বিষয়প্রবেশ
নারায়ণং নমস্কৃত্য নরং চৈব নরোত্তমম্
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয় মুদীরয়েৎ ॥ [মহাভারত, প্ৰথম শ্লোক]
(“নারায়ণকে, নরের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁহাকে, সরস্বতীদেবীকে, এবং ব্যাসকে নমস্কার করিয়া তাহার পর ‘জয়ী’ অর্থাৎ মহাভারত বলিতে শুরু করিবে” ইহাই এই শ্লোকের অর্থ । মহাভারতে নর ও নারায়ণ এই দুই ঋষি দুই স্বরূপে দ্বিধাভূত সাক্ষাৎ পরমাত্মাই; এবং ইঁহারাই দুইজনে পরে অর্জুন ও শ্ৰীকৃষ্ণ এই দুই অবতার হইয়াছিলেন, এইরূপ মহাভারতে বর্ণিত আছে [মভা|উ|৪৮|৭-৯ ও ২০-২২; এবং বন|১২|৪৪-৪৬] । ইঁহারাই নিষ্কামকর্মপর নারায়ণীয় ও ভাগবতধর্ম সর্বপ্রথমে প্রবর্তিত করার সকল ভাগবতধর্মীয় গ্রন্থের আরম্ভে ইঁহাদিগকেই নমস্কার করা হইয়া থাকে । কোন কোন গ্রন্থে এই শ্লোকে ‘ব্যাস’এর পরিবর্তে ‘চৈব’, এইরূপ পাঠ প্রদত্ত হইয়া থাকে; কিন্তু ওরূপ করা আমার যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না । কারণ, ভাগবতধর্মের প্রচারক নরনারায়ণ ঋষিদ্বয়ের ন্যায় এই ধর্মের দুই মুখ্য গ্ৰন্থ ভারত ও গীতা যিনি লিখিয়াছেন, সেই ব্যাসও আমার মতে নমস্য । মহাভারতের প্রাচীন নাম ‘জয়’ [মভা|আ|৬২|২০])
1) ভূমিকা
2) অন্যান্য গীতা
3) গ্রন্থের দুই প্রকার পর্যালোচনা
4) মহাভারতকারের মতে গীতার তাৎপৰ্য
5) গ্রন্থ তাৎপৰ্য নির্ণয়ে সাম্প্রদায়িক পন্থা
শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতা আমাদের ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে একটি অতীব ভাস্বর ও নির্মল হীরকখণ্ড । জড়ব্ৰহ্মাণ্ডজ্ঞানের সহিত আত্মবিদ্যার গূঢ় ও পবিত্ৰ তত্ত্ব সংক্ষেপে এবং অসংদিগ্ধরূপে বিবৃত করে, সেই সকল তত্ত্বের উপর মনুষ্যমাত্রেরই পুরুষাৰ্থ আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থার পরিচয় করিয়া দেয়, জ্ঞান ও ভক্তিকে মিলাইয়া উভয়কে শাস্ত্রসম্মত ব্যবহারের সহিত সংযুক্ত করে এবং ইহার দ্বারা সংসারের দুঃখক্লিষ্ট মনুষকে শান্তি প্ৰদান পূর্বক নিষ্কাম কর্তব্যাচরণে প্ৰবৃত্ত করে, গীতার ন্যায় এরূপ সরল দ্বিতীয় গ্ৰন্থ, শুধু সংস্কৃত সাহিত্যে কেন, জগতের সাহিত্যেও দুর্লভ । কেবল কাব্যের হিসাবে দেখিতে গেলেও ইহাকে উত্তম কাব্যের মধ্যে ধরা যাইতে পারে । কারণ, ইহাতে আত্মজ্ঞানের অনেক গহন সিদ্ধান্ত আবালবৃদ্ধের নিকট বোধগম্য বিশদ সহজ ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছে, এবং ইহা জ্ঞানসমন্বিত ভক্তিরসে পূর্ণ । যে গ্রন্থে শ্ৰীভগবানের বাণী হইতে সকল বৈদিক ধর্মের সার গৃহীত হইয়াছে তাহার যোগ্যতা সম্বন্ধে আর কি বৰ্ণনা করিব ? ভারতীয় যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে পর একদিন শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুন যখন প্রীতিভরে কথাবার্তা কহিতেছিলেন সেই সময় শ্ৰীকৃষ্ণের মুখে অর্জুনের পুনরায় গীতা শুনিবার ইচ্ছা হইয়াছিল । অর্জুন তৎক্ষণাৎ বিনয়পূর্বক এইরূপ অনুরোধ করিলেন যে “ভগবন, যুদ্ধারম্ভে তুমি যে উপদেশ দিয়াছিলে তাহা আমি বিস্মৃত হইয়াছি, তুমি কৃপা করিয়া আমাকে আর একবার তাহা বল ।” তখন ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই উত্তর দিলেন যে, “সে সময়ে আমি অত্যন্ত যোগযুক্ত চিত্তে উপদেশ করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন পুনর্বার ঐ প্রকার উপদেশ দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ।” অনুগীতার আরম্ভে বলা হইয়াছে [সভা|অশ্বমেধ|অ ১৬|শ্লো ৭০-৭৩] । বাস্তবিক দেখিতে গেলে, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নহে; কিন্তু তাহার উপরোক্ত উক্তি হইতে গীতার মাহাত্ম্য কত অধিক তাহাই সুন্দররূপে ব্যক্ত হইতেছে । বৈদিক ধর্মের অন্তর্ভূত ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট এই গ্ৰন্থ আজ প্ৰায় আড়াই হাজার বৎসর সকলের নিকটেই বেদের ন্যায় সমানরূপে মান্য ও প্রামাণ্য হইয়া আসিতেছে । এই গ্রন্থের মহত্ত্বই ইহার মূল কারণ । এই কারণে —
সমস্ত উপনিষদের সার এই গ্রন্থে আছে শুধু তাহা নহে, ইহার পুরা নামও — “শ্ৰীমদভগবদ্গীতা-উপনিষৎ” । গীতার প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে অধ্যায়সমাপ্তিজ্ঞাপক যে সঙ্কল্প আছে তাহাতে “ইতি শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্ৰহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে শ্ৰীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে” ইত্যাদি শব্দ আছে । এই সংকল্প মূল ভারতে দেওয়া না হইলেও গীতাগ্রন্থের সকল সংস্করণেই উহা দেখিতে পাওয়া যায় । এই হেতু অনুমান হয় যে, নিত্যপাঠের জন্য যে সময় মহাভারত হইতে গীতাকে পৃথক করিয়া বাহির করা হয় তখন হইতে অর্থাৎ গীতার কোনপ্রকার টীকা হইবার পূর্বাবধি উক্ত সংকল্প প্রচলিত হইয়া থাকিবে । এই হিসাবে গীতার তাৎপৰ্যনির্ধারণে উহার প্রয়োজনীয়তা কি, তাহা পরে বলা যাইবে । আপাতত সংকল্পবাক্যের মধ্যে “ভগবদ্গীতাসু” এবং “উপনিষৎসু” এই দুই পদের বিচার করা কর্তব্য । “উপনিষৎ” শব্দ মারাঠীতে ক্লীবলিঙ্গ হইলেও সংস্কৃত ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ; সুতরাং “শ্ৰীভগবান কর্তৃক গীত অর্থাৎ কথিত উপনিষৎ” এই অর্থ প্ৰকাশ করিবার কারণে সংস্কৃতভাষায় “শ্ৰীমদ্ভগবৎগীতা উপনিষৎ” এই দুই বিশেষণবিশেষ্যরূপ স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে; এবং গ্ৰন্থ এক হইলেও সম্মানার্থে “শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতাসু উপনিষৎসু” এই বহুবচনান্ত সপ্তমীর প্রয়োগ হইয়াছে । শঙ্করাচার্যের ভাষ্যেও এই গ্রন্থের উদ্দেশ্যেই “ইতি গীতাসু” এইরূপ বহুবচনের প্ৰয়োগ হইয়াছে । কিন্তু নামের সংক্ষেপ করিবার সময় সম্মানার্থক প্ৰত্যয়, পদ, এমন কি শেষের ‘উপনিষৎ’ এই জাতিবাচক সাধারণ শব্দও পরিত্যক্ত হইয়া ‘কেন’, ‘কঠ’, ‘ছান্দ্যোগ্য’ এই প্রকার সংক্ষিপ্ত নামের অনুসরণ করিয়া “শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতা উপনিষৎ” এই দুই একবচনান্ত প্ৰথমা বিভক্তিবিশিষ্ট শব্দের প্রথমে “ভগবদ্গীতা”, পরে কেবল ‘গীতা’ এই স্ত্রীলিঙ্গী অতি সংক্ষিপ্ত নাম প্ৰচলিত হইয়াছে । ‘উপনিষৎ’ এই শব্দ যদি মূল নামে না থাকিত তাহা হইলে ‘ভাগবতম্’, ‘ভারতম্’, ‘গোপীগীতম্’ এই সকল শব্দের ন্যায় এই গ্রন্থেরও নাম ‘ভগবদ্গীতম্’ কিংবা শুধু ‘গীতম্’ এইরূপ ক্লীবলিঙ্গী হইত । তাহা না হইয়া ‘ভগবদ্গীতা’ কিংবা ‘গীতা’ এইরূপ স্ত্রীলিঙ্গী শব্দই আজ পৰ্যন্ত বজায় থাকাতেই তাহার সহিত ‘উপনিষৎ’ এই শব্দ নিত্য অধ্যাহৃত আছে বলিয়া বুঝিতে হইবে । অনুগীতার উপর অর্জুন মিশ্রের টীকাতে ‘অনুগীতা’ এই শব্দের অর্থও এইরূপেই করা হইয়াছে ।
কিন্তু ‘গীতা’ এই শব্দ কেবল সপ্তশতশ্লোকী ভগবদ্গীতাতেই প্ৰযুক্ত হয় নাই, উহা আরো অনেক জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থে প্ৰযুক্ত হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায় । তাহার দৃষ্টান্ত, মহাভারতের শান্তিপর্বের অন্তর্ভূক্ত মোক্ষপর্বের কোন কোন বিচ্ছিন্ন প্রকরণের ‘পিঙ্গলগীতা’, ‘শম্পাকগীতা’, ‘মঙ্কিগীতা’, ‘বোধ্যগীতা’, ‘বিচখ্যুগীতা’, ‘হারীতগীতা’, ‘বৃত্ৰগীতা’, ‘পরাশরগীতা’ এবং ‘হংসগীতা’ এইরূপ নাম দেওয়া হইয়াছে । অশ্বমেধ পর্বের অনুগীতার এক ভাগ ‘ব্রাহ্মণগীতা’ এই বিশিষ্ট নামে অভিহিত হইয়াছে । ইহা ব্যতীত ‘অবধূতগীতা’, ‘অষ্টাবক্ৰগীতা’, ‘ঈশ্বরগীতা’, ‘উত্তরগীতা’, ‘কপিলগীতা’, ‘গণেশগীতা’, ‘দেবীগীতা’, ‘পাণ্ডবগীতা’, ‘ব্রহ্মগীতা’, ‘ভিক্ষুগীতা’, ‘যমগীতা’, ‘রামগীতা’, ‘ব্যাসগীতা’, ‘শিবগীতা’, ‘সূতগীতা’, ‘সুর্যগীতা’ প্রভৃতি আরো অনেক গীতা প্ৰসিদ্ধ আছে । ইহার মধ্যে কতকগুলি স্বতন্ত্র প্ৰণালীতে রচিত হইয়াছে, অবশিষ্টগুলি বিভিন্ন পুরাণ হইতে, গৃহীত হইয়াছে । উদাহরণ যথা – গণেশগীতা গণেশপুরাণের শেষে ক্রীড়া খণ্ডের ১৩৮ হইতে ১৪৮ অধ্যায় পর্যন্ত কথিত হইয়াছে । এই গণেশগীতা অল্পাধিক পরিবর্তন সহকারে ভগবদ্গীতারই অবিকল নকল, এরূপ বলিলে কোন ক্ষতি নাই । ‘ঈশ্বরগীতা’ কুর্মপুরাণের উত্তরভাগের প্রথম এগার অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হইয়াছে । পরবর্তী অধ্যায়ে ‘ব্যাসগীতার’ আরম্ভ হইয়াছে । এবং স্কন্দপুরাণান্তৰ্গত সূতসংহিতার চতুর্থ অর্থাৎ যজ্ঞবৈভব খণ্ডের উপরিভাগের প্রারম্ভে (১ হইতে ১২ অধ্যায় পৰ্যন্ত) ‘ব্রহ্মগীতা’ এবং ব্ৰহ্মগীতার পরবর্তী আঠ অধ্যায়ে ‘সূতগীতা’ আছে । স্কন্দপুরাণের এই ব্ৰহ্মগীতা হইতে স্বতন্ত্র আর এক ব্ৰহ্মগীতা, যোগবাশিষ্ঠের নির্বাণপ্রকরণের উত্তরার্ধে (১৭৩ হইতে ১৮১ সৰ্গ পৰ্যন্ত) প্রদত্ত হইয়াছে । ‘যমগীতা’ তিন প্রকারের - প্রথমটি বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয় অংশের ৭ম অধ্যায়ে, দ্বিতীয়টি অগ্নিপুরাণের তৃতীয় খণ্ডের ৩৮১ অধ্যায়ে, এবং তৃতীয়টি নৃসিংহপুরাণের অষ্টম অধ্যায়ে প্রকাশিত হইয়াছে । ‘রামগীতার’ কথাও এইরূপ । এখানে মহারাষ্ট্রদেশে যে রামগীতা প্ৰচলিত আছে তাহা অধাত্মরামায়ণের উত্তর কাণ্ডের পঞ্চমসর্গে দেখিতে পাওয়া যায় । এই অধ্যাত্মরামায়ণ ব্ৰহ্মাণ্ডপুরাণের একভাগ বলিয়া স্বীকৃত হইয়া থাকে । কিন্তু ইহা ব্যতীত আর এক রামগীতা মাদ্রাস অঞ্চলে প্ৰসিদ্ধ ‘গুরুজ্ঞানবাসিষ্ঠতত্ত্বসারায়ণ’ নামক গ্রন্থের মধ্যে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে । এই গ্ৰন্থ বেদান্ত-মূলক গ্ৰন্থ । ইহাতে জ্ঞান, উপাসনা ও কর্ম এইতিনটী কাণ্ড আছে । তন্মধ্যে উপাসনাকাণ্ডের দ্বিতীয় পাদের প্রথম ১৮ অধ্যায়ে রামগীতা এবং কর্মকাণ্ডের তৃতীয় পাদের প্রথম পাঁচ অধ্যায়ে ‘সূৰ্যগীতা’ বিবৃত হইয়াছে। কথিত আছে যে, ‘শিবগীতা’ পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডে আছে । কিন্তু এই পুরাণের পুনাস্থিত আনন্দাশ্রমে যে সংস্করণ ছাপা হইয়াছে তাহার মধ্যে শিবগীতা পাওয়া যায় না । গৌড়ীয় পদ্মোত্তর পুরাণে উহা পাওয়া যায় । এই কথা পণ্ডিত জ্বালাপ্ৰসাদ স্বরচিত “অষ্টাদশপুবাণদৰ্শন” নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন । নারদপুরাণে, অন্য পুরাণের সঙ্গে সঙ্গে পদ্মাপুরাণেরও যে বিষয়ানুক্ৰমণিকা প্রদত্ত হইয়াছে তাহার মধ্যে শিবগীতার উল্লেখ আছে । শ্ৰীমদ্ভাগবত-পুরাণের ১১শ স্কন্ধের ১৩শ অধ্যায়ে হংসগীতা এবং ২৩শ অধ্যায়ে ভিক্ষুগীতা বিবৃত হইয়াছে । তৃতীয় স্কন্ধের কপিলোপাখ্যানের (২৩-৩৩) “কপিলগীতা” এই নামও কেহ কেহ দিয়া থাকেন । কিন্তু কপিলগীতা বলিয়া এক স্বতন্ত্র মুদ্রিত গ্ৰন্থও আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে । এই কপিলগীতায় হঠযোগের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হইয়াছে এবং উহা পদ্মপুরাণ হইতে গৃহীত ইহাও উল্লিখিত হইয়াছে । কিন্তু পদ্মপুরাণে এই গীতা পাওয়াই যায় নাই । ইহার এক স্থলে (৪.৭) জৈন, জঙ্গম (লিঙ্গায়ৎ) এবং সুফী (মুসলমান সাধু), ইহাদেরও উল্লেখ থাকায় এই গীতা মুসলমানী আমলের হইবে, এইরূপ বলিতে হয় । ভাগবত পুরাণের ন্যায় দেবীভাগবতেও সপ্তম স্কন্ধের ৩১ হইতে ৪০ অধ্যায় পৰ্যন্ত এক গীতা আছে, দেবী কর্তৃক কথিত বলিয়া তাহার নাম দেবীগীতা হইয়াছে । ইহা ব্যতীত, স্বয়ং ভগবদ্গীতার সার অগ্নিপুরাণের তৃতীয় খণ্ডের ৩৮০ অধ্যায়ে এবং গরুড় পুরাণের পূর্বখণ্ডের ২৪২ অধ্যায়ে প্রদত্ত হইয়াছে । সেইরূপ আবার, বসিষ্ঠ রামচন্দ্ৰকে যে উপদেশ দিয়াছিলেন তাহাই যোগবাসিষ্ঠ নামে প্ৰসিদ্ধ । পরন্তু এই গ্রন্থের শেষ (অৰ্থাৎ নির্বাণ) প্ৰকরণে অর্জুনোপাখ্যানও প্রদত্ত হইয়াছে । ইহাতে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনের নিকট কথিত ভগবদ্গীতার সার, এমন কি, ভগবদ্গীতার অনেক শ্লোক যেমনটি তেমনিই বজায় রাখিয়া গ্রথিত করা হইয়াছে (যোগ, ৬ পূ: ৫২-৫৮ দেখ) । উপরে বলিয়াছি যে, পুনায় মুদ্রিত পদ্মপুরাণে শিবগীতা পাওয়া যায় না; কিন্তু শিবগীতা না পাওয়া গেলেও এই সংস্করণের উত্তর খণ্ডের ১৭১ হইতে ১৮৮ অধ্যায় পর্যন্ত ভগবদ্গীতামাহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে, -ভগবদ্গীতার প্রত্যেক অধ্যায় ধরিয়া এই মাহাত্ম্যের এক এক অধ্যায় রচিত হইয়াছে, এবং উহাতে এই সম্বন্ধীয় কথাও বিবৃত হইয়াছে । ইহা ব্যতীত, বরাহপুরাণে এক গীতামাহাত্ম্য আছে । শিবপুরাণে এবং বায়ুপুরাণেও গীতামাহাত্ম্য আছে বলিয়া কথিত হয় । কিন্তু কলিকাতায় মুদ্রিত বায়ুপুরাণে আমি তাহা পাই নাই । ভগবদ্গীতার মুদ্রিত সংস্করণের আরম্ভে ‘গীতাধ্যান” নামক এক নূতন শ্লোকপ্রকরণ প্রদত্ত হইয়াছে । ইহা কোথা হইতে গৃহীত হইয়াছে তাহা জানা যায় না । কিন্তু ইহার “ভীষ্মদ্রোণতটা জয়দ্ৰথজলা” এই শ্লোক অল্প শব্দভেদে সম্প্রতি প্ৰকাশিত ভাস কবির “উরুভঙ্গ” নামক নাটকের আরম্ভেই প্ৰদত্ত হইয়াছে । ইহা হইতে অনুমান হয় যে এই ধ্যান ভাসকবির সময়ের পরে প্রচারিত হইয়া থাকিবে । কারণ, ভাসের ন্যায় প্ৰসিদ্ধ কবি এই শ্লোক গীতাধ্যান হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন এইরূপ স্বীকার করা অপেক্ষা, গীতাধ্যানই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র স্থান হইতে শ্লোক সংগ্ৰহ করিয়া ও কতকগুলি নূতন শ্লোক রচনা করিয়া রচিত হইয়াছে, ইহা বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত । ভাস কবি কালিদাসের পূর্ববর্তী হওয়ায় তাঁহার কাল অন্তত তিনশত শকের (৪৩৫ সংবৎ) অধিক অৰ্বাচীন হইতে পারে না । (উপরি উক্ত অনেক গীতা এবং ভগবদ্গীতা শ্ৰীযুক্ত হরি রঘুনাথ ভাগবত সম্প্রতি পুনা হইতে বাহির করিতেছেন ।)
ভগবদ্গীতার কোন কোন অনুবাদ ও কতগুলি অনুবাদ, এবং অল্পাধিক পরিবর্তন সহকারে গৃহীত নকল, তাৎপৰ্য কিংবা মাহাত্ম্য পুরাণাদি গ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহা পূর্বোক্ত বিবরণ হইতে উপলব্ধ হইবে । ‘অবধূত’, ‘অষ্টাবক্ৰ’ প্রভৃতি দুই চারিটী গীতা স্বতন্ত্রভাবে কাহা কর্তৃক রচিত হয় অথবা কবে কোন পুরাণ হইতে গৃহীত হইয়াছে, তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না । তথাপি এই সমস্ত গীতার রচনা এবং তদন্তৰ্গত বিষয়-বিবেচন দেখিলে অনুমান হয় যে, এই সকল গ্ৰন্থ, ভগবদ্গীতা প্ৰকাশিত হইয়া লোকমান্য হইবার পর রচিত হইয়া থাকিবে । এই সকল গীতা সম্বন্ধে ইহা বলিলেও কোনই ক্ষতি নাই যে, ভগবদ্গীতার ন্যায় দুই একটা গীতা কোন বিশিষ্ট পন্থায় বা পুরাণে না থাকিলে সেই পন্থা বা পুরাণের পূর্ণতা হয় না এই ধারণাতেই সেই গীতাগুলি রচিত হইয়াছে । ভগবদ্গীতায় যেরূপ ভগবান অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইয়া জ্ঞানের উপদেশ দিয়াছেন, শিব-গীতা, দেবী-গীতা, গণেশ-গীতাতেও সেই প্ৰকার বর্ণনা আছে । শিবগীতা ঈশ্বরগীতা প্ৰভৃতির মধ্যে ভগবদ্গীতার অনেক শ্লোকই অক্ষরশঃ প্রদত্ত হইয়াছে । জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখিলে, এই সকল গীতায় ভগবদ্গীতা হইতে কোন বিশেষত্ব দৃষ্ট হয় না; বরঞ্চ, অধ্যাত্মজ্ঞান ও কর্মের মধ্যে মিলন সাধনে ভগবদ্গীতায় যে একটা অপূর্ব নৈপুণ্য দেখা যায়, সেরূপ নৈপুণ্য আর কোন গীতায় দেখিতে পাওয়া যায় না । ভগবদ্গীতায় পাতঞ্জল-যোগ বা হঠযোগ এবং কর্মত্যাগীরূপ সন্ন্যাসের, যথোচিত বৰ্ণন না দেখিয়া উহার পূর্ণতাসাধনের হিসাবে কৃষ্ণার্জুনের কথোপকথনচ্ছলে কোন ব্যক্তি পরে উত্তরগীতা রচনা করিয়াছেন । ‘অবধূত’, ‘অষ্টাবক্ৰ’ প্ৰভৃতি গীতা নিছক একদেশীয় - সেগুলিতে কেবল সন্ন্যাসমাৰ্গই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । যমগীতা, পাণ্ডবগীতা কেবল ভক্তিবিষয়ক সংক্ষিপ্ত স্তোত্ৰমাত্র । শিবগীতা, গণেশগীতা এবং সূৰ্যগীতা এ প্রকার নহে । যদিও উহাদের মধ্যে জ্ঞান ও কর্মের সম্মিলন সম্বন্ধে সংযৌক্তিক সমর্থন আছে সত্য, তথাপি উহাদের মধ্যে যাহা প্ৰতিপাদিত হইয়াছে তাহার অনেকাংশ ভগবদ্গীতা হইতে গৃহীত, সুতরাং উহাতে কোন নূতনত্ব আছে বলিয়া মনে হয় না । এই সকল কারণে ভগবদ্গীতার গভীর ও ব্যাপক তেজের সম্মুখে, পরবর্তীকালে রচিত এই সকল পৌরাণিক গীতা দাঁড়াইতে পারে নাই, বরঞ্চ এই সকল নকল গীতার কারণেই ভগবদ্গীতার মাহাত্ম্য অধিকতর ব্যক্ত ও স্থাপিত হইয়াছে । এই কারণেই “গীতা” শব্দের অর্থে “ভগবদ্গীতাই” মুখ্যরূপে প্ৰচলিত হইয়াছে । “অধ্যাত্মরামায়ণ” ও “যোগবাসিষ্ঠ” এই দুই গ্ৰন্থ বিস্তৃত হইলেও উহা যে ভগবদ্গীতার পরবর্তী গ্ৰন্থ তাহা উক্ত গ্ৰন্থদ্বয়ের রচনা হইতেই স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । মাদ্রাজ অঞ্চলের “গুরুজ্ঞানবাসিষ্ঠ-তত্ত্বসারায়ণ” কাহারও কাহারও মতে অতীব প্রাচীন; কিন্তু আমাদের তাহা মনে হয় না । তাহাতে যে ১০৮ উপনিষদের উল্লেখ আছে তাহাদের প্রাচীনতা সিদ্ধ হইতে পারে না । সূৰ্যগীতায় বিশিষ্টাদ্বৈত মতের উল্লেখ পাওয়া যায় [৩|৩০] এবং কোন কোন স্থানের যুক্তিক্রমও যেন ভগবদ্গীতা হইতে গৃহীত বলিয়া মনে হয়” [১|৬৮] । সুতরাং এই গ্ৰন্থও বহু পরবর্তী কালে, এমন কি, শ্ৰীশঙ্করাচার্যেরও পরবর্তী কালে রচিত হইয়া থাকিবে, এইরূপ অনুমান হয় ।
গীতা অনেকগুলি থাকিলেও ভগবদ্গীতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্বিবাদ বলিয়া এইরূপে প্ৰতিপন্ন হওয়ায় উত্তরকালীন বৈদিক পণ্ডিতেরা অন্যান্য গীতার প্রতি বেশী মনোযোগ না দিয়া কেবল ঐ ভগবদ্গীতার পর্যালোচনা করিয়াই তদন্তৰ্গত তাৎপর্য স্বকীয় ধর্মভ্ৰাতাদিগকে বলার সার্থকতা আছে, এইরূপ বিবেচনা করিয়াছিলেন । গ্রন্থের পর্যালোচনা দুই প্রকারে হইতে পারে; এক অন্তরঙ্গ-পর্যালোচনা, আর দ্বিতীয় বহিরঙ্গ-পর্যালোচনা । সমগ্ৰ গ্ৰন্থ দেখিয়া তাহার মর্ম, রহস্য, মথিতাৰ্থ ও প্ৰমেয় প্রভৃতি বাহির করার নাম অন্তরঙ্গ-পর্যালোচনা । গ্ৰন্থ কোথায় রচিত হইয়াছে, কে রচনা করিয়াছে, তাহারা ভাষা কিরূপ - কাব্যদৃষ্টিতে তাহাতে কতটা মাধুৰ্য ও প্রসাদগুণ আছে, গ্রন্থের শব্দ রচনা ব্যাকরণশুদ্ধ অথবা তাহাতে কতকগুলি আর্ষপ্রয়োগ আছে, তাহাতে কোন কোন মতের, স্থলের কিংবা ব্যক্তির উল্লেখ আছে, এই সকল ধরিয়া গ্রন্থের কালনিৰ্ণয় করা যাইতে পারে কি না, অথবা তৎকালীন সামাজিক অবস্থার কোন নির্ণয় হইতে পারে কি না, গ্রন্থান্তৰ্গত বিচার-আলোচনা স্বতন্ত্র বা অন্যের নিকট হইতে গৃহীত, যদি অপরের নিকটে গৃহীত হয় তবে কোথা হইতে কোনটা গৃহীত, এই সকল বাহ্যাঙ্গের বিচার-আলোচনাকেই বহিরঙ্গ-পর্যালোচনা বলে । গীতা সম্বন্ধে যে সকল প্ৰাচীন পণ্ডিতদিগের ভাষ্য, ও টীকা আছে, তাঁহারা বাহ্য বিষয়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন নাই । কারণ, তাঁহাদের মতে ভগবদ্গীতার ন্যায় অলৌকিক গ্রন্থের পর্যালোচনা করিবার সময় ঐ সকল বহিরঙ্গের আলোচনা করা, আর কোন উত্তম পুষ্প পাইয়া তাহার সুগন্ধ, সুন্দর বর্ণ ও সৌন্দর্যে কৌতুহলাক্রান্ত হইবার পরিবর্তে কেবল তাহার পাপড়ী গণনা করা অথবা মধুভরা মৌচাক হস্তে পাইয়া তাহার কতগুলি মধুচ্ছিদ্র আছে তাহার অনুসন্ধান করা, উভয়ই সমান - কেবল বৃথা সময় ক্ষেপণ মাত্ৰ ! পরন্তু, এক্ষণে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের অনুকরণে এদেশের আধুনিক বিদ্বানেরা গীতার বাহ্যাঙ্গেরই বিশেষ অনুশীলন করিতেছেন । গীতার মধ্যে আর্ষপ্ৰয়োগ সকল দেখিয়া এক ব্যক্তি এইরূপ নির্ধারণ করিয়াছেন যে, এই গ্ৰন্থ যিশুখৃষ্ট জন্মিবার কয়েক শতাব্দী পূর্বে রচিত হইয়া থাকিবে । ইহা হইতে গীতার অন্তর্ভূত ভক্তিমাৰ্গ তদুত্তরকালে প্ৰবর্তিত খৃষ্টধর্ম হইতে গৃহীত কি না এই সংশয় নির্মূল হইয়া যায় । গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে যে নাস্তিক মতের উল্লেখ আছে, তাহা বোধ হয় বৌদ্ধধর্ম হইবে এইরূপ কল্পনা করিয়া, অপর এক ব্যক্তি বুদ্ধানন্তর গীতা রচিত হইয়া থাকিবে, এইরূপ বলিয়াছেন । তৃতীয় আর এক ব্যক্তি এইরূপ বলেন যে, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, ‘ব্রহ্মসুত্ৰপাদৈশ্চৈব’ এই শ্লোকে ব্ৰহ্মসূত্রের উল্লেখ থাকায় গীতা ব্ৰহ্মসূত্রের পরে হইয়া থাকিবে । উল্টাপক্ষে একথাও কেহ কেহ বলেন যে, ব্ৰহ্মসূত্রের অনেক স্থানে গীতার প্রমাণ মীমাংসারূপে গৃহীত হওয়ায় গীতা তদুত্তরকালীন বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না । আরও কতকগুলি লোক এইরূপ বলেন যে, ভারতীয় যুদ্ধে রণভূমির উপর সাতশত-শ্লোকী গীতা অৰ্জুনকে বলার অবকাশ পাওয়া সম্ভব ছিল না । হ্যাঁ, ইহা সম্ভব হইতে পারে যে, যখন তুমুল যুদ্ধ চলিতেছিল সেই সময়ে শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে দশ কুড়িটী শ্লোক এবং তাহার অর্থ বলিয়াছিলেন এবং ঐ সকল শ্লোক বিস্তৃতভাবে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে, ব্যাস শুককে, বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে, এবং পরে সূত শৌনককে বলিয়াছিলেন; অর্থবা সর্বশেষে যাঁহা কর্তৃক মূলভারত ‘মহাভারতে’ পরিণত হয় তাঁহা কর্তৃক উহা লিখিত হইয়া থাকিবে । গীতাগ্রন্থের রচনা সম্বন্ধে মনের এইরূপ ধারণা হইবার পর, গীতাসাগরে ডুব দিয়া গীতার মূল শ্লোক কেহ সাত, কেহ আটাইশ, কেহ ছত্ৰিশ, কেহ বা একশত খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন ।
(সম্প্রতি এক সপ্তশ্লোকী গীতা প্রকাশিত হইয়াছে, উহাতে কেবল এই সাতটী শ্লোক - (১) ওঁ ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ইত্যাদি [গী|৮|১৩]; (২) স্থানে হৃষীকেশ তব প্রকীর্ত্যা ইত্যাদি [গী|১১|৩৬]; (৩) সর্বতঃ পাণিপাদং তত্ত্ব ইত্যাদি [গী|১৩|১৩]; (৪) কবিং পুরাণমনুশাসিতারং ইত্যাদি [গী|৮|৯]; (৫) উর্ধমূল মধঃশাখং ইত্যাদি [গী|১৫|১]; (৬) সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্ট ইত্যাদি [গী|১৫|১৫]; (৭) মন্মনাভব মদ্ভক্তো ইত্যাদি [গী|১৮|৬৫] । এই প্রকার আরো অনেক সংক্ষিপ্ত গীতা আছে ।)
কেহ কেহ ইহাও বলেন যে, রণভূমির উপর অর্জুনকে গীতান্তর্ভূত ব্ৰহ্মজ্ঞান বলিবার কোন প্ৰয়োজনই ছিল না; বেদান্তসম্বন্ধীয় এই উত্তম গ্ৰন্থ পরে কেহ মহাভারতের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছেন । বহিরঙ্গপ পর্যালোচনার এই সকল কথা যে সর্বথা নিরর্থক তাহা নহে । দৃষ্টান্তস্বরূপে, উপরে কথিত ফুলের পাপড়ীর কথা কিংবা মৌচাকের ছিদ্রের কথা ধরা যাক । বৃক্ষগণকে শ্রেণীবদ্ধ করিবার সময় অবশ্য তাহাদের ফুলের পাপড়ীরও বিচার নিশ্চয়ই করিতে হয় । সেইরূপ গণিতের সাহায্যে এক্ষণে প্রমাণিত হইয়াছে যে, মধুর পরিমাণ (ঘনফল) কম হইবে না অথচ পরিবেষ্টনের পরিমাণ (পৃষ্ঠফল) যাহাতে খুব কম হইয়া মোমের খরচ কম হয় এইরূপ আকারের মধু ধারণ করিবার ছিদ্র মৌচাকে থাকে এবং তাহার দরুণ মৌমাছিদিগের দৈহিক কারুকাৰ্য পরিব্যক্ত হয় । এই প্রকারের উপযোগিতার প্ৰতি লক্ষ্য করিয়া আমরাও এই গ্রন্থের পরিশিষ্টভাগে গীতার বহিরঙ্গ পর্যালোচনা করিয়াছি এবং উহার মাহাত্ম্য বিষয়ক সিদ্ধান্তেরও কিছু কিছু বিচার করিয়াছি । কিন্তু গ্রন্থের রহস্য যিনি বুঝিতে চাহিবেন, বহিরঙ্গের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তাঁহার কোন লাভ নাই । বাগ্দেবীর রহস্যজ্ঞ ও তাহার বহিরঙ্গ-সেবক - এই উভয়ের ভেদ প্ৰদৰ্শন করিয়া মুরারি কবি এক সরস দৃষ্টান্ত দিয়াছেন । তিনি বলেন –
‘ভগবদ্গীতা’ কিংবা ‘ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষৎ’ এই নাম হইতেই, গীতাতে অর্জুনকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা প্ৰধানতঃ ভাগবত ধর্মের উপদেশ, অর্থাৎ ভগবান কর্তৃক প্ৰবর্তিত ধর্মের উপদেশ, এইরূপ অনুমান হয় । কারণ, শ্ৰীকৃষ্ণের ‘শ্ৰীভগবান’ এই নাম ভাগবত ধর্মেই প্রদত্ত হইয়া থাকে । এই উপদেশ কিছু নূতন নহে; পূর্বে এই উপদেশই ভগবান কর্তৃক বিবস্বানকে, বিবস্বান কর্তৃক মনুকে এবং মনু কর্তৃক ইক্ষ্বাকুকে দেওয়া হয়, গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের আরম্ভেই [গী|৪|১-৩] এইরূপ বলা হইয়াছে । মহাভারতের শান্তিপর্বের শেষে নারায়ণীয় বা ভাগবত-ধর্মের যে সবিস্তার বিবৃতি আছে তাহাতে ব্ৰহ্মদেবের অনেক জন্মে অর্থাৎ কল্পান্তরে, ভাগবত-ধর্মের পারম্পর্য বর্ণনা করিবার পর, পরিশেষে ব্ৰহ্মদেবের বর্তমান জন্মের অন্তর্ভূত ত্ৰেতাযুগে “এই ভাগবত ধর্ম বিবস্বান-মনু-ইক্ষ্বাকুর পরম্পরার প্রসৃত হইয়াছে” এইরূপ বলা হইয়াছে -
ইহা বুঝা গিয়াছে যে স্বয়ং মহাভারতকারের মতে গীতার তাৎপৰ্য কি । এক্ষণে দেখিতে হইবে যে, গীতার ভাষ্যকার ও টীকাকারগণ গীতার কি তাৎপৰ্য স্থির করিয়াছেন । এই ভাষ্য ও টীকাসমূহের মধ্যে আজকাল শ্ৰীশঙ্করাচার্যের গীতা-ভাষ্য অতিপ্রাচীন বলিয়া সকলের স্বীকৃত । যদিও ইহাঁর পূর্বে গীতার অনেক ভাষ্য ও টীকা যে হইয়াছিল তাহাতে সংশয় নাই । কিন্তু সে সকল টীকা এক্ষণে পাওয়া যায় না; এবং সেই কারণে জানিবার উপায় নাই যে, মহাভারতের রচনাকাল অবধি শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব পর্যন্ত গীতার অর্থ কি ভাবে করা হইত । তথাপি শঙ্করভাষ্যেতেই এই প্ৰাচীন টীকাকারদিগের মতের যে উল্লেখ আছে [গী|শাংভা|২ ও ৩ এর উপোদ্ঘাত দেখ], তাহা হইতে স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায় যে, মহাভারতকারের ন্যায় আচার্যের পূর্ববর্তী টীকাকারেরা গীতার অর্থ জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয়াত্মক বলিয়াই ধরিতেন, অর্থাৎ উহার এই প্ৰবৃত্তিপর অর্থ করা হইত যে, জ্ঞানী মনুষ্যের জ্ঞান অনুসারেই আমরণ স্বধর্মবিহিত কর্ম করা উচিত । কিন্তু বৈদিক কর্মযোগের এই সিদ্ধান্ত শ্ৰীশঙ্করাচার্যের নিকট মান্য না হওয়ায় তিনি তাহা খণ্ডন করিয়া নিজের মতে গীতার তাৎপৰ্য বুঝাইবার অভিপ্ৰায়েই গীতাভাষ্য লিখিয়াছেন । তাঁহার ভাষ্যের আরম্ভের উপাদ্ঘাতে এই কথা, তিনি স্পষ্টই বলিয়াছেন । ‘ভাষ্য’ শব্দের অর্থ ইহাই । ‘ভাষ্য’ ও ‘টীকা’, এই দুই শব্দ অনেক সময়ে সমান অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে সত্য; কিন্তু সাধারণতঃ 'টীকা’তে মূল গ্রন্থের সরল অন্বয় করিয়া শব্দের অর্থ সুগম করা হয় । ভাষ্যকার এইটুকুতে সন্তুষ্ট না হইয়া, ন্যায্যভাবে সমস্ত গ্রন্থের পর্যালোচনা করেন এবং তাঁহার মতে গ্রন্থের তাৎপৰ্য কি ও তদনুসারে গ্রন্থের কিরূপ অৰ্থ করা হইবে, তাহাও ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন । গীতার শাঙ্কর-ভাষ্যের স্বরূপও এই প্রকার । কিন্তু গীতার তাৎপৰ্যবিচারে আচার্য যে ভেদ করিয়াছেন তাহার বীজ-সূত্রটির প্রতি লক্ষ্য করিবার পূর্বে প্রাচীন ইতিহাস এখানে একটু বলা আবশ্যক । বৈদিক ধর্ম কেবল তান্ত্রিক ধর্ম নহে; উহাতে যে গূঢ়তত্ত্ব আছে, তাহার সূক্ষ্ম বিচার প্রাচীন কালেই উপনিষদসমূহের ভিতরেই হইয়া গিয়াছিল । কিন্তু এই সকল উপনিষদ্ ভিন্ন ভিন্ন ঋষি কর্তৃক ভিন্ন ভিন্ন সময়ে রচিত হওয়ায় তাহাদের মধ্যে বিচার বিভিন্নতাও আসিয়া পড়িয়াছে । এই সকল বিচার-বিরোধ মিটাইবার জন্যই বাদরায়ণ আচাৰ্য নিজ বেদান্তসূত্রে সমস্ত উপনিষদেরই একবাক্যতা প্রতিপাদন করিয়াছেন; এবং এই কারণে বেদান্তসূত্রও উপনিষদসমূহকে প্রমাণ বলিয়া ধরিয়া থাকেন । এই বেদান্তসূত্রের অন্য নাম হইতেছে ‘ব্ৰহ্মসূত্ৰ’, বা ‘শারীরিক সূত্ৰ’ । তথাপি বৈদিকধর্মান্তৰ্গত তত্ত্বজ্ঞানের পূর্ণ বিচার এইটুকুতেই হইতে পারে না । কারণ, উপনিষদের উপদিষ্ট জ্ঞান প্রায়ই বৈরাগ্যপর অর্থাৎ নিবৃত্তিপর; এবং উপনিষদের একবাক্যতা সম্পাদন করিবার জন্যই বেদান্তসূত্র রচিত হওয়ায়, উহাতে কোথাও প্ৰবৃত্তিমার্গের সবিস্তার বিচার করা হয় নাই । তাই, প্ৰবৃত্তিমার্গপ্রতিপাদক ভগবদ্গীতা বৈদিক ধর্মতত্ত্বজ্ঞানের এই অভাব যখন সর্বপ্রথম পূর্ণ করিলেন, তখন উপনিষদ ও বেদান্তসূত্রের অন্তর্নিহিত তত্ত্বজ্ঞানের পূর্ণতাসম্পাদক গ্ৰন্থ ভগবদ্গীতা এই হিসাবেই উহাদের সহিত সমানরূপে সর্বমান্য ও প্রমাণভূত হইল । এবং পরিণামে উপনিষদ, বেদান্তসূত্র ও ভগবদ্গীতা এই তিন গ্ৰন্থ “প্রস্থানত্রয়ী” এই নাম প্রাপ্ত হইল । “প্রস্থানত্রয়ী”র অর্থ এই যে উহাতে বৈদিক ধর্মের আধারভূত তিন মুখ্য বা স্তম্ভ গ্রন্থ আছে, যে গ্রন্থগুলিতে নিবৃত্তি ও প্ৰবৃত্তি এই দুই মার্গেরই যথা পদ্ধতি তাত্ত্বিক বিচার করা হইয়াছে । এইরূপে; প্ৰস্থানত্ৰয়ীতে ভগবদ্গীতার সমাবেশ এবং প্ৰস্থানত্ৰয়ীর সাম্রাজ্য অধিকাধিক বিস্তৃত হইবার পর, যে ধর্মমত বা সম্প্রদায় এই তিন গ্ৰন্থকে অবলম্বন করিত না, কিংবা এই তিনের মধ্যে যাহার সমাবেশ হইতে পারিত না, সেই মত ও সম্প্রদায়কে বৈদিক ধর্মের লোকেরা গৌণ মনে করিয়া অগ্রাহ্য করিতে লাগিল । ইহার পরিণাম হইল এই যে, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈত, শুদ্ধাদ্বৈত প্রভৃতি এবং তদবলম্বিত সন্ন্যাস বা ভক্তিমূলক বৈদিক ধর্মের যে যে সম্প্রদায় বৌদ্ধধর্মের পতনের পর হিন্দুস্থানে প্রচলিত হইছে, উহাদের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আচার্যেরা প্রস্থানত্রয়ীর তিন ভাগের উপরেই (ভগবদ্গীতাসহ) ভাষ্য লিখিয়াছেন । তাঁহাদের ভাষ্য লিখিবার প্রয়োজন ছিল এই যে, তাঁহারা দেখাইতে চাহেন যে এই সকল সম্প্রদায় বাহির হইবার পূর্বেই যে তিন ধর্মগ্রন্থ প্রামাণিক গ্ৰন্থ বলিয়া স্বীকৃত হইত, সেই তিন গ্রন্থেরই উপর তাঁহদের নিজের নিজের সম্প্রদায় দাঁড়াইয়া আছে, অপর সম্প্রদায় ঐ সকল গ্ৰন্থকে মানিয়া চলেন না । এরূপ করিবার কারণ এই যে, যদি কোন আচাৰ্য ইহা স্বীকার করেন যে অন্য সম্প্রদায়ও প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থের উপর সংপ্ৰতিষ্ঠিত, তবে তাঁহার নিজ সম্প্রদায়ের মাহাত্ম্যের কতকটা লাঘব হয়; এবং এরূপ মাহাত্ম্যের লাঘব করা কোন সম্প্রদায়েরই অভীষ্ট নহে । সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে প্ৰস্থানত্রয় সম্বন্ধে ভাষ্য লিখিবার এই প্ৰথা আরম্ভ হইলে, বিভিন্ন পণ্ডিত নিজ নিজ সম্প্রদায়িক ভাষ্যের উপরেই নিজ নিজ টীকা লিখিয়া গীতাৰ্থ প্ৰতিপাদন করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক টীকাই অধিক মান্য হইয়া পড়িল । গীতা সম্বন্ধে এক্ষণে যে সকল ভাষ্য কিংবা টীকা পাওয়া যায়, তাহাদের প্রায় সকলগুলিই এই প্ৰকার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক আচার্য বা পণ্ডিতের রচিত । ইহার পরিণাম হইয়াছে এই যে, মূল ভগবদ্গীতাতে একই অর্থ সহজভাবে প্রতিপাদিত হইলেও, ঐ গীতাই প্ৰত্যেক সম্প্রদায়ের সমর্থক বলিয়া উপলব্ধ হয় ।
এই সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্ৰীশঙ্করাচার্যের সম্প্রদায়ই প্রাচীনতম সম্প্রদায় এবং তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে ঐ সম্প্রদায়ই হিন্দুস্থানে মান্যতম হইয়াছে । শ্ৰীমৎ শঙ্করাচার্য ৭১০ শালিবাহন শকে (৮৪৫ সম্বৎ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩২ বৎসরে তিনি গুহা-প্ৰবেশ করেন (৭১০-৭৪২), বর্তমানে ইহা নির্ধারিত হইয়াছে । (আমাদের মতে শঙ্করাচার্যের কাল আরও ১০০ বৎসর পিছাইয়া দেওয়া আবশ্যক । পরিশিষ্ট ভাগে তাহার প্রমাণাদি দ্রষ্টব্য ।) শ্ৰী শঙ্করাচার্য একজন অলৌকিক জ্ঞানী পুরুষ ছিলেন । তিনি স্বকীয় দিব্য শক্তির দ্বারা সেই সময় চতুর্দিকে ব্যাপ্ত জৈন ও বৌদ্ধ মতের খণ্ডন করিয়া অদ্বৈতমত স্থাপন করিলেন; এবং তিনি শ্রুতি-স্মৃতি-বিহিত বৈদিক ধর্মের সংরক্ষণার্থ ভারতবর্ষের চারিদিকে চারি মঠ দাঁড় করাইয়া নিবৃত্তিপর বৈদিক সন্ন্যাস ধর্ম বা সম্প্রদায় কলিযুগে পুনঃপ্রবর্তিত করিলেন, একথা সৰ্ববিশ্রুত । যে কোন সম্প্রদায়কেই ধর না কেন, স্বভাবতই তাহার দুই ভাগ আছে – (i) তত্ত্বজ্ঞানের ভাগ; (ii) আচরণের ভাগ । প্রথম ভাগে জড় ব্ৰহ্মাণ্ডের বিচারের দ্বারা পরমেশ্বরের স্বরূপ নিষ্পন্ন পূর্বক শাস্ত্ররীতি-অনুসারে মোক্ষসম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তও নির্ণয় করা হয়; এবং দ্বিতীয় ভাগে ঐ মোক্ষলাভের সাধন বা উপায় কি অৰ্থাৎ এই জগতে মনুষ্য কিরূপ আচরণ করিবে, তাহার নিরূপণ করা হইয়া থাকে । তন্মধ্যে প্রথম অর্থাৎ তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখিলে, শ্ৰীশঙ্করাচার্যের কথাটি এই যে, (১) :আমি, তুমি, কিংবা মুষ্যের চক্ষুগোচর দৃশ্যমান জগৎ অর্থাৎ সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থসমূহের নানাত্ব আসলে সত্য নহে । একই শুদ্ধ ও নিত্য পরব্রহ্ম এই সমস্ত ভরিয়া আছেন, এবং তাঁহার মায়াতে মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমক্ষে নানাত্ব অবভাসিত হয় । (২) মনুষ্যের আত্মাও মূলত পরব্রহ্মরূপই; এবং (৩) আত্মা ও পরব্রহ্মের একতার পূর্ণজ্ঞান অর্থাৎ অনুভবাত্মক উপলব্ধি না হইলে মোক্ষলাভ হইতে পারে না । ইহাকেই অদ্বৈতবাদ বলে । ইহার তাৎপৰ্য এই যে, একমাত্ৰ শুদ্ধ, বুদ্ধ, নিত্য ও মুক্ত পরব্ৰহ্ম ব্যতীত অপর কোন স্বতন্ত্র ও সত্য বস্তু নাই; যে নানাত্ব চোখে দেখা যায় তাহা মানবী দৃষ্টির ভ্রম বা মায়িক উপাধিমূলক অবভাস মাত্র । মায়াও সত্য বস্তু বা স্বতন্ত্র বস্তু নহে; উহাও মিথ্যা । এই সিদ্ধান্তের এইরূপ তাৎপৰ্য । কেবল তত্ত্বজ্ঞানের বিচার করিতে হইলে শাঙ্করমতের ইহা অপেক্ষা অধিক আলোচনা করা আবশ্যক হয় না । কিন্তু শাঙ্করসম্প্রদায়ের ইহাতেই পূর্ণতা হয় না । অদ্বৈত তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে শাঙ্করসম্প্রদায়ের আর এক সিদ্ধান্ত আছে, যাহা আচার দৃষ্টিতে প্ৰথমের সহিত সমান মাহাত্ম্যবিশিষ্ট । তাহার তাৎপৰ্য এই যে, যদিও চিত্তশুদ্ধি হইলে পর ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান প্ৰাপ্ত হইবার যোগ্যতা লাভ করিবার জন্য স্মৃতিগ্ৰন্থাদির উক্তি অনুসারে গৃহস্থাশ্রমের কর্ম সকল করা অত্যন্ত আবশ্যক, তথাপি এই সকল কর্মের আচরণ চিরকাল কর্তব্য নহে, কারণ পরিশেষে সকল কর্ম ছাড়িয়া দিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ ব্যতীত মোক্ষলাভ হইতে পারে না । ইহার কারণ এই যে, কর্ম ও জ্ঞান, অন্ধকার ও আলোকের ন্যায় পরস্পর বিরোধী হওয়া প্ৰযুক্ত, সমস্ত বাসনা ও কর্ম পরিত্যাগ ব্যতীত ব্ৰহ্মজ্ঞানের পূর্ণতাই হয় না । পরিশেষে সর্ব কর্ম ত্যাগ করিয়া জ্ঞানেতেই মগ্ন থাকা হয় বলিয়া, এই সিদ্ধান্তটিকে ‘নিবৃত্তিমাৰ্গ, সন্ন্যাসনিষ্ঠা’ বা ‘জ্ঞাননিষ্ঠা’ বলা হয় । উপনিষদ ও ব্ৰহ্মসূত্রের উপর যে শাঙ্করভাষ্য আছে তাহাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে ঐ উভয়ে শুধু অদ্বৈতজ্ঞানই আছে এরূপ নহে, সন্ন্যাসমাৰ্গও আছে অর্থাৎ শাঙ্করসম্প্রদায়ের উপরি-উক্ত দুই ভাগেরই উপদেশ আছে । গীতার উপর যে শাঙ্করভাষ্য আছে তাহাতে নিরূপিত হইয়াছে যে ভগবদ্গীতারও তাৎপৰ্য তাহাই [গী|শাংভা|উপোদ্ঘাত ও ব্ৰহ্মসূ, শাংভা|২|১|১৪ দেখ] । ইহার প্রমাণ স্বরূপে গীতার কোন কোন বাক্যও প্রদত্ত হইয়াছে, যথা — “জ্ঞানাগ্নিঃ সৰ্ব্বকৰ্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে” — জ্ঞানরূপ অগ্নিতে সকল কর্ম ভস্ম হইয়া যায় [গী|৪| ৩৭], “সৰ্ব্বকৰ্ম্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে” — জ্ঞানেতেই সর্বকর্মের পরিসমাপ্তি হয় [গী|৪| ৩৩] । সারকথা এই যে, বৌদ্ধধর্মের পতনের পর, প্রাচীন বৈদিক ধর্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থির করিয়া শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য যে বিশিষ্ট মার্গের স্থাপনা করিয়াছেন, গীতার তাৎপৰ্য তাহারই অনুকূল, পূর্ব টীকাকারদিগের কথাপ্রমাণে জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয় গীতার প্রতিপাদ্য নহে, প্ৰত্যুত কর্মই জ্ঞানপ্ৰাপ্তির গৌণ সাধন এবং সর্বকর্ম সন্ন্যাসপূর্বক জ্ঞানেতেই মোক্ষ লাভ হয়, শাঙ্করসম্প্রদায়ের এই সিদ্ধান্তই গীতাতে উপদিষ্ট হইয়াছে - ইহা দেখাইবার জন্যই শঙ্কারভাষ্য লিখিত হইয়াছে । শঙ্করাচার্যের পূর্বে যদি সন্ন্যাসপার কোন টীকা লিখিত হইয়া থাকে, তাহা এক্ষণে পাওয়া যায় না । এইজন্য গীতার প্রবৃত্তিপর রূপটি উঠাইয়া দিয়া নিবৃত্তিপর সাম্প্রদায়িক রূপ প্ৰদান করা উক্ত ভাষ্য হইতে আরম্ভ হইয়াছে, এইরূপ বলা যাইতে পারে । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের পরে তাঁহার সম্প্রদায়ের অনুযায়ী, মধুসূদনাদি যে সকল অনেক টীকাকার হইয়াছেন, তাঁহারা এই বিষয়ে অনেকটা শঙ্করাচার্যেরই অনুকরণ করিয়াছেন । ইহার পরে, এক অদ্ভুত বিচার উঠিয়াছে যে, অদ্বৈতমতের মূলীভূত মহাবাক্যসমূহের মধ্যে “তত্ত্বমসি” – [সেই (পরব্রহ্ম) তুমি (শ্বেতকেতু)] ছান্দোগ্যোপনিষদের এই মহাবাক্য গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে বিবৃত হইয়াছে । কিন্তু এই মহাবাক্যের পদসকলের ক্রম বদলাইয়া প্ৰথমে “ত্বং” ও তাহার পর “তৎ” এবং পরে “অসি” এই পদগুলিকে লইয়া, এই নূতন ক্ৰম অনুসারে প্রত্যেক পদের উপর গীতার আরম্ভ হইতে ছয় ছয় অধ্যায়, শ্ৰীভগবান অপক্ষপাতে সমান সমান বাঁটিয়া দিয়াছেন । গীতা সম্বন্ধে পৈশাচ ভাষ্য কোন সম্প্রদায়েরই নহে, উহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং হনুমান অর্থাৎ মারুতি কর্তৃক লিখিত এইরূপ কাহারো কাহারো ধারণা । কিন্তু আসল কথা তাহা নহে । ভাগবতের টীকাকার হনুমান পণ্ডিত এই ভাষ্য রচনা করেন এবং উহা সন্ন্যাস মার্গের । ইহার কয়েক স্থানে শাঙ্কর ভাষ্যেরই অর্থ শব্দশ প্রদত্ত হইয়াছে । সেইরূপ, পূর্বে ও অধুনা, মারাঠীতে গীতার যে ভাষান্তর কিংবা আলোচনাদি প্ৰকাশিত হইয়াছে সে সমস্ত প্রায়ই শঙ্কর ভাষ্যানুযায়ী । অধ্যাপক মোক্ষমূলর কর্তৃক প্ৰকাশিত “প্ৰাচ্যধর্মপুস্তক-মালায়” পরলোকগত কাশীনাথ পন্ত তৈলঙ্গকৃত ভগবদ্গীতার ইংরেজি অনুবাদও আছে । তাহার প্রস্তাবনায় লিখিত হইয়াছে যে, এই অনুবাদে অনেকটা শঙ্করাচার্য ও শাঙ্কর সম্প্রদায়ী টীকাকারদিগের অনুসরণ করা হইয়াছে ।
গীতা ও প্ৰস্থানত্রয়ীর অন্তর্ভূত অন্য গ্ৰন্থ সম্বন্ধে এই প্রকার সাম্প্রদায়িক ভাষ্য লিখিবার রীতি প্ৰচলিত হইলে পর, অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও ঐ রূপ অনুকরণ আরম্ভ হইল । মায়াবাদ, অদ্বৈত ও সন্ন্যাস প্ৰতিপাদনকারী শাঙ্করসম্প্রদায়ের প্রায় সাৰ্দ্ধ দুই শত বৎসর পরে, শ্ৰীরামানুজাচাৰ্য (জন্ম শক ৯৩৮, সম্বৎ ১৯৭৩) বিশিষ্টাদ্বৈত সম্প্রদায় প্ৰবর্তিত করিলেন । নিজ সম্প্রদায় পুষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে শঙ্করাচার্ধের ন্যায় রামানুচাৰ্যও প্রস্থানত্রীর উপর, (সুতরাং তদন্তৰ্গত গীতারও উপর) স্বতন্তু ভাষ্য লিখিয়াছেন । এই সম্প্রদায়ের মত এই যে, শ্ৰীশঙ্করাচার্যের মায়া-মিথ্যাত্মবাদ ও অদ্বৈত সিদ্ধান্ত এ দুইটী সত্য নহে; জীব, জগৎ ও ঈশ্বর এই তিন তত্ত্ব ভিন্ন হইলেও, জীব (চিৎ) ও জগত (অচিৎ) এই দুইটী একই ঈশ্বরের শরীর; সুতরাং চিৎ অচিৎ বিশিষ্ট ঈশ্বর একই এবং ঈশ্বর শরীরান্তর্ভূত এই সূক্ষ্ম চিৎ-অচিৎ হইতেই পরে স্থূল, চিৎ ও স্থূল অচিৎ বা অনেক জীব ও জগৎ উৎপন্ন হয় । এই মতই উপনিষদ, ব্ৰহ্মসূত্র ও গীতাতে প্রতিপাদিত হইয়াছে, - তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে ইহাই রামানুজাচার্যের অভিপ্ৰায় [গী|রা-ভা|২|১২; ১৩|২] । ইহাঁরই গ্ৰন্থসমূহের কারণে ভাগবত ধর্মের মধ্যে বিশিষ্টাদ্বৈত মত প্ৰবেশলাভ করিয়াছে, একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না । কারণ, ইহার পূর্বে মহাভারত ও গীতাতে ভাগবত ধর্মের যে বর্ণনা দেখা যায়, তাহাতে অদ্বৈতবাদই স্বীকৃত দৃষ্ট হয় । রামানুজাচাৰ্য ভাগবতধর্মাবলম্বী থাকা প্ৰযুক্ত, গীতাতে প্ৰবৃত্তিপর কর্মযোগ প্ৰতিপাদিত হইয়াছে - এই কথাই প্ৰকৃতপক্ষে তাঁহার মনে হওয়া উচিত ছিল । কিন্তু রামানুজাচার্যের সময়ে মূল ভাগবত ধর্মের অন্তর্ভূত কর্মযোগ অনেকটা লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল এবং তিনি তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও নৈতিক আচরণদৃষ্টিতে ভক্তিতত্ত্ব প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন । এই সকল কারণে গীতাতে জ্ঞান কর্ম ও ভক্তি এই তিনই বর্ণিত হইলেও তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে বিশিষ্টাদ্বৈত ও আচার দৃষ্টিতে বাসুদেবভক্তিই গীতার সারতত্ত্ব; কর্মনিষ্ঠা কোন স্বতন্ত্র বস্তু নহে, জ্ঞাননিষ্ঠার উৎপাদক মাত্র ইহাই রামানুজাচার্য সিদ্ধান্ত করিয়াছেন [গী|রা-ভা|১৮|১ ও ৩|১] দেখ] । অদ্বৈত জ্ঞানের স্থানে বিশিষ্টাদ্বৈত এবং সন্ন্যাসের স্থানে ভক্তি - যদিও রামানুজাচার্য শাঙ্করসম্প্রদায় হইতে এইরূপ প্ৰভেদ করিয়াছেন, তথাপি তিনি আচরণ দৃষ্টিতে ভক্তিই শেষ কর্তব্য বলিয়া স্বীকার করায়, বর্ণাশ্রমবিহিত সাংসারিক কর্ম আমরণ সম্পাদন করা – তাঁহার মতে গৌণ হইয়াছে । এবং সেইজন্য গীতার রামানুজীয় তাৎপৰ্যও একপ্রকার কর্ম-সন্ন্যাস পরই বলা যাইতে পারে । কারণ, কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হইয়া জ্ঞানোদয় হইলে পর, চতুর্থাশ্রম গ্ৰহণ করিয়া ব্ৰহ্মচিন্তাতে নিমগ্ন থাকা অথবা প্রেমযোগে অপরিসীম বাসুদেবভক্তিতে ডুবিয়া থাকা — এই দুই মার্গই কর্মযোগদৃষ্টিতে একই - উভয়ই নিবৃত্তিপর । রামানুজাচার্যে পরবর্তী সম্প্রদায়ের উপরেও এই আপত্তি হইতে পারে ।
মায়ামিথ্যাতত্ত্ববাদ অসত্য এবং বাসুদেবভক্তিই প্ৰকৃত মোক্ষসাধক, রামানুজসম্প্রদায়ের পরে এই মতপ্রচারক এক তৃতীয় সম্প্রদায় আবির্ভূত হইয়াছিল । এই সম্প্রদায়ের মত এই যে, পরব্রহ্ম ও জীব কিয়দংশে এক ও কিয়দংশে ভিন্ন, ইহা স্বীকার করা পরস্পরবিরুদ্ধ ও অসম্বন্ধ । এইজন্য উভয়ই সতত ভিন্ন এইরূপ স্বীকার করিতেই হয়; পূর্ণরূপে কিংবা অংশতও উহাদের মধ্যে ঐক্য থাকিতে পারে না । এই তৃতীয় সম্প্রদায়কে “দ্বৈতী সম্প্রদায়” বলা হয় । এই সম্প্রদায়ের লোকদিগের মতে ইহার প্ৰবর্তক শ্ৰীমধ্বাচাৰ্য (শ্ৰীমৎ আনন্দন্তীর্থ) । ইনি ১১২০ শকে (১২৫৫ সম্বতে) সমাধিস্থ হইয়াছেন এবং তখন তাঁহার বয়স ৩৯ বৎসর ছিল । কিন্তু ডাক্তার ভাণ্ডারকর “বৈষ্ণব, শৈব ও অন্য পন্থী” নামে যে ইংরাজী গ্ৰন্থ সম্প্রতি প্ৰকাশ করিয়াছেন, তাহাতে (৫৯ পৃঃ) তিনি শিলালেখাদি প্রমাণের বলে, মধ্বাচার্যের কাল ১১১৯ হইতে ১১৯৮ শক পৰ্যন্ত (১২৫৪-১৩৩৩ সম্বৎ) নির্ধারিত করিয়াছেন । শ্ৰীমধ্বাচার্যের প্রস্থানত্রয়ী সম্বন্ধে - সুতরাং গীতাসম্বন্ধেও - যে ভাষ্য আছে তাহাতে এই সমস্ত গ্ৰন্থ দ্বৈতমতেরই প্ৰতিপাদক - ইহাই তিনি দেখাইয়াছেন । তাঁহার গীতা-ভাষ্যে তিনি এইরূপ বলেন যে, নিষ্কাম কর্মের মাহাত্ম্য যদিও গীতাতে বৰ্ণিত হইয়াছে, তথাপি সেই নিষ্কাম কর্ম সাধনমাত্ৰ, ভক্তিই চরম নিষ্ঠা । ভক্তি সিদ্ধ হইলে পর, কর্ম কিছু করিলে বা না করিলে, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না । “ধ্যানাৎ কর্মফলত্যাগঃ” - পরমেশ্বরের ধ্যান বা ভক্তি অপেক্ষা কর্মফলত্যাগ বা নিষ্কাম কর্ম শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি । কতকগুলি গীতা বচন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ; কিন্তু গীতার মাধ্বভাষ্যে লিখিত হইয়াছে যে, ঐ সকল বচন অক্ষরশঃ সত্য বলিয়া ধরিবার পরিবর্তে অর্থবাদাত্মক বলিয়া বুঝিতে হইবে [গী|মা-ভা|১২|১৩] ।
চতুর্থ সম্প্রদায় শ্ৰীবল্লভাচার্য প্ৰবর্তিত (জন্মশক ১৪০১, সম্বৎ ১৫৩৬) । রামানুজ ও মাধ্ব-সম্প্রদায়ের ন্যায় এই সম্প্রদায়ও বৈষ্ণবপন্থী । কিন্তু জীব, জগৎ ও ঈশ্বর সম্বন্ধে এই সম্প্রদায়ের মত বিশিষ্টাদ্বৈত কিংবা দ্বৈত মত হইতে স্বতন্ত্র । মায়া-বিরহিত অর্থাৎ শুদ্ধ জীব ও পরব্রহ্ম একই, দুই নহে, এই সম্প্রদায় ইহা স্বীকার করেন । এই জন্যই এই মতকে ‘শুদ্ধাদ্বৈত’ বলে । এই সম্প্রদায় শ্ৰীশঙ্করাচার্যের ন্যায় জীব ও ব্ৰহ্ম এক বলিয়া স্বীকার করেন না । ইহারা বলেন যে, অগ্নির স্ফুলিঙ্গের ন্যায় জীব ঈশ্বরের অংশমাত্র; মায়াত্মক জগৎ মিথ্যা নহে, মায়াও ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঈশ্বর হইতে বিভক্ত এক শক্তি, এবং মায়াপরতন্ত্ৰ জীবের মোক্ষজ্ঞান ঈশ্বরানুগ্রহ ব্যতীত হইতে পারে না, সুতরাং ভগবদ্ভক্তিই মোক্ষের মুখ্য সাধন । এই সিদ্ধান্তের কারণেই শাঙ্কর-সম্প্রদায় হইতেও এই সম্প্রদায় ভিন্ন হইয়াছে । এই মার্গের লোকেরা পরমেশ্বরের এই অনুগ্রহকে “পুষ্টি, পোষণ” নামেও অভিহিত করেন, তাই এই সম্প্রদায়কে “পুষ্টিমাৰ্গ”ও বলা হইয়া থাকে । এই সম্প্রদায়ের তত্ত্বদীপিকাদি গীতাসম্বন্ধীয় যে সকল গ্ৰন্থ আছে, তাহাতে এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছে যে, ভগবান অর্জুনকে সাংখ্যজ্ঞান ও কর্মযোগের কথা প্রথমে বলিয়া শেষে ভক্তি-অমৃত পান করাইয়া কৃতকৃত্য করিয়াছেন; সেই কারণে ভগবৎ-ভক্তি এবং বিশেষভাবে নিবৃত্তিপর পুষ্টিমার্গীয় ভক্তিই সমস্ত গীতার মুখ্য তাৎপৰ্য । কারণ এই যে, ভগবান গীতার শেষে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, “সর্বধর্মানু পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্ৰজ” [গী|১৮|৬৬] - সকল ধর্ম ত্যাগ করিয়া একমাত্র আমারই শরণ লও ।
উপরি উক্ত সম্প্রদায়সমূহের অতিরিক্ত নিম্বার্কেরও রাধাকৃষ্ণভক্তিপর আর এক বৈষ্ণব-সম্প্রদায় আছে । এই আচার্য, রামানুজাচার্যের পর ও মধ্বাচার্যের পূর্বে, আনুমানিক ১০৮৪ শকে (১২১৯ সম্বৎ) আবির্ভূত হইয়াছিলেন, ডাক্তার ভাণ্ডারকর এইরূপ নির্ধারণ করিয়াছেন । জীব, জগৎ ও ঈশ্বর সম্বন্ধে নিম্বাৰ্কাচার্যের মত এই যে, এই তিন ভিন্ন হইলেও, জীব ও জগতের ব্যাপার ও অস্তিত্ব স্বতন্ত্র না হইয়া উহা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে অবলম্বন করিয়া আছে এবং মূল পরমেশ্বরের মধ্যেই জীব ও জগতের সূক্ষ্মতত্ত্ব অন্তর্ভুত রহিয়াছে । এই মত সিদ্ধ করিবার জন্য নিম্বার্ক বেদান্তসূত্ৰ সম্বন্ধে এক স্বতন্ত্র ভাষ্য লিখিয়াছেন । এই সম্প্রদায়ের কেশব কাশ্মীরী ভট্টাচাৰ্য গীতার ‘তত্ত্বপ্রকাশিকা’ নামে এক টীকা লিখিয়া তাহাতে দেখাইয়াছেন যে, প্ৰকৃত গীতাৰ্থ এই সম্প্রদায়ের অনুকুল । রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত হইতে এই সম্প্রদায়ের ভেদ প্ৰদৰ্শনার্থ ইহাকে “দ্বৈতাদ্বৈতী’ সম্প্রদায় বলা যাইতে পারে ।
ইহা স্পষ্টই উপলব্ধি হয় যে এই সকল ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় শাঙ্কর-সম্প্রদায়ের মায়াবাদ স্বীকার না করিয়াই প্ৰবর্তিত হইয়াছিল; কারণ, চক্ষুগ্ৰাহ্য প্ৰত্যক্ষ বস্তুকে সত্য বলিয়া স্বীকার না করিলে ব্যক্তের উপাসনা অর্থাৎ ভক্তি নিরাধার বা কিয়দংশে মিথ্যাও হইয়া যায় । কিন্তু ভক্তিবাদ স্থাপন করিবার জন্য অদ্বৈত ও মায়াবাদ সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতেই হইবে এমন কোনই কথা নাই । মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ স্বীকার করিয়াও মহারাষ্ট্র দেশীয় এবং অন্যান্য সাধু সন্তেরা ভক্তির সমর্থন করিয়াছেন । অতএব এই পন্থা শ্ৰীশঙ্করাচার্যের পূর্ব হইতেই চলিয়া আসিতেছে এইরূপ অনুমান হয় । অদ্বৈত, মায়া-মিথ্যাত্ববাদ ও কর্মত্যাগের আবশ্যকতা, এই সকল শাঙ্করসম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত, উক্ত পন্থাতেও গৃহীত হইয়া থাকে । কিন্তু এই পন্থার ইহাও মত যে, ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ মোক্ষপ্রাপ্তির সর্বাপেক্ষা সুগম সাধন হইতেছে ভক্তি । “তুজ হ্বাবা আহে দেব । তরি হা সুলভ উপায়” [তুকা|গা|৩০০২-২] অর্থাৎ - তোমার যদি দেবতা হইতে হয়, ইহাই তাহার সুলভ উপায় । তুকারাম বাবাজীর কথা অনুসারে এই পন্থাবলম্বীর ইহাই উপদেশ । গীতাতেও ভগবান প্রথমে এই কারণ বলিয়াছেন যে, “ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্” [গী|১২|৫] অর্থাৎ অব্যক্ত ব্ৰহ্মের প্রতি চিত্তকে আসক্ত করা অধিক ক্লেশকর । পরে, অর্জুনকে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, “ভক্তাস্তেহতীব মে প্রিয়াঃ” [গী|১২|২০] অর্থাৎ আমার ভক্তই আমার অতীব প্রিয় । অতএব ইহাই প্রকট হইতেছে যে, অদ্বৈতপর্যবসায়ী ভক্তিমাৰ্গই গীতার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । শ্ৰীধর স্বামীও গীতার স্বকৃত টীকাতে [গী|১৮|৭৮] গীতার এইরূপ তাৎপৰ্যই প্ৰকাশ করিয়াছেন । মারাঠী ভাষাতে এই সম্প্রদায়ের গীতাসম্বন্ধীয় সর্বোত্তম গ্ৰন্থ হইতেছে “জ্ঞানেশ্বরী” । ইহাতে বলা হইয়াছে যে, গীতার আঠারো অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ছয় অধ্যায়ে কর্ম, মধ্যের ছয় অধ্যায়ে ভক্তি এবং শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞান প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । স্বয়ং জ্ঞানেশ্বর মহারাজ নিজ গ্রন্থের শেষে বলিয়াছেন যে, “ভাষ্যকারাঁ তেঁ বাট পুসৎ” - অৰ্থাৎ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যকে পথ জিজ্ঞাসা করিয়া - অর্থাৎ শঙ্করাচার্যের মতানুসরণ করিয়া আমি নিজের টীকা রচনা করিয়াছি । কিন্তু “জ্ঞানেশ্বরী”কে এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র গ্ৰন্থ বলিয়া ধরা উচিত, কারণ ইহাতে গীতার মূল অর্থ অনেক বাড়াইয়া অনেক সরল দৃষ্টান্তের দ্বারা সেগুলি বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহাতে বিশেষভাবে ভক্তিমার্গের ও কিয়দংশে নিষ্কাম কর্মেরও শ্ৰীশঙ্করাচার্য অপেক্ষা উত্তম বিচার করা হইয়াছে । জ্ঞানেশ্বর মহারাজ নিজে যোগী ছিলেন । তাই, গীতার ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের যে শ্লোকে পাতঞ্জল-যোগাভ্যাসের বিষয় আসিয়াছে, তৎসম্বন্ধে তিনি এক বিস্তৃত টীকা করিয়াছেন । তাঁহার বক্তব্য এই যে, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ের শেষে “তস্মাদ্যোগী ভবাৰ্জুন” । অতএব হে অর্জুন তুমি যোগী হও [গী|৬|৪৯], অর্জুনকে এইরূপ বলিয়া সমস্ত মোক্ষপন্থার মধ্যে পাতঞ্জলযোগই সৰ্বোৎকৃষ্ট নির্দিষ্ট করিয়াছেন এবং এই কারণে নিজে উহাকে ‘পন্থরাজ’ বলিয়াছেন ।
সার কথা এই যে, ভিন্ন ভিন্ন সাম্প্রদায়িক ভাষ্যকার, ও টীকাকারগণ গীতার অর্থ আপনাপন মতের অনুকুল স্থির করিয়া লইয়াছেন । প্রত্যেক সম্প্রদায়ের এই কথা যে, গীতার উপদিষ্ট প্রবৃত্তিপর কর্মমার্গ গৌণ, অর্থাৎ জ্ঞানের একমাত্র সাধন; গীতাতে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের স্বীকৃত তত্ত্বজ্ঞানই পাওয়া যায়; আপন সম্প্রদায়ের মোক্ষদৃষ্টিতে শেষের কর্তব্য বলিয়া যে সকল আচার স্বীকৃত হইয়াছে, সেই সকলই গীতাতে বর্ণিত হইয়াছে । অর্থাৎ মায়াবাদাত্মক অদ্বৈতবাদ ও কর্মসন্ন্যাস, মায়াসত্যত্বপ্ৰতিপাদক বিশিষ্টাদ্বৈত ও বাসুদেবভক্তি, দ্বৈত ও বিষ্ণুভক্তি, শুদ্ধাদ্বৈত ও ভক্তি, শাঙ্করাদ্বৈত ও ভক্তি, পাতঞ্জল-যোগ ও ভক্তি, কেবল ভক্তি, কেবল যোগ, কেবল ব্ৰহ্মজ্ঞান, এইরূপ অনেক প্রকারের কেবলমাত্র নিবৃত্তিপর মোক্ষধর্মই গীতার প্ৰধান ও প্ৰতিপাদ্য বিষয় । (ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের আচাৰ্যদিগের গীতাসম্বন্ধীয় ভাষ্য ও সেই সেই সম্প্রদারের ছোট বড় সমস্ত মিলিয়া ১৫টি প্রধান প্রধা টীকা, বোম্বায়ে “গুজরাটী প্রিস্টিং প্রেসের” কর্তা সম্প্রতি একত্র ছাপাইয়াছেন । ভিন্ন ভিন্ন টীকাকারদিগেয় অভিপ্ৰায় একযোগে অবগত হইবার পক্ষে এই গ্রন্থটী বড়ই সুবিধাজনক ।)
ইহা শুধু আমাদেরই মত নহে, প্ৰসিদ্ধ মহারাষ্ট্র কবি বামন পণ্ডিতেরও মত এইরূপ । গীতাসম্বন্ধীয় তাঁহার “যথার্থদীপিকা” নামক বিস্তৃত মারাঠী টীকার উপোদ্ঘাতে তিনি প্রথমে লিখিয়াছেন -
এক্ষণে ইহা সুস্পষ্ট যে গীতার অনেক প্রকার তাৎপৰ্য ব্যাখ্যাত হইয়াছে । প্ৰথমেই তো স্বয়ং মহাভারতকার ভাগবতধর্মানুসারী অর্থাৎ প্ৰবৃত্তিপর তাৎপৰ্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাহার পর আবির্ভূত অনেক পণ্ডিত, আচার্য, কবি, যোগী ও ভগবদ্ভক্তগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়ানুরূপ শুদ্ধ নিবৃত্তিপর তাৎপৰ্য প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । ভগবদ্গীতার এইরূপ অনেক প্রকার তাৎপৰ্য দেখিয়া যে কোন ব্যক্তি বিভ্ৰান্তচিত্ত হইয়া স্বভাবতই এইরূপ প্রশ্ন করিতে পারে যে, এই পরস্পরবিরোধী নানাবিধ তাৎপৰ্য একই গ্ৰন্থ হইতে বাহির করা যাইতে পারে কি ? বাহির করা যাইতে পারে শুধু নয়, উহাতে ইষ্টও আছে এইরূপ যদি কেহ বলে, তবে এইরূপ হইবার হেতু কি ? বিভিন্ন ভাষ্যকার আচার্য, বিদ্বান, ধার্মিক ও অত্যন্ত সাত্ত্বিক প্ৰকৃতির লোক ছিলেন সে বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় নাই । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের মত মহাতত্ত্বজ্ঞানী আজ পৰ্যন্ত জগতে আবির্ভূত হয় নাই বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না । তবে আবার তাঁহার সহিত পরবর্তী আচাৰ্যদিগের এতটা মতভেদ কেন ? গীতাতো একটা ভোজবাজী নহে যে তাহা হইতে যে যাহা খুশি একটা অৰ্থ বাহির করিবে । উপরি-উক্ত সম্প্রদায়সমূহের আবির্ভাবের পূর্বেই গীতা রচিত হইয়াছিল । অর্জুনের ভ্রম বাড়াইবার জন্য নহে, পরন্তু তাঁহার ভ্ৰম দূর করিবার জন্যই শ্ৰীকৃষ্ণ এই গীতা অর্জুনের নিকট বিবৃত করিয়াছিলেন । গীতাতে একই বিশিষ্ট প্রকারের নিশ্চিত তাৎপর্যের উপদেশ করা হইয়াছে, এবং অর্জুনের উপর তাহার অভীষ্ট পরিণামফলও হইয়াছে । ইহার পরেও গীতার তাৎপৰ্য লইয়া এতটা গোলযোগ কেন হইয়া চলিয়াছে ? প্রশ্নটি কঠিন বলিয়া মনে হয় সত্য । কিন্তু উহার উত্তর প্রথম দৃষ্টিতে যতটা কঠিন বলিয়া মনে হয় আসলে ততটা কঠিন নহে । মনে কর, কোন সুমিষ্ট ও সুরস পক্কান্ন দেখিয়া নিজ নিজ রুচি অনুসারে, যদি বা কেহ তাহাকে গমের, কেহ বা ঘৃতের এবং কেহ বা চিনির পক্কান্ন বলে, তাহা হইলে আমরা কোনটা মিথ্যা বলিয়া স্বীকার করিব ? তিনই আপন আপন হিসাবে সত্য । কিন্তু এই প্রশ্নের মীমাংসা হইল না যে পক্কান্নটী কোন্ বস্তু দ্বারা প্ৰস্তুত হইয়াছে । গম, ঘৃত ও চিনি এই তিন পদার্থই একত্র মিলিত হইয়া তাহা হইতে লাড্ডু, জিলেপী, মোতিচুর ইত্যাদি অনেক প্রকার পক্কান্ন প্ৰস্তুত হইতে পারে, সুতরাং তাহার মধ্যে পক্কান্নটি কোন পদার্থ দ্বারা প্ৰস্তুত, তাহা নির্ণয় করিতে হইলে, উহা গোধূমপ্রধান, ঘৃতপ্রধান কিংবা শর্করাপ্রধান, শুধু এইরূপ বলিলেই চলিবে না । সমুদ্রমন্থনের সময় কেহ বা অমৃত, কেহ বা বিষ, আবার কেহ কেহ বা ঐরাবত, কৌস্তুভ, পারিজাত প্ৰভৃতি বিভিন্ন বস্তু লাভ করিয়াছিলেন, তবু তাহা দ্বারা সমুদ্রের বাস্তবিক স্বরূপ নিৰ্ণয় হয় নাই । সাম্প্রদায়িকভাবে গীতাসাগরের মন্থনকারী টীকাকারদিগের অবস্থাও ঠিক সেইরূপ । আর একটা উদাহরণ দিই । কংসবধের সময় রঙ্গমণ্ডপে অবতীর্ণ একই ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ যেরূপ প্ৰত্যেক দর্শকের নিকট বিভিন্ন স্বরূপে অৰ্থাৎ মল্লের নিকট বজ্রসদৃশ, স্ত্রীলোকের নিকট কামদেবসদৃশ, আপন মাতাপিতার নিকট পুত্রসদৃশ প্রতিভাত হইয়াছিলেন, সেইরূপ ভগবদ্গীতা এক হইলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট উহা বিভিন্নরূপে প্ৰতীয়মান হইয়াছে এইরূপ বলা যাইতে পারে । যে কোন ধর্মসম্প্রদায়ের কথা ধর না কেন, সে সম্প্রদায় একটা সাধারণত প্ৰামাণিক ধর্মগ্রন্থের অনুসরণ করিবেই করিবে, ইহা ত স্পষ্টই দেখা যায় । কারণ, তাহা না হইলে ঐ সম্প্রদায় একেবারেই অপ্ৰমাণ বিবেচিত হইয়া সকল লোকের নিকটেই অমান্য হইবে । এইজন্য বৈদিক ধর্মের যত সম্প্রদায়ই হউক না কেন, কোন বিশেষ বিষয়, যথা, ঈশ্বর, জীব ও জগৎ ইহাদের পরস্পরসম্বন্ধ, বাদ দিলে বাকী বিষয়ে সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায়ই মিল হয় । সেইজন্য আমাদের ধর্মের প্রামাণিক গ্রন্থাদির উপর যে সকল সাম্প্রদায়িক ভাষ্য বা টীকা আছে, সেগুলিতে মূলগ্রন্থের শতকরা নব্বইয়ের অধিক বচন বা শ্লোর্কের ভাবার্থ একই । যাহা কিছু ভেদ, তাহা অবশিষ্ট বচন বা শ্লোক সম্বন্ধেই দেখা যায় । ঐ সকল বচনের সরল অর্থ গ্ৰহণ করিলেও উহা সকল সম্প্রদায়ের পক্ষে সমান অনুকুল হইবে ইহা সম্ভবপর নহে । এই কারণে ইহার মধ্যে যে সকল বচন নিজ সম্প্রদায়ের অনুকুল সেই গুলিই প্রধান ও অন্যগুলি গৌণ বলিয়া স্বীকার করিয়া, অথবা প্রতিকুল বচনগুলির অর্থ যে কোন যুক্তির দ্বারা অন্যথা করিয়া যতটা সম্ভব সহজ ও সরল বচনাদি হইতেও নিজ নিজ অনুকুল শ্লেষার্থ ও অনুমান বাহির করিয়া, নিজ সম্প্রদায় যাহাতে সেই সকল প্ৰমাণের বলে সিদ্ধ হয়, বিভিন্ন সাম্প্রদারিক টীকাকারগণ তাহাই প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন । তাহার উদাহরণ স্বরূপ গীতা, ২|১২ ও ১৬, ৩|১৯; ৬|৩ এবং ১৮|২ শ্লোকগুলির উপর আমার টীকা দেখ । কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক রীতি অনুসারে কোন গ্রন্থের তাৎপৰ্য নিরূপণ করা, আর নিজ সম্প্রদায় গীতাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে এইরূপ কিংবা অন্য কোনরূপ অভিমান না রাখিয়া স্বতন্ত্র রীতিতে প্ৰথমে সমগ্র গ্রন্থের পরীক্ষা করিয়া কেবল তাহা হইতে সার অর্থ বাহির করা - এই দুই বিষয় স্বভাবতই অত্যন্ত ভিন্ন, ইহা সহজেই উপলব্ধি হইবে ।
গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি সদোষ বলিয়া পরিত্যক্ত হইল; এখন তবে গীতার তাৎপৰ্য বাহির করিবার অন্য উপায় কি আছে তাহা বলা আবশ্যক । গ্ৰন্থ, প্রকরণ ও বাক্য এই সকলের অর্থনির্ণয় কাৰ্যে অত্যন্ত কুশল মীমাংসিকদিগের এই সম্বন্ধে সর্বমান্য এক পুরাতন শ্লোক নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি :-
(i) & (ii) তন্মধ্যে সর্বপ্রথম বিচার্য ‘উপক্ৰমোপসংহারৌ’ অর্থাৎ গ্রন্থের আরম্ভ ও শেষ এই দুই বিষয় । প্ৰত্যেক মনুষ্যই মনোমধ্যে কোন বিশিষ্ট হেতু ধরিয়া গ্ৰন্থ লিখিতে আরম্ভ করেন; এবং উক্ত বিশিষ্ট উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে পর গ্ৰন্থ সমাপ্ত করেন । এইজন্য, গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়কাৰ্যে প্রথমেই গ্রন্থের উপক্রম ও উপসংহারের প্রতি লক্ষ্য করা আবশ্যক । সরল রেখা ব্যাখ্যা করিবার সময়, ভূমিতি শাস্ত্রে এইরূপ বলা হইয়া থাকে যে, আরম্ভের বিন্দু হইতে যে রেখা দক্ষিণে-বামে কিংবা উপরে-নীচে না বাঁকিয়া শেষের বিন্দু পৰ্যন্ত বরাবর সমান যায় তাহাকে সরল রেখা বলে । গ্রন্থের তাৎপৰ্যনির্ণয়েও এ নিয়ম প্ৰযুক্ত হইতে পারে । যে তাৎপৰ্য গ্রন্থের আরম্ভে ও শেষে স্পষ্টরূপে প্ৰকাশ পায়, তাহাই গ্রন্থের সরল তাৎপৰ্য । প্রারম্ভ হইতে শেষ পৰ্যন্ত যাইবার অন্য অন্য পথ থাকিলেও সে সব বাকী পথ বা আড়-পথ বলিয়া বুঝিতে হইবে ।
(iii) এইরূপে আদ্যন্ত দেখিয়া গ্রন্থের তাৎপৰ্য নির্ণয় করিবার পর সেই গ্রন্থে ‘অভ্যাস’ বা পুনরুক্তি কিরূপ করা হইয়াছে, অর্থাৎ পুনঃপুনঃ কি বলা হইয়াছে ইহা দেখিতে হইবে । কারণ, গ্ৰন্থকার যে বিষয় সিদ্ধ কমিতে চাহেন, তাহার সমর্থনার্থ তিনি অনেক সময় অনেক কারণ দেখাইয়া প্ৰত্যেকবার “অতএব এই বিষয় সিদ্ধ হইল” কিংবা “অতএব ইহা করা আবশ্যক” এইরূপ একই সিদ্ধান্ত পুনঃপুনঃ বলিয়া থাকেন ।
(iv) গ্ৰন্থতাৎপৰ্য বাহির করিবার চতুর্থ ও পঞ্চম সাধন ‘অপূর্বতা’ ও ‘ফল’ । ‘অপূর্বতা’ অর্থাৎ নূতনত্ব। যে কোন গ্ৰন্থকার হউন, একটা কিছু নূতন বলিবার কথা না থাকিলে, প্রায়ই তিনি নূতন গ্ৰন্থ লিখিতে প্ৰবৃত্ত হন না । অন্তত যে সময় ছাপাখানা ছিল না, সে সময় এরূপ হইত না । এইজন্য কোন গ্রন্থের তাৎপৰ্য নির্ণয় করিবার পূর্বে, সেই গ্রন্থে অপূর্বতা, বৈশিষ্ট, কিংবা নূতনত্ব কি আছে তাহাও দেখা আবশ্যক ।
(v) এই প্রকারে সেই লেখা বা গ্রন্থের কোন ফল অর্থাৎ উক্ত লেখা বা গ্রন্থের দরূণ কোন পরিণাম সঙ্ঘটিত হইয়া থাকিলে সে দিকেও বিশেষ লক্ষ্য রাখা আবশ্যক । কারণ এই ফল মিলিবে কিংবা হইবে মনে করিয়াই যখন কোন গ্ৰন্থ লেখা হইয়া থাকে, তখন সংঘটিত পরিণামের উপর মনোযোগ দিলেই গ্ৰন্থকারের অভিপ্ৰায় খুবই স্পষ্টরূপে ব্যক্ত হইবে ।
(vi) ষষ্ঠ সাধন ও সপ্তম সাধন কি ? না – ‘অর্থবাদ’ ও ‘উপপত্তি’ । ‘অর্থবাদ’ এই শব্দটি মীমাংসকদিগের পারিভাষিক শব্দ [জৈ|সু|১|২|১-১৮] । মুখ্যত কোন বিষয়ের বিধান করিতে হইবে অথবা কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে হইবে ইহা নির্ধারিত হইলেও গ্ৰন্থকার প্রসঙ্গক্রমে আরও অনেক বিষয়ের বর্ণনা করিয়া থাকেন । প্ৰতিপাদনের মুখে দৃষ্টান্ত দিবার জন্য, তুলনা করিয়া একবাক্যতা সম্পাদনার্থ অথবা সাম্য ও ভেদ প্রদর্শনার্থ, প্রতিপক্ষের দোষ দেখাইয়া স্বপক্ষ সমর্থনাৰ্থ, অলঙ্কারার্থ, অতিশয়োক্তির ভাবে এবং যুক্তিবিন্যাসের পরিপোষক কোন বিষয়ের পূর্ব ইতিহাসের সম্বন্ধসূত্রে অন্য অনেক বিষয় বর্ণিত হয় । উক্ত কারণ বা প্রসঙ্গসমূহের অতিরিক্ত অন্যান্য কারণও থাকিতে পারে, এবং কখনো কখনো বিশেষ কোনই কারণ থাকেও না । এরূপ স্থলে গ্ৰন্থকার যাহা বৰ্ণনা করেন, তাহা মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত না হইলেও গৌরবার্থ বা স্পষ্টীকরণার্থ কিংবা পূর্ণতা সম্পাদনার্থ করা হয় বলিয়া তাহা সকল সময়ে যে অক্ষরশ সত্য হইবে এরূপ কোন নিয়ম নাই । (অর্থবাদান্তর্ভূত বর্ণনা, বস্তুস্থিতিমূলক বর্ণনা হইলে তাহাকে ‘অনুবাদ’; বস্তুস্থিতির বিরুদ্ধ হইলে তাঁহাকে ‘গুণাবাদ’ এবং পূর্বে বস্তুস্থিতি ধরিয়া কিন্তু আপাতত বস্তুস্থিতি ছাড়িয়া দিয়া যে বর্ণনা তাহাঁকে "ভূতাৰ্থবাদ’ বলে । অর্থবাদের এই তিন বিভিন্ন নাম ‘অর্থবাদ” এই সামান্য শব্দের অন্তৰ্গত নিবন্ধাদির সত্যাসত্য অনুসারে এই তিন ভেদ ।) কিং বহুনা, এই অপ্রধান বর্ণনা অক্ষরশসত্য কি সত্য নহে ইহা দেখিবার জন্য কখন কখন গ্ৰন্থকার স্বয়ংও সাবধানতা অবলম্বন করেন না । এইজন্য ঐ সকল কথা প্ৰামাণ্য স্বীকার করা যায় না; অর্থাৎ ইহা স্বীকার করা যায় না যে, গ্ৰন্থকারের সিদ্ধান্তপক্ষের সঙ্গে এই বিভিন্ন বিষয়ের কোন বিশেষ সম্বন্ধ আছে । উহা কেবল প্ৰশংসাবাদ অর্থাৎ শূন্যগর্ভ, আগন্তুক বা স্তুতিবাচক, এইভাবে গ্ৰহণ করিয়া মীমাংসকগণ উহাকে ‘অর্থবাদ’ এই নাম দিয়া থাকেন, এবং এই অর্থবাদাত্মক কথাগুলি ছাড়িয়া দিয়া পরে গ্রন্থের তাৎপৰ্য নির্ধারণ করিয়া থাকেন ।
(vii) ইহার পর, উপপত্তির প্রতি মন দিতে হইবে । কোন বিশিষ্ট বিষয়কে সিদ্ধরূপে দেখাইবার জন্য তৰ্কশাস্ত্ৰানুসারে বাধক প্রমাণের খণ্ডন করা এবং সাধক প্রমাণের অনুকুল বিন্যাস করাকে ‘উপপত্তি’ বা ‘উপপাদন’ বলে । উপক্রম ও উপসংহাররূপ দুই সীমান্ত প্ৰথমে দৃঢ়প্ৰতিষ্ঠিত হইলে পর, মধ্য পথটা অর্থবাদ ও উপপত্তির সহায়তায় সুনিশ্চিত করিতে পারা যায় । কোন্ বিষয়টি অপ্ৰস্তুত ও আনুষঙ্গিক (অপ্রধান) ইহা অর্থবাদের সাহায্যে বুঝা যায় । অর্থবাদের একবার নির্ণয় হইলে পর, যে ব্যক্তি গ্রন্থতাৎপর্য নির্ণয় করিতে চাহেন তিনি সমস্ত বাঁকা পথ ছাড়িয়া দেন । পাঠক যখন এইরূপে বাঁকা পথ ছাড়িয়া সরল ও প্রধান রাস্তায় আসেন তখন উপপত্তির সরল পথ সাগর-তরঙ্গের ন্যায় পাঠককে কিংবা গ্ৰন্থসমালোচককে প্রথম হইতেই সম্মুখে ক্রমশ ধাক্কা দিতে দিতে শেষের তাৎপর্যে সোজা আনিয়া তবে ছাড়ে । আমাদের প্রাচীন মীমাংসকদিগের স্থিরীকৃত গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ের এই নিয়ম সর্বদেশীয় বিদ্বানদিগের সমান অভিমত হওয়ায় উহার উপযোগীতা ও আবশ্যকতা সম্বন্ধে বেশী বিচার আলোচনার প্রয়োজন নাই । (গ্ৰন্থতাৎপর্যের এই নিয়ম ইংরাজি আদালতেও পালিত হইয়া থাকে । যেমন মনে কর, কোন বিচারনিষ্পত্তির অর্থ ঠিক বুঝা না গেলে, ঐ বিচারনিষ্পত্তির ফল যে হুকুমনামায় আছে তাহা দেখিয়া নিষ্পত্তির অর্থ নিৰ্ণয় করা হয় এবং কোন নিষ্পত্তির অন্তৰ্গত উদ্দেশ্য নির্ণয় করিবার আবশ্যকতা নাই এইরূপ কোন বিধান থাকিলে উহা পরবর্তী মোকদ্দমায় প্রমাণ বলিয়া গণ্য হয় না । এইরূপ বিধানকে (obiter dicta) কিংবা ‘বাহ্য বিধান’ বলে এবং বাস্তবপক্ষে দেখিতে গেলে ইহা অর্থবাদেরই প্ৰকারান্তর মাত্র ।)
এ সম্বন্ধে কেহ এরূপ সন্দেহ করিতে পারৈন যে, মীমাংসকদিগের এই নিয়ম কি সম্প্রদায় প্ৰবর্তক আচার্যদিগের জানা ছিল না ? এবং তাঁহাদের গ্রন্থাদির মধ্যেও যদি এই সকল নিয়ম পাওয়া যায়, তবে তাঁহাদের উপদিষ্ট গীতাতাৎপৰ্য একদেশীয়তা-দোষে দুষ্ট মনে করিবার কারণ কি ? তাহার উত্তর এই যে, কাহারো দৃষ্টি একবার সাম্প্রদায়িক (সঙ্কুচিত) হইয়া পড়িলে আর তিনি ব্যাপকতা স্বীকার করিতে পারেন না । তখন তিনি কোন না কোন প্রকারে ইহা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করেন যে প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে নিজ সম্প্রদায়েরই বর্ণনা আছে । নিজ সম্প্রদায়প্ৰসিদ্ধ ব্যতীত উক্ত গ্রন্থের অন্য কোন অর্থ হইলেও উহা সত্য নহে, তাহাতে কোন-না-কোন স্বতন্ত্ৰ হেতু আছে, এই সকল গ্রন্থের তাৎপৰ্যসম্বন্ধে সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের পূর্ব হইতেই এই দৃঢ় ধারণা হইয়া থাকে । নিজ মতানুযায়ী যে অর্থ পূর্বেই সত্য বলিয়া তাঁহারা স্থির করিয়াছেন তাহাই সর্বত্ৰ প্ৰতিপাদিত আছে এইরূপ দেখাইতে গিয়া মীমাংসাশাস্ত্রের কোন নিয়মের বাধা আসিলেও উপরি-উক্ত দৃঢ় ধারণার দরুণ টীকাকারের ঐ সকল নিয়মের কোন গুরুত্ব আছে বলিয়া মনে করেন না । হিন্দু ধর্ম-শাস্ত্রান্তৰ্গত মিতাক্ষরা, দায়ভাগ প্রভৃতি গ্রন্থোক্ত স্মৃতি-বচনসমূহের ব্যবস্থা বা একবাক্যতা এই তত্ত্বানুসারে করা হয় । কিন্তু কেবল হিন্দুধর্মগ্রন্থাদিতেই যে এই প্রকার পাওয়া যায় তাহা নহে । খৃষ্টীয় ও মহম্মদীয় ধর্মের আদিগ্রন্থ বাইবেল ও কোরাণেরও পরবর্তীকালে আবির্ভূত শতশত সাম্প্রদায়িক গ্ৰন্থকারগণ এইরূপেই উহাদের অর্থান্তর ঘটাইয়াছেন এবং এই বাইবেলের পুরাতন অঙ্গীকারের অন্তর্গত কতকগুলি বাক্যের অর্থ ইহুদি লোকদিগের অর্থ হইতে খৃষ্টভক্তিরা ভিন্নরূপে নির্ধারিত করিয়াছেন । এ পর্যন্ত দেখা যাইতেছে যে, কোন বিষয় সম্বন্ধে প্ৰামাণিক গ্ৰন্থ কিম্বা লেখা কোন্টি, ইহা যে যে স্থলে পূর্ব হইতেই স্থিরনির্দিষ্ট হইয়াছে এবং যেখানে এই নির্দিষ্ট প্রামাণিক গ্রন্থের প্রমাণ-বলে পরবস্ত্রী সমস্ত বিষয়ের নির্ণয় করা হইয়া থাকে, সেই সেই স্থলে গ্রন্থার্থনির্ণয়ের উপরোক্ত পদ্ধতিই স্বীকৃত হইয়া থাকে দেখিতে পাওয়া যায় । এখনকার বড় বড় আইন-পণ্ডিত, উকীল ও বিচারপতি, ইহাঁরা পূর্বেকার প্রামাণিক আইন-গ্ৰন্থাদিকে কিংবা বিচার নিষ্পত্তির সম্বন্ধে আপনি আপনি দিকে যেরূপভাবে টানিয়া থাকেন, তাহারও মধ্যে এই রহস্য নিহিত আছে । যদি শুধু লৌকিক বিষয়ের সম্বন্ধেই এই অবস্থা হয়, তবে আমাদের ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ, বেদান্তসূত্র এবং তাহারই সমান প্ৰস্থানত্রয়ীর অন্তৰ্গত তৃতীয় গ্ৰন্থ ভগবদ্গীতা সম্বন্ধেও যে এই প্রকার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখিবার কারণে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেক ভাষ্য ও টীকা হইয়াছে ইহাতে বিস্মিত হইবার কোন কারণ নাই ।
কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক পদ্ধতি ছাড়িয়া উপযুক্ত মীমাংসকদিগের পদ্ধতি অনুসারে ভগবদ্গীতার উপক্রম, উপসংহারাদির দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, ভারতীয় যুদ্ধ প্ৰত্যক্ষ আরম্ভ হইবার পূর্বে যখন কুরুক্ষেত্রে দুই পক্ষের সৈন্য যুদ্ধে সজ্জিত হইয়া পরস্পরের উপর শস্ত্ৰসম্পাতে উদ্যত, এবং সেই অবসরে একাদিক্ৰমে অর্জুন ব্ৰহ্মজ্ঞানের বড় বড় কথা বিবৃত করিয়া ‘বিমনস্ক’ হইয়া সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য প্ৰস্তুত হইয়াছিলেন, তখনই অর্জুনকে স্বীয় ক্ষত্রিয়ধর্মে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্য, ভগবান গীতার উপদেশ করিয়াছেন । যখন অর্জুন দেখিতে লাগিলেন যে দুষ্ট দুর্যোধনের সহায় হইয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য কে কে আসিয়াছে, তখন বৃদ্ধপিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য ও গুরুপুত্ৰ অশ্বথামা, প্ৰতিপক্ষ হইলেও আত্মীয় কৌরব এবং অন্যান্য সুহৃদ, আত্মজন, মামা, কাকা, ভগ্নীপতি, শ্যালক, রাজা, রাজপুত্র প্রভৃতি তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল । কেবল এক ক্ষুদ্র হস্তিনাপুরের রাজ্যলাভার্থ ইহাঁদিগকে বধ করিয়া নিজ কুলক্ষয়াদি মহাপাপ করিতে হইবে এই বিচার তাহার মনে উদিত হওয়ায় তাহার হৃদয় একেবারে ক্ষুব্ধ হইল । একদিকে ক্ষাত্ৰধর্ম “যুদ্ধ কর” বলিতেছিল, এবং অন্যদিকে পিতৃভক্তি, গুরুভক্তি, বন্ধুপ্ৰেম, সুহৃৎপ্রীতি তাঁহাকে পিছনে টানিতেছিল । যদি যুদ্ধ করি তাহা হইলে পিতামহ গুরু ও আত্মীয়দিগকে হত্যা করিয়া ঘোর পাতকে পতিত হইতে হইবে, আর যদি না করি তবে ক্ষাত্ৰধর্মকে লঙ্ঘন করা হইবে । এইরূপ একদিকে গর্ত আর একদিকে কূপ দেখা দিলে পর, দুই ম্যাড়ার গুঁতার মধ্যে পড়িয়া কোন নিরূপায় প্রাণীর যে অবস্থা হয়, অর্জুনের সেই অবস্থা হইয়াছিল । অর্জুন খুব বড় যোদ্ধা ছিলেন সত্য; কিন্তু ধর্মাধর্মের সেই নৈতিক সঙ্কটে অকস্মাৎ পতিত হওয়ায় তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল, গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল, হাতের ধনু খসিয়া পড়িল । এবং “আমি যুদ্ধ করিব না” বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তিনি রথে আড়ষ্ট হইয়া রহিলেন । শেষে মানুষ্যের যাহা স্বভাবতই বেশী প্রিয়, সেই মমতা অর্থাৎ নিকটবর্তী বন্ধুস্নেহ, দূরবর্তী ক্ষাত্রধর্মের স্থান অধিকার করায়, মোহবশে তিনি এইরূপ বলিতে লাগিলেন যে, “পিতৃবধ, গুরুবধ, বন্ধু্বধ, সুহৃবধ, অধিক কি সমগ্ৰ কুলক্ষয় প্রভৃতি ঘোরতর পাপ করিয়া রাজ্যলাভাপেক্ষা উদরপুর্তির জন্য ভিক্ষা করা কি মন্দ ? শত্রু এ সময় আমাকে নিরস্ত্ৰ দেখিয়া আমার গলা কাটিয়া ফেলে, সেও ভাল; কিন্তু যুদ্ধে আত্মীয়দিগের বধসাধন করিয়া তাঁহাদের রক্তে কলঙ্কিত ও অভিশাপগ্ৰস্ত হইয়া আমি সুখভোগ ইচ্ছা করি না ! ক্ষাত্ৰধর্ম হইল তা কি হইল ? তার জন্য পিতৃবধ, বন্ধুবধ ও গুরুবধরূপ ভয়ঙ্কর পাতক যদি করিতে হয় তবে পুড়ে যাক সে ক্ষাত্ৰধর্ম, আগুন লাগুক সেই ক্ষাত্ৰনীতির মুখে ! প্ৰতিপক্ষ এ বিষয়ে ভ্ৰক্ষেপ না করিলেও, তাহারা দুর্জন হইলেও, এইরূপ আচরণ আমার পক্ষে উচিত নহে । আমার আত্মার কিসে প্রকৃত কল্যাণ হয় তাহাই আমার দেখা আবশ্যক । আমার যখন মনে হইতেছে এইরূপ ঘোর পাতক করা শ্ৰেয়স্কর নহে তখন ক্ষাত্ৰধর্ম যতই শাস্ত্রোক্ত ধর্ম হউক না কেন, এই প্রসঙ্গে তাহা আমার কি কাজে আসিবে ?”
এইরূপে তাহার মন চিন্তায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ায়, ধর্মসম্মুঢ় হইয়া অর্থাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হইলে ভগবান গীতা-উপদেশ দিয়া তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিলেন; এবং তৎকালে যুদ্ধ করাই তাঁহার কর্তব্য হওয়ায়, ভীষ্মাদিকে বধ করিতে হইবে এই ভয়ে পরাঙ্মুখ অর্জুনকে শ্ৰীকৃষ্ণ স্বেচ্ছাক্রমে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিলেন । গীতা-উপদেশের রহস্য যদি উদঘাটন করিতে হয় তবে এই তাহার উপক্রম, উপসংহার ও পরিণাম ফল আলোচনা করা আবশ্যক । ভক্তির দ্বারা কিরূপে মোক্ষ লাভ হয়, কিংবা ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা অথবা পাতঞ্জল যোগের দ্বারা কিরূপে তাহা লাভ করা যায়, ইত্যাদি নিবৃত্তিপর মার্গ কিংবা কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাসধর্মসম্বন্ধীয় প্রশ্নসমূহের কেবলমাত্র আলোচনা করিয়া কোন লাভ নাই । অর্জুনকে সন্ন্যাস-দীক্ষা দিয়া বৈরাগ্য অবলম্বনে ভিক্ষা করিবার জন্য বনে পাঠানো কিংবা কৌপীন ধারণ করিয়া ও নিন্বপত্ৰ খাইয়া আমরণ যোগাভ্যাস করিবার জন্য হিমালয়ে প্রেরণ করা শ্ৰীকৃষ্ণের মনোগত অভিপ্ৰায় ছিল না । অথবা ধনুর্বাণের বদলে হাতে করতাল, মৃদঙ্গ ও বীণা লইয়া সেই সকল বাদ্য-সহযোগে ভগবানের নাম কীর্তন করিতে করিতে প্ৰেমানন্দে পূর্ণ হইয়া কুরুক্ষেত্রের ধর্মভূমির উপর, ভারতবর্ষীয় ক্ষাত্রসমাজের সম্মুখে বৃহন্নলার ন্যায় আবার অর্জুনকে নৃত্যে প্ৰবৃত্ত করা ভগবানের উদ্দেশ্য ছিল না । এখন তো অজ্ঞাতবাস সম্পূর্ণ হইয়া গিয়াছে এবং কুরুক্ষেত্রের উপর অর্জুনের অন্যপ্রকার কঠোর নৃত্যের প্রয়োজন ছিল । গীতা বিবৃত করিবার সময় স্থানে স্থানে অনেক প্রকারের অনেক কারণ দেখাইয়া এবং শেষে ‘তস্মাৎ’ অর্থাৎ ‘অতএব’ এই পদ - অনুমানবাচক গৌরবাত্মক পদ ও প্রয়োগপূর্বক “তস্মাদ্যুধ্যস্ব ভারত” - হে অর্জুন, অতএব তুমি যুদ্ধ কর [গী|২| ১৮]; “তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ” - অতএব তুমি যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর [গী|২|৩৭] “তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর” - অতএব তুমি আসক্তি ছাড়িয়া নিজ কর্তব্য কর্ম কর [গী|৩|১৮]; “কুরু কৰ্ম্মৈব তস্মাৎ ত্বং” - অতএব তুমি কর্মই কর [গী|৪|১৮]; “মামনুস্মর যুধ্য চ” - আমাকে স্মরণ কর ও যুদ্ধ কর [গী|৬|৭] “সর্বকর্তা ও কারয়িতা আমি, তুমি নিমিত্তমাত্র, অতএব যুদ্ধ কর ও শক্রকে জয় কর” [গী|১১|৩৩] “শাস্ত্রোক্ত কর্তব্য করা তোমার উচিত” [গী|১৬|১৪] - এইরূপ অর্জুনকে নিশ্চিতাৰ্থক কর্মপর উপদেশ করিয়া, অষ্টাদশতম অধ্যায়ের উপসংহারে পুনৰ্বার “এই সমস্ত কর্ম করা উচিত” [গী|১৮|৬] এইরূপ নিজের নিশ্চিত ও উত্তম মত ভগবান বিবৃত করিয়াছেন । এবং পরিশেষে, “অর্জুন ! তোমার অজ্ঞানমোহ এখন নষ্ট হইল কি না” ? [গী|১৮|৭২] এই প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে এই সন্তোষজনক উত্তর দিলেন -
তাৎপৰ্য এই যে, প্ৰবৃত্তিধর্মেরই জ্ঞান গীতার মূল বিষয় এবং অন্যান্য কথা তৎসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কথিত ও আনুষঙ্গিক; সুতরাং গীতাধর্মের মে রহস্য তাহাও প্ৰবৃত্তিপর অর্থাৎ কর্মপরই হইবে, ইহাত স্পষ্টই রহিয়াছে । কিন্তু এই প্ৰবৃত্তিপর রহস্যটি কি এবং তাহা বেদান্তশাস্ত্ৰ হইতে কিরূপে নিষ্পন্ন হয়, কোন টীকাকারই তাহার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেন নাই । গীতার আদ্যন্ত উপক্রম ও উপসংহারের দিকে ঠিক লক্ষ্য না করিয়া, গীতার ব্ৰহ্মজ্ঞান বা ভক্তি নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কিরূপে অনুকূল হয়, নিবৃত্তিদৃষ্টিতে তাহাতেই টীকাকারগণ নিমগ্ন হইয়া গিয়াছেন দেখা যায় । যেন কর্মের সহিত জ্ঞান ও ভক্তির নিত্য-সম্বন্ধ স্থাপন করা একটা মহাপাপ ! আমি যে আশঙ্কার কথা বলিতেছি সেইরূপ আশঙ্কা এক জনের হওয়ায় তিনি আমাকে লিখিয়াছেন যে শ্ৰীকৃষ্ণের চরিত্র চক্ষের সম্মুখে রাখিয়া ভগব্দগীতার অর্থ করা উচিত । শ্ৰীক্ষেত্ৰ কাশীর সম্প্রতি সমাধিস্থ প্ৰসিদ্ধ অদ্বৈতী পরমহংস শ্ৰীকৃষ্ণানন্দ স্বামী, ‘গীতা-পরামর্শ’ নামে ভগবদ্গীতার সম্বন্ধে যে এক ক্ষুদ্র সংস্কৃত নিবন্ধ লিখিয়াছেন তাহাতে “তস্মাৎ গীতা নাম ব্ৰহ্মবিদ্যামূলং নীতিশাস্ত্ৰম্” - গীতা এই কারণে ব্ৰহ্মবিদ্যামূলক কর্তব্যধর্মশাস্ত্র এইরূপ স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । (শ্রীকৃষ্ণানন্দ স্বামীর শ্রীগীতা-রহস্য, গীতার্থ-প্রকাশ, গীতাপরামর্শ এবং গীতাসারদ্ধার এইরূপ এই বিষয়ে চারি ক্ষুদ্র নিবন্ধ আছে । সেগুলি সমস্তু একত্র করিয়া, রাজকোট ছাপান হইয়াছে । উপরিপ্রদত্ত বাক্য তাঁহার গীতাৰ্থপ্রকাশে আছে । এই টীকাকারের নাম এবং তাঁহার টীকা হইতে উদ্ধৃত কিয়দংশ বহু বৎসর পূর্বে একটি ভদ্রলোক আমাকে জানাইয়াছিলেন । কিন্তু ঐ পত্র আমার গোলযোগের সময় কোথায় যে গেল তাহা আর খুঁজিয়া পাইলাম না । এবং ঐ পত্র যদি কখন ঐ ভদ্রলোকটির চোখে পড়ে তাহা হইলে উক্ত বিষয়টি সম্বন্ধে তিনি যেন আমাকে আবার জানান তাঁহার নিকট আমার এই মিনতি ।)
জর্মন পণ্ডিত অধ্যাপক ডায়সন্ও স্বকীয় “উপনিষদের তত্ত্বজ্ঞান” গ্রন্থের এক স্থানে এইরূপ কথা বলিয়াছেন । আরো কতকগুলি পাশ্চাত্য ও প্ৰাচ্য গীতাসমালোচকও এই মত প্ৰকাশ করিয়াছেন । তথাপি তাঁহাদের মধ্যে কেহই সমগ্ৰ গীতাগ্রন্থের পর্যালোচনা করিয়া কর্মপর দৃষ্টিতে তদন্তর্ভূত সমস্ত বিষয় ও অধ্যায়ের যোগাযোগ কিরূপ তাহা স্পষ্ট করিয়া দেখাইবার প্রযত্ন করেন নাই; অধিকন্তু এই প্ৰতিপাদন কষ্টসাধ্য, এইরূপ ডায়সন স্বকীয় গ্রন্থে বলিয়াছেন । (Prof Deussen’s Philosophy of the Upanishads (p.362) English Translation-1906).
এই জন্য উক্ত প্ৰণালী অবলম্বনে গীতা পর্যালোচনা করিয়া উহার বিষয়সমূহের সঙ্গতি প্ৰদৰ্শন করা এই গ্রন্থের মুখ্য উদ্দেশ্য । কিন্তু তাহা করিবার পূর্বে, গীতার প্রারম্ভে পরস্পরবিরূদ্ধ নীতিধর্ম সমূহের কঠিন সমস্যা দেখিয়া অর্জুন যে সঙ্কটে পড়িয়াছিলেন, তাহার স্বরূপ আরো বেশী খোলসা করিয়া ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । নচেৎ গীতান্তর্গত বিষয়ের মর্ম ভাল করিয়া পাঠকের ধারণায় আসিবে না । অতএব, এই কর্ম অকর্মের বিচারসঙ্কট কিরূপে বিকট হয় এবং অনেক প্রসঙ্গে, “ইহা করি কি উহা করি” এইরূপ সংশয়-গোলযোগের মধ্যে পড়িয়া মানুষ কিরূপ হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে ঠিক্ বুঝিবার জন্য, এই প্রসঙ্গের অনেক উদাহরণ যাহা শাস্ত্ৰে, বিশেষতঃ মহাভারতে, পাওয়া যায়, এক্ষণে তাহারই বিচারে প্রবৃত্ত হইব ।
দেবীং সরস্বতীং ব্যাসং ততো জয় মুদীরয়েৎ ॥ [মহাভারত, প্ৰথম শ্লোক]
(“নারায়ণকে, নরের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁহাকে, সরস্বতীদেবীকে, এবং ব্যাসকে নমস্কার করিয়া তাহার পর ‘জয়ী’ অর্থাৎ মহাভারত বলিতে শুরু করিবে” ইহাই এই শ্লোকের অর্থ । মহাভারতে নর ও নারায়ণ এই দুই ঋষি দুই স্বরূপে দ্বিধাভূত সাক্ষাৎ পরমাত্মাই; এবং ইঁহারাই দুইজনে পরে অর্জুন ও শ্ৰীকৃষ্ণ এই দুই অবতার হইয়াছিলেন, এইরূপ মহাভারতে বর্ণিত আছে [মভা|উ|৪৮|৭-৯ ও ২০-২২; এবং বন|১২|৪৪-৪৬] । ইঁহারাই নিষ্কামকর্মপর নারায়ণীয় ও ভাগবতধর্ম সর্বপ্রথমে প্রবর্তিত করার সকল ভাগবতধর্মীয় গ্রন্থের আরম্ভে ইঁহাদিগকেই নমস্কার করা হইয়া থাকে । কোন কোন গ্রন্থে এই শ্লোকে ‘ব্যাস’এর পরিবর্তে ‘চৈব’, এইরূপ পাঠ প্রদত্ত হইয়া থাকে; কিন্তু ওরূপ করা আমার যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না । কারণ, ভাগবতধর্মের প্রচারক নরনারায়ণ ঋষিদ্বয়ের ন্যায় এই ধর্মের দুই মুখ্য গ্ৰন্থ ভারত ও গীতা যিনি লিখিয়াছেন, সেই ব্যাসও আমার মতে নমস্য । মহাভারতের প্রাচীন নাম ‘জয়’ [মভা|আ|৬২|২০])
সূচীপত্র
1) ভূমিকা
2) অন্যান্য গীতা
3) গ্রন্থের দুই প্রকার পর্যালোচনা
4) মহাভারতকারের মতে গীতার তাৎপৰ্য
5) গ্রন্থ তাৎপৰ্য নির্ণয়ে সাম্প্রদায়িক পন্থা
5.1) শ্ৰীশঙ্করাচার্যের ভাষ্য (অদ্বৈতবাদ)6) গ্রন্থ তাৎপৰ্য নির্ণয়ে মীমাংসিকদিগের পন্থা
5.2) শ্রীরামানুজাচার্যের ভাষ্য (বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ)
5.3) শ্ৰীমধ্বাচাৰ্যের ভাষ্য (দ্বৈতবাদ)
5.4) শ্ৰীবল্লভাচার্যের ভাষ্য (শুদ্ধাদ্বৈতবাদ/পুষ্টিমাৰ্গ)
5.5) শ্রীনিম্বার্কের ভাষ্য (দ্বৈতাদ্বৈতীবাদ)
5.6) মহারাষ্ট্র দেশীয় মত - “জ্ঞানেশ্বরী”
5.7) গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি বর্জনীয়
6.1) সম্প্রদায় প্ৰবর্তকদের সঙ্কুচিত দৃষ্টি7) উপসংহার - প্ৰবৃত্তিধর্মের জ্ঞানই গীতার মূল বিষয়
6.2) মীমাংসকদিগের পদ্ধতি অনুসারে ভগবদ্গীতার তাৎপৰ্য নির্ণয়
1) ভূমিকা
শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতা আমাদের ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে একটি অতীব ভাস্বর ও নির্মল হীরকখণ্ড । জড়ব্ৰহ্মাণ্ডজ্ঞানের সহিত আত্মবিদ্যার গূঢ় ও পবিত্ৰ তত্ত্ব সংক্ষেপে এবং অসংদিগ্ধরূপে বিবৃত করে, সেই সকল তত্ত্বের উপর মনুষ্যমাত্রেরই পুরুষাৰ্থ আধ্যাত্মিক পূর্ণাবস্থার পরিচয় করিয়া দেয়, জ্ঞান ও ভক্তিকে মিলাইয়া উভয়কে শাস্ত্রসম্মত ব্যবহারের সহিত সংযুক্ত করে এবং ইহার দ্বারা সংসারের দুঃখক্লিষ্ট মনুষকে শান্তি প্ৰদান পূর্বক নিষ্কাম কর্তব্যাচরণে প্ৰবৃত্ত করে, গীতার ন্যায় এরূপ সরল দ্বিতীয় গ্ৰন্থ, শুধু সংস্কৃত সাহিত্যে কেন, জগতের সাহিত্যেও দুর্লভ । কেবল কাব্যের হিসাবে দেখিতে গেলেও ইহাকে উত্তম কাব্যের মধ্যে ধরা যাইতে পারে । কারণ, ইহাতে আত্মজ্ঞানের অনেক গহন সিদ্ধান্ত আবালবৃদ্ধের নিকট বোধগম্য বিশদ সহজ ভাষায় ব্যক্ত হইয়াছে, এবং ইহা জ্ঞানসমন্বিত ভক্তিরসে পূর্ণ । যে গ্রন্থে শ্ৰীভগবানের বাণী হইতে সকল বৈদিক ধর্মের সার গৃহীত হইয়াছে তাহার যোগ্যতা সম্বন্ধে আর কি বৰ্ণনা করিব ? ভারতীয় যুদ্ধ সমাপ্ত হইলে পর একদিন শ্ৰীকৃষ্ণ ও অর্জুন যখন প্রীতিভরে কথাবার্তা কহিতেছিলেন সেই সময় শ্ৰীকৃষ্ণের মুখে অর্জুনের পুনরায় গীতা শুনিবার ইচ্ছা হইয়াছিল । অর্জুন তৎক্ষণাৎ বিনয়পূর্বক এইরূপ অনুরোধ করিলেন যে “ভগবন, যুদ্ধারম্ভে তুমি যে উপদেশ দিয়াছিলে তাহা আমি বিস্মৃত হইয়াছি, তুমি কৃপা করিয়া আমাকে আর একবার তাহা বল ।” তখন ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে এই উত্তর দিলেন যে, “সে সময়ে আমি অত্যন্ত যোগযুক্ত চিত্তে উপদেশ করিয়াছিলাম, কিন্তু এখন পুনর্বার ঐ প্রকার উপদেশ দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ।” অনুগীতার আরম্ভে বলা হইয়াছে [সভা|অশ্বমেধ|অ ১৬|শ্লো ৭০-৭৩] । বাস্তবিক দেখিতে গেলে, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নহে; কিন্তু তাহার উপরোক্ত উক্তি হইতে গীতার মাহাত্ম্য কত অধিক তাহাই সুন্দররূপে ব্যক্ত হইতেছে । বৈদিক ধর্মের অন্তর্ভূত ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট এই গ্ৰন্থ আজ প্ৰায় আড়াই হাজার বৎসর সকলের নিকটেই বেদের ন্যায় সমানরূপে মান্য ও প্রামাণ্য হইয়া আসিতেছে । এই গ্রন্থের মহত্ত্বই ইহার মূল কারণ । এই কারণে —
সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ ৷অর্থাৎ সমস্ত উপনিষদ গাভীস্বরূপ, গোপালনন্দন স্বয়ং দোগ্ধাস্বরূপ, সুধী পার্থ অর্জুন ভোক্তা বৎসস্বরূপ এবং মহৎ গীতামৃত দুগ্ধস্বরূপ - গীতাধ্যানে এই স্মৃতিকালীন গ্রন্থের এইরূপ অলঙ্কারযুক্ত বর্ণনা হইলেও যথাৰ্থ বৰ্ণনা করা হইয়াছে । হিন্দুস্থানের সমস্ত প্রাকৃত ভাষায় যে ইহার অনেক ভাষান্তর, টীকা অথবা ব্যাখ্যা হইয়াছে, তাহা কিছুই আশ্চৰ্য নহে । কিন্তু পাশ্চাত্যদেশে সংস্কৃতের পরিচয় হইবার পর অবধি গ্রীক, ল্যাটিন, জর্মণ, ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি প্রভূতি যুরোপীয় ভাষাতেও গীতার নানা ভাষান্তর হওয়াতে আজ সমস্ত জগতময় এই অপ্ৰতিম গ্রন্থের প্রসিদ্ধি হইয়াছে ।
পার্থো বৎসঃ সুধীর্ভোক্তা দুগ্ধং গীতামৃতং মহৎ ॥
সমস্ত উপনিষদের সার এই গ্রন্থে আছে শুধু তাহা নহে, ইহার পুরা নামও — “শ্ৰীমদভগবদ্গীতা-উপনিষৎ” । গীতার প্রত্যেক অধ্যায়ের শেষে অধ্যায়সমাপ্তিজ্ঞাপক যে সঙ্কল্প আছে তাহাতে “ইতি শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্ৰহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্ৰে শ্ৰীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে” ইত্যাদি শব্দ আছে । এই সংকল্প মূল ভারতে দেওয়া না হইলেও গীতাগ্রন্থের সকল সংস্করণেই উহা দেখিতে পাওয়া যায় । এই হেতু অনুমান হয় যে, নিত্যপাঠের জন্য যে সময় মহাভারত হইতে গীতাকে পৃথক করিয়া বাহির করা হয় তখন হইতে অর্থাৎ গীতার কোনপ্রকার টীকা হইবার পূর্বাবধি উক্ত সংকল্প প্রচলিত হইয়া থাকিবে । এই হিসাবে গীতার তাৎপৰ্যনির্ধারণে উহার প্রয়োজনীয়তা কি, তাহা পরে বলা যাইবে । আপাতত সংকল্পবাক্যের মধ্যে “ভগবদ্গীতাসু” এবং “উপনিষৎসু” এই দুই পদের বিচার করা কর্তব্য । “উপনিষৎ” শব্দ মারাঠীতে ক্লীবলিঙ্গ হইলেও সংস্কৃত ভাষায় স্ত্রীলিঙ্গ; সুতরাং “শ্ৰীভগবান কর্তৃক গীত অর্থাৎ কথিত উপনিষৎ” এই অর্থ প্ৰকাশ করিবার কারণে সংস্কৃতভাষায় “শ্ৰীমদ্ভগবৎগীতা উপনিষৎ” এই দুই বিশেষণবিশেষ্যরূপ স্ত্রীলিঙ্গ শব্দ প্ৰযুক্ত হইয়াছে; এবং গ্ৰন্থ এক হইলেও সম্মানার্থে “শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতাসু উপনিষৎসু” এই বহুবচনান্ত সপ্তমীর প্রয়োগ হইয়াছে । শঙ্করাচার্যের ভাষ্যেও এই গ্রন্থের উদ্দেশ্যেই “ইতি গীতাসু” এইরূপ বহুবচনের প্ৰয়োগ হইয়াছে । কিন্তু নামের সংক্ষেপ করিবার সময় সম্মানার্থক প্ৰত্যয়, পদ, এমন কি শেষের ‘উপনিষৎ’ এই জাতিবাচক সাধারণ শব্দও পরিত্যক্ত হইয়া ‘কেন’, ‘কঠ’, ‘ছান্দ্যোগ্য’ এই প্রকার সংক্ষিপ্ত নামের অনুসরণ করিয়া “শ্ৰীমদ্ভগবদ্গীতা উপনিষৎ” এই দুই একবচনান্ত প্ৰথমা বিভক্তিবিশিষ্ট শব্দের প্রথমে “ভগবদ্গীতা”, পরে কেবল ‘গীতা’ এই স্ত্রীলিঙ্গী অতি সংক্ষিপ্ত নাম প্ৰচলিত হইয়াছে । ‘উপনিষৎ’ এই শব্দ যদি মূল নামে না থাকিত তাহা হইলে ‘ভাগবতম্’, ‘ভারতম্’, ‘গোপীগীতম্’ এই সকল শব্দের ন্যায় এই গ্রন্থেরও নাম ‘ভগবদ্গীতম্’ কিংবা শুধু ‘গীতম্’ এইরূপ ক্লীবলিঙ্গী হইত । তাহা না হইয়া ‘ভগবদ্গীতা’ কিংবা ‘গীতা’ এইরূপ স্ত্রীলিঙ্গী শব্দই আজ পৰ্যন্ত বজায় থাকাতেই তাহার সহিত ‘উপনিষৎ’ এই শব্দ নিত্য অধ্যাহৃত আছে বলিয়া বুঝিতে হইবে । অনুগীতার উপর অর্জুন মিশ্রের টীকাতে ‘অনুগীতা’ এই শব্দের অর্থও এইরূপেই করা হইয়াছে ।
2) অন্যান্য গীতা
কিন্তু ‘গীতা’ এই শব্দ কেবল সপ্তশতশ্লোকী ভগবদ্গীতাতেই প্ৰযুক্ত হয় নাই, উহা আরো অনেক জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থে প্ৰযুক্ত হইয়াছে দেখিতে পাওয়া যায় । তাহার দৃষ্টান্ত, মহাভারতের শান্তিপর্বের অন্তর্ভূক্ত মোক্ষপর্বের কোন কোন বিচ্ছিন্ন প্রকরণের ‘পিঙ্গলগীতা’, ‘শম্পাকগীতা’, ‘মঙ্কিগীতা’, ‘বোধ্যগীতা’, ‘বিচখ্যুগীতা’, ‘হারীতগীতা’, ‘বৃত্ৰগীতা’, ‘পরাশরগীতা’ এবং ‘হংসগীতা’ এইরূপ নাম দেওয়া হইয়াছে । অশ্বমেধ পর্বের অনুগীতার এক ভাগ ‘ব্রাহ্মণগীতা’ এই বিশিষ্ট নামে অভিহিত হইয়াছে । ইহা ব্যতীত ‘অবধূতগীতা’, ‘অষ্টাবক্ৰগীতা’, ‘ঈশ্বরগীতা’, ‘উত্তরগীতা’, ‘কপিলগীতা’, ‘গণেশগীতা’, ‘দেবীগীতা’, ‘পাণ্ডবগীতা’, ‘ব্রহ্মগীতা’, ‘ভিক্ষুগীতা’, ‘যমগীতা’, ‘রামগীতা’, ‘ব্যাসগীতা’, ‘শিবগীতা’, ‘সূতগীতা’, ‘সুর্যগীতা’ প্রভৃতি আরো অনেক গীতা প্ৰসিদ্ধ আছে । ইহার মধ্যে কতকগুলি স্বতন্ত্র প্ৰণালীতে রচিত হইয়াছে, অবশিষ্টগুলি বিভিন্ন পুরাণ হইতে, গৃহীত হইয়াছে । উদাহরণ যথা – গণেশগীতা গণেশপুরাণের শেষে ক্রীড়া খণ্ডের ১৩৮ হইতে ১৪৮ অধ্যায় পর্যন্ত কথিত হইয়াছে । এই গণেশগীতা অল্পাধিক পরিবর্তন সহকারে ভগবদ্গীতারই অবিকল নকল, এরূপ বলিলে কোন ক্ষতি নাই । ‘ঈশ্বরগীতা’ কুর্মপুরাণের উত্তরভাগের প্রথম এগার অধ্যায়ে সন্নিবেশিত হইয়াছে । পরবর্তী অধ্যায়ে ‘ব্যাসগীতার’ আরম্ভ হইয়াছে । এবং স্কন্দপুরাণান্তৰ্গত সূতসংহিতার চতুর্থ অর্থাৎ যজ্ঞবৈভব খণ্ডের উপরিভাগের প্রারম্ভে (১ হইতে ১২ অধ্যায় পৰ্যন্ত) ‘ব্রহ্মগীতা’ এবং ব্ৰহ্মগীতার পরবর্তী আঠ অধ্যায়ে ‘সূতগীতা’ আছে । স্কন্দপুরাণের এই ব্ৰহ্মগীতা হইতে স্বতন্ত্র আর এক ব্ৰহ্মগীতা, যোগবাশিষ্ঠের নির্বাণপ্রকরণের উত্তরার্ধে (১৭৩ হইতে ১৮১ সৰ্গ পৰ্যন্ত) প্রদত্ত হইয়াছে । ‘যমগীতা’ তিন প্রকারের - প্রথমটি বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয় অংশের ৭ম অধ্যায়ে, দ্বিতীয়টি অগ্নিপুরাণের তৃতীয় খণ্ডের ৩৮১ অধ্যায়ে, এবং তৃতীয়টি নৃসিংহপুরাণের অষ্টম অধ্যায়ে প্রকাশিত হইয়াছে । ‘রামগীতার’ কথাও এইরূপ । এখানে মহারাষ্ট্রদেশে যে রামগীতা প্ৰচলিত আছে তাহা অধাত্মরামায়ণের উত্তর কাণ্ডের পঞ্চমসর্গে দেখিতে পাওয়া যায় । এই অধ্যাত্মরামায়ণ ব্ৰহ্মাণ্ডপুরাণের একভাগ বলিয়া স্বীকৃত হইয়া থাকে । কিন্তু ইহা ব্যতীত আর এক রামগীতা মাদ্রাস অঞ্চলে প্ৰসিদ্ধ ‘গুরুজ্ঞানবাসিষ্ঠতত্ত্বসারায়ণ’ নামক গ্রন্থের মধ্যে সন্নিবিষ্ট হইয়াছে । এই গ্ৰন্থ বেদান্ত-মূলক গ্ৰন্থ । ইহাতে জ্ঞান, উপাসনা ও কর্ম এইতিনটী কাণ্ড আছে । তন্মধ্যে উপাসনাকাণ্ডের দ্বিতীয় পাদের প্রথম ১৮ অধ্যায়ে রামগীতা এবং কর্মকাণ্ডের তৃতীয় পাদের প্রথম পাঁচ অধ্যায়ে ‘সূৰ্যগীতা’ বিবৃত হইয়াছে। কথিত আছে যে, ‘শিবগীতা’ পদ্মপুরাণের পাতালখণ্ডে আছে । কিন্তু এই পুরাণের পুনাস্থিত আনন্দাশ্রমে যে সংস্করণ ছাপা হইয়াছে তাহার মধ্যে শিবগীতা পাওয়া যায় না । গৌড়ীয় পদ্মোত্তর পুরাণে উহা পাওয়া যায় । এই কথা পণ্ডিত জ্বালাপ্ৰসাদ স্বরচিত “অষ্টাদশপুবাণদৰ্শন” নামক গ্রন্থে লিখিয়াছেন । নারদপুরাণে, অন্য পুরাণের সঙ্গে সঙ্গে পদ্মাপুরাণেরও যে বিষয়ানুক্ৰমণিকা প্রদত্ত হইয়াছে তাহার মধ্যে শিবগীতার উল্লেখ আছে । শ্ৰীমদ্ভাগবত-পুরাণের ১১শ স্কন্ধের ১৩শ অধ্যায়ে হংসগীতা এবং ২৩শ অধ্যায়ে ভিক্ষুগীতা বিবৃত হইয়াছে । তৃতীয় স্কন্ধের কপিলোপাখ্যানের (২৩-৩৩) “কপিলগীতা” এই নামও কেহ কেহ দিয়া থাকেন । কিন্তু কপিলগীতা বলিয়া এক স্বতন্ত্র মুদ্রিত গ্ৰন্থও আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়াছে । এই কপিলগীতায় হঠযোগের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণিত হইয়াছে এবং উহা পদ্মপুরাণ হইতে গৃহীত ইহাও উল্লিখিত হইয়াছে । কিন্তু পদ্মপুরাণে এই গীতা পাওয়াই যায় নাই । ইহার এক স্থলে (৪.৭) জৈন, জঙ্গম (লিঙ্গায়ৎ) এবং সুফী (মুসলমান সাধু), ইহাদেরও উল্লেখ থাকায় এই গীতা মুসলমানী আমলের হইবে, এইরূপ বলিতে হয় । ভাগবত পুরাণের ন্যায় দেবীভাগবতেও সপ্তম স্কন্ধের ৩১ হইতে ৪০ অধ্যায় পৰ্যন্ত এক গীতা আছে, দেবী কর্তৃক কথিত বলিয়া তাহার নাম দেবীগীতা হইয়াছে । ইহা ব্যতীত, স্বয়ং ভগবদ্গীতার সার অগ্নিপুরাণের তৃতীয় খণ্ডের ৩৮০ অধ্যায়ে এবং গরুড় পুরাণের পূর্বখণ্ডের ২৪২ অধ্যায়ে প্রদত্ত হইয়াছে । সেইরূপ আবার, বসিষ্ঠ রামচন্দ্ৰকে যে উপদেশ দিয়াছিলেন তাহাই যোগবাসিষ্ঠ নামে প্ৰসিদ্ধ । পরন্তু এই গ্রন্থের শেষ (অৰ্থাৎ নির্বাণ) প্ৰকরণে অর্জুনোপাখ্যানও প্রদত্ত হইয়াছে । ইহাতে ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ কর্তৃক অর্জুনের নিকট কথিত ভগবদ্গীতার সার, এমন কি, ভগবদ্গীতার অনেক শ্লোক যেমনটি তেমনিই বজায় রাখিয়া গ্রথিত করা হইয়াছে (যোগ, ৬ পূ: ৫২-৫৮ দেখ) । উপরে বলিয়াছি যে, পুনায় মুদ্রিত পদ্মপুরাণে শিবগীতা পাওয়া যায় না; কিন্তু শিবগীতা না পাওয়া গেলেও এই সংস্করণের উত্তর খণ্ডের ১৭১ হইতে ১৮৮ অধ্যায় পর্যন্ত ভগবদ্গীতামাহাত্ম্য বর্ণিত হইয়াছে, -ভগবদ্গীতার প্রত্যেক অধ্যায় ধরিয়া এই মাহাত্ম্যের এক এক অধ্যায় রচিত হইয়াছে, এবং উহাতে এই সম্বন্ধীয় কথাও বিবৃত হইয়াছে । ইহা ব্যতীত, বরাহপুরাণে এক গীতামাহাত্ম্য আছে । শিবপুরাণে এবং বায়ুপুরাণেও গীতামাহাত্ম্য আছে বলিয়া কথিত হয় । কিন্তু কলিকাতায় মুদ্রিত বায়ুপুরাণে আমি তাহা পাই নাই । ভগবদ্গীতার মুদ্রিত সংস্করণের আরম্ভে ‘গীতাধ্যান” নামক এক নূতন শ্লোকপ্রকরণ প্রদত্ত হইয়াছে । ইহা কোথা হইতে গৃহীত হইয়াছে তাহা জানা যায় না । কিন্তু ইহার “ভীষ্মদ্রোণতটা জয়দ্ৰথজলা” এই শ্লোক অল্প শব্দভেদে সম্প্রতি প্ৰকাশিত ভাস কবির “উরুভঙ্গ” নামক নাটকের আরম্ভেই প্ৰদত্ত হইয়াছে । ইহা হইতে অনুমান হয় যে এই ধ্যান ভাসকবির সময়ের পরে প্রচারিত হইয়া থাকিবে । কারণ, ভাসের ন্যায় প্ৰসিদ্ধ কবি এই শ্লোক গীতাধ্যান হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন এইরূপ স্বীকার করা অপেক্ষা, গীতাধ্যানই স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র স্থান হইতে শ্লোক সংগ্ৰহ করিয়া ও কতকগুলি নূতন শ্লোক রচনা করিয়া রচিত হইয়াছে, ইহা বলাই অধিক যুক্তিসঙ্গত । ভাস কবি কালিদাসের পূর্ববর্তী হওয়ায় তাঁহার কাল অন্তত তিনশত শকের (৪৩৫ সংবৎ) অধিক অৰ্বাচীন হইতে পারে না । (উপরি উক্ত অনেক গীতা এবং ভগবদ্গীতা শ্ৰীযুক্ত হরি রঘুনাথ ভাগবত সম্প্রতি পুনা হইতে বাহির করিতেছেন ।)
ভগবদ্গীতার কোন কোন অনুবাদ ও কতগুলি অনুবাদ, এবং অল্পাধিক পরিবর্তন সহকারে গৃহীত নকল, তাৎপৰ্য কিংবা মাহাত্ম্য পুরাণাদি গ্রন্থে পাওয়া যায়, তাহা পূর্বোক্ত বিবরণ হইতে উপলব্ধ হইবে । ‘অবধূত’, ‘অষ্টাবক্ৰ’ প্রভৃতি দুই চারিটী গীতা স্বতন্ত্রভাবে কাহা কর্তৃক রচিত হয় অথবা কবে কোন পুরাণ হইতে গৃহীত হইয়াছে, তাহার ঠিকানা পাওয়া যায় না । তথাপি এই সমস্ত গীতার রচনা এবং তদন্তৰ্গত বিষয়-বিবেচন দেখিলে অনুমান হয় যে, এই সকল গ্ৰন্থ, ভগবদ্গীতা প্ৰকাশিত হইয়া লোকমান্য হইবার পর রচিত হইয়া থাকিবে । এই সকল গীতা সম্বন্ধে ইহা বলিলেও কোনই ক্ষতি নাই যে, ভগবদ্গীতার ন্যায় দুই একটা গীতা কোন বিশিষ্ট পন্থায় বা পুরাণে না থাকিলে সেই পন্থা বা পুরাণের পূর্ণতা হয় না এই ধারণাতেই সেই গীতাগুলি রচিত হইয়াছে । ভগবদ্গীতায় যেরূপ ভগবান অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখাইয়া জ্ঞানের উপদেশ দিয়াছেন, শিব-গীতা, দেবী-গীতা, গণেশ-গীতাতেও সেই প্ৰকার বর্ণনা আছে । শিবগীতা ঈশ্বরগীতা প্ৰভৃতির মধ্যে ভগবদ্গীতার অনেক শ্লোকই অক্ষরশঃ প্রদত্ত হইয়াছে । জ্ঞানদৃষ্টিতে দেখিলে, এই সকল গীতায় ভগবদ্গীতা হইতে কোন বিশেষত্ব দৃষ্ট হয় না; বরঞ্চ, অধ্যাত্মজ্ঞান ও কর্মের মধ্যে মিলন সাধনে ভগবদ্গীতায় যে একটা অপূর্ব নৈপুণ্য দেখা যায়, সেরূপ নৈপুণ্য আর কোন গীতায় দেখিতে পাওয়া যায় না । ভগবদ্গীতায় পাতঞ্জল-যোগ বা হঠযোগ এবং কর্মত্যাগীরূপ সন্ন্যাসের, যথোচিত বৰ্ণন না দেখিয়া উহার পূর্ণতাসাধনের হিসাবে কৃষ্ণার্জুনের কথোপকথনচ্ছলে কোন ব্যক্তি পরে উত্তরগীতা রচনা করিয়াছেন । ‘অবধূত’, ‘অষ্টাবক্ৰ’ প্ৰভৃতি গীতা নিছক একদেশীয় - সেগুলিতে কেবল সন্ন্যাসমাৰ্গই প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । যমগীতা, পাণ্ডবগীতা কেবল ভক্তিবিষয়ক সংক্ষিপ্ত স্তোত্ৰমাত্র । শিবগীতা, গণেশগীতা এবং সূৰ্যগীতা এ প্রকার নহে । যদিও উহাদের মধ্যে জ্ঞান ও কর্মের সম্মিলন সম্বন্ধে সংযৌক্তিক সমর্থন আছে সত্য, তথাপি উহাদের মধ্যে যাহা প্ৰতিপাদিত হইয়াছে তাহার অনেকাংশ ভগবদ্গীতা হইতে গৃহীত, সুতরাং উহাতে কোন নূতনত্ব আছে বলিয়া মনে হয় না । এই সকল কারণে ভগবদ্গীতার গভীর ও ব্যাপক তেজের সম্মুখে, পরবর্তীকালে রচিত এই সকল পৌরাণিক গীতা দাঁড়াইতে পারে নাই, বরঞ্চ এই সকল নকল গীতার কারণেই ভগবদ্গীতার মাহাত্ম্য অধিকতর ব্যক্ত ও স্থাপিত হইয়াছে । এই কারণেই “গীতা” শব্দের অর্থে “ভগবদ্গীতাই” মুখ্যরূপে প্ৰচলিত হইয়াছে । “অধ্যাত্মরামায়ণ” ও “যোগবাসিষ্ঠ” এই দুই গ্ৰন্থ বিস্তৃত হইলেও উহা যে ভগবদ্গীতার পরবর্তী গ্ৰন্থ তাহা উক্ত গ্ৰন্থদ্বয়ের রচনা হইতেই স্পষ্ট প্ৰকাশ পায় । মাদ্রাজ অঞ্চলের “গুরুজ্ঞানবাসিষ্ঠ-তত্ত্বসারায়ণ” কাহারও কাহারও মতে অতীব প্রাচীন; কিন্তু আমাদের তাহা মনে হয় না । তাহাতে যে ১০৮ উপনিষদের উল্লেখ আছে তাহাদের প্রাচীনতা সিদ্ধ হইতে পারে না । সূৰ্যগীতায় বিশিষ্টাদ্বৈত মতের উল্লেখ পাওয়া যায় [৩|৩০] এবং কোন কোন স্থানের যুক্তিক্রমও যেন ভগবদ্গীতা হইতে গৃহীত বলিয়া মনে হয়” [১|৬৮] । সুতরাং এই গ্ৰন্থও বহু পরবর্তী কালে, এমন কি, শ্ৰীশঙ্করাচার্যেরও পরবর্তী কালে রচিত হইয়া থাকিবে, এইরূপ অনুমান হয় ।
3) গ্রন্থের দুই প্রকার পর্যালোচনা
গীতা অনেকগুলি থাকিলেও ভগবদ্গীতার শ্রেষ্ঠত্ব নির্বিবাদ বলিয়া এইরূপে প্ৰতিপন্ন হওয়ায় উত্তরকালীন বৈদিক পণ্ডিতেরা অন্যান্য গীতার প্রতি বেশী মনোযোগ না দিয়া কেবল ঐ ভগবদ্গীতার পর্যালোচনা করিয়াই তদন্তৰ্গত তাৎপর্য স্বকীয় ধর্মভ্ৰাতাদিগকে বলার সার্থকতা আছে, এইরূপ বিবেচনা করিয়াছিলেন । গ্রন্থের পর্যালোচনা দুই প্রকারে হইতে পারে; এক অন্তরঙ্গ-পর্যালোচনা, আর দ্বিতীয় বহিরঙ্গ-পর্যালোচনা । সমগ্ৰ গ্ৰন্থ দেখিয়া তাহার মর্ম, রহস্য, মথিতাৰ্থ ও প্ৰমেয় প্রভৃতি বাহির করার নাম অন্তরঙ্গ-পর্যালোচনা । গ্ৰন্থ কোথায় রচিত হইয়াছে, কে রচনা করিয়াছে, তাহারা ভাষা কিরূপ - কাব্যদৃষ্টিতে তাহাতে কতটা মাধুৰ্য ও প্রসাদগুণ আছে, গ্রন্থের শব্দ রচনা ব্যাকরণশুদ্ধ অথবা তাহাতে কতকগুলি আর্ষপ্রয়োগ আছে, তাহাতে কোন কোন মতের, স্থলের কিংবা ব্যক্তির উল্লেখ আছে, এই সকল ধরিয়া গ্রন্থের কালনিৰ্ণয় করা যাইতে পারে কি না, অথবা তৎকালীন সামাজিক অবস্থার কোন নির্ণয় হইতে পারে কি না, গ্রন্থান্তৰ্গত বিচার-আলোচনা স্বতন্ত্র বা অন্যের নিকট হইতে গৃহীত, যদি অপরের নিকটে গৃহীত হয় তবে কোথা হইতে কোনটা গৃহীত, এই সকল বাহ্যাঙ্গের বিচার-আলোচনাকেই বহিরঙ্গ-পর্যালোচনা বলে । গীতা সম্বন্ধে যে সকল প্ৰাচীন পণ্ডিতদিগের ভাষ্য, ও টীকা আছে, তাঁহারা বাহ্য বিষয়ের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেন নাই । কারণ, তাঁহাদের মতে ভগবদ্গীতার ন্যায় অলৌকিক গ্রন্থের পর্যালোচনা করিবার সময় ঐ সকল বহিরঙ্গের আলোচনা করা, আর কোন উত্তম পুষ্প পাইয়া তাহার সুগন্ধ, সুন্দর বর্ণ ও সৌন্দর্যে কৌতুহলাক্রান্ত হইবার পরিবর্তে কেবল তাহার পাপড়ী গণনা করা অথবা মধুভরা মৌচাক হস্তে পাইয়া তাহার কতগুলি মধুচ্ছিদ্র আছে তাহার অনুসন্ধান করা, উভয়ই সমান - কেবল বৃথা সময় ক্ষেপণ মাত্ৰ ! পরন্তু, এক্ষণে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদিগের অনুকরণে এদেশের আধুনিক বিদ্বানেরা গীতার বাহ্যাঙ্গেরই বিশেষ অনুশীলন করিতেছেন । গীতার মধ্যে আর্ষপ্ৰয়োগ সকল দেখিয়া এক ব্যক্তি এইরূপ নির্ধারণ করিয়াছেন যে, এই গ্ৰন্থ যিশুখৃষ্ট জন্মিবার কয়েক শতাব্দী পূর্বে রচিত হইয়া থাকিবে । ইহা হইতে গীতার অন্তর্ভূত ভক্তিমাৰ্গ তদুত্তরকালে প্ৰবর্তিত খৃষ্টধর্ম হইতে গৃহীত কি না এই সংশয় নির্মূল হইয়া যায় । গীতার ষোড়শ অধ্যায়ে যে নাস্তিক মতের উল্লেখ আছে, তাহা বোধ হয় বৌদ্ধধর্ম হইবে এইরূপ কল্পনা করিয়া, অপর এক ব্যক্তি বুদ্ধানন্তর গীতা রচিত হইয়া থাকিবে, এইরূপ বলিয়াছেন । তৃতীয় আর এক ব্যক্তি এইরূপ বলেন যে, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে, ‘ব্রহ্মসুত্ৰপাদৈশ্চৈব’ এই শ্লোকে ব্ৰহ্মসূত্রের উল্লেখ থাকায় গীতা ব্ৰহ্মসূত্রের পরে হইয়া থাকিবে । উল্টাপক্ষে একথাও কেহ কেহ বলেন যে, ব্ৰহ্মসূত্রের অনেক স্থানে গীতার প্রমাণ মীমাংসারূপে গৃহীত হওয়ায় গীতা তদুত্তরকালীন বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায় না । আরও কতকগুলি লোক এইরূপ বলেন যে, ভারতীয় যুদ্ধে রণভূমির উপর সাতশত-শ্লোকী গীতা অৰ্জুনকে বলার অবকাশ পাওয়া সম্ভব ছিল না । হ্যাঁ, ইহা সম্ভব হইতে পারে যে, যখন তুমুল যুদ্ধ চলিতেছিল সেই সময়ে শ্ৰীকৃষ্ণ অর্জুনকে দশ কুড়িটী শ্লোক এবং তাহার অর্থ বলিয়াছিলেন এবং ঐ সকল শ্লোক বিস্তৃতভাবে সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে, ব্যাস শুককে, বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে, এবং পরে সূত শৌনককে বলিয়াছিলেন; অর্থবা সর্বশেষে যাঁহা কর্তৃক মূলভারত ‘মহাভারতে’ পরিণত হয় তাঁহা কর্তৃক উহা লিখিত হইয়া থাকিবে । গীতাগ্রন্থের রচনা সম্বন্ধে মনের এইরূপ ধারণা হইবার পর, গীতাসাগরে ডুব দিয়া গীতার মূল শ্লোক কেহ সাত, কেহ আটাইশ, কেহ ছত্ৰিশ, কেহ বা একশত খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন ।
(সম্প্রতি এক সপ্তশ্লোকী গীতা প্রকাশিত হইয়াছে, উহাতে কেবল এই সাতটী শ্লোক - (১) ওঁ ইত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম ইত্যাদি [গী|৮|১৩]; (২) স্থানে হৃষীকেশ তব প্রকীর্ত্যা ইত্যাদি [গী|১১|৩৬]; (৩) সর্বতঃ পাণিপাদং তত্ত্ব ইত্যাদি [গী|১৩|১৩]; (৪) কবিং পুরাণমনুশাসিতারং ইত্যাদি [গী|৮|৯]; (৫) উর্ধমূল মধঃশাখং ইত্যাদি [গী|১৫|১]; (৬) সর্বস্য চাহং হৃদি সন্নিবিষ্ট ইত্যাদি [গী|১৫|১৫]; (৭) মন্মনাভব মদ্ভক্তো ইত্যাদি [গী|১৮|৬৫] । এই প্রকার আরো অনেক সংক্ষিপ্ত গীতা আছে ।)
কেহ কেহ ইহাও বলেন যে, রণভূমির উপর অর্জুনকে গীতান্তর্ভূত ব্ৰহ্মজ্ঞান বলিবার কোন প্ৰয়োজনই ছিল না; বেদান্তসম্বন্ধীয় এই উত্তম গ্ৰন্থ পরে কেহ মহাভারতের মধ্যে প্রক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছেন । বহিরঙ্গপ পর্যালোচনার এই সকল কথা যে সর্বথা নিরর্থক তাহা নহে । দৃষ্টান্তস্বরূপে, উপরে কথিত ফুলের পাপড়ীর কথা কিংবা মৌচাকের ছিদ্রের কথা ধরা যাক । বৃক্ষগণকে শ্রেণীবদ্ধ করিবার সময় অবশ্য তাহাদের ফুলের পাপড়ীরও বিচার নিশ্চয়ই করিতে হয় । সেইরূপ গণিতের সাহায্যে এক্ষণে প্রমাণিত হইয়াছে যে, মধুর পরিমাণ (ঘনফল) কম হইবে না অথচ পরিবেষ্টনের পরিমাণ (পৃষ্ঠফল) যাহাতে খুব কম হইয়া মোমের খরচ কম হয় এইরূপ আকারের মধু ধারণ করিবার ছিদ্র মৌচাকে থাকে এবং তাহার দরুণ মৌমাছিদিগের দৈহিক কারুকাৰ্য পরিব্যক্ত হয় । এই প্রকারের উপযোগিতার প্ৰতি লক্ষ্য করিয়া আমরাও এই গ্রন্থের পরিশিষ্টভাগে গীতার বহিরঙ্গ পর্যালোচনা করিয়াছি এবং উহার মাহাত্ম্য বিষয়ক সিদ্ধান্তেরও কিছু কিছু বিচার করিয়াছি । কিন্তু গ্রন্থের রহস্য যিনি বুঝিতে চাহিবেন, বহিরঙ্গের প্রতি আসক্ত হওয়ায় তাঁহার কোন লাভ নাই । বাগ্দেবীর রহস্যজ্ঞ ও তাহার বহিরঙ্গ-সেবক - এই উভয়ের ভেদ প্ৰদৰ্শন করিয়া মুরারি কবি এক সরস দৃষ্টান্ত দিয়াছেন । তিনি বলেন –
অব্ধিৰ্লঙ্ঘিত এব বানরভটৈঃ কিং ত্বস্য গম্ভীরতাম্ ৷অর্থাৎ সমুদ্রের অগাধ গভীরতা জানিতে চাহিলে কাহাকে তাহা জিজ্ঞাসা করিবে ? রামরাবণের যুদ্ধপ্রসঙ্গে শতশত সাহসী ও চপল বড় বড় বানরবীর অক্লেশে সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়া লঙ্কায় উপনীত হইয়াছিল সত্য, কিন্তু তাহাদের কয়জন সমুদ্রের গভীরতার পরিচয় পাইয়াছিল ? সমুদ্রমন্থনের সময় দেবতারা যে প্রকাণ্ড পর্বতকে মন্থনদণ্ড করিয়া সমুদ্রতলে প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং যে পর্বত সমুদ্রের নীচে পাতাল পর্যন্ত পৌঁছিয়াছিল, সেই মন্দরপর্বতই সমুদ্রের গভীরতা জানিতে সমর্থ হইয়াছিল । মুরারি কবির এই যুক্তি অনুসারে গীতার রহস্য জানিতে হইলে, যে সকল পণ্ডিত ও আচাৰ্য গীতাসাগর মন্থন করিয়াছেন, তাঁহাদিগের গ্রন্থসমূহেরই প্ৰতি অগ্রসর হওয়া উচিত । এই পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে মহাভারতকারই অগ্রগণ্য । অধিক কি, তিনি অধুনাতন প্ৰসিদ্ধ গীতার একপ্রকার রচয়িতা বলিলেও হয় । তাই সেই মহাভারতকারের মতে গীতার তাৎপৰ্য কি প্ৰথমে তাহাই সংক্ষেপ বলিতেছি ।
আপাতালনিমগ্নপীবরতনুৰ্জানাতি মন্থাচলঃ ॥
4) মহাভারতকারের মতে গীতার তাৎপৰ্য
‘ভগবদ্গীতা’ কিংবা ‘ভগবান কর্তৃক গীত উপনিষৎ’ এই নাম হইতেই, গীতাতে অর্জুনকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা প্ৰধানতঃ ভাগবত ধর্মের উপদেশ, অর্থাৎ ভগবান কর্তৃক প্ৰবর্তিত ধর্মের উপদেশ, এইরূপ অনুমান হয় । কারণ, শ্ৰীকৃষ্ণের ‘শ্ৰীভগবান’ এই নাম ভাগবত ধর্মেই প্রদত্ত হইয়া থাকে । এই উপদেশ কিছু নূতন নহে; পূর্বে এই উপদেশই ভগবান কর্তৃক বিবস্বানকে, বিবস্বান কর্তৃক মনুকে এবং মনু কর্তৃক ইক্ষ্বাকুকে দেওয়া হয়, গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের আরম্ভেই [গী|৪|১-৩] এইরূপ বলা হইয়াছে । মহাভারতের শান্তিপর্বের শেষে নারায়ণীয় বা ভাগবত-ধর্মের যে সবিস্তার বিবৃতি আছে তাহাতে ব্ৰহ্মদেবের অনেক জন্মে অর্থাৎ কল্পান্তরে, ভাগবত-ধর্মের পারম্পর্য বর্ণনা করিবার পর, পরিশেষে ব্ৰহ্মদেবের বর্তমান জন্মের অন্তর্ভূত ত্ৰেতাযুগে “এই ভাগবত ধর্ম বিবস্বান-মনু-ইক্ষ্বাকুর পরম্পরার প্রসৃত হইয়াছে” এইরূপ বলা হইয়াছে -
ত্ৰেতাযুগাদৌ চ ততো বিবস্বান্ মনবে দদৌ ৷এই দুই পরম্পরারই পরস্পর মিল আছে (গীতা|৪|১ এর উপরে আমার টীকা দেখ) । দুই ভিন্ন ধর্মের পারস্পর্য এক হইতে পারে না; তাই পারস্পর্যের ঐক্যের কারণে গীতাধর্ম ও ভাগবত-ধর্ম যে এক তাহাই অনুমান করা সহজ হয় । কিন্তু এই বিষয়টা কেবল অনুমান অবলম্বন করিয়াই আছে এরূপ নহে । নারায়ণীয় বা ভাগবত-ধর্মের নিরূপণ বিষয়ে বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে বলিতেছেন -
মনুশ্চ লোকভৃত্যৰ্থং সুতায়েক্ষাকবে দদৌ ৷
ইক্ষাকুনা চ কথিতো ব্যাপ্য লোকানবস্থিতঃ ॥ [মভা|শা|৩৪৮|৫১,৫২]
এবমেষ মহান্ ধর্মঃ স তে পূর্বং নৃপোত্তম ৷হে নৃপশ্রেষ্ঠ জন্মেজয় ! এই ভাগবত-ধর্ম বিধিযুক্ত ও সংক্ষিপ্ত প্ৰণালীতে হরিগীতাতে অর্থাৎ ভগবদ্গীতাতে পূর্বে তোমাকে বলিয়াছি” [মভা|শা|৩৪৬|১০] । ইহার পর এক অধ্যায় ছাড়িয়া পরবর্তী অধ্যায়ে [মভা|শা|৩৪৬|৮] নারায়ণীয় ধর্মের সম্বন্ধে আরও স্পষ্টরূপে বলা হইয়াছে –
কথিতো হরিগীতাসু সমাসবিধিকল্পিতঃ ॥
সমূপোঢেবনীকেষু কুরুপাণ্ডবয়োর্মৃধে ৷“কৌরব ও পাণ্ডবদিগের যুদ্ধে উভয়পক্ষের সৈন্য সজ্জিত থাকিলে অর্জুন যখন বিমনস্ক অর্থাৎ উদ্বিগ্ন হইলেন, তখন তাহাকে ভগবান স্বয়ং এই উপদেশ দিয়াছিলেন” । ইহা হইতে, স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে ‘হরিগীতা’ শব্দে ‘ভগবদ্গীতা’ই এই স্থানে বিবক্ষিত হইয়াছে । গুরুপরম্পরার ঐক্য ব্যতীত ইহাও মনে রাখা উচিত যে, যে ভাগবতধর্ম বা নারায়ণীয় ধর্মের বিষয়ে দুইবার বলা হইয়াছে, উহাই গীতার প্রতিপাদ্য বিষয় এবং উহাকেই “শাশ্বত” ও “ঐকান্তিক” ধর্ম বলা হইয়াছে । ইহার বিচারকালে দুই লক্ষণ উক্ত হইয়াছে -
অর্জুনে বিমনস্কে চ গীতা ভগবতা স্বয়ং ॥
নারায়ণপরো ধৰ্ম্মঃ পুনরাবৃত্তিদুর্লভঃ ৷“এই নারায়ণীয় ধর্ম পুনর্জন্ম-নিবারক অর্থাৎ পূর্ণ মোক্ষপ্রদ এবং প্ৰবৃত্তিপরও বটে” । ইহার পর এই ধর্ম কিরূপে প্ৰবৃত্তিপর মহাভারতে তাহার পুনরায় ব্যাখ্যা করা হইয়াছে । সন্ন্যাস গ্ৰহণ না করিয়া আমরণ চাতুর্বৰ্ণ্যবিহিত নিষ্কাম কর্মেই রত থাকা - এই অর্থে প্ৰবৃত্তি শব্দ প্ৰসিদ্ধ আছে । তাই, গীতাতে অর্জুনকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা ভাগবত ধর্মেরই উপদেশ, এবং উপরি উক্ত ধর্ম প্ৰবৃত্তিপর হওয়া প্ৰযুক্ত ঐ উপদেশ প্ৰবৃত্তিপর বলিয়াই যে মহাভারতকার বুঝিয়াছেন, তাহা স্পষ্ট উপলব্ধি হয় । তথাপি যদি ইহা বলা যায় যে গীতাতে কেবল প্ৰবৃত্তিপর ভাগবত ধর্মই আছে তাহাও ঠিক হইবে না, কারণ বৈশম্পায়ন জনমেজয়কে পুনরায় বলিয়াছেন -
প্ৰবৃত্তিলক্ষণশ্চৈব ধর্মো নারায়ণাত্মকঃ ॥ [শা|৩৪৭|৮০-১]
যতীনাং চাপি যো ধর্মঃ স তে পূর্বম্ নৃপোত্তম ৷“যতির অর্থাৎ সন্ন্যাসীর নিবৃত্তিপর ধর্মও, হে রাজন ! তোমাকে পূর্বে ভগবদ্গীতাতে যথাবিধি ও সংক্ষেপে বলিয়াছি”। [মাভা|শাং|৩৪৮|৫৩] । কিন্তু যদিও প্ৰবৃত্তিপর ধর্মের সঙ্গেই যতির নিবৃত্তিপর ধর্মও গীতাতে বলা হইয়াছে তথাপি মনু ইক্ষাকু ইত্যাদি গীতাধর্মের যে পারম্পর্য গীতাতে প্ৰদত্ত হইয়াছে, যতিধর্মের সহিত তাহার একেবারেই মিল হয় না; কেবল ভাগবত ধর্মেরই পারম্পর্যের সহিত তাহার মিল হয় । উপরিউক্ত বচন হইতে মহাভারতকারেরও এই অভিপ্ৰায় বুঝা যাইতেছে যে, গীতাতে অর্জুনকে যে উপদেশ দেওয়া হইয়াছে তাহা মুখ্যরূপে মনু ইক্ষাকু ইত্যাদি পরম্পরায় আগত প্ৰবৃত্তিপর ভাগবত ধর্মেরই উপদেশ; এবং উহাতে আনুষঙ্গিক ক্ৰমে নিবৃত্তিপর যতিধর্মের বর্ণনা করা হইয়াছে । মহাভারতের এই প্রবৃত্তিপর নারায়ণীয় ধর্ম এবং ভাগবত পুরাণের ভাগবত ধর্ম মূলে যে একই, তাহা পৃথু, প্রিয়ব্রত, প্ৰহ্লাদ প্রভৃতি ভগবদ্ভক্তদিগের কথা হইতে, এবং ভাগবতে বৰ্ণিত নিষ্কাম কর্মের বর্ণনা হইতে স্পষ্টই প্ৰতিপন্ন হয় [ভাগবত|৪|২১|৫১|৫২; ৭|১০|২৩ ও ১১, ৪|৬ দেখ] । কিন্তু ভাগবত ধর্মের কর্মপর প্রবৃত্তিতত্বের সমর্থন ভাগবতপুরাণের মুখ্য উদ্দেশ্য নহে । এই সমৰ্থন মহাভারতে এবং বিশেষভাবে গীতাতে করা হইয়াছে । কিন্তু এই সমর্থনের সময় ভাগবত ধর্মের ভক্তি-রহস্য যথোচিত দেখাইতে ব্যাস ভুলিয়া গিয়াছিলেন । এই কারণে ভাগবতের প্রথম অধ্যায়গুলিতে [ভাগ|১|৫,১২] লিখিত হইয়াছে যে, ভক্তি বিনা কেবল নিষ্কাম কর্ম ব্যর্থ ইহা বিবেচনা করিয়া এবং ভারতের এই অভাব পূরণ করিবার জন্য ভাগবত পুরাণ পরে রচিত হইয়াছে ইহাতেই ভাগবত পুরাণের মুখ্য উদ্দেশ্য কি তাহা স্পষ্টরূপে উপলব্ধি হয় । সেই উদ্দেশ্য এই যে, ভাগবতে অনেক প্রকারের হরিকথা বলিয়া ভাগবত ধর্মের ভগবদ্ভক্তিমাহাত্ম্য যেরূপ বিস্তারপূর্বক বর্ণিত হইয়াছে, ভাগবত ধর্মের কর্মপর অঙ্গের আলোচনা সে প্ৰকার করা হয় নাই । অধিক কি, ভাগবতকার ইহাই বলিতে চাহেন যে সমস্ত কর্মযোগ ভক্তি ব্যতীত নিষ্ফল [ভাগ|১|৫|৩৪] । তাই গীতার তাৎপর্য নির্ধারণে যে মহাভারতে গীতা উক্ত হইয়াছে তাহাতে নারায়ণীয় উপাখ্যান যেমন উপযোগী দেখা যায়, ভাগবত পুরাণ ভাগবত ধর্মসম্বন্ধীয় হইলেও কেবল ভক্তি প্ৰধান বলিয়া উহা সেরূপ উপযোগী হইতে পারে না । আর, যদিবা উহার কোন উপযোগিতা স্বীকার করা যায়, তথাপি এ কথা আমাদের মনে রাখা অবশ্যক যে, ভারত ও ভাগবত এই দুই গ্রন্থের উদ্দেশ্য এবং রচনাকাল বিভিন্ন । নিবৃত্তিপর যতিধর্ম এবং প্রবৃত্তিপর ভাগবত ধর্ম ইহাদের মূল স্বরূপ কি, ইহাদের এই ভেদ ঘটিবার কারণ কি, মূল ভাগবত ধর্মের এই সময়ে কি ভাবে রূপান্তর হইয়াছে ইত্যাদি প্রশ্নের বিচার পরে করা যাইবে ।
কথিতো হরিগীতাসু সমাসবিধিকল্পিতঃ ॥
5) গ্রন্থ তাৎপৰ্য নির্ণয়ে সাম্প্রদায়িক পন্থা
ইহা বুঝা গিয়াছে যে স্বয়ং মহাভারতকারের মতে গীতার তাৎপৰ্য কি । এক্ষণে দেখিতে হইবে যে, গীতার ভাষ্যকার ও টীকাকারগণ গীতার কি তাৎপৰ্য স্থির করিয়াছেন । এই ভাষ্য ও টীকাসমূহের মধ্যে আজকাল শ্ৰীশঙ্করাচার্যের গীতা-ভাষ্য অতিপ্রাচীন বলিয়া সকলের স্বীকৃত । যদিও ইহাঁর পূর্বে গীতার অনেক ভাষ্য ও টীকা যে হইয়াছিল তাহাতে সংশয় নাই । কিন্তু সে সকল টীকা এক্ষণে পাওয়া যায় না; এবং সেই কারণে জানিবার উপায় নাই যে, মহাভারতের রচনাকাল অবধি শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব পর্যন্ত গীতার অর্থ কি ভাবে করা হইত । তথাপি শঙ্করভাষ্যেতেই এই প্ৰাচীন টীকাকারদিগের মতের যে উল্লেখ আছে [গী|শাংভা|২ ও ৩ এর উপোদ্ঘাত দেখ], তাহা হইতে স্পষ্টই দেখিতে পাওয়া যায় যে, মহাভারতকারের ন্যায় আচার্যের পূর্ববর্তী টীকাকারেরা গীতার অর্থ জ্ঞান-কর্ম-সমুচ্চয়াত্মক বলিয়াই ধরিতেন, অর্থাৎ উহার এই প্ৰবৃত্তিপর অর্থ করা হইত যে, জ্ঞানী মনুষ্যের জ্ঞান অনুসারেই আমরণ স্বধর্মবিহিত কর্ম করা উচিত । কিন্তু বৈদিক কর্মযোগের এই সিদ্ধান্ত শ্ৰীশঙ্করাচার্যের নিকট মান্য না হওয়ায় তিনি তাহা খণ্ডন করিয়া নিজের মতে গীতার তাৎপৰ্য বুঝাইবার অভিপ্ৰায়েই গীতাভাষ্য লিখিয়াছেন । তাঁহার ভাষ্যের আরম্ভের উপাদ্ঘাতে এই কথা, তিনি স্পষ্টই বলিয়াছেন । ‘ভাষ্য’ শব্দের অর্থ ইহাই । ‘ভাষ্য’ ও ‘টীকা’, এই দুই শব্দ অনেক সময়ে সমান অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে সত্য; কিন্তু সাধারণতঃ 'টীকা’তে মূল গ্রন্থের সরল অন্বয় করিয়া শব্দের অর্থ সুগম করা হয় । ভাষ্যকার এইটুকুতে সন্তুষ্ট না হইয়া, ন্যায্যভাবে সমস্ত গ্রন্থের পর্যালোচনা করেন এবং তাঁহার মতে গ্রন্থের তাৎপৰ্য কি ও তদনুসারে গ্রন্থের কিরূপ অৰ্থ করা হইবে, তাহাও ব্যাখ্যা করিয়া থাকেন । গীতার শাঙ্কর-ভাষ্যের স্বরূপও এই প্রকার । কিন্তু গীতার তাৎপৰ্যবিচারে আচার্য যে ভেদ করিয়াছেন তাহার বীজ-সূত্রটির প্রতি লক্ষ্য করিবার পূর্বে প্রাচীন ইতিহাস এখানে একটু বলা আবশ্যক । বৈদিক ধর্ম কেবল তান্ত্রিক ধর্ম নহে; উহাতে যে গূঢ়তত্ত্ব আছে, তাহার সূক্ষ্ম বিচার প্রাচীন কালেই উপনিষদসমূহের ভিতরেই হইয়া গিয়াছিল । কিন্তু এই সকল উপনিষদ্ ভিন্ন ভিন্ন ঋষি কর্তৃক ভিন্ন ভিন্ন সময়ে রচিত হওয়ায় তাহাদের মধ্যে বিচার বিভিন্নতাও আসিয়া পড়িয়াছে । এই সকল বিচার-বিরোধ মিটাইবার জন্যই বাদরায়ণ আচাৰ্য নিজ বেদান্তসূত্রে সমস্ত উপনিষদেরই একবাক্যতা প্রতিপাদন করিয়াছেন; এবং এই কারণে বেদান্তসূত্রও উপনিষদসমূহকে প্রমাণ বলিয়া ধরিয়া থাকেন । এই বেদান্তসূত্রের অন্য নাম হইতেছে ‘ব্ৰহ্মসূত্ৰ’, বা ‘শারীরিক সূত্ৰ’ । তথাপি বৈদিকধর্মান্তৰ্গত তত্ত্বজ্ঞানের পূর্ণ বিচার এইটুকুতেই হইতে পারে না । কারণ, উপনিষদের উপদিষ্ট জ্ঞান প্রায়ই বৈরাগ্যপর অর্থাৎ নিবৃত্তিপর; এবং উপনিষদের একবাক্যতা সম্পাদন করিবার জন্যই বেদান্তসূত্র রচিত হওয়ায়, উহাতে কোথাও প্ৰবৃত্তিমার্গের সবিস্তার বিচার করা হয় নাই । তাই, প্ৰবৃত্তিমার্গপ্রতিপাদক ভগবদ্গীতা বৈদিক ধর্মতত্ত্বজ্ঞানের এই অভাব যখন সর্বপ্রথম পূর্ণ করিলেন, তখন উপনিষদ ও বেদান্তসূত্রের অন্তর্নিহিত তত্ত্বজ্ঞানের পূর্ণতাসম্পাদক গ্ৰন্থ ভগবদ্গীতা এই হিসাবেই উহাদের সহিত সমানরূপে সর্বমান্য ও প্রমাণভূত হইল । এবং পরিণামে উপনিষদ, বেদান্তসূত্র ও ভগবদ্গীতা এই তিন গ্ৰন্থ “প্রস্থানত্রয়ী” এই নাম প্রাপ্ত হইল । “প্রস্থানত্রয়ী”র অর্থ এই যে উহাতে বৈদিক ধর্মের আধারভূত তিন মুখ্য বা স্তম্ভ গ্রন্থ আছে, যে গ্রন্থগুলিতে নিবৃত্তি ও প্ৰবৃত্তি এই দুই মার্গেরই যথা পদ্ধতি তাত্ত্বিক বিচার করা হইয়াছে । এইরূপে; প্ৰস্থানত্ৰয়ীতে ভগবদ্গীতার সমাবেশ এবং প্ৰস্থানত্ৰয়ীর সাম্রাজ্য অধিকাধিক বিস্তৃত হইবার পর, যে ধর্মমত বা সম্প্রদায় এই তিন গ্ৰন্থকে অবলম্বন করিত না, কিংবা এই তিনের মধ্যে যাহার সমাবেশ হইতে পারিত না, সেই মত ও সম্প্রদায়কে বৈদিক ধর্মের লোকেরা গৌণ মনে করিয়া অগ্রাহ্য করিতে লাগিল । ইহার পরিণাম হইল এই যে, অদ্বৈত, বিশিষ্টাদ্বৈত, দ্বৈত, শুদ্ধাদ্বৈত প্রভৃতি এবং তদবলম্বিত সন্ন্যাস বা ভক্তিমূলক বৈদিক ধর্মের যে যে সম্প্রদায় বৌদ্ধধর্মের পতনের পর হিন্দুস্থানে প্রচলিত হইছে, উহাদের প্রত্যেক সম্প্রদায়ের প্রবর্তক আচার্যেরা প্রস্থানত্রয়ীর তিন ভাগের উপরেই (ভগবদ্গীতাসহ) ভাষ্য লিখিয়াছেন । তাঁহাদের ভাষ্য লিখিবার প্রয়োজন ছিল এই যে, তাঁহারা দেখাইতে চাহেন যে এই সকল সম্প্রদায় বাহির হইবার পূর্বেই যে তিন ধর্মগ্রন্থ প্রামাণিক গ্ৰন্থ বলিয়া স্বীকৃত হইত, সেই তিন গ্রন্থেরই উপর তাঁহদের নিজের নিজের সম্প্রদায় দাঁড়াইয়া আছে, অপর সম্প্রদায় ঐ সকল গ্ৰন্থকে মানিয়া চলেন না । এরূপ করিবার কারণ এই যে, যদি কোন আচাৰ্য ইহা স্বীকার করেন যে অন্য সম্প্রদায়ও প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থের উপর সংপ্ৰতিষ্ঠিত, তবে তাঁহার নিজ সম্প্রদায়ের মাহাত্ম্যের কতকটা লাঘব হয়; এবং এরূপ মাহাত্ম্যের লাঘব করা কোন সম্প্রদায়েরই অভীষ্ট নহে । সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে প্ৰস্থানত্রয় সম্বন্ধে ভাষ্য লিখিবার এই প্ৰথা আরম্ভ হইলে, বিভিন্ন পণ্ডিত নিজ নিজ সম্প্রদায়িক ভাষ্যের উপরেই নিজ নিজ টীকা লিখিয়া গীতাৰ্থ প্ৰতিপাদন করিতে আরম্ভ করিলেন, এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক টীকাই অধিক মান্য হইয়া পড়িল । গীতা সম্বন্ধে এক্ষণে যে সকল ভাষ্য কিংবা টীকা পাওয়া যায়, তাহাদের প্রায় সকলগুলিই এই প্ৰকার বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক আচার্য বা পণ্ডিতের রচিত । ইহার পরিণাম হইয়াছে এই যে, মূল ভগবদ্গীতাতে একই অর্থ সহজভাবে প্রতিপাদিত হইলেও, ঐ গীতাই প্ৰত্যেক সম্প্রদায়ের সমর্থক বলিয়া উপলব্ধ হয় ।
5.1) শ্ৰীশঙ্করাচার্যের ভাষ্য (অদ্বৈতবাদ)
এই সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্ৰীশঙ্করাচার্যের সম্প্রদায়ই প্রাচীনতম সম্প্রদায় এবং তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে ঐ সম্প্রদায়ই হিন্দুস্থানে মান্যতম হইয়াছে । শ্ৰীমৎ শঙ্করাচার্য ৭১০ শালিবাহন শকে (৮৪৫ সম্বৎ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩২ বৎসরে তিনি গুহা-প্ৰবেশ করেন (৭১০-৭৪২), বর্তমানে ইহা নির্ধারিত হইয়াছে । (আমাদের মতে শঙ্করাচার্যের কাল আরও ১০০ বৎসর পিছাইয়া দেওয়া আবশ্যক । পরিশিষ্ট ভাগে তাহার প্রমাণাদি দ্রষ্টব্য ।) শ্ৰী শঙ্করাচার্য একজন অলৌকিক জ্ঞানী পুরুষ ছিলেন । তিনি স্বকীয় দিব্য শক্তির দ্বারা সেই সময় চতুর্দিকে ব্যাপ্ত জৈন ও বৌদ্ধ মতের খণ্ডন করিয়া অদ্বৈতমত স্থাপন করিলেন; এবং তিনি শ্রুতি-স্মৃতি-বিহিত বৈদিক ধর্মের সংরক্ষণার্থ ভারতবর্ষের চারিদিকে চারি মঠ দাঁড় করাইয়া নিবৃত্তিপর বৈদিক সন্ন্যাস ধর্ম বা সম্প্রদায় কলিযুগে পুনঃপ্রবর্তিত করিলেন, একথা সৰ্ববিশ্রুত । যে কোন সম্প্রদায়কেই ধর না কেন, স্বভাবতই তাহার দুই ভাগ আছে – (i) তত্ত্বজ্ঞানের ভাগ; (ii) আচরণের ভাগ । প্রথম ভাগে জড় ব্ৰহ্মাণ্ডের বিচারের দ্বারা পরমেশ্বরের স্বরূপ নিষ্পন্ন পূর্বক শাস্ত্ররীতি-অনুসারে মোক্ষসম্বন্ধীয় সিদ্ধান্তও নির্ণয় করা হয়; এবং দ্বিতীয় ভাগে ঐ মোক্ষলাভের সাধন বা উপায় কি অৰ্থাৎ এই জগতে মনুষ্য কিরূপ আচরণ করিবে, তাহার নিরূপণ করা হইয়া থাকে । তন্মধ্যে প্রথম অর্থাৎ তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখিলে, শ্ৰীশঙ্করাচার্যের কথাটি এই যে, (১) :আমি, তুমি, কিংবা মুষ্যের চক্ষুগোচর দৃশ্যমান জগৎ অর্থাৎ সৃষ্টির অন্তর্গত পদার্থসমূহের নানাত্ব আসলে সত্য নহে । একই শুদ্ধ ও নিত্য পরব্রহ্ম এই সমস্ত ভরিয়া আছেন, এবং তাঁহার মায়াতে মনুষ্যের ইন্দ্ৰিয়সমক্ষে নানাত্ব অবভাসিত হয় । (২) মনুষ্যের আত্মাও মূলত পরব্রহ্মরূপই; এবং (৩) আত্মা ও পরব্রহ্মের একতার পূর্ণজ্ঞান অর্থাৎ অনুভবাত্মক উপলব্ধি না হইলে মোক্ষলাভ হইতে পারে না । ইহাকেই অদ্বৈতবাদ বলে । ইহার তাৎপৰ্য এই যে, একমাত্ৰ শুদ্ধ, বুদ্ধ, নিত্য ও মুক্ত পরব্ৰহ্ম ব্যতীত অপর কোন স্বতন্ত্র ও সত্য বস্তু নাই; যে নানাত্ব চোখে দেখা যায় তাহা মানবী দৃষ্টির ভ্রম বা মায়িক উপাধিমূলক অবভাস মাত্র । মায়াও সত্য বস্তু বা স্বতন্ত্র বস্তু নহে; উহাও মিথ্যা । এই সিদ্ধান্তের এইরূপ তাৎপৰ্য । কেবল তত্ত্বজ্ঞানের বিচার করিতে হইলে শাঙ্করমতের ইহা অপেক্ষা অধিক আলোচনা করা আবশ্যক হয় না । কিন্তু শাঙ্করসম্প্রদায়ের ইহাতেই পূর্ণতা হয় না । অদ্বৈত তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে শাঙ্করসম্প্রদায়ের আর এক সিদ্ধান্ত আছে, যাহা আচার দৃষ্টিতে প্ৰথমের সহিত সমান মাহাত্ম্যবিশিষ্ট । তাহার তাৎপৰ্য এই যে, যদিও চিত্তশুদ্ধি হইলে পর ব্ৰহ্মাত্মৈক্যজ্ঞান প্ৰাপ্ত হইবার যোগ্যতা লাভ করিবার জন্য স্মৃতিগ্ৰন্থাদির উক্তি অনুসারে গৃহস্থাশ্রমের কর্ম সকল করা অত্যন্ত আবশ্যক, তথাপি এই সকল কর্মের আচরণ চিরকাল কর্তব্য নহে, কারণ পরিশেষে সকল কর্ম ছাড়িয়া দিয়া সন্ন্যাস গ্ৰহণ ব্যতীত মোক্ষলাভ হইতে পারে না । ইহার কারণ এই যে, কর্ম ও জ্ঞান, অন্ধকার ও আলোকের ন্যায় পরস্পর বিরোধী হওয়া প্ৰযুক্ত, সমস্ত বাসনা ও কর্ম পরিত্যাগ ব্যতীত ব্ৰহ্মজ্ঞানের পূর্ণতাই হয় না । পরিশেষে সর্ব কর্ম ত্যাগ করিয়া জ্ঞানেতেই মগ্ন থাকা হয় বলিয়া, এই সিদ্ধান্তটিকে ‘নিবৃত্তিমাৰ্গ, সন্ন্যাসনিষ্ঠা’ বা ‘জ্ঞাননিষ্ঠা’ বলা হয় । উপনিষদ ও ব্ৰহ্মসূত্রের উপর যে শাঙ্করভাষ্য আছে তাহাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে যে ঐ উভয়ে শুধু অদ্বৈতজ্ঞানই আছে এরূপ নহে, সন্ন্যাসমাৰ্গও আছে অর্থাৎ শাঙ্করসম্প্রদায়ের উপরি-উক্ত দুই ভাগেরই উপদেশ আছে । গীতার উপর যে শাঙ্করভাষ্য আছে তাহাতে নিরূপিত হইয়াছে যে ভগবদ্গীতারও তাৎপৰ্য তাহাই [গী|শাংভা|উপোদ্ঘাত ও ব্ৰহ্মসূ, শাংভা|২|১|১৪ দেখ] । ইহার প্রমাণ স্বরূপে গীতার কোন কোন বাক্যও প্রদত্ত হইয়াছে, যথা — “জ্ঞানাগ্নিঃ সৰ্ব্বকৰ্ম্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতে” — জ্ঞানরূপ অগ্নিতে সকল কর্ম ভস্ম হইয়া যায় [গী|৪| ৩৭], “সৰ্ব্বকৰ্ম্মাখিলং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে” — জ্ঞানেতেই সর্বকর্মের পরিসমাপ্তি হয় [গী|৪| ৩৩] । সারকথা এই যে, বৌদ্ধধর্মের পতনের পর, প্রাচীন বৈদিক ধর্মের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থির করিয়া শ্ৰীশঙ্করাচাৰ্য যে বিশিষ্ট মার্গের স্থাপনা করিয়াছেন, গীতার তাৎপৰ্য তাহারই অনুকূল, পূর্ব টীকাকারদিগের কথাপ্রমাণে জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয় গীতার প্রতিপাদ্য নহে, প্ৰত্যুত কর্মই জ্ঞানপ্ৰাপ্তির গৌণ সাধন এবং সর্বকর্ম সন্ন্যাসপূর্বক জ্ঞানেতেই মোক্ষ লাভ হয়, শাঙ্করসম্প্রদায়ের এই সিদ্ধান্তই গীতাতে উপদিষ্ট হইয়াছে - ইহা দেখাইবার জন্যই শঙ্কারভাষ্য লিখিত হইয়াছে । শঙ্করাচার্যের পূর্বে যদি সন্ন্যাসপার কোন টীকা লিখিত হইয়া থাকে, তাহা এক্ষণে পাওয়া যায় না । এইজন্য গীতার প্রবৃত্তিপর রূপটি উঠাইয়া দিয়া নিবৃত্তিপর সাম্প্রদায়িক রূপ প্ৰদান করা উক্ত ভাষ্য হইতে আরম্ভ হইয়াছে, এইরূপ বলা যাইতে পারে । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের পরে তাঁহার সম্প্রদায়ের অনুযায়ী, মধুসূদনাদি যে সকল অনেক টীকাকার হইয়াছেন, তাঁহারা এই বিষয়ে অনেকটা শঙ্করাচার্যেরই অনুকরণ করিয়াছেন । ইহার পরে, এক অদ্ভুত বিচার উঠিয়াছে যে, অদ্বৈতমতের মূলীভূত মহাবাক্যসমূহের মধ্যে “তত্ত্বমসি” – [সেই (পরব্রহ্ম) তুমি (শ্বেতকেতু)] ছান্দোগ্যোপনিষদের এই মহাবাক্য গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে বিবৃত হইয়াছে । কিন্তু এই মহাবাক্যের পদসকলের ক্রম বদলাইয়া প্ৰথমে “ত্বং” ও তাহার পর “তৎ” এবং পরে “অসি” এই পদগুলিকে লইয়া, এই নূতন ক্ৰম অনুসারে প্রত্যেক পদের উপর গীতার আরম্ভ হইতে ছয় ছয় অধ্যায়, শ্ৰীভগবান অপক্ষপাতে সমান সমান বাঁটিয়া দিয়াছেন । গীতা সম্বন্ধে পৈশাচ ভাষ্য কোন সম্প্রদায়েরই নহে, উহা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং হনুমান অর্থাৎ মারুতি কর্তৃক লিখিত এইরূপ কাহারো কাহারো ধারণা । কিন্তু আসল কথা তাহা নহে । ভাগবতের টীকাকার হনুমান পণ্ডিত এই ভাষ্য রচনা করেন এবং উহা সন্ন্যাস মার্গের । ইহার কয়েক স্থানে শাঙ্কর ভাষ্যেরই অর্থ শব্দশ প্রদত্ত হইয়াছে । সেইরূপ, পূর্বে ও অধুনা, মারাঠীতে গীতার যে ভাষান্তর কিংবা আলোচনাদি প্ৰকাশিত হইয়াছে সে সমস্ত প্রায়ই শঙ্কর ভাষ্যানুযায়ী । অধ্যাপক মোক্ষমূলর কর্তৃক প্ৰকাশিত “প্ৰাচ্যধর্মপুস্তক-মালায়” পরলোকগত কাশীনাথ পন্ত তৈলঙ্গকৃত ভগবদ্গীতার ইংরেজি অনুবাদও আছে । তাহার প্রস্তাবনায় লিখিত হইয়াছে যে, এই অনুবাদে অনেকটা শঙ্করাচার্য ও শাঙ্কর সম্প্রদায়ী টীকাকারদিগের অনুসরণ করা হইয়াছে ।
5.2) শ্রীরামানুজাচার্যের ভাষ্য (বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ)
গীতা ও প্ৰস্থানত্রয়ীর অন্তর্ভূত অন্য গ্ৰন্থ সম্বন্ধে এই প্রকার সাম্প্রদায়িক ভাষ্য লিখিবার রীতি প্ৰচলিত হইলে পর, অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যেও ঐ রূপ অনুকরণ আরম্ভ হইল । মায়াবাদ, অদ্বৈত ও সন্ন্যাস প্ৰতিপাদনকারী শাঙ্করসম্প্রদায়ের প্রায় সাৰ্দ্ধ দুই শত বৎসর পরে, শ্ৰীরামানুজাচাৰ্য (জন্ম শক ৯৩৮, সম্বৎ ১৯৭৩) বিশিষ্টাদ্বৈত সম্প্রদায় প্ৰবর্তিত করিলেন । নিজ সম্প্রদায় পুষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে শঙ্করাচার্ধের ন্যায় রামানুচাৰ্যও প্রস্থানত্রীর উপর, (সুতরাং তদন্তৰ্গত গীতারও উপর) স্বতন্তু ভাষ্য লিখিয়াছেন । এই সম্প্রদায়ের মত এই যে, শ্ৰীশঙ্করাচার্যের মায়া-মিথ্যাত্মবাদ ও অদ্বৈত সিদ্ধান্ত এ দুইটী সত্য নহে; জীব, জগৎ ও ঈশ্বর এই তিন তত্ত্ব ভিন্ন হইলেও, জীব (চিৎ) ও জগত (অচিৎ) এই দুইটী একই ঈশ্বরের শরীর; সুতরাং চিৎ অচিৎ বিশিষ্ট ঈশ্বর একই এবং ঈশ্বর শরীরান্তর্ভূত এই সূক্ষ্ম চিৎ-অচিৎ হইতেই পরে স্থূল, চিৎ ও স্থূল অচিৎ বা অনেক জীব ও জগৎ উৎপন্ন হয় । এই মতই উপনিষদ, ব্ৰহ্মসূত্র ও গীতাতে প্রতিপাদিত হইয়াছে, - তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে ইহাই রামানুজাচার্যের অভিপ্ৰায় [গী|রা-ভা|২|১২; ১৩|২] । ইহাঁরই গ্ৰন্থসমূহের কারণে ভাগবত ধর্মের মধ্যে বিশিষ্টাদ্বৈত মত প্ৰবেশলাভ করিয়াছে, একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না । কারণ, ইহার পূর্বে মহাভারত ও গীতাতে ভাগবত ধর্মের যে বর্ণনা দেখা যায়, তাহাতে অদ্বৈতবাদই স্বীকৃত দৃষ্ট হয় । রামানুজাচাৰ্য ভাগবতধর্মাবলম্বী থাকা প্ৰযুক্ত, গীতাতে প্ৰবৃত্তিপর কর্মযোগ প্ৰতিপাদিত হইয়াছে - এই কথাই প্ৰকৃতপক্ষে তাঁহার মনে হওয়া উচিত ছিল । কিন্তু রামানুজাচার্যের সময়ে মূল ভাগবত ধর্মের অন্তর্ভূত কর্মযোগ অনেকটা লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল এবং তিনি তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও নৈতিক আচরণদৃষ্টিতে ভক্তিতত্ত্ব প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন । এই সকল কারণে গীতাতে জ্ঞান কর্ম ও ভক্তি এই তিনই বর্ণিত হইলেও তত্ত্বজ্ঞানদৃষ্টিতে বিশিষ্টাদ্বৈত ও আচার দৃষ্টিতে বাসুদেবভক্তিই গীতার সারতত্ত্ব; কর্মনিষ্ঠা কোন স্বতন্ত্র বস্তু নহে, জ্ঞাননিষ্ঠার উৎপাদক মাত্র ইহাই রামানুজাচার্য সিদ্ধান্ত করিয়াছেন [গী|রা-ভা|১৮|১ ও ৩|১] দেখ] । অদ্বৈত জ্ঞানের স্থানে বিশিষ্টাদ্বৈত এবং সন্ন্যাসের স্থানে ভক্তি - যদিও রামানুজাচার্য শাঙ্করসম্প্রদায় হইতে এইরূপ প্ৰভেদ করিয়াছেন, তথাপি তিনি আচরণ দৃষ্টিতে ভক্তিই শেষ কর্তব্য বলিয়া স্বীকার করায়, বর্ণাশ্রমবিহিত সাংসারিক কর্ম আমরণ সম্পাদন করা – তাঁহার মতে গৌণ হইয়াছে । এবং সেইজন্য গীতার রামানুজীয় তাৎপৰ্যও একপ্রকার কর্ম-সন্ন্যাস পরই বলা যাইতে পারে । কারণ, কর্মের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হইয়া জ্ঞানোদয় হইলে পর, চতুর্থাশ্রম গ্ৰহণ করিয়া ব্ৰহ্মচিন্তাতে নিমগ্ন থাকা অথবা প্রেমযোগে অপরিসীম বাসুদেবভক্তিতে ডুবিয়া থাকা — এই দুই মার্গই কর্মযোগদৃষ্টিতে একই - উভয়ই নিবৃত্তিপর । রামানুজাচার্যে পরবর্তী সম্প্রদায়ের উপরেও এই আপত্তি হইতে পারে ।
5.3) শ্ৰীমধ্বাচাৰ্যের ভাষ্য (দ্বৈতবাদ)
মায়ামিথ্যাতত্ত্ববাদ অসত্য এবং বাসুদেবভক্তিই প্ৰকৃত মোক্ষসাধক, রামানুজসম্প্রদায়ের পরে এই মতপ্রচারক এক তৃতীয় সম্প্রদায় আবির্ভূত হইয়াছিল । এই সম্প্রদায়ের মত এই যে, পরব্রহ্ম ও জীব কিয়দংশে এক ও কিয়দংশে ভিন্ন, ইহা স্বীকার করা পরস্পরবিরুদ্ধ ও অসম্বন্ধ । এইজন্য উভয়ই সতত ভিন্ন এইরূপ স্বীকার করিতেই হয়; পূর্ণরূপে কিংবা অংশতও উহাদের মধ্যে ঐক্য থাকিতে পারে না । এই তৃতীয় সম্প্রদায়কে “দ্বৈতী সম্প্রদায়” বলা হয় । এই সম্প্রদায়ের লোকদিগের মতে ইহার প্ৰবর্তক শ্ৰীমধ্বাচাৰ্য (শ্ৰীমৎ আনন্দন্তীর্থ) । ইনি ১১২০ শকে (১২৫৫ সম্বতে) সমাধিস্থ হইয়াছেন এবং তখন তাঁহার বয়স ৩৯ বৎসর ছিল । কিন্তু ডাক্তার ভাণ্ডারকর “বৈষ্ণব, শৈব ও অন্য পন্থী” নামে যে ইংরাজী গ্ৰন্থ সম্প্রতি প্ৰকাশ করিয়াছেন, তাহাতে (৫৯ পৃঃ) তিনি শিলালেখাদি প্রমাণের বলে, মধ্বাচার্যের কাল ১১১৯ হইতে ১১৯৮ শক পৰ্যন্ত (১২৫৪-১৩৩৩ সম্বৎ) নির্ধারিত করিয়াছেন । শ্ৰীমধ্বাচার্যের প্রস্থানত্রয়ী সম্বন্ধে - সুতরাং গীতাসম্বন্ধেও - যে ভাষ্য আছে তাহাতে এই সমস্ত গ্ৰন্থ দ্বৈতমতেরই প্ৰতিপাদক - ইহাই তিনি দেখাইয়াছেন । তাঁহার গীতা-ভাষ্যে তিনি এইরূপ বলেন যে, নিষ্কাম কর্মের মাহাত্ম্য যদিও গীতাতে বৰ্ণিত হইয়াছে, তথাপি সেই নিষ্কাম কর্ম সাধনমাত্ৰ, ভক্তিই চরম নিষ্ঠা । ভক্তি সিদ্ধ হইলে পর, কর্ম কিছু করিলে বা না করিলে, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না । “ধ্যানাৎ কর্মফলত্যাগঃ” - পরমেশ্বরের ধ্যান বা ভক্তি অপেক্ষা কর্মফলত্যাগ বা নিষ্কাম কর্ম শ্রেষ্ঠ ইত্যাদি । কতকগুলি গীতা বচন এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধ; কিন্তু গীতার মাধ্বভাষ্যে লিখিত হইয়াছে যে, ঐ সকল বচন অক্ষরশঃ সত্য বলিয়া ধরিবার পরিবর্তে অর্থবাদাত্মক বলিয়া বুঝিতে হইবে [গী|মা-ভা|১২|১৩] ।
5.4) শ্ৰীবল্লভাচার্যের ভাষ্য (শুদ্ধাদ্বৈতবাদ/পুষ্টিমাৰ্গ)
চতুর্থ সম্প্রদায় শ্ৰীবল্লভাচার্য প্ৰবর্তিত (জন্মশক ১৪০১, সম্বৎ ১৫৩৬) । রামানুজ ও মাধ্ব-সম্প্রদায়ের ন্যায় এই সম্প্রদায়ও বৈষ্ণবপন্থী । কিন্তু জীব, জগৎ ও ঈশ্বর সম্বন্ধে এই সম্প্রদায়ের মত বিশিষ্টাদ্বৈত কিংবা দ্বৈত মত হইতে স্বতন্ত্র । মায়া-বিরহিত অর্থাৎ শুদ্ধ জীব ও পরব্রহ্ম একই, দুই নহে, এই সম্প্রদায় ইহা স্বীকার করেন । এই জন্যই এই মতকে ‘শুদ্ধাদ্বৈত’ বলে । এই সম্প্রদায় শ্ৰীশঙ্করাচার্যের ন্যায় জীব ও ব্ৰহ্ম এক বলিয়া স্বীকার করেন না । ইহারা বলেন যে, অগ্নির স্ফুলিঙ্গের ন্যায় জীব ঈশ্বরের অংশমাত্র; মায়াত্মক জগৎ মিথ্যা নহে, মায়াও ঈশ্বরের ইচ্ছায় ঈশ্বর হইতে বিভক্ত এক শক্তি, এবং মায়াপরতন্ত্ৰ জীবের মোক্ষজ্ঞান ঈশ্বরানুগ্রহ ব্যতীত হইতে পারে না, সুতরাং ভগবদ্ভক্তিই মোক্ষের মুখ্য সাধন । এই সিদ্ধান্তের কারণেই শাঙ্কর-সম্প্রদায় হইতেও এই সম্প্রদায় ভিন্ন হইয়াছে । এই মার্গের লোকেরা পরমেশ্বরের এই অনুগ্রহকে “পুষ্টি, পোষণ” নামেও অভিহিত করেন, তাই এই সম্প্রদায়কে “পুষ্টিমাৰ্গ”ও বলা হইয়া থাকে । এই সম্প্রদায়ের তত্ত্বদীপিকাদি গীতাসম্বন্ধীয় যে সকল গ্ৰন্থ আছে, তাহাতে এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছে যে, ভগবান অর্জুনকে সাংখ্যজ্ঞান ও কর্মযোগের কথা প্রথমে বলিয়া শেষে ভক্তি-অমৃত পান করাইয়া কৃতকৃত্য করিয়াছেন; সেই কারণে ভগবৎ-ভক্তি এবং বিশেষভাবে নিবৃত্তিপর পুষ্টিমার্গীয় ভক্তিই সমস্ত গীতার মুখ্য তাৎপৰ্য । কারণ এই যে, ভগবান গীতার শেষে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, “সর্বধর্মানু পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্ৰজ” [গী|১৮|৬৬] - সকল ধর্ম ত্যাগ করিয়া একমাত্র আমারই শরণ লও ।
5.5) শ্রীনিম্বার্কের ভাষ্য (দ্বৈতাদ্বৈতীবাদ)
উপরি উক্ত সম্প্রদায়সমূহের অতিরিক্ত নিম্বার্কেরও রাধাকৃষ্ণভক্তিপর আর এক বৈষ্ণব-সম্প্রদায় আছে । এই আচার্য, রামানুজাচার্যের পর ও মধ্বাচার্যের পূর্বে, আনুমানিক ১০৮৪ শকে (১২১৯ সম্বৎ) আবির্ভূত হইয়াছিলেন, ডাক্তার ভাণ্ডারকর এইরূপ নির্ধারণ করিয়াছেন । জীব, জগৎ ও ঈশ্বর সম্বন্ধে নিম্বাৰ্কাচার্যের মত এই যে, এই তিন ভিন্ন হইলেও, জীব ও জগতের ব্যাপার ও অস্তিত্ব স্বতন্ত্র না হইয়া উহা ঈশ্বরের ইচ্ছাকে অবলম্বন করিয়া আছে এবং মূল পরমেশ্বরের মধ্যেই জীব ও জগতের সূক্ষ্মতত্ত্ব অন্তর্ভুত রহিয়াছে । এই মত সিদ্ধ করিবার জন্য নিম্বার্ক বেদান্তসূত্ৰ সম্বন্ধে এক স্বতন্ত্র ভাষ্য লিখিয়াছেন । এই সম্প্রদায়ের কেশব কাশ্মীরী ভট্টাচাৰ্য গীতার ‘তত্ত্বপ্রকাশিকা’ নামে এক টীকা লিখিয়া তাহাতে দেখাইয়াছেন যে, প্ৰকৃত গীতাৰ্থ এই সম্প্রদায়ের অনুকুল । রামানুজাচার্যের বিশিষ্টাদ্বৈত হইতে এই সম্প্রদায়ের ভেদ প্ৰদৰ্শনার্থ ইহাকে “দ্বৈতাদ্বৈতী’ সম্প্রদায় বলা যাইতে পারে ।
5.6) মহারাষ্ট্র দেশীয় মত - “জ্ঞানেশ্বরী”
ইহা স্পষ্টই উপলব্ধি হয় যে এই সকল ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় শাঙ্কর-সম্প্রদায়ের মায়াবাদ স্বীকার না করিয়াই প্ৰবর্তিত হইয়াছিল; কারণ, চক্ষুগ্ৰাহ্য প্ৰত্যক্ষ বস্তুকে সত্য বলিয়া স্বীকার না করিলে ব্যক্তের উপাসনা অর্থাৎ ভক্তি নিরাধার বা কিয়দংশে মিথ্যাও হইয়া যায় । কিন্তু ভক্তিবাদ স্থাপন করিবার জন্য অদ্বৈত ও মায়াবাদ সম্পূর্ণ ত্যাগ করিতেই হইবে এমন কোনই কথা নাই । মায়াবাদ ও অদ্বৈতবাদ স্বীকার করিয়াও মহারাষ্ট্র দেশীয় এবং অন্যান্য সাধু সন্তেরা ভক্তির সমর্থন করিয়াছেন । অতএব এই পন্থা শ্ৰীশঙ্করাচার্যের পূর্ব হইতেই চলিয়া আসিতেছে এইরূপ অনুমান হয় । অদ্বৈত, মায়া-মিথ্যাত্ববাদ ও কর্মত্যাগের আবশ্যকতা, এই সকল শাঙ্করসম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত, উক্ত পন্থাতেও গৃহীত হইয়া থাকে । কিন্তু এই পন্থার ইহাও মত যে, ব্ৰহ্মাত্মৈক্যরূপ মোক্ষপ্রাপ্তির সর্বাপেক্ষা সুগম সাধন হইতেছে ভক্তি । “তুজ হ্বাবা আহে দেব । তরি হা সুলভ উপায়” [তুকা|গা|৩০০২-২] অর্থাৎ - তোমার যদি দেবতা হইতে হয়, ইহাই তাহার সুলভ উপায় । তুকারাম বাবাজীর কথা অনুসারে এই পন্থাবলম্বীর ইহাই উপদেশ । গীতাতেও ভগবান প্রথমে এই কারণ বলিয়াছেন যে, “ক্লেশোহধিকতরস্তেষামব্যক্তাসক্তচেতসাম্” [গী|১২|৫] অর্থাৎ অব্যক্ত ব্ৰহ্মের প্রতি চিত্তকে আসক্ত করা অধিক ক্লেশকর । পরে, অর্জুনকে এই উপদেশ দিয়াছেন যে, “ভক্তাস্তেহতীব মে প্রিয়াঃ” [গী|১২|২০] অর্থাৎ আমার ভক্তই আমার অতীব প্রিয় । অতএব ইহাই প্রকট হইতেছে যে, অদ্বৈতপর্যবসায়ী ভক্তিমাৰ্গই গীতার মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । শ্ৰীধর স্বামীও গীতার স্বকৃত টীকাতে [গী|১৮|৭৮] গীতার এইরূপ তাৎপৰ্যই প্ৰকাশ করিয়াছেন । মারাঠী ভাষাতে এই সম্প্রদায়ের গীতাসম্বন্ধীয় সর্বোত্তম গ্ৰন্থ হইতেছে “জ্ঞানেশ্বরী” । ইহাতে বলা হইয়াছে যে, গীতার আঠারো অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ছয় অধ্যায়ে কর্ম, মধ্যের ছয় অধ্যায়ে ভক্তি এবং শেষ ছয় অধ্যায়ে জ্ঞান প্ৰতিপাদিত হইয়াছে । স্বয়ং জ্ঞানেশ্বর মহারাজ নিজ গ্রন্থের শেষে বলিয়াছেন যে, “ভাষ্যকারাঁ তেঁ বাট পুসৎ” - অৰ্থাৎ ভাষ্যকার শঙ্করাচার্যকে পথ জিজ্ঞাসা করিয়া - অর্থাৎ শঙ্করাচার্যের মতানুসরণ করিয়া আমি নিজের টীকা রচনা করিয়াছি । কিন্তু “জ্ঞানেশ্বরী”কে এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র গ্ৰন্থ বলিয়া ধরা উচিত, কারণ ইহাতে গীতার মূল অর্থ অনেক বাড়াইয়া অনেক সরল দৃষ্টান্তের দ্বারা সেগুলি বুঝাইয়া দেওয়া হইয়াছে এবং ইহাতে বিশেষভাবে ভক্তিমার্গের ও কিয়দংশে নিষ্কাম কর্মেরও শ্ৰীশঙ্করাচার্য অপেক্ষা উত্তম বিচার করা হইয়াছে । জ্ঞানেশ্বর মহারাজ নিজে যোগী ছিলেন । তাই, গীতার ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের যে শ্লোকে পাতঞ্জল-যোগাভ্যাসের বিষয় আসিয়াছে, তৎসম্বন্ধে তিনি এক বিস্তৃত টীকা করিয়াছেন । তাঁহার বক্তব্য এই যে, ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ এই অধ্যায়ের শেষে “তস্মাদ্যোগী ভবাৰ্জুন” । অতএব হে অর্জুন তুমি যোগী হও [গী|৬|৪৯], অর্জুনকে এইরূপ বলিয়া সমস্ত মোক্ষপন্থার মধ্যে পাতঞ্জলযোগই সৰ্বোৎকৃষ্ট নির্দিষ্ট করিয়াছেন এবং এই কারণে নিজে উহাকে ‘পন্থরাজ’ বলিয়াছেন ।
5.7) গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি বর্জনীয়
সার কথা এই যে, ভিন্ন ভিন্ন সাম্প্রদায়িক ভাষ্যকার, ও টীকাকারগণ গীতার অর্থ আপনাপন মতের অনুকুল স্থির করিয়া লইয়াছেন । প্রত্যেক সম্প্রদায়ের এই কথা যে, গীতার উপদিষ্ট প্রবৃত্তিপর কর্মমার্গ গৌণ, অর্থাৎ জ্ঞানের একমাত্র সাধন; গীতাতে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের স্বীকৃত তত্ত্বজ্ঞানই পাওয়া যায়; আপন সম্প্রদায়ের মোক্ষদৃষ্টিতে শেষের কর্তব্য বলিয়া যে সকল আচার স্বীকৃত হইয়াছে, সেই সকলই গীতাতে বর্ণিত হইয়াছে । অর্থাৎ মায়াবাদাত্মক অদ্বৈতবাদ ও কর্মসন্ন্যাস, মায়াসত্যত্বপ্ৰতিপাদক বিশিষ্টাদ্বৈত ও বাসুদেবভক্তি, দ্বৈত ও বিষ্ণুভক্তি, শুদ্ধাদ্বৈত ও ভক্তি, শাঙ্করাদ্বৈত ও ভক্তি, পাতঞ্জল-যোগ ও ভক্তি, কেবল ভক্তি, কেবল যোগ, কেবল ব্ৰহ্মজ্ঞান, এইরূপ অনেক প্রকারের কেবলমাত্র নিবৃত্তিপর মোক্ষধর্মই গীতার প্ৰধান ও প্ৰতিপাদ্য বিষয় । (ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের আচাৰ্যদিগের গীতাসম্বন্ধীয় ভাষ্য ও সেই সেই সম্প্রদারের ছোট বড় সমস্ত মিলিয়া ১৫টি প্রধান প্রধা টীকা, বোম্বায়ে “গুজরাটী প্রিস্টিং প্রেসের” কর্তা সম্প্রতি একত্র ছাপাইয়াছেন । ভিন্ন ভিন্ন টীকাকারদিগেয় অভিপ্ৰায় একযোগে অবগত হইবার পক্ষে এই গ্রন্থটী বড়ই সুবিধাজনক ।)
ইহা শুধু আমাদেরই মত নহে, প্ৰসিদ্ধ মহারাষ্ট্র কবি বামন পণ্ডিতেরও মত এইরূপ । গীতাসম্বন্ধীয় তাঁহার “যথার্থদীপিকা” নামক বিস্তৃত মারাঠী টীকার উপোদ্ঘাতে তিনি প্রথমে লিখিয়াছেন -
পরী অজী ভগবন্তজী ৷ য়া কলিযুগ মাজী ॥“হে ভগবান, এই কলিযুগে যে যে গীতাৰ্থ যোজিত হইয়াছে, তাহা নিজ নিজ মতানুরূপ । এবং পুনরায় আক্ষেপ পূর্বক লিখিতেছেন যে,
জো জো গীতাৰ্থ যোজী ৷ মতানুরূপ ॥
কোণ্যা মিসেঁ তরী কোণী ৷ গীতাৰ্থ অন্যথা বাখাণী ॥“কোন কারণে কোন কোন লোক, গীতার্থের অন্যথা ব্যাখ্যা করিয়াছেন, ঐ বড় লোকদের কাজ আমার ভাল লাগে না, কি করিব ভগবান” । অনেক সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের ভিন্ন ভিন্ন মতের এইরূপ তুমুল কোলাহল দেখিয়া তৎসম্বন্ধে কেহ কেহ এই কথা বলেন যে, যেহেতু এই সমস্ত মোক্ষসম্প্রদায় পরস্পরবিরোধী, এবং গীতায় কি প্ৰতিপাদিত হইয়াছে নিশ্চয় করিয়া কোন সম্প্রদায়ই তাহা বলিতে পারে নাই, অতএব ইহাই স্বীকার করিতে হয় যে, এই সকল মোক্ষসাধনের, বিশেষতঃ কর্ম, ভক্তি ও জ্ঞান এই তিনের বর্ণন স্বতন্ত্র প্রণালীতে সংক্ষেপে ও পৃথক পৃথক করিয়া ভগবান রণভূমির উপর ঠিক যুদ্ধের আরম্ভে, অনেক প্রকার মোক্ষোপায়ের গোলযোগের মধ্যে পড়িয়া বিভ্রান্তচিত্ত অর্জুনকে উপদেশ করিয়াছিলেন । কেহ কেহ এইরূপও বলেন যে, মোক্ষের অনেক উপায়ের এই সকল বর্ণনা পৃথক পৃথক নহে, কিন্তু এই সকলের একতাই গীতায় দেখান হইয়াছে । এবং সর্বশেষে কেহ কেহ একথাও বলেন যে, গীতার প্রতিপাদিত ব্ৰহ্মবিদ্যা উপরি উপরি যদিও সুলভ বলিয়া মনে হয়, তথাপি তাহার প্রকৃত মর্ম অতীব গূঢ়; গুরুমুখ ব্যতীত তাহা কেহ অবগত হইতে পারে না [গী|৪|৩৪] এবং গীতার টীকা যদিও অনেক হইয়াছে তথাপি গীতার গূঢ়াৰ্থ বুঝিবার পক্ষে গুরুদীক্ষা ব্যতীত অন্য পন্থা নাই ।
যজনাবডে তো থোরামতীহি করণী ৷ কায় করুঁ জী ভগবন্তা ॥
এক্ষণে ইহা সুস্পষ্ট যে গীতার অনেক প্রকার তাৎপৰ্য ব্যাখ্যাত হইয়াছে । প্ৰথমেই তো স্বয়ং মহাভারতকার ভাগবতধর্মানুসারী অর্থাৎ প্ৰবৃত্তিপর তাৎপৰ্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন । তাহার পর আবির্ভূত অনেক পণ্ডিত, আচার্য, কবি, যোগী ও ভগবদ্ভক্তগণ নিজ নিজ সম্প্রদায়ানুরূপ শুদ্ধ নিবৃত্তিপর তাৎপৰ্য প্ৰতিপাদন করিয়াছেন । ভগবদ্গীতার এইরূপ অনেক প্রকার তাৎপৰ্য দেখিয়া যে কোন ব্যক্তি বিভ্ৰান্তচিত্ত হইয়া স্বভাবতই এইরূপ প্রশ্ন করিতে পারে যে, এই পরস্পরবিরোধী নানাবিধ তাৎপৰ্য একই গ্ৰন্থ হইতে বাহির করা যাইতে পারে কি ? বাহির করা যাইতে পারে শুধু নয়, উহাতে ইষ্টও আছে এইরূপ যদি কেহ বলে, তবে এইরূপ হইবার হেতু কি ? বিভিন্ন ভাষ্যকার আচার্য, বিদ্বান, ধার্মিক ও অত্যন্ত সাত্ত্বিক প্ৰকৃতির লোক ছিলেন সে বিষয়ে কিছুমাত্র সংশয় নাই । শ্ৰীশঙ্করাচার্যের মত মহাতত্ত্বজ্ঞানী আজ পৰ্যন্ত জগতে আবির্ভূত হয় নাই বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না । তবে আবার তাঁহার সহিত পরবর্তী আচাৰ্যদিগের এতটা মতভেদ কেন ? গীতাতো একটা ভোজবাজী নহে যে তাহা হইতে যে যাহা খুশি একটা অৰ্থ বাহির করিবে । উপরি-উক্ত সম্প্রদায়সমূহের আবির্ভাবের পূর্বেই গীতা রচিত হইয়াছিল । অর্জুনের ভ্রম বাড়াইবার জন্য নহে, পরন্তু তাঁহার ভ্ৰম দূর করিবার জন্যই শ্ৰীকৃষ্ণ এই গীতা অর্জুনের নিকট বিবৃত করিয়াছিলেন । গীতাতে একই বিশিষ্ট প্রকারের নিশ্চিত তাৎপর্যের উপদেশ করা হইয়াছে, এবং অর্জুনের উপর তাহার অভীষ্ট পরিণামফলও হইয়াছে । ইহার পরেও গীতার তাৎপৰ্য লইয়া এতটা গোলযোগ কেন হইয়া চলিয়াছে ? প্রশ্নটি কঠিন বলিয়া মনে হয় সত্য । কিন্তু উহার উত্তর প্রথম দৃষ্টিতে যতটা কঠিন বলিয়া মনে হয় আসলে ততটা কঠিন নহে । মনে কর, কোন সুমিষ্ট ও সুরস পক্কান্ন দেখিয়া নিজ নিজ রুচি অনুসারে, যদি বা কেহ তাহাকে গমের, কেহ বা ঘৃতের এবং কেহ বা চিনির পক্কান্ন বলে, তাহা হইলে আমরা কোনটা মিথ্যা বলিয়া স্বীকার করিব ? তিনই আপন আপন হিসাবে সত্য । কিন্তু এই প্রশ্নের মীমাংসা হইল না যে পক্কান্নটী কোন্ বস্তু দ্বারা প্ৰস্তুত হইয়াছে । গম, ঘৃত ও চিনি এই তিন পদার্থই একত্র মিলিত হইয়া তাহা হইতে লাড্ডু, জিলেপী, মোতিচুর ইত্যাদি অনেক প্রকার পক্কান্ন প্ৰস্তুত হইতে পারে, সুতরাং তাহার মধ্যে পক্কান্নটি কোন পদার্থ দ্বারা প্ৰস্তুত, তাহা নির্ণয় করিতে হইলে, উহা গোধূমপ্রধান, ঘৃতপ্রধান কিংবা শর্করাপ্রধান, শুধু এইরূপ বলিলেই চলিবে না । সমুদ্রমন্থনের সময় কেহ বা অমৃত, কেহ বা বিষ, আবার কেহ কেহ বা ঐরাবত, কৌস্তুভ, পারিজাত প্ৰভৃতি বিভিন্ন বস্তু লাভ করিয়াছিলেন, তবু তাহা দ্বারা সমুদ্রের বাস্তবিক স্বরূপ নিৰ্ণয় হয় নাই । সাম্প্রদায়িকভাবে গীতাসাগরের মন্থনকারী টীকাকারদিগের অবস্থাও ঠিক সেইরূপ । আর একটা উদাহরণ দিই । কংসবধের সময় রঙ্গমণ্ডপে অবতীর্ণ একই ভগবান শ্ৰীকৃষ্ণ যেরূপ প্ৰত্যেক দর্শকের নিকট বিভিন্ন স্বরূপে অৰ্থাৎ মল্লের নিকট বজ্রসদৃশ, স্ত্রীলোকের নিকট কামদেবসদৃশ, আপন মাতাপিতার নিকট পুত্রসদৃশ প্রতিভাত হইয়াছিলেন, সেইরূপ ভগবদ্গীতা এক হইলেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিকট উহা বিভিন্নরূপে প্ৰতীয়মান হইয়াছে এইরূপ বলা যাইতে পারে । যে কোন ধর্মসম্প্রদায়ের কথা ধর না কেন, সে সম্প্রদায় একটা সাধারণত প্ৰামাণিক ধর্মগ্রন্থের অনুসরণ করিবেই করিবে, ইহা ত স্পষ্টই দেখা যায় । কারণ, তাহা না হইলে ঐ সম্প্রদায় একেবারেই অপ্ৰমাণ বিবেচিত হইয়া সকল লোকের নিকটেই অমান্য হইবে । এইজন্য বৈদিক ধর্মের যত সম্প্রদায়ই হউক না কেন, কোন বিশেষ বিষয়, যথা, ঈশ্বর, জীব ও জগৎ ইহাদের পরস্পরসম্বন্ধ, বাদ দিলে বাকী বিষয়ে সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রায়ই মিল হয় । সেইজন্য আমাদের ধর্মের প্রামাণিক গ্রন্থাদির উপর যে সকল সাম্প্রদায়িক ভাষ্য বা টীকা আছে, সেগুলিতে মূলগ্রন্থের শতকরা নব্বইয়ের অধিক বচন বা শ্লোর্কের ভাবার্থ একই । যাহা কিছু ভেদ, তাহা অবশিষ্ট বচন বা শ্লোক সম্বন্ধেই দেখা যায় । ঐ সকল বচনের সরল অর্থ গ্ৰহণ করিলেও উহা সকল সম্প্রদায়ের পক্ষে সমান অনুকুল হইবে ইহা সম্ভবপর নহে । এই কারণে ইহার মধ্যে যে সকল বচন নিজ সম্প্রদায়ের অনুকুল সেই গুলিই প্রধান ও অন্যগুলি গৌণ বলিয়া স্বীকার করিয়া, অথবা প্রতিকুল বচনগুলির অর্থ যে কোন যুক্তির দ্বারা অন্যথা করিয়া যতটা সম্ভব সহজ ও সরল বচনাদি হইতেও নিজ নিজ অনুকুল শ্লেষার্থ ও অনুমান বাহির করিয়া, নিজ সম্প্রদায় যাহাতে সেই সকল প্ৰমাণের বলে সিদ্ধ হয়, বিভিন্ন সাম্প্রদারিক টীকাকারগণ তাহাই প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন । তাহার উদাহরণ স্বরূপ গীতা, ২|১২ ও ১৬, ৩|১৯; ৬|৩ এবং ১৮|২ শ্লোকগুলির উপর আমার টীকা দেখ । কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক রীতি অনুসারে কোন গ্রন্থের তাৎপৰ্য নিরূপণ করা, আর নিজ সম্প্রদায় গীতাতে প্ৰতিপাদিত হইয়াছে এইরূপ কিংবা অন্য কোনরূপ অভিমান না রাখিয়া স্বতন্ত্র রীতিতে প্ৰথমে সমগ্র গ্রন্থের পরীক্ষা করিয়া কেবল তাহা হইতে সার অর্থ বাহির করা - এই দুই বিষয় স্বভাবতই অত্যন্ত ভিন্ন, ইহা সহজেই উপলব্ধি হইবে ।
6) গ্রন্থ তাৎপৰ্য নির্ণয়ে মীমাংসিকদিগের পন্থা
গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টি সদোষ বলিয়া পরিত্যক্ত হইল; এখন তবে গীতার তাৎপৰ্য বাহির করিবার অন্য উপায় কি আছে তাহা বলা আবশ্যক । গ্ৰন্থ, প্রকরণ ও বাক্য এই সকলের অর্থনির্ণয় কাৰ্যে অত্যন্ত কুশল মীমাংসিকদিগের এই সম্বন্ধে সর্বমান্য এক পুরাতন শ্লোক নিম্নে উদ্ধৃত করিতেছি :-
উপক্ৰমোপসংহারৌ অভ্যাসোহপূর্বতা ফলম্ ৷মীমাংসাকার বলিতেছেন যে, কোন লেখার, প্রকরণের কিংবা গ্রন্থের তাৎপৰ্য বাহির করিতে হইলে উদ্ধৃত শ্লোকোক্ত সাতটি বিষয় উপায়-স্বরূপ (লিঙ্গ) হওয়ায় ঐ সাত বিষয়ের বিচার করা নিতান্তই আবশ্যক -
অর্থবাদোপপত্তী চ লিঙ্গং তাৎপৰ্যনির্ণয়ে ॥
(i) & (ii) তন্মধ্যে সর্বপ্রথম বিচার্য ‘উপক্ৰমোপসংহারৌ’ অর্থাৎ গ্রন্থের আরম্ভ ও শেষ এই দুই বিষয় । প্ৰত্যেক মনুষ্যই মনোমধ্যে কোন বিশিষ্ট হেতু ধরিয়া গ্ৰন্থ লিখিতে আরম্ভ করেন; এবং উক্ত বিশিষ্ট উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইলে পর গ্ৰন্থ সমাপ্ত করেন । এইজন্য, গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়কাৰ্যে প্রথমেই গ্রন্থের উপক্রম ও উপসংহারের প্রতি লক্ষ্য করা আবশ্যক । সরল রেখা ব্যাখ্যা করিবার সময়, ভূমিতি শাস্ত্রে এইরূপ বলা হইয়া থাকে যে, আরম্ভের বিন্দু হইতে যে রেখা দক্ষিণে-বামে কিংবা উপরে-নীচে না বাঁকিয়া শেষের বিন্দু পৰ্যন্ত বরাবর সমান যায় তাহাকে সরল রেখা বলে । গ্রন্থের তাৎপৰ্যনির্ণয়েও এ নিয়ম প্ৰযুক্ত হইতে পারে । যে তাৎপৰ্য গ্রন্থের আরম্ভে ও শেষে স্পষ্টরূপে প্ৰকাশ পায়, তাহাই গ্রন্থের সরল তাৎপৰ্য । প্রারম্ভ হইতে শেষ পৰ্যন্ত যাইবার অন্য অন্য পথ থাকিলেও সে সব বাকী পথ বা আড়-পথ বলিয়া বুঝিতে হইবে ।
(iii) এইরূপে আদ্যন্ত দেখিয়া গ্রন্থের তাৎপৰ্য নির্ণয় করিবার পর সেই গ্রন্থে ‘অভ্যাস’ বা পুনরুক্তি কিরূপ করা হইয়াছে, অর্থাৎ পুনঃপুনঃ কি বলা হইয়াছে ইহা দেখিতে হইবে । কারণ, গ্ৰন্থকার যে বিষয় সিদ্ধ কমিতে চাহেন, তাহার সমর্থনার্থ তিনি অনেক সময় অনেক কারণ দেখাইয়া প্ৰত্যেকবার “অতএব এই বিষয় সিদ্ধ হইল” কিংবা “অতএব ইহা করা আবশ্যক” এইরূপ একই সিদ্ধান্ত পুনঃপুনঃ বলিয়া থাকেন ।
(iv) গ্ৰন্থতাৎপৰ্য বাহির করিবার চতুর্থ ও পঞ্চম সাধন ‘অপূর্বতা’ ও ‘ফল’ । ‘অপূর্বতা’ অর্থাৎ নূতনত্ব। যে কোন গ্ৰন্থকার হউন, একটা কিছু নূতন বলিবার কথা না থাকিলে, প্রায়ই তিনি নূতন গ্ৰন্থ লিখিতে প্ৰবৃত্ত হন না । অন্তত যে সময় ছাপাখানা ছিল না, সে সময় এরূপ হইত না । এইজন্য কোন গ্রন্থের তাৎপৰ্য নির্ণয় করিবার পূর্বে, সেই গ্রন্থে অপূর্বতা, বৈশিষ্ট, কিংবা নূতনত্ব কি আছে তাহাও দেখা আবশ্যক ।
(v) এই প্রকারে সেই লেখা বা গ্রন্থের কোন ফল অর্থাৎ উক্ত লেখা বা গ্রন্থের দরূণ কোন পরিণাম সঙ্ঘটিত হইয়া থাকিলে সে দিকেও বিশেষ লক্ষ্য রাখা আবশ্যক । কারণ এই ফল মিলিবে কিংবা হইবে মনে করিয়াই যখন কোন গ্ৰন্থ লেখা হইয়া থাকে, তখন সংঘটিত পরিণামের উপর মনোযোগ দিলেই গ্ৰন্থকারের অভিপ্ৰায় খুবই স্পষ্টরূপে ব্যক্ত হইবে ।
(vi) ষষ্ঠ সাধন ও সপ্তম সাধন কি ? না – ‘অর্থবাদ’ ও ‘উপপত্তি’ । ‘অর্থবাদ’ এই শব্দটি মীমাংসকদিগের পারিভাষিক শব্দ [জৈ|সু|১|২|১-১৮] । মুখ্যত কোন বিষয়ের বিধান করিতে হইবে অথবা কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিতে হইবে ইহা নির্ধারিত হইলেও গ্ৰন্থকার প্রসঙ্গক্রমে আরও অনেক বিষয়ের বর্ণনা করিয়া থাকেন । প্ৰতিপাদনের মুখে দৃষ্টান্ত দিবার জন্য, তুলনা করিয়া একবাক্যতা সম্পাদনার্থ অথবা সাম্য ও ভেদ প্রদর্শনার্থ, প্রতিপক্ষের দোষ দেখাইয়া স্বপক্ষ সমর্থনাৰ্থ, অলঙ্কারার্থ, অতিশয়োক্তির ভাবে এবং যুক্তিবিন্যাসের পরিপোষক কোন বিষয়ের পূর্ব ইতিহাসের সম্বন্ধসূত্রে অন্য অনেক বিষয় বর্ণিত হয় । উক্ত কারণ বা প্রসঙ্গসমূহের অতিরিক্ত অন্যান্য কারণও থাকিতে পারে, এবং কখনো কখনো বিশেষ কোনই কারণ থাকেও না । এরূপ স্থলে গ্ৰন্থকার যাহা বৰ্ণনা করেন, তাহা মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত না হইলেও গৌরবার্থ বা স্পষ্টীকরণার্থ কিংবা পূর্ণতা সম্পাদনার্থ করা হয় বলিয়া তাহা সকল সময়ে যে অক্ষরশ সত্য হইবে এরূপ কোন নিয়ম নাই । (অর্থবাদান্তর্ভূত বর্ণনা, বস্তুস্থিতিমূলক বর্ণনা হইলে তাহাকে ‘অনুবাদ’; বস্তুস্থিতির বিরুদ্ধ হইলে তাঁহাকে ‘গুণাবাদ’ এবং পূর্বে বস্তুস্থিতি ধরিয়া কিন্তু আপাতত বস্তুস্থিতি ছাড়িয়া দিয়া যে বর্ণনা তাহাঁকে "ভূতাৰ্থবাদ’ বলে । অর্থবাদের এই তিন বিভিন্ন নাম ‘অর্থবাদ” এই সামান্য শব্দের অন্তৰ্গত নিবন্ধাদির সত্যাসত্য অনুসারে এই তিন ভেদ ।) কিং বহুনা, এই অপ্রধান বর্ণনা অক্ষরশসত্য কি সত্য নহে ইহা দেখিবার জন্য কখন কখন গ্ৰন্থকার স্বয়ংও সাবধানতা অবলম্বন করেন না । এইজন্য ঐ সকল কথা প্ৰামাণ্য স্বীকার করা যায় না; অর্থাৎ ইহা স্বীকার করা যায় না যে, গ্ৰন্থকারের সিদ্ধান্তপক্ষের সঙ্গে এই বিভিন্ন বিষয়ের কোন বিশেষ সম্বন্ধ আছে । উহা কেবল প্ৰশংসাবাদ অর্থাৎ শূন্যগর্ভ, আগন্তুক বা স্তুতিবাচক, এইভাবে গ্ৰহণ করিয়া মীমাংসকগণ উহাকে ‘অর্থবাদ’ এই নাম দিয়া থাকেন, এবং এই অর্থবাদাত্মক কথাগুলি ছাড়িয়া দিয়া পরে গ্রন্থের তাৎপৰ্য নির্ধারণ করিয়া থাকেন ।
(vii) ইহার পর, উপপত্তির প্রতি মন দিতে হইবে । কোন বিশিষ্ট বিষয়কে সিদ্ধরূপে দেখাইবার জন্য তৰ্কশাস্ত্ৰানুসারে বাধক প্রমাণের খণ্ডন করা এবং সাধক প্রমাণের অনুকুল বিন্যাস করাকে ‘উপপত্তি’ বা ‘উপপাদন’ বলে । উপক্রম ও উপসংহাররূপ দুই সীমান্ত প্ৰথমে দৃঢ়প্ৰতিষ্ঠিত হইলে পর, মধ্য পথটা অর্থবাদ ও উপপত্তির সহায়তায় সুনিশ্চিত করিতে পারা যায় । কোন্ বিষয়টি অপ্ৰস্তুত ও আনুষঙ্গিক (অপ্রধান) ইহা অর্থবাদের সাহায্যে বুঝা যায় । অর্থবাদের একবার নির্ণয় হইলে পর, যে ব্যক্তি গ্রন্থতাৎপর্য নির্ণয় করিতে চাহেন তিনি সমস্ত বাঁকা পথ ছাড়িয়া দেন । পাঠক যখন এইরূপে বাঁকা পথ ছাড়িয়া সরল ও প্রধান রাস্তায় আসেন তখন উপপত্তির সরল পথ সাগর-তরঙ্গের ন্যায় পাঠককে কিংবা গ্ৰন্থসমালোচককে প্রথম হইতেই সম্মুখে ক্রমশ ধাক্কা দিতে দিতে শেষের তাৎপর্যে সোজা আনিয়া তবে ছাড়ে । আমাদের প্রাচীন মীমাংসকদিগের স্থিরীকৃত গ্ৰন্থতাৎপৰ্যনির্ণয়ের এই নিয়ম সর্বদেশীয় বিদ্বানদিগের সমান অভিমত হওয়ায় উহার উপযোগীতা ও আবশ্যকতা সম্বন্ধে বেশী বিচার আলোচনার প্রয়োজন নাই । (গ্ৰন্থতাৎপর্যের এই নিয়ম ইংরাজি আদালতেও পালিত হইয়া থাকে । যেমন মনে কর, কোন বিচারনিষ্পত্তির অর্থ ঠিক বুঝা না গেলে, ঐ বিচারনিষ্পত্তির ফল যে হুকুমনামায় আছে তাহা দেখিয়া নিষ্পত্তির অর্থ নিৰ্ণয় করা হয় এবং কোন নিষ্পত্তির অন্তৰ্গত উদ্দেশ্য নির্ণয় করিবার আবশ্যকতা নাই এইরূপ কোন বিধান থাকিলে উহা পরবর্তী মোকদ্দমায় প্রমাণ বলিয়া গণ্য হয় না । এইরূপ বিধানকে (obiter dicta) কিংবা ‘বাহ্য বিধান’ বলে এবং বাস্তবপক্ষে দেখিতে গেলে ইহা অর্থবাদেরই প্ৰকারান্তর মাত্র ।)
6.1) সম্প্রদায় প্ৰবর্তকদের সঙ্কুচিত দৃষ্টি
এ সম্বন্ধে কেহ এরূপ সন্দেহ করিতে পারৈন যে, মীমাংসকদিগের এই নিয়ম কি সম্প্রদায় প্ৰবর্তক আচার্যদিগের জানা ছিল না ? এবং তাঁহাদের গ্রন্থাদির মধ্যেও যদি এই সকল নিয়ম পাওয়া যায়, তবে তাঁহাদের উপদিষ্ট গীতাতাৎপৰ্য একদেশীয়তা-দোষে দুষ্ট মনে করিবার কারণ কি ? তাহার উত্তর এই যে, কাহারো দৃষ্টি একবার সাম্প্রদায়িক (সঙ্কুচিত) হইয়া পড়িলে আর তিনি ব্যাপকতা স্বীকার করিতে পারেন না । তখন তিনি কোন না কোন প্রকারে ইহা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করেন যে প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থসমূহের মধ্যে নিজ সম্প্রদায়েরই বর্ণনা আছে । নিজ সম্প্রদায়প্ৰসিদ্ধ ব্যতীত উক্ত গ্রন্থের অন্য কোন অর্থ হইলেও উহা সত্য নহে, তাহাতে কোন-না-কোন স্বতন্ত্ৰ হেতু আছে, এই সকল গ্রন্থের তাৎপৰ্যসম্বন্ধে সাম্প্রদায়িক টীকাকারদিগের পূর্ব হইতেই এই দৃঢ় ধারণা হইয়া থাকে । নিজ মতানুযায়ী যে অর্থ পূর্বেই সত্য বলিয়া তাঁহারা স্থির করিয়াছেন তাহাই সর্বত্ৰ প্ৰতিপাদিত আছে এইরূপ দেখাইতে গিয়া মীমাংসাশাস্ত্রের কোন নিয়মের বাধা আসিলেও উপরি-উক্ত দৃঢ় ধারণার দরুণ টীকাকারের ঐ সকল নিয়মের কোন গুরুত্ব আছে বলিয়া মনে করেন না । হিন্দু ধর্ম-শাস্ত্রান্তৰ্গত মিতাক্ষরা, দায়ভাগ প্রভৃতি গ্রন্থোক্ত স্মৃতি-বচনসমূহের ব্যবস্থা বা একবাক্যতা এই তত্ত্বানুসারে করা হয় । কিন্তু কেবল হিন্দুধর্মগ্রন্থাদিতেই যে এই প্রকার পাওয়া যায় তাহা নহে । খৃষ্টীয় ও মহম্মদীয় ধর্মের আদিগ্রন্থ বাইবেল ও কোরাণেরও পরবর্তীকালে আবির্ভূত শতশত সাম্প্রদায়িক গ্ৰন্থকারগণ এইরূপেই উহাদের অর্থান্তর ঘটাইয়াছেন এবং এই বাইবেলের পুরাতন অঙ্গীকারের অন্তর্গত কতকগুলি বাক্যের অর্থ ইহুদি লোকদিগের অর্থ হইতে খৃষ্টভক্তিরা ভিন্নরূপে নির্ধারিত করিয়াছেন । এ পর্যন্ত দেখা যাইতেছে যে, কোন বিষয় সম্বন্ধে প্ৰামাণিক গ্ৰন্থ কিম্বা লেখা কোন্টি, ইহা যে যে স্থলে পূর্ব হইতেই স্থিরনির্দিষ্ট হইয়াছে এবং যেখানে এই নির্দিষ্ট প্রামাণিক গ্রন্থের প্রমাণ-বলে পরবস্ত্রী সমস্ত বিষয়ের নির্ণয় করা হইয়া থাকে, সেই সেই স্থলে গ্রন্থার্থনির্ণয়ের উপরোক্ত পদ্ধতিই স্বীকৃত হইয়া থাকে দেখিতে পাওয়া যায় । এখনকার বড় বড় আইন-পণ্ডিত, উকীল ও বিচারপতি, ইহাঁরা পূর্বেকার প্রামাণিক আইন-গ্ৰন্থাদিকে কিংবা বিচার নিষ্পত্তির সম্বন্ধে আপনি আপনি দিকে যেরূপভাবে টানিয়া থাকেন, তাহারও মধ্যে এই রহস্য নিহিত আছে । যদি শুধু লৌকিক বিষয়ের সম্বন্ধেই এই অবস্থা হয়, তবে আমাদের ধর্মগ্রন্থ উপনিষদ, বেদান্তসূত্র এবং তাহারই সমান প্ৰস্থানত্রয়ীর অন্তৰ্গত তৃতীয় গ্ৰন্থ ভগবদ্গীতা সম্বন্ধেও যে এই প্রকার সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখিবার কারণে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনেক ভাষ্য ও টীকা হইয়াছে ইহাতে বিস্মিত হইবার কোন কারণ নাই ।
6.2) মীমাংসকদিগের পদ্ধতি অনুসারে ভগবদ্গীতার তাৎপৰ্য নির্ণয়
কিন্তু এই সাম্প্রদায়িক পদ্ধতি ছাড়িয়া উপযুক্ত মীমাংসকদিগের পদ্ধতি অনুসারে ভগবদ্গীতার উপক্রম, উপসংহারাদির দিকে দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাওয়া যাইবে যে, ভারতীয় যুদ্ধ প্ৰত্যক্ষ আরম্ভ হইবার পূর্বে যখন কুরুক্ষেত্রে দুই পক্ষের সৈন্য যুদ্ধে সজ্জিত হইয়া পরস্পরের উপর শস্ত্ৰসম্পাতে উদ্যত, এবং সেই অবসরে একাদিক্ৰমে অর্জুন ব্ৰহ্মজ্ঞানের বড় বড় কথা বিবৃত করিয়া ‘বিমনস্ক’ হইয়া সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য প্ৰস্তুত হইয়াছিলেন, তখনই অর্জুনকে স্বীয় ক্ষত্রিয়ধর্মে প্ৰবৃত্ত করিবার জন্য, ভগবান গীতার উপদেশ করিয়াছেন । যখন অর্জুন দেখিতে লাগিলেন যে দুষ্ট দুর্যোধনের সহায় হইয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য কে কে আসিয়াছে, তখন বৃদ্ধপিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণাচার্য ও গুরুপুত্ৰ অশ্বথামা, প্ৰতিপক্ষ হইলেও আত্মীয় কৌরব এবং অন্যান্য সুহৃদ, আত্মজন, মামা, কাকা, ভগ্নীপতি, শ্যালক, রাজা, রাজপুত্র প্রভৃতি তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইল । কেবল এক ক্ষুদ্র হস্তিনাপুরের রাজ্যলাভার্থ ইহাঁদিগকে বধ করিয়া নিজ কুলক্ষয়াদি মহাপাপ করিতে হইবে এই বিচার তাহার মনে উদিত হওয়ায় তাহার হৃদয় একেবারে ক্ষুব্ধ হইল । একদিকে ক্ষাত্ৰধর্ম “যুদ্ধ কর” বলিতেছিল, এবং অন্যদিকে পিতৃভক্তি, গুরুভক্তি, বন্ধুপ্ৰেম, সুহৃৎপ্রীতি তাঁহাকে পিছনে টানিতেছিল । যদি যুদ্ধ করি তাহা হইলে পিতামহ গুরু ও আত্মীয়দিগকে হত্যা করিয়া ঘোর পাতকে পতিত হইতে হইবে, আর যদি না করি তবে ক্ষাত্ৰধর্মকে লঙ্ঘন করা হইবে । এইরূপ একদিকে গর্ত আর একদিকে কূপ দেখা দিলে পর, দুই ম্যাড়ার গুঁতার মধ্যে পড়িয়া কোন নিরূপায় প্রাণীর যে অবস্থা হয়, অর্জুনের সেই অবস্থা হইয়াছিল । অর্জুন খুব বড় যোদ্ধা ছিলেন সত্য; কিন্তু ধর্মাধর্মের সেই নৈতিক সঙ্কটে অকস্মাৎ পতিত হওয়ায় তাঁহার মুখ শুকাইয়া গেল, গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল, হাতের ধনু খসিয়া পড়িল । এবং “আমি যুদ্ধ করিব না” বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তিনি রথে আড়ষ্ট হইয়া রহিলেন । শেষে মানুষ্যের যাহা স্বভাবতই বেশী প্রিয়, সেই মমতা অর্থাৎ নিকটবর্তী বন্ধুস্নেহ, দূরবর্তী ক্ষাত্রধর্মের স্থান অধিকার করায়, মোহবশে তিনি এইরূপ বলিতে লাগিলেন যে, “পিতৃবধ, গুরুবধ, বন্ধু্বধ, সুহৃবধ, অধিক কি সমগ্ৰ কুলক্ষয় প্রভৃতি ঘোরতর পাপ করিয়া রাজ্যলাভাপেক্ষা উদরপুর্তির জন্য ভিক্ষা করা কি মন্দ ? শত্রু এ সময় আমাকে নিরস্ত্ৰ দেখিয়া আমার গলা কাটিয়া ফেলে, সেও ভাল; কিন্তু যুদ্ধে আত্মীয়দিগের বধসাধন করিয়া তাঁহাদের রক্তে কলঙ্কিত ও অভিশাপগ্ৰস্ত হইয়া আমি সুখভোগ ইচ্ছা করি না ! ক্ষাত্ৰধর্ম হইল তা কি হইল ? তার জন্য পিতৃবধ, বন্ধুবধ ও গুরুবধরূপ ভয়ঙ্কর পাতক যদি করিতে হয় তবে পুড়ে যাক সে ক্ষাত্ৰধর্ম, আগুন লাগুক সেই ক্ষাত্ৰনীতির মুখে ! প্ৰতিপক্ষ এ বিষয়ে ভ্ৰক্ষেপ না করিলেও, তাহারা দুর্জন হইলেও, এইরূপ আচরণ আমার পক্ষে উচিত নহে । আমার আত্মার কিসে প্রকৃত কল্যাণ হয় তাহাই আমার দেখা আবশ্যক । আমার যখন মনে হইতেছে এইরূপ ঘোর পাতক করা শ্ৰেয়স্কর নহে তখন ক্ষাত্ৰধর্ম যতই শাস্ত্রোক্ত ধর্ম হউক না কেন, এই প্রসঙ্গে তাহা আমার কি কাজে আসিবে ?”
এইরূপে তাহার মন চিন্তায় ক্ষতবিক্ষত হওয়ায়, ধর্মসম্মুঢ় হইয়া অর্থাৎ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হইলে ভগবান গীতা-উপদেশ দিয়া তাহাকে প্রকৃতিস্থ করিলেন; এবং তৎকালে যুদ্ধ করাই তাঁহার কর্তব্য হওয়ায়, ভীষ্মাদিকে বধ করিতে হইবে এই ভয়ে পরাঙ্মুখ অর্জুনকে শ্ৰীকৃষ্ণ স্বেচ্ছাক্রমে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত করিলেন । গীতা-উপদেশের রহস্য যদি উদঘাটন করিতে হয় তবে এই তাহার উপক্রম, উপসংহার ও পরিণাম ফল আলোচনা করা আবশ্যক । ভক্তির দ্বারা কিরূপে মোক্ষ লাভ হয়, কিংবা ব্ৰহ্মজ্ঞানের দ্বারা অথবা পাতঞ্জল যোগের দ্বারা কিরূপে তাহা লাভ করা যায়, ইত্যাদি নিবৃত্তিপর মার্গ কিংবা কর্মত্যাগরূপ সন্ন্যাসধর্মসম্বন্ধীয় প্রশ্নসমূহের কেবলমাত্র আলোচনা করিয়া কোন লাভ নাই । অর্জুনকে সন্ন্যাস-দীক্ষা দিয়া বৈরাগ্য অবলম্বনে ভিক্ষা করিবার জন্য বনে পাঠানো কিংবা কৌপীন ধারণ করিয়া ও নিন্বপত্ৰ খাইয়া আমরণ যোগাভ্যাস করিবার জন্য হিমালয়ে প্রেরণ করা শ্ৰীকৃষ্ণের মনোগত অভিপ্ৰায় ছিল না । অথবা ধনুর্বাণের বদলে হাতে করতাল, মৃদঙ্গ ও বীণা লইয়া সেই সকল বাদ্য-সহযোগে ভগবানের নাম কীর্তন করিতে করিতে প্ৰেমানন্দে পূর্ণ হইয়া কুরুক্ষেত্রের ধর্মভূমির উপর, ভারতবর্ষীয় ক্ষাত্রসমাজের সম্মুখে বৃহন্নলার ন্যায় আবার অর্জুনকে নৃত্যে প্ৰবৃত্ত করা ভগবানের উদ্দেশ্য ছিল না । এখন তো অজ্ঞাতবাস সম্পূর্ণ হইয়া গিয়াছে এবং কুরুক্ষেত্রের উপর অর্জুনের অন্যপ্রকার কঠোর নৃত্যের প্রয়োজন ছিল । গীতা বিবৃত করিবার সময় স্থানে স্থানে অনেক প্রকারের অনেক কারণ দেখাইয়া এবং শেষে ‘তস্মাৎ’ অর্থাৎ ‘অতএব’ এই পদ - অনুমানবাচক গৌরবাত্মক পদ ও প্রয়োগপূর্বক “তস্মাদ্যুধ্যস্ব ভারত” - হে অর্জুন, অতএব তুমি যুদ্ধ কর [গী|২| ১৮]; “তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ” - অতএব তুমি যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর [গী|২|৩৭] “তস্মাদসক্তঃ সততং কাৰ্য্যং কর্ম সমাচর” - অতএব তুমি আসক্তি ছাড়িয়া নিজ কর্তব্য কর্ম কর [গী|৩|১৮]; “কুরু কৰ্ম্মৈব তস্মাৎ ত্বং” - অতএব তুমি কর্মই কর [গী|৪|১৮]; “মামনুস্মর যুধ্য চ” - আমাকে স্মরণ কর ও যুদ্ধ কর [গী|৬|৭] “সর্বকর্তা ও কারয়িতা আমি, তুমি নিমিত্তমাত্র, অতএব যুদ্ধ কর ও শক্রকে জয় কর” [গী|১১|৩৩] “শাস্ত্রোক্ত কর্তব্য করা তোমার উচিত” [গী|১৬|১৪] - এইরূপ অর্জুনকে নিশ্চিতাৰ্থক কর্মপর উপদেশ করিয়া, অষ্টাদশতম অধ্যায়ের উপসংহারে পুনৰ্বার “এই সমস্ত কর্ম করা উচিত” [গী|১৮|৬] এইরূপ নিজের নিশ্চিত ও উত্তম মত ভগবান বিবৃত করিয়াছেন । এবং পরিশেষে, “অর্জুন ! তোমার অজ্ঞানমোহ এখন নষ্ট হইল কি না” ? [গী|১৮|৭২] এই প্রশ্নের উত্তরে অর্জুন শ্ৰীকৃষ্ণকে এই সন্তোষজনক উত্তর দিলেন -
নষ্টো মোহঃ স্মৃতিৰ্লব্ধা ত্বৎপ্ৰসাদান্ময়াচ্যুত ৷“হে অচ্যুত ! আমার কর্তব্যমোহ ও সংশয় নষ্ট হইয়াছে; এখন আমি তোমার কথামত কাজ করিব ।” ইহা অর্জুনের শুধু মুখের কথা মাত্র নহে । তাহার পর অর্জুন সত্য সত্যই যুদ্ধ করিয়া সংগ্রামে ভীষ্ম কৰ্ণ জয়দ্রথাদির বধসাধন করিলেন । এই বিষয়ে কেহ কেহ এইরূপ বলেন যে, ‘অর্জুনকে ভগবান যে উপদেশ দিয়াছেন তাহা নিবৃত্তিপর জ্ঞান, যোগ কিংবা ভক্তিমাত্রেরই উপদেশ এবং তাহাই গীতারও মুখ্য প্ৰতিপাদ্য বিষয় । কিন্তু যুদ্ধের আরম্ভ হইয়াছিল বলিয়া, মধ্যে মধ্যে কর্মের অল্পস্বল্প প্ৰশংসা করিয়া ভগবান অর্জুনকে ঐ যুদ্ধ সম্পূর্ণ করিতে দিয়াছিলেন । সুতরাং, যুদ্ধের সম্পূর্ণতা সাধনকে মুখ্য বিষয় না ধরিয়া আনুষঙ্গিক কিংবা অর্থবাদাত্মক বলিয়াই ধরিতে হইবে ।” কিন্তু এইরূপ তর্কযুক্তি অনুসারে গীতার উপক্রম, উপসংহার ও পরিণাম ফল ঠিক দাড়াইতে পারে না । স্বধর্মসম্বন্ধীয় কর্তব্য অনেক কষ্ট ও বাধা সহিয়াও আমরণ সাধন করিবার মহত্ব দেখানই এই স্থলে আবশ্যক ছিল । ইহা সিদ্ধ করিবার জন্য উপরি-উক্তরূপ আপত্তিকারীদিগের শূন্যগর্ভ কারণ গীতার মধ্যে কোথাও কথিত হয় নাই; কথিত হইলেও, অর্জুনের ন্যায় বুদ্ধিমান্ ও চৌকোস পুরুষ উহা কি প্রকারে গ্ৰহণ করিতেন ? তাঁহার মনে মুখ্য প্রশ্ন ইহাই ছিল যে, ভয়ঙ্কর কুলক্ষয় প্ৰত্যক্ষ করিলেও আমাকে যুদ্ধ করিতে হইবে কি না; এবং যুদ্ধ করিতে হইলেও কি প্রকারে পাপে না পড়িতে হয় । “নিষ্কাম বুদ্ধিতে যুদ্ধ কর” কিংবা “কর্ম কর” ঐ প্রশ্নের অর্থাৎ মুখ্য উদ্দেশ্যের এইরূপ উত্তরকে অর্থবাদ বলিয়া কখনই উড়াইয়া দিতে পারা যায় না, সেরূপ করা, আর নিজ যজমানের ঘরেই যজমানের অতিথি হইয়া থাকা একই কথা ! বেদান্ত, ভক্তি কিংবা পাতঞ্জল যোগ এই সমস্ত গীতায় যে একেবারেই উপদিষ্ট হয় নাই, একথা আমি বলি না । কিন্তু গীতায় এই যে, তিন বিষয়ের সম্মিলন করা হইয়াছে, তাহা কেবল এইরূপ হওয়া চাই যে, তাহার ফলে পরস্পরবিরুদ্ধ কঠিন সমস্যায় পড়িয়া “এটা করিব, কি ওটা করিব” এই প্ৰকার কর্তব্যবিমূঢ় অর্জুনের যাহাতে নিজ কর্তব্যের নিষ্পাপ পন্থা লাভ হইয়া ক্ষাত্রধর্মানুসারে স্বকীয় শাস্ত্রোক্ত কর্ম করিতে প্ৰবৃত্তি জন্মে ।
স্থিতোহস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব ॥
7) উপসংহার - প্ৰবৃত্তিধর্মের জ্ঞানই গীতার মূল বিষয়
তাৎপৰ্য এই যে, প্ৰবৃত্তিধর্মেরই জ্ঞান গীতার মূল বিষয় এবং অন্যান্য কথা তৎসিদ্ধির উদ্দেশ্যে কথিত ও আনুষঙ্গিক; সুতরাং গীতাধর্মের মে রহস্য তাহাও প্ৰবৃত্তিপর অর্থাৎ কর্মপরই হইবে, ইহাত স্পষ্টই রহিয়াছে । কিন্তু এই প্ৰবৃত্তিপর রহস্যটি কি এবং তাহা বেদান্তশাস্ত্ৰ হইতে কিরূপে নিষ্পন্ন হয়, কোন টীকাকারই তাহার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেন নাই । গীতার আদ্যন্ত উপক্রম ও উপসংহারের দিকে ঠিক লক্ষ্য না করিয়া, গীতার ব্ৰহ্মজ্ঞান বা ভক্তি নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কিরূপে অনুকূল হয়, নিবৃত্তিদৃষ্টিতে তাহাতেই টীকাকারগণ নিমগ্ন হইয়া গিয়াছেন দেখা যায় । যেন কর্মের সহিত জ্ঞান ও ভক্তির নিত্য-সম্বন্ধ স্থাপন করা একটা মহাপাপ ! আমি যে আশঙ্কার কথা বলিতেছি সেইরূপ আশঙ্কা এক জনের হওয়ায় তিনি আমাকে লিখিয়াছেন যে শ্ৰীকৃষ্ণের চরিত্র চক্ষের সম্মুখে রাখিয়া ভগব্দগীতার অর্থ করা উচিত । শ্ৰীক্ষেত্ৰ কাশীর সম্প্রতি সমাধিস্থ প্ৰসিদ্ধ অদ্বৈতী পরমহংস শ্ৰীকৃষ্ণানন্দ স্বামী, ‘গীতা-পরামর্শ’ নামে ভগবদ্গীতার সম্বন্ধে যে এক ক্ষুদ্র সংস্কৃত নিবন্ধ লিখিয়াছেন তাহাতে “তস্মাৎ গীতা নাম ব্ৰহ্মবিদ্যামূলং নীতিশাস্ত্ৰম্” - গীতা এই কারণে ব্ৰহ্মবিদ্যামূলক কর্তব্যধর্মশাস্ত্র এইরূপ স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করিয়াছেন । (শ্রীকৃষ্ণানন্দ স্বামীর শ্রীগীতা-রহস্য, গীতার্থ-প্রকাশ, গীতাপরামর্শ এবং গীতাসারদ্ধার এইরূপ এই বিষয়ে চারি ক্ষুদ্র নিবন্ধ আছে । সেগুলি সমস্তু একত্র করিয়া, রাজকোট ছাপান হইয়াছে । উপরিপ্রদত্ত বাক্য তাঁহার গীতাৰ্থপ্রকাশে আছে । এই টীকাকারের নাম এবং তাঁহার টীকা হইতে উদ্ধৃত কিয়দংশ বহু বৎসর পূর্বে একটি ভদ্রলোক আমাকে জানাইয়াছিলেন । কিন্তু ঐ পত্র আমার গোলযোগের সময় কোথায় যে গেল তাহা আর খুঁজিয়া পাইলাম না । এবং ঐ পত্র যদি কখন ঐ ভদ্রলোকটির চোখে পড়ে তাহা হইলে উক্ত বিষয়টি সম্বন্ধে তিনি যেন আমাকে আবার জানান তাঁহার নিকট আমার এই মিনতি ।)
জর্মন পণ্ডিত অধ্যাপক ডায়সন্ও স্বকীয় “উপনিষদের তত্ত্বজ্ঞান” গ্রন্থের এক স্থানে এইরূপ কথা বলিয়াছেন । আরো কতকগুলি পাশ্চাত্য ও প্ৰাচ্য গীতাসমালোচকও এই মত প্ৰকাশ করিয়াছেন । তথাপি তাঁহাদের মধ্যে কেহই সমগ্ৰ গীতাগ্রন্থের পর্যালোচনা করিয়া কর্মপর দৃষ্টিতে তদন্তর্ভূত সমস্ত বিষয় ও অধ্যায়ের যোগাযোগ কিরূপ তাহা স্পষ্ট করিয়া দেখাইবার প্রযত্ন করেন নাই; অধিকন্তু এই প্ৰতিপাদন কষ্টসাধ্য, এইরূপ ডায়সন স্বকীয় গ্রন্থে বলিয়াছেন । (Prof Deussen’s Philosophy of the Upanishads (p.362) English Translation-1906).
এই জন্য উক্ত প্ৰণালী অবলম্বনে গীতা পর্যালোচনা করিয়া উহার বিষয়সমূহের সঙ্গতি প্ৰদৰ্শন করা এই গ্রন্থের মুখ্য উদ্দেশ্য । কিন্তু তাহা করিবার পূর্বে, গীতার প্রারম্ভে পরস্পরবিরূদ্ধ নীতিধর্ম সমূহের কঠিন সমস্যা দেখিয়া অর্জুন যে সঙ্কটে পড়িয়াছিলেন, তাহার স্বরূপ আরো বেশী খোলসা করিয়া ব্যাখ্যা করা আবশ্যক । নচেৎ গীতান্তর্গত বিষয়ের মর্ম ভাল করিয়া পাঠকের ধারণায় আসিবে না । অতএব, এই কর্ম অকর্মের বিচারসঙ্কট কিরূপে বিকট হয় এবং অনেক প্রসঙ্গে, “ইহা করি কি উহা করি” এইরূপ সংশয়-গোলযোগের মধ্যে পড়িয়া মানুষ কিরূপ হতবুদ্ধি হইয়া পড়ে ঠিক্ বুঝিবার জন্য, এই প্রসঙ্গের অনেক উদাহরণ যাহা শাস্ত্ৰে, বিশেষতঃ মহাভারতে, পাওয়া যায়, এক্ষণে তাহারই বিচারে প্রবৃত্ত হইব ।
ইতি বিষয়-প্ৰবেশ সমাপ্ত ।
___________________________
Reference:
Reference:
"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.
"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.
Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।
[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]
No comments:
Post a Comment