্চমহাভূত ঐ তেইস তত্ত্বের শেষের পাঁচ । এই শেষের পাঁচ তত্ত্বকে (স্থূল পঞ্চ মহাভূত) তেইস তত্ত্ব হইতে পৃথক করিলে আঠারো তত্ত্ব অবশিষ্ট থাকে । অতএব, এক্ষণে কাজে কাজেই বলিতে হয় যে, জ্ঞানপ্ৰাপ্ত না হইয়া যে মরে সেই পুরুষ পঞ্চমহাভূতাত্মক স্থূল শরীর হইতে অর্থাৎ শেষের পাঁচ তত্ত্ব হইতে মুক্ত হইলেও প্রকৃতির অন্য আঠার তত্ত্বের সহিত তাহার সম্বন্ধ এই প্রকার মরণের দ্বারা কখনই ছিন্ন হয় না । মহান্‌ (বুদ্ধি), অহঙ্কার, মন, দশ ইন্দ্ৰিয় এবং পঞ্চতন্মাত্র এই কয়েকটী আঠারো তত্ত্ব (পূর্বে প্রদত্ত ব্ৰহ্মাণ্ডের বংশবৃক্ষ দেখ) । এ সমস্তই সূক্ষ্ম তত্ত্ব । তাই এই তত্ত্বগুলির সহিত পুরুষের সংযোগ বজায় রাখিয়া যে দেহ নির্মিত হয় তাহাকে স্থূল শরীরের বিরুদ্ধ সূক্ষ্ম কিংবা লিঙ্গশরীর বলা হয় [সাং|কা|৪০] । 

যখন কোন প্রাণী জ্ঞান না পাইয়া মরে, তখন মৃত্যুর সময় তাহার আত্মার সঙ্গেই প্ৰকৃতির উক্ত আঠার তত্ত্বের নির্মিত এই লিঙ্গশরীরও স্থূল দেহ হইতে বাহির হইয়া যায়; এবং জ্ঞানপ্ৰাপ্তি না হওয়া পৰ্যন্ত সেই পুরুষ ঐ লিঙ্গশরীরেরই কারণে নব নব জন্ম পরিগ্ৰহ করিয়া থাকে । এই সম্বন্ধে কাহার কাহার এই সন্দেহ হয় যে, মনুষ্য মরিবার পর প্রাণের সঙ্গে সঙ্গেই জড়দেহ হইতে বুদ্ধি, অহঙ্কার, মন ও দশ ইন্দ্ৰিয়ের ব্যাপারও নষ্ট হওয়া প্রত্যক্ষ হয় বলিয়া লিঙ্গশরীরের মধ্যে এই তের তত্ত্বের সমাবেশ করিতে কোন বাধা নাই, কিন্তু লিঙ্গশরীরের মধ্যে এই তের তত্ত্বের সহিত পাঁচ সূক্ষ্ম তন্মাত্রের সমাবেশ কেন স্বীকার করিব ? ইহার উত্তরে সাংখ্যেরা বলেন যে, শুধু বুদ্ধি, শুধু অহঙ্কার, মন ও দশ ইন্দ্ৰিয় এই তের তত্ত্ব - প্রকৃতির শুধু গুণ; এবং ছায়ার যেরূপ কোন পদার্থের আশ্রয় আবশ্যক হয় কিংবা চিত্রের জন্য যেরূপ দেওয়াল কাগজ প্রভৃতির আশ্রয় দরকার হয়, সেইরূপ এই গুণাত্মক তের তত্ত্বেরও একত্ৰ থাকিবার জন্য কোন-না-কোন দ্রব্যের আশ্ৰয় চাই । এখন আত্মা (পুরুষ) স্বয়ং নির্গুণ ও অকর্তা, সুতরাং তাহা কোন গুণেরই আশ্রয় হইতে পারে না । মনুষ্য জীবিত থাকিতে, তাহার দেহের স্থূল পঞ্চ মহাভূতই এই তের তত্ত্বের আশ্ৰয় হইয়া থাকে । কিন্তু মরণান্তর অর্থাৎ স্থূল দেহের নাশানান্তর স্থূল পঞ্চ মহাভূতের এই আশ্রয় বিনষ্ট হয় । তখন এই গুণাত্মক তের তত্ত্বের অন্য কোন দ্রব্যকে আশ্রয় করা চাই । যদি মূল প্রকৃতিকেই আশ্রয় বলি, তবে উহা অব্যক্ত ও অবিকৃত অবস্থার অর্থাৎ অনন্ত ও সর্বব্যাপী হওয়া প্ৰযুক্ত উহা একটি ক্ষুদ্র লিঙ্গশরীরস্থ অহঙ্কার বুদ্ধি-আদি গুণের আধার হইতে পারে না । তাই মূল প্ৰকৃতিরই দ্রব্যাত্মক বিকারের মধ্যে স্থূল পঞ্চমহাভূতের বদলে তাহাদের মূলভূত পাঁচ সূক্ষ্ম তন্মাত্র দ্রব্যের সমাবেশ, উক্ত তের গুণের সহিতই তাহাদের আশ্রয়ের দৃষ্টিতে লিঙ্গশরীরের মধ্যে সমাবেশ করিতে হয় [সাং|কা|৪১] । অনেক সাংখ্যগ্ৰন্থকার লিঙ্গশরীর ও স্থূল শরীরের মধ্যে পঞ্চতন্মাত্রনির্মিত তৃতীয় এক শরীর কল্পনা করিয়া প্রতিপাদন করেন যে, এই তৃতীয় শরীর লিঙ্গশরীরের আশ্রয় । কিন্তু সাংখ্যকারিকার একচল্লিশ শ্লোকের প্রকৃত অর্থ সেরূপ নহে, টীকাকারেরা ভ্ৰান্তিবশত তৃতীয় শরীর কল্পনা করিয়াছে, এইরূপ আমার মনে হয় । আমার মতে এই শ্লোকের উদ্দেশ্য কেবল ইহাই বুঝানো যে, বুদ্ধি আদি ১৩ তত্ত্বের সহিত লিঙ্গশরীরে পঞ্চতন্মাত্রেরও সমাবেশ কেন করা হইয়াছে । * ইহার অতিরিক্ত অন্য কোন কারণ নাই ।
*(আমাদেরই মতানুযায়ী ভট্টকুমারিলও এই শ্লোকের অর্থ করিয়াছেন, ইহা তাঁহার মীমাংসাশ্লোকবার্তিক গ্রন্থের এক শ্লোক হইতে [আত্মবাদ|শ্লো|৬২] দেখিতে পাওয়া যায় । সেই শ্লোকটি এই -
অন্তরাভবদেহো হি নেষ্যতে বিন্ধ্যবাসিনা ৷
তদস্তিত্বে প্ৰমাণং হি ন কিঞ্চদবগম্যতে ॥ ৬২ ৷৷
“অন্তরাভব অর্থাৎ লিঙ্গশরীর ও স্থূল শরীর এই দুয়ের মধ্যস্থিত দেহ কিংবা শরীর বিন্ধ্যবাসীর সম্মত নহে । এই প্রকারের মধ্যবর্তী দেহ আছে বলিবার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না ।” ঈশ্বরকৃষ্ণ বিন্ধ্যপর্বতের উপর থাকিতেন বলিয়া উহাকে বিন্ধ্যবাসী বলা হইয়াছে । অন্তরাভব শরীরের ‘গন্ধর্ব’ এই নামও আছে । অমরকোষ [৩|৩|১৩২] এবং তাহার উপর কৃষ্ণাজী গোবিন্দ ওক প্রকাশিত ক্ষীরস্বামীর টীকা ও মূল গ্রন্থের প্রস্তাবনা পৃ ৮ দেখ ।)


