Sunday, June 4, 2017

অধ্যাত্ম (Spirituality)

অধ্যাত্ম


পরস্তস্মাত্তু ভাবোহন্যোহব্যক্তোহব্যক্তাৎ সনাতনঃ ৷
যঃ স সর্ব্বেষু ভুতেষু নশ্যাৎসু ন বিনশ্যতি ॥ [গীতা |৮|২০]

(“সেই (সাংখ্যা) অব্যক্ত হইতেও শ্রেষ্ঠ ও সনাতন যে অন্য অব্যক্ত পদাৰ্থ, যাহা সমস্ত প্ৰাণী বিনষ্ট হইলেও নাশ প্রাপ্ত হয় না”, তাহাই চরম গতি” ।)


সূচীপত্র



1) প্রকৃতি ও পুরুষরূপে দ্বৈতসম্বন্ধে আপত্তি
2) উভয়ের অতীত বিষয়ের বিচার করিবার পদ্ধতি
3) উভয়ের অতীত একই পরমাত্মা অথবা পরমপুরুষ
4) প্রকৃতি (জগৎ), পুরুষ (জীব) এবং পরমেশ্বর, এই ত্রয়ী
5) গীতাতে বর্ণিত পরমেশ্বরের স্বরূপ
5.1) ব্যক্ত অথবা সগুণ রূপ এবং উহার গৌণতা
5.2) অব্যক্ত কিন্তু মায়া দ্বারা ব্যক্ত
5.3) অব্যক্তেরই তিন ভেদ - সগুণ, নির্গুণ ও সগুণ-নির্গুণ
6) উপনিষদে উপাসনার জন্য ব্যাখ্যাত বিদ্যা ও প্রতীক
7) ত্রিবিধ অব্যক্তরূপের মধ্যে নির্গুণই শ্রেষ্ঠ
8) উক্ত সিদ্ধান্তসমূহের শাস্ত্রীয় উপপত্তি
9) নির্গুণ ও সগুণের গহন অর্থ
10) অমৃততত্ত্বের স্বভাবসিদ্ধ কল্পনা
11) সৃষ্টিজ্ঞান কিরূপে এবং কাহার হয় ?
12) জ্ঞানক্রিয়ার বর্ণনা
13) নামরূপের ব্যাখ্যা ও বস্তুতত্ত্ব
14) সত্যের ব্যাখ্যা
14.1) বিনশ্বর হইলে নামরূপ অসত্য এবং নিত্য হইলে বস্তুতত্ত্ব সত্য
15) বস্তুতত্ত্বই অক্ষরব্রহ্ম এবং নামরূপ মায়া
16) সত্য ও মিথ্যা শব্দের বেদান্তশাস্ত্রানুসারী অর্থ
17) আধিভৌতিক শাস্ত্রের নামরূপাত্মকতা
18) বিজ্ঞান-বাদ বেদান্তের গ্রাহ্য নহে
19) মায়াবাদের প্রাচীনতা
20) নামরূপে আচ্ছাদিত নিত্য ব্রহ্মের এবং শরীর আত্মার স্বরূপ একই
21) আত্মা ও ব্ৰহ্মকে চিদ্‌রূপী কেন বলে ?
22) ব্রহ্মাত্মৈক্য অর্থাৎ এই জ্ঞান যে 'যাহা পিণ্ডে, তাহাই ব্রহ্মাণ্ডে'
23) ব্রহ্মানন্দ
24) আমিত্বের মৃত্যু
25) তুরীয়াবস্থা অথবা নির্বিকল্প সমাধি
26) অমৃতত্ত্ব-সীমা এবং মরণের মরণ
27) দ্বৈতবাদের উৎপত্তি গীতা ও উপনিষদ উভয় অদ্বৈত বেদান্তেরই প্রতিপাদন করে
28) নির্গুণে সগুণ মায়ার উৎপত্তি কিরূপে হয়
29) বিবর্ত্তবাদ এবং গুণ পরিণামবাদ
30) ব্রহ্মের সত্যানৃতত্ব
31) ওঁ-তৎসৎ এবং অন্য ব্রহ্মনির্দেশ
32) জীব পরমেশ্বরের 'অংশ' কি প্রকারে
33) পরমেশ্বর দিককাল সীমাহীন
34) অধ্যাত্মশাস্ত্রের চরম সিদ্ধান্ত
35) দেহেন্দ্রিয়ে প্রবিদ্ধ সাম্যবুদ্ধি
36) মোক্ষরূপ ও সিদ্ধাবস্থার বর্ণনা
37) ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের সার্থ বিবরণ
38) পূর্বাপর প্রকরণের সঙ্গতি


1) প্রকৃতি ও পুরুষরূপে দ্বৈতসম্বন্ধে আপত্তি


পূৰ্ববর্তী দুই প্রকরণের মর্মার্থ এই যে, ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারে যাহাকে ক্ষেত্ৰজ বলে তাহারই নাম সাংখ্যশাস্ত্ৰে পুরুষ; সমস্ত ক্ষরাক্ষর বা চরাচর জগতের সংহা্র ও সৃষ্টির বিচার করিবার সময়, সাংখ্যমতানুসারে শেষে প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই দুই-ই স্বতন্ত্র ও অনাদি মূলতত্ত্ব থাকিয়া যায়; এবং আপনার সমস্ত দুঃখের অত্যন্ত নিবৃত্তি করিয়া মোক্ষলাভ করিতে হইলে, প্ৰকৃতি হইতে আপন ভিন্নতা অর্থাৎ কৈবল্য উপলব্ধি করিয়া পুরুষের ত্ৰিগুণাতীত হওয়া চাই । প্ৰকৃতি ও পুরুষের সংযোগ হইলে পর প্রকৃতি আপন প্ৰপঞ্চ পুরুষের সম্মুখে কেমন করিয়া বিস্তার করে এই বিষয়ের ক্রম আধুনিক সৃষ্টিশাস্ত্রবেত্তাগণ সাংখ্যশাস্ত্ৰ হইতে কিঞ্চিৎ ভিন্ন করিয়া বলিয়াছেন; এবং আধিভৌতিক শাস্ত্রসমূহের যেমন যেমন উন্নতি হইবে, তেমনি তেমনি এই ক্রম বিষয়ে আরও সংশোধন হইতে থাকিবার সম্ভাবনা আছে । যাই হোক, এক অব্যক্ত প্ৰকৃতি হইতেই সমস্ত ব্যক্ত পদার্থ গুণোৎকর্ষ অনুসারে ক্ৰমে ক্ৰমে উৎপন্ন হইয়াছে, এই মূল সিদ্ধান্তে কোনই পার্থক্য হইতে পারে না । তথাপি, এই বিষয় অন্য শাস্ত্রের, আমাদের নহে, এইরূপ মনে করিয়া বেদান্ত-কেশরী সেই সম্বন্ধে বিবাদ করিতে বসেন না । তিনি এই সমস্ত শাস্ত্রের অগ্ৰে চলিয়া পিণ্ডব্ৰহ্মাণ্ডেরও মূলে কোন শ্ৰেষ্ঠ তত্ত্ব আছে এবং মনুষ্য কেমন করিয়া সেই শ্রেষ্ঠতত্ত্বে মিলিত হইতে পারে অর্থাৎ কেমন করিয়া তদ্রূপ হইতে পারে তাহা বুঝাইবার জন্য প্ৰবৃত্ত হইয়াছেন । তাঁহার এই রাজ্যের মধ্যে অন্য কোন শাস্ত্রের গর্জন চলিতে দেন না । সিংহের সম্মুখে যেরূপ শৃগাল চুপ হইয়া যায় সেইরূপ বেদান্তের সম্মুখে অন্য শাস্ত্ৰসকলও নীরব হইয়া যায় । তাই একজন প্রাচীন সুভাষিতকার বেদান্তের যথার্থ বর্ণনা করিয়াছেন যে, -
তাবৎ গর্জন্তি শাস্ত্ৰাণি জম্বুকা বিপিনে যথা ৷
ন গর্জতি মহাশক্তিঃ যাবৎ বেদান্তকেসরী ॥
ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞের বিচারান্তে নিষ্পন্ন ‘দ্রষ্টা’ অৰ্থাৎ পুরুষ বা আত্মা এবং ক্ষরাক্ষর জগতের বিচারান্তে নিষ্পন্ন সত্ত্ব-রজ-তমোগুণময়ী অব্যক্ত প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র এবং জগতের মূলতত্ত্বকে এইরূপ দ্বিধা বলিয়৷ মানিতেই হয় - এইরূপ সাংখ্য বলেন । কিন্তু বেদান্ত আরও অগ্রসর হইয়া এইরূপ বলেন যে, সাংখ্যের পুরুষ নির্গুণ হইলেও অসংখ্য হওয়া প্ৰযুক্ত ইহা মানা সংগত নহে যে, এই অসংখ্য পুরুষের লাভ কিসে হয় তাহা বুঝিয়া প্ৰত্যেক পুরুষের সহিত তদনুসারে ব্যবহার করিবার সামর্থ্য প্রকৃতির আছে । এরূপ মানা অপেক্ষা সাত্ত্বিক তত্ত্বজ্ঞানের দৃষ্টিতে ইহা স্বীকার করাই অধিক যুক্তিসঙ্গত হইবে যে, ঐ একীকরণের জ্ঞানক্রিয়ার শেষ পর্যন্ত নির্বিবাদ প্রয়োগ করা হৌক এবং প্রকৃতি ও অসংখ্য পুরুষের একই পরমতত্ত্বে অবিভক্তরূপে সমাবেশ করা হৌক যাহা “অবিভক্তং বিভক্তেষু” এই অনুসারে নিম্ন হইতে উচ্চ পর্যন্ত শ্ৰেণীসমূহে দেখা যায় এবং যাহার সহায়তাতেই সৃষ্টির অনেক ব্যক্ত পদার্থ এক অব্যক্ত প্ৰকৃতিতে সমাবেশ করা হয় [গী|১৮, ২০-২২] । ভিন্নতার অবভাস হওয়া অহঙ্কারের পরিণাম; এবং পুরুষ যদি নির্গুণ হয়, তবে অসংখ্য পুরুষের পৃথক থাকিবার গুণ উহাতে থাকিতে পারে না । কিংবা বলিতে হয় যে, বস্তুত পুরুষ অসংখ্য নহে, কেবল প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন অহঙ্কার গুণরূপী উপাধির কারণেই উহাতে অসংখ্যতা দেখা যায় । তা ছাড়া আর এক প্রশ্ন এই উঠে যে, স্বতন্ত্র প্রকৃতির সহিত স্বতন্ত্র পুরুষের যে সংযোগ হইয়াছে তাহা সত্য বা মিথ্যা ? সত্য বলিয়া মানিলে সেই সংযোগ কখনই দূর হইতে পারে না, সুতরাং সাংখ্যমতানুসারে আত্মা কখনই মুক্তি লাভ করিতে পারে না । মিথ্যা বলিয়া যদি মানা যায়, তাহা হইলে, পুরুষের সংযোগ প্ৰযুক্ত প্ৰকৃতি, পুরুষের সম্মুখে নিজের বাজার সাজাইতে যে বসিয়া যান, সে কথা নির্মূল হয় । গাভী যেরূপ বাছুরের জন্য দুধ দেয় সেইরূপ পুরুষের লাভের জন্যই প্ৰকৃতি কার্যতৎপর থাকেন, এই দৃষ্টান্তও খাটে না; কারণ, গরুর পেটেই বাছুর হয় বলিয়া বাছুরের উপর গরুর সন্তানবাৎসল্যের উদাহরণ যেরূপ দেখান যায়, প্ৰকৃতি ও পুরুষ সম্বন্ধে সেরূপ দেখান যায় না [বেসু|শাং|ভা|২|২|৩] । প্ৰকৃতি ও পুরুষ সাংখ্যশাস্ত্ৰানুসারে মূলেই অত্যন্ত ভিন্ন - একটি জড়, আর একটি সচেতন । জগতের আরম্ভ হইতেই এই দুই পদার্থ যদি অত্যন্ত ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হইল, তবে আবার একের প্রবৃত্তি অন্যটির লাভের জন্য কেন হইবে ? ইহাই উহাদের স্বভাব, ইহা কিছুমাত্ৰ সন্তোষজনক উত্তর নহে । স্বভাবকেই যদি মানিতে হয়, তাহা হইলে হেকলের জড়াদ্বৈত মন্দই বা কি ? মূল প্ৰকৃতির গুণের বৃদ্ধি হইতে হইতে সেই প্ৰকৃতিতে আপনাকে দেখিবার ও আপনার সম্বন্ধে বিচার করিবার চৈতন্যশক্তি উৎপন্ন হয়, অর্থাৎ ইহা তাহার স্বভাবই, হেকলেরও ইহাই সিদ্ধান্ত কি না ? কিন্তু এইমত স্বীকার না করিয়া সাংখ্যশাস্ত্র এই ভেদ করিয়াছেন যে, ‘দ্রষ্টা’ পৃথক এবং ‘দৃশ্যজগৎ’ পৃথক । এখন এই প্রশ্ন উপস্থিত হয় যে, যে ন্যায়ানুসারে সাংখ্যবাদী এই ভেদ দেখান সেই ন্যায়ের উপযোগ করত আরও অগ্ৰে চলিব না কেন ? বাহ্য জগৎ তন্নতন্ন করিয়া পরীক্ষা করিলেও এবং চক্ষুর স্নায়ুর মধ্যে অমুক অমুক গুণধর্ম আছে নির্ধারণ করিলেও, এই সকল বিষয়ের জ্ঞাতা বা ‘দ্রষ্টা’ ভিন্ন রহিয়াই যায় । 


2) উভয়ের অতীত বিষয়ের বিচার করিবার পদ্ধতি


‘দ্রষ্টা’ পুরুষ ‘দৃশ্যজগৎ’ হইতে ভিন্ন, ইহা বিচার করিবার কোন সাধন বা উপায় কি নাই ? এবং ইহা জানিবার কোন মার্গ আছে কি নাই যে, এই দৃশ্য জগতের প্রকৃত স্বরূপ, আমাদের ইন্দ্রিয়ের দ্বারা আমরা যেরূপ দেখি তাহাই ঠিক কিংবা তাহা হইতে ভিন্ন ? সাংখ্যবাদী বলেন যে, এই প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া অসম্ভব বলিয়া প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুই তত্ত্ব মূলেই ভিন্ন ও স্বতন্ত্র এইরূপ ধরিয়া লইতে হয় । নিছক্‌ আধিভৌতিক শাস্ত্রের পদ্ধতি অনুসারে বিচার করিলেও সাংখ্যের উক্ত মত অসঙ্গত বলিতে পারা যায় না । কারণ, জগতের অন্য পদার্থ যেরূপ আমাদের ইন্দ্রিয়ের গোচর হইলে আমরা তাহাদের গুণধর্মের পরীক্ষা করিয়া থাকি, সেইরূপ এই ‘দ্রষ্টা’ পুরুষ যাহাক বেদান্ত ‘আত্মা’ বলেন সে দ্রষ্টার অর্থাৎ আপনারই ইন্দ্রিয়ের ভিন্ন-ভিন্নরূপে কখনও গোচর হইতে পারে না । এবং যে পদার্থ এইরূপ ইন্দ্রিয়ের গোচর হইতে পারে না অর্থাৎ ইন্দ্রিয়াতীত, মানবী ইন্দ্রিয়ের দ্বারা তাহার পরীক্ষা কি প্রকারে সম্ভব ? ভগবান ভগবদ্গীতাতেও ঐ আত্মার এই প্রকার বর্ণনা করিয়াছেন [গী|২|২৩] -
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্ৰাণি নৈনং দহতি পাবকঃ ৷
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥
অর্থাৎ আত্মা এরূপ পদার্থ নহে যে জগতের অন্য পদার্থের ন্যায় আমরা তাহার উপর উষ্ণ জল প্ৰভৃতি তরল পদার্থ ঢালিয়া দিলে তাহা দ্রব হইবে, কিংবা প্রয়োগশালার তীক্ষ্ণ শস্ত্রের দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া তাহার আন্তরিকস্বরূপ দেখিয়া লইব, অথবা অগ্নির উপর রাখিলে তাহা ধোঁয়া হইয়া যাইবে কিংবা বাতাসে তাহা শুকাইয়া যাইবে ! সারকথা, জাগতিক পদার্থের পরীক্ষা করিবার, আধিভৌতিক শাস্ত্রবেত্তাদিগের যে কোন উপায় আছে সে সমস্ত এস্থলে নিষ্ফল হইয়া যায় । তখন সহজেই প্রশ্ন উঠে যে, তবে আত্মার পরীক্ষা হইবে কি প্রকারে ? প্রশ্নটি কঠিন বলিয়া মনে হয় সত্য; কিন্তু একটু বিচার করিয়া দেখিলে ইহার মধ্যে কিছুই কঠিন নাই । সাংখ্যবাদীগণও ‘পুরুষকে’ নির্গুণ ও স্বতন্ত্র কিরূপে স্থির করিলেন ? আপন অন্তঃকরণের অনুভূতি হইতেই কি নহে ? তবে এই রীতিই প্রকৃতি ও পুরুষের স্বরূপ নির্ণয়ে কেন প্রয়োগ করা যাইবে না ? আধিভৌতিক শাস্ত্রের বিষয় ইন্দ্রিয়গোচর হইয়া থাকে; এবং অধ্যাত্মশাস্ত্রের বিষয় ইন্দ্ৰিয়াতীত অর্থাৎ নিছক স্বসম্বেদ্য হয় অথবা আপনিই আপনাকে জানিবার যোগ্য । কেহ যদি এইরূপ বলেন যে, ‘আত্মা’ যদি স্বসম্বেদ্য হয় তবে প্ৰত্যেক মনুষ্যের ঐ বিষয়ে যেরূপ জ্ঞান হইবে তাহাই হইতে দাও; তবে অধ্যাত্মশাস্ত্রের প্রয়োজন কি ? হাঁ, প্রত্যেক মনুষ্যের মন কিংবা অন্তঃকরণ যদি সমান শুদ্ধ হয়, তবে এই প্রশ্ন যোগ্য প্রশ্ন হইবে । কিন্তু যখন সকল লোকের মনের শুদ্ধি ও শক্তি এক প্রকার নহে বলিয়া আমরা জানি, তখন যাঁহাদের মন অত্যন্ত শুদ্ধ, পবিত্র ও বিশাল, তাঁহাদেরই প্ৰতীতি এই বিষয়ে আমাদের প্রমাণ বলিয়া মানিতে হইবে । অনৰ্থক “আমার এইরূপ মনে হয়” কিংবা “তোমার এইরূপ মনে হয়” বলিয়া বাদবিতণ্ডা বাড়াইয়া কোন লাভ নাই । যুক্তিবাদ ছাড়িয়া দেও, বেদান্তশাস্ত্র সে কথা একেবারেই বলে না । বেদান্তশাস্ত্ৰ ইহাই বলে যে, অধ্যাত্মশাস্ত্রের বিষয় স্বসম্বেদ্য অর্থাৎ নিছক আধিভৌতিক যুক্তির দ্বারা নির্ণীত হইবার নহে বলিয়া যে সকল যুক্তি অত্যন্ত শুদ্ধ, পবিত্র ও বিশাল মন-বিশিষ্ট মহাত্মাদিগের এই বিষয়ে অপরোক্ষ অর্থাৎ সাক্ষাৎ অনুভবের বিরুদ্ধে না যায় সেই সকল যুক্তিই গ্ৰাহ্য হইতে পারে । আধিভৌতিক শাস্ত্ৰে যেরূপ প্ৰত্যক্ষের বিরুদ্ধ অনুভব ত্যাজ্য বলিয়া মানা হয়, সেইরূপ বেদান্তশাস্ত্রে যুক্তি অপেক্ষা উক্ত স্বানুভূতির অর্থাৎ আত্মপ্রতীতির প্রামাণিকতা অধিক বলিয়া বিবেচিত হয় । যে যুক্তি এই অনুভূতির অনুকুল তাহাই বেদান্তীদিগের মান্য । শ্ৰীমৎ শঙ্করাচার্য আপন বেদান্তসূত্রের ভাষ্যে এই সিদ্ধান্তই দিয়াছেন । অধ্যাত্মশাস্ত্রের অনুশীলনকারীদিগের ইহা সর্বদা মনে রাখা আবশ্যক –
অচিন্ত্যা খলু যে ভাবা ন তাংস্তর্কেণ সাধয়েৎ ৷
প্রকৃতিভ্যঃ পরং যত্তু তদচিন্ত্যস্য লক্ষণম্ ॥
“ইন্দ্রিয়াতীত হওয়া প্ৰযুক্ত যে পদার্থের চিন্তা করা অসাধ্য তাহার নির্ণয় কেবল তর্কের দ্বারা কিংবা অনুমানের দ্বারা করিবে না; সমস্ত জগতের মূল প্রকৃতিরও বাহিরে যে পদার্থ তাহা এইরূপ অচিন্তনীয়” - এই একটী পুরাতন শ্লোক মহাভারতের মধ্যে [মভা|ভীষ্ম|৫|১২] পাওয়া যায় এবং ‘সাধয়েৎ’ ইহার বদলে ‘যোজয়েৎ’ এইরূপ পাঠভেদে বেদান্তসূত্ৰসম্বন্ধীয় শ্ৰীশঙ্করাচার্যের ভাষ্যেতেও গৃহীত হইয়াছে [বেসূ|শাং|ভা|২|১|২৭] । মুণ্ডক ও কঠোপনিষদেও আত্মজ্ঞান শুধু তর্কের দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায় না, ইহা কথিত হইয়াছে [মূং|৩|২|৩; কঠ|২|৮|৯ ও ২২] । অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে উপনিষদ্‌ গ্ৰন্থাদির বিশেষ মাহাত্ম্যের কারণও ইহাই । মনকে কি করিয়া একাগ্ৰ করিবে, সে বিষয়ে প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে অনেক আলোচনা হইয়া পরিশেষে এই বিষয়ে (পাতঞ্জল) যোগশাস্ত্ৰ নামক এক স্বতন্ত্র শাস্ত্রই রচিত হইয়াছে । যে সকল বড় বড় ঋষি এই শাস্ত্ৰে নিপুণ ছিলেন, এবং স্বভাবতই যাঁহাদের মন পবিত্র ও বিশাল ছিল, সেই সকল মহাত্ম্যাগণ মনকে অন্তর্মুখ করিয়া আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে যে অনুভূতি পাইয়াছিলেন, কিংবা সেই সম্বন্ধে তাঁহাদের শুদ্ধ ও শান্ত বুদ্ধির যে স্ফুরণ হইয়াছিল তাহাই উপনিষদ্‌গ্রন্থে কথিত হইয়াছে । তাই, যে কোন অধ্যাত্মতত্ত্বের নির্ণয়করণে এই শ্রুতিগ্ৰন্থসমূহে কথিত অনুভূতির শরণ গ্ৰহণ ভিন্ন আমাদের অন্য পন্থা নাই [কঠ|৪|১] । মনুষ্য কেবল স্বীয় তীক্ষ্ণবুদ্ধির দ্বারা এই আত্মপ্ৰতীতির পোষক ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের যুক্তি দেখাইতে পারে; কিন্তু তন্নিবন্ধন মূল প্ৰতীতির প্রামাণ্য এতটুকুও ন্যূনাধিক হইতে পারে না । ভগবদ্‌গীতা স্মৃতিগ্রন্থের অন্তৰ্গত সত্য; কিন্তু এই বিষয়ে তাহার যোগ্যতা উপনিষদের সমানই যে স্বীকৃত হয় ইহা প্ৰথম প্রকরণের আরম্ভেই বলিয়াছি । অতএব গীতা ও উপনিষদে প্ৰকৃতির অতীত এই অচিন্ত্য পদার্থ সম্বন্ধে কি কি সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে এই প্রকরণে শেষদিকে কেবল তাহাই উক্ত হইয়াছে; এবং উহাদের কারণের অর্থাৎ, শাস্ত্ররীতিতে উহাদের উপপত্তিয় বিচার পরে করা হইয়াছে ।


3) উভয়ের অতীত একই পরমাত্মা অথবা পরমপুরুষ


প্ৰকৃতি ও পুরুষ, সাংখ্যদিগের এই দ্বৈত ভগবদ্‌গীতার মান্য নহে । গীতান্তর্ভূত অধ্যাত্মজ্ঞানের এবং বেদান্তশাস্ত্রেরও প্রথম সিদ্ধান্ত এই যে, প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুয়েরই অতীত এক সর্বব্যাপী, অব্যক্ত ও অমৃত তত্ত্ব চরাচর জগতের মূলে আছে । সাংখ্যদিগের প্রকৃতি অব্যক্ত হইলেও ত্ৰিগুণাত্মক অর্থাৎ সগুণ । কিন্তু যাহা সগুণ তাহা নশ্বর বলিয়া, এই সগুণ ও অব্যক্ত প্ৰকৃতিরও নাশ হইলে পর শেষে যে কোন অব্যক্ত অবশিষ্ট থাকে, তাহাই সমস্ত জগতের মধ্যে সত্য ও নিত্য তত্ত্ব, প্ৰকৃতিপুরুষ বিচার করিবার সময় এই প্রকরণের আরম্ভে প্রদত্ত ভগবদ্‌গীতার অষ্টম অধ্যায়ের ২০তম শ্লোকে ইহা কথিত হইয়াছে । আরো পরে ১৫ম অধ্যায়ে [গী|১৫|১৭] ক্ষর ও অক্ষর – ব্যক্ত ও অব্যক্ত - সাংখ্যশাস্ত্রানুসারে এই দুই তত্ত্ব বলিবার পর উক্ত হইয়াছে :- 
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ ৷
যো লোকত্ৰয়মাবিশ্য বিভৰ্ত্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ ॥
অর্থাৎ এই দুই হইতে ভিন্ন যে পুরুষ তিনিই উত্তম পুরুষ, পরমাত্মসংজ্ঞক, অব্যয় ও সর্বশক্তিমান, এবং তিনিই ত্ৰিলোকে ব্যাপ্ত হইয়া তাহাদের সংরক্ষণ করেন । এই পুরুষ ক্ষর ও অক্ষর অর্থাৎ ব্যক্ত ও অব্যক্ত এই দুয়েরই অতীত হওয়ায় তাঁহার যথার্থ সংজ্ঞা ‘পুরুষোত্তম’ হইয়াছে [গী|১৫|৮] । মহাভারতেও ভূগু ঋষি ভরদ্বাজকে ‘পরমাত্মা’ ব্যাখ্যা করিবার সময় বলিয়াছেন -
আত্মা ক্ষেত্ৰজ্ঞ ইত্যুক্তঃ সংযুক্তঃ প্ৰাকৃতৈররগুণৈঃ ৷
তৈরেব তু বিনির্মুক্তঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ ॥
অর্থাৎ “আত্মা যখন প্ৰকৃতিতে বা দেহের মধ্যে বন্ধ থাকে, তখন তাহাকে ক্ষেত্ৰজ (জীবাত্মা) বলে; তাহাই প্ৰাকৃত অর্থাৎ প্রকৃতি বা দেহের গুণ হইতে মুক্ত হইলে তাহার ‘পরমাত্মা’ এই সংজ্ঞা হয় [মভা|শাং|১৮৭|২৪] । ‘পরমাত্মা’র উক্ত দুই ব্যাখ্যা ভিন্ন মনে হওয়া সম্ভব, কিন্তু বস্তুতঃ তাহা ভিন্ন নহে । ক্ষরাক্ষর জগৎ ও জীব (অথবা সাংখ্যশাস্ত্রানুসারে, অব্যক্ত প্ৰকৃতি ও পুরুষ) এই দুয়েরই অতীত একই পরমাত্মা আছেন এই কারণেও বলা যায় যে তিনি ক্ষরাক্ষরের অতীত, আবার কখনও বলা যায় যে তিনি জীব বা জীবাত্মার (পুরুষের) অতীত - এইরূপে এক পরমাত্মারই এই দুইটি লক্ষণ কিংবা ব্যাখ্যা করা হইলেও বস্তুত কোন ভিন্নতা হয় না । এই অভিপ্রায় মনে রাখিয়া কালিদাসও কুমারসম্ভবে পরমেশ্বরের বর্ণনা করিয়াছেন যে, পুরুষের লাভের জন্য সচেষ্ট প্রকৃতিও তুমিই, এবং নিজে উদাসীন থাকিয়া সেই প্রকৃতির দ্রষ্টা পুরুষও তুমিই [কুমা|২|১৩] । সেরূপ আবার গীতাতেও ভগবান বলিতেছেন “মম যোনির্মহদ্‌ব্রহ্ম” – এই প্রকৃতি আমার যোনি বা আমার এক স্বরূপ [১৪|৩] এবং জীব বা আত্মাও আমারই অংশ [১৫|৭] । ৭ম অধ্যায়েও ভগবান বলিতেছেন যে, - 
ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ ৷
অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা ॥
অর্থাৎ “পৃথ্বী, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার, এই আট প্রকারের আমার প্রকৃতি; ইহা ব্যতীত (অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং) সমস্ত জগৎ যাহা ধারণ করিয়া আছে সেই জীবও আমার অপর প্রকৃতি [গী|৭|৪,৫] । মহাভারতের শান্তিপর্বের অনেক স্থানে সাংখ্যের পঁচিশ তত্ত্বের বিচার করা হইয়াছে; কিন্তু সেখানে ইহাও বলা হইয়াছে যে, এই পঁচিশ তত্ত্বের অতীত ষড়বিংশতম এক পরম তত্ত্ব আছে, যাঁহাকে জানিতে না পারিলে মনুষ্য ‘বুদ্ধ’ হয় না [শাং|৩০৮] । আমাদের নিজের জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের দ্বারা জাগতিক পদার্থের যে জ্ঞান হয় তাহাই আমাদের সমস্ত জগৎ; তাই প্ৰকৃতি বা জগতকেই কখন কখন “জ্ঞান” এই নাম দেওয়া হয় এবং এই দৃষ্টিতে ‘পুরুষ’ জ্ঞাত বলিয়া উক্ত হয় [শাং|৩|৬|৩৫-৪১] । কিন্তু প্ৰকৃত ‘জ্ঞেয়’ যিনি [গী|১৩|১২] । তিনি প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই দুয়েরই, অর্থাৎ জ্ঞান ও জ্ঞাতা উভয়েরই অতীত হওয়ায় গীতায় তাহাকেই ‘পরমপুরুষ’ বলা হইয়াছে । ত্ৰিলোক ব্যাপ্ত করিয়া তাহার ধারয়িতা এই যে পরম বা পর-পুরুষ, তাঁহাকে জানো, তিনি এক, অব্যক্ত, নিত্য, ও অক্ষর, - এ কথা শুধু ভগবদ্‌গীতা নহে, বেদান্তশাস্ত্রের সকল গ্ৰন্থই উচ্চকণ্ঠে বলিয়াছেন । ‘অক্ষর’ ও ‘অব্যক্ত’ এই দুই বিশেষণ বা শব্দ সাংখ্যশাস্ত্ৰে প্ৰকৃতির উদ্দেশে প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে; কারণ, জগতের প্রকৃতি অপেক্ষা সূক্ষ্মতর অন্য কোন মূল কারণ নাই, ইহাই সাংখ্যদিগের সিদ্ধান্ত [সাং|কা|৬১] । কিন্তু বেদান্তদৃষ্টিতে দেখিলে, পরব্ৰহ্মই এক অ-ক্ষর হন অর্থাৎ তাঁহার কখন নাশ হয় না; তিনিই অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর; অতএব গীতায় ‘অক্ষর’ ও ‘অব্যক্ত’ এই দুই শব্দই প্ৰকৃতির অতীত পরব্রহ্মের স্বরূপ দেখাইবার জন্যও প্ৰযুক্ত হইয়া থাকে, এই বিষয় পাঠকের সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক [গী|৮|২০; ১১|৩৭; ১৫|১৬, ১৭] । বেদান্তের এই প্রকার দৃষ্টি স্বীকার করিলে, প্ৰকৃতি অব্যক্ত হইলেও তাহাকে ‘অক্ষর’ বলা যে ঠিক নহে, এ কথা সত্য । জগদ্যুৎপত্তিক্ৰমসম্বন্ধে সাংখ্যশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত সাংখ্যদিগের নিশ্চিত পরিভাষাতে কোন অদলবদল না করিয়া তাঁহাদের শব্দেই গীতাতে ক্ষরাক্ষর কিংবা ব্যক্তাব্যক্ত জগতের বর্ণনা করা হইয়াছে; কিন্তু মনে রেখো যে, এই বর্ণণ হইতে প্রকৃতি ও পুরুষের অতীত এই তৃতীয় উত্তম পুরুষের সর্বশক্তিত্বে কোন বাধা আসে না । সেইজন্য গীতারও মান্য, তাই, ভগবদ্‌গীতাতে পরব্রহ্মের স্বরূপ বলিবার যেখানে প্ৰসঙ্গ আসিয়াছে, সেখানে সাংখ্য ও বেদান্তের মতান্তর বিষয়ক সন্দেহ মিটাইবার জন্য, (সাংখ্য) অব্যক্তেরও অতীত অব্যক্ত এবং (সাংখ্য) অক্ষরেরও অতীত অক্ষর এইরূপ ভাষা প্রয়োগ করা আবশ্যক হইয়াছে । উদাহরণ যথা – এই প্রকরণের আরম্ভে প্রদত্ত শ্লোক দেখ । সারকথা, গীতা পড়িবার সময় সর্বদাই মনে রাখা আবশ্যক যে, ‘অব্যক্ত’ এবং ‘অক্ষর’ এই দুই শব্দই কখন সাংখ্যদিগের প্রকৃতির উদ্দেশে, এবং কখন বেদান্তের পরব্রহ্মের উদ্দেশে - অর্থাৎ দুই বিভিন্ন প্ৰকারে গীতায় প্ৰযুক্ত হইয়াছে । সাংখ্যদিগের অব্যক্ত প্ৰকৃতিরও অতীত অপর অব্যক্তই, বেদান্তের মতে জগতের মূল । জগতের মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে সাংখ্য ও বেদান্তের মধ্যে ইহাই উপরি-উক্ত পার্থক্য । এই পার্থক্য হইতে অধ্যাত্মশাস্ত্রোক্ত মোক্ষের স্বরূপ এবং সাংখ্যদিগের মোক্ষস্বরূপে কিরূপ পার্থক্য হইয়াছে তাহা পরে বলা যাইবে ।


4) প্রকৃতি (জগৎ), পুরুষ (জীব) এবং পরমেশ্বর, এই ত্রয়ী


প্ৰকৃতি ও পুরুষ, সাংখ্যদের এই দ্বৈতকে না মানিয়া, যখন ইহা স্বীকার করা হইয়াছে যে, এই জগতের মূলে পরমেশ্বররূপী অথবা পুরুষোত্তমরূপী এক তৃতীয় নিত্য তত্ত্ব আছে এবং প্রকৃতি ও পুরুষ উভয়ই তাঁহার বিভূতি, তখন সহজেই এই প্রশ্ন আসে যে, এই তৃতীয় মূলভূত তত্ত্বের স্বরূপ কি, এবং প্রকৃতি ও পুরুষ এই দুয়ের সহিত উহার কি সম্বন্ধ ? প্ৰকৃতি, পুরুষ ও পরমেশ্বর - এই ক্ৰয়ীকে অধ্যাত্মশাস্ত্রে, যথাক্রমে জগৎ, জীব ও পরব্রহ্ম বলা হয়; এবং এই তিন বস্তুরই স্বরূপ ও ইহাদের পরম্পরসম্বন্ধ নির্ণয় করাই বেদান্তশাস্ত্রের মুখ্য কার্য; উপনিষদেও ইহারই আলোচনা করা হইয়াছে । কিন্তু এই বিষয়ে সমস্ত বেদান্তের মতের ঐক্য নাই । কেহ কেহ মনে করেন যে, এই তিন পদার্থ মুলে একই; এবং কেহ বা মনে করেন যে, জীব ও জগৎ পরমেশ্বর হইতে আদিতেই অল্প বা অত্যন্ত ভিন্ন । ইহা হইতেই বেদান্তীদিগের অদ্বৈতী, বিশিষ্টাদ্বৈতী ও দ্বৈতী এইরূপ ভেদ হইয়াছে । জীব ও জগতের সমস্ত ব্যবহার পরমেশ্বরের ইচ্ছায় চলিতেছে এই সিদ্ধান্ত সকলেরই সমান গ্ৰাহ্য । কিন্তু কতক লোক বলেন যে, জীব, জগত ও পরব্রহ্ম এই তিন বস্তুর মূলস্বরূপ আকাশের ন্যায় এক ও অখণ্ড; আবার অন্য বেদান্তী বলেন যে, জড় ও চৈতন্য এক হইতে পারে না বলিয়া, দাড়িমের ফলের অনেক দানা থাকিলেও তাহার ফলের একত্ব যেমন লোপ পায় না, তেমনি জীব ও জগৎ পরমেশ্বরের মধ্যে ওতপ্ৰোত থাকিলেও উহা পরমেশ্বর হইতে মূলেতে ভিন্ন এবং তিনিই “এক” বলিয়া যখন উপনিষদে বর্ণিত হয় তখন তাহার অর্থে ‘দাড়িমের ফলের ন্যায় এক” এইরূপ বুঝিতে হইবে । জীবের স্বরূপ সম্বন্ধে যখন এই মতান্তর উপস্থিত হইল, তখন ভিন্ন ভিন্ন সাম্প্রদায়িক টীকাকার নিজ নিজ মতানুসারে উপনিষদসমূহের এবং গীতারও শব্দসকলের টানিয়া বুনিয়া অৰ্থ বাহির করিতে লাগিলেন । তাহার পরিণামে গীতার প্রকৃত স্বরূপ - উহার প্রতিপাদ্য সত্য - কর্মযোগ বিষয় তো একপাশে থাকিয়া গেল এবং অনেক সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের মতে গীতার মুখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় ইহাই হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, গীতা বেদান্তের দ্বৈতমতের বা অদ্বৈতমতের ! হৌক; এই সম্বন্ধে বেশী বিচার করিবার পূর্বে ইহাই দেখিতে হইবে যে, জগৎ (প্ৰকৃতি), জীব, (আত্মা কিংবা পুরুষ), এবং পরব্রহ্ম (পরমাত্মা কিংবা পুরুষোত্তম) ইহাদের পরস্পর সম্বন্ধবিষয়ে স্বয়ং ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ গীতায় কি বলিয়াছেন । এই বিষয়ে গীতা ও উপনিষদ উভয়েরই যে একই মত এবং গীতার সমস্ত বিচার উপনিষদে যে প্ৰথমেই আসিয়াছে, পরবর্তী বিচার হইতে পাঠকদিগের তাহা উপলব্ধি হইবে ।


5) গীতাতে বর্ণিত পরমেশ্বরের স্বরূপ


প্ৰকৃতি ও পুরুষ এই উভয়েরই অতীত যে পুরুষোত্তম পর-পুরুষ, পরমাত্মা বা পরব্রহ্ম, তাঁহার বর্ণনা করিবার সময় ভগবদ্‌গীতায় প্ৰথমে তাহার ব্যক্ত ও অব্যক্ত (দৃষ্টির গোচর ও দৃষ্টির অগোচর) এই দুই স্বরূপ কথিত হইয়াছে । 


5.1) ব্যক্ত অথবা সগুণ রূপ এবং উহার গৌণতা


তন্মধ্যে ব্যক্ত স্বরূপ অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়-গোচর রূপ যে সগুণই হইবে, ইহাতে সন্দেহ নাই । বাকী রহিল অব্যক্ত । এই অব্যক্ত রূপ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর হইলেও উহা যে নির্গুণই হইবে, তাহা বলা যাইতে পারে না । কারণ, আমাদের দৃষ্টিগোচর না হইলেও, তাহার মধ্যে সকল গুণই সুক্ষ্মরূপে থাকিতে পারে । তাই, অব্যক্তেরও সগুণ, সগুণ-নির্গুণ ও নির্গুণ এই তিন ভেদ করা হইয়াছে । ‘গুণ’ শব্দে শুধু মনুষ্যের বহিরিন্দ্রিয় সমূহের দ্বারা নহে, মনের দ্বারাও যে সকল গুণের জ্ঞান হয়, সেই সমস্ত গুণই এই স্থলে বিবক্ষিত হইয়াছে । পরমেশ্বরের মূর্তিমান অবতার ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ স্বয়ং সাক্ষাৎ অর্জুনের সম্মুখে দণ্ডায়মান হইয়া উপদেশ করিতেছিলেন, তাই গীতার স্থানে স্থানে তিনি আপনার সম্বন্ধে প্ৰথম পুরুষের নির্দেশ এই প্ৰকার করিয়া ছিলেন - যথা, “প্ৰকৃতি আমার স্বরূপ” [৯|৮], “জীব আমার অংশ” [১৫|৭], “সমস্ত ভূতের অন্তরাত্মা আমি” [১০|২০], “জগতে যে যে শ্ৰীমান্‌ কিংবা বিভূতিমান মূর্তি আছে সে সমস্ত আমার অংশ হইতে হইয়াছে” [৪০|৪১], “আমার পরে মন রাখিয়া আমার ভক্ত হও” [৯|৩৪], “তবে তুমি আমারই সহিত মিলিত হইবে, তুমি আমার প্রিয় ভক্ত বলিয়া তোমাকে আমি ইহা নিশ্চয় করিয়া বালিতেছি” [১৮|৬৫] । এবং যখন নিজের বিশ্বরূপ দেখাইয়া অর্জুনকে ইহা প্ৰত্যক্ষ উপলব্ধি করাইলেন যে, সমস্ত চরাচর জগৎ আপনি ব্যক্ত স্বরূপেই ওতপ্ৰোত হইয়া আছে, তখন ভগবান তাঁহাকে এই উপদেশ করিলেন যে, অব্যক্ত রূপ অপেক্ষা ব্যক্তরূপের উপাসনা করা অধিক সহজ; তাই তুমি আমার উপরই তোমার ভক্তি স্থাপন কর [গী|১২|৮] আমিই ব্ৰহ্মের, অব্যয় মোক্ষের, শাশ্বত ধর্মের ও নিত্য সুখের মূল স্থান [গী|১৪|২৭] । ইহা দ্বারা জানা যায় যে, আরম্ভ হইতে শেষ পৰ্যন্ত গীতার অধিকাংশ স্থলেই ভগবানের ব্যক্ত স্বরূপই মুখ্যরূপে বৰ্ণিত হইয়াছে ।


5.2) অব্যক্ত কিন্তু মায়া দ্বারা ব্যক্ত


এইটুকু হইতেই নিছক ভক্তিমানী পণ্ডিত ও টীকাকারগণ এই মত প্ৰকাশ করিয়াছেন যে, গীতাতে পরমেশ্বরের ব্যক্ত রূপই অন্তিম সাধ্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছে; কিন্তু তাহা সত্য বলিয়া মানিতে পারা যায় না । কারণ, উপরিউক্ত বৰ্ণনার সঙ্গেই ভগবান স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, আমার ব্যক্ত স্বরূপ মায়িক, এবং তাহার অতীত (পর) অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর স্বরূপই আমার সত্য স্বরূপ । উদাহরণ যথা সপ্তম অধ্যায়ে বলিয়াছেন -
অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ ৷
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্ ॥
অর্থাৎ - “আমি অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর হইলেও অজ্ঞান লোক আমাকে ব্যক্ত মনে করে, এবং ব্যক্তের অতীত আমার শ্রেষ্ঠ ও অব্যয় স্বরূপ তাহারা জানে না”; এবং ইহার পরবর্তী শ্লোকে [৭|২৫], ভগবান বলিতেছেন যে, “আমি আমার যোগমায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত থাকায় মূর্খ লোক আমাকে জানে না ।” আবার চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি আপন ব্যক্ত স্বরূপের উপপত্তি এই প্রকার বলিয়াছেন - “আমি জন্মবিরহিত ও অব্যয় হইলেও আপন প্ৰকৃতিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া আমি নিজ মায়ার দ্বারা (স্বাত্মমায়য়া) জন্মগ্রহণ করি অর্থাৎ ব্যক্ত হইয়া থাকি” [৪-৬] । এবং পরে সপ্তম অধ্যায়ে বলিতেছেন - “এই ত্ৰিগুণাত্মক প্ৰকৃতি আমার দৈবী মায়া; এই মায়াকে যে কাটাইয়া উঠে সে-ই আমাকে প্রাপ্ত হয়, এবং সেই মায়ার দ্বারা যাহার জ্ঞান নষ্ট হয় সেই মূঢ় নরাধম আমার সহিত মিলিত হইতে পারে না” [৭|১৫] । শেষে আঠারো অধ্যায়ে [১৮|৬১] ভগবান উপদেশ করিয়াছেন -“হে অর্জুন ! সমস্ত প্ৰাণীর হৃদয়ে জীবরূপে পরমাত্মাই বাস করেন, এবং তিনি আপন মায়ার দ্বারা সমস্ত প্ৰাণীকে যন্ত্রের ন্যায় ঘুরাইয়া থাকেন ।” অর্জুনকে ভগবান যে বিশ্বরূপ দেখাইয়াছেন তাহাই ভগবান নারদকেও দেখাইয়াছিলেন, এইরূপ মহাভারতের শান্তিপর্বান্তর্গত নারায়ণী প্রকরণে কথিত হইয়াছে [শাং|৩৩৯]; এবং নারায়ণীয় কিংবা ভাগবত ধর্মই গীতার প্রতিপাদ্য ইহা আমি প্ৰথম প্রকরণেই দেখাইয়াছি । নারদকে এইরূপ সহস্ৰ চক্ষুর, রঙ্গের এবং অন্য দৃশ্য গুণের বিশ্বরূপ দেখাইবার পর ভগবান বলিয়াছেন -
মায়া হ্যেষা ময়া সৃষ্টা যন্মাং পশ্যসি নারদ ৷
সর্বভুতগুণৈর্যুক্তং নৈবং ত্বং জ্ঞাতুমৰ্হসি ॥
“তুমি আমার যে রূপ দেখিতেছ তাহা আমার উৎপাদিত মায়া; ইহা হইতে তুমি এরূপ বুঝিও না যে, সমস্ত ভূতের গুণের দ্বারা আমি যুক্ত ।” আবার ইহা বলিয়াছেন যে, “আমার প্রকৃত স্বরূপ সর্বব্যাপী, অব্যক্ত ও নিত্য এবং তাহা সিদ্ধপুরুষেরা জানেন,” [শাং|৩৩৯|৪৪|৪৮] । এইজন্য, বলিতে হয় যে, গীতায় বর্ণিত অর্জুনকে ভগবানের প্রদর্শিত বিশ্বরূপও মায়িকই ছিল । সারকথা, উপসনার নিমিত্ত ভগবান গীতায় ব্যক্ত স্বরূপের প্রশংসা করিলেও পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠস্বরূপ অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অগোচর; এবং সেই অব্যক্ত হইতে ব্যক্ত হওয়াই তাঁহার মায়া; এবং এই মায়া কাটাইয়া শেষে পরমাত্মার শুদ্ধ ও অব্যক্ত স্বরূপের জ্ঞান না হইলে মনুষ্যের মোক্ষলাভ হয় না, ইহাই, যে গীতার সিদ্ধান্ত, তাহা উপরি-উক্ত বিচার হইতে নিঃসন্দেহ দেখা যায় । মায়া জিনিসটা কি তাহার অধিক বিচার পরে করিব । উপরে প্রদত্ত বচনাদি হইতে এইটুকু স্পষ্ট হইতেছে যে, এই মায়াবাদ শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য নূতন বাহির করেন নাই, তাহার পূর্বে তাহা ভগবদ্‌গীতায়, মহাভারতে এবং ভাগবত ধর্মেতেও গ্রাহ্য বলিয়া স্বীকৃত হইয়াছিল । শ্বেতাশ্বতরোপনিষদেও জগতের উৎপত্তি এইরূপ প্ৰদত্ত হইয়াছে । “মায়াং তু প্রকৃতিং বিদ্যান্মায়িনিং তু মহেশ্বরং” [শ্বেতা|৪|১০] অর্থাৎ মায়াই (সাংখ্যের) প্ৰকৃতি, এবং পরমেশ্বর সেই মায়ার অধিপতি; তিনিই আপন মায়া দ্বারা বিশ্ব নির্মাণ করেন ।


5.3) অব্যক্তেরই তিন ভেদ - সগুণ, নির্গুণ ও সগুণ-নির্গুণ


পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠস্বরূপ ব্যক্ত নহে, অব্যক্ত, - ইহা এখন স্পষ্ট হইলেও, এই শ্ৰেষ্ঠ অব্যক্তস্বরূপ সগুণ বা নির্গুণ ইহারও এইখানে কিছু বিচার করা আবশ্যক । কারণ, যখন সগুণ অব্যক্তের আমার সম্মুখে এই এক উদাহরণ আছে যে, সাংখ্যশাস্ত্রের প্রকৃতি অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর হইলেও সগুণ অর্থাৎ সত্ত্বরজস্তমোগুণময়ী, তখন কাহারও কাহারও মতে পরমেশ্বরের অব্যক্ত ও শ্রেষ্ঠ স্বরূপও ঐ প্রকার সগুণ বলিয়া মানিতে হয় । আপন মায়ার দ্বারাই হোক না কেন; কিন্তু যখন ঐ অব্যক্ত পরমেশ্বর ব্যক্ত জগৎ নির্মাণ করেন [গী|৯|৮] এবং সকলের হৃদয়ে থাকিয়া তাহাদের দ্বারাই সমস্ত ব্যাপার করাইয়া থাকেন [১৮|৬১], যখন তিনি সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ও প্রভু [৯|২৪], যখন প্ৰাণীদিগের সুখ-দুঃখাদি সমস্ত ‘ভাব’ তাঁহা হইতে উৎপন্ন হয় [১০|৫], এবং যখন প্রাণীগণের হৃদয়ে শ্ৰদ্ধা উৎপাদনকারীও তিনিই এবং “লভতে চ ততঃ কামান্‌ ময়ৈব বিহিতান্‌ হি তান্‌” [৭|২২] - প্ৰাণীদিগের বাসনার ফলদাতাও তিনিই; তখন তো এই কথাই সিদ্ধ হইতেছে যে, তিনি অব্যক্ত অৰ্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অগোচর হইলেও দয়া, কর্তৃত্ব প্রভৃতি গুণের দ্বারা যুক্ত সুতরাং ‘সগুণ’ । কিন্তু উল্টাপক্ষে ভগবান এইরূপও বলিতেছেন যে “ন মাং কর্মাণি লিম্পন্তি” - কর্ম অর্থাৎ গুণও আমাকে কখন স্পৰ্শ করিতে পারে না [৪|১৪]; প্ৰকৃতির গুণের দ্বারা মোহ প্ৰাপ্ত হইয়া মূর্খলোক আত্মাকেই কর্তা বলিয়া মনে করে [৩|২৭; ১৪|১৯]; কিংবা এই অব্যয় ও অকর্তা পরমেশ্বরই প্ৰাণিমাত্রের হৃদয়ে জীবরূপে থাকা প্ৰযুক্ত [১৩|৩১], প্ৰাণিমাত্রের কর্তৃত্ব ও কর্ম এই দুই হইতেই বস্তুত তিনি অলিপ্ত হইলেও অজ্ঞানে অভিভূত লোক মোহে পতিত হয় [৫|১৪,১৫] । এই প্রকার অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর পরমেশ্বরের স্বরূপ-সগুণ ও নির্গুণ - এই দুই প্রকারেই বর্ণিত হইয়াছে এরূপ নহে; কিন্তু কোন কোন স্থলে এই দুই রূপকে একত্রে মিশাইয়া পরমেশ্বরের বর্ণনা করা হইয়াছে । উদাহরণ যথা – “ভূতভৃৎ ন চ ভূতস্থো” [৯|৫] – আমি ভূতসমূহের আধার হইলেও তাহাদের মধ্যে আমি নাই; “পরব্রহ্ম সৎও নহেন অসৎও নহেন[১৩|১২]; “সর্বেন্দ্রিয় আছে বলিয়া প্রতিভাত অথচ সর্বেন্দ্রিয়বিবর্জিত; এবং নির্গুণ হইয়াও গুণের উপভোক্তা” [১৩|১৪]; “দূরে এবং নিকটেও আছেন” [১৩|১৫]; “অবিভক্ত অথচ বিভক্তরূপে দৃষ্ট” [১৩|১৬] - এইপ্ৰকার পরমেশ্বর-স্বরূপের পরস্পরবিরুদ্ধ অর্থাৎ সগুণ-নির্গুণমিশ্রিত বর্ণনাও করা হইয়াছে । তথাপি প্রারম্ভে দ্বিতীয় অধ্যায়েই বলা হইয়াছে যে, “এই আত্মা, অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকার্য” [২|২৫]; আবার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে “এই পরমাত্মা অনাদি, নির্গুণ ও অব্যয় হওয়া প্ৰযুক্ত শরীরের মধ্যে থাকিলেও কিছুই করেন না এবং তিনি কিছুতেই লিপ্ত হন না” [১৩|৩১] । এইরূপ পরমাত্মার শুদ্ধ, নির্গুণ, নিরবয়ব, নির্বিকার, অচিন্ত্য, অনাদি ও অব্যক্ত স্বরূপেরই শ্রেষ্ঠত্ব গীতায় বর্ণিত হইয়াছে ।


6) উপনিষদে উপাসনার জন্য ব্যাখ্যাত বিদ্যা ও প্রতীক


ভগবদ্‌গীতার ন্যায় উপনিষদেও অব্যক্ত পরমেশ্বরের স্বরূপ কখন সগুণ, কখন সগুণ-নির্গুণ এইরূপ উভয়বিধ এবং কখন শুদ্ধ নির্গুণ, এই তিন প্ৰকার বর্ণিত হইয়াছে দেখা যায় । উপাসনায় সর্বদা প্ৰত্যক্ষ মূর্তিই চোখের সম্মুখে থাকিতে হইবে এমন কোন কথা নাই । নিরাকার অর্থাৎ চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের অগোচর স্বরূপের উপাসনাও হইতে পারে । কিন্তু যাঁহার উপাসনা করিতে হইবে তিনি চক্ষুরাদি জ্ঞানেন্দ্ৰিয়ের গোচর না হইলেও, মনের গোচর না হইলে তাঁহার উপাসনা হইতে পারে না । উপাসনা অর্থে চিন্তন, মনন বা ধ্যান । চিন্তিত বস্তুর কোন রূপ না থাকিলেও অন্য কোনও গুণ মনের উপলব্ধি না হইলে মন কিসের চিন্তা করিবে ? তাই উপনিষদে যে যে স্থানে অব্যক্ত অর্থাৎ চক্ষের অগ্রাহ্য পরমাত্মার উপাসনা (চিন্তন, মনন, ধ্যান) কথিত হইয়াছে, সেই সেই স্থানে অব্যক্ত পরমেশ্বর সগুণ বলিয়াই কল্পিত হইয়াছেন । পরমাত্মা সম্বন্ধে কল্পিত এই গুণ উপাসকের অধিকার অনুসারে ন্যূনাধিক ব্যাপক বা সাত্ত্বিক হইয়া থাকে; এবং যাহার যেরূপ নিষ্ঠা তাহার সেইরূপ ফলও লাভ  হয় । ছান্দোগ্যোপনিষদে [৩|১৪|১] উক্ত হইয়াছে, “পুরুষ ক্রতুময়, যাহার যেরূপ ক্রতু (নিশ্চয়), মরিবার পর সে সেইরূপই ফল প্ৰাপ্ত হয়”, এৰং ভগবদ্‌গীতাতেও কথিত হইয়াছে যে, “দেবতাদের প্রতি ভক্তিমান দেবতাদের সহিত এবং পিতৃগণের প্রতি ভক্তিমান পিতৃগণের সহিত গিয়া মিলিত হয়েন” [গী|৯|২৫], অথবা “যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ” - যাহার যেরূপ শ্ৰদ্ধা তাহার সেইরূপ সিদ্ধি লাভ হয় [১৭|৩] । তাৎপর্য এই যে, উপাসকের অধিকারভেদে উপাস্য অব্যক্ত পরমাত্মার গুণও উপনিষদে ভিন্ন ভিন্নরূপে বর্ণিত হইয়াছে । উপনিষদের এই প্রকরণকে ‘বিদ্যা’ বলে । বিদ্যা ঈশ্বরপ্রাপ্তির (উপাসনারূপ) মাৰ্গ, এবং এই মাৰ্গ যে প্রকরণে কথিত হইয়া থাকে, তাহাও শেষে ‘বিদ্যা’ নামে অভিহিত হয় । শাণ্ডিল্যবিদ্যা [ছাং|৩|১৪], পুরুষবিদ্যা [ছাং|৩|১৬,১৭], পর্যঙ্কবিদ্যা [কৌষী|১], প্রাণোপাসনা [কোষী|২] ইত্যাদি অনেক প্রকারের উপাসনা উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে; এবং বেদান্তসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় পাদে এই সকল বিষয়ের বিচার করা হইয়াছে । এই প্রকরণে অব্যক্ত পরমাত্মার সগুণ বৰ্ণন এই প্রকারে করা হইয়াছে যে তিনি মনোময়, প্ৰাণশরীর, ভারূপ, সত্যসঙ্কল্প, আকাশাত্মা, সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ ও সর্বারস [৩|১৪|২] । তৈত্তিরীয়োপনিষদে তো অন্ন, প্ৰাণ, মন, জ্ঞান বা আনন্দ - এই সকল রূপেও পরমাত্মাৱ ক্ৰমোচ্চ উপাসনা কথিত হইয়াছে [তৈা|২,১-৫; ৩|২-৬] । বৃহদারণ্যকে [২|১] অজাতশত্রুকে গাৰ্গ্য বালাকী সর্বপ্রথম আদিত্য, চন্দ্ৰ, বিদ্যুৎ, আকাশ, বায়ু, অগ্নি, জল বা দিক্‌সমূহে অধিষ্ঠিত পুরুষসমূহেরই ব্ৰহ্মরূপে উপাসনা কথিত হইয়াছে; কিন্তু পরে প্রকৃত ব্ৰহ্ম এই সকলেরও অতীত, ইহা অজাতশত্রু তাহাকে বলিয়া শেষে প্ৰাণোপাসনাকেই মুখ্য প্রতিপাদন করিয়াছেন । ইহাতেই এই পরম্পরা কিছু সম্পূর্ণ হয় না । উপরি-উক্ত সমস্ত ব্ৰহ্মরূপকে ‘প্রতীক’ অৰ্থাৎ এই সকলকে উপাসনার জন্য কল্পিত গৌণ ব্ৰহ্মস্বরূপ কিংবা ব্রহ্মনিদর্শক চিহ্ণ বলা যায়; এবং এই গৌণ রূপকেই কোন মূর্তির রূপে চোখের সামনে রাখিলে তাহাকেই ‘প্ৰতিমা’ বলা হয় । কিন্তু মনে রেখো, সমস্ত উপনিষদের ইহাই সিদ্ধান্ত যে, প্ৰকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ ইহা হইতে ভিন্ন [কেন|১|২-৮] । এই ব্ৰহ্মের লক্ষণ বৰ্ণনা করিবার সময় কোন স্থানে “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্ৰহ্ম” [তৈত্তি|২|১] কিংবা “বিজ্ঞানমানন্দং ব্ৰহ্ম” [বৃ|৩|৯|২৮] বলা হইয়াছে; অর্থাৎ ব্ৰহ্ম সত্য (সৎ), জ্ঞান (চিৎ) এবং আনন্দ রূপ অৰ্থাৎ সচ্চিদানন্দস্বরূপ, - এই প্রকারে তিনগুণেরই মধ্যে সমস্ত গুণের সমাবেশ করিয়া বৰ্ণন করা হইয়াছে । এবং অন্যস্থানে, ভগবদ্‌গীতারই ন্যায় পরস্পরবিরুদ্ধ গুণসমূহ একত্ৰ করিয়া ব্ৰহ্মের বর্ণন এইপ্ৰকার করা হইয়াছে যে, “ব্ৰহ্ম সৎও নহেন, অসৎও নহেন” [ঋ|১০|১৯০] অথবা “অণোরণীয়ান্‌ মহতো মহীয়ান্‌” অর্থাৎ অণু অপেক্ষা ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ অপেক্ষাও বৃহৎ [কঠ|২|২০], “তদেজতি তন্নৈজতি তদ্‌দূরে তদ্বন্তিকে” অর্থাৎ তিনি চলেন এবং চলেন না, তিনি দূরেও আছেন, এবং নিকটেও আছেন [ঈশ|৫; মুং|৩|১|৭], অথবা ‘সর্বেন্দ্ৰিয়গুণাভাস’ অথচ ‘সর্বেন্দ্ৰিয়বিবর্জিত’ [শ্বেতা|৩|১৭]যম নচিকেতাকে এই জ্ঞানোপদেশ দিয়াছেন যে, শেষে উপযুক্ত সমস্ত লক্ষণ ছাড়িয়া দিয়া ধর্ম ও অধর্মের, কৃত ও অকৃতের, কিংবা ভূত ও ভব্যেরও অতীত যিনি তাঁহাকেই ব্ৰহ্ম বলিয়া জান [কঠ|২|১৪] । এইপ্ৰকার মহাভারতের নারায়ণীয় ধর্মে ব্ৰহ্মা রুদ্রকে [মভা|শাং|৩৫১|১১], এবং মোক্ষধর্মে নারদ শুকদেবকে বলিয়াছেন [৩৩১|৪৪] । বৃহদারণ্যক উপনিষদেও [২|৩|২] পৃথিবী, জল ও অগ্নি, এই তিনটীকে ব্ৰহ্মের মূর্তরূপ বলা হইয়াছে; আবার বায়ু ও আকাশকে অমূর্তরূপ বলিয়া দেখানো হইয়াছে যে, এই অমূর্তের সারভূত পুরুষের রূপ বা রং বদল হয়; এবং শেষে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, ‘নেতি নেতি’ অর্থাৎ এতক্ষণ পর্যন্ত যাহা কিছু বলা হইল, তাহা নহে, তাহা ব্ৰহ্ম নহে, - এই সমস্ত নামরূপাত্মক মূর্ত বা অমূর্ত পদার্থের অতীত (পর) যে ‘অগৃহ্য’ বা ‘অবৰ্ণনীয়’ আছেন তাঁহাকেই পরব্রহ্ম জানিবে [বৃহ|২|৩|৬ এবং বেসূ|৩|২|২২] । অধিক কি, যে যে পদার্থের কোন নাম দেওয়া যাইতে পারে সেই সমস্তেরও অতীত যিনি, তিনিই পরব্ৰহ্ম এবং সেই ব্ৰহ্মের অব্যক্ত ও নির্গুণ স্বরূপ দেখাইবার জন্য ‘নেতি নেতি’ এই এক ক্ষুদ্র নির্দেশ, আদেশ বা সূত্রই হইয়া গিয়াছে এবং বৃহদারণ্যকোপনিষদেই উহার চারিবার প্রয়োগ হইয়াছে [বৃহ|৩|৯|২৬; ৪|২|৪; ৪|৪|২২; ৪|৫|১৫] । সেইরূপ অন্য উপনিষদেও পরব্রহ্মের নির্গুণ ও অচিন্ত্যরূপের বর্ণন পাওয়া যায়, যথা - “যতো বাচো নিবৰ্ত্তন্তে অপ্ৰাপ্য মনসা সহ” [তৈত্তি|২|৯]; “অদ্রেশ্যং (অদৃশ্য), অগ্ৰাহ্য” [মুং|১|১|৬] “ন চক্ষুষা গৃহ্যতে নাপি বাচা” [মুং|৩|১|৮] – চোখে দেখা যায় না কিংবা নাক্যের দ্বারা বলা যায় না; অথবা -
অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ং তথাহরসং নিত্যমগন্ধবচ্চ যৎ ৷
অনাদ্যনন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং নিচায্য তন্মত্যুমুখাৎ প্ৰমুচ্যতে ॥
অর্থাৎ সেই পরব্রহ্ম পঞ্চ মহাভূতের শব্দ, স্পৰ্শ, রূপ, রস ও গন্ধ এই পাঁচ গুণবিরহিত, অনাদি, অনন্ত, ও অব্যয় [কঠ|৩|১৫; বেসূ|৩|২|২২-৩০ দেখ] । মহাভারতের শান্তিপর্বে নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মের বর্ণনাতেও ভগবান নারদকে আপন বাস্তব স্বরূপ “অদৃশ্য, অঘ্রেয়, অস্পৃশ্য, নির্গুণ, নিষ্ফল (নিরবয়ব), অজ, নিত্য, শাশ্বত ও নিষ্ক্রিয়” এইরূপ বলিয়া তিনিই জগতের উৎপত্তি ও প্ৰলয়কর্তা ত্ৰিগুণাতীত পরমেশ্বর, এবং ইহাঁকেই ‘বাসুদেব পরমাত্মা’ বলা হয়, এইরূপ বলিয়াছেন [মভা|শাং|৩৩৯|২১-২৮]


7) ত্রিবিধ অব্যক্তরূপের মধ্যে নির্গুণই শ্রেষ্ঠ


উপরি-উক্ত বচনাদি হইতে উপলব্ধি হইবে যে, শুধু ভগবদ্‌গীতায় নহে, মহাভারতের অন্তৰ্গত নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মে এবং উপনিষদেও পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপ অপেক্ষা অব্যক্ত স্বরূপই শ্রেষ্ঠ স্বীকৃত হইয়াছে, এবং এই শ্ৰেষ্ঠ অব্যক্ত স্বরূপ সেখানে সগুণ, সগুণ-নির্গুণ ও শেষে কেবল নিগুৰ্ণ এই তিনপ্রকারে বর্ণিত হইয়াছে । এখন প্রশ্ন এই যে, অব্যক্ত ও শ্ৰেষ্ঠ স্বরূপের এই তিন পরস্পর-বিরোধী রূপের মিল কিরূপে করা যাইবে ? এই তিনের মধ্যে সগুণ-নিগুৰ্ণ অর্থাৎ উভয়াত্মক যে রূপ তাহা সগুণ হইতে নির্গুণে (কিংবা অজ্ঞেয়ে) যাইবার সোপান বা সাধন এইরূপ বলা যাইতে পারে । কারণ, প্ৰথমে সগুণ রূপের জ্ঞান হইলে পরই আস্তে আস্তে এক এক গুণ ছাড়িয়া দিলে নির্গুণ স্বরূপের অনুভব হইতে পারে এবং এই পদ্ধতি অনুসারেই ব্ৰহ্মপ্রতীকের ক্ৰমোচ্চ উপাসনা উপনিষদে বর্ণিত হইয়াছে । উদাহরণ যথা - তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভৃগুবল্লীতে বরুণ ভৃগুকে প্ৰথমে এই উপদেশ দিলেন যে, অন্নই ব্ৰহ্ম; তদনন্তর ক্রমে ক্রমে প্ৰাণ, মন, বিজ্ঞান ও আনন্দ এই ব্ৰহ্মস্বরূপের জ্ঞান তাঁহাকে দিলেন [তৈত্তি|৩|২-৬] । কিংবা এরূপও বলা যাইতে পারে যে, গুণবোধক বিশেষণের দ্বারা কেহ নির্গুণের বর্ণনা কখনই করিতে পারে না বলিয়া, অগত্যা পরস্পরবিরুদ্ধ বিশেষণের দ্বারাই তাঁহার বর্ণনা করিতে হয় । কারণ, ‘দূর’ বা ‘সৎ’ শব্দ উচ্চারণ করিবামাত্র অন্য কোন বস্তু ‘নিকট’ বা ‘অসৎ’ এইরূপ পরোক্ষ ভাবে আমাদের মনে উপলব্ধি হইয়া থাকে । কিন্তু একই ব্ৰহ্ম যদি সর্বব্যাপী হয়েন তবে পরমেশ্বরকে ‘দূর’ বা ‘সৎ’ বিশেষণ দিয়া ‘নিকট’ বা ‘অসৎ’ কাহাকে বলিব ? এই অবস্থাতে ‘দূর নহেন, নিকট নহেন; সৎ নহেন, অসৎ নহেন’ - এইরূপ ভাষার উপযোগ করিলে, দূর ও নিকট, সৎ ও অসৎ ইত্যাদি পরস্পরসাপেক্ষ গুণের জোড় উঠাইয়া দিয়া, বাকী যাহা কিছু নির্গুণ সর্বব্যাপী, সর্বদা নিরপেক্ষ ও স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তাহাই ব্ৰহ্ম এইরূপ বোধ হইবার জন্য, ব্যবহারক্ষেত্রে পরস্পরবিরুদ্ধ বিশেষণের ভাষাই প্ৰয়োগ করা ভিন্ন গত্যন্তর নাই [গী|১৩|১২] । যাহা কিছু আছে তাহা সমস্তই ব্ৰহ্ম হওয়ায় দূরে তিনিই, নিকটেও তিনিই, সৎও তিনিই এবং অসৎও তিনিই । তাই, অন্য দৃষ্টিতে দেখিলে, সেই ব্ৰহ্মের পরস্পরবিরুদ্ধ বিশেষণের দ্বারা একই সময়ে বর্ণনা করা চলে [গী|১১|৩৭; ১৩|১৫] । কিন্তু সগুণ-নির্গুণ এই উভয়বিধ বৰ্ণনার উপপত্তি এইরূপ করিলেও একই পরমেশ্বর কিরূপে সগুণ ও নির্গুণ এই দুই পরস্পরবিরুদ্ধ স্বরূপ প্ৰাপ্ত হন, সে কথার ব্যাখ্যা অবশিষ্টই রহিয়া যায় । মানিলাম, যখন অব্যক্ত পরমেশ্বর ব্যক্ত বা ইন্দ্ৰিয়গোচর রূপ ধারণ করেন তখন উহা তাহার মায়া, কিন্তু ব্যক্ত কিংবা ইন্দ্ৰিয়ের গোচর না হইয়া অব্যক্ত থাকিয়াই যখন তিনি নির্গুণের স্থানে সগুণ হইয়া যান তখন তাঁহাকে কি বলিবে ? উদাহরণ যথা - একই নিরাকার পরমেশ্বরকে কেহ ‘নেতি নেতি’ বলিয়া নির্গুণ বলেন, আবার কেহ তাঁহাকে সত্ত্বগুণসম্পন্ন, সর্বকর্মা ও দয়ালু বলেন । ইহার রহস্য কি ? উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পক্ষ কোনটি ? এই নির্গুণ অব্যক্ত ব্ৰহ্ম হইতে সমস্ত ব্যক্ত জগৎ ও জীব কিরূপে উৎপন্ন হইল ? এই সকল বিষয়ের স্পষ্ট ব্যাখ্যা আবশ্যক । সমস্ত সঙ্কল্পের দাতা অব্যক্ত পরমেশ্বর বাস্তবিক সগুণ; উপনিষদে ও গীতায় নিগুৰ্ণস্বরূপের যে বর্ণনা আছে, তাহা অতিশয়োক্তি বা নিরর্থক প্ৰশংসাপর উক্তি - এইরূপ বলিলে অধ্যাত্মশাস্ত্রের মূল ভিত্তিকেই আঘাত করা হয় । যে বড় বড় মহাত্মাগণ ও ঋষিরা মনকে একাগ্র করিয়া সূক্ষ্ম ও শান্ত বিচারের দ্বারা এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, “যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ” [তৈ|২|৯] মনেরও যিনি দুৰ্গম, বাক্যও যাঁহাকে বর্ণনা করিতে পারে না, তিনিই চরম ব্ৰহ্মস্বরূপ - তাঁহাদের আত্মপ্রতীতি অতিশয়োক্তি, কি প্রকারে বলা যায় ? আমরা সাধারণ মনুষ্য, আমাদের ক্ষুদ্ৰ মনে অনন্ত ও নির্গুণ ব্ৰহ্মেয় ধারণা হয় না বলিয়া প্ৰকৃত ব্ৰহ্ম সগুণই হইবে বলা আর সূর্যাপেক্ষা আমাদের দীপ শ্রেষ্ঠ বলা একই ! হাঁ, যদি এই নির্গুণ রূপের উপপত্তি উপনিষদে অথবা গীতায় না দেওয়া হইত তবে পৃথক কথা হইত । কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে । 


8) উক্ত সিদ্ধান্তসমূহের শাস্ত্রীয় উপপত্তি


দেখ না, ভগবদ্‌গীতায় তো স্পষ্টই বলা হইয়াছে যে, পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ ও প্রকৃত স্বরূপ অব্যক্তই; এবং তিনি ব্যক্ত জগতের রূপ যে ধারণ করেন সে তো তাঁর মায়া [গী|৪|৬]; কিন্তু ভগবান ইহাও বলিয়াছেন যে, প্রকৃতির গুণের দ্বারা “মোহ প্ৰাপ্ত হইয়া মূর্খ লোক (অব্যক্ত ও নির্গুণ) আত্মাকেই কর্তা মনে করে” [গী|৩|২৭-১৯], কিন্তু ঈশ্বর তো কিছুই করেন না, কেবল অজ্ঞানের দ্বারা লোক ভ্ৰান্ত হয় [গী|৫|১৫] অর্থাৎ ভগবান স্পষ্টাক্ষরে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, অব্যক্ত আত্মা বা পরমেশ্বর বস্তুত নির্গুণ হইলেও [গী|১৩|৩১] মোহ বা অজ্ঞানবশতঃ লোকে তাঁহার উপর কর্তৃত্বাদিগুণের অধ্যারোপ করিয়া তাঁহাকে সগুণ অব্যক্ত করিয়া তোলে [গী|৭|২৪] । ইহা হইতে পরমেশ্বরের স্বরূপ বিষয়ে গীতার এই সিদ্ধান্ত বুঝা যায় – 
(১) গীতায় পরমেশ্বরের ব্যক্ত স্বরূপের অনেক বর্ণনা থাকিলেও পরমেশ্বরের মূল ও শ্ৰেষ্ঠ স্বরূপ নির্গুণ ও অব্যক্তই, এবং মনুষ্য অজ্ঞান বা মোহবশত তাঁহাকে সগুণ মনে করে, 
(২) সাংখ্যদিগের প্রকৃতি বা তাহার ব্যক্ত প্ৰপঞ্চ অর্থাৎ সমস্ত জগৎ এই পরমেশ্বরের মায়া; এবং 
(৩) সাংখ্যদিগের পুরুষ বা জীবাত্মা যথার্থত পরমেশ্বররূপী, পরমেশ্বরেরই ন্যায় নির্গুণ ও অকর্তা, কিন্তু অজ্ঞানবশত লোকে তাহাকে কর্তা বলিয়া মনে করে । 

বেদান্তশাস্ত্রের সিদ্ধান্তও এইরূপ; কিন্তু উত্তরবেদান্ত গ্রন্থে এই সিদ্ধান্ত বলিবার সময় মায়া ও অবিদ্যা এই দুয়ের মধ্যে একটু প্ৰভেদ করা হইয়াছে । উদাহরণ যথা - পঞ্চদশীতে প্ৰথমে কথিত হইয়াছে যে, আত্মা ও পরব্রহ্ম উভয়ই মূলে একই অর্থাৎ ব্ৰহ্মস্বরূপ; এই চিৎস্বরূপ ব্ৰহ্ম যখন মায়াতে প্ৰতিবিম্ব হন তখন সত্ত্বরজস্তমোগুণময়ী (সাংখ্যদিগের মূল) প্ৰকৃতি নির্মিত হয় । কিন্তু পরে এই মায়ারই আবার ‘মায়া’ ও ‘অবিদ্যা’ এইরূপ দুই ভেদ করিয়া বলা হইয়াছে যে, মায়ার ত্ৰিগুণের মধ্যে ‘শুদ্ধ’ সত্ত্বগুণের যখন উৎকর্ষ হয় তখন তাহাকে কেবল মায়া বলা হয়, এবং এই মায়াতেই প্ৰতিবিন্বিত ব্ৰহ্মকে সগুণ অর্থাৎ ব্যক্ত ঈশ্বর (হিরণ্যগৰ্ভ) বলা হয়; এবং এই সত্ত্বগুণ ‘অশুদ্ধ’ হইলে ‘অবিদ্যা’ হয় এবং তাহাতে প্ৰতিবিন্বিত ব্ৰহ্মকে ‘জীব’ এই নাম দেওয়া হয় [পঞ্চ|১|১৫-১৭] । এইভাবে দেখিলে একই মায়ার স্বরূপত দুই ভেদ করিতে হয় - অর্থাৎ উত্তরকালীন বেদান্তের দৃষ্টিতে দেখিলে, পরব্রহ্ম হইতে ‘ব্যক্ত ঈশ্বর’ উৎপন্ন হইবার কারণ মায়া এবং ‘জীব’ উৎপন্ন হইবার কারণ অবিদ্যা মানিতে হয় । কিন্তু গীতাতে এইপ্রকার ভেদ করা হয় নাই । গীতা বলেন যে, ভগবান স্বয়ং যে মায়ার দ্বারা ব্যক্ত অর্থাৎ সগুণ রূপ ধারণ করেন [৭|২৫], কিংবা যে মায়ার দ্বারা অষ্টধা প্ৰকৃতি অর্থাৎ জগতের সমস্ত বিভূতি তাঁহা হইতে উৎপন্ন হয় [৪|৬], সেই মায়ারই অজ্ঞানের দ্বারা জীব মোহ প্ৰাপ্ত হয় [৭|৪-১৫] । ‘অবিদ্যা’ এই শব্দ গীতার কোথাও আসে নাই, এবং শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে যেখানে ঐ শব্দ আসিয়াছে সেখানে তাহার অর্থও এইপ্রকারে স্পষ্ট করা হইয়াছে যে, মায়ার প্রপঞ্চকেই অবিদ্যা সংজ্ঞা দেওয়া হইয়াছে, [শ্বেত|৫|১] । তাই, উত্তরবেদান্তগ্রন্থে কেবল নিরূপণের সুবিধার জন্য জীব ও ঈশ্বরের দৃষ্টিতে অবিদ্যা ও মায়ার সূক্ষ্ম ভেদ স্বীকার না করিয়া আমি ‘মায়া’, ‘অবিদ্যা’ ও ‘অজ্ঞান’ এই শব্দগুলিকে সমানার্থকই মানি; এবং এক্ষণে শাস্ত্রীয় পদ্ধতি অনুসারে সংক্ষেপে এই বিষয়ের বিচার করিব যে, ত্ৰিগুণাত্মক মায়া অবিদ্যা বা অজ্ঞান ও মোহ ইহাদের সামান্যত তাত্ত্বিক স্বরূপ কি, এবং উহার সাহায্যে গীতা ও উপনিষদের সিদ্ধান্তসমূহের উপপত্তি কিরূপে লাগানো যায় ।


9) নির্গুণ ও সগুণের গহন অর্থ


নির্গুণ ও সগুণ এই শব্দ দুটি দেখিতে ছোট হইলেও উহার মধ্যে কোন্‌ কোন্‌ বিষয়ের সমাবেশ হয় তাহা দেখিতে গেলে, সত্যই সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ড চক্ষের সম্মুখে আসিয়া দণ্ডায়মান হয় । যথা, জগতের মূল যখন ঐ অনাদি পরব্রহ্মই, যিনি এক, নিষ্ক্রিয় ও উদাসীন, তখন তাহাতে মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের গোচর অনেক প্ৰকার ব্যাপার ও গুণ কি প্রকারে উৎপন্ন হইল এবং এইপ্ৰকার তাঁহার অখণ্ডতা কি প্রকারে ভগ্ন হইল; কিংবা যিনি মূলেতে একই তাঁহাতে ভিন্ন ভিন্ন বহুবিধা পদাৰ্থ কিরূপে দৃষ্ট হইতেছে; যে পরব্রহ্ম নির্বিকার এবং যাঁহাতে, মধুর, অম্ল, কটু কিংবা ঘন, তরল অথবা শীতোষ্ণাদি ভেদ নাই, তাঁহাতেই বিভিন্ন রুচি, ন্যূনাধিক ঘন-তরলতা কিংবা শীতল ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখ, আলোক ও অন্ধকার, মৃত্যু ও অমরতা ইত্যাদি অনেক প্রকারের দ্বন্দ্ব কিরূপে উৎপন্ন হইল; যে পরব্রহ্ম শান্ত ও নির্বাত, তাঁহাতেই নানাবিধ ধ্বনি ও শব্দ কিরূপে উৎপন্ন হইল; যে পরব্রহ্মে অন্তর-বাহির কিংবা দূর-নিকট ভেদ নাই, তাঁহাতে অগ্রপশ্চাৎ এ-পার ও-পার কিংবা দূর-নিকট অথবা পূর্ব-পশ্চিম ইত্যাদি দিক্‌কৃত স্থলকৃত ভেদ কিরূপে আসিল; যে পরব্রহ্ম অবিকারী, ত্রিকালে অবাধিত, নিত্য ও অমৃত, তাঁহাতে ন্যূনাধিক কালপরিমাণে নশ্বর পদার্থসমূহ কিরূপে হইল; কিংবা যাঁহাতে কার্যকারণভাবের স্পৰ্শমাত্ৰ নাই সেই পরব্রহ্মের কার্যকারণরূপ, - যথা মৃত্তিকা ও ঘট - কেন দেখা যায়; এই প্রকার অনেক বিষয়ের সমাবেশ উক্ত ছোট শব্দ দুটির মধ্যে হইয়াছে । কিংবা সংক্ষেপে বলিতে হইলে, এক্ষণে এই বিষয়ের বিচার করিতে হইবে যে, একেরই মধ্যে নানাত্ব, নির্দ্বন্দ্বে, অনেক প্রকার দ্বন্দ্ব, অদ্বৈতে দ্বৈত, অথবা অসঙ্গে সঙ্গ কিরূপে জুটল । সাংখ্যকারেরা এই বিবাদ হইতে রক্ষা পাইবার জন্য এই দ্বৈত কল্পনা করিয়াছেন যে, নির্গুণ ও নিত্য পুরুষের ন্যায় ত্ৰিগুণাত্মক অর্থাৎ সগুণ প্ৰকৃতিও নিত্য ও স্বতন্ত্র । কিন্তু জগতের মূলতত্ত্ব অনুসন্ধান করিবার মানবমনের যে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি আছে, এই দ্বৈতের দ্বারা তাহার সমাধান হয় না । শুধু নহে, প্ৰত্যুত যুক্তিবাদেও এই দ্বৈত টেঁকে না । - তাই, প্রকৃতি ও পুরুষের বাহিরে গিয়া উপনিষৎকারেরা এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে, সচ্চিদানন্দ ব্ৰহ্ম হইতেও শ্রেষ্ঠপদবীর ‘নিগুৰ্ণ’ ব্ৰহ্মই জগতের মূল । কিন্তু এক্ষণে নির্গুণ হইতে সগুণ কিরূপে উৎপন্ন হইল, তাহার উপপত্তি দেওয়া আবশ্যক । কারণ সাংখ্যের ন্যায় বেদান্তশাস্ত্রেরও ইহাই সিদ্ধান্ত যে, যাহা নাই তাহা হইতেই পারে না; এবং তাহা হইতে যাহা আছে তাহা কখনই উৎপন্ন হইতে পারে না । এই সিদ্ধান্ত অনুসারে নির্গুণ অর্থাৎ যাহাতে গুণ নাই সেই ব্ৰহ্ম হইতে, সগুণ অর্থাৎ যাহাতে গুণ আছে এইরূপ জাগতিক পদার্থ উৎপন্ন হইতে পারে না । তবে আবার সগুণ আসিল কোথা হইতে ? সগুণ কিছু নাই যদি বল, তাহা তো চোখের সামনে দেখা যাইতেছে । এবং নির্গুণের ন্যায় সগুণও সত্য যদি বল, তাহা হইলে দেখিতেছি যে, ইন্দ্রিয়ের গোচর শব্দ-স্পর্শ রূপ-রসাদি সমস্ত গুণের স্বরূপ আজ এক প্রকার কল্য অন্য প্ৰকার - অর্থাৎ উহা নিত্য পরিবর্তনশীল, অতএব নশ্বর, বিকারী ও অ-শাশ্বত, তখন তো (পরমেশ্বর বিভাজ্য এইরূপ কল্পনা করিয়া) ইহাই বলিতে হয় যে এইরূপ সগুণ পরমেশ্বরও পরিবর্তনশীল ও নশ্বর । কিন্তু বিভাজ্য ও নশ্বর হইয়া যিনি জাগতিক নিয়মপদ্ধতির মধ্যে নিত্য পরতন্ত্র হইয়া কাজ করেন তাঁহাকে কেমন করিয়া পরমেশ্বর বলিবে ? সারকথা, চাই ইন্দ্ৰিয়গোচর সমস্ত সগুণ পদার্থ পঞ্চমহাভূত হইতে উৎপন্ন হইয়াছে স্বীকার কর, কিংবা সাংখ্যের ন্যায় অথবা আধিভৌতিক দৃষ্টিতে মনে কর যে, সমস্ত পদার্থ একই অব্যক্ত কিন্তু সগুণ মূল প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; - যে কোন পক্ষই স্বীকার কর না কেন ইহা নির্বিবাদরূপে সিদ্ধ যে, নশ্বর গুণ যে পৰ্যন্ত এই মূল প্ৰকৃতি হইতেও বিচ্যুত না হয় সে পৰ্যন্ত পঞ্চ মহাভূতকে বা প্ৰকৃতিরূপ এই সগুণ মূল পদার্থকে জগতের অবিনাশী, স্বতন্ত্র ও অমৃত তত্ত্ব মানিতে পারা যায় না । তাই যিনি প্রকৃতিবাদ স্বীকার করেন তাঁহার পরমেশ্বরকে নিত্য, স্বতন্ত্র ও অমৃত বলা ছাড়িয়া দিতে হয়; অথবা পঞ্চ মহাভূতের অথবা সগুণ মূল প্ৰকৃতিরও অতীত কোন্‌ তত্ত্ব আছে তাহার অনুসন্ধান করিতে হয় । ইহা ব্যতীত অন্য কোন মাৰ্গ নাই । মৃগতৃষ্ণিকায় তৃষ্ণা নিবারণ কিংবা বালুকা হইতে তৈল বাহির হওয়া যেরূপ অসম্ভব, সেইরূপ প্ৰত্যক্ষ নশ্বর বস্তু হইতে অমৃতত্ব প্ৰাপ্তির আশাও ব্যর্থ; এবং এইজন্য, যাজ্ঞবল্ক্য আপনার পত্নী মৈত্ৰেয়ীকে স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, যতই কেন সম্পত্তিলাভ হউক না, তাহা দ্বারা অমৃতত্ব লাভের আশা নাই — “অমৃতত্বস্য তু নাশাস্তি বিত্তেন” [বৃ|২|৪|২] । 


10) অমৃততত্ত্বের স্বভাবসিদ্ধ কল্পনা


ভাল, এখন যদি অমৃতত্বকে মিথ্যা বল, তবে মানুষের এই স্বাভাবিক ইচ্ছা দেখা যায় যে, সে কোন রাজার নিকট হইতে প্ৰাপ্ত ইনাম বা পুরস্কার কেবল নিজে নহে বরঞ্চ পুত্রপৌত্ৰাদিক্ৰমে অর্থাৎ চিরকাল উপভোগ করিতে চায়; অথবা ইহাও দেখা যায় যে, চিরস্থায়ী বা শাশ্বত কীর্তির অবসর উপস্থিত হইলে আমরা জীবনেরও পরোয়া রাখি না । ঋক্‌বেদের ন্যায় অতি প্ৰাচীন গ্রন্থেও পূর্বতন ঋষিদের এই প্রার্থনা যে, “হে ইন্দ্ৰ ! তুমি ‘অক্ষিতশ্রব’ অর্থাৎ অক্ষয় কীর্তি’ বা ধন দাও” [খ|১|৯|৭], অথবা “হে সোম ! তুমি আমাকে বৈবস্বত (যম) লোকে অমর কর” [ঋ|৯|১১৩|৮] । পূৰ্বঋষিদিগের প্রার্থনা ছাড়িয়া দিলেও অর্বাচীনকালে এই দৃষ্টিই স্বীকার করিয়া স্পেনসর, কোঁৎ প্রভৃতি নিছক আধিভৌতিক পণ্ডিতও প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, “কোন ক্ষণিক সুখে না ভুলিয়া বর্তমান ও ভাবী মানবজাতির চিরন্তন সুখের জন্য চেষ্টা করাই এই জগতে মনুষ্যমাত্রের নৈতিক পরম কর্তব্য”। আমাদের দৃষ্টিসীমার বাহিরে নিরন্তর কল্যাণের অর্থাৎ অমৃতত্বের এই কল্পনা আসিল কোথা হইতে ? যদি বল তাহা স্বভাবসিদ্ধ, তাহা হইলে এই বিনশ্বর দেহের বাহিরে কোন প্ৰকার অমৃত বস্তু আছে এইরূপ বলিতে হয় । এবং এই প্রকার অমৃত বস্তু কিছু নাই যদি বল, তবে আমাদের যে মনোবৃত্তির সাক্ষাৎ প্রতীতি হয় তাহার অন্য কোন উপপত্তিও দেওয়া যাইতে পারে না ! এই কঠিন সমস্যার স্থলে কোন কোন আধিভৌক্তিক পণ্ডিত এই উপদেশ করেন যে, এই প্রশ্ন কখনই মীমাংসা হইবার নহে, তাই ইহার বিচার না করিয়া, দৃশ্য জগতের পদার্থসমূহের গুণধর্মের বাহিরে আমাদের মনকে ধাবিত হইতে দিবে না । এই উপদেশ সহজ বলিয়া মনে হয়; কিন্তু মনুষ্যের মনে তত্ত্বজ্ঞানের যে স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা আছে তাহা কে আটক করিবে, আর কি করিয়া আটক করিবে ? এবং এই দুর্দমনীয় জ্ঞানস্পৃহাকে একবার নিহত করিলে, পরে জ্ঞানের বৃদ্ধি কোথা হইতে হইবে ? যে দিন মনুষ্য এই পৃথিবীতে উৎপন্ন হইয়াছে সেই দিন অবধি সে ইহার বিচার বরাবর করিয়া আসিয়াছে যে, “সমস্ত দৃশ্য ও নশ্বর জগতের মুলীভূত অমৃত তত্ত্ব কি, এবং তাহা আমি কিরূপে প্ৰাপ্ত হইব” । আধিভৌতিক শাস্ত্রের যতই উন্নতি হোক না কেন, মনুষ্যের অমৃততত্ত্বসম্বন্ধীয় জ্ঞানের দিকে এই স্বাভাবিক প্ৰবৃত্তি কখনই হ্রাস হইবার নহে । আধিভৌতিক শাস্ত্রের যতই উন্নতি হোক না কেন, সমস্ত আধিভৌতিক জগৎবিজ্ঞানকে বগলে রাখিয়া আধ্যাত্মিক তত্ত্বজ্ঞান তাহার অগ্ৰেই নিয়ত দৌড়িতে থাকিবে ! দুই চারি হাজার বৎসর পূর্বে এই অবস্থাই ছিল, এবং এক্ষণে পাশ্চাত্য দেশেও ঐ প্রকার অবস্থাই দৃষ্টিগোচর হয় । অধিক কি, মানববুদ্ধির এই আকাঙ্ক্ষা যে দিন চলিয়া যাইবে সেই দিন তাহাকে “স বৈ মুক্তোহথবা পশুঃ” এইরূপ বলিতে হইবে ।


11) সৃষ্টিজ্ঞান কিরূপে এবং কাহার হয় ?


যাক্‌ । দিককালে অসীম, অমৃত, অনাদি, স্বতন্ত্র, সম, এক, নিরন্তর, সর্বব্যাপী ও নির্গুণ তত্ত্বের অস্তিত্বসম্বন্ধে অথবা সেই নির্গুণ তত্ত্ব হইতে সগুণ জগতের উৎপত্তিবিষয়ে আমাদের প্রাচীন উপনিষদে যাহা উপপাদিত হইয়াছে তাহা অপেক্ষা অধিক সযুক্তিক উপপাদন অন্য কোন দেশের তত্ত্বজ্ঞানী অদ্যাপি বাহির করেন নাই । “অর্বাচীন জর্মান তত্ত্বজ্ঞ ক্যাণ্ট মনুষ্যের বাহ্যজগতের নানাত্বজ্ঞান একত্বের দ্বারা কেন ও কি প্রকারে হয়; এবং তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিয়া এই উপপত্তিকেই অর্বাচীনশাস্ত্ৰ-পদ্ধতিতে অধিক স্পষ্ট করিয়াছেন; এবং হেগেল নিজের বিচারে কাণ্ট হইতে কিছু আগাইয়া গেলেও তাঁহারও সিদ্ধান্ত বেদান্তকে ছাড়াইয়া যাইতে পারে নাই । শোপেন্‌হৌরের কথাও তাই । তিনি ল্যাটিন ভাষায় অনুদিত উপনিষদ অধ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং তিনি একথাও লিখিয়া রাখিয়াছেন যে, ‘জগতের সাহিত্যের এই অত্যুত্তম গ্ৰন্থ’ হইতে কোন কোন বিচার তিনি আপন গ্রন্থে গ্ৰহণ করিয়াছেন । এই গভীর বিচার এবং তাহার সাধকবাধক প্রমাণে কিংবা বেদান্তের সিদ্ধান্ত এবং ক্যাণ্ট প্রভৃতি পাশ্চাত্য তত্ত্বজ্ঞদিগের সিদ্ধান্তে কতটা সাদৃশ্য ও কতটা বৈষম্য; অথবা উপনিষদ ও বেদান্তসূত্র প্রভৃতি প্ৰাচীন গ্রন্থোক্ত বেদান্ত এবং তদুত্তরকালীন গ্রন্থোক্ত বেদান্ত - ইহাদের মধ্যে ক্ষুদ্র বৃহৎ ভেদ কি কি আছে, এই সকল বিষয়ের সবিস্তর নিরূপণ এই ক্ষুদ্র গ্রন্থে সম্ভব নহে । তাই, গীতার অধ্যাত্মসিদ্ধান্তের সত্যতা, উপপত্তি ও মহত্ত্বের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা আবশ্যক মনে করিয়া, মুখ্যরূপে উপনিষদ, বেদান্তসূত্র ও তাহার শাঙ্করভাষ্য-অবলম্বনে, আমি কেবল ঐ সকল বিষয়ের প্রতি অঙ্গুলী নির্দেশ করিয়াছি মাত্র । প্রকৃতি ও পুরুষরূপী সাংখ্যোক্ত দ্বৈতের অতীত কি, তাহা নির্ণয় করিবার জন্য জগৎদ্রষ্টা ও দৃশ্যজগৎ এই দ্বৈতী ভেদের উপরেই দাঁড়াইয়া না থাকিয়া জগৎদ্রষ্টা পুরুষের বাহ্য-জগৎ সম্বন্ধে যে জ্ঞান হয় তাহার স্বরূপ কি, তাহা কি করিয়া ও কাহার হয়, এই বিষয়েরও সূক্ষ্ম বিচার করা আবশ্যক । 


12) জ্ঞানক্রিয়ার বর্ণনা


বাহ্য জগতের পদার্থ মনুষ্যের চক্ষে যেরূপ প্ৰতিভাত হয়, পশুদের নিকটেও সেইরূপ প্ৰতিভাত হইয়া থাকে । কিন্তু মনুষ্যের ইহাই বিশেষত্ব যে, চক্ষু, কৰ্ণ ইত্যাদি জ্ঞানেন্দ্ৰিয়যোগে উহার মনের উপর সংঘটিত সংস্কারসমূহের একীকরণ করিবার শক্তি উহাতে বিশেষরূপে থাকা প্ৰযুক্ত, বাহ্যজগতের পদার্থ মাত্রের জ্ঞান উহার হইয়া থাকে । এই বিশেষ শক্তি যে একীকরণের ফল, সেই শক্তি মন ও বুদ্ধিরও অতীত, অর্থাৎ উহা আত্মার শক্তি, ইহা পূর্বে ক্ষেত্রক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারে বলিয়াছি । কেবল একটীমাত্র পদার্থের নহে, প্ৰত্যুত জগতের অন্তৰ্গত ভিন্ন ভিন্ন পদার্থের কার্যকারণভাবাদি যে অনেক সম্বন্ধ - যাহাকে জাগতিক নিয়ম বলে - তাহারও জ্ঞান এই প্রকারেই হইয়া থাকে । কারণ, ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ দৃষ্টিগোচর হইলেও, তাহাদের কার্য্যকারণাদি সম্বন্ধ প্ৰত্যক্ষগোচর হয় না; কিন্তু দ্রষ্টা স্বীয় মানসিক ব্যাপারের দ্বারা তাহা নির্ধারণ করিয়া থাকে । উদাহরণ যথা - কোন এক পদার্থ আমাদের চক্ষুর সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেলে তাহার রূপ ও গতি দেখিয়া আমরা স্থির করি যে, তাহা একজন যুদ্ধের সেপাই এবং সেই সংস্কার মনে স্থায়ী রহিয়া যায় । ইহার পরেই আর কোন পদার্থ ঐ প্রকার রূপ ও গতি লইয়া চক্ষুর সম্মুখে আসিলে আবার সেই মানসিক ক্রিয়া শুরু হয় এবং উহাও আর এক সিপাই এইরূপ আমাদের বুদ্ধি নিশ্চিত ধারণা করে । এই প্রকার ভিন্ন ভিন্ন ক্ষণে একের পর এক করিয়া যে অনেক সংস্কার আমাদের মনের উপর সংঘটিত হয়, আমাদের স্মরণশক্তি দ্বারা সেগুলি স্মরণ করিয়া একত্ৰ করি; এবং যখন ঐ পদার্থসমূহ আমাদের সম্মুখে আসে, তখন ঐ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন সংস্কারের জ্ঞান একতা প্ৰাপ্ত হয়, আর আমরা বলি যে আমাদের সম্মুখ দিয়া ‘সৈন্য’ চলিতেছে । এই সৈন্যের পশ্চাতে আগত পদার্থের রূপ দেখিয়া তাহাকে ‘রাজা’ বলিয়া নির্ধারিত করি । এবং সৈন্যসম্বন্ধীয় পূর্ব সংস্কার ও ‘রাজা’ সম্বন্ধীয় এই নূতন সংস্কার - এই দুই সংস্কারকে একত্র করিয়া আমরা বলিয়া থাকি যে, ‘রাজার সোয়ারী’ চলিয়াছে । এই জন্য বলিতে হয় যে, জগৎ-জ্ঞান কেবল ইন্দ্ৰিয়ে প্ৰতিভাত জড় পদার্থের জ্ঞান নহে; কিন্তু ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা মনের উপর সংঘটিত অনেক সংস্কারের বা পরিণামের যে ‘একীকরণ’ ‘দর্শক’ আত্মা করে, তাহারই ফল এই জ্ঞান । এই জন্য ভগবদ্গীতাতেও জ্ঞানের লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে যে, “অবিভক্তং বিভক্তেষু” অর্থাৎ যাহা বিভক্ত বা ভিন্ন ভিন্ন, তাহার মধ্যে অবিভক্ততা বা একত্ব যাহা দ্বারা বুঝা যায় তাহাই প্ৰকৃত জ্ঞান [গী|১৮|২০](Cf. “Knowledge is first produced by the synthesis of what is manifold” Kant's “Critique of Pure Reason”, P.64, Max Muller's translation 2nd Ed.) 


13) নামরূপের ব্যাখ্যা ও বস্তুতত্ত্ব


কিন্তু ইন্দ্ৰিয়-যোগে মনের উপর যে সংস্কার প্রথমে সংঘটিত হয়, তাহা কিরূপ, এই বিষয়ের সূক্ষ্ম বিচার করিলে আবার দেখিতে পাওয়া যায় যে, চোখ, কান, নাক প্রভৃতি ইন্দ্ৰিয় দ্বারা পদার্থ মাত্রের রূপ, শব্দ, গন্ধ প্রভৃতি গুণ জানিতে পারিলেও এই বাহ্য গুণ যে দ্রব্যের মধ্যে আছে সেই দ্রব্যের অন্তরঙ্গ স্বরূপসম্বন্ধে আমাদের ইন্দ্ৰিয় আমাদিগকে কিছুই বলিতে পারে না । ভিজা মাটির ঘট হইল ইহা আমরা দেখি সত্য, কিন্তু যাহাকে আমরা ‘ভিজা মাটি’ বলি, সেই পদার্থের মূল তাত্ত্বিক স্বরূপ কি, তাহা আমরা জানিতে পারি না । চিকনাই, আর্দ্রতা, ময়লা রঙ বা গোলার ন্যায় আকার (রূপ) ইত্যাদি গুণ, ইন্দ্ৰিয়যোগে মন পৃথক পৃথকরূপে অবগত হইলে পর, সেই সমস্ত সংস্কারের একীকরণ করিয়া ‘দ্রষ্টা’ আত্মা, বলিয়া থাকে যে ইহা ‘ভিজা মাটি’; এবং পরে এই দ্রব্যের (কারণ, দ্রব্যের তাত্ত্বিক স্বরূপ বদলিয়াছে এরূপ মনে করিবার কোন কারণ নাই) ভিতর ফাপা ও গোলাকার রূপ, খনখনে আওয়াজ ও শুষ্কতা ইত্যাদি গুণ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা মন অবগত হইলে পর, তাহাদের একীকরণ করিয়া ‘দর্শক’ আত্মা তাহাকে ‘ঘট’ বলিয়া থাকে । সারকথা, সমস্ত পরিবর্তন বা ভেদ, ‘রূপ বা আকারেই’ হইতে থাকে; এবং মনের উপর উক্ত গুণসমূহের যে সংস্কার সংঘটিত হয়, ‘দ্রষ্টা’ সেই সকল সংস্কারের একীকরণ করিবার পর, একই তাত্ত্বিক পদার্থ অনেক নাম প্ৰাপ্ত হইয়া থাকে । ইহার সর্বাপেক্ষা সহজ উদাহরণ - সমুদ্র ও তরঙ্গ, কিংবা সুবর্ণ ও অলঙ্কার । কারণ, এই দুই উদাহরণে রং, ঘনত্ব, তরলতা, ওজন প্রভৃতি গুণ একই থাকে, কেবল রূপ (আকার) ও নাম এই দুই গুণ বদল হয় । সেই জন্যই বেদান্তে এই সহজ দৃষ্টান্ত সর্বদাই প্রদত্ত হইয়া থাকে । সোনা একই, কিন্তু তাহার আকারে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যে পার্থক্য ঘটিয়াছে, ইন্দ্ৰিয়যোগে গৃহীত তাহারই সংস্কারসকল মনের দ্বারা একত্ৰ করিয়া ‘দ্রষ্টা’, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে একই মূল পদার্থের একবার ‘ঠুসী’, একবার ‘পোঁটী’, একবার ‘সল্লে’, একবার ‘তন্মণি’ এইরূপ ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়া থাকে । আমরা সময়ে সময়ে পদার্থসমূহের এই প্রকার যে নাম দিয়া থাকি, সেই নামকে এবং যে ভিন্ন ভিন্ন আকৃতির দরুণ উক্ত নাম বদলাইতে থাকে সেই আকৃতিসমূহকে উপনিষদে ‘নামরূপ’ (নাম ও রূপ) বলা হয়; এবং অন্য সমস্ত গুণেরও উহারই মধ্যে সমাবেশ করা যায় [ছা|৩ ও ৪; বৃ|১|৪|৭] । কারণ, যে কোন গুণ ধর না কেন, তাহার কোন না কোন নাম বা রূপ থাকিবেই । কিন্তু এই নামরূপ ক্ষণে ক্ষণে বদল হইলেও, মূলে তাহাদের আধারভূত এই নামরূপ হইতে ভিন্ন ও অপরিবর্তনীয় কোন দ্রব্য আছে বলিতে হয় । জলের উপর যেমন ফেণপুঞ্জ (বা তরঙ্গ) থাকে, সেইরূপ একই মূল দ্রব্যের উপর অনেক নামরূপের আবরণ আসিয়া পড়িয়াছে — ইহা বলিতেই হইবে । আমাদের ইন্দ্ৰিয়গণ, নামরূপ ব্যতীত আর কিছুই উপলব্ধি করিতে পারে না সত্য; তাই এই নামরূপের আধারভূত অথচ নামরূপ হইতে ভিন্ন ঐ যে মূল দ্রব্য, ইন্দ্ৰিয়গণ তাহাকে জানিতে সমর্থ হয় না । কিন্তু সমস্ত জগতের আধারভূত এই তত্ত্ব অব্যক্ত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের অজ্ঞেয় হইলেও তাহা সৎ, অর্থাৎ সত্য সত্যই সর্বকালে সকল নামরূপের মূলে এবং নামরূপের মধ্যেও বাস করিতেছে, তাহার কখনই লোপ পায় না, আমাদের বুদ্ধির দ্বারা এই নিশ্চিত অনুমান করিতে হয় । কারণ, ইন্দ্ৰিয়গোচর নামরূপ ব্যতীত মূলে কিছুই নাই, এইরূপ মানিলে ‘হার’ ও ‘বলয়’ প্ৰভৃতি বিভিন্ন পদার্থ একই পদার্থে নির্মিত হইয়াছে, আমাদের এই যে জ্ঞান এক্ষণে হয় তাহার কোনই ভিত্তি থাকিবে না । এই অবস্থাতে ইহা ‘হার’ ইহা ‘বলয়', ইহাই বলা যাইতে পারে । কিন্তু ‘হার সোনার’, এবং ‘বলয় সোনার’ ইহা কখনও বলা যাইতে পারে না । তাই ন্যায়ত ইহা সিদ্ধ হয় যে, ‘সোনার হার’, ‘সোনার বালা’ ইত্যাদি বাক্যে ‘সোনার’ এই শব্দের দ্বারা যে সোনার সঙ্গে নামরূপাত্মক হার ও বালার সম্বন্ধ যোজিত হইয়াছে, সেই সোনা কেবল শশশৃঙ্গবৎ অভাবরূপী নহে, উহা সমস্ত অলঙ্কারের আধারভূত দ্রব্যাংশেরই বোধক । এই ন্যায়টি জাগতিক সমস্ত পদার্থে প্রয়োগ করিলে এই সিদ্ধান্ত বাহির হয় যে, পাথর, মুক্তা, রূপা, লোহা, কাঠ প্রভৃতি বিভিন্ন নাম রূপাত্মক যে সকল পদার্থ আমাদের নজরে আসে সে সমস্ত একই কোন নিত্য দ্রব্যের উপর বিভিন্ন নামরূপের গিল্টি চড়াইয়া উৎপন্ন হইয়াছে; অর্থাৎ সমস্ত ভেদ কেবল নামরূপেরই, মূল দ্রব্যের নহে, নানাপ্রকার নামরূপের নীচে মূলে একই পদাৰ্থ নিত্য বাস করিতেছে । ‘সমস্ত পদার্থে এইরূপ নিত্যরূপে সর্বদাই থাকা’ - ইহাকেই সংস্কৃত ভাষায় ‘সত্তাসামান্যত্ব’ বলে ।

আমাদের বেদান্তশাস্ত্রের উক্ত সিদ্ধান্তই কাণ্ট প্রভৃতি অর্বাচীন পাশ্চাত্য তত্ত্বজ্ঞানীরাও স্বীকার করিয়াছেন । নামরূপাত্মক জগতের মূলে অবস্থিত, নামরূপ হইতে ভিন্ন, এই যে কোন অদৃশ্য দ্রব্য আছে তাহাকেই তাঁহারা আপন গ্রন্থে ‘বস্তুতত্ত্ব’ বলিয়া এবং নেত্ৰাদি ইন্দ্ৰিয়ের গোচর নামরূপকে ‘বহিদৃশ্য’ বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন । (কাণ্টের “Critique of Pure Reason” গ্রন্থে এই বিচার করা হইয়াছে । নামরূপাত্মক জগতের মূলে অবস্থিত দ্রব্যকে তিনি ‘ডিং আন্‌ জিশ্‌’ (Ding an Sich - Thing in itself) এইরূপ নাম দিয়াছেন এবং ইহারই ভাষান্তর আমরা বস্তুতত্ত্ব করিয়াছি । নামরূপের অবভাস  কাণ্টের ‘এরশায়নুঙ্গ্‌’ (Ercheinung - appearance) । কাণ্টের মতে বস্তুতত্ত্ব অজ্ঞেয় ।)


14) সত্যের ব্যাখ্যা



কিন্তু বেদান্তশাস্ত্ৰে, নিত্য পরিবর্তনশীল নামরূপাত্মক বহির্দৃশ্যকে ‘মিথ্যা’ বা ‘নশ্বর’ এবং মূল দ্রব্যকে ‘সত্য’ বা ‘অমৃত’ বলিবার রীতি আছে । সাধারণ লোক ‘চক্ষুর্বৈ সত্যং’ অর্থাৎ চোখে যাহা দেখা যায় তাহাই সত্য, এইরূপ সত্য শব্দের ব্যাখ্যা করিয়া থাকে; এবং লোকব্যবহারেও দেখা যায় যে, লাখ টাকা পাইয়াছি এইরূপ স্বপ্ন দেখা কিংবা লাখ টাকা পাইবার কথা কানে শোনা, এবং লাখ টাকা হাতে পাওয়া, - ইহাদের মধ্যে অনেক প্রভেদ আছে । এইজন্য কাণাঘুসা কোন কথা যে শুনে এবং চক্ষে যে দেখে, এই উভয়ের মধ্যে কাহার উপর অধিক বিশ্বাস স্থাপন করিবে ইহার মীমাংসার জন্য বৃহদারণ্যক উপনিষদে, ‘চক্ষুর্বৈ সত্যং’ এই বাক্য আসিয়াছে [বৃ|৫|১৪|৪] । কিন্তু টাকা পদার্থটি — ‘টাকা’ দৃশ্যটি নাম ও রূপে অর্থাৎ বৰ্ত্তুল আকৃতিতে সত্য কিনা - যে শাস্ত্ৰ ইহার নির্ণয় করিবে সেই শাস্ত্ৰে সত্যের এই আপেক্ষিক ব্যাখ্যা কি উপযোগী ? ব্যবহারে দেখা যায় যে, কোন ব্যক্তির কথায় যদি মিল না থাকে, যদি সে এখন এক কথা পরক্ষণে আর এক কথা বলিতে থাকে তখন লোকে তাহাকে মিথ্যুক বলে । আবার ঐ ন্যায়ই প্রয়োগ করিয়া ‘টাকার’ নামরূপকে (আভ্যন্তরিক দ্রব্যকে নহে) মিথ্যুক কিংবা মিথ্যা বলিতে বাধা কি ? কারণ, টাকার এই চক্ষুগ্রাহ্য নামরূপ আজ টাকা হইতে বাহির করিয়া লইয়া কাল তাহার স্থানে ‘চেন’ কিংবা ‘পেয়ালা’ এই নামরূপ দেওয়া হইয়া থাকে অর্থাৎ নামরূপ নিত্য তফাৎ হয়, নামরূপের মিল থাকে না, ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । এখন চোখে যাহা দেখা যায় তাহা ব্যতীত আর কিছুই সত্য নহে এইরূপ বলিলে, একীকরণের যে মানসিক ক্রিয়াতে জগৎজ্ঞান হয় সেই ক্রিয়াও চোখে দেখা যায় না অতএব তাহাকেও মিথ্যা বলিতে হয়; সেইজন্য আমাদের সমস্ত জ্ঞানকেই মিথ্যা বলিতে হয় । 


14.1) বিনশ্বর হইলে নামরূপ অসত্য এবং নিত্য হইলে বস্তুতত্ত্ব সত্য



এই বাধা এবং এইরূপ অন্য বাধার কথা মনে আনিয়া, যাহা চোখে দেখা যায় এইরূপ সত্যকে, সত্যের এই লৌকিক ও আপেক্ষিক লক্ষণকে সত্য বলিয়া স্বীকার না করিয়া, যাহা অবিনাশী অর্থাৎ অন্য সমস্ত বিষয় লোপ পাইলেও যাহা কখনই লোপ পায় না তাহাই সত্য, সমস্ত উপনিষদে এই প্রকার সত্য শব্দের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে । এবং মহাভারতেও সত্যের এইরূপ লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে -
সত্যং নামাহব্যয়ং নিত্যমবিকারি তথৈব চ ৷ *
অর্থাৎ - “যাহা অব্যয় অর্থাৎ কখন বিনাশ পায় না, নিত্য অর্থাৎ চিরকাল সমান থাকে এবং অবিকারী অর্থাৎ যাহার পরিবর্তন কখনই হয় না, তাহাই সত্য” – [মভা|শাং|১৬২|১০]*(গ্রীন real এর (সৎ বা সত্য) ব্যাখ্যা করিবার সময় “whatever anything is really, it is unalterably” এইরূপ বলিয়াছেন (Prolegomena to Ethics $25) । গ্রীনের এই ব্যাখ্যা এবং মহাভারতের উপরি-উক্ত ব্যাখ্যা এই দুই তত্ত্বতঃ একই ।)


15) বস্তুতত্ত্বই অক্ষরব্রহ্ম এবং নামরূপ মায়া


এখন এক কথা বলা, আর এক সময়ে আর এক কথা বলা - এই ব্যবহারকে যে মিথ্যা ব্যবহার বলা হয়, ইহাই তাহার বীজ । সত্যের এই নিরপেক্ষ লক্ষণ স্বীকার করিলে বলিতে হয় যে, চোখে দেখিলেও ক্ষণপরিবর্তনশীল নাম রূপ মিথ্যা; এবং চোখে না দেখা গেলেও নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত ও নামরূপের মূলে সতত সমানভাবে অবস্থিত অমৃত বস্তুতত্ত্বই সত্য । ভগবদ্‌গীতাতে “যঃ স সর্বেষু ভুতেষু নশ্যৎসু ন বিনশ্যতি” [গী|৮|২০; ১৩|২৭] সমস্ত পদার্থ অর্থাৎ সমস্ত পদার্থের নামরূপাত্মক শরীর লোপ পাইলেও যাহা লোপ পায় না তাহাই অক্ষর ব্ৰহ্ম - ব্ৰক্ষের এইরূপ যে বৰ্ণনা করা হইয়াছে তাহা এই ভাবেই করা হইয়াছে । মহাভারতে নারায়ণীয় কিংবা ভাগবত ধর্মের নিরূপণে, “যঃ স সর্বেষু” ইহার বদলে ‘ভূতগ্রামশরীরেষু’ এইরূপ পাঠভেদে এই শ্লোকই পুনর্বার আসিয়াছে [মভা|শাং|৩৩৯|২৩] । সেইরূপ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৬ ও ১৭ শ্লোকের তাৎপর্যও ইহাই । 


16) সত্য ও মিথ্যা শব্দের বেদান্তশাস্ত্রানুসারী অর্থ


বেদান্তে ‘অলঙ্কার’ মিথ্যা এবং ‘সুবৰ্ণ’ সত্য এইরূপ যে বলা হয়, তাহার অর্থে অলঙ্কার নিরুপযোগী কিংবা একেবারেই মিথ্যা, অর্থাৎ চক্ষুর অগোচর, অথবা মাটীতে গিল্টী করা অর্থাৎ উহার মূলেই অস্তিত্ব নাই এরূপ অভিপ্রেত নহে । এখানে ‘মিথ্যা’ শব্দ এইস্থানে পদার্থের বর্ণরূপাদি গুণ ও আকৃতি অর্থাৎ উপরকার বাহ্য দৃশ্য সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হইয়াছে, আভ্যন্তরিক তাত্ত্বিক দ্রব্যের লক্ষণসম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হয় নাই । তাত্ত্বিক দ্রব্য চিরকালই সত্য, ইহা মনে রাখিতে হইবে । পদার্থমাত্রেরই নামরূপাত্মক আবরণের নীচে মূলদেশে কি তত্ত্ব আছে বেদান্তী তাহাই দেখেন; তত্ত্বজ্ঞানের প্রকৃত বিষয়ই ত তাহাই । ব্যবহারে আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই যে, কোন গহনা গড়াইবার জন্য আমরা অনেক মজুরী দিলেও আপৎকালে সেই গহনা পোদ্দারের নিকট বিক্রয় কবিবার সময়, পোদ্দার আমাদিগকে স্পষ্ট এই কথা বলে যে “গহনা গড়াইতে তোলা-পিছু কত খরচা হইয়াছে আমি তা দেখিব না  তুমি এই গহনা যদি সোনার দরে দাও ত কিনিব ।” বেদান্তের পরিভাষায় এই বিচারই ব্যক্ত করিতে হইলে “পোদ্দারের চোখে গহনা মিথ্যা ও গহনার সোনাটাই সত্য” এইরূপ বলিতে হয় । নূতন গঠিত গৃহ বিক্রয় করিবার সময় তাহার সুন্দর আকার (রূপ), অথবা সুবিধাজনক রচনা (আকৃতি) করিতে কত খরচা হইয়াছে সে দিকে লক্ষ্য না করিয়া, গৃহের মালমস্‌লা ও কাঠের দামে আমাকে বিক্রয় কর, খরিদ্দার এইরূপ বলিয়া থাকে । নামরূপাত্মক জগৎ মিথ্যা এবং ব্ৰহ্ম সত্য বেদান্তের এই উক্তির অর্থ উক্ত দৃষ্টান্ত হইতে পাঠকের উপলব্ধি হইবে । 

‘দৃশ্য জগৎ মিথ্যা’ ইহার অর্থে জগৎ চক্ষে দেখা যায় না এরূপ ধরিবে না; একই দ্রব্যের নামরূপের ভেদে উৎপন্ন জগতের অনেক স্থলকৃত কিংবা কালকৃত দৃশ্য নশ্বর অতএব মিথ্যা, এবং এই সমস্ত নামরূপাত্মক দৃশ্যের আবরণের নীচে নিয়ত অবস্থিত অবিনাশী ও অপরিবর্তনীয় দ্রব্যই নিত্য ও সত্য, ইহাই তাহার প্রকৃত অর্থ । পোদ্দারের নিকট গোট, তাবিজ, বাজুবন্দ, হার প্রভৃতি গহনা মিথ্যা এবং সেই সব গহনার সোনাই সত্য; কিন্তু জগতের যে স্বর্ণকার, তাঁহার কারখানায় মূল একই দ্রব্যের ভিন্ন ভিন্ন নামরূপ দিয়া সোনা, পাথর, কাঠ, জল, বায়ু প্ৰভৃতি, সমস্ত গহনা গড়া হয় বলিয়া বেদান্তী পোদ্দার অপেক্ষা আরও কিছু বেশী তলাইয়া সোনা, রূপা কিংবা পাথর প্রভৃতি নাম রূপকে গহনারই ন্যায় মিথ্যা জানিয়া এই সমস্ত, পদার্থের মূলে অবস্থিত দ্রব্য অর্থাৎ বস্তুতত্ত্বই সত্য অর্থাৎ অবিকারী সত্য, এইরূপ সিদ্ধান্ত করেন । এই বস্তুতত্ত্বে নামরূপ আদি কোন গুণই না থাকা প্ৰযুক্ত উহা নেত্ৰাদি ইন্দ্রিয়ের গোচর কখনই হইতে পারে না । কিন্তু চক্ষে না দেখিলেও, নাকে আঘ্রাণ না করিলেও, হাতে স্পর্শ না করিলেও অব্যক্তরূপে তাহা থাকেই, কেবল এইটুকু বুদ্ধির দ্বারা যে অনুমান করা যায় তাহা নহে, কিন্তু জগতে যাহার কখন পরিবর্তন হয় না এমন একটা কিছু যাহা আছে তাহাই সত্য বস্তুতত্ত্ব, এরূপও নিশ্চয় করিতে হয় । ইহাকেই জগতের মূল সত্য বলে । কিন্তু সত্য ও মিথ্যা, ইহাদের বেদান্তশাস্ত্রোক্ত পারিভাষিক অর্থ লক্ষ্য না করিয়া কিংবা আমরা এই শব্দের যে অর্থ মনে করি তাহা হইতে ভিন্ন অর্থ হইতে পারে কি না ইহা দেখিবার কষ্ট স্বীকার না করিয়া “আমাদের চোখে প্ৰত্যক্ষদৃষ্ট জগতও বেদান্তী মিথ্যা বলে, এর উপায় কি ?” এই কথা বলিয়া কতকগুলি অজ্ঞ বিদেশী এবং স্বদেশী পণ্ডিতন্মন্য লোকও অদ্বৈত বেদান্তের প্রতিবাদ করিয়া থাকেন । কিন্তু যাস্কের উক্তি অনুসারে বলিতে পারি যে, অন্ধ যে স্তম্ভ দেখিতে পায় না তাহা কিছু স্তম্ভের দোষ নহে ! নিত্য পরিবর্তনশীল অতএব নশ্বর নামরূপ সত্য নহে; যে ব্যক্তি সত্য অর্থাৎ চিরস্থায়ী তত্ত্ব দেখিতে চায় তাহার দৃষ্টি নামরূপ ছাড়াইয়া নামরূপের বাহিরে যাওয়া চাই, ছান্দোগ্য [৬|১; ও ৭|১], বৃহদারণ্যক [১|৬|৩], মুণ্ডক [৩|২|৮], এবং প্রশ্ন [৬|৫] প্রভৃতি উপনিষদে ইহা বারবার উক্ত হইয়াছে । এই নামরূপকে কঠ [২|৫] মুণ্ডক [১|২|৯] প্রভৃতি উপনিষদে ‘অবিদ্যা’ এবং শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে ‘মায়া’ নামে কথিত হইয়াছে । ভগবদ্‌গীতায় ‘মায়া’ ‘মোহ’, ‘অজ্ঞান’ এই সকল শব্দের দ্বারা ঐ অর্থই বিবক্ষিত । জগতের আরম্ভে যাহা কিছু ছিল তাহা নামরূপবৰ্জিত অৰ্থাৎ নির্গুণ ও অব্যক্ত ছিল; পরে তাহা নামরূপ প্ৰাপ্ত হইয়া ব্যক্ত ও সগুণ হইয়া পড়িল [বৃ|১|৪|৭; ছাং|৬|১|২,৩] । তাই বিকারী কিংবা নশ্বর নামরূপকেই ‘মায়া’ সংজ্ঞা দিয়া এই সগুণ বা দৃশ্য জগৎ এক মূল দ্রব্যের অর্থাৎ ঈশ্বরের মায়ার খেলা কিংবা লীলা এইরূপ বলা হয় । এইরূপ দৃষ্টিতে দেখিলে সাংখ্যদিগের প্রকৃতি অব্যক্ত হইলেও উহা সত্ত্বরজস্তমোগুণী অতএব নামরূপের দ্বারা যুক্ত মায়াই । এই প্ৰকৃতি হইতে (৮ম প্রকরণে বর্ণিত) বিশ্বের যে উৎপত্তি বা বিস্তার হইতেছে, তাহাও সেই মায়ার সগুণ নামরূপাত্মক বিকার । 


17) আধিভৌতিক শাস্ত্রের নামরূপাত্মকতা


যে কোন গুণই বল, তাহা ইন্দ্ৰিয়গোচর সুতরাং নামরূপাত্মক হইবেই হইবে । সমস্ত আধিভৌতিক শাস্ত্রও এইরূপ মায়ার গণ্ডীর মধ্যে আসে । ইতিহাস, ভূজ্ঞান, বিদ্যুৎশাস্ত্র, রসায়নশাস্ত্ৰ, পদার্থবিজ্ঞান প্রভৃতি যে-কোন শাস্ত্ৰ ধর না কেন, তাহার মধ্যে যে বিচার-আলোচনা করা হইয়া থাকে তাহাতে সমস্ত নামরূপেরই বিচার থাকে অর্থাৎ কোন পদার্থের এক নামরূপ চলিয়া গিয়া সেই পদার্থের অন্য নামরূপ কি করিয়া হয় তাহারই বিচার-আলোচনা করা হয় । উদাহরণ যথা, যার নাম জল তাহার বাষ্প নাম কখনও কিরূপে আসে, কিংবা এক কুচুকুচে কালো জাম হইতে তাম্র, সবুজ, নীল প্ৰভৃতি অনেক প্রকারের রঙ (রূপ) কি করিয়া হয় ইত্যাদি নামরূপের ভেদেরই বিচার এই শাস্ত্রে করা হইয়া থাকে । তাই, নামরূপের মধ্যেই মগ্ন এই শাস্ত্রের অভ্যাসের দ্বারা নামরূপের বাহিরে অবস্থিত সত্য বস্তুর জ্ঞান হইতে পারে না । যে ব্যক্তি সত্য ব্ৰহ্মবস্তুর অনুসন্ধান করিতে চায়, তাহার দৃষ্টিকে এই সমস্ত আধিভৌতিক অর্থাৎ নামরূপাত্মক শাস্ত্রের বাহিরে লইয়া যাইতে হইবে, ইহা সুস্পষ্ট । এবং এই অর্থ ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ের প্রারম্ভিক কথার মধ্যে ব্যক্ত করা হইয়াছে । কথারম্ভে নারদ ঋষি সনৎকুমার অর্থাৎ স্কন্দের নিকট গিয়া “আমাকে আত্মজ্ঞানের উপদেশ দাও”, এইরূপ বলিলেন; তখন সনৎকুমার “তুমি কি শিখিয়াছ আগে বল তার পর আমি বলিব” এইরূপ প্রশ্ন করিলেন । নারদ বলিলেন “আমি ঋগবেদাদি চারি ও ইতিহাস পুরাণরূপী পঞ্চম সমেত সমস্ত বেদ, ব্যাকরণ, গণিত, তৰ্কশাস্ত্ৰ, কালশাস্ত্ৰ, নীতিশাস্ত্ৰ, বেদাঙ্গ, ধর্মশাস্ত্ৰ, ভূতবিদ্যা, ক্ষাত্রবিদ্যা, নক্ষত্রবিদ্যা, সর্পদেবজনবিদ্যা প্রভৃতি সমস্তই শিক্ষা করিয়াছি; কিন্তু তাহার দ্বারা আত্মজ্ঞান হয় নাই বলিয়া এক্ষণে আপনার নিকট আসিয়াছি ।” তাহাতে সনৎকুমার “তুমি যাহা কিছু শিখিয়াছ তাহা সমস্ত নামরূপাত্মক, প্রকৃত ব্ৰহ্ম এই নাম ব্ৰহ্মের অতীত” এইরূপ উত্তর দিয়া পরে ক্ৰমে ক্রমে এই নামরূপ অর্থাৎ সাংখ্যদিগের অব্যক্ত প্ৰকৃতির অতীত কিংবা বাণী, আশা, সঙ্কল্প, মন, বুদ্ধি (জ্ঞান) ও প্রাণ - ইহাদেরও অতীত এবং ইহাদের খুব উপরে অবস্থিত যে পরমাত্মারূপী অমৃত তত্ত্ব, নারদকে তাহারই সহিত পরিচয় করাইয়া দিলেন ।


18) বিজ্ঞান-বাদ বেদান্তের গ্রাহ্য নহে


উপরি-উক্ত বিচার-আলোচনার তাৎপর্য এই যে, মানব-ইন্দ্ৰিয়ের নামরূপের অতিরিক্ত আর কিছুরই প্ৰত্যক্ষ জ্ঞান না হইলেও এই অনিত্য নামরূপের আবরণের নীচে চক্ষুর অগোচর অতএব অব্যক্ত কোন কিছু নিত্য দ্রব্য অবশ্যই থাকিবে এবং তৎপ্ৰযুক্তই সমস্ত জগতের জ্ঞান আমাতে একত্বের দ্বারা হইয়া থাকে । যাহা কিছু জ্ঞান হয় তাহা আত্মারই হইয়া থাকে, তাই আত্মা জ্ঞাতা । এই জ্ঞাতার যে জ্ঞান হয় তাহা নামরূপাত্মক জগতেরই জ্ঞান; তাই, নামরূপাত্মক বাহ্য জগতই জ্ঞান [মভা|শাং|৩০৬|৪০]; এবং এই নামরূপাত্মক জগতের মূলে যে কিছু বস্তুতত্ত্ব আছে তাহাই জ্ঞেয় । এই বৰ্গীকরণ স্বীকার করিয়া ভগবদ্‌গীতায় জ্ঞাতাকে ক্ষেত্ৰজ্ঞ আত্মা এবং জ্ঞেয়কে ইন্দ্ৰিয়াতীত নিত্য পরব্ৰহ্ম [গী|১৩|১২-১৭] বলা হইয়াছে; এবং পরে জ্ঞানের তিন ভেদ করিয়া ভিন্নত্ব কিংবা নানাত্বের দ্বারা উৎপন্ন জগৎজ্ঞানকে রাজসিক এবং শেষে নানাত্বের যে জ্ঞান একত্বরূপ হইতে হয় তাহাকে সাত্ত্বিক জ্ঞান বলা হইয়াছে [গী|১৮|২০,২১] । এই সম্বন্ধে কেহ কেহ এইরূপ তর্ক করেন যে, জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় এইরূপ ত্ৰিবিধ ভেদ করা ঠিক নহে; আমাদের যাহা কিছু জ্ঞান হয়, এই জগতে তাহা হইতে ভিন্ন আর কিছু আছে এরূপ বলিবার পক্ষে আমাদের কোন প্ৰমাণ নাই । গরু ঘোড়া প্ৰভূত যে সকল বাহ্য বস্তু আমরা দেখিতে পাই তাহা আমাদের জ্ঞানই, এবং এই জ্ঞান সত্য হইলেও তাহা কি করিয়া উৎপন্ন হইল বুঝাইবার জন্য আমার জ্ঞান ব্যতীত অন্য কোন উপায় থাকে না; অতএব এই জ্ঞান ব্যতীত বাহ্য পদাৰ্থ বলিয়া কোন স্বতন্ত্র বস্তু আছে কিংবা এই সকল বাহ্য বস্তুর মূলে অন্য কোন স্বতন্ত্র তত্ত্ব আছে এরূপ বলিতে পারা যায় না । কারণ, জ্ঞাতা না থাকিলে জগৎ থাকে কোথায় ? এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে, জ্ঞাতা, জ্ঞান ও জ্ঞেয় ইহাদের মধ্যে জ্ঞেয় এই তৃতীয় বৰ্গ থাকে না; জ্ঞাতা ও তাহার জ্ঞান এই দুই শুধু বাকী থাকে; এবং এই যুক্তিবাদকে আর একটু দূরে লইয়া গেলে ‘জ্ঞাতা’ বা ‘দ্রষ্টা’ওতো, একপ্রকারের জ্ঞানই, তাই শেষে জ্ঞান ব্যতীত আর কোন বস্তুই অবশিষ্ট থাকে না । ইহাকে ‘বিজ্ঞানবাদ’ বলে; এবং ইহাকেই যোগাচারপন্থী বৌদ্ধেরা প্ৰমাণ বলিয়া ধরিয়াছে । জ্ঞাতার জ্ঞান ব্যতীত স্বতন্ত্র অন্য কিছুই এই জগতে নাই; অধিক কি, জগতই নাই, যাহা কিছু আছে তাহা মনুষ্যের জ্ঞানই, এইরূপ এই মার্গের বিদ্বানেরা প্রতিপাদন করিয়াছেন । ইংরেজ গ্রন্থকারদিগের মধ্যেও হিউমের ন্যায় পণ্ডিত এই প্ৰকার মতের অগ্ৰণী । কিন্তু বেদান্তীদিগের নিকট এই মত মান্য নহে; বাদরায়ণাচার্য বেদান্তসূত্রে [বেসূ|২|২|২৮-৩২] এবং শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য উক্ত সূত্রসমূহের ভাষ্যে এই মত খণ্ডন করিয়াছেন । মনুষ্যের মনের উপর উৎপন্ন সংস্কারই শেষে মনুষ্য জানিয়া থাকে, ইহা মিথ্যা নহে; এবং ইহাকেই আমরা জ্ঞান বলি । কিন্তু জ্ঞান ব্যতীত যদি অন্য কিছু না থাকে, তবে ‘গরু’সম্বন্ধীয় জ্ঞান ভিন্ন, ‘ঘোড়া’সম্বন্ধীয় জ্ঞান ভিন্ন, এবং ‘আমি’বিষয়ক জ্ঞান ভিন্ন, - “এইরূপ বিভিন্ন জ্ঞানের মধ্যেই যে ভিন্নতা আমাদের বুদ্ধি উপলব্ধি করে তাহার কারণ কি ? জ্ঞান হইবার মানসিক ক্রিয়া সর্বত্র একই মানিলাম; কিন্তু তদ্ব্যতীত অন্য কিছুই নাই বলিলে গরু ঘোড়া ইত্যাদি বিভিন্ন ভেদ আসিল কোথা হইতে ? স্বপ্নজগতের ন্যায় মন আপনিই আপন মর্জি অনুসারে জ্ঞানের এই ভেদ স্থাপন করে এইরূপ কেহ যদি বলেন, তাহা হইলে স্বপ্নজগৎ হইতে ভিন্ন জাগ্ৰত অবস্থার জ্ঞানে যে একপ্রকার সুসঙ্গতি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার কারণ বলিতে পারা যায় না [বেসু|শাংভা|২|২|২৯; ৩|২|৪] । তাছাড়া, জ্ঞান ব্যতীত অন্য কোন বস্তু নাই, এবং ‘দ্রষ্টার’ মনই সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ নির্মাণ করে এইরূপ বলিলে, প্ৰত্যেক দ্রষ্টার ‘আমার মন’ অৰ্থাৎ ‘আমিই স্তম্ভ’ কিংবা ‘আমিই গরু’ এইরূপ ‘আমি-পূর্বক’ সমস্ত জ্ঞান হওয়া চাই । কিন্তু তাহা না হইয়া, আমি পৃথক, স্তম্ভ গরু প্ৰভৃতি পদার্থও আমা হইতে ভিন্ন, যখন এইরূপ প্ৰতীতি সকলের হইয়া থাকে, তখন দ্রষ্টার মনে সমস্ত জ্ঞান উৎপন্ন হইবার জন্য এই আধারভূত বাহ্যজগতে অন্য কোন স্বতন্ত্র বাথ্য বস্তু অবশ্যই থাকিবে, এইরূপ শঙ্করাচার্য সিদ্ধান্ত করিয়াছেন [বেসু|শাংভা|২|২|২৮]কাণ্টের মতও এইরূপ; জাগতিক জ্ঞানলাভের জন্য মনুষ্যের বুদ্ধির একীকরণ আবশ্যক হইলেও, এই জ্ঞানকে বুদ্ধি একেবারেই আপন হইতে অর্থাৎ নিরাধার কিংবা সম্পূর্ণ নূতন উৎপন্ন করে না, তাহা সর্বদাই জাগতিক বাহ্য বস্তুর অপেক্ষা করে, ইহা তিনি স্পষ্ট বলিয়াছেন । এই স্থানে কেহ প্রশ্ন করিতে পারেন যে, “কিহে ! শঙ্করাচার্য একবার বাহ্য জগত মিথ্যা বলেন এবং পুনরায় বৌদ্ধদিগের মত খণ্ডন করিবার সময় সেই বাহ্য জগতের অস্তিত্বই ‘দ্রষ্টা’র অস্তিত্বেরই ন্যায় সত্য, এইরূপ প্ৰতিপাদন করেন ! কেমন করিয়া ইহার সমন্বয় করা যাইবে ?” এই প্রশ্নের উত্তর পূর্বেই দেওয়া হইয়াছে । আচার্য বাহ্য জগতকে যখন মিথ্যা বা অসত্য বলেন, তখন বাহ্যজগতের দৃশ্য নামরূপ অসত্য অর্থাৎ নশ্বর ইহাই তাহার অর্থ বুঝিতে হইবে । এ নামরূপাত্মক বাহ্য দৃশ্য মিথ্যা হইলেও উহার দ্বারা তাহার মূলে কোন প্রকার ইন্দ্রিয়াতীত সত্য বস্তু আছে, এই সিদ্ধান্তের কোন বাধা হয় না । সারকথা, ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচারে যেমন এই সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে যে দেহেন্দ্রিয়াদি নশ্বর নামরূপের মূলে কোন নিত্য আত্মতত্ত্ব আছে; সেইরূপ বলিতে হয় যে, নামরূপাত্মক বাহ্য জগতের মূলেও কোন নিত্য আত্মতত্ত্ব আছে । তাই, দেহেন্দ্ৰিয় ও বাহ্য জগৎ এই দুয়ের নিত্য পরিবর্তনশীল অর্থাৎ মিথ্যা দৃশ্যমান বস্তুর মূলে দুইদিকেই কোন নিত্য অর্থাৎ সত্য বস্তু আচ্ছাদিত হইয়া আছে, এইরূপ বেদান্তশাস্ত্ৰ নির্ধারণ করিয়াছেন । ইহার পরে দুই দিকের এই যে নিত্য তত্ত্ব, ইহা বিভিন্ন কি একরূপ এই প্রশ্ন আসে । কিন্তু ইহার বিচার আবার করিব । অনেক সময় এই মতের অর্বাচীনতা সম্বন্ধে যে আপত্তি করা হয় প্ৰথমে তাহার একটু বিচার করিব ।


19) মায়াবাদের প্রাচীনতা


কেহ কেহ বলেন যে, বৌদ্ধদের বিজ্ঞানবাদ বেদান্তশাস্ত্রের অভিমত না হইলেও, চক্ষুর গোচর বাহ্যজগতের নাম রূপাত্মক স্বরূপ মিথ্যা এবং তাহার মূলদেশে যে অব্যয় ও নিত্য দ্রব্য আছে তাহাই সত্য, শঙ্করাচার্যের এই মত - যাহাকে মায়াবাদ বলে - প্রাচীন উপনিষদে বর্ণিত না থাকা প্ৰযুক্ত উহাকেও বেদান্তশাস্ত্রের মূল-ভাগ মানিতে পারা যায় না । কিন্তু উপনিষদ্‌ মনোযোগের সহিত পাঠ করিলে এই আপত্তি যে ভিত্তিহীন, ইহা যে-কোন ব্যক্তির সহজে উপলব্ধি হইবে । ইহা প্ৰথমেই বলা হইয়াছে যে, ‘সত্য’ শব্দ ব্যবহারে চক্ষুর গোচর বস্তুর প্রতি প্ৰযুক্ত হয় । এইজন্য ‘সত্য’ শব্দের এই ব্যবহারিক অর্থ লইয়াই উপনিষদের কোন কোন স্থানে চক্ষুর গোচর নাম রূপাত্মক বাহ্য পদার্থকে ‘সত্য’ এবং সেই নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত দ্রব্যকে ‘অমৃত’ নাম দেওয়া হইয়াছে । উদাহরণ যথা, বৃহদারণ্যক উপনিষদে [১|৬|৩] “তদেতদমৃতং সত্যেন ছন্নং” - সেই অমৃত সত্যের দ্বারা আচ্ছাদিত - এইরূপ বলিয়া অমৃত ও সত্য এই দুই শব্দের “প্ৰাণো বা অমৃতং নামরূপে সত্যং তাভ্যাময়ং প্রাণশছন্নঃ” - প্ৰাণ অমৃত এবং নামরূপ সত্য, এবং এই নামরূপ সত্যের দ্বারা প্ৰাণ আচ্ছাদিত - এইরূপ ব্যাখ্যা করা হইয়াছে । এখানে প্ৰাণের অর্থ প্ৰাণস্বরূপ পরব্রহ্ম । ইহা হইতে দেখা যায় যে, পরবর্তী উপনিষদে যাহাকে ‘মিথ্যা’ ও ‘সত্য’ বলা হইয়াছে পূর্বে তাহারই অনুক্রমে ‘সত্য’ ও ‘অমৃত’ এই নাম ছিল । কোন কোন স্থানে এই অমৃতকে ‘সত্যস্য সত্যং’ - চক্ষুর গোচর সত্যের ভিতরকার চরম সত্য [বৃ|২|৩|৬] বলা হইয়াছে । কিন্তু ইহা হইতেই উক্ত আপত্তি সিদ্ধ হয় না যে, উপনিষদের কোন কোন স্থানে চক্ষুর গোচর জগৎকেই সত্য বলা হইয়াছে - কারণ, বৃহদারণ্যকেই শেষে আত্মরূপ পরব্রহ্ম ব্যতীত অন্য সমস্ত ‘আৰ্ত্তম্‌’ অর্থাৎ নশ্বর, এই রূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে [বৃ|৩|৭|২৩] । জগতের মূল তত্ত্বের অনুসন্ধান যখন প্রথম আরম্ভ হয়, তখন চক্ষুর গোচর জগতকে প্ৰথম হইতেই সত্য মানিয়া লইয়া তাহার অভ্যন্তরে অন্য কোন্‌ সূক্ষ্ম সত্য লুক্কায়িত আছে তাহার অনুসন্ধান হইতে লাগিল । কিন্তু পরে এইরূপ দেখা গেল যে, যে দৃশ্য জগতের রূপকে আমরা সত্য বলিয়া মনে করি, তাহা আসলে নশ্বর এবং তাহার অভ্যন্তরে কোন অবিনশ্বর বা অমৃত তত্ত্ব আছে । দুয়ের মধ্যে এই ভেদ যেমন যেমন অধিক ব্যক্ত করিবার প্রয়োজন উপস্থিত হইল, সেই অনুসারে ‘সত্য’ ও ‘অমৃত’ এই দুই শব্দের স্থানে ‘অবিদ্যা’ ও ‘বিদ্যা’ এবং পরিশেষে ‘মায়া ও সত্য’ কিংবা ‘মিথ্যা ও সত্য’ এই পরিভাষা প্রচলিত হইতে লাগিল । কারণ ‘সত্য’ শব্দের ধাত্ব্যৰ্থ ‘নিত্যস্থায়ী’ হওয়া প্ৰযুক্ত নিত্য পরিবর্তনশীল ও নশ্বর নামরূপকে সত্য বলা উত্তরোত্তর অধিকতর অসঙ্গত বলিয়া মনে হইতে লাগিল । কিন্তু এই প্রকারে ‘মায়া’ কিংবা ‘মিথ্যা’ শব্দ পূর্বাবধি প্ৰচলিত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের চক্ষুর গোচর জাগতিক বস্তুর বাহ্য আবির্ভাব নশ্বর ও অসত্য, এবং তাহার মূলস্থিত ‘তাত্ত্বিক দ্রব্য’ই সৎ কিংবা সত্য, এই বিচার অতীব প্রাচীন কাল হইতেই চলিয়া আসিয়াছে । ঋগ্‌বেদেই “একং সদ্‌ বিপ্ৰা বহুধা বদন্তি” [১|১৬৪|৪৬ ও ১০|১১৪|৫] - যাহা মূলে এক ও নিত্য (সৎ) তাহাকেই বিপ্ৰ (জ্ঞাতা) বিভিন্ন নাম দিয়া থাকেন - অর্থাৎ এক সত্য বস্তুই নামরূপের দ্বারা বিভিন্ন প্ৰতীত হয় এইরূপ কথিত হইয়াছে । “এক রূপের অনেক রূপ করিয়া দেখান” এই অর্থে ঋগ্‌বেদেও ‘মায়া’ শব্দের প্রয়োগ হইয়াছে, “ইন্দ্ৰো মায়াভিঃ পুরুরূপঃ ঈয়তে” ইন্দ্ৰ নিজের মায়ার দ্বারা অনেক রূপ ধারণ করেন [ঋ|৬|৪৭|১৮] । তৈত্তিরীয় সংহিতায় এক স্থলে [তৈ সং|৩|১১] এই অর্থেই ‘মায়া’ শব্দের প্রয়োগ করা হইয়াছে; এবং শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে এই ‘মায়া’ শব্দ নামরূপের সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হইয়াছে । কিন্তু মায়াশব্দের নামরূপ সম্বন্ধে প্রয়োগ করিবার রীতি শ্বেতাশ্বতরোপনিষদের কাল অবধিই প্রচলিত হইলেও ইহা তো নির্বিবাদ যে, নামরূপকে অনিত্য কিংবা অসত্য কল্পনা করা উহার পূর্ববৰ্তী, ‘মায়া’ শব্দের বিপরীত অৰ্থ করিয়া শ্ৰীশঙ্করাচার্য এই কল্পনা নূতন বাহির করেন নাই । শ্রীশঙ্করাচার্যের ন্যায় যাঁহাদের নামরূপাত্মক জগৎ-স্বরূপকে ‘মিথ্যা’ নাম দিবার সাহস হয় না, অথবা গীতায় যেমন ভগবান ঐ অর্থে মায়া শব্দের উপযোগ করিয়াছেন, তাহা করিতেও যাঁহারা ভয় পান, তাঁহারা ইচ্ছা করেন তো বৃহদারণ্যক উপনিষদের ‘সত্য’ ও ‘অমৃত’ শব্দের স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করিতে পারেন । যাই বলনা কেন, নামরূপ ‘নশ্বর’ এবং নামরূপের দ্বারা আচ্ছাদিত তত্ত্ব ‘অমৃত’ বা ‘অবিনশ্বর’ এবং এই ভেদ প্ৰাচীন বৈদিক কাল হইতে চলিয়া আসিয়াছে, এই সিদ্ধান্তে কোনই বাধা আসে না । 


20) নামরূপে আচ্ছাদিত নিত্য ব্রহ্মের এবং শরীর আত্মার স্বরূপ একই


যাক্‌ । নামরূপাত্মক বাহ্য জগতের পদার্থমাত্রের যে জ্ঞান আমাদের আত্মায় উৎপন্ন হয় তাহা উৎপন্ন হইতে হইলে আমাদের আত্মার আধারভূক্ত, এবং আত্মার সহিত সমশ্রেণীর বাহ্যজগতের নানা পদার্থের মূলে বর্তমান ‘কোন-না-কোন কিছু’ এক মূলীভূত নিত্য এবং পদার্থ থাকা চাই; নচেৎ এই জ্ঞান হইতেই পারে না । কিন্তু এইটুক স্থির করিলেই অধ্যাত্মশাস্ত্রের কাজ শেষ হয় না । বাহ্য জগতের মূলে অবস্থিত এই নিত্য বস্তুকেই বেদান্তী ‘ব্ৰহ্ম’ বলেন; এবং সম্ভব হইলে এই, ব্রহ্মের স্বরূপ নির্ধারণ করাও আবশ্যক । সমস্ত নামরূপাত্মক পদার্থের মূলে অবস্থিত এই নিত্য তত্ত্ব অব্যক্ত হওয়া প্রযুক্ত তাহার স্বরূপ নামরূপাত্মক পদার্থের ন্যায় ব্যক্ত ও স্থল (জড়) হইতে পারে না, ইহা সুস্পষ্ট । কিন্তু ব্যক্ত ও স্থূল পদার্থ ছাড়িয়া দিলেও মন, স্মৃতি, বাসনা প্রাণ ও জ্ঞান প্রভৃতি স্থূল নহে এমন অনেক অব্যক্ত পদার্থ আছে, এবং ইহা অসম্ভব নহে যে, পরব্রহ্মও তাহাদেরই মধ্যে কোন না-কোন একটীর স্বরূপবিশিষ্ট । কেহ কেহ বলেন যে, প্ৰাণের ও পরব্রহ্মের স্বরূপ একই । জর্মন পণ্ডিত শোপেনহর পরব্রহ্মকে বাসনাত্মক স্থির করিয়াছেন । বাসনা মনের ধর্ম হওয়ায়, এই মতানুসারে ব্ৰহ্মকে মনোময় বলা যাইতে পারে [তৈ|৩|৪] । কিন্তু এখন পর্যন্ত যে বিচার করা হইয়াছে তাহা হইতে বলা যাইতে পারে যে, ‘প্রজ্ঞানং ব্ৰহ্ম’ [ঐ|৩|৩], কিংবা ‘বিজ্ঞানং ব্ৰহ্ম’ [তৈ|৩|৫] - জড়জগতের নানাত্বের যে জ্ঞান এক স্বরূপ হইতে আমার হয় তাহাই ব্ৰহ্মের স্বরূপ । হেগেলের সিদ্ধান্ত এই ধরণেরই । কিন্তু উপনিষদে চিদ্‌রূপী জ্ঞানের ন্যায়ই সৎকে (অর্থাৎ জাগতিক সমস্ত বস্তুর অস্তিত্বের সাধারণ ধর্ম বা সত্তাসামান্যত্বকে) এবং আনন্দকেও ব্ৰহ্মস্বরূপেরই অন্তর্ভুক্ত করিয়া ব্ৰহ্মকে সচ্চিদানন্দরূপ বলা হইয়াছে । ইহা ব্যতীত অন্য ব্ৰহ্মস্বরূপ হইতেছে ওঁকার । ইহার উপপত্তি এইরূপ - প্ৰথমে সমস্ত বেদ অনাদি ওঁকার হইতে নিঃসৃত হইয়াছে; এবং উহা বাহির হইবার পর সেই বেদের নিত্য শব্দ হইতেই পরে ব্ৰহ্মা যখন সমস্ত জগৎ নির্মাণ করিলেন [গী|১৭|২৩; মভা|শাং|২৩১|৫৬-৫৮], তখন ওঁকার ব্যতীত মূলারম্ভে অন্য কিছু ছিল না । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, ওঁকারই প্ৰকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ [মাণ্ডুক্য|১; তৈত্তি|১,৮] । কিন্তু শুধু অধ্যাত্মশাস্ত্ৰদৃষ্টিতে বিচার করিলে পরব্রহ্মের এই সমস্ত স্বরূপই ন্যূনাধিক নামরূপাত্মক হইয়া পড়ে । কারণ এই সমস্ত স্বরূপ মানব-ইন্দ্রিয়ের গোচর, এবং মনুষ্য এইপ্রকারে যাহা জানে তাহা নামরূপের গণ্ডীর মধ্যেই পড়িয়া যায় । তবে, এই নামরূপের মূলে অবস্থিত যে অনাদি, অন্তর বাহিরে পূর্ণরূপে অবস্থিত, একাত্মক, নিত্য ও অমৃত তত্ত্ব [গী|১৩|১২-১৭] আছে, তাহার বাস্তব স্বরূপের নির্ণয় কি করিয়া হইবে ? অনেক অধ্যাত্মশাস্ত্ৰজ্ঞ বলেন যে, আর যাহাই হউক না কেন, এই তত্ত্ব আমাদের ইন্দ্ৰিয়ের অজ্ঞেয় থাকিবেই; ক্যাণ্ট তো এই প্রশ্নের বিচার করাই ছাড়িয়া দিয়াছেন । সেইরূপ উপনিষদেও “নেতি নেতি” - অৰ্থাৎ যাহার সম্বন্ধে কিছু বলা যাইতে পারে তাহা নহে; ব্ৰহ্ম তাহারও অতীত, এবং চক্ষুর অদৃশ্য; “যতো বাচো নিবর্ত্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ” - বাক্যমনের অগোচর - এই প্রকারে, পরব্রহ্মের অজ্ঞেয় স্বরূপের বর্ণনা করা হইয়াছে । তথাপি এই অগম্য অবস্থাতেও মনুষ্য আপন বুদ্ধির দ্বারা ব্ৰহ্মস্বরূপের একপ্ৰকার নির্ণয় করিতে পারে, ইহা অধ্যাত্মশাস্ত্র স্থির করিয়াছে । বাসনা, স্মৃতি, ধৃতি, আশা, প্ৰাণ, জ্ঞান প্রভৃতি যে সকল অব্যক্ত পদার্থ উপরে বলা হইয়াছে তন্মধ্যে যাহা অতিশয় ব্যাপক কিম্বা সর্বশ্রেষ্ঠ নির্ধারিত হইবে তাহা সেই পরব্রহ্মের স্বরূপ মানিতে হইবে । কারণ সমস্ত অব্যক্ত পদার্থের মধ্যে পরব্রহ্ম শ্ৰেষ্ঠ এই বিষয়টি নির্বিবাদ । এই দৃষ্টিতে বিচার করিলে, আশা, স্মৃতি, বাসনা, ধৃতি ইত্যাদি মনের ধর্ম হওয়ায় মন ইহাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা জ্ঞান শ্ৰেষ্ঠ; এবং জ্ঞান বুদ্ধির ধর্ম বলিয়া জ্ঞান অপেক্ষা বুদ্ধি শ্ৰেষ্ঠ; এবং শেষে বুদ্ধিও যাহার ভূত্য সেই আত্মা সকল হইতে শ্ৰেষ্ঠ [গী|৩|৪২] । ক্ষেত্ৰক্ষেত্রজ্ঞপ্রকরণে ইহার বিচার করা হইয়াছে । এখন বাসনা, মন প্রভৃতি সমস্ত অব্যক্ত পদার্থের মধ্যে যদি আত্মা শ্রেষ্ঠ হয় তবে পরব্রহ্মের স্বরূপও অবশ্য তাহাই হইবে ইহা স্বতই নিষ্পন্ন হইল । ছান্দোগ্য উপনিষদের সপ্তম অধ্যায়ে এই যুক্তিবাদই স্বীকৃত হইয়াছে; এবং সনৎকুমার নারদকে বলিয়াছেন যে, বাক্য অপেক্ষা মন অধিক যোগ্য (ভূয়স্‌), মন অপেক্ষা জ্ঞান, জ্ঞান অপেক্ষা বল, এবং এইপ্ৰকার ক্রমশঃ ঊর্দ্ধে উঠিয়া আত্মা যখন সকল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ (ভূমন্‌) তখন আত্মাকেই পরব্রহ্মের প্রকৃত স্বরূপ বলিতে হয় । ইংরেজ গ্ৰন্থকারদিগের মধ্যে গ্ৰীণ এই সিদ্ধান্তই স্বীকার করিয়াছেন; কিন্তু তাঁহার যুক্তিবাদ একটু ভিন্ন হওয়ায় তাহা এখানে বেদান্তের পরিভাষায় সংক্ষেপে বলিব । গ্ৰীণ বলেন যে, ইন্দ্ৰিয়াদির যোগে আমাদের মনের উপর বাহ্য নামরূপের যে সকল সংস্কার সংঘটিত হয় তাহাদের একীকরণ করিয়া আত্মার জ্ঞান উৎপন্ন হয়; ঐ জ্ঞানের অনুরূপ বাহ্যজগতের ভিন্ন ভিন্ন নামরূপের মূলেও একত্বের দ্বারা উৎপন্ন কোনপ্রকার বস্তু থাকা চাই; নচেৎ আত্মার একীকরণের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান স্বকপোলকল্পিত ও নিরাধার হইয়া বিজ্ঞানবাদের ন্যায় মিথ্যা হইয়া পড়িবে । এই ‘কোন এক’ বস্তুকে আমরা ব্ৰহ্ম বলি । প্ৰভেদ এই যে কাণ্টের পরিভাষা স্বীকার করিয়া গ্ৰীণ তাহাকে বস্তুতত্ত্ব বলেন যাহাই বলনা কেন, শেষে বস্তুতত্ত্ব (ব্ৰহ্ম) ও আত্মা পরস্পরের অনুরূপ এই দুই পদার্থই অবশিষ্ট থাকে । তন্মধ্যে ‘আত্মা’ মন ও বুদ্ধির অতীত অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়াতীত হইলেও, নিজের প্রতীতিকে প্ৰমাণ মানিয়া আমরা নির্ধারণ করিয়া থাকি যে, আত্মা জড় নহে, - উহা চিৎরূপী বা চৈতন্যরূপী । আত্মার স্বরূপ এইরূপ নির্ধারিত করিলে পর, বাহ্যজগতের অন্তর্গত ব্রহ্মের স্বরূপ কি তাহা স্থির করিতে হইবে । এই বিষয়ে দুইটী মাত্র পক্ষই সম্ভব - এই ব্ৰহ্ম বা বস্তুতত্ত্ব (১) আত্মস্বরূপাত্মক কিংবা (২) আত্মা হইতে ভিন্ন স্বরূপাত্মক । কারণ ব্রহ্ম ও আত্মা ব্যতীত তৃতীয় বস্তুই অবশিষ্ট থাকে না । কিন্তু সকলেই ইহা জানে যে, কোনও দুই পদার্থ স্বরূপত ভিন্ন হইলে তাহাদের পরিণাম কিংবা কাৰ্যও অবশ্য ভিন্ন হইবে । তাই, পদার্থের পরিণাম হইতেই উক্ত পদার্থ ভিন্ন কিংবা একরূপ, তাহার নির্ণয় আমরা যে কোন শাস্ত্ৰে করিয়া থাকি । উদাহরণ যথা - দুই গাছের মূল, ডালপালা, ছাল, পাতা, ফুল ফল প্রভৃতি দেখিয়া আমরা স্থির করি যে, ঐ দুইটী গাছ একই অথবা ভিন্ন । এই রীতি উপস্থিত ক্ষেত্রে প্রয়োগ কবিলে, আত্মা ও ব্ৰহ্ম এক-স্বরূপাত্মকই হইবে, এইরূপ উপলব্ধি হয় । কারণ, ভিন্ন ভিন্ন জাগতিক পদার্থের যে সংস্কার মনের উপর হয়, এই আত্মার ব্যাপারের দ্বারা তাহাদের একীকরণ হয়; একীকরণের সঙ্গে যে একীকরণ দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন বাহ্য পদার্থের মূলে অবস্থিত বস্তুতত্ত্ব অর্থাৎ ব্ৰহ্ম উক্ত পদার্থসমূহের নানাত্ব ভাঙ্গিয়া দেয় সেই একীকরণের মিল হওয়া চাই, নচেৎ সমস্ত জ্ঞান নিরাধার ও মিথ্যা হইয়া পড়িবে, ইহা উপরে বলা হইয়াছে । একই নমুনার এবং সম্পূর্ণ এক অন্যের সহিত মিলাইয়া একীকরণকারী এই তত্ত্ব দুই স্থানে হইলেও পরস্পর হইতে ভিন্ন থাকিতে পারে না; অতএব ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে, ইহার মধ্যে, আত্মার যে রূপ তাহাই ব্রহ্মেরও রূপ হইবে । (Green's Prolegomena to Ethics. $$ 26-36). 

সারকথা, যে কোন প্রকারেই বিচার করা হোক না কেন, ইহাই সিদ্ধ হইতেছে যে বাহ্যজগতের নামরূপে আচ্ছাদিত ব্ৰহ্মতত্ত্ব নামরূপাত্মক প্রকৃতির ন্যায় জড় তো নহে, পরন্তু বাসনাত্মক ব্ৰহ্ম, মনোময় ব্ৰহ্ম, জ্ঞানময় ব্ৰহ্ম, প্ৰাণব্ৰহ্ম, কিংবা ওঁকাররূপী শব্দব্ৰহ্ম, এই সমস্ত ব্ৰহ্মের রূপও নিম্নপদবীর এবং প্রকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ ইহার অতীত ও ইহা হইতে অধিক যোগ্য অর্থাৎ শুদ্ধ আত্মস্বরূপ । ইহাই যে গীতারও সিদ্ধান্ত তাহা এই সম্বন্ধে গীতার অনেক স্থানে যে উল্লেখ আছে তাহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় [গী|২|২০; ৭|৫; ৮|৪; ১৩|৩১; ১৫|৭,৮ দেখ] । তথাপি ব্রহ্মের ও আত্মার স্বরূপ এক, এই সিদ্ধান্ত কেবল এই যুক্তিপ্রয়োগে আমাদের ঋষিরা যে প্ৰথমে সন্ধান করিয়াছিলেন এরূপ বুঝিবে না । কারণ, অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে কেবল বুদ্ধির সাহায্যে কোন অনুমানই নিশ্চিত করা যাইতে পারে না, তাহার সহিত সর্বদা আত্মপ্ৰতীতির যোগ হওয়া চাই, ইহা এই প্রকরণের আরম্ভেই বলিয়াছি । তাছাড়া আধিভৌতিক শাস্ত্রেও অনুভূতি আগে আসে তাহার পর তাহার উপপত্তি জানা যায়, কিংবা অনুসন্ধান করিয়া বাহির করা হয়, ইহা ত আমরা সর্বদাই দেখিতে পাই । এই ন্যায় অনুসারে উপরিপ্রদত্ত ব্ৰহ্মাত্ম্যৈক্যের বুদ্ধিগম্য উপপত্তি বাহির হইবার শত শত বৎসর পূর্বে আমাদের প্রাচীন ঋষিরা “নেহ নাহস্তি কিঞ্চন” [বৃ|৪|৪|১৯; কঠ|৪|১১] এই জগতের দৃশ্যমান অনেকত্ব সত্য নহে, তাহার মূলে চারিদিকে একই অমৃত, অব্যয় ও নিত্য তত্ত্ব আছে [গী|১৮|২০] এইরূপ প্ৰথমে নির্ণয় করিয়া, শেষে বাহ্যজগতের নানারূপের দ্বারা আচ্ছাদিত অবিনাশী তত্ত্ব এবং আমাদের শরীরান্তর্ভূত বুদ্ধির অতীত আত্মতত্ত্ব এই দুই একই অর্থাৎ একপদার্থী, অমর ও অব্যয় কিংবা যে তত্ত্ব ব্ৰহ্মাণ্ডে তাহাই পিণ্ডে অর্থাৎ মনুষ্যের দেহেতেই অবস্থিত, এই সিদ্ধান্ত তাঁহারা অন্তদৃষ্টির দ্বারা বাহির করিয়াছেন; এবং বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞ্যবল্ক্য মৈত্রেয়ীকে, গার্গী বারুণী প্রভৃতিকে এবং জনককে সম্পূর্ণ বেদান্তের এই রহস্যই বলিয়াছেন [বৃ|৩|৫-৮; ৪|২-৪]“অহং ব্রহ্মাস্মি” – আমিই ব্রহ্ম, - ইহা যিনি জানিয়াছেন তিনি সমস্তই জানিয়াছেন এইরূপ এই উপনিষদেই পূর্বে বলা হইয়াছে [বৃ|১|৪|১০]; ছান্দোগ্য উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্বেতকেতুকে তাঁহার পিতা অদ্বৈতবেদান্তের এই তত্ত্বই অনেক প্রকারে বুঝাইয়া দিয়াছেন । “মাটীর এক গোলায় কি আছে তাহা জানিতে পারিলে মৃত্তিকার নামরূপাত্মক সমস্ত বিকার যেরূপ বুঝা যায় সেইরূপ যে এক বস্তুর জ্ঞান হইলে সমস্ত বস্তুই জানা যায়, সেই বস্তু আমাকে বল, তদ্বিষয়ক জ্ঞান আমার নাই” অধ্যায়ের আরম্ভে শ্বেতকেতু আপন পিতাকে এইরূপ প্রশ্ন করিলে, তাঁহার পিতা তখন নদী, সমুদ্র, জল ও লবণ ইত্যাদি অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইলেন যে, বাহ্য জগতের মূলে যে দ্রব্য আছে তাহা (তৎ) এবং তুমি (ত্বম্‌) অর্থাৎ তোমার দেহান্তর্গত আত্মা একই – “তত্ত্বমসি”; এবং আপনাকে আপনি জানিলে, সমস্ত জগতের মূলে কি আছে তাহা স্বতই তুমি জানিতে পারিবে । এইরূপ শ্বেতকেতুর পিতা নূতন নূতন বিভিন্ন দৃষ্টান্তের দ্বারা শ্বেতকেতুকে উপদেশ দিলেন; এবং প্রতিবারই “তত্ত্বমসি” - তাহাই তুমি - এই সূত্রের পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন [ছাং|৬|৮-১৬]“তত্ত্বমসি” ইহাই অদ্বৈতবেদান্তের মহাবাক্যগুলির মধ্যে মুখ্য বাক্য ।


21) আত্মা ও ব্ৰহ্মকে চিদ্‌রূপী কেন বলে ?


ব্ৰহ্ম আত্মস্বরূপী - ইহা নির্ণয় হইল । কিন্তু আত্মা চিদ্‌রূপী বলিয়া ব্ৰহ্মও চিদ্‌রূপী, এরূপ কেহ কেহ মনে করিতে পারেন । তাই এখানে ব্রহ্মের ও সেই সঙ্গে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ কি, তাহার আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । আত্মার সান্নিধ্যে জড়াত্মক বুদ্ধিতে উৎপন্ন ধর্মকে চিৎ অর্থাৎ জ্ঞান বলে । কিন্তু যখন বুদ্ধির এই ধর্মকে আত্মার উপর চাপানো উচিত নহে, তখন তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে আত্মার মূল স্বরূপকেও নির্গুণ ও অজ্ঞেয় বলিয়াই মানিতে হইবে । তাই কাহারও কাহারও মত এই যে, ব্ৰহ্ম আত্মস্বরূপী হইলেও এই উভয়কে কিংবা ইহাদের মধ্যে কোন একটিকে চিদ্‌রূপী বলা কিয়দংশে গৌণ । কেবল চিদ্‌রূপসম্বন্ধেই এই আপত্তি নহে; কিন্তু ‘সৎ’ এই বিশেষণও পরব্রহ্মের উপর চাপানো ঠিক নহে ইহাও ঐ সঙ্গে স্বতঃই প্রাপ্ত হওয়া যায় । কারণ সৎ ও অসৎ এই দুই ধর্ম পরস্পর-বিরুদ্ধ ও নিয়ত পরস্পরসাপেক্ষ অর্থাৎ দুই বিভিন্ন বস্তুর উদ্দেশ্যেই বলা হইয়া থাকে । যে ব্যক্তি আলোক কখনই দেখে নাই, সে আঁধারের কল্পনা করিতে পারে না; শুধু তাহাই নহে, আলো ও আঁধার এই দুটি শব্দের দ্বন্দ্বও সে বুঝিতে পারিবে না । সৎ ও অসৎ এই শব্দদ্বয়ের দ্বন্দ্বসম্বন্ধে এই ন্যায়ই উপযোগী । কোন কোন বস্তুর নাশ হইয়া থাকে ইহা আমাদের উপলব্ধি হইলে, আমরা সমস্ত বস্তুর অসৎ (নশ্বর) ও সৎ (অবিনশ্বর) এই দুই বর্গ নির্দেশ করিতে থাকি; কিংবা সৎ ও অসৎ এই দুই শব্দ বুঝতে হইলে মনুষ্যের দৃষ্টির সম্মুখে দুই প্রকারের বিরূদ্ধ ধর্ম আসা আবশ্যক । কিন্তু মূলারম্ভে যদি একই বস্তু ছিল, তবে দ্বৈত উৎপন্ন হইলে পর দুই বস্তুর উদ্দেশে যে সাপেক্ষ সৎ ও অসৎ এই দুই শব্দের প্রচার হইয়াছে, এই মূল বস্তুতে উহাদের কিরূপে প্রয়োগ করা যাইবে ? কারণ ইহাকে সৎ বলিলে সেই সময়ে তাহার বিরুদ্ধ কোন অসৎ ছিল কি না এই সন্দেহ উপস্থিত হয় । তাই পরব্রহ্মের কোন বিশেষণ না দিয়াই “জগতের আরম্ভে সৎও ছিল না অসৎও ছিল না, যাহা কিছু ছিল তাহা একই ছিল”, ঋগ্‌বেদের নাসদীয় সূক্তে জগতের মূলতত্ত্বের এইরূপ বর্ণনা আছে [ঋ|১০|১২৯] । সৎ ও অসৎ এই দুই শব্দের জুড়ী (কিংবা দ্বন্দ্ব) পরে বাহির হইয়াছে; এবং সৎ ও অসৎ, শীত ও উষ্ণ প্রভৃতি দ্বন্দ্ব হইতে যাহার বুদ্ধি মুক্ত হইয়াছে সে এই সমস্ত দ্বন্দ্বের অতীত অর্থাৎ নির্দ্বন্দ্ব ব্ৰহ্মপদে উপনীত হয় এইরূপ গীতাতে উক্ত হইয়াছে [গী|৭|২৮; ২|৪৫] । অধ্যাত্মশাস্ত্রের বিচার কিরূপ গভীর ও সূক্ষ্ম তাহা ইহা হইতে উপলব্ধি হইবে । কেবল তর্কদৃষ্টিতে বিচার করিলে, পরব্রহ্মের কিংবা আত্মারও অজ্ঞেয়ত্ব স্বীকার না করিয়া উপায় নাই । কিন্তু ব্ৰহ্ম এইরূপ অজ্ঞেয় ও নির্গুণ অতএব ইন্দ্ৰিয়াতীত হইলেও ইহা প্ৰতীতি হইতে পারে যে, প্ৰত্যেক মনুষ্যের নিজ নিজ আত্মার সাক্ষাৎ প্ৰতীতি হওয়ায়, আমার নির্গুণ ও অনির্বাচ্য আত্মার যে স্বরূপ সাক্ষাৎকারে আমি জানিতে পারি তাহাই পরব্রহ্মেরও স্বরূপ । সেইজন্য ব্ৰহ্ম ও আত্মা একস্বরূপী, এই সিদ্ধান্ত নিরর্থক হইতে পারে না । এই দৃষ্টিতে দেখিলে, “ব্ৰহ্ম আত্মস্বরূপী” ইহা অপেক্ষা ব্ৰহ্মস্বরূপ সম্বন্ধে বেশী কিছু বলা যাইতে পারে না; অবশিষ্ট বিষয়সম্বন্ধে স্বানুভূতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিতে হয় । কিন্তু বুদ্ধিগম্য শাস্ত্রীয় প্রতিপাদনে যতদূর সম্ভব শব্দের দ্বারা খোলসা ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । তাই ব্ৰহ্ম সর্বত্র সমান ব্যাপ্ত অজ্ঞেয় অনিৰ্বাচ্য হইলেও জড়জগতের ও আত্মস্বরূপী ব্ৰহ্মতত্ত্বের ভেদ ব্যক্ত করিবার জন্য আত্মার সন্নিধানে জড়প্রকৃতিতে চৈতন্যরূপী যে গুণ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় তাহাকেই আত্মার প্রধান লক্ষণ মানিয়া, অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ আত্মা ও ব্ৰহ্ম দুইকেই চিদ্‌রূপী বা চৈতন্যরূপী বলিয়া থাকে । কারণ সেরূপ না করিলে আত্মা ও ব্রহ্ম দুই-ই নির্গুণ, নিরঞ্জন ও অনির্বাচ্য হওয়ায় তাহাদের স্বরূপ বৰ্ণন একেবারেই বন্ধ করিতে হয়, কিংবা শব্দের দ্বারা কোন কিছু বর্ণনা করিতে হইলে “নেতি নেতি” । “এতস্মাদন্যৎপরমস্তি” -  ইহা নহে, ইহা (ব্ৰহ্ম) নহে, (ইহা নামরূপ), প্ৰকৃত ব্ৰহ্ম ইহার অতীত আর কিছু; এইরূপ নিয়ত “না”-“না” ধারা পাঠের ন্যায় আবৃত্তি করিতে থাকা ভিন্ন অন্য উপায় নাই [বৃ|২|৩|৬] । তাই চিৎ (জ্ঞান), সৎ (সত্তামাত্রত্ব কিংবা অস্তিত্ব) ও আনন্দ - সাধারণত, ব্ৰহ্মস্বরূপের এই লক্ষণগুলি বলা হয় । এই লক্ষণগুলি অন্য সমস্ত লক্ষণ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ইহাতে সংশয় নাই । তথাপি শব্দের দ্বারা যতদূর হইতে পারে ব্রহ্মের স্বরূপ জানাইবার জন্য এই লক্ষণগুলি কথিত হইয়াছে; প্ৰকৃত ব্ৰহ্মস্বরূপ নির্গুণ হওয়ায় তাহার জ্ঞানলাভ করিতে হইলে তাহার অপরোক্ষ অনুভূতি আবশ্যক হয়, ইহা বিস্মৃত হইলে চলিবে না । এই অনুভূতি কিরূপে আসিতে পারে, অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়াতীত অতএব অনিৰ্বাচ্য ব্ৰহ্মস্বরূপ ব্ৰহ্মনিষ্ঠ পুরুষের কিরূপে ও কখন অনুভবে আইসে, আমাদের শাস্ত্রকারেরা ইহার যে বিচার করিয়াছেন তাহা এক্ষণে সংক্ষেপে বলিব ।


22) ব্রহ্মাত্মৈক্য অর্থাৎ এই জ্ঞান যে “যাহা পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে”


ব্ৰহ্ম ও আত্মা এক – এই সমীকরণকে মারাঠীতে “যাহা পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে” এইরূপ বলা হইয়া থাকে । এই ব্ৰহ্মাত্মৈক্য অনুভূতিতে আসিলে পর জ্ঞাতা অর্থাৎ দ্রষ্টা আত্মা পৃথক এবং জ্ঞেয় অর্থাৎ দৃষ্ট বস্তু ভিন্ন, এই ভেদ থাকিতে পারে না । কিন্তু মনুষ্য যতদিন জীবিত থাকে, ততদিন তাহার নেত্ৰাদি ইন্দ্ৰিয় যদি তাহা হইতে বিচ্যুত না হয়, তবে ইন্দ্রিয় ভিন্ন ও ইন্দ্ৰিয়গোচর বিষয় ভিন্ন – এই ভেদ কি করিয়া চলিয়া যাইবে ? এবং এই ভেদ না চলিয়া গেলে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অনুভূতি কি করিয়া ঘটিবে ? এইরূপ এক সংশয় আসিতে পারে । কেবল ইন্দ্ৰিয়দৃষ্টিতেই বিচার করিলে এই সংশয় সম্পূর্ণ অসঙ্গতও মনে হয় না । কিন্তু একটু তলাইয়া বিচার করিলে এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায় যে, ইন্দ্ৰিয়গণ বাহ্য বিষয় দেখিবার কাজটা কেবল আপনা হইতেই করে এরূপ নহে । “চক্ষুঃ পশ্যতি রূপাণি মনসা ন তু চক্ষুষা” [মভা|শাং|৩১১|১৭] যে কোন বস্তু দেখিতে হইলে (এবং শুনিতে হইলে) নেত্রের (ও কান প্রভৃতির) মনের সাহায্য আবশ্যক হয়; মন শূন্য থাকিলে অন্য কোন বিষয়ে ডুবিয়া থাকিলে, বস্তু চোখের সম্মুখে থাকিলেও দেখা যায় না, ইহা পূর্বে বলা হইয়াছে । এই ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার প্রতি লক্ষ্য করিলে, ইহা সহজে অনুমান করা যায় যে, নেত্রাদি ইন্দ্রিয় ঠিক্‌ থাকিলেও মনকে যদি তাহা হইতে বাহির করিয়া আনা যায়, তাহা হইলে ইন্দ্ৰিয়বিষয়ের দ্বন্দ্ব বাহ্য জগতে থাকিলেও আমাদিগের নিকট না থাকিবার মতনই হয় । পরিণামে মন কেবল আত্মাতে অর্থাৎ আত্মস্বরূপী ব্ৰহ্মেতেই রত হওয়ায় আমাদিগের ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের সাক্ষাৎকার হয় । ধ্যানের দ্বারা, সমাধির দ্বারা, একান্ত উপাসনার দ্বারা, কিংবা অত্যন্ত ব্ৰহ্মবিচারান্তে শেষে এই মানসিক অবস্থা যে ব্যক্তি প্ৰাপ্ত হয়, দৃশ্য জগতের দ্বন্দ্ব বা ভেদ তাহার নেত্রসম্মুখে থাকিলেও না থাকিবার মতই হয়; এবং পরে স্বতই তাহার অদ্বৈত ব্ৰহ্মস্বরূপের পূর্ণ সাক্ষাৎকার হয় । পূর্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞানের শেষে এই যে নিত্য অবস্থা প্ৰাপ্ত হয়, সেই অবস্থার মধ্যে জ্ঞাতা, জ্ঞেয় ও জ্ঞান এই তিনপ্রকারের ভেদ অর্থাৎ ত্ৰিপুটী অবশিষ্ট থাকে না, কিংবা উপাস্য ও উপাসক এই দ্বৈতভাবও থাকে না । তাই, এই অবস্থার কথা অন্য কাহাকে বুঝাইতে পারা যায় না । কারণ ‘অন্য’ এই শব্দ উচ্চারণ করিবামাত্র এই অবস্থা বিঘট্টিত হয় এবং মনুষ্য অদ্বৈত হইতে দ্বৈতে আসিয়া পড়ে, ইহা স্পষ্টই প্ৰকাশ পায় । অধিক কি, এই অবস্থা আমি নিজে উপলব্ধি করিয়াছি, ইহা বলাও মুস্কিল ! কারণ, ‘আমি’ বলিলেই অন্য হইতে ভিন্ন এই ভাবনা মনে আসে এবং ব্ৰহ্মাত্মৈক্য হইবার পক্ষে উহা সম্পূর্ণ বাধক হয় । এই কারণে “যত্র হি দ্বৈতমিব ভবতি তদতির ইতরং পশ্যতি ... জিঘ্রতি ... শৃণোতি ... বিজানাতি । ... “যত্র ত্বস্য সর্বমাত্মৈবাভূৎ তৎ কেন কং পশ্যেৎ ... জিঘ্রেৎ ... শৃণুয়াৎ ... বিজানীয়াৎ । ... বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ । এতাবদরে খলু অমৃতত্ত্বমিতি ।” — দ্রষ্টা ও দ্রষ্টব্য পদার্থ এই দ্বৈত যে পর্যন্ত স্থায়ী হয় সে পর্যন্ত এক আর এককে দেখে, আঘ্রাণ করে, শ্ৰবণ করে, এবং জানে; কিন্তু সমস্ত যখন আত্মাময় হইয়া যায় (অর্থাৎ আত্ম-পর ভেদই থাকে না) তখন কে কাহাকে দেখিবে, আঘ্রাণ করিবে, শুনিবে বা জানিবে ! ওরে ! যে স্বয়ং জ্ঞাতা তাহার জ্ঞাতা আর কোথা হইতে আসিবে ? - যাজ্ঞবল্ক্য বৃহদারণ্যকে এই চরম ও পরম অবস্থার এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন [বৃ|৪|৫|১৫; ৪|৩|২৭] । 


23) ব্রহ্মানন্দ


এইরূপ সমস্তই আত্মীভূত কিংবা ব্ৰহ্মভুত হইলে পর, সে অবস্থায় ভীতি, শোক কিংবা সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্বও থাকিতে পারে না [ঈশ|৭] । কারণ, যাহার ভয় হইবে, কিংবা যাহার জন্য শোক হইবে, তাহার আপনা হইতে - আমা হইতে - ভিন্ন হওয়া চাই এবং ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অনুভূতি আসিলে পর এইপ্ৰকার ভিন্নতার কোন অবকাশ থাকে না । এই দুঃখশোকবিরহিত অবস্থাকেই ‘আনন্দময়’ এই নাম দিয়া এই আনন্দই ব্রহ্ম এইরূপ তৈত্তিরীয় উপনিষদে উক্ত হইয়াছে [তৈ|২|৮; ৩|৬] । কিন্তু এই বর্ণনাও গৌণ । কারণ, আনন্দের অনুভবকারী এখন থাকে কোথায় ? তাই, লৌকিক আনন্দ হইতে আত্মানন্দ কিছু বিশেষ প্রকারের, এইরূপ বৃহদারণ্যকে কথিত হইয়াছে [বৃ|৪|৩|৩২] । ব্ৰহ্মবৰ্ণনায় যে ‘আনন্দ’ শব্দ প্ৰযুক্ত হয় সেই শব্দের গৌণত্বের প্রতি লক্ষ্য করিয়াই অন্য স্থানে ‘আনন্দ’ শব্দকে ছাঁটিয়া ব্ৰহ্মবেত্তা পুরুষের শেষ বর্ণনা এইমাত্র করা হয় যে, “ব্ৰহ্ম ভবতি য এবং বেদ” [বৃ|৪|৪|২৫] কিংবা “ব্ৰহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” [মুং|৩|২,৯] - যে ব্ৰহ্মকে জানে সে ব্ৰহ্ম হইয়া যায় । এই অবস্থার এইরূপ দৃষ্টান্ত উপনিষদে প্রদত্ত হইয়াছে [বৃ|২|৪|১২; ছাং|৬|১৩] - লবণখণ্ড জলের মধ্যে মিশিয়া গেলে, সেই জলের মধ্যে অমুক ভাগ লবণাক্ত এবং অমুক ভাগ লবণাক্ত নহে এইরূপ ভেদ যেমন থাকে না, তেমনি ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের জ্ঞান হইলে পর সমস্ত ব্ৰহ্মময় হইয়া যায় । কিন্তু “জয়াচী বদে নিত্য বেদান্ত বাণী” - যিনি বলেন নিত্য বেদান্তের বাণী - সেই তুকারাম বাবা এই লবণাক্ত দৃষ্টান্তের বদলে -
গোড়পণে জৈসা গুড় ৷ তৈসা দেব ঝালা সকল ॥
আতাঁ ভজো কোণেপরী ৷ দেব সবাহ্য অন্তঁরী ॥
অর্থাৎ “গুড়ের মধ্যে যেরূপ মিষ্টতা, সেইরূপ সমস্তের মধ্যেই ভগবান, এখন যে রকমেই ভজনা কর - ভগবান বাহিরেও আছেন, অন্তরেও আছেন” - এইরূপ গুড়ের মিষ্টতার দৃষ্টান্ত দ্বারা নিজের অনুভূতির বর্ণনা করিয়াছেন [তু|গা|৩৬২৭] । পরব্রহ্ম ইন্দ্ৰিয়ের অগোচর ও মনেরও অগম্য হইলেও তিনি স্বানুভবগম্য এইরূপ যে বলা হয় তাহার তাৎপর্যই এই । পরব্রহ্মের যে অজ্ঞেয়তা বৰ্ণনা করা হইয়া থাকে, তাহা জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় এই দ্বৈতী অবস্থাসম্বন্ধীয়, অদ্বৈত-সাক্ষাৎকারের অবস্থাসম্বন্ধীয় নহে । 


24) আমিত্বের মৃত্যু


আমি ভিন্ন এবং জগৎ ভিন্ন এই বুদ্ধি যে পৰ্যন্ত স্থায়ী হয়, সে পর্য্যন্ত যাহাই কর না কেন ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের সম্পূর্ণ জ্ঞান হইতে পারে না । কিন্তু নদী সমুদ্র হইতে না পারিলেও সমুদ্রে পড়িয়া তাহার যেরূপ সমুদ্র-রূপ হইয়া থাকে, সেইরূপ পরব্রহ্মের মধ্যে ডুব দিলে তাহার অনুভব মনুষ্যের হইয়া থাকে; এবং তাহার পর, “সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মনি” [গী|৬|২৯] সমস্ত ভূত আপনাতে এবং আপনি সর্বভূতে - এই রূপ তাঁহার ব্ৰহ্মময় অবস্থা হইয়া পড়ে । পূর্ণ ব্ৰহ্মজ্ঞান এইরূপ কেবল স্বানুভূতিকেই অবলম্বন করিয়া আছে, এই অর্থ ব্যক্ত করিবার উদ্দেশ্যে “অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতমবিজানতাং” [কেন|২|৩] আমি পরব্রহ্মকে জানি যাহারা বলে তাহারা তাঁহাকে জানে না এবং যাহারা বলে আমি পরব্রহ্মকে জানি না তাহারাই তাঁহাকে জানে, কেনোপনিষদে এইরূপ পরব্রহ্মস্বরূপের বিরোধাভাসাত্মক অতি সুন্দর বর্ণনা করা হইয়াছে । কারণ, পরব্রহ্মকে আমি জানি এইরূপ যখন কেহ বলে, সেই সময় আমি (জ্ঞাতা) ভিন্ন, এবং আমার জানা (জ্ঞেয়) ব্ৰহ্ম ভিন্ন, এই দ্বৈতবুদ্ধি মনে উৎপন্ন হওয়া প্ৰযুক্ত তাহার ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপী অদ্বৈত অনুভব এই সময় ততটা কাঁচা কিংবা অপূর্ণই হইয়া থাকে । তাই, এইরূপ যে বলে সে প্রকৃত ব্ৰহ্মকে জানে না ইহা তাহার নিজের মুখেই সিদ্ধ হয় । উল্টাপক্ষে, ‘আমি’ ও ‘ব্ৰহ্ম’ এই দ্বৈতী ভেদ লুপ্ত হইয়া ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের যখন, পূর্ণ অনুভূতি আসে তখন “আমি তাহা (অর্থাৎ আমা হইতে ভিন্ন অন্য কিছু) জানি” এই ভাষা তাহার মুখ হইতে বাহির হইতে পারে না । তাই এই অবস্থায়, অর্থাৎ আমি ব্ৰহ্মকে জানি ইহা বলিতে যখন কোন জ্ঞানী মনুষ্য অসমর্থ হয়, তখন সে ব্ৰহ্মকে জানিয়াছে এইরূপ বলা হইয়া থাকে । দ্বৈতীভাবের এইরূপ সম্পূর্ণ লোপ হইয়া জ্ঞাতার সমস্তই ব্রহ্মেতে রঞ্জিত হওয়া, লয় পাওয়া, নিঃশেষে মিশাইয়া যাওয়া, মাখামাখি হওয়া, ‘মরিয়া’ যাওয়া সাধারণতঃ দুষ্কর বলিয়া মনে হয় । কিন্তু প্ৰথম দৃষ্টিতে এই ‘নির্বাণ’ অবস্থা দুর্ঘট মনে হইলেও, অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা শেষে মনুষ্যের সাধ্য হইতে পারে এইরূপ আমাদের শাস্ত্রকারেরা অনুভবের দ্বারা স্থির করিয়াছেন । আমিত্বের দ্বৈতভাব এই অবস্থাতে নাশ কিংবা লোপ পায় বলিয়া ইহা আত্মনাশেরই এক প্ৰকারভেদ, এইরূপ কেহ কেহ সন্দেহ করেন । কিন্তু এই অবস্থা অনুভূতিতে উপলব্ধি করিবার সময় উহার বর্ণনা করা যাইতে পারে না, তবে পরে তাহার স্মরণ হইতে পারে, ইহার প্ৰতি লক্ষ্য করিলে উক্ত সন্দেহ নির্মূল হয় * ইহা অপেক্ষাও বলবত্তর প্রমাণ সাধুসন্তদিগের অনুভূতি ।
* (ধ্যানের দ্বারা ও সমাধির দ্বারা প্ৰাপ্ত এই অদ্বৈতের কিংবা অভেদভাবের অবস্থা Nitrous Oxide gas নামক একপ্রকার রাসায়নিক বায়ু আঘ্রাণ করিলেও প্রাপ্ত হওয়া যায় । এই বায়ুকে ‘লাফিং গ্যাস’ (laughing gas) বলে । (Will to Believe and Other Essays on Popular Philosophy by William James, pp. 294. 298.) কিন্তু এই অবস্থা কৃত্রিম । সমাধির দ্বারা প্রাপ্ত অবস্থা সত্য ও স্বাভাবিক । এই দুইয়ের মধ্যে ইহাই গুরুতর প্রভেদ । তথাপি এই কৃত্ৰিম অবস্থার প্রমাণ হইতে অভেদাবস্থার অস্তিত্বসম্বন্ধে কোন বিরোধ থাকে না, তাই এইখানে উহার উল্লেখ করিয়াছি ।)


25) তুরীয়াবস্থা অথবা নির্বিকল্প সমাধি


পূর্বেকার সিদ্ধপুরুষদের অনুভূতির বর্ণনা রাখিয়া দেও; কিন্তু নিতান্ত আধুনিক ভগবদভক্ত শিরোমণি তুকারাম বাবাও -“আদুলে” মরণ পাহিলেঁ ম্যাঁ ঢোলাঁ । তো জালা সোহলা অনুপম ।” অর্থাৎ নিজের মরণ নিজের চোখে দেখেছি, সে এক অনুপম উৎসব, এইরূপ আলঙ্কারিক ভাষায় এই পরম অবস্থার বেশ চমৎকার বর্ণনা করিয়াছেন [গা|৩৫৮৯] । ব্যক্ত কিংবা অব্যক্ত সগুণ ব্ৰহ্মের উপাসনা হইতে ধ্যানের দ্বারা ক্ৰমশঃ উর্ধে উঠিতে উঠিতে উপাসক শেষে “অহং ব্ৰহ্মাস্মি” [বৃ|১|৪|১০] -আমিই ব্ৰহ্ম এইরূপ অবস্থায় আসিয়া পৌঁছায়; তাহার এই ব্ৰহ্মাত্মৈক্য অবস্থার সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে । তাহার পর তাঁহার মধ্যে সে এরূপ নিমজ্জিত হয় যে, আমি কি অবস্থাতে আছি, অথবা কাহার অনুভব করিতেছি, সেদিকে তাহার লক্ষ্যই যায় না । এই অবস্থায় জাগরণ বজায় থাকায় এই অবস্থাকে স্বপ্ন কিংবা সুষুপ্তি অর্থাৎ নিদ্ৰা বলিতে পারা যায় না; যদি জাগৃতি বল, তবে জাগ্ৰত অবস্থাতে সাধারণত যে সমস্ত ব্যবহার উৎপন্ন হয় সে সমস্ত বন্ধ থাকে । তাই স্বপ্ন, সুষুপ্তি, (নিদ্ৰা) কিংবা জাগরণ, এই তিন ব্যবহারিক অবস্থা হইতে ভিন্ন ইহা এক চতুৰ্থ কিংবা তুরীয় অবস্থা এইরূপ শাস্ত্ৰে উক্ত হইয়াছে; এবং এই অবস্থা প্রাপ্ত হইতে হইলে, নির্বিকল্প অর্থাৎ যাহাতে দ্বৈতের কিঞ্চিন্মাত্রও স্পর্শ নাই, এইরূপ সমাধিযোগে প্ৰবৃত্ত করাই পাতঞ্জল যোগদৃষ্টিতে মুখ্য সাধন । এবং এই কারণেই গীতাতে এই নির্বিকল্প সমাধিযোগ অভ্যাসের দ্বারা আয়ত্ত করিতে মনুষ্য যেন অবহেলা না করে, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|৬|২০-২৩] । এই ব্ৰহ্মাত্ম্যৈক্য অবস্থাই জ্ঞানের পূর্ণ অবস্থা । কারণ, সমস্ত জগৎ ব্ৰহ্মরূপ অর্থাৎ একই হইয়া গেলে “অবিভক্তং বিভক্তেষু” - অনেকের একত্ব করা চাই গীতার জ্ঞানক্রিয়ার এই লক্ষণের পূর্ণতা হয়, এবং ইহার পর কাহারও অধিক জ্ঞান হইতে পারে না । 


26) অমৃতত্ত্ব-সীমা এবং মরণের মরণ


সেইরূপ আবার, নামরূপের অতীত এই অমৃতত্বের অনুভব আসিলে পর, জন্মমরণের আবৃত্তিও মানুষের আপনা-আপনিই চুকিয়া যায় । কারণ, জন্মমরণ তো নামরূপেতেই আছে এবং ইহা তাহার অতীত [গী|৮|২১]তুকারাম এইজন্য এই অবস্থাকে ‘মরণের মরণ’ এই নাম দিয়াছেন [গা|৩৫৮৯]; এবং যাজ্ঞবল্ক্য এই অবস্থাকে অমৃতত্বের সীমা বা পরাকাষ্ঠা বলিয়াছেন । ইহাই জীবন্মুক্তাবস্থা । এই অবস্থায় আকাশগমনাদি কতকগুলি অপূর্ব ও অলৌকিক সিদ্ধিলাভ হয় এইরূপ পাতঞ্জল যোগসূত্রে এবং অন্যত্রও বর্ণিত আছে [পাতঞ্জল সূ|৩|১৬-৫৫]; এবং এইজন্য কাহারও যোগাভ্যাসের সখ হইয়া থাকে । কিন্তু যোগবাসিষ্ঠকারের উক্তি অনুসারে আকাশগমনাদি সিদ্ধি ব্ৰহ্মনিষ্ঠ অবস্থার সাধ্য বা অংশ নহে; জীবন্মুক্ত পুরুষ এই সিদ্ধিলাভ করিবার উদ্যোগ করেন না এবং অনেক সময় তাহার এই সিদ্ধি দেখাও যায় না [যো|৫|৮৯] । তাই, শুধু যোগবাসিষ্ঠে নহে, গীতাতেও এই সিদ্ধির কোন উল্লেখ নাই । ইহা চমৎকার মায়ার খেলা, ব্ৰহ্মবিদ্যা নহে, এইরূপ বসিষ্ঠ রামকে স্পষ্ট বলিয়াছেন । উহা কদাচিৎ সত্য হয়, সত্য হইবে না এইরূপ আমি বলি না । যাহা হউক উহা ব্রহ্মবিদ্যার বিষয় নহে এইটুকু নির্বিবাদ । তাই এই সিদ্ধি লাভ হউক বা না হউক, তাহার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া কিংবা তাহার ইচ্ছা বা আশাও না করিয়া সর্বভূতের মধ্যে এক আত্মা উপলব্ধি করা, ব্ৰহ্মনিষ্ঠের এই পরম অবস্থা আমাদের যে প্রকারে লাভ হইতে পারে তৎপক্ষেই মনুষ্যের চেষ্টা ও প্ৰযত্ন করা চাই, অলৌকিক সিদ্ধি লাভের আকাঙ্ক্ষা করিবে না, ইহাই ব্ৰহ্মবিদ্যাশাস্ত্রের উক্তি । ব্ৰহ্মজ্ঞানই আত্মার শুদ্ধাবস্থা, জাদু অথবা ধোঁকা লাগাইবার কেরামতী ব্যাপার নহে । এই কারণে উক্ত চমৎকার শক্তির দ্বারা ব্ৰহ্মজ্ঞানের মাহাত্ম্যের বৃদ্ধি তো হয়ই না, ব্ৰহ্মবিদ্যার মাহাত্ম্য সম্বন্ধে উক্ত আশ্চর্য শক্তি প্ৰমাণও হইতে পারে না । পক্ষীর ন্যায় এক্ষণে মানুষও বিমানে করিয়া আকাশে উড়িয়া থাকে; কিন্তু তাই বলিয়া সেই মানুষকে কেহ ব্ৰহ্মবেত্তার মধ্যে গণনা করে না । এমন কি, আকাশগমনাদি সিদ্ধিপ্ৰাপ্ত কোন ব্যক্তি মালতীমাধব নাটকের অঘোরঘণ্টের ন্যায় ক্রূর ঘাতক পর্যন্ত হইতে পারে ।


27) দ্বৈতবাদের উৎপত্তি গীতা ও উপনিষদ উভয় অদ্বৈত বেদান্তেরই প্রতিপাদন করে


ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ আনন্দময় অবস্থার অনিৰ্বাচ্য অনুভূতি অন্যকে পূর্ণরূপে বলা যাইতে পারে না । কারণ, তাহা অন্যকে বলিতে গেলে ‘আমি-তুমি’ এই দ্বৈতাত্মক ভাষা প্রয়োগ করা আবশ্যক হয়; এবং এই দ্বৈতী ভাষায় অদ্বৈতের সমস্ত অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় না । তাই এই চরম অবস্থার উপনিষদে যে বর্ণনা আছে তাহাও অপূর্ণ ও গৌণ বলিয়া বুঝিতে হইবে । এবং এই বর্ণনা যখন গৌণ, তখন জগতের উৎপত্তি, রচনা প্ৰভৃতি বুঝাইবার জন্য উপনিষদের অনেক স্থানে যে শুদ্ধ দ্বৈতী বৰ্ণনা পাওয়া যায়, তাহাও গৌণ বলিয়াই মানিতে হইবে । উদাহরণ যথা, - আত্মস্বরূপী, শুদ্ধ, নিত্য, সর্বব্যাপী ও অবিকারী ব্ৰহ্ম হইতেই পরে হিরণ্যগৰ্ভ নামক সগুণ পুরুষ অথবা অপ (জল) প্রভৃতি জগতের ব্যক্ত পদার্থ ক্ৰমে ক্রমে সৃষ্ট হয়, কিংবা এই নামরূপ সৃষ্টি করিয়া পরে জীবরূপে পরমেশ্বর তাহাতে প্ৰবেশ করেন [তৈ|২|৬; ছাং|৬|২|৩; বৃ|১|৪|৭], এইরূপ দৃশ্য জগতের উৎপত্ত্বির যে বর্ণনা উপনিষদে করা হইয়াছে তাহা অদ্বৈত দৃষ্টিতে যথার্থ হইতে পারে না । কারণ, জ্ঞানগম্য নির্গুণ পরমেশ্বরই যদি চতুর্দিকে ব্যাপ্ত হইয়া আছেন, তবে এক অপর এককে উৎপন্ন করিয়াছে এই কথাও তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে নির্মূল হইয়া পড়ে । কিন্তু সাধারণ লোককে জগৎ-রচনা বুঝাইয়া দিবার জন্য ব্যবহারিক অর্থাৎ দ্বৈতের ভাষাই একমাত্ৰ সাধন হওয়ায়, ব্যক্ত জগতের অর্থাৎ নামরূপের উৎপত্তির উপরি-উক্ত বর্ণনা উপনিষদে পাওয়া যায় । তথাপি তাহাতেও অদ্বৈতের যোগসূত্রটি বজায় আছে এবং এই প্ৰকার দ্বৈতের ব্যবহারিক ভাষা ব্যবহৃত হইলেও মূলে অদ্বৈতই সত্য, এইরূপ অনেক স্থানে কথিত হইয়াছে । সূর্য ভ্ৰমণ করে না এইরূপ এক্ষণে নিশ্চিত জ্ঞান হইলেও, সূৰ্য উদয় হইল কিংবা অস্ত হইল এই ভাষা যেমন আমরা ব্যবহার করি সেইরূপ একই আত্মস্বরূপী পরব্ৰহ্ম চারিদিকে অখণ্ড রূপে ব্যাপ্ত রহিয়াছেন, তিনি নির্বিকার এইরূপ নিশ্চয়াত্মক নির্ধারণ হইলেও “পরব্রহ্ম হইতে ব্যক্ত জগৎ সৃষ্টি হইয়াছে” এইরূপ ভাষা উপনিষদে প্ৰয়োগ হইয়া থাকে; এবং গীতাতেও সেইরূপ “আমার প্রকৃত স্বরূপ অব্যয় ও অজ” [গী|৭|২৫] উক্ত হইলেও “আমি সমস্ত জগৎ উৎপন্ন করিয়া থাকি” [গী|৪|৯] ইহা ভগবান বলিয়াছেন । কিন্তু এই বর্ণনার মর্মের প্ৰতি লক্ষ্য না করিয়া উহা শব্দশঃ সত্য এবং উহাই মুখ্য এইরূপ কল্পনা করিয়া কোন কোন পণ্ডিত, দ্বৈত কিংবা বিশিষ্টাদ্বৈত মত উপনিষদের প্রতিপাদ্য, এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন । তাঁহারা বলেন যে, সর্বত্র একই নির্গুণ ব্ৰহ্ম ব্যাপ্ত হইয়া আছেন এইরূপ মানিলে, এই নিৰ্বিকার ব্ৰহ্ম হইতে সবিকার বিনশ্বর সগুণ পদার্থ কিরূপে সৃষ্ট হইল ইহার উপপত্তি পাওয়া যায় না । কারণ, নাম-রূপাত্মক জগৎকে ‘মায়া’ বলিলে নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সগুণ মায়া উৎপন্ন হওয়া তৰ্কদৃষ্টিতে সম্ভব না হওয়ায় অদ্বৈতবাদ খঞ্জ হইয়া পড়ে । ইহা অপেক্ষা সাংখ্যশাস্ত্রের উক্তি অনুসারে প্রকৃতির ন্যায় নামরূপাত্মক ব্যক্ত জগতের কোন সগুণ অথচ ব্যক্ত রূপকে নিত্য মনে করিয়া লৌহ যন্ত্রের মধ্যে বাষ্পের ন্যায় তাহার অন্তরে পরব্রহ্মরূপ অন্য কোন নিত্য তত্ত্ব খেলিতেছে, [বৃ|৩|৭], এবং এই দুয়ের মধ্যে দাড়িম ফলের মধ্যে তাহার দানার ন্যায় ঐক্য আছে এইরূপ মনে করা অধিক প্রশস্ত । কিন্তু আমার মতে, উপনিষদের তাৎপর্য এইরূপ নির্ধারণ করা ঠিক নহে । উপনিষদে কখন দ্বৈতী ও কখন শুদ্ধ অদ্বৈতী বৰ্ণনা থাকায় এই দুয়ের কোন প্রকার সমন্বয় করিতে হইবে ইহা সত্য । কিন্তু অদ্বৈতবাদকে মুখ্য মানিয়া, নিগুৰ্ণ ব্ৰহ্ম সগুণ হওয়া পৰ্যন্ত মায়িক দ্বৈতের অবস্থা প্ৰাপ্ত হয়, এইরূপ মনে করিলে সমস্ত বৰ্ণনার যেরূপ সমন্বয় হয়, দ্বৈতপক্ষকে প্ৰধান করিয়া মানিলে সেরূপ সমন্বয় হয় না । উদাহরণ যথা - তৎ ত্বমসি” এই বাক্যান্তর্গত পদের অন্বয় দ্বৈত মত অনুসারে কখনই ঠিক লাগে না । দ্বৈতীদিগের মনে ইহা একটা খটকা বলিয়া মনে হয় না এরূপ নহে । কিন্তু তত্ত্বম্‌ = তস্য ত্বম্‌ - অর্থাৎ তোমা হইতে ভিন্ন এরূপ যে কোন ব্যক্তি তাহার তুমি, সে তুমি নও - এইরূপে কোন রকমে এই মহাবাক্যের অর্থ করিয়া দ্বৈতী নিজের মনকে প্ৰবোধ দিয়া থাকেন । কিন্তু যাঁহার সংস্কৃত জ্ঞান কিছুমাত্ৰ আছে, যাঁহার বুদ্ধি আগ্রহের দ্বারা বিদ্ধ হয় নাই তিনিই এই ‘টানাবুনা’ অর্থ সত্য নহে বলিয়া বুঝিতে পারিবেন । কৈবল্যোপনিষদে আবার “স ত্বমেব ত্বমব তৎ” [কৈ|১|১৬] এইরূপ “তৎ”“ত্বম্‌” শব্দদুইটীকে উল্টাপাল্টা করিয়া উক্ত মহাবাক্যের অদ্বৈতপর সিদ্ধান্তই দেখান হইয়াছে । অধিক কি বলিব ? সমস্ত উপনিষদের অধিকাংশ কাটিয়া না ফেলিলে কিংবা জানিয়া বুঝিয়া তাহার প্রতি দুৰ্লক্ষ্য না করিলে উপনিষদশাস্ত্রের অদ্বৈত ব্যতীত অন্য কোন রহস্য আছে, এরূপ দেখান যাইতে পারে না । কিন্তু এই বাদপ্রতিবাদ কখনই শেষ হইবে না মনে করিয়া সেই সম্বন্ধে আমি অধিক আলোচনা করিতে চাহি না । যাঁহার অদ্বৈত ব্যতীত অন্য মত ভাল লাগে তিনি তাহা স্বীকার করিতে পারেন । যে মহাত্মারা উপনিষদে “নেহ নানাস্তি কিঞ্চন” [বৃ|৪|৪|১৯; কঠ|৪|১১] - এই জগতে নানাত্ব কিছুই নাই - যাহা কিছু আছে মূলে সমস্ত “একমেবাদ্বিতীয়ং” [ছাং|৬|২|২], এইরূপ আপন প্ৰতীতি স্পষ্ট বলিয়া পরে “মৃত্যোঃ স মৃত্যুমাপ্নোতি য ইহ নানেব পশ্যতি” — এ জগতে যে নানাত্ব দেখে সে জন্মমরণের ফেরে পড়িয়া যায় - এইরূপ বর্ণনা করিয়াছেন, সেই মহাত্মাদের লক্ষ্য অদ্বৈত ব্যতীত অন্য কোনরূপ হইতে পারে এরূপ আমার মনে হয় না । কিন্তু অনেক বৈদিক শাখার অনেক উপনিষদ থাকা প্ৰযুক্ত সমস্ত উপনিষদের তাৎপর্য একই কি না এই সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কদাচিৎ যেরূপ অবকাশ পাওয়া যায়, গীতা-সম্বন্ধে সেরূপ নহে । গীতা একই গ্রন্থ হওয়ায়, একই প্রকারের বেদান্ত তাহার প্রতিপাদ্য ইহা স্পষ্ট রহিয়াছে; এবং সেই বেদান্ত কি, ইহার নির্ণয় করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে “সমস্ত ভূতের নাশ হইলেও যে একই বজায় থাকে” [গী|৮|২০] তাহাই প্ৰকৃত সত্য হওয়ায়, পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ড মিলিয়া সর্বত্র তাহাই ওতপ্রোত হইয়া আছে [গী|১৩|৩১], এইরূপ অদ্বৈতমূলক সিদ্ধান্ত না করিলে চলে না । অধিক কি, আত্মৌপম্যবুদ্ধির যে নীতিতত্ত্ব গীতাতে বলা হইয়াছে, তাহার পুরাপুরি উপপত্তিও অদ্বৈত ব্যতীত অন্য প্রকারের বেদান্ত-দৃষ্টিতে উপযোগী হয় না । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের সময়ে কিংবা তদুত্তরকালে অদ্বৈতমতপ্রতিপাদক যে সকল যুক্তি অথবা প্রমাণ বাহির হইয়াছে তাহার সমস্তই গীতাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে এরূপ বলা আমার উদ্দেশ্য নহে । দ্বৈত, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত প্ৰভৃতি সম্প্রদায় বাহির হইবার পূর্বেই গীতা হইয়াছে; এবং সেইজন্য তাহাতে কোন বিশিষ্ট সাম্প্রদায়িক যুক্তির সমাবেশ হইতে পারে না, ইহা আমিও স্বীকার করি । কিন্তু সেইজন্য গীতাতে যে বেদান্ত আছে তাহা সাধারণত শঙ্করসম্প্রদায়ের জ্ঞানা্নুরূপ অদ্বৈতী, দ্বৈতী নহে, ইহা বলিতে কোন বাধা নাই । তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে গীতা ও শাঙ্করসম্প্রদায় মধ্যে এই প্রকার সাধারণ মিল থাকিলেও আচার দৃষ্টিতে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা গীতা কর্মযোগকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ায়, গীতাধর্ম শাঙ্করসম্প্রদায় হইতে ভিন্ন হইয়াছে এইরূপ আমার মত । কিন্তু তাহার বিচার পরে করা যাইবে । এখনকার বিষয় তত্ত্বজ্ঞানসম্বন্ধীয়; তাই এই তত্ত্বজ্ঞান গীতা ও শাঙ্করসম্প্রদায়ের মধ্যে একই প্ৰকার অর্থাৎ অদ্বৈতী ইহাই এখানে বক্তব্য । অন্য সাম্প্রদায়িক ভাষ্য অপেক্ষা গীতার শাঙ্করভাষ্যের গৌরব যে বেশী হইয়াছে তাহার কারণও এই ।


28) নির্গুণে সগুণ মায়ার উৎপত্তি কিরূপে হয়


সমস্ত নামরূপ জ্ঞানদৃষ্টিতে একপাশে সরাইয়া রাখিবার পর, একই নিৰ্বিকার ও নির্গুণ তত্ত্ব থাকিয়া যায়; সেই জন্য পূর্ণ ও সূক্ষ্ম বিচারান্তে অদ্বৈতসিদ্ধান্তই স্বীকার করিতে হয় । ইহা সিদ্ধান্ত হইলে পর এই এক নির্গুণ ও অব্যক্ত দ্রব্য হইতে নানাবিধ ব্যক্ত সগুণ সৃষ্টি কি করিয়া হইল, অদ্বৈত বেদান্তদৃষ্টিতে তাহার বিচার করা আবশ্যক । নিগুৰ্ণ পুরুষেরই সহিত ত্ৰিগুণাত্মক অর্থাৎ সগুণ প্ৰকৃতিকে অনাদি ও স্বতন্ত্র মানিয়া সাংখ্যেরা এই প্রশ্ন ছাড়িয়া দিয়াছে, ইহা পূর্বেই বলিয়াছি । কিন্তু সগুণ প্ৰকৃতিকে এইরূপ স্বতন্ত্র বলিয়া মানিলে জগতের মূলতত্ত্ব দুই হয়; এবং এইরূপ করিলে অনেক কারণে পূর্ণরূপে নির্ধারিত অদ্বৈতমতে বাধা আসে । সগুণ প্ৰকৃতিকে স্বতন্ত্র বলিয়া না মানিলে একই মূল নির্গুণ দ্রব্য হইতে নানাবিধ সগুণ সৃষ্টি কিরূপে উৎপন্ন হইল তাহা বলিতে পারা যায় না । কারণ, নির্গুণ হইতে সগুণ - অর্থাৎ যাহা কিছু নাই তাহা হইতে অন্য কিছু - উৎপন্ন হইতে পারে না, সৎকার্যবাদের এই সিদ্ধান্ত অদ্বৈতীদিগেরও মান্য হইয়াছে । এইজন্য, দুইদিক্‌ হইতেই বাধা । এখন এই জটিল প্যাঁচ ঘুচিবে কি করিয়া ? অদ্বৈতকে না ছাড়িয়াই নিগুৰ্ণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হইবার মার্গটি কি তাহা বলিতে হইবে; এবং সৎকার্যবাদের দৃষ্টিতে উহা বন্ধ হইবার মতো দেখায়। পেঁচটা খুবই বড় সত্য । অধিক কি, কাহারও কাহারও মতে, অদ্বৈত সিদ্ধান্ত স্বীকার করিবার পক্ষে ইহাই মুখ্য বাধা এবং এই জন্যই তাহারা দ্বৈতকে অঙ্গীকার করিয়া থাকে । কিন্তু অদ্বৈতী পণ্ডিতেরা নিজ বুদ্ধির দ্বারা এই বিকট বাধা হইতে মুক্ত হইবারও এক সযুক্তিক ও অক্ষুণ্ণ মাৰ্গ বাহির করিয়াছেন । তাঁহারা এইরূপ বলেন যে, কার্য ও কারণ এই দুই-ই যখন একই গণ্ডীর মধ্যে কিংবা একই বর্গের মধ্যে থাকে তখনই সৎকার্যবাদের কিংবা গুণপরিণামবাদের সিদ্ধান্তের উপযোগ হয় । এবং সেই জন্য সত্য ও নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সত্য ও সগুণ মায়া উৎপন্ন হইতে পারে না ইহা অদ্বৈত বেদান্তও স্বীকার করিবে । কিন্তু এই স্বীকৃতি তখনকারই যখন দুই পদার্থই সত্য । যেখানে এক পদার্থ সত্য এবং অন্যটি শুধু তাহার অনুরূপ, সেখানে সৎকার্যবাদ প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । পুরুষের ন্যায় প্ৰকৃতিকেও সাংখ্য স্বতন্ত্ৰ ও সত্য পদাৰ্থ বলিয়া মানে । তাই উহা নির্গুণ পুরুষ হইতে সগুণ প্ৰকৃতির উৎপত্তির উপপত্তি সৎকার্যবাদ অনুসারে করিতে পারে না । কিন্তু অদ্বৈতবাদের এই সিদ্ধান্ত যে, মায়া অনাদি হইলেও তাহা সত্য ও স্বতন্ত্র নহে, গীতার উক্তি অনুসারে তাহা, ‘মোহ’, ‘অজ্ঞান’ কিংবা ‘ইন্দ্ৰিয়ের নিকট প্ৰতীয়মান বিষয়’; তাই সৎকার্যবাদ হইতে নিষ্পন্ন আপত্তি অদ্বৈত সিদ্ধান্তে প্ৰযুক্ত হইতে পারে না । পিতা হইতে পুত্র হইলে পিতার গুণ-পরিণামে হইয়াছে বলিব; কিন্তু পিতা একই ব্যক্তি হইয়া তিনি যখন কখনও বালকের, কখনও যুবকের এবং কখনও বৃদ্ধের রূপ গ্ৰহণ করেন দেখা যায়, তখন - এই ব্যক্তিতে এবং ইহার অনেক রূপের মধ্যে গুণ পরিণামরূপী কার্য-কারণভাব থাকে না, এইরূপ আমরা সর্বদা দেখিতে পাই । সেইরূপ আবার সূর্য একই, ইহা নিশ্চিত হইলে পর, জলেতে চক্ষুগোচর তাহার প্রতিবিম্ব একটা ভ্ৰম, গুণ-পরিণাম প্ৰযুক্ত উৎপন্ন অন্য সূর্য নহে, এইরূপ আমরা বলি । সেইরূপ দুর্বীণে কোন গ্রহের প্রকৃত স্বরূপ নিশ্চিত করিলে পর, সেই গ্রহের কেবল চক্ষুদৃষ্ট স্বরূপ চক্ষের দুর্বলতা প্ৰযুক্ত ও অতি দীর্ঘ অন্তর প্রযুক্ত উৎপন্ন শুধু প্ৰতীয়মান আবির্ভাব মাত্ৰ, এইরূপ জ্যোতিঃশাস্ত্ৰ স্পষ্ট বলে ।

ইহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় যে, কোন বিষয় ইন্দ্ৰিয়ের প্রত্যক্ষগোচর হইলেই তাহাকে স্বতন্ত্র ও সত্য বস্তু বলিয়া মানিতে পারা যায় না । আবার ঐ ন্যায়ই অধ্যাত্মশাস্ত্ৰেও প্রয়োগ করিয়া জ্ঞানচক্ষুরূপ দুর্বীণের দ্বারা নির্ধারিত নির্গুণ পরব্ৰহ্মই সত্য, এবং জ্ঞানশূন্য চর্মচক্ষুর গোচর নামরূপ এই পরব্রহ্মের কার্য নহে, উহা ইন্দ্ৰিয়ের দুর্বলতা হইতে উৎপন্ন শুধু একটা ভ্রম অর্থাৎ মোহাত্মক প্ৰতীয়মান রূপ মাত্র, এইরূপ বলিতে বাধা কি ? নির্গুণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হইতে পারে না, এই আপত্তিও এখানে থাকে না । কারণ, দুই বস্তু একই গণ্ডীভুক্ত নহে; একটী সত্য, অপরটা শুধু প্ৰতীয়মান রূপ মাত্ৰ; এবং মূলে একই বস্তু থাকিলেও দ্রষ্টা পুরুষের দৃষ্টিভেদে, অজ্ঞানে, দৃষ্টিবিভ্রমে সেই একই বস্তুর প্রতীয়মান” রূপ পরিবর্তিত হয় এইরূপ আমাদের অনুভব আছে । উদাহরণ যথা - কানে শোনা শব্দ আর চোখে দেখা রঙ, এই দুই গুণ ধরন । তন্মধ্যে কানে আমরা যে শব্দ বা আওয়াজ শুনিতে পাই তাহার সূক্ষ্ম পরীক্ষা করিয়া ‘শব্দ’ বায়ুর তরঙ্গ কিংবা গতি এইরূপ আধিভৌতিক শাস্ত্ৰ পূর্ণরূপে সিদ্ধ করিয়াছেন । সেইরূপ আবার চোখে দেখা লাল, হলদে, নীল প্রভৃতি রংও মূলে একই সূর্যালোকের বিকার, এবং সূর্যালোকও একপ্রকার গতি এইরূপ এক্ষণে সূক্ষ্ম অনুসন্ধানের দ্বারা নির্ধারিত হইয়াছে । ‘গতি’ মূলে একই হওয়ায় কান যদি তাহাকে শব্দ ও চোখ যদি তাহাকে রং বলে । তবে এই ন্যায়ই অধিকতর ব্যাপকরূপে সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ের প্রতি প্রয়োগ করিলে, সমস্ত নামরূপের উৎপত্তি সম্বন্ধে সৎকার্যবাদের সহায়তা ব্যতীতই ঠিক ঠিক উপপত্তি এই প্ৰকার দেওয়া যাইতে পারে যে, মনুষ্যের বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয় আপনা আপন দিক হইতে এক নির্বিকার বস্তুর উপরেই শব্দরূপাদি অনেক নামরূপাত্মক গুণসমূহের ‘অধ্যারোপ’ করিয়া নানাপ্রকার প্রতীয়মান রূপ উৎপন্ন করিয়া থাকে, কিন্তু মূলের একই বস্তুতে এই প্রতীয়মান রূপ, গুণ কিংবা এই নামরূপ থাকিবেই এমন কোন কথা নাই । এবং এই অর্থই সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে রজ্জুতে সৰ্পভ্ৰম, শুক্তিতে রজতভ্রম, অথবা চোখে আঙ্গুল দিলে এক বস্তুকে দুইটী দেখা, অথবা অনেক রংয়ের চসমা পরিলে এক পদার্থকে বিভিন্ন রংয়ের দেখা ইত্যাদি অনেক দৃষ্টান্ত বেদান্তশাস্ত্ৰে পাওয়া যায় । মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমূহ মনুষ্যকে কখনই ছাড়িয়া যায় না বলিয়া জগতের নামরূপ কিংবা গুণ তাহার নজরে অবশ্যই পড়িবে । কিন্তু ইন্দ্ৰিয়বান মনুষ্যের দৃষ্টিতে জগতের এই যে আপেক্ষিক স্বরূপ দেখা যায়, তাহাই এই জগতের মূলগত অর্থাৎ নিরপেক্ষ ও নিত্য স্বরূপ, এরূপ বলিতে পারা যায় না । মনুষ্যের বর্তমান ইন্দ্ৰিয় অপেক্ষা যদি সে ন্যূনাধিক ইন্দ্ৰিয় প্ৰাপ্ত হয়, তাহা হইলে এই জগৎ তাহার চোখে এখন যেরূপ দেখায় তখন সেরূপ দেখা যাইবে না । এবং ইহা যদি সত্য হয়, তবে দ্রষ্টা মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের অপেক্ষা না রাখিয়া জগতের মূলে যে তত্ত্ব আছে তাহার নিত্য ও প্ৰকৃত স্বরূপ কি তাহা বল, এইরূপ কেহ জিজ্ঞাসা করিলে, ঐ মূলতত্ত্ব নির্গুণ বটে, কিন্তু মনুষ্যের নিকট উহা সগুণ দেখায়; ইহা মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের ধর্ম, মূল বস্তুর গুণ নহে, এইরূপ উত্তর দিতে হয় । আধিভৌতিক শাস্ত্ৰে কেবল ইন্দ্ৰিয়-গোচর বিষয়েরই বিচার হয় বলিয়া এইপ্ৰকার প্রশ্ন কখনই উত্থিত হয় না । কিন্তু মনুষ্য ও তাহার ইন্দ্ৰিয় নষ্ট প্রায় হইলে, পরমেশ্বরও লোপ প্ৰাপ্ত হন, কিংবা মনুষ্যের নিকট তিনি অমুক প্রকার দৃষ্ট হন বলিয়া তাঁহার ত্রিকালঅবাধিত নিত্য ও নিরপেক্ষ স্বরূপও তাহাই হইবে, এরূপ বলা যাইতে পারে না । তাই, জগতের মূলে অবস্থিত সত্যের মূলস্বরূপ কি, যে অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে ইহার বিচার করিতে হয় তাহাতে মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ের আপেক্ষিক দৃষ্টি ছাড়িয়া দিয়া কেবল জ্ঞানদৃষ্টিতে অর্থাৎ যতদূর সম্ভব বুদ্ধির দ্বারাই শেষ বিচার করা আবশ্যক হয় । এইরূপ করিলে ইন্দ্ৰিয়গোচর সমস্ত গুণই স্বতই চলিয়া যায় এবং ইহা সিদ্ধ হয় যে, ব্ৰহ্মের নিত্য স্বরূপ ইন্দ্ৰিয়াতীত অর্থাৎ নির্গুণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ । কিন্তু যে নির্গুণ, তাহার বর্ণনা কে-ই বা করিবে, আর কি প্রকারে করিবে ? এইজন্য পরব্রহ্মের চরম অর্থাৎ নিরপেক্ষ ও নিত্য স্বরূপ কেবল নির্গুণ নহে, তাহ অনির্বাচ্যও বটে; এবং এই নির্গুণ স্বরূপে মনুষ্য স্বকীয় ইন্দ্ৰিয়যোগে সগুণ রূপ দেখিতে পায়, অদ্বৈতবেদান্তে এইরূপ সিদ্ধান্ত করা হইয়াছে । কিন্তু নির্গুণকে সগুণ করিবার এই শক্তি ইন্দ্ৰিয়ের আসিল কোথা হইতে, এইখানে আবার এই প্রশ্ন উত্থিত হয় । অদ্বৈত বেদান্তশাস্ত্ৰ ইহার উত্তরে এইরূপ বলেন যে, মানবজ্ঞানের গতি এখানে বাধিত হয়, এইজন্য ইহা ইন্দ্রিয়সমূহের অজ্ঞান এবং নিগুৰ্ণ পরব্রহ্মে সগুণ জগতের রূপ দেখা সেই অজ্ঞানের পরিণাম; কিংবা ইন্দ্রিয়াদিও পরমেশ্বরের জগতেরই অন্তৰ্ভুক্ত হওয়ায় এই সগুণ স্বষ্টি (প্রকৃতি) নির্গুণ পরমেশ্বরেরই এক ‘দৈবী মায়া’ [গী|৭|১৪] এখানে এইটুকু নিশ্চিত অনুমান করিয়া নিশ্চিন্ত হইতে হয় । অপ্ৰবুদ্ধ অর্থাৎ কেবল ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা প্ৰত্যক্ষকারী লোকের নিকট পরমেশ্বর ব্যক্ত ও সগুণ দৃষ্ট হইলেও পরমেশ্বরের প্রকৃত ও শ্ৰেষ্ঠ স্বরূপ নির্গুণ, তাহা জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখাতেই জ্ঞানের চরম সীমা, ইত্যাদি গীতাতে যে বৰ্ণনা আছে [গী|৭|১৪,২৪,২৫], তাহার তত্ত্ব পাঠকের এক্ষণে উপলব্ধি হইবে । পরমেশ্বর মূলে নির্গুণ, তাহার মধ্যেই মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয় সগুণ জগতের বিবিধ প্রতীয়মান রূপ দেখিতে পায়, এইরূপ নিৰ্ণয় করিলেও উক্ত সিদ্ধান্তের মধ্যে ‘নির্গুণ’ শব্দের অর্থ কি বুঝাইবার জন্য এই বিষয়ে আরও কিছু ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । আমাদের ইন্দ্ৰিয় যখন বায়ু তরঙ্গের উপর শব্দরূপাদি গুণের কিংবা শুক্তির উপর রজতের অধ্যারোপ করে তখন বায়ুতরঙ্গের মধ্যে শব্দরূপাদির কিংবা শুক্তির মধ্যে রজতের গুণ থাকে না ইহা সত্য; কিন্তু অধ্যারোপিত গুণ তাহাতে না থাকিলেও উহা হইতে ভিন্ন গুণ মূল পদার্থের মধ্যে থাকিবেই না এরূপ বলিতে পারা যায় না; কারণ, শুক্তির মধ্যে রজতের গুণ না থাকিলেও রজতের গুণের অতিরিক্ত অন্য গুণ উহাতে থাকে । ইহা আমরা প্ৰত্যক্ষ দেখিতে পাই । ইহা হইতে আপন অজ্ঞানে মূল ব্ৰহ্মের উপর ইন্দ্ৰিয়াদির অধ্যারোপিত গুণ এই ব্রহ্মের মধ্যে নাই বলিলেও অন্য গুণ পরব্রহ্মের মধ্যে কি নাই, এবং যদি থাকে তবে তিনি নির্গুণ হন কিরূপে, এইরূপ আর এক সংশয় এই স্থানে আসে । কিন্তু আর একটু সূক্ষ্ম বিচার করিলে বুঝা যাইবে যে, ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারা অধ্যারোপিত গুণ ব্যতীত মূল ব্রহ্মের মধ্যে অন্য গুণ থাকিলেও তাহা, আমরা জানিব কিরূপে ? মনুষ্য যে গুণ অবগত হয় তাহা নিজের ইন্দ্ৰিয়ের দ্বারাই অবগত হয়; এবং যে গুণ ইন্দ্ৰিয়গোচর হয় না তাহা মনুষ্য জানিতেই পারে না । সার কথা এই যে, ইন্দ্ৰিয় দ্বারা অধ্যারোপিত গুণ ব্যতীত যদি অন্য কোন গুণ, পরব্রহ্মে থাকে, তাহা জানা আমাদের সাধ্য নহে, এবং তাহা পরব্রহ্মের মধ্যে আছে এইরূপ বিধান করাও ন্যায়শাস্ত্ৰসৃষ্টিতে ঠিক্‌ নহে । তাই গুণ শব্দের “মনুষ্যের জ্ঞানগম্য গুণ” অর্থ গ্ৰহণ করিয়া ব্ৰহ্ম ‘নির্গুণ’ ইহা বেদান্তী সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন । মনুষ্যের অচিন্তনীয়  এইরূপ গুণ কিংবা শক্তি মূল পরব্রহ্মস্বরূপে আছে অদ্বৈত বেদান্তও এরূপ বলেন না, আর অপর কেহ তাহা বলিতে পারে না । অধিক কি, বেদান্তীগণও ইন্দ্ৰিয়াদির উপরি-উক্ত অজ্ঞান কিংবা মায়াকে সেই মূল পরব্রহ্মেরই এক অচিন্ত্য শক্তি বলিয়া থাকেন, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে ।


29) বিবর্ত্তবাদ এবং গুণ পরিণামবাদ


ত্ৰিগুণাত্মক মায়া কিংবা প্ৰকৃতি স্বতন্ত্র কোন বস্তু নহে; কিন্তু একই নির্গুণ ব্ৰহ্মর উপর মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয় অজ্ঞানবশতঃ সগুণ দৃশ্য রূপের অধ্যারোপ  করিয়া থাকে । এই মতকে ‘বিবৰ্ত্তবাদ’ বলে । নির্গুণ ব্ৰহ্ম একই মূলতত্ত্ব হওয়ায়, নানাবিধ সগুণ জগৎ প্রথমে কিরূপে দেখিতে পাওয়া গেল, - অদ্বৈত বেদান্ত অনুসারে এই বিষয়ের ইহাই উপপত্তি । কাণাদন্যায়শাস্ত্ৰে অসংখ্য পরমাণুই জগতের মূল কারণ স্বীকার করা হইয়াছে; এবং নৈয়ায়িক এই পরমাণুকে সত্য বলিয়া মানেন । তাই, এই অসংখ্য পরমাণুর সংযোগ হইতে আরম্ভ হইলে পর জগতের অনেক পদার্থ উৎপন্ন হইতে লাগিল, এইরূপ তাঁহারা নির্ধারণ করিয়াছেন । এই মতানুসারে পরমাণুদের সংযোগ আরম্ভ হইবার পর জগৎ সৃষ্ট হয়, তাই ইহাকে ‘আরম্ভবাদ’ বলে। কিন্তু নৈয়ায়িকদিগের অসংখ্য পরমাণুসম্বন্ধীয় মত স্বীকার না করিয়া “একপদার্থী, সত্য ও ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতিই” জড় জগতের মূল কারণ, এবং এই ত্রিগুণাত্মক প্রকৃতির অন্তর্গত গুণের বিকাশে কিংবা পরিণামে ব্যক্ত জগতের সৃষ্টি হয়, ইহা সাংখ্যেরা বলেন । এই মতকে ‘গুণপরিণামবাদ’ বলে । কারণ, এক মূল সগুণ প্ৰকৃতির গুণবিকাশেই সমস্ত ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে এইরূপ ইহাতে প্ৰতিপাদিত হয় । কিন্তু এই দুই মতবাদকে অদ্বৈতবেদান্তী স্বীকার করেন না । পরমাণু অসংখ্য হওয়া প্ৰযুক্ত অদ্বৈতমতানুসারে উহা জগতের মূল হইতে পারে না; এবং অবশিষ্ট প্রকৃতি এক হইলেও উহা পুরুষ হইতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র হওয়ায় এই দ্বৈতও অদ্বৈত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ হয় । কিন্তু এই প্রকারে এই দুই মতবাদকে ছাড়িয়া দিলে এক নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সগুণ জগৎ কিরূপে উৎপন্ন হইল ইহার অন্য কোন উপপত্তি দেওয়া আবশ্যক । কারণ, সৎকার্যবাদ অনুসারে নির্গুণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হইতে পারে না । এই সম্বন্ধে বেদান্তী বলেন যে, সৎকার্যবাদের এই সিদ্ধান্ত, কার্য ও কারণ এই দুই বস্তু যেখানে সত্য সেইখানেই খাটে । মূল বস্তু যেখানে একই এবং তাহার শুধু বাহ্যরূপ যেখানে বদল হয় সেখানে এই ন্যায়ের প্রয়োগ হইতে পারে না । কারণ, একই বস্তুর বিভিন্ন রূপ দেখা সেই বস্তুর ধর্ম না হইয়া দ্রষ্টা পুরুষের দৃষ্টিভেদে এই বিভিন্ন বাহ্যরূপ উৎপন্ন হইতে পারে, ইহা সর্বদাই আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় (appearances are the results of subjective conditions, viz. The senses of the observer and not of the thing in itself) । এই ন্যায় নির্গুণ ব্ৰহ্ম ও সগুণ জগতের সম্বন্ধে প্ৰয়োগ করিলে ব্ৰহ্ম নির্গুণ, এবং মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়ধর্মপ্রযুক্ত তাহাতেই সগুণত্বের প্রতীয়মান রূপ উৎপন্ন হয়, এইরূপ বলিতে হয় । ইহা বিবৰ্ত্তবাদ । একই মূল সত্য দ্রব্যের উপরেই অনেক অসত্য অর্থাৎ নিত্য পরিবর্তনশীল রূপের অধ্যারোপ হইয়া থাকে, ইহাই বিবৰ্ত্তবাদের মত; এবং গুণ পরিণামবাদে প্রথমেই দুই সত্য দ্রব্যকে মানিয়া লওয়া হয়; তন্মধ্যে একের গুণের বিকাশ হইয়া জগতের নানা গুণযুক্ত অন্যান্য বস্তু উৎপন্ন হয় । রজ্জুতে সর্পভ্ৰম বিবৰ্ত্ত; এবং নারিকেল ছোবড়ায় দড়ি হওয়া কিংবা দুধ হইতে দৈ হওয়া গুণপরিণাম । এই কারণে বেদান্তসার গ্রন্থের এক সংস্করণে এই দুই মতবাদের এই লক্ষণ দেওয়া হইয়াছে -
যস্তাত্ত্বিকোহন্যথাভাবঃ পরিণাম উদীরিতঃ ৷
অতাত্ত্বিকোহন্যথাভাবো বিবৰ্ত্ত: স উদীরিতঃ ॥
“কোন মূল বস্তু হইতে যখন তাত্ত্বিক অর্থাৎ সত্যই অন্য প্রকারের বস্তু প্ৰস্তুত হয় তখন তাহাকে (গুণ-) ‘পরিণাম’ বলে; এবং সেরূপ না হইয়া মূল বস্তুই যখন অসত্যরূপে (অতাত্ত্বিক) প্ৰকাশ পায়, তখন তাহাকে ‘বিবর্ত’ বলে [বে|সা|২১] । আরম্ভবাদ নৈয়ায়িকদিগের, গুণপরিণামবাদ সাংখ্যদিগের, এবং বিবর্ত্তবাদ অদ্বৈতবেদান্তীদিগের । অদ্বৈতবেদান্তী পরমাণু কিংবা প্ৰকৃতি এই দুই সগুণ বস্তুকে নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে ভিন্ন ও স্বতন্ত্র বলিয়া মানেন না । কিন্তু আবার এই আপত্তি হয় যে, সৎকাৰ্যবাদ অনুসারে নির্গুণ হইতে সগুণ উৎপন্ন হওয়া অসম্ভব । ইহা দূর করিবার জন্যই বিবৰ্ত্তবাদ বাহির হইয়াছে । কিন্তু তাহা হইতে কেহ কেহ যে ধারণা করেন যে, বেদান্তী গুণপরিণামবাদ কখনই স্বীকার করেন না, কিংবা কখনও করিবেন না, তাহা ভুল । নির্গুণ ব্ৰহ্ম হইতে সগুণ প্ৰকৃতির অর্থাৎ মায়ার উদ্ভব হওয়াই অসম্ভব অদ্বৈত মতের উপর সাংখ্যদিগের কিংবা অন্য দ্বৈতীদিগেরও এই যে মুখ্য আপত্তি তাহা অপরিহার্য নহে । একই নির্গুণ ব্ৰহ্মেতে মায়ার অনেক প্রতীয়মান বাহ্য রূপ আমাদের ইন্দ্ৰিয়গণ প্ৰত্যক্ষ করিতে পারে । ইহা দেখানোই বিবৰ্ত্তবাদের মুখ্য উদ্দেশ্য । এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে পর, অর্থাৎ এক নির্গুণ পরব্রহ্মেতেই সগুণ প্ৰকৃতির রূপ দেখা যাইতে পারে, বিবৰ্ত্তবাদে ইহা সিদ্ধ হইলে পর, এই প্রকৃতির পরবর্তী বিস্তার গুণপরিণামের দ্বারা উৎপন্ন হইয়াছে, ইহা স্বীকার করিতে বেদান্তশাস্ত্রের কোনও বাধা নাই। মূলপ্রকৃতি স্বয়ং এক প্রতীয়মান রূপ, সত্য নহে - ইহাই অদ্বৈত বেদান্তের মুখ্য উক্তি । প্রকৃতির প্রতীয়মান রূপ একবার দেখা দিলে তাহার পর এই প্ৰতীয়মান রূপ হইতে নিৰ্গত অন্য প্ৰতীয়মান রূপকে স্বতন্ত্র না মানিয়া এক প্ৰতীয়মানরূপের গুণ হইতে অন্য প্রতীয়মান রূপের গুণ, এইরূপ নানাগুণাত্মক’রূপ উৎপন্ন হইয়া থাকে, ইহা মানিতে অদ্বৈত বেদান্তের কোন বাধা নাই । তাই “প্ৰকৃতি আমারই মায়া” [গী|৭|১৪; ৪|৬] ভগবান ইহা গীতাতে বলিলেও আবার গীতাতেই ইহা বলিয়াছেন যে, ঈশ্বর-অধিষ্ঠিত [গী|৯|১০] এই প্ৰকৃতির পরবর্তী বিস্তার এই “গুণা গুণেষু বৰ্ত্তন্তে” [গী|৩|২৮; ১৪|২৩] এই নীতি অনুসারেই হইয়া থাকে । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, বিবৰ্ত্তবাদ অনুসারে মূল নির্গুণ পরব্রহ্মেতে একবার মায়ার দৃশ্য রূপ উৎপন্ন হইলে পর, এই মায়িক রূপের অর্থাৎ প্ৰকৃতির পরবর্তী বিস্তারের উপপত্তির জন্য গুণোৎকর্ষের তত্ত্ব গীতাতেও স্বীকৃত হইয়াছে । সমস্ত দৃশ্য জগৎকেই একবার মায়াত্মক রূপ বললে, এই রূপের রূপান্তরের জন্য গুণোৎকর্ষের ন্যায় কোন একটা নিয়ম চাই-ই এরূপ বলিবার প্রয়োজন নাই । মায়াত্মক রূপের বিস্তারও নিয়মবদ্ধই থাকে ইহা বেদান্তীরা অস্বীকার করেন না । তাঁহাদের কথাটা এই যে, মূল প্রকৃতির ন্যায় এই নিয়মও মায়িক, এবং পরমেশ্বর এই সমস্ত মায়িক নিয়মের অধিপতি এবং তাহাদের অতীত; তাঁহার সত্তাতেই এই নিয়মের নিয়ম স্ব অর্থাৎ নিত্যত্ব প্ৰাপ্ত হইয়াছে । ত্রিকালে অবাধিত নিয়ম স্থাপন করিবার সামৰ্থ্য, প্রতীয়মান-রূপবিশিষ্ট সগুণ সুতরাং নশ্বর প্রকৃতির হইতে পারে না ।


30) ব্রহ্মের সত্যানৃতত্ব


উপরে যাহা আলোচিত হইল তাহা হইতে জগৎ, জীব ও পরমেশ্বর - অথবা অধ্যাত্মশাস্ত্রের পরিভাষা অনুসারে মায়া (অর্থাৎ মায়ার দ্বারা উৎপন্ন জগৎ), আত্মা ও পরব্রহ্ম - ইহাদের স্বরূপ ও পরস্পর সম্বন্ধ কি তাহা জানা যাইবে । অধ্যাত্মদৃষ্টিতে জাগতিক সমস্ত বস্তু এই দুই বর্গে বিভক্ত - “নামরূপ” এবং তাহাদের আবরণের নিম্নে ‘নিত্য তত্ত্ব’ । তন্মধ্যে নামরূপকেই সগুণ মায়া কিংবা প্ৰকৃতি বলে । কিন্তু নামরূপকে একপাশে সরাইয়া রাখিলে যে ‘নিত্য দ্রব্য’ অবশিষ্ট থাকে, তাহা নির্গুণই থাকিবে । কারণ কোন গুণই নামরূপবৰ্জিত হইতে পারে না । এই নিত্য ও অব্যক্ত তত্ত্বই পরব্রহ্ম; এবং মনুষ্যের দুর্বল ইন্দ্ৰিয়ের নিকট এই নির্গুণ পরব্রহ্মেই সগুণ মায়ার উদ্‌ভব হইয়াছে বলিয়া মনে হয় । এই মায়া সত্য পদার্থ নহে; পরব্রহ্মই সত্য অর্থাৎ ত্ৰিকালাবাধিত ও অপরিবর্তনীয় বস্তু । দৃশ্য জগতের নামরূপ এবং তাহা দ্বারা আচ্ছাদিত পরব্রহ্ম, ইহাদের স্বরূপসম্বন্ধে এই সিদ্ধান্ত হইয়াছে । এক্ষণে এই ন্যায় অনুসারে মনুষ্যের বিচার করিলে ইহাই সিদ্ধ হয় যে, মনুষ্যের দেহ ও ইন্দ্ৰিয় দৃশ্য জগতের অন্যান্য পদার্থের ন্যায় নামরূপাত্মক অর্থাৎ অনিত্য মায়ার বর্গে পড়ে; এবং এই দেহেন্দ্ৰিয়ে আচ্ছাদিত আত্মা নিত্যস্বরূপ পরব্রহ্মের শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত; কিংবা ব্ৰহ্ম ও আত্মা একই । যে অদ্বৈতীসিদ্ধান্ত এবং বৌদ্ধসিদ্ধান্ত এই অর্থে বাহ্য জগতাকে স্বতন্ত্র সত্য পদাৰ্থ বলিয়া স্বীকার করে না তাহাদের উভয়ের ভেদ পাঠকের এখন অবশ্যই উপলব্ধ হইয়াছে । বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ বলেন যে, বাহ্য জগৎই নাই; তিনি একমাত্র জ্ঞানকেই সত্য বলিয়া স্বীকার করেন; এবং বেদান্তশাস্ত্রী বাহ্য জগতের নিত্যপরিবর্তনশীল নামরূপকেই অসত্য বলিয়া মনে করেন, এবং এই নামরূপের মূলে ও মনুষ্যের দেহে, উভয়েতেই একই আত্মস্বরূপী নিত্য দ্রব্য ব্যাপ্ত হইয়া আছে, এবং এই একপদার্থাত্মক আত্মতত্ত্বই চরম সত্য এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া থাকেন । সাংখ্যবাদী “অবিভক্তং বিভক্তেষু” এই ন্যায় অনুসারে সৃষ্ট পদার্থের নানাত্বের একীকরণকে জড়প্ৰকৃতিরই পক্ষে স্বীকার করেন । কিন্তু বেদান্তীরা সৎকার্যবাদের বাধাটা বাহিরে ফেলিয়া দিয়া স্থির করিয়াছেন যে, “যাহা পিণ্ডে তাহাই ব্ৰহ্মাণ্ডে”; এই কারণে এক্ষণে সাংখ্যেতে অসংখ্য পুরুষের ও প্রকৃতির একই পরমাত্মাতে অদ্বৈতভাবে কিংবা অবিভাগে সমাবেশ হইয়াছে । শুদ্ধাধিভৌতিক পণ্ডিত হেকেলকে অদ্বৈতী ধরিলাম । কিন্তু তিনি এক জড় প্রকৃতিতেই চৈতন্যেরও সংগ্ৰহ করেন; এবং বেদান্ত জড়কে প্ৰাধান্য না দিয়া দেশকালে অসীম, অমৃত ও স্বতন্ত্র চিদ্‌রূপী পরব্রহ্মই সমস্ত জগতের মূল এইরূপ সিদ্ধান্ত করেন । হেকেলের জড়াদ্বৈত এবং অধাত্মশাস্ত্রের অদ্বৈত এই দুয়ের মধ্যে ইহাই গুরুতর ভেদ । অদ্বৈত বেদান্তের এই সিদ্ধান্তই গীতাতেই আছে, এবং এক প্ৰাচীন কবি সমস্ত অদ্বৈত বেদান্তের সার এইরূপে বৰ্ণনা করিয়াছেন -
শ্লোকার্ধেন প্ৰবক্ষ্যামি যদুক্তং গ্ৰন্থকোটিভিঃ ৷
ব্ৰহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ ॥
“কোটি গ্রন্থের সার অর্ধ শ্লোকে বলিতেছি - 
(১)ব্ৰহ্ম সত্য 
(২)জগৎ অর্থাৎ জগতের সমস্ত নামরূপই মিথ্যা কিংবা নশ্বর; এবং
(৩)মানুষের আত্মা ও ব্ৰহ্ম মূলে একই, দুই নহে” । 
এই শ্লোকের ‘মিথ্যা’ শব্দ কাহারও কানে খারাপ লাগিলে তিনি বৃহদারণ্যকোপনিষদ অনুসারে ইহার তৃতীয় চরণের ‘ব্ৰহ্মামৃতং জগৎ সত্যং’ এই পাঠান্তর স্বচ্ছন্দে করিয়া লইতে পারেন; সেইজন্য ভাবার্থের বদল হইবে না ইহা পূৰ্বেই বলিয়াছি । তথাপি সমস্ত দৃশ্য জগতের অদৃশ্য অথচ নিত্য পরব্রহ্মরূপী মুলতত্ত্বকে সৎ (সত্য) বলিবে কি অসৎ (অসত্য-অনৃত) বলিবে, ইহা লইয়া কোন কোন বেদান্তী বড়ই অনৰ্থক বিবাদ করিয়া থাকেন । তাই এই বিষয়ের প্রকৃত বীজ কি, তাহার একটু ব্যাখ্যা করিতেছি । সৎ কিংবা সত্য এই একই শব্দের দুই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ হওয়ায় এই মতবাদ বিপুল হইয়া উঠিয়াছে; এবং ‘সৎ’ এই শব্দকে প্ৰত্যেক ব্যক্তি কি অর্থে প্রয়োগ করেন, তৎপ্রতি ঠিক লক্ষ্য করিলে, কোন গোলযোগ থাকে না । কারণ ব্ৰহ্ম অদৃশ্য হইলেও নিত্য, এবং নামরূপাত্মক জগৎ দৃশ্য হইলেও প্রতিক্ষণে পরিবর্তনশীল, এই ভেদ সকলেরই সমান স্বীকার্য । এই সৎ কিংবা সত্য শব্দের ব্যবহারিক অর্থ হইতেছে (১) চক্ষের সম্মুখে এক্ষণে জাজ্জল্যমান অর্থাৎ ব্যক্ত (কাল উহার বাহ্য রূপ বদলাক বা নাই বদলাক); এবং দ্বিতীয় অর্থ (২) চক্ষের অগোচর অর্থাৎ অব্যক্ত হইলেও যে স্বরূপ চিরকাল এক রকমই থাকে, কখনও পরিবর্তিত হয় না । ইহার মধ্যে, প্রথম অর্থ যাঁহার সম্মত তিনি চক্ষুগোচর নামরূপাত্মক জগৎকে সত্য বলেন, এবং পরব্রহ্মকে তদ্বিরুদ্ধ অর্থাৎ চক্ষের অদৃশ্য সুতরাং অসৎ বা অসত্য বলেন । উদাহরণ যথা - তৈক্তিরীয় উপনিষদে দৃশ্য জগতের প্রতি ‘সৎ’ ও দৃশ্য জগতের অতীতের প্রতি ‘ত্যৎ’ (অর্থাৎ যাহা অতীত) কিংবা ‘অনৃত’ (চক্ষের অদৃশ্য) শব্দ প্রয়োগ করিয়া ব্ৰহ্মের এই প্ৰকার বর্ণন করা হইয়াছে যে, যাহা কিছু মূলে বা আরম্ভে ছিল সেই দ্রব্যই “সচ্চ ত্যচ্চভবৎ । নিরুক্তং চানিরুক্তং চ । নিলয়নং চানিলয়নং চ । বিজ্ঞানং চাবিজ্ঞানং চ । সত্যং চানৃতং চ ।” [তৈ|২|৬] -  সৎ (চক্ষের গোচর) এবং ‘তাহা’ (যাহা অতীত), বাচ্য ও অনির্বাচ্য, সাধার ও নিরাধার, জ্ঞাত ও অবিজ্ঞাত (অজ্ঞেয়), সত্য ও অনৃত - এইরূপ দ্বিধা হইয়া গিয়াছে । কিন্তু ব্ৰহ্মকে এইরূপ ‘অনৃত’ বলিলেও অনৃতের অর্থ মিথ্যা নহে; পরে তৈত্তিরীয় উপনিষদেই “এই অনৃত ব্ৰহ্ম জগতের ‘প্ৰতিষ্ঠা’ কিংবা আধার, তাহার অন্য আধারের অপেক্ষা নাই, এবং তাহাকে যে জানিয়াছে সে অভয় হইয়াছে” এইরূপ উক্ত হইয়াছে । ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, শব্দভেদে ভাবার্থের বদল হয় না । সেইরূপ আবার শেষে “অসদ্‌ বা ইদমগ্ৰ আসীৎ” - “এই সমস্ত জগৎ প্ৰথমে অসৎ (ব্ৰহ্ম) ছিল”, এবং ঋগ্বেদের [১০|১২৯|৪] বর্ণন অনুসারে তাহা হইতেই পরে সৎ অর্থাৎ নামরূপাত্মক ব্যক্ত জগৎ নিঃসৃত হইয়াছে এইরূপ উক্ত হইয়াছে [তৈ|২|৭] । ইহা হইতেও স্পষ্টই দেখা যায় - ‘অসৎ’ শব্দ এই স্থানে অব্যক্ত অর্থাৎ, “চক্ষের অদৃশ্য” এই অর্থেই প্ৰযুক্ত হইয়াছে; এবং বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণাচার্য উক্ত বচনের এইরূপ অর্থই করিয়াছেন, [বেসূ|২|১|১৭] । কিন্তু ‘সৎ’ কিংবা ‘সত্য’ এই শব্দের, - চক্ষে দেখা না গেলেও চিরস্থায়ী কিংবা নিত্য এইরূপ (অর্থাৎ উপরে প্রদত্ত দুই অর্থের মধ্যে দ্বিতীয়) অর্থ যাঁহাদের সন্মত, তাঁহারা অদৃশ্য অথচ অপরিবর্তনীয় পরব্রহ্মকেই সৎ কিংবা সত্য নাম দিয়া, নামরূপাত্মক মায়াকে অসৎ অর্থাৎ অসত্য সুতরাং নশ্বর, এইরূপ বলিয়া থাকেন । উদাহরণ যথা - “সদেব সৌম্যেদমগ্ৰ আসীৎ কথমসতঃ সজ্জায়েত” - হে সৌম্য, সমস্ত জগৎ প্ৰথমে সৎ (ব্ৰহ্ম) ছিল, যাহা অসৎ অর্থাৎ যাহা ‘নাই’ তাহা হইতে সৎ অর্থাৎ “যাহা আছে” তাহা কিরূপে উৎপন্ন হইবে - এইরূপ ছান্দোগ্য উপনিষদে উক্ত আছে [ছাং|৯|২|১,২] । আবার ছন্দোগ্য উপনিষদেই এই পরব্রহ্মকে একস্থানে অব্যক্ত অর্থে ‘অসৎ’ বলা হইয়াছে [ছাং|৩|১৯|১] । * (অধ্যাত্মশাস্ত্ৰসম্বন্ধীয় ইংরেজ গ্রন্থকারদিগের মধ্যেও, সৎ শব্দ জগতের প্রতীয়মান আবির্ভাব (মায়া) সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইবে, অথবা বস্তুতত্ত্ব (ব্ৰহ্ম) সম্বন্ধে প্ৰযুক্ত হইবে এই বিষয়ে মতভেদ আছে । কান্ট জগতের প্রতীয়মান আবির্ভাবকে সৎ বুঝিয়া (real) বস্তুতত্ত্বকে অবিনাশী বলেন । কিন্তু হেগেল ও গ্রীন প্রভৃতি উক্ত আবির্ভাবকে অসৎ (unreal) বুঝিয়া বস্ততত্ত্বকে (real) সৎ বলেন ।)


31) ওঁ-তৎসৎ এবং অন্য ব্রহ্মনির্দেশ


একই পরব্রহ্মের প্রতি বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন অর্থে একবার ‘সৎ’ ও একবার ‘অসৎ’ এইরূপ পরস্পরবিরুদ্ধ নাম দিবার এই গোলযোগ - অর্থাৎ বাচ্য অর্থ একই হইলেও শুধু শব্দবাদ বাড়াইবার পক্ষে সাহায্যকারী - পদ্ধতি পরে ভাঙ্গিয়া গিয়া শেষে ব্ৰহ্ম সৎ বা সত্য অর্থাৎ নিত্যস্থায়ী, এবং দৃশ্য জগৎ অসৎ অর্থাৎ নশ্বর, এই এক পরিভাষাই স্থায়ী হইয়া গিয়াছে । ভগবদ্‌গীতাতে এই শেষের পরিাভাষা স্বীকৃত হইয়াছে এবং তদনুসারে দ্বিতীয় অধ্যায়ে [গী|২|১৬-১৮] পরব্রহ্ম সৎ ও অবিনাশী, এবং নামরূপ অসৎ অর্থাৎ বিনশ্বর, এইরূপ উক্ত হইয়াছে; এবং বেদান্তসূত্রের সিদ্ধান্তও এইরূপ । পুনশ্চ দৃশ্য জগতকে ‘সৎ’ বলিয়া পরব্ৰহ্মকে ‘অসৎ’ বা ‘তৎ’ (তাহা=অতীত) বলিবার তৈত্তিরীয়োপনিষদীয় সেই পুরাতন পরিভাষার চিহ্ন এখনও একেবারে লুপ্ত হয় নাই । ওঁ তৎসৎ এইরূপ যে ব্রহ্মনিৰ্দেশ গীতাতে প্রদত্ত হইয়াছে [গী|১৭|২৩] তাহার মূল অর্থ কি হইতে পারে - এই পুরাতন পরিভাষার দ্বারা ইহার সুন্দর ব্যাখ্যা হয় । এই ‘ওঁ’ গূঢ়াক্ষররূপী বৈদিক মন্ত্র; উপনিষদে অনেক প্রকারে ইহার ব্যাখ্যা করা হইয়াছে [প্ৰ|৫; মাং|৮-১২; ছাং|১|১] । ‘তৎ’ অর্থাৎ তাহা কিংবা দৃশ্য জগতের অতীত, দুরবর্তী অনিৰ্বাচ্য তত্ত্ব; এবং ‘সৎ’ অর্থাৎ চক্ষের সম্মুখস্থ দৃশ্য জগৎ । এই তিন মিলিয়া সমস্তই ব্ৰহ্ম, ইহাই এই সংকল্পের অর্থ । এবং সেই অর্থেই “সদসচ্চাহমৰ্জ্জুন” [গী|৯|১৯] - সৎ অর্থাৎ পরব্রহ্ম ও অসৎ অর্থাৎ দৃশ্য জগৎ দুই-ই আমি, এইরূপ ভগবান গীতাতে বলিয়াছেন । তথাপি গীতায় কর্মযোগই প্রতিপাদ্য হওয়ায় সপ্তদশ অধ্যায়ের শেষে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে, এই ব্রহ্মনির্দেশের দ্বারাও কর্মযোগের পূর্ণ সমর্থন হয়; “ওঁ তৎসৎ” এর ‘সৎ’ শব্দের অর্থ লৌকিক দৃষ্টিতে ভাল অর্থাৎ সদ্‌বুদ্ধিতে কৃত কিংবা যাহার ভাল ফল পাওয়া যায় সেই কর্ম; এবং তৎ-এর অর্থ অতীত কিংবা ফলাশা ছাড়িয়া কৃত কর্ম । সংকল্পে যাহাকে ‘সৎ’ বলা হইয়াছে তাহা দৃশ্য জগৎ অর্থাৎ কর্মই হওয়ায় (পর প্রকরণ দেখ) এই ব্ৰক্ষ্মনির্দেশের এই কর্মমূলক অর্থ মূল-অর্থ হইতে সহজেই নিষ্পন্ন হয় । ওঁ তৎসৎ, নেতি নেতি, সচ্চিদানন্দ, এবং সত্যস্য সত্যং ব্যতীত আরও কতকগুলি ব্ৰহ্মনির্দেশ উপনিষদে প্ৰদত্ত হইয়াছে; কিন্তু গীতাৰ্থ বুঝিবার পক্ষে তাহাদের উপযোগ না থাকায় এখানে সেগুলি বুঝানো হয় নাই ।


32) জীব পরমেশ্বরের 'অংশ' কি প্রকারে


জগৎ, জীব ও পরমেশ্বর (পরমাত্মা) ইহাদের পরস্পর-সম্বন্ধের এইরূপ নিষ্পত্তি হইলে পর, “জীব আমারই অংশ” [গী|১৬|৭] এবং “আমিই এক ‘অংশের দ্বারা’ এই সমস্ত জগৎ ব্যাপিয়া আছি” [গী|১০|৪২] এইরূপ যাহা ভগবান গীতায় বলিয়াছেন - এবং বাদরায়ণাচাৰ্যও বেদান্তসূত্রে ইহাই বলিয়াছেন [বেসু|২|৩|৪৩|৪|১৯] - কিংবা পুরুষসূক্তে “পাদোহস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি” - “স্থিরচর ব্যাপুনি অবঘা জো জগদাত্মা দশাংগুলে উরলা” - সমস্ত চরাচর ব্যাপিয়া যে জগদাত্মা দশাঙ্গুলে রহিয়াছেন — এইরূপ যে বর্ণনা আছে, তন্মধ্যে ‘পাদ বা অংশ’ শব্দের অর্থনির্ণয়ও সহজ হয় । পরমেশ্বর বা পরমাত্মা সর্বব্যাপী হইলেও নিরবয়ব একপদার্থাত্মক ও নামরূপবিরহিত সুতরাং অচ্ছেদ্য এবং নির্বিকার হওয়া প্রযুক্ত তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন বিভাগ অর্থাৎ বিচ্ছিন্ন টুকরা হওয়া সম্ভব নহে [গী|২|২৫] । তাই, চতুর্দিকে ওতপ্রোতভাবে অবস্থিত এই একপদার্থী পরব্ৰহ্ম এবং মনুষ্যের দেহান্তৰ্গত আত্মা, এই দুয়ের ভেদ দেখাইবার জন্য ব্যবহারে ‘শারীর আত্মা’ পরব্রহ্মেরই ‘অংশ’ এইরূপ বলিতে হইলেও, ‘অংশ’ বা ‘ভাগ’ শব্দের ‘কাটিয়া ফেলা বিচ্ছিন্ন টুকরা’, বা ‘ডালিমের অনেক দানার মধ্যে একটি দানা’ এইরূপ অর্থ না করিয়া, তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে গৃহস্থিত আকাশ, ঘটস্থ আকাশ (মঠাকাশ, ঘটাকাশ) এই সকল যেরূপ সর্বব্যাপী এক আকাশেরই ভাগ, সেইরূপ শারীর আত্মাও পরব্রহ্মের অংশ, এইরূপ অর্থ করিতে হয় [অমৃতবিন্দু উপনিষৎ ১৩ দেখ] । 


33) পরমেশ্বর দিককাল সীমাহীন


সাংখ্যদিগের প্রকৃতি এবং হেকেলের আধিভৌতিক জড়াদ্বৈতবাদে স্বীকৃত একপদার্থমূলক তত্ত্ব, - ইহাও এইরূপ সত্য নির্গুণ পরমেশ্বরেরই সগুণ অর্থাৎ সসীম অংশ । অধিক কি, আধিভৌতিক শাস্ত্রের পদ্ধতি অনুসারে ইহাই প্ৰকাশ পায় যে, যে কোন ব্যক্ত বা অব্যক্ত মূলতত্ত্ব (তাহা আকাশের মত যতই কেন ব্যাপক হউক না) আছে, সে সমস্ত দেশ ও কালের দ্বারা বদ্ধ নামরূপমাত্র সুতরাং সসীম ও নশ্বর । ইহা সত্য যে, সেই তত্ত্বসমূহের ব্যাপকতার কারণে ততটুকুই পরব্রহ্ম তাহাদের দ্বারা আচ্ছাদিত; কিন্তু পরব্রহ্ম তাহাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ না হইয়া সেই সমস্তের মধ্যে ওতপ্ৰোত আছেন এবং তদতিরিক্ত জানি না তিনি কতটা বাহিরে আছেন, যাহার কোন সন্ধান নাই । পরমেশ্বরের ব্যাপকতা দৃশ্য জগতের বাহিরে কতটা, তাহা দেখাইবার জন্য ‘ত্ৰিপাদ’ শব্দ পুরুষসূক্তে প্ৰযুক্ত হইলেও তাহার অর্থ ‘অনন্তই’ বিবক্ষিত । বস্তুত দেখা যায় যে দেশ ও কাল, পরিমাণ বা সংখ্যা ইত্যাদি সমস্ত নামরূপেরই প্ৰকার; এবং ইহা বলিয়া আসিয়াছি যে পরব্রহ্ম এই সমস্ত নামরূপের অতীত । এইজন্য, যে নামরূপাত্মক ‘কালের’ দ্বারা সমস্ত কবলিত রহিয়াছে সেই কালকেও যিনি আচ্ছাদন করিয়া রহিয়াছেন তিনিই পরব্রহ্ম, উপনিষদে ব্ৰহ্মস্বরূপের এইরূপ বর্ণনা দেখা যায় [মৈ|৬|১৫]; এবং “ন তদ্‌ভাসয়তে সূৰ্য্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ” - পরমেশ্বরকে প্ৰকাশ করিবার পক্ষে সূর্য চন্দ্ৰ কিংবা অগ্নির সমান কোন প্ৰকাশক সাধন নাই, কিন্তু তিনি স্বপ্ৰকাশ, ইত্যাদি যে বর্ণনা গীতাতে ও উপনিষদে আছে [গী|১৫|৬; কঠ|৫|১৫; শ্বে|৬|১৩] তাহারও ইহাই তাৎপর্য । সূর্য চন্দ্ৰ তারা সমস্তই নামরূপাত্মক নশ্বর পদার্থ । যাঁহাকে “জ্যোতিষাং জ্যোতিঃ” [গী|১৩|১৭; বৃ|৪|১৬] - জ্যোতির জ্যোতি বলা হয় সেই স্বপ্ৰকাশ ও জ্ঞানময় ব্ৰহ্ম এই সমস্তের অতীত অনন্ত ব্যাপিয়া আছেন; তাঁহার অন্য প্ৰকাশক পদার্থের অপেক্ষা নাই; এবং উপনিষদেও স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, সূর্য চন্দ্ৰ প্ৰভৃতি যে আলোক প্রাপ্ত হয় তাহাও এই স্বপ্ৰকাশ ব্ৰহ্ম হইতেই তাহারা প্রাপ্ত হয় [মুং|২|২|১০] । আধিভৌতিক শাস্ত্রের যুক্তি অনুসারে ইন্দ্রিয়গোচয় অতি সূক্ষ্ম বা অত্যন্ত দূরের পদার্থ ধর না কেন, সে সমস্তই দেশকালাদি নিয়মের বন্ধনে আবদ্ধ, অতএব ‘জগতেই’ উহাদের সমাবেশ হয় । সত্য পরমেশ্বর উহাদের মধ্যে থাকিয়াও উহাদের হইতে পৃথক্‌, উহাদের অপেক্ষা অধিক ব্যাপক, এবং নামরূপের জাল হইতে স্বতন্ত্র; অতএব কেবল নামরূপেরই বিচারকারী আধিভৌতিক শাস্ত্রের যুক্তি বা সাধন বর্তমান অবস্থা অপেক্ষা শতগুণ সূক্ষ্ম ও প্ৰগল্‌ভ হইলেও তাহার দ্বারা জগতের মূল “অমৃত তত্ত্বের” সন্ধান পাওয়া সম্ভব নহে । সেই অবিনাশী, নির্বিকার ও অমৃততত্ত্বকে কেবল অধ্যাত্মশাস্ত্রের জ্ঞানমার্গের দ্বারাই অনুসন্ধান করিতে হইবে ।


34) অধ্যাত্মশাস্ত্রের চরম সিদ্ধান্ত


এ পর্যন্ত অধ্যাত্মশাস্ত্রের যে মুখ্য মুখ্য সিদ্ধান্ত ও শাস্ত্রীয় রীতিতে তাহাদের যে সংক্ষিপ্ত উপপত্তি বলা হইয়াছে, তাহা হইতে ইহা সুস্পষ্ট হইবে যে, পরমেশ্বরের নামরূপাত্মক সমস্ত ব্যক্ত স্বরূপ কেবল মায়িক ও অনিত্য এবং ইহা অপেক্ষা তাহার অব্যক্ত স্বরূপ শ্ৰেষ্ঠ, এবং তাহারও মধ্যে নির্গুণ অর্থাৎ নামরূপরহিত স্বরূপই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; এবং নির্গুণই সগুণরূপে অজ্ঞানফলে প্ৰতিভাত হয় ইহা গীতায় বলা হইয়াছে । কিন্তু কেবল শব্দের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত গ্রথিত করিবার কাজ, সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ন্যায় যাহাদের দুই অক্ষরের কোন জ্ঞান হইয়াছে তাহারাই করিতে পারেন, ইহাতে কোন অসাধারণত্ব নাই । এ বিষয়ে বিশেষত্ব এই যে, এই সমস্ত সিদ্ধান্ত বুদ্ধিতে আসিয়া মনের মধ্যে প্ৰবেশ করে, হৃদয়ের মধ্যে মগ্ন হয় এবং অস্থিমাংসের মধ্যে বিদ্ধ হইয়া যায় । এই প্ৰকার হইবার পর একই পরব্রহ্ম সমস্ত প্ৰাণীর মধ্যে ওতপ্রোত হইয়া আছেন, পরমেশ্বরের স্বরূপের এই প্রকার পূর্ণ জ্ঞান লাভ হয়, এবং সেই ভাবের দ্বারা সঙ্কটকালেও সম্পূর্ণ সমতার সহিত আচরণ করিবার স্থির স্বভাব উৎপন্ন হয়; কিন্তু ইহার জন্য বহুবংশাগত সংস্কারের, ইন্দ্ৰিয়নিগ্রহের, দীর্ঘ উদ্যোগের এবং ধ্যান ও উপাসনার সহায়তা আবশ্যক হয় । এই সমস্তের সাহায্যে “সর্বভূতে একই আত্মা” এই তত্ত্ব যখন কোন মনুষ্যের সঙ্কট সময়েও তাহার প্রত্যেক কর্মে সহজভাবে স্পষ্ট উপলব্ধি হয়, তখনই বুঝিতে হইবে যে, তাহার ব্ৰহ্মজ্ঞান প্রকৃতই পরিপক্ক হইয়াছে এবং এই প্রকারেই মনুষ্যের মোক্ষলাভ হয় [গী|৫|১৮-২০; ৬|২১,২২] – ইহাই অধ্যাত্মশাস্ত্রের উপরিউক্ত সর্ব সিদ্ধান্তের সারভূত ও শিরোমণিভূত চরম সিদ্ধান্ত । এই আচরণ যে ব্যক্তিতে দেখা যায় না তাহাকে ‘কাঁচা’ বুঝিতে হইবে - ব্ৰহ্মজ্ঞানের অগ্নিতে সে এখনও সম্পূর্ণ পক্ক হয় নাই । প্রকৃত সাধু এবং নিছক বেদান্তশাস্ত্রী, ইহাদের মধ্যে ইহাই ভেদ । 


35) দেহেন্দ্রিয়ে প্রবিদ্ধ সাম্যবুদ্ধি


এবং এই অভিপ্ৰায়েই গীতাতে জ্ঞানের লক্ষণ বলিরার সময় “বাহ্য জগতের মূল তত্ত্বকে শুধু বুদ্ধিতে জানা” জ্ঞান না বলিয়া “অমানিত্ব, ক্ষান্তি, আত্মনিগ্ৰহ, সমবুদ্ধি” ইত্যাদি উদাত্ত মনোবৃত্তি জাগৃত হইয়া যাহার দ্বারা চিত্তের পূর্ণ শুদ্ধি আচরণে সর্বদা ব্যক্ত হয় তাহাই প্রকৃত জ্ঞান, এইরূপ উক্ত হইয়াছে [গী|১৬|৭-১১] । জ্ঞানের দ্বারা যাহার ব্যবসায়াত্মক বুদ্ধি আত্মনিষ্ঠ অর্থাৎ আত্ম-অনাত্ম বিচারে স্থির হয় এবং যাহার মনে সর্বভূতাত্মৈক্য-জ্ঞানের পূর্ণ প্ৰকাশ পায় সেই ব্যক্তির বাসনাত্মক বুদ্ধিও নিঃসন্দেহ শুদ্ধ হয় । কিন্তু কাহার বুদ্ধি কিরূপ বুঝিতে হইলে তাহার আচরণ ব্যতীত অন্য বাহ্য সাধন না থাকায় এখনকার কেবল কেতাবী জ্ঞানপ্রচারের কালে ইহা বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত যে, ‘জ্ঞান’ বা ‘সমবুদ্ধি’ শব্দেই শুদ্ধ (ব্যবসায়াত্মক) বুদ্ধি, শুদ্ধ বাসনা (বাসনায়ক বুদ্ধি) ও শুদ্ধ আচরণ, এই তিন শুদ্ধ বিষয়ের সমাবেশ করা হয় । ব্ৰহ্মসম্বন্ধে শুষ্ক বাক্‌পাণ্ডিত্য প্ৰদৰ্শক এবং তাহা শুনিয়া “বাঃ বাঃ” বলিয়া শিরঃসঞ্চালক, কিংবা অভিনয়দর্শকের ন্যায় “আরও একবার” বলিবার লোক অনেক আছে [গী|২|২৯; ক|২|৭] । কিন্তু উপরি-উক্ত অনুসারে যে ব্যক্তি অন্তর্বাহ্যশুদ্ধ অর্থাৎ সাম্যশীল হইয়াছে সেই প্ৰকৃত আত্মনিষ্ঠ এবং তাহারই মুক্তি লাভ হয়, নিছক্‌ পণ্ডিতের হয় না - সে যতই কেন বুদ্ধিমান বা বিদ্বান হোক না । “নায়মাত্মা প্ৰবচনেন লভ্যো ন মেধয়া ন বহুনা শ্রুতেন” এইরূপ উপনিষদে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে [ক|২|২২; মুং|৩|২|৩] । এইরূপ তুকারাম বাবাও বলিয়াছেন — “ঝালাসি পণ্ডিত পুরাণ সাঙ্গসী । পরী তুঁ নেণসি মী হেঁ কোণ ।।” অর্থাৎ - “পণ্ডিত হইয়াছে, পুরাণ বলিতেছ । কিন্তু তুমি জান না যে ‘আমি’ কে ।” [গা|২৫|৯৯] । 


36) মোক্ষরূপ ও সিদ্ধাবস্থার বর্ণনা


আমাদের জ্ঞান কত কম তাহা দেখ । ‘মুক্তি লাভ হয়’ এই শব্দ আমাদের মুখ হইতে সহজেই বাহির হইয়া পড়ে । মনে করি আত্মা হইতে এই মুক্তি কোন পৃথক বস্তু ! ব্ৰহ্ম ও আত্মার একত্ব জ্ঞান হইবার পূর্বে দ্রষ্টা ও দৃশ্য জগতে ভেদ ছিল ঠিক; কিন্তু আমাদের অধ্যাত্মশাস্ত্ৰে নিশ্চিত অবধারিত হইয়াছে যে, ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের পূর্ণ জ্ঞান হইলে আত্মা ব্ৰহ্মেতে মিশিয়া যায় এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানী পুরুষ আপনিই ব্ৰহ্মরূপ হইয়া যান; এই আধ্যাত্মিক অবস্থাকেই ‘ব্রহ্মনিৰ্বাণ’ মোক্ষ নাম দেওয়া হইয়াছে; এই ব্ৰহ্মনিৰ্বাণ কেহ কাহাকে দিতে পারে না, ইহা অন্য কোথা হইতে আসে না, অথবা তাহার জন্য অন্য কোন লোকে যাইবারও প্রয়োজন নাই । পূর্ণ আত্মজ্ঞান যখন ও যেখানে হইবে সেইক্ষণে ও সেই স্থানেই মোক্ষ ধরা রহিয়াছে; কারণ মোক্ষ তো আত্মারই মূল শুদ্ধাবস্থা; উহা পৃথক স্বতন্ত্র কোন বস্তু বা স্থল নহে । শিবগীতাতে এই শ্লোক আছে [১৩|৩২] -
মোক্ষস্য ন হি বাসোহস্তি ন গ্রামান্তরমেব বা ৷
অজ্ঞানহৃদয়গ্ৰন্থি-নাশো মোক্ষ ইতি স্বতঃ ॥
অর্থাৎ “মোক্ষ অমুক স্থানে লাভ হয়, কিংবা মোক্ষের জন্য অন্য কোন গ্রামে অর্থাৎ প্রদেশে যাইতে হয়, এরূপ নহে; আপন হৃদয়ের অজ্ঞান-গ্রন্থির নাশ হওয়াকেই মোক্ষ বলে ।” এই প্রকারে অধ্যাত্মশাস্ত্ৰ হইতে নিষ্পন্ন এই অর্থই “অভিতো ব্ৰহ্মনিৰ্বাণং বৰ্ত্ততে বিদিতাত্মনাম,” [গী|৫|২৬] - যাঁহার পূর্ণ আত্মজ্ঞান হইয়াছে তাঁহার সকল স্থানেই ব্রহ্মনিৰ্বাণরূপী মোক্ষলাভ হয়, এবং “যঃ সদা মুক্ত এব সঃ [গী|৫|২৮] ভগবদ্‌গীতার এই শ্লোকসমূহে এবং “ব্ৰহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি” - যিনি ব্ৰহ্মকে জানিয়াছেন তিনি ব্ৰহ্মই হইয়াছেন [মুং|৩|২|৯] - ইত্যাদি উপনিষদবাক্যেও বর্ণিত হইয়াছে । মনুষ্যের আত্মার জ্ঞানদৃষ্টিতে এই যে পূর্ণাবস্থা হয়, ইহাকেই ‘ব্ৰহ্মভূত’ [গী|১৮|৫৪], বা ‘ব্ৰাহ্মী স্থিতি’ [গী|২|৭২], বলা হইয়া থাকে; এবং ‘স্থিতপ্রজ্ঞ’ [গী|২|৫৫-৭২], ‘ভক্তিমান্‌’ [গী|১২|১৩-২০] বা ‘ত্ৰিগুণাতীত’ [গী|১৪|২২-২৭] পুরুষদিগের ভগবদ্‌গীতায় যে বর্ণনা আছে তাহাও এই অবস্থারই বর্ণনা । ‘ত্রিগুণাতীত’ পদ হইতে প্ৰকৃতি ও পুরুষ উভয়কে স্বতন্ত্র মানিয়া সাংখ্য যেরূপ পুরুষের কৈবল্যকে মোক্ষ বলেন, সেইরূপ মোক্ষই গীতারও অভিমত, এরূপ বুঝা যেন না হয়; আধ্যাত্মশাস্ত্রের “অহং ব্ৰহ্মাস্মি”- আমিই ব্ৰহ্ম – [বৃ|১|৪|১০] - এই ব্ৰাহ্মী অবস্থা কখন ভক্তিমার্গের দ্বারা, কখন চিত্তনিরোধরূপ পাতঞ্জল যোগমার্গের দ্বারা এবং কখন বা গুণাগুণবিচাররূপ সাংখ্যমার্গের দ্বারাও প্ৰাপ্ত হওয়া যায়, ইহাই গীতার অভিপ্ৰায় । এই মাৰ্গসমূহের মধ্যে অধ্যাত্মবিচার কেবল বুদ্ধিগম্য মার্গ হওয়া প্ৰযুক্ত পরমেশ্বরস্বরূপের জ্ঞানলাভার্থ সাধারণ মনুষ্যের পক্ষে ভক্তিই সুলভ সাধন ইহা গীতাতে উক্ত হইয়াছে । এই সাধনের সবিস্তার বিচার আমি পরে ত্ৰয়োদশ প্রকরণে করিয়াছি । সাধন যাহাই হোক না, ব্ৰহ্মাত্মৈক্যের অর্থাৎ প্ৰকৃত পরমেশ্বরের স্বরূপের জ্ঞান হইয়া জগতের সর্বভূতের মধ্যে একই আত্মাকে উপলব্ধি করা এবং তদনুসারে কার্য করাই অধ্যাত্মজ্ঞানের পরাকাষ্ঠা; এবং এই অবস্থা যাহার লাভ হইয়াছে সেই পুরুষই ধন্য ও কৃতকৃত্য হন - এইটুকুতো নির্বিবাদ । ইহা পূৰ্বেই বলা হইয়াছে যে, কেবল ইন্দ্ৰিয়সুখ পশু ও মনুষ্যের একই সমান হওয়া প্ৰযুক্ত মনুষ্যজন্মের সার্থকতা কিংবা মনুষ্যের মনুষ্যত্ব জ্ঞানলাভেই হইয়া থাকে । সমস্ত ভূতের বিষয়ে কায়মনোবাক্যে সর্বদা এইপ্ৰকার সাম্যবুদ্ধি স্থাপন করিয়া সমস্ত কর্ম করাই নিত্য মুক্তাবস্থা, পূর্ণযোগ বা সিদ্ধাবস্থা । গীতায় এই অবস্থার যে বৰ্ণনা আছে তন্মধ্যে দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তিমান পুরুষের বর্ণনার উপর টীকা করিবার সময় জ্ঞানেশ্বর মহারাজ * অনেক দৃষ্টান্ত দিয়া ব্ৰহ্মভূত পুরুষের সাম্যাবস্থার সুরস ও চটক্‌দার নিরূপণ করিয়াছেন; এবং তাহাতে গীতার চারি স্থানে বর্ণিত ব্ৰাহ্মী স্থিতির সার বিবৃত হইয়াছে ইহা বলিতে বাধা নাই । যথা - “হে পাৰ্থ ! যাহার হৃদয়ে বৈষম্য কিছুমাত্র নাই, যিনি শত্রুমিত্র সকলকে সমান ভাবেন; অথবা হে পাণ্ডব ! যিনি প্ৰদীপের ন্যায় ইহা আমার ঘর বলিয়া এখানে আলোক দিব, উহা অপরের ঘর বলিয়া ওখানে অন্ধকার করিয়া রাখিব, এ প্রকার ভেদজ্ঞান করেন না; বীজ যে বপন করে এবং গাছ যে কাটে, উভয়ের উপরেই বৃক্ষ যেমন সমভাবে ছায়াদান করে;” ইত্যাদি [জ্ঞা|১২|১৮] । 
* (জ্ঞানেশ্বর মহারাজের “জ্ঞানেশ্বরী” গ্রন্থের হিন্দী অনুবাদ নাগপুরে সবজজ শ্ৰীযুক্ত রঘুনাথ মালব ভগড়ে বি-এ, করিয়াছেন; এবং এই গ্ৰন্থ উহার নিকট পাওয়া যায় । বর্তমানে প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক প্রভুপাদ শ্রীযুক্ত প্রাণকিশোর গোস্বামী তাহা বাংলা ভাষাতেও সম্পূর্ণ অনুবাদ করিয়াছেন ।) 

সেইরূপ “পৃথিবীর ন্যায় তিনি এ প্রকার ভেদ একেবারেই জানেন না যে, উত্তমকে গ্ৰহণ করিতে হইবে এবং অধমকে ত্যাগ করিতে হইবে; যেমন দয়ালু ব্যক্তি ইহা ভাবেন না যে, রাজার শরীর রক্ষা করি এবং দরিদ্রের শরীর বিনষ্ট করি; যেমন জল এই ভেদ করে না যে, গরুর তৃষ্ণা শান্তি করি এবং ব্যাঘ্রের পক্ষে বিষ হইয়া তাহার সর্বনাশ করি; সেইরূপই সর্বভূতে যাঁহার একই মৈত্রী; যিনি স্বয়ং মূর্তিমান দয়া, এবং যিনি ‘আমি’ ও ‘আমার’ ব্যবহার করিতে জানেন না, এবং যাহাতে সুখদুঃখের আভাসও দেখা যায় না” ইত্যাদি [জ্ঞা|১২|১৩] * অধ্যাত্মবিদ্যার দ্বারা শেষে যাহা লাভ হয় তাহা ইহাই ।
* (পার্থ জয়াচিয়া ঠাষী । বৈষম্যাচী বাৰ্ত্তা নাহী । বিদুমিত্রা দোহী । সরিসা পাডু ।। 
কাঁ ঘরিচিয়া উজিযেতু করারা পারখিয়া অঁধারু পাডাবা । হে নেনেচি গা পাণ্ডবা । দীনূ জৈসা ।। জো খাণ্ডাবয়া ঘাকে ঘালী । কাঁ লাবণী জয়ানে কেলী ।। দেঘাঁ একাচি সাডলী । বৃক্ষুদে জৈসা ।।
কিংবা তৎপূর্বে [জ্ঞা|১২|১৩] সেই অধ্যায়ে –
উত্তমানে ধরিজে । অধমানে অহ্বেরিজে । হেঁ কাঁহীঁচ নেণিজে । অসুধা জেবীঁ ।।
কাঁ রায়াচেঁ দেহ চালুঁ । রক্ষা পবৌতে গালুঁ । হেঁনে ক্ষণেচি কৃপালু । প্রাণু সৈঁ গা ।।
গাঈচা তৃষা হরুঁ । কাঁ ব্যাঘ্রা বিষ হোউনি মারু । ঐ সে নেণেচি কাঁকরু, তোর জৈসেঁ ।।
তৈসী আষ বিবাঁচি ভূতমাত্রী । একপণে জয়া মৈত্রী ।। কৃপেশী ধাত্রী । আপণচি জো ।।
আণি মী হে ভাব নেণে । মাঝেঁ কহীঁচি ন ক্ষণে । সুখদুঃখ জাণণেঁ । নাহিঁ জয়া ।।)


37) ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের সার্থ বিবরণ


সমস্ত মোক্ষধর্মের মূল অধ্যাত্মজ্ঞানের পরম্পরা আমাদের নিকট উপনিষদ হইতে আরম্ভ করিয়া জ্ঞানেশ্বর, তুকারাম, রামদাস, কবীরদাস, তুলসীদাস, ইত্যাদি আধুনিক সাধুপুরুষ পর্যন্ত কিরূপ অব্যাহত চলিয়া আসিয়াছে, তাহা উপরিউক্ত বিচার-আলোচনা হইতে উপলব্ধি হইবে । কিন্তু উপনিষদেরও পূর্বে অর্থাৎ অত্যন্ত প্ৰাচীন কালেই আমাদের দেশে এই জ্ঞানের প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল এবং তখন হইতে পরে ক্রমে ক্ৰমে উপনিষদের বিচারের বৃদ্ধি হইতে চলিয়াছে । ইহা পাঠককে ভালরূপে বুঝাইবার জন্য উপনিষদের ব্রহ্মবিদ্যার আধারভূত ঋগ্‌বেদের এক প্ৰসিদ্ধ সূক্ত ভাষান্তর সহ এইখানে শেষে দিয়াছি । জগতের অগম্য মূলতত্ত্ব এবং তাঁহা হইতে এই বিবিধ দৃশ্য জগতের উৎপত্তির বিষয়ে এই সূক্তে যে বিচার প্রদর্শিত হইয়াছে সেরূপ প্ৰগল্‌ভ, স্বতন্ত্র ও মূলস্পর্শী তত্ত্বজ্ঞানের মার্মিক বিচার অন্য কোন ধর্মেরই মূল গ্রন্থে পাওয়া যায় না । শুধু তাহাই নহে, এই প্রকার অধ্যাত্মবিচারে পূর্ণ এত প্ৰাচীন লেখাও অদ্যাপি কোথাও উপলব্ধ হয় নাই । তাই, মনুষ্যের মনের প্রবৃত্তি এই নশ্বর ও নামরূপাত্মক জগতের অতীত নিত্য ও অচিন্ত্য ব্ৰহ্মশক্তির দিকে সহজেই কিরূপ ধাবমান হয় ইহা দেখাইবার জন্য ধর্ম-ইতিহাসের দৃষ্টিতেও এই সূক্তের গুরুত্ব বুঝিয়া আশ্চর্য হইয়া অনেক পাশ্চাত্য পণ্ডিত আপনাপন ভাষায় তাহার চমৎকার ভাষান্তর করিয়াছেন । ইহা ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলের ১২৯তম সূক্ত হইতেছে; এবং এই সূক্তের প্রারম্ভিক শব্দ হইতে ইহাকে “নাসদীয় সূক্ত” বলে । এই সূক্তই তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণে [২|৮|৯] প্রদত্ত হইয়াছে; মহাভারতের নারায়ণীয় বা ভাগবত ধর্মে, এই সূক্তেরই আধারে ভগবদিচ্ছায় সর্বপ্রথমে জগতের সৃষ্টি কিরূপে হইল, তাহার বর্ণনা করা হইয়াছে [মভা শাং|৩৪২|৮] । সর্বানুক্ৰমণিকা অনুসারে ইহার ঋষি পরমেষ্টি প্রজাপতি, এবং দেবতা পরমাত্মা; ইহাতে ত্ৰিষ্টুভ বৃত্তের অর্থাৎ এগারো অক্ষরের চার চরণের সাত ঋক আছে । ‘সৎ’ ও ‘অসৎ’ শব্দ দ্ব্যর্থী হওয়া প্ৰযুক্ত জগতের মূল দ্রব্যকে ‘সৎ’ বলা সম্বন্ধে উপনিষৎকারদিগের যে মতভেদের কথা পূর্বে এই প্রকরণে উল্লেখ করিয়াছি সেই মতভেদ ঋগ্বেদেও দেখিতে পাওয়া যায় । উদাহরণ যথা - এই মূল কারণ সম্বন্ধে কোন স্থানে উক্ত হইয়াছে “একং সদ্‌বিপ্ৰা বহুধা বদন্তি” [ঋ|১|১৬৪|৪৬] কিংবা “একং সন্তং বহুধা কল্পয়ন্তি” [ঋ|১|১১৪|৫] - তিনি এক ও সৎ অর্থাৎ নিত্যস্থায়ী, কিন্তু তাঁহাকেই লোকে বিভিন্ন নাম দিয়া থাকে; আবার কোন কোন স্থলে ইহার উল্টাও বলা হইয়াছে যে, “দেবানাং পূর্ব্যে যুগেহসতঃ সদজায়ত” [ঋ|১০|৭২|৭] - দেবতাদেরও পূর্বে অসৎ অর্থাৎ অব্যক্ত হইতে ‘সৎ’ অর্থাৎ ব্যক্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে । ইহা ছাড়া, কোন-না-কোন এক দৃশ্য তত্ত্ব হইতে জগতের উৎপত্তি হওয়া সম্বন্ধে ঋগ্বেদেই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দেখা যায়; যেমন জগতের আরম্ভেমূল হিরণ্যগৰ্ভ ছিলেন, এবং অমৃত ও মৃত্যু এই দুই তাঁহারই ছায়া; তিনিই পরে সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিলেন [ঋ|১০|১২১|১|২] প্ৰথমে বিরাট্‌রূপী পুরুষ ছিলেন; তাঁহা হইতে যজ্ঞের দ্বারা সমস্ত জগৎ উৎপন্ন হইয়াছে [ঋ|১০|৯০]; প্ৰথমে আপ (জল) ছিল, তাহাতে প্ৰজাপতি উৎপন্ন হইলেন [ঋ|১০|৭২|৬; ১০|৮২|৬]; ঋত ও সত্য প্ৰথমে উৎপন্ন হইল, অনন্তর রাত্রি (অন্ধকার) ও তাহার পর সমুদ্র (জল), সম্বৎসর প্রভৃতি উৎপন্ন হইল [ঋ|১০|১৯০|১] । ঋগ্বেদে বর্ণিত এই মূল দ্রব্যসমূহের পরে অন্যান্য স্থানে এই প্রকার উল্লেখ করা হইয়াছে, যথা – (১) জলের, তৈত্তিরীয় ব্ৰাহ্মণে ‘আপো বা ইদমগ্রে সলিলমাসীৎ’ এই সমস্ত প্ৰথমে কেবল তরল জল ছিল [তৈ|ব্ৰা|১|১|৩|৫]; (২) অসতের, তৈত্তিরীয় উপনিষদে ‘অসদ্বা হদমগ্ৰ আসীৎ’ ইহা প্ৰথমে অসৎ ছিল [তৈ|২|৭]; (৩) সতের, ছান্দ্যোগ্যে ‘সদেব সৌম্যেদমগ্ৰ আসীৎ” এই সমস্ত প্ৰথমে সৎই ছিল [ছাং|৬|২]; কিংবা (৪) আকাশের, ‘আকাশঃ পরায়ণম্‌’ আকাশই সমস্তের মূল [ছাং|১|৯], (৫) মৃত্যুর, বৃহদারণ্যকে নৈবেহ কিঞ্চনাগ্ৰ ‘আসীন্মৃত্যুনৈবেদমাবৃতমাসীৎ’ প্ৰথমে ইহা কিছুই ছিল না, সমস্তই মৃত্যুর দ্বারা আচ্ছাদিত ছিল [বৃ|১|২|১]; এবং (৬) তমের, মৈক্র্যপনিষদে ‘তমো বা ইদমগ্ৰ আসীদেকম্‌’ [মৈ|৫|২] প্ৰথমে এই সমস্ত একমাত্র তম (তমোগুণী, অন্ধকার) ছিল - পরে তাহা হইতে রজ ও সত্ত্ব হইল । শেষে এই সকল বেদবচনের অনুসরণ করিয়া মনুস্মৃতিতে জগতের আরম্ভের বর্ণনা এই প্রকার করা হইয়াছে -
আসীদিদং তমোভূতমপ্ৰজ্ঞাতমলক্ষণম ৷
অপ্ৰতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং প্ৰসুপ্তমিব সর্বতঃ ॥
অর্থাৎ “এই সমস্ত প্ৰথমে তমের দ্বারা অর্থাৎ অন্ধকারের দ্বারা ব্যাপ্ত ছিল, ভেদাভেদ উপলব্ধি হইত না, অগম্য ও নিদ্রিতের ন্যায় ছিল; অনন্তর তাহার মধ্যে অব্যক্ত পরমাত্মা প্ৰবেশ করিয়া প্ৰথমে জল উৎপন্ন করিলেন” – [মনু|১|৫-৮] । জগৎ আরম্ভের মূলদ্রব্যসম্বন্ধে উক্ত বৰ্ণনা কিংবা এইপ্ৰকার ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা নাসদীয় সূক্তের সময়েও অবশ্য প্রচলিত ছিল; এবং সেই সময়েও ইহাদের মধ্যে কোন মূলদ্রব্য সত্য ধরা যাইবে এই প্রশ্ন উপস্থিত হইয়াছিল । তাই উহার সত্যাংশ সম্বন্ধে এই সূক্তের ঋষি বলিতেছেন যে -
নাসদাসীন্নো সদাসীৎ তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরে যৎ ৷
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্‌ গহনং গভীরম্‌ ॥ ১ ॥
১ । তখন অর্থাৎ মূলারম্ভে অসৎ ছিল না এবং সৎও ছিল না । অন্তরীক্ষ ছিল না এবং তাহারও অতীত আকাশও ছিল না । (এইরূপ অবস্থাতে) কে (কাহাকে) আবরণ করিল ? কোথায় ? কাহার সুখের জন্য ? অগাধ ও গহন জলও কোথায় ছিল ? 
(প্ৰথম ঋক্‌ - চতুর্থ চরণে ‘আসিৎ কিং’ এই অন্বয় করিয়া আমি উক্ত অর্থ দিয়াছি; এবং উহার ভাবার্থ হইতেছে ‘জল সে সময়ে ছিল না’ [তৈ|ব্রা|২|২|৯ দেখ] ।)
ন মৃত্যুরাসীদ্‌ মৃতং ন তর্হি ন রাত্ৰ্যা অহ্ন আসীৎ প্ৰকেতঃ ৷
আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধান্যন্ন পরঃ কিঞ্চনাহস ॥ ২ ॥
২ । তখন মৃত্যু অর্থাৎ মৃত্যুগ্রস্ত নশ্বর দৃশ্য জগৎ সৃষ্ট হয় নাই, সেইজন্য (অন্য) অমৃত অর্থাৎ অবিনাশী নিত্য পদার্থ (এই ভেদ)ও ছিল না । (এইপ্ৰকার) রাত্রি ও দিনের ভেদ জানিবার কোন সাধন (=প্রকেত) ছিল না । (যাহা ছিল) তাহা একমাত্র আপনি শক্তি (স্বধা) দ্বারাই বায়ু বিনা শ্বাসোচ্ছ্বাস করিত অর্থাৎ স্ফূৰ্ত্তিমান হইত । তাহা ব্যতীত কিংবা তাহার বাহিরে অন্য কিছুই ছিল না ।
তম আসীত্তমসা গৃঢ়মগ্রেহপ্ৰকেতং সলিলঃ সর্বমা ইদম্‌ ৷
তুচ্ছেনান্বপিহিতং যদাসীৎ তপসস্তন্মহিনাহজায়তৈকম্‌ ॥ ৩ ॥
৩ । যে (যৎ) এইরূপ বলা যায় যে, অন্ধকার ছিল, আরম্ভে এই সমস্ত অন্ধকারে ব্যাপ্ত (এবং) ভেদাভেদবিরহিত জল ছিল, কিংবা আভু অর্থাৎ সর্বব্যাপী ব্ৰহ্ম (আরম্ভেই) তুচ্ছের দ্বারা অর্থাৎ মিথ্যা মায়ার দ্বারা আচ্ছাদিত ছিলেন, তাহা (তৎ) মূলে এক (ব্রহ্মই) তপের মহিম্র দ্বারা (রূপান্তরে পরে) প্রকট হইয়াছিলেন ।
(তৃতীয় ঋক্‌ - কেহ কেহ ইহার প্রথম তিন চরণ স্বতন্ত্র কল্পনা করিয়া উহার এইরূপ বিধানাত্মক অর্থ করেন যে, “অন্ধকার, অন্ধকারে পরিব্যাপ্ত জল, কিংবা তুচ্ছের দ্বারা আচ্ছাদিত আভু (শূন্যগর্ভ) ছিলেন” । কিন্তু আমার মতে ইহা ভুল । কারণ প্রথম দুই ঋকে, মূলারম্ভে কিছুই ছিল না এইরূপ যখন স্পষ্ট বিধান আছে, তখন তাহার বিপরীত, অন্ধকার কিংবা জল মূলারম্ভে ছিল, এই সূক্তে ইহা উক্ত হইতে পারে না । তাছাড়া, এইরূপ অৰ্থ করিলেও তৃতীয় চরণের যৎ শব্দকে নিরর্থক মানিতে হয় । তাই তৃতীয় চরণের যৎ-এর সহিত চতুর্থ চরণের তৎ পদের সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া উপরি-উক্ত অর্থ করা আবশ্যক বলিয়া মনে করি । ‘মূলারম্ভে জল প্রভৃতি পদার্থ ছিল’ এইরূপ যাহারা বলে তাহাদের উত্তরস্বরূপে এই ঋক্ এই সূক্তে আসিয়াছে; এবং তোমার কথা অনুসারে তম, জল, প্রভৃতি পদার্থ মূলে ছিল না, উহা এক ব্ৰহ্মেরই পরবর্তী বিস্তুার, এইরূপ বলাই ঋষির উদ্দেশ্য । ‘তুচ্ছ’ ও ‘আভু’ এই দুই শব্দ পরস্পর-প্রতিযোগী হওয়া প্রযুক্ত তুচ্ছের বিপরীত আভু শব্দের অর্থ বড় কিংবা সমর্থ হইতেছে; এবং ঋগ্‌বেদে অন্য যে দুই স্থানে এই শব্দ আসিয়াছে [ঋ|১০|২৭|১|৪] তথায় সায়ণাচার্যও উহার এই অর্থই করিয়াছেন । পঞ্চদশীতে [চিত্র|১২৯|১৩০] তুচ্ছ এই শব্দ মায়ার প্রতি প্ৰযুক্ত হইয়াছে [নৃসিং|উত্ত|৯ দেখ], সুতরাং আভুর অৰ্থ শূন্যগর্ভ না হইয়া ‘পরব্রহ্ম’ই হইতেছে । ‘সৰ্ব্বং আঃ ইদম্’ এই স্থানে আঃ (আ + অস্‌) অস্‌ ধাতুর ভূতকালের রূপ; তাহার অর্থ ‘আসীৎ’ ।)
কামন্তদগ্রে সমবৰ্ত্ততাধি মনসো রেতঃ প্ৰথমং যদাসীৎ ৷
সতো বন্ধুমসতি নিরবিন্দন্‌ হৃদি প্রতীষ্যা কবয়ো মনীষা ॥ ৪ ॥
৪ । ইহার মনের যে রেত অর্থাৎ বীজ প্ৰথমে নিঃসৃত হয় তাহাই আরম্ভে কাম (অর্থাৎ জগৎ সৃষ্টি করিবার প্রবৃত্তি কিংবা শক্তি) হইয়াছে । জ্ঞানীরা অন্তঃকরণে বিচার করিয়া বুদ্ধির দ্বারা নির্ধারণ করিয়াছেন যে, (ইহাই) অসৎ-এর মধ্যে অর্থাৎ মূল পরব্রহ্মের মধ্যে সৎ-এর অর্থাৎ নশ্বর দৃশ্য জগতের (প্ৰথম) সম্বন্ধ ।
তিরশ্চীনো বিততো রশ্মিরেষাম্‌ অধঃ স্বিদাসীদুপরি স্বিদাসীৎ ৷
রেতোধা আসন্‌ মহিমান আসন্‌ স্বধা অবস্তাৎ প্ৰযতিঃ পরস্তাৎ ॥ ৫ ॥
৫ । (এই) রশ্মি বা সূত্র বা কিরণ ইহার মধ্যে অন্তরালরূপে প্রসারিত; এবং যদি বল যে ইহা নীচে ছিল তবে ইহা উপরেও ছিল । (ইহাদের ভিতর কিছু) রেতোধা অর্থাৎ বীজপ্ৰদ হয় এবং (বাড়িয়া) বড়ও হয় । তাহারই স্বশক্তি এদিকে ছিল এবং প্ৰযতি অর্থাৎ প্রভাব ওদিকে (ব্যাপ্ত) হইয়া থাকে । 
কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্ৰ বোচৎ কুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ ৷
অর্বাগ্‌ দেবা অস্য বিসর্জনেনাথ কো বেদ যত আবভূব ॥ ৬ ॥
৬ । (সৎ-এর) এই বিসর্গ অর্থাৎ বিস্তার কাহা হইতে বা কোথা হইতে আসিল - ইহা (ইহা অপেক্ষা অধিক) প্ৰ অৰ্থাৎ বিস্তারপূর্বক এখানে কে বলিবে ? কে ইহাকে নিশ্চিত জানে ? দেবতারাও এই (সৎ জগতের) বিসর্গের পরে হইল । আবার উহা যেখান হইতে নিঃসৃত হইল, তাহা কে জানিবে ?
ইয়ং বিসৃষ্টিৰ্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন ৷
যো অসাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্‌ সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ ॥ ৭ ॥
৭ । (সৎ-এর) এই বিসর্গ অর্থাৎ বিস্তার যেখান হইতে আসিয়াছে, কিংবা সৃষ্ট হইয়াছে বা হয় নাই, - তাহাই পরম আকাশে অবস্থিত এই জগতের যে অধ্যক্ষ (হিরণ্যগৰ্ভ), তিনিই জানেন; কিংবা না জানিতেও পারেন ! (কে বলিতে পারে) ?

চক্ষের বা সাধারণত সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ের গোচর সবিকার ও বিনশ্বর নামরূপাত্মক নানা দৃশ্যের জালে বিজড়িত না থাকিয়া তাহার অতীত কোন এক ও অমৃত তত্ত্ব আছে ইহা জ্ঞানদৃষ্টিতে উপলব্ধি করাই সমস্ত বেদান্তশাস্ত্রের রহস্য । এই মাখনের গোলা পাইবার জন্যই উক্ত সূক্তের ঋষির বুদ্ধি একেবারেই দৌড়িয়া গিয়াছিল; ইহা হইতে স্পষ্ট দেখা যায় যে, তাঁহার অন্তদৃষ্টি কত তীব্র ছিল ! মূলারম্ভে অর্থাৎ জগতের নানা পদার্থ অস্তিত্বে আসিবার পূর্বে যাহা কিছু ছিল তাহা সৎ বা অসৎ, মৃত্যু বা অমৃত, আকাশ বা জল, আলো বা অন্ধকার ছিল, ইত্যাদি অনেক প্ৰশ্নকারীদিগের সহিত বিবাদ করিতে না বসিয়া, উক্ত ঋষি সকলের পুরোভাগে ধাবমান হইয়া বলিলেন যে, সৎ ও অসৎ, মৰ্ত্ত্য ও অমৃত, অন্ধকার ও আলো, আচ্ছাদনকারী ও আচ্ছাদিত, সুখদাতা ও সুখভোক্তা, এই প্রকার দ্বৈতের পরস্পরসাপেক্ষ ভাষা দৃশ্য জগতের সৃষ্টির পরে হওয়ায়, জগতে এই দ্বন্দ্ব উৎপন্ন হইবার পূর্বে, অর্থাৎ এক ও দুই এই ভেদও যখন ছিল না, তখন কে কাহাকে আচ্ছাদিত করিত ? তাই এই সূক্তের ঋষি আরম্ভেই নিৰ্ভয়ে বলিতেছেন যে, মূলারম্ভের এক দ্রব্যকে সৎ বা অসৎ, আকাশ বা জল, আলো বা অন্ধকার, অমৃত বা মৃত্যু ইত্যাদি পরস্পরসাপেক্ষ কোন নাম দেওয়া উচিত নহে; যাহা কিছু ছিল তাহা এই সমস্ত পদার্থ হইতে ভিন্ন ছিল এবং তাহা একমাত্র একই চতুর্দিকে আপনার অপার শক্তিতে স্ফূৰ্ত্তিমান ছিল; তাহার জুড়ী কিংবা তাহার আচ্ছাদক অন্য কিছুই ছিল না । দ্বিতীয় ঋকে ‘আনীৎ’ এই ক্রিয়াপদের ‘অন্‌’ ধাতুর অর্থ শ্বাসোচ্ছাস গ্ৰহণ করা বা স্ফুরণ হওয়া, এবং ‘প্ৰাণ’ শব্দও সেই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন হইয়াছে; কিন্তু যাহা না সৎ এবং না-অসৎ, তাহা সজীব প্রাণীর ন্যায় শ্বাসোচ্ছ্বাস গ্ৰহণ করিতেছিল, তাহা কে বলিতে পারে ? এবং শ্বাসোচ্ছ্বাস চলিবার জন্য তখন বায়ুই বা কোথায় ? তাই ‘আনীৎ’ এই পদের সঙ্গেই ‘অবাতং’ = বায়ুহীন, ও ‘স্বধয়া’ = আপনার নিজ মহিমাতে - এই দুই পদ জুড়িয়া “জগতের মূলতত্ত্ব জড় ছিল না” এই অদ্বৈতাবস্থার অর্থ দ্বৈতের ভাষায় খুব নিপুণভাবে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে যে, “তাহা এক বায়ু বিনা আপন শক্তিতেই শ্বাসোচ্ছ্বাস করিতেছিল কিংবা স্ফুরিত হইতেছিল” । ইহাতে বাহ্য দৃষ্টিতে যে বিরোধ দেখা যায়, তাহা দ্বৈতী ভাষার অপূর্ণতাপ্রযুক্ত উৎপন্ন হইয়াছে । “নেতি নেতি” “একমেবাদ্বিতীয়ম্‌” বা “স্বে মহিম্নি প্রতিষ্ঠিতঃ” [ছাং|৭|২৪|১] – আপনারই মহিমাতে অর্থাৎ অন্য কাহারও অপেক্ষা না রাখিয়া একাই অবস্থিত - ইত্যাদি পরব্রহ্মের যে বর্ণনা উপনিষদে আছে তাহাও উপরোক্ত অর্থেরই দ্যোতক । সমস্ত জগতের মূলারম্ভে চারিদিকে যে অনিৰ্বাচ্য তত্ত্ব স্ফূরিত ছিল বলিয়া এই সূক্তে উক্ত হইয়াছে, সমস্ত দৃশ্য জগতের প্ৰলয় হইলেও তাহাই নিঃসন্দেহ অবশিষ্ট থাকিবে । তাই গীতাতে “সমস্ত পদার্থের নাশ হইলেও যাহার নাশ হয় না” [গী|৮|২০], এইরূপ এই পরব্ৰহ্মেরই কোন পর্যায়ে বর্ণনা করা হইয়াছে; এবং পরে এই সূক্ত ধরিয়াই স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, “তাহা সৎও নহে, অসৎও নহে” [গী|১৩|১২] । কিন্তু প্রশ্ন এই যে, নির্গুণ ব্ৰহ্ম ব্যতীত মূলারম্ভে যদি অন্য কিছুই ছিল না তবে “আরম্ভে জল, অন্ধকার, বা আভু ও তুচ্ছ ইহাদের দ্বন্দ্ব ছিল” ইত্যাদি যে বৰ্ণনা বেদেতে আছে তাহার ব্যবস্থা কি হইবে ? তাই, তৃতীয় খকে কবি বলিতেছেন যে, জগতের আরম্ভে অন্ধকার ছিল কিংবা অন্ধকারে আবৃত জল ছিল, কিংবা আভু (ব্ৰহ্ম) ও তাঁহার আচ্ছাদনকারী মায়া (তুচ্ছ) এই দুই প্রথম হইতেই ছিল ইত্যাদি, ঐ সমস্ত যখন একমাত্র মূল পরব্রহ্মের তপমাহাত্ম্যে তাঁহার বিবিধ রূপে বিস্তার হইয়াছিল সেই সময়েরই — এইরূপ যত বৰ্ণনা তাহা মূলারম্ভের স্থিতিবিষয়ক নহে । এই ঋকে ‘তপ’ শব্দে মূল ব্রহ্মের জ্ঞানময় বিশেষ শক্তি বিবক্ষিত এবং তাহার বর্ণনা চতুর্থ ঋকে করা হইয়াছে [মুং|১|১|৯ দেখ]“এতাবান্‌ অস্য মহিমাহতো জ্যায়াংশ্চ পুরুষঃ” [ঋ|১০|৯০|৩] এই ন্যায় অনুসারে সমস্ত জগৎই যাহার মহিমা, সেই মূল দ্রব্য যে এই সমস্তের অতীত, সমস্ত হইতে শ্ৰেষ্ঠ ও ভিন্ন, তাহা আর বলিতে হইবে না । কিন্তু দৃশ্য বস্তু ও দ্রষ্টা, ভোক্তা ও ভোগ্য, আচ্ছাদক ও আচ্ছাদ্য, অন্ধকার ও আলো, মৃত্যু ও অমৃত ইত্যাদি সমস্ত দ্বৈতকে এই প্ৰকার পৃথক করিয়া এক অমিশ্ৰ চিদ্‌রূপী, অসাধারণ পরব্রহ্মই মূলারম্ভে ছিলেন ইহা নির্ধারণ করিলেও যখন ইহা বুঝাইবার সময় আসিয়াছে যে, এই অনির্বাচ্য নির্গুণ একমাত্ৰ এক তত্ত্ব হইতে আকাশ, জল প্ৰভৃতি দ্বন্দ্বাত্মক নশ্বর সগুণ নামরূপাত্মক বিবিধ সৃষ্টি কিংবা এই জগতের মূলভূত ত্ৰিগুণাত্মক প্রকৃতি কিরূপে উৎপন্ন হইল, তখন তো আমাদের উল্লিখিত ঋষিকেও মন, কাম, অসৎ ও সৎ এইরূপ দ্বৈতের ভাষাই প্রয়োগ করিতে হইয়াছে; এবং শেষে ঋষি স্পষ্ট বলিয়া দিয়াছেন যে, এই প্রশ্ন মনুষ্যের বুদ্ধির সীমার বাহিরে । চতুর্থ ঋকে মূল ব্ৰহ্মকেই ‘অসৎ’ বলা হইয়াছে; কিন্তু তাহার অর্থ “কিছু নাই” ইহা গ্ৰহণ করিতে পারা যায় না; কারণ দ্বিতীয় ঋকেই ‘তাহা আছে’ এইরূপ স্পষ্ট বিধান আছে । শুধু এই সূক্তে নহে, কিন্তু অন্যত্রও দৃশ্য জগতের সহিত যজ্ঞের উপমা দিয়া এই যজ্ঞ করিবার ঘৃত, সমিধ প্রভৃতি সামগ্ৰী প্ৰথমে কোথা হইতে আসিল [ঋ|১০|১৩০|৩] ? কিংবা গৃহের দৃষ্টান্ত লইয়া মূল এক নির্গুণ হইতে চক্ষুর প্রত্যক্ষগোচর আকাশ পৃথিবীর এই বৃহৎ অট্টালিকা গঠন করিবার কাষ্ঠন (মূল প্ৰকৃতি) কোথা হইতে মিলিল ? - কিস্বিদ্বনং ক উ স বৃক্ষ আস যতো দ্যাবা পৃথিবী নিষ্টতক্ষুঃ, এইরূপ ব্যবহারিক ভাষা স্বীকার করিয়াই ঋগ্‌বেদ ও বাজসনেয়ীসংহিতায় কঠিন বিষয়সমূহের বিচার এই প্রকার প্ৰশ্ন দ্বারা করা হইয়াছে [ঋ|১০|৩১|৭; ১০|৮১|৪; বাজ সং|১৭|২৭] । সেই অনিৰ্বাচ্য একমাত্ৰ এক ব্ৰহ্মেরই মনে জগৎ সৃষ্টি করিবার ‘কাম’-রূপী তত্ত্ব কোন প্রকারে উৎপন্ন হইয়াছে, এবং বস্ত্রের সূত্রের ন্যায় কিংবা সূর্যালোকের ন্যায় তাহারই শাখা বাহির হইয়া নীচে উপর চারিদিকে প্রসারিত হইয়া সৎএর সমস্ত বিস্তার হইয়াছে অর্থাৎ আকাশপৃথিবী-রূপ এই বৃহৎ অট্টালিকা নির্মিত হইয়াছে, উপরোক্ত সূক্তের চতুর্থ ও পঞ্চম ঋকে [বাজ সং|৩৩|৭৪ দেখ] এইরূপ যাহা উক্ত হইয়াছে, তাহা অপেক্ষা এই প্রশ্নের বেশী উত্তর দেওয়া যাইতে পারে না । এই সূক্তের অর্থও উপনিষদে আরও স্পষ্ট করা হইয়াছে - “সোহকাময়ত ৷ বহু স্যাং প্ৰজায়েয়েতি ৷” [তৈ|২|৬; ছাং|৬|২,৩] - সেই পরব্রহ্মেরই বহু হইবার ইচ্ছা হইল – [বৃ|১|৪ দেখ]; অথর্ববেদেও এইরূপ বর্ণনা আছে যে, এই সমস্ত দৃশ্য জগতের মূলভূত দ্রব্য হইতেই সর্ব প্ৰথমে ‘কাম’ উৎপন্ন হইল, [অথর্ব|৯|২|১৯] । কিন্তু এই সূক্তের বিশেষত্ব এই যে, নির্গুণ হইতে সগুণের, অসৎ হইতে সৎ-এর, নির্দ্বন্দ্ব হইতে দ্বন্দ্বের কিংবা অসঙ্গ হইতে সঙ্গের উৎপত্তির প্রশ্ন মানব-বুদ্ধির অগম্য বলিয়া সাংখ্যের ন্যায় কেবলমাত্র তর্কের বশীভূত হইয়া মূল প্রকৃতিকেই বা তাহার ন্যায় অন্য কোন তত্ত্বকে স্বয়ংভূ ও স্বতন্ত্র মানা হয় নাই; কিন্তু এই সূক্তের ঋষি প্ৰতিপাদন করিতেছেন যে, “যাহা বুঝা যায় নাই, স্পষ্ট বল যে তাহা বুঝা যায় নাই; কিন্তু সেই জন্য শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা ও আত্মপ্ৰতীতির দ্বারা অবধারিত অনির্বাচ্য ব্ৰহ্মের যোগ্যতাকে দৃশ্য জগৎরূপ মায়ার উপর আরোপ করিয়া পরব্রহ্মসম্বন্ধে অদ্বৈত বুদ্ধি ছাড়িয়া দেওয়া ন্যায্য নহে !” তাছাড়া, ইহা দেখিতে হইবে যে, প্রকৃতিকে এক স্বতন্তু ত্রিগুণাত্মক ভিন্ন পদাৰ্থ বলিয়া মানিলেও তাহাতে জগৎ সৃষ্টি করিবার জন্য বুদ্ধি (মহান) বা অহঙ্কার প্রথমে কি করিয়া উৎপন্ন হইল, এই প্রশ্নের উত্তর তো দেওয়া যায় না । এবং এই দোষ যখন কিছুতে এড়ানো যায় না, তখন প্রকৃতিকে আবার স্বতন্ত্র বলিয়া মানিলেই বা কি লাভ ? মূল ব্ৰহ্ম হইতে সৎ অর্থাৎ প্ৰকৃতি কিরূপে উৎপন্ন হইল তাহা জানা যায় না এইটুকুই বল । ইহার জন্য প্রকৃতিকে স্বতন্ত্র বলিয়া মানিবার কোনই আবশ্যকতা নাই । মানববুদ্ধির কথা দূরে থাক্‌, সৎ-এর উৎপত্তি কিরূপে হইল, দেবতারাও তাহা জানিতে পারেন না । কারণ দেবতারাও দৃশ্য জগৎ আরম্ভ হইবার পর উৎপন্ন হওয়ায়, তাহার পুর্বের ব্যাপার তাহারা কি প্রকারে জানিবেন ? [গী|১০|২ দেখ] । কিন্তু দেবতাদের অপেক্ষাও হিরণ্যগৰ্ভ অনেক প্রাচীন ও শ্ৰেষ্ঠ এবং ঋগ্‌বেদেই উক্ত হইয়াছে যে, একমাত্ৰ তিনিই আরম্ভে “ভূতস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ” [ঋ|১০|১২১|১] - সমস্ত জগতের ‘পতি’ অর্থাৎ ‘রাজা’ বা অধ্যক্ষ ছিলেন । তখন তিনি এই বিষয় জানিতে পারিবেন না কেন ? এবং তিনি যদি জানিয়া থাকেন, তবে উহা দুৰ্ব্বোধ কেন বলিতেছ, এইরূপ কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারেন । তাই, এই সূক্তের ঋষি প্ৰথমে তো উক্ত প্রশ্নের এই ঔপচারিক উত্তর দিলেন যে, -“হাঁ; তিনি এই বিষয় জানিয়া থাকিবেন”; কিন্তু আপনি বুদ্ধির দ্বারা ব্ৰহ্মদেবেরও জ্ঞানের গভীরতা-দ্ৰষ্টা এই ঋষি আশ্চর্য হইয়া শেষে সভয়ে তখনই আবার বলিয়াছেন যে, “অথবা নাও জানিতে পারেন ! কে বলিবে ? কারণ তিনিও সৎএর শ্রেণীতে পড়ায়, ‘পরম’ বলা হইলেও ‘আকাশের’ মধ্যেই অবস্থিত জগতের এই অধ্যক্ষের সৎ, অসৎ, আকাশ ও জল ইহাদেরও পূৰ্ববৰ্ত্তী বিষয়সম্বন্ধে নিশ্চিত জ্ঞান কোথা হইতে আসিবে ?” কিন্তু এক ‘অসৎ’ অর্থাৎ অব্যক্ত ও নির্গুণ দ্রব্যেরই সহিত বিবিধ নামরূপাত্মক সৎ-এর অর্থাৎ মূলপ্ৰকৃতির সম্বন্ধ কিরূপে স্থাপিত হইল ইহা বুঝা না গেলেও মূলব্ৰহ্ম যে একই সে বিষয়ে ঋষি নিজের অদ্বৈতবুদ্ধিকে অপসারিত হইতে দেন নাই । এ বিষয়ে এই একটী উৎকৃষ্ট উদাহরণ যে, অচিন্ত্য বস্তুর গহন-অরণ্যে মানববুদ্ধি, সাত্ত্বিক শ্রদ্ধা ও নির্মল প্রতিভার বলে সিংহের ন্যায় নির্ভয়ে বিচরণ করিয়া সেখানে তর্কের অতীত বিষয় যথাশক্তি কেমন নির্ধারণ করিয়া থাকে ! ঋগ্‌বেদে যে এইরূপ সূক্ত পাওয়া যায় ইহা বাস্তবিকই আশ্চর্য ও গৌরবের বিষয় ! এই সুক্তান্তৰ্গত বিষয়সম্বন্ধে পরে আমাদের দেশে ব্ৰাহ্মণে [তৈত্তি ব্ৰা|২|৮|৯], উপনিষদে, এবং তাহার পরে বেদান্তশাস্ত্ৰবিষয়ক গ্রন্থে সূক্ষ্মভাবে বিচার করা হইয়াছে । এবং আধুনিককালে পাশ্চাত্য দেশেও কাণ্ট প্রভৃতি তত্ত্বজ্ঞানী কর্তৃক ঐ বিষয়েরই অনেক সূক্ষ্ম আলোচনা করা হইয়াছে । কিন্তু মনে রেখো যে, এই সূক্তের ঋষির শুদ্ধ বুদ্ধিতে যে পরম সিদ্ধান্তের স্ফুরণ হইয়াছে সেই সিদ্ধান্তই পরে প্রতিপক্ষকে বিবৰ্ত্তবাদের ন্যায় সমুচিত উত্তর প্রদান করিয়া আরও দৃঢ়, স্পষ্ট কিংবা তর্কদৃষ্টিতে নিঃসন্দেহ করিয়াছে — ইহার পরে এখনও কেহ অগ্রসর হইতে সমর্থ হয় নাই, সমর্থ হইবে বলিয়া অধিক আশাও নাই ।


38) পূর্বাপর প্রকরণের সঙ্গতি


অধ্যাত্মপ্রকরণ সমাপ্ত হইল ! এক্ষণে অগ্ৰে চলিবার পূর্বে ‘কেসরী’র অনুকরণে যে রাস্তা ধরিয়া এতক্ষণ চলা গেল তাহার প্রতি আর একবার কটাক্ষপাত করা উচিত । কারণ, এইরূপ সিংহাবলোকন না করিলে, প্ৰকৃত বিষয়ানুসন্ধান হইতে ভ্ৰষ্ট হইয়া অন্য পথে বিচরণ করিবার সম্ভাবনা থাকে । গ্রন্থের আরম্ভে পাঠককে বিষয়ের মধ্যে প্ৰবেশ করাইয়া দিয়া কর্মজিজ্ঞাসার স্বরূপ সংক্ষেপে বলিয়া তৃতীয় প্রকরণে কর্মযোগশাস্ত্ৰই গীতার যে মূখ্য প্রতিপাদ্য বিষয় তাহা দেখান হইয়াছে । অনন্তর, চতুৰ্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ প্রকরণে সুখদুঃখবিচারপূর্বক প্রতিপাদন করা হইয়াছে যে, এই শাস্ত্রের আধিভৌতিক উপপত্তি একদেশদর্শী ও অপূর্ণ, এবং আধিদৈবিক উপপত্তি খঞ্জ । আবার কর্মযোগের আধ্যাত্মিক উপপত্তি বলিবার পূর্বে, আত্মা কি তাহা জানিবার জন্য ষষ্ঠ প্রকরণে প্ৰথমেই ক্ষেত্ৰক্ষেত্ৰজ্ঞবিচার এবং পরে সপ্তম ও অষ্টম প্রকরণে সাংখ্যশাস্ত্ৰাৰ্গত দ্বৈতমতের ক্ষরাক্ষরবিচার করা হইয়াছে । আবার এই প্রকরণে আসিয়া আত্মার স্বরূপ কি এবং পিণ্ড ও ব্ৰহ্মাণ্ডে দুইদিকে একই অমৃত ও নির্গুণ আত্মতত্ত্ব কিরূপে ওত-প্রোত ও পরিপূর্ণ হইয়া আছে তাহার নিরূপণ করিয়াছি । এই প্রকার এখানে ইহাও নির্ধারণ করা হইয়াছে যে, সর্বভূতে একই আত্মা - এই সমবুদ্ধিযোগ সম্পাদনা করিয়া তাহা সর্বদাই জাগৃত রাখাই আত্মজ্ঞান ও আত্মসুখের পরাকাষ্ঠা; এবং আরও বলা গিয়াছে যে, নিজের বুদ্ধিকে এইরূপ শুদ্ধ আত্মনিষ্ঠাবস্থায় আনাতেই মনুষ্যের মনুষ্যত্ব অর্থাৎ নরদেহের সার্থকতা বা মনুষ্যের পরম পুরুষাৰ্থ । এই প্ৰকার মানবজাতির আধ্যাত্মিক পরমসাধ্যের নির্ণয় হইলে পর, সংসারে আমাদের যে ব্যবহার করিতে হয় তাহা কি ভাবে করিতে হইবে, কিংবা যে শুদ্ধ বুদ্ধিতে এই ব্যবহার করিতে হইবে তাহার স্বরূপ কি - এই যে কর্মযোগশাস্ত্রের মুখ্য প্রশ্ন তাহারও মীমাংসা সহজ হইয়া পড়ে । কারণ এই সমস্ত ব্যবহার পরিণামে ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ সমবুদ্ধির পোষক, কিংবা অবিরোধীভাবে যে করিতে হইবে ইহা আর এক্ষণে বলিতে হইবে না । কর্মযোগের এই আধ্যাত্মিক তত্ত্ব ভগবদ্‌গীতায় অর্জুনকে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে । কিন্তু কর্মযোগের প্ৰতিপাদন কেবল ইহাতেই শেষ হয় না । কারণ কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, নামরূপাত্মক জগতের ব্যবহার আত্মজ্ঞানের বিরুদ্ধ হওয়ায় তাহা জ্ঞানীপুরুষের ত্যাগ করা উচিত; এবং ইহাই যদি সত্য হয়, তবে জগতের সমস্ত ব্যবহার ত্যাজ্য নির্ধারিত হইবে এবং কর্মাকর্মশাস্ত্ৰও নিরর্থক হইবে ! তাই এই বিষয়ের নির্ণয় করিবার জন্য কর্মের নিয়ম কি, ও তাহার পরিণাম কি, অথবা বুদ্ধি শুদ্ধ হইলেও ব্যবহার অর্থাৎ কর্ম কেন করিতে হইবে ইত্যাদি প্রশ্নেরও কর্মযোগশাস্ত্রে অবশ্য বিচার করা আবশ্যক । ভগবদ্‌গীতাতে তাহারও বিচার করা, হইয়াছে । সন্ন্যাসমাৰ্গীয় লোকেরা এই প্রশ্নের কোনই গুরুত্ব উপলব্ধি না করায় ভগবদ্‌গীতার বেদান্ত বা ভক্তিবিষয়ক নিরূপণ শেষ হইতে না হইতেই, তাঁহারা আপন পুঁথি গুটাইতে প্ৰায় শুরু করিয়া দেন । কিন্তু সেরূপ করিলে আমার মতে গীতার মুখ্য অভিপ্ৰায়ের প্রতি উপেক্ষা করা হয় । এইজন্য ভগবদ্‌গীতায় উক্ত প্রশ্নের কি উত্তর প্রদত্ত হইয়াছে এক্ষণে ক্রমশঃ তাহার আলোচনা করিব ।


ইতি নবম প্রকরণ সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment