গীতা ও বাইবেল
(লোকমান্য বাল-গঙ্গাধর তিলক, অনুবাদ : শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর)
সূচি
1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য – পাদ্রিদের ভ্রান্ত প্রচার
2) যুক্তির দ্বারা গ্রন্থদ্বয়ের সাম্য বিচার
3) ইহুদী বাইবেল ও খৃষ্টধর্মের নব-বিধান
4) এসী/এসীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়
5) ইহুদীদের মধ্যে সন্ন্যাসপর ধর্মের উৎপত্তি
6) বৌদ্ধধর্মের সহিত এসী/খৃষ্টধর্মের সাম্য
7) বৌদ্ধধর্মের সহিত এই সাম্যের কারণ
8) সার কথা : বৈদিক ধর্ম ⇒ বৌদ্ধ ধর্ম ⇒ খৃষ্টধর্ম
9) উপসংহার
1) অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য – পাদ্রিদের ভ্রান্ত প্রচার
উপর্য্যুক্ত আলোচনা হইতে স্থির হইল যে, ভারতবর্ষে ভক্তিপ্রধান ভাগবতধর্মের আবির্ভাব খৃষ্টপূর্ব প্রায় ১৪ শতাব্দীতে হইয়াছিল, এবং খৃষ্টের পূর্বে প্ৰাদুর্ভূত সন্ন্যাসপ্রধান মূল বৌদ্ধধর্মে প্ৰবৃত্তিপ্রধান ভক্তিতত্ত্বের প্রবেশ, বৌদ্ধ গ্ৰন্থকারদিগেরই মতে, শ্ৰীকৃষ্ণপ্ৰণীত গীতারই কারণে হইয়াছে । গীতার অনেক সিদ্ধান্ত খৃষ্টানদিগের নূতন বাইবেলেও পাওয়া যায়; বস্, এই ভিত্তির উপরেই খৃষ্টধর্ম হইতে এই সকল তত্ত্ব গীতায় গৃহীত হইয়া থাকিবে, এইরূপ কতকগুলি পাদ্রি স্বকীয় গ্রন্থে প্ৰতিপাদন করিয়া থাকেন, এবং বিশেষতঃ ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে; ডাঃ লরিনসর গীতার জর্মন অনুবাদগ্রন্থে যাহা কিছু প্ৰতিপাদন করিয়াছেন তাহার নির্মূলত্ব এক্ষণে স্বতই সিদ্ধ হয় । লরিনসর স্বকীয় পুস্তকের (গীতার জর্মন ভাষান্তরের) শেষে ভগবদ্গীতা ও বাইবেলের-বিশেষত নূতন বাইবেলের প্ৰায় শতাধিক স্থলে শব্দসাদৃশ্য দেখাইয়াছেন এবং তন্মধ্যে কতকগুলি অসাধারণ ও ভাবিয়া দেখিবার যোগ্যও আছে । উদাহরণ যথা - “সেইদিন তোমরা জানিতে পরিবে যে, আমি আমার পিতার মধ্যে, তোমরা আমার মধ্যে এবং আমি তোমাদের মধ্যে আছি” [জন|১৪|২০], এই বাক্য গীতার “যেন ভূতান্যশেষাণি দ্রক্ষ্যস্যাত্মন্যথো ময়ি” [গী|৪|৩৫] এবং “যো মাং পশ্যতি সর্বত্র সর্বং চ ময়ি পশ্যতি” [গী|৬|৩০] এই বাক্যগুলির সহিত কেবল সমানার্থকই নহে, প্ৰত্যুত শব্দশও একই । সেইরূপ জনের পরবর্তী “যে আমাকে প্ৰীতি করে আমিও তাহাকে প্ৰীতি করি ।” এই বাক্য [১৪|২১], গীতার “প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যৰ্থং অহং স চ মম প্ৰিয়ঃ” [গী|৭|১৭] এই বাক্যের সহিত সর্বাংশেই সদৃশ । এই বাক্য এবং এই প্রকার অন্য সদৃশ বাক্য হইতে ডাক্তার লরিনসর এইরূপ অনুমান করেন যে, বাইবেল গীতাকারের বিদিত ছিল, এবং গীতা খৃষ্টের প্রায় পাঁচ শত বৎসর পরে রচিত হইয়া থাকিবে । ডাঃ লরিনসরের পুস্তকের এই অংশের ইংরাজী অনুবাদ ‘ইণ্ডিয়ান আন্টিকোয়ারি’র দ্বিতীয় খণ্ডে সেই সময়ে প্ৰকাশিত হইয়াছিল । এবং ৺ তৈলং ভগবদ্গীতার যে পদ্যাত্মক ইংরাজী অনুবাদ করিয়াছেন তাহার প্রস্তাবনায় তিনি লরিনসরের মতের সম্পূর্ণ খণ্ডন করিয়াছেন । (See Bhagavadgita translated into English Blank Verse with Notes &c. by K. T. Telang, 1875 (Bombay). This book is different from the translation in the S.B.E. Series.)