12) বেদান্তে বর্ণিত লিঙ্গশরীর


একটু বিচার করিয়া দেখিলেই বুঝা যায় যে, সূক্ষ্ম আঠারো তত্ত্বের সাংখ্যোক্ত লিঙ্গশরীর ও উপনিষদে বর্ণিত লিঙ্গশরীর এই দুয়ের মধ্যে বেশী পার্থক্য নাই । বৃহদারণ্যকোপনিষদে উক্ত আছে যে, “জোঁক (জলৌকা) যেরূপ একগাছা ঘাসের এক ডগায় পৌছিলে অন্য একগাছা ঘাসের উপর (সামনের পা দিয়া) শরীরের সামনের ভাগ রাখিয়া, পূর্ব ঘাসের উপর অবস্থিত দেহের পশ্চাদ্‌ভাগটা টানিয়া লয়, সেইরূপ আত্মা এক শরীর ছাড়িয়া অন্য শরীরে প্রবেশ করে” [বৃ|৪|৪|৩] । কিন্তু কেবল এই দৃষ্টান্ত হইতে, শুধু আত্মাই অন্য শরীরে যায়, এবং তাহাও এক শরীর ছাড়িবামাত্ৰই যায়, এই দুই অনুমান সিদ্ধ হয় না । কারণ, বৃহদারণ্যকোপনিষদেই পরে [বৃ|৪|৪|৫] বর্ণিত হইয়াছে যে, আত্মার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চ (সূক্ষ্ম) ভূত, মন, ইন্দ্ৰিয়সকল, প্রাণ ও ধর্মাধর্মও শরীর হইতে বাহির হইয়া যায়; আর ইহাও উক্ত হইয়াছে যে, আপন আপন কর্ম-অনুসারে আত্মা ভিন্ন ভিন্ন লোক প্ৰাপ্ত হয়, এবং সেই সেই লোকে কিছুকাল বাস করে [বৃ|৬|২|১৪,১৫] । সেইরূপ, ছান্দোগ্যোপনিষদেও অপ (জল) মূলতত্ত্বের সঙ্গে জীবের যে গতি বৰ্ণিত হইয়াছে [ছাং|৫|৩|৩; ৫|৯|১], এবং বেদান্তসূত্রে তাহার যে অর্থ নির্ণয় করা হইয়াছে [বেসূ|৩|১|১-৭], তাহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, লিঙ্গশরীরে জল, তেজ ও অন্ন এই তিন মূলতত্ত্বেরই সমাবেশ ছান্দোগ্যোপনিষদেরও অভিপ্রেত । সার-কথা, মহদাদি আঠারো সূক্ষ্ম তত্ত্বের নির্মিত সাংখ্যোক্ত লিঙ্গশরীরেই প্রাণ ও ধর্মাধর্ম অর্থাৎ কর্ম সামিল করিলেই বেদান্তীর লিঙ্গশরীর হয় দেখা যাইতেছে । কিন্তু সাংখ্যশাস্ত্র অনুসারে এগারো ইন্দ্ৰিয়বৃত্তির মধ্যেই প্ৰাণের এবং বুদ্ধীন্দ্ৰিয়ের ব্যাপারের মধ্যেই ধর্মাধর্মের সমাবেশ হওয়া প্ৰযুক্ত উক্ত ভেদ কেবল শাব্দিক, - লিঙ্গশরীরের গঠনসম্বন্ধে বেদান্ত ও সাংখ্যের মধ্যে বস্তুত কোন ভেদ নাই বলিলেও চলে । এইজন্য মৈত্র্যুপনিষদে [মৈ|৬|১০] “মহদাদিসূক্ষ্মপৰ্যন্ত” এই সাংখ্যোক্ত লিঙ্গশরীরের লক্ষণ “মহদাদ্যবিশেষান্তং” এইরূপ পর্যায়ের দ্বারা যেমনটি তেমনি ঠিক রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে ।*
