Sunday, June 4, 2017

আধিভৌতিক সুখবাদ (Materialistic Theory of Happiness)

আধিভৌতিক সুখবাদ


দুঃখাদুদ্বিজতে সৰ্ব্বঃ সর্ব্বস্য সুখমীপ্সিতম্‌ ৷ [মভা|শান্তি|১৩৯|৬১]

(দুঃখ সকলকেই উদ্বেজিত করে, সুখ সকলেরই অভীপ্সিত ।)


সূচীপত্র



1) ভূমিকা - কর্মাকর্মের বিচার
2) আধিভৌতিক মার্গ
3) আধিভৌতিক সুখবাদের শ্রেণীবিভাগ
3.1) কেবল স্বার্থ (চার্বাক/জাবালি/কণিক)
3.2) দূরদর্শী স্বার্থ (হব্‌স/হেল্‌বেশিয়াস্‌)
3.2.1) স্বার্থ-বুদ্ধির ন্যায়ই পরোপকারবুদ্ধিও স্বাভাবিক
3.2.2) যাজ্ঞবল্ক্যের আত্মার্থ
3.3) উদাত্ত / জ্ঞানদীপ্ত / উচ্চ স্বার্থ (স্বার্থ-পরার্থ-উভয় বাদ)
আপত্তি
3.4) অধিক লোকের অধিক সুখ - পরার্থপ্রধান মাৰ্গ
আপত্তি-১ : কেবল সংখ্যাধিক্য দ্বারা নীতি নির্ধারণ
আপত্তি-২ : কে নিশ্চিত করিবে যে, অধিকাংশ লোকের অধিক সুখ কি ?
আপত্তি-৩ : কর্ম অপেক্ষা কর্তার বুদ্ধির মহত্ব
আপত্তি-৪ : পরোপকার কেন করা চাই ?
3.4.1) মনুষ্যজাতির পূর্ণ অবস্থা
4) সুখদুঃখের অনিত্যতা এবং নীতিধর্মের নিত্যতা


1) ভূমিকা - কর্মাকর্মের বিচার


মনুপ্ৰভৃতি শাস্ত্রকারদিগের “অহিংসাসত্যমস্তেয়ং” ইত্যাদি নিয়ম স্থাপন করিবার কারণ কি, উহা নিত্য কি অনিত্য, উহাদের ব্যাপ্তি কিরূপ, উহাদের মূলতত্ত্বটি কি, এবং উহাদের মধ্যে কোন দুইটী পরস্পরবিরোধী ধর্ম একই সময়ে আসিয়া পড়িলে, কোন মাৰ্গ স্বীকার করা যাইবে, ইত্যাদি প্রশ্নের “মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ”, কিংবা “অতি সর্বত্ৰ বৰ্জয়েৎ” এইরূপ সাধারণ যুক্তির দ্বারা নিষ্পত্তি হইতে পারে না । এই সকল প্রশ্নের উচিত নির্ণয় কি প্রকারে হয় এবং শ্রেয়স্কর মার্গ কোনটি তাহা স্থির করিবার জন্য নির্ভুল যুক্তি কি, তাহা এক্ষণে দেখিতে হইবে; অর্থাৎ জানা চাই যে, পরস্পরবিরুদ্ধ ধর্মসমূহের লাঘব ও গৌরব, ন্যূনাধিক মহত্ব কোন দৃষ্টিতে নির্ধারণ করা যাইতে পারে । অন্য শাস্ত্রীয় প্ৰতিপাদন অনুসারে কর্মাকর্মবিচার সম্বন্ধীয় প্ৰশ্নসমূহের মীমাংসা করিবার আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক এই তিন মাৰ্গ আছে । এই মাৰ্গত্ৰয়ের ভেদ কি, তাহা পূর্বপ্রকরণে বলিয়াছি । আমাদের শাস্ত্ৰকর্তাদিগের মতে, এই সকলের মধ্যে আধ্যাত্মিক মাৰ্গই শ্রেষ্ঠ । কিন্তু অধ্যাত্মমার্গের মহত্ত্ব পূর্ণরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইলে অন্য দুই মার্গেরও বিচার করা আবশ্যক, তাই প্ৰথমে এই প্রকরণে কর্মাকর্ম পরীক্ষণের আধিভৌতিক মূলতত্ত্বের চর্চা করা হইয়াছে । 


2) আধিভৌতিক মার্গ


যে আধিভৌতিক শাস্ত্রের আজকাল অনেক উন্নতি হইয়াছে তাহাতে ব্যক্ত পদার্থসমূহের বাহ্য ও দৃশ্য গুণেরই বিচার বিশেষভাবে করা হয় । এইজন্য আধিভৌতিক শাস্ত্ৰাদির অধ্যয়নে যাহার জীবন কাটিয়া গিয়াছে, এবং এই সকল শ্বাস্ত্রের বিচারপদ্ধতি সম্বন্ধে যাহাদের অভিমান আছে, তাহারা বাহ্য পরিণামের বিচারেই অভ্যস্ত হইয়া পড়েন । তাহার পরিণামে তাহাদের তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিও অল্পবিস্তর সঙ্কুচিত হয় এবং তাহারা কোন বিষয়ের বিচার করিবার সময় আধ্যাত্মিক, পারলৌকিক, অব্যক্ত বা অদৃশ্য কারণসমূহের বিশেষ গুরুত্ব উপলব্ধি করেন না । কিন্তু যদিও তাহারা এইরূপ কারণে আধ্যাত্মিক ও পারলৌকিক দৃষ্টি পরিহার করেন, তথাপি তাহাদের ইহা মানিতে হয় যে, মনুষ্যদিগের সাংসারিক ব্যবহার সুচারুরূপে পরিচালিত করিবার এবং লোকসংগ্ৰহ করিবার জন্য নীতিনিয়মের অত্যন্ত প্রয়োজন আছে । আমি দেখিতেছি যে, পরলোক সম্বন্ধে যাহাদিগের অনাস্থা আছে কিংবা অব্যক্ত অধ্যাত্মজ্ঞানের উপর (অর্থাৎ পরমেশ্বরেতেও) যাহাদের বিশ্বাস নাই, এইরূপ পাশ্চাত্যদেশের পণ্ডিতেরাও কর্মযোগশাস্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্ব উপলব্ধি করেন । এই সকল পণ্ডিত পাশ্চাত্যদেশে এই সম্বন্ধে অনেক তর্কবিতর্ক করিয়াছেন এবং এখনও এই তর্কবিতর্ক চলিতেছে যে, কেবল আধিভৌতিক শাস্ত্ররীতি অনুসারে অর্থাৎ নিছক ঐহিক প্রত্যক্ষ যুক্তিবাদ অনুসারেই কর্মাকর্মশাস্ত্রের উপপত্তি দেখানো যাইতে পারে কি না । এই তর্কবিতর্কের ফলে ঐ সকল পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন যে, নীতিশাস্ত্রের বিচার করিবার জন্য আধ্যাত্মশাস্ত্রের কোনই প্ৰয়োজন নাই । 

কোন কর্মের ভালমন্দ উক্ত কর্মের আমাদের প্রত্যক্ষ বাহ্য পরিণাম হইতেই করা আবশ্যক; এবং এইভাবে করাও হয় । কারণ, মনুষ্য, যে যে কর্ম করে তাহা সমস্তই সুখের জন্য কিংবা দুঃখ নিবারণার্থই করিয়া থাকে । অধিক কি, ‘সকল মনুষ্যের সুখ’ই ঐহিক পরমসাধ্য বিষয়; এবং যদি সকল কর্মের শেষ দৃশ্যফল এই প্রকার নিশ্চিত হয়, তবে সুখপ্ৰাপ্তির কিংবা দুঃখনিবারণের তারতম্য অর্থাৎ লাঘবগৌরব দেখিয়া সকল কর্মের নীতিমত্ত নির্ধারণ করা নীতিনির্ণয়ের প্রকৃত মার্গ । যে গরু ক্ষুদ্ৰশৃঙ্গী ও শান্ত কিন্তু অধিক পরিমাণে দুধ দেয় সেই গরু যেমন ভাল বলা যায়, সেইরূপ যদি ব্যবহারে কোন বিষয়ের ভালমন্দ বাহ্য উপযোগের হিসাবেই স্থির করা যায়, তবে ঐ নীতি অনুসারেই যে কর্ম হইতে সুখপ্ৰাপ্তি দুঃখনিবারণাত্মক বাহ্য ফল অধিক, তাহাই নীতিদৃষ্টিতেও শ্ৰেয়স্কর বুঝিতে হইবে । আমরা যখন কেবল বাহ্য ও দৃশ্য পরিণামসমূহের লাঘবগৌরব দেখিয়া নীতিমত্তার নির্ণয় করিবার এই সরল ও শাস্ত্রীয় কষ্টিপাথর পাইলাম, তখন তাহার জন্য আত্ম-অনাত্ম বিচারের গভীর সাগরে প্রবেশ করিয়া “দ্রাবিড়ী প্ৰাণায়াম” করা উচিত নহে । “অর্কে চেন্মধু বিন্দেত কিমৰ্থং পর্বতং ব্ৰজেৎ” অর্থাৎ হাতের কাছে যদি মধু পাওয়া যায় তবে মধুর জন্য কিজন্য পর্বতে যাইবে ? (এই শ্লোকে ‘অর্ক’ শব্দের অর্থ তুলার বৃক্ষ এইরূপ কেহ কেহ করিয়া থাকেন । কিন্তু ব্রহ্মসূত্র ৩|৪|৩, উপরি-উক্ত শাঙ্কর ভাষ্যের টীকায় আনন্দগিরি ‘অর্ক’ এই শব্দের অর্থ ‘সমীপ’ এইরূপ করিয়াছেন । এই শ্লোকের দ্বিতীয় চরণ এই – “সিদ্ধস্যার্থস্য সংপ্রাপ্তৌ কে বিদ্বান্‌ যত্নমাচরেৎ” ।) কোন কর্মের কেবল বাহ্যফল দেখিয়া নীতি ও অনীতির নির্ণয়কারীর পক্ষকে আমি “আধিভৌতিক সুখবাদ” এই নাম দিয়াছি । কারণ, নীতিমত্তার নির্ণয়াৰ্থ এই মত অনুসারে যে সুখদুঃখের বিচার করা হয়, সে সমস্ত প্রত্যক্ষদৃষ্ট এবং কেবল বাহ্য অর্থাৎ বাহ্য পদার্থের ইন্দ্ৰিয়ের সহিত সংযোগ হইবার পর উৎপন্ন বা আধিভৌতিক । এবং এই পন্থাও সর্বজগতের কেবল আধিভৌতিক দৃষ্টিতে বিচারকারী পণ্ডিতেরাই প্রচার করিয়াছেন । 

এই মতবাদের সবিস্তার বিবরণ এই গ্রন্থে বলা অসম্ভব । ভিন্ন ভিন্ন গ্ৰন্থকারদিগের মতের সংক্ষিপ্তসার দিতে গেলেও একটা স্বতন্ত্র গ্ৰন্থ লিখিতে হয় । তাই, ভগবদ্গীতান্তৰ্গত কর্মযোগশাস্ত্রের স্বরূপ ও গুরুত্ব সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিবার নিমিত্ত নীতিশাস্ত্রের এই আধিভৌতিক মার্গের যতটা বিবরণ দেওয়া নিতান্ত আবশ্যক সেইটুকু স্থুল বিবরণই এই প্রকরণে সংক্ষেপে একত্র করিয়া আমি দিয়াছি । ইহা অপেক্ষা অধিক বিবরণ কাহারও জানিতে হইলে পাশ্চাত্য বিদ্বানদিগের মূল গ্ৰন্থ তাহার দেখা আবশ্যক ।

উপরে বলা হইয়াছে যে, আধিভৌতিকবাদী পরলোক সম্বন্ধে কিংবা আত্মবিদ্যা সম্বন্ধে উদাসীন; একথার ইহা তাৎপৰ্য নহে যে, এই মার্গের সকল বিদ্বানই স্বার্থসাধক আত্মম্ভরী কিংবা অনীতিমান্‌ । এই সকল লোকের পারলৌকিক দৃষ্টি যদি না থাকে তো নাই রহিল । ইহারা মনুষ্যের কর্তব্য বিষয়ে ইহাই বলেন যে প্রত্যেক মনুষ্যের স্বীয় ঐহিক দৃষ্টিকেই, যতদূর সন্তব, ব্যাপক করিয়া সমস্ত জগতের কল্যাণের নিমিত্ত চেষ্টা করাই কর্তব্য । আন্তরিক পূর্ণ উৎসাহের সহিত যাহারা এই ভাবের উপদেশ করিয়াছেন, সেই কোঁৎ, মিল, স্পেন্‌সর প্রভৃতি সাত্ত্বিকবৃত্তির অনেক পণ্ডিতও এই মার্গে আছেন; এবং উহাদের গ্ৰন্থ অনেক প্রকারের উদাত্ত ও প্ৰগল্‌ভ বিচারের দ্বারা পূৰ্ণ হওয়ায় উহাদের গ্ৰন্থ সকলেরই পঠনীয় । যদিও কর্মযোগশাস্ত্রের পন্থা ভিন্ন, তথাপি যে পৰ্যন্ত জগতের কল্যাণ, এই বাহ্য সাধ্য উহা হইতে বাদ না পড়ে সে পৰ্যন্ত ভিন্ন রীতিতে নীতিশাস্ত্রের প্রতিপাদক কোনও মার্গ বা পন্থাকে উপহাস করা উচিত নহে । সে যাই হোক্‌; নৈতিক কর্মাকর্মের নির্ণয়াৰ্থ যে আধিভৌতিক বাহ্য সুখের বিচার করিতে হইবে, সে কাহার সুখ ? নিজের, না, পরের; একজনের, না, বহুলোকের ? এই সম্বন্ধে আধিভৌতিকবাদীদিগের মধ্যে মতভেদ আছে । এক্ষণে সংক্ষেপে বিচার করিব যে নব্য ও প্রাচীন সমস্ত আধিভৗতিকীবাদীদিগকে মুখ্যত কতগুলি বর্গের অন্তৰ্ভুক্ত করা যাইতে পারে, এবং তাহাদের এই মার্গ কতদূর উচিত বা নির্দোষ ।


3) আধিভৌতিক সুখবাদের শ্রেণীবিভাগ



3.1) কেবল স্বার্থ (চার্বাক/জাবালি/কণিক)


তন্মধ্যে প্ৰথম বর্গটি নিছক স্বাৰ্থসুখবাদীদিগের । এই মার্গের বক্তব্য এই যে, পরলোক ও পরোপকার সমস্তই মিথ্যা, দুর্নীতিপরায়ণ লোকেরা শুধু নিজের উদর পূর্ণ করিবার জন্য আধ্যাত্মিক ধর্মশাস্ত্ৰ লিখিয়াছে, এই জগতে স্বার্থই একমাত্র সত্য, এবং, যে উপায়ে স্বার্থসিদ্ধি হইতে পারে অথবা যাহার দ্বারা নিজের আধিভৌতিক সুখের বৃদ্ধি হয়, তাহাই ন্যায্য, প্রশস্ত বা শ্রেয়স্কর বলিয়া বুঝিতে হইবে । আমাদের ভারতবর্ষে অতি প্ৰাচীনকালে চার্বাক উৎসাহ সহকারে এই মত প্রতিপাদন করিয়াছিলেন; এবং রামায়ণে অযোধ্যাকাণ্ডের শেষে, জাবালি রামকে যে কুটিল উপদেশ করিয়াছেন তাহা এবং মহাভারতে বর্ণিত কণিক নীতিও [মভা|আ|১৪২] এই মার্গেরই অন্তৰ্ভুত । চাৰ্বাকের মত এই যে, পঞ্চমহাভূত একত্র হইয়া তাহার মিশ্রণ হইতে আত্মারূপ এক গুণ উৎপন্ন হয় এবং দেহ দগ্ধ হইলে তাহার সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও দগ্ধ হইয়া যায়; তাই পণ্ডিতদিগের কর্তব্য এই যে, আত্ম-বিচারের গণ্ডগোলের মধ্যে না পড়িয়া শরীর যতদিন বাঁচিয়া থাকিবে ততদিন “ঋণ করিয়াও উৎসব করিবে” - ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ - কারণ মরিবার পর আর কিছুই থাকে না । চাৰ্বাক ভারতবর্ষে জন্মিয়াছিলেন বলিয়া ঘৃতের উপরে তাঁহার লোভটি বেশি ছিল । নতুবা “খণং কৃত্বা সুরাং পিবেৎ” এইরূপ সূত্রটির রূপান্তর দেখা যাইত । কোথায় বা ধর্ম, কোথায় বা পরোপকার ! এজগতে যত পদার্থ পরমেশ্বর - শিব শিব ! ভুল হইয়াছে ! পরমেশ্বর আসিল কোথা হইতে ? - এই জগতে যে কিছু বস্তু আমি দেখিতেছি সে সমস্তই আমারই উপভোগের জন্য । সে সকলের অন্য কোন ব্যবহার দেখা যায় না, - নাই ই ! আমি মরিলেই জগৎ অন্তৰ্হিত হইল । তাই, যতদিন বাঁচি তত দিন আজ এটা, কাল ওটা, এইরূপ যাহা কিছু সমস্ত আমার আয়ত্ত করিয়া লইয়া আমার সমস্ত বাসনা কামনা আদি পরিতৃপ্ত করিব । আমি যদি তপস্যা করি কিংবা দান করি, সে সমস্তই আমার মহত্ব বৃদ্ধির জন্যই করিব । এবং আমি যদি রাজসূয় বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করি, তা কেবল আমার অধিকাব সর্বত্র অবাধিত প্ৰদৰ্শন করিবার জন্যই করি । সারাংশ, — এই জগতের ‘আমি’ই একমাত্র কেন্দ্ৰ; ইহাই সমস্ত নীতিশাস্ত্ৰের রহস্য, বাকী সব মিথ্যা । “ঈশ্বরোহহমহং ভোগী সিদ্ধোহহং বলবান্‌ সুখী” [গী|১৬|১৪] আমিই ঈশ্বর, আমিই ভোগী, আর আমিই সিদ্ধ, আমিই বলবান্‌ ও সুখী - এই প্রকারের আসুরী মতাভিমানীদিগের বিষয় গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে বর্ণিত হইয়াছে । শ্ৰীকৃষ্ণের পরিবৰ্তে জাবালির ন্যায় এই মার্গের কোন ব্যক্তি অর্জুনের পাশে বসিয়া অর্জুনকে যদি উপদেশ দিতেন তাহা হইলে তিনি প্রথমেই অর্জুনকে মুখথাব্‌ড়া দিয়া বলিতেন — “ওরে তুই কি মুর্খ ! যুদ্ধে সকলকে জিতিয়া অনেক প্রকারের রাজভোগ ও বিলাস উপভোগের এই উত্তম সুযোগ পাইয়াও ইহা করিব কি উহা করিব” এইরূপ ব্যর্থ প্ৰলাপ কেন করিতেছিস্‌ ? এরূপ সুযোগ আর আসিবে না । কোথাকার আত্মা, আর কোথাকার আত্মকুটুম্বের জন্য বসে আছিস্‌ ! ভারী ভুল ! তুই হস্তিনাপুরের সাম্রাজ্য সুখে ও নিষ্কণ্টকে ভোগ কর্‌ ! ইহাতেই তোর পরম কল্যাণ । নিজের প্রত্যক্ষ ঐহিক সুখ ব্যতীত এই জগতে আর আছে কি ? কিন্তু অর্জুন এই জঘন্য স্বার্থসাধক ও নিছক্‌ আত্মম্ভৱী রাক্ষসী উপদেশ অপেক্ষা না করিয়া প্রথমেই শ্ৰীকৃষ্ণকে বলিয়া রাখিয়াছেন যে -
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূদন ৷অপি ত্ৰৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং নু মহীকৃতে ॥
“শুধু পৃথিবী কেন, সমস্ত ত্ৰৈলোক্যের রাজ্যও (এ বড় বিষয়সুখ) যদি (এই যুদ্ধে) আমি পাই, তবু আমি কৌরবদিগকে বধ করিতে ইচ্ছা করি না । আমার যদি গল৷ কাটা যায় তাহাও স্বীকার ।” [গী|১|৩৪] । অর্জুন প্রথমেই যে আত্মমৎলবী নিছক্‌ স্বার্থপরায়ণ ও আধিভৌতিক সুখবাদের এই প্রকারে নিষেধ করিলেন, সেই আসুরী মতের কেবল উল্লেখ মাত্রেই তাহার খণ্ডন হয় বলা যাইতে পারে । লোকের যাই হৌক না কেন, কেবল আমার নিজের বিষয়েীপভোগসুখকেই পরম পুরুষাৰ্থ মনে করিয়া নীতি ও ধর্মবিসর্জনকারী আধিভৌতিকবাদীদিগের এই অত্যন্ত কনিষ্ঠ শ্রেণী, কর্মযোগশাস্ত্রসংক্রান্ত সমস্ত গ্ৰন্থকার এবং সাধারণ লোকেরও নিকটে এক্ষণে অত্যন্ত অনীতিমূলক, ত্যাজ্য ও গৰ্হিত বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে । অধিক কি, এই পন্থাটি নীতিশাস্ত্র কিংবা নীতিবিচার নামেরও যোগ্য নহে । তাই, এই সম্বন্ধে বেশী আলোচনা না করিয়া আধিভৌতিক সুখবাদীদিগের দ্বিতীয় বর্গের দিকে ফেরা যাক ।


3.2) দূরদর্শী স্বার্থ (হব্‌স/হেল্‌বেশিয়াস্‌)


সুস্পষ্ট নগ্ন স্বাৰ্থ বা আত্মোদর ভরণসর্বস্বতা জগতে চলে না । কারণ, আধিভৌতিক-বিষয়সুখ প্ৰত্যেকের অভীষ্ট হইলেও, নিজের সুখ অন্য লোকের সুখভোগের যখন অন্তরায় হয়, তখন অন্য লোকেরা আমার নিজের সুখের বিঘ্ন না জন্মাইয়া নিরস্ত হয় না, ইহা প্ৰত্যেক লোকই নিজের অভিজ্ঞতায় জানে । তাই, আর কতকগুলি আধিভৌতিক পণ্ডিত এইরূপ প্ৰতিপাদন করেন যে, নিজের সুখ বা স্বার্থসাধন আমার সাধ্য হইলেও, অন্য লোকদিগকে নিজের মতো সাহায্য করা ব্যতীত নিজেরও সুখলাভ হইতে পারে না, তাই নিজের সুখের জন্য, দুরদৰ্শিতাসহকারে অন্যেরও সুখের প্রতি আমাদের লক্ষ্য রাখা আবশ্যক । এই আধিভৌতিকবাদীদিগকে আমি অন্য বর্গের অন্তভুর্ক্ত বলিয়া গণনা করি । কিন্তু নীতির আধিভৌতিক উপপত্তির প্রকৃত আরম্ভ এইখান হইতেই হয় বলিলেও চলে । কারণ ইহারা চার্বাকের ন্যায় সমাজ-বিধরণের জন্য নীতির বন্ধন নিষ্প্রয়োজন, সে কথা বলেন না; কিন্তু ঐ সমস্ত নীতি কেন পালন করা আবশ্যক, ইহারা স্বীয় বিচারদৃষ্টিতে তাহার কারণ উল্লেখ করিয়াছেন । ইহারা বলেন যে, জগতে অহিংসাধর্ম কিরূপে উৎপন্ন হইল কিংবা লোকেরা তাহা কেন পালন করে তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিলে, “আমি অন্যকে মারিলে অন্যেরাও আমাকে মারিবে ও পরে আমার সুখ চলিয়া যাইবে ।” এই স্বাৰ্থমূলক ভয় ব্যতীত তাহার অন্য কোন গভীর কারণ নাই, এইরূপ দেখা যায় । অহিংসাধর্মের ন্যায় অন্য সমস্ত ধর্মই এই প্রকার স্বাৰ্থমূলক কারণেই প্রচলিত হইয়াছে । আমার দুঃখ হইলে আমি কাঁদি এবং অন্যের দুঃখে আমাদের দয়া হয় কেন ? আমারও কখনো ঐরূপ অবস্থা হইতে পারে এই ভীতি, সুতরাং নিজের ভাবী দুঃখ, মনে আইসে - এই কারণেই কি নহে ? পরোপকার, ঔদার্য, দয়া, মায়া, কৃতজ্ঞতা, নম্রতা, মৈত্রী প্রভৃতি যে সকল গুণ প্ৰথম দৃষ্টিতেই লোকের সুখের নিমিত্ত আবশ্যক বলিয়া মনে হয়, সে সমস্তই মূলত দেখিতে গেলে, আমার নিজেরই সুখের জন্য কিংবা নিজেরই দুঃখনিবারণের জন্য । কেহ কাহাকে সাহায্য করে বা দান করে - কেন ? ইহাই, কি তাহার কারণ নহে যে, আমার নিজের সঙ্কট উপস্থিত হইলে অন্য লোকেও আমাকে সাহায্য করিবে ? আমার উপর লোকেরা দয়া করিবে বলিয়া আমিও তাহাদের উপর দয়া করি । নিদানপক্ষে, লোকেরা ভাল বলিবে, অন্তত এই স্বাৰ্থমূলক হেতুটিও আমাদের মনের মধ্যে নিহিত থাকে । পরোপকার ও পরার্থ এই দুই শব্দ নিছক ভ্ৰান্তিমূলক । একমাত্র স্বার্থই সত্য; এবং স্বাৰ্থ অর্থে নিজের সুখলাভ কিংবা দুঃখনিবারণ । মাতা সন্তানকে স্তন্য দেন, তাহার কারণ মাতার প্রেম নহে; ইহার প্রকৃত কারণ এই মে, মাতার স্তনের স্ফীতি তাহাকে কষ্ট দেয়া বলিয়া সেই কষ্ট নিবারণের জন্য, কিংবা পরে সন্তানেরা তাহার প্রতি মমতা করিয়া তাহাকে সুখ দিবে এই স্বাৰ্থসিদ্ধির জন্যই সে এই স্বার্থসাধক উপায় অবলম্বন করিয়া থাকে, - প্রেম বাৎসল্যাদির ইহাই মূল কারণ ! দ্বিতীয় বর্গের আধিভৌতিকবাদী স্বীকার করেন যে, আমার নিজের সুখের জন্য যাহাই হউক না, কিন্তু ভবিষ্যতের উপর দৃষ্টি রাখিয়া এমন নীতিধর্ম পালন করা উচিত, যাহাতে অন্যেরও সুখ হইতে পারে - বস্, এইখানেই এই মতের সহিত চার্বাকমতের প্ৰভেদ । তথাপি চার্বাকমত-অনুসারে এই মতেও স্বীকার করা হয় যে, মনুষ্য নিছক বিষয়সুখরূপ স্বার্থের ছাঁচে ঢালা এক পুতুল । ইংলণ্ডে হব্‌স্‌ এবং ফ্রান্সে হেল্‌বেশিয়াস্‌ এই মত প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । কিন্তু এই মতের অনুগামী এক্ষণে না ইংলণ্ডে না অন্যত্র বেশী পাওয়া যায় । হব্‌সের নীতিধর্মের এই উপপত্তি বহুলপ্রচার হইলে পর বট্‌লরের ন্যায় বিদ্বানেরা উহার খণ্ডন করিয়া সপ্রমাণ করিলেন যে, মানবস্বভাব নিছক স্বার্থপর নহে; স্বার্থের ন্যায় ভূতদয়া, প্ৰেম, কৃতজ্ঞতা প্রভৃতি সদ্‌গুণও ন্যূনাধিক পরিমাণে মনুষ্যের মধ্যে জন্ম হইতেই নিহিত থাকে । (হব্‌সের মত তাহার Leviathan গ্রন্থে প্রদত্ত হইয়াছে; এবং বট্‌লরের মত তাহার Sermons on Human nature এই প্রবন্ধে বিবৃত হইয়াছে । হেল্‌বেশিয়সের পুস্তকের সারাংশ, মর্‌লি স্বীয় Diderot বিষয়ক গ্রন্থে দিয়াছেন, Vol II, Chap. V.)


3.2.1) স্বার্থ-বুদ্ধির ন্যায়ই পরোপকারবুদ্ধিও স্বাভাবিক


এই নিমিত্ত, কোন ব্যবহার বা কর্মের নৈতিক দৃষ্টিতে বিচার করিবার সময়, কেবল স্বার্থের দিকে কিংবা দূরদর্শী স্বার্থের দিকেই না দেখিয়া, স্বার্থ ও পরার্থ মানবস্বভাবের এই দুই নৈসর্গিক প্রবৃত্তির দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখা অবশ্যক । বাঘিনীর ন্যায় ক্রূর জানোয়ার পর্যন্ত আপন বাচ্ছাদের রক্ষণার্থ যখন প্ৰাণ দিতে প্ৰস্তুত থাকে, তখন সকল মনুষ্যের মধ্যে প্রেম ও পরোপকারবুদ্ধি নিছক স্বাৰ্থ হইতেই উৎপন্ন হইয়াছে এরূপ বলিতে পারি না । ইহা হইতে  সিদ্ধ হইতেছে যে, কেবল দূরদর্শী স্বাৰ্থ বুদ্ধিতেই ধর্মাধর্মের পরীক্ষা করা শাস্ত্ৰদৃষ্টিতেও উচিত নহে । কেবল সংসারেতেই আসক্ত থাকায় যাহাদের বুদ্ধি পরিশুদ্ধ হয় নাই এইরূপ মনুষ্য এ জগতে অন্যের জন্য যাহা কিছু করে তাহা অনেক সময় নিজের হিতের জন্যই করিয়া থাকে, এই কথা আমাদের প্রাচীন পণ্ডিতদিগেরও মনে আসিয়াছিল । মহারাষ্ট্রে তুকারাম বড় ভগবদ্ভক্ত ছিলেন । “শাশুড়ীর তরে কাঁদে বৌ, কিন্তু মনের ভাব ভিন্ন রূপ” [গা|২৫৮|৩|২] এইরূপ তুকারাম বলিয়াছেন । অনেক পণ্ডিত হেল্‌বেশিয়স্‌কেও ছাড়াইয়া গিয়াছেন । উদাহরণ যথা -

মনুষ্যের সমস্ত স্বার্থ ও পরার্থপ্রবৃত্তিই দোষময় হইয়া থাকে - প্ৰবর্তনালক্ষণা দোষাঃ - এই গৌতম-ন্যায়সূত্রের [১০|১|১৮] বনিয়াদে ব্ৰহ্মসূত্ৰভাষ্যে শ্ৰীশঙ্করাচার্য যাহা কিছু বলিয়াছেন [বে|সূ|শাং-ভা|২|২|৩], তাহার উপর টীকা করিবার সময় আনন্দগিরি লিখিয়াছেন যে, “আমার হৃদয়ে কারুণ্যবৃত্তি জাগ্ৰত হইলে, তাহা হইতে আমাদের যে দুঃখ হয় তাহা দূর করিবার জন্য আমরা লোকের উপর দয়া কিংবা পরোপকার করিয়া থাকি ।” আনন্দগিরির এই যুক্তি প্রায় সমস্ত সন্ন্যাসমার্গীর গ্রন্থে প্রাপ্ত হওয়া যায় । উহার দ্বারা মুখ্যরূপে ইহাই সিদ্ধ করিবার চেষ্টা দেখা যায় যে, সব কর্মই স্বার্থপর অতএব ত্যাজ্য । 


3.2.2) যাজ্ঞবল্ক্যের আত্মার্থ


কিন্তু বৃহদারণ্যক উপনিষদে, যাজ্ঞবল্ক্য ও তাঁহার স্ত্রী মৈত্ৰেয়ী ইঁহাদের যে কথোপকথন দুই স্থানে আছে [বৃ|২|৪; ৪|৫], তাহাতে আর এক চমৎকার রীতিতে এই যুক্তিবাদের উপযোগ করা হইয়াছে । “আমার অমৃতত্ত্ব কিসে লাভ হইবে ?” মৈত্রেয়ীর এই প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় যাজ্ঞবল্ক্য তাঁহাকে বলিলেন যে, “মৈত্ৰেীয়ী ! স্ত্রী স্বামীকে যে ভালবাসে তাহা স্বামীর জন্য নহে; - আত্মপ্ৰীত্যৰ্থই ভালবাসে । সেইরূপ পুত্ৰকে পুত্ৰ বলিয়া আমরা ভালবাসি না, আমার নিজের জন্য পুত্রকে ভালবাসি । ধনসম্পত্তি, পশু ও অন্য সমস্ত পদার্থেই এই নীতি প্ৰযুক্ত হইতে পারে । ‘আত্মনস্তু কামায় সৰ্ব্বং প্ৰিয়ং ভবতি’ - আত্মপ্রীত্যৰ্থ সমস্ত পদার্থ আমাদের প্রিয় হইয়া থাকে । এবং সমস্ত প্ৰেমই যদি এইরূপ আত্মমূলক হয়, তবে আত্মাকে (আমি) প্ৰথমে চেনা আবশ্যক নহে কি ?” এইরূপ বলিয়া শেষে যাজ্ঞবল্ক্য উপদেশ দিলেন – ‘আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো নিদিধ্যাসিতব্যঃ’ - “আত্মা কে (প্ৰথমে) তাহা দেখ, শোনো, এবং তাঁহার মনন ও ধ্যান কর” । এই উপদেশ অনুসারে আত্মার প্রকৃত স্বরূপ একবার জানিতে পারিলে তাহার পর সমস্ত জগতই আত্মময় দৃষ্ট হয়, এবং স্বার্থ ও পরার্থের ভেদও মন হইতে বিলুপ্ত হয় । যাজ্ঞবল্কোর এই যুক্তিবাদ আপাতত হব্‌সের অনুরূপ বলিয়া মনে হয়; কিন্তু ইহা জানা কথা যে, এই উভয় হইতে উপপন্ন সিদ্ধান্ত পরস্পরবিরুদ্ধ । 
(“What say you of natural affection ? Is that also a species of self-love ? Yes; All is self-love. Your children are loved only because they are yours. Your friend for a like reason. And Your country engages you only so far as it has a connection with Your-self.” হিউমও স্বকীয় “of the Dignity or Meannness of Human nature” নামক প্রবন্ধে এই যুক্তির উল্লেখ করিয়াছেন । হিউমের নিজের মত ইহা হইতে ভিন্ন ।)

হব্‌স্‌ স্বার্থকেই প্ৰাধান্য দেন এবং সমস্ত পরার্থকে দূরদর্শী স্বার্থেরই এক আকার ভাবিয়া বলেন যে, স্বাৰ্থ ব্যতীত এই জগতে আর কিছু নাই । যাজ্ঞবল্ক্য ‘স্বাৰ্থ’ এই শব্দান্তর্ভূত ‘স্ব’ (আপনি) এই পদের বনিয়াদে দেখাইয়াছেন যে, অধ্যাত্মদৃষ্টিতে আমার এক আত্মাতেই সমস্ত ভূতের ও সমস্ত ভূতেতেই আমার আত্মার অবিরোধে কিরূপে সমাবেশ হয় । ইহা দেখাইয়া স্বার্থ ও পরার্থ এই উভরের মধ্যে অবভাসমান দ্বৈতের বিরোধও ভাঙ্গিয়া দিলেন । যাজ্ঞবল্ক্যের উক্ত মত এবং সন্ন্যাসমাৰ্গ সম্বন্ধে পরে আরও বিচার করা যাইবে । “সাধারণ মনুষ্যের প্রবৃত্তি স্বার্থপর অর্থাৎ আত্মসুখপর হইয়া থাকে ।” এই একই বিষয়ের ন্যূনাধিক গৌরব প্ৰদান করিয়া কিংবা উহাকে সর্বথা অপবাদরহিত বা অব্যভিচারী স্বীকার করিয়া আমাদের প্রাচীন গ্ৰন্থকারেরা উহা হইতেই হব্‌সের বিপরীত অন্য সিদ্ধান্ত কিরূপে বাহির করিয়াছেন তাহা দেখাইবার জন্যই এইস্থানে যাজ্ঞবল্ক্যাদির উল্লেখ করিয়াছি ।


3.3) উদাত্ত / জ্ঞানদীপ্ত / উচ্চ স্বার্থ (স্বার্থ-পরার্থ-উভয় বাদ)


একথা যখন সিদ্ধ হইল যে, ইংরেজ গ্ৰন্থকার হব্‌স্‌, ও ফরাসী পণ্ডিত হেল্‌ভেশিয়াসের সিদ্ধান্ত অনুসারে মনুষ্যস্বভাব নিছক স্বার্থপর অর্থাৎ তমোগুণী রাক্ষসী নহে; কিন্তু স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে পরোপকার-বুদ্ধিরূপ সাত্ত্বিক মনোবৃত্তিও মনুষ্যের অন্তরে জন্ম হইতেই নিহিত থাকে; অর্থাৎ যখন ইহা স্থির হইল যে, পরোপকার শুধু দূরদর্শী স্বাৰ্থ নহে, তখন স্বাৰ্থ অর্থাৎ স্ব-সুখ এবং পরার্থ অর্থাৎ অন্যের সুখ এই দুই তত্ত্বের উপরে সমান দৃষ্টি রাখিয়া কার্যাকাৰ্যব্যবস্থিতিশাস্ত্রের রচনা করিবার প্রয়োজন প্ৰতীত হইতেছে । ইহাই আধিভৌতিকবাদীদিগের তৃতীয় বর্গ । তথাপি কি স্বাৰ্থ কি পরার্থ, উভয়ই ঐহিক সুখবাচক, ঐহিক সুখের ওদিকে আর কিছুই নাই, এই আধিভৌতিক মত এই পক্ষেও অক্ষুন্ন রহিয়াছে । এইটুকু প্ৰভেদ যে, এই পন্থার লোকেরা স্বাৰ্থ বুদ্ধির ন্যায় পরার্থ বুদ্ধিকেও নৈসৰ্গিক স্বীকার করিয়া বলেন যে, নীতির বিচার করিবার সমস্ত স্বার্থের ন্যায় পরার্থকেও আমাদের দেখা কর্তব্য । সাধারণতঃ স্বার্থ ও পরার্থ ইহাদের মধ্যে বিরোধ উৎপন্ন হয় না, তাই মনুষ্য যে কোন কর্ম করে তাহা প্রায়ই সমাজের হিতকর হয় । একজন ধন সঞ্চয় করিলে তাহাতে সমস্ত সমাজেরও হিত সাধিত হয়; কারণ সমাজ অর্থে অনেক ব্যক্তির সমূহ এবং যদি ঐ সমাজের প্ৰত্যেক ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি না করিয়া আপনাপন লাভ করে, তাহাতে সমাজের কল্যাণই হয় । এইজন্য এই মার্গের লোকেরা স্থির করিয়াছেন যে নিজের সুখের প্রতি দুৰ্লক্ষ্য না করিয়া যদি কেহ লোকের হিতসাধন করিতে পারে তাহাই তাহার কর্তব্য । কিন্তু এই পক্ষের লোক পরার্থের শ্ৰেষ্ঠত্ব স্বীকার করেন না, এবং বলেন যে, সকল সময়ে নিজের বুদ্ধি অনুসারে, স্বার্থ শ্রেষ্ঠ কি পরার্থ শ্রেষ্ঠ ইহার বিচার করিবে । ইহার পরিণাম এই হয় যে, যখন স্বার্থ ও পরার্থের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হয়, তখন অনেকে লোকের সুখের জন্য নিজের সুখ কতটা বিসর্জন করিবে ইহার নির্ণয়ে গোলযোগ পড়িয়া অনেক সময় স্বার্থেরই দিকে বেশী ঝুঁকীয়া পড়ে । উদাহরণ যথা, - স্বার্থ ও পরার্থ দুই-ই সমান প্ৰবল বলিয়া মানিলে সত্যের জন্য প্ৰাণ দেওয়া কিংবা রাজ্য হারানো দুরের কথা, ধনের ক্ষতি অধিক হইলেও উহা সহ্য করিবে কিনা, ইহা এই মার্গের মতানুসারে নির্ণয় হয় না । কোন উদারচিত্ত ব্যক্তি পরার্থের জন্য নিজের প্রাণ দিলে, এই মাৰ্গাবলম্বী লোক কদাচিৎ তাহার প্রশংসা করিবে । কিন্তু নিজের সম্বন্ধে ঐরূপ প্ৰসঙ্গ উপস্থিত হইলে, স্বার্থ ও পরার্থ এই দুই নৌকায় যে সকল পণ্ডিত সর্বদাই পা দেন তাহারা স্বার্থের দিকেই যে অধিক ঝুঁকিবেন তাহা আর বলিতে হইবে না । হব্‌সের ন্যায় ইহারা পরার্থকে স্বার্থেরই দূরদর্শী প্ৰকারভেদ বলিয়া মানেন না; কিন্তু ইহা মনে করেন যে, স্বার্থ ও পরার্থ উভয়কে তৌলে স্থাপন পূর্বক উহাদের তারতম্য অর্থাৎ ন্যূনাধিক্য বিচার করিয়া খুব চতুরতার সহিত তাহারা নিজের নিজের স্বার্থের নির্ণয় করিয়া থাকেন; এইজন্য এই পন্থার লোকেরা আপন মাৰ্গকে “উদাত্ত” বা “উচ্চ” বা “জ্ঞানদীপ্ত স্বাৰ্থ” (কিন্তু স্বাৰ্থ বটে) নাম দিয়া তাহারই মাহাত্ম্য কীর্তন করিয়া থাকেন । (ইংরাজীতে ইহাকে Enlightened self-interest বলে ।) কিন্তু ভর্তৃহরি কি বলিতেছেন দেখ -
একে সৎপুরুষাঃ পরার্থঘটকাঃ স্বাৰ্থান্‌ পরিত্যজ্য যে
সামান্যাস্তু পরার্থমুদ্যমবতঃ স্বাৰ্থাহবিরোধেন যে ৷
তেহমী মানবরাক্ষসাঃ পরহিতং স্বার্থায় নিঘ্নন্তি যে
যে তু ঘ্নন্তি নিরর্থকং পরহিতং তে কে ন জানমহে ॥
“নিজের লাভ ছাড়িয়া দিয়া যাঁহারা লোকের কল্যাণ করিয়া থাকেন তাঁহারাই প্ৰকৃত সৎপুরুষ; স্বাৰ্থ না ছাড়িয়া লোকের হিতের জন্য যাহার চেষ্টা করিয়া থাকেন তাহারা সাধারণ পুরুষ; এবং নিজের লাভের জন্য লোকের ক্ষতি যাহারা করে তাহারা মনুষ্য নহে, তাহারা রাক্ষস; কিন্তু ইহাদের পরেও, যাহারা নিরর্থক লোকহিত নষ্ট করে, তাহাদের কি নাম দিব তাহা জানি না” [নী|শ|৭৪] । রাজধর্মের উত্তম অবস্থা বৰ্ণনা করিতে গিয়া কালিদাসও বলিয়াছেন -
স্বসুখনির ভিলাষীঃ খিাদ্যসে লোকহেতোঃ ৷
প্রতিদিনমথবা তে বৃত্তিরে বন্বিধৈব ॥
“নিজ সুখের অভিলাষ না করিয়া তুমি প্ৰতিদিন লোকহিতের জন্য কষ্ট করিয়া থাক । অথবা তোমার বৃত্তি বা ব্যবসায়ই এইরূপ” [শকুং|৫|৭] । ভর্তৃহরি কিংবা কালিদাস দেখেন নাই যে, কর্মযোগশাস্ত্ৰে স্বার্থ ও পরার্থ এই দুই তত্ত্বই স্বীকার করিয়া উহাদের তারতম্যের দ্বারা ধর্মাধর্মের বা কর্মাকর্মের নিৰ্ণয় কেমন করিয়া করিতে হইবে, তথাপি পরার্থের জন্য যাহারা স্বাৰ্থ ত্যাগ করেন সেই সব পুরুষকে তাঁহারা যে প্রথম স্থান দিয়াছেন, তাহা নীতিদৃষ্টিতেও ন্যায্য । এই মার্গের লোকেরা এই সম্বন্ধে বলেন যে, “তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে পরার্থ শ্রেষ্ঠ হইলেও সনাতন বিশুদ্ধ নীতি কি, তাহা না দেখিয়া, সাধারণ ব্যবহারে ‘সামান্য’ মনুষ্য কি ভাবে কাজ করিবে তাহাই স্থির করিতে হইবে; এবং সেই কারণে জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থকে আমরা যে অগ্ৰস্থান দিই তাহাই ব্যবহারদৃষ্টিতে সমুচিত ।” (Sidgwick's Methods of Ethics, Book I. Chap. II. $ 2, pp 18-29; also Book IV. Chap. IV, $ 3, p 474. এই তৃতীয় পন্থা Sidgwick বাহির করিয়াছেন এরূপ নহে; কিন্তু সাধারণ সুশিক্ষিত ইংরেজ লোক প্রায় এই পন্থারই অনুগামী; ইহার Common sense morality এইরূপ নামও আছে ।)


আপত্তি

কিন্তু আমাদের মতে এই যুক্তিবাদে কোন লাভ নাই । বাজারে ব্যবহৃত ওজন মাপে সর্বদাই কিছু কমি বেশী হইয়া থাকে; বস্‌ - এই কারণে যদি রাজদরবারে সকলের প্রমাণভূত বলিয়া নির্ধারিত ওজনমাপেও ন্যূনাধিক্য রাখা হয়, তবে কি আমরা সেই সম্বন্ধে অধিকারীদিগের উপর দোষারোপ করি না ? কর্মযোগশাস্ত্ৰেও এই নীতি প্ৰযুক্ত হইতে পারে । নীতিধর্মের পূর্ণ, শুদ্ধ ও, নিত্য স্বরূপ কি, - ইহার শাস্ত্রীয় নির্ণয় সম্পাদনার্থই নীতিশাস্ত্ৰ প্ৰবর্তিত হইয়াছে; এবং এই কাজ নীতিশাস্ত্ৰ যদি না করে তবে নীতিশাস্ত্ৰ নিষ্ফল বলিতে হইবে । ‘জ্ঞানালোকিত স্বাৰ্থ’ সাধারণ মনুষ্যের মার্গ – সিজ্‌বিক্‌ যে ইহা বলেন, তাহা কিছু মিথ্যা নহে । ভর্তৃহরিও তাহাই বলেন । কিন্তু এই সাধারণ লোকদিগেরই পরাকাষ্ঠা-নীতিমত্তা সম্বন্ধে কিরূপ মত তাহা যদি অনুসন্ধান করা যায়, তাহা হইলে দেখা যাইবে যে, সিজ্‌বিক্‌ “জ্ঞানদীপ্ত উচ্চ স্বাৰ্থে” যে মহত্ত্ব আরোপ করিয়াছেন তাহা ভ্ৰান্তিমূলক; কারণ সাধারণ লোকেরও ধারণা এই যে, নিষ্কলঙ্ক নীতির মাৰ্গ কিংবা সৎপুরুষদিগের অনুসৃত আচরণের মাৰ্গ - ইহা সাধারণ স্বোদর-পূরণ মার্গ হইতে শ্রেয়স্কর । উপরি-উক্ত শ্লোকে ভর্তৃহরি ইহাই বিবৃত করিয়াছেন ।


3.4) অধিক লোকের অধিক সুখ - পরার্থপ্রধান মাৰ্গ


আধিভৌতিক সুখবাদের নিছক স্বাৰ্থী, দূরদর্শী স্বার্থী ও উভয়বাদী বা জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থী, - এই যে তিন মাৰ্গ আছে, সেই তিন মাৰ্গ সম্বন্ধে এতক্ষণ পৰ্যন্ত বিচার করিয়া তাহাদের মুখ্য দোষগুলি কি তাহা বলিয়াছি । কিন্তু ইহাতেও সমস্ত আধিভৌতিক মাৰ্গ শেষ হয় নাই । সাত্ত্বিক আধিভৌতিক পণ্ডিতৈরা প্ৰতিপাদন করিয়াছেন যে, সমস্ত আধিভৌতিক মার্গের মধ্যে “একই মনুষ্যের সুখের দিকে লক্ষ্য না করিয়া, সমস্ত মনুষ্যেরই আধিভৌতিক সুখদুঃখের তারতম্যের প্রতি লক্ষ্য করিয়া নৈতিক কার্যাকাৰ্যের নির্ণয় করা অবশ্যক” । এইরূপ মাৰ্গই শ্রেষ্ঠতম মাৰ্গ । (বেন্থাম, মিল প্রভৃতি পণ্ডিত এই মার্গের অগ্রণী । Greatest good of the greatest number, ইহার অনুবাদ করিয়াছি – “অধিকাংশ লোকের অধিক সুখ” ।) একই কাৰ্যে একই সময়ে সমাজের কিংবা জগতের অন্তৰ্গত সমস্ত ব্যক্তির সুখ হইতে পারে না । একজন যাহা সুখ বলিয়া মনে করে, অন্যের নিকট তাহাই দুঃখজনক । কিন্তু পেচকের আলোক ভাল লাগে না বলিয়া আলোক ত্যাজ্য এরূপ কেহ বলে না, সেইরূপ কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের কোন কথা লাভজনক মনে না হইলেও তাহা যে সকলের পক্ষেই হিতাবহ নহে - একথা কর্মযোগশাস্ত্ৰও বলিতে পারে না ! এবং এই কারণেই “সকল লোকের সুখ” এই শব্দগুলির “অধিক লোকের অধিক সুখ” - এই অৰ্থও করিতে হয় । সারকথা, - “যাহাতে অধিক লোকের অধিক সুখ হয় – তাহাই নীতিদৃষ্টিতে ন্যায্য ও গ্রাহ্য বলিয়া বুঝিতে হইবে” - এই মার্গের এইরূপ  মত । 

আধিভৌতিক সুখবাদের এই তত্ত্ব আধ্যাত্মিক মাৰ্গও স্বীকার করিয়া থাকে । অধিক কি, এই তত্ত্ব আধ্যাত্মিকবাদীরা অতি প্ৰাচীনকালে অনুসন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছেন; প্ৰভেদ এইটুকু যে, আধিভৌতিকবাদীরা এক্ষণে একটা বিশেষ রীতিতে উহার উপযোগ করিয়াছে মাত্র । তুকারামের কথা অনুসারে “জগতের কল্যাণেরই জন্য সাধুদিগের বিভূতি । পরোপকারের জন্য তাঁহারা দেহকে কষ্ট দেন ।” ইহা কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে হয় না । সুতরাং এই তত্ত্বের সত্যতা সম্বন্ধে কিংবা ঔচিত্য সম্বন্ধে কোন বিরোধই নাই । স্বয়ং ভগবদ্গীতাতেও পূর্ণ যোগযুক্ত অর্থাৎ কর্মযোগযুক্ত জ্ঞানী পুরুষের লক্ষণ বলিবার সময় “সর্বভূতহিতে রূতাঃ” অর্থাৎ সর্বভূতের কল্যাণ সাধনেই তাঁহারা নিমগ্ন, এইরূপ দুইবার স্পষ্টরূপে কথিত হইয়াছে [গী|৫|২৫; ১২|৪] । ধর্মাধর্মের নির্ণয়ার্থেও আমাদিগের শাস্ত্রকার যে এই তত্ত্বের প্রতি সর্বদাই লক্ষ্য রাখেন তাহা দ্বিতীয় প্রকরণে প্রদত্ত “যদ্‌ভূতহিত্যমত্যন্তং তৎ সত্যমিতি ধারণা” এই মহাভারতের বচনে স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । কিন্তু আমাদের শাস্ত্ৰকারদিগের উক্তি অনুসারে, “সর্বভূতহিত”কে জ্ঞানী ব্যক্তিদিগের আচরণের বাহ্য লক্ষণ স্থির করিয়া ধর্মাধর্ম নির্ণয়াৰ্থ প্ৰসঙ্গ বিশেষে স্থুলভাবে উহার উপযোগ করা এক কথা; এবং উহাকে নীতিমত্তার সর্বস্ব মনে করিয়া অন্য কোন বিষয়ের বিচার না করিয়া, কেবল এই ভিত্তির উপরেই নীতিশাস্ত্রের সমস্ত ইমারত খাড়া করা পৃথক কথা । এই উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য । আধিভৌতিক পণ্ডিত অন্য মার্গ স্বীকার করিয়া প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন যে, অধ্যাত্মবিদ্যার সহিত নীতিশাস্ত্রের কোন সম্বন্ধ নাই । তাই, তাহার এই কথা কতটা যুক্তিসংগত তাহা আমাদিগের এখন দেখিতে হইবে । ‘সুখ’ ও ‘হিত’ এই দুই শব্দের অর্থে খুবই ভেদ আছে; কিন্তু আপাতত ঐ ভেদ যদি একপাশে সরাইয়া রাখা হয় এবং ‘সর্বভূতহিত’ অর্থে “অধিক লোকের অধিক সুখ” ধরিয়াই কাজ চালানো হয়, তথাপি, কার্যাকাৰ্যনির্ণয়ের কাজে কেবল এই তত্ত্বেরই উপযোগ করিলে দেখা যায় যে, অনেক,গুরুতর বাধাবিঘ্ন উৎপন্ন হইয়া থাকে । মনে কর, এই তত্ত্বের কোন অধিভৌতিক উপদেষ্টা অর্জুনকে উপদেশ দিতে গেছেন; তিনি তাঁহাকে কি উপদেশ দিতেন ? ইহাই না কি যে, ভারতীয় যুদ্ধে তোমাদেয় জয়লাভ হইলে, যদি অধিক লোকের অধিক সুখ হইবার সম্ভাবনা থাকে, তবেই ভীষ্মকে বধ করিয়াও যুদ্ধ করা তোমার কর্তব্য” ? 


আপত্তি-১ : কেবল সংখ্যাধিক্য দ্বারা নীতি নির্ধারণ

বাহ্যদৃষ্টিতে এই উপদেশ অত্যন্ত সহজ ও সরল বলিয়া মনে হয়; কিন্তু একটু তলাইয়া দেখিলে, উহার অপূর্ণতা ও বাধা বুঝা যায় । অধিক অর্থে কত লোক ? পাণ্ডবদিগের সাত, আর কৌরবদিগের এগারো অক্ষৌহিণী লোক; পাণ্ডবদিগের পরাজয় হইলে এই এগারো অক্ষৌহিণীর সুখ হইত, - এই যুক্তিবাদে, পাণ্ডবদিগের পক্ষ ন্যায়ের বিরোধী পক্ষ ছিল, একথা বলা যাইতে পারে কি ? শুধু ভারতীয় যুদ্ধ সম্বন্ধে কেন, অন্য অনেক প্রসঙ্গেও কেবল সংখ্যা ধরিয়া নীতিমত্তার নির্ণয় করা ভুল । লক্ষ দুৰ্জ্জনের সুখ হওয়া অপেক্ষা যাহাতে একজন সজ্জনেরও সন্তোষ হয় তাহাই প্ৰকৃত সৎকাৰ্য, - ব্যবহার ক্ষেত্রে সকল লোকই এইরূপ বুঝিরা থাকে । এই ধারণা সত্য হইলে, এক সজ্জনের সুখকে লক্ষ দুৰ্জ্জনের সুখাপেক্ষা অধিক মূল্য দিতে হয়; এবং ঐরূপ করিলে, “অধিক লোকের অধিক সুখই” নীতিমত্তার পরীক্ষার একমাত্ৰ সাধন, এই প্ৰথম সিদ্ধান্তটি ঐ পরিমাণে পঙ্গু হইয়া পড়ে । তাই, লোকের সংখ্যা কম কিংবা বেশী হওয়ার সহিত নীতিমত্তার নিত্য সম্বন্ধ হইতে পারে না, একথা স্বীকার করিতেই হয় । 


আপত্তি-২ : কে নিশ্চিত করিবে যে, অধিকাংশ লোকের অধিক সুখ কি ?

আর একটা কথা মনে করা উচিত যে, সাধারণতঃ সকল লোকে যে বিষয়কে কখন কখন সুখাবহ বলিয়া মনে করে, তাহাই দূরদর্শী ব্যক্তি পরিণামে সকলের পক্ষেই অনিষ্টজনক মনে করেন দেখা যায় । উদাহরণ যথা – সক্রেটিস্‌যিশুখৃষ্ট । দুজনেই দেশভাইদিগকে আপনি আপন মত কল্যাণজনক জানিয়া তদনুসারে উপদেশ দিতেন । কিন্তু তাঁহাদের দেশভাইরা তাঁহাদিগকে “সমাজের শত্রু” মনে করিয়া তাঁহাদিগের জন্য “দেহান্ত প্ৰায়শ্চিত্ত” ব্যবস্থা করিলেন । সেই সময়ের জনসাধারণ ও জন-নায়ক উভয়েই মিলিতভাবে “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই তত্ত্ব ধরিয়াই কাজ করিয়ছিল; কিন্তু এখন আমরা বলিতে পারি না যে, সাধারণ লোকের আচরণ ন্যায্য হইয়াছিল । সারকথা, “অধিক লোকের অধিক সুখ”ই নীতির মূলতত্ত্ব - ইহা যদি মুহুর্তের জন্যও স্বীকার করা যায় তথাপি, তাহা দ্বারা লক্ষকোটী লোকের সুখ কিসে হয় এবং কি করিয়া তাহা স্থির হইবে এবং কে স্থির করিবে, এ সকল প্রশ্নের কোন মীমাংসা হয় না । সাধারণত, যে সকল লোকের সুখদুঃসম্বন্ধে প্রশ্ন উপস্থিত হয়, সেই সকল হস্তেই ইহার মীমাংসার ভার দেওয়া যাইতে পারে । কিন্তু সাধারণ প্রসঙ্গে, এতটা হ্যাঙ্গাম হুজ্জৎ করিবার কোন প্রয়োজন হয় না; এবং যখন কোন গোলমেলে বিশেষ প্রসঙ্গ উপস্থিত হয় তখন নিজের সুখ কিসে হয় ইহার নির্ভুল বিচার করা সাধারণ লোকের সাধ্যায়ত্ত হয় না । এই অবস্থায় ভূতের হাতে জ্বলন্ত কাঠ দিলে যে পরিণাম হয়, “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই নীতিতত্ত্ব অনধিকারী লোকের হাতে পড়িলে ঐরূপ পরিণামই হইয়া থাকে । ইহা উপরি-উক্ত দুই উদাহরণে স্পষ্ট উপলব্ধি হয় । “আমাদের এই নীতিধর্মের তত্ত্বটি আসলে সত্য, কিন্তু অজ্ঞান লোকেরা যদি তাহার অপব্যবহার করে, আমরা তাহার কি করিব ?” এই উত্তরের কোন অর্থ নাই । কারণ, কোন তত্ত্ব সত্য হইলেও তাহার উপযোগ করিবার অধিকারী কে এবং সেই অধিকারী ইহার উপযোগ কখনও কিরূপে করিবে, - ইত্যাদি বিষয়ের নিয়মও ঐ তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে বলিয়া দেওয়া উচিত । নচেৎ, সক্রেটিসেরই ন্যায় নীতিমত্তা নির্ণয় করিতে আমরা সমর্থ মনে করিয়া আমাদের অর্থকে অনর্থে পরিণত করাই সম্ভব ।


আপত্তি-৩ : কর্ম অপেক্ষা কর্তার বুদ্ধির মহত্ব

কেবল সংখ্যা ধরিয়া নীতির সমুচিত নির্ণয় হয় না, এবং অধিক লোকের অধিক সুখ কিসে হয় ইহা তর্কের দ্বারা নির্ধারণ করিবার কোনো বাহ্য সাধন নাই । এই দুই আপত্তি ছাড়া, এই মার্গ সম্বন্ধে আরও গুরুতর আপত্তি আনা যাইতে পারে । উদাহরণ যথা, বিচার করিয়া দেখিলেই সহজে উপলব্ধি হইবে যে, কোন কাৰ্যের শুধু বাহ্য পরিণাম ধরিয়াই সেই কাৰ্য ন্যায্য কিংবা অন্যায্য ইহার পূর্ণ ও সন্তোষজনক মীমাংসা অনেক সময় করিতে পারা যায় না । কোন ঘড়ি ঠিক্‌ সময় রাখে কি না, তাহা ধরিয়াই ঐ ঘড়ি ভাল কি মন্দ নির্ণয় করি সত্য; কিন্তু মনুষ্যের কাৰ্যে এই ন্যায় প্রয়োগ করিবার পূর্বে, মনুষ্য শুধু একটা ঘড়ির মত যন্ত্র নহে, ইহা মনে রাখা আবশ্যক । সজ্জনমাত্রেই জগতের কল্যাণার্থে চেষ্টা করিয়া থাকেন সত্য; কিন্তু উল্টাপক্ষে, যে কোন লোক লোকহিতের চেষ্টা করিবে সে-ই যে সাধু হইবে এরূপ নিশ্চয় করা যাইতে পারে না । মনুষ্যের অন্তঃকরণ কিরূপ তাহাও দেখা আবশ্যক । যন্ত্র ও মনুষ্যের মধ্যে যদি কোন ভেদ থাকে, তাহা এই যে, যন্ত্র হৃদয়হীন আর মনুষ্য হৃদয়যুক্ত; এবং সেই জনাই, অজ্ঞান কিংবা ভুলক্রমে যদি কাহারো অপরাধ হয় আইনে তাহা মাৰ্জনীয় বলিয়া স্বীকৃত হয় । তাৎপৰ্য, - কোন কর্ম ভাল কি মন্দ, ধর্ম কি অধর্ম, নীতিমূলক কি অনীতিমূলক, শুধু বাহ্য ফল বা পরিণাম দেখিয়া, অর্থাৎ ‘অধিক লোকের অধিক সুখ’ হইবে কি না এই মাত্র দেখিয়া তাহা নিৰ্ণয় করা যাইতে পারে না । উক্ত কর্ম করিবার বুদ্ধি, বাসনা, বা হেতু কিরূপ সে সম্বন্ধেও দেখিতে হইবে । একবার আমেরিকার কোন বড় শহরে সকল লোকের সুখ ও সুবিধার জন্য ট্রামওয়ে করা আবশ্যক হইয়াছিল; কিন্তু অধিকারীদিগের বিনা আদেশে ট্রামওয়ে করা সম্ভব ছিল না । সরকারী মঞ্জুরী পাইতে বিলম্ব হইতেছিল । তখন ট্রামওয়ের ব্যবস্থাপক, অধিকারীদিগকে কিছু টাকা ঘুষ দিয়া শীঘ্র শীঘ্ৰ মঞ্জুরী বাহির করিয়া লইলেন । ট্রামওয়ে হইয়া গেল এবং তাহার দরূণ শহরের সকল লোকের সুবিধা ও উপকার হইল । কিছু দিন পরে ঘুষ দিবার কথা প্ৰকাশ হওয়ায় ব্যবস্থাপকের উপর ফৌজদারী মোকদ্দমা রুজু হইল । প্ৰথম “জুরি” একমত না হওয়ায়, অন্য “জুরি” নির্বাচিত হইল, এবং সেই জুরি দোষী বলিয়া সা্ব্যস্ত করায় ট্রামওয়ে ব্যবস্থাপকের দণ্ড হইল । এই স্থলে, ‘অধিক লোকের অধিক সুখ’ এই নীতিতত্ত্ব ধরিয়া নিষ্পত্তি হইতে পারে না । ঘুষ দিবার দরুণ ট্রামওয়ে হইল - এই বাহ্য পরিণামে অধিক লোকের অধিক সুখ হইবার কথা; কিন্তু তৎসত্ত্বেও এইরূপ ঘুষ দিয়া কার্য উদ্ধার করাটা ন্যায়সঙ্গত হয় নাই । (পল্‌ কেরসের “The Ethical Problem” গ্ৰন্থ হইতে এই উদাহরণ গৃহীত হইয়াছে ।)

আমাদের কর্তব্য মনে করিয়া নিষ্কাম বুদ্ধিতে দান করা, এবং কীর্তির জন্য বা অন্য কোন ফলকামনায় দান করা - এই দুই প্ৰকার দানের বাহ্য পরিণাম একই রকম হইলেও প্রথম প্রকারের দান সাত্ত্বিক ও দ্বিতীয় প্রকারের দান রাজসিক - ভগবদ্গীতায় এইরূপ ভেদ করা হইয়াছে [গী|১৭|২০, ২১] । এবং ঐ দান কুপাত্রে প্রদত্ত হইলে তাহা তামসিক বা গর্হিত বলিয়াও উক্ত হইয়াছে । কোন গরীব লোক কোন ধর্মকাৰ্যে চারি পয়সা দিলে এবং সেই একই কাৰ্যে কোন ধনবান ব্যক্তি একশো টাকা দিলে, উভয়েরই নৈতিক যোগ্যতা জনসাধারণের নিকট সমান বলিয়াই বিবেচিত হয় । কিন্তু কেবল “অধিক লোকের অধিক হিত” এই বাহ্য সাধনের দ্বারা যদি বিচার করা যায় তাহা হইলে এই দুই দান নৈতিক দৃষ্টিতে সমান যোগ্য নহে এইরূপ বলিতে হয় । “অধিক লোকের অধিক হিত” এই আধিভৌতিক নীতিতত্ত্বের একটা মস্ত দোষ এই যে, কর্তার মনোগত অভিপ্ৰায় বা ভাবের কোন বিচার উহাতে হয় না; এবং মনোগত অভিপ্ৰায়ের প্রতি লক্ষ্য করিতে হইলে, অধিক লোকের অধিক বাহ্য সুখই নীতিমত্তার কষ্টিপাথর এই যে প্ৰথম প্ৰতিজ্ঞা, তাহার সহিত বিরোধ উপস্থিত হয় । ব্যবস্থাপক সভা কিংবা মণ্ডলী অনেক ব্যক্তির সমষ্টি হওয়ায়, তৎকর্তৃক প্ৰণীত আইন বা নিয়ম উচিত কি অনুচিত বিচার করিবার সময় সভাসদ্‌দিগের অন্তঃকরণ কিরূপ ছিল তাহা দেখিবার কোন হেতু থাকে না; তাহাদের কৃত আইন হইতে, অধিক লোকের অধিক সুখ হইবে কি না, এই বাহ্য বিচার করিলেই যথেষ্ট হয় । কিন্তু অন্য স্থলে ঐ ন্যায় খাটে না, তাহা পুর্বোক্ত উদাহরণ হইতে সহজেই উপলব্ধি হইবে । “অধিক লোকের অধিক হিত বা সুখ” একেবারেই অনুপযোগী এরূপ আমি বলি না । কেবল বাহ্য পরিণামের বিচার করিতে হইলে উহ্য অপেক্ষা অন্য উৎকৃষ্ট তত্ত্ব কোথাও পাওয়া যাইরে না । কিন্তু আমার বক্তব্য এই যে, কোন বিষয় নীতিদৃষ্টিতে ন্যায্য বা অন্যায্য নির্ণয় করিতে হইলে, এই বাহ্য তত্ত্বের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর না করিয়া অনেক প্রসঙ্গে অন্য বিষয়েরও বিচার করা আবশ্যক হয় । 

সুতরাং নীতিতত্ত্বনির্ণয় শুধু এই তত্ত্বের উপরেই সম্পূর্ণরূপ নির্ভর করিয়া থাকিতে পারে না, ইহা অপেক্ষা অধিকতর নিশ্চিত ও নির্দোষ তত্ত্ব খুঁজিয়া বাহির করা আবশ্যক । “কর্মাপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ” [গী|২|৪৯] এই যে কথা গীতার আরম্ভেই উক্ত হইয়াছে, তাহারও ইহাই অভিপ্ৰায় । শুধু বাহ্য কর্মের উপর দৃষ্টি রাখিলে অনেক সময় ভ্ৰমে পড়িতে হয় । “স্নান, সন্ধ্যা, তিলক, মালা” ইত্যাদি বাহ্য কর্ম স্থির রাখিলেও “অন্তরে ক্ৰোধের জ্বালা” জলিতে থাকা অসম্ভব নহে । কিন্তু উল্টাপক্ষে অন্তরের ভাব শুদ্ধ থাকিলে, বাহ্য কর্মের কোন গুরুত্বই থাকে না; সাধারণ লোকের নিকট সুদামের প্রদত্ত একমুষ্টি চাউল দানের ন্যায় অত্যন্ত অল্প বাহ্য কর্মের ধর্মসংগত ও নীতিসংগত যোগ্যতা, অধিক লোকের অধিক সুখদায়ী বিশ মণ অন্নের সমান । তাই, জর্মান তত্ত্বজ্ঞানী কাণ্ট, কর্মের বাহ্য ও প্ৰত্যক্ষ পরিণামের তারতম্যবিচার গৌণ স্থির করিয়া কর্তার শুদ্ধ বুদ্ধি হইতেই নীতিশাস্ত্ৰ বিষয়ে স্বীয় বিচার আরম্ভ করিয়াছেন । (Kants’ “Theory of Ethics”, translated by Abbott, 6th Ed, P.6).

আধিভৌতিক সুখবাদের এই প্রধান ত্রুটি আধিভৌতিকবাদীদিগের যে নজরে পড়ে নাই তাহা নহে । হিউম স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, যখন মনুষ্যের কর্ম তাহার স্বভাবের দ্যোতক হয়, এবং সেই কারণে যখন লোকেরা উহাই নীতিমত্তার প্রদর্শক বলিয়া স্বীকার করে, তখন কেবল বাহ্য পরিণাম ধরিয়া ঐ কর্ম স্তুত্য বা নিন্দনীয় তাহা স্থির করা অসম্ভব । (“For as actions are objects of our moral sentiment, so far only as they are indications of the internal character, passions and affections, it is impossible that they can give rise either to praise or blame, where they proceed not from these principles, but are derived altogether from external objects." – Hume’s “Inquiry concerning Human Understanding”, Section VIII. Part II., P.368 of Hume’s “Essays”, the World Library Edition.)

“কর্তা যে বুদ্ধিতে বা হেতুতে কোন কর্ম করে, সেই কর্মের নীতিমত্তা সম্পূর্ণরূপে তাহারই উপর নির্ভর করে” এই কথা মিল সাহেবেরও অভিমত । কিন্তু স্বপক্ষ সমর্থনাৰ্থ মিল এই সম্বন্ধে এইরূপ কুটতর্ক করেন যে, “যে পর্যন্ত বাহ্য কর্মের মধ্যে কোন ভেদ না হয় সে পর্যন্ত কর্তার উহা করিবার যে কোন বাসনা হউক না কেন তাহার দ্বারা কর্মের নীতিমত্তার কোন ইতরবিশেষ হয় না ।” (“Morality of the action depends entirely upon the intention, that is, upon what the agent wills to do. But the motive, that is, the feeling which makes him will so to do, when it makes no difference in the act, makes none in the morality.” Mill’s “Utilitarianism” P.27.)

মিলের এই তর্কে সাম্প্রদায়িক আগ্ৰহ দেখা যায়; কারণ, বুদ্ধি পৃথক হওয়া প্ৰযুক্ত, দুই কর্ম দেখিতে এক হইলেও, তত্ত্বতঃ উহা একই মূল্যের কখনই হইতে পারে না । তাই “যে পৰ্যন্ত (বাহ্য) কর্মের মধ্যে ভেদ না হয়” ইত্যাদি মিলের নিয়মটিও নির্মূল হইয়া পড়ে, ইহা গ্রীনসাহেব উত্তরে বলিয়াছেন (Green’s “Prolegomena to Ethics” $202 note, Р.348. 5th Cheaper Edition.) । গীতার অভিপ্ৰায়ও তাহাই । কারণ, দুই ব্যক্তি একই ধর্মকাৰ্যের জন্য একই রকমের দান করিলেও, উভয়ের বুদ্ধিভেদমূলে এক দান সাত্ত্বিক, অন্য দান রাজসিক বা তামসিকও হইতে পারে, ইহা গীতাতে উক্ত হইয়াছে । কিন্তু এই সম্বন্ধে বেশী বিচার, প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য মতের তুলনা করিবার সময় পরে করিব । এক্ষণে এইটুকু দেখিতে হইবে যে, কর্মের নিছক্‌ বাহ্য পরিণামের উপর নির্ভরকারী আধিভৌতিক সুখবাদের শ্রেষ্ঠ শ্রেণীও নীতিনির্ণয়কাৰ্যে কিরূপ অসম্পূর্ণ হইতেছে; এবং ইহা সিদ্ধ করিবার জন্য মিলের উপরি-উক্ত স্বীকৃতিই আমাদের মতে যথেষ্ট ।


আপত্তি-৪ : পরোপকার কেন করা চাই ?

“অধিক লোকের অধিক সুখ” এই আধিভৌতিক মার্গে, কর্তার বুদ্ধির বা ভাবের কোন বিচারই হয় না, ইহাই সব চেয়ে বড় দোষ । মিলের উক্তি হইতে ইহা স্পষ্টই সিদ্ধ হইতেছে যে, তাহার যুক্তিকে সত্য বলিয়া মানিয়া লইলেও সব সময়ে তাহার একই প্ৰকার উপযোগ করা যাইতে পারে না; কারণ উহা কেবল বাহ্য ফল ধরিয়া নীতিনির্ণয় করে, অর্থাৎ তাহার উপযোগ একটা সীমার মধ্যে বদ্ধ সুতরাং একদেশদর্শী । কিন্তু ইহা ছাড়া এই মত সম্বন্ধে আরও একটা আপত্তি আছে যে, ‘স্বাৰ্থ অপেক্ষা পরার্থ কেন এবং কিসে শ্রেষ্ঠ’ তাহার কোন যুক্তি না বলিয়া ইহারা এই তত্ত্বকে সত্য বলিয়া মানিয়া লয়েন । ফলে দাড়ায় এই যে, জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থের অপ্রতিহত বৃদ্ধি হইতে থাকে । স্বার্থ ও পরার্থ এই দুই তত্ত্বই মনুষ্যের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই যদি উৎপন্ন হইয়া থাকে অর্থাৎ স্বাভাবিক হয়, তবে স্বাৰ্থ অপেক্ষা “অধিক লোকের সুখ” এই তত্ত্বের অধিকতর গুরুত্ব আমি কেন মানিব ? তুমি অধিকাংশ লোকের অধিক সুখ দেখিয়া এইরূপ কর, ঐ প্রশ্নের ইহা সন্তোষজনক উত্তর হইতেই পারে না; কারণ, “অধিক লোকের অধিক সুখ” আমরা কেন করিব, ইহাই হইল মূল প্রশ্ন । লোকের হিত করিলে প্ৰায় আপনারও হিত হয় বলিয়া এই প্রশ্ন সর্বদা উপস্থিত হয় না, এ কথা সত্য । কিন্তু আধিভৌতিক মার্গের উপরি-উক্ত তৃতীয় বৰ্গ হইতে এই শেষের অর্থাৎ চতুর্থ বর্গের বিশেষত্ব এই যে, এই আধিভৌতিক মার্গের লোকেরা মনে করে যে, স্বার্থ ও পরার্থের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইলে, জ্ঞানদীপ্ত স্বার্থের মার্গ অনুসরণ না করিয়া, উচ্চ স্বাৰ্থ ছাড়িয়া পরার্থ সাধনেরই চেষ্টা করা কর্তব্য । এই আধিভৌতিক মার্গের বিশেষত্বসম্বন্ধে কোন যুক্তি দেখানো হয় নাই । 


3.4.1) মনুষ্যজাতির পূর্ণ অবস্থা


এই অভাব এই মার্গের এক আধিভৌতিক পণ্ডিতের নজরে পড়ে । তিনি ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্য পৰ্যন্ত সমস্ত সজীব প্ৰাণীদিগের ব্যবহার বিশেষরূপ নিরীক্ষণ করেন । শেষে তিনি এই সিদ্ধান্ত করিলেন যে, যখন আপনার মতোই আপনার সন্তানসন্ততি ও জাতিকে পরিপোষণ করা এবং কাহাকে কষ্ট না দিয়া আপন বন্ধুদিগকে যতদূর সম্ভব সাহায্য করা - এই গুণটি ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্য পর্যন্ত উত্তরোত্তর বর্ধিত আকারে ব্যক্ত হইয়া আসিতেছে দেখিতে পাওয়া যায়, তখন বলা যাইতে পারে যে, সজীব সৃষ্টির আচরণের এই পরস্পরকে সাহায্য করা একটী মুখ্য ভাব । সজীব সৃষ্টির এই ভাবটী প্রথমতঃ সন্তানোৎপাদন এবং পরে তাহার রক্ষণ-পোষণ ব্যাপারেই দেখা যায় । স্ত্রী-পুরুষ ভেদ যাহাদের মধ্যে হয় নাই এইরূপ অতিসূক্ষ্ম কীটজগতের মধ্যেও দেখা যায় যে, কীটের দেহ বাড়িতে বাড়িতে ফাটিয়া গিয়া উহা দুই কীটে পরিণত হয় । সন্ততির জন্য অর্থাৎ পরের জন্য এই ক্ষুদ্র কীট আপন দেহ বিসর্জন করে বলিলেও চলে । সেইরূপ আবার, সজীব সৃষ্টির মধ্যে এই কীটের উপরউপরকার পদবীর স্ত্রীপুরুষাত্মক প্ৰাণীও আপনি সন্ততি রক্ষণার্থ স্বাৰ্থত্যাগে আনন্দ অনুভব করিয়া থাকে; এবং এই গুণ পরে উত্তরোত্তর বাড়িয়া গিয়া মনুষ্যজাতির নিতান্ত বন্য অসভ্য সমাজের মধ্যেও দেখা যায় যে, শুধু আপনি সন্ততিকে নহে, আপন জাতভাইদিগকেও আনন্দের সহিত সাহায্য করিতে প্ৰবৃত্ত হয় । তাই, পরার্থের কাজে ও স্বার্থের মতোই সুখ অনুভব করা, সমস্ত সৃষ্টি্র এই যে মুখ্য ভাব, এই ভাবটিকে আরও সন্মুখে অগ্রসর করিয়া দিয়া স্বার্থ ও পরার্থের মধ্যে প্ৰতীয়মান বিরোধটি একেবারে বহিষ্কৃত করিবার প্রযত্ন সজীব সৃষ্টির শিরোমণি মনুষ্যের কর্তব্য । বস্, ইহাতেই উহার কর্তব্যের শেষ । (এই মতবাদ স্পেনসারের “Data of Ethics” গ্রন্থে প্রদত্ত হইয়াছে । তাঁহার নিজের মত ও মিলের মতের মধ্যে কি প্রভেদ, তাহা মিলের নিকট প্রেরিত পত্রের মধ্যে বিবৃত হওয়ায়, ঐ পত্র হইতে, উহা উদ্ধৃত করিয়া উক্ত গ্রন্থে প্রদত্ত হইয়াছে । PP. 57, 123. Also, see Bain's “Mental and Moral Science”, PP.721, 722, (1875).

এই যুক্তিবাদ খুবই ঠিক । পরোপকার করিবার সদ্‌গুণ, মুক-সৃষ্টির মধ্যেও সন্ততিরক্ষণব্যাপারে পাওয়া যায়, অতএব উহার পরমোৎকর্ষ সাধন করাই জ্ঞানবান মনুষ্যের পুরুষাৰ্থ, এই তত্ত্ব কিছু নূতন নহে । এই তত্ত্বের বিশেষত্ব কেবল এইটুকু যে, আধিভৌতিক শাস্ত্রের জ্ঞান অধুনা অনেক বাড়িয়া যাওয়ায় এই তত্ত্বের আধিভৌতিক উপপত্তি ভাল করিয়া বিবৃত করা হইয়াছে । আমাদের শাস্ত্রকারদিগের দৃষ্টি আধ্যাত্মিক হইলেও প্রাচীন গ্ৰন্থাদিতে কথিত হইয়াছে যে, -
অষ্টাদশপুরাণানাং সারং সারং সমুদ্‌ধৃতম্‌ ৷
পরোপকারঃ পুণ্যায় পাপায় পরপীড়নম্‌ ॥
“পরোপকারই পুণ্য এবং পরপীড়নই পাপ - ইহাই অষ্টাদশ পুরাণের সার কথা” । ভর্তৃহরিও বলিয়াছেন যে, “স্বাথো যস্য পরার্থ এবং স পুমান্‌ একঃ সতাং অগ্ৰণীঃ” পরার্থই যাহার স্বাৰ্থ হইয়াছে সে-ই সমস্ত সজ্জনের মধ্যে শ্ৰেষ্ঠ । ভাল; এখন ক্ষুদ্র কীট হইতে মনুষ্য পৰ্যন্ত সৃষ্টির উত্তরোত্তর উন্নত শ্রেণীদিগকে লক্ষ্যের মধ্যে আনিলে আর একটী প্রশ্ন বাহির হয় যে, মনুষ্যে কেবল পরোপকারবুদ্ধিরই কি উৎকর্ষ হইয়াছে, অথবা তাহার সঙ্গে ন্যায়বুদ্ধি, দয়া, উদারতা, দূরদৃষ্টি, তর্ক, শৌর্য, ধৃতি, ক্ষমা, ইন্দ্ৰিয়নিগ্ৰহ ইত্যাদি অন্য সাত্ত্বিক গুণেরও বৃদ্ধি হইয়াছে ? এই বিষয়ে বিচার করিলে পর বলিতে হয় যে, অন্য সমস্ত সজীব প্ৰাণী অপেক্ষা, মানুষ্যের মধ্যেই সমস্ত সদ্‌গুণের উৎকর্ষ হইয়াছে । এই সমস্ত সাত্ত্বিক গুণসমূহের সমুচ্চয়কে আমরা মনুষ্যত্ব নামে অভিহিত করি । এক্ষণে ইহা সিদ্ধ হইল যে, পরোপকার অপেক্ষা “মনুষ্যত্ব”কে আমি শ্ৰেষ্ঠ বলিয়া মানি; এ অবস্থাতে কোন কর্মের ঔচিত্য অনৌচিত্য বা নীতিমত্তার নির্ণয়ে, সেই কর্মের পরীক্ষা কেবল পরোপকারের দিক দিয়া করা যায় না - “মনুষ্যত্বের” দৃষ্টিতে, অর্থাৎ মানবজাতির মধ্যে অন্য প্ৰাণী অপেক্ষা যে সকল গুণ উৎকর্ষ লাভ করিয়াছে দেখা যায়, সেই সমস্ত গুণের দৃষ্টিতে উক্ত কর্মের পরীক্ষা করা একান্ত আবশ্যক । কেবল এক পরোপকারবুদ্ধির উপর ভিত্তিস্থাপন করিয়া কোন প্রকার সিদ্ধান্ত করিবার পরিবর্তে ইহাই স্বীকার করিতে হয় যে, সমস্ত মনুষ্যের “মনুষ্যপণা” বা “মনুষ্যত্ব” যে কর্মের দ্বারা বৃদ্ধি পাইতে পারে কিংবা “মনুষ্যত্ব” যে কর্মের দ্বারা বিভূষিত হয় তাহাই সৎকাৰ্য, তাহাই নীতিধর্ম । এই ব্যাপক দৃষ্টিকে একবার অনুসরণ করিলে, “অধিক লোকের অধিক সুখ” উক্ত দৃষ্টির একটা স্বল্প অংশ হইয়া যাইবে -  কেবল এই শেষোক্ত দৃষ্টিতেই সমস্ত কাৰ্যের ধর্মাধর্ম বা নীতিমত্তার বিচার করিতে হইবে, এই মতের উপর আর নির্ভর করা যায় না; সুতরাং ধর্মাধর্মের নির্ণয়ের জন্য মনুষ্যত্বেরই বিচার করা আবশ্যক হইবে । “মনুষ্যত্ব বা মনুষ্যপণা”র যথার্থ স্বরূপ কি, তাহার সূক্ষ্ম বিচার করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে, আমার মনে যাজ্ঞবল্ক্যের উক্তি অনুসারে “আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ” এই বিষয় স্বভাবতই উপস্থিত হয় । নীতিশাস্ত্রের বিচারক এক মার্কিন গ্ৰন্থকার এই সমুচ্চয়াত্মক মনুষ্যধর্মকেই ‘আত্মা’ সংজ্ঞা প্রদান করিয়াছেন ।

নিছক স্বাৰ্থ বা নিজের বিষয়-সুখের কনিষ্ঠ শ্রেণী হইতে উচ্চে উঠিতে উঠিতে আধিভৌতিক সুখবাদীরাও কেমন করিয়া পরোপকার ও শেষে মনুষ্যত্বের শ্রেণী পর্যন্ত আসিয়া পৌঁছেন তাহা উপরি-উক্ত আলোচনা হইতে উপলব্ধি হইবে । কিন্তু মনুষ্যত্ববিষয়েও আধিভৌতিকবাদীদিগের মনে প্রায় সমস্ত লোকের বাহ্য বিষয়সুখেরই কল্পনা মুখ্য হয়; অতএব যাহাতে অন্তঃশুদ্ধি ও অন্তঃসুখের বিচার আমলে না আসে, আধিভৌতিকবাদীদিগের সেই শেষের শ্রেণীও আমাদিগের, অধ্যাত্মবাদী শাস্ত্রকারের মতে নির্দোষ বলিয়া নির্ধারিত হয় নাই । মনুষ্যের সমস্ত চেষ্টা-প্ৰযত্ন, সুখপ্রাপ্তি ও দুঃখনিবারণার্থ হইয়া থাকে, ইহা সাধারণত স্বীকার করিলেও, প্ৰকৃত ও নিত্যসুখ আধিভৌতিক অর্থাৎ ঐহিক বিষয়োপভোগের মধ্যেই আছে কিংবা অন্য কিছুতে আছে প্ৰথমে এই প্রশ্নের নির্ণয় ব্যতীত, কোন আধিভৌতিক পক্ষই গ্ৰাহ্য বলিয়া ধরা যাইতে পারে না । শারীরিক সুখাপেক্ষা মানসিক সুখের যোগ্যতা অধিক, ইহা আধিভৌতিকবাদীও স্বীকার করেন । পশুর যে-যে সুখ উপভোগ করিতে সমর্থ, সেই সমস্ত সুখ কোন মনুষ্যকে দিয়া, তাহাকে যদি প্রশ্ন করা যায় “তুই পশু হইতে রাজি আছিস কি ?” - একজন মনুষ্যও পশু হইতে স্বীকার করিবে না । সেইরূপ, তত্ত্বজ্ঞানের গভীর বিচার নিবন্ধন বুদ্ধি যে এক প্রকার শান্তি লাভ করে তাহার যোগ্যতা, ঐহিক সম্পত্তি কিংবা বাহ্য উপভোগ অপেক্ষা শতগুণ অধিক, একথা জ্ঞানী ব্যক্তিকে বলিতে হইবে না । ভাল; লোকমতের প্রতি লক্ষ্য করিলেও দেখিতে পাওয়া যায় যে, নীতিমত্তা-নির্ণয় শুধু সংখ্যার উপর নির্ভর করে না; মনুষ্য যাহা কিছু করে তাহা কেবল আধিভৌতিক সুখের জন্যই করে না, আধিভৌতিক সুখকেই পরম সাধ্য বলিয়া মানে না । আমাদের বক্তব্য এই যে, শুধু বাহ্য সুখ কেন, প্ৰসঙ্গবিশেষ আসিলে জীবনেরও পরোয়া রাখা কর্তব্য নহে । কারণ, সেই সময়ে আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে সত্যাদি যে সকল নীতিধর্মের যোগ্যতা নিজের প্রাণ অপেক্ষাও অধিক, সেই সকল পালন করিবার জন্য মনোনিগ্ৰহেতেই মনুষ্যের মনুষ্যত্ব । অর্জুনের এইরূপ অবস্থা হইয়াছিল । অর্জুনেরও প্রশ্ন ইহা ছিল না যে, যুদ্ধ করিলে কাহার কতটা সুখ হইবে । শ্ৰীকৃষ্ণের নিকট তাঁহার এই প্রশ্ন ছিল যে, “আমার অর্থাৎ আমার আত্মার শ্রেয় কিসে হইবে তাহা আমাকে বল” [গী|২|৭; ৩|২] । আত্মার এই নিত্যকালের শ্ৰেয় ও সুখ, আত্মার শান্তিতে আছে । তাই ঐহিক সুখ কিংবা সম্পত্তি যতই পাওয়া যাক না কেন, শুধু তাহাতে এই আত্মসুখ কিংবা শান্তিলাভের আশা নাই - “অমৃতত্বস্য তু নাশাস্তি বিত্তেন” - ইহা বৃহদারণ্যক উপনিষদে উক্ত হইয়াছে [বৃ|২|৪|২] । এই প্রকারে কঠোপনিষদে লিখিত আছে যে, মৃত্যু নচিকেতাকে পুত্র পৌত্র পণ্ড ধান্য দ্রব্য প্রভৃতি বহু প্রকার ঐহিক সম্পত্তি দিবার জন্য প্ৰস্তুত থাকিলেও, নচিকেতা মৃত্যুকে স্পষ্ট জবাব দিলেন – “আমি আত্মবিদ্যা চাই, আমি সম্পত্তি চাই না;” এবং প্রেয় অর্থাৎ ইন্দ্ৰিয়ের প্রীতিজনক ঐহিক সুখ এবং শ্ৰেয় অর্থাৎ আত্মার প্রকৃত কল্যাণ এই দুয়ের মধ্যে ভেদ দেখাইয়া বলিলেন -
শ্ৰেয়শ্চ প্রেয়শ্চ মনুষ্যমেতস্তৌ সংপরীত্য বিবিনক্তি ধীরঃ ৷
শ্ৰেয়ো হি ধীরোহৰ্ভিপ্রেয়সো বৃণীতে প্রেয়ো মন্দো যোগক্ষেমাদ্‌বৃণীতে ৷৷
প্রেয় (ক্ষণিক বাহ্য ইন্দ্ৰিয় সুখ) এবং শ্ৰেয় (প্রকৃত চিরন্তন কল্যাণ) এই দুই মনুষ্যের সম্মুখে আসিলে, বিজ্ঞ মনুষ্য ঐ দুয়ের মধ্যে একটীকে বাছাই করিয়া লয়েন । সুবুদ্ধি যিনি, তিনি প্ৰেয় অপেক্ষা শ্রেয়কে অধিক পছন্দ করেন; কিন্তু মন্দবুদ্ধি মনুষ্যের নিকট আত্মকল্যাণ অপেক্ষা প্ৰেয় অর্থাৎ বাহ্য সুখই অধিক প্রিয়,” [কঠ|১|২|২] । তাই, সংসারের ইন্দ্ৰিয়গম্য বিষয়সুখই এই জগতে মনুষ্যের পরম সাধ্য, এবং মনুষ্য যাহা কিছু করে সে সকলই কেবল বাহ্য অর্থাৎ আধিভৌতিক সুখের জন্য অথবা নিজের দুঃখনিবারণার্থই করিয়া থাকে এরূপ মনে করা ঠিক নহে ।


4) সুখদুঃখের অনিত্যতা এবং নীতিধর্মের নিত্যতা


ইন্দ্রিয়গম্য বাহ্য সুখ অপেক্ষা বুদ্ধিগম্য অন্তঃসুখের যোগ্যতা অধিক তো আছেই; কিন্তু তাহার সঙ্গে একটী কথা এই যে, বিষয়সুখ আজ আছে, কাল নাই, অর্থাৎ বিষয়সুখ অনিত্য । নীতিধর্মে একথা খাটে না । সকল লোকেই মানিয়া থাকে যে, অহিংসা, সত্য প্রভৃতি ধর্ম কোন বাহ্য উপাধির উপর নির্ভর করে না । অর্থাৎ বাহ্য সুখদুঃখকে অবলম্বন করিয়া নাই; সর্বকালে ও সর্বপ্রসঙ্গে তাহা একইপ্রকার, সুতরাং নিত্য । বাহ্য বিষয়ের উপর যাহা নির্ভর করে না সেই  নীতিধর্মের নিত্যত্ব কোথা হইতে আসিল, তাহার কারণ কি ? আধিভৌতিকবাদে ইহার কোন উপপত্তি পাওয়া যায় না । কারণ, বাহ্য সৃষ্টির সুখদুঃখ অবলোকন করিয়া কোন একটা সাধারণ সিদ্ধান্ত করিলেও সমস্ত সুখদুঃখ স্বভাবতই অনিত্য হওয়ায়, উহাদের অসম্পূর্ণ ভিত্তির উপর নির্মিত নীতিসিদ্ধান্তও ঐরূপ কাঁচা অৰ্থাৎ অনিত্য হইবে । এবং এই অবস্থাতে সুখদুঃখের কোনও পরোয়া না করিয়া, সত্যের খাতিরে প্রাণ গেলেও ভাল - ত্রিকালে অবাধিত এই সত্যধর্মের যে নিত্যতা তাহা “অধিক লোকের অধিক সুখ” এই তত্ত্বের দ্বারা সিদ্ধ হয় না । এ বিষয়ে এই আপত্তি করা যায় যে, যখন সাধারণ ব্যবহারে সত্যের জন্য প্ৰাণ দিবার সময় উপস্থিত হইলে ভাল ভাল লোকও অসত্যের আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে সংকোচ করেন না, এবং শাস্ত্রকারেরাও এরূপ সময়ে খুব টানিয়া ধরেন না, তখন সত্যাদি ধর্মের নিত্যতা কেন স্বীকার করি ? কিন্তু এই আপত্তি ঠিক নহে । কারণ, সত্যের জন্য প্ৰাণ দিতে যাহার সাহস হয় না সেও এই নীতিধর্মের নিত্যত্ব নিজ মুখে স্বীকার করিয়াই থাকে । এইজন্য মহাভারতে, অৰ্থকামাদি পুরুষাৰ্থ যাহা দ্বারা সিদ্ধ হয় সেই সকল ব্যবহারিক ধর্মের বিচার আলোচনা করিয়া শেষে ভারতসাবিত্রীতে (এবং বিদুরনীতিতেও) ব্যাসদেব সকল লোককে এই উপদেশ দিয়াছেন -
ন জাতু কামান্ন ভয়ান্ন লোভাদ্ধর্মং ত্যজেজ্জীবিতস্যাপি হেতোঃ ৷
ধর্মো নিত্যঃ সুখদুঃখে ত্বনিত্যে জীবো নিত্যঃ হেতুরস্য ত্বনিত্যঃ ॥
“সুখদুঃখ অনিত্য, কিন্তু (নীতি-) ধর্ম নিত্য; অতএব, সুখেচ্ছায়,  ভয়ে, লোভে, অথবা প্ৰাণসঙ্কট উপস্থিত হইলেও, ধর্মকে কখনই ছাড়িবে না । জীব নিত্য, তাহার হেতু অৰ্থাৎ সুখদুঃখাদি বিষয় অনিত্য” । অতএব; ব্যাসদেব উপদেশ দিতেছেন যে, অনিত্য সুখদুঃখের বিচার করিতে না বসিয়া, নিত্য ধর্মের সঙ্গেই নিত্য জীবকে সংযুক্ত করিয়া দেওয়া কর্তব্য [মভা|স্ব|৫|৬০; উ|৩৯|১২, ১৩] । ব্যাসের এই উপদেশ কতটা যোগ্য ইহা দেখিবার জন্য, সুখদুঃখের প্রকৃত স্বরূপ কি, এবং নিত্য সুখ কাহাকে বলে, - এক্ষেণে তাহার বিচার করা আবশ্যক ।


ইতি চতুর্থ প্রকরণ সমাপ্ত ।

___________________________
Reference:

"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.

"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.

Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।

[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings partially added/modified by up-loader. Uploaded by rk]

<Previous-Contents-Next>

No comments:

Post a Comment