ডাঃ লরিনসর পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত বলিয়া পরিগণিত ছিলেন না, এবং সংস্কৃত অপেক্ষা খুষ্টধর্মের জ্ঞান ও অভিমান তাহার অধিক ছিল । তাই, তাঁহার মত, শুধু ৺ তৈলঙ্গের নহে, কিন্তু মোক্ষমূলার প্রভৃতি প্ৰধান প্ৰধান পাশ্চাত্য সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদিগেরও অগ্রাহ্য হইয়াছিল । বেচারা লরিনসরের এ কল্পনাও হয় তো আসে নাই যে, একবার যখন গীতার কাল নিঃসংশয়রূপে খৃষ্টপূর্ব বলিয়া স্থির হইল, তখনই গীতা ও বাইবেলের মধ্যে যে শত শত অর্থসাদৃশ্য ও শব্দসাদৃশ্য দেখাইয়াছি তাহা ভূতের মতো উল্টা আমারই ঘাড়ে চাপিবে । কিন্তু ইহাতে সন্দেহ নাই যে, যাহা কখনও স্বপ্নেরও গোচর হয় না, তাহাই কখন কখন চক্ষের সম্মুখে আসিয়া খাড়া হয় ও সত্য সত্য প্রত্যক্ষ হয়, তবে এখন ডাঃ লরিনসরের কথার উত্তর দিবার কোনই আবশ্যকতা নাই । তথাপি কোন কোন বড় ইংরাজী গ্রন্থে এখনও এই মিথ্যা মতেরই উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাই এখানে এই সম্বন্ধে আধুনিক গবেষণার পর যাহা নিষ্পন্ন হইয়াছে, তাহাই সংক্ষেপে বলা অবশ্যক মনে হয় ।
2) যুক্তির দ্বারা গ্রন্থদ্বয়ের সাম্য বিচার
প্ৰথমে ইহা মনে রাখা উচিত যে, যখন কোন দুই গ্রন্থের সিদ্ধান্ত একরকম হয়, তখন কেবল এই সিদ্ধান্তের সাম্য হইতেই কোন গ্ৰন্থটি প্রথম এবং কোনটি পরবর্তী, তাহা নির্ণয় করা যাইতে পারে না । কারণ এস্থলে এই দুই-ই সম্ভব যে, (১) এই দুয়ের মধ্যে প্রথম গ্রন্থের বিচার দ্বিতীয় গ্রন্থ হইতে, কিম্বা (২) দ্বিতীয় গ্রন্থের বিচার প্রথম গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়া থাকিবে । তাই প্ৰথমে যখন দুই গ্রন্থের কাল স্বতন্ত্রভাবে করিয়া লওয়া হয়, তখন আবার বিচারসাদৃশ্য হইতে স্থির করিতে হয় যে, অমুক গ্ৰন্থকার অমুক গ্ৰন্থ হইতে অমুক বিচার গ্রহণ করিয়াছেন । তাছাড়া, একই রকম বিচার দুই বিভিন্ন দেশের দুই গ্ৰন্থকারের মনে স্বতন্ত্রভাবে একই কালে কিংবা অগ্রপশ্চাতে উদয় হওয়া নিতান্ত অসম্ভব নহে; এই জন্য, ঐ দুই গ্রন্থের সাম্য দেখিবার সময় ইহাও বিচার করিতে হয়যে, উহার উদ্ভব স্বতন্ত্রভাবে হওয়া সম্ভব কি না; এবং যে দুই দেশে এই গ্ৰন্থ রচিত হইল, তাহাদের মধ্যে তৎকালে যাতায়াত বা কারবার থাকায় এক দেশ হইতে এই বিচার অপর দেশে যাওয়া সম্ভব ছিল কি না । এই প্রকার সকল দিক হইতে দেখিলে দেখা যায় যে, খৃষ্টধর্ম হইতে কোন বিষয়ই গীতায় গৃহীত হওয়া সম্ভব ছিল না; বরঞ্চ গীতার তত্ত্বসমূহের ন্যায় যে কিছু তত্ত্ব খৃষ্টীয় বাইবেলে পাওয়া যায়, সেগুলি বাইবেলেই, অন্তত বৌদ্ধ ধর্ম হইতে - অৰ্থাৎ পর্যায়ক্ৰমে গীতা বা বৈদিক ধর্ম হইতেই - খৃষ্ট কিংবা তাঁহার শিষ্যদের কর্তৃক গৃহীত হওয়াই খুব সম্ভব; এবং কোন কোন পাশ্চাত্য পণ্ডিত এক্ষণে ইহা স্পষ্টরূপে বলিতেও আরম্ভ করিয়াছেন । এই প্রকারে দাঁড়িপাল্লা অন্যদিকে ঝুঁকিয়াছে দেখিয়া গোঁড়া খৃষ্টভক্তেরা আশ্চৰ্য হইবেন এবং এই কথা অস্বীকারের দিকেই যদি তাহাদের মনের প্রবণতা হয়, তাহাতে আশ্চৰ্য হইবার কিছুই নাই । কিন্তু ইহাঁদিগকে আমি এইটুকু বলিতে চাহি যে, এই প্রশ্ন ধর্মঘটিত নহে, ইহা ঐতিহাসিক; অতএব ইতিহাসের চিরন্তন পদ্ধতি অনুসারে অধুনা উপলব্ধ বিষয়সমূহের শান্তভাবে বিচার করা আবশ্যক । তার পর ইহা হইতে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় সেই সিদ্ধান্তই সকলের পক্ষে, বিশেষত বিচারসাদৃশ্যের প্রশ্ন যাঁহারা প্রথমে উপস্থিত করিয়াছেন তাঁহাদের পক্ষে আনন্দের সহিত ও পক্ষপাতরহিত বুদ্ধিতে গ্রহণ করাই ন্যায্য ও যুক্তিসিদ্ধ ।
3) ইহুদী বাইবেল ও খৃষ্টধর্মের নব-বিধান
ইহুদী বাইবেলে অর্থাৎ বাইবেলের পুরাতন বিধানে প্ৰতিপাদিত প্ৰাচীন ইহুদী ধর্মের সংস্করণ হিসাবে খৃষ্টধর্মের নব-বিধান বাহির হইয়াছে । ইহুদী ভাষায় ঈশ্বরকে ‘ইলোহা’ (আরবী ‘ইলাহ’) বলে । কিন্তু মোজেসের (Moses) স্থাপিত নিয়মানুসারে ইহুদীধর্মের মুখ্য উপাস্য দেবতার বিশেষ সংজ্ঞা হইল ‘জিহোভা’ । পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরাই এক্ষণে স্থির করিয়াছেন যে, এই ‘জিহোভা’ শব্দ মূলে ইহুদী শব্দ নহে; খাল্দীয় ভাষার ‘যবে’ (সংস্কৃত যহ্ব) শব্দ হইতে আসিয়াছে । ইহুদীরা মূর্তিপূজক নহে । অগ্নিতে পশু বা অন্য বস্তুর হোম করা; ঈশ্বরের ব্যাখ্যাত নিয়ম-সকল পালন করা এবং তাঁহার দ্বারা ইহলোকে নিজের ও নিজের জাতির কল্যাণ সাধন করা - ইহাই উহাদের ধর্মের মুখ্য আচার । সংক্ষেপে বলিতে হইলে, বৈদিক ধর্মের কর্মকাণ্ড অনুসারে, ইহুদী ধর্মকেও যজ্ঞময় ও প্ৰবৃত্তিপর বলা যায় । ইহার বিরুদ্ধে অনেক স্থানে খৃষ্টের উপদেশ আছে যে, ‘আমি (হিংসাকারক) যজ্ঞ চাহি না, আমি (ঈশ্বরের) কৃপা চাই’ [মাথ্যু|৯|১৩], ঈশ্বর ও দ্রব্য উভয়ের সাধন এক-সঙ্গে হইতে পারে না” [মাথ্যু|৬|২৪], ‘যে অমৃতত্ব লাভ করিতে চাহে, তাহাকে স্ত্রীপুত্ৰ ত্যাগ করিয়া আমার ভক্ত হইতে হইবে’ [মাথ্যু|১৯|২১]; এবং তাঁহার শিষ্যদিগকে ধর্মপ্রচারার্থ যখন দেশবিদেশে প্রেরণ করেন, তখন সন্ন্যাসধর্মের এই নিয়ম সকল পালন করিবার জন্য খৃষ্ট তাহাদিগকে উপদেশ করিলেন যে, “তোমরা তোমাদের কাছে সোনা, রূপা কিংবা অনাবশ্যক বস্ত্ৰাচ্ছাদনও রাখিবে না” [মাথ্যু|১০|৯-১৩] । ইহা সত্য যে, আধুনিক খৃষ্টীয় রাষ্ট্রসকল খৃষ্টর এই সমস্ত উপদেশ গুটাইয়া তাকে উঠাইয়া রাখিয়াছেন; কিন্তু আধুনিক শঙ্করাচার্য হাতী ঘোড়া ব্যবহার করিলে শাঙ্কর সম্প্রদায়কে যেরূপ দরবারী বলা যায় না, সেইরূপ আধুনিক খৃষ্টীয় রাষ্ট্রসমূহের এই আচরণের জন্য মূল খৃষ্টধর্মও প্ৰবৃত্তিপর ছিল, একথা বলা যায় না । মূল বৈদিক ধর্ম কর্মকাণ্ডাত্মক হইলে পরও, যে প্রকার তাহার মধ্যে পরে জ্ঞানকাণ্ডের আবিভাব হইয়াছিল, সেইপ্রকারই ইহুদী ও খৃষ্টধর্মেরও সম্বন্ধ । কিন্তু বৈদিক কর্মকাণ্ডে ক্রমশ জ্ঞানকাণ্ডের ও তাহার পর ভক্তিপ্রধান ভাগবতধর্মের উৎপত্তি ও বৃদ্ধি শত শত বৎসর পৰ্যন্ত হইতে চলিয়াছে; কিন্তু একথা খৃষ্টধর্মে খাটে না ।
4) এসী/এসীন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়
ইতিহাস হইতে জানা যায় যে, খৃষ্টের অনধিক প্রায় ২০০ বৎসর পূর্বে এসী বা এসীন (Essenes) নামক সন্ন্যাসী সম্প্রদায় ইহুদিদিগের দেশে সহসা আবির্ভূত হইয়াছিল । এই এসী লোকেরা ইহুদীধর্মাবলম্বী হইলেও হিংসাত্মক যাগযজ্ঞ ত্যাগ করিয়া উহারা কোন নির্জনস্থানে বসিয়া ঈশ্বরচিন্তায় কালাতিপাত করিত, এবং জীবিকার জন্য বড় জোর কৃষিকার্যের মত কোন নিরুপদ্রব ব্যবসায় করিত । অবিবাহিত থাকা, মদ্যমাংস বর্জন করা, শপথ গ্ৰহণ না করা, সংঘের সহিত মঠে থাকা, এবং কেহ কোন দ্রব্য পাইলে তাহা সমস্ত সংঘের সামাজিক লাভ মনে করা প্ৰভৃতি এই সম্প্রদায়ের মুখ্য তত্ত্ব ছিল । এই মণ্ডলীর মধ্যে কেহ প্ৰবেশ করিতে চাহিলে, তাহাকে তিন বৎসর উমেদারী করিয়া তাহার পর কতকগুলি নিয়ম পালন করিব বলিয়া স্বীকার করিতে হইত । উহাদের মুখ্য মঠ মৃতসমুদ্রের (Dead Sea) পশ্চিমাধারে এঙ্গদীতে (Ein Gedi) ছিল; সেখানেই উহারা সন্ন্যাস অবলম্বন করিয়া শান্তিতে অবস্থিতি করিত । স্বয়ং খৃষ্ট এবং তাঁহার শিষ্যেরা নববিধান বাইবেলে এসী সম্প্রদায়ের মতের যেরূপ সম্মান পূর্বক নির্দেশ করিয়াছেন [মাথ্যু|৫|৩৪; ১৯|১২; জেম্স্|৫|১২; কৃত্য|৪|৩২-৩৫], তাহা হইতে দেখা যায় যে, যিশু খৃষ্ট এই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন; এবং এই পন্থার সন্ন্যাসধর্ম তিনি অধিক প্রচার করিয়াছেন ।
5) ইহুদীদের মধ্যে সন্ন্যাসপর ধর্মের উৎপত্তি
খৃষ্টের সন্ন্যাসপর ভক্তিমার্গের পরম্পরা এই প্রকারে এসী-সম্প্রদায়ের পরম্পরার সহিত মিলাইয়া দিলেও মূল কর্মময় ইহুদী ধর্মের মধ্যে সন্ন্যাসপর এসী সম্প্রদায়ই বা কিরূপে প্রাদুর্ভূত হইল, ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাহার কোন-না কোন সযুক্তিক উপপত্তি বলা আবশ্যক । খৃষ্ট এসীন সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন না, এইরূপ কেহ কেহ বলিয়া থাকেন । এখন ইহা সত্য বলিয়া মনে করিলেও বাইবেলের নববিধানে যে সন্ন্যাসপর ধর্ম বৰ্ণিত হইয়াছে তাহার মূল কি, কিংবা কর্ম প্ৰধান ইহুদীধর্মে তাহার আবির্ভাব সহসা কিরূপে হইল এই প্রশ্নটিকে এড়াইতে পারা যায় না । ইহাতে কেবল এইটুকু ভেদ হয় যে, এসীন সম্প্রদায়ের উৎপত্তিসম্বন্ধীয় প্রশ্নের বদলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আবশ্যক হয় । কারণ, এক্ষণে সমাজশাস্ত্রের এই মামুলী সিদ্ধান্ত স্থির হইয়া গিয়াছে যে, কোনও বিষয় কোথাও হঠাৎ উৎপন্ন হয় না, উহা আস্তে আস্তে অনেক দিন পুর্ব হইতে বৃদ্ধি পাইতে থাকে; এবং যেস্থলে এই প্ৰকার বৃদ্ধি নজরে না আসে, সেস্থলে প্রায়ই উহা পরকীয় দেশ হইতে কিংবা পরকীয় লোক হইতে গৃহীত হইয়া থাকে” । এই কঠিন সমস্যা প্ৰাচীন খৃষ্টীয় গ্ৰন্থকারদিগের নজরে যে আসে নাই এরূপ নহে । কিন্তু বৌদ্ধধর্ম যুরোপীয়দিগের জ্ঞানগোচরে আসিবার পূর্বে অর্থাৎ খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দী পৰ্যন্ত তত্ত্বানুসন্ধায়ী খৃষ্টীয় বিদ্বানদিগের এই মত ছিল যে, গ্ৰীক ও ইহুদি লোকদিগের পরস্পর নিকট-সম্বন্ধ ঘটিলে পর গ্রীকলোকদিগের - বিশেষতঃ পাইথাগোরসের-তত্ত্বজ্ঞানের কল্যাণে কর্মময় ইহুদীধর্মে এসী-সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসমার্গের আবির্ভাব হইয়া থাকিবে । কিন্তু আধুনিক গবেষণা হইতে এই সিদ্ধান্ত সত্য বলিয়া মানা যায় না । ইহা হইতে সিদ্ধ হয় যে, যজ্ঞময় ইহুদী ধর্মেই একা এক সন্ন্যাসপর এসী-ধর্মের বা খৃষ্টধর্মের আবির্ভাব হওয়া স্বভাবত সম্ভব ছিল না, এবং তাহার জন্য ইহুদীধর্মের বাহিরে উহার অন্য কোন-না-কোন কারণ হইয়াছিল - এই কল্পনাটি নূতন নহে, কিন্তু খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে খৃষ্টান পণ্ডিতদিগেরও এই মত গ্ৰাহ্য হইয়াছিল ।
6) বৌদ্ধধর্মের সহিত এসী/খৃষ্টধর্মের সাম্য
কোলব্রুক বলিয়াছেন যে, পাইথাগোরসের তত্ত্বজ্ঞানের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বজ্ঞানের কোথাও অধিক সাম্য আছে; তাই উপরিউক্ত সিদ্ধান্ত ঠিক মনে করিলেও বলা যাইতে পারে যে, এসী-সম্প্রদায়ের জনকত্ব পরম্পরাক্রমে ভারতবর্ষেই আসে । (See Colebrooke's Miscellaneous Essays, Vol.1, pp. 399-400.) কিন্তু এতটা ঘোর-ফের করিবারও কোন আবশ্যকতা নাই । বৌদ্ধগ্ৰন্থ ও বাইবেলের নববিধান তুলনা করিলে স্পষ্ট দেখা যায় যে, পাইথাগোরীয় মণ্ডলীর সহিত এসী বা খৃষ্টধর্মের যত সাম্য আছে, তদপেক্ষা অধিক ও বিশেষ সাম্য বৌদ্ধধর্মের সহিত শুধু এসীধর্মেরই নহে, কিন্তু খৃষ্টচরিত্র ও খৃষ্ট-উপদেশেরও আছে । খৃষ্টকে ভুলাইবার জন্য যেরূপ শয়তান চেষ্টা করিয়াছিল এবং যে প্রকার সিদ্ধাবস্থা প্ৰাপ্ত হইবার সময় খৃষ্ট যেরূপ ৪০ দিন উপবাস করিয়াছিলেন, সেইরূপই বুদ্ধকেও মারের ভয় দেখাইয়া মোহমুগ্ধ করিবার জন্য চেষ্টা করা হইয়াছিল এবং সেই সময় বুদ্ধ ৪৯ দিন (সাত সপ্তাহ) উপবাসী ছিলেন, ইহা বুদ্ধচরিত্রে বর্ণিত হইয়াছে । এই প্রকারেই পূৰ্ণশ্ৰদ্ধার প্রভাবে জলের উপর দিয়া চলা, মুখের দেহের কান্তি সম্পূর্ণ সুৰ্যের সদৃশ করা, অথবা শরণাগত চোর ও বেশ্যাদিগকেও সদ্গতি দেওয়া, ইত্যাদি কথা বুদ্ধ ও খৃষ্ট উভয়ের চরিত্রে একই সমান পাওয়া যায়; এবং “তুমি আপন প্রতিবেশীকে এবং বৈরীকেও প্রীতি করিবে” প্ৰভৃতি খৃষ্টের যে মুখ্য মুখ্য নৈতিক উপদেশ আছে, তাহাও কখন কখন একেবারে অক্ষরশঃ মূল বৌদ্ধধর্মের মধ্যে খৃষ্টের পূর্বেই আসিয়াছে । উপরে বলিয়া আসিয়াছি যে, ভক্তির তত্ত্ব মূল বৌদ্ধধর্মে ছিল না; কিন্তু তাহাও পরে, অর্থাৎ খৃষ্টের ন্যূন দুই তিন শতাব্দী পূর্বেই, মহাযান বৌদ্ধপন্থায় ভগবদ্গীতা হইতে গৃহীত হইয়াছিল ।
মিঃ আৰ্থর লিলী স্বকীয় পুস্তকে প্রমাণের সহিত স্পষ্ট দেখাইয়াছেন যে, এই সাম্য শুধু এইটুকু বিষয়েই পর্যাপ্ত নহে, ইহা ব্যতীত খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে আরও শত শত ছোটখাটো বিষয়ে এইরূপই সাম্য আছে । অধিক কি, খৃষ্টকে ক্রুশে চড়াইয়া বধ করিবার দরুণ খৃষ্টানদিগের নিকট ক্রুশের চিহ্ন পবিত্র ও পূজ্য সেই ক্রুশের চিহ্নকে ‘স্বস্তিক’ 卐 আকারে বৈদিক ও বৌদ্ধধর্মের লোকেরা খৃষ্টের শত শত বৎসর পুর্বাবধিই শুভদায়ক বলিয়া মনে করিত; এবং ইজিপ্ট প্রভৃতি পৃথিবীর পুরাতন খণ্ডের দেশেই শুধু নহে, কিন্তু কলম্বসের কয়েক শতাব্দী পূর্বে আমেরিকার পেরু ও মেক্সিকো দেশেও স্বস্তিক-চিহ্ন শুভাবহ বলিয়া বিবেচিত হইত, ইহা প্রত্নতত্ত্ববেত্তারা স্থির করিয়াছেন । (See “The Secret of the Pacific” by C. Reginald Enock, 1912, pp, 248-252.) ইহা হইতে অনুমান করিতে হয় যে, খৃষ্টের পূর্বেই স্বস্তিক চিহ্ন সমস্ত লোকের পূজ্য ছিল, পরে খৃষ্টভক্তেরা কোন-এক বিশেষ ধরণে উহারই উপযোগ করিয়া লয় । বৌদ্ধ ভিক্ষু ও প্রাচীন খৃষ্টধর্মোপদেশকদিগের, বিশেষত প্ৰাচীন পাদ্রীদিগের, পরিচ্ছদ ও ধর্মানুষ্ঠানের মধ্যেও অনেক সাম্য আছে । উদাহরণ যথা, ‘ব্যাপ্টিজ্ম্-এর অনুষ্ঠান অর্থাৎ স্নানোত্তর দীক্ষা দিবার অনুষ্ঠানও খৃষ্টের পূর্বেই প্রচলিত ছিল । এক্ষণে ইহা সপ্রমাণ হইয়াছে যে, দূর-দূর দেশে ধর্মোপদেশক পাঠাইয়া ধর্ম প্রচার করিবার পদ্ধতি খৃষ্টীয় ধর্মোপদেশকদিগের পূর্বেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদিগের সম্পূর্ণ স্বীকৃত হইয়াছিল ।
এই প্রশ্ন যে-কোন চিন্তাশীল ব্যক্তির মনে উদয় হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, বুদ্ধ ও খৃষ্টের চরিত্র ও নৈতিক উপদেশে এবং এই দুই ধর্মের অনুষ্ঠানবিধির মধ্যে এই যে অসাধারণ ও ব্যাপক সাম্য দেখিতে পাওয়া যায়, ইহার কারণ কি ?
(এই সম্বন্ধে মিঃ আর্থর লিলী Buddhism in Christendom এই নামে এক স্বতন্ত্র গ্রন্থ লিখিয়াছেন; তাছাড়া স্বকীয় মত সংক্ষেপে Buddha and Buddhism নামক গ্রন্থের শেষ চার ভাগে স্পষ্টরূপে নিরূপণ করিয়াছেন । আমি পরিশিষ্টের এই ভাগে যে বিচার আলোচনা করিয়াছি তাহা মুখ্যরূপে এই দ্বিতীয় গ্রন্থের আধারেই করিয়াছি । Buddha and Buddhism গ্রন্থ The World’s Epoch-makers Series-এ ১৯০০ খৃষ্টাব্দে প্ৰকাশিত হয় এবং তাহার দশম ভাগে, বৌদ্ধ ও খৃষ্টধর্মের মধ্যে প্রায় ৫০টা সাদৃশ্য দেখাইয়াছেন ।)
7) বৌদ্ধধর্মের সহিত এই সাম্যের কারণ
বৌদ্ধ ধর্ম-গ্রন্থের অনুশীলনের ফলে এই সাম্য যখন প্রথম-প্ৰথম পাশ্চাত্যদিগের নজরে পড়িল, তখন কোন কোন খৃষ্টীয় পণ্ডিত বলিতে লাগিলেন যে, বৌদ্ধের এই তত্ত্ব ‘নেষ্টোরিয়ান’ (Nestorianism) নামক আসিয়াখণ্ডে (Sasanian Empire) প্রচলিত খৃষ্টীয় পন্থা হইতে গ্ৰহণ করিয়া থাকিবে । কিন্তু এই কথাই সম্ভবপর নহে; কারণ, নেষ্টার সম্প্রদায়ের প্রবর্তকই খৃষ্টের প্রায় সওয়া চারি শত বৎসর পরে আবির্ভূত হইয়াছিলেন; এবং এখন অশোকের শিলালিপি হইতে নিঃসংশয়রূপে সিদ্ধ হইয়াছে যে, খৃষ্টের প্রায় পাঁচ শত বৎসর পূর্বে এবং নেষ্টারের প্রায় নয় শত বৎসর পূর্বে - বুদ্ধের জন্ম হইয়া গিয়াছিল । অশোকের সময়ে, অর্থাৎ খৃষ্টের অন্তত আড়াই শত বৎসর পূর্বে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে ও আশপাশের দেশে খুব প্রচলিত হইয়াছিল; এবং বুদ্ধ-চরিত্ৰাদি গ্ৰন্থও তখন রচিত হইয়াছিল । এই প্রকারে বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনত্ব যখন নির্বিবাদ, তখন খৃষ্টীয় ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে সাম্য দেখা যায় তৎসম্বন্ধে দুই পক্ষমাত্র অবশিষ্ট থাকিয়া যায়; (১) ঐ সাম্য স্বতন্ত্র ভাবে দুইদিকে উৎপন্ন হইয়া থাকিবে, কিংবা (২) বৌদ্ধ ধর্ম হইতে এই সকল তত্ত্ব খৃষ্ট বা খৃষ্টের শিষ্যেরা গ্ৰহণ করিয়া থাকিবেন । প্রোঃ রিস-ডেভিড্স্ বলেন যে, এই বিষয়ে বুদ্ধ ও খৃষ্টের পরিস্থিতির ঐক্য নিবন্ধন, উভয়ের মধ্যেই এই সাম্য, স্বভাবতই স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হইয়াছে । (See Buddhist Suttas, S.B.E. Series Vol XI, p.163.) কিন্তু একটু বিচার করিয়া দেখিলেই সহজে উপলব্ধি হইবে যে, এই কল্পনা সন্তোষজনক নহে । কারণ, কোন নূতন বিষয় কোথাও যখন স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হয়, তখন উহা ক্ৰমে ক্ৰমেই হইয়া থাকে এবং সেইজন্য উহার উন্নতির ক্রমও আমরা বলিতে পারি । উদাহরণ যথা - বৈদিক কর্মকাণ্ড হইতে জ্ঞানকাণ্ড, এবং জ্ঞানকাণ্ড অর্থাৎ উপনিষৎ হইতেই পরে ভক্তি, পাতঞ্জল যোগ কিংবা শেষে বৌদ্ধধর্ম কেমন করিয়া নিঃসৃত হইল, যুক্তিসহকারে তাহার ক্রমপরম্পরা ঠিক দেখান যাইতে পারে । কিন্তু যজ্ঞময় ইহুদীধর্মে সন্ন্যাসপার এসী বা খৃষ্টধর্মের উদ্ভব এই প্রকারে হয় নাই । উহা একেবারেই উৎপন্ন হইয়াছে; এবং উপরে বলিয়া আসিয়াছি যে, প্রাচীন খৃষ্টান পণ্ডিতও ইহা মানিতেন যে, এইভাবে উহার একেবারে উৎপন্ন হইবার কোন কিছু কারণ ইহুদীধর্মের বাহিরে ঘটিয়া থাকিবে । তাছাড়া, খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে যে সাম্য দেখা যায় তাহা এত অসাধারণ ও সম্পূর্ণ যে, সেরূপ সাম্য স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন হইতেই পারে না । ইহা যদি সপ্ৰমাণ হইয়া গিয়া থাকিত যে, সে সময় বৌদ্ধধর্মের কথা ইহুদীদিগের জানাই সর্বথা অসম্ভব ছিল, তবে সে কথা স্বতন্ত্র ছিল । কিন্তু ইতিহাস হইতে সপ্ৰমাণ হয় যে, আলেক্জাণ্ডারের পরবর্তী সময়ে - এবং বিশেষতঃ অশোকের সময়েই (অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব প্রায় ২৫০ বৎসরে) - বৌদ্ধ যতির পূর্বদিকে ইজিপ্টের অন্তর্গত আলেকজান্দ্ৰিয়া এবং গ্রীস পৰ্যন্ত প্ৰবেশ করিয়াছিল । অশোকের এক শিলালিপিতে এইরূপ লিখিত আছে যে, তিনি ইহুদীলোকদিগের এবং আশপাশের দেশসমূহের গ্ৰীক রাজা আন্টিওকসের সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন । সেইরূপ বাইবেলে ইহা বর্ণিত হইয়াছে [মাথ্যু|২|১] যে, খৃষ্ট যখন জন্মিয়াছিলেন তখন পুর্বাঞ্চলের কোন, জ্ঞানী ব্যক্তি জেরুজালেমে গিয়াছিলেন, খৃষ্টানেরা বলেন যে, এই জ্ঞানী পুরুষেরা ‘মগী’ অর্থাৎ সম্ভবত ইরাণীধর্মের লোক হইবেন, - ভারতবর্ষের নহে । কিন্তু যাহাই বল না কেন, উভয়ের অর্থ তো একই । কারণ, এই কালের পুর্বেই বৌদ্ধধর্মের প্রসার কাশ্মীর ও কাবুলে হইয়া গিয়াছিল; এবং উহা পূর্বদিকে ইরান ও তুর্কিস্থান পৰ্যন্তও পৌঁছিয়াছিল, ইহা ইতিহাস হইতে স্পষ্ট জানা যায় । তাছাড়া, খৃষ্টের সময়ে ভারতবর্ষের এক যতি লোহিতসমুদ্রের উপকূলে এবং আলেকজান্দ্ৰিয়ার আশপাশের প্রদেশে প্রতিবৎসর আসিতেন, এইরূপ প্লুটার্ক স্পষ্ট লিখিয়াছেন ।
(“See Plutarch's Morals - Theosophical Essays”, translated by C. N. King (George Bell & Sons) pp. 96, 97. পালীভাষার মহাবংশে [২৯|৩৯] যবনদিগের অর্থাৎ গ্ৰীকদিগের অলসন্দা (যোননগরী হলসন্দা) নামক নগরের উল্লেখ আছে । উহাতে কথিত হইয়াছে যে, খৃষ্টীয় শতাব্দীর কয়েক বৎসর পূর্বে সিংহলে এক দেবালয়ের নির্মাণকালে অনেক বৌদ্ধ যতি উৎসব উপলক্ষে গিয়াছিল । মহাবংশের ইংরাজী অনুবাদক অলসন্দা শব্দে ইজিপ্টদেশের আলেকজান্দ্ৰিয়া নগর গ্রহণ না করিয়া, কাবুলের মধ্যে এই নামে আলেক্জাণ্ডার এক যে গ্রাম স্থাপন করেন, অলসন্দা শব্দে এই স্থানই বিবক্ষিত এইরূপ বলেন । কিন্তু ইহা ঠিক নহে । কারণ, এই ক্ষুদ্র গ্রামকে কেহই যবনদিগের নগর বলিত না । তাছাড়া উপরি-উক্ত অশোকের শিলালিপিতেই যবনদিগের রাজ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষু পাঠাইবার স্পষ্ট উল্লেখ আছে ।)
তাৎপৰ্য, খৃষ্টের দুই তিন শত বৎসর পূর্বেই, ইহুদীদের দেশে বৌদ্ধ যতিগণ যে প্ৰবেশ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল, সে সম্বন্ধে এখন আর কোন সংশয় নাই; এবং এই গতিবিধি যখন সপ্ৰমাণ হইল, তখন ইহুদীলোকের মধ্যে সন্ন্যাসপর এসী ধর্মের এবং পরে সন্ন্যাসযুক্ত ভক্তি প্রধান খৃষ্টধর্মের আবির্ভাব হইবার পক্ষে বৌদ্ধধর্মই যে বিশেষ কারণ হইয়া থাকিবে তাহা সহজেই নিষ্পন্ন হয় । ইংরাজ গ্রন্থকার লিলীও ইহাই অনুমান করিয়াছেন (See Lillie's Buddha and Buddhism pp, 158 ff.); এবং ইহার সমর্থনে ফরাসী পণ্ডিত এমিল্ বুর্ণুফ্ এবং রোস্নীর এই প্রকার মত আপন গ্রন্থে উল্লেখ করিয়াছেন; এবং জর্মনদেশে লিপজিকের তত্ত্বজ্ঞানশাস্ত্রের অধ্যাপক প্রোঃ সেডন এই বিষয়সংক্রান্ত স্বকীয় গ্রন্থে এই মতই প্ৰতিপাদনা করিয়াছেন । জর্মন প্রোফেসর শ্ৰডর তাঁহার এক নিবন্ধে বলেন যে, খৃষ্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ণরূপে সমান নহে; দুয়ের মধ্যে কোন কোন বিষয়ে সাম্য থাকিলেও অন্য বিষয়ে বৈষম্যও অনেক আছে এবং সেইজন্য খৃষ্টধর্ম বৌদ্ধ ধর্ম হইতে নিঃসৃত এই মত গ্ৰাহ্য হইতে পারে না । কিন্তু এই কথা আসল বিষয়ের বহির্ভূত হওয়ায় এই কথার কোন মূল্য নাই । খৃষ্ট ও বৌদ্ধধর্ম সর্বাংশে একই, এ কথা কেহই বলে না; কারণ তাহা যদি হইত, তবে এই দুই ধর্ম ভিন্ন বলিয়া ধরা হইত না । মুখ্য প্রশ্ন তো এই যে, যখন মূলে ইহুদি ধর্ম নিছক কর্মময়, তখন উহাতে সংস্কারের আকারে সন্ন্যাসযুক্ত ভক্তিমাৰ্গপ্রতিপাদক খৃষ্টধর্মের আবির্ভাবের সম্ভবতঃ কি কারণ হইয়াছিল । এবং খৃষ্টধর্মাপেক্ষা বৌদ্ধধর্ম নিঃসংশয় প্রাচীন; উহার ইতিহাসের প্ৰতি লক্ষ্য করিলে, সন্ন্যাসপর ভক্তি ও নীতির তত্ত্ব খৃষ্ট স্বতন্ত্ররূপে আবিষ্কার করিষাছিলেন এই কথা ঐতিহাসিক দৃষ্টিতেও সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না । খৃষ্ট দ্বাদশ বৎসর বয়স হইতে ত্ৰিশ বৎসর বয়স পৰ্যন্ত কি করিতেন, অথবা কোথায় ছিলেন এই সম্বন্ধে বাইবেলে কোন সংবাদই পাওয়া যায় না । ইহা হইতে প্ৰকাশ পায় যে, এই কাল তিনি সম্ভবত জ্ঞানার্জনে, ধর্মচিন্তনে, ও প্ৰবাসে অতিবাহিত করিয়াছিলেন । অতএব, জীবনের এই সময়ে তাঁহার বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সহিত প্ৰত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও সম্বন্ধ ঘটিয়াছিল কি না তাহা দৃঢ় বিশ্বাসের সহিত কে বলিতে পারে ? কারণ, বৌদ্ধ যতিদিগের গতিবিধি সেই সময়ে গ্রীস দেশ পৰ্যন্ত ছিল । নেপালের এক বৌদ্ধ মঠের গ্রন্থে স্পষ্ট উক্ত হইয়াছে যে, যিশু সেই সময়ে ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন এবং সেখানে তিনি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন । নিকোলস নোটোভিশ নামক এক রুসিয়ান ভদ্রলোক এই গ্ৰন্থ প্রাপ্ত হইয়া ১৮৯৪ খৃষ্টাব্দে ফরাসী ভাষায় তাহার ভাষান্তর প্রকাশ করিয়াছিলেন । নোটোভিশের ভাষান্তর ভাল হইলেও মূল গ্ৰন্থ পরে কোন মিথ্যুক মিথ্যা করিয়া রচনা করিয়াছে, এইরূপ অনেক খৃষ্ঠান পণ্ডিত বলেন । উক্ত গ্ৰন্থ এই পণ্ডিতেরা সত্য মনে করুন বলিয়া আমারও বিশেষ কোন আগ্রহ নাই । নোটোভিশ যে গ্রন্থ পাইয়াছেন তাহা সত্যই হউক বা প্রক্ষিপ্তই হউক, কেবল ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে আমি যে বিচার-আলোচনা উপরে করিয়াছি তাহা হইতে স্পষ্ট উপলব্ধি হইবে যে, খৃষ্টের না হউক, নিদান পক্ষে বাইবেলের নববিধানে তাঁহার চরিত্ৰলেখক ভক্তদিগের বৌদ্ধধর্মের কথা জানা অসম্ভব ছিল না; এবং ইহা যদি অসম্ভব না হয় তবে খৃষ্ট এবং বুদ্ধের চরিত্র ও উপদেশে যে অসাধারণ সাম্য পাওয়া যায়, উহার স্বতন্ত্র ভাবে উৎপত্তি স্বীকার করাও যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না ।
(রমেশচন্দ্র দত্তেরও এইরূপ মত; তিনি তাঁহার গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন । Romesh Chandra Dutt's History of Civilization in Ancient India, Vol II, Chap. xx. P.328-340.)
8) সার কথা : বৈদিক ধর্ম ⇒ বৌদ্ধ ধর্ম ⇒ খৃষ্টধর্ম
সার কথা, মীমাংসকদিগের নিছক্ কর্মমাৰ্গ, জনকাদির জ্ঞানযুক্ত কর্মযোগ (নৈষ্কর্ম্য), উপনিষৎকারদিগের ও সাংখ্যাদিগের জ্ঞাননিষ্ঠা ও সন্ন্যাস, চিত্তনিরোধরূপ পাতঞ্জল যোগ, এবং পাঞ্চরাত্র বা ভাগবত ধর্ম অর্থাৎ ভক্তি - এই সমস্ত ধর্মাঙ্গ ও তত্ত্বই মূলে প্ৰাচীন বৈদিক ধর্মেরই অন্তর্ভূত । তন্মধ্যে ব্ৰহ্মজ্ঞান, কর্ম ও ভক্তিকে ছাড়িয়া, চিত্তনিরোধ রূপ যোগ ও কর্মসন্ন্যাস এই দুই তত্ত্বেরই ভিত্তিতে বুদ্ধ সর্বপ্রথম আপন সন্ন্যাসপর ধর্ম চারি বর্ণকে উপদেশ করেন; কিন্তু পরে উহাতেই ভক্তি ও নিষ্কাম কর্ম মিলাইয়া দিয়া বুদ্ধের অনুগামীরা তাঁহার ধর্ম চারিদিকে প্রচার করেন । অশোকের সময়ে বৌদ্ধধর্মের এই প্ৰকার প্রচার হইলে পর, নিছক কর্মপর ইহুদীধর্মে সন্ন্যাসমার্গের তত্ত্ব প্ৰবেশ করিতে আরম্ভ হয়; এবং শেষে উহাতেই ভক্তি মিলাইয়া দিয়া খৃষ্ট স্বকীয় ধর্ম প্ৰবর্তিত করেন । ইতিহাস হইতে নিষ্পন্ন এই পরম্পরা দেখিলে, ডাঃ লরিনসরের এই উক্তি তো অসত্য সিদ্ধ হয় যে, গীতাতে খৃষ্টধর্ম হইতে কোন কিছু গৃহীত হইয়াছে, বরং বিপরীতে, আত্মৌপম্যদৃষ্টি, সন্ন্যাস, নির্বৈরত্ব ও ভক্তির যে সকল তত্ত্ব বাইবেলের নববিধান-ভাগে পাওয়া যায় তাহা বৌদ্ধ ধর্ম হইতে অর্থাৎ পরম্পরাক্রমে বৈদিক ধর্ম হইতে খৃষ্টধর্মে গৃহীত হওয়া খুব সম্ভবমাত্র নহে, বরঞ্চ গৃহীত হওয়াই বিশ্বাসযোগ্য । এবং ইহার জন্য হিন্দুদিগকে অপরের মুখের দিকে তাকাইবার কোনও আবশ্যকতা ছিলই না, ইহা সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হয় ।
9) উপসংহার
এই প্রকারে, এই প্ৰকরণের আরম্ভে প্ৰদত্ত সাত প্রশ্নের বিচার শেষ হইল । এক্ষণে ইহারই সঙ্গে কতকগুলি এইরূপ গুরুতর প্রশ্ন উদিত হয় যে, ভারতবর্ষে যে ভক্তিপন্থা আজকাল প্ৰচলিত আছে, উহার উপর ভগবদ্গীতার কি পরিণাম ঘটয়াছে ? কিন্তু এই সকল প্ৰশ্নকে গীতাগ্রন্থসম্বন্ধীয় বলা অপেক্ষা হিন্দুধর্মের আধুনিক ইতিহাসের অন্তর্গত এইরূপ বলাই সঙ্গত, সেইজন্য, এবং বিশেষতঃ এই পরিশিষ্ট প্রকরণ অল্প অল্প করিলেও আমার নির্দিষ্ট সীমা অনেক অতিক্রম করিয়াছে; অতএব গীতার বহিরঙ্গের বিচার-আলোচনা এইখানেই শেষ করা গেল ।
ইতি পরিশিষ্ট প্রকরণ সমাপ্ত ।
___________________________
Reference:
Reference:
"Shrimadbhagabadgita Rahasya" or "Karmajogsastra" by Lokmanya Bal Gangadhar Tilak, translated by Sri Jyotirindranath Tagore, 1924. Published by Sri Khitindranath Thakur, Adi Bramha Samaj, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. Printed by Sri Ranagopal Chakraborty, Adi Bramha Samaj Press, 55 Upper Chitpur Road, Kolkata. 2013 Tenth Reprint, Edited by Dr. Dhyanesh Narayan Chakrabarti, Published by Progressive Book Forum, 33, College Row, Kolkata-700009.
"Sri Bhagavadgita-Rahasya or Karma-Yoga-Sastra" by Sri Bal Gangadhar Tilak, English Translation by Sri Bhalchandra Sitaram Sukthankar, 1935. Volume 1 & 2; Published by R.B. Tilak, Lokamanya Tilak Mandir, 568, Narayan Peth, Poona City, India. Printed by S. V. Parulekar at the Bombay Vaibhav Press, Servants of India Society's Building, Sandhurst Road, Bombay, India.
Disclaimer:
This is a personal, non-commercial, research-oriented effort of a novice religious wanderer.
এটি আধ্যাত্মিক পথের এক অর্বাচীন পথিকের ব্যক্তিগত, অবাণিজ্যিক, গবেষণা-ধর্মী প্রয়াস মাত্র ।
[Digitised by running Google OCR on scanned copy obtained from publicly available digital library and then by editing/typing mostly in MS-Word/Notepad using Unicode Bengali "Siyam Rupali" font and Avro Phonetic Keyboard for transliteration. Contents and sub-headings added by up-loader. Uploaded by rk]