*(দ্বাত্রিংশৎ উপনিষদের পুণা আনন্দাশ্ৰম-সংস্করণের মৈত্র্যুপনিষদের উক্ত মন্ত্রের পাঠ “মহদাদ্যং বিশেষান্তং” এইরূপ দেওয়া হইয়াছে এবং উহাই টীকাকারও স্বীকার করিয়াছেন । এই পাঠ গ্ৰহণ করিলে লিঙ্গশরীরের মধ্যে আরম্ভের মহৎ-তত্ত্বের সমাবেশ করিয়া বিশেষান্তং এই পদের দ্বারা সূচিত বিশেষ অর্থাৎ পঞ্চ মহাভূত ছাড়িয়া দিতে হয় । অথবা এই অৰ্থ করা আবশ্যক হয় যে, ‘মহদাদ্যং’ ইহার মধ্যে ‘মহৎ’কে ধরিয়ে হইবে এবং ‘বিশেষান্তং’ ইহার মধ্যে ‘বিশেষ’কে ছাড়িতে হইবে । কিন্তু যেখানে আদ্যন্ত বলা হইয়াছে সেখানে দুই-ই ধরা কিংবা ছাড়া যুক্তিসিদ্ধ । তাই প্রোফেসর ডয়সন্‌ বলিয়াছেন যে, মহদাদ্যং এই পদের অনুস্বার ছাঁটিয়া ফেলিয়া “মহদাদ্যর্বিশেষান্তম্‌” (মহদাদি + অইশেষান্তম্‌) এই পাঠ গ্রহণ করা উচিত । এইরূপ করিয়া অবিশেষ পদ ধরিলে, মহৎ ও অবিশেষ অর্থাৎ আদি ও অন্ত এই দুয়েতেই একই নিয়মের প্রয়োগ হইবে এবং লিঙ্গশরীরে উভয়েরই সমাবেশ করা যাইবে । এই পাঠের ইহাই বিশেষ গুণ । কিন্তু যে-কোন পাঠই গ্ৰহণ করা না কেন, অর্থের ভেদ হয় না, ইহা মনে রাখা আবশ্যক ।)

ভগবদ্‌গীতাতে “মনঃষষ্ঠানীন্দ্ৰিয়াণি” [গী|১৫|৭] অর্থাৎ মন ও পাঁচ জ্ঞানেন্দ্ৰিয় লইয়াই সুক্ষ্ম শরীর হয়, এইরূপ বলিয়া পরে বলা হইয়াছে - “বায়ুৰ্গন্ধানিবাশয়াৎ” [১৫|৮] অর্থাৎ বায়ু যেরূপ ফুল হইতে সুগন্ধ হরণ করে সেইরূপ জীব স্থূল শরীর ছাড়িবার সময় লিঙ্গশরীর সঙ্গে লইয়া যায় । তথাপি গীতার অধ্যাত্মজ্ঞান উপনিষদ হইতেই গৃহীত হওয়ায় বলা যায় যে, ‘মনের সহিত ছয় ইন্দ্রিয়’ এই শব্দগুলির মধ্যেই পাঁচ কর্মেন্দ্ৰিয়, পঞ্চতন্মাত্র, প্রাণ ও পাপপুণ্য ইহাদের সংগ্ৰহই ভগবানের অভিপ্ৰেত । মনুস্মৃতিতেও বর্ণিত হইয়াছে যে, মনুষ্য মরিবার পর এই জন্মের পাপপুণ্য-ফল ভোগ করিবার জন্য পঞ্চতন্মাত্রাত্মক সূক্ষ্ম শরীর প্রাপ্ত হয় [মনু|১২|১৬,১৭]“বায়ুৰ্গন্ধানিবাশয়াৎ” গীতার এই দৃষ্টান্ত হইতে এই শরীর যে সূক্ষ্ম, তাহাই সিদ্ধ হয়; কিন্তু তাহার আকার কত বড় তাহা বুঝা যায় না । মহাভারতের সাবিত্রী উপাখ্যানে [মভা|বন|২৯৭|১৬] সত্যবানের (স্থূল) শরীর হইতে অঙ্গুষ্ঠপরিমিত এক পুরুষকে যম বাহির করিল, - “অঙ্গুষ্ঠমাত্ৰং পুরুষং নিশ্চকৰ্ষ যমো বলাৎ” এই যে বর্ণনা আছে, তাহা হইতে এই দৃষ্টান্তেরই জন্য লিঙ্গশরীর অঙ্গুষ্ঠ আকারবিশিষ্ট মানা হইয়াছে বলিয়া প্রতীত হয় ।


13) লিঙ্গশরীর পশু, পক্ষী, মনুষ্য প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন দেহ কেন উৎপন্ন করে ?


লিঙ্গশরীর আমাদের চোখে না দেখা গেলেও, তাহার অস্তিত্ব কোন্‌ অনুমানের দ্বারা সিদ্ধ হয়, এবং সেই শরীরের অবয়ব-গঠন কিরূপ, তাহার বিচার করা হইল । কিন্তু, প্ৰকৃতি ও পাঁচ স্থূল মহাভূতের অতিরিক্ত আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয় হইতে লিঙ্গশরীর নির্মিত হয়, এই কথা বলিলেই যথেষ্ট বলা হয় না বলিয়া মনে হয় । এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, লিঙ্গশরীর যেখানে যেখানে থাকিবে, সেখানে সেখানে, এই আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয় নিজনিজ গুণধর্মানুসারে মাতাপিতার স্থূল দেহ হইতে এবং পরে স্থূল জগতের অন্ন হইতে হস্তপদাদি স্থূল অবয়ব বা স্থূল ইন্দ্ৰিয় উৎপন্ন করিবে অথবা তাহাদের পোষণ করিবে । কিন্তু এখন বলা আবশ্যক যে, আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয়ে উৎপন্ন লিঙ্গশরীর পশু, পক্ষী, মনুষ্য প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন দেহ কেন উৎপন্ন করে । সজীব জগতের সচেতন তত্ত্বকে সাংখ্যবাদী ‘পুরুষ’ বলেন; এবং সাংখ্যদিগের মতে এই পুরুষ অসংখ্য হইলেও প্ৰত্যেক পুরুষ স্বভাবতই উদাসীন ও অকৰ্তা হওয়া প্ৰযুক্ত পশুপক্ষী-আদি প্ৰাণীদিগের ভিন্ন ভিন্ন দেহ উৎপন্ন করিবার কর্তৃত্ব পুরুষেতে আসিতে পারে না । বেদান্তশাস্ত্রে পাপপুণ্যাদি কর্মের পরিণাম হইতে এই ভেদ উৎপন্ন হয়, উক্ত হইয়াছে । এই কর্মবিপাকের বিচার পরে করা যাইবে । সাংখ্যশাস্ত্ৰ অনুসারে কর্মকে পুরুষ ও প্ৰকৃতি হইতে ভিন্ন তৃতীয় তত্ত্ব মানিতে পারা যায় না; এবং পুরুষ যখন উদাসীন, তখন বলিতেই হয় যে, কর্ম প্রকৃতির সত্ত্বরজতমগুণেরই বিকার । লিঙ্গশরীরে যে আঠারো তত্ত্বের সমুচ্চয় আছে, তন্মধ্যে বুদ্ধিতত্ত্ব প্রধান । কারণ, বুদ্ধি হইতেই পরে অহঙ্কারাদি সতেরো তত্ত্ব উৎপন্ন হয় । অতএব বেদান্ত যাহাকে কর্ম বলে, তাহাকেই সাংখ্যশাস্ত্ৰে সত্ত্ব রজ ও তম এই তিন গুণের ন্যূনাধিক পরিমাণে উৎপন্ন বুদ্ধির ব্যাপার, ধর্ম বা বিকার বলা হয় । বুদ্ধির এই ধর্মের সংজ্ঞা – ‘ভাব । সত্ত্ব রজ ও তম এই গুণত্রয়েয় তারতম্যে এই ভাব অনেক প্ৰকারের হইয়া থাকে । ফুলেতে যেরূপ গন্ধ ও কাপড়ে যেরূপ রং, সেইরূপ লিঙ্গশরীরে এই ভাব লাগিয়া থাকে [সাং|কা|৪০] । এই ভাব অনুসারে কিংবা বেদান্তের পরিভাষায় কর্মানুসারে লিঙ্গশরীর নব নব জন্ম গ্ৰহণ করে; এবং জন্মগ্রহণ করিবার সময় পিতামাতার শরীর হইতে যে দ্রব্য লিঙ্গশরীর আকর্ষণ করিয়া লয় সেই সকল দ্রব্যেতেও অন্যভাব আসিয়া থাকে । ‘দেবযোনি, মনুষ্যযোনি, পশুযোনি ও বৃক্ষযোনি’ এই সকল ভেদ এই ভাবের সমুচ্চয়েরই পরিণাম [সাং|কা|৪৩-৫৫] । এই সমস্ত ভাবের মধ্যে সাত্ত্বিক গুণের উৎকর্ষ হইয়া যখন মনুষ্য জ্ঞান ও বৈরাগ্য প্রাপ্ত হয় এবং সেই প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতি ও পুরুষের ভেদ বুঝিতে আরম্ভ করে, তখন মনুষ্য আপনার মূলস্বরূপ কৈবল্যপদে উপনীত হয়; এবং তখন এই লিঙ্গশরীর হইতে মুক্তি পাইয়া তাহার দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি হয় । কিন্তু এই প্ৰকৃতিপুরুষের ভেদজ্ঞান না হইয়া শুধু সাত্ত্বিকগুণেরই উৎকর্ষ হইলে লিঙ্গশরীর দেবযোনিতে অর্থাৎ স্বৰ্গে জন্ম গ্ৰহণ করে; রজোগুণের প্রাবল্য হইলে মনুষ্যযোনিতে অর্থাৎ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে এবং তমোগুণের আধিক্য হইলে তাহাকে তির্যকযোনিতে প্ৰবেশ করিতে হয় [গী|১৪|১৮]“গুণা গুণেষু জায়ন্তে” এই তত্ত্ব ধরিয়াই সাংখ্যশাস্ত্ৰে বৰ্ণিত হইয়াছে যে, মানবযোনিতে জন্ম হইলে পর রেতবিন্দু হইতে ক্ৰমে ক্ৰমে কলল, বুদ্‌বুদ, মাংস, পেশী ও ভিন্ন ভিন্ন স্থূল ইন্দ্ৰিয়সকল কিরূপে গঠিত হয় [সাং|কা|৪৩; মভা|শাং|৩২০] । সাংখ্য ও গর্ভোপনিষদের বর্ণনা প্ৰায় একই প্ৰকার । উপরি-উক্ত আলোচনা হইতে বুঝা যাইবে যে, সাংখ্যশাস্ত্ৰে ‘ভাব’ শব্দের যে পারিভাষিক অর্থ বলা হইয়াছে, তাহা বেদান্তশাস্ত্ৰে বিবক্ষিত না হইলেও ভগবদ্‌গীতাতে [গী|১০|৪,৫; ৭|১২], “বুদ্ধির্জ্ঞানমসংমোহঃ ক্ষমা সত্যং দমঃ শমঃ” ইত্যাদি গুণের (পরবর্তী শ্লোকে) যে ‘ভাব’ নাম দেওয়া হইয়াছে, অনুমান হয়, তাহা সাংখ্যশাস্ত্রের পরিভাষা মনে করিয়া দেওয়া হইয়াছে ।


14) উৎপত্তি-প্রলয়


এই প্রকারে সাংখ্যশাস্ত্ৰানুসারে মূল অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতে কিংবা বেদান্ত অনুসারে মূল সৎ-রূপী পরব্রহ্ম হইতে সৃষ্টির সমস্ত সজীব ও নির্জীব ব্যক্ত পদার্থ ক্ৰমে ক্রমে সৃষ্ট হইয়াছে; এবং যখন সৃষ্টির সংহারের সময় উপস্থিত হয়, তখন উপরে কথিত জগৎ-উৎপত্তির গুণপরিণামক্রমের বিপরীত ক্ৰমে সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ অব্যক্ত প্ৰকৃতিতে কিংবা মূল ব্ৰহ্মেতে লয় প্রাপ্ত হয় । এইরূপ সিদ্ধান্ত সাংখ্য ও বেদান্ত উভয় শাস্ত্রেরই মান্য [বেসু|২|৩|১৪; মভা|শাং|২৩২] । উদাহরণ যথা, পঞ্চ মহাভূতের মধ্যে পৃথিবীর লয় জলেতে, জলের অগ্নিতে, অগ্নির বায়ুতে, বায়ুর আকাশে, আকাশের তন্মাত্রে, তন্মাত্রের অহংকারে, অহঙ্কারের বুদ্ধিতে, এবং বুদ্ধি বা মহানের প্রকৃতিতে লয় হয়, এবং বেদান্তানুসারে প্রকৃতি মূল ব্ৰহ্মেতে লয় প্রাপ্ত হয় । 


15) কালগণনা


জগতের উৎপত্তি বা সৃষ্টি হইলে পর উহার লয় ও সংহার পর্যন্ত কতকাল অতীত হয়, ইহা সাংখ্যকারিকায় কোথাও কথিত হয় নাই । তথাপি মনে হয় যে, মনুসংহিতা [১|৬৬-৭৩], ভগবদ্‌গীতা [৮|১৭], এবং মহাভারতে [শাং|২৩১] বর্ণিত কালগণনা সাংখ্যদিগেরও মান্য । 


15.1) দেবতাদের দিবারাত্রি ও বৎসর


আমাদের উত্তরায়নই দেবতাদের দিন এবং আমাদের দক্ষিণায়নই দেবতাদের রাত্ৰি । কারণ, শুধু স্মৃতিগ্রন্থাদিতে নহে পরন্তু জ্যোতিষশাস্ত্ৰের সংহিতাদিতেও বর্ণনা আছে [সূর্যসিদ্ধান্ত|১|১৩; ১২|৩৫, ৬৭] যে, দেবতা মেরুপর্বতের উপর অর্থাৎ উত্তর ধ্রুবস্থানে থাকেন । অর্থাৎ দুই অয়নের আমাদের এক বৎসরই দেবতাদের এক দিবারাত্রি এবং আমাদের ৩৬০ বৎসরে দেবতাদের ৩৬০ দিবারাত্রি বা এক বৎসর । 


15.2) চারিযুগ + সন্ধিকাল = মহাযুগ


সত্য, ত্রেতা, দ্বাপরকলি এইরূপ আমাদের চারি যুগ ৷ এই চারিযুগের কালগণনা এইরূপ - সত্যযুগের চারি হাজার বৎসর, ত্ৰেতাযুগের তিনি হাজার, দ্বাপরের দুই হাজার এবং কলির এক হাজার বৎসর । কিন্তু এক যুগ শেষ হইতেই অন্য যুগ একেবারে আরম্ভ না হইয়া মধ্যে দুয়ের গোলযোগ অর্থাৎ সন্ধিকালের কএক বৎসর চলিয়া যায় । এই প্রকারে সত্যযুগের আদিতে ও অন্তে প্ৰত্যেক দিকে চারিশত বর্ষের, ক্রেতাযুগের আদিতে ও অন্তে প্ৰত্যেক দিকে তিনশত বর্ষের, দ্বাপরের আদিতে ও অন্তে প্ৰত্যেক দিকে দুই শত বর্ষের, এবং কলিযুগের পুর্ব পশ্চাৎ প্রত্যেক দিকে একশত বর্ষের সন্ধিকাল মিলিয়া মোট চারিযুগের আদ্যন্তের সন্ধিকাল দুই হাজার বৎসর হয় । এই দুই হাজার বৎসর এবং সত্য, ত্ৰেতা, দ্বাপর ও কলি ইহাদের পূর্ববর্ণিত সাংখ্যমতে চারি যুগের দশ হাজার বৎসর মিলিয়া মোট বারো হাজার বৎসর হয় । এই বারো হাজার বৎসর মনুষ্যদিগের না দেবতাদিগের ? মনুষ্যের বলিয়া ধরিলে, কলিযুগের আরম্ভ হইতে এক্ষণে পাঁচ হাজার বৎসরের উপর হইয়া গিয়াছে; কাজেই বলিতে হয় যে, হাজার মানব-বৎসরের কলিযুগ শেষ হইয়াছে, পুনরায় তার পরে আগন্তব্য সত্যযুগও শেষ হইয়া এক্ষণে ক্রেতাযুগ আসিয়াছে । এই বিরোধকে ঠেকাইবার জন্য এই বারো হাজার বৎসর দেবতাদের, এইরূপ পুরাণে নিৰ্ধারিত হইয়াছে । দেবতাদিগের বারো হাজার বৎসর, মনুষ্যদের ৩৬০ x ১২,০০০ = ৪৩,২০,০০০ অর্থাৎ তেতাল্লিশ লক্ষ, বিশ হাজার বৎসর হয় । এখনকার পঞ্জিকায় যুগপরিমাণ এই পদ্ধতিতেই বর্ণিত হইয়া থাকে । (দেবতাদের) বারো হাজার বৎসর মিলিয়া মনুষ্যদের এক মহাযুগ বা দেবতাদের এক যুগ হয় । 


15.3) মন্বন্তর ও কল্প


দেবতাদের একাত্তর যুগে এক মন্বন্তর বলা যায় এবং এইরূপ মন্বন্তর চৌদ্দটী । কিন্তু প্ৰথম মন্বন্তরের আরম্ভে ও শেষে, এবং পরে প্রত্যেক মন্বন্তরের শেষে দুই দিকে সত্যযুগের ন্যায় একাদিক্ৰমে এইরূপ পনেরো সন্ধিকাল হইয়া থাকে ৷ এই পনেরো সন্ধিকাল ও চৌদ্দ মন্বন্তর মিলিয়া দেবতাদের এক হাজার যুগ কিংবা ব্ৰহ্মদেবের এক দিন হয় [সূর্যসিদ্ধান্ত|১|১৫-২০]; এবং মনুস্মৃতিতে ও মহাভারতে লিখিত হইয়াছে যে, এইরূপ হাজার যুগ মিলিয়া ব্ৰহ্মদেবের এক রাত্রি হয় [মনু|১|৬৯-৭৩ ও ৭৯; মভা|শাং|২৩১|১৮-২১; এবং যাস্কের নিরুক্ত|১৪|৯ দেখ] । এই গণনানুসারে ব্ৰহ্মদেবের একদিন মনুষ্যের চার অর্বুদ বত্রিশ কোটি বৎসর হয়, এবং ইহারই নাম – কল্প(জ্যোতিষশাস্ত্রের ভিত্তিতে যুগাদির গণনার বিচার স্বর্গীয় শঙ্কর বালকৃষ্ণ দীক্ষিত স্বীয় ‘ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র’ নামক গ্রন্থে ঠিকঠিকানা করিয়াছেন । তাহা দেখ পৃঃ১০৩-১০৫; ১৯৩ ইত্যাদি ।)

ভগবদ্গীতাতে [গী|৮|১৮ ও ৯|৭ দেখ], স্মৃতিগ্রন্থে এবং মহাভারতেও কথিত হইয়াছে যে, ব্ৰহ্মদেবের এই দিন কিংবা কল্প আরম্ভ হইলে পর -
অব্যক্তাদ্‌ব্যক্তয়ঃ সর্বাঃ প্ৰভবন্ত্যহরাগমে ৷
রাত্ৰ্যাগমে প্ৰলীয়ন্তে তত্ৰৈবাব্যক্তসঙ্গকে ॥
“অব্যক্ত হইতে জগতের সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ উৎপন্ন হইয়া থাকে; এবং ব্ৰহ্মদেবের রাত্রি শুরু হইলে, সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ আবার অব্যক্তের মধ্যে লয় প্ৰাপ্ত হয়” । ইহা ব্যতীত অন্যান্য প্রলয়েরও কথা পুরাণ-সমূহে বর্ণিত হইয়াছে । কিন্তু এই প্ৰলয়সমূহে সূৰ্যচন্দ্ৰাদি সমস্ত জগতের নাশ না হওয়ায়, ব্ৰহ্মাণ্ডের উৎপত্তি ও সংহারের বিচার করিবার সময় ইহাদিগকে জমার মধ্যে ধরা হয় না । কল্প - ব্রহ্মদেবের এক দিন কিংবা রাত্রি; এবং এইরূপ ৩৬০ দিন ও ৩৬০ রাত্রিই তাঁহার এক বৎসর । তাই পুরাণাদিতে বৰ্ণনা আছে [বিষ্ণুপুরাণ|১|৩ দেখ] যে, ব্ৰহ্মদেবের আয়ু একশত বৎসর, তাহার অর্ধেক চলিয়া গিয়াছে, দ্বিতীয় অর্ধেক অর্থাৎ ৫১ বৎসরের প্রথম দিন কিংবা শ্বেতবারাহ নামক কল্প এখন শুরু হইয়াছে; এবং এই কল্পের চৌদ্দ মন্বন্তরের মধ্যে ছয় মন্বন্তর গিয়া সপ্তম অর্থাৎ বৈবস্বত মন্বন্তরের ৭১ মহাযুগের মধ্যে ২৭ মহাযুগ পুর্ণ হইয়া ২৮তম মহাযুগের অন্তৰ্গত কলিযুগের প্রথম পাদ অর্থাৎ চতুর্থ ভাগ এখন চলিতেছে । ১৯৫৬ সন্বতে (১৮২১ সকে) এই কলিযুগের ঠিক ৫০০০ বৎসর অতীত হইয়াছিল । এই অনুসারে হিসাব করিলে দেখা যাইবে যে, কলিযুগের প্রলয় হইতে ১৮২১ অব্দে (১৯৫৬ সম্বতে) মনুষ্যের চারি লক্ষ সাতাশ হাজার বৎসর বাকী ছিল; আর বর্তমান মন্বন্তরের শেষে কিংবা এখনকার কল্পান্তে যে মহাপ্ৰলয় হইবে সে ত দূরেই রহিয়া গেল ! মানবী চার অব্জ বত্ৰিশ কোটি বৎসরের ব্ৰহ্মদেবের যে দিন এখন চলিতেছে, তাহার পূর্ণ মধ্যাহ্নও এখনো হইল না অর্থাৎ সাত মন্বন্তর এখনও অতীত হয় নাই !


16) সৃষ্টির উৎপত্তির অন্য ক্রমের সহিত বিরোধ ও একতা


জগতের উৎপত্তি ও সংহারের এখন পর্যন্ত যে বিচার করা হইয়াছে তাহা বেদান্তের উপর এবং পরব্রহ্মকে ছাড়িয়া দিলে সাংখ্যশাস্ত্রের তত্ত্বজ্ঞানের উপর করা হইয়াছে, সেই কারণে জগৎ উৎপত্তিক্রমের এই পরম্পরাই আমাদের শাস্ত্রকার সর্বদা প্ৰমাণ বলিয়া মনে করেন, এবং ভগবদ্‌গীতাতেও এই ক্রমই প্রদত্ত হইয়াছে । এই প্রকরণের আরম্ভেই কথিত হইয়াছে যে, সৃষ্টির উৎপত্তিক্রমের সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন বিচারও দেখা যায়; যেমন শ্রুতি স্মৃতি পুরাণের কোন কোন স্থানে কথিত আছে যে, প্ৰথমে ব্ৰহ্মদেব বা হিরণগৰ্ভ উৎপন্ন হয়েন কিংবা জল প্ৰথমে উৎপন্ন হয় এবং তাহাতে পরমেশ্বরের বীজ হইতে এক সুবৰ্ণময় অণ্ড উৎপন্ন হয় । কিন্তু এই সমস্ত বিচার গৌণ ও উপলক্ষণাত্মক বুঝিয়া তাহাদের উপপত্তি বুঝাইবার প্রসঙ্গ যখন আসে তখন ইহাই বলা যায় যে, হিরণ্যগর্ভ কিংবা ব্ৰহ্মদেব অর্থে প্ৰকৃতিই বুঝায় । ভগবদ্‌গীতাতেও “মম যোনির্মহৎ ব্ৰহ্ম” [গী|১৪|৩] এইরূপ ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতিকেই ব্ৰহ্ম বলা হইয়াছে, এবং ভগবান ইহাও বলিয়াছেন যে, আমার বীজ হইতে এই প্ৰকৃতিতে ত্ৰিগুণের দ্বারা অনেক মূর্তি উৎপন্ন হয় । অনাত্র এইরূপ বর্ণন আছে যে, ব্ৰহ্মদেব হইতে আরম্ভে দক্ষাদি সাত মানসপুত্র বা সাত মনু উৎপন্ন হইয়া তাঁহারা পরে চরাচর জগৎ নির্মাণ করিলেন [মভা|আ|৬৫-৬৭; মভা|শাং|২০৩; মনু|১|৩৪-৬৩]; এবং ইহার উল্লেখ একবার গীতাতেও করা হইয়াছে [গী|১০|৬] । কিন্তু বেদান্তগ্ৰন্থ ইহাই প্ৰতিপাদন করে যে, এই সকল বিভিন্ন বর্ণনাতে ব্ৰহ্মদেবকেই প্ৰকৃতি ধরিলে উপরি-প্রদত্ত তাত্ত্বিক জগদুৎপত্তিক্রমের সহিত মিল হইয়া যায়; এবং এ নিয়ম অন্যত্রও উপযোগী হইতে পারে । উদাহরণ যথা, শৈব ও পাশুপতদর্শনে শিবকে নিমিত্ত-কারণ জ্ঞান করিয়া তাহা হইতে কার্যকারণাদি পাঁচ পদার্থ উৎপন্ন হয়, এইরূপ মত দেখা যায়; এবং নারায়ণীয় ভাগবত ধর্মে বাসুদেবকে প্ৰধান মানিয়া বাসুদেব হইতে প্ৰথমে সংকর্ষণ (জীব), সংকর্ষণ হইতে প্ৰদ্যুম্ন (মন) এবং প্ৰদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধ (অহঙ্কার) উৎপন্ন হয় এইরূপ বর্ণনা আছে । কিন্তু বেদান্তশাস্ত্ৰানুসারে জীব প্ৰত্যেকবারই নব নব উৎপন্ন হয় না, উহা নিত্য ও সনাতন পরমেশ্বরের, নিত্য (অতএব অনাদি) অংশ; তাই বেদান্তসূত্রের দ্বিতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে [বেসূ|২|২|৪২-৪৫] ভাগবতধর্মোক্ত জীবের উৎপত্তিবিষয়ক উপরি-উক্ত মতের খণ্ডন করিয়া ঐ মত বেদবিরুদ্ধ অতএব তাজ্য, এইরূপ কথিত হইয়াছে । এবং গীতাতে বেদান্তসূত্ৰের এই সিদ্ধান্তেরই অনুবাদ করা হইয়াছে [গী|১৩|৪; ১৫|৭] । সেইরূপ আবার সাংখ্যবাদী প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই উভয়কে স্বতন্ত্র তত্ত্ব মানিয়া থাকেন; কিন্তু এই দ্বৈত অস্বীকার করিয়া প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই তত্ত্ব নিত্য ও নির্গুণ এক পরমাত্মারই বিভূতি, ইহাই বেদান্ত সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । ভগবদ্‌গীতাতেও এই সিদ্ধান্ত গ্ৰাহ্য হইয়াছে [গী|৯|১০] । কিন্তু এই সম্বন্ধে সবিস্তার বিচার পরবর্তী প্রকরণে করা যাইবে । এখানে ইহাই বক্তব্য যে, ভাগবত বা নারায়ণীয় ধর্মে বর্ণিত বাসুদেবভক্তির ও প্রবৃত্তিপর ধর্মেৱ তত্ত্ব ভগবদ্‌গীতায় মান্য হইলেও গীতাতে ভাগবতধর্মের এই কল্পনা স্বীকৃত হয় নাই যে, বাসুদেব হইতে সংকর্ষণ বা জীব উৎপন্ন হয় এবং তাহার পরে প্ৰদ্যুম্ন (মন) এবং প্ৰদ্যুম্ন হইতে অনিরুদ্ধ (অহঙ্কার) প্রাদুর্ভূত হয় । সংকর্ষণ, প্ৰদ্যুম্ন, বা অনিরুদ্ধ, ইহাদের নামও গীতায় কোথাও আসে নাই । পাঞ্চরাত্রে কথিত ভাগবতধর্ম এবং গীতার ভাগবত ধর্মের মধ্যে ইহাই গুরুতর ভেদ । এই বিষয়ের উল্লেখ এখানে জানিয়া বুঝিয়া করা হইয়াছে; কারণ “ভগবদ্গীতাতে ভাগবতধর্ম বলা হইয়াছে” এইটুকু হইতে কেহ ইহা না বুঝেন যে জগতের উৎপত্তি ক্রমসম্বন্ধে কিংবা জীব-পরমেশ্বর স্বরূপ সম্বন্ধে ভাগবতাদি ভক্তি-সম্প্রদায়ের মতও গীতার মান্য । 

এক্ষণে সাংখ্যশাস্ত্রোক্ত প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুয়েরই বাহিরে ব্যক্তাব্যক্ত ও ক্ষরাক্ষর জগতে মূলের অন্য কোন তত্ত্ব আছে কি না তাহার বিচার করিব । ইহারই নাম অধ্যাত্ম কিংবা বেদান্ত ।


ইতি অষ্টম প্রকরণ সমাপ্ত

___________________________
References:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

সৃষ্টিতত্ত্ব এবং সাংখ্যের ২৫ তত্ত্ব (Cosmology & Sankhya Philosophy) in "Sri Gita" or "Srimadbhagabadgeeta" by Gitashastri Jagadish Chandra Ghosh & Anil Chandra Ghosh. 26th Edition - June 1997 (1st Edition, 1925 from Dhaka now in Bangladesh). Published by Subhadra Dey (Ghosh), Presidency Library, 15 Bankim Chatterjee Street, Kolkata-700073. Printed by Web Impressions Pvt.Ltd., 34/2 Beadon Street, Kolkata-700006.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment